একটা ন্যাকা বৃষ্টি অনেকক্ষণ ধরে হয়ে যাচ্ছে। হয়েই যাচ্ছে। ধরছে না, কমছে না। জোরেও নয়, আস্তেও নয়। ঘ্যান ঘ্যান ঘ্যান ঘ্যান ঘ্যান ঘ্যান। একখানা পাতলা ঝরোকার মতো ঢেকে আছে চারপাশ।
বৃষ্টি খুবই ভালবাসে মণীশ। মণীশের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি ঘটেছে বর্ষাকালে। এমন কি অপর্ণার সঙ্গে তার চমকপ্রদ প্রেমটাও। এখন মণীশ নার্সিং হোম-এ। শক্তিশালী ওষুধে আচ্ছন্ন। সেই গাঢ় কুয়াশার মতো আচ্ছন্নতার ভিতরে এই বৃষ্টির কোনও খবর পৌঁছোচ্ছে না। মাঝে মাঝে গভীর ব্যথায় এক একটা কাতর শব্দ উঠে আসে বুকের গহন থেকে।
মণীশের বাড়ির অবস্থাটা সন্ধে সাড়ে সাতটার সময় খুব ম্লান ও স্তব্ধ। টি ভি-টা চলছে। বাংলা খবর একটু আগেই শুরু হল। টি ভি-র মুখোমুখি বসে মণীশের ছেলে অনীশ। বাবাকে নিয়ে দু রাত জাগার পর এখন তার চোখের পাতা চুম্বকের টানে জুড়ে যাচ্ছে বারবার। করুণ গলায় একবার বলেছিল অনেকক্ষণ আগে, মা, একটু চা দেবে? একটু কড়া করে?
অপর্ণা বলেছিল, দিই।
সাড়ে সাতটা নাগাদই ঝুমকি তার কমপিউটার ক্লাস থেকে ফেরে। ফিরে চা চায় বা নিজেই করে নেয়। অপর্ণা একটু দেরী করছিল চা করতে। এখনই তো ফিরবে ঝুমকি।
এ বাড়িতে কারও মন ভাল নেই বলে সংসারটাই যেন এলিয়ে পড়েছে। ছোটো মেয়ে অনু এ সময়ে রোজ স্টিরিওতে গান শোনে। রাজ্যের হিন্দি গান। অনুশীলা অর্থাৎ অনু দু রাতের টেনশনের পর বাইরের ঘরে ডিভানে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়েছে কখন।
বাচ্চা কাজের মেয়েটা রান্নাঘরের মেঝেয় বসে আটা মাখছে। রাতের রুটি হবে। ফ্রিজ খুলে অপর্ণা দেখে নিয়েছে, আনাজপাতি প্রায় কিছুই নেই। রান্না করা ডাল-ডালনাও নয়। দুদিন তাদের এসব খেয়াল ছিল না। কিন্তু আজ রাতে রাঁধতে হবে, খেতেও হবে— ভাবতেই গায়ে জ্বর আসছিল অপর্ণার। খিচুড়ি করলে ঝামেলা মিটে যেত। কিন্তু স্বাভাবিক বুদ্ধি তো কাজ করছে না মাথায়।
খিচুড়ির কথা মনেই ছিল না।
মণীশ কি চলল? মণীশ চলে গেলে অপর্ণার কি করে চলবে?
