এখন শেষবিকেল। বৈশাখের বিকেল। কালবৈশাখী আসতে পারে আজ। পশ্চিমের আকাশ সাজছে। যদি আসে, তবে কিছু আমগাছের মুকুল আর কিছু গুটি আম ঝরে যাবে। গেলে যাবে। এসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপারে আর কোনো ঔৎসুক্য নেই কিরণশশীর।
কিরণশশী, কুলোতে করে কিশমিশ বাছছিলেন। হাঁসগুলো প্যাঁ-অ্যাক, প্যাঁ-অ্যাক করে হরিসভার পুকুর থেকে দিনভর গুগুলি আর কুচোমাছ খেয়ে পেট ফুলিয়ে হেলতে-দুলতে উঠোন পেরিয়ে খোপের দিকে ফিরছিল।
ওরা এখুনি খোপে ঢুকবে না। কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে গা শুকিয়ে নেবে পড়ন্ত রোদে। ওদের গায়ে জল দাঁড়ায় না। যদিও তলপেট ও ভেতরের দিকে ভেজা থাকে। তা ছাড়া, সারাদিন জলে থাকায় হিম হয়ে যায় শরীর। কেউ কেউ এক পা তুলে অন্য পা-টা পেটের মধ্যে গুঁজে গোল গোল চোখ, আধো বুজে কত কী ভাবে। হাঁসেরা কী ভাবে? কেউ কি জানে?
শিলি এসে এখুনি বসল কিরণশশীর সামনে। রান্নাঘরের দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে।
শিলি বলল, করতাছটা কী বুড়ি?
–পোলাউ রাঁধুম, তাই কিশমিশ বাছতাছি।
লিচু গাছে পাখিরা শোর করছে।
এই দুই নারীই নিজের নিজের ভাবনাতে ডুবে রয়েছেন ও রয়েছে। অনুষঙ্গর কোনো প্রভাব-ই পড়ছে না কারও ওপরেই। দূরে, নগেন সেনের বাড়ির খোনা মেয়েটি, পুকুরের দিকে মুখ তুলে হাঁসদের ডাকছে চৈ…চৈ….চৈ…চৈ,…চৈ। তার নাকিসুরের ডাক এই সন্ধের মুখের বিষণ্ণতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। নানারকম আওয়াজ। হাঁসেদের বাড়ি ফেরার ডাক ডাকছে সে, কুলোতে করে ধান নিয়ে, ফলসা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে। ওঁদের পুকুর থেকে বাড়িতে আসার রাস্তা ওই ফলসাতলা দিয়েই। ডাকছে, চেঁ, চৈ, চেঁ, চৈ, চৈ।
এইসব শব্দসমষ্টির ঝুমঝুমির মধ্যে বুঁদ হয়ে যায় শিলি।
মসজিদের আহ্বান ভেসে আসছে। মকবুল চাচা মগরিবের নামাজে বসেছেন। ওদের বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে আসার সময়ে একটু আগেই দেখে এসেছে শিলি।
-খবদ্দার।
বলেই, হঠাৎ কে যেন চিৎকার করে উঠল। একেবারে উঠোনের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে।
দু-জনেই চমকে উঠলেন ওঁরা। আলিমুদ্দির; চমকে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এ হাঁক। রমজান মিয়ার ছোটোছাওয়াল কখন যে, এসেছে, তা ওঁরা দেখেন-ইনি।
আলিমুদ্দি ঝুড়ি নামাল উঠোনে। ঝুড়ি নামিয়ে, গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে বলল, বড়োই মেহনত গেছে আজ সারাটা দিন। বোঝলা দিদি।
ওর লাল-হওয়া মুখের দিকে চেয়ে শিলি বলল, হ। তাই ত দ্যাখতাছি। জল খাবা নাকি এটু? তা ম্যাহত তোমার কোনদিন যায় না তাই কও দেহি।
–তা দিদি যা কইছ। ওই তুমি যা, এই মাইনষের দুঃখ-কষ্ট বোঝলা। আর কেউই বোঝে না।
শিলি হাসল।
বলল, আমিই হইল্যাম গিয়া কুমারগঞ্জের বুঝি মা। কী কইস?
–পানি? পাইলে তো খুবই ভালো হয়। পানি আনলা কই?
আলিমুদ্দি বলল।
কিরণশশী বলল, দিবিটা কীসে? জল?
–ক্যান? আমি আইন্যা দিতাছি। রান্নাঘরে গ্লাস আছে তো নাকি?
–নমঃশুদ্র আর মোছলমানদের গ্লাস নাই।
–ছিঃ ছিঃ।
বলল, শিলি।
আলিমুদ্দির পরিশ্রমে লাল-হওয়া মুখ আরও লাল হয়ে যায়।
শিলি বলে, আমি এই আইতাছি। তুমি খাড়াও দেহি এক মিনিট আলিমুদ্দি।
বলেই, আঁচল উড়িয়ে দৌড়ে গেল নিজেদের বাড়ির দিকে। এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই পেতলের রেকাবিতে ওর নিজের হাতে তৈরি কাঁচাগোল্লা আর গ্লাস নিয়ে ফিরে এল। কাঁচাগোল্লার রেকাবিটা আলিমুদ্দির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ধরো।
-আমি পানি আইন্যা দিতেছি তোমারে।
বলেই, কথা ঘোরাবার জন্যে বলল, মাছ পাইল্যা কি আজ? তাই কও। বুড়ি হক্কলরে দাওয়াত দিছে তো।
কথাটা বলেই, লজ্জা পেয়ে গেল।
আলিমুদ্দি, যে নিজে হাতে সারাদুপূর পোলো দিয়ে দিয়ে বৈশাখের খর রোদে, পুকুরে আর বিলে মাছ ধরে আনল কিরণশশীর নিমন্ত্রিতদের খাওয়ানোর জন্যে, সেই নিজে কোনোদিনও একটু জল খেতে পারবে না এ বাড়িতে? ওর সামনে, কিরণশশীর দাওয়াতের কথা না বললেই পারত।
ভাবল, শিলি।
আলিমুদ্দি জলের গ্লাসটা নিতে দ্বিধা করছিল।
শিলি বলল। না খাও তো আমার মাথাডা খাও। ছাত্তার চাচায় আমাগো রসুই ঘরে বইস্যা আমাগোর জন্যে মোরগা রান্ধে। বি.এ., এম.এ পাশ করি নাই বটে, কিন্তু অশিক্ষাও পাই নাই মা-বাপের কাছে। খাও। খাও।
কাঁচাগোল্লা খেয়ে ও যখন জল খাচ্ছে তখন কিরণশশী শিলিকে বললেন, ওই গ্লাসে যেন পুতনরে আবার জল দিস না, হে তগো বাড়ি গ্যালে।
শিলি বিরক্তির গলায় বলল, সে আমি বুঝবনে। তোমার ছাওয়ালে আর আলিমুদ্দিতে ফারাকাটা কী? তোমার ছাওয়ালরেই বরং কইয়া দিয়ে, সে য্যান আমাগো বাড়ি আর না যায়। আমি এক-ই গ্যালাসে হক্কলেরে জল দিম। খাইলে খাইবে, নাইলে যাইতে মানা কইর্যা দিয়ে। তুমি মাছগুলান বুইঝ্যা লইয়া অরে ছাইড়্যা দ্যাও না ক্যান। সারাদিন খাওন-দাওন নাই। বাড়ি যাইব না, না খাড়াইয়া খাড়াইয়া তোমার বক্তৃতা শুনব অনে?
