কলকাতার ভাষা ও সাহিত্য
ভাষার কথা মনে পড়ল আমার বড়বাজারের রতন সরকার গার্ডেন স্ট্রিটে এসে। কেন, সে কথা পরে বলছি। তার আগে, আমার মতো আপনারাও নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, কলকাতা শহরে সম্প্রতি ভাষাশিক্ষার কেমন একটা প্লাবন জেগে উঠেছে। অফিসের ফেরার পথে, এমনকী টিফিনে কেরানিরা, কলেজের পরে ছাত্ররা অ-আ-ক-খ’র বই নিয়ে ছুটছে ‘রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতি’র কেন্দ্রের দিকে অথবা ফরাসি জার্মান কিংবা রুশ ভাষার ক্লাস করতে। কেন সহসা এমন ভাষা-ভূত চেপে বসেছে শহরের স্কন্ধে, তা অবশ্য এদের অধিকাংশই জানে না। বরং তার চেয়ে কিছু কিছু বলতে পারেন তাদের অভিভাবক কিংবা হিতাকাঙ্খী বন্ধুরা।
আমার প্রতিবেশী এক ভদ্রলোকের একমাত্র পুত্রসন্তানটি এবার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। ভদ্রলোক ইতিমধ্যেই মহা ভাবিত হয়ে পড়েছেন ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কী করবেন, কী না করবেন, কিছুতেই কিছু ঠিক করে উঠতে পারছেন না। অবশেষে সেদিন বললেন, ‘ঠিক করে ফেলেছি বুঝলেন। তবে দু’ বছর টাইম নেবে। তা নিক, তবুও এই একমাত্র পন্থা। জওহরলালজি থেকে শুরু করে আমাদের বড়বাবু পর্যন্ত সবার এই এক পরামর্শ। বিদেশি ভাষা শেখো। দু’ চারটে না পারো, অন্তত একটা।’
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তা কোনটা আপনার পছন্দ?’
‘আমার পছন্দ বলবেন না, বলুন, কোনদিকে হাওয়ার গতি, দেশের প্রয়োজন কোনটির। আমি ঠিক করেছি, নন্তুকে রাশিয়ান শেখাব। এক বছর রাশিয়ান, এক বছর শর্টহ্যান্ড। দু’বেলা দুটো চালিয়ে গেলে এক বছরেই তৈরি হয়ে যাবে। সময়ও লাগবে কম, পয়সাও তাই। কী হবে বাবা আই.এ. বি.এ. পড়ে, সেই তো স্কুল মাস্টার। কী বলেন আপনি?’
আমি বললাম, ‘তা ভাল, কিন্তু হঠাৎ রাশিয়ান…’
ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘হঠাৎ নয় বাবা, খবরের কাগজ পড়ি। তিরিশ বছর ধরে নিয়মিত পড়ে আসছি আর ওদের হালচাল বুঝি না? দেখবেন রাশিয়া নির্ঘাত বিজ্নেস একস্প্যান্ড করবে এদিকে।’
এই ভদ্রলোকের মতো অনেক ভদ্রসন্তান রীতিমত আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি স্টাডি করে ভাষা শেখায় মত্ত হয়েছেন নিজেরা, অথবা পরামর্শ দিয়ে বেড়াচ্ছেন অন্যদের লেগে পড়তে। সম্প্রতি কাগজের সংবাদ, ৭ হাজার লোক এখন বিদেশি ভাষা শিখছেন কলকাতায়। হিন্দি, ফরাসি, জার্মান, রাশিয়ান, বাংলা ইত্যাদি। তাঁদের ভাগ করা যায় এভাবে, রাজনীতিপরায়ণ ব্যক্তিরা হিন্দি, ইনটেলেকচুয়ালরা ফরাসি, ভাবী ইঞ্জিনিয়াররা জর্মান এবং বামপন্থীগণ (বুলগানিন-ক্রুশ্চেভের পর পূর্বকথিত দক্ষিণপন্থীরাও এর অন্তর্গত) রুশ। এর মধ্যে এক ভদ্রমহিলা নাকি আচার্য বিনোবার বক্তৃতা শোনার এবং হৃদয়ঙ্গম করার জন্য হিন্দি শিখছেন। তাঁকে বাদ দিন। বাদ দিন রাজকাপুর-নার্গিসের অভিনয় ভাল করে বোঝার জন্য যে যুবকটি হিন্দি শিখছে, তাকেও। তা হলে দেখা যাবে নব্য ভাষা-শিক্ষার্থীরা সংখ্যায় সাত হাজারের কিছু কম অর্থাৎ ছ’ হাজার ন’শো আটানব্বই। আমি এই প্রায়-সাত হাজার চাকুরি-অন্বেষু বন্ধুদের শুধু পরামর্শ দিতে চাই একটু।
১৯৫১ সালের সেন্সাস রিপোর্ট মতে কলকাতায় এখন ভাষা চালু আছে ৮০টি। তার মধ্যে বাংলা ছাড়া ভারতীয় ভাষা ৫০টি। হিন্দি-উর্দু-গুজরাতি-তামিল-ওড়িয়া এসব। আর বাদবাকি ৩০টি হচ্ছে অ-ভারতীয়। অর্থাৎ ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, চিনা, রুশ ইতালীয়, আফ্রিকান ইত্যাদি। সবচেয়ে কম চালু যে ভাষাটি তাতেও অন্তত ১০০ জন কথা বলে এ শহরে। সুতারং ধরে নিচ্ছি একশো জন অন্তত এখনই রুশ জানে কলকাতা শহরে এবং তার চেয়ে বেশি লোক জানে জার্মান। তা হলে আপনি কী করে আশা করেন এদের আগেই চাকরি হয়ে যাবে আপনার? কখনও ভাববেন না এরা সবাই কর্মনিযুক্ত কিংবা উপযুক্ত যোগ্যতাহীন।
তেরোটি ভারতীয় এবং অ-ভারতীয় ভাষা জানেন এমন লোককে আমি চিনি। তিনি এই কলকাতার কোনও স্কুলের ষাট টাকা মাইনের ক্লাসিক্যাল ল্যাংগোয়েজ অর্থাৎ সংস্কৃতের শিক্ষক। কলকাতার অন্য একটি স্কুলের ভূতপূর্ব সংস্কৃত শিক্ষককে আমি ডালহৌসিতে দেখেছি ভিক্ষে করতে। ইউ.এস.আই.এস-এর পাঠকক্ষে দেখেছি আমি ফরাসি-ইতালিয়ান জানা ভদ্রলোককে দিনের পর দিন বসে উইমেনস্ হোম জার্নালের পাতা ওলটাতে। সুতরাং আমার পরামর্শ, হরিনাথ দে ছেড়ে রতন সরকারের পথ ধরুন।
বোধ হয় চিনতে পারলেন না রতন সরকার মশাইকে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ স্ট্রিট চেনেন? দেখবেন তাকে ঘিরে চার-চারটে রাস্তা আছে রতন সরকারের নামে। রতন সরকার গার্ডেন স্ট্রিট, তস্য ফার্স্ট লেন, সেকেন্ড লেন এবং রতু সরকার লেন। কলকাতার ক’টা লোকের নামে চারটে রাস্তা আছে? অবশ্য এই মুহূর্তে আছে কিনা সঠিক জানি না। কারণ, যে হারে শহরের পথের নাম বদল হচ্ছে তাতে কিছুই বলা যায় না।
যা-হোক, ১৬৭৯ সালের কথা। প্রথমে ব্রিটিশ জাহাজ এসে পৌঁছেছে গার্ডেনরিচে। শেঠ বসাকেরা ছুটোছুটি করে গেলেন অভ্যর্থনা জানাতে। কথাবার্তা হল কাপ্তেনের সঙ্গে। কিন্তু কেউ কারও কথা বুঝতে পারেন না। দু’দলেরই আজব বুলি৷ কাপ্তেন স্টাফোর্ড তখন বললেন, একজন দো-ভাষীর সন্ধান দিতে। এই কথাটাও বলতে হল তাঁকে ইংরেজিতেই। বসাক মশাই ভাবলেন সাহেবের বুঝি ধোপা চাই একজন। ছুটে এসে রতুকে পাঠিয়ে দিলেন সেখানে। পরামাণিকেরই বুদ্ধি আছে রজকের নেই ইতিহাস তা বলে না। রতন সরকার বিলক্ষণ বুদ্ধিমান ছিল। ব্যাপার দেখে সে ছুটে পালিয়ে এল না শেঠ মহাশয়ের কাছে। ‘ইয়েস’, ‘নো’ বলে দিব্যি চালিয়ে নিল কাজ। সাহেব তো মহাখুশি। কী বিপদেই না পড়েছিল তারা। তখনও ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ বসেনি যে, ফারসি কিংবা উর্দু জানা ছোকরা সিভিলিয়ান দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে। সুতরাং, স্থায়ী দোভাষী হিসেবে থেকে গেল রতন সরকার। কোম্পানির আনুকূল্যে লক্ষ্মীও অনুকূল হলেন তার প্রতি। আর কাপড় কাচতে হল না বেচারাকে। রতন সরকার প্রভূত ধন-সম্পত্তির মালিক হলেন। আজ দুশো আড়াইশো বছর পর তাঁর নামে চারটে রাস্তা। আর হরিনাথ দে?
তাই বলি—রতন সরকারকেই আদর্শ করুন কলকাতার ভাষা-রোগীরা। মনে রাখবেন ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের নিয়ম এক্ষেত্রেও খাটে। বেশি লোক একাধিক ভাষাভাষী হয়ে গেলে, সবাই কাজ পাবে কী করে? দেখলেন তো, রতু সরকার কাজ পেয়ে গেল অথচ ‘নেসফিল্ড’ মুখস্থ করেও আজ কর্মহীন কত লোক দেশে। গতকল্যের ইংরেজির যা ঘটে গেছে, আগামীকল্য রুশ ভাষারও তাই ঘটবে। ‘একসপ্যান্ড’ করুক না রাশিয়ানরা। লোকের দরকার হলে, তখন চাইবেই। আর যোগ্য লোক না থাকে তো, আমাদের মতো রতু সরকারদেরই বাধ্য হবে লাগিয়ে দিতে। বুদ্ধিমানের মতো তাই অপেক্ষা করুন। অনেক কম ঝঞ্ঝাট এবং সেই সঙ্গে অনেক কম প্রতিযোগিতা হবে এই পথে। কারণ ইংরেজি ব্যাকরণ মুখস্থ করা আর ‘রতু সরকার’ হওয়া এক মাথার কর্ম নয় জানবেন।
তা ছাড়া, ভাষার ব্যাপারে বাহ্যত নির্বোধেরাই চিরকাল জয়ী হয়ে আসছে কলকাতা শহরে। অন্তত কলকাতার ইতিহাস তাই বলে।
আমাদের এই ২নং ‘নির্বোধ’ ব্যক্তিটি একজন ইংরেজ সিভিলিয়ান। নাম মিঃ হেনরি পিটস ফরস্ট্যার। ভবানীপুরের লোকেরা বলেন, ‘হাবা-ফ্রস্টার’। তাঁর একটা বাড়ি ছিল রসা রোড আর চৌরঙ্গির যোগস্থলে। জাস্টিস দ্বারকানাথ মিত্রের বাড়ির ঠিক উলটো দিকে। বাড়ির সঙ্গেই ছিল মস্ত এক পুকুর আর তার মাঝখানে একখানা ‘জলটুঙ্গি’। কথিত আছে ফরস্টার সাহেবের জাঠ-গিন্নি স্নান করতেন ওটাতে। ফরস্টার সাহেব বিগত হলে এক বাঙালি বাবুর অধিকারে আসে বাড়িটি, তারপর ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের হাতে। ভেঙে ফেলার আগে পর্যন্ত চাঁদনি রাতে ও পাড়ার লোকেরা বেড়াতে আসত এখানে, ফরস্ট্যারের ‘বোকা-ঘরে’। ছেলেরা পিকনিক করত সেই ‘বোকার’ জলটুঙ্গিতে।
কী কারণে ফরস্ট্যার বোকা বনে গেলেন ওদের কাছে, জানি না। কিন্তু ইতিহাস পড়ে জেনেছি, লোকটি ছিলেন প্রথম শ্রেণীর চিত্রকর, তার ওপরে তখনকার কালের শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ। ১৭৯৯ সালে তিনি দুই খণ্ডে বের করেছিলেন একখানা শব্দকোষ বই। ‘A Vocabulary…English and Bengalee, vice-versa’! ইংরেজি থেকে বেশ কিছু আইনের বইও বাংলায় অনুবাদ করেছেন তিনি।
শুধু তাই নয়, শোনা যায় বাংলা ভাষা যে সরকারি ভাষা তথা সাহিত্যের ভাষারূপে গৃহীত হয়েছিল তখনকার দিনে, সেও তাঁরই অক্লান্ত চেষ্টায়। ‘নির্বোধ ফরস্টারের’ উদ্যোগে।
কলকাতার যেমনি লাট-ভাগ্য, তেমনি সাহিত্য-ভাগ্য। মোগলাই-দিল্লি, ক্যাথলিক-মাদ্রাজ কিংবা বৈদিক-বারাণসী—শহর-কুলে এ ব্যাপারে কারও সঙ্গে এর তুলনা চলে না। এমনকী বোধহয় তুলনা চলে না দূরের স্বপ্নের শহর লন্ডনের সঙ্গেও। এমন বনেদি শহর হয়তো আরও অনেক আছে, কিন্তু এমন কালচার্ড সিটি মেলে দৈবাৎ। বাস্তবিক, সাহিত্য-দৌলতে কলকাতা অদ্বিতীয়। স্বয়ংসম্পূর্ণ একখানা লাইব্রেরি হতে পারে তাকে নিয়ে লেখা পুঁথিপত্রের। এবং গত পঁচিশ-ত্রিশ বছরের বঙ্গসাহিত্যের সমুদয় ফসলকে (যা স্বভাবতই ক্যালকাটা প্রডাক্ট অথবা বাই প্রডাক্ট) বাদ দিয়েই সে গুদাম ভরে যাবে। কী চাই? সব আছে। গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ স্মৃতিকথা, আত্মকথা, পত্র-সাহিত্য, জার্নাল, ছড়া, কীর্তন, পাঁচালী, এমনকী ইতিহাস-ভূগোল-স্বাস্থ্য কোনওটির কমতি নেই। মায় রম্য রচনাও। আশ্চর্য এই, প্রতিটি বইয়ে কলকাতা নায়িকা। গ্রন্থকার লেখিকা হলে অবশ্য ‘নায়ক’। কালভেদ নেই, রুচিভেদ নেই, বয়ঃসীমার প্রশ্ন নেই, প্রথম দিনটি থেকে এই বার্ধক্যেও কলকাতা সাহিত্যিকের যৌবনবতী নায়িকা। শহরকুলে উর্বশী।
উর্বশীকে পেয়ে দেব-সাহিতের উৎকর্ষ কিংবা অপকর্ষ হয়েছিল কিনা জানি না, তবে কলকাতাকে ধরে যে ইঙ্গ এবং বঙ্গ উভয় সাহিত্যই স্ফীত কলেবর হয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এমনই এ শহরের গুণ, যে-ই পা দিয়েছে এখানকার মাটিতে, দু’চার ছত্র অমনি বের হয়ে গেছে তার কলমে। চিঠির প্যাডেই হোক, আর ডায়েরির পাতায়ই হোক। ফলে কলকাতা-সাহিত্যে বইয়ের মলাটে যাঁদের নাম, তাঁদের মধ্যে শুধু সাহিত্যিক নয়, আছেন অনেক রথী-মহারথী, লাট-বেলাট, সাবঅলর্টান, গিন্নি, রাইটার-প্রিয়া ইত্যাদি। তদুপরি সাহিত্যিক তো আছেনই। কিপলিং থেকে শুরু করে একালের জন মাস্টার্স, হুতুম-পেঁচা, ভুতুম-পেঁচা থেকে আমি এই অধম পর্যন্ত। কলকাতা সাহিত্যে এঁরা সংখ্যা-লঘিষ্ঠ। সুতরাং এঁদের কথা পরে হবে।
কলকাতা সাহিত্য দেখেশুনে এর একটা স্পষ্ট ধারা আমি আবিষ্কার করেছি। সেটা আগে থেকেই বলে দিই। তা হলে অনেক অহেতুক শ্রম বেঁচে যাবে আপনাদের। প্রথমেই দেখবেন, লেখকটি কে? যদি দেখেন, সত্যিকারের একজন লেখকই তবে রেখে দেবেন। সময়ে অসময়ে পড়বেন। যদি দেখেন লেখক লর্ড অমুক, তা হলে বইটির যে নামই থাকুক ধরে নেবেন আত্মজীবনীমূলক। নিশ্চিন্ত জানবেন, তার বিষয়বস্তু: আমি কেমন করে এই শহর এবং সাম্রাজ্য গড়লাম। যদি দেখেন লেখক তারই অধস্তন কোনও কর্মচারী, তবে জানবেন তার বইয়ের মর্মার্থ হচ্ছে: আমার প্রভু কী অসীম বীরত্ব এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিবলে বাইরের প্রবল শত্রু এবং ভিতরের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে রাজত্ব করেছেন, তারই কাহিনী। এ বইয়ের বিশেষ দ্রষ্টব্য হচ্ছে এই সব ঘটনাই লেখকের চোখের সামনে ঘটা। এ ছাড়া, যদি দেখেন লেখিকা, তবে সঙ্গে সঙ্গে জানতে চেষ্টা করুন, উনি কোন ঘরের। সেটা কঠিন কাজ নয়। ভূমিকাটুকুই তার জন্যে যথেষ্ট। যদি দেখেন লেখিকার পৃষ্ঠপোষকদের তালিকাটি বেশ ভারী, তবে ধরে নেবেন তার বই কয়েকটি বড় বড় খানাপিনার গল্প, দু’-একটি রোমাঞ্চকর (!) ভ্রমণ-বিবরণ, অধস্তন কর্মচারী কিংবা তদীয় গিন্নিদের গুটি তিন কেলেঙ্কারির বা কেচ্ছার সমবায়। লেখিকা অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্না হলে, এর সঙ্গে যুক্ত হবে ভারতের আকাশ, কলকাতার নেটিভপাড়া, সাপ-বাঘ-সাধু, পাখা-এক্কা-মশা, হুক্কা-বানর-গোঁফ কিংবা কান্ট্রি-ক্যাপ্টেন নতুবা বর্ধমান স্টু নামক খাদ্যের অনুপান। মেয়েটি যদি অপেক্ষাকৃত ছোট ঘরের হয়, তবে জানবেন পূর্বোল্লিখিত সবই আছে তাঁর বইয়েও, তবে আনুপাতিক হিসেবে। অর্থাৎ কম কম করে। কেলেংকারি কাহিনীগুলো তাঁর উঁচু মহলের, ভারতবর্ষ সম্পর্কিত ইনফরমেশন আরও নিচু মহলের। সংক্ষেপে এই হচ্ছে কলকাতা-সাহিত্য। লর্ড-বিচারপতি-যাজক, লেডি-মিস্ট্রেস, মিস্ নির্বিশেষে সকলের সকল শ্রমেরই এই হচ্ছে মোটামুটি সারবস্তু। আর একটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে তৎকালীন এইসব লেখক-লেখিকাদের ধৈর্য এবং স্বাস্থ্য। দু’তিন ভল্যুমের নীচে কেউ একটা বড় থামেননি। যার পদমর্যাদা যত বড়, তাঁর বই তত মোটা। স্বভাবতই তত অপাঠ্য। অবশ্য এও ঠিক, পাঠকের কথা স্মরণ রেখে লেখবার মেজাজ লাট-বেলাটদের থাকবার কথা নয়। তাঁরা কষ্ট করে লিখেছেন তাই তো যথেষ্ট। ভালয়-মন্দে মিশিয়ে তবুও তো তাঁরা আমাদের আলমারি ভরিয়ে দিয়ে গেছেন। তাঁদের ধন্যবাদ।
যাক এসব কথা। এবার আসুন কলকাতার যথার্থ সাহিত্য জগতে। দুর্ভাগ্যবশত সাহিত্যের চেয়ে সাহিত্য-সমাচারই এখানে পরিমাণে বেশি। যথা: কিপলিং কলকাতায় বাস করে গেছেন। থ্যাকারে কলকাতায় জন্মেছেন, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ৭৯ নম্বর বাড়ির দোতলা থেকে আজব নগরীর আকাশ দেখেছেন, আলিপুরের থ্যাকার রোডে নামকরণ পরবর্তী কালে গুলি খেলেছেন। মার্ক টোয়েন এক রাত্তির কাটিয়ে গেছেন হোটেল কনটিনেন্টালে। হোটেলের কর্তৃপক্ষের চাইতে কলকাতার কি কম গর্ব সে জন্যে? অবশ্য রসিকপ্রবর সে রাত্তিরে হেসেছিলেন, না খাটে বসে কেঁদেছিলেন জানা যায়নি। কারণ, ঈশ্বর গুপ্তের মতো চৌরঙ্গি পাড়ার লোকেরা তখনও রাতে মশা নামক জন্তু (মিস এলি ইডন তার বইয়ে মশাকে animal বলেছেন) এবং দিনে মাছি নিয়েই বাস করছেন।
এখানেই শেষ নয়। এ শহরের সঙ্গে যোগ ছিল কবি ওয়ালটার স্যাভিজ ল্যান্ডরের, খুদে কিপলিং জন মাস্টার্সের, এমনকী ডেভিস গ্যারিকের। ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা অনেক খেটে খুটে বার করেছেন: গ্যারিকের খাটের চাদরটি নাকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফ্যাকটরিতে তৈরি। এ হল সাক্ষাৎ যোগের কথা। যোগাযোগ হতে পারত এমন সংবাদও আছে। ১৭৭৬ সালে ডক্টর জনসনের মনেও নাকি এক প্রবল বাসনা জেগেছিল এদিকে আসবার। বলাবাহুল্য, জনসন এলে বসওয়েলও নিশ্চয় বাকি থাকতেন না। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, মন ঘুরে গেল ডাক্তারের। বসওয়েলেরও তাই আর কলকাতা দেখা হয়ে উঠল না।
কলকাতার সাহিত্য-সমাচার বলতে মোটামুটি এই। তার চেয়ে বরং এবার শুনুন সাহিত্যিক সংবাদ। এটি চিরকালই সাহিত্যের চেয়ে নীরস। স্বভাবতই, চিরকালই এর শ্রোতা কম। তবুও শুনতে বলব। কারণ সাহিত্যে যা যোগ্যভাবে পাবেন না, সাহিত্য-সমাচারে যা উহ্য এমন জিনিস পাবেন এখানে। শুধু কালি-কলমের মানুষ, শুধু বাক্যবিন্যাসের হৃদয় নয়, কবরখানায়।
কিপলিংকে যদি পান লাইব্রেরির কক্ষে, পুরানো পুঁথির জীর্ণ পত্রে, তবে তাঁর নায়িকাকে পাবেন কবরখানায়। বিশ্বাস করুন, তাঁর লুসিয়াকে আমি পেয়েছি। পেয়েছি এই শহরের এই কবরখানাতে। লুসিয়াকে চিনলেন না? লুসিয়া রাডিয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘সিটি অব ড্রেডফুল নাইটস’ বইয়ের নায়িকা। ‘Concerning Lucia’ নামে তার একটি সুন্দর রেখাচিত্র এঁকেছেন কিপলিং। সাহিত্যে সুন্দর সৃষ্টি। ব্যস, হয়ে গেল। কিন্তু, শুনতে পেলাম যখন এ সৃষ্টি মনের নয়, লুসিয়া সত্যিই একদিন ছিল, তখন আরও ভাল লাগল কিপলিংকে। তারপর ক্রমে আরও শুনলাম ছিল নয়, লুসিয়া আজও আছে। তবে কবরখানায়।
ছুটে গেলাম। বিরাট কবর। স্বভাবতই অনেক বিত্তের স্বাক্ষর। দীর্ঘ গুণলিপি পড়ে জানলাম, ২৫ বছরের এই সুন্দরী মেয়েটি ছিল রবার্ট পল্কের স্ত্রী। নাম শুনে চিনতে পারলাম নন্দকুমার হত্যা ষড়যন্ত্রের অন্যতম নায়কপত্নী। কলকাতার এক বিরাট জমিদার-গিন্নি। তবুও ক্ষোভ নেই, ক্রোধ নেই। কিপলিংয়ের মতো দাঁড়িয়ে, ধীরে ধীরে পড়লাম:
To tell the treasure that these walls contain,
Let those describe it most who knew best…
কিপলিং সাহেবের এই অশ্রু আমি ‘সিটি অব ড্রেডফুল নাইটস’-এর পাতায় পাইনি, এবার পেলাম। সাহেব সাম্রাজ্যবাদী কবি নয়, তিনি তখন হৃদয়বান একজন মানুষ, তাঁর কলম কাঁদতে জানে।
দ্বিতীয় সংবাদটি চোখে পড়তেই ছুটলাম আলিপুর মিলিটারি সিমেট্রির দিকে।
‘হ্যাল্লো বাবু, হোয়াট ডু য়্যু ওয়ান্ট?’ বলতে বলতে যিনি এগিয়ে এলেন, তিনিও একটি কবর। জরাজীর্ণ চেহারা। ইংরেজি বলেন বটে, কিন্তু ইংরেজ নয়, ইংরেজের প্রেত। দেখে কষ্ট হল। বললাম একখানা কবর। ওয়াল্টার ল্যান্ডর নামে একটি ছেলের কবর।
‘ওয়াজ হি এনি বিগ মিলিটারি পার্সন?’
বললাম, বিগ কিনা জানিনে, তবে মিলিটারি তো বটেই। তুমি নিশ্চয়ই ডিকেন্সের নাম শুনেছ। সেই বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, এ ছেলেটি তাঁরই।
‘ডিকন্স, ডিকন্স বলে কিছুক্ষণ মাথা চুলকালেন বেচারা। তারপর বললেন ‘দেখো, আমি নতুন এসেছি এখানে। রেলে ছিলাম, এক মাসও হয়নি।’
হেসে বললাম, ‘সত্যিই তো, তা হলে আর তুমি ডিকেন্স সাহেবকে চিনবে কী করে? আচ্ছা, আমিই খুঁজে নিচ্ছি।’
খুঁজতে খুঁজতে পেলাম সেই দুষ্টু ছেলের কবরটি। একদিন নার্সের দিকে চেয়ার ছুড়ে মারার অপরাধে ডিকেন্স তাকে সারাদিন শুধু জল আর দু’টুকরো রুটি দিয়ে আটকে রেখেছিলেন ঘরে। তাও রোববারের মতো একটা দিনে। আর আজ? এক টুকরো পাথর যেন গুহার মুখে বসে আটকে রেখেছে একটা ২৩ বছরের তরুণকে।
ছেলেটি চার্লস ডিকেন্সের চতুর্থ সন্তান এবং দ্বিতীয় পুত্র। এর জন্মের দু’দিন আগেও বড় কষ্টে কাটিয়েছেন ঔপন্যাসিক। ডায়েরিতে লিখছেন: ‘কিউরিওসিটিস অব লিটরেচ্যার’-এর একটা পাতা খুলে সকাল সাড়ে দশটা থেকে বসে আছি। এখন তিনটে বাজে। একছত্রও পড়া হয়নি। পাতা ওলটানোর সময় নেই আমার, পরের ক’দিনও কেটে গেল এমন দুশ্চিন্তা এবং অশান্তিতে। ৮ তারিখে (৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪১) জন্মগ্রহণ করল এই ছেলেটি। ৯ তারিখের ডায়েরিতে ঔপন্যাসিক নিঃশংকচিত্তে লিখে গেলেন—“Thank God, quite well.”
ওয়াল্টারকে সুলক্ষণ পুত্র হিসাবেই গ্রহণ করলেন তিনি। নাম রাখলেন এডগার। এমন সময়ে অতিথি হয়ে এলেন কবিবন্ধু ওয়াল্টার স্যাভেজ ল্যান্ডর। ডিকেন্স বললেন, তুমি এডগারের ধর্ম-পিতা। কবি আপত্তি করলেন না। এডগারের নাম হল ওয়াল্টার ল্যান্ডর ডিকেন্স।
‘নামটি সুন্দর। তার চেয়েও বড় কথা, তোমার আমার হৃদ্যতার পরিচয় থেকে গেল এর নামে— ডিকেন্স হেসে বললেন।
ছেলেটি ক্রমে বড় হল। স্কুল থেকে প্রাইজ নিয়ে বাড়ি ফেরে। ডিকেন্স আদর করে বলেন ‘ইয়ং স্কাল, আই ব্লেস য়্যু।’
ক’বছর পরের কথা। তরুণ ডিকেন্স-তনয় চাকরি নিয়ে ভারতবর্ষে আসছেন। মিস বারদেৎ কাউট্স নিজে বহু চেষ্টা করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যবিভাগে তার জন্যে একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। ডিকেন্স এই সুখবর জানিয়ে বন্ধুকে লিখলেন:
‘ওয়াল্টার শিগ্গিরই ভারতবর্ষে পরীক্ষা দেবে। তারপর পাস করলে সে এক বিচিত্র দেশে জীবনধারণ করে কর্মে নিযুক্ত থাকবে।’
কিন্তু বেশিদিন ছেলেটিকে থাকতে হল না এ দেশে, মহাকাল কেড়ে নিয়ে গেল তাকে। ১৮৫৭ সালের জুলাইয়ে ওয়াল্টার জাহাজে চড়েছিল। আর ক’বছর যেতে না যেতেই ফেরার জাহাজে পা পড়বার আগেই থামতে হল তাকে। মা-বাবার ভয় ছিল অন্য দিকে। সবে মাত্র মিউটনি হয়ে গেছে, এমন সময়। কিন্তু দেশীয় সিপাহিদের হাতে প্রাণ গেল না। ওয়াল্টারের মৃত্যু হল অসুখে।
ছুটি নিয়েছে। বাড়ি যাবে। কলকাতা থেকে জাহাজ ছাড়বে। ওয়াল্টার তাই উত্তর ভারত থেকে কলকাতায় এসেছে। সহসা অসুখ। হাসপাতালে ভর্তি করা হল। আলিপুরের মিলিটারি হসপিটাল। অনেক বড় বড় ডাক্তার। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। ৩১ ডিসেম্বর, বছরের শেষ দিনে দূর ভারতবর্ষের মাটিতে শেষ নিশ্বাস ফেলল ডিকেন্সের দু’টি মাত্র ছেলের একটি। তাঁর স্নেহের এডগার।
খবর গেল দেশে। ডিকেন্স কলম নিয়ে বসলেন। তারপর লিখলেন তাঁর জীবনের সবচাইতে ছোট গল্পটি।
Aged 23 years, In memory of Lieut. Walter Landor Dickens, the second son of Charles Dickens, who died at the Officer’s Hospital, Calcutta, on his way home on sick leave, December 31st, 1863.
ক’লাইনে একটি দীর্ঘ ছোটগল্প। অলিভার টুইস্ট লিখতেও বোধহয় চোখ দিয়ে জল পড়েনি তাঁর। কিন্তু এই ক’লাইন লিখতে বার বার নিশ্চয় কাগজের উপর টপটপ করে পড়ছিল ঔপন্যাসিক-শ্রেষ্ঠের চোখের জল। পাথরের গায়ে, আলিপুরের এই কবরখানায় আজও যেন চিক চিক করছে সেই ক’ফোঁটা অশ্রু।
একটি কবিতার ইতিহাস
সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরখানা। কবরখানা নয়তো, যেন কবরের বন। ছোট-বড়-মাঝারি, পিরামিড-ওবলিস্ক-কুপলাস। আকারে-প্রকারে-স্থাপত্যে এখানকার কবর বহুবিধ, পরিচয়ে সহস্রবিধ। একটু চোখ মেলে হাঁটলেই মনে হয় এ তো বিষন্ন এক ঘুমন্তপুরী, স্মৃতির অরণ্য। মাত্র ২৩ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবন। (এই কবরখানার উদ্বোধন, অর্থাৎ প্রথম নরদেহের পৃষ্ঠসঞ্চার উৎসব হয় ১৭৬৭ সালে এবং এখানে শেষ মানুষটি আশ্রয় নিয়েছেন ১৭৯০ সালে।) তবু একটা সম্পূর্ণ যুগের ইতিহাস যেন। চারটে ভাঙা দেওয়ালের বেষ্টনীতে একটা অখণ্ড যুগের স্মৃতি। ইউরোপের ইতিহাসে এ যুগ গৌরবের প্রহর। বিঠোফেন, শেরিডন, বিউন্যাস এবং নেপোলিয়নিক যুদ্ধের মরসুম চলেছে তখন সাগরপারে। আর এই এশিয়াখণ্ডে চলছে চন্দননগরের লড়াই, হেস্টিংসের শাসন, মিসেস লিচের নাচ, লেডি অ্যানের বড়মানুষি পার্টি এবং হুক্কা-এক্কার যুগ।
ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম, আর ভাবছিলাম সেই যুগের কথা। এখানে ওখানে মাত্র একটুকরো পাথরের পরিচয় বুকে ধরে পড়ে রয়েছেন বোটানিস্ট কিড সাহেব, ডাক্তার ক্যাম্বেল, প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদ জোনস, নব্যবঙ্গের অন্যতম প্রবক্তা ডিরোজিও প্রমুখ যুগন্ধরগণ। রয়েছেন ‘উন্মাদ’ স্টুয়ার্ট, বীর ক্লেভারিং এবং আরও কত কে। খ্যাত, তত খ্যাত নয়, অখ্যাত নানা বিচিত্র পরিচয়। যেন গণ্যমান্য এবং নগন্য মানুষের এক বিরাট জমায়েত।
আজ এখানে কবরের বন। কিন্তু সে দিন? সেদিন সত্যি সত্যিই অরণ্য এখানে। শহরের পালকিবাহকেরা এদিকে আসতে দ্বিগুণ ভাড়া চায়। তাও, যাত্রার আগে গায়ের ‘দামি’ জামাকাপড়গুলো রেখে আসতে চায়। কেননা, পথে ডাকাতেরা ওত পেতে আছে। অষ্টাদশ শতকের মধ্যাহ্নেও এখানে রাত্রির অন্ধকার। দূর দূরান্তব্যাপী শুধু বন আর বন। মাঝে মাঝে পতিত জলা, নয়তো ধানের খেত। তারই ধারে ধারে এখানে ওখানে গুটিকয় গরিব মানুষের কুটির। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে পর্যন্ত তখন বাঁশবন এবং সে বনে একমাত্র বাসিন্দা নাকি তখন বাঘ। স্বভাবতই সাহেবসুবারা বড় একটা আসতেন না এদিকে। এলেও, আসতেন বন্দুক হাতে, শিকারে। হেস্টিংস নাকি নিজহাতে বাঘ মেরেছেন এখানে।
কিশোর কলকাতা তখন পালিত হচ্ছে লালদিঘির কোলে। নবাগত যাঁদের পদসঞ্চার হয় শহরে, তাঁদের যেমন বাস ওখানে, যাঁরা চলে যান চিরদিনের জন্যে, তাঁদের জন্যে নির্ধারিত স্থানটুকুও তখন ওদিকেই। সেন্ট জন চার্চের উঠোনে। ক্রমে লোকসমাগম বৃদ্ধি পেল। সেই সঙ্গে বেড়ে উঠল মৃত্যুলোকে যাত্রীর সংখ্যা। আর ঠাঁই নেই। অপরিসর উঠোনে আর কাজ চলে না। বাধ্য হয়ে প্রাণহীন দেহ কাঁধে পা বাড়াতে হল এদিকে। তদানীন্তন শহরের এই প্রান্তে।
সহসা ভাবনায় ছেদ পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল পা দুটোও। চোখে পড়ে এমন একখানা কবর। একটা বন্ধ্যা আমগাছ আদর করে ছায়া দিয়ে যেন আগলে রেখেছে। গায়ে জ্বলজ্বল করছে সোনার হরফে লেখা কটি লাইন। আশ্চর্য উজ্জ্বল গুটিকয় ছত্র। কাছে গিয়ে দেখি, হরফগুলোকে রক্ষা করছে একখণ্ড কাচ। তাই এতকাল পরেও এমন সহজপাঠ্য। মনে হয়, গতকাল যেন লেখা হয়েছে। ধীরে ধীরে পড়লাম—
“…Rose Aylmer, whom these wakeful eyes
May weep, but never see,
A night of memories and sight
I consecrate to thee.”