আজ সব কাজ ফেলে রেখে অপর্ণার ইচ্ছে করছে কাউকে ডেকে গল্পটা শোনায়, তাদের প্রেম হয়েছিল কত অদ্ভুতভাবে, কী রোমান্টিক ভাবে।
বৃষ্টির জন্যই দেরী হচ্ছে মেয়েটার, ভিজে আসবে বোধহয়। মেয়েটার সাইনাস, ঠান্ডায় এলার্জি, ইসিনোফেলিয়া খুব বেশী। বাবার জন্য দুদিন ধরে মেয়েটা কেঁদেছে আর ছুটেছে এখানে সেখানে। ঝুমকি বরাবর তার বাপের বেশী ন্যাওটা। এখনও বাপের হাতে ভাত খায়, বায়না করে, কোলে অবধি বসে।
মণীশ যদি চলে যায় তাহলে এ বাড়ির আলোটুকু, সুখটুকু, উত্তাপটুকু সব টেনে নিয়ে যাবে। এটা মণীশের দ্বিতীয় অ্যাটাক এবং ম্যাসিভ। ডাক্তার প্রথমে ছত্রিশ, তারপর আটচল্লিশ এবং তারপর বাহাত্তর ঘন্টার অনিশ্চয়তার সতর্কবার্তা দিয়েছেন। এগুলো কথার কথা। পদ্মপাতার জলের মতোই টলমল মণীশের আয়ু, অপর্ণা জানে।
শক্ত হওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে অপর্ণা। কিন্তু মুঠোয় ধরবার মতো কিছু পাচ্ছে না। যথাক্রমে কুড়ি, আঠারো এবং চৌদ্দ বছরের তিন ছেলেমেয়ে তাদের। বয়সের অনুপাতে তিনজনই কিন্তু ছেলেমানুষ রয়ে গেছে। সংসারের কোনও আঁচ ওদের গায়ে লাগতে দেয়নি অপর্ণা আর মণীশ। আজ ওরা সবচেয়ে বেশী অসহায়, দিশাহারা।
জলের মতো টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। মহার্ঘ টাকা, কিন্তু টাকার কথাটা একদম ভাবতে চাইছে না অপর্ণা। টাকাটা তো আসল নয়, মণীশই আসল। টাকার অপচয়ের কথা ভাবাও বোধহয় মণীশের প্রতি অসম্মান।
ভাবতে চাইছে না। তবু ঘুরে ফিরে মাছির মতো একই জায়গায় এসে বসছে মনটা। কারণ আছে। গত কয়েক বছর মণীশ একটু টাকা ওড়াচ্ছিল। না, তার বাইরের কোনও দোষটোষ নেই। আসলে সে একটু বড়লোকের মতো থাকতে শুরু করেছিল। দামী জিনিসপত্র কিনে আনা, ভাল হোটেলে আকাশ-ছোঁয়া দামে সপরিবারে গিয়ে মাঝে মাঝে খাওয়া, সেকেন্ড ক্লাশের বদলে ট্রেনের এ সি কামরায় বেড়াতে যাওয়া। এসব বড়লোকী লক্ষণের পিছনে মণীশের প্রথম জীবনের অভাব-কষ্টের স্মৃতি কাজ করে নিশ্চয়ই। কিছু টাকা হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গে যেন সব পুষিয়ে নিতে উঠে পড়ে লাগল সে। ইদানীং অপর্ণা লক্ষ করেছে, ছেলেমেয়ে এবং মণীশের মধ্যে একটা ভাব এসে গেছে— আমরা বড়লোক।
এই ভাবটাই মিথ্যে। মণীশের চাকরিটা চমৎকার। বহুজাতিক প্রথম শ্রেণীর কোম্পানিতে সে চাকরি করে। বিশাল মাইনে। কিন্তু সেটা মাইনেই। আমাপা, অফুরন্ত টাকা তো নয়। মাইনে মানেই দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ সমন্বিত টাকা। সীমাবদ্ধ। বুদ্ধিমান মানুষ কখনও সীমাবদ্ধ টাকার ওপর নির্ভর করে বড়লোকী করতে যায় না। বড়লোক করার জন্য যে টাকার প্রয়োজন তার দৈর্ঘ্য প্রস্থ আর বেধ থাকে না। তা মাসের শেষেও আসবে না।
এসব মণীশকে বোঝানো খুব সহজ কাজ নয়। মণীশ অবুঝ ও অত্যন্ত অভিমানী। কথায় কথায় সে বিগড়ে যায়। অপর্ণা তাই মণীশকে শাসন করতে হলে করেছে আদরের ছলে। বেশির ভাগ সময়ে ঘন আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে শ্বাসবায়ুতে স্বাসবায়ু মিশিয়ে বলেছে, শোননা, আমরা কিন্তু বড়লোক নই। টাকা উড়িয়ে দেওয়াটা কি খুব ভাল? আমাদের না দুটো মেয়ে আছে, যাদের বিয়ে দিতে হবে?
