৪. কান্নার সমর্পণ

কান্নার সমর্পণ

.

একজন লম্বামত বুড়ো লোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

ক্রিস বেশ অবাক হল। এত রাতে কে আসবে? ফাদার কারাস সন্ধ্যাবেলাতেই এসেছেন। তিনি আছেন রেগানের ঘরে। কিণ্ডারম্যান নয় তো? পুলিশ অফিসারটি যে তার বাড়ির ওপর কড়া নজর রাখছে, তা ক্রিস বেশ বুঝতে পারে। কয়েকবার দেখা হয়েছে রাস্তায়। কিণ্ডারম্যান এমন ভাব করেছে যেন এই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিল, হঠাৎ দেখা। কিন্তু যে এসেছে সে কিণ্ডারম্যান নয়। কিণ্ডারম্যান বেঁটে, বুড়ো অনেক লম্বা। ক্রিস দরজার কাছে এসে অপরিচিত লোকটার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। লোকটা অন্ধকারে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় লম্বা একটা টুপি। তাতে মুখ ঢাকা পড়ে আছে।

কি করতে পারি আপনার জন্যে?

মিসেস ম্যাকনীল?

হ্যাঁ।

লোকটা মাথার টুপি খুলে ফেলল। ক্রিস স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল। লোকটির চোখ দুটো কি শান্ত। মুখাবয়বে গাঢ় বিষাদ ও প্রশান্তি। যেন উনি পৃথিবীর সাধারণ মানুষ হয়েও পৃথিবীর নন।

মিসেস ম্যাকনীল, আমি ফাদার মেরিন ল্যাংকাস্টার।

সম্বিৎ ফিরে পেতে ক্রিসের বেশ কিছু সময় লাগল। ইনিই ফাদার মেরিন? কি আশ্চর্য!

ফাদার, আমি বুঝতেই পারিনি আপনি এত তাড়াতাড়ি আসবেন! আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়ত আসবেন পরশু নাগাদ।

আমি জানি।

ফাদার মেরিন ঘরে ঢুকলেন। ক্রিসের মনে হল ঘরে পা দিয়েই তিনি কি যেন বুঝতে চাইছেন, অনুভব করতে চাইছেন। মনে মনে যেন কিসের হিসেব মিলাচ্ছেন। তার কপালে সূক্ষ একটা কুঞ্চন।

ফাদার মেরিন, আপনার স্যুটকেসটা বরং আমার হাতে দিন।

না, ঠিক আছে। ফাদার কারাস কি এ-বাড়িতে আছেন?

হ্যাঁ, এতক্ষণ রেগানের ঘরে ছিলেন, এখন রান্নাঘরে। ফাদার, আপনি কি রাতের খাবার–

না, আমি খেয়ে এসেছি।

চা কিংবা কফি?

না, মিসেস ম্যাকনীল। আমার জন্যে ভাববেন না।

আমি যদি জানতাম আপনি আসছেন তাহলে স্টেশনে থাকতাম।

আমার কোন অসুবিধা হয়নি।

আপনার জন্যে একটা ঘর আমরা গুছিয়ে রেখেছি। এখন বিশ্রাম নিন। নকি ফাদার কারাসের সঙ্গে কথা বলবেন?

আমি আপনার মেয়েকে একটু দেখব।

এখনই?

হ্যাঁ।

ফাদার, রেগান এখন ঘুমুচ্ছে। তাকে লিব্রিয়াম দিয়ে কিছুক্ষণ আগেই ঘুম পাড়ানো হয়েছে।

আমার তা মনে হয় না। মিসেস ম্যাকনীল, ও জেগেই আছে।

ফাদার মেরিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই রেগানের ঘর থেকে বিকট চিৎকার ভেসে এল। প্রচণ্ড সেই আওয়াজে ঘরের কাচের জানালায় যেন ধাক্কা লাগল। দ্বিতীয়বার চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে রেগানের ঘর থেকে ভাঙা গলায় কেউ একজন ডাকল–মেরিন …-মেরি … ই-ই-ই-ন!।

ফাদার মেরিন মাথা তুলে দোতলার সিঁড়ির দিকে তাকালেন। তার মুখ দেখে ক্রিসের মনে হল, তিনি জগৎ-সংসার ভুলে গেছেন। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন ফাদার মেরিন। ইতিমধ্যে কারাস রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে ক্রিসের পাশে দাঁড়িয়েছেন। রেগানের ঘর থেকে তখন হাঁ-হাঁ জাতীয় একটা বিকট শব্দ ভেসে আসছে।

ফাদার মেরিন রেগানের ঘরে ঢোকামাত্র চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। দুজন দুজনের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল। এক সময় রেগানের মুখ থেকে কঠিন স্বরে কেউ একজন কথা বলল, মেরিন, তুমি তাহলে এসেছ?