-খুব কথা শিখছস ত দেহি।–
-হ। শিখছি। কথা কি তোমার পোলায় একাই শিখছে?
কিরণশশী বললেন, ভারি পিরিত তো দেহি মোছলার পুতের লইগ্যা।
শিলির বড়ো লজ্জা হল।
তারপর বলবে না ভেবেও বলেই ফেলল, তোমাগো কপালে আরও অনেক-ই দুঃখ আছে বুড়ি। যারা মাইনষেরে মাইনষের সম্মান এহনেও দিতে শ্যাখে নাই, তারা নিজেরাই মানুষ হয় নাই। আমার বাবায় তো হেই কথাই কয়।
–তর বাবা তো মহাপন্ডিত। তার কথা থো এহন। দয়া কইর্যা মাছগুলান বুইঝ্যা লইয়া, আমার আয়নার সামনের সিন্দুরের কৌটার ভিতর একখান দশটাকার নোট আছে, অরে আইন্যা দে।
–পাইছস কী কী রে মাছ?
কিরণশশী শুধোলেন, আলিমুদ্দিকে, একেবারে নৈর্ব্যক্তিক গলায়। যেন, চৌকাঠের সঙ্গে কথা বলছেন।
–আপনে ত কুচামাছ-ই কইছিলেন। তা পাই নাই। বাইন মাছ, অ্যাই দেখেন দুইডা, পেরায় সাপের মতো বড়ো হইবনে। আর এই বাইশখান কই পাইছি। খুব-ই বড়ো। মাগুর। একখানের ওজন-ই হইব গিয়া পেরায় তিনপোয়া।
-আর?
–পোলো দিয়া আর কী পামু? আমি ত আর নদীতে জাল ফেইল্যা মাছ ধরি না।
–তাইলে, আমার চিতল পামু কোত্থিকা?
–মুনীন্দ্ররে কইয়েন।
–কাল পারবা তো আনতে?
–পারব না ক্যান? রোজ-ই তো ধরে দেহি, চার-পাঁচটা কইর্যা। তবে, বেশিবড় হইব না। বড়ো চায়েন তো ধুবড়ি থিক্যা আনন লাগব। গরম পইড়া গেল গিয়া। খারাপ না হইয়া যায়।
শিলি, কিরণশশীর ঘর থেকে টাকাটা এনে আলিমুদ্দিকে দিল।
কিরণশশী বললেন, দুইডা টাকা ফেরত দিয়া যাবি। এই কয়ডা মাছের দাম দশটাকা। তুই ডাকাইত হইয়া গেলি দেহি।
স্বল্পক্ষণ মুখ নীচু করে চুপ করে থেকে আলিমুদ্দি বলল, ঠিক আছে।
-কাল দিয়া যামু আনে। এহনে তো নাই।
–কাল দিলেই হইব।
আলিমুদ্দি ঝুড়ি তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছিল।
শিলি বলল, চলো আমিও যাব।
-এই ত আইলি।
কিরণশশী বললেন।
-নাঃ, কাল আসুমানে।
–সক্কাল কইর্যা আসস। আমি একা সব সামলাইতে পারুম না।
–ক্যান, হোন্দলের মায়ে ত আছেই।
–তা হইলেও পারুম না।
–তাইলে নিমন্ত্রণ করনের দরকার কী?
রুক্ষ গলায় বলল, শিলি।
কিরণশশী অবাক হয়ে তাকালেন শিলির দিকে। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না।
শিলি বুঝল, কিরণশশীর মন খারাপ। তাই মেজাজও খারাপ। শিলির নিজের মেজাজও কিছু ভালো নয়। সবসময়ে অন্যায় বরদাস্ত হয় না। আলিমুদ্দির সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে শিলি বলল, ওই বুড়ির কথায় কিছু মনে করিস নাই তো তুই?
–আরে নাঃ। মনে করনের কী আছে?
–কিছু মনে করিস না। আজ বাদে কাল মইরা যাইব গিয়া। মানষেরে যারা এমন কইর্যা অপমান করে, তাদের পাপ লাগে। লাগেই।
–ছাড়ান দাও দিদি। বুড়াবুড়িরা আর ক-দিন। নরেশকাকা, পরেশকাকায় তো এক্কেরে অন্যরকম মানুষ। সবাই কি সমান অইব? মোছলমানেরাও কি সবাই সমান? তুমি কও?
কথা ঘুরিয়ে, শিলি বলল, আমার বাজে বকনের সময় নাই।
তারপর-ই বলল, শোন। কাল দুপুরে আমাগো বাড়ি তর নিমন্ত্রণ। খাবি আইস্যা। আমাগো সাথে বইস্যা। আমি, তুই, বাবায় আর কাকায়। ছাত্তার কাকারে যদি পাওন যায় তো তারেও কয়্যা দিমু।
-পাগল হইল্যা নাকি? দুপুরে ক্যামনে পারুম? সারাদিন মাছ না ধইরবার পারলে আম্মায় রান্ধে কী? আব্বার শরীরও তো ভালো নাই। বাতে এক্কেরেই মাইরা থুইছে। ঘর থিক্যা বাইরাইতেই পারে না। সারাদিন যা পাই, তাই বেইচ্যা-বুইচ্যা চলে কোনোমতে। বুনটারে বিয়া দিতে গিয়া দুই হাজার টাকা কর্জ হইয়া গ্যাছে গিয়া। তাও তো দামাদ তারে দুইবেলা ঠেঙ্গাইতেছে। আবার নিকাহ করনের ইচ্ছা আর কী! তাও গদাইদায় সুদ লয় না। ওই কর্জর লইগ্যা কখনো তাগাদাও করে না। বলে, নাই-ই যদি পারস, তো দিবি না। আমার তো বুন নাই। না হয় তর বোনের বিয়াটা আমিই দিয়া দিছি। হইছেটা কী তায়?