সঞ্চয়ের কথা, মিতব্যয়িতার কথা শুনলেই মণীশ চটে যায়। এসব হিসেবী কথা সে একদম সইতে পারে না। ভবিষ্যতের ভাবনা তার একদম নেই। সে বলে, মেয়ের বিয়ে ফুঁয়ে হয়ে যাবে।
আমি কত প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্র্যাচুইটি পাবো জানো?
অনেক বলেও মণীশকে এ ব্যাপারে লাগাম পরাতে পারেনি অপর্ণা। আর মণীশের ছায়াতে তিনটে ছেলেমেয়েও হল ওইরকম। টাকা-পয়সাকে টাকা-পয়সা বলে মনে করতে চায় না।
টাকা বোধহয় প্রতিশোধ নেয়। নার্সিং হোমের খাতায় প্রতিদিন মোটা টাকার অংক জ্বরের পারদের মতো ওপরে উঠে যাচ্ছে। ভাবতেও ভয় পায় অপর্ণা। এ সংসারে একমাত্র সে-ই বাস্তববাদী। সে একা। সে কখনও নিজেদের সীমাবদ্ধতা বিস্মৃত হয় না। সে জানে, মণীশের চিকিৎসার সব খরচ দেবে তার কোম্পানি। সেজন্য চিন্তা নেই। কিন্তু মণীশ যদি না ফেরে?
মণীশ না ফিরলে তার পিছনে চালচিত্রের মতো বহুজাতিক সংস্থাটিও মুছে যাবে। এককালীন কিছু টাকা গছিয়ে দিয়ে কোম্পানি তাদের সম্পূর্ণ ভুলে যাবে। আর তখনই কি শুরু হবে টাকার প্রতিশোধ?
চায়ের কাপে চামচে নাড়তে নাড়তে যখন সামনের ঘরে এল অপর্ণা তখন অনীশের মাথা ঝুঁকে পড়েছে বুকের ওপর। নাক ডাকছে। খুব আদর করে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে অপর্ণা নরম গলায় ডাকল, বুবকা, ও বুবকা! চা খাবি না?
অনীশ রক্তবর্ণ চোখ মেলে চাইল। তারপর লজ্জার হাসি হাসল।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, না?
ঘুমের আর দোষ কি? যা যাচ্ছে আমাদের ওপর দিয়ে!
আর এক কাপ চা করে ফেলেছে অপর্ণা, কিন্তু ঝুমকি এখনও এল না। যদি দেরী করে তাহলে চা নষ্ট হবে। ঠাণ্ডা চা ফের গরম করে দিলে তা ছোঁবেও না। নতুন করে বানিয়ে দিতে হবে। অপর্ণার একটা কান উদ্গ্রীব রয়েছে ডোরবেল-এর জন্য। ঝুমকির বুক দুর্বল। সর্দিকাশি জ্বরে খুব ভোগে। বড্ড রোগা। তবু নানারকম অকাজের ট্রেনিং নিচ্ছে। অনার্স ছাড়া বি এ পাশ করেছে। এম এ পড়ার উপায় নেই! গাদা গুচ্ছের টাকা দিয়ে কমপিউটার এবং গান শিখছে। এই অপচয়টাও যদি রোধ করা যেত!
মাছিটা উড়ে উড়ে ঘুরে ফিরে একটা জায়গাতেই এসে বসছে। টাকা। অপর্ণা ভাবছে, টাকা কি প্রতিশোধ নেয়? টাকাকে যদি অসম্মান, উপেক্ষা করা হয়, টাকাকে যদি যথোচিত মূল্য না দেওয়া হয়, তাহলে কি টাকা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে?
অপচয় এবং অপব্যয়ে বাঁধ দিতে চেয়েছিল অপর্ণা। পুরোপুরি পারেনি। সঞ্চয়মুখী করে তোলার অনেক চেষ্টা করেছে, মণীশ হয়নি। শুধু আয়কর থেকে বাঁচতে প্রতি বছর এন এস এস আর এন এস সি-তে যা একটু-আধটু জমা হয়। কিছু টাকা জমছে জীবনবীমায়। ব্যস।
নিস্তব্ধ বাড়িতে ডোরবেলের আওয়াজ প্রায় বজ্রাঘাতের মতো চমকে দিল অপর্ণাকে। ঝুমকি এল বুঝি! কত না জানি ভিজে এসেছে মেয়েটা!