ফাদার মেরিন কোন উত্তর দিলেন না।

মেরিন, এইবার তুমি হারবে। নিশ্চয়ই হারবে।

ফাদার নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজা টেনে দিলেন। দ্রুত পায়ে নিচে নেমে এসে হাসিমুখে বললেন, আপনি বুঝি ফাদার ডেমিয়েন কারাস?

জ্বি, হ্যাঁ।

ফাদার কারাস, আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। এখনই শুরু করতে হবে। আপনাকে একটা লিস্ট দিচ্ছি, এই জিনিসগুলো নিয়ে আসুন।

ফাদার মেরিন, আপনি এখনই শুরু করতে চান?

হ্যাঁ।

কিভাবে ওর এই অবস্থা হল তা শুনবেন না?

না, কোন প্রয়োজন নেই।

ফাদার কারাস বেশ অবাক হলেন। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারছেন, এই দুর্বল বৃদ্ধের মধ্যে কি এক প্রচণ্ড ক্ষমতা লুকানো রয়েছে, যেটা স্পষ্ট অনুভব করা যায়।

আমি এখনই জিনিসগুলো নিয়ে আসছি।

ক্রিস এগিয়ে এসে বলল, আপনাকে বড় ক্লান্ত লাগছে, ফাদার মেরিন। আপনি কি একটুও বিশ্রাম নেবেন না?

না।

একটু গরম কফি খান, প্লীজ।

বেশ তো, খাওয়া যাবে।

কার্ল ছুটে গেল কফি তেরি করতে। ক্রিস লক্ষ্য করল ফাদার মেরিনের মুখে একটা হাসি হাসি ভাব। ক্রিসের দিকে তাকিয়ে তিনি হঠাৎ বললেন, আপনার নামটা ভারি সুন্দর–ক্রিস্টিন ম্যাকনীল।

ক্রিস হেসে বলল, আপনার নামটা কিন্তু বেশ অদ্ভুত।

আমার মা রেখেছিলেন। এটা আসলে একটা জাহাজের নাম–মেরিন ল্যাংকাস্টার। কেন যে তিনি এরকম একটা জাহাজের নাম রাখলেন কে জানে? ফাদার মেরিন কফিতে চুমুক দিয়ে হালকা সুরে বললেন, কত সুন্দর সুন্দর নাম থাকে মানুষের। যেমন ধরুন ডেমিয়েন কারাস। এ রকম একটা নাম যদি আমার থাকত।

এ নামটা কোত্থেকে এসেছে, ফাদার?

একজন ফাদারের এই নাম ছিল। তিনি মোলোকাই দ্বীপে কুষ্ঠ রোগীর সেবা করতেন। শেষ পর্যন্ত কুষ্ঠ হয়ে মারা যান। পৃথিবীতে তাঁর মত দরদী মানুষ খুব কম জন্মেছে, মিসেস ম্যাকনীল, খুব কম।

কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন ফাদার। ক্রিসকে বললেন, আপনি আমার ঘর দেখিয়ে দিন। ফাদার কারাস না আসা পর্যন্ত আমি একটু একা থাকতে চাই।

ফাদার কারাসের ফিরতে ঘণ্টা দুয়েক দেরি হল। তিনি এসে দেখেন ফাদার মেরিনের ঘর অন্ধকার। হয়ত ক্লান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছেন। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলেন কারাস। না, ঘুম নয়। ফাদার মেরিন প্রার্থনা করছেন। শান্ত সমাহিত ভঙ্গি। কারাস দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, কি করে মানুষ এত গভীরভাবে ঈশ্বরের সান্নিধ্য পায়? কোত্থেকে আসে এমন সমর্পণ।

ফাদার মেরিন প্রার্থনা ছেড়ে উঠতেই কারাস বললেন, যা যা বলেছেন সবই এনেছি। আপনার জন্যে একটা গরম সোয়েটারও এনেছি। মেয়েটার ঘরে খুব ঠাণ্ডা।

ভাল করেছেন। ফাদার কারাস?