একটু থেমে, আলিমুদ্দি বলল। সত্যই। গদাইদার মতো বড়োলোক দ্যাশে আর নাই। মনখান তো না, যেন ব্ৰহ্মপুত্ৰই।
শিলি, আলিমুদ্দির পাশে হাঁটছিল। শেষবিকেলের আলো পড়ে ওকে আরও সুন্দরী দেখাচ্ছিল। আলিমুদ্দি ভাবছিল, এমন একটি বউ পেলে ব্ৰহ্মপুত্ৰয় নৌকো ভাসিয়ে তাকে নিয়ে মাছ ধরে একেবারে বড়োলোক হয়ে যেত। কিন্তু তা তো হবার নয়। এ জন্মে হবার নয়। শিলিকে দেখলেই ওর শরীরের রক্ত দৌড়াদৌড়ি করে। শিরা-উপশিরা সব শক্ত হয়ে যায়।
মোড়ে এসে ধরা গলায় বলল, চলি দিদি।
–তাইলে আইবি না কাল?
–ক্যামনে আসুম দিদি? রাতে একদিন কইও, অবশ্যই যামু। তুমি আদর কইর্যা খাওয়াইবা আর যামু না, তা কি হয়?
–কালরাতে তো এ বাড়ির নিমন্ত্রণ। আহা, দিন ঠিক কইর্যা কমু তরে আলিমুদ্দি। অবশ্যই আসিস য্যান।
আলিমুদ্দি বাঁশবনের আড়ালে হারিয়ে গেলে, হঠাৎ-ই শিলির মনে হল, আলিমুদ্দি কোথায় যে, থাকে, তাও ও জানে না। যদিও একই গ্রামে বাড়ি ওদের, তবুও ওদের বাড়ি কখনো চোখেও দেখেনি। তবে শুনেছে যে, বাড়ি ওই নামেই। আসলে ঝুপড়ি একটি। শীতকালে চরেই ঘর বানিয়ে থাকে আলিমুদ্দি। তরমুজ ফলায়, ধানও। এই করেই কোনোরকমে চলে। ওর চওড়া বুক। পাথরের মতন হাত-পা, সরু কোমর, বাঁশির মতো নাক আর মাথাভরতি চুলে, ভারি ভালো দেখে ওকে শিলি। ওকে দেখলেই বুকের মধ্যে রক্ত ঝুনুক-ঝুনুক করে।
কিন্তু রক্তরসঙ্গে নাচতে পারা তো যায় না। রক্ত যা বলে, তা শোনাও যায় না।
মানুষের জীবন বড়ড়াই কষ্টের।
ভাবে, শিলি।
বাড়ি ফিরেই, গা ধুতে ঢোকে স্নান-ঘরে। সিঁদুরে আমগাছে বোল এসেছে। খুব তাড়াতাড়িই এসেছে এবারে। আজ কালবৈশাখী আর এল না। মেঘ উড়ে গেছে দূরে। হাওয়া জোরে বইলেই আমের বোলের গন্ধ ভাসে আলতো হয়ে। শেষবিকেলের রোদের সোনার আঙুল ছুঁয়েছে গাছ-গাছালিকে এখন। একটি বসন্তবৌরি পাখি ডানা ঝট-পটিয়ে উড়ে যায় আমগাছের গভীর থেকে।
স্নান করতে করতে শিলি ভাবে যে, রাজেন ছেলেটি বেশ। কত কী জানে!
বাবা-কাকার সঙ্গে কত কী বিষয়ে আলোচনা করল সেদিন। কত জ্ঞান।
আর খুব ভদ্রও কিন্তু। দোষের মধ্যে করলুম, খেলুম, নুন, নঙ্কা, নেবু, নুচি এইরকম অসভ্য ভাষায় কথা বলে এই-ই যা।
আর গান? সেদিন তার গানে সে, শিলিকে একেবারেই মেরে রেখে গেছে। এরকম গান শিলি আগে কখনো শোনেনি। এমন ধরনের গানও নয়। গান যদি তেমন করে গাওয়া যায়, তবে সেই গায়ক বা গায়িকা তাৎক্ষণিক সম্রাট অথবা সম্রাজ্ঞীই হয়ে ওঠে। তাকে অদেয় তখন কারোরই কিছু থাকে না।
একটি গান গেয়েছিল গত রাতে রাজেন। কালও এসেছিল রাতে। পুতন আসেনি। একাই এসেছিল। বাবা ও কাকা বাড়িতেই ছিলেন। কাল গেয়েছিল এই গানটি :
ওগো কেমনে বলো না,ভালো না বেসে থাকি গো।পাগল করেছে মোরেওই দুটি আঁখি গো৷কী জানি কী গুণ করেরেখেছে মন মজাইয়ে,সাধ হয় সদা যেন,বুকে করে রাখি গো। ওগো কেমনে বলো না?