দরজা খুলল বুবক। না, ঝুমকি নয়। অনুর বান্ধবী মোহিনী। চমৎকার দেখতে মেয়েটা। বাইরের চটক ততটা কিন্তু নেই। মোহিনীর সৌন্দর্য দেখতে হলে একটু মন দিয়ে দেখলে ধরা যায়। মুখ চোখ যেন সূক্ষ্ম সব যন্ত্র দিয়ে কমপিউটারে মাপজোখ করে তৈরি। কিন্তু মোহিনী খুব ফর্সা নয়, খুব লম্বা নয়। আলটপকা চোখে পড়ে না। কিন্তু মিষ্টি ধারালো মুখখানা আর ভারী পাতার নিচে ঢলঢলে দুখানা চোখ অপর্ণার খুব পছন্দ। একটাই দোষ, বড্ড ইংরিজিতে কথা বলে।
অপর্ণার বাড়িতেও একই অবস্থা। ঝুমকি বাদে বাকি দুজন প্রথম থেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে! ওরা বাংলা বলতে একটুও ভালবাসে না। মণীশও ওদের ইংরিজিকে আকণ্ঠ প্রশ্রয় দেয়।
আন্টি, কি খবর জানতে এলাম।
একইরকম। বোসো। এই ড্রেসটা কবে করালে?
মোহিনী তার ঘাঘরা আর কামিজের নতুন পোশাকটাকে যেন হাত বুলিয়ে একটু আদর করে বলল, আমার বার্থ ডে ছিল তো গত মাসে। বাবা দিয়েছে।
বেশ পোশাকটা হয়েছে। ঘাঘরার তলায় রঙিন বলগুলো কি তোমরা লাগিয়ে নিয়েছো, না কি ওরকমই?
এরকমই কিনতে পাওয়া যায়। বাবা বম্বে থেকে এনেছে।
তাই বলো। এখানে এখনও এসব ফ্যাশন চালু হয়নি।
মিষ্টি করে হাসল মোহিনী, খুশির হাসি।
তবে এই বৃষ্টির দিনে ড্রেসটা পরে ভাল করোনি।
মোহিনী অকপটে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, চট করে চলে এলাম তো, খেয়াল করিনি।
বোসো। চা খাবে?
আমি তো খাই না। বলে আবার সেই মিষ্টি হাসি।
ওঃ, তাই তো। আসলে আমার এক কাপ চা বাড়তি হয়েছে। কী যে করি!
বুবকা বিরক্ত গলায় বলল, তোমার প্রবলেমগুলো এত ছোটখাটো কেন বলো তো মা! চা-টা আমাকে দিয়ে দাও।
আঠারো বছরের ছেলেরা আজকাল ভোট দেয়। বুকার আঠারো। তার মানে কি বুবকা সাবালক হয়ে গেল! এক কাপ চা বাড়তি হয়েছে, একথাটা বোধহয় মোহিনীর কাছে বলাটা উচিত হয়নি। যেন বাড়তি হয়েছে বলেই অফার করা হচ্ছে। বুবকা বোধহয় সেই কারণেই অপর্ণার ওপর বিরক্ত হল। আজকাল অপর্ণা কত কি শেখে ছেলের কাছ থেকে।
মোহিনী আসতেই এক ডাকে উঠে পড়ল অনু।
অপর্ণা মনে মনে এরকমই একটা কিছু চাইছিল। কেউ একজন আসুক। এই নিস্তব্ধ বিষণ্ণ বাড়িটার ভারী বাতাস কেটে যাক কথায় বার্তায় হাসিতে।
অফিস থেকে লিজ নেওয়া এই ফ্ল্যাটটা বেশ বড় এবং স্ট্যাটাস সিম্বল সবই প্রায় আছে। শুধু গ্যারেজে গাড়িটা নেই। আগের অ্যাম্বাসাডারটা ভাল দাম পেয়ে বিক্রি করে দিয়েছে মণীশ গত মাসেই। একটা মারুতি ভ্যান কেনার কথা। দরাদরি চলছিল। দু-চার দিনের মধ্যেই এসে যেত। কিন্তু মণীশের অসুখটাই বাধা হল বোধহয়। অপর্ণা একরকম খুশি। তেলের যা দাম বাড়ছে, গাড়ি পোষার মানেই হয় না। মণীশ অফিসে যায় আসে পুল কার-এ। তবে গাড়িটা দিয়ে কি হয়? অপর্ণার শখ ছিল গাড়ি চালানো শিখবে। মোটর ট্রেনিং স্কুলে শিখেও ফেলল। লাইসেন্স দিয়ে দিল। আর তারপরই সেই ভয়াবহ অ্যাকসিডেন্ট… অপর্ণা সে কথা আর ভাবতেই চায় না।