বলুন।

আপনি নিশ্চয়ই নিয়ম কানুন সব জানেন?

জানি।

একটা জরুরী কথা আপনাকে জানিয়ে রাখি। শয়তানের কথার কোন উত্তর দেবেন না। মনে রাখবেন শয়তান হচ্ছে মিথ্যেবাদী। কিন্তু তার সমস্ত মিথ্যাই সত্য দিয়ে ঢাকা। কাজেই বোঝা যাবে না সে সত্য বলছে কি মিথ্যা বলছে। সে চেষ্টা করবে আমাদের মানসিকভাবে পঙ্গু করে ফেলতে। খুব সাবধানে থাকবেন।

কারাস কিছু বললেন না।

ফাদার মেরিন বললেন, আপনি কি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চান?

না, ফাদার। কিন্তু আপনার কি মনে হয় না রেগানের ইতিহাস জানা থাকলে আপনার সুবিধে হবে? ওর মধ্যে দিয়ে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্ব কথা বলে।

তিনটি নয় ফাদার, একটিই। ওকে আমি চিনি। ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে আগে। চলুন, যাওয়া যাক।

 

ক্রিস হলঘরে অপেক্ষা করছিল। শ্যারনও তার কাছে দাঁড়িয়ে। ফাদার মেরিন বললেন, আপনারা না এলেই ভাল। প্রয়োজন হলে আমরা ডাকব।

ঠিক আছে, ফাদার।

আপনার মেয়ের পুরো নামটা কি?

রেগান টেরেসা ম্যাকনীল।

আহ, কি চমৎকার নাম! কি সুন্দর!

দরজা খুলে কারাস দেখলেন এক বীভৎস দৃশ্য। রেগান জিভ বের করে শুয়ে আছে। ঘন কাল রঙের জিভ, মুখ থেকে অনেকখানি বেরিয়ে আছে। চোখ দুটো বেড়ালের চোখের মত জ্বল জ্বল করছে। ভারি গম্ভীর গলায় রেগান বলল, তাহলে এসেছিস শেষ পর্যন্ত? দে ছিটিয়ে দে, তোর পেচ্ছাব এই মেয়েটির গায়ে ছিটিয়ে দে। তোর গায়ের বোটকা ঘাম দিয়ে এই মেয়েটিকে পবিত্র কর। প্যান্ট খুলে তোর ওই জিনিসটাও বের কর। মেয়েটা আদর করে চুমু খাবে, চুমু খেয়ে সে পবিত্র হবে। হা-হা-হা।

ফাদার মেরিন একটা প্রচণ্ড ধমক লাগালেন, চুপ।

চুপ হয়ে গেল চারদিক। রেগান ঝকঝকে বেড়াল-চোখে অপলক তাকিয়ে রইল। তার কাল জিভটা লকলক করতে লাগল। ফাদার মেরিন বিছানার পাশে আসন পেতে বসতেই রেগান থু করে একদলা থুতু ফেলল। যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে ফাদার মেরিন প্রার্থনা শুরু করলেন :

হে, পরম করুণাময় ঈশ্বর। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মহাজ্ঞানী প্রভু। আমরা তোমার করুণা ভিক্ষা করছি। তুমি তোমার অসীম শক্তির মহিমায় পবিত্র কর আমাদের। হে, করুণাময় ঈশ্বর, পবিত্র কর এই শিশুটিকে। রেগান টেরেসা ম্যাকনীল, আজ সে আমাদের আদিম শত্রুর ছায়ায় আবদ্ধ। হে, প্রভু…

ফাদার মেরিন চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করে যেতে লাগলেন। কারাসের মনে হল একটা কিছু ঘটছে। প্রার্থনার কথাগুলো তিনি ঠিক শুনতে পারছেন না। মন লাগছে না। অসহনীয় এক অস্থিরতা অনুভব করছেন। মেরিন প্রার্থনার বইটি বন্ধ করে ডাকলেন, ফাদার কারাস।

বলুন।

আপনি আমার সঙ্গে সঙ্গে পড়ুন।

হে প্রভু, রক্ষা কর তোমার সন্তানদের, যারা শত্রুর মুখোমুখি অবস্থায় আশ্রয় ভিক্ষা করে তোমার কাছে। তোমার পবিত্র মঙ্গলময় হস্ত তুমি প্রসারিত কর …

একটা অব্যক্ত ধ্বনি উঠল। কারাসের চোখ থমকে গেল রেগানের মুখের ওপর। এসব কি তিনি সত্যি সত্যি দেখছেন? না চোখের ভুল? তার প্রার্থনায় গণ্ডগোল হয়ে যেতে লাগল। হিস-হিস শব্দ হচ্ছে চারদিকে। ফাদার মেরিন চাপ। স্বরে বললেন, ফাদার ডেমিয়েন কারাস?

