উড কিং-এর মালিক বদরুল আলম
‘উড কিং’-এর মালিক বদরুল আলম, মনজুরের মেজো মামা। ‘উড কিং’ ছাড়াও ঢাকা শহরে তাঁর আরো দুটি ফার্নিচারের দোকান আছে। মূল কারখানা মালিবাগে। কারখানার সঙ্গে তার হেড অফিস।
এই মুহূর্তে তিনি মালিবাগের হেড অফিসে বসে আছেন। চায়ের কাপে মুড়ি ভিজিয়ে চামচ দিয়ে তুলে তুলে খাচ্ছেন। তাঁর সামনে কারখানার ম্যানেজার ইয়াসিন মোল্লা। ইয়াসিন মোল্লার হাতে গোটা দশেক রসিদ। একটু দূরে কান ধরে ‘উড কিং ফার্নিচারের সৰ্বকনিষ্ঠ কর্মচারী নসু। মিয়া দাঁড়িয়ে আছে। তার বয়স এগার। সে এক টিন তাৰ্পিন তেল পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। বদরুল আলম চা-পর্ব শেষ করেইনসুর শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। নসুকে আসন্ন শাস্তির আশঙ্কাতে খুব উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে না।
বদরুল আলমের বয়স একষট্টি। শক্ত-সমর্থ চেহারার বেঁটেখাটাে মানুষ। তিনি ধমক না দিয়ে কোনো কথা বলতে পারেন না। কিছুদিন হলো আলসার ধরা পড়েছে। আলসারের চিকিৎসা হিসাবে সারাক্ষণ কিছু না কিছু খাচ্ছেন। চায়ে মুড়ি ভিজিয়ে খাওয়া সেই চিকিৎসারই অঙ্গ।
মনজুর ঘরে ঢুকে মামার দিকে তাকিয়ে হাসল। বদরুল আলম সেই হাসির দিকে কোনোরকম গুরুত্ব দিলেন না। এটাও তাঁর স্বভাবের অংশ। যে-কোনো আগন্তুককে প্রথমে কিছুক্ষণ তিনি অগ্রাহ্য করেন। ভাব করেন যেন দেখতে পান নি।
মনজুর পাশের চেয়ারে বসল। মামার দৃষ্টি আকর্ষণের কোনাে চেষ্টা করল না। কারণ সে জানে চেষ্টা করে লাভ হবে না।
ম্যানেজার ইয়াসিন মোল্লা ক্ষীণ গলায় বলল, স্যার, নসুর শাস্তির ব্যাপারটা শেষ করে দেন। ,
বদরুল আলম কড়া গলায় বললেন, শেষ করাকরি আবার কী? তাৰ্পিন তেলের টিনটিা উদ্ধার হয়েছে?
জ্বি স্যার।
তাহলে ঐ টিন থেকে বড় চামচে দুই চামচ তেল খাইয়ে দাও। এটাই ওর শাস্তি।
শাস্তির এই ব্যবস্থায় নসুকে খুব আনন্দিত মনে হলো। সে ফিক করে হেসেও ফেলল। ইয়াসিন মোল্লাকে দেখে মনে হচ্ছে শাস্তির এই ধারাটি তার পছন্দ না। সে বিরস গলায় বলল, স্যার রসিদগুলো একটু দেখবেন? দুই হাজার সিএফটি কাঠ …
বদরুল আলম। শুকনো গলায় বললেন, সব কিছু যদি আমি দেখি তাহলে আপনি আছেন কী জন্যে? এখন যান। নসুকে নিয়ে যান। শান্তি দেন।
তেল সত্যি সত্যি খাওয়াব?
অবশ্যই খাওয়াবেন। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যান।
ঘর খালি হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বদরুল আলম বললেন, আমার এই ম্যানেজার বিরাট চোর। থিফ নাম্বার ওয়ান।
মনজুর বলল, থিফ নাম্বার ওয়ান হলে বিদায় করে দেন না কেন? চোর পোষার দরকার কী?
দরকার আছে। পোষা চোর কী করে চুরি করে সেই কায়দা-কানুন জানা থাকে। ম্যানেজার ব্যাটা চুরি করামাত্র ধরে ফেলি। নতুন একজনকে নিলে তার চুরির কায়দাকানুন ধরতে ধরতে এক বৎসর চলে যাবে। এক বৎসরে সে দোকান ফাঁক করে দেবে, বুঝলি?