একটা নতুন আওয়াজ বজ্রাঘাতের মতোই ফের চমকে দেয় অপর্ণাকে, ভুল শুনছে না তো! করিডোরে টেলিফোন বাজছে নাকি? চার মাস ধরে টেলিফোন মূক ও বধির হয়ে ছিল। তারা ক্রমে ভুলে যাচ্ছিল টেলিফোনের কথা। পরশুদিনই ঝুমকি গিয়ে টেলিফোন অফিসে ধরে পড়েছিল, আমার বাবার ভীষণ সিরিয়াস অসুখ, আমাদের টেলিফোনটা ঠিক করে দিন।
এসব আবেদনে কাজ হয় কি?
টেলিফোনের আওয়াজে বুকা আর অনুও উঠে দাঁড়িয়েছিল। বিস্ময়ে।
অপর্ণাই গিয়ে সবার আগে ধরল।
হ্যালো।
আপনাদের লাইন ঠিক করে দেওয়া হল।
অপর্ণা বুকভরা কৃতজ্ঞতা অনুভব করে বলে, কি বলে যে ধন্যবাদ দেবো। আমার স্বামী ভীষণ অসুস্থ, নার্সিং হোমে। তাই টেলিফোনটা আমাদের এখন ভীষণ দরকার।
অসুখ আছে বলছেন! আচ্ছা ঠিক আছে।
লাইন এখন চালু থাকবে তো!
চেষ্টা তো আমরা সবসময়েই করি।
মেশিন সব পুরোনো, বুঝতেই পারছেন।
অপর্ণার অভিজ্ঞতা আছে। লাইন চালু হয়েই ফের বন্ধ হয়ে যায়। সে টেলিফোনটা রেখে আবার তুলল। ডায়ালটোন আছে। নিশ্চিন্ত।
বুবকা উঠে এসেছে। টেলিফোন তুলে নিয়ে বলল, দাঁড়াও, নার্সিং হোমে একটা ফোন করি।
এই তো সন্ধেবেলায় দেখে এলি।
তবু। টেলিফোনটাও একটু বাজিয়ে নেওয়া যাবে।
বাড়ির সকলে যতক্ষণ না ফিরছে ততক্ষণ স্বস্তি নেই অপর্ণার। সন্ধের পর একে একে ফিরতে থাকে সবাই। সকলে যখন ফিরল, কেউ বাকি রইল না, তখন স্বস্তি। অপর্ণা অস্বস্তি টের পাচ্ছে ঝুমকির জন্য। আটটা বাজতে চলল।
অফিসের বদান্যতায় তারা বেশ ভাল আছে। খুব ভাল আছে। বাইরে থেকে তাদের বড়লোক বলেই তো ভাবে লোকে। কিন্তু ভাল থাকাকে বিশ্বাস করে না অপর্ণা। যেদিন পিছনে পেখম ধরার মতো মণীশের মস্ত নামজাদা অহংকারী কোম্পানিটি থাকবে না সেদিন ব্ল্যাকবোর্ডের লিখন মুছে দেবে সময়।
মণীশ বাড়ি করতে আগ্রহী ছিল না। ফ্ল্যাট কিনতে রাজি ছিল, তবে খুব অভিজাত কোনও পাড়ায়। কিন্তু তাতে যা টাকা লাগবে তা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু মণীশ কেবলই বলেছে, হয়ে যাবে। টাকা ঠিক জুটিয়ে নেবো।
কিন্তু সেরকম জুটিয়ে নেওয়ার মানে অর্পণা জানে। হয়তো এমন সোর্স থেকে টাকা জোগাড় করবে যাতে চড়া সুদ দিতে হয়। আর ফলে হাঁড়ির হাল হবে।
অন্যদিকে বুদ্ধি কতটা তীক্ষ্ণ তা অপর্ণা জানে না, তবে টাকা-পয়সার ব্যাপারে তার স্বাভাবিক মেধা খুবই বাস্তববাদী। সে মণীশকে ডুবে-মরার হাত থেকে বাঁচাতে রোজ রাতে পইপই করে বোঝাতো। বুঝিয়ে বুঝিয়ে মুখে ফেনা তুলে অবশেষে মণীশ অতিশয় তাচ্ছিল্য ও উপেক্ষার ভাব দেখিয়ে রাজি হল ইস্টার্ণ বাইপাসের কাছাকাছি অপর্ণার মিনি মাসীর একটা চার কাঠা প্লট কিনতে। দাম খুবই সুসাধ্য। তখনও ওপাশটায় লোকালয় নেই।
দু’বছর আগে জমিটা কেনা হয়েছে। মণীশ একবারও দেখতে যায়নি। ছেলেমেয়েরা দেখে নাক সিঁটকেছে। ওঃ, এই জায়গা!