জ্বি।

দয়া করে আমার সঙ্গে যোগ দিন। প্রস্তাবনায় অংশ নিন। আমার সঙ্গে সঙ্গে বলুন–শত্রুর ওপর তোমার জয় হোক।

শত্রুর ওপর তোমার জয় হোক।

আমার প্রার্থনা তুমি গ্রহণ কর, প্রভু।

আমার প্রার্থনা তুমি গ্রহণ কর, প্রভু।

নরকের শয়তানের হাত থেকে রক্ষা কর এই শিশুটিকে।

নরকের শয়তানের হাত থেকে রক্ষা কর এই শিশুটিকে।

ফাদার মেরিন রেগানের মুখের ওপর ক্রস এঁকে পবিত্র জল ছিটিয়ে দিলেন। প্রার্থনার প্রথম অংশ শেষ হয়েছে।

ফাদার মেরিন হাত-মুখ পরিষ্কার করবার জন্যে ঘর থেকে বেরোতেই রেগানের মুখ থেকে খিকখিক হাসির আওয়াজ হল। সে হাসি থামতেই কেউ একজন ফিস ফিস করে বলল, মেরিন হারতে শুরু করেছে। হারতে শুরু করেছে। এই কুত্তী মাগীর মরবার সময় এসে গেছে। দেখ, কারাস দেখ। তুই তো আবার ডাক্তার, ওর নাড়ি পরীক্ষা করে দেখ।

কারাস দেখলেন নাড়ির গতি অত্যন্ত ক্ষীণ।

দেখলি? এই শুরু। এই কুত্তীকে এখন থেকে আর আমি ঘুমুতে দেব না। তার ফল কি হবে জানিস তো? তা জানবি, তুই তো আবার ডাক্তার।

কারাস শিউরে উঠলেন। ঘুম না হলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হবে। ঘুমের দরকার খুব। ক্রিস দরজা খুলে উঁকি দিল। ভয়ে তার মুখ সাদা হয়ে গেছে।

এই যে এসেছে, ধাড়ী কুত্তীটা এসেছে। আয় আয়, দেখে যা, তুই নিজের মেয়েকে কি করেছিস। তোরই জন্যে এই অবস্থা হয়েছে, বুঝলি? তুই পাগল বানিয়েছিস, তুই!

ক্রিস থর থর করে কাপতে লাগল। কারাস বললেন, ওর কথা শুনবেন না। ওর কথায় কান দেবেন না।

শুনবে, এই হারামজাদী শুনবে। ও জানে, আমি যা বলছি তা সব সত্যি।

মিসেস ম্যাকনীল, আপনি চলে যান। এক মুহূর্তও থাকবেন না।

ক্রিস ছুটে বেরিয়ে গেল। ফাদার মেরিন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঢুকলেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন, কিছু হয়েছে কি?

ফাদার মেরিন, রেগানের এখন ঘুমানো দরকার। কিন্তু ওই জিনিসটা বলছে, ওকে সে ঘুমুতে দেবে না।

ফাদার কারাস, আপনি কোন ওষুধ দিতে পারেন?

প্রচুর লিব্রিয়াম দেয়া হয়েছে, আর দেয়া ঠিক হবে না।

রেগানের কণ্ঠ থেকে বার্ক ডেনিংসের স্বর ভেসে এল।

ওহে শুনছ, পাত্রী সাহেবরা, তোমাদের নিয়ে দেখি মহাবিপদ হল। মেয়েটা তো মরতে বসেছে, এখন আমরা যাই কোথায়? জায়গার বড় টানাটানি। তাছাড়া এখানে থাকার অধিকার আছে আমার। এই শালীর বাচ্চা শালীই তো আমাকে মেরেছে।

কারাস জিজ্ঞেস করলেন, কিভাবে মেরেছে?