হ্যাঁ বুঝলাম।
কিছুই বুঝিাস নাই। ম্যানেজার রসিদগুলো নিয়ে ঘুরঘুর করছে। কেন করছে? কারণ চুরি আছে। ওর মধ্যে। বিরাট ঘাপলা। আমি তাকে কী বললাম? বললাম–আমি কিছু দেখতে পারব না–সে নিজে যেন দেখে। এখন সে নিশ্চিন্ত হয়ে চুরি করবে। আগের মতো সাবধান থাকবে না। ধরা পড়ে যাবে, ক্যাঁক করে ঘাড় চেপে ধারব। বুঝলি?
বুঝলাম।
কিছুই বুঝিস নাই। আমার কাছে কী ব্যাপার?
তোমাকে দেখতে এলাম।
ঠাট্টা করছিস নাকি?
ঠাট্টা করব কেন? মাসে এক বার তোমাকে দেখতে আসি না?
বদরুল আলম চােখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন। মনজুর সত্যি কথাই বলছে। সে মাসে একবার আসে। প্রতি মাসের শেষের দিকে। ঘণ্টা খানেক থাকে।
কেন আসিস আমার কাছে?
তোমাকে দেখতে আসি।
কেন?
কী যন্ত্রণা, এত জেরা করছি কেন?
বদরুল আলম চোখ থেকে চশমা খুলে খানিকক্ষণ মনজুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চশমা খুলে তিনি প্রায় কিছুই দেখেন না। তবু কাউকে বিশেষভাবে দেখার প্রয়োজন হলে চশমা খুলে ফেলেন।
তোর কি শরীর খারাপ নাকি?
হুঁ।
সমস্যা কী?
শরীরের রক্ত ঠিকমতো পরিষ্কার হচ্ছে না।
কালোজাম খা। কালোজামে রক্ত পরিষ্কার হয়।
মনজুর হাসতে হাসতে বলল, শীতকালে কালোজাম পাব কোথায়? তাছাড়া কালোজামের স্টেজ পার হয়ে গেছে। কিডনি যেটা ছিল সেটাও যাই-যাই করছে।
কী বলছিস তুই!
সত্যি। আমি এখন কিডনির সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
ইয়ারকি করছিস নাকি?
ইয়ারকি করছি না। দুজন বড় ডাক্তার তাই বললেন।
বড় ডাক্তাররা কিছুই জানে না। ছােট ডাক্তারদের কাছে যা।
ছোট ডাক্তারদের কাছে যাব?
হ্যাঁ। ওরা যত্ন করা দেখবে। এই পাড়ায় একজন এল.এম.এফ ডাক্তার আছে। ভূপতি বাবু ভালাে। তার কাছে যাবি? ‘আমি নিয়ে যাব। আমার সঙ্গে খুব ভালাে খাতির।
না।
ছোট বলে অবহেলা করিস না। ছোট কাঁচামরিচের ঝাল বেশি।
ঝাল পচা আদারও বেশি। তাই বলে পচা অাদা কোনো কাজের জিনিস না।
বদরুল আলম দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন, পচা আদার কোনো ব্যবহার মনে পড়ে কিনা। মনে পড়ল না।
তোমার কাছে একটা কাজে এসেছি মামা।
টাকা-পয়সার কোনো ব্যাপার না হলে বল। টাকা-পয়সা ছাড়া সব পাবি।
টাকা-পয়সা কি তোমার নেই?
আছে। দেয়া যাবে না। টাকা ব্যবসায় খাটে। ব্যাংকে ফেলে রাখি না।
ব্যাংকে কিছু তো আছে?
তা আছে।
সেখান থেকে এক লাখ দেয়া যাবে?
এত লাগবে কেন?
কিডনি কিনতে হবে। লাখ খানিক টাকা লাগবে কিনতে। অপারেশন করাতে দেশের বাইরে যেতে হবে। সব মিলিয়ে দরকার তিন থেকে চার লাখ টাকা।
বদরুল আলম টেবিলে রাখা চশমা চোখে পরলেন। সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, তুই কি জনে জনে ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছিস?
হ্যাঁ।
কোনো লাভ নাই–অন্য পথ ধর।
অন্য কী পথ ধরব?