এই তাচ্ছিল্য ও উপেক্ষা মেনে নিয়েছে অপর্ণা। দেয়াল দিয়ে প্লটটা ঘেরা করিয়েছে।
মাঝে মাঝে সে ওই চার কাঠা জমির কথা ভাবে আর মনটা আনন্দে ভরে যায়। সব জায়গা থেকে উৎখাত হয়ে গেলেও তাদের জন্য ওই চারকাঠা জমি কোল পেতে থাকবে। সেখানে অনেক গাছ লাগিয়ে এসেছিল অপর্ণা। গাছগুলো হয়েছে। তাদের ঘিরে আগাছাও জন্মেছে অনেক।
আজ এই বিষণ্ণ সন্ধ্যায় অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ভাবনার মধ্যে তার কাছে একটা দ্বীপের মতো ভেসে উঠল ওই চারকাঠা জমি। মণীশ, তুমি জানো না, এখন কত হিসেব-নিকেশের দিন এল আমাদের।
মা! একটু চা হবে?
অনু খুব করুণ গলায় বলে।
অপর্ণা মৃদু ধমক দিয়ে বলে, খালি পেটে চা কিসের? আগে কিছু খেয়ে নে। পাঁউরুটি টোস্ট করে দিচ্ছি।
না, কিছু খাবো না। অবেলায় খেয়ে বমি বমি লাগছে। চা দেবে মা?
মোহিনী তো চা খায় না, ওকে একটু মিষ্টি-টিষ্টি দে। দ্যাখ, ফ্রিজে বোধহয় আছে।
মোহিনী বলে, মাসিমা, আমার সঙ্গে ফর্মালিটি কিসের? মিষ্টি আমি খাই না।
তুমি তো চাও খাও না, কত ভাল তুমি! আর দেখ অনুর এ বয়সেই চায়ের নেশা।
টেলিফোনটা রেখে অনীশ রাগের গলায় বলে, ওরা কোনও ইনফর্মেশন দেয় না কেন বলো তো মা?
কেন, কী বলল?
বলল, পেশেন্ট স্টেবল, ঘুমোচ্ছেন।
তাহলে তো ঠিকই আছে। আর কী ইনফর্মেশন চাস?
তুমি বুঝছো না। ফোন ধরেই বলে দিল। তার মানে বাবার কেবিনে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে তো আর বলল না। সবাইকেই বোধহয় এরকম বলে দেয়। আমি বরং একবার গিয়ে ঘুরে আসি।
দূর পাগল! এত অস্থির হওয়ার কী আছে? দু রাত নার্সিং হোমের চেয়ারে বসে কাটিয়েছিস। আজ একটু রিল্যাক্স কর।
মা, তুমি নিজে রিল্যাক্স করতে পারছো কি? বাবা যতক্ষণ না আউট অব ডেনজার হচ্ছে ততক্ষণ আমার রিল্যাক্স করার প্রশ্নই নেই।
টেলিফোনটা আবার বেজে উঠতেই আবার যেন বজ্রাঘাতে কেঁপে ওঠে অপর্ণা। কী হল? ফোন বাজছে কেন?