সাধারণত এসব শোকপদ্যে ‘কবির’ নাম থাকে না। বিশেষ অর্থও থাকে না। কারণ, প্রাপ্য এবং অপ্রাপ্য ঋণ শোধের এমন প্রশস্ত স্থান তো আর হয় না। ব্যক্তিগত ঔদার্য কিংবা পারিবারিক মহিমা কীর্তনের পক্ষেও এই স্থানটি নিঃসন্দেহে নিরাপদতম। তাই তেমনিভাবেই চিরকাল এগুলো পড়ে থাকি আমরা। নামধাম কিংবা পরিচয়টুকু কোনওমতে পেয়ে গেলে বাকিটুকু আর শেষ করি না। করি না, অর্থাৎ প্রয়োজনই পড়ে না। কারণ সবার বক্তব্যই এখানে মোটামুটি এক। কিন্তু এ কবিতায় ‘I consecrate to thee’ পড়তে গিয়েই আমি বা ‘I’ কথাটা যেন আর সর্বনাম রইল না আমার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ্য হয়ে ভেসে উঠলেন একজন বিশেষ মানুষ। একটু নজর দিতেই দেখি কবিতাটির নীচেই রয়েছে তাঁর স্বাক্ষর: Walter Savage Landor। ল্যান্ডর পরিচিত কবি। সুতরাং তাকালাম ওপরের দিকে যার জন্যে কবি এমন করে গেয়েছেন এই শোকগাথা। পাথরের গায়ে তাঁর নামটিও অতি স্পষ্ট। ‘অনারবল, মিস রোজ উইথাট এলমার।’
এলমার আর ল্যান্ডর কলকাতার ইতিহাসে একটা কাহিনী। এ নগরের মনের খাতায় একটুকরো ট্র্যাজেডি।
১৮০০ সালের মার্চ মাস। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সহসা, গুডুম গুডুম বন্দুকের আওয়াজ। দাওয়ায় বসে তামাক খেতে খেতে চমকে উঠল এ পাড়ার দরিদ্র বাসিন্দারা। কিন্তু মুহূর্তের জন্যে। এ আওয়াজ তাদের চেনা। তাদের যেমন হরিধ্বনি, কিংবা নিঃশব্দ পদচারণা, সাহেবদের তেমনি রাইফেলের বোল। মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কবরখানায়। ব্যুরিয়াল গ্রাউন্ড রোড ধরে শব-মিছিল আসছে। আগে-পিছে মশালচি, বন্দুকধারী সেপাই। জায়গাটা তো ভাল নয়। বাঘ-ভাল্লুকের ভয় আছে। তাই মাঝে মাঝে এমনি ফাঁকা আওয়াজ। একজন বলে উঠল—আহা, আজ আবার একজন গেল। অনুকম্পার স্বর তাঁর কণ্ঠে। সঙ্গে সঙ্গে হয়তো কল্কে হস্তান্তরিত করতে করতে উত্তর দিল অন্যজন, তা এত ধকল সইবে কেন এমন সোনার শরীরে। এ তো আর আমাদের গরিবের কপাল নয়, রাজার জাত কষ্ট দেখলেই পালিয়ে যায়।’
কে বিদেয় নিল, কেউ জানে না। নেটিভপাড়া এসব খবর রাখা বিশেষ দরকার মনে করে না। কিন্তু সারা সাহেবপাড়া সেদিন বিষন্ন। সারাদিন অপেক্ষা করে, সন্ধ্যার অন্ধকারে মৃতদেহ নিয়ে পথে নামে তারা। তাই রীতি। রাত্রে কবর দেওয়াই তখন প্রথা। বিবিরা রয়েছেন। তাঁরা কোমলহৃদয়া। এমন জায়গায় মরতেও হয়, কিংবা এত সুখ চিরদিন থাকে না—একথা মুখোমুখি জানতে পারলে বিষাদ তাঁদের আচ্ছন্ন করতে পারে। উল্লাস-আনন্দে অরুচি ধরে যেতে পারে। দেশে যাওয়ার জন্যে বায়না ধরতে পারেন। তাই রাত্রেই ভাল। রাত্রে কবর হয়ে গেল এলমারেরও। দু’দিন বাদে ক্যালকাটা গেজেটে বের হল শোকসংবাদ:
“On Sunday last at the house of her uncle Sir Henry Russell, in the bloom of youth and possession of every accomplishment that could gladden or embellish life, deplored by her relatives and regretted by a society of which she was the brightest ornament, the honourable Miss Rose…etc.”
ক্যালকাটা গেজেট যে-পরিচয় দিয়েছেন এলমারের, তারপর তাঁর নতুন কোনও পরিচয় আছে, তা নয়। আবার এখানেই তা শেষ নয়। যদি তা হত যদি রূপে-গুণে তার সমাজের মধ্যমণিই শুধু হতেন তিনি, তা হলে আজ তাঁকে নিয়ে পাতা নষ্ট না করলেও চলত। কিন্তু এই এলমার, কলকাতার এই সমাজমণিটিই যে ছিলেন আর একজনের হৃদয়মণি। এলমার ল্যান্ডরের প্রিয় রোজ, তাঁর কবিতা।
ল্যান্ডর কবি। ইংল্যান্ডের কবিসমাজে তাঁর প্রতিষ্ঠা সর্বজনবিদিত। এলমার কবি-প্রিয়া। শুধু কবিতা নয়, এলমার একদিক থেকে ল্যান্ডরের কবিতার ইতিহাসও।
এলমারদের পারিবারিক বাস ছিল ওয়েলস-এ। ল্যান্ডর সবেমাত্র অক্সফোর্ড ছেড়ে বেরিয়েছেন। তরুণ কবি তিনি। এমন সময় ঘটনাচক্রে পরিচয় হল তাঁর এলমার-পরিবারের সঙ্গে। ক্রমে রোজের সঙ্গে। রোজেরা তিন বোন। বয়সের দিক থেকে এলমার ল্যান্ডরের কাছাকাছি, মনের দিক থেকেও তাই। এলমার ল্যান্ডরের চেয়ে বয়সে মাত্র চার বছরের ছোট। বৃদ্ধ ল্যান্ডর দীর্ঘকাল পরে বন্ধুর কাছে চিঠিতে স্বীকার করেছেন—কলকাতায় এলমার আর তাঁর বিষয়ে রটনাটা ঘটনা।
‘I was not indifferent to Rose, nor Rose quite to me.’
ওয়েলসের উপকূলে নিবিড় বন্ধুত্বে অনেক সন্ধ্যা কাটিয়েছেন। তাঁরা দু’জন কানাকানি কথা বলেছেন, বোবা হয়ে সমুদ্রের ঢেউ গুনেছেন। সে কথার বিষয়বস্তু কী ছিল, কতখানি কাছাকাছি হয়েছিলেন তাঁরা, আমরা জানি না। এলমার কাউকে সে কথা বলেননি। ল্যান্ডরের কবিতা একমাত্র স্বাক্ষর তার।
“…With a low tune I bent to hear;
How close I bent I quite forget,
I only know I hear it yet!”
এই একটিমাত্র কবিতা নয়। রোজ কবির অনেক কবিতার নায়িকা। ল্যান্ডরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘Geber’ যা পরবর্তী কালে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল শেলি এবং সাউদকে, তার পিছনেও নাকি ছিল রোজ, আমাদের কলকাতার এই রোজ এলমার। শোনা যায়, একদিন বেড়াতে গিয়ে ল্যান্ডর এলমারের হাত থেকে টেনে নিয়েছিলেন একখানা বই। স্থানীয় কোনও লাইব্রেরি থেকে ধার করা সাধারণ বই। মলাটের পিছনে ছিল আরব্য উপন্যাসের কাহিনীমূলক একটি ছবি। এই ছবিই ‘Geber’-এর প্রেরণা। রোজ হাতে তুলে না দিলে এ তিনি কোথায় পেতেন।
বন্ধুত্ব ঘনিষ্ঠ হল। কিন্তু হায়, একদিন এই দুটো সদ্যফোটা তাজা ফুলের সব সৌরভ আচমকা মিলিয়ে গেল, সব সুখকে আড়াল করে সামনে এসে দাঁড়াল ল্যান্ডরের ভাষায় ‘ব্রিট্নফেরির ওকবন।’
“When the buds began to burst
Long ago with Rose the first,
I was walking, joyous then,
Far above all other men,
Till before us up there stood
Britonferry’s Oken wood.”
এলমারের বাবা মারা গেলেন। মা বিয়ে করে বসলেন আর এক ভদ্রলোককে। এলমারের সম্মতি ছিল না এ ব্যাপারে। স্বভাবতই মা তাকে কাছাকাছি না রাখাটাই ভাবলেন যুক্তিসঙ্গত। স্থির হল ওকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে কলকাতায় মাসির বাড়িতে। মেসো কলকাতার বড়মানুষ। সার হেনরি রাসেল। রাসেল প্রথমে ছিলেন পিউনি জজ্, তারপর চিফ জাস্টিস। সুতরাং দিনক্ষণ ধার্য হয়ে গেল এবং এক বিষন্ন সন্ধ্যায় ল্যান্ডরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাহাজে চড়লেন এলমার। অনিচ্ছাসত্ত্বেও দুঃখের দরিয়ায় ভাসতে হল তাঁকে। ল্যান্ডর ঘরে ফিরে এসে লিখলেন:
Where is she now? Called far away,
By one she dared not disobey,
To those proud halls, for youth unfit,
Where princes stand and judges sit,
Where Ganges rolls his widest wave. ইত্যাদি ইত্যাদি।
এলমার কলকাতায় এলেন। সতেরো বছর বয়সের সুন্দরী মেয়ে। লর্ড এবং লেডি রাসেলের পরিবারের কন্যা। সুতরাং সঙ্গীর অভাব হল না। সারা কলকাতার সমাজ সানন্দে বরণ করে নিল তাঁকে। কিন্তু এলমার সহ্য করতে পারলেন না কলকাতাকে। দিনে দিনে ক্রমেই যেন ভিতর থেকে শুকিয়ে এল রোজ, গোলাপের পাঁপড়ি। ডাক্তার বদ্যি বৃথা। এক বছরও পার হল না। এলমার চলে গেলেন। ল্যান্ডরের তাজা গোলাপ ঝরে পড়ল। জোর করে তাঁকে কলকাতায় আটকে রাখতে ব্যর্থ হলেন তাঁর মা।
কলকাতা শোক করল। ল্যান্ডরের কথা তারা জানে না। নিজেদের কথা ভেবেই কাঁদলেন রাসেল পরিবারের নিকটজনেরা। তাঁরা ভাবলেন, দোষ কলকাতার। কলকাতার জলবায়ু হত্যা করেছে এই মেয়েটিকে। হিকি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন: এ নির্ঘাত পেটের ব্যামো। কতদিন মানা করেছি এই শয়তান এবং বিপজ্জনক ফলগুলো (আনারস) এত বেশি বেশি না খেতে। তখন ঠাট্টা করত আমাকে। বলত রেখে দিন আপনার সারমন। আর এখন? এমনি নিরপরাধ ভাবনা অনেকেই ভাবলেন। কিন্তু সব ভাবনা থেমে গিয়ে রোগ এবং নিরাময় সবই জানা হয়ে গেল সবার, যেদিন ইংল্যান্ড থেকে এসে পৌঁছাল ল্যান্ডরের শোকবার্তা এবং তৎসহ আনুষঙ্গিক কাহিনী। কলকাতায় শুভাকাঙ্ক্ষীরা কবরের গায়ে কবিতাটুকুই সেঁটে দিয়ে চলে গেলেন যে যার ঘরে। এমনকী সেই ছেলেটি পর্যন্ত। শোনা যায়, রোজকে হারিয়ে কলকাতায় সবচেয়ে মন খারাপ হয়েছিল যাঁর, তিনি আর্ল অব লিভারপুলের জনৈক কাজিন। তাঁর নাম রিকেটস। তিনি পর্যন্ত অবশেষে সান্ত্বনা খুঁজে পেলেন, সমসাময়িকদের সাক্ষ্য অনুযায়ী জনৈকা আইরিশ মেয়ের হৃদয়ে। (‘in the arms of a vulgar, huge, corase, Irish slammerkin, Miss Prendergast.’)
কিন্তু ল্যান্ডর আর ঘরে ফিরতে পারলেন না সারা জীবনে। শেষজীবনে চলে যান তিনি ফ্লোরেন্সে। তারপর একদিন আরও দূরে। এলমার যেখানে গিয়েছে, সেখানে। কবি সুইনবার্ন শেষ বারের মতো দেখা করতে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। তিনিই তাঁর কবরে লিখে রেখে এসেছেন ক’লাইনের একটি কবিতা:
“…So shall thy lovers, come from far
Mix with thy name,
As morning-star with evening-star.”
ইত্যাদি। বোধ হয় সুদূর কলকাতার এই কবরখানা থেকে আজও নিঃশব্দে ভোরের আকাশে ওঠে একখানা তারা। একটি লজ্জিত নক্ষত্র। ভীত ত্রস্ত পায়ে ছুটে ছুটে অবশেষে এক সময় স্পর্শ করে ফ্লোরেন্সের আকাশ। তারপর সারা দিনের ক্লান্তিতে অবসন্ন দেহ এলিয়ে দেয় এক টুকরো নরম ঘাসের জমিতে। সেখানে এই সন্ধ্যার অপেক্ষায় আর একটি ত্রস্ত হাতে সারা দিন চলে তারই আয়োজন। মাঝরাত্তিরে আবার পূর্বগামী হয় এলমার। এ কি অসম্ভব? ছ’লাইনের কবিতায় কাহিনীর চারটে লাইনই শুধু সত্য, আর পুরোপুরি মিথ্যা দু’লাইনের সামান্য কামনাটুকু?
একটি দশ টাকার কবর
নাঃ, পাওয়া গেল না। অনেক খোঁজাখুঁজি হল, কিন্তু কিছুতেই পাওয়া গেল না কবরটাকে। দশ টাকার চুন-বালি-ইটের সেই করুণ ইতিহাসটাকে।
কাসিয়াবাগান কবরখানা। ইংরেজদের যেমন সাউথ পার্ক স্ট্রিটে সিমেট্রি, মুসলমানদেরও তেমনি কাসিয়াবাগান। দুই জায়গায় মাটির নীচে ইতিহাসের দুটি অধ্যায়। একই যুগ, একই দেশ। শুধু দুটি ভিন্ন জাতি। একটি বিজয়ী, অন্যটি বিজিত। সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরখানায় নিদ্রিত সেই বিজয়ী দলের নায়কেরা, কাসিয়াবাগানে পরাজিত নবাবেরা।
সাহায্য করতে এগিয়ে এলো দীন মহম্মদ। পাশের বস্তির একটি ছেলে। কবরখানাটা সে চেনে। এখানে যে নবাবদের মাটি দেওয়া হয়েছে, তাও জানে। কোথাকার নবাব—তা অবশ্য তার জানা নেই, কিন্তু দীন মহম্মদ উর্দু পড়তে জানে। সুতরাং, উৎসাহের সঙ্গেই পথ দেখিয়ে নিয়ে এল সে আমাদের।
কাসিয়াবাগন কবরখানা। বলতে গেলে কলকাতার আদি বনেদি মুসলিম কবরখানা। কিন্তু আজ তার দিকে তাকিয়ে কারও মনে হবে না সে-কথা। মনে হবে না, এখানে মাটির নীচে ঘুমচ্ছেন মহীশূরের নবাবজাদারা, অযোধ্যায় খোদ নবাবেরা এবং এমনি আরও বড়মানুষেরা।
বিরাট এলাকা। নবাবদের বেওয়ারিশ কবরখানায় আজ অবহেলার রাজত্ব। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে প্লাইউড-এর শয্যা বিছিয়েছে পাশের করাত-কল, ফাঁকে ফাঁকে ঘুঁটের আলপনা দিয়েছে প্রতিবেশী বস্তিবাসীর দল। দীন মহম্মদ মাথা নাড়ল। সে বুঝতে পেরেছে, এর নীচে থেকে কোনও নবাবকে খুঁজে বের করা তার কাজ নয়।
তবুও খুঁজলাম। খুঁজতে খুঁজতে ভোরের সূর্য এসে পৌঁছল অফিস টাইমে। কিন্তু তবুও পাওয়া গেল না দশ টাকার সেই ঐতিহাসিক ইমারতটিকে। হয়তো এই সামান্য অর্থের বলে দেড়শো বছর একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি বেচারা। অস্বাস্থ্য আর অবহেলায় ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে কোন কালে। কিংবা এমনও হতে পারে, হয়তো এই সামান্য কয়টি জীবিত কবরের মধ্যেই সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে আজও বেঁচে আছে সেই ঐতিহাসিক অবজ্ঞাটি।
ওয়াজির আলির বিয়ের খরচা হয়েছিল তিরিশ লাখ টাকা, আর শেষকৃত্যে মাত্র সত্তর টাকা। কবর খরচা বেশি হলে দশ টাকা।
১৭৯৪ সাল। মহা ধুমধাম করে নবাব আসফউদ্দৌলা বিয়ে দিলেন পুত্র ওয়াজির আলির। ওয়াজির তাঁর ছেলে নয়, পোষ্যপুত্র। তাই বলেই বা কেন কম খরচা করবেন নবাব আসফউদ্দৌলা। ওয়াজির আলি তাঁর উত্তরাধিকারী। অযযাধ্যার সে ভবিষ্যৎ নবাব। সুতরাং, মাস ভরে উৎসব হল। দেশবিদেশের লোকেরা নেমন্তন্ন পেল। ওয়াজির আলির বিয়েতে পাকা তিরিশ লাখ টাকা খরচ হল।
তিন বছর পরে, ১৭৯৭ সালে বিদায় নিলেন আসফউদ্দৌলা। অযোধ্যার সিংহাসনে বসলেন তরুণ নবাব ওয়াজির আলি। হয়তো নবাবের মতোই বেঁচে থাকতেন তিনি, হয়তো মৃত্যুর পর কবরস্থ হতেন রাজকীয় মর্যাদায়, কিন্তু ওয়াজির আলি ছিলেন সিরাজউদ্দৌলার মতোই অসহিষ্ণু নবাব।
সুতরাং, সিংহাসনে ভাল করে বসতে না বসতেই ইংরেজরা জানতে পেলেন, ওয়াজির আলি তাঁদের শত্রু। ইংরেজদের পরাজিত করতে না পারলেও অপদস্থ করাই তাঁর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা।
সময় থাকতে ইংরেজরা সাবধান হলেন। তাঁরা ওয়াজির আলিকে সহসা সিংহাসনচ্যুত করলেন, বিগত নবাবের পুত্র সাদত আলি এ ব্যাপারে সহায়ক হলেন। পুরস্কারস্বরূপ তিনি অযোধ্যার সিংহাসন পেলেন, ওয়াজির আলি পেলেন নির্বাসন দণ্ড।
অসহায়ের মতো ওয়াজির আলি মেনে নিলেন সে দণ্ড। লখনউ থেকে বেনারস এলেন। বেনারসের রেসিডেন্ট জর্জ চেরীর দরবারে ডাক পড়েছে তাঁর। এর পর তিনি কোথায় যাবেন, তা স্থির হবে ওখানেই।
যথাসময়ে মিঃ চেরীর দরবারে ডাক পড়ল পদচ্যুত নবাবের। সেদিন ১৪ জানুয়ারি, ১৭৯৯ সাল। ওয়াজির আলিকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য মি. চেরী বাইরে এসেছেন। এসেই চমকে উঠলেন তিনি। ওয়াজির আলি একা আসেননি তাঁর নেমন্তন্ন রক্ষা করতে। সঙ্গে এসেছে রাশি রাশি ‘সোয়ারি’। নবাবের অনুগত ফৌজ। পালাবার আর তখন পথ নেই সামনে। মি. চেরী সোয়ারিদের হাতে প্রাণ হারালেন। মারা গেলেন ক্যাপ্টেন কনওয়ে এবং মি. গ্রাহাম।
ওয়াজির আলির ক্ষিপ্ত অনুচরেরা চলল তখন জজ সাহেবের কুঠির দিকে। অসীম বীরত্বের সঙ্গে শুধুমাত্র একটা বর্শা দিয়ে তাদের ঠেকিয়ে রাখলেন বিচারপতি মি. ডেভিস। অনুচরদের নিয়ে ওয়াজির আলি পালিয়ে গেলেন বেরার।
বেরারেই ইংরেজদের হাতে অবশেষে বন্দি হলেন তিনি। সেখান থেকে তাঁকে চালান করে দেওয়া হল কোম্পানির রাজধানীতে—কলকাতায়। তারপর শুরু হল সেই লজ্জাকর শেষকৃত্যের প্রস্তুতি।
ইংরেজদের তথাকথিত বিচারে কলকাতায় অযোধ্যার ভূতপূর্ব নবাবের স্থান হল ফোর্ট উইলিয়মের একটা অন্ধকার ঘরে, একটা লোহার খাঁচায়। চরম অবহেলার মধ্যে আজন্ম ঐশ্বর্যলালিত নবাব বন্দিজীবন যাপন করে চললেন। রাজকীয় বন্দির জন্যে সামান্য মানবিক কর্তব্যগুলোও পালন করা সঙ্গত মনে করলেন না ইংরেজ কর্তৃপক্ষ। এমনকী, সময়মতো পানাহারের বন্দোবস্তটুকুও করেননি তাঁরা। ওয়াজির আলি পেট ভরে খেতে পেতেন না, বরাদ্দের বেশি এক ফোঁটা জল পর্যন্ত দেওয়া হত না তাঁকে। তবুও ইংরেজদের তৎকালীন বর্বরতার সাক্ষী হয়ে দীর্ঘ সতেরো বছর কয়েক মাস ফোর্ট উইলিয়মে বেঁচে ছিলেন আসফউদ্দৌলার আইনসঙ্গত উত্তরাধিকারী। অবশেষে ১৮১৭ সালের মে মাসে ইংরেজদের নাগালের বাইরে পালিয়ে গেলেন বিদ্রোহী নবাব।
মৃত্যুর পরেও যেন ইংরেজরা শান্ত হলেন না। ওয়াজির আলির উপর তাঁদের প্রতিশোধের তখনও কিছু বাকি। কাসিয়াবাগান কবরখানায় এই সেদিন অবধিও ছিল তাঁদের সেই শেষ নৃশংসতার সাক্ষ্যটি। দীন মুহম্মদ জানেন না, সেটিকে মুছে ফেলে ইংরেজের কত উপকার করেছে তারা।
মৃত্যুসংবাদ শোনামাত্রই ফোর্ট উইলিয়ম কর্তৃপক্ষ আদেশ দিলেন ওয়াজির আলির শেষকৃত্যে যেন সত্তর টাকার বেশি খরচ না হয়। ইংরেজরা জানত, তেইশ বছর আগে এই তরুণটি যখন বিয়ে করে, তখন খরচ হয়েছিল নগদ তিরিশ লাখ টাকা। অনেক বড় বড় সাহেব নেমন্তন্নও পেয়েছিল সেই বিয়েতে। সুতরাং, এবার হুকুম হল, সত্তর টাকার বেশি নয়। অর্থাৎ অন্যান্য খরচ মিটিয়ে কবরের জন্য শেষ পর্যন্ত দশটা টাকাও থাকবে কিনা সন্দেহ।
অযোধ্যার নবাবকে দশ টাকায় কেন কবর দিতে চেয়েছিলেন ইংরেজরা? মানুষকে মানুষের নিয়তির কথা শেখাতে চেয়েছিলেন কি তাঁরা? অথবা, মর্তে ঈশ্বরের বিচার দেখাতে চেয়েছিলেন তাঁরা? কিংবা ইতিহাসকে নিজেদের হীনতা দেখাতে?
কাসিয়াবাগানের কবরখানা অনেকদিন অনেক মানুষকে দেখিয়েছে তা। আজ যদি একান্তই তা নজরে না পড়ে আপনার, তাতেও বোধ হয় কোনও ক্ষতি নেই। কেননা, ওয়াজির আলির সেই দশটাকার কবরটি না থাকলেও, তার ইতিহাসটা আছে আজও। চিরকাল থাকবে।
ঐতিহাসিক ভূত
মহামান্য হেস্টিংস বাহাদুরের স্বনামধন্য ভূতটি যে এখনও বহাল তবিয়তে বর্তমান এ সংবাদ পেলাম আলিপুরে এসে। আলিপুর হেস্টিংস হাউসে। শোনা যায়, এককালে এই প্রেতাত্মাটি তার পদমর্যাদা অনুযায়ী দেশেবিদেশে যোগ্য খ্যাতি এবং প্রতিপত্তি লাভ করেছিল। ফলে, কলকাতার ইঙ্গ-বঙ্গ প্রেতাত্মা সমাজে তার প্রতিষ্ঠাও ছিল অনন্যসাধারণ, —লাটতুল্য। জীবিত বঙ্গসন্তানেরা অবশ্য এটা ধরেই নিয়েছিলেন যে, দুটো গির্জা গড়ার চাঁদা দিলেই নন্দকুমারের মতো ব্রহ্মহত্যার পাপ স্খালন হবে না। ব্রহ্মদৈত্য না হোক, নিদেনপক্ষে একটা যেমন-তেমন ভূত হয়েও হেস্টিংসকে থেকে যেতে হবে এ দেশে। এমনকী, বার্ক শেরিডনের বক্তৃতার পর ইংরেজদের মনেও হেস্টিংসের আত্মার ভবিষ্যৎ শান্তি সম্পর্কে রীতিমতো আশংকা ছিল। তাই পরবর্তী কালে লর্ড কার্জনের মতো জাঁদরেল পুরুষও হেস্টিংস হাউসে বাস করতে গিয়ে জনশ্রুতিকে আস্কারা দিয়েছেন, আগ্রহভরে শুনেছেন প্রত্যক্ষদর্শী দ্বারপালদের বিবরণ। শুধু তাই নয়, বুদ্ধিবাদী (!) ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা পর্যন্ত এই পরলোকবাসী মাননীয় আত্মাটির নামে দু’ চার ছত্র পিণ্ডদানে ইতস্তত করেননি। বরং ইতিহাসের সূত্র ধরে এর একটা কার্যকারণ-সম্পর্ক আবিষ্কারের চেষ্টায় তাঁরা প্রাণপাত করেছেন। কটন সাহেব তাঁর কলকাতার ইতিহাসে লিখেছেন: (জনশ্রুতি মতে) দুপুর-রাতে বাড়ির সংলগ্ন বনপথকে মথিত করে একখানা চারঘোড়ার গাড়ি এসে থামে হেস্টিংস হাউসের গাড়ি-বারান্দার নীচে। খটাং করে দরজা খুলে লাফ দিয়ে নামেন হেস্টিংস। অর্থাৎ মহামান্য ওয়ারেন হেস্টিংস সাহেবের ভূত, তাঁর পবিত্র প্রেতাত্মা। তারপর শুরু হয় ছুটোছুটি। একবার এদিক, একবার ওইদিক। এই ঘর, ওই ঘর। হেস্টিংস উন্মাদের মতো হাতড়ে ফেরেন একটা বাক্স। একটা কালো কাঠের বাক্স। তার মধ্যে নাকি আছে তাঁর সর্বস্ব, তাঁর প্রাণ-ভোমরা।
ঐতিহাসিক সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এলেন যুক্তি নিয়ে: হতে পারে। অসম্ভব নয়। খুবই সম্ভব হেস্টিংসের পক্ষে ওই বাক্সটার সন্ধান করা। Gleig-এর লেখা হেস্টিংসের জীবনীতে দেখুন, অমুক পৃষ্ঠার এই হারানো রত্নের জন্যে আক্ষেপ করে হেস্টিংসের লেখা একখানা চিঠি ‘কোট’ করা আছে। শুধু তাই নয়, আরও প্রাণপাত করে ঐতিহাসিক আবার আবিষ্কার করলেন: ১৭৮৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের ‘ক্যালকাটা গেজেটে’র হারাননাপ্রাপ্তি কলমে এই মর্মে একখানা বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন জি. জি. অর্থাৎ গভর্নর জেনারেল। তাঁর একটি কাঠের হাতবাক্স হারিয়ে গেছে। ওই বাক্সে ছিল অমূল্য ধন। কী ধন? না, খানকয় দলিল আর দুটো মিনিয়েচার ছবি।
কীসের দলিল? কার ছবি?
আজকের হেস্টিংস হাউসের মেয়ে বোর্ডাররা মনে মনে যথেষ্ট ভয় রেখেও মুচকি হাসে, এ ওর দিকে আড়চোখে তাকায়। একজন বলেন, আমরা কি ছাই জানি? এই মেয়েটিকে নাকি ‘বিট্রে’ করেছিলেন হেস্টিংস।
ভূতটি তা হলে পেত্নী, অর্থাৎ নারী ভূত? জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমরা পরিচিত একটি মেয়েকে।
যে মেয়েরা দেখেছেন, তাঁরা তো তাই বলেন। উত্তর দিলেন তিনি। আর দারোয়ানেরা কী বলে শুনি? মাঝে পড়ে জিজ্ঞাসা করে বসলেন আমার স্ত্রী।
‘ওরা অবশ্য ভূতটিকে সাহেব বলেই বলে থাকে।’
ব্যস, আর বলতে হবে না। হেসে বললেন স্ত্রী। তারপর আমার বিমূঢ় মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এর পরও কি তোমার বুদ্ধিতে এর ব্যাখ্যা হল না? তা হলে আর হতে হবে না। আমি আজই লিখে দিচ্ছি মাকে, ওকে ওখান থেকে বাড়ি নিয়ে আসার জন্যে।’ ইত্যাদি।
এমনি সব আমার ভূত। হেস্টিংস থেকে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ডঃ জে জি ভস. কেউ ধোপে টেকে না। নিজের বুদ্ধি ঘায়েল হলেও স্ত্রীর বুদ্ধির আলোকে দিব্যি জট খুলে যায়, পাকা লিখিয়ের নোট বইয়ের মতো অল্পেই ব্যাখ্যা হয়ে যায়। অবশ্য দ্রষ্টব্য: ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ওই ঐতিহাসিক ভূতটিও প্রথম দৃষ্টিগোচর হয় ওখানে একটি মেয়েদের হস্টেল (Ellerton Home) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর।
মিথ্যে বলব না, ভূতদের আমি যথেষ্ট সমীহ করি, কিন্তু তবুও মনে মনে কেমন যেন একটা আক্ষেপ থেকে গেল, স্বচক্ষে তেনাদের কারও দর্শন পেলাম না বলে। অর্থাৎ খিদে আছে, কিন্তু খাবার ইচ্ছে নেই। ইতিহাসের ভূত ঘেঁটে ঘেঁটে এমনই আমার মানসিক অবস্থা। কত ভূতকাহিনী পড়লাম—পান্তভূত, জ্যান্তভূত, পেত্নী, ব্রহ্মদৈত্য, কবন্ধ, কেউ বাদ নেই। রাষ্ট্রনায়কের ভূত, সমাজ-নায়িকার ভূত, শিল্পীর ভূত, দেশি ভূত, বিদেশি ভূত—কিন্তু সব ছাপার হরফে। মা বলতেন ‘খাঁ-খাঁ দুপুর, ঊষা-ভোর আর, তিন-সন্ধ্যা, এই হচ্ছে ওদের আনাগোনার সময়। এ সময়ে এ বয়সে মাঠেঘাটে একা একা যেতে নেই, দাওয়ায় চুল মেলে শুয়ে থাকতে নেই।’ ইত্যাদি। বলতেন অবশ্য দিদিকে, কিন্তু উপলক্ষে আমি যে ছিলাম না তাও বলতে পারি না। তাই আজব নগরী দেখতে একা-একাই ঘুরতাম, বিশেষ করে ওই নিষিদ্ধ কালগুলোই ছিল আমার ঘুরবার সময় এবং ঘুরতামও মাঠেঘাটে নয়, কবরখানা থেকে কবরখানায়। কিন্তু মিথ্যা। কোথাও পেলাম না ধর্মতলা স্ট্রিটে ‘অজ্ঞাত আততায়ী কর্তৃক নিহত, মিসেস কুপারের প্রেতাত্মাকে,’ পেলাম না সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্য মি. শেক্সপিয়রের মৃত পিতাকে। হেস্টিংসসহ গোটা কাউন্সিল নাকি একসঙ্গে দেখেছিলেন এই ভদ্রলোকের প্রেতাত্মাকে। শোনা যায়, হেস্টিংসের আদেশে কাউন্সিলের খাতায় লিপিবদ্ধ করা আছে সে ভূত-দর্শনের কাহিনী।
যাক, অবশেষে স্থির করলাম, বৃহস্পতিবারের দুপুরে ঘুরতে হবে। যদিও দু’ সপ্তাহ পরেই বুঝতে পারলাম আমার ভুল হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার নয়, কলকাতার ইতিহাসে প্রেতসিদ্ধ বার হচ্ছে শনিবার। ইংরেজ ঐতিহাসিকেরাই আমায় জানালেন এ কথা। নিখুঁত তালিকা তৈরি করে রেখেছেন তাঁরা কলকাতার ইতিহাসে শনিবারের কৃতিত্ব সম্পর্কে। তাতে দেখা যায়, নন্দকুমার অভিযুক্ত হন শনিবারে, তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয় শনিবারে, এমনকী, তাঁর ফাঁসিও হয় শনিবারেই। ক্লেভারিং এবং মনসনের মৃত্যু শনিবারে এবং সর্বোপরি ভাদ্র মাসের শনিবারে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এতটা খেয়াল ছিল না সেদিন। একটা সদ্য-সন্ধান-পাওয়া কবরের খোঁজে ঢুকেছি সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরখানায়। ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে এল। চারদিক নিস্তব্ধ। হঠাৎ কা-কা করে এক-ঝাঁক কাক একরাশ ঢিলের মতো পড়ল এসে দূরের গাছটায়। পরমুহূর্তেই একসঙ্গে আর্তনাদ করে আবার ছিটকে পড়ল আকাশের গায়ে। গাছটা যেন বসামাত্রই বিছুটি হয়ে উঠেছে ওদের কাছে। কেন জানিনে, সহসা ছমছম করে উঠল গা-টা। মনে পড়ল আজ শনিবার। আরও মনে পড়ল মাসটা ভাদ্র এবং সময়টা তিন সন্ধ্যা। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা আমার সামর্থ্যের বাইরে। পাছে সেই বহু-আকাঙিক্ষত ‘দর্শন’ আজ ঘটে যায়, সেই আশংকাতেই তাড়াতাড়ি পা বাড়ালাম বড় পথটির দিকে। কিন্তু এ কী?
সাদায় কালোতে মেশানো কী একটা বস্তুপিণ্ড যেন নড়েচড়ে উঠল সেই গাছটার পাশেই, বাঁ-হাতি বড় কবরটার গা ঘেঁষে। ভাল করে দেখতে না দেখতে একরাশ শুকনো পাতা মাড়িয়ে এল সেই দীর্ঘকায় পুরুষমূর্তি। হ্যাঁ, একেবারে আমার সামনে। পাশ কাটাতে গিয়েও হোঁচট খেলাম। কোনওমতে গলায় জোর এনে বললাম, ‘আপ।’
জি, ইখানেই থাকি। পরিষ্কার বাংলায় উত্তর দিল সেই সশরীরী অশরীরী। কত লম্বা হবে তার দেহটি বলতে পারব না। উপরের দিকে তাকানোর মতো সাহস অবশিষ্ট ছিল না আমার কলজেতে। অনাবৃত সরু পা দু’খানার গায়ে রুক্ষ ললামগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই বললাম, এখানে মানে?
‘ই কবরখানায়। একটা বিড়ি হবে?’
বার করে দিলাম একটা সিগারেট। কালো একখানা জোব্বার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা নোংরা কর্কশ হাত। অস্পষ্ট অন্ধকারেও সে হাতের চেটোখানাকে মনে হল আমার অত্যন্ত ফ্যাকাশে, গাঁটগুলো বেশি মোটা। লোকটা হাতে রাখল সিগারেট। ধরাল না।
তোমায় ইদিকে মাঝে মধ্যে দেখি। আবার কথা বলল সেই কণ্ঠ। পায়ের তলায় যেন শিকড় গজিয়ে গেছে আমার। জুতো ফুঁড়ে এই কংকরাকীর্ণ রাস্তা ফুঁড়ে সে শিকড় যেন নেমে গেছে পাতালে। কারা টানাটানি করছে নীচে থেকে। সহস্র সহস্র কবরের নীচে থেকে লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত হাত। তবুও বললাম, হ্যাঁ, আসতে হয় মাঝে মাঝে।
তা আলবত আসবা। লেখাপড়ার কাম যখন, আসতি তো হবেই। সহসা একটু থেমে বলল, ‘কব্বর লিয়া’ এত লিখন, তা মুইগো কথা লেখ না কেনে?
সেরেছে। এ তো দেখি সবই জানে। অলক্ষে থেকে নিশ্চয়ই নিয়মিতভাবে দেখেছে আমার আনাগোনা, ফোটো তোলা সব। আর গোপন করা ঠিক নয়। বললাম, এবার নিশ্চয়ই লিখব, আপনাদের নিয়ে।
‘আর লিখে কী অইব। মুইগো নসিব ফতে হইয়া গেছেন লবারের সাথে।’ আশ্বাসের পরিবর্তে রীতিমতো আক্ষেপ ওর নাকি কণ্ঠস্বরে। প্রমাদ গুনলাম আমি। তবুও বললাম, কোন নবাব?
‘ক্যা?’ ঝাঁজিয়ে উঠল সেই ‘অজ্ঞাতলোকের পুরুষ’ মুর্শিদাবাদের লবাববাড়ির নাতিপো। ‘লবাব কইলকাত্তায় আইলেন, আমরাও আইলাম। আমার বাপজানের বাপ, নানা ছিলেন বড় ফৌজি। বাপও কম না। বাপবাপ, কী লড়াই। সাহেব মেম-সাইব ছুইটা পলাইল ফলতামুখী। আমাগো ডেরা পড়ল লালদিঘির কোণে।’
বলার শক্তি তখন আর নেই আমার। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি। সে বলে গেল, ডেরা তোমার হোগলার। তাও মন্দ কি। কিন্তু খোদাতাল্লা নারাজ। কয় রোজ বাদেই ফিন্ ফিরি আইল সায়েব সুবারা। নানা গাইব হইয়ে গেলান। বাপজান তখন নাবালক। তারপর যে কি অইল খোদাতাল্লাই জানে। মুই এখন ইখানে।
‘কেন? তোমাদের বাড়ি?’
‘মুইগো ফিন্ ঘরবাড়ি। বিদঘুটে হেসে উঠল লোকটা, ক্যান, কাগজে পড়নি? সায়েবরাই তো লিখেছিল—লাটের ল্যেইগ্যা মুইগো বাড়ি লিয়া লিছে।
‘তাই নাকি?’ এবার ভয়ের স্থান অধিকার করেছে আমার বিস্ময়, ‘কবে, কোন কাগজে বেরিয়েছে সে কথা।’
মনে মনে বিড় বিড় করে কী যেন হিসেব করল সে। তারপর বলল, ‘দু কুড়ি এক বছর। কী কাগজে কে জানে। কী হুনছি সাহেবদের কাগজেই।’
বলতে বলতে ধীরে ধীরে এগুচ্ছিল লোকটি। সঙ্গে সঙ্গে আমিও। ও পিছনে, আমি সামনে কিংবা পাশাপাশি। সহসা, ক্যাঁচ করে একটা আর্তনাদ হল সামনের রেলিংটায়। পিছনে তাকিয়ে দেখি, কেউ নেই। আমার সামনে পড়ে আছে চিরকালের সেই আধখোলা কবরখানার ভাঙা গেটটি আর পার্ক স্ট্রিট। ছুটে এক লাফে পা দিলাম রাস্তায়। পিছন ফিরে তাকালাম না একবারের জন্যও। মা বলতেন, যদি কখনও মনে হয়, ‘কেউ আছে সঙ্গে, পিছন তাকাতে নেই তখন’।
পিছনে আর তাকাইনি। কিন্তু তখনও মনে ছিল আমার নাকি সুরের সেই হিসেবটি, দু’ কুড়ি এক বছর। ইংরেজি কাগজ।’ অনুমান করলাম, কাগজটি ‘স্টেটসম্যান’ হতে পারে। প্রেতাত্মাদের হিসেবে ভুল হয় না। পরদিনই ‘দ্য স্টেটসম্যান’ অফিসে। বসলাম দু’ কুড়ি এক বছর আগেকার জরাজীর্ণ ‘দ্য স্টেটসম্যান’ কাগজের ফাইল নিয়ে। ওকে যাচাই করতে হবে আমার। হতেও পারে তো, নেহাত চোখের ভুল কিংবা মনের ভ্রান্তি। অতএব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি দিনের পর দিন ১৯১৫ সালের ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এর পাতা, কিন্তু কোথাও নেই ওর বাড়ির কথা, ওর বাপজান কিংবা নানার কথা। নিরাশ হয়ে উঠেছি। সুউচ্চ ফাইল ক্রমে ক্ষীণতনু হয়ে আসছে। আর ক’মাসের কাগজপত্র দেখতে বাকি। কিন্তু কে জানত, সেদিন প্রশস্ত দিনের আলোতে পাখার নীচে বসেও সজ্ঞানে আবার ঘামতে হবে আমায়। ১৯১৫ সালের ২৪ অক্টোবর তারিখের ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এর বিবর্ণ পাতায় প্রতিটি কথা অতি স্পষ্টভাবে দিব্যি পড়া যায় আজও: কলকাতার ক্লাইভ স্ট্রিটের পুরনো রয়েল এক্সচেঞ্জের ভিত খুঁড়তে গিয়ে সম্প্রতি দুটি কৌতূহলোদ্দীপক জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে। জিনিসগুলো হচ্ছে দু’খানা কুয়ো। গভীরতায় ওগুলো প্রায় কুড়ি ফুট। অনুমান করা হচ্ছে, এগুলো প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো। এই স্থানটিতে এককালে একটি বস্তি ছিল। পরে অবশ্য এখানকার বাড়িটাতে যথাক্রমে হেস্টিংস এবং ক্লাইভ বাস করে গেছেন।
অতঃপর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। ভাদ্রমাসের শনিবারের সন্ধ্যায় ওই অলৌকিক মনুষ্যদেহীটি কে কিংবা কী এর পর আর জানতে বাকি থাকার কথা নয় আমার। কিন্তু সত্যি বলতে কি, আজও তা রহস্যাবৃত রয়ে গেছে আমার কাছে।
তারপর বেশ ক’দিন পরের কথা। একটা দরকারি কাজে ও পথ দিয়ে যেতে হচ্ছিল। কাজের মনেই যাচ্ছিলাম। স্বভাববশতই একবার এমনি তাকালাম কবরখানাটির দিকে। গেটের গোড়ায় এককালের কবর-অফিসের বারান্দায় একটা শ্বেতপাথরের টুকরোতে লঙ্কা বাটছিল একটা লোক উপুড় হয়ে। বোধহয় কবরখানার দারোয়ানদের কেউ। খসে যাওয়া কোনও কবর-ফলককে বাটনা-বাটার উপকরণ করে নিয়েছে। যাকে বলে নোড়া। সহসা এক হাতে জোব্বার হাতা টেনে উপরে তুলে দিলে লোকটি। আশ্চর্য, সেই শীর্ণ ফ্যাকাশে হাত, মোটা মোটা কুঁচির মতো লোম— অনেকটা সেদিনের সেই লোকটির মতো। সেদিন ওর মুখের দিকে তাকাইনি, আজও, দিনের বেলাতেও সাহস হল না ওর মুখের দিকে তাকাবার। এক লাফে ছুটে গিয়ে উঠলাম ওদিকের ফুটপাথে। তারপর একেবারে সোজা নিজের ঠিকানায়।
তবে কি সে আদৌ প্রেতাত্মা ছিল না? না কি সেই প্রেতাত্মাই আজ আবার আমায় ধরতে চেয়েছিল অমন মিথ্যা বাটনা-বাটার ভান করে? এমনও তো হতে পারে, যাকে আমি দেখেছিলাম সে বাস্তবিকই ছিল প্রেতাত্মা, আর আজ যাকে দেখলাম, সে মানুষ। হয়তো সেই অশরীরীরই কোনও নিকট আত্মীয়, হয়তো তার ছেলে কিংবা নাতি। বাপ-ঠাকুরদার জমিতে লাটের বাড়ির জায়গা করে দিয়ে, আজ এই সব খুদে লাটদের কবর পাহারা দেয়, তাদের পরিত্যক্ত কবরে সংসার করে, কবর-ফলকে লঙ্কা বাটে।
বড়দিনের কলকাতা
ফুল্লরার মতোই কলকাতার বারমাস্যা। দুঃখ, আর দুঃখ। গ্রীষ্মে কাঠফাটা রোদ, অসহ্য গরম। বর্ষায় অঝোর বৃষ্টি, থই থই জল। অথচ গ্রীষ্ম আর বর্ষা বাদ দিলে হাতে থাকে মাত্র কটি মাস। কেননা, রোদ বৃষ্টি ঝড় এ শহরে পঞ্জিকা মেনে চলে না, তাদের দৌরাত্ম্য আপন আপন সীমারেখার বাইরে অনেক দূর প্রসারিত। পশ্চিমীদের চোখে কলকাতায় তাই দুটি মাত্র ঋতু, ‘হট’, আর ‘ভেরি হট’, গরম আর খুব-গরম। একমাত্র সান্ত্বনা অতএব শীত। মেকলের কথায় কলকাতায় বছরে চার মাস আমরা ভাজা-ভাজা হই, চার মাস হই সেদ্ধ, আর বাকি চার মাস ধরে জুড়োই। শীতের দেশে শীত জরার ঋতু, অন্ধকারের কাল, সব কুয়াশা আর বরফের তলায়। এখানে ঠিক তার উলটো। পাতা ঝরে, কিন্তু সর্বব্যাপ্ত সবুজ তবু অবিচল। গ্রাম-বাংলার মাঠে মাঠে তখনও ফসল, সর্ষে ফুল, কলাই, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, মুলো, রকমারি রবিশস্য আর সবজি আর চরাচরব্যাপী সোনা রোদুর। উঠোনে মাড়াই, পুকুরে টলটলে জল, গোয়ালের চালে লতানো লাউ অথবা শিম গাছ। নদী শান্ত, খেজুর গাছ রসস্থ। গাঁয়ের পথে টোপাকুল, গাঁদা ফুল, নতুন গুড়ের গন্ধ।
কলকাতায় শীত আসে ধুনুরির ধনুকের টংকারে, উল বোনার কাঁটায়, ফুলকপির উঁকিঝুঁকি আর জয়নগরের মোয়ায়। হঠাৎ পালটে যায় রোদ্দুরের রং, দিন ছোট হয়ে আসে, রাত নিবিড়। চৌরঙ্গির আকাশে নিওন আলোগুলো সন্ধ্যা রাত্তিরেই কেমন যেন নিবু নিবু, পথেঘাটে মানুষেরা সব ছায়ামানুষ। শেষরাতে উত্তরের জানালা বেয়ে নিঃশব্দে ঘরে ঢোকে হিমেল হাওয়া, ‘উঠি উঠি’ করেও সূর্যের আগে ওঠা হয় না আর। এ আলস্য কিছুক্ষণের। তাপরই কলকাতা চিরকালের ‘শীতের কলকাতা’। বাগানে বাগানে ফুল। গোলাপ, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা। পথেঘাটে। মাঠে মানুষের মেলা। রং, আর রং। রেশমী আঁচল, পশমী পুলওভার। ক্রিকেট, সার্কাস, পিকনিক, গানের আসর, চলচ্চিত্র উৎসব, ছবির প্রদর্শনী আরও কত কী! কখনও অকারণ পুলকে ঘুরে বেড়ানো। অথবা পিঠে চুল মেলে দিয়ে ছাতে বসে রোদ পোহানো।
এরই মধ্যে একসময় আসে বড়দিন। তারপর নিউ ইয়ারস ডে। ফাঁকে ফাঁকে পৌষ সংক্রান্তি, ইতু পুজো, মাঘমণ্ডলের ব্রত, সরস্বতী পুজো ইত্যাদি। কিন্তু শীতের কলকাতায় আর সব আবছা আবছা স্মৃতির মতো, মরসুমের সব উদ্যোগ যেন বড়দিন আর ইংরাজি নববর্ষ উপলক্ষ করেই। পার্ক স্ট্রিটে স্যান্টাক্লজ, নিউ মার্কেটের শো-কেসে বাহারি পোশাকের সমারোহ, মেটেবুরুজে ওস্তাগরের ব্যস্ততা, গ্রিটিংস কার্ডের ছোটাছুটি—সবই ওই দুটি দিনকে ঘিরেই। স্বভাবতই ইংরাজ বর্জিত এই শহরে। বিশেষ করে এই দিনগুলোতে মনে পড়ে বড় সাহেবদের কথা, যাদের উদ্যোগে এই দুঃখী শহরে হঠাৎ একটি দিন চিহ্নিত হয়েছিল—বড়দিন। কেমন করে বড়দিন উদ্যাপন করতেন ওঁরা?
ওঁদের মুখেই শোনা ভাল। ১৮৭৫ সালে চৌরঙ্গি থেকে লেডি গে স্প্যানকার নামে একজন ‘বড়িবিবি’ মধ্যপ্রদেশের পাগলাবাদ নিবাসিনী বান্ধবীকে লিখছেন: আগের চিঠির উত্তর নেই কেন? পথে মারা গেল নাকি? তবে গেছি! ওটা আবার দুষ্টু চার্লি সেন্টজনকে নিয়ে লেখা। তবে ভয়ের কিছু নেই, বাড়াবাড়ি কিছু লিখিনি। চার্লি আমার কে? স্প্যানকারের বন্ধু মাত্র, রোজ সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে চায়ের আসরে আসেন, এই যা।…যাকগে, আসল কথা বলি। গত পনেরো দিন ধরে কলকাতা সত্যিই খুশির শহর। প্রথমত, ক্রিসমাস ডে। আমরা সেদিন টমলিনসনদের ওখানে নেমন্তন্ন খেলুম। মিসেস টমলিনসন—যিনি চিরকাল গম্ভীর, খিটখিটে মেজাজের, তিনিও দেখলুম বেশ হাসিখুশি। চার্লি বলে ওটা নাকি শ্যাম্পেনের ফল। আমি বিশ্বাস করিনি। তবে কি জানো, ওঁর নাকটা এত লাল দেখাচ্ছিল। চার্লি কোন একজন গ্রিফিন সম্পর্কে খুব মজার একটা গল্প বলছিল। ছেলেটা শহরে সবে এসেছে, ‘হরিৎ শৃঙ্গী’, যাকে বলে। ক্রিসমাস ডে’-তে একজন বিখ্যাত লোকের বাড়িতে তার নেমন্তন্ন। ভাগ্য এমনই খারাপ, পাতে পড়ল একটা পচা ডিম। তা, গৃহকর্তার মেয়ে— তাকে তুমি চেন—লজ্জায় বিবর্ণ, বলল—অত্যন্ত দুঃখিত, দাঁড়ান পালটে দিচ্ছে। কিন্তু ছেলেটি নাছোড়বান্দা। সে বলল—না, না, দরকার নেই, আমি এই ডিমই পছন্দ করি। খুব মজার ব্যাপার, তাই না?
: বড়দিনের মুখে জি-জি’র (গভর্নর জেনারেল) ওখানে সান্ধ্য আসর বসেছিল। দু’ ঘণ্টা ধরে আমরা শুধু ঘুরে গল্পই করলুম, সক্কলের এক কথা—নাচ হবে কি? হয়নি শেষ পর্যন্ত। অথচ চার্লি বলছিল, নোয়া’জ্ আর্ক বাদ্য বাজবে, জন্তুরা জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়াবে। তবে হ্যাঁ, কানাঘুষোয় শোনা গেল, জি-জি অচিরেই ‘বল’ লাগাচ্ছেন। খবরটা সত্যি হলে খুবই ভাল হয়। অপেক্ষায় আছি।
: সামনের মাসে এখানে অবশ্য একটা ‘ফ্যান্সি বল’ হচ্ছে। স্প্যানকার আমাকে বলছে ‘মেষপালিকা’র বেশে যেতে। আমার মোটে পছন্দ নয়। চার্লি বলছে, সে আমাকে ‘লর্ড ডানড্রেরি’ সাজিয়ে দেবে। দাড়ি, গোঁফ সব থাকবে। কাউকে বোলো না যেন। ইতিমধ্যে ইউনাইটেড সার্ভিসের ক্লাব একটা ‘বল’ দিচ্ছে। সুতরাং সে যাচ্ছে না। চার্লিই আমাকে নিয়ে যাবে। ইডেন গার্ডেনস-এ ব্যান্ড স্ট্যান্ড জমজমাট। সেই অদ্ভুত বংশীবাদক বিদেয় নিয়েছে। ভালই হল। বুড়ো ম্যাকেঞ্জি কিন্তু ওর খুব ভক্ত ছিল…বৃহস্পতিবার আমরা অপেরায় গিয়েছিলুম। ইতালিয়ান অপেরা সত্যিই দেখবার মতো। দৈনিক কাগজে কোনও সমালোচনা কিন্তু দেখলুম না…
: নিউ ইয়ারস ডে-তে বেলভেদেরে ফ্যান্সি ফেয়ার হয়েছিল। আমি যেতে পারিনি। চার্লি আমার জন্য ব্যারাকপুরে পিকনিকের একটা টিকিট নিয়ে এসেছিল কিনা, তাই। পিকনিকের আয়োজন করেছিল কলকাতার ব্যাচেলররা। সবসুদ্ধ দেড়শো মানুষ। জায়গাটা দিয়েছিলেন এখানকার একজন রাজা। চমৎকার আসর। নাচের ফ্লোর এত পিছলে ছিল যে, চার্লি সব সময় ধরে না থাকলে হয়তো পড়েই যেতুম। ভোর চারটে অবধি নেচেছিলুম আমরা।…যেতে যেতে দেখলুম ব্যারাকপুরে মিঃ হগের পিকনিক আসরেও অনেকে যাচ্ছে।…মিনি কালভার্ট গিয়েছিল জনসনদের সঙ্গে বোটানিক্যাল গার্ডেনে। নদী পার হওয়ার সময় পকেটে খুচরো খুঁজে না পেয়ে জনসন একটা দশ টাকার নোটই দিয়ে দিলে। ছ’আনার জায়গায় দশ টাকা, বুঝতেই পারছ।…নদীতে এখন ‘গ্লাসগো’ নোঙর করে আছে। নাবিকেরা একটা পার্টি দিচ্ছে জাহাজেই।…বদলি হিসাবে আমাদেরও একটা কিছু আয়োজন করতে হবে বই কি…ইত্যাদি ইত্যাদি।
লক্ষণীয় ‘যদিও খ্রিস্টের জনম-দিন বড়দিন নাম’ তবু এই আমুদে-বিবির চিঠিতে গির্জা, পাদরি ইত্যাদির উল্লেখ পর্যন্ত নেই। অথচ, সবাই জানেন, বড়দিন উপলক্ষে ধর্মীয় কৃত্যও অনেক। কিন্তু সেকালে সে-সব গৌণ। শহরের শৈশবে তো বটেই, বোধহয় যৌবনেও।
১৬৯৮ সালে কোম্পানিকে নতুন করে সনদ দেওয়ার সময় শর্ত ছিল: ৫০০ টনের জাহাজমাত্রেই একজন করে পাদরি বয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেই সঙ্গে নিয়ম ছিল প্রত্যেক ‘গ্যারিসন’ এবং ‘ফ্যাক্টরি’তেও একজন করে পাদরি রাখতে হবে। চল্লিশ বছর ধরে কোম্পানি প্রথম নির্দেশটি এড়িয়ে গেছে সুকৌশলে। পাঁচশো’র বদলে তাঁরা ভারতের দিকে ডিঙা ভাসাতেন চারশো নিরানব্বই টনের। কেল্লা কিংবা অফিসেও পাদরি থাকতেন কদাচিৎ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য রাজকীয় নির্দেশ এড়ানো সম্ভব হয়নি। কোম্পানিকে পাদরিও নিয়োগ করতে হত। প্রথমদিকে কলকাতায় পাদরির মাইনে ছিল বছরে একশো পাউন্ড। তৎসহ নানা ভাতার বন্দোবস্ত। পালকির খরচও পেতেন তিনি। কাজ ছিল দিনে দু’বার প্রার্থনা, রোববার সুসমাচার প্রচার। তা ছাড়া, বিয়ে, শেষকৃত্য ইত্যাদি। তার জন্য উপরি নজরানাও ছিল অবশ্য। সুতরাং, রাজার হালে থাকতেন ওঁরা। শোনা যায়, বিশপ হিসার যখন কলকাতায় আসেন, তখন উদ্বিগ্ন হিন্দু সমাজপতিরা তাঁর সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য চর নিয়োগ করেছিলেন। তারা বিশপ বাহাদুরের প্রাসাদ, ভৃত্যবহর, পোশাক-পরিচ্ছদ এসব দেখে এসে রিপোর্ট দিল: আর যাই হোক, এই পাদরি সম্পর্কে হিন্দুদের কোনও উদ্বেগের কারণ নেই।
তা সত্ত্বেও অনেক যাজকেরই নাকি কলকাতা মোটে ভাল লাগত না। ফ্রান্সিসের সেক্রেটারি ম্যাকরারি বলেন কলকাতার একজন পাদরি শিকারে অতুলনীয়, আর একজন সৈন্যবাহিনীতে বলদ সাপ্লাই করেন, তৃতীয়জনের নেশা চিনা কায়দায় বাগান করা। কোনও কোনও পাদরির বদ নেশাও ছিল। কাউকে কবর দিতে হলে অনেক সময় পাদরিকে ধরে আনতে হত নাকি জুয়ার আড্ডা থেকে। প্লাট নামে এক পাদরির কথা বলেছেন হিকি। সেই পাদরিপ্রবর নাকি মাতাল হয়ে চার্চেই এক একদিন যাচ্ছেতাই কাণ্ড করতেন।
ফলে ১৭৪৪ অবধি যদিও নিয়ম ছিল চার্চে না গেলে নগদ জরিমানা ১২ পেনি, এবং সপ্তাহের জন্য গৃহবন্দি, তবু অনেকেই তা এড়িয়ে চলতেন। এড়িয়ে চলতেন যথাসম্ভব পাদরিদেরও। একজনের কৈফিয়ত—তা ছাড়া উপায় কী, ধর্মশীল পাদরি সাহেবের মতে আমার মুখের দশ ভাগের নয় ভাগ শব্দই নাকি ‘কন্ট্রাব্যান্ড’ মানে নিষিদ্ধ। ধর্মশীলা মেমসাহেব বলেন আমি গির্জায় যাইনে বটে, কিন্তু দাসী যখন চুল আঁচড়ায়, আমি কিন্তু তখন ঘরে বসে বাইবেলই পড়ি।
গির্জায় তবু যে ভিড় জমত, সে নাকি অন্য কারণে। হিন্দুস্থানিরা বলে—সুন্দরী মেয়ে দেখতে আর ইংরাজি কথাবার্তা শিখতে। স্থানীয় লোকেদের লক্ষ্য তাই। হলে বিস্ময়ের কিছু নেই। সাহেবমেমদের কাছে চার্চ ছিল কিন্তু কনে আর বর পছন্দের ঠাঁই। নবাগত মেয়েদের হাত ধরে আসনে পৌঁছে দেওয়া সেকালের গির্জায় পুরুষের বিশেষ কৃত্য। আসনগুলোও সাজানো ছিল কায়দা করে, মেয়েরা বসত পুরুষের দিকে মুখ করে। ফলে, প্রার্থনাসভা ভাঙলে দেখা যেত এখানে ওখানে ভিড় জমে গেছে, এবং দক্ষিণা চড়িয়ে দিয়ে জোড়া-পিছু পঞ্চাশ সুবর্ণ গোলক গুনে নিয়েও কাজ সারতে পারছেন না পাদরি সাহেব। গিয়েছিলেন যাঁরা একা একা, বেরিয়ে আসছেন তাঁরা জোড়ায় জোড়ায়।
যাঁদের সেসব ভাবনা নেই, মিছিমিছি কেন তাঁরা ভিড় জমাবেন চার্চে? অনেকেই নাকি ভুলে যেতেন, দিনটি রবিবার। ইজ ইট সানডে? বন্ধুর উত্তর ইয়েস, কেননা দেখছি নিশান উড়ছে। কলকাতার ইংরাজের এই কথোপকথন নিয়ে অনেক কথাই হয়েছে। ১৮৭৫ সালেও অতএব এই শহরের কাগজে কার্টুন দেখি চার্চে গিয়ে ছোট মেয়ে বলছে, ঠাকুমা, আমাদের অপেরা গ্লাস নিয়ে এলে না তো। বড়দিনে, নববর্ষে ওঁরা নিশ্চয়ই “জমকে পোশাক পরি গাড়ি আরোহণে চার্চে যান সুরূপসী শ্ৰীমতীর সনে।” কিন্তু পরক্ষণেই “ভজনা হইলে পর উঠে দেন ছুট সহিস বোলাও বগী ড্যাম ড্যাম হুট।”
‘ঢল ঢল ঢল ঢল বাঁকা ভাব ধরে’ ‘বিবিজান’ দর্শকদের ‘লবেজান করে’ কোথায় চলে গেলেন, অনুমান করা শক্ত নয়। দেবদারু পাতা, কলা গাছ, আর গাঁদা ফুলের মালায় সাজানো হয়েছে ঘরদোর। সেখানে নিশ্চয় বড়খানার আয়োজন সেদিন। সাহেব পাড়ায় সাধারণ নিয়ম: সকালে ‘ছোটা হাজরি’ বা ব্রেকফাস্ট। তারপর অফিস, আদালত, কাজকর্ম। বেলা দুটোয় ডিনার, মধ্যাহ্নভোজ। প্রত্যহ কমপক্ষে আট পদ চৰ্যচোষ্য লেহ্য পেয়। ১৭৮০ সালের একটি মেনুতে দেখছি আছে: স্যুপ, রোস্ট মুরগি, কারি-রাইস, মটন পাই, ল্যাম চপ, রাইস পুডিং, টার্ট, চীজ, মাখন-রুটি ইত্যাদি। তৎসহ ফাঁকে ফাঁকে মদ্য। ‘বর্ধমান স্টু’ নামে একটা অদ্ভুত ডিশের কথাও শোনা যায়, তাতে মাছ, মাংস সবই নাকি থাকত। স্বভাবতই খেতে খেতে দুপুর গড়িয়ে আসত। তারপর, নিজেদের গড়িয়ে নেওয়ার পালা। সন্ধ্যায় হাওয়া খেতে গাড়ি হাঁকিয়ে ময়দানের দিকে চলে যাওয়া। সেখানে নাকি তৎকালে নানা সম্ভাবনা অপেক্ষা করে থাকত। একালের কোনও কোনও বাংলা উপন্যাসের মতোই নায়ক-নায়িকারা প্রায়শ মুখোমুখি হতেন ‘দৈবাৎ’, কোনও দুর্ঘটনা উপলক্ষে। হাওয়ার বদলে ধুলো খেতেও অতএব আপত্তি ছিল না উদ্যমশীলদের। বাড়ি ফিরে চা-পান, তাস, অথবা ঘরোয়া গানের আসর। নয়তো অন্য কারও বাড়ি বেড়াতে যাওয়া। এক এক দিন সন্ধ্যায় কাউকে কাউকে এক ডজন বাড়িতে উঁকি দিতে হত। মেমসাহেব সামাজিকতা সেরে বাড়ি ফিরে দেখতেন, তাঁর অপেক্ষায় প্রতিবেশিনী অথবা বান্ধবীরা বসে। কোনও আগন্তুককে টুপি খুলতে বলার অর্থ তখন, অনুগ্রহ করে রাত্তিরে আমাদের সঙ্গে খেয়ে যাবেন। রাত্তিরের খাওয়া দশটায়। তারপর মেজাজ, মর্জি, পরিবেশ এবং পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে হয়তো শেষরাত্তির অবধি চলবে নাচ, গান, হুল্লা। বড়ঘরে বলতে গেলে রোজই তখন বড়দিন, ছোট হাজরিতে হাজির থাকেন গড়ে তিরিশজন, ডিনারে পঞ্চাশজন, সাপার মাঝরাত্তিরে, তারপর নাচতে নাচতে রাত কাবার।
বড়দিনে স্বভাবতই আরও ‘বড়খানার’ আয়োজন সাহেবপাড়ায়। ‘গভর্নমেন্ট হাউস’ থেকে শুরু করে সাব-অলটার্নের ঘর—সর্বত্র ব্যস্ততা। অতিথির আনাগোনা। যাকে বলে ক্রিসমাস কার্ড তা আদানপ্রদানের রেওয়াজ ছিল না তখন, খাস বিলেতেই কার্ডের চল হয়েছে উনিশ শতকের মাঝামাঝি। কলকাতায় ছিল ‘চিট’, হাতে লেখা চিরকুট। মেমসাহেব সেই কাগজের টুকরো পাঠিয়েই নিমন্ত্রণ জানান অন্যকে। একটা ছবিতে দেখছিলাম নিমন্ত্রণপত্র হাতে বিহুল একটি তরুণী দাঁড়িয়ে আছেন, চিঠিতে লেখা: ডিয়ার গ্রেস, কাম অ্যান্ড ডাইন উইথ আস, বাট প্লিজ ডোন্ট ড্রেস। ইওরস এভার জেমিমা। সব নিমন্ত্রিতরা একসঙ্গে মিলিত হওয়ার পর কী কাণ্ড হত সহজেই অনুমান করা যায়, বাটলার পর্যন্ত নাকি রাতারাতি ‘বুটলিয়র সাহেব’ বনে যেত। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে কিচেন থেকে খাওয়ার টেবিল পর্যন্ত তার আনাগোনা, সে নাকি ওয়েলিংটনের সমর-কৌশলের মতোই দর্শনীয়। দারোয়ানদের কাজ ছিল অতিথিদের খিদমতগারবাহিনীকে সার্চ করা, পাছে কাঁটা-চামচ ইত্যাদি খোয়া যায়। রাজভবনে কার্জন নাকি আড়চোখে দেখতেন, তাঁর অতিথিরা চুরুট চুরি করছেন।
বড়লাট ভবনে অবশ্য বড়দিন ছাড়াও অনেক বড় পরব ছিল নিউ ইয়ারস ডে, রাজা-রানির জন্মদিন, শ্রীরঙ্গপত্তমের পতন বার্ষিকী ইত্যাদি। প্রথম প্রথম কলকাতার বড় উৎসব ১৫ নভেম্বরের সাহেবি ‘বিজয়া-সম্মেলন’। ভাগীরথী তীরে আগন্তুকদের গড় আয়ু নাকি তখন ‘দুই বর্ষা’। সুতরাং, বর্ষায় যাঁরা ধুয়ে মুছে যেতেন না, নভেম্বরে একসঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁরা একটু আমোদ-আহ্লাদ করতেন। তারপর ক্রমে স্থিতি এবং হরেক উৎসবের জন্য আকুলি-বিকুলি। ওয়েলেসলির আমলে রাজভবন কোনও খানদানি ক্লাববাড়ি যেন। সেখানে নিত্য পরব, সপ্তাহে একদিন ‘পাবলিক ব্রেকফাস্ট’, মাঝে মাঝে ডিনার, সাপার, বল। ‘পাবলিক ব্রেকফাস্ট’ কর্নওয়ালিস বন্ধ করে দিয়েছিলেন, কিন্তু রাজভবনে আমাদের ঘাটতি হয়নি তবু। ১৮০৩ সালে ওয়েলেসলি যদি আটশো অতিথিকে নিয়ে সারা রাত নেচে গেয়ে খেয়ে কাটিয়ে গিয়ে থাকেন, তবে একশো বছর পরে কার্জনও তাই করে গেছেন। সেদিন ‘শতবার্ষিকী বল’-এ তিনি নিজেই সেজেছিলেন ওয়েলেসলি। একজন প্রত্যক্ষদর্শী লিখছেন: সেদিন আমরা নিজেরাই আমাদের ঠাকুরদা, ঠাকুমা। আবার এক রাত্তিরের জন্য ওয়েলেসলির কালে ফিরে গিয়েছিলুম আমরা। একশো বছর আগে এই হল ঘরে যে পোশাক দেখা গেছে, যে ভাষা শোনা গেছে, আবার ফিরে এল সব। আবার সেই হারানো দিনের হারানো নাচ। ১৮২৭ সালের ডিসেম্বরে লর্ড আমহার্স্টের জন্য সার চার্লস মেটকাফ আয়োজন করেছিলেন অন্য আসরের, নিমন্ত্রিতরা এসেছিলেন শেক্সপিয়রের নানা চরিত্রের সাজে সেজে। লর্ড মিন্টোর উপস্থিতিতে ব্যারাকপুরে এক আসরের সংগীত ছিল ‘মেরিলি ড্যান্সড দি কুয়েকারস ওয়াইফ।’ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জয়ধ্বনির পরে নতুন গান ‘মানি ইন বোথ্ পকেটস।’
মরসুমে হোটেলে ট্যাভার্নেও হরেক আয়োজন। হোটেল এলাকা তখন ডালহৌসি স্কোয়ার লালবাজার অঞ্চল। ‘হারমনিক’, ‘লে গ্যালিস’, ‘লন্ডন ট্যাভার্ন’ ইত্যাদি। শীতে সেখানে যাকে বলে বিপুল আয়োজন। ‘লে গ্যালিস’-এ এমন এক ডিসেম্বরের রাত্রেই ভোজের টেবিলে বসে গ্র্যান্ড সাহেব শুনেছিলেন তাঁর স্ত্রীর কাণ্ড। মই খাটিয়ে মাদাম গ্র্যান্ডের শোবার ঘরে নাকি হাজির হয়েছিলেন ফ্রান্সিস। কলকাতার সেই অবিস্মরণীয় কাহিনী। ১৭৮৮ সালের একটি বিজ্ঞাপনে দেখছি ধর্মতলায় কাশীনাথবাবুর বাগানবাড়িতে ‘ভক্স্হল স্যান্ড ফায়ার ওয়ার্কস’, সেখানে ‘গার্ডেন অভ প্লেজার’ বা লুকোচুরি খেলার জন্য গোপন কুঞ্জও রয়েছে। টিকিট ষাট টাকা। ১৮২৯-এ কসাইটোলায় মিঃ হিগস আর মিসেস রামসবটম-এর উদ্যোগে মুখোস-নৃত্য আর নৈশ-ভোজের আয়োজন। টিকিট মাত্র তিন সিক্কা টাকা। নাচের পর খাওয়ার টেবিলেও অনেকে নাকি মুখোস খুলতে চাননি। একটি লঘু-কাগজে এমনই এক মুখখাস-নৃত্যের আসরের বিবরণে দেখা যাচ্ছে: এক তরুণ মুখখাস-পরা একটা মেয়েকে বলছে ‘মিস স্মিথ, এরপর কি আপনি আমার সঙ্গে একটু নাচবেন?’ আঁতকে উঠে মিস স্মিথ বলছেন ‘কিন্তু আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?’ ছেলেটির জবাব, ‘আপনার সঙ্গের লোকটিকে দেখে।’
নাচ আর নাচ। এদেশের মানুষ জানালা দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি দিত, আর বলত পাগল। সাহেব মেমদের নাচ তখন ‘পাগল নাচ’। যুক্তি: পয়সা দিলেই যখন নাচনেওয়ালিই মেলে, তখন নিজেরা এত পরিশ্রম করা কেন? প্রথম দিকে সাহেবরা অবশ্য তা-ই করতেন। কিন্তু ঝাঁকে ঝাঁকে মেমদের অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে দেশি বাইজিদের কুর্নিশ করে বিদায় নিতে হল মিলিটারি ছাউনিতে। নাচঘর অতঃপর পুরোপুরি মেমদের দখলে। ম্যাকরাবি লিখছেন: মেয়েরা এমন নাচ নাচছে যেন আর মাত্র ঘণ্টাখানেক তাদের পরমায়ু। এমিলি ইডন অবাক হয়ে গেছেন তাদের কাণ্ড দেখে, এই ফার্নেসেও এমন করে নাচতে পারে মানুষ। নাচের আসর নিয়ে তৎকালে নানা কানাঘুষা। গির্জার মতোই ভালবাসার ফাঁদ পাতা নাকি সেখানে। ফলে পরদিন শহরে জল্পনা: কে কার সঙ্গে নেচেছিল, কার বিয়ের ফুল ফুটল বলে, কার আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেল, আর কারাই বা সোজা চলে গেল নাটমন্দির থেকে শয়নমন্দিরে। সোফিয়া গোল্ডবোর্ন:(১৭৮৯) লিখেছেন মেয়েরা নিজেরাই এখানে আরশির মতো। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছেলেরা জীবনের অর্থ খোঁজে। হুঁশিয়ার না থাকলে কলকাতায় যে-কোনও মুহূর্তে লুঠ হয়ে যেতে পারে তোমার সম্মতি। যে-কোনও সন্ধ্যায়। তখন আর পিছু হঠবার উপায় নেই। তাড়াহুড়োর বিয়ের পর, ধীরেসুস্থে অনুশোচনাই নিয়তি।
কে কোন পোশাকে নেচেছিল, বড়দিনের পর প্রতিবেশীদের কাছে সেটাও জরুরি আলোচ্য বইকি। প্রসঙ্গত অতএব ফ্যাশানের কথাও কিছু বলা দরকার। ফ্যাশানে আজ আমরা নাকি দুনিয়ার আর-সব উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পা মিলিয়ে চলছি। টন টন স্নো, পাউডার উড়ে যাচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় কেশসজ্জার বিপণি, যত্রতত্র ‘বুটিক’, পথে পথে ফ্যান্সি প্যারেড। কলকাতার পথে গরুর গাড়ি থেকে শুরু করে অতিআধুনিক মোটর গাড়িসহ যেমন যাবতীয় যানের আনাগোনা, ঠিক তেমনই পৃথিবীর তাবত পোশাকের শোভাযাত্রা। সেকালের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অন্য রকম। আজকের মতো শৌখিনেরা তখন বড় বড় চোখ করে পশ্চিমের দিকেই তাকিয়ে থাকতেন বটে, কিন্তু সে যেন শবরীর প্রতীক্ষা, দিন আর ফুরোয় না। সুয়েজের আগে জাহাজ আসতে সময় লাগে প্রায় ছ’ মাস। এদিকে শহরে ‘ইউরোপ শপ’ মাত্র গুটিকয়, তাদের ভাণ্ডারেও সব পুরানো, পচা ডিজাইন। নিউ মার্কেট তখনও অবয়ব লাভ করেনি, মেমসাহেবের ভরসা তখন প্রধানত ‘বিক্রিওয়ালারা’, অর্থাৎ ফেরিওয়ালা। সুতরাং নবাগত কেউ এলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ত তার ঘরে, নতুন নতুন ডিজাইনের খোঁজে বাক্স-তোরঙ্গ সব তছনছ। তারপর তা-ই নিয়ে ছোট, ‘ডিরজি’র কাছে। অনেক মেমের মাইনে করা ওস্তাগর ছিল। অন্যরা বাড়ি গিয়ে কাজ বুঝে নিয়ে আসত। দরজির সৌভাগ্য দেখে এক রসিক সাহেব কপট ঈর্ষা প্রকাশ করেছেন: আমাদের যেখানে ছাড়পত্র নেই, ওদের সেখানে অবাধ গতি। যে প্রতিমা আমাদের স্পর্শাতীত, দরজির কাছে তা যেন খেলার পুতুল মাত্র।
একবার জাহাজ থেকে নামল কয়টি মেয়ে। অদ্ভুত তাদের পোশাকের ছাঁদ। কোমরে কোনও বন্ধনী নেই, দেখে মনে হয় যেন মা হতে চলেছে তারা। এক ডাচ সাহেব নাকি মন্তব্য করেছিলেন এ কী অলক্ষুণে কাণ্ড। হায়, ওদের বেচারা মা-বাবার কথাই ভাবি। মেয়েদের পোশাক চিরকালের মতো তখনও অন্যতম সমালোচনার বিষয়। কলকাতার সাহেবি কাগজে কার্টুন: টিপয় ভেবে অতিথি গৃহস্বামিনীর পিছনে স্তূপীকৃত পোশাকেই নিজের টুপিটি রেখেছেন। আর এক কার্টুনে দেখা যাচ্ছে: তরুণ নাচের আসরে তরুণীর পোশাক মাড়িয়ে দিচ্ছে। ক্ষমা চাওয়ার বদলে তার আর্জি—পোশাক মাটিতে লুটিয়ে না পরে একটু উপরে থাকলে ভাল ছিল না কি? অথচ, পদযুগল প্রকাশিত হলেও বিপদ। থিয়েটারে একটি মেয়ে এক ধরনের মিনি-স্কার্ট পরে নেচেছিল। পরক্ষণেই কাগজে পদ্য:
Now in this land of pegs
It’s not the acting that we want,
We like to see good legs,
Legs, Legs, Legs,
All Calcutta is running after legs, legs, legs…
শহর তখন অল্পেই মাতাল। কীসে যে তার আমোদ, আর কীসে নয়, বলা শক্ত। থিয়েটার, অপেরা, পিকনিক, ক্রিকেট, বোট রেস, শিকার—বড়দিনের কলকাতায় ঘাটতি নেই কোনও কিছুর। কলকাতায় থিয়েটার সেই আদ্যিকাল থেকে। ক্যালকাটা থিয়েটার, হুইলার থিয়েটার, চৌরঙ্গি থিয়েটার, এথেনিয়াম, থিয়েটার বৈঠকখানা। ভ্রাম্যমাণ দলও আসত। কলকাতায় প্রথম ঘোড়দৌড় ১৭৯৮ সালে, প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ ১৮০৪ সালে, বোট রেস ১৮১৩ সালে। ১৮৭০ সাল অবধি রেস হত সকালে।
মাঠে তাঁবু পড়ত। খাওয়াদাওয়া এবং নাচের ব্যবস্থা ছিল সেখানেও। প্রথমদিকে রেস হত এলেনবরা কোর্স-এ, খিদিরপুরে আকরার মাঠে। তারপর আজকের অঙ্গন। সাহেবদের দেখাদেখি বাঙালিবাবুরাও রেস চালু করেছিলেন। ছাতুবাবুর আমলে অন্যতম আমোদ ছিল বুলবুল পক্ষীর লড়াই, তাঁর দৌহিত্রের আমলে পক্ষীরাজের দৌড়। সে রেসকোর্স ছিল শহরের উত্তরে, রাজা নরসিংহের বাগানে। থিয়েটারও ছিল বাংলা নাটক দেখাবার জন্য। কিন্তু ২৫ নম্বর ডোমতলায় ১৭৯৫ সালে লেবেদফের বাংলা থিয়েটারেও সাহেব, মেমদেরই ভিড়। কেননা টিকিটের হার: বক্স—ষোল সিক্কা টাকা, গ্যালারি—আট সিক্কা টাকা। সাহেবি থিয়েটারের অনুপাতে নজরানা অবশ্য খুব বেশি নয়। সে বছরই অন্যরা ‘ট্রিক আপন ট্রিক’, ‘দ্য পুওর সোলজার’ দেখাচ্ছেন কলকাতায়, ৬৪ সিক্কা টাকা করে তার টিকিট। সিজন টিকিট কিনলে অবশ্য কিঞ্চিৎ সস্তা, দুটি শো’র জন্য দিতে হবে ১২০ সিক্কা টাকা। বেশ কিছুকাল পরে সার্কুলার রোডের ‘অ্যাথেনিয়াম’ থিয়েটারে টিকিটের দাম ছিল এক গোল্ড মোহর। তবু লেবেদফের সস্তা থিয়েটারে বাঙালিদের ভিড় করার প্রশ্নই ওঠে না। বিশেষত রুশ সাহেবের যা বাংলা। ‘কাল্পনিক সংবদল’-এ অভিনেতা বলছেন ‘এখনকার দিনে স্ত্রীলোক সকল এমন মত্তা হইয়াছে যে কিঞ্চিৎ মর্ন্দা আকারের ম্যায়া হয়, তাহারাই উপযুক্ত পুরুষ হৈতে।
এই সংলাপ শুনে না জানি সে কী হাসির হুল্লোড়। বড়দিনের কলকাতা খুশির কলকাতা। কোনও কারণে মন যার কিঞ্চিৎ বিষন্ন, তার জন্যও রয়েছে খুশির আয়োজন—শ্রীমতী ‘বোতল সুন্দরী’। আহারের মতো পানের জন্য এদেশের ইংরাজ বিশেষভাবে খ্যাত। একজন সাধারণ সাহেবের ‘সেলার’-এর দিকে তাকালেই নাকি বোঝা যেত, এ খ্যাতি অমূলক নয়। জন এসেছে পিটারের বাড়ি। এসেই জিজ্ঞাসা—কী আছে ঘরে? পিটার: বিয়ার চার বোতল, ক্ল্যারেট বারো বোতল, স্যাক নয় বোতল, মদিরা একশো বোতল। ওয়াইন কী আছে, তাই বলে জন আবার জানতে চায়। পিটার উত্তরে সবিনয় জানাল কেপ অব গুড হোপ থেকে আনা ফরাসি ওয়াইন আছে চার বোতল, তাছাড়া সাদা ওয়াইন, লাল ওয়াইন, ক্লারেট, রেনিস, মসেল, মালমসি, পাম, পেরিয়া… আবগারির আয়োজন সত্যই তুলনারহিত।
অষ্টাদশ শতকে এদেশে সাহেবদের প্রিয় পানীয় ছিল ‘আরক’। তা বাংলা হোক আর গোয়ানই হোক। আরক দিয়ে পাঁচমিশেলি পাচন তৈরি হত একটা, তারই নাম পাঞ্চ। পাঞ্চ থেকেই পাঞ্চ হাউস, জনপ্রিয় পাব, সেকালের খালাসিটোলা। এ ছাড়া ছিল তাড়ি, গেরি। ছিল পোটার, বাস্ অ্যালসপ্ ইত্যাদিও। ১৮১০ সাল অবধি খানদানি সাহেবরা নাকি হুইস্কি ছুঁতে চাইতেন না, কারণ ওটা দেখতে অনেকটা সস্তা আরকের মতো। ঈশ্বর গুপ্তের ‘বীর’ তথা বিয়ারও ছিল অবশ্য। তৎকালের সামাজিকতায় টুপির মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তার। কেউ যদি বলতেন একটু বিয়ার পান করে যান, তা হলে বোঝা যেত গৃহকর্তা খেয়ে যেতে বলছেন। ১৭৮৭ সালে একশো বোতল পেল এল-এর দাম দেড়শো সিক্কা টাকা। সুতরাং ১৮১৪ সালে কলকাতার সাহেবদের মুখে পদ্য: ‘হোয়াট আর দ্য লাকসারিজ দে বোস্ট, দেন হিয়ার দি ললিং কোচ, দি জয়েস অব বটল্ড বিয়ার।’
বলা বাহুল্য, বড়দিনে এই তরল আমোদের একটা অংশ জোগাতেন নেটিভরা। আর, তাঁদের অগ্রগণ্য সেদিন কলকাতার বাবুরা। তাঁদের দেওয়া ‘ডালিগুলো বাদ দিলে সাহেবপাড়ায় বড়দিন বোধহয় অনেক হালকা হয়ে যায়। বাঙালির প্রার্থনা সেদিন: ‘হে শুভংকর। আমার শুভ কর। আমি তোমার খোশামোদ করিব, তোমার প্রিয় কথা কহিব, তোমার মন রাখা কাজ করিব, আমায় বড় কর।…হে মানব, টাইটেল দাও, খেতাব দাও, খেলাত দাও, আমাকে তোমার প্রসাদ দাও।…হে ভগবান, আমি অকিঞ্চন। আমি তোমার দ্বারে দাঁড়াইয়া থাকি, তুমি আমাকে মনে রাখিও। আমি তোমাকে ডালি পাঠাইব, তুমি আমাকে মনে রাখিও।…
সাহেবরা বলতেন ‘ডলি’। এক সাহেব লিখেছেন: ‘ডলি’ প্রাচুর্যময় প্রাচ্যে ভিজিটিং কার্ড। শুধু ফলমূল, ফল কিংবা হাঁস, মুরগি আর ‘চেরী, ব্রান্ডি, বীর’ নয়, ‘ডলি’তে অনেক সময় অন্য উপহারও থাকত। ফ্যানি পার্কস এলাহাবাদে কালেক্টারের বউ। একবার ‘কিসমিস বকশিস’ বা বড়দিনের ডালিতে তিনি যেসব উপহার পেয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্কের একটি স্কেচ, ওয়ালনাটের থলি, হিরের আংটি, কাশ্মিরী শাল, দুই বোতল পাহাড়ি মধু ইত্যাদি।
সাহেবদের দিন ফুরিয়েছে আজ বেশ কিছুকাল। কলকাতায় পাক্কা-সাহেব এখন ছিঁটেফোঁটা। ১৭৫৬ সালে এই শহরে সাচ্চা সাহেব ছিলেন ৬৭১ জন, সন্দেহজনক সাহেব ১৩৩ জন। ১৯১০ সালে ছিলেন ১৪ হাজার, আর স্থানীয় সাহেব ১৬ হাজার। ১৯৬৮-তে মাত্র ২ হাজার। ১৯৭০-এ আরও কম, কুল্যে নাকি ১৩৫০ জন। তা সত্ত্বেও বড়দিনে কলকাতা যেন এখনও সেকালেরই মতো এক উদ্দাম শহর। পশ্চিমের মতো এখানে রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে হাজার হাজার মানুষ নিজেদের উড়িয়ে দেন না হয়তো, কিন্তু চোখ মেলে তাকালে মনে হয়, আমরাও যেন হঠাৎ অপিক্যুরাস কিংবা চার্বাকপন্থী। আমাদের পুজো আছে, দেওয়ালি আছে। আছে আমোদ-আহ্লাাদের আরও হাজার উপলক্ষ। কিন্তু কলকাতায় বড়দিনের মেজাজ যেন সম্পূর্ণ অন্য রকম। কলকাতায় যারা রবাহূত, অবাঞ্ছিত, উপদ্রব বলে গণ্য, সেই মানুষগুলোর কথা বলছি না। গ্রীষ্মে যারা ছায়ার জন্য কাড়াকাড়ি করে, শীতে একটু রোদ্দুরের জন্য, সেদিনের কলকাতায়ও ছিল ফুটপাতবাসী সেই নাগরিকরা। তাদের প্রসঙ্গ তখনও ওঠেনি, এখনও বড়জোর ক’টি কম্বল ছুড়ে দিলেই চাপা যায় সে আবর্জনাপুঞ্জ। অন্যরা, সংবৎসর যারা স্বাভাবিক সুখে দুঃখে কোনওমতে জীবনকে টেনে নিয়ে যেতে পারলেই খুশি বড়দিনের নামে তাঁরাও যেন হঠাৎ চঞ্চল। সেকালে নাকি যেসব বাঙালির ‘ইংলিশ ফ্যাশন’ বড়দিনে একমাত্র তাঁদেরই ‘সাহেব ধরুন’। আজ কিন্তু বড়দিন সর্বজনীন। পার্কসার্কাসের কবরখানার সামনে আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে ফুল কিনছেন যে বৃদ্ধারা, আর রঙিন কার্ডে ঠিকানা লিখছেন যিনি সেই বিলাসিনীর মতো, বড়দিন বাঙালিটোলায় অনেকেরই মনে মনে। পিকনিক, পার্টি, চিনা খাবার, চিড়িয়াখানা, সার্কাস, তন্দুরি চিকেন, তিব্বতি ম-ম, আরও কত কী। বোটানিক্যাল গার্ডেনস-এ প্রহরীরা ব্যর্থ হবে, হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে নিষিদ্ধ ফুল ছিঁড়ে খোঁপায় গুজবে মেয়েটি, পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোর্যাঁয় মাঝবয়সী সজ্জন স্বেচ্ছায় মাথায় পরবেন ‘গাধার টুপি’। গলির মোড়ের থেকে কেকের পাহাড় উড়ে যাবে, মেজাজি ঘরে বোতল আসবে ‘ডজনি ডজনি’। যে মেয়েটি তেতলায় বারান্দায় বসে, ছুটির দিনে পড়ন্ত রোদুরে মুখ রেখে আপন মনে বাংলা নভেল পড়ে, সেই সন্ধ্যায় সেও যেন ছটফটে এক খাঁচার পাখি, কে জানে, হয়তো আজই শেষ রজনী। দোষ ওর নয়, অপরাধী যদি কেউ হয়, তবে এই বিনোদিনী কলকাতা, এই শীতের কলকাতা, এই কুয়াশা, এই উত্তুরে হাওয়া, নীল চাঁদোয়ায় সাঁটা ওই তারার ঝাঁক। এদের মিলিত ষড়যন্ত্রেই জর্ডন আর টেমস-তীরের দূরত্ব লোপ পেয়েছিল একদিন, এদের প্ররোচনার ফলেই টেমস আর গঙ্গার তীর মেজাজে আজ হঠাৎ সমান সমান। কলকাতায়ও ধ্বনি: ক্রিসমাস কাম্স্ বাট ওয়ান্স্ এ ইয়ার।
লাটসাহেবি
‘নে, লাটসাহেবি করিস না।’
‘আঃ লাটের বাট আর কি।’
‘বড়বাবু নয়তো, যেন লাটসাহেব।’
কলেজের বন্ধু সস্তা সিগারেট না ছুঁতে চাইলে, আমরা বলতুম, ‘লাটসাহেবি’।
কারও গায়ে দামি জামাকাপড় দেখলে এখনও সাদাসিধে পোশাকের অক্ষম মানুষটি আড়ালে বলেন ‘লাটসাহেব’। কাদা ছিটিয়ে চলে যায় দামি ঝকঝকে মোটর। অসহায় পথচারী রেগে গিয়ে ছুড়ে দেন মনের শের ‘লাটসাহেব’ আর কি।
কেউ ‘লাটসাহেব’ চালচলনের জন্য, কেউ লোক-দেখানো বড়মানুষির জন্য, কেউ বা মেজাজের জন্য। বাংলা কথায় ‘লাটসাহেবি’ মানে মেজাজি রকমসকম। ট্রামে-বাসে, পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, অফিসে-আদালতে, সর্বত্র আমরা অতএব প্রতিদিন কোনও না কোনও লাটসাহেবের মুখোমুখি। ব্যঙ্গ আর বিদ্রূপই ওঁদের একমাত্র প্রাপ্য। সত্যিকারের লাটসাহেবি, বলা অনাবশ্যক, একটু অন্যরকম। বলতে কি, লাটসাহেব না হওয়া পর্যন্ত অনেক সাহেবের কাছেও ব্যাপারটা যাকে বলে—চিন্তার অতীত।
সে কাহিনী শোনার আগে বোধ হয় শব্দটার অর্থভেদ করে নেওয়া ভাল। ‘লাটসাহেব’ সবাই জানেন, ‘লর্ড সাহেব’-এর দিশি চেহারা। ‘লর্ড’ থেকে ‘লার্ড’ ‘লার্ড’ থেকে ‘লাট’। সুতরাং, সেই আইন অনুযায়ী যে-কোনও লর্ড সাহেবেরই ‘লাটসাহেব’ খেতাব পাওয়ার কথা। মেজাজে অবশ্য তৎকালে যে-কোনও সাহেবই— তা তিনি লর্ড হোন, আর সাব অলটার্নই হোন—এক একজন লাটসাহেব। কিন্তু ওই বিশেষ শব্দটি তবু সংরক্ষিত থাকত বিশেষ ক’জন সাহেবের জন্যই। হয়তো তাঁরা তখনও ‘লর্ড’ হননি, জনতার চোখে তবু তাঁরা ‘লাটসাহেব’। কেননা, বিশেষ ঠিকানায় তাঁদের বাস, পরিচয়ে সাহেবদের মধ্যেও তাঁরা সবিশেষ।
লাটসাহেব হরেক রকম। ছোটলাট, বড়লাট, জঙ্গিলাট। শুধু কি তাই? তা ছাড়াও আছেন লাট পাদরিসাহিব বা লর্ড পাদরি, লর্ড জাস্টিসসাহেব ইত্যাদি। আমরা আলোচনা করব গভর্নমেন্ট হাউস নিবাসী সেই ভদ্রজনদের নিয়েই, যাঁরা গভর্নর-জেনারেল বা নিছক গভর্নর। কোম্পানি আমলের প্রথম দিকে, বোম্বাই, মাদ্রাজ আর কলকাতা—তিন প্রেসিডেন্সির তিন গভর্নর আপন আপন এলাকার সত্যিই লাটসাহেব, এদেশে তখন তাঁদের ওপরওয়ালা কেউ নেই। ১৭৭৪ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস এই তিনের প্রধান মনোনীত হলেন, আর সেই থেকেই গভর্নর জেনারেল বা বড়লাটের আবির্ভাব। ১৮৫৮ সাল থেকে, অর্থাৎ মহারানির সরাসরি রাজত্ব শুরু হওয়ার পর থেকে গভর্নর-জেনারেল আবার ‘গভর্নর-জেনারেল অ্যান্ড ভাইসরয়’। ডবল পদবি তার। ইতিমধ্যেই নতুন নতুন যে-সব এলাকা ইংরাজের দখলে এসেছে, সেখানে গদিয়ান হয়েছেন লেফ্টেন্যান্ট গভর্নর বা ছোটলাট। ১৯২১ থেকে তাঁরা আবার শুধুই ‘গভর্নর’। তা ছাড়া লখনউ হায়দ্রাবাদ লাহোর ইত্যাদি দরবারে ছিলেন রেসিডেন্ট। মেজাজে তাঁরাও এক একজন লাটসাহেব। তবু, এ কাহিনী প্রধানত বড়লাট আর ছোটলাটদের নিয়েই, যাঁদের চালচলন আর জীবনভঙ্গিই ‘লাটসাহেবি’, এই ছোট্ট কথাটির আদি। কথাটি ছোট। কিন্তু বলা নিষ্প্রয়োজন, ইতিহাস দীর্ঘ এবং বিচিত্র।
প্রথমে লাটসাহেবের বাড়িটির দিকে তাকানো যাক। গভর্নমেন্ট হাউস। আজকে আমরা বলি ‘রাজভবন’। ট্রাম-বাসের জানালা দিয়ে এ বাড়ির কতটুকুই বা আর দেখা যায়। কলকাতার প্রথম রাজভবন ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে যান সিরাজউদ্দৌলা। সেটা ১৭৫৬ সালের কথা। কলকাতা তখন ক্ষণিকের জন্য ‘আলিনগর’। হেস্টিংস আর তাঁর দুই উত্তরাধিকারী কোম্পানির ‘বাণিজ্য’ চালিয়ে গেছেন একটি ‘সাধারণ প্রাসাদ’ থেকেই। কিন্তু ১৭৯৮ সালে আর্ল অব মনিংটন জাহাজ থেকে নেমেই বললেন, ছ্যাঃ, এ বাড়িতে কি বাস করা যায়? আইরিস পিয়ার আর্ল অব মনিংটন, ওরফে রিচার্ড ওয়েলেসলি খানদানি মেজাজের মানুষ। দু’ জাহাজ পাউন্ডের বিলাস-সামগ্রী নিয়ে জাহাজ থেকে কলকাতায় নেমেছিলেন তিনি। সুতরাং এক মাসের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, পুরনো গভর্নমেন্ট হাউস ভেঙে নতুন বাড়ি গড়া হবে। ভার পড়ল চার্লস ওয়েট নামে এক স্থপতির উপর। ডার্বিশায়ারের কেডলস্টন হলের অনুকরণে নকশা আঁকলেন তিনি। গভর্নর জেনারেলের ইঙ্গিতে শুরু হয়ে গেল কাজ।
নতুন বাড়ির কাজ শুরু হয় ১৭৯৯ সালে, শেষ হয় চার বছর পরে, ১৮০৩ সালে। খরচ বাড়ি বাবত ৬৩,২৯১ পাউন্ড (মতান্তরে ৮০,০০০ পাউন্ড), জমির দাম ৭১,০০০ পাউন্ড, আসবাবপত্র ১৮,০০০ পাউন্ড, আশপাশের রাস্তার জন্য আরও ৩০০০ পাউন্ড। বাড়ি যখন তৈরি হচ্ছে টিপুর সঙ্গে যুদ্ধ চলছে তখন। যুদ্ধে টিপু পরাজিত এবং নিহত হলেন। মনিংটন অতএব নাম নিলেন ‘মার্কিস’ ওয়েলেসলি। টিপুর সিংহাসন এনে ঘর সাজালেন তিনি। শুধু কি তাই? গভর্নমেন্ট হাউসের মর্মর-কক্ষে দ্বাদশ সিজারের মর্মর মূর্তি। গভর্নর-জেনারেল তাঁদের মধ্যে বসে রাজনীতি বা সমরনীতি বিষয়ে চিন্তা করেন। সিঁড়ির নীচে পাথরের স্ফিংকস্। তাদের পরিপুষ্ট বুক কেটে সমান করা। পাছে (হোক না পাথরের মূর্তি) অনাবৃত বক্ষ গভর্নর জেনারেলের অতিথি কোমল হৃদয় কোনও সম্ভ্রান্ত নারীর রুচিকে আহত করে তাই নাকি এই বর্বরতা। যা হোক, ওয়েলেসলি সবে সাজিয়ে-গুছিয়ে বসছেন, এমন সময় কোম্পানির ডিরেক্টরদের হাতে পৌঁছল নতুন গভর্নমেন্ট হাউস তৈরির বিল। টাকার অঙ্ক দেখে তাঁদের চক্ষু চড়কগাছ। এ কেমন ধারা বড়মানুষি? ব্যবসা করে থাকে যারা, তাঁদের পক্ষে এমন নবাবি কি শোভা পায়? ঠিক এ ধরনের ধমক সইতে হয়েছিল ক্লাইভকেও, মাদ্রাজে নতুন গভর্নমেন্ট হাউস গড়তে গিয়ে। ক্লাইভ সওয়াল করেছিলেন আর্কটের নবাবের সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে আমাদের, নয়তো মান থাকবে না। আর, মান না থাকলে রাজত্বও থাকবে কিনা ঘোরতর সন্দেহ। ওয়েলেসলির পক্ষেও সওয়ালকারীর অভাব হয় না। কেউ বললেন: তিনি আমাদের মেডিসি। কলকাতা তাঁর দৌলতেই ফ্লোরেন্স। কেউ বললেন: ‘নবাব’ বটে, কিন্তু ওয়েলেসলির এই নবাবি তো কোম্পানিরই স্বার্থে। মুঘলদের রাজত্ব হাতে নিতে যাচ্ছি আমরা, প্রাসাদ থেকে দেশ চালাব না, তো কি ‘মফস্বলের কাছারিবাড়ি থেকে?’ ডিরেক্টররা তবু নরম হলেন না। তাঁদের ধারণা, এমন খরচে গভর্নর জেনারেল থাকলে কোম্পানি ডকে উঠতে বেশি দিন লাগবে না। সুতরাং, সাধের গভর্নমেন্ট হাউস ছেড়ে অচিরেই দেশে ফিরতে হল ওয়েলেসলিকে। সেটা ১৮০৫ সালের কথা।
ওয়েলেসলি বিদায় নিলেন। কিন্তু সেই যে লাটসাহেবির পত্তন করে গেলেন তিনি, সে ধারাই অব্যাহত যুগের পর যুগ। সম্ভবত আজও। টিপুর সিংহাসনের সঙ্গে গৃহসজ্জা হিসাবে যুক্ত হল লখনউ-এর মার্টিন সাহেবের বাড়ির কাটগ্লাসের ঝাড়ওয়ালা বাতিদান, বর্মার রাজা খিবরের প্রাসাদের আরশি ইত্যাদি ইত্যাদি। লর্ড এলেনবরো বসালেন চিনা কামান, লর্ড হেস্টিংস বেজওয়াটার থেকে নুড়ি এসে ছড়ালেন অঙ্গনে। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু যোগ করতে লাগলেন ওয়েলেসলির প্রাসাদে। যেন তিলোত্তমার সৃষ্টিপর্ব। লর্ড কার্জন বাহারি গ্রিক-পাত্র বসালেন, হার্ডিঞ্জ তোরণগুলো নতুন করে সাজালেন। লর্ড এলগিন বাড়িতে গ্যাস আনলেন। লর্ড নর্থবুক গরম জলের বন্দোবস্ত করলেন। তাঁর আমলে কল খুললেই গভর্নমেন্ট হাউসে ঠাণ্ডা আর গরম জলের ধারা। তিনতলা বাড়ি। কার্জন অতএব বৈদ্যুতিক লিফট বসাতেও ভুললেন না। তাঁর আমলেই বিদ্যুৎ এসেছিল গভর্নমেন্ট হাউসে। ঘরে ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা।
তবে মার্বেল-হলে টানা পাখাই বহাল রইল। কেননা, বৈদ্যুতিক পাখা এক অনাসৃষ্টি। সে তার ইচ্ছেমতো ভোঁ ভোঁ করে ঘোরে, টানা-পাখা হাওয়া দেয়, ধীরে সুস্থে, প্রভুর মর্জিমাফিক মেপে মেপে।
লাট-গিন্নিরাও অনেক কাণ্ড করেছেন ও বাড়িতে। কলকাতার গভর্নমেন্ট হাউসে তাঁদের অবদানও কম নয়। বহুকাল গভর্নমেন্ট হাউস ছিল উলঙ্গ, তার চারপাশে না ছিল গাছপালা না বাগান। লেডি আমহার্স্ট ফুলের কেয়ারি সাজালেন। যদিও লেডি উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সে বাগান দেখে বললেন, আহা, বাগানের কী ছিরি। তিনি সব গাছ উপড়ে ফেললেন। মেয়েরা, হ্যাঁ, এমন কী লাটের বউরাও একে অন্যকে সহ্য করতে রাজি হবেন না সেটাই তো নিয়ম, প্রতিদ্বন্দ্বী নাই বা রইলেন কাছে-পিঠে। লেডি বেন্টিঙ্কের ওই ধ্বংসযজ্ঞের পর লর্ড অকল্যান্ডের বোন এমিলি ইডেন আর ফ্যানির হাতের স্পর্শে আবার প্রাঙ্গণে ফুলের হাসি। (ওঁদের নামেই ইডেন গার্ডেন)। ওঁরা একটা কৃত্রিম হ্রদও বানালেন গভর্নমেন্ট হাউসের সামনে। ১৮৫৬ সালে লেডি ক্যানিং (ওঁর নামে ‘লেডিকেনি’ নামে ছানার মিঠাই) গৃহপ্রবেশ করে দেখেন উঠানময় আগাছা। একদা যা ছিল জুঁই গাছ, অযত্নের ফলে তা-ই পরিণত হয়েছে জুঁই বনে, গোলাপ গাছ চেহারা নিয়েছে গোলাপ বনের। বড় গাছ বলতে আছে ক’টি পাম। দেশে তখন ‘মিউটিনি’, ভারতীয় সিপাইদের মহাবিদ্রোহ। তারই মধ্যে বাগানে মনোনিবেশ করলেন লেডি ক্যানিং। তবে রাজভবনের চারপাশে যত বড় গাছগাছড়া, সবই ১৮৭০ সালের পরে লর্ড আর লেডি মেয়োর হাতে বসানো। পরিচর্যা করেছেন পরবর্তী দুজন গভর্নর, নর্থব্রুক আর লিটন। এ তো গেল বহিরঙ্গের কথা। ভিতরে ভিতরে লেডি-সাহেবদের সংযোজন অনেক। গভর্নমেন্ট হাউসের সুইমিং পুল লেডি লিটনের কীর্তি, টেনিস কোর্ট লেডি ডাফরিনের।
সপরিবার এই বাড়িতেই লাটসাহেব। লর্ড অকল্যান্ডের আমলে গভর্নমেন্ট হাউসে অতিথি হয়েছিলেন আফগানিস্তানের আমির দোস্ত মহম্মদ। বাড়ি দেখে তাঁর চক্ষুস্থির। ঘুরে ফিরে তাঁর মুখে এক প্রশ্ন, সত্যিই বলো তো সাহেব, দুনিয়ার আর কোথাও, এমন পেল্লাই প্রাসাদ কি আছে? সত্যিই নেই। অনেক দর্শনীয় প্রাসাদ আছে দুনিয়ায়। কিন্তু একজন সরকারি কর্মচারীর জন্য এমন এলাহি বন্দোবস্ত দুনিয়ায় আর কুত্রাপি দেখা যাবে না। সরকারি কর্মীও ঠিক নন, ১৮৫৭ সাল অবধি ওঁরা একটি ব্যবসায়ী সংস্থার কর্মচারী মাত্র। ১৮১০ সালে মালয়ের এক মুনসি এসেছিলেন গভর্নমেন্ট হাউসে। তিনিও বিস্ময়ে হতবাক। পরবর্তী কালে সাহেবরা যদিও তাঁর লেখা বিবরণ পড়ে সমান বিমূঢ়। ‘গভর্নমেন্ট হাউসে যত মেম, সবাই মনে হল গর্ভবতী’, লিখেছেন তিনি। ‘মনে হয়’, বিজ্ঞ মুনসি লিখেছেন, ‘ওঁরা সবাই লাটসাহেবের বউ।’ মুনসির বিভ্রমের হেতু বুঝতেই পারছেন, সেকালের ইংরেজ মেয়েদের ফ্যাশন। আর গভর্নমেন্ট হাউসে হারেমের কল্পনার সূত্র নিশ্চয়ই দেশজ। মালয়েও কি খানদানি ব্যক্তিদের অন্তঃপুরে ঝাঁক ঝাঁক পরির বাস নয়?
বিশাল বাড়ি। সব মিলিয়ে কমপক্ষে সেখানে হাজার মানুষের মেলা। মিলিটারি সেক্রেটারি, এ-ডি-সি, কন্ট্রোলার অব দ্য হাউসহোল্ড, সদলবল ওরা তো আছেনই, সেই সঙ্গে রয়েছে আনুষ্ঠানিক লাঠিসোঁটা-ধারী অনুচর, সহর-পার্শ্বচর এবং ভৃত্যের দল। দু’চারজন নয়, ঝাঁকে ঝাঁকে। কিছু অনধিকারীও একসময় ঠাঁই করে নিয়েছিল নাকি ও-বাড়ির আনাচে-কানাচে। চড়ুইপাখির আস্তানার মতো বারান্দার এক কোণে দরমার বেড়া দিয়ে সংসার পেতে বসে মালীর দল। হঠাৎ একদিন মার্বেল হলে একটি উলঙ্গ কৃষ্ণকায় শিশুকে দেখে চমকে ওঠেন লেডি ব্রাবোর্ন। ছেলেটির গায়ে হাম। সেই সূত্রেই ধরা পড়ল জবরদখলকারীরা। ওদের যেতে হল। এরকমভাবে বাড়ি ‘সুস্থ’ রাখার জন্য কখনও হয়তো কাউকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, আবার কাউকে টানা হয়েছে কাছে। একসময় গভর্নমেন্ট হাউসের রান্নাঘর ছিল বাড়ির বাইরে, রাস্তার ওপারে। খাবার আসত মস্ত মস্ত কাঠের বাক্সে, বাহকের কাঁধে। লেডি ডাফরিন বলতেন, রান্নাঘর কোথায় জানি না, শুনেছি এই কলকাতারই কোথাও। এই সব বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটান কার্জন। তাঁরই ব্যবস্থাপনায় পাকাপাকিভাবে ঠিক করে দেওয়া হল কার কোথায় ঠাঁই।
কর্নওয়ালিস চমকে উঠেছিলেন ভৃত্য-বহর দেখে। কোথাও উঁকি দিতে গেলেই দেখি সঙ্গীনধারী প্রহরী আমার ডাইনে বাঁয়ে, সামনে পিছনে। এ কেমনতর ব্যবস্থা? প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। তাঁর ইচ্ছে ছিল ব্যয়সংক্ষেপ, অর্থাৎ কিছু ভৃত্য ছাঁটাই করে দেওয়া। কিন্তু সরকারি চাকুরি খাওয়া কি এতই সহজ? সুতরাং, সংখ্যা ওদের মোটেই কমল না, বরং দিনে দিনে বেড়েই চলল। লর্ড মিন্টো লিখেছেন, প্রথম রাত্তিরে শুতে যাব, পিছনে মসলিনে-মোড়া চতুর্দশ মূর্তি। এদের মধ্যে দু’চারটে যদি মেয়েমানুষ হত, তবু একটা কথা ছিল। কিন্তু হায়, প্রত্যেকের মাথায় পাগড়ি, গালে কালো দাড়ি।
এমিলি ইডেন লিখেছেন: বাড়ির এক মহল থেকে আর এক মহলের দূরত্ব মাইল মাইল, যেন মেরুর ব্যবধানে। ভাইয়ের মহলে যেতে হলে বারান্দায় শায়িত রাশি রাশি কাপড়ের পুঁটলি ডিঙিয়ে তবে পথ চলতে হয়। অধিকাংশ ভৃত্যই বারান্দায় ঘুমোয়।
এমিলি গভর্নর জেনারেলের বোনমাত্র। তাঁর নিজের ভৃত্য-বহরের বিবরণ শুনুন একবার: প্রথমে খিদমদগার। সে এবং অন্য চারজন ছায়ার মতো সব সময় আমার পিছনে ঘুরছে। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেও সঙ্গ ছাড়ছে না। তা ছাড়া রয়েছে দুজন বেয়ারা। একজন একটা সিজন-চেয়ার নিয়ে সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে। যদি আমি ক্লান্ত বোধ করি, তবে ওরা আমাকে চেয়ারে বসিয়ে বসে নিয়ে যাবে। আমার ড্রেসিংরুমের দরজায় একজন সান্ত্রী সব সময় খাড়া আছে। আমি পকেট-রুমাল আনতে গেলেও সে সঙ্গীন উঁচিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। তা ছাড়া আছে দাড়িওয়ালা বুড়ো ওস্তাগর, পাংখাওয়ালা, আয়া, কুকুরের জন্য ‘ডুরিয়া’। ওঁর ছোট একটি কুকুর ছিল। নাম ‘চান্স’। কিন্তু কলকাতায় এসে নাম রাখতে হল ‘দি ইয়ং প্রিন্স্’, ছোট রাজকুমার। কেননা, ভৃত্যরা তাকে নিয়ে সব সময় এত ব্যস্ত যে, ভাবা যায় না। হয়তো মনে মনে ওদের ধারণা, মেমসাহেবের খাতির করতে হলে, তার কোলের কুকুরটিকে খাতির দেখানো চাই।
এমিলি তদুপরি আরও একজন দরজি নিয়োগ করেছিলেন। তৎসহ এমিলি এমব্রয়ডারির কাজের জন্য দুজন ঢাকাই কারিগর। তাঁর ছোট বোন ফ্যানির সঙ্গে সব সময় থাকত তিনজন খিদমতগার, ভাই অকল্যান্ডের সঙ্গে পনেরো জন। এমিলি লিখছেন, ‘করিডরে তিনজন হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে গেলে কী অবস্থা দাঁড়ায়, ভেবে দেখ। অসংখ্য ভৃত্যের ভিড়ে আমরা তিনজন। চামর দুলিয়ে আমাদের ভৃত্যদের মশা-মাছি তাড়ানোর কাজ তখন বন্ধ। লাটসাহেব হাজির থাকলে সে অধিকার একমাত্র তাঁর ভৃত্যদেরই। লেডি ক্যানিংয়ের অভিযোগ: আমার ঘরে যখন-তখন দাড়িওয়ালা খিদমতগার ঢুকে পড়ে। আপনমনে একটু পিয়ানো বাজাব তারও উপায় নেই। চারদিকে ভৃত্যরা ভিড় করে আছে। লেডি ডাফরিন বলেন: সকালে একজন নেংটিপরা মালী এসে আমাকে একটা করে ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে যাচ্ছে। কী যে করা যায়।
করার কিছু নেই। ক্যাপ্টেন-গিন্নিরাও যে দেশে হাতে তুলে দেওয়া ফুলগুলোকে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা ছাড়া আপন হাতে করার মতো কিছু খুঁজে পান না, লাট-গিন্নিরা তখন আর কী করতে পারেন? লখনউয়ে এক ছোটলাট গিন্নি বাগান থেকে ফুল তুলতেন বন্দুক চালিয়ে। তাঁর হাতের টিপ নাকি খুব ভাল ছিল। কলকাতায় এরকম কোনও বন্দুকওয়ালির খবর নেই। ইংলিশ ভ্যালে ফ্যাসি কি ইতালিয়ান শেফ, আর নেটিভ ভৃত্যকুল নিয়ে তাঁদের আলস্যের সংসার। ফুলস্কেপের চার পাতাব্যাপী খাদ্য-তালিকা নিয়ে সামনে দাঁড়ায় শেফ—টিক দিয়ে দিলেই গোল মিটে যায়। তারপর অখণ্ড অবসর। কেউ কেউ এটা ওটা পুষতেন। লেডি ক্যানিং ছবি আঁকতেন, আর এদেশীয় পোকামাকড় ধরে বোতলে রাখতেন ভিক্টোরিয়ার খোকাখুকিদের উপহার দেবেন বলে। লেডি ডাফরিন মাঝে মাঝে উঁকি দিতেন ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে, কলকাতার বস্তি দেখতে। সমাজসেবা আর কি।
১৮৫৭ সালে গভর্নমেন্ট হাউসে সাতজন দরজি কাজ করছিল লাট গিন্নির অধীনে, রিলিফের পোশাক বানাতে।
এসব টুকিটাকি অবান্তর কাজ বাদ দিলে গভর্নমেন্ট হাউসে প্রধান অনুষ্ঠান—পার্টি, আর পার্টি। বড়াখানা আর নাচের আসর। ওয়েলেসলির আমলে ছিল সপ্তাহে একদিন পাবলিক ব্রেকফাস্টের বন্দোবস্ত। যে কেউ (বলা নিষ্প্রয়োজন, নেটিভরা নয়) খাতায় সই করে বসে যেতে পারতেন। তার উপর ডিনার এবং গ্র্যান্ড-বল। যা হোক একটা কিছু উপলক্ষ খুঁজে নিলেই হল। স্বদেশ থেকে অতিথিরা আসেন। তাঁদের আগমন উপলক্ষেও দিব্যি আয়োজিত হতে পারে খানাপিনা নাচা-গানার আসর। এক বড়াখানার নেমন্তন্ন পেয়েছিলেন আটশো ইউরোপিয়ান। ডাফরিনের আমলে অফিসিয়াল ডিনারে যোগ দিতেন একশো জন, বল-এ হাজার। কার্জনের আমলে ছোটখাটো আসরেও কমপক্ষে হাজির থাকতেন দুশো অতিথি, রাষ্ট্রীয় সান্ধ্য আসরে পনেরোশো, বল-এ যোলোশো। গভর্নমেন্ট হাউসে তখন ডিনারে যখন-তখন বসে গেছেন একশো কুড়ি জন। একবার হিসেব করে দেখা গিয়েছিল, হেঁসেল থেকে একমাসে সাড়ে তিন হাজার খানা সরবরাহ করা হয়েছে অতিথিদের। একসঙ্গে দুশো অতিথি বাস করতে পারেন গভর্নমেন্ট হাউসে। তবু এক এক মরসুমে তাঁবু খাটাতে হত উঠোনে। বলা নিষ্প্রয়োজন, সবই গৌরী সেনের টাকায়। খকচ জুগিয়েছে এদেশেরই মানুষ।
আমোদ কি শুধু কলকাতায়? আমোদ পনেরো মাইল দূরে ব্যারাকপুরের ‘পল্লীভবনে’। সাড়ে তিনশো একরব্যাপী ব্যারাকপুরের বাগানে দ্বিতীয় গভর্নমেন্ট হাউসের পত্তনও ওয়েলেসলির উদ্যোগে। রাষ্ট্রীয় প্রমোদতরী ‘সোনামুখী’ চড়ে লাটসাহেব মাঝে মাঝে সবান্ধব সেখানে বেড়াতে যান। সঙ্গে যায় চারশো ভৃত্য। এমিলি লিখেছেন ব্যারাকপুরে গিয়ে দেখি ‘আমার ঘরের সামনে উবু হয়ে বসে ঠিক তেমনই কাজ করে চলেছে বুড়ো দরজি, ক’ঘণ্টা আগে কলকাতায় দেখে এসেছিলাম ওকে। যেন ম্যাজিক। ফেরার পরও তাই। কখন যে ওরা এল, কে জানে। ফিরতে না ফিরতে আঠারোজনের ব্রেকফাস্ট তৈরি।’
হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, ঘাটে বাঁধা নৌকো—যথা ইচ্ছা তথা যাও। বিশাল দেশ, কাজ খুঁজে নিতেই বা অসুবিধা কোথায়? একসময় লাটসাহেবের পিলখানায় হাতি ছিল ১৪৬টি। ডালহাউসি রুপোর হাওদা বানিয়েছিলেন হাতির জন্য। লাটসাহেবের নিজের অশ্বারোহী বাহিনীতে ছিল চারশো অশ্বারোহী। লাল আর সোনালি কুর্তা তাদের গায়ে, পায়ে বুট, মাথায় জেব্রার মতো ডোরা-কাটা পাগড়ি। তা ছাড়া ছিল তিরিশজনের ব্যান্ড, বাদ্যকরের দল। আর ছিল ওই ‘সোনামুখী’ নামে প্রমোদতরীটি। এটি তৈরি করিয়েছিলেন লর্ড হেস্টিংস। তাতে বৈঠকখানা, ড্রেসিংরুম, মার্বেল বাথ, সব ছিল। সোনামুখীর পিছনে চলত ভারিক্কি চালে সবুজ আর সোনালি রঙের আরও অগুনতি নৌকো। লাটসাহেবের ব্যক্তিগত নৌবহরে নানা ধরনের নৌকোর সংখ্যা দুশো। মাঝিমাল্লার গায়ে লাল কুর্তা। ব্যারাকপুরের ঘাটে বাঁধা থাকত সেগুলো। ইঙ্গিতমাত্ৰ ছুটে আসত চাঁদপাল ঘাটে।
সিমলা ‘আবিষ্কৃত’ হওয়ার পর গরমে চললা সিমলা। এপ্রিল থেকে নভেম্বর লাট আর লেডি-সাহেব সিমলায় শীতল হাওয়ায় নিশ্চিন্ত। সেখানেও নানা মজা। আট হাজার ফুট উঁচুতে পোলো খেলা, এক লাখ পাউন্ড খরচে তৈরি ডাফরিনের প্রাসাদে বড়াখানার আয়োজন করা। সে বাড়িতেও আটশো ভৃত্য। সিমলায় যাওয়ার রীতি চালু করেন অবশ্য বেন্টিঙ্ক। কিন্তু আগের সেই গভর্নমেন্ট হাউসে ছিল খুবই স্থানাভাব। দরজা খুলে নিয়ে তবে সাজাতে হত নাচের আসর। তা ছাড়া আড়াল-আবডালও ছিল খুব কম। একদিন দেখা গেল বেহারারা পর্দা খাটিয়ে একদিকে আড়াল তৈরি করছে। কী ব্যাপার? মাথা নিচু করে উত্তর দিল প্রবীণ খিদমতগার ‘কিসিকা ওয়াসতে, ফর লর্ড ব্রাসপট সাহেব’। লর্ড ব্রেসফোর্ড স্বনামধন্য মিলিটারি সেক্রেটারি। অমন তুখোড় মানুষ নাকি বড় একটা দেখা যায় না। রাষ্ট্রীয় সমস্যা তো বটেই, লাটসাহেবের মশারিতে একটি মশা ঢুকলেও সবাই শরণ নেন তাঁর। ঘৌড়দৌড়ের মতো আর এক নেশা ছিল তাঁর সুন্দরী রমণী। নাচের আসর বসছে, ‘ব্রাসপট’ সাহেবের ওষ্ঠের তৃষ্ণা মেটাবার জন্য তাই এই পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ। নতুন বাড়িতে এসব সমস্যা নেই। অন্তরঙ্গ ভোজের আসরে তরুণ এ-ডি-সি গুন গুন করেন—‘আই শ্যাল রিমেম্বার ইওর কিসেস হোয়েন ইউ হ্যাভ ফরগটেন মাই নেম।’ আনমনা হয়ে পড়েছিলেন লাট-গিন্নি। তিনি বলে উঠলেন ‘কী বললে’? জড়ানো গলায় উত্তর দিলেন এ-ডি-সি ‘ইউ উইল রিমেম্বার মাই কিসেস, ইওর এক্সেলন্সি, হোয়েন আই হ্যাভ ফরগটেন ইওর নেম।’
গভর্নমেন্ট হাউসে এমনি ছোটখাটো কত নাটক। কলকাতার গভর্নমেন্ট হাউসে লর্ড ময়রার বউ প্রথম লাট-গিন্নি। ওয়েলেসলি ও মিন্টো বউ নিয়ে আসেননি এখানে। (আহা, দুইজন লেডি-সাহেব কী সুখ থেকেই না বঞ্চিত হলেন।) কর্নওয়ালিস অকৃতদার। লর্ড অকল্যান্ড এক সময় লেডি বায়রনের পাণিপ্রার্থী ছিলেন। চিড়িয়া হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর মনের দুঃখে ব্যাচেলার। লর্ড এলেনবরা আর হার্ডিঞ্জেরও উড়ো উড়ো মন। মাদ্রাজের এক লাটসাহেব কোনেমারার বউ স্বামীর অসভ্য অভব্য চালচলন দেখে বিরক্ত হয়ে গভর্নমেন্ট হাউস থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন এক রাত্রে। লাটসাহেবের প্রবণতা নাকি পরকীয়া-ক্রিয়া-কলাপের দিকে। লাট-গিন্নি রাত্রিযাপন করেছিলেন হোটেলে। শোনা যায়, আজকের ‘কোনেমারা’ই সেই হোটেল। এলেনবরার গিন্নির কেস একটু অন্য রকম। বিবাহ-বিচ্ছেদের পর তিনি ব্যাভেরিয়া-রাজের রক্ষিতা। তাঁর ভূতপূর্ব স্বামী যখন কলকাতার লাটসাহেব, তিনি তখন একজন আরব শেখের বউ। লাটসাহেব স্বভাবতই কলকাতায় একটু আনমনা। ঘরকন্নায় মন নেই তাঁর। আর সে কারণেই বুঝি, ডালহৌসি শুতে না শুতেই লাটের ভারে ভেঙে পড়ল খাট। তাঁর পূর্বসূরিরা বাড়ির ফার্নিচারগুলোর দিকেও নজর দেওয়ার সময় পাননি।
গভর্নমেন্ট হাউসের ঘরে ঘরে সুখ-দুঃখের নানা টুকরো খবর। মাদ্রাজে লাটসাহেবের ডাক্তারের মেয়েকে প্রথমে একটি প্রেম-পদ্য, পরে হিরের আংটি উপহার দিয়ে গেলেন এক বয়স্ক আমেরিকান ব্যবসায়ী। তাই নিয়ে চারদিকে ফিসফিস। বোম্বাইয়ে লাটসাহেবের মেয়ে, তরুণ ডাক্তারের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলতে খেলতে এক সময় সস্নেহে হাতের র্যাকেট দিয়ে তার পিছনে মৃদু আঘাত করে বসলেন। চিকিৎসক তাকিয়ে দেখেন অদূরে দাঁড়িয়ে স্বয়ং গভর্নর। তিনি যখন ভয়ে নীল, লাটসাহেব তখন মনে মনে ভাবছেন, যাক, মেয়ের লাজুক ভাবটা তবে কাটল। লখনউয়ের লাট-গিন্নি চিঠি লিখছেন: প্রিন্স অফ ওয়েলস রাজপুত্তুর বটে, কিন্তু কী যে বাজে টাইপের লোক, তোমরা ভাবতেই পারবে না। যা তা করে বেড়াচ্ছে। আমার বাড়িতে মদ কী পরিমাণে খরচ হয়েছে, জানো? প্রতিদিন সোডার বোতল আনাতে হয়েছে চৌদ্দ ডজন করে। পনেরো দিনে শুধু শ্যাম্পেন খরচ হয়েছে সত্তর থেকে আশি ডজন। কলকাতার গভর্নমেন্ট হাউসেও নানা নাটক। চাঁদনি রাত। নিঃস্তব্ধ রাজভবন। হঠাৎ দেখা গেল, পরির মতো লঘুপায়ে এগিয়ে আসছে একটি ‘স্বর্ণকেশী তরুণী’। কিছুক্ষণ বাদেই ছায়ার মতো তার পাশে এসে দাঁড়াল একটি তরুণ। ওরা দু’জনে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল দু’জনকে। তারপর চাঁদের দিকে একটা করে চুমো ছুড়ে দিয়ে মিশে গেল অন্ধকারে। কে ওরা, কে জানে? নিজের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে গভর্নমেন্ট হাউসের মান্য অতিথি যেন স্বপ্ন দেখলেন।
গভর্নমেন্ট হাউস স্বপ্ন-রাজ্য। ‘স্বপ্নেরও অতীত’—নির্দ্বিধায় ঘোষণা করেছিলেন ফ্যানি ইডেন। ‘যেন আরব্য-রজনীর দেশ’। সব পেয়েছির দেশও বটে। ইচ্ছামাত্র ইচ্ছা পূরণ। অথচ নগদ কোনও খরচ নেই। মোটা মাইনে লাটসাহেবের। ছোটলাটও হাতে পান নগদ দশ হাজার পাউন্ড। বছরে। বড়লাট প্রায় দ্বিগুণ। লর্ড ল্যান্সডাউন পেতেন সতেরো হাজার পাউন্ড। তা থেকেই পাঁচ বছরে নাকি কুড়ি হাজার পাউন্ড জমিয়ে ছিলেন তিনি। কেউ কেউ দেশে ফিরতেন বস্তা বস্তা টাকা নিয়ে। মাদ্রাজের এক লাটসাহেব একবার অদ্ভুত ঠিকানা লেখা একটি চিঠি পেয়েছিলেন। খামের ওপর লেখা রয়েছে—‘দি অলমাইটি গড। কেয়ার অফ দি রাইট অনারেবল বাউন্টস্টুায়ার্ট ই গ্রান্ট, গভর্নর অফ মাদ্রাজ।’ লাটসাহেব দ্বিতীয় ঈশ্বর। তিনি আজকের রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতি নন। তাঁর ডাইনে বাঁয়ে কোনও নির্বাচিত প্রতিনিধি সভা নেই, টেবিলে ইয়া মোটা কোনও সংবিধান নেই, ক্ষমতায় এদেশে তিনি একরকম অদ্বিতীয়ম। তিনি দ্বিতীয় ঈশ্বর বই কি।
লাটসাহেব হয়ে যাঁরা আসতেন, সাধারণত তাঁরা বড়ঘরের ছেলে, স্বদেশে সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক মহলে প্রায় প্রত্যেকেই তাঁরা এক এক জন কেষ্ট-বিষ্ণু। দেশে থাকলে দলের সেবায়েত হিসাবে হয়তো পুরস্কার মিলত মন্ত্রিসভার আসন, বিকল্প পারিতোষিক এই ভারত-শাসনের দায়িত্ব। দেশে যেহেতু শাসকশ্রেণী নিত্য বদলায় না, নাম পালটালেও লাটসাহেবদের চরিত্রও তাই দশকের পর দশক প্রায় অপরিবর্তিতই থেকে যায়। লাটগিরি অনেক সময় যেন পারিবারিক পেশা। ১৯১০ পর্যন্ত আমাদের বড়লাট ছিলেন মিন্টো। একশো বছর আগে তাঁর ঠাকুর্দার বাবাও ছিলেন কিন্তু আমাদের লাটসাহেব। এলগিনেরা বাপ-বেটা দু’জনই লাটগিরি করে গেলেন ভারতে। লর্ড হার্ডিঞ্জ (১৯১০-১৬) ছিলেন আর এক ভূতপূর্ব লাটসাহেব ভাইকাউন্ট হার্ডিঞ্জের (১৮৪৪-৪৮)নীতি। সুবা বাংলার ছোটলাট লিটনের বাবা ছিলেন তাঁর পঞ্চাশ বছর আগে ভারতের বড়লাট। লেডি কোনেমারার কথা আগেই বলেছি, সেই যিনি স্বামীর সঙ্গে রাগারাগি করে হোটেলে রাত কাটিয়েছিলেন। তিনি মাদ্রাজের ছোটলাটের বউ বটে, কিন্তু বড়লাটের মেয়ে। তাঁর বাবার নাম ডালহৌসি। এমনি সব বংশ-পরিচয়। লাটসাহেব আর লেডিসাহেবরা বড় হয়েই জন্মান, ছোট থেকে বড় হয়েছেন অতি অল্পজনই।
লাটগিরির ঝকমারিও কম নয়। যুদ্ধ-বিগ্রহের পালা অবশ্য মহাবিদ্রোহের পর প্রায় শেষ। কিন্তু ভারতের গ্রীষ্ম চিরন্তন। প্রজাদের শাসনে রাখা দূরূহ নয়, কিন্তু এই গরমে নিজের শরীরটা শান্ত রাখা বড়ই কঠিন কাজ। গরম। মশা-মাছি। পেটের গোলমাল। বাতব্যাধি। দাঁতের ব্যথা (কার্জনের দুটোই ছিল)। তারই মধ্যে দরবার, পার্টি সদলবল চলো ‘আপ দ্য কানট্রি।’ লাটসাহেব যখন দূরের যাত্রী, প্রত্যেক স্টেশনে তখন কফিন মজুত তার জন্য। যদি কিছু ঘটে যায়। কেউ কেউ দেহরক্ষা করেছেন এদেশে। কেউ দেশে ফিরেই। লেডি-সাহেবদের কেউ বা ফেরার পথে জাহাজেই। যথা লেডি ডালহৌসি। আবার অন্যভাবেও প্রাণ দিয়েছেন কোনও কোনও লাটসাহেব। হেনরি লরেন্স লখনউ রেসিডেন্সি বাঁচাতে গিয়ে ‘শহিদ’। লর্ড মেয়ো আন্দামান বেড়াতে গিয়ে নিহত আততায়ীর হাতে। পঞ্জাবের এক গভর্নর সার হেনরি ডুরান্ড মারা পড়েন হাতির হাওদা ভেঙে পড়ায়। তাতে কী আসে যায়? সাহেবরা নিজেরাই বিচার-বিবেচনা করে বলেছেন, ভারতে লাটসাহেব নিহত হওয়ার সম্ভাবনা ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী খুন হওয়ার মতোই দূরবর্তী সম্ভাবনা। দুই পদেরই ঝুঁকি প্রায় সমান সমান। শুধু তাই নয়, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের চেয়ে তিনগুণ নিরাপদ ভারতের লাটসাহেব। সুতরাং, ওয়ারেন হেস্টিংস থেকে মাউন্টব্যাটেন—বিলাতের উঁচুতলায় মুখে মুখে স্লোগান ‘চলো কলকাতা। নয়তো চলো দিল্লি’।
ট্রামে-বাসে কোথায় পাবেন সেই লাট আর লেডি-সাহেবদের? আজকের রাজভবনে তো বটেই, কোম্পানির পয়সায় ভাড়া নেওয়া বাংলো আর বাহারি ফ্ল্যাটগুলোতেও তাঁদের দেখা মেলা শক্ত। তাঁদের চলনে-বলনে হয়তো সত্যিই লাটের মেজাজ, কিন্তু মস্ত কোম্পানির চেয়ারম্যান নিজেই যখন বলেন, সপ্তাহে তিন দিনের বেশি মাছ-মাংস খেতে পাই না আমরাও, তাও একবেলা, তখন তাঁদের লাটের সঙ্গে তুলনা করা যায় কিনা, এ-বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে অন্তত লাটদের কেউ অনৃতভাষণের দায়ে ফেলতে পারেননি কোনও দিন। মন খারাপ হলে তথাকথিত এই সব খুদে লাটেরা হয়তো শিশি-বোতল নিয়ে বসেন, নয়তো ক্লাবে ছোটেন, লর্ড ডালহৌসির মতো ইঁদুরের সঙ্গে আড্ডা দিতে বসেন কি কেউ? ডালহৌসির নাকি একটি পোষা ইঁদুর ছিল। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি ওর কাছেই মনের কথা বলতেন। স্ত্রী কাছে থেকেও দূরে, এমন ঘটনাও আছে। লর্ড ক্যানিংয়ের সঙ্গে লেডির সম্পর্ক নাকি মোটেই আদর্শ দম্পতিতুল্য ছিল না। মেনে নেওয়া গেল, কোম্পানির মনসবদারদের বউরা এক এক জন সত্যিই যাকে বলে ‘লেডি-সাহেব’, বাড়ি-গাড়ি থেকে শুরু করে চাকর-বাকর, ইলেকট্রিক, ডাক্তার, তোয়ালেটা পর্যন্ত কোম্পানির দায়িত্ব, তখন দেমাকে তাদের পা মাটিতে পড়বে না, এটাই স্বাভাবিক। কেউ কেউ নিশ্চয়ই নাচে উর্বশী। কিন্তু নাচের আগে নারকেল দিয়ে মেঝে পালিশ করিয়েছেন কি কেউ? নেই। নেই। সে লাটসাহেব আর লেডি-সাহেবরা কোথাও নেই। নেই এমন কী টাকার কুমির ‘বক্সওয়ালাদের’ পাড়ায়ও। মেয়ের বিয়েতে চোখ-ধাঁধানো নেমন্তন্নের চিঠি ছাপান অনেকেই। কিন্তু গভর্নমেন্ট হাউসে জাপানি বাজিকর খেলা দেখাবে বলে, কেউ কি কখনও নীল আর সাদা সাটিনের উপর সোনা দিয়ে প্রোগ্রাম ছেপেছেন? লাটসাহেবরা তাও দেখিয়ে গিয়েছেন কিন্তু।
করিম বক্স বাহাদুর
গৃহভৃত্যরা যদি সাচ্চা প্রলেতারিয়েত হত, তা হলে বোধ হয় দুনিয়ায় (অন্ততপক্ষে এশিয়ায়) প্রথম সোস্যালিস্ট স্টেট প্রতিষ্ঠিত হত আমাদের এই কলকাতায়। কারণ, কলকাতায় তখন যত গৃহ, তার চেয়ে অনেক বেশি ভৃত্য। প্রতি ইউনিট বা ঘর প্রতি তাদের গড় সংখ্যা তখন কমপক্ষে পঞ্চাশ জন। হিসাবটা আমার নয়, সাহেবলোগের। সুতরাং, ধরে নেওয়া যায় সেবায়েতদের এই আদমসুমারি সাহেবটোলার।
এমেলি ইডেন নিজের মুখে স্বীকার করেছেন, লাটভবনে তখন সাকুল্যে ক’জন ভৃত্য ছিল, তা তাঁর পক্ষে বলা মুশকিল। তবে তাঁর নিজের পায়ে-পায়ে সব সময় ঘুরে বেড়াত পাঁচজন। এই একই কাজে, অর্থাৎ ঘুরে বেড়াবার কাজে জজের পিছনে ছিল পনেরোজন। এবং শনিবারে শনিবারে তাঁরা যখন বেড়াতে যেতেন ব্যারাকপুরে, তখন তাঁদের সঙ্গে যেত চারশো জন।
চাঁদপাল ঘাটে এই চারশো ভৃত্যের বাহিনী যখন সেলাম জানাল তাদের নতুন লাট বাহাদুরকে, কর্নওয়ালিস তখন অবাক না হয়ে পারলেন না। কোম্পানি যে এখানে ‘নবাব’ বনে গেছে, সে খবর তিনি রাখতেন। কিন্তু এতটা তাঁর স্বপ্নেও ছিল না। তিনি একান্তসচিব রবিনসনকে তলব করলেন। ‘রবিনসন হে, এটা কী ব্যাপার হে?’
রবিনসন বললেন, ‘আজ্ঞে এরা আপনার ভৃত্য। আপনাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে যেতে এসেছে।’
‘হে।’ ধমক দিয়ে উঠলেন কর্নওয়ালিস। বলে রাখা ভাল, কথায় কথায় এই ‘হে’টা ছিল কর্নওয়ালিস-এর মুদ্রাদোষ। ‘তা হে রবিনসন হে—ওরা কি হে মাথায় করে নিয়ে যাবে আমাকে হে।’
রবিনসন বললেন, ‘আজ্ঞে, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। আপনি পালকিতে যাবেন। ইচ্ছে হয় ঘোড়ার গাড়িতেও যেতে পারেন।’
রেগে আগুন হয়ে উঠলেন কর্নওয়ালিস। ‘রবিনসন হে তুমি কী বলতে চাও হে, আমি খোঁড়া হে? আমি হেঁটে যাব, হে। ইউ ফলো মি হে, রবিনসন হে৷’ বলেই কোনও দিকে না তাকিয়ে গট গট করে রাজভবনের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন কর্নওয়ালিস।
ভাবলেন না, তার ফলে ভাত মারা গেল শ’চারেক লোকের। ওরা সে অর্থে লাট বাহাদুরের চাকর নয়। ওরা একটা রাজত্বের শোভা, ঐশ্বর্যের পতাকা। সুতরাং, ফলে ফুলবাগানে পাতাবাহারের মতো বেঁচে ছিল শুধু কর্নওয়ালিস-এর রাজত্বে নয়, গোটা ইংরেজ রাজত্বে।
কর্নওয়ালিস-এর পরে এলেন মিন্টো। তাঁর জন্যেও রাজভবনের খাতায় ছিল বরাবরের সেই চারশো ভৃত্যের বরাদ্দ। কলকাতায় তাঁর প্রথম রাত্তিরে তো, আমার পিছন পিছন এসে ঢুকল জনা চোদ্দ মানুষ। লম্বা মসলিনের গাউন তাদের গায়ে। হা কপাল। এদের দু’চারটে যদি মহিলা হত, তা হলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু একটু ভাল করে নজর করতেই দেখি আমার চারপাশে যতগুলো গাউন ঠিক ততগুলো পাগড়ি এবং ঠিক ততগুলো কালো দাড়িওয়ালা মুখ। (One might have hoped that, some of these were ladies; but on finding that there were as many turbans and black beards as gowns etc.) সুতরাং বাধ্য হয়েই এই দাড়িওয়ালা হাউস-মেডদের (bearded house maid) বিদায় দিতে হল আমাকে। এ ঘরটায় অন্তত একা থাকতে চাই আমি।
কিন্তু একা থাকবেন, তার সুবিধে কোথায়? লাটভবনের কথা বাদই দিচ্ছি। সার ফিলিপ ফ্রান্সিস লাট ছিলেন না। তিনি ছিলেন লাটসাহেবের কাউন্সিলের একজন সদস্য মাত্র। তাঁর সেক্রেটারি ম্যাকবেরি সাহেব লিখেছেন তাঁদের চারজনের সংসারে ভৃত্য ছিল একশো দশজন। এবং এই শয়তানকুলের (ট্রাইবস অব ডেভিলস) তদারকির জন্যে রীতিমত ক’টি ডিপার্টমেন্টই নাকি খুলতে হয়েছিল তাঁকে।
শুধু বড়ঘরেই নয়। ছোট-বড়-মাঝারি সব ঘরেই তখন এক অবস্থা। সর্বত্র ভৃত্যদের আস্ত আস্ত রেজিমেন্ট। হিকি সাহেব ছিলেন একজন অ্যাটর্নি। মিথ্যে বলব না, রোজগার তাঁর ভালই ছিল। তা এক-হাজারি ব্যারিস্টার তো এখনও অনেক আছেন কলকাতায়। কিন্তু তেষট্টিজন ভৃত্য আছে কি তাঁদের কারও ঘরে? নেই। ঘরে কেন, স্বপ্নেও নেই। অথচ হিকি সাহেবের তাই ছিল। আটজন শুধু হাজির থাকত তাঁর খাবার টেবিলে। বাদবাকিরা কী করত? সে একটা প্রশ্ন বটে। এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে হলে আপনাকে একটা প্রমাণসাইজ আধুনিক গভর্নমেন্টের কার্যপ্রণালী খুঁটিয়ে দেখতে হবে। নয়তো, মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে পার্কিনসন ল’। পড়লেই দেখতে পাবেন—এই গণ্ডা গণ্ডা ভৃত্যের কারণ মোটেই ‘ডিভিশন অব লেবার’ নয়। যে কারণে মন্ত্রিসভায় ডেপুটিদের সংখ্যা বাড়ে, কিংবা উপনিবেশের সংকোচনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে কলোনিয়াল আপিসের আকৃতি, এর পিছনের কারণও অনেকটা তাই। অর্থাৎ এটাও নেহাতই পার্কিনসন সাহেবের সেই কমিটিওলজিরই ফল। বৃদ্ধিটা নিয়ম, সুতরাং বাড়ে।
কলকাতায় তখন ভৃত্যদেরই রাজত্ব। সুতরাং যে রাঁধবে, সে কিছুতেই চুল বাঁধবে না। ‘আবদার’ জল ঠাণ্ডা করবে, কিন্তু গরম করবে অন্যজন। সেই গরম জল সাহেব সমীপে বয়ে আনবে একজন, ঢালবে দ্বিতীয়জন। তৃতীয়জনের কাজ হবে ভিজে পা তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দেওয়া, সব ব্যাপারেই এমন। ‘চোবদার’ লাঠি ছাড়া মশাল ধরবে না। ‘খিদমতগার’ খাওয়ার টেবিল ছাড়বে না। ‘হরকরা’ কখনও টেবিল ঘেঁষবে না। মালী বাগান সাজাবে, কিন্তু বাগানের ঘাস কাটবে ঘেসুড়ে।
প্রত্যেকের কাজ আলাদা, বস্ আলাদা এবং ডিপার্টমেন্টও আলাদা। সাহেব বা মেমসাহেবের নিজস্ব ‘এন্টুরেজ’ বা পার্শ্বচরের দল তো ছিলই, এমন কী, ছিল ঘোড়া কুকুর ইত্যাদি জন্তু জানোয়ারদের জন্যেও আলাদা আলাদা ভৃত্যবহর। নবাগত এক সাহেব তো কাণ্ড দেখে অবাক। তিনি তাঁর বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা ভাই, বেড়ালেরও কি কোনও খিদমতগার আছে এখানে?’ যখন শোনা গেল তা নেই, তখন কিঞ্চিৎ নিশ্চিন্ত হলেন তিনি। যাক, বন্ধুগৃহে তা হলে একটা স্বাধীন প্রাণী আছে এখনও।
কেউ কেউ খেপে যেতেন। জন লরেন্স নাকি মোটেই সহ্য করতে পারতেন না তাঁর বেহারা, হরকরাদের। প্রতি রবিবার গির্জা থেকে বের হয়েই তাঁর প্রথম কাজ হত, সামনে সারি করে দণ্ডায়মান ভৃত্যকুলের উপর কজির বল পরখ করা। আর এক মনিব অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গেই জানাচ্ছেন ‘A black rascal makes an oration by my bed every morning. I wake and see him Salaaming with a hot coffee in his hand.’
মাটিতে অষ্টাঙ্গ লুটিয়ে ‘মি লর্ড, আই অ্যাম ইওর স্লেভ’ কিংবা ‘দাই স্লেভ নোজ নট হাউ টু প্লিজ ইউ’ ইত্যাদি মুখস্থ করা বক্তৃতা দিনের পর দিন শুনতে কারই বা ভাল লাগে? কিন্তু বিছানায় এক কাপ গরম কফি পেলে খুশি হয় না, এমন সাহেব বিলেতেও আছে কিনা সন্দেহ। শুধু কি তাই? শুধু মুখ ফুটে একটু আওয়াজ করো—‘বয়’। দেখবে, হুকুমটা গলা ছাড়তে না ছাড়তেই এসে হাজির হয়েছে তালিমদার। যেন এতক্ষণ সাহেবের গলাতেই শব্দ হয়ে মিশে ছিল আধবুড়ো লোকটা।
সুতরাং সব সাহেবেরই সয়ে যেত ওদের। কখনও কখনও চাকরদের তাঁরা সইতে পারতেন না বটে, কিন্তু বরখাস্তও করতে পারতেন না।
তার কারণ এই নয় যে গৃহভৃত্যদের তখন ইউনিয়ন ছিল। ইউনিয়ন ছিল বরং মালিকদের। ‘ফোরাম অব জমিনদারস’ ১৭৫৯ সালে কড়া কড়া আইন লিখবেন তাঁদের খাতায়। চাকরেরা যদৃচ্ছ মাইনে আদায় করবে, এবার থেকে তা আর চলবে না। বেয়ারা কত পাবে, খিদমতগার কত, সব লেখা হয়ে গেল। হেড কুক মাসে পাঁচ টাকা, খানসামা, খিদমতগারও তাই, ধোপা পুরো ফ্যামিলির হলে তিন টাকা, এক জনের হলে তার অর্ধেক, পরামাণিক দেড় টাকা (শীতকালে তাকে আসতে হবে ৭টায়, গরমের সময় ৮টায়), দরজি তিন টাকা। এবং এবংবিধ।
প্রসঙ্গত, আজকের দরজিরা শুনে খুশি হবেন যে, সেকালে শুধু কোট, বেনিয়ান বা গাউন সেলাই-ই তাদের কাজ ছিল না। বড় সাহেবেরা যখন শিকারে বের হতেন, তখন দরজিকেও সঙ্গে যেতে হত তাঁর। কারণ দরজি তখন অন্যতম শল্যচিকিৎসক। বাঘের আঁচড়ে জখম হয়ে গেল হাতিটা। অমনি বেয়ারা ছুটল দরজি ডাকতে। হাতি সেলাই করতে হবে।
যা হোক, ‘ফোরাম অব জমিনদারস’ দরজি সমেত সকলের মাইনে বাঁধলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঢোল বাজিয়ে হুকুম জারি হল: যে এই আইন অমান্য করবে, তার ফাঁসি হবে। ফাঁসি অবশ্য তাঁরা বলেননি। তাঁদের কথাটা ছিল ‘কর্পোর্যাল পানিশমেন্ট’। ‘ক্যাপিট্যাল পানিশনেন্ট’ থেকে এক ধাপ নীচে। সেকালের লোক জানত, এর অর্থ কমপক্ষে ফাঁসি।
শুধু ভৃত্যদের নয়, মালিকদেরও সাবধান করে দেওয়া হল। খবরদার। কেউ কখনও বেশি দিয়ে বোসো না যেন। যদি দাও, তবে ‘কোর্ট অব জমিনদারস’ কখনও দায়ী থাকবে না তার জন্যে। এবং তার চেয়েও বড় শাস্তি, যে বেশি দেবে, সে একঘরে হবে। (and the protection of the establishment will be withdrawn from him.) বলা বাহুল্য, দূর বিদেশে, ছোট স্বীয় সমাজের এই শাস্তিটা কোনও রুশ প্রজার নাগরিক অধিকার হারাবার চেয়েও মারাত্মক।
তবুও মোটেই ঘাবড়াল না কলকাতার ভৃত্যকুল। তারা দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসল। মিসেস ফে বললে, ‘বেয়ারা ইধর আও। ওই ছোট টেবিলটা আমার সামনে এনে দাও তো।’
সঙ্গে সঙ্গে লোকটা গলা ছেড়ে, বাড়ির যেখানে যত ভৃত্য ছিল, তাদের ডাকতে শুরু করলে। কাণ্ড দেখে নিজেই উঠলেন ভদ্রমহিলা। টেবিলটার একদিকে ধরে বললেন, ‘তুমি ওদের ডাকছ কেন? এইটুকুন, এ তো আমি নিজেই বইতে পারি।’
মিসেস ফে লিখছেন: ‘উত্তরে কী বলল লোকটা জান! বলে কিনা Oh. I no English, I bengalman. I no estrong like English, One-two-three bengalman cannot do like a English- টওঠ. মেম সাহেব, আপনি অ্যাংরেজ, আমরা বাঙালি। আমাদের গায়ে বল কম। ইত্যাদি।
এটা ঠিক ‘ফোরাম অব জমিনদারস’-এর উপর প্রতিশোধ নয়। ভৃত্য-বুরোক্রাসির একটু নমুনা মাত্র। কম মাইনের জবাবও তারা দিল বটে, কিন্তু সে অন্যভাবে। এই মহিলাই লিখছেন: চারিদিকে আমার শুধু চোর। খানসামা এইমাত্র এক গ্যালন দুধ এবং তেরোটা ডিম এনেছে, কিন্তু তাতে যদি দেড় পাঁইট কাস্টার্ড হয়। আমি তাকে কথাটা বলামাত্র সে ধমক দিয়ে উঠল, ‘নোকরি নেহি করেগা’। সঙ্গে সঙ্গে আমি বিদেয় করে দিলাম ওকে। এবার অন্যজন এল। আমি তাকে বললাম, দেখো, বাজারে কোন জিনিসের কী দর আমি তা জানি। সঙ্গে সঙ্গে মাথা চুলকে বলল তা হলে নাকি তার ডবল মাইনে চাই।’
তা-ই দিতে হল। ১৭৬০ থেকে ১৭৮৯ সালে কলকাতার সব ভৃত্যেরই দ্বিগুণ হয়ে গেল মাইনে। এবং তৎসত্ত্বেও বাজারের হিসেবে মাথাপিছু দৈনিক মাখনের বরাদ্দ ধরে চলল তারা বারো আউন্স করে।
সুতরাং ‘ফোরাম অব জমিনদারস’ হার মানলেন। কেউ মানল না তাঁদের আইন। এমনকী, ১৭৬৩ সালে চাকর-বাকরদের নামধাম লেখবার জন্যে তাঁরা খাতা খুলেছিলেন একটা। কোনও মনিব এক ছত্রও লিখলেন না তাতে। বরং জমিনদাররা অবাক হয়ে দেখলেন, হিকি সাহেব গম্ভীরভাবে ভাবছেন এদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে চাকরদের একটা পেনশনের ব্যবস্থা করা যায় কিনা তারই কথা। হিকি নিজে লিখেছেন: তাঁর ভৃত্য-সমুদয়কে পেনশন না দিতে পারার জন্যে সত্যিই তিনি আন্তরিক দুঃখিত।
তবে মনের এই খেদও তিনি মিটিয়েছিলেন বই কি। সে আমাদের মুন্নোকে উইলিয়ম মিন্নাউ বানিয়ে। অবশ্য, এটা ঠিক যে, এ প্রলেতারিয়েত থেকে বুর্জোয়া হওয়া নয়, প্রমোশন দেওয়া। স্বগুণে যিনি এতদ্দেশে প্রথম তা হয়েছিলেন, তিনি হিকির মুন্নো নয়, মেজর কার্কপ্যাট্রিকের হুঁকো-বরদার। লোকটা নাকি একদিন মেজর সাহেবের হুঁকো নল সব নিয়ে পালিয়ে গিয়ে সোজা বিলেতে। সেখানে গিয়ে আবার বলে বেড়াতে শুরু করল যে, সে সিলেটের রাজকুমার, প্রিন্স অব সিলেট। সিলেট তখনও ভাল করে কোম্পানির ভূগোলে ওঠেনি। সুতরাং স-হুঁকা রাজপুত্তুরকে নিয়ে দেখতে দেখতে হই-চই শুরু হয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী পিট ছুটে এলেন তাকে সম্মান জানাতে, ডিউক অব ইয়র্ক ভোজসভায় আপ্যায়িত করলেন তাকে। এমনকী সম্রাট পর্যন্ত দর্শন দিলেন মহামান্য সিলেটকুমারকে।
মুন্নো ঠিক এ ধরনের করিতকর্মা ভৃত্য নয়। সে ছিল হিকির তেষট্টি ভৃত্যের সেরা জনৈক বঙ্গ-রত্ন। হিকি যাওয়ার সময় কিছুতেই ছেড়ে যেতে পারলেন না তাকে। মুন্নো তাঁর সঙ্গে বিলেতে এল। প্রথমে লন্ডনে। তারপর সেখান থেকে বেকনসফিল্ডে। এখানে এসে হিকি ব্যাপ্টাইজ্ করলেন তাঁকে। মুন্নোর নাম হল এবার উইলিয়ম মিন্নাউ।
বলতে পারেন, এগুলো গল্পকথা। কিন্তু কলকাতার ছকু খানসামা লেন তো আর গল্প নয়। প্রিয় খানসামা লেন আজও আছে স্ট্রিট ডিরেক্টরিতে। পৃথিবীর আর কোনও শহরে তা আছে কি? না, নেই। লেনিনগ্রাদ, বেজিং, মস্কো—কোথাও না। কোথাও, কোনও দেশের কোনও মিউজিয়ামে মিলবে না—‘বড়া খানসামার’ কোনও তৈলচিত্র। কিন্তু কলকাতায় তা-ও আছে। রাজভবনে খোঁজ নিলে দেখা যাবে একসময় সেখানে ঝুলত ইয়া বড় এক তৈলচিত্র। নীচে নাম লেখা ‘করিমবক্স’। করিমবক্স কে? হায়দরাবাদের নবাবজাদা নয়, সিলেটের রাজকুমার নয়, কলকাতার খানসামা।’ ‘বড়া খানসামা’। লর্ড ডালহৌসি থেকে লর্ড লিটন (১৮৪৮-৭৭) অবধি সাত-সাতজন লাট বাহাদুরের বড়া-খানসামা ছিলেন তিনি। তাঁর নামে অতএব একটা দুটো রাস্তাই যথেষ্ট হবে কেন,—রাজভবনে ঝুলছিল রীতিমত এক তৈলচিত্র।
বরফের মতো ঠাণ্ডা
নেহরুজি নাকি বলেছিলেন ‘কলকাতা ডেরেলিক্ট সিটি’। আমি বলি কলকাতা ‘ঠাণ্ডি-শহর’। বরফের মতো ঠাণ্ডা।
কর্কটক্রান্তির কাছা কাছি হলেও কলকাতা শহরে উত্তাপ নেই, উষ্ণতা নেই। এপ্রিলের ফারেনহাইটে একশো তেরো ডিগ্রি বললেও এ শহরের প্রাণ আজ বরফের মতো ঠাণ্ডা।
ভেবে দেখুন, এ শহরের নাগরিকেরা ট্রামে-বাসে গরম হন খুচরো পয়সা নিয়ে, খেলার মাঠে হারলে অথবা জিতলে, রাজনীতিতে ভোট না মিললে, বা অনুরূপ কারণেই। ছাত্ররা এখানে উত্তেজিত প্রশ্নপত্র দেখলে, কেরানিরা দুটো টাকার জন্যে, বাড়িওয়ালা বা মুদি অনাদায়ী ভাড়া বা চাল-ডালের দামের জন্যে বা এবংবিধ। প্রতিবেশীদের রক্ত উষ্ণ হয় এখানে কলের জলের জন্যে, প্রতিবাদীদের অন্যপক্ষের মুখ বন্ধ করার জন্যে। কলকাতার নগর জীবনের আজ এটাই ‘কোড; নাগরিকের এটাই জীবন। এই আটপৌরে জীবনই কলকাতার আজ স্বাভাবিক জীবন। তার বড় একটা ব্যতিক্রম নেই, নড়চড় নেই। অথচ জীবনের নড়চড় আছে, সেটাই তার প্রাণের লক্ষণ। প্যারিস ওয়াশিংটনে মাঝে মাঝে তা দেখা যায়। যে কোনও একটা হলিডেতে শত শত লোক জীবন দিয়ে তার প্রমাণ দেয় ওয়াশিংটন-নিউইয়র্কে। আর প্যারিসের রিভিয়েরা? তার যে বিবরণ শুনেছি, কলকাতার রকের বা ‘পাড়ার ছেলে’ তার কাছে হাস্যাস্পদ প্রাণী। এ শহর যে পচে গলে শেষ হয়ে যায় না, তার কারণ জীবনের কোনও গোপন ফল্গু নয়, এ শহরের শব ডালহৌসি-বড়বাজারের আরকে জড়িত আর মসলিনে জড়ানো। তাদের এই বাণিজ্য-পিরামিডে মমি-কলকাতা তাই একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায় না।
কিন্তু একদিন ছিল ঠিক এর উলটো। কলকাতা তখন সম্রাট। শিরায় শিরায় তার তখন নতুন তাজা রক্ত। বরফের মতো ঠাণ্ডা আজকের এই শহর, বরফ দিয়েই উত্তেজনার আগুন জ্বালিয়ে তুলতে পারত সেদিন। তুলেছেও। পৃথিবীর কোনও শহরের জীবনে যা কোনও দিন সম্ভব হয়নি, কলকাতা তাই করেছে। সত্যি-সত্যিই এক টুকরো বরফ হাতে নিয়ে ছোট্ট ছেলের মতো উর্ধ্ববাহু নৃত্য করেছে সে।
প্রমেথিউস স্বর্গ থেকে যেদিন আগুন চুরি করে এনেছিলেন, সে দিনও বোধহয় এমন উত্তেজনা হয়নি, যেমনটি হয়েছিল কলকাতায় প্রথম বরফ পড়ার দিনে। অন্তত সেদিনের কাহিনীটি শুনলে তাই মনে হবে আপনার।
কলকাতা ভূমণ্ডলের যেখানটায় অবস্থিত সেখানটা বরফের রাজ্য না হলেও মাঝে মাঝে এখানেও বরফ পড়ে। ঝমঝম বৃষ্টির সঙ্গে ইলশেগুঁড়ি বরফ। মেমসাহেবরা দামি দামি ফ্রক কাদা করে তাই কুড়োতে লেগে যেতেন। বাধ্য হয়ে বাবুর্চি-বেয়ারাও সাহায্য করে। কিন্তু পুরো ‘কোম্পানি’র আন্তরিক উদ্যমেও আস্ত একটি গ্লাস ভরে না। এক পেগ ক্ল্যারেটও ভেজে না তাতে। সাহেব-মেমদের মনে তাই ভীষণ দুঃখ। শিলাবৃষ্টি যদি নিত্য হত, তাও একটা কথা। দু’বছর কি চার বছরে একদিন, আধদিন হয়। এতে কি কখনও তেষ্টা মেটে, না মন ঠাণ্ডা হয়?
এক ভরসা নবাব-বাড়ির নেমন্তন্ন। এমিলি শেক্সপিয়র নামে এক মহিলা মুর্শিদাবাদে নেমন্তন্ন খেয়ে জানালেন:
‘There was abundance of ice—which at the this season is a variety no less than a luxury and to which we are indebted for cool wine and water.’
ওটা ১৮১৪ সালের কথা এবং তখন জুলাই মাস।
জুলাই মাসে বরফের খবর শুনে কলকাতার ইংরেজদের নোলা ছোঁক-ছোঁক করে উঠল। হোলি ফাদার জানেন নবাবরা কোত্থেকে এ সময়ে এমন জিনিস টেবিলে এনে হাজির করে। হয়তো বা কাশ্মীর থেকে। যেখান থেকেই হোক কলকাতার তা জেনে লাভ কী? কাশ্মীর থেকে বরফ এনে খাবে, কলকাতার রাইটারদের তা স্বপ্নেরও অগোচর। তাদের কাছে নবাব-বাড়ির নেমন্তন্নও তাই।
শেষ অবধি একটা ব্যবস্থা হল। হুগলিতে কল বসল, একটা বরফ তৈরির কল। অধিকাংশ সময়েই তা আবার বিগড়ে যায়। কলকাতার হোটেল-রেস্টুরেন্টেও তাই নিত্য বরফ মেলে না। চৌরঙ্গি পার্ক স্ট্রিটের সাহেব-কুঠিতে তো নয়ই। ফলে কাছাকাছি বরফের সন্ধান পেয়ে তেষ্টা আরও বেড়ে গেল কলকাতার নাগরিকদের। এতকাল বরফ ছিল তাদের স্বপ্ন, হুগলিতে বরফ এসে এখন তা হয়ে দাঁড়াল সাধনা। কী ভাবে দু’ টুকরো পাওয়া যায় তারই সাধনা। শুতে-বসতে-খেতে সবার এই এক ভাবনা।
অবশেষে একদিন এক অঘটন ঘটে গেল।
১৮৩৩ সালের কথা। জনৈক সাংবাদিক লিখছেন:
সবে সকাল হয়েছে। আমি তখনও ঘুমিয়ে। সহসা আমার ভৃত্য ঘরে ঢুকে, সে কী চেঁচামেচি!
‘কী ব্যাপার?’
‘হুগলিতে বরফ এসেছে হুজুর।’
‘হুগলি!’
‘হুগলি নয়, আমাদের হুগলি নদীতে হুজুর।’
‘বরফ? এ সময়ে, দূর তাও কি হয়?’
‘জি হুজুর, তাই হয়েছে। পেতে চান তো শিগগির চলুন।’
‘So I at once jumped up, bathed while my horse was being saddled, and rode down to the Ghaut.’
‘সেখানে গিয়ে একখানা পানসি নিলাম। ধীরে ধীরে পানসি গিয়ে ঠেকল এক বিরাট জাহাজের গায়ে। তার পেট বোঝাই নাকি বরফে।’
আমেরিকান জাহাজ। শিকাগো থেকে চার মাসে শত শত মাইল পথ সাঁতরে এসেছে কলকাতাকে ঠাণ্ডা করতে। (গম বিতরণের বহু আগে ভারতবর্ষে বরফ দানের এই অবিস্মরণীয় ঘটনাটি ইঙ্গ-মার্কিন সহযোগিতার একটি ঐতিহাসিক নজির নয় কি?)
কাপ্তেনের সঙ্গে আলাপ হল। সত্যিই তিনি বরফ নিয়ে কলকাতায় এসেছেন।
আমাদের কলকাতার এই ভদ্রলোকটি পেশায় ছিলেন সাংবাদিক, আগেই বলা হয়েছে। সুতরাং আর পাঁচজনের ভাগ্যে যা সম্ভব হয়নি, তিনি সেখানে খাতির পেলেন। কাপ্তেন হাতে ধরে তাঁকে নিয়ে গেলেন জাহাজের খোলে। ‘বরফ দেখুন’। (‘I was allowed to peep into the abyss where the treasure lay’)।
‘ওই তো ওখানে পড়ে রয়েছে রাশি রাশি বরফ। সাদা ধবধবে কাচের মতো স্বচ্ছ বিরাট বিরাট চৌকো টুকরো। বৈজ্ঞানিক উপায়ে যত্ন করে প্যাক করা। এই অনিন্দ্যসুন্দর অবয়বের উপর বিউটি-স্পটের মতো আয়াসে গা এলিয়ে পড়ে রয়েছে কতকগুলো গোলাপি রঙের আমেরিকান আপেল।’
‘কিন্তু মুশকিল হল, একে তীরস্থ করা যায় কী করে? আর কী করেই বা সম্ভব কলকাতার আবহাওয়ায় এর সংরক্ষণ? এমন আগন্তুককে অভ্যর্থনা করার মতো উপযুক্ত কোনও ঘর কলকাতায় নেই, এমনকী, দুই-চারদিন একে ধরে রাখবার মতো একখানা বাক্সও।’
অগত্যা সাংবাদিক খালি হাতেই কুঠিতে ফিরলেন। বাড়ি এসে খানসামাকে পাঠালেন বাক্স-প্যাঁটরা দিয়ে। কাপ্তেন তাকে বলে দিয়েছেন, ফানেল কাগজে কিংবা কাপড়ে মুড়ে নিতে বলবেন, দেখবেন বাতাস যেন না লাগে।
খানসামা বরফ নিয়ে ফিরল। কিন্তু এ কী? মাত্র এইটুকু? একটা রুপেয়া তোমাকে দেওয়া হল, কথা হয়েছে এক পাউন্ড দেবে। এখানে তো দেখছি বড়জোর আধ পাউন্ড হবে। ব্যাপার কী খোদাবক্স?’
‘জি হুজুর, সব পানি হো গিয়া।’
‘কাপড়টা দিয়ে ভাল করে জড়িয়ে নিয়েছিলে কি?’
‘না সাহেব, তাতে বরফ নাকি ভীষণ গরম হয়ে যায়।’
‘Then the ice has had the full benefit of sun and air!’
‘Yes master…’
‘বাক্সটা বন্ধ করেছিলে তো?’
‘না সাহেব, তাতেও বরফ নাকি ভীষণ গরম হয়ে যায়।’
মেমসাহেব বারান্দায় মোড়া পেতে বসে আছেন, হঠাৎ নজরে পড়ল উঠোনের এক কোণে চকচক করছে বিরাট একখণ্ড বরফ।
ছুটে গেলেন ভিতরে। ‘বেয়ারা, বাগানে বরফ এল কোত্থেকে?’
ভৃত্য সবিনয়ে জানাল, ওটি সে নিজেই ভাঁড়ারঘর থেকে বাগানে ফেলে দিয়ে এসেছে।
‘কেন?’
‘মেমসাহেব, ওটা কালকের বরফ, বাসী হয়ে গেছে।’
‘ইডিয়ট।’
যা হোক, শহরে সেদিন একমাত্র সংবাদ, কলকাতায় বরফ এসেছে। এক টুকরো, দু’ টুকরো নয়, আস্ত এক-জাহাজ বরফ। যে যেখানে ছিল, গাড়ি হাঁকিয়ে ছুটল গঙ্গার দিকে।
আপিস-আদালত, দোকান-বাজার আজ সব বন্ধ। আজ বরফ, শুধু বরফ খাবার দিন। এক বেলার জন্যে কোম্পানির রাজত্ব বন্ধ রইল। কলকাতা বরফ নিয়ে গরম হয়ে উঠল।
স্টকক্যুইলার লিখছেন:
‘All the business were suspended until noon, that people might rush about to pay each other congratulatory visits and device means for perpetuating the ice supply’.
সবাই সবাইকে ডিনারে নেমন্তন্ন করতে লাগলেন। আমেরিকান বরফে ঘরে-ঘরে ক্ল্যারেট বিয়ার ইত্যাদির স্বাদে কী পরিবর্তন ঘটেছে, তা চেখে দেখতে একে অন্যকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। খবরের কাগজওয়ালারা বসে গেলেন এই প্রীতিপ্রদ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে। ‘(Never was the Editorial pen employed upon a more delightful theme’.)
দেখতে দেখতে জাহাজ অবশ্য খালি হয়ে গেল, কিন্তু বরফ-পর্ব শেষ হয়ে গেল না। নিষ্ঠাভরে কলম ধরেই রইলেন সম্পাদকেরা। বরফ প্রশ্ন (Ice-question) আপাতত তাঁদের প্রধান আলোচ্য। বড়মানুষেরাও পরামর্শে বসলেন। ভবিষ্যতের কথা পরে, উপস্থিত এই আমেরিকান ভদ্রলোককে তাঁর প্রাপ্য দাম চুকিয়ে দিয়েই কর্তব্য সম্পাদন করা যে কলকাতার পক্ষে ভদ্রসুলভ আচরণ হবে না, এ বিষয়ে সবাই একমত হলেন। জাহাজের কাপ্তেনকে নিয়ে কলকাতার একটা কিছু করা উচিত—এটাই সবার মত। নয়তো শহরের ইজ্জত থাকবে না। নেতারা গিয়ে ধরলেন লাটবাহাদুরকে। মহামতি বেন্টিঙ্ক তখন গভর্নর-জেনারেল। সুযোগ পেলেই জনসেবা করা তাঁর নেশা। এ সুযোগটাও তিনি হাতছাড়া হতে দিতে রাজি নন। তিনি সব পরামর্শ শুনলেন। অতঃপর স্থির করলেন, কলকাতায় একখানা গুদাম তৈরি করবেন তিনি। বরফের গুদাম। আজকাল যার নাম কোল্ডস্টোরেজ। জনসাধারণের চাঁদায় তৈরি হবে সেটি এবং যে-যার ইচ্ছেমতো বরফ রাখতে পারবে সেখানে। এমনকী নিজ নিজ বাক্সে পুরে মদ্য-মাংসও রাখা চলবে।
আর ঠিক হল, আমেরিকান জাহাজের কাপ্তেন রোজার্সের সম্মানে একটা সংবর্ধনা হবে।
যথাসময়ে টাউন হলে মহা ধুমধাম করে আয়োজিত হল সে সভা। ভারতের গভর্নর-জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক কলকাতাবাসীর হয়ে সে সভায় পড়লেন বরফওয়ালা রোজার্সের প্রতি কলকাতার অভিনন্দনপত্র:
‘T W C Rogers Esq. of Boston.
Sir,-The importation of American ice into Calcutta is an enterprise so novel and beneficial that I cannot resist the desire of expressing to you my sense of the spirit and skill by which it has been planned and executed…
…আমি আপনাকে তাই অনুরোধ করছি, আপনি আজ আপনার এই অভূতপূর্ব উদ্যোগ এবং তার সফল রূপায়ণের কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ আমাদের এই সামান্য উপহারটি গ্রহণ করে আমাকে বাধিত করুন।’
বলেই বেন্টিঙ্ক সাহেব কাপ্তেন রোজার্সের হাতে তুলে দিলেন একখানা রুপোর কাপ। কলকাতাবাসীর চাঁদার টাকায় তৈরি স্মারক। চারদিক থেকে আনন্দধ্বনি উঠল—আর তার মধ্যেই আবেগমথিত কণ্ঠে মহামান্য গভর্নর বলে চললেন:
‘ক্যাপ্টেন রোজার্স, ক’মাস আগেও আপনার এই পরিকল্পনা হয়তো আখ্যাত হত অলীক কল্পনা বলে। কিন্তু আজ আমি নিঃসন্দেহ যে, আপনার কৃতিত্ব সম্বন্ধে আমরা সবাই একমত। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, আপনার এই কর্মের ফলে জনসাধারণের প্রভূত উপকার হবে।’
তারপর রোজার্স সাহেবের প্রতি এই আবেদন জানিয়ে বেন্টিঙ্ক তাঁর অভিভাষণ শেষ করলেন যে, তিনি যেন তাঁর এই ‘মহৎ পরিকল্পনা’ অনুযায়ী ভবিষ্যতেও কাজ করে যান।
বরফ নিয়ে বেন্টিঙ্ক এ পর্যন্তই এগিয়েছিলেন। কলকাতা একটা ঠাণ্ডাঘরও তৈরি করেছিল। তার পরের গভর্নমেন্ট এগিয়ে গেলেন আরও অনেকদূর। তাঁরা নিজেরাই বরফের কল বসালেন লখনউতে। হুগলির ফ্যাকটরি ছিল প্রাইভেট সেকটার-এ, লখনউর বরফ সরকারি কারখানা, পুরোপুরি পাবলিক সেকটারের প্রোডাক্ট, সুতরাং গর্ব করে গভর্নমেন্ট বিজ্ঞাপন দেন কাগজে:
‘Ice is now procurable at the Govt. Manufacturing, Lucknow, at two annas per seer. The Govt. is now in a position to offer this invaluable luxury to the public at a price which defies competition and special attention is invited to the fact, that their principles are small profit and quick returns.
Observe-Two annas per seer only’-Only two annas per seer!
‘দু’আনা, মাত্র দু’-দু’ আনা সের।’ এমন করে আজ আর কলকাতায় সরকার বাহাদুর বরফ ফিরি করে না, কোল্ড ড্রিংকের চেয়ে ‘কোন্ড ওয়ার’ আমাদের মস্তিষ্ককে আজ বিব্রত করে বেশি, বরফের মতো ঠাণ্ডা জিনিস নিয়ে তাই আর কেউ লেখে না, লিখতে জানে না।
তাই বলছিলাম, কলকাতা আজ বরফের মতো ঠাণ্ডা।
কালচার ও সোডার বোতল
কালচারের সঙ্গে সোডার যোগাযোগ আজ অনেকটা সাহেবের সঙ্গে প্যান্টের মতো। ঢিলেঢালা তো নয়ই, বরং আরও আঁটোসাটোই হবে। সময়মতো ভেবে দেখুন একটু, আপনারও মনে হবে, সোডা আছে বলেই বোধ হয় আমরা আছি। আমরা মানে, আমাদের কালচার আছে।
পোশাক-আসাক পুরোপুরি উঠে গেলেও হয়তো আমাদের সভ্যতা আজ বহাল তবিয়তে চলতে সমর্থ। শুধু আমাদের এই সনাতন দেশেই নয়, পশ্চিমেও তার নড়চড় ঘটার কারণ নেই। কেননা, ভারতবর্ষ যেমন সাধু-সন্ন্যাসীর দেশ, ওসব দেশেও তেমনি দিগম্বর সম্প্রদায়ের সাধক বিস্তর। এবং তাদের ক্লাবগুলো সব রেজিস্টার্ড কোম্পানি। সুতরাং কৌপীন বা বিনে-কৌপীনে ইচ্ছে করলেই চলতে পারি আমরা। কিন্তু কালিঝুলি মাখা শার্টে কিংবা পাটভাঙা শাড়িতে? কক্ষনো না। লজ্জায় মাথা কাটা যাবে না মিঃ ডাটার? তার চেয়ে বরং মিসেস সেন একেবারেই যাবেন না আজকের পার্টিতে। আর ওই দাগি জামাতে কালকের আপিস? অসম্ভব। রাত ন’টার কলে অদ্বিতীয় জামাটার কলংকমোচনে লেগে যাবেন মার্চেন্ট আপিসের ছোট কেরানি। পয়সা দুটো কম থাকতে পারে তাঁর, তাই বলে কি কালচার নেই একটা? সোডা সেদিক থেকে আমাদের কালচারের আসল অনুপান, আমাদের পোশাকি সভ্যতার আসল দ্বারবান।
তা ছাড়া, আয়ুর্বেদোক্ত বস্তু না হলেও সোডার ঊনত্রিশ গুণ। বোতলের সোডার কথাই ধরুন। বিজ্ঞাপনের কথা বলছি না। স্কুলবয় থেকে রিটায়ার্ড মুনসেফ, জাতি ধর্ম বর্ণ ও বয়স নির্বিশেষে সেবকেরা বলেন, সোডা ওষুধ। তা খেলে পেট ঠাণ্ডা থাকে, বদহজম চলে যায়, নেমন্তন্নে নির্ভয়ে কম্পিটিশনে নামা যায় এবং ইত্যাদি। যাঁরা প্রকৃত সমজদার তাঁরা বলেন, এগুলো তুচ্ছ, সোডার আসল গুণ অন্যত্র। গরমে সোডা খান, গা জুড়িয়ে যাবে, শীতে খান—গা’টা একটু গরম হবে। এবং দিবারাত্র সব ঋতুতে খান মাথাটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। বস্তুত, কাপড় কাচার চেয়ে বিনা পরিশ্রমে এই মাথা ধোলাইয়ের কারণেই নাকি আজ সোডার খাতির বেশি।
তাকিয়ে দেখুন। দেখবেন, পরীক্ষার টিফিনে ছেলেরা সোড়া-লেমনেড খাচ্ছে। মেয়েদের কাঁচা সোডা সয় না। তাঁরা রেস্তোরাঁর টেবিলে বসে ‘আইসক্রিম সোডা’ চান। নয়তো কমলালেবুর গন্ধ মাখা সোডা পানি। তাও যদি না থাকে, তবে লেমনেড। মোট কথা, একটা কিছু চাই-ই। নারী-পুরুষ, ছেলে বুড়ো সকলেরই সোড়া চাই। কোনও না কোনও দিন, কোনও না কোনও নামের একটা বোতল হলেও চাই-ই চাই।
মার্কিনিরা তাঁদের চলতি যুগটার নাম দিয়েছেন ‘কোকাকোলার যুগ’। কলকাতার আজকের যুগটাকেও সেটা বলা ঠিক হবে নাকি পেপসি’র বললে বেশি মানাবে, তা নিয়ে তর্কাতর্কি করে দুটো বোতল না ফাটিয়ে, আমার মনে হয় আপসে একে বোতলের যুগ বলাই হবে ঠিক। ‘বোতল’ শুনে আবার মতি শীলের যুগ ভাববেন না যেন। শীলমশাই টাকা করেছিলেন শুধু বোতলের ব্যবসা করে। তাই দেখে এক মদ্যব্যবসায়ী নাকি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘কত লোক খালি বোতল বেচে বড়লোক হয়ে গেল, আর আমরা ভরা বোতল বেচেও কিছু করতে পারলাম না।’
সেটা হয়তো ভাগ্যের কথা। অন্তত সে বেচারা তাই ভেবেছিলেন। তা বলে এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, সেকালে ভরা বোতলের কদর কিছু কম ছিল। ১৮০০ সালের খবর বলি। কলকাতায় তখন পঁচিশটি মদের দোকান। ‘আরক’ বিক্রি হয় সেখানে। সাহেবরা পা মুড়ে মাটিতে পড়ে পছন্দসই মেয়ের জুতোয় করে তাই ঢকাঢক গেলেন।
‘আরক’ ছাড়াও তাঁদের জানা ছিল ব্যাটাভিয়ান ‘দোয়াস্তা’, আরমেনিয়ান ‘আনিস’, আর দেশি ‘টডি’। শেষোক্তটিরও বিলক্ষণ খাতির ছিল তখন। তবে শিবনাথ শাস্ত্রী মশাই পচাই সম্পর্কে যা বলেছেন, ঠিক ততখানি কিনা বলা কষ্টকর। ‘আত্মজীবনী’তে বিলাত-ভ্রমণ প্রসঙ্গে এক জায়গায় তিনি লিখছেন:
‘চারিদিকে ইংরাজ জাতির পানাসক্তির নিদর্শন প্রাপ্ত হইতাম। কোথায়ও পথের পার্শ্বে দেখি, পর্বতাকায় আমাদের দেশের ধান্যরাশি হইতে মদ্য প্রস্তুত হইয়া পচাধান্য পরিত্যক্ত হইয়াছে।’
এ সংবাদটি সম্পর্কে আজ মনে সন্দেহ জাগলেও কলকাতায় ‘টডি’ যে সেকালে ইঙ্গ-বঙ্গ উভয় মহলে ‘জনপ্রিয় পানীয় ছিল’ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে তাড়ি বা টডি নামেই ছিল কিনা, সেকথা হলপ করে বলা যাবে না। কেননা, সেকালে এসব জিনিসের সুবিধেমতো নামকরণ করে নেওয়াই ছিল প্রথা। লখনউয়ের এক নিষ্ঠাবান নবাবের কথা শোনা যায়। তিনি বিলেতি মদের নাম দিয়েছিলেন ‘ইংলিশ সিরাপ’। সুতরাং, তাড়িরও ‘আরক’ নাম হওয়া অসম্ভব নয়।
তাড়ি বিক্রি করতে সেকালে লাইসেন্স দরকার হত না। সুতরাং ঠিক কত তাড়ির দোকান ছিল এ শহরে কালেকটার তা বলতে পারবেন না। তবে তাঁর অনুমান শ’তিনেক তো হবেই। এবং তাদের বিক্রি হবে মাসে গড়ে পাঁচ হাজার চার শো ষাট টাকা।
সাইনবোর্ডওয়ালা দোকান ছাড়াও সেকালে এসব পণ্যের জন্যে ছিল পাঞ্চহাউস, ট্যাভার্ন ইত্যাদি। সেগুলো তাদের নাম অনুযায়ী আপাতদৃষ্টিতে খাওয়া থাকার জায়গা বটে, কিন্তু কলকাতার কালেকটর জানেন, পানীয়ও সেখানে সহজলভ্য।
তবে হ্যাঁ, এত রকমের মদ থাকতেও কলকাতার মেজাজে তখন মাদকতা ছিল না। কারণ কলকাতায় তখন সোডার বোতল ছিল না। আর, সময়মতো হাতের কাছে সোডার বোতলটি না থাকা যে কী মুশকিলের কথা, তা যে শুধু পাড়ার ছেলেরাই জানে তা নয়, সাহেবরাও তা জানতেন। জানতেন বলেই তাঁদের মন উসখুস করত, গলা খুসখুস।
মাঝে মাঝে এক-আধ বোতল সোডা যে তখন কলকাতায় না পাওয়া যেত তা নয়। তবে বলতে গেলে, তা না পাওয়ারই সামিল। কারণ, তা আসত সুদূর জাভা থেকে। তার সরবরাহের পরিমাণ কতখানি ছিল অনুমান করতে পারবেন—যদি উৎসটির কথা শোনেন—তবেই।
ইংরেজরা যখন ডাচদের হাত থেকে জাভা কেড়ে নিয়েছেন, তখনকার কথা। একদিন এক ইংরেজ কর্মচারী জাহাজ থেকে নেমে আপনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এমন সময় সহসা তিনি দেখেন, তাঁর সামনেই একটি ছোট ফোয়ারা। সাহেবের মনে হল, জলটা যেন কেমন তেজি। হাতে নিয়ে একটু চেখে দেখলেন, খেতে যেন সোডার মতো। ব্যস, আর যায় কোথা। তক্ষুনি তিনি ছুটলেন তাঁর জাহাজের দিকে। পরক্ষণেই ফিরে এলেন লোকজন নিয়ে। ফোয়ারার মুখটা সিমেন্ট দিয়ে বন্ধ করে ফেলা হল। ওপরে সিলমোহর আঁটা হল ডিউক অব নাসুর নামে। তারপর জাহাজের ক্যাপ্টেন সে খবর বয়ে নিয়ে নামলেন এসে কলকাতায়। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল সিমেন্ট-আঁটা সেই ফোয়ারা নিয়ে ব্যবসায়ীদের স্পেকুলেশান। দেখতে দেখতে গঠিত হয়ে গেল বিরাট এক কোম্পানিও।
কিন্তু অচিরেই বোঝা গেল ‘কোম্পানিটি যত বড় হোক, কলকাতার গলা ভেজাবার সামর্থ্য নেই তার। সুতরাং অবশেষে যেদিন টোলা কোম্পানির বিজ্ঞাপনে জানা গেল বিলেত থেকে নিয়মিত সোডা আসছে কলকাতায়, সেদিন শহরের মনের কী অবস্থা বুঝতেই পারেন। কলকাতার ট্যাভার্নে, ট্যাভার্নে সেদিন উৎসব।
বারবার পড়তে ইচ্ছে করে বিজ্ঞাপনটা, ‘কলকাতার মেসার্স টোলা অ্যান্ড কোং সানন্দে ঘোষণা করছেন যে, সম্প্রতি তাঁরা বিক্রির জন্যে কিয়ৎপরিমাণে সোডাপানি আমদানি করতে সমর্থ হয়েছেন।’
সোডার চেয়েও সেকালের বিজ্ঞাপনে বেশি প্রশংসা সোডার বোতলটির। পরবর্তী একটি বিজ্ঞাপন নিবেদন করছে ‘পানিটুকু রক্ষিত আছে মজবুত কাচের বোতলে। প্রতিটি বোতলের জন্যে আমরা গ্যারান্টি দিতে রাজি। তবে হ্যাঁ, বোতলগুলো যেন সব সময়েই উলটো করে রাখা হয়।’
১৮১২ সালের জন্য একটি বিজ্ঞাপনে, এই রাখবার কৌশলটাই হচ্ছে ‘বিশেষ দ্রষ্টব্য’। তাতে বলা হচ্ছে ‘Care must be taken to keep the bottles on their sides- if this is not attended to, the fixed air will escape in a few days.’
সোডাপানির এই উড়ে যাওয়া নিয়েই নাকি বিশেষ ভাবিত হয়ে উঠেছিলেন জনৈক এতদ্দেশীয় নবাব। সাহেবেরা তাঁকে নেমন্তন্ন করেছেন। নবাব খাচ্ছেন। এমন সময় বাটলার ফটাস করে একটা বোতল খুলে বসল। সে কী ফোঁসফোঁসানি রাগ সে বোতলের। যেন বোতল ভেঙেই উড়ে যাবে পানি। দেখে নবাব বাহাদুরের চক্ষুস্থির। সাহেবেরা তাঁকে নানাভাবে বোঝাতে লাগলেন। সোডা কী করে তৈরি হয়, সোডা কেন এমনি করে, একে একে সবই বলা হল তাঁকে। কিন্তু তবুও নবাবের বিস্ময় আর কাটে না। অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, ‘এসবই না হয় বুঝলাম সাহেব। কিন্তু আমি ভাবছি, যে পানি বোতল খুললেই উড়ে যায়, সেই পানি তোমরা বোতলে পুরলে কী করে?’
দেশীয় লোকেরা নাকি এসব কারণেই এই আজব-পানির নাম দিয়েছিল ‘বিলাতি পানি। ট্রেভেলিয়ান সাহেব লিখেছেন, ওদের ধারণা ছিল বিলাতের নদী-নালার জলও এমনি তেজি। (This arises from an idea which prevails in the Hindoo’s mind that the ordinary water of the English rivers is bottled for exportation).
সোডাপানির এ রহস্য উদঘাটন করতে পুরো একটি যুগ লেগেছিল কলকাতার। অর্থাৎ নিজের হাতে সোডার জল বোতলে পুরতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল পুরো বারো বছর। তবে পানিটুকু রপ্ত করতে পুরো এক বছরও যে লাগেনি, সে কথা বলাই বাহুল্য। ডজন প্রতি সোডার বোতলের দাম তখন চোদ্দ টাকা। বোতল ফেরত দিলে—বারো টাকা। তবুও কবে জাহাজ আসবে, সেই অপেক্ষায় বসে থাকতেন খদ্দেররা।
পরের বছর (১৮১৩) দাম দশ টাকায় নেমে এল বটে, কিন্তু নিয়মিত জোগান সমস্যার কোনও মীমাংসা হল না। তা হতে হতে কলকাতা এসে পৌঁছল ১৮২৪ সালে। সে বছর ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটের একটি বিখ্যাত কেমিক্যাল কোম্পানি ঘোষণা করলেন, তাঁরা বিলেতি যন্ত্রপাতিতে বিলেতি মসলায় এতদ্দেশে সর্বপ্রথম সোডাপানি তৈরি করেছেন। দাম বোতলসহ—ডজন সাত টাকা, বোতল ছাড়া—পাঁচ টাকা।
তবুও কি ফ্যাসাদ কম। সোডা একবার রপ্ত হয়ে গেছে। সুতরাং কলকাতা তখন সোডা ছাড়া একদিনও চলতে নারাজ। অথচ জিনিসটা তো আর আকাশ থেকে পড়ছে না, কলে হচ্ছে। কল বিগড়াতে পারে, যে চালায় তার অসুখ হতে পারে। কিন্তু সোড়া কলকাতার কালচারের সঙ্গে ততদিনে গলাগলি হয়ে গেছে। সে তখন কোনও কৈফিয়ত শুনতে রাজি নয়। সুতরাং চিঠি গেল কল-মালিকদের কাছে। গালাগালি-বোঝাই ক্রুদ্ধ চিঠি।
সেই বিশেষ কলটির মালিক ছিলেন বাঙালি এবং বৃদ্ধ। তিনি ইংরেজি জানতেন না। তার ওপর ক’দিন ধরে শয্যাগত। সুতরাং, চিঠিখানা যথারীতি বাড়িয়ে দিলেন তাঁর ছেলের দিকে।
ছেলে তো চিঠি পড়ে ভয়েই অস্থির। সে বেচারা সোডা তৈরি করতে জানে না বটে, কিন্তু এটা জানে যে ‘খরিদ্দার প্রভুর সমান’। সুতরাং, তার সাকুল্য ইংরেজি বিদ্যে একসঙ্গে করে ইনিয়ে বিনিয়ে উত্তর দিল:-
‘Respected Sir,
This is to inform you that my father has been ill and unable to make water —but in a fews days he will be better when he will make plenty of water with lots of gas, etc. etc.
চিঠিটা অনুবাদের অযোগ্য।
আপনারা হয়তো বলবেন ‘আনকালচারড চিঠি’। কিন্তু কলকাতা বলবে: কোনটা তা হলে বেশি কালচারাল? রাগের উত্তরে এমন একটা চিঠি ছাড়াটা, নাকি হাল আমলের ধারায় মাথায় একখানা আস্ত বোতল ফাটানো?
শীতে শত্রু তুমি
এই গ্রীষ্মের সখাটিকে এতক্ষণে নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছেন আপনারা। এত দিন,—এমনকী কলকাতার সদ্যবিগত বহু ডিগ্রি গরমেও কেন এর বন্দনায় অবতীর্ণ হইনি, তার কৈফিয়তস্বরূপ বলে রাখি, কারণটি সম্পূর্ণ টেকনিক্যাল। সিদ্ধ এবং বুদ্ধ—উভয় শ্রেণীর শিল্প-সূত্ৰকারেরা বলে থাকেন সৃষ্টির হাল যাতে পেঁচোয়-পাওয়া না হয়, তার জন্যে কাঁচামাল এবং কারিগরের মধ্যে, অর্থাৎ লেখক এবং লেখ্যবস্তুর মধ্যে ডিটাচ্মেন্ট বা বিচ্ছেদ অত্যাবশ্যক, সম্প্রতি আমার তা-ই ঘটেছে। শুধু আমারই বা বলি কেন, এতদিনে তার ভোঁ-ভোঁ কিংবা পন্পনানি নিশ্চয়ই স্তব্ধ হয়ে গেছে আপনার মাথার ওপরেও। আমারটির স্থান অবশ্য মস্তকোপরি ছিল না—ছিল যথার্থ সখা হিসাবে শয্যাতেই। সম্প্রতি তিনি স্থান নিয়েছেন উনুন-পার্শ্বে, অবশ্য স্থান বদল হলেও হাতবদল হয়নি। ডাটাটি অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত তা হওয়ার উপায় নেই। শীত-গ্রীষ্ম নির্বিশেষে আর পাঁচটা নিম্নবিত্ত ঘরের মতো গৃহিণীর সখারূপে তাকে সেখানে অবস্থান করতেই হবে।
সে-কথা থাক। হঠাৎ পাখাকে নিয়ে লেখার আরও একটা কারণ আছে। কলকাতা-বিষয়ক অন্তত একটা হলেও গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখা উচিত, এ কথা বারবার পরামর্শ হিসেবে বন্ধুদের থেকে শুনে আসছি। অবশেষে অনেক ভেবেচিন্তে স্থির করেছি, পাখাই এ-ব্যাপারে আমার কঠিনতম পরীক্ষা। এ ছাড়া গবেষণাযযাগ্য দ্বিতীয় কোনও বিষয় কলকাতা শহরে আছে বলে আমার জানা নেই। সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করে রাজনীতিক্ষেত্রে কতখানি ভুল করেছিলেন, অন্ধকূপ-হত্যা সত্য কিনা—কিংবা আদৌ কোনও হলওয়েল মনুমেন্ট ছিল কি না ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে ঢের লেখা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আশা করি, ভবিষ্যতে ‘নবতর’ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আরও হবে। কিন্তু এই ‘পাখাতে’ কেউ হাত দেননি। অথচ বিষয়টি নিঃসন্দেহে গবেষণামূলক। কারণ, এর প্রচলনের সন-তারিখ রীতিমতো বিতর্কমূলক। দ্বিতীয়ত, এর পরিবর্তন সংস্কার এবং পরিবর্জনের ধারাবাহিকতা কলকাতা তথা তামাম হিন্দুস্থানের ইতিহাসের সঙ্গে যথেষ্ট সংগতিপূর্ণ। তৃতীয়ত, ইঙ্গ-জীবনে বঙ্গপ্রভাব, অর্থাৎ কলকাতাস্থ ইঙ্গ-সমাজে বঙ্গীয় হাওয়া যদি কিছু লেগে থাকে, তবে তার অনেকখানিই সঞ্চালিত হয়েছে এই পাখায় ভর করেই। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, তথাকথিত বৃহৎ ঐতিহাসিক ঘটনার চেয়ে এটি কত গভীর অনুধ্যানের বিষয়। আমার কাছে আরও গভীর এই কারণে যে, একমাত্র এতেই আমার পক্ষে সম্ভব এক ঢিলে দুটি পাখি মারা। একসঙ্গে যুগল-বন্ধুকৃত্য সম্পাদনের এমন সুযোগ বোধ হয় আর আমি পাব না। আশা করি, এতে একদিকে যেমন এই নির্বাক মৌসুমী মিত্রটির প্রতি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন হবে, অন্যদিকে কফি-হাউসের বন্ধুদেরও স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
পাখা কবে কিংবা কীভাবে অত্র শহরে চালু হয়, সে বিষয়ে গবেষণায় অবতীর্ণ হওয়ার আগে, কেন বা কোন পরিস্থিতিতে প্রচলিত হয়, তা অনুসন্ধান করা সমাজ-সচেতন গবেষক হিসাবে আমার প্রথম কর্তব্য। তদনুযায়ী যথেষ্ট পরিশ্রম করে আমি এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছি যে, কলকাতায় পাখা প্রচলিত হওয়ার পশ্চাতের কারণ গ্রীষ্ম নয়, মশা-মাছি। সম-অক্ষাংশদ্রাঘিমায় পৃথিবীর অন্যত্রও গরম সম-পরিমাণেই ছিল, কিন্তু টানা পাখা ছিল না সেখানে। অথচ কলকাতায় যে পরিমাণ মশা-মাছি ছিল, তার তুল্য মশা-মাছি ভূ এবং ভারতে কুত্রাপি ছিল না। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী লিখে গেছেন: প্রতিদিন ভোরে একটি গরুর গাড়ি বোঝাই করে মাছি ইত্যাদি প্রাণীর শবদেহ নিয়ে যাওয়া হত স্পেন্সেস হোটেল থেকে। উজ্জ্বল আলোর আকর্ষণে তারা রাত্রে মৃত্যুবরণ করত সেখানে। মশার কথা বলাই বাহুল্য। আজও ১৯৯৮ সালেও কলকাতার মতো আধুনিক শহরে কর্পোরেশনের সৌজন্যে এই প্রাণীটি আমাদের কাছে সুদুর্লভ হয়ে ওঠেনি, সে আমাদের সৌভাগ্য। কর্পোরেশনের সক্রিয় সহযোগিতা না পেলে শুধুমাত্র ঈশ্বর গুপ্ত মহাশয়ই কলকাতার মশককুলকে এতকাল নিশ্চয়ই বাঁচিয়ে রাখতে সমর্থ হতেন না। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই অষ্টাদশ উনিশ শতকের মশা আজ আর নেই। মশার যথেষ্ট প্রকৃতি বদল হয়ে গেছে গেল দেড়’শ দু’শ বছরে। শোনা যায়, আগে এরা লোক চিনে কামড়াত, নেটিভদের ওপর বৃহত্তর মশকদের শোষণ দেখে এরা নাকি তাদের করুণা করত। যে-কোনও কারণেই হোক, রক্তহীন নেটিভ-অঙ্গের চেয়ে ইউরোপিয়ানদের প্রতিই ছিল এদের বেশি আকর্ষণ। এ সম্পর্কে স্যার চার্লস ডয়লির (Charles D’oyly) সাক্ষ্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন: মশার গুঞ্জন শুনতে চাও তো সন্ধের দিকে কোনও ইউরোপিয়ানের বাসায় এসো। ঝাঁকে ঝাঁকে মশারা সব গান ধরে তখন। শব্দ শুনে মনে হয় তাঁত চলছে বাড়িতে। নেটিভেরা সাধারণত এ সময়টায় তাদের রাত্তিরের খানা পাকায়। ফলে ধোঁয়ার জ্বালায় মশারা টিকতে পারে না ওখানে। তারা পাখা মেলে পাড়ি জমায় ইউরোপিয়ান কোয়ার্টারের দিকে। অনুমান করি, এই ক্রমাগত এবং একতরফা আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্যেই একদিন এই কলকাতা শহরে মশকদের সংহারার্থে কামান দেগে বসেছিলেন কোনও মেজাজি ইউরোপিয়ান সৈনিক। বাংলা প্রবাদের অন্তর্নিহিত সত্যে যাঁদের আস্থা আছে, এবং সেই সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচয় আছে অষ্টাদশ শতকের এ দেশীয় ইংরেজ জীবনের সঙ্গে, তাঁরা অতঃপর আমার এই কথাটিকে ‘অনুমান মাত্র’ বলে মনে করবেন না বলেই আমার বিশ্বাস। অন্য একজন লেখক পরিষ্কার লিখেছেন: পাখা সঞ্চালনের প্রথম উদ্দেশ্য মাছি বিতাড়ন। অতঃপর বায়ু সঞ্চালন। (এখানে বলে রাখা দরকার, মাছি এবং মশার পার্থক্য প্রথম যুগে অনেক ইংরেজের কাছেই খুব স্পষ্ট ছিল না। ফলে Fly বলতে উনি মশককে বাদ দিয়ে বলেছেন এমন মনে করার কোনও কারণ নেই।)
যা হোক, পাখার জন্মের দ্বিতীয় কারণটি যে কলকাতার গরম, এ বিষয়ে আমার পূর্ববর্তী বাঙালি লেখকদের সঙ্গে আমি একমত। কারণ, এই অতিশয় মনোরম এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্রটির অন্যতম কার্যকারিতা সম্পর্কে প্রায় সকলেই বলে আসছেন ইহা বায়ুকে আন্দোলিত করে (‘It agitates the air greatly’)। কেউ কেউ বলেছেন: ইহা কৃত্রিম বায়ু-প্রবাহ সৃষ্টি করে। (‘Produces a tolerably comfortable artificial air.’)
অর্থাৎ বর্তমান যুক্তিধারায় আমরা দেখতে পাচ্ছি কলকাতায় মশা-মাছি ছিল বলেই পাখা আছে এবং পাখা বাতাস-সঞ্চলনে সক্ষম বলেই গ্রীষ্মের সখারূপে এতদ্দেশে স্বীকৃত ও আদৃত হয়েছে।
এখানে কলকাতার গ্রীষ্মকে বাদ দিয়ে শুধু পাংখা-বিচারে মত্ত আমাদের সিদ্ধান্তে ত্রুটি থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা। কারণ, কলকাতার গরম ভারতের অন্যান্য বহু জায়গার থেকে কম হলেও, অন্যান্য সকল স্থানের ইঙ্গ-সমাজে এর অবদান রয়েছে। সুতরাং কলকাতার গরম সম্পর্কে এখানে দু’চার কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। প্রথমেই এই গ্রীষ্মের ভয়াবহতা সম্পর্কে চলা বলে অষ্টাদশ শতকে কলকাতার রোদ ছিল সাহেবদের কাছে দড়ির তুল্য। অর্থাৎ, গলায় দড়ি না বেঁধে নগ্ন মস্তকে রাস্তায় দু’ একটা পাক খেলেই তাদের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেত। (‘…To be out in the sunshine was looked upon as attempted suicide.’ H. HOBBS.) অনেকেই নাকি এভাবে আত্মহত্যা করতেন তখন। ভাবতে পারেন, কোথায়! আমরা তো সাঙ্গ হইনা। সে হয় আমাদের মন্দভাগ্য, তাই গলায় দড়ি বেঁধে হ্যাঁচকা-হেঁচকি করি, নয়তো গায়ে স-অগ্নি কেরাসিন ঢেলে তারস্বরে চিৎকার করি। তা ছাড়া তো সে গরমও বোধ হয় আজ আর নেই। এমিলি ইডেন অতি সুন্দর অথচ সংক্ষিপ্তভাবে তা বুঝিয়েছেন আমাদের। তিনি লিখেছেন: ‘It was so HOT-I don’t know how to spell it large enough.’ ‘হট’ কথাটাকে ক্যাপিটাল অক্ষরে বলে তিনি যে গরমটি বোঝাতে চেয়েছেন, আশা করি, তা সর্বজনবোধ্য। নয়তো অন্যান্য বিবরণ আমাদের কাছে রীতিমত অর্থহীন হয় বলেই আমার ধারণা। যেমন একজন লিখেছেন: বাপরে, কী গরম! মনে হয় যেন, বাস্তিলের দেওয়াল-বেষ্টনীতে আছি। তবে হ্যাঁ, মনে রাখতে হবে, কলকাতার এই প্রচণ্ড গরমই সাহেবদের হাতে পাখা তুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথায় তুলেছে শোলার টুপি। (টুপির ওপরে সেলুলয়েডের হালকা আস্তরণটি অবশ্য বসিয়েছে কলকাতার বৃষ্টি)। তদুপরি এই গ্রীষ্মই শিখিয়েছে তাঁদের স্নানাভ্যাস এবং পরিমিত পানাভ্যাস। সুতরাং গরমেরও কৃতিত্ব আছে বই কি!
যা হোক, গরম ছেড়ে আবার পাখার কথায় আসা যাক এবার। কেন কলকাতায় পাখা প্রচলিত হয়। তা নির্ণয়ে আমরা সমর্থ হয়েছি। এবার আমাদের সন্ধান করতে হবে, কলকাতায় পাখা প্রচলিত হয় সঠিক কোন সময়ে। যাঁরা গুরুতর সমাজতাত্ত্বিক তাঁরা বলবেন—সামন্ত যুগে। ব্যক্তিগত বিলাসবিহ্বল জীবনকে ফুরফুরে করে তোলার জন্যে দাসশ্রেণীর পায়ে বেড়ি দিয়ে, এবং হাতে পরমানন্দে টানা-পাখার দড়িটি ছেড়ে দিয়ে যে যুগে দরজা বন্ধ করে মানুষ ঘুমাত, সেই যুগে অর্থাৎ মুঘল যুগে বা পরবর্তী কালে ইংরেজের পদসঞ্চারের পর। কিন্তু ইতিহাস বলে—‘না’। ইংরেজ আমলের প্রথমে পাখা ছিল না। ক্লাইভ তো পরে। এমনকী হেস্টিংস-ফ্রান্সিসের আমলেও পাখা ছিল না কলকাতায়। কেননা, তখন সহস্রবিধ ভৃত্যশ্রেণীর সন্ধান মিললেও সে তালিকায় পাংখা-বরদার অনুপস্থিত। মিসেস গোল্ডবোর্ন (১৭৮৩-৮৪) সালে লিখছেন: খেতে বসলে চারদিকে ঘিরে ছেলেরা সব ছোটবড় পাখা নিয়ে দাঁড়াবে হাওয়া করার জন্যে। (‘A…during the whole period of dinner, boys with flappers and fans surround you…’) পাখা সম্পর্কে সেই প্রথম ঘোড়ার মুখের সংবাদ। অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে পাখা ছিল।
ঐতিহাসিক অমনি তেড়ে এলেন—পাখা তো বৈদিক যুগেও ছিল। কালিদাস কি ভেজা পদ্মপত্রে শকুন্তলাকে হাওয়া খাওয়াননি? শুধু পদ্মপাতাই বা বলি কেন, তালপত্রও ছিল। ‘না বাতি বায়ুস্তৎপার্শ্বে তাল বৃন্তানিলাধিকম্’। তারকাসুরের বাগানের কথা বলা হচ্ছে। সেখানে পাছে ফুলের পাঁপড়ি ঝরে পড়ে, তার জন্যে বাতাস তালপাতার পাখার চাইতে জোরে বইত না। তা ছাড়া, ভক্ত দেবতার সামনে আন্দোলিত করতেন— চামর। সেও তো পাখারই রকমফের। সুতরাং পাখা কবে কলকাতায় প্রচলিত হয়েছে তা প্রশ্ন নয়, টানা-পাখা কবে থেকে চালু হয়েছে, তাই হচ্ছে জিজ্ঞাসা। মিসেস গোল্ডবার্নের কথা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়—তখন পাখা থাকলেও টানা-পাখা ছিল না। অথচ তার ক’বছর পরেই (১৭৭৯) M L De Grandpore লিখেছেন: ‘অনেক বাড়িতে খাওয়ার টেবিলের উপরে সিলিং থেকে একটা পাখা ঝুলতে দেখা যায়।’ সুতরাং অনায়াসেই সিদ্ধান্ত হল টানা পাখার জন্ম ১৭৮৪ সাল থেকে ১৭৯০ সালের মধ্যে। তারপর স্বাভাবিক নিয়মেই এর বৃদ্ধি হয়েছে, পুষ্টি হয়েছে, ক্রমে আদৃত এবং পরিত্যক্ত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন: কে এর জাতক? এই আশ্চর্য পবন-সঞ্চালকের আবিষ্কারক কে?
এই জাতক-নির্ণয় সহজ কর্ম নয়। বিজ্ঞজন যাঁরা, তাঁরা হয়তো বলবেন—‘জাতক’ ব্যক্তি নয়, যুগ। যে যুগে ঘোড়ার পায়ে নাল লাগাতে শিখেছে মানুষ সেই যুগেই শিখেছে পাখার মাথায় দড়ি লাগাতে। কিন্তু মূঢ় পিতা তাতে সম্মত নন। জাতির রূপ ধরে এগিয়ে এলেন তিনি। বললেন: শিল্প বিপ্লব ঘটিয়েছি আমরা, আর পাখা আবিষ্কার করেছ তোমরা, তা কি হয়? এটি অনিবার্যভাবেই ইংরেজ সভ্যতার দান।
এভাবেই চলছিল। প্রথম আপত্তি জানালেন ভোলানাথ চন্দর। তিনি লিখলেন, অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে কলকাতারও আগে চুঁচুড়ার ডাচ গভর্নর তা আবিষ্কার করেন। ইউরোপীয় ইউরোপীয়ে বিবাদ। সুতরাং অন্যদের চুপ করে থাকার কথা নয়! ক’বছরের মধ্যেই (১৭৯২) ‘ক্যালকাটা ক্রনিক্যাল’ লিখেছে: পাংখা নামক যে যন্ত্রটি বর্তমানে আমাদের গৃহাদিতে প্রচলিত, তা সর্বপ্রথম এদেশে আনেন পর্তুগিজরা।
অর্থাৎ পাখার আবিষ্কারক ইংরেজ নয়, ডাচ নয়, পর্তুগিজ। আর যায় কোথায়? হোক না মামুলি পাখা, তাই বলে কি প্রাচ্যের কোনও দাবি থাকবে না এমনি একটা আবিষ্কার উপলক্ষে? Yule এবং Burnell সাহেব লিখলেন: অষ্টম শতকে আরব দেশে উহা প্রচলিত ছিল। কোথায় অষ্টাদশ, আর কোথায় অষ্টম শতক। সুতরাং একসঙ্গে নীরব হয়ে গেল কলকাতা, চুঁচুড়া এবং লিসবন।
কিন্তু এগিয়ে চলল পাখার ব্যাপ্তি। রাজা সুখময় রায়ের বাড়িতে এল পাখা। এল নবাব, মুনসি, মুৎসুদ্দির ঘরে ঘরে। দড়ি ধরে ঝিমুতে লাগল পাখা-বরদার। বংশানুক্রমে চলল তাদের হাওয়া জোগানোর কাজ। দেশের হাওয়া বদলায়, পাখার ঝালর বদল হয়, রঙ বদল হয়। নামি-দামী শিল্পী এসে চিত্র করতে বসেন তার গায়ে। এক-এক বাড়ির পাখার এক-এক রকম খ্যাতি। সেই খ্যাতির মধ্যে চাপা পড়ে রইল আসল আবিষ্কর্তার নাম। কিন্তু তলে তলে লোকে চালু রেখে গেল তার কাহিনীটি। সেটি হচ্ছে এই: পাখার প্রকৃত আবিষ্কারক জনৈক ইউরেশিয়ান কেরানি। তার কাজ ছিল ফোর্ট উইলিয়মের একটা নিচু ঘরে। একদিন অসহ্য গরমে এবং মশার কামড়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বেচারা তার ক্যাম্প-টেবিলের একটি দিক কাঠসমেত ছিঁড়ে মাথার উপরে ঝুলিয়ে, তাতে একটা দড়ি সংযোগ করে টানতে শুরু করে। জন্ম হয় টানা-পাখার। কেরানির ঘর থেকে প্রথমে পদ্ধতিটি চালু হয় বড়বাবুর ঘরে, তারপর ক্রমে আরও বড় ঘরের দিকে। উঠতে উঠতে যখন সবচেয়ে বড় ঘরে ঝুলল পাখা তখন কেরানির ঘর আবার হয়ে গেল পাখাশূন্য। কারণ তখন টানবার জিনিস নয়, পোষবার জিনিস এবং পরিবার ছাড়া যে-কোনও সাধ-আহ্লাদই তখন কেরানিদের পুষতে মানা।
পৃথিবীতে বোধহয় কেরানির ভাগ্যে সর্বপ্রথম একটি আবিষ্কার গৌরব জুটল। দেশীয় গবেষক হিসেবে স্বভাবতই বাঙালি কেরানিকে এই গৌরবের অংশভাগী করার জন্য আমি যারপরনাই চেষ্টা করেছি। ইউরেশিয়ান (Eurasian) কথাটা দেখে আশান্বিতও হয়েছিলাম যথেষ্ট। ভেবেছিলাম চেষ্টা করলে এটাকে ‘এশিয়ান’ ক্রমে ‘বাঙালি’ রূপদানে সক্ষম হব। কিন্তু সে চেষ্টায় আগেই বাদ সেধেছেন স্বয়ং বাঙালি কেরানিকুল। তাদের মতামত নিয়ে দেখেছি, এমন অবস্থায় পড়লে তাঁরা পাখা আবিষ্কারের বদলে যা করতেন বলে মনে করেন, তা হচ্ছে: হয় কবিতা লেখা, নয় আত্মহত্যা। ওঁদের একদল এমন মশা এবং গরম মিশ্রিত নিদ্রাহীন রাত্রিটাকে কবিতার পক্ষে শ্রেষ্ঠতম বলে মনে করেন। আর এক দলের মতে, গিন্নির নিদ্রাভঙ্গ না করে ক্যাম্পখাট ভাঙতে পারলে কিংবা ‘কড়িতে’ দড়ি লাগাতে পারলে, আত্মহত্যার পক্ষে ওটাই ‘বেস্ট মোমেন্ট’।
হুক্কা ও এক্কা
হুক্কা আর এক্কা এক জিনিস নয় বটে, কিন্তু একই যুগের জিনিস। তার চেয়েও বড় কথা একই মেজাজের জিনিস। তাই একটির কথা বললেই আর একটির কথা এসে যায়। হুক্কার কথা তুললেই এসে পড়ে এক্কার কথা। আর এক্কার কথা ভাবলেই আমার মনে পড়ে যায় পালকির কথা। কারণ, পালকি কলকাতার এক্কার জনক।
অষ্টাদশ শতকের কলকাতার বাহন বলতে ছিল দুটো পা। পা-ই, তবে কিনা, নিজের অথবা অন্যের। গরিব লোকেরা সেই শীর্ণ কালো কালো পা দু’খানায় ভর করেই চরে বেড়াত আজব নগরীতে, আর বড়মানুষেরা বেড়াতেন এদেরই ঘাড়ে চড়ে। নিজের পা মাটিতে ছোঁয়াতে হত না তাঁদের। হেঁইও-হো, হেঁইও-হো করতে করতে সেই শীর্ণ পদযুগলই তাঁদের বয়ে বেড়াত দেশময়। অর্থাৎ বেহারাই ছিল তখন বাবুলোকের একমাত্র বাহন। অবশ্য মোটটি বইত তারা পালকিতে চাপিয়েই। কিন্তু তাতে কী আসে যায়? বাবু ভাবতেন হয়তো পালকি চড়েছি, কিন্তু বেহারা মনে মনে ঠিকই জানত পালকি নয়, বাবু বইছি। তবুও যুগটা বেহারার যুগ না হয়ে হচ্ছে পালকির যুগ। যেন তা হলেই পালকির আড়ালে পড়ে যাবে সাধ-আহ্লাদ করে মানুষের ঘাড়ে চড়ার কাহিনীটা।
কিন্তু আড়াল পড়েনি। নতুন যাঁরা দেখেছেন কলকাতার পালকি, তাঁদের সকলের দৃষ্টিতে প্রথমেই পড়েছে কলকাতার বেহারা। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে বালসাজার নামে একজন ইটালিয়ান চিত্রশিল্পী এসেছিলেন কলকাতায়। তিনি লিখেছেন: ‘ইউরোপিয়ানরা যে-সব শহরে বসবাস শুরু করেছে, তার প্রত্যেকটি পালকিময়। পালকিগুলো সব বেশ সুন্দর গড়নের। চারজন বেহারা তা বহন করে থাকে। প্রত্যেকের হাতে হাতে থাকে একটি করে লণ্ঠন। তার আগে আগে চলে হরকরা এবং পেয়াদার দল।’ বেহারাদের নৈপুণ্য সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন: ‘বেহারা’ নামক লোকগুলো এমনি সুন্দর চলে, কী বলব ভাই, টেরই পাবে না যে, তুমি কারও ঘাড়ে চড়ে চলছ। ওরা ঘাড় বদল করে কখন, তাও টের পাবেনা। চলনও এদের এমনি দ্রুত যে, দেখতে না দেখতে মাইলের পর মাইল চলে যায়। চলতে চলতে কখনও থামে না ওরা, এমনকী, চলার তালে তালে কথাবার্তা কিংবা গানও চলে দিব্যি। তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে ইউরোপের ডাকগাড়ির ঘোড়া বদলের মতো, হিন্দুস্থানে বেহারাও পথে জায়গায় জায়গায় বদল হয়। ইত্যাদি।’
মিস সোফিয়া গোল্ডবার্ন (১৭৪৮) নামে আর এক মহিলা লিখেছেন, ‘যেখানটায় নামলাম আমরা, চৌরঙ্গি সেখান থেকে প্রায় চার মাইল। অথচ আশ্চর্য, দেখতে না দেখতেই পৌঁছে গেলাম। এমনই ওস্তাদ এই বেহারাগুলো। রোদ বা গরম কিছুই লাগে না ওদের। ঘণ্টায় ন’ থেকে বারো মাইল চলে যায় অক্লেশে। আর পালকিগুলোও এমনভাবে তৈরি, মনে হয় যেন গদিতে বসে আছি। সামনে লাল সরাব এবং আনুষঙ্গিক উপচার,… ইত্যাদি।’
এভাবেই লোকে যেত। পাঁচশ মাইলও যেত। কলকাতা থেকে এলাহাবাদে বা কাশী যেখানে খুশি। বড়বাবু তীর্থ করতে যেতেন পালকি চড়ে, বড়া সাহেব অফিসে, বড় গিন্নি স্নানে। যার যেমন ঘর, তার তেমন পালকি, তার তত বেহারা। সিন্দুকের পরিস্থিতি অনুযায়ী দুই বেহারাতে চলে যায় কারও। কারও চাই চারজন, কারও আবার ছ’ বেহারা না হলে চলেই না। বেহারার ওপরে আছে হরকরা, পেয়াদা, সোটা-বরদার, মশালচি। সুতরাং পালকি পোষা সহজ ব্যাপার নয় তখন।
পালকির দাম আছে। যেমন তেমন একটা হলে বড়মানুষি থাকে না। অথচ একটু রঙচঙওয়ালা ভাল একখানা পালকি করতে হলে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ। তারপর আছে বেহারাকুলের মাইনে। মধ্যবিত্ত মানুষেরা তাই ঠিকা পালকি চড়তেন। তারও খরচ কম নয়। কলকাতা থেকে কাশীর ভাড়া ৫০০ সিক্কা টাকা। তাই পালকি করে তাদের তীর্থ করা হত না। কাছাকাছি জায়গায় যাতায়াতটুকুই হত শুধু। তারও ভাড়া কম নয়। প্রতি ক্রোশে এক টাকা দু’আনা।
তাই বলে ভাববেন না, বেহারাদের রোজগার খুব ভাল ছিল। বরং একেবারে তার উলটো। ঠিকা পালকি বয়ে দিনে তাদের রোজগার হত একটাকা চার আনা। তার থেকে চার আনা দিয়ে দিতে হত মালিককে। নিজেদের পালকি ছিল না বেচারাদের। অর্থাৎ আজকালকার রিক্সাওয়ালাদের মতো ওরাও ছিল মজুর মাত্র। যা হোক বাকি যে টাকাটা হাতে রয়ে গেল, সেটি ভাগ হত চারজনের মধ্যে। মাথাপিছু দৈনিক রোজগার হত তাই চার আনা মাত্র। সাহেবের চাকরিতে আরও কম। সেখানে মাথাপিছু মাসিক মাইনে তাদের পাঁচ টাকা।
তাতেও হয়তো দিন চলে যেত কোনও মতে। কিন্তু সহসা একদিন সভ্যতার বিপাকে পড়ে গেল বেচারা বেহারার দল। শহুরে কানুনের কবলে পড়ে গেল তারা। ১৮২৭ সালের কথা। সহসা পুলিশ বিভাগ থেকে নোটিশ জারি হল, ঠিকা পালকি সব রেজিষ্ট্রি করতে হবে। আর বেহারাদেরও নিতে হবে লাইসেন্স নম্বর। সেই নম্বর খোদাই করা থাকবে একটি পিতলের চাকতির ওপর এবং প্রত্যেক বেহারাকে তাবিজের মতো বাহুতে ধারণ করতে হবে সেটি। কঠিন আইন।
কিন্তু তার চেয়েও কঠিন ছিল বেহারাদের শ্ৰেণীবন্ধন। তারা সবাই উৎকলবাসী। সুদূর ওড়িশা থেকে কলকাতায় এসেছে তারা পালকি বইতে, জাত খোয়াতে নয়। খেপে গেল তারা। পালকি বই বলে কি মান-অপমান নেই আমাদের, টিকিট ঝোলাব হাতে?
বেহারাদের মিটিং বসল। স্থির হল, ঠিকা পালকি-বেহারারা সব হরতাল করবে। ধর্মঘট। ২১ মে তারিখে গঠিত হল তাদের এক সংগ্রাম-পরিষদ। পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিল, যতদিন পর্যন্ত না এই অন্যায় আইন তুলে নেওয়া হচ্ছে ততদিন পালকি ছোঁব না আমরা। যদি কেউ তা করে, তবে একঘরে করা হবে তাকে। কঠিন সংকল্প।
সেই দিনই, অর্থাৎ ১৮২৭ সনের ২১ মে দুপুরের একটু আগে ময়দানে সমবেত হল শহরের এক হাজার পালকি-বেহারা। তারপর মিছিল করে চলল তারা লালবাজারের দিকে। লালবাজার তখনও পুলিশ অফিস। ‘চলবে না’ ‘চলবে না’ করতে করতে সেই জনতা এসে হাজির হল সেখানে। কিন্তু পুলিশের মেজাজ সনাতন। তারা এই আইন প্রত্যাহার করতে সম্মত হল না। সুতরাং বেহারাবাহিনী ফিরে চলল। ফেরার পথে সুপ্রিম কোর্টের সামনের মাঠে আবার মিটিং হল তাদের। গরম গরম বক্তৃতা হল। পুলিশি-জুলুমের নিন্দা এবং সরকারের জনস্বার্থবিরোধী নীতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে চলে গেল যে-যার বস্তিতে।
পালকি চড়েন যাঁরা, তাঁরা হাঁফ ছাড়লেন। ‘যাক বাবা, বাঁচা গেল।’ এ তাদের এক নতুন অভিজ্ঞতা। বেহারা আবার মিছিল করে, মিটিং করে—ছোঃ। দিনে দিনে কত কী-ই বা হবে।
কিন্তু আরও বিস্ময় ছিল তাঁদের জন্যে। পরদিন সকালবেলা ছোট সাহেবের ঠিকা পালকি অনুপস্থিত। মেজ সাহেব শ্বশুরবাড়ি যাবেন। হরকরা ঘুরে এসে বলল পালকি নেই। বড় গিন্নি গঙ্গাস্নানে যাবেন, তাঁর পালকি তো এল না এখনও। তা হলে সত্যি-সত্যিই ধর্মঘট করেছে বেহারারা।
সত্যি-সত্যিই ধর্মঘট। কলকাতার নগরজীবনে প্রথম যানবাহন ধর্মঘট। হই-চই পড়ে গেল সারা শহরে। কাগজে কাগজে চিঠিপত্র লেখা হতে লাগল—ধর্মঘটের পক্ষে এবং বিপক্ষে। ক্রমে ক্রমে ধর্মঘট ছড়িয়ে পড়তে লাগল মাইনে-করা বেহারাদের মধ্যেও। ঠিকাভাইদের সমর্থনে তারাও এসে দাঁড়াল পেছনে। নগর-জীবন অচল হওয়ার উপক্রম হল।
কিন্তু, আজকের মতো তখনও রুজি-রোজগারহীন মানুষে ভর্তি দেশ। কলকাতার ধর্মঘটী বেহারাদের তাই বিপদ এল অন্য দিক থেকে। তাদের অনুপস্থিতির সুযোগে ক্রমে ক্রমে দু’চারজন করে কলকাতার রাস্তায় দেখা দিল রেওয়ানী বেহারা। এরা ধর্মঘটের সুযোগ নিয়ে দলে দলে পাড়ি জমাতে লাগল কলকাতায়। ধর্মঘট বানচাল হওয়ার উপক্রম দেখা দিল। কিন্তু ওড়িয়া বেহারারা তবুও সংকল্পে স্থির।
অবশেষে তাদের টনক নড়ল আরও ক’দিন পরে। কিন্তু তখন হাতে চাকতি বেঁধেও পালকি ঘাড়ে নেবার সুযোগ আর অবশিষ্ট নেই আগের মতো। নতুন দুর্ঘটনা ঘটে গেছে তাদের ভাগ্যে। ব্যাপারটা হয়েছিল এরকম: মি. ব্রাউনলো নামে এক সাহেব ছিলেন শহরে। তাঁরও পালকি ছিল একখানা। বেহারাদের হরতালে আপিস-আদালত করাই ভার হয়ে উঠল সাহেবের। আচ্ছা কাণ্ড। বিরক্তি আর ধরে না তাঁর। দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে, অথচ ধর্মঘট শেষ হওয়ার কোনও লক্ষণই নেই। অবশেষে একদিন খেপে গেলেন সাহেব। সারারাত্রি উত্তেজনায় পায়চারি করে বেড়ালেন ঘরময়। তারপর ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে, নিজের পালকিখানার নীচে কী করে চাকা বসানো যায় তাই নিয়ে ভাবতে বসলেন। শহরে ঘোড়ার গাড়ি যখন চলে তখন আর চাকার অভাব কি! জেদি সাহেব পালকিতে চাকা বসালেন। তারপর মেমসাহেবের ছোট্ট আরবি ঘোড়াটা জুড়ে চেপে বসলেন তার মধ্যে। গটমট করে গাড়ি হাজির হল আপিসের দরজায়।
বের হল ‘ব্রাউনবেরি গাড়ি’ আমরা বলি ‘পালকি গাড়ি’। বেগতিক দেখে ওড়িয়া বেহারারা হাতে টিকিট বেঁধেই ফিরে এল যে-যার কাজে। কিন্তু তত দিনে তাদের পালকিগুলো সব ঘোড়ার পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছে অনেক দূরে।
ক্রমে ‘মোকাম কলিকাতায় ছ্যাকড়া গাড়ির উৎপাতে রাস্তা চলা ভার’ হয়ে উঠল। শুধু পালকি নয়, নানা রকমের গাড়ি। শ্রেণীভেদ আছে, জাতিভেদ আছে তাদের। কোনটা এক ঘোড়ার, কোনটা দুই ঘোড়ার। এমনকী, চার ঘোড়া, আট ঘোড়ার গাড়িও ছিল তৎকালে শহরে।
শুরু হল ঘোড়ার গাড়ির বড়মানুষি। হাজার হাজার টাকা ব্যয় হত একখানা মনের মতো গাড়ি গড়তে। তারপর ঘোড়া আছে। যেমন গাড়ি, তেমন ঘোড়া না হলে চলে না। আবার তেমন মানানসই কোচোয়ান ইত্যাদি না হলেও গাড়ির মান থাকে না। ঘোড়ার সাজ চাই, চাই কোচোয়ানেরও। সে এক রাজসিক ব্যাপার।
এমন ঠিকাগাড়িও অবশ্য ছিল, কিন্তু গরিব লোকের সাধ্য ছিল না তাতে চড়া। সাহেবরাই সে সব গাড়ি রাখতেন, সাহেবরাই ভাড়া নিতেন। একটা দু’ ঘোড়ার গাড়ির দৈনিক ভাড়া ছিল ষোল টাকা, মাসে দুশো টাকা। মেমসাহেবদের সন্ধ্যায় মার্কেটিংয়ের জন্যে গাড়ি নিতে হলে তাদের দিতে হত প্রথম ঘণ্টায় আট টাকা, আর যদি এক ঘণ্টার বেশি লেগে যায় এবং দু’ ঘণ্টা পুরো হওয়ার আগেই ছেড়ে দেয়, তবে মাত্র বারো টাকা। দিব্যি লাভের কারবার। সাহেবরা জায়গায় জায়গায় আস্তাবল খুললেন। কসাইটোলায় এমনি অনেক আস্তাবল ছিল তখন। ছিল ধর্মতলায়ও। বিখ্যাত ঘোড়ার গাড়ির ব্যবসায়ী চার্লস মেরিথের নামে কসাইটোলা অর্থাৎ বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট অঞ্চলে রাস্তা আছে আজও একটা।
কিন্তু কোনও ব্যবসাই একতালে চলে না। একদিন রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ির জায়গায়ও এসে দাঁড়াল মোটর। তার আগে অবশ্য এসেছে ঘোড়ায় টানা ট্রাম। কিন্তু সে যান ব্যক্তিগত নয়, বারোয়ারি। মোটর ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক। সাহেব-মেমরা পরমানন্দে চেপে বসলেন তাতে। আরও তাড়াতাড়ি যাতায়াত হবে, হবে আরও আরাম। মেরিথরা ঘাবড়ালেন না ওড়িয়া বেহারাদের মতো। তাঁরা আস্তাবলকে গ্যারেজ করলেন। কিন্তু বিপদ হল সহিস কোচোয়ানদের। সহিস থেকে কোচোয়ান হওয়া যায়, কিন্তু কোচোয়ান থেকে ড্রাইভার হওয়া কঠিন। অগত্যা তারা তাই পরিত্যক্ত ঘোড়া আর গাড়িখানাকেই আগলে পড়ে রইল এখানে ওখানে। আধমরা ঘোড়া, ভাঙা গাড়ি, আর জীর্ণ সহিস প্রেতের মতো সেই থেকে টুকটুক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরে। আজও।
এক্কার ইতিহাসটা যেখানে শেষ, হুক্কাটারও ইতি সেখানেই। জীবন যত অলস, গতি তত শ্লথ, আর হুঁকোর নলটিও ততই লম্বা। পালকি থেকে মোটর অবধি হুক্কার ইতিহাসটি সংক্ষেপে এই-ই। লোকে যখন পালকি চড়ত তখন রুপোর গড়গড়ায় সোনা বাঁধানো নলে হুকো খেত। তারপর যখন পালকি গিয়ে এল ঘোড়ার গাড়ি, তখন নল ছোট হয়ে হয়ে এত কাছে এল যে, নিজেই হাত বাড়িয়ে লাগানো যায়, খোলা যায়। তারপর আজ মোটরের যুগে নল উঠে এসেছে সোজাসুজি মুখে। পাইপ, চুরুট, সিগারেটের যুগ এটা। আজও লোকে ধূমপান করে। অনুসন্ধানীদের মতে, আগের চেয়ে বেশিই করে। কিন্তু সিনেমার ইন্টারভ্যালে ট্রাম-স্টপেজে কিংবা রেস্তোরাঁর টেবিলে বসে ধোঁয়া গেলার সঙ্গে সেদিনের ধূমপানের তুলনা হয় না। ইদানীং অবশ্য অনেক স্থানেই ধূমপান নিষিদ্ধ। কিন্তু অনুমোদিত এলাকাও বিস্তীর্ণ। তবু মানতেই হবে সেকালে ধূমপান বাস্তবিকই ছিল ধূমধাম করে ধোঁয়াপান। একটি মাত্র বিবরণ দিচ্ছি এখানে। ১৮৩৯ সালে এ দেশের প্রধান সেনাপতি-পত্নী লেডি ন্যুজেন্টের লেখা। হুক্কার অন্তিম যুগের বিবরণ। তবুও কলকাতার হুঁকা-যুগের কিঞ্চিৎ পরিচয় পাবেন পাঠক এর থেকে। লেডি অ্যাজেন্ট লিখছেন:
‘হুঁকো জিনিসটি কিন্তু বাস্তবিকই অপূর্ব। এখন গভর্নমেন্ট হাউসে হুঁকো খেতে অনুমতি দেওয়া হয় না। কিন্তু আমাদের পূর্ববর্তী প্রধান সেনাপতি এবং তাঁর স্ত্রীর মতো আমি এবং স্যার জর্জ (তাঁর স্বামী) এ বিষয়ে আপত্তির কিছু দেখিনে। আমাদের কাছে এর গন্ধ তেমন কিছু আপত্তিকর কিংবা অসমর্থনীয় বলে মনে হয় না। তা ছাড়া, হুঁকো নিষিদ্ধ করার অর্থ আমাদের সমাজের অর্ধেক লোককে তাদের অতিপ্রিয় আমোদ থেকে বঞ্চিত করা। আমরা তাই হুঁকোর ব্যাপারে আপত্তি তুলিনি। আর বাস্তবিক পক্ষেই সামাজিক বৈঠকে এ একটা দেখবার জিনিস বটে।’ তারপর সেই ‘মহীয়সী’ মহিলা বিবরণ দিয়েছেন এমনি একটা হুঁকো-বৈঠকের। কল্পনা করে দেখুন: ‘বিরাট বৈঠকের আধাআধি লোকই হুঁকো খাচ্ছেন। গুড়গুড় করে ধোঁয়া ছাড়ছেন। অদ্ভুত শব্দ উঠছে সারা ঘরে। এক-এক হুঁকোর এক-এক রকম শব্দ। আমার মনে হয়, নলের দৈর্ঘ্য এবং হুঁকোতে গোলাপজলের তারতম্যের ওপরই এই শব্দ-ভেদের কারণ নির্ভর করে। আমার দু’ পাশে বসে দু’জন দু’রকম শব্দ করে ধূমপান করছেন।’
মেয়েরাও খেতেন। লেডি ন্যুজেন্ট নাকি একদিন দু’ টান দিয়ে কেশেই অস্থির। কিন্তু লেডি পামার ছিলেন ওস্তাদ হুঁকোখোর। তিনি নাকি তাঁর জাঁকজমকি হুঁকোবরদার নিয়ে হাজির হতেন বৈঠকে বৈঠকে। তবে মেয়েরা নিজের হুঁকোসহ হাজির হলেও তাঁদের নিজ হুঁকো টানা বড় হয়ে উঠত না। তাঁরা আসতে না আসতেই পুরুষেরা এগিয়ে ধরতেন নিজ নিজ নল, ‘ইফ য়্যু প্লিজ।’
মহিলাটি হেসে হয়তো হাত বাড়াতেন কারও দিকে। সে ব্যক্তি তক্ষুনি একটা নতুন মুখ-নল লাগিয়ে দিতেন নলেতে। উচ্ছিষ্ট নলটা তো আর দেওয়া যায় না কোনও লেডিকে। এ সুযোগেই তিনি অবশ্য কৃতার্থ। অন্যরা তাঁর ভাগ্যে রীতিমত ঈর্ষান্বিত।
এত সময়ও নেই এত পয়সাও নেই। জীবন ক্রমেই কঠিন হয়ে এল শহর কলকাতার। সঙ্গে সঙ্গে ছোট হয়ে এল হুঁকোর নলও। প্রথমে বন্ধ হল সামাজিক বৈঠকে, থিয়েটারে, তারপর ক্রমে ঘরে। অবশেষে ইংরেজ সমাজ থেকে একেবারে লুপ্ত হয়ে গেল হুঁকো। হুঁকোর গুড়গুড় আজ তাই এক্কার ঠকাঠকের মতোই দুর্লভ। তবুও শহর কলকাতা আজও ধরে রেখেছে সেই যুগের স্মৃতি। এক্কা দেখতে চান তো চলে যান হাওড়া কিংবা শিয়ালদহ স্টেশনে, দেখবেন প্রেতের মতো দীর্ঘ মিছিল করে দাঁড়িয়ে আছে অষ্টাদশ শতকের স্মৃতি। লেজ নেড়ে ঘোড়ার কংকালেরা মাছি তাড়াচ্ছে পিঠের ঘায়ের। আর হুক্কা চান তো, চলে আসুন লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরখানায়। পশ্চিমের ৪ নম্বর প্লটের দ্বিতীয় সারিতে দেখবেন কবর রয়েছে একটা। উপরে নাম লেখা এইচ. ভি. বেইলি. বি. সি. এস.। এই ভদ্রলোক কলকাতার শেষ হুঁকোবীর। পরিচয়লিপিতে দেখেছি, ইনিই নাকি শেষ হুঁকো খেয়েছিলেন বেঙ্গল ক্লাবে। বাড়িতে হয়তো আজও কেউ কেউ খান, কিন্তু প্রকাশ্য ক্লাবে বেইলিই শেষ বীর, অষ্টাদশ শতকের সামাজিকতার প্রথম শহিদ।
পালকি থেকে ট্রাম
‘জানিস, ফার্স্ট ক্লাসে তুই যেই উঠলি, অমনি কোম্পানির সব খরচা উঠে গেল, কন্ডাক্টরদের মাইনে-টাইনে সব। তারপর একজন লোক উঠলেও কোম্পানির লাভ।’
‘আর সেকেন্ড ক্লাস?’
‘সেকেন্ড ক্লাস কিচ্ছু না। সেকেন্ড ক্লাস বোগাস। ওটা ফাঁকা গেলেও কোম্পানির লাভ।’
ট্রাম ডিপোর সামনে দাঁড়িয়ে বারো বছরের এক স্কুল বয় তার ন’ বছরের সঙ্গীকে ‘ট্রাম-কোম্পানি’ বোঝাচ্ছে। সে প্রায় তিন দশক আগেকার কথা।
কিন্তু সেদিনই বুঝেছিলাম ট্রাম একদিন বন্ধ হবে। ট্রাম-কোম্পানির লাভ-লোকসান সম্পর্কে বারো বছরের ছেলের যা ধারণা, তাতে কন্ডাক্টররা না চাইলেও এ শহরে ট্রাম চলবে না। চললেও, মাঝে মাঝে থেমে চলবে না। এবং যেখানে ‘আবশ্যক হইলে থামিবেক’ টাঙানো, মাঝে মাঝে সেখানে আবশ্যক না হলেও থামবে।
এবার ঠিক জায়গামত থামল কি না, তা নিয়ে প্যাসেঞ্জার কন্ডাক্টর তর্ক করুন, আপাতত এটা ঠিক যে, শহরে ট্রাম নেই। থেকেও নেই। কলকাতার ট্রাম আজ বিবর্ণ, ম্রিয়মাণ। তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বেশ কিছু লাইন বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন যেটুকু যুক্ত হয়েছে তার অবস্থাও খুব সুখকর নয়। এই শহরে ট্রাম, অনেকের মতে মৃতপ্রায়, তার মৃত্যুই কাম্য। কেউ কেউ তাকে ফের বাঁচিয়ে তোলার কথা বলেন বটে, কিন্তু উৎসাহী চিকিৎসক কোথায়? আর, গন্ধমাদনই বা জোগাবেন কে বা কারা?
অথচ কয়েক দশক আগে কলকাতায় দিনে ট্রামে চড়তেন কমপক্ষে দশ লক্ষ মানুষ!
অর্থাৎ যদি ধরে নিই, কলকাতা শহরে দিনের বেলায় স্থানীয় এবং বাইরে থেকে আসা পঞ্চাশ লক্ষ লোক জমায়েত হন এবং তারা সবাই ঘুরে বেড়ান রাস্তায়, তবে তাদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ তখন ট্রামের উমেদার। আর এখন?
ট্রাম যথেষ্ট না চললেও তাই শহর চলে। কলকাতা শহর একা-ট্রামের পায়ে চলে না। বাস আছে, ট্যাকসি আছে, পাতাল রেল, চক্ররেল আছে, ঘোড়ার গাড়ি আছে, রিকশা আছে, তার উপর আছে আমাদের এই সনাতন পদযুগল। সুতরাং ট্রামের সাধ্য কি তর্জনী তুলে কলকাতাকে বলতে পারে— তিষ্ঠ।
তবুও অন্য সব যানকে মনে মনে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে হতভাগ্য ট্রামের জন্যে মনটা কেমন করে। চোখ তার বাঁধা পড়ে আছে এসপ্লানেডের গুমটিতে। তারে-বোনা সতর্ক মাকড়সার জালখানা একটা প্রকাণ্ড ষড়যন্ত্রের মতো অষ্টপ্রহর ওত পেতে আছে সেখানে। গুবরে পোকার মতো ট্রামগুলো গুটিগুটি নিজে থেকে এসে কখন ধরা দেবে, তারই অপেক্ষায়। নিঃঝুম রাত্রির অস্পষ্ট আলোতে চিকচিক করে ইস্পাতের লাইনগুলো। চোখের কোণে জলের মতো চিকচিকে লাইন।
বাসের মতো ডাঙার পাখি নয় ট্রাম। পথে পথে এর উড়ে চলার ইতিহাসটা লিখিত ইতিহাস। ইস্পাতে লেখা। টায়ারের পাটি-বোনা ছাপ পায়ে পায়ে মুছে যায়, করপোরেশনের জলের তোড়ে ধুয়ে যায় আমাদের মতো নাগরিকের ক্লান্ত পায়ের স্বাক্ষরও। কিন্তু ট্রাম থাকে। চোখের সামনে না থাকলেও মনে থাকে। এ শহরের মনের মাটিতে এর চাকার দাগ পাকা দাগ। অনেকদিনের পুরনো, অনেকখানি গভীর।
ঘোড়ার গাড়ির পরেই ট্রাম কলকাতার বনেদি বাহন। এরা দুজনে এক বংশেরই সন্তান। অবশ্য পৃথগন্ন এবং দ্বিতীয়জন অধিকতর সম্পন্ন। ঘোড়ার গাড়ি আর ট্রামে পার্থক্য এই, ট্রামের ঘোড়াগুলো কনডেন্সড ঘোড়া। অশরীরী হয়ে তারা লোহার তার হয়ে গিয়েছে। হর্স-পাওয়ারে তাদের হিসেব— আর ছ্যাকরাগাড়ির ঘোড়াগুলো ন্যাচারালই থেকে গিয়েছে, তাদের হিসেব আজও দানাপানিতে।
ট্রামও এককালে সাক্ষাৎ ঘোড়ায় টানত। সে খুব বেশি দিনের কথাও নয়। অবশ্য আমাদের আজকের ট্রাম কোম্পানি তখন জন্মায়নি। এদের জন্ম বিলেতে ১৮৮০ সালে। কলকাতায় আসতে লেগেছে এক বছর। আর আমি বলছি ১৮৭৩ সালের কথা।
সে ট্রাম চালিয়েছিলেন বিলাতি কোম্পানি নয়, বিলাতি সরকার। যেমন এখন চালাচ্ছেন বা চালাবার ভান করছেন আমাদের দেশি সরকার। সুতরাং তাদের ইতিহাসটা শুনে রাখা ভাল।
শিয়ালদহে তখন শিয়ালদের হটিয়ে রেলের আড্ডা বসেছে। আর ব্যবসার আড্ডা তখন গঙ্গার তীরে চিৎপুর, শোভাবাজার, আহেরিটোলায়। কলকাতা তখন পুরোপুরি ব্যবসায়ীর শহর। অফিস-বাবু নয়, ইস্টিশনে আর গুদামে মালপত্তর টানাটানি করাই তখন নগরকর্তাদের সমস্যা। ভারত সরকার তাঁদের পরামর্শ দিলেন: ট্রাম বসাও, হাঙ্গামা চুকে যাবে। বঙ্গ সরকার বসে বসে তার প্ল্যান কষলেন। প্ল্যান মঞ্জুর হল এবং দেড় লক্ষ টাকা খরচ করে বসানো হল ট্রাম লাইন। একখানা মাত্র মিটারগেজ লাইন। শিয়ালদহ থেকে শুরু করে বউবাজার-ডালহৌসি স্কোয়ার হয়ে, কাস্টমস হাউসের ভিতর দিয়ে স্ক্র্যান্ড রোড ধরে আরমেনিয়ান ঘাট অবধি তার সীমা। দু’ মাইল মাত্র পথ। এদিকে রেল কোম্পানিও বড় ব্যবসাদার। কথা ছিল, তারা শহরে ঢুকবে না। কিন্তু শহরে না এলে মালগাড়ি খালি যায় দেখে, পা বাড়িয়ে চলে এল চিৎপুরে। ফলে মালটানা-ট্রাম মালের বদলে মানুষ নিয়েই চলল আরমেনিয়ান ঘাট থেকে শিয়ালদহের দিকে।
বেশিদিন চলতে হল না। ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ নভেম্বর। মাত্র এ কয় মাসের পরমায়ু নিয়েই জন্মেছিল কলকাতার প্রথম ট্রাম। টুক-টুক করে এ ক’মাস কোনওমতে চলে তারপর গেল বন্ধ হয়ে।
ট্রাম কর্তৃপক্ষ বললেন: এর জন্যে দায়ী রেল কোম্পানি। তারা মাল টানতে চিৎপুরে এল বলেই না মাসে মাসে আমাদের লোকসান দিতে হল পাঁচ শ’ টাকা করে। সুতরাং ভারত সরকারের উচিত ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেওয়া।
ভারত সরকার ক্ষতিপূরণ দিলেন না। ফলে স্থির হল, ট্রামের লাইন এবং গাড়ি সব বিক্রি করে দেওয়া হবে। ম্যাকলিস্টার নামে এক সাহেব কেনা দামে কিনতে রাজিও হলেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিনলেন বিলেতের মেসার্স প্যারিস অ্যান্ড সাউদার। তাঁরাই জাতীয়করণের আগে পর্যন্ত এ শহরের একমেবাদ্বিতীয়ম ট্রাম কোম্পানি। এঁদের হাতে কলকাতার রাস্তায় প্রথম গাড়ি চলে ১৮৭৯ সালের ২ অক্টোবর। এঁদেরও হাতেখড়ি ঘোড়ায় টানা গাড়িতে। একটি মাত্র সেকশনে ছিল স্টিম ইঞ্জিন। দেখতে দেখতে আরও সেকশন খুলে গেল, আরও ইঞ্জিন এল। সরকার তাজ্জব বনে গেলেন এঁদের কাজ দেখে। ১৯০০ সালে উনিশ মাইল পথ হয়ে গিয়েছে ওঁদের। গাড়িও স্টিমে ঘোড়ায় মিলিয়ে কম নয়, ১৮৬টি। বছরে ১৩০ লক্ষ লোক চাপে এখন ট্রাম। অথচ মাত্র ক’ বছর আগে লোকের অভাবে বন্ধ হয়ে গেল তাঁদের লাইনটি। একেই বলে ভাগ্য!
কোম্পানির ভাগ্যে কলকাতায় বিজলি এল। ১৯০২ থেকে চলল বিজলি গাড়ি। ক’ বছরের মধ্যে ঘোড়া বিদায় নিল, স্টিম লাগল কাপড় কাচার কাজে। কলকাতার ট্রাম এখন বিজলির ট্রাম। আধুনিকতম যান। সাড়ে তিন হাজার লোক কাজ করে এর কারখানায়, ড্রাইভার কন্ডাক্টর মিলিয়ে তার ফৌজের সংখ্যা ছ’ হাজার।
ছ’ হাজার মানুষ আজ ট্রাম চালায়। না চালালে ট্রাম বন্ধ হয়, কিন্তু শহর থামে না।
ছ’ হাজার কেন, এগারো হাজার কয়েক শ’ ঠিকা বেহারারও সাধ্যে কুলোয়নি যে, এ শহর থামিয়ে দেয়। কলকাতা থেমে দাঁড়ায়, কিন্তু একেবারে থামে না—এ সত্যটা প্রমাণ হয়েছিল সেদিন। সে কাহিনীটি শোনার মতো। তার কথা আগে বলা হয়েছে। তবু আর এক দফা বিস্তারিত শুনতে দোষ নেই।
ট্রাম তো পরের কথা, ঘোড়ার গাড়ি বা রিকশা কিছুই নেই তখন কলকাতায়। শহর কলকাতা তখন চলে ঠিকা বেহারার ঘাড়ে চড়ে। পালকি তার একমাত্র বাহন। প্রাইভেট পালকি এবং ঠিকা পালকি।
ইউনিয়ন, ধর্মঘট, এসব কথার তখন জন্মও হয়নি। ১৮২৭ সালের কথা। হঠাৎ একদিন দেখা গেল, ওড়িয়া বেহারারা সব ঘাড় থেকে পালকি নামিয়ে রেখেছে। এগারো হাজার কয়েক শ’ ঠিকা বেহারা। জাত খুইয়ে পালকি বইবে না তারা।
কী ব্যাপার?
কেউ কেউ বললেন, ‘অনুমান হয় ইহার মধ্যে কিছু দুষ্টতা থাকিবেক কিংবা কেহ তাহাদিগকে কুমন্ত্রণা দিয়া থাকিবেক (সমাচার দর্পণ)। এটা বোধ হয় কর্তৃপক্ষের মত। অনুমানের কিছু নেই। এ ধর্মঘটের কারণ তাঁরাই।
‘পোলিশ আফিস’ থেকে ফতোয়া বের হয়েছে: সব ঠিকা বেহারাকে লাইসেন্স করাতে হবে। আর পালকি বইবার সময়ে সেই লাইসেন্সটি ঝুলিয়ে রাখতে হবে হাতে। আজকের শিয়ালদার কুলিদের মতো সে তাবিজটি আবার সবাইকে কিনতে হবে নিজের নিজের পয়সায়।
‘পোলিশ অফিস’ ভাড়াও বেঁধে দিল। তাদের বিধানমতো এখন থেকে পালকি ভাড়া:
‘সমস্ত দিন ফি—। চারি আনা।
ইঙ্গরেজি ১৪ ঘড়িতে একদিন গণা যাইবেক
অর্ধদিন—অর্থাৎ ইঙ্গরেজি এক ঘড়ির অধিক পাঁচ ঘড়ির কম—দুই আনা।’
বেহারাদের ভাড়াও তাই। দিনে চার আনা। চোদ্দ ঘড়ির দিন। অবশ্য ‘ইতোমধ্যে বিশ্রাম ও জলপানের সমুচিত ছুটি দিতে হইবেক।’ আধা দিন হলে মজুরি হবে দু’আনা। তবে, ‘ইঙ্গরেজি এক ঘড়ির কম হইলে ফি বেহারা এক আনা ও ফি পালকির ভাড়া এক আনা পাইবেক।’
বেহারারা দল বেঁধে হাজির হল ‘কলকাতার’ পোলিশ আফিসে। যাওয়ার আগে তাদের একটা মিটিংও হল ময়দানে (Calcutta plains)। পোলিশ আফিসের কর্তারা তাদের বক্তব্য শুনলেন। তাঁদের তরফ থেকে কিঞ্চিৎ ছাড়লেনও। কথা দিলেন, লাইসেন্সের তাবিজটির জন্যে পয়সা দিতে হবে না বেহারাদের। বেহারারা চুপ করে শুনল। ‘তাহাদের প্রত্যাগমন কালে এমন বোধ হইল যে, তাহাদের সকল ওজর মিটিয়া গিয়াছে এবং তাহারা সকলেই স্ব-স্ব কর্মে নিযুক্ত থাকিবেক।’ কিন্তু ‘ইংলিশম্যানের’ রিপোর্টে দেখা যায়, লালবাজার থেকে বের হয়েই তারা জমা হল সুপ্রিম কোর্টের সামনের জমিটায়। এবং সেখানে বেশ হই-হট্টগোল হল কিছুক্ষণ। (‘They resorted to the meadow before Supreme Court and raised loud clamours’) বোধ হয়, সরকারি প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখা হল।
লিখিত কোনও প্রস্তাব নেওয়া হল না বটে, কিন্তু পরদিনও দেখা গেল বেহারা অনুপস্থিত। কোনও পালকি নেই কলকাতার পথে। কেন থাকবে? রুটির জন্যে জাত খোয়াতে পারে না তারা। হাতে চাকতি বাঁধা মানে জাত দেওয়া।
কারও কারও কাছে রুটিটা যে জাতের চেয়ে বেশি দামি ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ সর্দাররা ধর্মঘটের মধ্যেই সবাইকে শাসিয়ে দিয়েছে, যদি কেউ দল ভাঙাও তবে একঘরে হবে।
একঘরে হতে এখনও কেউ রাজি হয় না সহজে। তখনকার কাল তো আরও কঠিন।
শুরু হল তাই বেহারাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। আধুনিক ভাষায়: শহর কলকাতায় মেহনতি জনতার পয়লা লড়াই।
পাবলিক প্রমাদ গুনলেন। কাগজে কাগজে শুরু হল লেখালিখি।
কেউ লিখলেন, সত্যিই তো, ঘড়ি দেখে মজুরি নিতে গেলে বেচারাদের পোষাবে কেন? ‘কেবল সময়ানুসারে হার নিরূপিত হওয়াতে তাহাদের অনেক ক্ষতি অতএব সময়ানুসারে হার না করিয়া যদি দূরাদূর বুঝিয়া করা যাইত তবে ভাল হইত যেহেতুক কলিকাতা হইতে কালীঘাটে কোনও বাবুকে লইয়া যাইতে হইলে মরে পিটে এক ঘণ্টার মধ্যে যাওয়া যায় এবং সে এক ঘণ্টার মজুরি তাহারা প্রত্যেকে কেবল এক ২ আনা করিয়া পাইবেক কিন্তু সেই এক ঘণ্টায় তাহাদের তাবৎ দিবসের বল যাইবে।’
কেউ কেউ কনস্ট্রাকটিভ মত দিলেন। এক ইংরেজি কাগজের মতে সময়ানুসারে বেতন নিরূপণের আইন হওয়াতে বেহারাদের প্রাণ লইয়া টানাটানি হইয়াছে, যেহেতু বেহারাদের ঘড়ি নাই আরোহীদের ঘড়ি আছে এবং ইতর লোক অপেক্ষা মান্য লোকের কথা প্রায় সর্বত্রই মান্য। এমন অনেক মান্য লোক আছেন, তাঁহারা দেড় ঘণ্টা কিম্বা ততোধিককাল পর্যটন করাইয়া ঘড়ি দেখাইয়া এক ঘণ্টার বেতন দান করিবেন, বেচারা বেহারা কিন্তু তাহাতে বাধ্য কিছু কহিতে পারিবে না, কহিলে আইনানুসারে দণ্ডনীয় হইবে, সুতরাং বেচারির মৃত্যু।’
অতএব তাঁদের পরামর্শ ‘সরকারী ব্যয়ে প্রত্যেক বেহারাকে এক ২টা ঘড়ি দেওয়া যায় তাহা হইলে বেহারারা যখন পালকি ঘাড়ে করিবেক তখন টেক হইতে ঘড়ি বাহির করিয়া দেখিবেক ও যখন পালকি নামাইবেক তখন বস্ত্র দ্বারা মুখের ঘাম মুছিয়া পুনর্বার ঘড়ি দেখিবেক তাহাতে আরোহকের ঘড়ির সঙ্গে যদি ঠিক মিলে তবে কিছু অন্যায় হইতে পারিবেক না কিন্তু যদি না মিলে তবে উভয়ে কলিকাতার বড় গির্জায় গিয়া আপনাদের ঘড়ি ঠিক করিবে কিন্তু সেখানে যাইবার মজুরি বেহারাদের নিজ খরচ।’
খবরের কাগজের লেখালেখিতে কিছু হল না। এদিকে প্রাইভেট পালকির মালিকরাও পড়লেন বিপদে। দিব্যি চলছিলেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের বেহারাও বেঁকে বসল একদিন। ঠিকা ভাইদের সমর্থনে তাদেরও ধর্মঘট।
গলা দিয়ে ফুটে না বের হলেও ‘শ্রমিক ঐক্য জিন্দাবাদ’ ধ্বনি উঠল কলকাতায়। ঊনবিংশ শতকের কলকাতার রাস্তায়। মনে মনে আশার ঢেউ খেলে গেল ঠিকা বেহারাদের বুকে।
কিন্তু মা কলকেত্তাশ্বরীর মর্জিই ভিন্ন। তিনি যদি কলকাতাকে রাখেন, তবে কলকাতাকে থামায় কে?
তাঁরই ইচ্ছেয় সব হয়। ওড়িয়াদের মতিগতি দেখে হিন্দুস্থানি রাউনি বেহারারা সব পার হতে লাগল হাওড়ার সাঁকো। মা কলকেত্তাশ্বরী তাদের ডেকেছেন।
দেখতে দেখতে রাউনি বেহারায় শহর ছেয়ে গেল। ঠিক আজ যেমন বাসে বাসে কলকাতা ভরে উঠেছে, তেমনি।
কলকাতার মনে আরও ছিল। চৌরঙ্গির জনৈক মি. ব্রাউনলোকে স্বপ্নে তিনি দেখা দিলেন। কী বললেন, তিনিই জানেন। তিন দিন মনমরা হয়ে পড়ে ছিল সাহেব। আপিস যাওয়া হয়নি। সেদিন ঘুম থেকে উঠেই লাগলেন হাতুড়ি বাটালি নিয়ে। পালকিটার নীচে চারটে চাকা জুড়লেন। তারপর সামনের হাতলটায় একটা ঘোড়া জুড়ে দিয়ে চললেন আপিসে।
কলকাতার রাস্তায় বের হল ‘ব্রাউন বেরি’। নেটিভরা বলে পালকিগাড়ি। খবরের কাগজে ঘোষিত হল: ‘কলকাতা নগরে ঘোড়া সকল পালকি বাহক হইয়াছে এবং বোধ হয় যে দুই তিন হপ্তার মধ্যে ঘোড়াদেরও সভা হইয়া এক দরখাস্ত উপস্থিত হইবেক। ইহাও অসম্ভব নয় যেহেতুক হিতোপদেশ প্রভৃতি গ্রন্থের মধ্যে বাঁড় শৃগালাদি কথা কহিয়াছে।”
এদিকে বেহারারা দেখলে বেগতিক। তারা তৎক্ষণাৎ ছুটে এল যে যার কাজে। ঘাট হয়ে গিয়েছে। আর বিবাদ করবে না তারা। ‘A meeting was held, rates were fixed, palkees numbered and bearers ticketed returned to their labours.’
কিন্তু ততক্ষণে কলকাতা শহর ঘোড়ার পিঠে এগিয়ে গিয়েছে অনেক দূর। তারপর ঘোড়াদের সভা এবং দরখাস্তের আগেই এল একদিন ট্রাম। আজবগাড়ি। বাষ্পে টানে, বিদ্যুতে ঠেলে। অক্ষম ঘোড়ারা তাই নিরুপায় হয়ে চোখ বুজে বুজেই ছ্যাকরা গাড়ি টানে। ট্রাম-বাসের জন্যে মুখ ফুটে কিছুই বলা হয় না তাদের।
কলকাতার ট্রাম—এ শহরের পথের এই ইতিহাসটিকে বেমালুম ভুলে গেলে, তার বেহারাদের মতো ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা। বাসের রাউনি বেহারারা যদি এই বিলেতি ওড়িয়াদের চমকে না দিয়ে থাকে, তবে বলতে হবে, অষ্টাশি বছরেও কলকাতার মেজাজ জানতে পায়নি তারা।
যে হারে কলকাতাবাসী পদচর্চা শুরু করেছেন, কে জানে মা কলকেত্তাশ্বরীর মনে কী আছে। বিশেষত, ট্রাম ছাড়া শহর মেলাই আছে ভূমণ্ডলে এবং কলকাতা ভূমণ্ডলের বহির্ভূত নয়। স্বপ্নে একালের ব্রাউনলো সাহেবদের কী শেখাচ্ছেন তিনি, তিনিই জানেন।