তা আমি কী বলব। ভেবে-চিন্তে বার করা। তুই গরিব মানুষ, বাঁধাবি গরিবের অসুখ–দাস্ত, খোস-পাঁচড়া, হাম, জলবসন্ত, তা না… চা খাবি?
না।
খা। চা খা। ফ্রেশ মুড়ি আছে, খেজুর গুড় দিয়ে খা।
মনজুর উঠে দাঁড়াল।
বদরুল আলম বললেন, তুই কি রাগ করে চলে যাচ্ছিস নাকি? রাগ নিয়ে যাওয়া ঠিক না। তুই ঝগড়া করি আমার সঙ্গে। চিৎকার, চেঁচামেচি করা। তাহলে তোর মনটা হালকা হবে। তুই রোগী মানুষ, মনটা হালকা থাকা দরকার।
আমার মন হালকাই আছে।
আরে সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছিস?
হ্যাঁ।
বোস বোস। চা খেয়ে তারপর যা। সিগারেটখোররা বিনা সিগারেটে চা খেতে পারে না। এই জন্যে মুরুব্বিদের সামনে তারা চা খায় না। যা, তোকে সিগারেটের অনুমতি দিলাম। এখন চা খাবি তো? নাকি এখনো না!
মনজুর বসল।
বদরুল আলম গলার স্বর নিচু করে বললেন, মনটা খুবই খারাপ। তোর অসুখবিসুখের জন্যে না। অসুখ-বিসুখ তো মানুষের জীবনে আছেই। এই দেখ না বুড়ো বয়সে আমার হয়ে গেল আলসার।
মন খারাপ কী জন্যে?
আমার ছেলেমেয়েদের ব্যবহারে মনটা খারাপ। তারা এখন লায়েক হয়ে গেছে। সমাজে পজিশন হয়েছে। আমি যে একজন কাঠমিন্ত্রি এই জন্যে তারা লজ্জিত। আমাকে লোকজনের সামনে কীভাবে পরিচয় করিয়ে দেয় জানিস? বলে–ইনি আমার ফাদার। ব্যবসা করেন। টিম্বর মার্চেন্ট। আমি তখন কী করি জানিস? আমি গভীর হয়ে বলি–না রে ভাই। আমি কোনো টিম্বার মার্চেন্ট না। আমি একজন কাঠমিস্ত্রি।
তুমি তো সত্যি কাঠমিস্ত্রি না।
না তোকে বলল কে? কাঠের কাজ আমি করি না? এখনো করি।
চা এসে গেছে। মনজুর সিগারেট ধরিয়েছে। বদরুল আলম খেজুর গুড় দিয়ে মুড়ি চিবুচ্ছেন। ম্যানেজার ইয়াসিন মোল্লা একটু আগে এসে বলে গেছে–নস মিয়ার শান্তি দেয়া হয়েছে। তার্পিন তেল খাওয়ানো হয়েছে। সে এখন বমি করছে। বদরুল আলম বলেছেন–করুক। তুমি ফট করে ঘরে ঢুকবে না। কথা বলছি। এর মধ্যে একবার টেলিফোন এসেছে। বদরুল আলম রিসিভার তুলে রেখেছেন। এখন তাঁর টেলিফোনে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। মনজুরের সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলতে ভালো লাগছে। ছেলেটা ভালো। কোনো কথা বললে মন দিয়ে শোনে–দশজনের কাছে গিয়ে বলে না।
মনজুর।
জ্বি।
আমার সর্বকনিষ্ঠ পুত্রের কাণ্ডকারখানা শুনিবি?
বল।
বিয়ে করার পর মনে করছে–আহা কী করলাম। রাজকন্যা পেয়ে গেলাম। চোখেমুখে সব সময় ‘সখী ধর ধর’ ভাব। মুখে হাসি লেগেই আছে। কী মধুর হাসি। এখন কথা বলে শান্তিনিকেতনী ভাষায়–এলুম, গেলুম এইসব। ব্যাটা রবিঠাকুর হয়ে গেছে!
অসুবিধা কী?
অসুবিধা আছে। সবটা না শুনলে বুঝবি না।— গত বৃহস্পতিবার সকালে বারান্দায় এসে দেখি মতিন নেইল কাটার দিয়ে তার বৌয়ের পায়ের নখ কেটে দিচ্ছে। আমি না-দেখার ভান করে ঘরে ঢুকে গেলাম। তোর মামিকে বললাম— এই কুলাঙ্গারের মুখ দেখতে চাই না। লাথি দিয়ে একে ঘর থেকে বের করে দাও। একে আমি ত্যাজ্যপুত্ৰ করলাম।
নখ কাটা এমন কী অপরাধ?