গানটি যে, শিলিকে উদ্দেশ করেই গাওয়া তা শিলির বুঝতে বাকি ছিল না। শিলির মনও সেদিন রাত থেকেই রাজেনকে বুকে করে রাখতেই চায়। কিন্তু এদেশের মেয়েদের তো বুকে করে রাখার অধিকার নেই; ক্ষমতাও নেই। বুকে থাকার জন্যেই তারা। রাজেনের বুকে থাকার অনেক-ই অসুবিধে। বৃদ্ধ বাবা, কাকা। কলকাতায় কার যেতে না ইচ্ছে করে? কোনোদিন তো যায়নি।
পুতনদা, কাকাকে বলেছে, রাজেনরা নাকি বনেদি বড়োলোক। কলকাতায় যারা বড়োলোক, তারা গদাইদের মতো গেঁয়ো বড়োলোকদের দু-হাজারবার কিনে যেকোনো হাটে আবারও বেচে দিতে পারে নাকি। রাজেনদের অনেকগুলো গাড়ির মধ্যে একটি গাড়ি আছে রোলস। সেই গাড়িটির-ই যা দাম, তাতে গদাই আর গদাইর বাপের সব সম্পত্তি নিলামে চড়ানো যায়। রাজেনও বাবার এক ছেলে। তবে, ছেলের স্বভাব-চরিত্রটি সুবিধের নয়।
শিলি, গায়ে সাবান দিতে দিতে ভাবছিল, ওর মা বলতেন, ছেলেদের চরিত্র কখনো নোংরা হয় না। অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেই পুরুষমানুষকে ছোটো বলা যায় না। যদি সে ছোটোমনের মানুষ হয়, তবেই শুধু ছোটো বলা যায় তাকে।
ছোটোমনের পুরুষমানুষের মতো ঘৃণিত জীব আর নেই।
চান সেরে গা মুছছিল যখন, তখন কাদের গলায় আওয়াজ পেল যেন বাইরে।
রাজেন আর পুতন? বুকটা ধক করে উঠল শিলির।
তারপর-ই বুঝল যে, শুধু রাজেন।
তাড়াতাড়ি করে জামাকাপড় পরে ফেলল ও। রাজেনের সামনে অসুন্দর হয়ে যেতে চায় না। নিজেই ভেবে অবাক হয়ে যাচ্ছিল যে, যে-মানুষটিকে দু-চোখে দেখতে পারত না ক-দিন আগেই, সেই মানুষটিই এখন তার মনের মানুষ হয়ে উঠেছে। তার পাশে, পুতনদাকেও মনে ধরে না আর। এ কি শুধু গানের-ই জন্যে? নাকি মানুষটি যে, খারাপ, দুশ্চরিত্র এসব শুনেছে বলেই, তার প্রতি এক বিশেষ আকর্ষণ বোধ করেছে ও। যে-মানুষেরা নিজেদের সবসময়ই ভালো বলে প্রমাণ করতে চায়, আসলে তাদের মধ্যে বেশিরাই বোধ হয় খারাপ। শিলির অভিজ্ঞতা তাই-ই বলে। ভালোমানুষ, বড়ো সহজে খারাপ হয়ে যেতে পারে, যেমন পুতনদা হয়েছে। কিন্তু যাকে খারাপ বলেই জানা আছে, তার আরও খারাপ হওয়ার ভয় থাকে না কোনোই। বরং ভালো হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। খারাপ যদি ভালো হয়, তখন সে বোধ হয় ভালোই থাকে বাকিজীবন। খারাপের ওপর ভরসা করা চলে, ভালোর ওপরে কখনোই নয়, কারণ, কোন মুহূর্তে, সে যে খারাপ হবে, তা নিজেও আগের মুহূর্তে জানে না।
শিলির মা, একজনকে ভালোবাসতেন। আলিপুরদুয়ারে বাড়ি ছিল তাঁর। একবারমাত্র তিনি মাকে দেখতে এসেছিলেন কুমারগঞ্জে। নাম ছিল সুধীর। শিলি ডাকত সুধীরমামা বলে। দু-দিন ছিলেন ওদের বাড়িতে।
বাবা সে দু-দিন নানা অছিলাতে ইচ্ছে করেই বাড়ির বাইরে ছিলেন। সুধীরমামা চলে যাওয়ার পর মা বলেছিলেন, তোর বাবা মানুষটা বড়ো উদার রে শিলি। এমন পুরুষ, সব মেয়ের-ই শ্রদ্ধার পাত্র।
সুধীরমামা আঁচড়ের চপ খেতে ভালোবাসতেন বলে, দু-দিনই বিকেলে আঁচড়ের চপ করেছিলেন মা। মনে আছে শিলির।
একদিন আলিপুরদুয়ার থেকে খবর এল পোস্টকার্ডে যে, সুধীরমামা কুমারগঞ্জের দিকেই আসছিলেন শিলির মায়ের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে। স্টেশনে নেমে, বাস ধরার আগেই রক্তবমি করে প্ল্যাটফর্মেই মারা যান। অচেনা মানুষের মৃতদেহ মর্গে নিয়ে যায় পুলিশ। কাটা ছেঁড়া হয়। সাতদিন পরে সুধীরমামার ছোটোভাই লোকমুখে খবর পেয়ে মর্গে পৌঁছে মৃতদেহ শনাক্ত করেন। সুধীরমামা তখন আর সুধীরমামা ছিলেন না। গলে, ফুলে, পচে সে নাকি এক বীভৎস ব্যাপার। ওইখানেই দাহ করে ফিরে যান তাঁর ভাই।
গিয়েই মাকে একখানা পোস্টকার্ড লেখেন।
সুধীরমামাও খুব মদ খেতেন। বিয়ে-থা করেননি। মামাবাড়ির আত্মীয়দের কানাঘুসোয় সে শুনেছে, মাকে ভালোবাসতেন বলেই তিনি বিয়ে করেননি। পুববাংলার এক-ই গ্রামে বাড়ি ছিল ওঁদের। মায়ের নিজের নামে না ডেকে সুধীরমামা মাকে ডাকতেন পারু বলে। দেবদাসের পার্বতী।
জীবনের শেষটাতে অনেক-ই মিল ছিল দেবদাসের সঙ্গে।
শিলির মা বলতেন, তোর বাবা কাঠ-খোট্টা মানুষ। প্রেমের মতো গভীর ব্যাপার ওঁর জন্যে নয়। তবে, প্রত্যেক মানুষের-ই প্রেমের প্রকাশ আলাদা আলাদা। সুধীরমামার মৃত্যুর পর বাবাই ওদের বাড়িতে এঁচড়ের চপ কোনোদিনও আর করতে দেননি। মাকে বলতেন, সুধীরবাবু খেতে অত ভালোবাসতেন। ও জিনিস আর নাই-ই বা করলে।
সুধীরমামাও কিন্তু দারুণ ভালো গান গাইতেন। যে দু-দিন ছিলেন, গানে গানে মুখর করে রেখেছিলেন। মায়ের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতেন। শিলির খুব অবাক লাগত তখন, ওই মাকে দেখে। মা যেন অন্য মা হয়ে গেছিলেন। এক অচেনা মানুষ।
সুধীরমামা চলে যাওয়ার পর, মা বলেছিলেন একদিন শিলিকে ডেকে, দেখ শিলি, প্রেমে যদি কোনোদিনও পড়িস কারও সঙ্গে, সত্যিকারের প্রেম রে, মোহ নয়, তবে তাকে কখনো বিয়ে করিস না। বিয়েটা একটা অভ্যেস। অন্ধকার ঘর। আর প্রেম হচ্ছে আলোকিত বারান্দা। যেখানে পাখি ডাকে, ফুলের গন্ধ ভাসে।
শিলি শুধিয়েছিল, কী করে বুঝব মা, যে, প্রেমে পড়েছি?
মা হেসে, শিলির থুতনিতে হাত দিয়ে বলেছিলেন, বুঝতে ঠিক-ই পারবি।
–প্রেম যেমন আনন্দর, তেমন বড় কষ্টেরও। প্রসব-বেদনার চেয়েও অনেক বেশি কষ্ট প্রেমে। প্রেম এলে, ঠিক বুঝবি। যদিও শব্দ করে, জানান দিয়ে আসে না প্রেম।
-তবে? মানুষ প্রেমে পড়ে কেন? অত যদি কষ্টই?
হেসেছিলেন মা। বলেছিলেন, না-পড়ে পারে না বলেই পড়ে।
রাজেন বারান্দাতে বসেছিল। রাজেন একাই। পুতন বোধ হয় পৌঁছে দিয়েই চলে গেছিল। যেকোনো কারণেই হোক, পুতনদা কয়েকদিন হল এড়িয়ে যাচ্ছিল শিলিকে।
শিলি বলল, বসুন একটু। আসছি।
বলেই ভেতরে গিয়ে চুলটা ঠিক করে, চোখে কাজল দিয়ে এল।
বাবা আর কাকা একসঙ্গেই বেরিয়েছিলেন। গজেনকাকাদের ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়ার সালিশি হয়েছেন ওঁরা। রোজ-ই একবার করে যাচ্ছেন ক-দিন হল।
আজকে মিটিয়ে দিয়ে আসবেন, এমন-ই কথা আছে।
শিলি এসে বসল, রাজেনের সামনে।
বলল, কী করলেন? সারাটা দিন?
–কিছুই করলাম না। অথচ দিনটা চলে গেল। এই কথাই ভাবছিলাম। আমার মতো উদ্দেশ্যহীন লোকের দিন তো বটেই, জীবনও বোধ হয় এমনি করেই চলে যাবে। চলে যাবার সময়ই শুধু জানতে পারব যে, চলে গেল।
–তাই?
শিলি বলল।
–আমি কাল-ই ফিরে যাচ্ছি। চা-বাগানে।
শিলির বুকটা ধক করে উঠল। মনে হল যেন কোনো স্বপ্ন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেল। প্রথমটা, কোনো কথাই বলতে পারল না শিলি। তারপর সামলে নিয়ে বলল, সাতবোশেখির মেলা দেখে যাবেন না? মেলার মুখেই চলে যাবেন?
–যেতে যখন হবেই, তখন মায়া বাড়িয়ে আর লাভ কী?
–মায়া? কীসের মায়া?
মুখ নামিয়ে বলল, শিলি।
–এই! কুমারগঞ্জের মায়া। এখানের মানুষজনের মায়া।
-ওঃ ।
-এখানের মানুষজনকে ভালো লাগল না বুঝি?
–না। না। তারজন্যে নয়। হয়তো উলটোটাই। বেশি ভালো লাগলেও চলে যেতে হয়। চলে যাওয়াই ভালো।
একটু চুপ করে থেকে রাজেন বলল, তুমি, কলকাতায় কখনো যাওনি, না?
-না।
–কখনো কি যাবে?
–আমরা গেঁয়ো লোক। তার ওপরে কলকাতায় তো আমাদের আত্মীয়স্বজনও কেউই নেই। থাকার জায়গাই বা কোথায়? তা ছাড়া বিনা কাজে বেড়িয়ে বেড়াই এমন সামর্থ্যও তো আমাদের নেই। বাবা কাকারও আমি ছাড়া কেউই নেই। ওঁদের কে দেখবে?
-আমি আমার মাকে লিখেছি তোমার কথা।
–আমার কথা? আমার কথা কী লিখেছেন?
–এই! যা মনে হয়েছে।
–কবে লিখেছেন?
–যেদিন তোমাদের বাড়িতে খেয়ে গেলাম, সেদিন-ই রাতে। তোমার গান শোনার পর।
–আমার কথা লেখার কীই-ই বা আছে। লেখাপড়া শিখিনি। কোনো গুণ নেই। আমি অতিসামান্য মেয়ে।
–সেই কথাই লিখেছি। তোমার গানটা ভালো করে করা উচিত শিলি।
-আমার কোনোই গুণ নেই। বড়োলোকের বকা ছেলে বলেই সকলে আমাকে জানে। আমার দোষের শেষ নেই। কিন্তু গান আমি ভালোবাসি। এবং নিজের কথা অন্য কেউই এখানে বলার নেই বলেই বলছি; যে, গান ব্যাপারটা আমি একটু-আধটু বুঝি। তুমি গান ভালো করে শিখলে, দেশের নামি গাইয়েদের একজন হতে পারো। ভগবান-দত্ত গলা তোমার। তুমি কি রিয়াজ করো কখনো?
–রিয়াজ? জীবনে করিনি।
–তবেই দ্যাখো। ঠিক-ই ধরেছি। কিছু গাইয়ে থাকেন, ঈশ্বর নিজেই তাঁদের অনেকখানি পথ এগিয়ে দিয়ে, অন্যদের হ্যাঁণ্ডিক্যাপ করে দিয়ে আসরে নামান তাঁদের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্যে।
–হ্যাণ্ডিক্যাপ কী?
–ও। সে তুমি বুঝবে না। ও ঘোড়দৌড়ের ব্যাপার। রেসের মাঠের টার্ম। আমি তো রেসের মাঠেও যাই। সব গুণ-ই তো আছে।
-কী হয়? সেই মাঠে?
হেসে ফেলল রাজেন, শিলির নিষ্পাপ অজ্ঞতায়।
বলল, সে তুমি যখন কলকাতায় যাবে, তখন জানবে। তোমাকে একদিন নিয়ে গিয়ে ঘোড়দৌড় দেখিয়ে আনব। তোমাদের এখানে যেমন আমার বিস্ময়ের অনেক কিছুই আছে, গঙ্গাধর নদী, রাঙামাটি, পর্বতজুয়ার, আলোকঝারি, আমার অদেখা সাতববাশেখির মেলা এবং তুমি– এই শিলি। তেমন, তোমারও বিস্ময়ের অনেক জিনিস-ই আছে কলকাতায়।
–আমি কলকাতায় যাব কেন হঠাৎ? ঠিক বুঝলাম না।
-আমার মা তোমাকে চিঠি লিখবেন, নেমন্তন্ন জানিয়ে। আর আমার বাবা লিখবেন তোমার বাবাকে। তুমি তোমার বাবার সঙ্গেই যাবে। পরেশকাকাকেও নিয়ে যেয়ো। ওখানে কত বড়ো বড়ো বন্দুকের দোকান আছে। ওঁকে দেখাব। আমার ছোটোমামারও খুব শিকারের শখ ছিল। ছিল কী, এখনও আছে। বিহারের হাজারিবাগ, ওড়িশার ঢেনকানল ইত্যাদি কত জায়গাতে শিকারে যান উনি, প্রতিশীতে। পরেশকাকাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন উনি।
-কেন? আমাদের নেমন্তন্ন করবেন কেন, আপনার মা-বাবা?
–আমার তোমাকে খুব ভালো লেগেছে বলে। মানে, তোমাদের সকলকেই।
–তাই?
বলে, বড়ো বড়ো চোখ মেলে শিলি চেয়ে রইল, রাজেনের মুখের দিকে বিস্ময়ে।
ওর বুকের মধ্যে দারুণ এক উত্তেজনা বোধ করতে লাগল ও।
হঠাৎ রাজেন বলল, তোমার বিয়ে কবে? শিলি?
বড়োকষ্ট হল রাজেনের কথা শুনে শিলির। একটু আগেই বুকে যে, আনন্দর বোধ চিড়িক, করে উঠেছিল, তা-ই হঠাৎ বেদনার বোধ হয়ে গেল।
সামলে নিয়ে বলল, আমার বিয়ে? কে বলেছে, আপনাকে?
–অনেকের কাছেই তো শুনছি। তোমার বিয়েতে আমাকে নেমন্তন্ন কোরো কিন্তু। আর বিয়ের আগেই একবার কলকাতা বেড়িয়ে যাও। আমাদের নায়েবমশাইকে পাঠাবেন বাবা, তোমাদের নিয়ে যাবার জন্যে।
–আমার বিয়ের কথা শুনেছেন, কিন্তু পাত্রটি কে?
বেশ মজা লাগছিল শিলির। মজার গলাতেই বলল।
–পাত্র?
–হ্যাঁ।
–পাত্র দু-জন আছেন বলে শুনেছি।
এবারে শিলি হেসে ফেলল। বলল, ও তাহলে বিয়েটা পাকা হয়নি এখনও? তা ছাড়া পাত্র একজন নয়, দু-জন? একেবারে স্বয়ংবর সভা যে!
বোকা বনে গেল রাজেন।
বলল, হয়তো তাই-ই।
–পাত্রই যখন ঠিক হয়নি এখনও, তবে তো বিয়ে নাও হতে পারে।
শিলি বলল।
–তা নয়। শুনেছি বিয়ে হবেই। এবং শিগগির।
–পাত্র তাহলে দু-জনের জায়গায় তো চারজনও হতে পারে। পাকাই যখন হয়নি।
এবারে হেসে ফেলল রাজেন। আনন্দে।
বলল, তাই?
-তাই-ই! তবে আমার বাবা ছাড়া তো আমার কেউই নেই। বাবাকে ছাড়া কোথাও যেতে পারব না। আর পারব না বলেই, বোধ হয় বাবা-কাকা আমার জন্যে এখানের-ই কোনো পাত্রর কথা ভাবছেন। আমার না আছে রূপ, না আছে কোনো গুণ। লেখাপড়াও শিখিনি বলার মতো। আমার বাবার টাকাও নেই। আমার যেমন যোগ্যতা, তেমন পাত্রই আমার জুটবে।
–পুতনকে তোমার কেমন লাগে শিলি?
হঠাৎ বলল, রাজেন।
শিলি চুপ করে রইল।
-কী? কিছু বলছ না যে?
–সত্যি কথা বলব? আপনি কথাটা নিজের কাছেই রাখবেন তো?
নির্ভয়ে বলো।
–খুব-ই ভালো লাগত। পাশাপাশি বাড়ি। তা ছাড়া বড়ো হওয়ার পর বেশি ছেলেদের সঙ্গে মেশার সুযোগ তো পাই না আমরা, এই গাঁয়ের মেয়েরা। তাই পুতনদাকেই দেখেছি ছোটোবেলা থেকে। খুব-ই ভালো লাগত। পড়াশুনোতেও ভালো। আমাদের গর্ব। তার মায়েরও গর্ব। পুতনদার মাও আমাকে খুব ভালোবাসেন। কিন্তু এই পুতনদা মানে, যে পুতনদা আপনার সঙ্গে এবারে এল, তাকে আমার ভালো লাগেনি। অনেক-ই বদলে গেছে পুতনদা।
রাজেন বলল, ওকে আমিই বকিয়ে দিয়েছি। দোষ আমার-ই। ও সত্যিই ভালো ছেলে। আমার সংশ্রব ছাড়লেই ও আবার তোমার পুরোনো পুতনদাই হয়ে যাবে।
-জানি না। যাদের যে-কেউই এত সহজে নষ্ট করতে পারে, তাদের ওপর ভরসা কি করা যায়? আসলে, পুতনদার মধ্যে নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রবণতা ছিল নিশ্চয়ই। নিজে নষ্ট না হতে চাইলে, অন্যে কি নষ্ট করতে পারে কাউকে?
–নিশ্চয়ই পারে শিলি। এই যেমন তুমি। এক রাজেন এখানে এসেছিল, তুমি তাকে আবার নষ্ট করে অন্য রাজেন করে দিলে।
একটু চুপ করে থেকে বলল, আসলে নষ্ট হবারও নানারকম থাকে তো!
শিলি, আহত গলায় বলল, আমি? আমি আপনাকে নষ্ট করে দিলাম? কী বলছেন আপনি?
–দিলেই তো। নষ্ট হওয়া মানে, সবসময় খারাপ হওয়া নয়। পুরোনো যা, তা নষ্ট তো হলই। বদলে যাওয়ারও তো আর এক নাম নষ্ট হওয়া! নাকি?
শিলি চুপ করে রইল। মুখ নামিয়ে।
কিছুক্ষণ পরে, নিজের আঙুলে আঁচলের কোণটি পাকাতে পাকাতে বলল, আমি; আমি…
ওর দিকে চেয়ে খুব ভালো লাগছিল রাজেনের। কলকাতার কোনো মেয়ে এমন করে আঁচল আঙুলে পাকালে তাকে অভব্য-অসভ্য বলা হত। অথচ এই চাঁদ-ভাসি উঠোনের এক কোণের বারান্দায়, এই গ্রাম্য মেয়েটির আঙুলে আঁচল পাকানো দেখে রাজেনের মনে হল, এর চেয়ে বেশি ভদ্র, স্বাভাবিক অভ্যেস আর কিছুই হতে পারে না। সেখানে যা মানায়, যা রেওয়াজ।
একটু পর-ই পুতন ফিরে এল।
শিলি বুঝল ও চলে যায়নি, হয়তো কিছু কিনতে-টিনতে গেছিল।
পুতন হাঁটিয়ে-আনা সাইকেলে, কির-র-র-র শব্দ তুলে উঠোনে ঢুকল।
বলল, হুইস্কি পেলাম না গুরু, রাম এনেছি।
রাজেন উঠল। বলল, এখানে নয়। শিলি বাড়িতে একা আছে। তা ছাড়া শিলি পছন্দ করে না এসব।
একটু চুপ করে থেকে রাজেন বলল, তুমি মদ খাওয়া ছেড়ে দাও পুতন।
–যাঃ বাবা। ভূতের মুখে রামনাম!
–তাই-ই! ভূত যে, ভগবান হয়ে ওঠে কখনো-কখনো, তাও তো সত্যিই।
–কী ব্যাপার?
–কেন? ভূত ভগবান হতে পারে না?
অবাক হয়ে রাজেনের সঙ্গে চলে যেতে যেতে পুতন শিলিকে বলল, শিলি, তাহলে এই কথাই রইল। দেখা হবে সাতবোশেখির মেলায়।
রাজেন কিছুই বলল না পুতনকে, সেই কথার পিঠে। শিলিকেও নয়।
শিলি অবাক হল।
রাজেন বলল, চললাম শিলি। ভালো থেকো। খুশি থেকো, সবসময়ে।
–হঠাৎ এইসব কথা? সময় কি চলে যাচ্ছে নাকি?
পুতন বলল।
তারপর বলল, এখান থেকে যেদিন যাবে, সেদিন-ই এইসব ফেয়ারওয়েলের কথা হবে এখন। অনেক-ই হবে। ফুল, মালা, চোখের জল।
রাজেন উত্তর দিল না।
শিলি, চ্যাগারের দরজা অবধি এল ওদের সঙ্গে। যাওয়ার সময়ে রাজেন খুব কাছ থেকে শিলির মুখে তাকাল একবার।
তারপর আবারও বলল, মাঝে মাঝে গানের রিয়াজ করলে ক্ষতি কী? ভেবে দেখো।
তারপর-ই নীচু গলায় বলল, ভালো থেকো শিলি।
ভালোবেসে, কাউকে ভালো থাকতে বলার মধ্যেও যে, এত লজ্জা, এত সুখ থাকতে পারে, তা রাজেনের জানা ছিল না।
ওরা দু-জনে জ্যোৎস্নার মধ্যে বাঁশপাতা-ঝরা আলো-ছায়ার ডোরাকাটা শতরঞ্জি মাড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। পুতন আর রাজেন। সাইকেলের চেনের কিরকির শব্দ হচ্ছিল। আমের বোল-এর আর কাঁঠালের মুচির গন্ধে ম ম করছিল চাঁদভাসি, কুমারগঞ্জ। কোকিল ডাকছিল, কাক-জ্যোত্সাকে দিন ভেবে। পাগলের মতো। কোকিলদের মধ্যেও পাগল থাকে। আর বউ কথা-কও।
শিলির দু-চোখের সামনে দিয়ে, যেন রাজেন নয় মায়ের প্রেমিক সুধীরমামাই জ্যোৎস্নায় ভেসে ভেসে চলে গেলেন।
মা চলে গেছেন। সুধীরমামাও গেছেন আরও আগে। মানুষ ঠিক-ই মরে যায় একদিন না একদিন, কিন্তু প্রেম থেকে যায় অন্যের মধ্যে। প্রেমিক-প্রেমিকার রূপান্তর ঘটে মাত্র। প্রেমিক এক-ই থাকে। দিদিমা, মা অথবা মেয়ের। জন্মে জন্মে তাদের চেহারা এবং নাম বদলায়। রকমের বদল বোধ হয় না।
হঠাৎ-ই কুচিন্তায় মন ভরে উঠল শিলির।
শিলির মন বলল, রাজেন আর কোনোদিনও ফিরে আসবে না এই কুমারগঞ্জে; শিলির কাছে। কে জানে? আসবে কি?
মনে একথা হতেই মনে মনে সেই মনের মুখ চেপে ধরল ও।
ওরা দু-জনে বড়োরাস্তায় পড়ে চাঁপার মাঠের দিকে যেতে লাগল। চাঁপার গন্ধে ম ম করে জায়গাটা। তাই খুব-ই পছন্দ করে পুতন। ওখানে বসেই মাল খাচ্ছে গত তিনদিন হল ওরা।
পুতন বলল, গুরু? কী হল তোমার? মনমরা দেখছি যে। আর কী? যে জন্যে আসা সেই কারণ তো সিদ্ধ হবে এবারে। কিছু বলো গুরু।
-গুরু তো ছিলে তুমিই? আমি আবার গুরু হলাম কবে থেকে।
রাজেন বলল।
-তোমার নিজের গুণেই।
পুতন বলল।
হেসে ফেলল, রাজেন।
বলল, তাই-ই?
পুতন বলল, ভিলেজ-বিউটির নথ কবে খসাবে? কেস তো একেবারে তৈরি করেই ফেলেছ। ওকে নষ্ট করবে বলেই তো এখানে আসা তোমার। পারোও বাবা তুমি। শিকারি বাঘও তোমার মতো ধৈর্য রাখে না। অসীম ক্ষমতা তোমার। খুরে খুরে পেন্নাম।
–হুঁ।
–পথেই খাবে নাকি? খুলব পাঁইট?
অধৈর্য গলায় বলল, পুতন।
–নাঃ। আমি খাব না।
রাজেন বলল, অন্যমনস্ক গলাতে।
–সে কী? এ কী কথা? সন্ধেবেলা ওষুধ না খেলে শরীর ম্যাজম্যাজ করবে না? আমি তো খাবই। তুমিই আমাকে ধরিয়ে, এখন তুমিই..বাঃ।
–এ সব না-খাওয়াই ভালো। পরে, এই-ই খায়।
–যাঃ শালা। বলছ কী তুমি গুরু? যাকগে, কাল অবধি তো খাও। তারপর দেখা যাবে এখন। গুড়ি-গুডি বয় হওয়া যাবে।
-আরে! সাতবোশেখির মেলার দিনেই তো ক্লাইম্যাক্স হবে। না খেলে, চলবে কেন? প্ল্যানটা কী করলে শুনি?
-কীসের প্ল্যান?
-বাঃ, প্ল্যানটা যাতে নির্বিঘ্নে করতে পারো। তাই তো তোমাকে একা পাঠালাম আগে। কীসের প্ল্যান আবার কী?
–শিলিকে নষ্ট করার প্ল্যান।
–ওঃ।
বলেই, চুপ করে গেল রাজেন।
মনে মনে বলল, একথা ঠিক-ই যে, ওকে নষ্ট করতেই এসেছিলাম। কিন্তু নিজেই নষ্ট হয়ে গেলাম। অথবা, কে বলতে পারে; অমৃত হয়ে গেলাম!
রাজেন, পুতনকে বলেনি যে, কাল ভোরের বাসেই ফিরে যাবে ও। অনেক-ই কাজ বাকি আছে। সময় বেশি নেই।
পুতন বলল, তুমি কথাবার্তা কইচো না যে!
বলল, একেবারেই কলকাতার লোকেদের-ই মতন। ওই ভাষা পুরোপুরি রপ্ত করে ফেলে, পুতনের খুব গর্ব হয় আজকাল। কিছু মেকি মানুষ, মেকি-বাঙাল তাঁদের মাতৃভাষার ব্যাপারে একধরনের হীনম্মন্যতাতে ভোগেন। পুতনও তাদের-ই দলে। ব্যতিক্রম নয়। মেকিরাই তো এখন দলে ভারী সব জায়গাতে। তাদের-ই রাজত্ব। অথচ একদিন পুতন ঘৃণা করত। আজ সে তাদেরই একজন।
তবুও রাজেন কথা বলল না।
-কী গুরু? উত্তর দিচ্ছ না যে কথার?
রাজেন হাসল এবারে।
বলল, জান পুতন আমি না মাইরি, আলোকঝারি হয়ে গেছি।
পুতনের প্রতি এক গভীর কৃতজ্ঞতা বোধ করছিল রাজেন।
–সে আবার কী?
–সত্যিই। আলোকঝারি।
তারপর বলল, আমি তোমার কাছে খুব-ই কৃতজ্ঞ যে, তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলে।
–আরে এখন-ই কী! কালকে কম্মো ফতে থোক। তারপরে না! কেস যেমন তৈরি করেছ, তাতে তো জোর খাটাতেও হবে না দেখছি।
রাজেন হাসল।
মুখে কিছু বলল না।
হাসিটা, চাঁদের আলোতেও অদ্ভুত ঠেকল পুতনের।
মনে মনে বলল, অনেক-ই দিন জোর খাটিয়েই পেয়েছি মেয়েদের। গায়ের জোর, টাকার জোর, বুদ্ধির জোর। এবারে পাব জোর না-খাটিয়েই। হেরে যাব এবারে। যেসব জেতাকে, আমি জেনে এসেছিলাম, তারা যে সব-ই সস্তা জয়ের রং-করা হার, আত্মাবমাননাই একরকমের, তা আমি আজ জেনেছি। সসম্মানে জিতব এবার।
–কী হল গুরু। কতা কও। হলটা কী তোমার?
–আর কথা? সত্যি পুতন। আমি নিজেই আলোকঝারি হয়ে গেছি তোমাদের দেশে এসে। সত্যিই!
-কেন? আলোকঝারি কেন?
–এত আলো, এত আনন্দ; আমার মধ্যে সত্যিই হাজারো ফোয়ারা খুলে গেছে। তা থেকে দিন-রাত শুধু আলোই ঝরে। খুশিও! এও কি এক আলোকঝারি নয়? আমার মন? এই আমিকে কি আমি জানতাম?
পুতন ভাবছিল, এক-ই মানুষের অনেকগুলো মানুষ থাকে বোধ হয়। বোধ হয় নয়; অবশ্যই থাকে।
রাজেনের মধ্যে থেকে এ কোন মক্কেল হঠাৎ বেরিয়ে এল মাল না খেয়েই, এমন হেঁয়ালি শুরু করল, কে জানে! কলকাতার মালেদের বোঝাই মুশকিল। কিরণশশীর ভাষাতে বলতে গেলে বলতে হয়, খিটক্যাল। কী খিটখ্যাল।
ভাবছিল পুতন।
দূরের আলোকঝারি পাহাড়টা চাঁদের আলোতে রুপোঝুরি হয়ে গেছিল। আর দু-দিন পরেই পূর্ণিমা। পাহাড় থেকে নানা রাত-পাখি আর নিশাচর জানোয়ারদের আওয়াজ ভেসে আসছে। ওদের চলে-যাওয়া দেখে এসে, শিলি বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, আলোকঝারির দিকেই চেয়েছিল। আজ বিনুনি বেঁধেছিল ও। এক বিনুনি। বাঁ-দিক দিয়ে ঘুরিয়ে, বুকের ওপর ছেড়ে দিয়েছিল কালো, চিকন সাপের মতন। শ্বেতকরবী গুঁজেছিল বাঁ কানের পেছনের চুলে।
ভাবছিল শিলি, সুগন্ধি ঘোরের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে, স্বপ্নে সাঁতার দিয়ে, এক অচেনা স্বপ্নের দেশে ভেসে যাচ্ছিল ও।
আলোকঝারি থেকে উড়ে-আসা ময়নামারীর বিলের দিকে চলে যাওয়া, ঘাড়ে কেশর ঝোলানো সাদা হেরনরা কোয়াক কোয়াক কোয়াক করে ডাকতে ডাকতে উড়ে যেমন করে ভেসে যায়, তেমন-ই উড়ে যাচ্ছিল শিলি, নিঃশব্দে।
এইমুহূর্তে মাকে বড়োই মনে পড়ছিল ওর।
মা আজ পাশে থাকলে বড়োভালো হত। মা যে, ওর মধ্যেই ছিলেন আর রাজেনের মধ্যে সুধীরমামা।
একথা মনে করেই রোমাঞ্চিত হচ্ছিল ও।
রাজেনকে ও মরতে দেবে না।