সে তো, ভাই, লম্বা গল্প। দিব্যি স্টাডিতে বসে পান করছিলাম, হঠাৎ শুনি। খট খট শব্দ। ভয় ধরে গেল, বুঝলে? আস্তে আস্তে উঠলাম দোতলায়। উঠে দেখি…

কি দেখলেন?

ফাদার মেরিন কড়া গলায় বললেন, কারাস, প্লীজ; কথা বলবেন না, প্লীজ।

আহ, এই বুড়ো শালাকে নিয়ে যন্ত্রণা। তুই চুপ থাক না, শালা।

ফাদার মেরিন আবার প্রার্থনা শুরু করলেন। অসম্ভব শীতল হয়ে গেল ঘর। গরম কোর্টের নিচেও ঠক ঠক করে কাপতে লাগলেন কারাস। ঘরের উজ্জ্বল আলোও কেমন যেন কমে আসছে বলে মনে হল। ভয় পাওয়া গলায় বললেন, যে করেই হোক ওকে ঘুম পাড়াতে হবে। ফাদার কারাস এক সময় ঘুমের জন্যে নিজের অজান্তেই প্রার্থনা শুরু করলেন– ঘুম দাও, হে পরম প্রভু, এই মেয়েটার চোখে ঘুম দাও। ঘুম দাও। হে মহাশক্তিধর পরম পবিত্র জগৎ-প্রভু, ঘুম দাও।

ঘুম কিন্তু এল না।

ভোর হল। আবার সন্ধ্যা হল। আবার এল রাত।

ফাদার মেরিন এক সময় বললেন, আপনাকে বড়ই ক্লান্ত মনে হচ্ছে, কারাস।

আমি এর আগেও দুরাত ঘুমুতে পারিনি, ফাদার।

আপনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আসুন।

রেগান এই সময় বৃদ্ধার গলায় কথা বলে উঠল, ডিমি, ও ডিমি, তুই কেন। আমার সাথে এরকম করলি। কেন আমাকে ফেলে গেলি? কি করেছিলাম আমি? ও বেটা, ও ডিমি, কেন এ-রকম করলি? এখন আমার যাওয়ার জায়গা নেই। আমি শুধু ঘুরি। ডিমি।

কারাস চমকে গেলেন। রেগানের কণ্ঠে তার মায়ের স্বর।

ফাদার মেরিন কঠিন স্বরে বললেন, শুনবেন না, ওর কথা শুনবেন না, আপনি বিশ্রাম নিয়ে আসুন। যান।

কারাস ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। কফি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে কিন্তু তার চেয়েও অনেকক্ষণ ধরে গোসল করার বেশি ইচ্ছা হচ্ছে। সারা শরীরে কেমন যেন অশুচির। স্পর্শ। নিজের ঘরে গিয়ে গোসল সেরে এক কাপ কফি খেয়ে ফিরবেন, কিন্তু এত রাতে ক্রিসকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা হল না।

 

রেসিডেন্স হলের রিসেপশন রুমে কিণ্ডারম্যান বসে ছিল। ফাদার কারাসকে দেখে সে উঠে দাঁড়াল।

মিঃ কিণ্ডারম্যান, এত রাতে আমার কাছে?

হ্যাঁ ফাদার, আপনার কাছেই।

কি ব্যাপার বলুন তো?

আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে এসেছি ফাদার। প্রশ্নটা করবার আগে আমার এক খালার গল্প বলছি। এই খালা তার স্বামীকে দারুণ ভয় পেত। স্বামী রাগারাগি করত, বকা ঝকা করত, আর আমার খালার কাছে যখন সেসব অসহনীয় মনে হত তখন সে দৌড়ে চলে যেত তার আলনার কাছে। আলনার ঝুলন্ত কাপড়গুলোকে তার দুঃখের কথা বলে মনে শান্তি পেত। আমারও ঠিক সেই রকম অবস্থা। কাউকে আমার কিছু বলা দরকার, ফাদার।

তাহলে আমি এখন আপনার আলনার কাপড়?

হ্যাঁ, কিন্তু এই কাপড়কে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।

বলুন, শুনি।

ফাদার, মনে করুন আমি একটা খুন নিয়ে তদন্ত করছি। খুনটা হয়েছে। অদ্ভুতভাবে।

আপনি কি বার্ক ডেনিংসের কথা বলছেন?