বুবকা ফোন তুলল, কে? … ওঃ দিদি! তুই কোথা থেকে ফোন করছিস! অ্যাাঁ! …নার্সিং হোম! তোকে কে বলল যে আমাদের ফোন ঠিক হয়ে গেছে! … ওঃ। হ্যাঁ।
অপর্ণা স্তব্ধ হয়ে থাকে। কান ঝাঁ ঝাঁ করছে ভয়ে, উত্তেজনায়।
কী বলছে রে ও?
বুবকা হেসে বলে, দিদি নার্সিং হোমে চলে গেছে। ওখানে ওরাই বলেছে যে বাড়ির ফোন ঠিক হয়ে গেছে। তাই দিনি ফোন করছিল।
নার্সিং হোমে চলে গেছে! আর দেরি দেখে আমি এদিকে ভেবে মরছি।
বুবকা উদাস হাসি হেসে বলে, আমাদের এখন কোনও রুটিন নেই মা। মাথা কারও নর্ম্যাল কাজ করছে না। তোমারই কি করছে, বলো! মঙ্গলবার ওই দৃশ্য দেখার পর… ওঃ ইট ওয়াজ এ নাইটমেয়ার!
অপর্ণা চোখ বুজে শক্ত হয়ে যায়। প্রিয় মানুষের ব্যথা সহ্য করাই বোধহয় পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ। যখন বুক জুড়ে সেই ব্যথার বাঁশি বেজে উঠল মণীশের, সে শুধু চিৎকার করেছিল অপু… অপু… বাঁচাও… মরে যাচ্ছি…
বুক মথিত করা সেই ব্যথা। যেন এক মত্ত মাতঙ্গ পায়ের তলায় পিষে ফেলছে ওর বুক। দুটো চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছিল, বেঁকে যাচ্ছিল মুখ। সে যেন নিত্যকার চেনা মণীশ নয়। এ যেন অন্য মণীশ।
কিছুক্ষণ তারা সকলেই শুধু ‘কি হল কি হল’ বলে উদ্ভ্রান্ত আচরণ করেছিল। সবার আগে স্বাভাবিক বুদ্ধি ফিরে পেল অপর্ণা। সে দৌড়ে বেরিয়ে গিয়ে উল্টোদিকে বাড়ির ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনল। তিনি সাধারণ ডাক্তার। হাট স্পেশালিস্ট নন। কিন্তু প্রাথমিক একটা সামাল দিয়েই বললেন, ইমিডিয়েটলি হসপিটালাইজ করুন। কেস সিরিয়াস।
আজও সেই ঘোষণার ধাক্কা তারা সামলে উঠতে পারেনি। আজও যেন মণীশের সেই ব্যথা এ বাড়িতে রয়ে গেছে।
হঠাৎ ডোরবেল বেজে উঠলে, কেউ জোরে কথা বললে, হঠাৎ দমকা বাতাস বয়ে গেলে কেন যে ধক করে ওঠে অপর্ণার বুক! সামান্য শব্দই বজ্রপাতের মতো চমকে দেয় তাকে। আর অপর্ণার চারদিক যেন এক ঘোর লাগা অবাস্তব। রিয়ালিটি ব্যাপারটা সে ঠিক টের পাচ্ছে না। প্রাণপণে সে স্বাভাবিক থাকতে চাইছে। ঠিকঠাক পেরে উঠছে না। অভিনয় করে যাচ্ছে। রাতে একা ঘরে সে কেন টের পায়, মণীশের বুক—জোড়া গহন ব্যথা গুমরে বেড়াচ্ছে ঘরময়? এরকম ভাবা কি স্বাভাবিক?
এত ভয় করে! এত একা লাগে! এত দুশ্চিন্তা আসে মনে! কাজের মেয়েটা আগে বস্তা পেতে সামনের ঘরে শুততা। তাকে এখন শোওয়ার ঘরের মেঝেতে শোওয়ায় সে।
প্রথমবার মণীশের হৃদযন্ত্র বিনীত ভাবেই তার অক্ষমতা জ্ঞাপন করতে শুরু করেছিল বছর দুই আগে। সেবার খুব মারাত্মক হয়নি। নার্সিং হোমেও যেতে হয়নি। ব্যথাও উঠে যায়নি চৌদুনে। সেদিন সকালে অফিস যাওয়ার সময় খুব হাঁসফাঁস, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা নিয়ে অফিসে যাওয়ার পোশাক সমেত বিছানায় শুয়ে পড়েছিল মণীশ। পাড়ার ডাক্তার দেখেই বলেছিল হার্ট স্পেশালিষ্ট ডাকতে। বড় ডাক্তার এসে মণীশকে বিছানার বাইরে এক পাও নড়তে, সিগারেট ও স্নেহযুক্ত বা মশলাদার খাবার খেতে বারণ করেছিলেন। দিন দশেক শয্যা নিয়ে ছিল মণীশ। সিগারেট ছাড়ল, খাওয়া-দাওয়ার নিয়ন্ত্রণ মেনে নিল। সেবার তারা সবাই মণীশের অনিশ্চয়তা নিয়ে এমন দিশাহারা হয়ে যায়নি। ভেবেছিল, ঠিক হয়ে যাবে।
দশ দিনের মধ্যেই সামান্য ডিগবাজি খাওয়া হৃদযন্ত্র ফের ঠিকঠাক চলতে শুরু করে। মণীশ ফিরে আসে স্বাভাবিক কাজেকর্মে। দুবছর লম্বা সময়। মণীশের হৃদযন্ত্রের কথা আর কারও মনে থাকেনি। মণীশেরও না। রুটিনমাফিক মাঝে মাঝে ই সি জি করা হত। কোনও বেচাল পাওয়া যেত না তাতে।
প্রথমটা ছিল প্রোলগ মাত্র। নেহাতই ভূমিকা। পাঁয়তারা। বহ্বআস্ফোট। লড়াইটা তখন শুরুই হয়নি।
দ্বিতীয়টা এল দিগ্বিজয়ী ঘোড়সওয়ারের মতো। সারা পৃথিবী জুড়ে তার দাপট। বুড়ো-বাচ্চা, ধনী-নির্ধন, পাবলিক-ভি আই পি সকলেই নতজানু তার কাছে। হার্ট অ্যাটাক—এ দুটি শব্দ যেন দামামা বাজিয়ে দেয় বুকে।
কে জানে কেন, হার্ট অ্যাটাক কথাটা অপর্ণার ভাল লাগে। একটা স্পর্ধিত আভিজাত্য, একটা অমোঘ পরিণতির ধ্বনি আছে তাতে। অথচ কী সর্বনেশে ব্যাপার। একটা হার্ট অ্যাটাক মানে কত জন মানুষের কত কী বন্ধ হয়ে যাওয়া।
মণীশ যদি চলেও যায় তাদেরও কত কী বন্ধ করে দিতে হবে। প্রথমেই বন্ধ হবে সব বিলাসিতা, বাহুল্য, বড়লোকী। তারপরও হিসেব করে টিপে টিপে চলা শুরু হবে। এখন যেমন তাদের ছেলেমেয়েরা পাতে মাছ ভাত ফেলে উঠে যায়, অপ্রয়োজন ফ্যাশনের জিনিস কিনে উড়িয়ে দেয় টাকা, অন্যায্য বায়না করে বসে, ঠিক তেমনটি তো আর হবে না।
মোহিনী উঠে এল রান্নাঘরের দরজায়, মাসীমা, যাচ্ছি। আঙ্কল তো এখন আউট অফ ডেনজার, তাই না?
কে জানে বাবা! তুমি কিন্তু রোজ এসো।
আমি প্রায় রোজই আসি। তবে টিউটর পড়াতে আসেন তো সন্ধেবেলায়, তাই এ সময়টায় আসা যায় না।
যখন খুশি এসো। আমি তো বাড়িতেই থাকি।
মোহিনী চলে গেল। আচমকা অপর্ণার মনে হল, আচ্ছা, মোহিনীর সঙ্গে অনীশের কোনও গোপন ভাবসাব নেই তো? আঠারো বছরের ছেলে, চৌদ্দ বছরের মেয়ে!