বৌয়ের পায়ের নখ কেটে দেয়া অপরাধ না? তুই কখনো বৌমার পায়ের নখ কেটে দিয়েছিস?
না।
তাহলে?
আমি কি আদর্শ মানব? আমি যা করব সেটাই ঠিক, অন্যেরটা ঠিক না?
বদরুল আলম বিরক্ত গলায় বললেন, তুই আদর্শ মানব হবি কেন? তুই হচ্ছিাস গাধা-মানব। এখন কথা হলো, গাধা-মানব হয়ে তুই যে কাজটা করছিস না সেই কাজটা আমার কুলাঙ্গার করছে–বৌয়ের পায়ের নখ কেটে দিচ্ছে। তাও কোনো রাখঢাক নেই। বারান্দায় বসে কাটছে। হারামজাদা।
মতিনের বৌকে তো তুমি পছন্দ করা। কর না?
অবশ্যই করি। ও ভালো মেয়ে। ভেরি গুড গার্ল। আমার কুলাঙ্গারটা মেয়েটার মাথা খাচ্ছে। একদিন কী হবে জানিস? এই মেয়ে নেইল কাটার নিয়ে আমার কাছে এসে বলবে, বাবা আমার পায়ের নখগুলি একটু কেটে দিন তো।
মনজুর হেসে ফেলল। বদরুল আলম রাগী গলায় বললেন, হাসছিস কেন? হাসবি না। হাসি-তামাশা এখন আমার সহ্য হয় না। হাসি শুনলেই ব্লাডপ্রেসার বেড়ে যায়।
উঠি মামা?
আচ্ছা যা। কোনো চিন্তা করিস না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখা। গড অলমাইটি ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই।
মনজুর রাস্তায় এসেই রিকশা নিয়ে নিল। আগে হাঁটতে ভালো লাগত। এখন আর লাগে না। কয়েক পা এগোলেই ক্লান্তিতে হাত-পা এলিয়ে আসে। কয়েকবার সে রিকশাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ যে রকম ক্লান্ত লাগছে তাতে মনে হয়–রিকশায় উঠা মাত্রই ঘুমিয়ে পড়তে হবে।
রিকশাওয়ালা বলল, কই যাইবেন সাব?
মনজুর কিছু বলল না। কোথায় যাবে এখনো সে ঠিক করে নি। অফিসে যাওয়া যেত কিন্তু আজ অফিস বন্ধ। তাদের অফিস হচ্ছে একমাত্র অফিস যা সপ্তাহে দুদিন বন্ধ থাকে–শুক্রবার এবং রোববার। আফসার সাহেব তার সব কর্মচারীকে বলে দিয়েছেনদুদিন বন্ধ দিচ্ছি। এই কারণে যাতে বাকি পাঁচদিন আপনারা দশটা-পাঁচটা অফিস করেন এবং মন দিয়ে করেন।
আজ রোববার।
সব জায়গায় কাজকর্ম হচ্ছে। তাদের অফিস বন্ধ। নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকা যেত। শরীরের ক্লান্তি তাতে হয়তো খানিকটা কীটত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অফিস যেদিন থাকে সেদিনই শুধু ঘরে শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। অফিস বন্ধের দিন ইচ্ছে করে বাইরে বেরিয়ে পড়তে। আজ যেমন করছে। অবশ্যি যাবার মতো জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। ট্রেনে করে গ্রামের দিকে গেলে কেমন হয়? পছন্দ হয় এমন কোনো স্টেশনে নেমে পড়া। বিকেলের দিকে ফিরে আসা।
সাব যাইবেন কই?
সামনে।
রিকশাওয়ালা রিকশা টেনে নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তেমন উৎসাহ পাচ্ছে না। বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে।
স্যারের শইল কি খারাপ?
হুঁ।
কী হইছে?
কিডনি নষ্ট–বেশিদিন বাঁচব না।
না বাঁচাই ভালো। বাঁইচ্যা লাভ কী কন? চাউলের কেজি হইল তের টাকা। গরিবের খানা যে আটা হেইডাও এগার টেকা কেজি।
খুবই সত্যি কথা–দেখি তুমি কমলাপুরের দিকে যাও তো।
রেল ইস্টিশন?