না ফাদার, এটা কাল্পনিক খুন।

 

বেশ।

ধরুন, যে বাড়িতে খুন হয়েছে সে বাড়িতে পাঁচটি মানুষ আছে এবং তাদেরই কেউ একজন খুন করেছে। যাবতীয় প্রমাণ পরিষ্কার করে বলে খুনটি করেছে বারো বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে। আপনার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু ঘটনাটা সত্যি। সেই বাড়িতে একজন ফাদার প্রায়ই যান। তিনি বিখ্যাত মানুষ। নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট। আমার কাছে যে-সব প্রমাণ আছে তা বলে এই ফাদার সেখানে যান, কারণ বাচ্চা মেয়েটা অসুস্থ। এখন ফাদার, আপনি বলুন, আমি কি করব? আমি কি পুরো ব্যাপারটা ভুলে যাব, না আমার ওপরওয়ালাকে জানাব? ফাদার, আপনি আমার এই প্রশ্নের জবাব দিন।

ফাদার কারাস নরম সুরে বললেন, আমি যদি কিণ্ডারম্যান হতাম তাহলে ওপরওয়ালাকেই বোধহয় জানাতাম।

কিণ্ডারম্যান রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। শুকনো গলায় বলল, আমি জানতাম আপনি এই কথা বলবেন। গুড নাইট, ফাদার।

গুড নাইট।

ফাদার, আমার খুব শখ একদিন আপনার সঙ্গে একটা ছবি দেখি। ক্রেস্ট সিনেমা হলে ওথেলো হচ্ছে। চমৎকার ছবি।

যাব, একদিন নিশ্চয়ই যাব।

সব সময় আপনি বলবেন–এখন নয়, যাব একদিন। আপনার কি সত্যি সময় হবে কখনো?

হবে, একদিন হয়ত হবে।

ফাদার কারাসের হঠাৎ এই ক্ষুরধার ডিটেকটিভকে ভাল লেগে গেল। তিনি তার কাঁধে হাত রেখে অল্প হাসলেন। কিণ্ডারম্যান হাঁটতে শুরু করল। কারাস তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। নির্জন রাস্তায় মোটাসোটা মানুষটা থপ থপ করে পা ফেলে হাঁটছে–ছবিটাতে এক ধরনের বিষণ্ণতা আছে।

 

ক্রিসের বাড়িতে যখন কারাস ঢুকলেন তখন রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। শ্যারনের সঙ্গে বসবার ঘরে দেখা। সে বলল, সব কিছু আগের মতই আছে।

রেগানের ঘর থেকে জান্তব চিকার ভেসে আসছে। কফির সন্ধানে রান্নাঘরে এসে কারাস দেখেন রেগানের একটা অ্যালবাম হাতে নিয়ে ক্রিস বসে আছে। তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে।

ফাদার, আমি আপনাকে কফি দিচ্ছি। হাত-মুখ ধুয়ে আসি। আপনি বসুন।

ক্রিস বেরিয়ে গেল। কারাস উকি দিয়ে দেখেন অ্যালবামের যে পৃঠাটা খোলা, সেখানে রেগানের একটা ভারি সুন্দর ছবি। ছবির পাশে কাঁচা হাতে লেখা একটা কবিতা।

ছেলেমানুষী রচনা, কিন্তু কবিতাটা পড়ামাত্র ফাদার কারাস অন্তরের গভীরতম কোণে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলেন। ব্যথা এবং ক্ষোভ। সে ক্ষোভ কুশ্রীতার বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, মৃত্যুর বিরুদ্ধে। তার আর কফির জন্যে অপেক্ষা করতে ইচ্ছা হল না। ক্লান্ত পায়ে রেগানের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। ঢোকার আগ মুহূর্তে শুনলেন শয়তান টেনে-টেনে বলছে, মেরিন, তুই ফিরে আয়। তোর সঙ্গে বোঝাপড়া হয়নি।

