কাছে-দূরে
১.
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কলকাতা থেকে মুক্তধারা আমার মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য পুনর্মুদ্রণ করেছিল। সেটাই ছিল দেশের বাইরে আমার বইয়ের প্রথম। প্রকাশনা। ১৯৭৮ সালে কিয়োটোতে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিম্পোজিয়মে পঠিত প্রত্যেকটি প্রবন্ধই বোধহয় মনোগ্রাফ-আকারে ওই বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ করেছিল টোকিও থেকে। তার মধ্যে আমারটাও ছিল একটি। সেটি আবার সংকলিত হয়েছিল আনোয়ার আবদেল মালেক ও এ এন পাণ্ডেয়া-সম্পাদিত সিম্পোজিয়মের বিবরণ-সংবলিত Intellectual Creativity in Endogenous Culture গ্রন্থে, তাও টোকিও থেকেই, ১৯৮১ সালে। এই ১৯৮১ সালেই লন্ডন থেকে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি প্রকাশ করলো আমার Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India Office Library and Records, গ্রন্থস্বত্ব রানির। আমি পরিহাস করে বলেছিলাম, রানি আমার প্রকাশকদের একজন।
লাইব্রেরি-কর্তৃপক্ষ আমার জন্যে বই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ঢাকায় ব্রিটিশ কাউনসিলের কাছে–কূটনৈতিক ব্যাগের সুবিধে নিয়ে। ব্রিটিশ কাউনসিলের আঞ্চলিক প্রতিনিধি আমাকে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, কীভাবে বইটি গ্রহণ করার সুবিধে আমার হবে। বলেছিলাম, আমি ঢাকায় আসছি–তখন সংগ্রহ। করবো। সে-ভদ্রলোকের সঙ্গে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের ভালো আলাপ ছিল। সারূকেও তিনি বইটির প্রাপ্তিসংবাদ জানিয়েছিলেন। সার মহাখুশি। চট্টগ্রামে আমাকে ফোন করে নানা কথা বললেন। আমি ঢাকায় এসে সারূকে সঙ্গে নিয়ে ব্রিটিশ কাউনসিলে গেলাম। বইগুলো নিয়ে সার ও আমি স্বামীবাগে এলাম–সেখানে বেবী এবং ছেলেমেয়েরাও ছিল। সার বেবীকে বললেন, আমার ষাট বছর বয়সে বইটি বের হলে তিনি এত উত্তেজিত হতেন না, মধ্য-চল্লিশে ব্লুমহার্টের ক্যাটালগের সাপ্লিমেন্টারি ভলিউম প্রকাশ করতে পারা একেবারে সামান্য অর্জন নয়। আমার মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য এবং মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (ঢাকা, ১৯৬৯) তাঁর অনুমোদন লাভ করেছিল। তবে স্বরূপের সন্ধানে (ঢাকা, ১৯৭৬) তাঁর কৌতূহল জাগায়নি, এবং মুনীর চৌধুরী (ঢাকা, ১৯৭৫) পড়ে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘কী সব। লিখছেন! এখন তিনি প্রসন্ন হলেন, যদিও এ-প্রসন্নতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আমি যে দেশ-বিদেশে সেমিনার-সিম্পোজিয়মে প্রবন্ধ পড়তে যাই, এ ছিল তাঁর খুবই অপছন্দ। তিনি বলতেন, ‘ওদের দরকার সেমিনার করা, কিন্তু হেইখানে প্রবন্ধ পড়ার কী দরকার আপনার! অন্যের কাজে সময় নষ্ট না কইরা নিজের কাজ করেন না কেন?’ পরে তিনি আশাহত হয়ে বলেছিলেন, আপনি তো আর ল্যাখ্যাপড়া করলেন না! তিনি নিজেই মুসলিম-মানস ইংরেজিতে অনুবাদ করতে শুরু করেছিলেন, শেষ করতে পারেননি; আমার কাছে তার অনেক প্রত্যাশা ছিল, আমি পূরণ করতে পারিনি। তাঁর নির্লিপ্ততা আমি আয়ত্ত করারও চেষ্টা করিনি।
Factory Correspondence-এর প্রকাশ আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা, একথা আমি সব সময়ে স্বীকার করবো। ওটি আমার অশেষ পরিশ্রমের ফসল। Bulletin of the School of Oriental and African Studiesu 478 কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের Modern Asian Studiesএ তার অনুকূল সমালোচনা বের হয়েছিল। তা না হলেও, আমি জানতাম, আমি ফাঁকি দিইনি। কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমিক স্টাফ ফেলো হিসেবে আমি নামমাত্র যুক্ত ছিলাম সোয়াসের ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ অ্যান্ড সিলোন ডিপার্টমেন্টের প্রধান। প্রফেসর রাইটের সঙ্গে। সংস্কৃতের পরে বিকশিত হয়েছে, এমন কোনো ভাষার সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহী হওয়ার কোনো কারণ তাঁর ছিল না। তিনি যখন প্রথম। শোনেন যে, আমি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোন ঢাকা কুঠির ‘লেটার-বুকস নিয়ে মেতে উঠেছি (লেটার-বুকস’ কথাটাতেই তার আপত্তি ছিল), তখন সাহিত্যের অধ্যাপকের এহেন দুর্মতিতে তিনি বেশ উদৃবিগ্ন হয়েছিলেন, যদিও তা যথাসাধ্য চেপে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি ওঁকে এক কপি বই পাঠিয়েছিল সৌজন্যস্বরূপ, তিনি পত্রপাঠ–সম্ভবত বইটির একটি পাতা না খুলেই–সেটা চালান করে। দিয়েছিলেন সোয়াস লাইব্রেরিতে। পরে তিনি আমাকে বলেছিলেন, আশা করি, আমি কাজটা ঠিকই করেছি।’
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান ডেসমন্ড আমাকে জিজ্ঞাসা। করেছিলেন, কত কপি বই ছাপবেন। আমি বলেছিলাম, পাঁচ পাউন্ডের কম দাম হলে ৫০০, নইলে ৩০০। ডেসমন্ড হতাশ হয়ে বললেন, এত কম! আমি বলেছিলাম, এটা শোওয়ার আগে পড়ার (বেডসাইড রিডিং’) মতো বই হতে যাচ্ছে না। তারা বইয়ের দাম ধরেছিলেন ১৬ পাউন্ড। আমার ধারণা, ওই বইয়ের বড়ো ক্রেতা ছিলাম আমিই। পরের বছর লন্ডনে গিয়ে, বন্ধুবান্ধবদের উপহার দেওয়ার জন্যে, আমি পাঁচ কপি বই কিনেছিলাম।
২.
দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি, যদিও যেদিন ১২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সেনা বিদ্রোহের দায়ে ফাঁসি দেওয়া হয়, সেদিনই জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা হয়। তারপর রাষ্ট্রপতি-নির্বাচন। বৃহৎ মন্ত্রিসভা-গঠন। আমার খুবই শ্রদ্ধেয় মানুষ ড. এম এন হুদার উপরাষ্ট্রপতিরূপে নিয়োগলাভ।
এর মধ্যে শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে এলো। আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে সে দেশে ফিরেছিল, তার পরপরই জিয়া-হত্যার ঘটনা ঘটে। সেদিন সে সফরে গিয়েছিল সিলেটে। এখন চট্টগ্রাম-সফরে এসে সে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলো ক্যাম্পাসে। তার এ সৌজন্যবোধে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। এতদিন। পরে দেখা হওয়ায় প্রথমেই তার স্বজন-হারানোর দুঃখের কথাটাই মনে ভিড় করেছিল। রাজনীতির কথা যা হয়েছিল, তা সামান্য।
এদিকে সেনাপ্রধান এরশাদ হঠাৎ করে খুব সক্রিয় হয়ে উঠলেন। আজ এক সেনানিবাসে, কাল আরেক সেনানিবাসে বক্তৃতা। এ-কাগজে সাক্ষাৎকার, ও কাগজে বিবৃতি। দেশের শাসনব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর অংশ দাবি করে বসলেন তিনি। জেনারেল ওসমানী বললেন, সামরিক বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় এমন বিবৃতি দেওয়া সকল নিয়মবহির্ভূত। কা কস্য পরিবেদনা!
এই পরিস্থিতিতে আমি চলে গেলাম দেশের বাইরে এবং বেশ কিছু কালের জন্যে। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পের অংশস্বরূপ আনোয়ার আবদেল-মালেক ‘বিশ্বের রূপান্তর’ শিরোনামে পাঁচটি নতুন সেমিনার অনুষ্ঠানের প্রস্তাব অনুমোদন করিয়ে নেন। প্রথমটি বেলগ্রেডে হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে, ১৯৭৯ সালে; দ্বিতীয়টি হলো মাদ্রিদে, অর্থনীতি ও সমাজ নিয়ে, ১৯৮০ সালে। দ্বিতীয়টিতে তিনি আমাকে যোগ দিতে বলেছিলেন; মাদ্রিদে কখনো যাওয়ার সুযোগ পাইনি, তা সত্ত্বেও সেখানে আমি যাইনি, বিষয়টি আমার এলাকাভুক্ত নয় বলে। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে তিনি আলজিয়ার্সে সংস্কৃতি ও চিন্তাধারা-বিষয়ে (Culture and Thought in the Transformation of the World) তৃতীয় সেমিনার করবেন। এতে আমাকে যোগ দিতে হবে, শুধু তাই না, এই সেমিনারের বিবরণও গ্রন্থাকারে প্রকাশের জন্যে তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদন করতে হবে। আমি রাজি হলাম। তবে এই শর্তে যে, আলজিয়ার্সে সেমিনারে যোগ দেওয়ার পরে আমি প্যারিসে তাঁর কাছাকাছি থেকে বিবরণ সম্পাদনা করবো। বস্তুত, দেশে আমার নানাধরনের সংশ্লিষ্টতার কারণে আশঙ্কা হচ্ছিল, সম্পাদনার কাজটা সময়মতো শেষ করতে পারবো না। তার ওপর এক সম্পাদক প্যারিসে, অপরজন চট্টগ্রামে, সমন্বয়সাধনও দুরূহ। আনোয়ার আবদেল-মালেককে বললাম, আমার পারিশ্রমিকের অর্থটা প্যারিসে দিলে তা দিয়ে আমার থাকা-খাওয়া চলে যাবে। তিনি যেন তেমন ব্যবস্থা করেন। আনোয়ার খুবই খুশি হলেন, তবে তিনি নিশ্চয় আমাকে বেকুব ঠাওরালেন।
অতএব এক ‘পউষ প্রখর শীতে ঝঝর ঝিল্লিমুখর রাতি’তে (বোধহয় পৌষ আসতে তখনো দু-চারদিন বাকি ছিল) চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে, দিল্লি বোম্বাই-রোম হয়ে আলজিয়ার্স রওনা হলাম। ঢাকায়, আমার বন্ধু আবদুল আলীর জ্যেষ্ঠাগ্রজ, এ জেড এম আবদুল আলিম বললেন, ‘সে কী, তুমি আলজিরিয়া যাচ্ছো, মিসেস আলজিরিয়া তো এখন ঢাকায়। তাঁর শ্যালিকা ইলার স্বামী আবুল ফতেহ্ আলজিয়ার্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। ওই সময়টায় ইলা আবার ঢাকায়। তাই তার এই বিস্ময় বা দুঃখবোধ।
ঢাকা থেকে রোম পর্যন্ত গেলাম এয়ার ইন্ডিয়ায়। ওখান থেকে অন্য এক এয়ারলাইনসে আলজিয়ার্স। বিমানবন্দরে পৌঁছে ভিসা পেতে কোনো অসুবিধে হলো না। এক সরকারি কর্মকর্তা আমাকে নিতে এসেছিলেন সেখানে। অল্পসময়ে আনুষ্ঠানিকতা পার করে তিনি আমাকে পৌঁছে দিলেন হোটেলে। রোম-আলজিয়ার্স অংশে বিমানে নৈশভোজ করতে হয়েছিল। তাতে এমন কিছু খেয়েছিলাম, যা আমার সয়নি। রাতে বমি করতে শুরু করলাম। বেসিন ভরে গেল, আমি দুর্বল হয়ে পড়লাম। কোনোক্রমে বমি করতে যাই আর বিছানায় ফিরে আসি। ঘরের টেলিফোন কাজ করে না, সাহায্য প্রার্থনা করার উপায় নেই। সকালে যে-মেয়েটি ঘর পরিষ্কার করতে এলো, সে আরবিতে কী যে বললো, বোঝার উপায় নেই। ভাবলাম, এবার সাহায্য আসবে। এলো না। সকালে সেমিনারের উদ্ববাধনী অনুষ্ঠান। আমি হোটেলে, অথচ অনুষ্ঠানে নেই। সেই অধিবেশনের শেষে আনোয়ার আবেদল-মালেক এলেন সেমিনারের সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি ড. জামিল বেনবুজিদকে নিয়ে আমার খোঁজ করতে। ভাগ্যক্রমে তিনি একজন পেশাদার চিকিৎসক, এদেশের উচ্চতর বৈজ্ঞানিক গবেষণা মন্ত্রণালয়ের পরিচালক। তিনি এসে আমাকে দেখলেন, ব্যবস্থাপত্র লিখলেন, ওষুধ পাঠিয়ে দিলেন, দিনটা বিশ্রাম করে কাটাতে বললেন, টেলিফোন ঠিক করার ব্যবস্থা করলেন। তার কথা শুনেই অর্ধেক ভালো হয়ে গেলাম, অধিবেশনে অনুপস্থিতির ফলে লজ্জিত হওয়ার কারণও অপসৃত হলো।
সেমিনারে যোগ দিলাম দ্বিতীয় দিনে। দেখি, কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন দি সোশাল সায়েন্সেসের পার্থ চট্টোপাধ্যায় এসেছেন–সেন্টারের অতিথি ভবনে একাধিকবার থাকার সুযোগে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ছিল। নিউ ইয়র্ক থেকে এসেছেন ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন–তারই আমন্ত্রণে ১৯৭৪ সালে মন্ট্রিয়লে গিয়েছিলাম এক সেমিনারে। এখন তিনি স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কে (বিংহ্যামটন) ফার্ডিনান্ড ব্রডেল সেন্টার ফর দি স্টাডিজ ইন ইকনমিক্স, হিস্টরিকাল সিসটেমস অ্যান্ড সিভিলিজেশনের পরিচালক–তাঁর সেন্টার সম্পর্কিত কাগজপত্র আমাকে নিয়মিত পাঠিয়ে থাকেন চট্টগ্রামে। প্যারিস থেকে এসেছেন ফাদার ব্রুনো রাইবস–যে-শ্রেণির যাজকেরা আফ্রিকায় ও ল্যাটিন আমেরিকায় এসটাবলিশমেন্ট-বিরোধী সংগ্রামে জড়িত, তিনি সেই শ্রেণির; বলেন, খ্রিষ্টের শিক্ষাই তাঁকে প্রতিবাদী হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ১৯৭৮ সালে, কিয়োটোতে।
নতুন করে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হলো। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন রেক্টর হয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার সমাজবিজ্ঞানী সোয়েজাতমোকো। মালয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুসেন আলি–বামপন্থী চিন্তাধারার জন্যে জেল খেটেছেন অনেককাল। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. জন ডান। মেক্সিকোর এক গবেষণা-প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ড. সুসানা ব্রুনা। বুদাপেস্টের কার্ল মার্কস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অধ্যাপক ড. তামাস জানতেস। আলজিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রধান নাজি সাফির। দার-এস-সালামের এক কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. এমনুয়া। আরো অনেকে। তার মধ্যে আনোয়ার আবেদল-মালেকের সচিব ক্রিস্তিন কলপার কথা পরে বলতে হবে।
আনোয়ার আবদেল-মালেক নাকি সেমিনারের মূল প্রতিবেদক করতে চেয়েছিলেন আমাকে, আমি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে ভার বর্তালো পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ওপরে। তবে চারটি অধিবেশনের একটির রিপোর্ট আমাকে তৈরি করতে হলো। বাকি তিনটি করলেন অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অয়ভিন্দ অসতেরুদ, ভেনেজুয়েলার কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা-কেন্দ্রের পরিচালক ড. হোসে অগাস্তিন সিলভা-মিশেলেনা এবং বেলগ্রেড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. ব্লাদিমির স্তামবুক।
সেমিনার চললো ১৩ থেকে ১৭ ডিসেম্বর অবধি। ১৫টি প্রবন্ধ, আটটি গবেষণা-প্রতিবেদন, আরেকটি বাড়তি লেখা। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে যে-সেমিনার দুটি করেছিলাম, আমারটা ছিল তার আলোচনার সারসংক্ষেপ। পার্থের লেখাটাও এমনি প্রতিবেদন-শ্রেণিভুক্ত। সেটি পরে তাঁর Nationalist Thought and the Colonial World (লন্ডন, ১৯৮৬) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এটি পড়ার আগে তিনি ছোটো যে-ভূমিকা করেছিলেন, তাতে বলেছিলেন যে, আমার উপস্থিতিতে লেখাটি পড়তে তার সংকোচ হচ্ছে, কেননা, এতে বাংলার যেসব লেখকের প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে, তাদের সম্পর্কে আমি অনেক বেশি জানি। পার্থের এ-কথায় অনেকেই আমাকে মস্ত পণ্ডিত বলে ভুল করেছিলেন। কলম্বো থেকে সুসান্ত গুণতিলেকে আসতে পারেননি, কিন্তু ঐতিহ্য ও আধুনিকতা সম্পর্কে অতি চমৎকার একটি প্রবন্ধ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আরো কয়েকটি ভালো প্রবন্ধ উপস্থাপিত হয়েছিল। লেখাগুলো ছিল আরবি, ইংরেজি, ফরাসি ও স্প্যানিশে। ফলে তাৎক্ষণিক অনুবাদের ওপর খুব ভরসা করতে হয়েছিল।
যে-হোটেলে আমরা ছিলাম, সেমিনার হয়েছিল সেখানেই। তার বাইরে যাওয়ার সুযোগ তাই বেশি হয়নি। যেখানে বেনবেল্লা গৃহবন্দি ছিলেন দীর্ঘকাল, তার সামনে দিয়ে বারদুই আসা-যাওয়া করতে হলো। বেনবেল্লা বোধহয় তখন দেশত্যাগের শর্তে মুক্ত হয়েছেন–প্যারিসে প্রবাসজীবন যাপন করছেন। বুমেদিন তখন আর বেঁচে নেই। তবে আলজিরিয়ার স্বাধীনতা-সংগ্রামের বেশ কিছু স্মারক এখানে-ওখানে দেখা গেল। তবে তার চেয়েও বেশি দেখা গেল নিরাপত্তা বাহিনীর সর্বত্র উপস্থিতি। ইসলামপন্থীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তারও কিছু আভাস পাওয়া গেল। এফএলএনের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সেমিনারের বোর্ড অফ অনারে ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হলো।
একদিন সবাই মিলে যাওয়া হলো আলজিয়ার্সের বাইরে। রোমানরা যখন এই অঞ্চল শাসন করেছিল, তার স্মৃতিনিদর্শন দেখতে। রোমানদের তৈরি নগর দেওয়ালের ভগ্নাবশেষ তখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। সে-আমলের নগর পরিকল্পনার কিছু বিস্ময়কর প্রমাণও পাওয়া গেল।
রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহর আমন্ত্রণে এক সন্ধ্যা তাঁর বাড়িতে কাটালাম। ঢাকা থেকে তিনি খবর পেয়েছিলেন আমার আসার, পৌঁছে আমিও ফোন করেছিলাম। এই সৌজন্যপরায়ণ মানুষের সান্নিধ্যে সন্ধ্যাটা ভালো কাটলো।
হোটেলে একদিন আনোয়ার আবদেল-মালেকের সঙ্গে দেখা করতে এলো দুটি মেয়ে। তার মধ্যে একজন অপূর্ব সুন্দরী। আনোয়ার তার নাম দিয়েছিল নেফারতিতি। আলজিয়ার্সে রাষ্ট্রীয় বেতারের ঘোষিকা। আরবি ছাড়াও ভালো ইংরেজি ও ফরাসি বলে। অনেককাল পরে প্যারিসে আনোয়ারের ঘরেই আবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
আলজিয়ার্স থেকে আনোয়ার, মাদাম কলপ ও ফাদার রাইবস একসঙ্গে ফিরে গেলেন প্যারিসে। অন্য একটি ফ্লাইটে পার্থ ও আমিও সেখানে যাত্রা করলাম। পার্থ কয়েকদিন থাকবেন প্যারিসে। আমার প্রায় মাসতিনেক থাকার পরিকল্পনা। সিতে য়ুনিভার্সিতেয়ারে রেজিস রোবের গারিক বলে একটি অংশ আছে–সফরকারী বিদেশি শিক্ষকদের থাকতে দেওয়া হয় সেখানে। ওই রেজিসে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।
৩.
প্যারিসে পৌঁছানোমাত্র আনোয়ার আবদেল-মালেকের সেক্রেটারি ক্রিস্তিন কলপা আমাকে তার পক্ষপুটে টেনে নিলেন। ঠিকমতো পৌঁছোলাম কি না এবং রজিস রোবের গারিকে আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে কি না, তা জানতে টেলিফোন করলেন প্রথমে। পরদিন সকালে আনোয়ারের অফিসে কীভাবে পৌঁছোবো, তার হদিস দিলেন।
আনোয়ার আবদেল-মালেকের অফিস সঁত্র নাসিওনাল র্যশেৰ্শ সিয়ান্তিফিক বা সংক্ষেপে সিএনআরএসে। সেখানে তাঁর কক্ষে বসেন ক্রিস্তিন এবং কনিষ্ঠ সচিব সানিয়া আরুসি। সানিয়া আরব ও তরুণী, ফরাসি তার মাতৃভাষার মতো, ইংরেজিও আয়ত্তে, তবে দ্রুত কাজ করতে অভ্যস্ত নয়। সেই ঘরেই জানলার পাশে আমার জন্য চেয়ার-টেবিল পাতা হয়েছে। ক্রিস্তিন আমাকে সঙ্গে করে অফিস থেকে বেরিয়ে প্রথমে গেলেন ব্যাংকে–আমার হিসাব খুলতে। তারপর বড় একটা দোকানে গিয়ে–আমার কী কী লাগবে, জেনে নিয়ে এবং কী কী লাগতে পারে, ভেবে নিয়ে–একে একে সব সংগ্রহ করে দিলেন। তার মধ্যে একটি অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাস ছিল–তাতে বৈদ্যুতিক তার লাগিয়ে ইমারশন হিটারের মতো চা-কফির জন্যে পানি গরম করা যেতো–ভারি সুবিধের। জিনিসপত্র কিনে-কেটে সিএনআরএসে ফেরা। সেখানে আমার পরিচয়পত্র সংগ্রহ করা, ওই বিশাল ভবনের যেসব অংশের সঙ্গে আমার যোগাযোগ অপরিহার্য–যেমন, লাইব্রেরি, ডাইনিং রুম, ক্যাফেটারিয়া–সেগুলো চেনানো এবং ভর্তুকি-দেওয়া হারে খাবার কুপন কেনা। তারপর দুপুরে একসঙ্গে খাওয়া। তিনি বাড়ির টেলিফোন নম্বর আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। এখন খুব জোর দিয়েই বললেন, প্রয়োজন হলেই যেন যে-কোনো সময়ে তাঁকে নিঃসঙ্কোচে ফোন করি বাসায়। ক্রিস্তিনকে আমি মাদাম কলপা বলে ডাকতাম, তিনিও আমাকে প্রফেসর আনিস বলে সম্বোধন করতেন। এই আনুষ্ঠানিকতা সত্ত্বেও আমাদের গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। অফিসের বাইরেও আমরা একসঙ্গে খেয়েছি, একসঙ্গে সিনেমায় গেছি, তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছি, তাঁর স্বামীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, যে-কোনো সময়ে তাঁর সাহায্য চেয়েছি এবং পেয়েছি।
আলজিয়ার্স থেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায় আর আমি একসঙ্গে প্যারিসে এসেছিলাম। পার্থর স্ত্রী সেখানে আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন। আমাদের তিনজনকে এক সন্ধ্যায় আনোয়ার আবদেল-মালেক তাঁর বাড়িতে নৈশভোজে ডাকলেন। তার সঙ্গে তাঁর মিশরীয় ডাক্তার স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে অনেক দিন। মহিলা বোধহয় জেনেভায় থাকেন। তাদের কন্যা–একমাত্র সন্তান–ডাক্তারি পড়ে ভিয়েনায়। আমরা গিয়ে দেখলাম, অতি সুন্দরী এক ফরাসিনী রান্নাবান্না করছেন, যথাসময়ে তিনিই পরিবেশন করে খাওয়ালেন। পরেও দেখেছি, আনোয়ার কাউকে বাড়িতে খেতে ডাকলে কোনো না কোনো মহিলা এসে সবকিছু সামাল দেন। একইসঙ্গে গুণবান ও রূপবান হওয়ার এই সুবিধাটা তিনি পুরোপুরি লাভ করেছেন এবং ভোগ করেছেন।
সেই প্রথম সন্ধ্যায় আনোয়ারের ফ্ল্যাটে ঢুকে তাঁর সুন্দরী বান্ধবীকে লক্ষ করার আগে যা চোখে পড়েছিল, তা ড্রয়িংরুমের টেবিলে রাখা জামাল আবদেল নাসেরের আবক্ষ প্রতিকৃতি। জীবনের শেষদিকে নাসের যখন মিশরে বামপন্থীদের দমন করতে অগ্রসর হন, তখন গ্রেপ্তার এড়াতে এক গভীর রাতে আনোয়ার আবদেল-মালেক স্বদেশ ত্যাগ করে ফ্রান্সে চলে আসেন। সেই থেকে প্যারিসই তার স্থায়ী আবাস, যদিও পরে তিনি নিজের মায়ের কাছে এবং দেশমাতৃকার কাছে ফিরে গেছেন। এসব কথা ভেবেই আমি মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি না নাসেরের দ্বারা নির্যাতিত ও বিতাড়িত, তাহলে তাঁর ছবি কেন আপনার ঘরে শোভা পাচ্ছে? আনোয়ার দ্বিধাহীনভাবে বলেছিলেন, নাসের আমার প্রতি সুবিচার করেননি, কিন্তু মিশরের জন্য তিনি যা করেছেন, তা অবিস্মরণীয়। হয়তো আর কয়েক বছর বাঁচলে তার নীতির পরিবর্তন হতো এবং আমি দেশে ফিরে যেতে পারতাম। আনোয়ার সাদাতকে আনোয়ার আবদেল মালেক যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়নক ভাবতেন। আমরা যখন সেই সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে বসে আলাপ করছি, তখন সাদাত নিহত এবং হোসনি মুবারক সদ্য রাষ্ট্রপতি হয়েছেন মিশরের। তাঁর প্রতিও আনোয়ারের আস্থা ছিল না। আনোয়ার ছিলেন ইসরাইলের চরম বিরোধী। নাসের ছাড়া আর কেউ সত্যিকারভাবে ইসরাইলের বিরোধিতা করেছেন বলে তিনি মনে করতেন না। তার সন্দেহ ছিল, ইসরাইলি গোয়েন্দারা তাঁকে চোখে-চোখে রাখছে। তিনি বলতেন, হে আমার প্রিয় ভ্রাতা, রমণীর সান্নিধ্যলাভের বিষয়েও খুব সতর্ক থাকতে হয়, কারণ ইসরাইলিদের কৌশলের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
প্যারিসে আমার কাজটা ছিল আলজিয়ার্সে সদ্যসমাপ্ত সেমিনারের কার্যবিবরণী তৈরি করা। অধিবেশন-অনুযায়ী পঠিত প্রবন্ধগুলো সাজিয়ে তার একটা ভূমিকা লিখে আমি দায়িত্ব শেষ করতে পারতাম। কিন্তু আমি তার বদলে চেয়েছিলাম, ভাব-অনুযায়ী একটা কার্যবিবরণী তৈরি করতে। একই প্রবন্ধে যদি একাধিক ভাবের প্রসঙ্গ এসে থাকে, তবে সেই প্রবন্ধকে ভাব-অনুযায়ী ভাগ করে একাধিক জায়গায় সন্নিবিষ্ট করতে। ফরাসি, স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ ভাষায় লিখিত প্রবন্ধ নিয়ে কী করবো, তা ছিল আমার শিরঃপীড়ার বিষয়। আনোয়ার। বলেছিলেন ফরাসি প্রবন্ধগুলো ক্রিস্তিন ও সানিয়া মিলেমিশে ব্যাখ্যা করে দেবেন। আমার কাছে। ওই সন্ধ্যায় তিনি বললেন, তোমার জন্যে সুসংবাদ, সুসানা ব্রুনাও আলজিয়ার্স থেকে প্যারিসে এসেছে এবং থাকছে তার এক বান্ধবীর সঙ্গে–তুমি যেখানে আছ, তারই পাশের বাড়িতে। সুন্দরী মহিলার সঙ্গে কাঁধ ঘষাঘষি করতে তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি সুসানাকে বলে দিচ্ছি, তুমি তার ওখানে যাবে এবং যতক্ষণ লাগে, সে তার স্প্যানিশ প্রবন্ধ তোমাকে ইংরেজি করে শোনাবে। আমি বললাম, আপনার মতো আকর্ষণীয়তা আমার নেই, তবে আপনার জানা উচিত, মহিলাদের অনুবর্তী হতে আমার কোনো দ্বিধাও নেই।
অতএব এক সকালে পাশের বাড়ি গিয়ে হানা দিলাম এবং সুসানা ব্রুনার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বললাম। মুশকিল হলো এই যে, তার ইংরেজিজ্ঞান কিছুটা সীমাবদ্ধ, ফলে নিজের প্রবন্ধের যে-ইংরেজি ভাষ্য সে মুখে-মুখে প্রণয়ন করছিল, তা স্প্যানিশ বাক্যরীতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারছিল না। আমি তার কথামৃত টুকে রাখছিলাম বটে, তবে সর্বত্র মর্মভেদ করতে সমর্থ হচ্ছিলাম না।
এর মধ্যে তার গৃহকত্রী একাধিকবার দেখা দিলেন এবং কফি ও খাবার পরিবেশন করলেন। ভদ্রমহিলাও, মনে হলো, মেক্সিকান এবং সন্দেহাতীতভাবে অপূর্ব সুন্দরী। বিদায় নেওয়ার সময়ে তিনি বললেন, যেহেতু আমি তার নিকটতম প্রতিবেশী, সেহেতু তিনি আশা করবেন, সুসানা চলে যাওয়ার পরও আমি তার খোঁজ নেবো। আমি বার দুই ফোন করেছিলাম, কিন্তু পরিচারিকার সঙ্গে ফরাসিতে কিছু বলতে অপারগ হওয়ায় গৃহকত্রীর কাছে পৌঁছাতে পারিনি। আমি নীরব থাকলেও ভদ্রমহিলা যেচে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, তা বোধহয় সভ্য সমাজের দস্তুর নয়।
৪.
প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রতিষ্ঠান আছে–আঁস্তিত্যু নাসিওনাল দ্যে লংগ এ সিভিলিজাসিওঁ ওরিয়তাল বা প্রাচ্যের ভাষা ও সভ্যতা সম্পর্কিত জাতীয় ইনস্টিটিউট, সংক্ষেপে ইনালকো। সেখানে বাংলা ভাষার শিক্ষক তখন দুজন–ফ্রাঁস ভট্টাচার্য ও সিরাজুল ইসলাম। মঙ্গলকাব্য সম্পর্কে গবেষণা করে ফ্রাঁস ডক্টরেট অর্জন করেছেন, বাংলা থেকে ফরাসিতে অনুবাদ করেছেন প্রচুর–যেমন, বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালি, সত্যজিৎ রায়ের অনেক ছবির ফরাসি সাব-টাইটুল তার করে দেওয়া। সিরাজুল ইসলাম মূলত পরিসংখ্যানবিদ, তবে ওই ইনস্টিটিউটে বাংলা পড়াচ্ছেন অনেককাল ধরে। তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় লন্ডনে, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে–সেখানে তিনি বঙ্গদেশে মরত্ব বা নশ্বরতা নিয়ে দুঃসাধ্য ও চমকপ্রদ গবেষণার উপকরণ আহরণ করছিলেন। এই বাংলা শিক্ষকদ্বয়ের সম্পর্ক আদর্শস্থানীয় নয়। সুতরাং তাদের সঙ্গে আলাদা করে সাক্ষাৎ করতে হলো।
ফ্রাঁস খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে আমাকে গ্রহণ করলেন। আমার একটা বক্তৃতার আয়োজন করলেন তিনি ইনালকোতে। তাছাড়া যে জন পনেরো ছাত্রছাত্রী বাংলা পড়ে, তাদের তার বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ করলেন আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্যে। আমি তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তারা বাংলা শিখতে চায় কেন। কেউ বললো, সত্যজিৎ রায়ের ছবি দেখে সে আগ্রহী হয়েছে; কেউ বললো, রবীন্দ্রনাথের কোনো লেখার অনুবাদ পড়ে মূল ভাষাটা জানতে উৎসাহী হয়েছে। একটি মেয়ে বললো, তার ছেলে-বন্ধু বাংলাভাষী, তাই সে বাংলা শিখতে চায়।
আমার অনুরোধে ফ্রাঁস আমাকে নিয়ে গেলেন বিবলিওথেক নাসিওনালে এবং সেখানকার সদস্য হতে সাহায্য করলেন। সময় ও সুযোগমতো আমি সেখানে বসে আঠারো শতকের বাংলা পাণ্ডুলিপিগুলো দেখি। এর মধ্যে ইন্দ্রাণীর সংগৃহীত সেক্রেতেয়ার বেঙ্গলের পাণ্ডুলিপি ছিল–তার সবটাই আমি হাতে নকল করে নিই। তাছাড়া অগুস্তে অসার শব্দমালাগুলো দেখি এবং বাংলা আদর্শলিপির মতো একটা পাণ্ডুলিপিও পরীক্ষা করি। ফ্রাসের সঙ্গে কথা বলতে বলতে স্থির করলাম, যদি কখনো সময় ও সুযোগ হয়, তিনি ও আমি মিলে অন্তত অসার বাংলা-ফরাসি শব্দমালা সম্পাদনা করবো। বহুকাল পরে সত্যিই কাজটি করতে পেরেছিলাম।
ফ্রাঁসের স্বামী লোকনাথ ভট্টাচার্য তখন ভারতে–বোধহয় সাহিত্য একাডেমির সচিবের দায়িত্বস্বীকার করে দিল্লিতে কর্মরত। তাঁদের একমাত্র সন্তান-কন্যা–ইসা অত্যন্ত সদালাপী। প্রাণরসায়ন পড়ে ফার্মেসিস্ট হবে বলে তখন সে ভাবছিল।
সিরাজুল ইসলাম সিতে য়ুনিভার্সিতেয়ারে চলে এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর মনে হয়েছে, ইনালকো তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়নি। তাই তিনি কর্তব্যের অধিক কোনো কাজেই সেখানে জড়াতে চান না। এই কারণে আমার বক্তৃতায় উপস্থিত থাকেননি, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকারের সময়েও নয়। এমন অভিমান করে হয়তো তিনি ছাত্রছাত্রীদের থেকেও দূরে চলে যাচ্ছিলেন, যা শিক্ষকের জন্যে অভিপ্রেত নয়। তিনি কিছু একটা করতে চাইছিলেন, কিন্তু ঠিক কী যে করবেন, তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
৫.
আমি সকালে উঠে মুখ হাত ধুয়ে রাস্তাটা পার হয়ে সিতে য়ুনিভার্সিতেয়ার স্টেশনে আসি। সেখানে কফির দোকানে দাঁড়িয়ে ক্রোয়াসে আর কফি খাই। দুপুরে হয় সিতের মূল ডাইনিং হলে এসে ছাত্রদের সঙ্গে লাঞ্চ খাই তুমুল হইচইয়ের মধ্যে, নয়তো সিএনআরএসে এসে ক্রিস্তিনের সঙ্গে–অথবা তিনি ব্যস্ত থাকলে একাই–খাওয়াটা সারি। লেখালিখির কাজটা ঘরে বসেই করি বেশির ভাগ। খানিকদূর লেখা হলে ক্রিস্তিনকে দিয়ে যাই টাইপ করার জন্যে। সন্ধ্যায় স মিশেল এলাকায় যাই। সেখানে নানা দেশীয় খাবারের রেস্টুরেন্টের সারি। কোনো একটায় রাতের খাবার খাই। কখনো কখনো ফাস্ট ফুড খেয়ে নিই। কদাচিৎ ভালো রেস্টুরেন্টে যাই। জাঁ পল সার্ত যেখানে আড্ডা দিতেন, সেখানে যেমন গেলাম এক সন্ধ্যায়।
ঘরে বসে কাজ করার সময়ে কফি বানিয়ে খাই। একদিন লক্ষ করলাম অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসটা গরম হওয়ায় কাঠের মেঝেতে কালো দাগ পড়ছে। ওটার ব্যবহার বন্ধ করে দেবো ভাবলাম। সেদিন মেইডের চোখেও দাগটা ধরা পড়ল। সে কীসব বললো। ভাবলাম, তিরস্কার করছে বা সাবধান করে দিচ্ছে। খানিক পরে দেখি, সে আবার এসেছে, এবারে হাতে একটা সেরামিক ইট। ঘরের একধারে ইটটা রেখে তার ওপরে অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসটা বসিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিলো, এবার আর দাগ পড়ার আশঙ্কা নেই। এক গাল হেসে মাথা। দুলিয়ে সে যা বললো, তার মর্মার্থ হয়তো ঠিক আছে? কিংবা খুশি তো? আমি তাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানালাম।
সিতের ডাইনিং হলে একদিন একটি মেয়ে এসে আমার নাম করে জানতে চাইলো, আমিই সেই ব্যক্তি কি না। তার অনুমান ঠিক, একথা জানাবার পরে সে নিজের পরিচয় দিলো। নাম হাসনাত জাহান। তার বড় বোন ফিরোজ জাহান ঢাকায় সরকারি কলেজে বাংলার শিক্ষক–আমার বিলক্ষণ পরিচিত। বস্তুত আমার ছোটোবুর সঙ্গে তাদের পরিবারের খুবই অন্তরঙ্গতা। হাসনাতের অধীত বিষয় ভিন্ন হলেও ফ্রাঁস ভট্টাচার্যের সঙ্গে সে গবেষণা শুরু করেছে অঁদ্রে জিদকৃত গীতাঞ্জলির অনুবাদ সম্পর্কে। সিতের বিশাল এলাকার মধ্যে অনেকগুলি মেজো বা ভবন আছে–কয়েকটি কোনো না কোনো দেশের নামে–মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত প্রভৃতি, কয়েকটি অন্য নামে। এমনি একটি মেজোতে হাসনাত থাকে, খণ্ডকালীন কাজও করে।
সেদিন থেকে হাসনাত আমার পথপ্রদর্শক ও পরামর্শদাতা হয়ে গেল। সে আলাপ করিয়ে দিলো নাসিমা জামানের সঙ্গে। নাসিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রিলাভের জন্যে গবেষণা করছে। সে-ও আমার এক সহায় হয়ে দাঁড়ালো। ওরাই আমাকে নিয়ে গেল পপিদু সঁৎরে। তার অত্যাধুনিক স্থাপত্যরীতি বাইরে থেকে আমার ভালো লাগেনি, তবে ভেতরটা খুবই সুন্দর। দোকানপাট থেকে শুরু করে সিনেমা হল পর্যন্ত কী নেই সেখানে! সেখানকার সিনেমা হলে সত্যজিৎ রায়ের কয়েকটি ছবি দেখেছিলাম।
হাসনাত আমার কাপড় ধোওয়ার সমস্যার সমাধান করে দিলো। ওদের মেজেতে লড্রেট আছে। সে নিজেই চাইলো সেখানে আমার কাপড়চোপড় ধুয়ে দিতে। আমি বললাম, মেশিনে কাপড় দেওয়া-নেওয়ার সময়ে সে উপস্থিত থাকলে যথেষ্ট সাহায্য হবে।
সপ্তাহান্তের দিনগুলোতে হাসনাত, নাসিমা ও আমি দুপুরে একসঙ্গে খাওয়ার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন বাইরে থেকে আসা এক বা একাধিক বাংলাদেশি। তার মধ্যে ডা. ওয়াহিদ নামে এক তরুণ প্রায়ই আসেন। তিনি খুব নামজাদা এক ডাক্তারের অধীনে কাজ করেন। সেই প্রবীণের নানারকম খামখেয়ালির গল্প বলে মাতিয়ে রাখেন। ডা. ওয়াহিদ পরে হৃদ্রোগ-বিশেষজ্ঞ হিসেবে খুব খ্যাতি অর্জন করেন এবং কিছুকাল আগে বারডেমের নতুন কার্ডিয়াক সেন্টারে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করে আবার ফ্রান্সে ফিরে যান।
হাসনাতই খবর দিলো যে, যুক্তরাষ্ট্র-ভবনে ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা আছে এবং অন্য ভবনের অতিথিরাও সেখানে গিয়ে খেতে পারে। সেই থেকে আমার প্রাতরাশের জায়গা বদলে গেল এবং তৃপ্তির সঙ্গে দিন শুরু করতে সমর্থ হলাম।
রোববারে আমার ঘরের জানলা দিয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেতাম। খোলা জায়গায় দু দল ইরানি ছাত্র সমবেত হয়েছে। একদল বয়ে এনেছে আয়াতোল্লাহ খোমেনির ছবি, আরেক দলের হাতে শাপুর বখতিয়ারের প্রতিকৃতি। দুদল আলাদা সভা করছে। খানিক পরই একদল চড়াও হচ্ছে অপর দলের ওপরে। অনতিবিলম্বে গাড়িভর্তি পুলিশের আবির্ভাব হাতের মোটা ব্যাটন দিয়ে তারা নির্বিচারে ইরানিদের মারছে, অনেককে ধরে গাড়িতে তুলছে। বাদ-প্রতিবাদ এভাবে মুলতবি হচ্ছে পরের রোববার পর্যন্ত।
প্যারিসে আসার পরপরই ফোন করলাম আমাদের ভিয়েতনামি বন্ধু লে থান খোয়কে। তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিয়োটো সিম্পোজিয়ামে। সে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বিষয়ের অধ্যাপক, অতি চমৎকার মানুষ। আমার ফোন পেয়েই যথেষ্ট উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো এবং পরের শনিবারই লাঞ্চ খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালো তার বাড়িতে। এখন ভাবতে লজ্জা করে, পয়সাকড়ির হিসেব করে আমি খুব শস্তা একটা হোয়াইট ওয়াইন কিনে নিয়ে গেলাম তার জন্যে। লে থান খোয় এমনই ভদ্রলোক, সঙ্গে সঙ্গে সেটা ফ্রিজে রেখে দিয়ে খাওয়ার সময়ে পরিবেশন করলো। অবশ্য তার বিকল্পও ছিল। সেই দুপুরে তার আরেকজন অতিথি ছিলেন ইউনেসকোর এক আফ্রিকান কর্মকর্তা–বেশ উচ্চ পদাধিকারী। ভদ্রলোক আমাকে উৎসাহ দিতে বললেন, ফরাসি ভাষা ইংরেজির চেয়ে অনেক সহজ, তোমার শিখতে সময় লাগবে না। ইংরেজরা লেখে এক রকম, বলে আরেক রকম, বুঝতেই প্রাণান্ত। আমি বললাম, ফরাসিরা যা লেখে, তার অর্ধেক যে উচ্চারণ করে না, সেটাই তো আমার কাছে সমস্যা মনে হয়। ভাষা ছেড়ে উঠলো খাবারের প্রসঙ্গ। লে থান খোয় বললো, প্যারিসে ভিয়েতনামি রেস্টুরেন্ট আছে অনেক। একটু ভালো জায়গার ভিয়েতনামি রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওয়েটারের সাহায্য নিয়ে ফরমাশ দিলে তুমি ঠকবে না। সে কয়েকটা খাবারের নামও বলে দিয়েছিল।
সেসব নাম মনে রাখতে পারিনি। তবে তার পরামর্শমতো গোটা দুই ভিয়েতনামি রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবারের ফরমাশ দিয়েছিলাম। আমার অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। আমার ফরাসি ভাষাশিক্ষা মোটেই এগোয় নি। ক্রিস্তিন। বলেছিলেন রোজ সন্ধ্যায় টেলিভিশনের খবর শুনতে। আমাদের রেজিসের টিভিরুমে গিয়ে সে-চেষ্টা করেছিলাম। সবসময়ে খবর দেখতেও পেতাম না, কেননা অন্য চ্যানেলের কোনো প্রোগ্রাম হয়তো অন্য কেউ দেখছেন। ভাষাশিক্ষার জন্যে যে-সময় দিতে হয়, তাও আমার হাতে ছিল না। সুতরাং আমার ফরাসিজ্ঞান সৌজন্যবিনিময় এবং সামান্য কিছু কেনাকাটার সামর্থ্যের চেয়ে বেশি হলো না।
৬.
আমার আলজিয়ার্স যাওয়ার আগেই আমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ক্লিনটন বুথ সিলি, সে কথাটা এখানে উল্লেখ করার মতো। জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে গবেষণা করে এবং তাঁর কবিতার অনুবাদ করে ক্লিন্ট বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। জীবনানন্দ সম্পর্কে তাঁর বই A Poet Apart উচ্চপ্রশংসিত হয় এবং বাংলা সাহিত্যের প্রচার ও প্রসারে ভূমিকার জন্যে ক্লিন্ট পরে আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন–সে পুরস্কারের অর্থও তিনি জীবনানন্দের কবিতার প্রচার ও প্রসারের জন্যে ব্যয় করতে কবি-পরিবারের হাতে তুলে দেন।
গবেষণার উপকরণ সংগ্রহের লক্ষ্যে ছ মাস বাংলাদেশে কাটাবার জন্যে ১৯৮১ সালে ক্লিন্ট ফুলব্রাইট বৃত্তি লাভ করেন। তিনি স্থির করেন, তিন মাস ঢাকায় ও তিন মাস চট্টগ্রামে থাকবেন। আমাকে তিনি লেখেন চট্টগ্রামে তার থাকার ব্যবস্থা করতে। স্বগৃহে আমি তাঁকে সাদর আমন্ত্রণ জানাই, তিনি তা গ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বক্তৃতা দেন, চট্টগ্রাম শহরে সভা সমিতিতেও যোগ দেন এবং আমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েন। ছেলেমেয়েরা ক্লিন্ট চাচার সান্নিধ্য খুব উপভোগ করে।
পরে ক্লিন্ট বাংলা শেখার যে-বইটি লেখেন, তাতে তাঁকে লেখা রুচির একটি চিঠি নামধাম বদলে গ্রহণ করেন–চিঠি লেখার আদর্শ নমুনারূপে। আদর্শ মানে এখানে স্বাভাবিক, অকৃত্রিম।
ক্লিন্ট ঘরে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে থাকেন, খাবার দেওয়া হয়েছে বললেই হাতের কাজ ফেলে তৎক্ষণাৎ টেবিলে চলে আসেন। কাজে ও বিনা কাজে যারা আমার কাছে আসেন, অনেক সময়ে তিনি তাঁদের সঙ্গে আলাপ করেন। কামরু ভাই একবার ঢাকা থেকে গাড়ি চালিয়ে সোজা আমার বাসায় চলে আসেন। তখন বেবী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমি শহরে চলে গিয়েছিলাম। ক্লিন্টই তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। কামরু ভাই পরে বলেছিলেন, ‘লুঙ্গি-পরা সাহেবের সঙ্গে বাংলায় কথা বলব না ইংরেজিতে, সেটাই স্থির করতে পারছিলাম না।
আমার এবার প্রবাসযাত্রার আগে চট্টগ্রাম শহরে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে আমাদের তরুণ সহকর্মী গোলাম মুস্তাফা আমার Factory Correspondence সম্পর্কে একটি আলোচনা পাঠ করে। ক্লিন্ট এ-সভায় উপস্থিত থাকেন এবং সবটা বেশ উপভোগ করেন বলে জানান।
আমি প্যারিসে পৌঁছোবার কিছুদিন পরে শিকাগো থেকে ক্লিন্টের বান্ধবী গোয়েনের একটি চিঠি পাই। সঙ্গে ৩০০ মার্কিন ডলারের একটি চেক। গোয়েন লিখেছেন, ক্লিন্টের কথামতো তিনি চেকটা পাঠাচ্ছেন। এটা ক্লিন্টের আতিথ্যগ্রহণের প্রতিদান বলে যেন আমি মনে না করি। বিদেশ-বিভুঁইয়ে টাকা পয়সার দরকার হতে পারে, অন্তত পরিবারের জন্যে কিছু কেনাকাটা করতেও। বন্ধুকৃত্য হিসেবে আমি যেন চেকটা গ্রহণ করি।
৭.
ইউনেসকোতে তখন আমার চেনাজানা দুজন কাজ করতেন : ড. আবদুল মুয়ীদ ও মাহফুজ আনাম। তার আগে মুয়ীদ ছিলেন কুমিল্লার পল্লী-উন্নয়ন একাডেমিতে। তাঁর মৃত্যুর পরে সেখানে একটি কক্ষ তাঁর স্মৃতিতে চিহ্নিত হয়েছে। তাঁর স্ত্রী ফাতেমা হলেন ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বোন এবং বেবীর সহপাঠী। মুয়ীদের আমন্ত্রণে মাঝে মাঝে তার অফিসে যেতাম। সেখান থেকে তাঁর গাড়িতে করে তার বাড়ি। সেখানে আমাকে খাইয়ে-দাইয়ে তিনি মেট্রোতে তুলে দিতেন আমাকে। নিজের মতো ফিরে আসতাম।
দেশের অবস্থা নিয়ে তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই খুব উদৃবিগ্ন ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উভয়েরই ছিল প্রবল আস্থা। সামরিক শাসন ও বিএনপির রাজনীতি তাঁদের অনুমোদন লাভ করেনি। বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবধারার পুনরাবির্ভাব তাদের শঙ্কিত এবং অনেক পরিমাণে হতাশ করেছিল। আমার সঙ্গে তাঁরা প্রধানত এসব বিষয়েই কথা বলতেন।
মাহফুজ আনাম আমাকে তার বাড়ি নিয়ে গেল সপ্তাহান্ত কাটাতে। মেট্রো থেকে বেরিয়ে একটা সুন্দর বনাঞ্চল পেরিয়ে যেতে হয় সেখানে। শাহীনের আতিথেয়তা পরম উপভোগ্য। রোজ তখন নিতান্তই শিশু–খুবই আদরণীয়। দেশের বিষয়ে উদ্বেগ থাকলেও মাহফুজের মধ্যে একটা আশাবাদ কাজ করে। হতাশ্বাস না হয়ে বরঞ্চ কী করণীয় আছে, সে তা খোঁজ করার পক্ষপাতী।
হাসনাতের মাধ্যমে পরিচয় হয় প্রলয় দত্তের সঙ্গে। সে এখানে আছে বেশ কিছুকাল, চেষ্টা করছে কৃতবিদ্য দোভাষী হতে। তার জন্যে একাধিক ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা দরকার। ফরাসি ও স্প্যানিশ নিয়েছে সে, হয়তো জার্মানও সেইসঙ্গে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা ফরাসিতে অনুবাদও করছে। প্রলয়ের প্রাণশক্তি অসাধারণ। গল্প করে, হই-হুঁল্লোড় করে, সময় কাটাতে তার জুড়ি নেই। তার ফরাসি বান্ধবী অপেক্ষাকৃত চুপচাপ-ভাষার বাধাও তার একটা কারণ হতে পারে। আমি দেশে ফিরে আসার পরে একবার প্রলয় তার বান্ধবীকে নিয়ে চট্টগ্রামে নিজের বাড়িতে এসেছিল–তখন তারা দুজনেই চট্টগ্রাম। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে।
হাসনাতের দক্ষিণ ভারতীয় বন্ধু কুমার স্বল্পভাষী, খুবই সৌজন্যপরায়ণ। কী যেন একটা চাকরি করে। আর হাসনাতের স্প্যানিশ বান্ধবী অ্যালিস শিক্ষাবিষয়ে পড়াশোনা করছে। অ্যালিসের ইতালীয় স্বামী জিওভানি পেশায় ডাক্তার–চর্মরোগে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। দুজনই চমৎকার মানুষ। অ্যালিস তার বাবার গল্প করে–তিনি খ্যাতিমান স্থপতি। কোনো আন্তর্জাতিক উন্নয়ন-সংস্থা তাঁকে আহ্বান জানিয়েছিল আফ্রিকার একটি দরিদ্র দেশে বাঁধ নির্মাণের নকশা তৈরি করে দিতে। সরেজমিনে সেখানে গিয়ে তার মনে হয়, বাঁধ তৈরি করে দিলেও তা যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করার সামর্থ্য সেদেশের নেই। ফলে তা কাল হয়ে উঠতে পারে তাদের জন্যে। সুতরাং তিনি সেই কাজটি করতে অস্বীকার করেন। জিওভানি বলে, তার শ্বশুর খুব ভালো দাবাড়। তাকে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন কম্পিউটারে দাবা খেলতে। খেলতে গিয়ে জিওভানি দেখে, কম্পিউটারে প্রতিপক্ষ খালি খেলে না, তার খেলা নিয়ে কটাক্ষও করে। সত্যি সত্যি অপমান বোধ হয় তার, খেলা বন্ধ করে দেয়। জিওভানি পানভোজন রসিক। সেসব সম্পর্কেও তার গল্প করার এবং পরামর্শ দেওয়ার আছে। এই দম্পতির সঙ্গে পরেও আমার প্যারিসে দেখা হয়েছে, তারা স্থায়ীভাবে ইতালিতে চলে যাওয়ার পরেও কিছুকাল যোগাযোগ থেকেছে।
৮.
আমার লেখা কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পরে আনোয়ার আবদেল-মালেক বলেন, ব্যস, আমি আর দেখতে চাই না। তুমি সব শেষ করে আমাকে দিও। আমার যদি কিছু যোগ করার থাকে, তখন আমি তা করবো।
ফলে আমি স্বাধীনভাবে লিখতে থাকি। ফরাসিতে লেখা প্রবন্ধ মুখে মুখে তরজমা করেন ক্রিস্তিন। আমি শুনে শুনে টুকে নিই। পর্তুগিজ-জানা এক সেক্রেটারিকে ধরে একটা প্রবন্ধের সারসংক্ষেপ লিখিয়ে আনেন ক্রিস্তিন। আমি সেটা ব্যবহার করি। আমার লেখা খানিকটা অগ্রসর হলে টাইপ করতে দিই তাঁকে। টাইপ করা হলে পড়ে আবার শুদ্ধ করতে দিই। আমার লেখায় কোনো অপরিচিত ইংরেজি শব্দ পেলে একটা কাগজে তা টুকে রাখেন ক্রিস্তিন। পরে অভিধান দেখে তার অর্থ ও ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করেন। আমার কাছে একসময়ে জানতে চান, আমার ব্যবহৃত তাঁর অজানা ইংরেজি শব্দের বেশির ভাগ ল্যাটিন থেকে এসেছে–তার কী কোনো কারণ আছে? আমি বলি, আমি তো ল্যাটিন জেনে সেসব ব্যবহার করিনি–সুতরাং কারণ বের করা যাবে না।
ক্রিস্তিন একদিন হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেন, আচ্ছা আপনার মেয়ে যদি অবিবাহিত অবস্থায় মা হতে চলে, তখন আপনি কী করবেন?
আমি একটু থতমত খাই। বলি, এমন অবস্থা তো কল্পনা করিনি। সুতরাং সে-ভাবনা মাথায় আসেনি।
সানিয়া বলে, যদির কথা হচ্ছে।
আমি বলি, সম্ভবত সে-অবস্থায় আমার মেয়ে যা চাইবে, আমি তাই চাইবো। সে যদি ভ্রূণ নষ্ট করতে চায়, তাকে সাহায্য করবো। সে যদি সন্তান জন্ম দিতে চায়, তাহলেও সাহায্য করবে।
ক্রিস্তিন বলেন, এখন বলতে পারি, আপনি সত্যি উদার। অনেক উদার মানুষই এসব ক্ষেত্রে ঔদার্য হারিয়ে ফেলে।
ক্রিস্তিনের পরামর্শে আমি প্রতি সপ্তাহে বিনোদনের বিবরণ-সংবলিত পত্রিকা। কিনি। তা দেখে সিনেমা দেখতে যাই। এভাবে চার্লি চ্যাপলিনের কিছু চলচ্চিত্র দেখা হয়, আবার জেমস বন্ডও দেখি। ইংরেজি সাব-টাইটল আছে, অন্য ভাষায় তৈরি এমন ছবিও দেখা হয়। প্যারিসের দর্শনীয় বস্তু দেখতে যাই। পুরোনো বাড়ি কিংবা রাস্তা। বাস্তিল। নানা জাদুঘর। স্যুভে কতবার গেলাম। অল্প অল্প করে দেখি। মোমার্তের দিকে যাই–শিল্পীরা ছবি আঁকছেন, তা দেখি। খাবারের বৈচিত্র্য খুঁজি। এক সন্ধ্যায় মুলা রুজে যাই।
জিওভানি একটা ইংরেজি বইয়ের দোকানের খোঁজ দিয়েছিল–সেখানে মাঝে মাঝে যাই। তার পরামর্শমতো পি ডি জেমসের গোয়েন্দাকাহিনি কিনি। অতটা মুগ্ধ হই না।
এক সপ্তাহান্তে ভের্সাই গেলাম। প্রাসাদ এবং সংগ্রহ দেখে দিন কেটে গেল। দুঃখের বিষয়, তখন সন্ধ্যায় আতসবাজির কর্মসূচি ছিল না। সেটা না-দেখার। অতৃপ্তি নিয়ে ফিরলাম।
৯.
প্যারিসের জাদুঘরে ছবি দেখতে দেখতে, এক সময়ে মনে হলো, অ্যামস্টারডাম এত কাছে–সেখানে গিয়ে তো আরো ছবি দেখে আসা যায়। একটা নতুন দেশেও যাওয়া হবে।
ভিসা পেতে অসুরিধে হলো না। কোচে করে সন্ধ্যায় রওনা হলাম। কোচে। বসেই কাস্টমস-ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ। সকালে অ্যামস্টারডাম। একটি হোটেলে পৌঁছে সকালের নাশতা। তারপর যে-যার মতন ঘুরে বেড়ানো।
অ্যামস্টারডামে একা-একা ঘুরতে অসুবিধে হয় না। এখানে বেশির ভাগ মানুষ ত্রিভাষী–ওলন্দাজ ছাড়া ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মানের মধ্যে দুটি জানে–অন্তত কাজ চালাবার মতো। বেশির ভাগই ইংরেজি জানে এবং অপরকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক। সুতরাং পথ জিজ্ঞেস করে ট্রামে করেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া যায়।
এখানে ডাচ মাস্টারদের এত ছবি রাখা আছে! দেখে সত্যি সুখ হয়। তবু মনে হয়, আরেকবার আসতে হবে।
প্রান্তরের পর প্রান্তর নানা রঙের টিউলিপ ফুটে আছে। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
উইন্ডমিল দেখি, পনির বানাবার কারখানা দেখি। ভিতরে যাই না।
অ্যামস্টারডামের খালে নৌকাভ্রমণ পর্যটকদের অবশ্য করণীয়। বস্তুত ভ্রমণটা আনন্দের। নৌকা থেকে এ শহরের সবচেয়ে পুরোনো বাড়ি দেখা যায়। তাও চমকপ্রদ।
সন্ধ্যায় হোটেলে ফেরার পথে দেখি একদিকে নারী-পুরুষনির্বিশেষে জনস্রোত যাচ্ছে। আমি তাদের সঙ্গ নিই। দেখি, এক এলাকায় পরপর কয়েকটি বাড়িতে বিরাট কাঁচ-লাগানো ছোটো ঘরে একেকজন স্বল্পবসনা রঞ্জিতবর্ণা মহিলা ভঙ্গিসহকারে আসীন। অনেকটা অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছের মতো–তফাৎ এই যে, অ্যাকুরিয়ামে মাছ নড়াচড়া করে, আর এই নারীরা গতিহীন। হঠাৎ স্ট্যাচু বলে ভুল হতে পারে! দু-একজন তোক একটু এগিয়ে গিয়ে পাশের দরজা ঠেলে তাদের সঙ্গে বোধহয় দরদস্তুর করছে–তখনই কেবল তাদের মাথা হেলে, ঠোঁট নড়ে, অন্যথায় তারা নিশ্চল। রাস্তাটি খুব লম্বা নয়, তবে পুরো সড়কজুড়ে একই দৃশ্য।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাবা দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় যে তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, তাদের কালে বিজয়ার রাতে লোকজন দেবীপ্রতিমা দেখার মতো বারাঙ্গনাদর্শন করে বেড়াত, এ যেন সে রকম।
হোটেলে ফিরে আসি। দ্রুত কিছু খেয়ে নিই। তারপর কোচে চাপি। ভোরবেলা ফিরে আসি প্যারিসে।
১০.
প্যারিসের কাজ শেষ করে মার্চের ৬ তারিখে রাতের কোচে লন্ডনে রওনা হলাম। ফেরিতে ইংলিশ চ্যানেল পার হতে যে একটু রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলাম, সেকথা কবুল করা ভালো। সাতারু ব্ৰজেন দাশের কথা বারবার মনে পড়ছিল।
লন্ডনে আমার মাসখানেক থাকার পরিকল্পনা। উঠলাম আবদুল মোমেনের বাড়িতে। প্রথমে গেলাম ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। সেখান থেকে আগের বছরে আমার Factory Correspondence প্রকাশিত হওয়ায় আমার খাতির কিছু বেড়েছে। আরো একটা ব্যাপার। ১৯৭৯ সালে সেখানে কাজ করার সময়ে আমি ঢাকা কুঠির চিঠির খাতা পাই তেইশটা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছিল, আরো চিঠির একটা খাতা লাইব্রেরিতে কোথাও অগোচরে আছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট কিপার মাইকেল ও’কিফকে সেকথা বলেছিলাম, ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান আর জি সি ডেসমন্ডকেও বলেছিলাম। ওঁরা আমার কথাকে গুরুত্ব দেননি, তা নয়, তবে কিছু খুঁজে পাননি। এবার লাইব্রেরিতে যেতেই মাইকেল বললো, তোমার অনুমান যথার্থ। চিঠির আরেকটা খাতা এতদিনে পাওয়া গেছে। আমি হতাশ গলায় বললাম, তাতে আর কী লাভ? বই তো বেরিয়ে গেছে। মাইকেল বললো, চিঠির খাতা পাওয়ার পরই ডেসমন্ডের সঙ্গে এ-বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। উনি ব্লুমফিল্ডের সঙ্গেও কথা বলেছেন। তুমি যদি এটা তালিকাভুক্ত করতে রাজি হও, তাহলে আমরা ছোটো আকারে একটা সাপ্লিমেন্ট বের করবো এবং তোমার বইয়ের সঙ্গে এটা ক্রেতাদের এমনি দেওয়া হবে। এমনকী, যদি কেউ দাবি করে যে, তোমার বই কিনেছে, তাহলে সেও বিনা পয়সায় এর একটা কপি পাবে। অবশ্য তুমি যদি কাজটা করতে সম্মত হও, তবে এটা হবে। ভালোবাসার খাটুনি। আমরা কোনো পারিশ্রমিক তোমাকে দিতে পারবো না–লাইব্রেরির তেমন পয়সা নেই, এবং ব্রিটিশ অ্যাকাডেমির কাছে দুবার আমরা এর জন্যে মনজুরি চেয়েছি, এই একটা খাতার বিবরণ লেখার জন্যে আবার মনজুরি চাওয়া যাবে না। আমি বললাম, মাইকেল, তুমি জানো, তোমরা যে-পয়সা আমাকে দিয়েছ, তাতে আমার লন্ডনে থাকা-খাওয়ার খরচ কুলাতো না। ভাগ্যিস আমার বন্ধুবান্ধব ছিল এবং বিবিসির বাংলা বিভাগ ছিল। আমি এই কাজটা করবো, তাহলে এই পর্বের কাজ সমাধা হয়। তোমাদেরকে পয়সা দিতে হবে না। আমার বন্ধুবান্ধব এবং বিবিসি দীর্ঘজীবী হোক। আমার খরচ আমিই জোগাবো।
পরদিন থেকে ওই খাতার চিঠির বিবরণ লিখতে লেগে গেলাম।
লন্ডনে এতজনের কাছে আমি ঋণী, তাদেরকে অন্তত এক কপি করে বই উপহার দিতে হয়। মোমেন, জ্যান, বুলু, শফিউল্লাহ–এদেরকে বই না দিয়ে পারি কী করে! দেশেও তো কাউকে কাউকে দিতে হবে–বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল করিম–এঁদেরকে। আমাকে মাত্র এক কপি বই পাঠিয়েছিল ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি। আরো এক কপি বই পেলাম সৌজন্যস্বরূপ। আর ছয় না আট কপি বই কিনলাম। বই ছিল মিসেস পি ওয়ার্ডের দায়িত্বে। তাঁরও নাম প্রতিভাতার বাবা সুকুমার রায় একদা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্য সচিব। তাঁকে নামে জানতাম। মিসেস ওয়ার্ড আগে ছিলেন ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে–সেখানে আমার বন্ধু শামসুল মোরশেদের (পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন-উপদেষ্টা) তিনি ছিলেন সহকর্মী ও বন্ধু। মিসেস ওয়ার্ড আমার প্রত্যাশার অধিক ছাড়ে বইগুলি আমাকে বিক্রি করলেন এবং একদিন লাঞ্চের সময়ে ওল্ড ভিকের পাশে একটা ওয়াইন বারে আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখানে খাওয়াটা গৌণ, পানটা মুখ্য এবং তা যেমন আনন্দদায়ক, তেমনি শিক্ষাপ্রদ।
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে একদিন সেই ইরানি মেয়েটি এসে উপস্থিত। গতবারে আমি যখন এখানে কাজ করছিলাম, তখন সেও এখানে লেখাপড়া করছিল। আমার সঙ্গে সৌজন্য-বিনিময়ের বেশি আলাপ হয়নি তার, তবে প্রায় রোজই তার সঙ্গে দেখা হতো। সে আসততা পাশ্চাত্য পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে, দেখে মনে হতো সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে। এবারে তার চোখে-মুখে বেশে-বাসে মলিনতার আভাস। পাঠকক্ষের দরজা পেরোতেই সে আমার সঙ্গে যোগ দিলো। কেমন আছো, জিজ্ঞেস করায় সে বললো, বেশ খারাপ। ইরানের বিপ্লবে যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে তাদেরটা একটা। তারা যে শাহর সমর্থক, তা নয়, বরঞ্চ শাহর সময়ে সাভাকেরা যে-অত্যাচার করেছে, তারা তার ঘোর বিরোধী। তবে তাদের পরিবার সংগতিসম্পন্ন এবং পাশ্চাত্যভাবাপন্ন। কেবল সেজন্যেই তাদের দুর্গতি হয়েছে। তার বড়ো ভাই বিমানচালক। কদিন আগে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন ভাগ্যান্বেষণে। সেও অনেক কষ্টে তেহরান থেকে বেরিয়েছে–জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে তার নেই। তার ভাগ্যে যা আছে তা-ই হবে।
মেয়েটি নিম্নস্বরে কথা বলছিল এবং মাঝে মাঝে পেছন দিকে তাকাচ্ছিল–কেউ তার কথা শুনছে কি না, সেটা দেখতে। বোঝা গেল, যে আতঙ্কের মধ্যে সে এতকাল কাটিয়েছে, তার রেশ এখনো যায়নি।
আমার মনে পড়ল, ইরানি বিপ্লবের সাফল্যের আশায় কত রাত বেতারযন্ত্রের সামনে বসে কাটিয়েছি। প্যারিস থেকে স্বদেশে ফিরে আসছেন জনগণের মুক্তিদাতা–আয়তোল্লাহ খোমিনির এই রূপই চোখে ভেসে উঠেছিল। কিন্তু তার শাসনকালে যে নতুন করে নিপীড়ন ও রক্তপাতের সূচনা হবে, তা তখন বোঝা যায়নি।
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে সেবারে যতদিন ছিলাম, মেয়েটি অনিয়মিতভাবে আসততা। সে এলে এবারে স্বতোপ্রণোদিত হয়ে আমিই তার খোঁজখবর নিতাম। সে আগ্রহ করে কথাবার্তা বলতো বটে, কিন্তু আমি আর তার হাসিমুখ দেখিনি।
১১.
লাইব্রেরিতে প্রথম দিন হাজিরা দিয়ে আমার গন্তব্য ছিল বুশ হাউজে বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের বাংলা বিভাগ। সিরাজুর রহমান এখন তার প্রধান–বরাবরের মতো তিনি অভ্যর্থনা করলেন। কিন্তু এবার সেখানে এক বড়ো শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল শ্যামল লোধের তিরোধানে। শ্যামল সপরিবারে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন সমুদ্র-সৈকতে। তিনি যখন সাঁতার দিতে নেমেছেন সমুদ্রে, তখনই স্ত্রীকন্যার চোখের সামনেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়। ১৯৭৯ সালে। শ্যামলের বাড়িতে গিয়েছিলাম নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে–তখন তার ইংরেজ স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় এবং সদ্য শৈশবোত্তীর্ণ কন্যার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তারপর শ্যামল এসেছিলেন বাংলাদেশে–চট্টগ্রামে আমার বাড়িতে দু দিন দুরাত কাটিয়েছিলেন, বিবিসির শ্রোতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে। সেই দিনগুলির এবং শ্যামলের অকৃত্রিম বন্ধুত্বের স্মৃতি পীড়া দিচ্ছিল বারবার–কিন্তু ততদিনে জেনে গেছি, জীবন এমনই, কারো জন্যে অপেক্ষা করে না, কারো জন্যে থেমে থাকে না।
বিবিসি বাংলা বিভাগে গিয়ে দেশের কিছু খবর পাওয়া গেল। রাষ্ট্রপতি সাত্তার নিজে যে-মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন, তিন মাসের মধ্যে তাকে দুর্নীতিপরায়ণ বলে বরখাস্ত করেছেন তিনি নিজেই। তার অব্যবহিত পূর্বে মন্ত্রী আবুল কাসেমের সরকারি বাসভবন থেকে সাত হত্যার আসামি ইমদুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং এমন এক ভয়ানক সন্ত্রাসীকে আশ্রয়দান ও তাকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশকে বাধাদানের অভিযোগে মন্ত্রীবর গ্রেপ্তার হয়েছেন। কয়েকজন নতুন মন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন। পরবর্তী কয়েক দিনে বিবিসিতে কাজ করার সূত্রে জানা গেল, দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী–আমার আত্মীয় জামালউদ্দীন আহমদ এবং অগ্রজপ্রতিম এস এ বারী এ টিসহ বেশ কয়েকজন প্রাক্তন মন্ত্রী গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আরো আছেন আমার বন্ধু হাবীবুল্লাহ খান, পরিচিত নূরুল হক ও কে এম ওবায়দুর রহমান এবং আমার ছাত্র তানবীর আহমদ সিদ্দিকী। তাঁদের সবার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের হয়েছে। ড. এম এন হুদা উপরাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করেছেন এবং মোহাম্মদউল্লাহ-যাকে বঙ্গবন্ধু
অকারণে রাষ্ট্রপতিপদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন, তিনি–উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। পুতুলনাচের সুতো যে আর কারো হাতে বাঁধা, সেকথা বুঝতে অসুবিধে হলো না।
২৪ মার্চ সকালে বাথরুমে দাড়ি কামাচ্ছি–পাশেই রান্নাঘর থেকে মোমেনের চিৎকার : বাংলাদেশে কু্য হয়ে গেছে–জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছে।’
খবরটা যে একেবারে অপ্রত্যাশিত, তা বলা যাবে না। তবু কী এক বিষণ্ণতায় মন ভরে গেল। খাবারটাও বিস্বাদ মনে হলো।
বুশ হাউজে এসে শুনলাম, রাষ্ট্রপতি সাত্তার নিজেই সেনাপতি এরশাদকে আহ্বান করেছেন ক্ষমতা নিতে। কয়েক শতাব্দী আগে নবদ্বীপে ইখতিয়ারউদ্দীন মুহম্মদ ইবনে বখতিয়ার খিলজির সসৈন্য আগমনে গৌড়রাজ লক্ষ্মণ সেন নাকি খাবারের থালা ফেলে খিড়কি দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই তুলনায় বিচারপতি সাত্তার আর এমন কী করেছেন। তবে লক্ষ্মণ সেনের প্রতিপক্ষ ছিল তুর্কি সৈন্য, এরশাদ তো স্বদেশি সেনাবাহিনীর প্রধান।
ক্রমে জানতে পারলাম, বিচারপতি এ এফ এম আহসানউদ্দীন চৌধুরী রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হয়েছেন এবং বেশ কজন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাকে প্রধান সামরিক শাসনকর্তার উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়েছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনা কর্মকর্তারা ক্ষমতা দখল করে বিচারপতিদের যে রাষ্ট্রপ্রধান করে টেনে আনেন, তা বাংলাদেশে একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিচারবিভাগের জন্যে এটা ভালো হচ্ছে বলে মনে হয় না।
উপদেষ্টাদের মধ্যে আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্ ও আবুল মাল আবদুল মুহিত আছেন। এঁরা উপদেষ্টা-পরিষদে যাওয়ায় আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। আমার ধারণা হলো, আমাদের যেসব রাজনৈতিক বন্ধু মুহিতের ঘনিষ্ঠ, সামরিক শাসনের সমর্থক না হয়েও তারা তাঁকে এই দায়িত্বগ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। হয়তো তাঁদের চাপে সামরিক শাসনবিরোধী হয়েও মুহিতকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এর জন্যে যে তাকে একদিন মূল্য দিতে হবে, একথা ভেবে আমার খারাপ লাগলো।
১২.
প্যারিস থেকে আমি লন্ডনে আসবো জেনে আনোয়ার আবদেল-মালেক বললেন, তাহলে তুমি আর কদিন বেশি থেকে কেমব্রিজে আমি যে-সেমিনার করছি (Geo-political visions of the World), তাতে যোগ দাও। আমি হলফ করে বলতে পারি, তোমার তা ভালো লাগবে।
সেমিনারের স্থান রবিনসন কলেজ। ওটাই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীনতম কলেজ–কোনো টেলিভিশন-নির্মাতার টাকায় তৈরি এবং তারই নামে কলেজের নাম। বনেদি কলেজগুলোর সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের খানিকটা অবজ্ঞা আছে এই কলেজটির প্রতি। তবে কলেজটির নির্মাণশৈলী আধুনিক, সে হিসেবে তার কিছু সুবিধা আছে যা অন্য কলেজে লভ্য নয়। সেমিনারের সময়টা কলেজ বন্ধ–সুতরাং আমাদের প্রত্যেককে আলাদা ঘর দিতে কোনো অসুবিধা হয়নি।
এই সেমিনারের মধ্যমণি জোসেফ নিডহাম–বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ হিসেবে তাঁর জগৎজোড়া খ্যাতি। কয়েক খণ্ডে রচিত তাঁর Science and Civilization in China (কেমব্রিজ, ১৯৫৪ থেকে) বইটি মানব-মনীষার অসামান্য নিদর্শন বলে কীর্তিত। তাঁর গবেষণার সুবিধের জন্যে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা। একটি গ্রন্থাগার তৈরি করে দিয়েছেন–পূর্ব এশিয়ার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-সম্পর্কিত বইপত্র দিয়ে। তাছাড়া কয়েকজন বিশিষ্ট সহকারীও দিয়েছেন তাঁর কাজে সাহায্য করতে।
কেমব্রিজ থেকে যারা এ-সেমিনারে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের একজন অর্থনীতিবিদ জোন রবিনসন, আরেকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন ডান। জোন রবিনসনের বয়স হয়েছে, চলতে-ফিরতে কষ্ট হয়–যদিও মুখে সেকথা বলেন না। জন ডানের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল আলজিয়ার্সে, এবার আবার সাক্ষাৎ হলো। কলকাতা থেকে এসেছেন বরুণ দে–তাতে আমি খুবই আনন্দিত। শিকাগো থেকে এসেছেন প্রবীণ ইতিহাসবিদ ডোনাল্ড লাক–দক্ষিণপূর্ব ও পূর্ব এশীয় ইতিহাস সম্পর্কে বড়ো বিশেষজ্ঞ। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে এই প্রথম যোগ দিয়েছেন চীনের দুজন পণ্ডিত-চীনকে সঙ্গে পেয়ে আনোয়ার খুবই উল্লসিত।
সেমিনার আরম্ভ হওয়ার আগের দিন প্রায় সবাই কলেজে পৌঁছে গেছি। রাতে খাবার সময়ে আমি আর বরুণ যে-টেবিলে বসেছি, সেখানে এসে যোগ দিলেন ডোনাল্ড লাক। আমি শিকাগোতে ছিলাম শুনে খুব খুশি হলেন। ওই টেবিলে আরো জনাতিনেক এসে বসলেন। আমরা মেন্যু দেখছি, অধ্যাপক লাক জিজ্ঞাসা করলেন, কে কে ওয়াইন খেতে চাও। জিজ্ঞাসা করার কারণ, তার দামটা আমাদের দিতে হবে–সেমিনার-কর্তৃপক্ষ দেবে না। দেখা গেল, টেবিলের সবাই ওয়াইন খেতে চায়। একজন তো ওয়াইন-লিস্ট নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। লাক একটা ওয়াইনের কথা বললেন, সে বললো আরেকটা। লাক হাতের তালিকাটা টেবিলে রেখে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার যুবক বন্ধু, আমি ৪০ বছর ইতিহাস পড়াচ্ছি–হয়তো ইতিহাস সম্পর্কে আমার অনেক কিছু অজানা। তবে ওয়াইন সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল, এমন দাবি করতে পারি। তুমি আমার ওপর নির্ভর করতে পারো। লাকের কথায় সে বেচারি চুপসে গেল।
আমি খুব মজা পেলাম। একটু একটু করে প্রশ্ন করতে থাকলাম লাককে-ওয়াইন-বিষয়ে তার আগ্রহ সম্পর্কে জানতে। তিনি ওয়াইন-সম্পর্কিত একাধিক সাময়িকীর গ্রাহক, বাড়িতে জায়গা হয় না বলে শিকাগোতে স্বতন্ত্র একটি সেলার ভাড়া করেছেন, লন্ডনে ওয়াইনের নিলাম হলে শিকাগো থেকে। তিনি টেলিফোনে তাতে ডাক দেন, তারপর নিলাম জিতলে সেই ওয়াইনের সংগ্রহ জাহাজযোগে শিকাগোতে আনিয়ে নেন। তার সংগ্রহে সবচেয়ে পুরোনো ওয়াইনের বোতল কত সালের, তা জানতে চাইলে, লাক বললেন, আমার জন্মসালের এক বোতল ওয়াইন আছে, সেটা যে খুব ভালো, তা নয়, তবে স্মারক হিসেবে রেখেছি–আমার পৌত্রকে উপহার দিয়ে যাবো।
সেমিনারের উদ্বোধনীতে নিডহাম বললেন তাঁদের সময়কার কোনো গ্রন্থাগারের কথা। সে-গ্রন্থাগারে পৃথিবীর ইতিহাস ও ইউরোপের ইতিহাস স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত থাকতো–তারপর থাকতো অন্যান্য দেশের ইতিহাস বলে একটা অংশ। ইউরোপ ছাড়া পৃথিবীর বাকি অংশকে এইভাবে এক করে রাখার মধ্যে যে ইউরোপকেন্দ্রিক মনোভাব আছে, তার সমালোচনা করলেন তিনি।
সেমিনারে বরুণ দে শুধু ভালো বক্তৃতা করেন নি, বিভিন্ন সময়ে তাঁর মন্তব্যও খুব মনোগ্রাহী হয়েছিল। নিডহাম তো বললেন, বরুণ দে কোন বিষয়ে জানেন না, তা আমি ঠাহর করতে পারছি না। আনোয়ারের বক্তৃতায় সমাজবিজ্ঞানের দুরূহ পারিবারিক শব্দের প্রচুর ব্যবহার ছিল। নিডহাম চোখ বন্ধ করে তা শুনছিলেন। বক্তৃতা শেষ হলে চোখ খুলে বললেন, এটা কেউ ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেবে আমার জন্যে? আনোয়ার খুব অপ্রতিভ হলেন–যদিও নিডহাম ব্যক্তিগতভাবে তাকে অপ্রতিভ করতে চাননি।
নিডহামের প্রধানতম সহকারী ছিলেন এক বয়স্ক চেক বিজ্ঞানী–এখন ব্রিটিশ নাগরিক। সেমিনারের অধিবেশনগুলির মধ্যবর্তী এক সময়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তাগোরে কি তোমাদের দেশে এখনো জনপ্রিয়?
তাগোরে কে, তা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল, তবে বেশি নয়। বললাম, রবীন্দ্রনাথ আমাদের সংস্কৃতির প্রধানতম গর্বের পাত্র; তাঁকে নিয়ে আমরা রীতিমতো যুদ্ধ করেছি; তাঁর গানকে আমরা জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দিয়েছি।
তিনি সন্তুষ্ট হলেন। আমি জানতে চাইলাম, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর জানবার বা কৌতূহলের সূত্র কী?
তিনি হেসে বললেন, সে এক মজার ঘটনা। আমার বড়ো ভাই আর আমি দেশে একই স্কুলে পড়েছি একটু আগে-পরে। সে একবার অ্যাসাইনমেন্ট নিলো, তাগোরে সম্পর্কে লিখবে। তখন তিনি সদ্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তা সত্ত্বেও আমাদের শহরে ও ভাষায় তাগোরে সম্পর্কে বইপত্র খুঁজে পাওয়া দুরূহ। কিন্তু সে দমবার পাত্র নয়। তার অ্যাসাইনমেন্ট শেষ না হওয়া পর্যন্ত সারাদিন ধরে সে তাগোরের কথা বলতে থাকতো। কোন সুদূর ভারতবর্ষের কবিতার সম্পর্কে অগ্রজের এই মুগ্ধতা আমার মনে দাগ কেটেছিল। আমি তো বিজ্ঞানী–কবিতার সমঝদার নই। কিন্তু ভাইয়ের কাছে শুনে কবিকে খানিকটা জেনেছিলাম। পরে তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পড়েছি আর তার শতবার্ষিকীর সময়ে তাকে আরেকটু জেনেছি। মানুষের ওপর তার প্রভাব, শিল্পী হিসেবে তাঁর মহত্ত্ব দূর থেকে অনুধাবন করতে পারি।
একদিন রাতে খাওয়ার সময়ে দেখি, চীনা বিদ্বানেরা তাঁদের নৈশভোজের কুপন দিয়ে গেছেন দুই চীনা ছাত্রকে। তারা খুব জড়োসড়ো হয়ে খাচ্ছে। অন্যেরা অনেকে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে বটে, কিন্তু কেউ এ-বিষয়ে উচ্চবাচ্য করছে না।
লাঞ্চের বিরতিতে একদিন দেখি ডোনাল্ড লাক বাইরে থেকে ফিরছেন। এমনি ফরসা মানুষ, ভারিক্কি চেহারা–এখন যথেষ্ট রক্তিম দেখাচ্ছে। আমার টেবিলে বসে পড়ে বললেন, এমন একটা অসম্ভব ব্যাপার ঘটেছে যে, আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না।
জানতে চাইলাম, কী ঘটেছে?
লাক বললেন, ট্রাভেলার্স চেক ভাঙাতে গিয়েছিলাম। মানি এক্সচেঞ্জে যে মহিলা বসেন, তিনি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, আমি আর্জেন্টাইন কি না। বললাম, না, কিন্তু কেন? মহিলা জবাব দিলেন, তাহলে আপনার টি সি আমি ভাঙাতাম না।
তখন ফকল্যান্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ব্রিটিশ রণতরি ঝাঁক বেঁধে রওনা হয়ে গেছে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশে। ব্রিটেনের জয়ধ্বনি এবং আর্জেন্টিনার নিপাত-কামনা শোনা যাচ্ছে ইংল্যান্ডে।
অধ্যাপক লাক বেদনার্ত কণ্ঠে বললেন, বিশ শতকের শেষে এমন যুদ্ধবাদ, এমন বর্ণবাদ, ভাবা যায়?
বললাম, মার্গারেট থ্যাচারের বক্তৃতা শুনলে আপনি তার যথেষ্ট প্রমাণ। পাবেন।
সেমিনারের মধ্যে একদিন জানলাম, মোমেনের বাড়ি থেকে টেলিফোন এসেছিল আমার খোঁজে। এটা প্রত্যাশিত নয়। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম তার বাড়িতে–মোমেন ও রোজী কেউই বাড়ি নেই, রঙ্গন টেলিফোন ধরলো। আমাকে কেন খোঁজ করেছিল, জানতে চাওয়ায় সে বললো, এ টেলিফোন কল কেম ফ্রম বাংলাদেশ। ইয়োর লিটল সিসটার হ্যাজ ডায়েড অফ অ্যাকসিডেন্ট।
আমি বিমূঢ়। লিটল সিসটার কে? রীনা-বীণাদের কেউ?
রোজী কখন বাসায় থাকবে জেনে নিয়েছিলাম। আবার ফোন করলাম সে সময়ে। রোজী বললো, যশোর থেকে ছোটোবু-দুলাভাই বাসে করে ঢাকায় ফিরছিলেন। সাভারের কাছে আরেক বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে ছোটোবু আসনে বসেই মারা গেছে, ছোটোদুলাভাই গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন।
আমার পৃথিবীটা এক নিমিষে কেমন জানি হয়ে গেল।
আনোয়ারকে বললাম, আমার বোন মারা গেছে, আমি এখনই দেশে ফিরে যাবো। সেমিনারের বাকি সময় থাকতে পারব না।
তিনি বললেন, তুমি যেতে চাইলে বাধা দেওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ভেবে দেখো, তুমি কি ফিরে গিয়ে দাফন-কাফনে উপস্থিত থাকতে পারবে?
আমি তার কথার উত্তর দিলাম না। একটা ট্যাকসি নিয়ে রেলস্টেশনে চলে এলাম। পরের ট্রেনে লন্ডনে পৌঁছে সোজা এয়ার ইন্ডিয়া অফিসে। তারা আগের কোনো ফ্লাইট ধরাবার বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারল না। বললো, সম্ভব হলে ফোনে জানাবে। মোমেনদের বাসার ফোন নম্বর দিয়ে রাখলাম।
ফিরে এলাম কেমব্রিজে। বরুণ সঙ্গ দিলেন। সেমিনারেও বসলাম। কিন্তু মন দিতে পারলাম না।
এয়ার ইন্ডিয়ার ফোন আসে না। উলটো নিজেই ফোন করি। কোনো লাভ হয় না।
এপ্রিলের ১০ তারিখে রওনা হই। বোম্বে আসতে আসতে বিলম্ব হয়ে যায়। ঢাকার ফ্লাইট পাবো কি না সন্দেহ হয়। ক্যাপ্টেনকে চিরকুট পাঠাই–আমার বোন মারা গেছে। যত দ্রুত সম্ভব ঢাকায় ফিরতে চাই। আপনি কি কন্ট্রোল টাওয়ারে খবর দিয়ে কানেকটিং ফ্লাইট ধরাবার ব্যবস্থা করতে পারবেন?
এয়ার হোস্টেস এসে বলে, উনি চেষ্টা করবেন।
পরে বুঝতে পারি, আমার ওই অনুরোধের কোনো অর্থ ছিল না। আর ক্যাপ্টেন যা বলে পাঠিয়েছিলেন, তা কেবল আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে।
তবে ঢাকাগামী ফ্লাইট ধরতে ব্যর্থ হইনি।
১৩.
ঢাকায় ফিরে প্রথমে গেলাম বনানীতে–ছোটোবুর কবরে।
ছোটোবুর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মতো। তার অনেক সুখ দুঃখের সাথী ছিলাম আমি। অল্প সম্বল নিয়ে বড়ো সংসার চালাতে তাকে বেশ কষ্ট করতে হতো। তার মধ্যেও সে মুখের হাসি ম্লান হতে দেয়নি। নিপুণ হাতে ঘরবাড়ি গুছিয়ে রাখতো সে। শেষকালে কিছুই আর তাকে ধরে রাখতে পারলো না। কাউকেই ধরে রাখা যায় না।
ছোটোদুলাভাইকে দেখতে গেলাম হাসপাতালে। তখনো তিনি জানেন না, ছোটোবু নেই। আমাকে দেখেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার ছোটোবুকে দেখে এসেছ? কেমন আছে?’
কী উত্তর দেবো! বললাম, ‘দেখে এসেছি।’
১৪.
১৯৮২ সালে কুমিল্লা বোর্ডের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে দেখা গেল, মানবিক বিভাগে রুচি বিংশ স্থান অধিকার করেছে। আমাদের বাড়িতে তো বটেই, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে এবং আমাদের পাড়ায়ও এ-নিয়ে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। এখলাসউদ্দীন তার আগের মন্তব্যের পুনরুক্তি করলেন আমার সম্পর্কে : সারা বছর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার কোনো খবর রাখি না, কেবল পরীক্ষায় তারা ভালো ফল করলে গৌরবের ভাগী হই।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা দেখি না, বেবীর এমন অনুযোগের কারণে একদিন ওদের তিন ভাইবোৰুকে বলেছিলাম, বইপত্র নিয়ে এসো। স্কুলে বাড়ির কাজ কী দিয়েছে, শুনি। আনন্দ বললো, ‘চার লাইন কবিতা মুখস্থ করতে দিয়েছে।
জানতে চাইলাম, ‘মুখস্থ করেছ?’
সে বললো, ‘দু লাইন করেছি।’
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘চার লাইন মুখস্থ করতে দিয়েছে–তুমি দু লাইন মুখস্থ করেছ কেন?’
তার জবাব, ‘এক লাইন শুনেই তো সার বলেন, বোসো।’
বুঝতে পারি, শ্রেণিকক্ষের সব ছেলেমেয়ের পড়া ধরার মতো সময়ের সংকুলান হয় না এক পিরিয়ডে। এও বুঝতে পারি যে, ছোটো ছেলেমেয়েরাও এই পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার পথ খুঁজে নিয়েছে।
ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার তত্ত্বাবধানে আমার পক্ষে আর এগোনো সম্ভব হয়নি।
১৫.
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল আজিজ খানের সততা সম্পর্কে আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়সংকোচেও তিনি নানারকম ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিস্তর বৃক্ষরোপণ তাঁর অক্ষয় কীর্তি। বিদ্যমান নিয়মকানুন তিনি সব সময়ে অনুসরণ করতে চাইতেন না-এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার বিরোধ হতো। তিনি ধার্মিক ছিলেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজেকর্মেও তার প্রকাশ ঘটিয়ে ফেলতেন–এ-নিয়েও আমাদের মতান্তর ঘটতো। একবার জানা গেল, বিশ্ববিদ্যালয় জামে মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি মাদ্রাসার পত্তন হয়েছে, নিজের দায়িত্বে উপাচার্য তার অনুমোদন দিয়েছেন এবং আর্থিক দায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয় নেবে বলে সিদ্ধান্ত করে ফেলেছেন। আমি তাকে বলি, এ-বিষয়ে এককভাবে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে স্কুল-কলেজের ব্যয়নির্বাহের দায়িত্ব নিয়েছে, সেখানে মাদ্রাসার দায়িত্ব না নেওয়ার কোনো হেতু নেই। তর্কের মধ্যে আমি বলেছিলাম, মাদ্রাসা-শিক্ষার পক্ষে কথা বলেন, এমন অনেককেই দেখেছি, নিজের ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পাঠান না। কয়েকদিন পরে শুনলাম, উপাচার্য তার ছেলেকে ওই মাদ্রাসায় পাঠাচ্ছেন। এ-ঘটনাটি তাঁর আমলের পরের দিকের, কিন্তু প্রায় প্রথম থেকেই পদ্ধতিগত প্রশ্ন নিয়ে আমার সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কখনো কখনো এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি আমাদের অগোচরে রাখতেন এবং তা প্রকাশ হয়ে পড়লে এক ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। এ রকম কোনো একটি ঘটনার পরে অ্যাকাডেমিক কাউনসিলের সভায় আমি বলেছিলাম যে, উপাচার্যের কথায় আমি আস্থা রাখতে পারছি না। আমি তখন কলা অনুষদের ডিন। আমার এই রূঢ় উক্তিতে সভায় বেশ হইচই হয়েছিল।
বিদেশ থেকে আমার চট্টগ্রামে ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যে কাগজে দেখলাম, রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ এফ এম আহসানউদ্দীন চৌধুরী চট্টগ্রাম সফরে আসছেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চানসেলরও। আমি ভাবলাম, তাঁর সঙ্গে দেখা করে উপাচার্যের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আপত্তি জানাবো। হাসনাত আবদুল হাই তখন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার। তাকে অনুরোধ করলাম, চানসেলরের সঙ্গে সাক্ষাতের একটা ব্যবস্থা করে দিতে। তিনি বললেন, এখন সামরিক শাসনের কাল, তাই রাষ্ট্রপতির সফর-সম্পর্কিত সকল ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছেন আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক। আমি চাইলে তাকে অনুরোধ করতে পারি। তাতে কোনো কাজ হবে কি না, সে-সম্পর্কে আমার সন্দেহ ছিল। তবু হাসনাত আবদুল হাইকে বললাম, আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসককে আমার কথাটা বলতে। হাই জিওসিকে ফোন করে আমার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিলেন–আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু বললেন না। অনতিবিলম্বে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে গিয়ে সাক্ষাৎ করলাম মেজর জেনারেল এম এ মান্নাফের সঙ্গে। বললাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনদের মধ্যে আমি জ্যেষ্ঠ-সেই দায়িত্ববোধ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে চানসেলরের সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। তিনি খুব সৌজন্যের সঙ্গে বললেন, আপনাকে আসতে হবে ভাইস-চানসেলরের মাধ্যমে। বললাম, ভাইস-চানসেলরের সম্পর্কেই আমি অভিযোগ করতে চাই। তিনি বোধহয় একটু বিস্মিত হলেন, তবে সেটা প্রকাশ না করেই বললেন, প্রোটোকল অনুযায়ী ভাইস চানসেলরের মাধ্যমেই আমাকে চানসেলরের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রার্থনা করতে হবে, সাক্ষাতের কারণ বর্ণনা করে। আমি বুঝতে পারলাম, কোনো কাজ হলো না, বরঞ্চ এমন ধারণার সৃষ্টি হলো যে, আমি উপাচার্যের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছি। এটা আমার পক্ষে ভালো হয়নি।
অল্পকালের মধ্যে শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আবদুল মজিদ খান চট্টগ্রাম সফরে এলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হলেন। তাঁর সঙ্গে আমার অনেককালের পরিচয়, তবে তিনি নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরে এই প্রথম দেখা। আলোচনা করতে করতে বেশ তর্কই হয়ে গেল তাঁর সঙ্গে, কিন্তু বিষয়টিকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নেননি। সভার পরে আমরা কয়েকজন আবার উপাচার্যের অফিসকক্ষে তাঁর সঙ্গে বসলাম। তখন একদল ছাত্র এসে ড. মজিদ খানের সঙ্গে দেখা করতে চাইলো–তারা বেশ সংঘবদ্ধ হয়ে এসেছে, উপাচার্যের বিরুদ্ধে স্লোগানও দিচ্ছে। যেহেতু ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করার কোনো কর্মসূচি শিক্ষা-উপদেষ্টার ছিল না, তিনি তাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন না, অথবা বলা যেতে পারে, সরকারি প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে ছাত্রদের সঙ্গে দেখা না করার পরামর্শ দেওয়া হলো। ছাত্ররা দেখা করার জন্যে চাপ দিতে লাগলো। তখন জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ছাত্রদের যেন আমি চলে যেতে বলি। তার ধারণা, আমি ঠিকমতো বললে ছাত্ররা চলে যাবে। বুঝতে পারলাম যে, তাঁরা ধরে নিয়েছেন, ছাত্রদের সেখানে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে আমার সংশ্রব আছে। আমি ছাত্রদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলাম, তাতে কাজ হলো না। কিছুক্ষণ পর গোয়েন্দা কর্মকর্তা আবার আমাকে একই অনুরোধ জানালেন, এবারে তার সঙ্গে যোগ দিলেন সাদা পোশাকপরা একজন সামরিক কর্মকর্তা–হয়তো সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কেউ। আমি ছাত্রদের সঙ্গে আবার কথা বললাম। তারা এবারে চলে যেতে সম্মত হলো। তাতে গোয়েন্দাদের ধারণা পোক্ত হলো।
এর অল্পকালের মধ্যে আমাদের পূর্বতন উপাচার্য আবদুল করিম, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আফিজউদ্দিন আহমদ, প্রধান প্রকৌশলী নাসিরউদ্দীন চৌধুরী এবং সহকারী প্রকৌশলী লুৎফর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে সামরিক আইনে মামলা দায়ের হলো। অভিযোগ যে বর্তমান উপাচার্যের উদযোগে আনীত হয়েছে, সেটা স্পষ্টতই জানাজানি হলো। দুর্নীতির তদন্ত বা দুর্নীতির অভিযোগে মামলা হওয়ায় আমার কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু সামরিক আইনের অধীনে উপাচার্যের বিচারে আমার ঘোরতর আপত্তি ছিল। তার ওপর, আবদুল করিম আমার সরাসরি শিক্ষক–সেই মর্যাদা অমি সব সময়ে তাঁকে দিয়েছি, তাঁর সঙ্গে মতপার্থক্য ঘটলেও। তাঁর প্রতি আমার সহানুভূতি আমি গোপন করলাম না।
এ-সময়ে উপাচার্য আজিজ খানের ভবনে এক নৈশভোজের আমন্ত্রণ পেলাম। উপস্থিত হয়ে দেখলাম, অপর নিমন্ত্রিত অতিথি হলেন জেনারেল মান্নাফ। তাঁর সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ হলো, তিনি খুবই সৌজন্যের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এক পর্যায়ে গৃহকর্তার অনুপস্থিতিতে তিনি জানতে চাইলেন যে, উপাচার্য থাকার সময়ে অধ্যাপক করিমের সঙ্গে আমার মতপার্থক্য ছিল বলে তিনি শুনেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হওয়ায় আমি তাঁর পক্ষসমর্থন করেছি বলেও তিনি জেনেছেন। ব্যাপারটা তাঁর বোধগম্য হচ্ছে না। আমি বললাম, তিনি যা শুনেছেন, সবই সত্যি। দুর্নীতির যে-অভিযোগ অধ্যাপক করিমের বিরুদ্ধে হয়েছে, তার সত্যাসত্য সম্পর্কে আমি কিছু জানি না এবং সে বিষয়ে কিছু বলিওনি। আমার আপত্তি সামরিক আইনে তার বিচারে–দেশের প্রচলিত আইনে বিচার হলে আমি কোনো কথা বলতাম না। আমি আরো বললাম, এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মযহারুল ইসলাম সামরিক আইনে দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল মতিন চৌধুরীও অনিয়মের অভিযোগে সামরিক আইনে সাজা পেয়েছেন এবং পরে মুক্ত হয়ে অল্পকালের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। সামরিক আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তি আত্মপক্ষসমর্থনের যথাযথ সুযোগ পান না বলে আমার বিশ্বাস। এইভাবে সামরিক আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদাধিকারীর হেনস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং তার শিক্ষকদের ভাবমূর্তি যেভাবে ধ্বংস করছে, আমি তার বিরুদ্ধে। জেনারেল মান্নাফ পালটা প্রশ্ন করলেন, উপাচার্যেরা যদি দুর্নীতি বা অনিয়ম করেন, তাতে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের গোটা সম্প্রদায়ের (ইউনিভার্সিটি কমিউনিটির) ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় না? বললাম, নিশ্চয় হয়। তবে দুর্নীতি বা অনিয়ম সম্পর্কে প্রশাসন এত নিশ্চিত হলে প্রচলিত আইনে বিচার করলেই পারে। তিনি বললেন, আমার তো জানার কথা যে, প্রচলিত আইনে বিচার সময়সাপেক্ষ হয় এবং তার ফাঁকফোকর দিয়ে অভিযুক্তরা অনেক সময়েই বেরিয়ে যায়। আমি বললাম, জেনারেল তো নিশ্চয় জানেন যে, শুধু বিচার হলেই হয় না, তা যে সুবিচার হয়েছে, তা দৃশ্যমান হওয়া আবশ্যক হয়। জেনারেল হাসলেন। বললেন, তিনি আশা করবেন যে, অনুরাগ-বিরাগের দ্বারা নিজের ন্যায়বোধকে আমি বিচলিত হতে দেবো না। ওই প্রসঙ্গের সেখানেই পরিসমাপ্তি ঘটলো। পরে আমরা অন্যান্য বিষয়ে আলাপ করলাম। তাঁর মা-শিশু একাডেমীর পরিচালক–জোবায়দা খানমের সঙ্গে আমার পরিচয়ের কথা বললাম। বুঝতে পারলাম, তিনি সে-সম্পর্কে অবহিত।
প্রসঙ্গান্তরে কিছুকাল পরের একটি ঘটনার উল্লেখ করি। চট্টগ্রাম থাকতে প্রায়ই রাতের মেলে আমি ঢাকা আসা-যাওয়া করতাম। সাধারণত, টেলিফোন করে আসন সংরক্ষণ করতে অনুরোধ জানাতাম, তারপর ট্রেন ছাড়ার কিছু আগে স্টেশনে গিয়ে টিকিট নিতাম। একবার কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে শুনি, আমাকে ওপরের বার্থে যেতে হবে, কেননা জোবায়দা খানম চট্টগ্রাম যাবেন এবং আর কোথাও জায়গা না পেয়ে বলেছেন, আমার সঙ্গে একই কুপে যাবেন এবং সংশ্লিষ্ট রেল-কর্মচারীকে আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে, তিনি যাচ্ছেন জানলে আমি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিচের বার্থ ছেড়ে দিয়ে ওপরের বার্থে যাবো। কথাটা পুরোপুরি সত্যি। তিনি আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করলেও ছোটো ভাইয়ের মতো জানেন এবং আমিও তাকে বড়ো বোনের মতোই দেখি। তিনি কামরায় উঠে আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যে অনেক দুঃখপ্রকাশ করলেন এবং তাঁকে ওই রাতেই যেতে হবে বলে অনন্যোপায় হয়ে ওই ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন বলে ব্যাখ্যা করলেন। আমি তাকে বললাম যে, তিনি আমার ওপরে সব সময়েই অমন দাবি করতে পারেন। পরদিন চট্টগ্রামে পৌঁছে দেখা গেল, ছেলের বাড়ি থেকে তাকে কেউ নিতে আসেনি-যোগাযোগের কোনো বিভ্রাট ঘটেছে। আমি বললাম, আপা, আপনাকে আমি ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছে দিয়ে যাবো-আমাকে তার সামনে দিয়েই বাড়ি যেতে হবে। তাকে জিওসি-র বাড়িতে নামিয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম। বাড়ি পৌঁছোতেই জেনারেল মান্নাফের ফোন পেলাম–তার মাকে সাহায্য করায় তিনি আমাকে সমূহ ধন্যবাদ জানাচ্ছেন।
যাহোক, ওই মামলায় জরিমানা এবং আদালত চলা পর্যন্ত আটক থাকার শাস্তি হয়েছিল অধ্যাপক আবদুল করিমের, অন্যদেরও কিছু সাজা হয়েছিল। সাজাপ্রাপ্ত সকলের বাড়িতেই আমি সহানুভূতি জানাতে গিয়েছিলাম। সে-খবর শুনে উপাচার্য আজিজ খান আমার কাছে তার সত্যতা জানতে চেয়েছিলেন। আমি যখন বলি যে, তিনি যা শুনেছেন, তা সত্যি, তখন তিনি চুপ করে গিয়েছিলেন, এ-প্রসঙ্গে আর কিছু বলেননি।
১৯৮৩ সালে ঢাকায় ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সামরিক আইনের নিষেধ অমান্য করে চট্টগ্রাম শহরে এসে মৌন মিছিল করি। মিছিল বের করার উদ্দেশ্যে আমরা যখন শহরে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে এসে সমবেত হই, তখন দুজন পুলিশ-কর্মকর্তা এসে আমাদের বলেন, কর্তৃপক্ষ আমাদের মিছিলে বাধা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তবে সার্বিক নিরাপত্তা ও যান-চলাচলের স্বার্থে তারা মিছিলের যাত্রাপথ সম্পর্কে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে এসেছেন। আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করি এবং উভয়পক্ষের সম্মত পথ ধরে মিছিল পরিচালনা করি। পরে আমরা শুনেছিলাম যে, শিক্ষকদের সঙ্গে কোনো সংঘর্ষে লিপ্ত না হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন জেনারেল মান্নাফ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হলে একবার পুষ্পেদ্যান-রচনার বিশেষ উদযোগ নেওয়া হয়। ঘটা করে উদ্যানের উদ্বোধন হয়। হলের প্রোভোস্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ হারুন-উর রশীদ সেই অনুষ্ঠানে আমাকে প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন এবং বাগানের ফুল না ছিঁড়তে ছাত্রদের পরামর্শ দিতে বলেছিলেন। আমার বক্তৃতার শেষ বাক্যটি ছিল এই : ‘আমরা যদি মনে রাখি যে, বন্যেরা বনে সুন্দর, সৈন্যেরা ব্যারাকে এবং পুষ্প উদ্যানে, তাহলে জীবন অনেক সুসহ হয়।’ পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা জুড়ে এবং তার দু একদিনের মধ্যে চট্টগ্রাম শহরে পোস্টার পড়েছিল : ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, সৈন্যেরা ব্যারাকে।’ তখনো সামরিক শাসন চলছে।
পরের দিকে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আমি তার প্রতিনিধিরূপে সিন্ডিকেট-সদস্য নির্বাচিত হই। তার অল্প সময়ের মধ্যেই সিন্ডিকেটে চানসেলরের প্রতিনিধিরূপে আমার মনোনয়নের সংবাদ আসে। আমি বিস্মিত হই, তবে ধরে নিই যে, সম্ভবত ড. মজিদ খানের সুপারিশে এটা ঘটেছে। মনোনয়নলাভের পরে আমি নির্বাচিত সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দিই। কিছুকাল পরে চট্টগ্রাম শহরে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ শিক্ষক সমিতির এক সভায় আমি বাংলাদেশে সামরিক শাসন এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে একটি বক্তৃতা করি। তার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি আসে যে, সিন্ডিকেটের সদস্যরূপে আমার মনোনয়ন চানসেলর বাতিল করেছেন। পরে জানতে পারি, আমার ওই বক্তৃতার সংবাদ চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল নূরুদ্দীন খানের কাছে পৌঁছায়। তিনি তা চানসেলর এরশাদের গোচরে আনেন। শিক্ষা সচিব কাজী জালালউদ্দীন আহমদকে ফোন করে এরশাদ জানতে জানতে চান যে, আমার মনোনয়ন আইনত বাতিল করা যায় কি না। শিক্ষা সচিব বলেন, যিনি মনোনয়ন দেন, তিনি অবশ্যই তা বাতিল করতে পারেন। অতএব, সিন্ডিকেটে আমার সদস্যপদ খারিজ হয়ে যায়।
ঘটনাক্রমে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের প্রতিনিধি পদটি তখনো শূন্য ছিল। আমি আবার নির্বাচনে প্রার্থী হই, আবার নির্বাচিত হই, আবার সিন্ডিকেটের সদস্যপদ লাভ করি।
এই সময়ে আমার হাতে অনেকগুলো কাজ জমে গেল। জাপানের ৎসুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতে হবে মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন। উদ্যাক্তারা কার কাছে আমার নামধাম পেয়েছেন, জানি না, সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আবার আনোয়ার আবদেল মালেক লিখেছেন, কেমব্রিজের সেমিনারের কার্যবিবরণী আমাকেই সম্পাদনা করতে হবে। যেভাবে আলজিয়ার্সের সেমিনারের কার্যবিবরণী সম্পাদনা করেছিলাম, সেভাবেই কাজটা করা কর্তব্য। তিনি জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কথা বলে ফেলেছেন আমাকে জিজ্ঞাসা না করেই। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় আমার পারিশ্রমিকের অর্থ আগাম পাঠাবেন প্যারিসে। সেখানে আমি পাণ্ডুলিপি তৈরি করে ফেলতে পারবো আগেরবারের মতো সকল ব্যবস্থায়। আমি না। বললে তিনি শুনছেন না। ওদিকে ১৯৭৫ সালের পরে পুরোনো বাংলা গদ্যের কাজটা আর ধরা হয়নি। কলকাতায় গিয়ে মাসাধিককাল কাজ করা প্রয়োজন–মূলত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের গ্রন্থাগারে রক্ষিত পাণ্ডুলিপি পড়া এবং নকল করা।
একসঙ্গে তিনটি সফরের প্রস্তাব দিয়ে ছুটি চাইলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের অনুমতি চাইলাম বিদেশে যাওয়ার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সুপারিশ করলেন। তারপর বেশ সময় নিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তর থেকে চিঠি এলো বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের কাছে। জেনারেল সালজার জানতে চান, এত দীর্ঘ সময়ের জন্য অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অনুপস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থের প্রতিকূল হবে কি না সে সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত। বিশ্ববিদ্যালয় তো আগেই আমার বিষয়ে সুপারিশ করেছে, তারই পুনরাবৃত্তি হলো। আমি তদবির করতে গেলাম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। প্রায় পুরো একটা দিন লেগে গেল। শিক্ষামন্ত্রীর একান্ত সচিব অধ্যাপক শুজাউদ্দীন–যিনি আমার বিশেষ পরিচিত–তিনি আর ড. মজিদ খানকে আমার উপস্থিতির কথা বলার সুযোগ পান না। মন্ত্রী যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন করিডোরে তাঁকে পাকড়াও করলাম। তিনি আমাকে দেখে অবাক হলেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের অফিসে ফিরে গেলেন। ফাইলটা খুঁজে আনালেন, তারপর লিখলেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে বিদেশে যেতে দেওয়া হবে দেশের স্বার্থের অনুকূল।
হিতৈষীরা বললেন, তাতেও হবে না। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসনের দপ্তরে তদবির করতে হবে। কাকে ধরবো! বেবীর বান্ধবী ও আমার ছাত্রী আবেদার স্বামী জেনারেল মোজাম্মেল ওই দপ্তরের প্রভাবশালী কর্মকর্তা। আবেদার ফোন নম্বর জোগাড় করে তাকে বললাম, জেনারেল মোজাম্মেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দিতে। তিনি বললেন, জেনারেল সামনেই আছেন, আমি টেলিফোনেই কথা বলতে পারি। খুব বেশি বলতে হলো না। তিনি বললেন, আমি দেখবো। দিন দুই পরে জানা গেল, ফাইলে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সই হয়ে গেছে।
১৬.
ৎসুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক মূল্যবোধ-সম্পর্কিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সময় ঘনিয়ে এলো। অথচ আমার যে-প্রবন্ধ সেখানে পড়ার কথা, তা এগোচ্ছে না। শেষে স্থির করলাম, দুদিন আগে বেরিয়ে পড়ব-ব্যাংককে। হোটেলে বসে প্রবন্ধ তৈরি করে তবে যাব ৎসুকুবায়।
১৯৮৩ সালের ১৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম ছাড়লাম। ঢাকা থেকে ব্যাংককে গেলাম পরদিন। ১৭ ও ১৮ এই দুদিনে নিজের খরচে হোটেলে থেকে লেখা শেষ করলাম। ১৯ তারিখে পৌঁছোলাম নারিতায়। বিমানবন্দরে দেখা হয়ে গেল ডা. তাহমিনা হোসেনের সঙ্গে সরকারি প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে তিনি একটি সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন।
উদ্যাক্তারা গাড়ি পাঠিয়েছেন বিমানবন্দরে। তাতেই যাওয়া গেল। ৎসুকুবায়। একটা বড় হোটেলে থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। রিসেপশনেই যথেষ্ট ভিড়। কোনোমতে চাবি নিয়ে কক্ষে ঢোকা। জাপানে যেমন হয় সাধারণত, ঘরটা অপরিসর, বাথরুম আরো সংকীর্ণ–তবে কোনো কিছুর অভাব নেই, সবই সুসজ্জিত। স্নান সেরে তৈরি হয়ে বের হবো ঘর থেকে–টের পেলাম, চাবি নেই সঙ্গে। ওটা দরজায় রেখেই ঢুকে পড়েছি ঘরে, এখন তালাবদ্ধ অবস্থা। দরজা খুলতে না পেরে টেলিফোনের ডায়াল ঘোরাতে থাকলাম। যিনি টেলিফোন ধরলেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম রিসেপশন? উত্তর এলো, জি হ্যাঁ, কী করতে পারি? বললাম, ঘরে আটকা পড়ে গেছি–সাহায্য চাই। বললেন, এক্ষুনি। খানিক পরে সাহায্য এলো।
নিচে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসেছি। এক অনতিতরুণ ইংরেজ এগিয়ে এসে বলল, আশা করি, তোমাকে উদ্ধার করতে সময় নেয়নি এরা–এবারে রিসেপশনের নম্বরটা জেনে নিও। বুঝলাম, আন্দাজে ফোন করতে গিয়ে এরই ঘরে ডাকটা গেছে এবং আমার দুর্বিপাকের কথা সে-ই জানিয়েছে। রিসেপশনকে। তখন মনে পড়ল, চেক-ইন করার সময়ে আমার সামনে দুই নরনারী দাঁড়িয়ে ছিল। পুরুষটি ইনিই। একটু তাকাতে অদূরে মেয়েটিকেও দেখতে পেলাম মিটিমিটি হাসছে। লোকটি এবারে আমাকে আহ্বান জানাল তাদের সঙ্গে যোগ দিতে। পরিচয় দিলো নিজেদের। তারা লন্ডনে গ্যালাপে সহকর্মী, মানবিক মূল্যবোধ সম্মেলনেই যোগ দিতে এসেছে। ভদ্রলোকের নাম বোধহয় গর্ডন, মেয়েটির নাম এখন ভুলে গেছি। দুজনে সদালাপী তো বটেই, বেশ হাসিখুশি, লোকটি তো ফুর্তিবাজ।
পরদিন রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে মনে হলো, সম্মেলন তো নয়, মেলা। সাদা, পীত, কালো, তরুণ, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ নরনারীতে জায়গাটা গিজ গিজ করছে। কেউ আমার প্রবন্ধ চাইল না, সুতরাং নিজের মূল্যবান (হোটেল খরচের হিসেবে) লেখাটা কারো ওপর চাপাবার চেষ্টা করলাম না–ওটা জ্যাকেটের পকেটেই রয়ে গেল।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা বেশ জমকালো হলো। মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে দেখা হয়ে গেল হাসান হানাফির সঙ্গে। এই মিশরীয় ভদ্রলোক মরক্কোর কিং হাসান ইউনিভার্সিটির দর্শনের অধ্যাপকতার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল কুয়েতে। দেখামাত্র জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, হে আমার প্রিয় ভ্রাতা, তুমি যে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলে, মুসলমানদের মধ্যে আরবরা সংখ্যালঘু, সেকথা আমার একটা লেখায় উল্লেখ করেছি। এবারে তুমি কী বার্তা বহন করে নিয়ে এসেছ?
বললাম, কোনো বার্তা নয়, অনেক কষ্ট করে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম, তাও কেউ চাইলো না। সেটা আমার সঙ্গেই ফেরত যাবে।
হানাফি বললেন, তাহলে কি আমরা তোমার গভীর চিন্তার ফসল থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছি?
বললাম, গভীর চিন্তা না ছাই। আমি আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর নেওয়া আমার পোষায় না। লোভে পড়ে এসব সম্মেলনে আসি। কোনোমতে আত্মরক্ষা করতে পারলে হয়।
হানাফি বললেন, তুমি কি ভাবো, আমি অন্য উদ্দেশ্যে এসব জায়গায় আসি? তবে এখানে এসে মনে হচ্ছে, এরা লোক জড়ো করতে যত আগ্রহী, কথা শুনতে তত নয়।
বললাম, আমার পক্ষে সেটাই ভালো।
মধ্যাহ্ন-বিরতির পর অনেকগুলো অধিবেশন সমান্তরালভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। আমার জন্যে যেটা বরাদ্দ, সেখানে গিয়ে দেখি, গর্ডনও তাতে উপস্থিত। চেনামুখ দেখে আমরা উভয়েই খুশি, বসলাম পাশাপাশি। এক মার্কিন অধ্যাপক মডারেটর, এক বিদ্বান জাপানি প্রবন্ধ-পাঠক। লেখাটি পড়া হলো জাপানি ভাষায়, দীর্ঘক্ষণ ধরে। সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি অনুবাদও শুনলাম দোভাষীর কণ্ঠে, তবে অনেক কিছু অস্পষ্ট রয়ে গেল। চা-বিরতিতে সঞ্চালক বললেন, ইংরেজি অনুবাদটি ভালো হয়নি। মেয়েটি সম্ভবত বাণিজ্যিক সভা সমিতিতে দোভাষীর কাজ করে, সংস্কৃতিবিষয়ক অনেক পরিভাষার সঙ্গে পরিচিত নয়।
বিরতির পরে আলোচনা শুরু। প্রবন্ধ-পাঠককে আমি একটা প্রশ্ন করলাম–তাতে symbiosis কথাটা ব্যবহার করেছিলাম। গর্ডন আমাকে বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমি synthesis বলতে চাইছি কি না। সঞ্চালক আমার হয়ে জবাব দিলেন, না উনি সিমবায়োসিস বলেছেন, ঠিকই বলেছেন।
গর্ডন আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘ইউ অ্যাকাডেমিকস ক্যান বি কোয়াইট ট্রাইং।
আমার প্রশ্নের উত্তরে মূল বক্তা এতক্ষণ ধরে কথা বললেন যে, সঞ্চালক তাঁকে থামাতে পারেন না। গর্ডন ফিস ফিস করে বললো, ঈশ্বরের শপথ, যদি তুমি আরেকটা প্রশ্ন করো, তাহলে তোমার টাই দিয়েই গলায় ফাঁস দিয়ে তোমাকে মেরে ফেলব।
সঞ্চালক বললেন, আমাদের হাতে সময় এত কম যে, আর কাউকে মূল কোনো প্রতিপাদ্য উপস্থাপন করতে বলতে পারছি না। আলোচিত বিষয়ে যদি কেউ কোনো আলোকপাত করতে চান।
কেউ হাত তুললেন না। সঞ্চালক ভাষণ দিতে শুরু করলেন।
প্রায় ছটা বাজে। আমি একটা কাগজে লিখলাম : ইলেভেন্থ কম্যান্ডমেন্ট : দাউ শ্যাল নট হোল্ড সেমিনারস আফটার সি পিএম। কাগজটা গর্ডনের দিকে এগিয়ে দিলাম।
সে বললো ফিস ফিস করে, গলায় ফাঁসের কথা ভুলো না।
সেদিনের মতো কাজ শেষ।
আয়োজকদের হয়ে যে-ছেলেটি আমাকে আনতে গিয়েছিল, তার সঙ্গে দেখা। একগাল হেসে বললো, ইওর প্রিন্স হ্যাজ অ্যারাইভড।
কিছুই বুঝলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের আবার প্রিন্স কে? বলো তো কে এসেছে জাপানে?
সে আরো একগাল হেসে বললো, জাপানে নয়, বাংলাদেশে। তোমাদের প্রেসিডেন্টের পুত্রলাভ হয়েছে।
মনে মনে বললাম, এ তো বড় রঙ্গ, জাদু, এ তো বড় রঙ্গ। গর্ডন ও তার সহকর্মীর সঙ্গে বাকি সন্ধেটা কাটলো।
পরদিন কোনো নির্দিষ্ট অধিবেশনে উপস্থিত থাকার কথা নয়। পছন্দসই এ অধিবেশনে ও-অধিবেশনে টু দিই। যতক্ষণ ভালো লাগে থাকি, তারপর বেরিয়ে আসি। এক জায়গায় হাসান হানাফির সঙ্গে দেখা। তিনি জানতে চান, তুমি কয় মিনিট কথা বলেছ?
বলি, তিন মিনিট, বড়জোর চার।
জিজ্ঞাসা করেন, তোমার ওই তিন-চার মিনিটের কথার জন্য এদের কত খরচ হয়েছে? তোমার প্রতি মিনিট কথার মূল্য কত?
আমি প্রশ্ন করি, আপনি কতক্ষণ বলেছেন?
হেসে বললেন, বড়জোর পাঁচ মিনিট।
ৎসুকুবা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরে দেখছি। কে যেন ‘সার’ বলে ডাকল। দেখি, আমাদের আর্ট কলেজের মাহমুদুল হক।
মাহমুদুল হক জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে এসেছেন। আমাকে দেখে অবাক। আগাগোড়া শীতবস্ত্রে আচ্ছাদিত আমাকে ঠাহর করতেও সময় নিয়েছে। কিন্তু একবার চেনামাত্রই আতিথেয়তার অদম্য ঝোঁক মাথাচাড়া দিয়েছে। সুতরাং তাঁর বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করতে হলো। সেখানে দেখা পেলাম আরেক শিল্পী জামাল আহমেদের। জামালও বৃত্তি নিয়ে ৎসুকুবায়, সেও অতি অতিথিপরায়ণ। ফলে তার ডেরায় গিয়ে তুলিকে কষ্ট দেওয়া অনিবার্য হয়ে দাঁড়ালো।
ৎসুকুবার পাট চুকিয়ে ট্রেনে এলাম টোকিওতে। বলা যায়, আমার পূর্বপরিচিত সন্দীপ কুমার ঠাকুরের সঙ্গে। তিনি শিক্ষকতা করেন ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর ব্যবস্থাপনায় টোকিওতে দু রাত থাকা গেল ইনস্টিটিউট অফ ইস্ট এশিয়ান স্টাডিজের অতিথিশালায়। রাতে একটু জ্বর-জ্বর ভাব, পরদিন বিকেলে সেটা ছাড়লো। সন্ধ্যার দিকে বের হলাম। রাতে বাইরে খেয়ে ফিরলাম। জ্বরাক্রান্ত ও বহিষ্ক্রান্ত হওয়ার ফলে সন্দীপের সঙ্গে তেমন আড্ডা হলো না।
আমার শ্যালক আজিজ টোকিওর এক বিশেষ দোকান থেকে তার জন্যে টাই কিনে নিয়ে যাওয়ার ফরমাশ দিয়েছিল। সকালবেলায় মেট্রো করে জায়গামতো পৌঁছে সওদা করলাম। সেখানেই বোধহয় মেট্রোর ইংরেজি নির্দেশিকা ফেলে এলাম। ফেরার পথে তাই ভয় করতে লাগলো, ঠিক স্টেশনে নামতে পারব তো! বলা বাহুল্য, স্টেশনে ইংরেজিতে কোনো সাইনবোর্ড নেই, গাড়ির ভেতরে লাইনের যে-চিত্র দেওয়া আছে তাও জাপানি ভাষায়। আমার উলটো দিকের সারিতে এক মহিলাকে মার্কিন বলে মনে হলো। সাহস করে ইংরেজিতে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার গন্তব্য সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারবেন কি না। তিনি ধারণা দিলেন এবং যথাস্থানে ফিরে এলাম।
সন্ধ্যায় টোকিও থেকে প্যানামে যাবো হংকংয়ে। বিমানের দরজায় দুজন বিমানবালা অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করছে। তার মধ্যে একজন সহাস্যে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কি আজ সকালে মেট্রোতে অমুক স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলে?
বিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি, তুমিই কি আমার উদ্ধারকারিণী?
সে বলে, হ্যাঁ।
মেয়েটি ইউনিফরমে থাকায় তাকে চেনার উপায় নেই। আমার সকালের পোশাকে সামান্য পরিবর্তন সত্ত্বেও সে চিনতে পেরেছে। অবাক হওয়ারই কথা।
বিমানবালা আমার আসনসংখ্যা দেখে রাখল। বললো, বিমান ছাড়লে দেখা হবে।
মেয়েটি সামনের দিকে একটি কেবিনে কর্তব্যরত। বিমান ছাড়ার পরে সে এলো। দু দণ্ড কথা বলে আমার কিছু প্রয়োজন কি না জেনে ফিরে গেল। আমি যখন বললাম যে, তোমার কেবিনে আমার আসন কিংবা আমার কেবিনে তোমার ডিউটি পড়লে ভালো হতো, তখন সে হাসলো। বললো, বিমান নামার আগে আবার আসবে।
সত্যি সে আবার এলো। হংকংয়ে আমি কোথায় থাকবো জানতে চাইলো। বললাম, অ্যামবাসাডর হোটেলে। সে দলেবলে কোথায় থাকবে, তাও বললো। আমার হোটেল থেকে সেটা খুব দূরে নয়।
ক্ষণিকের অতিথির সঙ্গে তার এমন ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিলাম। হংকংয়ে হোটেলে পৌঁছে একবার ভেবেছিলাম, তাকে একটা ফোন করি। তারপর রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টারের মতো মনে এই তত্ত্বের উদয় হলো, জীবনে এমন কত সাক্ষাৎ, এমন কত বিদায় আছে, ফোন করে ফল কী? পৃথিবীতে কে কার!
আগেরবারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার আগে থেকেই অ্যামবাসাডরে ঘর সংরক্ষণ করা হয়েছিল। সুতরাং দুদিন দুরাত হংকংয়ে আরামেই ছিলাম। সেখান থেকে ব্যাংকক। ব্যাংককে এবারে এয়ারলাইনসের অতিথি হয়ে এক রাত হোটেলে কাটিয়ে ঢাকায় ফেরা।
একদিনে বলার মতো কিছু ঘটেনি।
১৭.
ফেব্রুয়ারির শেষে পুরোনো পাণ্ডুলিপি দেখতে গেলাম কলকাতায়। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের প্রধান–সহায়তার হাত বাড়িয়েই রেখেছেন। বিভাগের সচিব ড. তুষারকান্তি মহাপাত্র আবার আমার বন্ধু অনিল সরকারের ঘনিষ্ঠ। তিনি কর্তব্যের অধিক করলেন। বাংলা বিভাগের পাণ্ডুলিপি দেখার সুব্যবস্থা তো করলেনই, উপরন্তু পরামর্শ দিলেন, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সুধাংশু তুঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। সুধাংশু তুঙ্গ ‘বাংলার বাইরে বাংলা গদ্যের চর্চা (ষোড়শ-অষ্টাদশ শতক)’ নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন–সেটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। পরে আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করায় তিনি আমাকে কিছু মূল্যবান উপকরণ পাঠিয়েছিলেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতে করতে বাংলা বিভাগের কোনো কোনো শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ হয়–ক্ষুদিরাম দাস, আশুতোষ দাস, উজ্জ্বলকুমার মজুমদার। আশুতোষ দাস একটু বেশি সময় ব্যয় করেন আমার জন্যে, একদিন বিকেলে নিয়ে যান কলেজ স্ট্রিটে তাঁর প্রকাশকের কাছে–সেখানে বসে সিঙ্গাড়া ও মিষ্টিসহযোগে চা খাওয়া হয়। এতটা যে করেন, সে আমি বাংলাদেশ থেকে গেছি বলে। তিনি পূর্ববঙ্গের লোক, এখানকার প্রতি তাঁর প্রাণের টান রয়ে গেছে। তিনি অভিযোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথোপযুক্ত মর্যাদা পাননি–তিনি পূর্ববঙ্গের মানুষ বলে। জিজ্ঞাসা করে যখন জানেন আমার পিতৃপুরুষের ভিটে পশ্চিমবঙ্গে, তখন একটু হতাশ হন। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে ‘নব চর্যাপদে’র অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি থেকে খানিক নকল করে নিই। সুকুমার সেনের বাড়িতে গিয়ে তাকে যখন সে-কথা জানাই, তিনি আমার নকল-করা পদগুলি পড়ে শোনাতে বলেন–তাঁর দৃষ্টিশক্তি তখন বেশ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। আমার মুখে শুনে। পদগুলি সম্পর্কে দু-একটি মন্তব্য করেন তিনি, তবে ঈষৎ ব্যঙ্গের সুরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ সম্পর্কে যা বলেন, তাতে বুঝি, বিভাগের প্রতি তিনি খুবই বিরক্ত। পুরোনো গদ্য নিয়ে আমি কাজ করছি জেনে খুশি হন তিনি, পরামর্শ দেন, আলোচনার সঙ্গে যেন বিশদ উদ্ধৃতি দিই।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেও যাই পাণ্ডুলিপি দেখতে। সেখানে বিশ্বনাথ দে বড়ো সহায়। বলেন, ‘আমাদের এখানে বিদ্যুৎ কখন থাকে, কখন থাকে না, তার ঠিক নেই। আপনি অনেকগুলো পাণ্ডুলিপি চাইবেন–কর্মীরা ওপর থেকে নামিয়ে এনে রাখবে–আপনি নিজের সুবিধেমতো পড়বেন। নইলে পাণ্ডুলিপির অপেক্ষায়ই আপনার অনেক সময় কেটে যাবে। সাহিত্য পরিষদৃগ্রন্থাগারে আলাপ হয় প্রশান্তকুমার পালের সঙ্গে তিনি রবিজীবনীর নতুন কোনো খণ্ডের উপকরণ আহরণ করছেন। কী নিষ্ঠার সঙ্গেই না রবীন্দ্রনাথের কবিতার বইয়ের পাঠের সঙ্গে পত্রিকায় প্রকাশিত পাঠ মিলিয়ে চলেছেন শব্দ ও যতিচিহ্ন ধরে ধরে! পরে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভবনে পাণ্ডুলিপি যদি পাওয়া যায় তার সঙ্গে মেলাবেন। তাঁর সঙ্গে গল্প করতে মাঝে মাঝে চলে যাই রাস্তা পেরিয়ে অপরদিকের ফুটপাতে–সেখানকার চায়ের দোকানে মাটির ভাঁড়ে চা খাই আর তাঁর কাজের বিষয়ে নানা কথা শুনি।
বরুণ দের সৌজন্যে থাকি সেন্টার ফর দি স্টাডিজ অফ সোশাল সায়েন্সেসের অতিথি-ভবনে। রাত দশটায় সেটার দরজা বন্ধ হয়ে যায়, সুতরাং ফিরতে হয় তার আগেই। একদিন দেরি হয়ে গেল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হায়াৎ মামুদের পিএইচ ডি ডিগ্রিলাভ উপলক্ষে ইন্টারন্যাশনাল হস্টেলে তাঁর ঘরে পানাহারের আয়োজন হয়েছে–ঢাকার আলমগীর রহমান, চট্টগ্রামের ভূঁইয়া ইকবাল ও লায়লা জামান, যাদবপুরের নবনীতা দেবসেন, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, সুবীর রায়চৌধুরী, অমিয় দেব, শুদ্ধশীল বসু–এঁরা সবাই আছেন। অতিথি-ভবনের দোহাই দিয়ে আমি যতই উঠতে চাই, কেউ না কেউ আটকে দেন। শেষ পর্যন্ত আড্ডা শেষ হলো। নবনীতা, প্রণবেন্দু, অমিয়, শুদ্ধশীল ও আমি এক ট্যাকসিতে অতিথি-ভবনে এসে দেখলাম, যথারীতি দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। কলিং বেল বাজিয়ে কোনো লাভ হলো না। আমার অবস্থার জন্যে শুদ্ধশীল নিজেকেই অনেকটা দায়ী মনে করলো। সে অপরিসীম দক্ষতায় পাচিল টপকে ভেতরে গেল এবং সামনের দরজায় করাঘাত ও তারস্বরে ডাকাডাকি করতে লাগলো। ওপরতলার লোকজনের ঘুম ভেঙে গেল, তারা আলো জ্বালালেন, বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন কী হচ্ছে দেখতে, তারপর ভেতরে চলে গেলেন। আমি ধরেই নিলাম, পরদিন ওঁরা নালিশ করবেন। শেষ পর্যন্ত দরজা খুললো। শুদ্ধশীলের তম্বি শুনে যে দরজা খুলেছিল সে বললো, দশটায় দরজা বন্ধ করে দেওয়া নিয়ম। শুদ্ধশীল। খুবই অপমানিত বোধ করে জানতে চাইলো, কোনো ভদ্রলোক রাত দশটার মধ্যে বাড়ি ফেরে? যাহোক, আমি ঘরে ঢুকতে পেলাম। ওরা চারজন ওই ট্যাকসি নিয়ে চলে গেল।
সবাইকে নামিয়ে শুদ্ধশীল শেষে বাড়ি ফিরবে, এমন ব্যবস্থা। বাড়ির কাছাকাছি যখন এসেছে, তখন ট্যাকসি-চালক শুদ্ধশীলের কাছে তার যা আছে তা দিয়ে দেওয়ার দাবি জানায়। ব্যাপারটা বুঝতে শুদ্ধশীল একটু সময় নেয়–তারই মধ্যে চালক তাকে সতর্ক করে দেয় তার কথা অমান্য করার পরিণাম সম্পর্কে। হৃতসর্বস্ব শুদ্ধশীল বাকি পথ পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরে।
কলকাতায় আমার কাজ প্রায় শেষ। ফাঁকে ফাঁকে ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল ও এশিয়াটিক সোসাইটিতেও কাগজপত্র দেখে ফেলেছি। এখন ফেরার পালা। ফেরত আসার তারিখ বসাতে হবে টিকিটে, যেতে হবে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স অফিসে। এক বিকেলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে কলেজ স্ট্রিট ও মহাত্মা গান্ধি রোডের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে ট্যাকসি খুঁজছি আর খালি দেখলে। তার পেছনে দৌড়াচ্ছি।
একটা খালি ট্যাকসি দেখে আমি তার বাঁ-দিকের দরজার হাতলে হাত দিয়েছি, তারই মধ্যে আরেকজন ডানদিকের দরজা খুলে উঠে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে আহ্বান করলো, ‘উঠে পড়ুন! অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ সামান্যই, আমাকে চিনে ডাকলেন কি
কে জানে! দ্বিতীয়বার তার আহ্বান শুনে উঠেই পড়লাম। ট্যাকসি চলতে থাকলো কলেজ স্ট্রিট ধরে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পায়ের কাছে খবরের কাগজে মোড়া কিছু একটা রাখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমা বের হতেই সেটা ধরে মুখের কাছে নিয়ে তিনি বললেন, ‘ট্যাকসিতে খেতে-খেতে যাচ্ছি দেখলে ছেলেমেয়েরা কী মনে করবে, তাই একটু দেরি করলাম। এবারে চুমুক এবং প্রশ্ন, কোথায় যাবেন?’ বললাম, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইসে–আমাকে মোড়ে নামিয়ে দিলে চলবে।’ শক্তি বললেন, তা কী হয়? আমিও যাবো আপনার সঙ্গে। তারপর। বোতলটার দিকে ইঙ্গিত করে, এটা ততক্ষণে শেষ করে ফেলা দরকার।’ এরপর চুমুক এবং প্রশ্ন, ‘ওখানে কী কাজ?’ বললাম, ‘ফেরার দিনক্ষণ এনডোর্স করতে হবে টিকিটে।’ এ আর এমন কী’ বলে শক্তি যথাকৰ্তব্য করতে। থাকলেন। ট্যাকসি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে এসে থামলো। শক্তি বৃথা চেষ্টা করলেন ট্যাকসিটাকে দাঁড় করিয়ে রাখার। আমি বৃথা চেষ্টা করলাম ট্যাকসিভাড়া দেওয়ার।
আমি একতলায় টিকিট কাউন্টারে যেতাম। শক্তি আমাকে দোতলায় নিয়ে গেলেন পাবলিক রিলেশনস ম্যানেজার কল্যাণ মজুমদারের কাছে। বললেন, ‘ইনি বাংলাদেশের বিশিষ্ট অধ্যাপক। কফি খাওয়াও এবং যথাশীঘ্র এঁর কাজটি করে দাও।
কাজ হয়ে গেলে কল্যাণ মজুমদারকে ধন্যবাদ দিয়ে নিচে নামি। শক্তি জানতে চান, কোথায় যাবো। অতিথি-ভবনের ঠিকানা বলি। তিনি বলেন, ‘সেখানে পরে গেলে হবে। এখন আমার সঙ্গে চলুন। আর এই আজ্ঞে-আপনি ভালো লাগছে না। আমি তুমি বলব, তুমিও আমাকে তুমি বলবে।’
এবারে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে এক বন্ধ রেস্টুরেন্ট ও বারের সামনে। ট্যাকসি থেকে নামলাম। হাঁকডাক করে দরজা খোলানো হলো। নিচের তলায় এক টেবিল অধিকার করে শক্তি পানীয় আনতে হুকুম করলো আর বললো, ‘সঙ্গে কিছু দিস রে বাপু!’ বেয়ারার বললো, ‘সার, আজ ড্রাই ডে।’ শক্তি সখেদে বললো, বাবা, বাংলাদেশ থেকে আমার বন্ধু এসেছে, তাকে নিয়ে। এসেছি খাওয়াবো বলে, তোরা বন্ধুর সামনে আমাকে অপমান করবি!’ সে বললো, ‘সার, আমি কী করবো! ম্যানেজার সাহেবও নেই।’ শক্তি বললো, ‘টেলিফোনে লাগা ম্যানেজারকে।’ আমি বাধা দিতে চেষ্টা করি, তাতে কাজ হয় না। টেলিফোনে আবার তার কথা, বাংলাদেশ থেকে খুব সম্মানিত একজন অতিথি নিয়ে এসেছি–ওসব ড্রাই ফ্রাই বুঝি না–আমার মানসম্মান নেই বুঝি! এবার টেলিফোন গেল ওয়েটারের হাতে–’হ্যাঁ সার, হ্যাঁ সা’ শুনতে পেলাম। তার মুখে। তারপর দোতলায় প্রাইভেট অফিস’ লেখা এক ঘরে আমাদের বসিয়ে সে গেল রসদ আনতে। আমি শক্তিকে বলি, আমার জন্যে এটা খুব আর্লি। সে বলে, ‘ড্রিংকসের আবার আর্লি-লেট কী! এতক্ষণে সে আরাম করে। বসে। জোড়া আসনের একটায় হেলান দিয়ে বলে, ‘আল মাহমুদের কবিতা আমার খুব ভালো লাগে। শামসুর রাহমানের চেয়েও।
সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে বেরোনো গেল। ময়দানের দিকে কোনো একটা মেলা বসেছে। সেখানে তার যাওয়ার কথা। আমি বিদায় নিতে চাইলাম। সে বললো, ‘কেন এমন কচ্ছ? আমার সঙ্গ কি তোমার খুব খারাপ লাগছে? শশব্যস্তে বলি, না, না, তা নয়; তোমার এখানে কাজ আছে আর আমারও ফেরা দরকার।’ সে বললো, আচ্ছা, ওখানে হয়ে তোমাকে পৌঁছে আমি বাড়ি ফিরবো!’
মেলায় অসংখ্য ছেলেমেয়ে শক্তির সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল। এখানে। তার কোনো আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব ছিল না, কিন্তু অন্তত বিশ-পঁচিশজনকে সে এখানে আসতে বলেছিল, তা বোঝা গেল। সবাইকে সে আমার পরিচয় দেয় অতিরঞ্জিত করে, কিন্তু তাদের লক্ষ্য তো শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সৌজন্য করে যারা আমার সঙ্গে কথা বলে, তাদেরও মন পড়ে থাকে তার দিকে। ভালোই লাগে দেখতে-কবির জন্যে মানুষের এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। তারা শক্তির কবিতা আবৃত্তি করে, তার কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে চায়। শক্তি বলে, ‘আমি পদ্য লিখি–কবি হলো সুনীল। ওর কবিতা ভালো করে পড়লে তোমরা অনেক কিছু পাবে। মাঝে মাঝে তাগাদাও দিই শক্তিকে, কিন্তু খুব জোরের সঙ্গে নয়। সে বলে, এখান থেকে বেরিয়ে কোথাও একটু বসে তারপর ফেরা যাবে!’ এবারে আমি শঙ্কিত হই। বলি, তেমন মতলব থাকলে তোমাকে একাই যেতে হবে।’
মেলা থেকে বেরিয়ে ট্যাকসি নিই। শক্তি ততক্ষণে মন বদলে ফেলে। বলে, ‘আমাকে বাড়িতে নামিয়ে যদি তুমি ফেরো, খুব অসুবিধে হবে?’ আমি রাজি হই। শক্তি বলে, আমার বউটা খুব লক্ষ্মী। আমি বড়ো কষ্ট দিই তাকে। তারপর খানিক চুপ করে থাকে।
১৮.
একদিন গেলাম নবনীতা দেব সেনের হিন্দুস্থান পার্কের ভালো বাসা বাড়িতে। ডাক পড়ল তার মা রাধারানী দেবীর ঘরে। ওঁর শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না–বিশাল খাটে শুয়ে ছিলেন। সেই খাটের এক প্রান্তে নবনীতা বসে, সেদিন সে একটু সেজেছে। অদূরে একটা চেয়ারে আসীন তারাপদ রায়। তার পাশের চেয়ারটিতে গিয়ে বসলাম। নবনীতা জিগ্যেস করলো, জানো তো আজ ভাইফোঁটা?’ বললাম, ‘তাই নাকি? সে বললো, ‘তোমাদের দুজনকেই আজ ফোঁটা দেবো।’
খানিক পরে তারাপদ আর আমি মেঝেতে বসলাম আসন গেড়ে। নবনীতা চন্দনের বাটি নিয়ে বসলো আমাদের মুখোমুখি। সে ছড়া কাটতে লাগলো, তার শেষটা অনেকটা এরকম : যমের দুয়ারে দিয়ে কাঁটা/ভগ্নি দেয় ভাইকে ফোঁটা’। উত্তরে বোনের কল্যাণকামনায় ভাইকেও কিছু বলতে হয়, কিন্তু তা আমার জানা নেই। তারাপদ বললো, আমি বলছি, তুমি আমার সঙ্গে বলতে থাকো।’ নকল করে পাশ করলাম। রাধারানী দেবী মৃদু মৃদু হাসতে থাকলেন। নবনীতা আমাদের কপালে ফোঁটা দিলো। ফোঁটা মেখে খেতে বসলাম। ভোজ কয় যাহারে।
আরেক সন্ধ্যায় নবনীতার বাড়িতে গিয়ে দেখি অমর্ত্য সেন বসে আছেন। নবনীতার মুখে ঝড়ের আভাস। ওদের বড়ো মেয়ে অন্তরাও রয়েছে সেখানে। ব্যাপারটা এরকম: অমর্ত্য কলকাতায় এসেছেন অল্প সময়ের জন্যে। ও-বাড়ি গেছেন মেয়েদের দেখতে। নবনীতা তাকে রাতে খেয়ে যেতে বলছে, কিন্তু সে অনুরোধ তিনি রাখতে পারছেন না, কেননা তার অন্যত্র খাওয়ার নিমন্ত্রণ রয়েছে। নবনীতার প্রশ্ন, সময়ের যদি এতই টানাটানি, তাহলে আর আসা কেন? এইরকম কথাবার্তার মধ্যে তৃতীয় পক্ষের বসে থাকাটা স্বস্তিকর নয়। সুতরাং এক ফাঁকে বললাম, আমি আসি এখন।’ নবনীতা ঝঝের সঙ্গে বলে উঠলো, ‘তোমারও নেমন্তন্ন আছে নাকি?’ বললাম, না, তা ঠিক নয়, তবে।’ নবনীতা হুকুম করলো, তবে বসে থাকো।’ অন্তরা নিঃশব্দে চোখ বড়ো করে আমাদের সবাইকে একবার দেখে নিলো। সেই মুহূর্তে তার ছোটো বোন টুম্পা ঘরে ঢুকে। কী গো আনিস মামা, কখন এলে?’ বলে জায়গামতো বসে পড়ল–তাতেই আবহাওয়াটা একটু লঘু হয়ে গেল।
অমর্ত্য সেনের সঙ্গে আমার সর্বশেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের লন্ডনের বাড়িতে। আমি তাকে সে-কথা মনে করিয়ে দিলাম। তিনি বললেন, তার বিলক্ষণ মনে আছে। বস্তুত অমর্ত্য লন্ডনে এলে তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে তাঁকে একবার যেতেই হতো। আমি লন্ডনে থাকলে তারাপদ আমাকেও আমন্ত্রণ জানাতেন। সেখানে অমর্ত্যকে কখনো একা, কখনো সস্ত্রীক, একবার তার স্ত্রী ও মায়ের সঙ্গে পেয়েছি। অমিতা সেনের কাছে আমি নবনীতার বন্ধু বলেই নিজেকে পরিচয় দিয়েছি, যদিও তারাপদ আমার পপাশাকি পরিচয় অনেক দিয়েছেন। অমিতা সেনকে এটাও বলেছিলাম যে আমি সত্যেন সেনের স্নেহধন্য। তা শুনে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। ঢাকার কথা বলতে তিনি ভালোবাসতেন। তাঁর স্বামী আশুতোষ সেন যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত সে-সময়ের স্মৃতি তাঁর চিত্তে অমলিন হয়ে ছিল। তার থেকেই কিছু কিছু আহরণ করে কথা বলতে থাকলেন।
কলকাতার সেই সন্ধেবেলায় অমর্ত্য শেষ পর্যন্ত অন্যত্র নিমন্ত্রণরক্ষা করতে চলে গেলেন। নবনীতা ঘোষণা করলো, সবাই মিলে বাইরে খেতে যাবে। মেয়েরা তৈরি হয়ে এলে নবনীতাই গাড়ি চালিয়ে আমাদের নিয়ে এলো হাজরার মোড়ে এক ঢাবায়। আমি এর আগে আর কখনো ঢাবায় খাইনি। অতএব নতুন একটা অভিজ্ঞতা হলো।
১৯.
এপ্রিলের গোড়ায় কলকাতা থেকে ফিরে এসে সে-মাসের মাঝামাঝি প্যারিস রওনা হলাম। ঢাকা ছাড়ার আগে লন্ডন থেকে লেখা হায়াৎ মামুদের চিঠি পেলাম। রোজীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করে আবদুল মোমেন বিয়ে করেছে। সালমান রুশদীর বোন সামিনকে। যদি সম্ভবপর হয়, প্যারিস যাওয়ার পথে আমি যেন লন্ডনে রোজীর সঙ্গে দেখা করে যাই। আমার টিকিটটা ছিল ঢাকা কলকাতা-বোম্বাই-প্যারিসের। সুতরাং প্যারিসে যাওয়ার পথে লন্ডনে থামা সম্ভবপর নয়। প্যারিসে পৌঁছে প্রথম সপ্তাহান্তেই কোচে করে লন্ডনে এলাম। একরাত থাকলাম বুলুর বাড়িতে। রোজীর বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে এবং একটা রেস্টুরেন্টে মোমেনের সঙ্গে দেখা করলাম। সামিনের সঙ্গে দেখা করিনি। ফলে, তিনি আমাকে তাঁর প্রতি বিরূপ ভাবলেন।
প্যারিসে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল আগেরবারের মতোই সিতে য়ুনিভার্সিতেয়ারের রেজিস রোবের গ্যারিকে। কিন্তু সবটা সময়ের জন্যে সেখানে জায়গা পাওয়া যায়নি। ফলে, ওই চত্বরেই অন্য এক মেজেতে আমাকে চলে যেতে হয়, থাকতে হয় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। যেদিন বাসস্থান পালটাবো, তার আগের দিন আনোয়ার আবদেল-মালেকের ফ্ল্যাটে গেছি। খানিক পরে আলজিয়ার্সে দেখা সেই মেয়েটি এলো আবদেল-মালেক যার নাম দিয়েছিলেন নেফারতিতি। মেয়েটি যখন আমার ঠিকানা চাইলো, বললাম, কালই জায়গা বদল করছি। নতুন জায়গার টেলিফোন নম্বরটা জানা হয়নি, পুরোনোটা সঙ্গে নেই। ব্যাপারটা সত্যি, কিন্তু মেয়েটির বোধহয় আমার কথা বিশ্বাস হয়নি। সে হয়তো ভাবলো, আমি তাকে এড়িয়ে যাচ্ছি। তাই আমি যখন বললাম, তোমার ফোন নম্বর দাও, নতুন জায়গায় গিয়ে তোমাকে ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর জানিয়ে দেবো, তখন সে আমাকে এড়িয়ে গেল। এই পরমাসুন্দরীর সঙ্গে যে আমার আর যোগাযোগ হলো না, সে-ক্ষতিটা আমারই।
এবারে হাসনাত জাহান আর সিতেতে ছিল না, ঘর ভাড়া করেছিল বাইরে। সুতরাং সিতেতে আমার অভিভাবকত্বের ভার সম্পূর্ণই পড়েছিল নাসিমা জামানের ওপরে। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার রওশানুজ্জামান প্যারিসে গিয়েছিলেন কোনো এক প্রশিক্ষণ-উপলক্ষে, কিছুদিন তাঁর সঙ্গ পাওয়া গিয়েছিল। হাসনাতের বাসায় জিওভানি-দম্পতির সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হতো, তারাও এক-আধবার সিতেতে এসে আমার সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে গেছে। অন্যদিকে আনোয়ার আবদেল-মালেক ও ক্রিস্টিন কলপা তো ছিলেনই, তবে সানিয়া ছিল না। ফ্রাঁস ভট্টাচার্যও ছিলেন। তাঁর সৌজন্যে ইনালকোতে এবারও কিছু বলতে হলো। দিলীপ ছিল, কিন্তু গতবারে তার যে-ফরাসি বান্ধবীকে দেখেছিলাম, যাকে নিয়ে সে একবার চট্টগ্রাম হয়ে এলো, তাকে দেখলাম না।
তখন প্যারিসে আমাদের রাষ্ট্রদূত কে এম শেহাবউদ্দীন। তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর উদার আতিথেয়তা উপভোগ করেছি। তবে ইনালকোর সঙ্গে আমাদের দূতাবাসের যোগাযোগ-স্থাপনের চেষ্টায় আমি সফল হইনি। ইনালকো তথা ফ্রাসের ধারণা, বিদ্যায়তনিক বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস উদাসীন। দূতাবাস তথা রাষ্ট্রদূতের ধারণা, বাংলাদেশের বিদ্বজ্জন দেখলে ইনালকোর মতো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা যেমন আগ্রহ দেখান, আসলে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের তেমন। আগ্রহ নেই। ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেই তারা বেশি উৎসাহী, তাই সেদেশের দূতাবাসের সঙ্গে তাঁদের আদানপ্রদান হয়, আমাদের দূতাবাসের সঙ্গে হয় না। দূতাবাসের কথা যে অগ্রাহ্য করার মতো, তা নয়। তবে বিদেশের বিদ্যায়তনিক ও সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের দূতাবাসের সম্পর্ক যে খুব ক্ষীণ, তাও সত্য।
প্যারিসে থাকাটা সবদিক থেকে আনন্দদায়ক হয়েছিল আমার পক্ষে। কাজও সম্পন্ন হয়েছিল দ্রুতগতিতেই–কিছুটা আগেরবারের অভিজ্ঞতার ফলে। এবারে মার্কস ব্রাদার্সের কয়েকটা ছবি দেখার সুযোগ হয়। প্যারিসের মিউজিয়মগুলোর সঙ্গে পরিচয়ও আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়।
জুলাইয়ের মাঝামাঝি প্যারিস থেকে যাই লন্ডনে–এবারও কোচে। শফিউল্লাহ লন্ডনের বাইরে কোথাও গেছেন, আমি উঠলাম জ্যান ড্রাইডেনের বাসায়। ওর ছেলে-বন্ধু অ্যালান ততদিনে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়ে জ্যানের ফ্ল্যাটেই উঠেছে। তারা খুব শিগগিরই বিয়ে করতে যাচ্ছে–দিন-তারিখ ঠিক হয়ে গেছে। জ্যান তো খুব গোছালো মেয়ে। নতুন সংসার পাততে তার কী কী প্রয়োজন। হবে, তার একটা তালিকা যেখানে তার টেলিফোন থাকে, তার পাশেই টাঙিয়ে রেখেছে। বিয়েতে নিমন্ত্রিত বন্ধুরা সেই তালিকা-অনুযায়ী উপহার আনতে পারবে। তালিকা শুনে যে বলছে সে অমুকটা দেবে, সেই উপহারসামগ্রীর নামের পাশে উপহারদাতার নাম লিখে রাখছে জ্যান। এরপর কেউ জানতে চাইলে ওই বস্তুর নাম সে করবে না।
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি হালে আঠারো শতকের চন্দননগরবাসী ফরাসি ব্যবসায়ী ও কুঠিয়াল ভেরলের পারিবারিক কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে। তার মধ্যে কিছু বাংলা কাগজপত্র আছে। তার একটা তালিকা করে দেওয়ার অনুরোধ এলো। সেই কাজে লেগে গেলাম। তখন কথা উঠলো, কিছু পুরোনো কাব্যের পাণ্ডুলিপি এবং রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তলিখিত গানের যে-সংগ্রহ লাইব্রেরিতে আছে, তাও তার সঙ্গে তালিকাভুক্ত করি না কেন! আমিও সাগ্রহে সে-কাজটা করলাম। একটি ছোটো তালিকাগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে গেল। হাকিম নড়ে যাওয়ায় অবশ্য সে-তালিকা আজো প্রকাশিত হতে পারেনি।
ফেরার পথে রোমে থেমে আসবো বলে স্থির করলাম। লন্ডনের ইতালীয় দূতাবাস থেকে ভিসা নিতে গিয়ে লাইন দিতে হলো ফুটপাতে–একটু ভিজেও গেলাম। সমবেত ভিসাপ্রার্থীগণ সুসভ্য ভাষায় দূতাবাসকে গালাগাল করতে থাকলো–কিন্তু তা দেয়াল ভেদ করে কর্তৃপক্ষের কর্ণগোচর হলো না। এয়ার ইন্ডিয়ার লন্ডন অফিসে যেতেই দেখা হয়ে গেল নূরুল কাদের ওরফে ঝিলুর সঙ্গে। সেও রোম হয়ে দেশে ফিরবে। রোমে পৌঁছোবে আগে, তবে রোম ছাড়বে আমার সঙ্গে একই ফ্লাইটে। রোমে যে-হোটেলে সে থাকবে, তার ঠিকানা দিলো। আগস্টের মাঝামাঝি আমি রোমে পৌঁছোলাম। পরদিন ঝিলু এবং তার ছেলের সঙ্গে সারাটা সময় কাটালাম রোমের দ্রষ্টব্য দেখে। তার পরদিন আমার জিনিসপত্র নিয়ে ওর হোটেলে। আরো কিছু ঘোরাঘুরি করে, লাঞ্চ খেয়ে ফিরতি পথে যাত্রা। ওর জিনিসপত্র এতই বেশি যে স্যুটকেসের ডালা লাগানো ভার। অগত্যা আমি একবার করে সুটকেসের ওপরে চেপে বসি আর ঝিলু স্যুটকেস বন্ধ করে। বিমানবন্দরে এসে বোঝা গেল, আমার জিনিসপত্রও নেহাৎ কম নয়। অতিরিক্ত মালের মাশুল দিতে হবে। কাউনটার যদিও এয়ার ইন্ডিয়ার, তার ব্যবস্থাপনা অল-ইতালিয়ার। তারা মার্কিন ডলার নেবে না, শুধু ইতালীয় লিরা নেবে। আমি দৌড়ে যাচ্ছিলাম মানি-এক্সচেঞ্জে। ঝিলু থামিয়ে দিয়ে পকেট থেকে এক মুঠো লিরা বের করে বললো, ‘সময় নেই টাকা ভাঙানোর।’ ঝিলুকে বোধহয় বাড়তি কিছু দিতে হয়নি–দুটো টিকিট তার বিজনেস ক্লাসের।
বোম্বাইতে যাত্রাবিরতি। এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনায় হোটেলে। সেখানে আমি ঝিলুকে জোর করে ডলার গছিয়ে দিলাম। ঝিলু কেনাকাটি করবে, আমাকেও সঙ্গে নিলো। হোটেলে ফিরে এসে একটা শাড়ির প্যাকেট আমার হাতে দিয়ে বললো, এটা তোমার বউয়ের জন্য।
বিকেলে ঢাকার ফ্লাইট। বাংলাদেশ সরকারের এক প্রতিনিধিদল ফিরছেন। আফ্রিকার কোনো দেশ সফর করে–সম্ভবত কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনের শেষে। দলের সদস্যেরা আমার সহযাত্রী। ঝিলু তার কেবিন থেকে বেরিয়ে আমার খোঁজ নিতে এসে তাঁদেরও সাক্ষাৎ পেল। এয়ার হোস্টেসকে বললো, এদের সকলকে ড্রিংকস দাও আমার হয়ে–যে যা খেতে চায়। বিস্মিত এয়ার হোস্টেস পরে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, উনি কে? আর তোমরা এতজন পরস্পরকে চেনো কী করে?’ বললাম, বাংলাদেশ ছোটো জায়গা। লোকসংখ্যা যদিও অনেক, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সংখ্যা খুব বেশি নয়। আমাদের কালে একটাই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল–সুতরাং পরস্পর চেনাজানা থাকা অস্বাভাবিক নয়। দিলদরাজ যে-ব্যক্তি সবাইকে আপ্যায়ন করতে চাইলেন, তিনি এককালে সচিব ছিলেন, এখন বড়ো শিল্পপতি। সবাইকে না হলেও অধিকাংশকে চেনেন। আর তার হৃদয়টা খুব বড়ো।’
ঢাকায় নেমে ল্যান্ডিং কার্ডটাও ঠিকমতো পূরণ করলো না ঝিলু। নাম, পাসপোর্ট নম্বর লিখে আর সই করে ছেড়ে দিলো। ইমিগ্রেশন অফিসারকে বললো, এখন বাড়ি ফেরার জন্যে ব্যাকুল, এত লিখতে পারবো না, বাকিটা আপনি লিখে নেবেন। কাস্টমসের কর্মকর্তা জানতে চাইলেন, তার কাছে। বৈদেশিক মুদ্রা কত আছে। সে বললো, আছে দু-এক হাজার ডলার–এখন গুনতে পারবো না, বাড়ি যাবো। কর্মকর্তা এবারে তার স্যুটকেস খুলতে চাইলো। সে বললো, ‘এই ড. আনিসুজ্জামানকে স্যুটকেসের ওপর বসিয়ে তারপর তালা লাগিয়েছি। এখন খুললে আর বন্ধ করতে পারবো না। এখানে আর ঝামেলা করবেন না–তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে চাই।’
সত্যি আর কেউ ঝামেলা করলেন না।
২০.
চট্টগ্রামে ফিরে আসার পরের একটি স্মরণীয় ঘটনা শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের নামে স্থানীয় বিমানঘাঁটির নামকরণ। সার্জেন্ট জহুরুল হককে আমি সামান্য চিনতাম, তাঁর অগ্রজ আমিনুল হকের সঙ্গেই পরিচয় ছিল বেশি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকাকালে ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে নিরাপত্তা রক্ষীদের গুলিতে তিনি নিহত হন। তাঁর প্রতি ব্যাপক সমর্থনজ্ঞাপন এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে ছাত্রেরা তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল রাখে। বিমানবাহিনী এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দেশের বিভিন্ন বিমানঘাঁটি পরিচিত হবে মুক্তিযুদ্ধের এবং স্বায়ত্তশাসন-আন্দোলনের শহীদদের নামে। যশোরের বিমানঘাঁটির নাম দেওয়া হচ্ছে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান বিমানঘাঁটি, চট্টগ্রামেরটা শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক বিমানঘাঁটি।
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক বিমানঘাঁটির নামকরণ-অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় দু-এক কথা বলার জন্যে। ঘাঁটির অধিনায়ক স্বাগত ভাষণ জানালেন, অ্যাডভোকেট আমিনুল হক ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করলেন, আমি সামান্য কিছু বললাম, তারপর বিমানবাহিনী-প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ ভাষণ দিলেন। অতি সংক্ষিপ্ত তবে ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের শেষে চা-পান। আমিনুল হক ঢাকা থেকে এসেছিলেন সপরিবারে। তার স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রী ছিলেন। বহুদিন পর তাঁর সঙ্গে দেখা হলো।
এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি খুব সম্মানিত বোধ করেছিলাম। এয়ার ভাইস-মার্শাল সুলতান মাহমুদকে তাই সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানালাম। আলাপের এক পর্যায়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কথা উঠলো। দেখলাম, আমাদের অবস্থান বিপরীত মেরুতে। তিনি ক্যাডেট কলেজের মতো বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবশ্যকতায় দৃঢ়বিশ্বাসী, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদানের পক্ষপাতী, উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে উদৃবিগ্ন, তবে শিক্ষাবিস্তারের বিষয়ে খানিকটা উদাসীন। অনেকক্ষণ ধরে আমরা নিষ্ফল তর্ক করলাম।
সুলতান মাহমুদ একজন মুক্তিযোদ্ধা। তবে সেই মুহূর্তে তাঁকে এলিট সমাজের বিশেষ প্রতিনিধি বলে মনে হয়েছিল।
২১.
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বড়োরকম বিপর্যয় ঘটে গেল।
বিষয়টার শুরু পরীক্ষা পেছানোর দাবি নিয়ে–তা এমন কিছু নতুন নয়। ছাত্রেরা দাবি নিয়ে উপাচার্যের কাছে উপস্থিত হয়, তিনি অনুষদের ডিন, আবাসিক হলের প্রোভোস্ট এবং বিভাগীয় চেয়ারম্যানদের তাঁর দপ্তরে ডাকেন, কথাবার্তা হয়, কখনো তাৎক্ষণিক মীমাংসা হয়, কখনো আন্দোলন দীর্ঘায়িত হয়। এবারেও সূচনাটা তেমনই হলো। আমরা উপাচার্যের দপ্তরে হাজির হলাম, আলোচনা চলতে চলতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাবৃদ্ধি পেতে থাকলো। উপাচার্যের সচিব একসময়ে এসে আমাদের গাড়িগুলো সরিয়ে রাখার পরামর্শ দিলেন। আমি তার হাতে গাড়ির চাবি দিয়ে বললাম, কাউকে দিয়ে উত্তর ক্যাম্পাসে কারো বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করে রাখতে। একটু পরই ছাত্রছাত্রীরা ঘোষণা করলো তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা আমাদের ঘেরাও করে রাখবে। আমরা দাবি মানতে রাজি নই–উপাচার্যের অফিসকক্ষেই রাত্রিযাপনের কোনো বিকল্প দেখা গেল না।
এই সময়েই আবিষ্কার করা গেল যে, এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলা বিভাগেরই এক ছাত্র এবং এক ছাত্রী। ছাত্রটি আমার এক ছাত্র ও সহকর্মীর (সে তখন দেশে ছিল না) অনুজ, আমার বিশেষ স্নেহভাজন, আবাসিক হলে জায়গা পাওয়ার আগে আমারই বাড়িতে বাস করেছিল। ছাত্রীটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তার ভ্রাতুস্পুত্রী, আমার নিকটতম প্রতিবেশিনী, সংগীতে পারদর্শিনী, আমার বাড়িতে তার অবাধ যাতায়াত, বাড়ির সবাই তাকে ভালোবাসে। এরা দুজনেই আমার এত ঘনিষ্ঠ যে, যদি কেউ মনে করেন যে, উপাচার্যকে বিব্রত করার জন্যে আন্দোলনে আমি এদের প্রবৃত্তি দিয়েছি, তাহলে তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না।
আমরা সারারাত উপাচার্যের ঘরে আটকে থাকলাম এবং আমাদেরও রাগের মাত্রা বাড়তে থাকলো। ভোর হতে হতে আমরা সিদ্ধান্ত করলাম যে, ঘেরাও ভেঙেই আমরা বেরিয়ে পড়বো। তার মানে সিঁড়িতে যেসব ছেলেমেয়ে সারারাত ধরে শুয়ে-বসে আছে, আক্ষরিক অর্থে তাদের গায়ের ওপর দিয়ে আমরা নেমে যাবো। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না, কিন্তু সবাই একমত হলেন যে, ঘেরাওকারীরা সীমা ছাড়িয়ে গেছে, অতএব আমাদেরও কঠোর হতে হবে।
হঠাৎ দরজা খুলে ছেলেমেয়েদের একরকম পাড়িয়েই আমরা একযোগে নেমে এলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় তারাও বিমূঢ়, কেউ কেউ আমাদের পা জাপটে ধরতে চেষ্টা করলো, আমরা সজোরে তাদের হাত সরিয়ে দিলাম। আমি বেশ আগের দিকেই ছিলাম। উপাচার্যের দপ্তর থেকে বেরিয়ে আমি চললাম উত্তর ক্যাম্পাসে। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরবো। ক্যাম্পাসের পশ্চিম দিক দিয়ে অনায়াসে চলে যেতে পারতাম নিরাপদে। কিন্তু গাড়িতে উঠে মনে হলো, একা না গিয়ে বরঞ্চ আরো কয়েকজন সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে যাই। গাড়ি নিয়ে উপাচার্যের অফিসের দিকে চললাম, দু-একজন সহকর্মীকে বোধহয় গাড়িতেও তুললাম, তারপরই পড়ে গেলাম বিক্ষুব্ধ ছাত্রদলের সামনে।
তারপর যা ঘটলো, তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ও অভাবিত। ছাত্রদের দেখে আমি গাড়ি থামালাম এবং নেমে আসার চেষ্টা করলাম। তখনই লাঠির বাড়ি দিয়ে গাড়ির সামনের ও পেছনের উইন্ডস্ক্রিন ভাঙা শুরু হলো। ছাত্রেরা আমার সঙ্গে অসংগত আচরণ করবে না বলে আমার অহংকারও চূর্ণ হলো। আমি একেবারেই বিমূঢ়। ছাত্রেরা কাঁচ ভেঙে আনন্দিতচিত্তে প্রস্থান করলো। গণিত বিভাগের অধ্যাপক ফজলী হোসেনের চুলের মধ্যে ভাঙা কাঁচ ঢুকে মাথার চামড়া খানিক কেটে গেল। ততক্ষণে পেছনে-পড়া সহকর্মীরা কাছে চলে এসেছেন। আমি কেন অকুস্থলে ফিরে গেলাম, সেজন্যে তাঁরা তিরস্কার করতে থাকলেন। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছোটো নূরুল ইসলাম সামনের সিটের কাঁচ সরিয়ে গাড়িতে বসলেন। বাড়িতে ফিরলাম গাড়ি নিয়ে এবং গাড়ি গ্যারাজে রেখে নূরুল ইসলাম ও আমি আবার রওনা হলাম অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে যোগ দিতে। তখনই টের পেলাম, আমার পায়ের আঙুলের কাছে কিছুটা কেটে গেছে এবং সামান্য রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
আটকাবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়া সহকর্মীরা তাদের দিকে আমাকে যেতে দেখে তিরস্কারই করলেন এবং যার যার বাড়ি না গিয়ে সবাই আমার বাড়িতেই এলেন। যারা আমাদের সঙ্গে রাতে ছিলেন না, তাঁরাও অনেকে এসে যোগ দিলেন। পাড়ার মহিলারাও এলেন সহানুভূতি জানাতে। ডাক্তার এসে আমার শুশ্রূষা করলেন। উপাচার্য একবার নিজের বাড়ি ঘুরে সরাসরি চলে এলেন এবং করণীয় সম্পর্কে সকলের পরামর্শ চাইলেন। খবর পাওয়া গেল যে, নেতৃত্বদানকারী আমার ছাত্র ও ছাত্রী ক্যাম্পাস ছেড়ে গেছে এবং খুব সম্ভব চট্টগ্রাম ত্যাগ করেছে।
পরদিন থেকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেল আমার কাছে। ওই ছাত্র এবং ছাত্রীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ সম্পর্কে তাঁরা জানতে চাইলেন, তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে এই আন্দোলন সম্পর্কে আমি আগে কিছু আঁচ করতে পেরেছিলাম কি না, তাও ছিল তাঁদের জিজ্ঞাস্য। যারা গাড়ির কাঁচ ভাঙলো, তাদের কাউকে আমি শনাক্ত করতে পেরেছি কি না, তাও ছিল তাদের জানবার বিষয়। অনেক প্রশ্নে আমি যথেষ্ট বিব্রত হয়েছিলাম।
তবে ভাগ্য ভালো, সহকর্মীরা আমাকে ভুল বোঝেন নি। উপাচার্য স্বয়ং যথেষ্ট সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে আমার গাড়ি মেরামত করে দেওয়া হয়। ওই ছাত্র ও ছাত্রীকে বহিষ্কৃত করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারা আর ক্যাম্পাসে ফিরে আসেনি। তবে ছাত্রের বাবা মনে করেছিলেন, আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণেই–অর্থাৎ শিক্ষকদের দলাদলির ফলস্বরূপ–হয়তো তার ছেলেকে এমন শাস্তি পেতে হয়েছিল।
২২.
জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত সেমিনারের যে-রিপোর্টটি পরের বছরে প্যারিসে বসে তৈরি করেছিলাম, ১৯৮৩ সালের শেষদিকে তা ম্যাকমিলান প্রেস থেকে প্রকাশিত হলো লন্ডনে। প্রকাশক আমাকে যে-কপি পাঠিয়েছিল, তা পেতে সময় নিয়েছিল। শফিউল্লাহ্ লন্ডনে বইটি দেখে এক কপি কিনে এনে চট্টগ্রামে আমাকে উপহার দেন। কী যে আনন্দ হয়েছিল, তা অল্পকথায় প্রকাশ করা যায় না।
বইটির নাম Culture and Thought। দেখলাম, আনোয়ার আবদেল মালেক দুটি পরিবর্তন করেছেন আমার পাণ্ডুলিপিতে। সম্পাদক হিসেবে আমার নামটা আগে দিয়ে নিজের নাম পরে দিয়েছেন। আর অবতারণা অংশে এই গবেষণা-প্রকল্প সম্পর্কে প্রকল্প-পরিচালক আনোয়ার আবদেল-মালেকের ভাষণের একটা খণ্ডিতাংশ আমি উদ্ধৃত করেছিলাম, সেখানে তিনি নিজের লেখা সবটাই তুলে দিয়েছেন। আমাদের এই বইটি ছিল Transformation of the World’ সিরিজের–প্রকল্পের নামই ছিল তাই–তৃতীয় খণ্ড। আনোয়ার ছিলেন সিরিজের জেনারেল এডিটর বা সিরিজ-সম্পাদক। প্রথম খণ্ড Science and Technology বেরিয়েছিল আগের বছরে। দ্বিতীয় খণ্ড Economy and Society প্রকাশ পায় ১৯৮৪ সালে। পরিকল্পিত চতুর্থ ও পঞ্চম খণ্ডের নাম ছিল যথাক্রমে Religion and Philosophy 47° The Making of a New International order: A Prospective-এগুলো কবে বেরিয়েছিল, আমার ঠিক জানা নেই। সবকটি খণ্ডের আরবি অনুবাদ কায়রো থেকে এবং স্প্যানিশ অনুবাদ মেক্সিকো থেকে প্রকাশিত হওয়ার কথা–শেষ পর্যন্ত তা হয়েছিল কি না, বলতে পারি না।
ইংরেজি প্রত্যেকটি খণ্ডের জ্যাকেটেই ছিল জার্মান মানচিত্রকর আরুনো পিটার্সের অভিক্ষেপণে পৃথিবীর নতুন মানচিত্র–তবে কোনো অজ্ঞাত কারণে বইতে তাঁর স্বীকৃতি ছিল না। আর্ননা পিটার্স দাবি করেছিলেন যে, মারূকেটরের অভিক্ষেপণ ইউরোপকেন্দ্রিক, দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলি তাতে যথাযথ অনুপাতে রূপ পায়নি। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ তাদের প্রকৃত আয়তনের চেয়ে মারূকেটরের মানচিত্রে ছোটো মনে হয়, তুলনায় ইউরোপের বহু দেশকে বড়ো মনে হয় বটে, কিন্তু আসলে তারা তেমন নয়। এই ত্রুটি সংশোধন করে পিটার্স নতুন অভিক্ষেপণ-অনুযায়ী তাঁর মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। ভূ-পৃষ্ঠের দেশগুলো তাতে লম্বাটে দেখায়, তবে সেটা আসল নয়, আসল কথা তাদের আয়তনের যথার্থ প্রতিফলন।
২৩.
বাংলা সাহিত্যের মানসম্পন্ন ইতিহাসগুলোয় যেসব উপকরণ অবহেলিত হয়েছে কিংবা ওইসব বই প্রকাশের পরে যেসব উপাদান আবিষ্কৃত হয়েছে, সেসব বিষয়কে যথাযথ স্থান দিয়ে বাংলা সাহিত্যের একটি নতুন ইতিহাস রচনার চিন্তা অনেকদিন ধরে আমাদের অঞ্চলে দেখা দিয়েছিল। ১৯৬৮ সালে অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই আমাকে এমন একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে বলেন। বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্ন পরিচ্ছেদ লিখবেন এবং একটি সম্পাদকমণ্ডলী তা সম্পাদনা করে গ্রন্থের আকার দেবেন, এই ধারণার ভিত্তিতে আমি চার খণ্ডে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনার পরিকল্পনা প্রণয়ন করি। হাই সাহেব প্রস্তাবটি পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করলে মন্ত্রণালয় অনুকূল সাড়া দেয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে এক লক্ষ টাকার অনুদান মনজুর করে। মুহম্মদ আবদুল হাইকে সভাপতি, মুনীর চৌধুরী ও আহমদ শরীফকে সদস্য এবং আমাকে সদস্য-সচিব করে সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়। ১৯৬৯ সালে হাই সাহেবের মৃত্যুর এবং আমার চট্টগ্রামে চলে যাওয়ার পরে এ-বিষয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদ আবার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনার উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য বিষয়ে একটি এবং আধুনিক বাংলা সাহিত্য বিষয়ে অপর একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটি দুটি প্রাথমিক পরিকল্পনার কাজে কিছুদূর অগ্রসর হলেও খুব বেশিদূর যেতে পারেনি। ১৯৮৩ সালে আমি বিদেশ থেকে ফিরে এলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মনজুরে মওলা আমাকে এই দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ করেন।
আমাকে প্রধান সম্পাদক করে এবং আহমদ শরীফ, কাজী দীন মুহম্মদ, মমতাজুর রহমান তরফদার ও মুস্তাফা নূরউল ইসলামকে সদস্য করে সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়। আমার পরিকল্পনা-অনুযায়ী ইতিহাসটি বিন্যস্ত হবে পাঁচ খণ্ডে : প্রথম খণ্ডে থাকবে চোদ্দ শতক পর্যন্ত, দ্বিতীয় খণ্ডে পনেরো ও ষোলো শতকের, তৃতীয় খণ্ডে সতেরো ও আঠারো শতকের, চতুর্থ খণ্ডে উনিশ শতকের এবং পঞ্চম খণ্ডে বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের পরিচয়। প্রতি খণ্ডের থাকবে দুটি ভাগ–একভাগে ঐতিহাসিক পটভূমি অর্থাৎ বর্ণিত কালের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাসের আলোচনা থাকবে। দ্বিতীয়ভাগে থাকবে সে-সময়কার বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার পরিচয়। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ এক বা একাধিক অধ্যায় লিখবেন। সম্পাদকমণ্ডলী তাতে প্রয়োজনীয় সংশোধন-সংযোজন করবেন। আমার প্রস্তাবিত প্রথম খণ্ডের সূচি সম্পাদকমণ্ডলী অনুমোদন করলে লেখকদের রচনা আহ্বান করে পত্র দিলাম।
এরই মধ্যে মনজুরে মওলা একদিন আমাকে চট্টগ্রামে ফোন করে জানালেন, বাংলা একাডেমী বক্তৃতামালা প্রবর্তিত হতে যাচ্ছে এবং তিনি চান খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমি যেন প্রথম বক্তৃতাটা দিই। বক্তৃতার বিষয় তিনি আমার ওপরেই ছেড়ে দিলেন। কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে আমি সম্মত হয়ে গেলাম।
‘পুরোনো বাংলা গদ্য’ শিরোনামে লিখিত বক্তৃতা দিলাম ১৯৮৪ সালের ১৬, ১৭ ও ১৮ জানুয়ারিতে। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ববর্তী বাংলা গদ্য সম্পর্কে আমার সংগৃহীত মালমশলা এবং নিজস্ব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বক্তব্য উপস্থাপন করলাম। বক্তৃতার তিনদিনই অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক উপস্থিত ছিলেন। তাঁর হাবভাবে মনে হলো, নিতান্ত মন্দ হয়নি। কবীর চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে আমার বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। আমার কাছে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন কথাশিল্পী শওকত আলী, তাতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসেরও খানিকটা সায় ছিল।
আমাকে অবাক করে দিয়ে মনজুরে মওলা সঙ্গে সঙ্গেই বক্তৃতাটা ছাপতে অগ্রসর হলেন। তখন ওবায়দুল ইসলাম ছিল বাংলা একাডেমী প্রেসের দায়িত্বে। বইটা বের করায় তার উৎসাহ কারো থেকে কম ছিল না। শিল্পীকে প্রচ্ছদ আঁকতে দিলে দেরি হয়ে যাবে ভেবে সে নিজেই প্রচ্ছদ-পরিকল্পনা করলো, আমার তা ভালো লাগল। সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ প্রুফ দেখে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল। তবু চূড়ান্ত প্রুফ দিয়ে আবদুল হান্নান ঠাকুরকে চট্টগ্রামে আমার কাছে। পাঠালেন মনজুরে মওলা। সে একরাত আমার বাড়িতে থেকে আমাকে দিয়ে প্রুফ সংশোধন করিয়ে ঢাকা ফিরে গেল। অভাবিত ব্যাপার। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পুরোনো বাংলা গদ্য বেরিয়ে গেল।
গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সুধাংশু তুঙ্গ পুরোনো বাংলা গদ্যের কিছু নিদর্শন। আমাকে দিয়েছিলেন-আমার বইতে তার যথাযথ স্বীকৃতি ছিল। তাকে এক কপি বই পাঠালাম। তিনি একাধারে অভিভূত ও বিস্মিত। আমাকে লিখলেন, জানুয়ারি মাসের বক্তৃতা ফেব্রুয়ারিতে বই হয়ে বের হয়, এমন বোধহয় কেবল। বাংলাদেশেই সম্ভবপর। তিনি কবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছেন–তা পড়ে রয়েছে (বইটি বোধহয় ১৯৮৫ সালে প্রকাশ পায়)। বাস্তবিক, পুরোনো বাংলা গদ্য বইটি আমাকে দিয়ে লেখানো এবং অত দ্রুত প্রকাশ করার কৃতিত্ব বা দায়িত্ব মূলত মনজুরে মওলার।
অনেকদিন পরে মনজুরে মওলা আবার আমাকে ফোন করেছিলেন চট্টগ্রামে। সরকার আমাকে একুশে পদক দিতে চাইছে, আমি তা গ্রহণ করবো কি না জানতে চান। তাঁর অনুরোধ, আমার উত্তর যেন হাঁ-সূচক হয়। আমি একদিন সময় নিলাম। একুশে পদক রাষ্ট্রীয় সম্মান–তা পেলে আমি সম্মানিত হবো। কিন্তু যে-সরকার সেটি দিতে যাচ্ছেন, সে-সরকারের ঘোরতর বিরোধী আমি। রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্যের কথা বলা হয় বটে, কিন্তু আমাদের মতো দেশে সে-পার্থক্য নিতান্ত ক্ষীণ। তারপরও, রাষ্ট্রীয় সম্মান যে-সরকারই দেয়, আমি নেবো, এমন একটা ভাবা যেতে পারে হয়তো।
পরের দিন মনজুরে মওলা যখন ফোন করলেন, তখন সম্মতি জানালাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আমাকে একুশে পদক দেওয়ার ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী আবদুল মজিদ খানের উদযোগ কার্যকর ছিল। আমার সঙ্গে একুশে পদক আরো পেয়েছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী ও শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। গাফ্ফার চৌধুরী সরকারের বিরুদ্ধে যথেষ্ট লিখছেন তখন। শুনেছি, মজিদ খান। বলেছিলেন রাষ্ট্রপতি এরশাদকে : যার গান গেয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির সকাল হয়, তাঁকে একুশে পদক না দিতে পারা লজ্জার বিষয়।
একুশে পদকের ঘোষণার পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে আমার সহকর্মী ও ছাত্রেরা আমাকে সংবর্ধনা জানিয়ে একটি সুন্দর অনুষ্ঠান করেছিল।
২৪.
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট উপাচার্য-নিয়োগের জন্য তিনজনের নামের একটি প্যানেল তৈরি করবে। একপক্ষ থেকে মনোনীত হলেন ইংরেজির মোহাম্মদ আলী, রসায়নের এ কে এম শামসুদ্দীন আহমদ ও ইতিহাসের আলমগীর মোহম্মদ সিরাজউদ্দীন। আমরা দলে ভারি নই। তাই স্থির হলো, শুধু আমিই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবো এ-পক্ষ থেকে। কেউ কেউ প্রস্তাব করেছিলেন, বর্তমান উপাচার্য আবদুল আজিজ খানকে আমার সঙ্গে নিতে। উপাচার্য নিজেও তা চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমাদের মতের মিল খুব সামান্যই। সেক্ষেত্রে • একপক্ষভুক্ত হওয়া আমাদের কারো জন্যেই ঠিক হবে না। উপাচার্যও একাই নামলেন প্রতিযোগিতায়।
প্রথামাফিক সিনেট-সদস্যদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা করতে হলো। ব্যাপারটা আনন্দজনক নয়। ভোট চাইতে না গেলে যিনি স্বতই সমাদর করতেন, তিনি এখন উদাসীনতা দেখালেন। কেউ জানিয়ে দিলেন, অন্য প্রার্থীরাও তাঁর কাছে এসেছিলেন, এ-অবস্থায় তিনি বিপন্ন বোধ করছেন। কেউ বললেন, মুখ ফুটে কিছু বলার দরকার নেই, তিনি মোটের উপর ওয়াকিবহাল এবং যোগ্যকে বঞ্চিত করবেন না। সহকর্মীদের অনেকেই আমার জন্যে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছিলেন আন্তরিকভাবে।
নির্বাচনের ফল প্রকাশ পেলে দেখা গেল, মোহাম্মদ আলী সর্বাধিক ভোট পেয়েছেন, তারপর আমি, তারপর আলমগীর সিরাজউদ্দীন।
প্যানেলে যে-তিনজনের নাম থাকলো, এখন চান্সেলর তার একজনকে উপাচার্য নিয়োগ করবেন। তদৃবির শুরু হলো ক্ষমতার কেন্দ্রে। মন্ত্রী জেনারেল মাহমুদুল হাসানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় রেজাউল হকের সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের হামিদা বানুর পারিবারিক সৌহার্দ্য। সেই সূত্রে হামিদা জেনারেলের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করলেন। আমি ঢাকায় এলাম।
জেনারেল বললেন, ‘প্যানেলের যে-কাউকে প্রেসিডেন্ট ভাইস-চান্সেলর নিযুক্ত করতে পারেন। তবে যাঁকে করবেন, তাঁর কাছে তাঁর কিছু প্রত্যাশা থাকবে।
জানতে চাইলাম, ভাইস-চান্সেলরের কাছে চান্সেলরের আবার কী প্রত্যাশা?’
মাহমুদুল হাসান বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট রাজনীতি করেন, তার ছাত্র-সংগঠন আছে।
কথাটা বাড়তে না দিয়ে বললাম, ছাত্রদের মধ্যে নিরপেক্ষ থাকতে না পারলে কোনো ভাইস-চ্যান্সেলর বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে পারবেন না।’
জেনারেল বললেন, তার মানে আপনি আমাদের সাহায্য করবেন না?
বললাম, আমি মনে করি, ছাত্র-রাজনীতিতে ভাইস-চ্যান্সেলরকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে।’
এরপর চা-মিষ্টি খেয়ে বিদায়গ্রহণ।
অর্থনীতি বিভাগের মাহবুবউল্লাহ আমার পক্ষে চেষ্টা করতে অনুরোধ করেছিলেন বিচিত্রা-সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরীকে। মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও শাহাদাত একসঙ্গে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি এরশাদের কাছে।
পরে শাহাদাত আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, ‘আনিস ভাই, এরশাদ আপনার ওপর এত খ্যাপা কেন?’
বলেছিলাম, ‘নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।’
আমি যখন এ-ব্যাপারে ঢাকায়, তখন রাজ্জাক সাহেব আমাকে বলেছিলেন, ভাইস-চ্যান্সেলর হয়ে আমি কী করতে চাই, তা যেন একটা কাগজে লিখে ফেলি।
আমি পরিহাস করে বললাম, আমি যদি ভাইস-চান্সেলর হইতাম শিরোনামে রচনা?
সার বললেন, আপনি যদি অ্যাকাডেমিক কাজকর্ম করতে চান, তাইলে কী করবেন, তার একটা লিস্টি করা ভালো। যদি ফিজিকাল ডেভেলপমেন্ট করবার ইচ্ছা করেন, তয় সেক্ষেত্রে কী করবেন, তার একটা হিসাব করা ভালো। তা না হইলে রোজকার কাজের চাপে কিছুই করতে পারবেন না।
তখন মনে হয়েছিল, ব্যাপারটা গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেলের মতো। এখন। বুঝি, ওটা খুবই দরকারি বিষয়।
অল্প কয়েকদিনের মধ্যে অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীকে উপাচার্য নিয়োগ করলেন চান্সেলর।
২৫.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যাপকপদ থেকে নীলিমা ইব্রাহিম ও আহমদ শরীফ অবসর নিয়েছিলেন ১৯৮১ সালের ৩০ জুন। তারপর নীলিমা ইব্রাহিম এক বৎসরের জন্যে এবং আহমদ শরীফ দু বছরের জন্যে পুনর্নিয়োগ পেয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী তাঁদের পুনর্নিয়োগের কাল আরো বাড়ানো যেতো–সর্বমোট পাঁচ বছর–কিন্তু কারো ক্ষেত্রেই তা আর হয়নি। তার জন্যে কিছুটা দায়ী ছিল বিভাগের অন্তর্কলহ। ফলে নীলিমা ইব্রাহিম ১৯৮২ সালের ৩০ জুন এবং আহমদ শরীফ ১৯৮৩ সালের ৩০ জুন চূড়ান্ত অবসরে চলে যান। এর কিছুকাল পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল আজিজ খান আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, আহমদ শরীফকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা যায় কি না। আবদুল আজিজ খান ব্যক্তিগতভাবে আহমদ শরীফের অনুরাগী এবং তাঁর বিদ্যাবত্তায় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কাজী নজরুল ইসলামের নামে অধ্যাপকের একটি পদ সৃষ্টি করেছিলেন। সেটি উন্মুক্ত ছিল কেবল অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের জন্যে। অধ্যাপক আবুল ফজল ও অধ্যাপক আবদুল করিমের আগ্রহে একবার এই পদে ড. মুহম্মদ এনামুল হককে নিয়োগদানের প্রস্তাব আমি করেছিলাম। তখন ড. হক নিজেও এই পদে যোগ দিতে উৎসাহী ছিলেন। আমাদের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে হতে এনামুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন অধ্যাপকপদ লাভ করেন। সেটি ছেড়ে চট্টগ্রামে আসতে তাঁর আর ইচ্ছে হয়নি। এসব কথা আগে লিখেছি।
কাজী নজরুল ইসলাম অধ্যাপকের পদটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে খালিই পড়ে ছিল। উপাচার্যের ইঙ্গিত পেয়ে আমি যখন এর পরের বার ঢাকায় আসি, তখন আহমদ শরীফের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়ি গিয়ে তাঁকে ওই পদগ্রহণের মৌখিক আমন্ত্রণ জানাই। হেনা আপাকে (সালেহা শরীফ) বলি, দেখেন, আপনি আর্মানিটোলার বাড়ি ছেড়ে নীলক্ষেতে আসতে যেমন কান্নাকাটি করেছিলেন, ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম যেতে যেন তেমন কান্নাকাটি করবেন না। হাজার হোক, চট্টগ্রাম আপনার শ্বশুরবাড়ি। কতদিন আগের তাঁর সেই প্রবল কান্নার কথা মনে রেখেছি দেখে হেনা আপা খুশি হলেন, লজ্জাও পেলেন। মুখে বললেন, ‘দ্যাখো, তোমার সার রাজি হন কি না। উনি যদি যান, তখন দেখা যাবে ছেলেদের ফেলে আমি যেতে পারি কি না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ওই পদে তাঁর নিয়োগের প্রস্তাব করার অনুমতি আহমদ শরীফ আমাকে দিলেন।
এ-প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো। আহমদ শরীফ নিয়োগপত্র পেলেন। কদিন দেরি করে তিনি কর্মে যোগ দিতে এলেন। আমাকে বললেন, ‘শোনো। আমি ভেবে দেখেছি, ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে এসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি ঢাকায় বসে নজরুল সম্পর্কে গবেষণা করবো, চট্টগ্রামে এসে তিন মাস পরপর একটি করে বক্তৃতা দিয়ে যাবো। তোমাদের। নিয়োগপত্রেও উল্লেখ নেই যে, আমাকে চট্টগ্রামেই থাকতে হবে।’
উপাচার্যকে বিষয়টা জানালাম। তিনি মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। বললেন, ‘আমি আশা করেছিলাম, উনি এখানে থাকলে ছাত্রছাত্রীরা ওঁর সাহচর্য পাবে, তাতে তারা উপকৃত হবে। উনি হয়তো পিএইচ ডি পর্যায়ে গবেষণার তত্ত্বাবধান করবেন। শুধু বক্তৃতা দিতে এলে তার তো কিছু হবে না।’
এ কথা তো আমারও। পরে শুনতে পাই–সত্যমিথ্যা জানি না–আইনের মারপ্যাঁচে সিদ্ধ আমাদের এক ছাত্র-সহকর্মী শরীফ সাহেবকে বুঝিয়েছে, ‘নিয়োগপত্রে তো লেখা নেই যে, আপনাকে চট্টগ্রামে থাকতে হবে কিংবা রোজ সেখানে যেতে হবে। আপনি ঢাকা ছাড়বেন কেন? যে আমাকে কথাটা জানিয়েছিল, তাকে বলেছিলাম, আমাদের নিয়োগপত্রে কি ক্লাস নেওয়ার কথা লেখা থাকে? তাই বলে কি কেউ বলতে পারে, আমি ক্লাস নেবো কেন? সার কথাটা বিবেচনা করলেন না?
আহমদ শরীফকে এ-কথাটা বলতে পারলাম না। কেননা, তিনি ঠিক কাজ করছেন বলে নিজেকে বুঝিয়ে ফেলেছেন। এখন আমি একটা যুক্তি দিলে তিনি পাল্টা যুক্তি দেবেন দশটা। তর্ক করতে গেলে হয়তো বলে বসবেন, ‘তোমাদের চাকরির দরকার নেই আমার–আমি চললাম।
সুতরাং আহমদ শরীফকে আমরা চট্টগ্রামে পেয়েও পেলাম না। তিনি অবশ্য নজরুল-বক্তৃতা দিতে শৈথিল্য করেননি। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল-যে দুবছর তিনি ছিলেন, তখন নির্দিষ্ট সময় অন্তর-অন্তর তিনি বক্তৃতা দিয়ে গেছেন। বক্তৃতাগুলো পরে একালে নজরুল (ঢাকা, ১৯৯০) নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বইটি তিনি উৎসর্গ করেন এভাবে : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল আজিজ খান প্রীতিনিলয়েষু এবং অধ্যাপক এ. টি. এম. আনিসুজ্জামান প্রিয়বরেষু।’ বইতে কোনো ভূমিকা বা মুখবন্ধ নেই। আখ্যাপত্রের উলটো পৃষ্ঠায় যেখানে ইংরেজিতে বইয়ের পরিচয় দেওয়া হয়, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এতে সংকলিত বক্তৃতাগুলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজী নজরুল ইসলাম অধ্যাপকরূপে প্রদত্ত।
২৬.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরে অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী যখন চট্টগ্রামে আসেন, তখন তিনি ক্যাম্পাসে আমার বাড়িতেও এসেছিলেন। আমার প্রতি তাঁর-পরশুরামের ভাষায়–’অহৈতুকী’ প্রীতি ছিল। তাঁর স্ত্রী ও বেবী যে সহপাঠিনী, তাও তিনি মনে রাখতেন। আমাকে তিনি জিগ্যেস করলেন, বলেন তো, আপনাকে ঢাকায় নেওয়ার ব্যাকরণটা কী?’ আমি বললাম, এটা নিয়ে এত কাদা ছোঁড়াছুড়ি হয়েছে যে আপনার আর নিজের হাত নোংরা না করাই উচিত। অধ্যাপক চৌধুরী আরো দু-একবার পরোক্ষে কথাটা তুলেছেন, আমিও এড়িয়ে গেছি। ব্যাপারটা তার বেশি আর অগ্রসর হয়নি।
তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল হকও আমাকে বললেন, ‘এবারে ঢাকায় চলে আসেন–এখানে তো অনেকদিন হলো, আর কত? একসময়ে আমাকে বললেন, বাংলার প্রফেসরশিপ অ্যাডভার্টাইজড হবে শিগগির, অবশ্যই অ্যাপ্লাই করবেন।’ বিজ্ঞাপন বের হলো, তারপরও আমি নড়াচড়া করিনি। আমি একবার ঢাকায় এলে বাংলা বিভাগের মোহাম্মদ আবু জাফর একটা আবেদনপত্র নিয়ে এসে বললো, আপনি এখানে সই করে দিন, আর কিছু করতে হবে না। নিয়োগ পেলে তখন আপনি ভাববার সময় পাবেন, আসবেন কী আসবেন না। আমি স্বাক্ষর দিলাম, বাকি কাগজপত্র সে-ই কোত্থেকে জোগাড় করে আবেদনপত্র জমা দিয়ে দিলো। জাফরের অসাধ্য কিছুই নেই।
চট্টগ্রামে ফিরে যখন বেবীকে ঘটনাটা বললাম, মনে হলো, সে বেশ খুশিই হয়েছে। ছেলেমেয়েরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, এমন ইচ্ছে সে পোষণ করতো। দুই মেয়ে ঢাকায় পড়তে এলে আমাদেরও চলে আসতে হবে, এটাও সে ভেবে রেখেছিল। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মের জন্যে আমি যে আবেদন করেছি, তা তার ভালোই লেগেছিল।
দরখাস্ত জমা দেওয়ার তারিখ চলে যাওয়ার পরে নির্বাচকমণ্ডলীর সভা আর বসে না। উপাচার্যের কথার সুরও পাল্টে যায়। যিনি আমাকে আনতে ব্যগ্র ছিলেন, তিনি বলেন, ‘ভেবে দেখেন, আসবেন কি না। যদি না-আসার সিদ্ধান্ত নেন তাহলে অ্যাপ্লিকেশন উইথড্র করে একটা চিঠি লিখে দেবেন। যিনি বলেছিলেন, চট্টগ্রামে আমি আর কত দিন থাকবো, তিনি বলেন, আপনি ওখানেই ভাইস-চ্যান্সেলর হয়ে যাবেন, কী হবে ঢাকায় এসে!’ তাঁর ভাবান্তরে আমি আহত হই, কিন্তু বিস্মিত হই না। জানতে পারি, নির্বাচকমণ্ডলীর সভা দেরি করে ডাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তাঁকে–যাতে কর্মে যারা আমার অনুবর্তী, তাঁরা যেন অধ্যাপকপদে নিযুক্তিলাভের ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ পান।
শেষ পর্যন্ত নির্বাচকমণ্ডলীর অধিবেশন ঘটে। বিজ্ঞাপিত পদে এবং পদোন্নতি লাভ করে অধ্যাপক নিযুক্ত হন চারজন : আমি, সৈয়দ আকরম হোসেন, ওয়াকিল আহমদ ও আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ। যেহেতু চট্টগ্রামের পাট চুকিয়ে আসতে আমার সময় লাগবে আর অন্যেরা নিয়োগপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যোগ দিতে পারবেন, সেহেতু আমি হবো কর্মে সবার কনিষ্ঠ।
ততদিনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে মোহাম্মদ আলীর নিয়োগ হয়ে গেছে। আমার সম্পর্কে অত্যন্ত রুচিবিগর্হিত একটি প্রচারপত্র ছড়ানো হয়েছে। তার আগে কলা অনুষদের এক সভায় অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজউদ্দীনের সঙ্গে আমার সংঘাত এমন পর্যায়ে গেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কার্যকারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করতে বাধ্য হয়েছে। সুতরাং চট্টগ্রামের সঙ্গে আমার বাঁধন কাটতে শুরু করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগপত্র বোধহয় পেলাম মে মাসে। নিয়োগ গ্রহণ করে চিঠি দিলাম। বললাম, কর্মে যোগদানের জন্যে আমাকে মাসতিনেক সময় দিতে হবে।
সময় চাইবার দুটি কারণ ছিল। রুচি ততদিনে তার নানাবাড়িতে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স পড়ছে। শুচির এসএসসি পরীক্ষার সময়। ঘনিয়ে এসেছে। চট্টগ্রাম ছাড়ার কথা উঠলেই সে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়। সুতরাং বিষয়টি সম্পর্কে আমরা সিদ্ধান্ত নিইনি, তাকে এটা বোঝানো দরকার।
দ্বিতীয়ত, ১৯৮৫ সালে আমার মাসিক বেতন সর্বসাকুল্যে তিন হাজার টাকা। অচিরে নতুন বেতনক্রম চালু হবে। কর্মে জ্যেষ্ঠতা-অনুযায়ী অধ্যাপকদের এক-চতুর্থাংশ সর্বোচ্চ বেতনলাভের যোগ্য হবেন। অর্থাৎ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলে জুলাই মাসে আমার বেতন হয়ে যাবে ছয় হাজার টাকা। সেটা নিয়ে ঢাকায় যোগ দিলে আমার মাইনে ছয় হাজারই থেকে যাবে।
অতএব, আগস্টের কোনো এক সময়ে ঢাকায় যোগ দেবো বলে স্থির করলাম।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরগ্রহণের আবেদন যখন করলাম–শুভানুধ্যায়ীরা বললেন, অবসর নিলে পেনশনের পুরো সুবিধে পাবো, নইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী পেনশনের জন্যে আমার ২৬ বছরের চাকুরিজীবনের মোট দশ বছর গণ্য হবে হিসেবে; আরো পনেরো বৎসর চাকরি করলে তবে পুরো পেনশন পাবো, পনেরো বছর যে বেঁচে থাকবো, তার নিশ্চয়তা কী–তখন বিভাগের এবং বিভাগের বাইরের অনেক সহকর্মীই চাইলেন, আমি থেকে যাই। শহর থেকে বন্ধু ও অনুরাগীরা এসে অনুরোধ জানাতে থাকলেন, আমি যেন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করি।
আমাকে অবাক করে দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা আমার বাড়ির সামনে অবস্থান ধর্মঘট করতে শুরু করে দিলো। একদিন নয়, দুদিন নয়, বহুদিন–এক ঘণ্টা নয়, দুঘণ্টা নয়, অনেক সময়। একবার তো তাদের সরাতে উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারকে আসতে হলো। আমি তো অভিভূত, অন্য বিভাগের সহকর্মীরাও অবাক। চট্টগ্রামের সংবাদপত্রে এই অভূতপূর্ব ঘটনার সংবাদ বের হলো।
এই ভালোবাসা ঠেলে ফেলে আসতে আমার খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি জানি, আমাকে যেতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে আরেকটা চিঠি দিয়ে জানালাম, ১৯ আগস্ট তারিখে ঢাকায় যোগ দেবো।
দু-একদিন পর দুপুরে উপাচার্য মোহাম্মদ শামসুল হকের ফোন এলো। বেশ রাগতস্বরেই বললেন, কী, আমার সঙ্গে কথা না বলেই আপনি জয়েন করার তারিখ ঠিক করে ফেলেছেন!
আমি অবাক। নিয়োগ-প্রস্তাব গ্রহণ করেছি, যোগদানের জন্যে মাসতিনেক সময় চেয়েছি। কাজে যোগ দিতে উপাচার্যের সঙ্গে তারিখ ঠিক করতে হবে কেন?
আমি মিনমিন করে কিছু একটা বললাম। উপাচার্য বললেন, না, ১৯ তারিখে আপনি যোগ দেবেন না। আমি পরে আপনাকে জানাবো, কবে যোগ দিতে হবে।’
বাংলা বিভাগের সভাপতি তখন রফিকুল ইসলাম। দু-একদিন আগেই তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে এসেছিলেন। তার কাছে এমন কোনো আভাস তো পাইনি। ফোন করলাম তাকে। তিনি বললেন, এ-বিষয়ে তিনি বিন্দুবিসর্গ জানেন না, কেন যে ভাইস-চান্সেলর আমাকে দেরি করে যেতে বলছেন, তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
ঢাকায় ফোন করলাম অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে। তিনি রেগেমেগে ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন, কবে থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে হলে ভাইস-চান্সেলরের অনুমতি নিতে হয়?
ড. কামাল হোসেনকে ফোনে সব জানালাম। তিনি বললেন, উপাচার্যের মৌখিক উপদেশ আমি অগ্রাহ্য করতে পারি। আমি যেন ঈপ্সিত তারিখে কাজে যোগ দিই। কর্তৃপক্ষ বাধা দিলে মামলা করে দেবেন।
ড. মোজাফফর আহমদকেও বলি ব্যাপারটা। তিনি বললেন, এ তো বড়ো অন্যায় কথা। কাউকে দিয়ে বলানো দরকার যে, কাজটা উনি ঠিক। করছেন না।’ মোজাফফরের যাওয়ার কথা ছিল দেশের বাইরে–সেটা তিনি স্থগিত করলেন।
এবার চট্টগ্রামের উপাচার্যকে গিয়ে ধরলাম। সব কিছু খুলে বলে অনুরোধ করলাম, আমাকে অব্যাহতিদানের তারিখ পিছিয়ে দেওয়া যায় কি না, তা বিবেচনা করতে (সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অবশ্য হয়ে গেছে, কিন্তু সে-সিদ্ধান্ত তখনো আমাকে লিখিতভাবে জানানো হয়নি)। বোধহয় পরদিন–ছুটির দিনে–ফোন করে উপাচার্য তাঁর বাড়িতে ডেকে নিলেন। দেখলাম, আলমগীর সিরাজউদ্দীন আগেই পৌঁছে গেছেন। তিনি আমার উপস্থিতিতে উপাচার্যকে বললেন, অবসরগ্রহণের তারিখ একবার স্থির হয়ে গেলে আইনত সেটা আর বদল করা যায় না। তিনি ব্যারিস্টার, আইন ভালো জানেন।
উপাচার্য বললেন, ‘শুনলেন তো, তারিখ বদলানো যাবে না।’
ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম।
শহরের বন্ধুবান্ধবেরা চারুকলা কলেজের প্রাঙ্গণে আমাকে বিদায়-সংবর্ধনা জানানোর আয়োজন করেছেন সেদিনই। আমার ত্রিশঙ্কু অবস্থার কথা দু একজনকে চুপি চুপি বলেছিলাম। তারা ‘বিদায়’ কথাটা উহ্য রেখে আর যা যা করার সবই করলেন। এত ভালোবাসা রাখবো কোথায়!
শামসুল হক সাহেবকে ফোন করলাম। বললাম, ‘১৮ তারিখেই এখানে। আমার কাজ শেষ। ১৯ তারিখে ঢাকায় যোগ না দিলে আমাকে বেকার থাকতে হবে–চাকরিজীবনে ছেদ পড়বে। ভবি ভুললেন না।
জাফর ফোন করে খবর নিচ্ছে কী হলো। আমি ফোন করলাম আমার বন্ধু ও শামসুল হক সাহেবের ছাত্র–পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক–অজয় রায়কে। তাকে অনুরোধ করলাম উপাচার্যের কাছে যেতে। তিনি গেলেন ঠিকই, কিন্তু কাজ হলো না।
ফোন করলাম বন্ধু নুরুল হককে। তার মাধ্যমেই ১৯৫৩ সালে পরিচয় হয়েছিল তার শিক্ষক শামসুল হকের সঙ্গে। নুরুল হক নিজে গেলেন না, কিন্তু তাঁর বন্ধু এম সাইদুজ্জামানকে আমার দুরবস্থার কথা বললেন। সাইদুজ্জামান। শামসুল হক সাহেবের ছাত্র, তখন অর্থমন্ত্রী।
এবারে কাজ হলো। শামসুল হক সাহেব নিজেই ফোন করলেন। বললেন, ‘আপনি আবার সাইদুজ্জামানকে বলতে গেছেন কেন? ঠিক আছে, ১৯ তারিখে আসেন। আগে আমার সঙ্গে দেখা করবেন, তারপর জয়েন করতে যাবেন। ডিপার্টমেন্টে।
১৮ তারিখ রাতের ট্রেনে ঢাকা রওনা হবো। স্টেশনে লোকে লোকারণ্য। সহকর্মীরা ক্যাম্পাস থেকে এসেছেন, শহরের নানা জায়গা থেকে এসেছেন। ছাত্রছাত্রীরা এসেছে–কোনো কোনো ছাত্রী বা প্রাক্তন ছাত্রীর সঙ্গে তার স্বামীও রয়েছেন।
এ কদিন এ এফ রহমান হলের দারোয়ান-মালিরা–মুনশী মিয়া, আবুল খায়ের, জয়নাল, আমীর হোসেন–বিভাগের পিয়ন আলী অমানুষিক পরিশ্রম। করে আমার জিনিসপত্র বাঁধাবাঁধি করেছে। সেসব রেখে যাচ্ছি পরে নিয়ে যাবো বলে। তবে ওরা সকলেই এসেছে স্টেশনে। অনুষদের কেরানি-পিয়ন এসেছে, বিভাগের সহকারী আবদুর রশীদ এসেছেন।
সাড়ে দশটায় গাড়ি ছাড়লো।
স্বামীবাগে শ্বশুরবাড়িতে এসে উঠলাম। নাশতা খেয়ে ছুটলাম উপাচার্যের দপ্তরে। উপাচার্য সমস্ত ব্যাপারটা হালকা করে উড়িয়ে দিলেন। কেন আমি এত উদৃবিগ্ন হয়েছিলাম, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি বললেন, এখান থেকে বেরিয়ে ডিপার্টমেন্টে যান-সেখানে জয়েনিং রিপোর্ট দিয়ে সোজা বাড়ি চলে যাবেন।
বললাম, সার, আপনি যদি অনুমতি দেন, আজ রাতেই চট্টগ্রামে রওনা হই। জিনিসপত্র আনতে দুদিন সময় লাগবে।
শামসুল হক বললেন, ‘তা যান। তবে ওদিকে যাবেন না।’
‘কোনদিকে সার?’
‘ওই টিএসসির দিকে।’
এতক্ষণে বুঝলাম। কলা অনুষদের ডিনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। টিএসসিতে আজ ভোটদান ও গণনা। প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের সঙ্গে ইতিহাসের আবদুল মমিন চৌধুরীর। মনিরুজ্জামান উপাচার্যের দলীয় লোক। উপাচার্যকে বোধহয় কেউ কেউ বলেছে যে, আমি মমিন চৌধুরীকে ভোট দেবো, সেজন্যে ঠিক নির্বাচনের দিনেই যোগ দিচ্ছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ব্যাপারটা আগে জানলে উনিশের বদলে বিশে যোগ দিতাম। উনিশ-বিশে পার্থক্য যে সামান্য নয়, সে জ্ঞান হলো।