হুঁ।
ঘুম আসছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মনজুর শক্ত করে রিকশার হুড চেপে ধরল। ঘুম হচ্ছে অনেকটা মৃত্যুর মতো। মৃত মানুষের শরীর যেমন শক্ত হয়ে যায়-ঘুমন্ত মানুষদের বেলায়ও তাই হয়। শরীর খানিকটা হলেও শক্ত হয়। ঘুমিয়ে পড়লেও হুড ধরা থাকবে। বাকুনি খেয়ে রিকশা থেকে পড়ে যাবার সম্ভাবনা কমে যাবে। অক্ষত অবস্থায় কমলাপুর রেল স্টেশনে পৌঁছানো যেতেও পারে।
অবশ্যি পৌঁছালেও যে শেষ পর্যন্ত কোথাও যাওয়া যাবে তা মনে হয় না। ইচ্ছা মরে যাবে। মানুষের কোনো ইচ্ছাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
কিছুদিন ধরে মনজুরের ইচ্ছা করছে অচেনা একজনের সঙ্গে দীর্ঘ সময় গল্প করা; যে তাকে চেনে না। কিন্তু না চিনলেও যে গল্প শুনবে আগ্রহ নিয়ে। প্রয়োজনে আগ্রহ নিয়ে গল্প শোনার জন্যে কিছু টাকা-পয়সাও দেয়া যেতে পারে। সমস্যা হলো, কেউ গল্প শুনতে চায় না ; সবাই বলতে চায়। সবার পেটে অসংখ্য গল্প।
মেজো মামার সঙ্গে আরো খানিকক্ষণ থাকলে তিনি মতিনের নতুন কিছু গল্প শুনাতেন। গল্প বলতে পারার আনন্দের জন্যে মেজো মামার মতো মানুষও তাকে সিগারেট খাবার অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন।
স্যার নামেন। কমলাপুর আসছে।
মনজুরের নামতে ইচ্ছা করল না। কেমন যেন মাথাটা ঘুরাচ্ছে। বমি-বমি লাগছে। ঝকঝকে রোদ। সেই রোদ এমন কড়া যে চোখে লাগছে। খুবই তীক্ষ কোনো সুচ দিয়ে রোদের ছবি কেউ যেন চোখের ভেতর আঁকছে।
সাব নামেন।
ভাই শোন, এখানে নামিব না। তুমি আমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাও। ভাড়া নিয়ে চিন্তা করবে না। যা ভাড়া হয় তার সঙ্গে পাঁচ টাকা ধরে দেব বকশিশ।
বাসা কোনহানে?
বলছি–তুমি চালাতে শুরু কর, তারপর বলছি।
টাইট হইয়া বহেন।
বসেছি। টাইট হয়ে বসেছি। তুমি আস্তে চালাও।
রিকশাওয়ালা খুবই ধীরগতিতে রিকশা চালাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে রিকশার প্যাসেঞ্জার ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমিয়ে পড়লে ভালাে কথা— অজ্ঞান না হয়ে পড়লেই হয়। রিকশাওয়ালা পথের পাশে গজিয়ে-ওঠা একটা চায়ের স্টলের কাছে এনে রিকশা থামাল। প্যাসেঞ্জার খানিকক্ষণ ঘুমােক। এই ফাঁকে সে টেস্ট দিয়ে এক কাপ চা খেয়ে নিবে। ভাড়া হিসাবে বাড়তি কিছু টাকা পাওয়া যাবে। একটা টাকা চা-টােষ্টের জন্যে খরচ করা যায়। সে চায়ের কাপ নিয়ে উবু হয়ে বসেছে, এমন সময় হৈহৈ শব্দ উঠল। ঘুমন্ত প্যাসেঞ্জার গড়িয়ে রিকশা থেকে পড়ে গেছে। পড়ে গিয়েও তার ঘুম ভাঙছে না। তার মানে ঘুম নালোকটা হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে, নয় মারা গেছে।
লোকজন লোকটাকে ধরাধরি করে তুলছে। তুলতে থাকুক, এই ফাঁকে সে দ্রুত চা-টা শেষ করতে চায়। চা-টা মজা হয়েছে। দ্রুত চা খেতে গিয়ে রিকশাওয়ালা মুখ পুড়িয়ে ফেলল।