কারাস ঘরে ঢুকলেন, কিন্তু তাঁর দিকে ফিরেও তাকাল না রেগান। সে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। কি আছে সেখানে? ফাদার মেরিনই বা কোথায়? কারাসের বুঝতে বেশ সময় লাগল যে, ফাদার মেরিন মেঝেতে পড়ে আছেন। তার শরীর বরফ-শীতল। কারাস একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তার কপালের শিরাগুলো ফুলে উঠতে লাগল। কিন্তু তিনি আবেগশূন্য ভঙ্গিতেই ফাদার মেরিনের হাত দুটো ক্রুশের ভঙ্গিতে রাখলেন। শয়তান হাসতে শুরু করল। খলখল হাসি। ফাদার কারাসের সহজ জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পেল। তিনি বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন, আহ-পিশাচ, আহ শয়তান।

খল খল হাসি থেমে গেল। বেগান কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে এখন।

ওহে কারাস, তুমি কি বুঝতে পারছ তুমি হেরে যাচ্ছ? হা-হা-হা।

চুপ, শয়তান। চুপ।

ক্রিস আর শ্যারন কফির কাপ হাতে বসে ছিল। তারা ফাদার কারাসের প্রচণ্ড চিৎকার শুনতে পাচ্ছিল। ক্রিস শুনল কারাস বললেন–চুপ, শয়তান চুপ। তারপর শয়তানটা কিছু বলল। এর পর আবার চেঁচিয়ে উঠলেন কারাস, না, আমি তোকে নিকেশ না করে ছাড়ব না। তুই আর কারোর কোন ক্ষতি করতে পারবি না। না!

ঠিক তার দুএক সেকেণ্ডের মধ্যে রেগানের ঘরের জানালাটা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে পড়ল। কোন ভারি জিনিস কেউ যেন ছুঁড়ে ফেলল নিচে। ক্রিস আর শ্যারন ছুটে গেল দোতলায়। ফাদার কারাসের দেহটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে এম স্ট্রীটের মাঝামাঝি। তার চারপাশে লোকজন জমতে শুরু করেছে। অ্যামবুলেন্সের জন্যে ছুটোছুটি হচ্ছে। ক্রিস চেঁচিয়ে উঠল, শ্যারন, আমি বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে। ফাদার কারাস কি মারা যাচ্ছেন? ওই শ্যারন, ওহ!

শ্যারন হাঁটু গেড়ে ফাদার মেরিনের মাথার পাশে বসল। আর ঠিক তখুনি মিষ্টি গলায় রেগান ডাকল, কি হচ্ছে এসব, মা? এ রকম করছ কেন তোমরা? আমার বড় ভয় লাগছে।

এ কি সত্যি সত্যি রেগান? ক্রিস অবাক হয়ে দেখল দড়ি দিয়ে বাধা বাচ্চা মেয়েটা অবাক হয়ে তাকাচ্ছে তার মুখের দিকে। ভয় পাওয়া বড় বড় দুটো ঘন কাল চোখ।

ক্রিস ছুটে গেল মেয়ের দিকে।

প্রচণ্ড ভিড় জমেছে ফাদার কারাসের চারপাশে। ভিড় ঠেলে যিনি অগ্রসর হতে চাচ্ছেন তিনি ফাদার ডায়ার। শ্যারন তাঁকে খবর দিয়েছে। তিনি ফাদার কারাসের মাথার পাশে দাঁড়ালেন। এখনো প্রাণ আছে। তিনি প্রতিটি শব্দ অত্যন্ত স্পষ্ট করে উচ্চারণ করে বললেন, ফাদার কারাস, আপনি আমার কথা বুঝতে পারছেন?

কারাস মাথা নাড়লেন। তিনি বুঝতে পারছেন।

ফাদার ডায়ার তার মাথা কোলে তুলে নিলেন। শান্ত স্বরে বললেন, আপনি কি ঈশ্বরের কাছে শেষবারের মত ক্ষমাভিক্ষা করতে চান?

কারাস মাথা নাড়ালেন–তিনি চান।

আপনি কি আপনার সমস্ত পাপের জন্য ইশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন?

মাথা অল্প নড়ল–তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করছেন।

বেশ এখন আমার সঙ্গে সঙ্গে বলুন, ইগো তে এবসলভো …

ফাদার কারাসের ঠোঁট কাপতে লাগল। তার চোখ দিয়ে এক ফোটা পানি বেরিয়ে এল। তিনি কি যেন বলতে চাইলেন, পারলেন না। ফাদার ডায়ার গাঢ় স্বরে বললেন, বন্ধু, আপনার যাত্রা শুভ হোক। বিদায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *