৪. উইল স্কারলেট
বেশ বেলা হয়ে গেছে। রোদ-ঝলমল রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে ওরা তিনজন-
রবিন হুড, লিটল জন আর আর্থার এ ব্ল্যাণ্ড। পথচারী অনেকে থমকে দাঁড়িয়ে দেখছে ওদের। চওড়া কাঁধ, এমন সুন্দর স্বাস্থ্য, আর কী দৃঢ়, বলিষ্ঠ পদক্ষেপ-একসাথে এরকম তিনজন যুবকের সাক্ষাৎ সচরাচর মেলে না।
‘আচ্ছা লিটল জন,‘ হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করলো রবিন, ‘সোজা অ্যাংকাস্টারে না গিয়ে কি মনে করে ব্লুবোরে রয়ে গেলে তুমি কাল? আমার কথা শুনলে আজকে আর এই বিপদে পড়তে হতো না
‘বৃষ্টির ভয়ে,’ বিমর্ষ কণ্ঠে বললো লিটল জন। রবিনের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ায়, এবং প্রচুর বকাঝকা আর টিটকারি হজম করতে হওয়ায় মেজাজটা খিঁচড়ে আছে ওর। এছাড়া বেদম পিট্টি খেয়ে শরীরের নানান জায়গায় কম-বেশি বিভিন্ন ধরনের ব্যথা তো আছেই।
‘বৃষ্টি!’ পথের ওপর থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো রবিন হুড। বিস্মিত দৃষ্টিতে চাইলো লিটল জনের মুখের দিকে। ‘ওরে উল্লুক, বৃষ্টি কোথায় পেলে? একটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়েনি গত তিন দিন। বৃষ্টি কেন, কালো মেঘের আভাসও দেখা যায়নি এ তল্লাটে।’
‘বৃষ্টি হয়নি ঠিক, কিন্তু হতে তো পারতো,’ মুখ আঁধার করে বললো লিটল জন। ‘দেবতার ইচ্ছায় বৃষ্টি। ইচ্ছে করলে তিনি পরিষ্কার আকাশ থেকেও বৃষ্টি ঝরাতে পারেন। যদি হতো, তাহলে ভিজে জ্বর আসতো না? তুমি কি তাই চাও?’
কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো রবিন। ‘ওরে শয়তান! ভেবে ভেবে কী অপূর্ব [ক্তি খাড়া করা হয়েছে! এর সাথে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকে কার সাধ্য!’
অসহায় ভঙ্গিতে এপাশ ওপাশ মাথা নেড়ে আবার পা বাড়ালো রবিন হাসিমুখে। ওনা হয়ে গেল সবাই। বেশ কিছুদূর এগিয়ে তেষ্টা পেল রবিনের। গরম হয়ে উঠছে নিটা। পথের ধুলো খেয়ে শুকিয়ে গেছে গলা। একটা বেড়া-ঝোপের ওপাশে ছোট্ট একটা ফোয়ারা দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো ওরা, বেড়া ডিঙাবার সিঁড়ি টপকে চলে গেল পারে। শ্যাওলা ধরা একটা পাথরের নিচ থেকে বেরোচ্ছে বরফের মত ঠাণ্ডা পানি। চুপ্তির সাথে আঁজলা ভরে ভরে পানি খেল ওরা, তারপর একটা ছায়া দেখে শুয়ে পড়লো ধানিক বিশ্রাম নিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে।
বেড়ার ওপাশে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে রাস্তাটা, অন্য পাশে শষ্যের খেতে কচি বুজ পাতার ওপর রোদের মমতা, মাথার ওপর বীচ গাছের পাতায় মৃদু ঝিরঝির াতাসে বুনো থাইম আর বেগুনী ভায়োলেট ফুলের হালকা মিষ্টি গন্ধ। ফোয়ারার অস্পষ্ট লকুল। নিস্তব্ধ, নিঝুম একটা সুন্দর পরিবেশ। মাঝে মাঝে অখণ্ড নীরবতা ভাঙছে হুদূর থেকে ভেসে আসা মোরগের বাঁক, কিংবা এক ফুল থেকে আরেক ফুলে উড়ে াওয়া ভ্রমরের গুঞ্জন, অথবা কাছের কোন গেরস্ত বাড়ি থেকে ব্যস্ত গৃহিণীর উচ্চৈঃস্বর। অনেকক্ষণ একটি কথাও বললো না ওরা, নীরবে আকণ্ঠ পান করে নিচ্ছে যেন স্বর্গের শান্তিধারা। চুপচাপ শুয়ে পাতার ফাঁক দিয়ে দেখছে অসীম নীল আকাশ। অনেকক্ষণ পর পাশ ফিরলো রবিন, তারপর আস্তে করে কনুই দিয়ে গুঁতো দিল লিটল জনের পাঁজরে।
‘দেখো, দেখো। ননীর পুতুল একটা! এইদিকেই আসছে মক্কেল।’
সবাই দেখলো রাস্তা দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে আসছে এক যুবক। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, সৌখিন লোক। উজ্জ্বল লাল রঙের সিল্কের কাপড় তার পরনে, লাল মোজা, মাথায় পরা ভেলভেটের টুপিটাও লাল। বড়সড় একটা সাদা পালক গোঁজা রয়েছে এক চানের পাশে টুপিতে। যুবকের লম্বা, কোঁকড়া, হলুদ চুল নেমে এসেছে কাঁধ পর্যন্ত কি হাতে একটা গোলাপ-মাঝে মাঝে নাকের কাছে নিয়ে শুঁকছে।
‘আহা! কী মিষ্টি!’ হেসে উঠলো রবিন। যেন সোনার ময়না পাখি! দেখে নাও, টিল জন, ভাল করে দেখে চক্ষু জুড়িয়ে নাও। এমন মেয়েলী ব্যাটাছেলে টাকায় ম্বালটা মেলে না।’
‘রঙের বাহার একটু বেশিই মনে হচ্ছে আমার কাছে,’ বললো আর্থার। তবে ঠিক নীর পুতুল বলা যাবে না একে। কাঁধ দুটো দেখেছো? যেমন চওড়া কাঁধ, তেমনি সরু কামর। তাছাড়া হাত দুটো লক্ষ্য করো-ল্যাগব্যাগ করে ঝুলছে না, রীতিমত শক্ত, নুইয়ের কাছে আবার একটু বাঁকা। উঁহু, দুধের বাচ্চা না; সৌখিন হতে পারে, কিন্তু ময়েলী বলা যায় না কিছুতেই। আমার বিশ্বাস, ওই ঝলমলে পোশাকের নিচে পেটা কটা শরীর রয়েছে লোকটার।
‘আমারও তাই মনে হচ্ছে,’ বললো লিটল জন। ‘ঠিকই বলেছে আর্থার। দেখে তটা মনে হয় ততটা ফুলের পাপড়ি নয় ছোকরা।’
‘আরে, দূর!’ বললো রবিন হুড। এইসব কোমল পেলব পুরুষ দেখলে গা-টা ঘিন ন করে ওঠে আমার। ফুলটা ধরেছে কিভাবে দেখো না, আহা-হা! ওটা দিয়ে এক ড়ি দিলেই যেন লুটিয়ে পড়বে ধুলায়। নাহ্, ভুল হয়েছে তোমাদের দুজনেরই। সামনে ড়িয়ে একটা ধমক দাও, দেখবে ইঁদুরের মত কিচ কিচ আওয়াজ তুলে গর্ত খুঁজবে; ‘ চংবা বলা যায় না, সোজা মূর্ছা যাবে। ভাবছি, কে হতে পারে লোকটা?’
‘কোন বিরাট ব্যারনের আদরের দুলাল, সন্দেহ নেই,’ বললো লিটল জন। ‘ওর লিতে চকচকে কিছু মুদ্রা আশা করা অন্যায় হবে না।’
‘ঠিক বলেছো, বললো রবিন। ‘এইসব বিলাসপ্রিয় ধনীর দুলাল দেখলে পিত্তি জ্বলে যায় আমার। যখন ভাবি এইসব অকর্মণ্য, অযোগ্য নর্মানদের তর্জনীর ইঙ্গিতে ওদের ইচ্ছেমত উঠতে বসতে হচ্ছে হাজার হাজার স্যাক্সন প্রজাকে, যাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা টাকা চুষে নিয়ে সুন্দর সুন্দর কাপড় পরে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে এরা, অথচ যাদের পায়ের কড়ে আঙুলের যোগ্যতা নেই এদের; তাদেরই জমিজমা কেড়ে নিয়ে…
‘হয়েছে, হয়েছে,’ হেসে ফেললো লিটল জন। ওর থলেটা খানিক হালকা করার জন্যে এত গরম বক্তৃতার দরকার নেই। তবে, মনে হচ্ছে, ভুল হচ্ছে তোমার কোথাও। নর্মানদের তুলনায় অনেক হালকা ওর চুল, আমাদের মত সাচ্চা স্যাক্সন হওয়াও বিচিত্র নয়। খুব সম্ভব অপাত্রে বর্ষণ হচ্ছে…
‘বাজি রাখো,’ বললো রবিন। মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না। যাই হোক, একটু পরেই জানা যাবে আসল সত্য। তোমার কথা যদি সত্যি হয়, একটা কানাকড়িও নেব না, কিন্তু যদি আমার কথাই ঠিক হয়, ওর গা থেকে ছাল ছাড়িয়ে নিতে কেবল বাকি রাখবো। তোমরা বলছো ওর কাপড়ের নিচে পেশী বলে কিছু আছে, বেশ, চুপচাপ এখানে শুয়ে শুয়ে দেখো কিরকম পিট্টি লাগাই।’ এই বলে বেড়া ডিঙিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালো রবিন, দুই কোমরে হাত রেখে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে দেখছে আগন্তুককে।
কাছে এসে পড়েছে যুবক। ধীর পায়ে হাঁটছে, মাঝে মাঝে গোলাপটা নাকের কাছে নিয়ে শুঁকছে, এদিক তাকাচ্ছে, ওদিক তাকাচ্ছে কিন্তু রবিন হুড বলে যে একটা লোক দুনিয়ায় আছে, লক্ষ্যই করছে না। রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো রবিন, তবু ভূক্ষেপ করলো না যুবক, চলার গতি বাড়লো না, কিংবা কমলো না; যেমন আসছিল, আসতেই থাকলো।
‘দাঁড়াও!’ হুঙ্কার ছাড়লো রবিন। ‘যেখানে আছো, দাঁড়িয়ে পড়ো। এক পা সামনে বাড়াবে না!’
‘কেন, ভাই?’ মৃদু নরম গলায় জানতে চাইলো সুশ্রী যুবক। ‘কেন এক পা সামনে বাড়াবো না? আচ্ছা, ঠিক আছে। বলছো যখন, কিছুক্ষণের জন্যে থেমে না হয় শুনেই যাই তোমার কথা। ‘
‘বেশ,’ বললো রবিন। তুমি যখন আমার কথামত কাজ করছো, নরম, ভদ্র ভাষায় কথা বলছো; ভদ্রতা দেখাতে আমিও কসুর করবো না। আমি হচ্ছি সাধু উইলফ্রেডের পবিত্র প্রতিনিধি। এই পথে যারাই যায়, আমি তাদের কাছ থেকে টোল আদায় করি এবং সে-টাকা ভাল কাজে ব্যয় করি। কাজেই তোমার থলেটা বের করে একটু দেখাতে হবে আমাকে। যদি মনে করি তোমার কাছে যতটা থাকা উচিত তার চেয়ে বেশি আছে, তাহলে বেশিটুকু রেখে দেয়াই আমাদের নিয়ম। সাথে বেশি টাকা রাখা তোমার নিজের জন্যেও খুব একটা মঙ্গলজনক বা নিরাপদ নয়।’
হাসি হাসি মুখ করে রবিনের কথাগুলো শুনছিল আর দু’আঙুলে গোলাপের বোঁটা ধরে সুগন্ধ নিচ্ছিল যুবক, রবিন থামতেই মিষ্টি করে হাসলো। ‘বেশ লাগছে কিন্তু,‘ বললো সে, ‘তোমার কথা শুনতে ভালই লাগছে আমার। আরো কিছু বলার থাকলে বলো, ভাই। হাতে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়াবার সময় আছে আমার।’
‘যা বলার বলেছি,’ গম্ভীর স্বরে বললো রবিন। এবার বের করে ফেল থলিটা। কথা দিচ্ছি, যদি বেশি কিছু না থাকে, একটা পয়সাও নেব না তোমার থেকে। নির্বিঘ্নে চলে যেতে পারবে নিজের পথে।
‘আমি খুবই দুঃখিত,’ নরম গলায় বললো যুবক। ‘তোমাকে দেয়ার মত তেমন কিছুই নেই আমার। এবার তাহলে আমি আসি? নিশ্চয়ই বাধা দেবে না তুমি আমাকে, কারণ, তোমার তো কোন ক্ষতি করিনি আমি।
পা বাড়াতে যাচ্ছিল যুবক, হাত তুলে বাধা দিল রবিন। ‘খবরদার! থলে না দেখিয়ে যেতে পারবে না তুমি।’
‘দেখো, বন্ধু, অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললো যুবক। ‘বিশেষ একটা কাজ আছে আমার। তোমাকে যথেষ্ট সময় দিয়েছি, ধৈর্য ধরে সব কথা শুনেছি তোমার, এবার দয়া করে আমাকে নিজের কাজে যেতে দাও। ঝগড়া-ঝাঁটি করে লাভ আছে কিছু?’
‘তোমার নেই, কিন্তু আমার আছে!’ দৃঢ় কণ্ঠে বললো রবিন। ‘আমার হুকুম অমান্য করে এক পা-ও এগোতে পারবে না তুমি!’ বলেই মস্ত লাঠিটা তুললো সে মাথার উপর।
‘খুবই দুঃখের বিষয়,’ এপাশ ওপাশ মাথা নেড়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো যুবক। ‘এরকম একটা ঘটনা না ঘটলেও পারতো। কিন্তু এখন তোমাকে হত্যা করা ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না।’ বলেই সোনালী কারুকাজ করা চামড়ার খাপ থেকে সড়াৎ করে এক টানে বের করলো সে তলোয়ারটা।
‘তলোয়ার রাখো,’ বললো রবিন। ‘ওক-ডালের লাঠির সাথে তলোয়ার দিয়ে কিছুই করতে পারবে না তুমি, এক বাড়িতে দু’টুকরো হয়ে যাবে তোমার খেলনা। তারচেয়ে, এই দেখো, ওখানে অনেকগুলো ওকের চারা দেখা যাচ্ছে, পছন্দসই একটা লাঠি কেটে নিয়ে এসোগে যাও। অবশ্য,’ যোগ করলো রবিন, ‘যদি পিট্টি খেতে আপত্তি না থাকে।’
রবিনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলালো যুবক, লাঠিটা দেখলো, তারপর বললো, ‘ঠিকই বলেছো তুমি। ওই লাঠির কাছে কিছুই না এই তরবারী। ঠিক আছে, একটু অপেক্ষা করো, আমি এক্ষুণি নিয়ে আসছি লাঠি। কথাটা বলে শেষবারের মত ঘ্রাণ নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল যুবক ফুলটা, তরবারী খাপে পুরে এগিয়ে গেল ওকের চারাগুলোর দিকে। রবিন লক্ষ্য করলো হাঁটার ছন্দ সম্পূর্ণ বদলে গেছে যুবকের, ধীর- স্থির, ঢিলেঢালা ভাবটা অদৃশ্য হয়ে গেছে বেমালুম। পছন্দ মত চারা খুঁজে পেতে দেরি হলো না যুবকের। কাটলো না সেটা, আস্তিন দুটো একটু গুটিয়ে নিয়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো গাছটার গোড়ার দিকে, তারপর পায়ের গোড়ালি দুটো শক্ত করে মাটিতে গেড়ে হ্যাঁচকা এক টানে তুলে আনলো সেটাকে শিকড় সহ। তারপর, যেন এমন কোন বিস্ময়কর কাজ করেনি সে, এমনি ভঙ্গিতে, তলোয়ার দিয়ে শিকড় আর ছোট ছোট শাখা-প্রশাখা ছাঁটতে ছাঁটতে শান্ত পদক্ষেপে ফিরে এলো।
চুপচাপ শুয়ে শুয়ে সব দেখছিল আর্থার আর লিটল জন। গোটা একটা ওকের চারা শিকড় ছিঁড়ে উপড়ে তুলতে দেখে ঠোঁট দুটো শিস দেয়ার ভঙ্গিতে গোল করে লম্বা করে বাতাস টানলো আর্থার। মুখটা হাঁ হয়ে গিয়েছিল লিটল জনেরও, সংবিৎ ফিরে পেয়ে নড়েচড়ে উঠলো। ‘সব্বোনাশ! দেখলে, আর্থার? মনে হচ্ছে বারোটা বাজবে আজ ওস্তাদের। মাই গড! মড়মড়িয়ে তুলে ফেললো আস্ত গাছটা!’
রবিনের মনের ভিতর কি চলছে বোঝা গেল না, তবে দেখা গেল, পিছু হটবার লক্ষণ নেই তার মধ্যে। মুখোমুখি দাঁড়াল এসে মিষ্টভাষী যুবক। শুরু হলো লড়াই।
অল্পক্ষণেই টের পেয়ে গেল লিটল জন আর আর্থার, গায়ে যে কেবল অসুরের শক্তিই রয়েছে তা নয়, লাঠি খেলার সব কৌশলই জানা আছে যুবকের বিলক্ষণ রবিনের কলা-কৌশল যদিও আগন্তুকের চেয়ে অনেক উন্নত মানের, ক্ষিপ্রতায়ও তার তুলনা হয় না, কিন্তু কৌশল আর ক্ষিপ্রতা দিয়ে কতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে সে প্রচণ্ড আসুরিক শক্তিকে? দু’জনের দাপাদাপিতে ধুলোর মেঘ সৃষ্টি হলো রাস্তার উপর মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে ওদের। মাঝে মাঝে শুধু শোনা যাচ্ছে খটাখট অদৃশ্য লাঠির ঠোকাঠুকির আওয়াজ। সুযোগ মত তিনটে বাড়ি কষিয়ে দিয়েছে রবিন ইতিমধ্যেইঃ দু’বার পাঁজরে, একবার হাতের উপর। অনেক চেষ্টা করেও একটিবারও রবিনের শরীর স্পর্শ করতে পারেনি যুবকের লাঠি। কপাল ভাল, প্রতিটা আঘাত ঠেকিয়ে দিতে পেরেছে রবিন; কারণ, যে কোন একটা আঘাতই ওকে ধরাশায়ী করার জন্যে যথেষ্ট ছিল। যুবক যখন দেখলো কৌশলে কিছুতেই এঁটে ওঠা যাবে না রবিনের সাথে, তখন গায়ের জোর খাটিয়ে ওকে পরাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিলো সে। প্রচণ্ড জোরে মারলো সে রবিনের লাঠির মাঝ বরাবর; এতই জোরে, যে থতমত খেয়ে গেল রবিন, লাঠিটা আঁকড়ে ধরে রাখাও মুশকিল হয়ে পড়লো ওর পক্ষে। সামলে নেয়ার বিন্দুমাত্র সময় না দিয়ে আবারও মারলো যুবক। বাঁকা হয়ে গেল রবিনের শরীরটা সে আঘাত ঠেকাতে গিয়ে। সাথে সাথেই এলো তৃতীয় আঘাত। মড়াৎ করে মাঝখান থেকে দু’টুকরো হয়ে গেল রবিনের লাঠি, কিন্তু তাতেও আঘাতের গতি কমলো না, দড়াম করে বাড়ি পড়লো রবিনের কাঁধে, ধরাশায়ী হলো সে।
‘থামো!’ যুবককে আবারও লাঠি তুলতে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। ‘থামো, হার মানছি আমি।’
‘থামো।’ হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে উঠলো লিটল জনও। একলাফে বেড়া ডিঙিয়ে লাঠি হাতে ছুটলো সে ওদের দিকে, পিছনে আর্থার। আবার চেঁচিয়ে উঠলো, ‘থামো! থামো বলছি!’
‘না।’ মারমুখো দুইজন ষণ্ডা চেহারার লোক দেখেও বিন্দুমাত্র ঘাবড়ালো না যুবক। শান্ত গলায় বললো, ‘আরো লোক থাকলে ডেকে আনো তাদেরকে। আমার সাধ্যমত যুঝবো আমি সবার সাথে।’
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, দুই পাশ থেকে আর্থার আর লিটল জনকে লাঠি তুলতে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। হাত তুলে এগোতে নিষেধ করলো সঙ্গীদের। আর মারামারি নয়। দেখা যাচ্ছে দিনটা তোমার-আমার কারো জন্যেই ভালো যাচ্ছে না। বাপরে বাপ! হাতের আঙুল থেকে কাঁধ পর্যন্ত অবশ হয়ে গেছে। এত জোরও থাকে মানুষের গায়ে!’
রবিনের দিকে ফিরলো লিটল জন। ‘আহা-হা, খুব ব্যথা লেগেছে বুঝি, ওস্তাদ? সত্যিই বড় দুঃখজনক ব্যাপার। ধুলো-টুলো লেগে জামা-কাপড় এক্কেবারে শেষ। উঠে পড়ো, আমার হাতটা ধরে উঠে পড়ো।’
‘কুণ্ঠ হোক তোর হাতে! রেগে মেগে বললো রবিন। ‘লাগবে না, আমি নিজেই উঠতে পারবো।’
‘বেশ, উঠে দাঁড়াও, তোমার কোটটা অন্ততঃ ঝেড়ে দেয়া উচিত আমার। আহা! এখনও কি ঝনঝন করছে হাড়গোড়গুলো?’ সমবেদনার সুরে বললো লিটল জন, কিন্তু ওর চোখ দুটো চিক চিক করছে দেখে খেপে গেল রবিন।
‘থামবে তুমি, লিটল জন? টিটকারি মারার আর সময় পেলে না?’ কথাটা বলেই হাসি হাসি হলো রবিনের মুখটা। যা ঝাড়ার ঝেড়ে দিয়েছে এই ছোকরা।’ লাল পোশাক পরা যুবকের দিকে ফিরলো এবার সে, ‘তোমার নামটা জানতে পারি?’,
‘আমার নাম গ্যামওয়েল,’ বললো যুবক।
‘তাই নাকি? আরে!’ ভুরু কুঁচকে উঠলো রবিনের। ওই নামের নিকটাত্মীয় আছে আমার। বাড়ি কোথায় তোমার, বলো তো?’
‘ম্যাক্সফিল্ড শহর থেকে আসছি আমি,’ বললো যুবক। ওখানেই জন্ম, ওখানেই মানুষ। এখানে এসেছি আমার মামাকে খুঁজতে।
‘মামা?’
‘হ্যাঁ। আমার মায়ের ছোট ভাই। লোকে তাকে ডাকে রবিন হুড বলে। যদি তোমরা কেউ বলতে পার কোনদিকে গেলে তার দেখা…’
‘আরে! উইল গ্যামওয়েল!’ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে গেল রবিনের দুই চোখ। দুই হাতে চেপে ধরলো যুবকের দুই কাঁধ। ‘তাই তো! সে-ই তো দেখছি! তোমার ওই সুন্দর মেয়েদের মত চুল দেখেই চিনতে পারা উচিত ছিল আমার। তাছাড়া হাঁটার ভঙ্গিটাও মনে পড়ছে এখন। হাসিটাও চিনতে পারছি। ওরে শয়তান! চিনতে পারছিস আমাকে? ভাল করে দ্যাখ তো চেয়ে?’
‘সত্যিই তো!’ এবার অবাক হবার পালা যুবকের। তুমিই তো রবিন মামা!’ এই বলে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো সে মামাকে, চুমো খেলো দুই গালে।
খুশিতে চিকচিক করছে রবিনের চোখ। যুবকের গালে কপালে চুমো খেয়ে বললো, ‘আশ্চর্য! আট-দশ বছর আগে কি দেখেছিলাম, এখন কি!’ যুবকের আপাদমস্তক দেখলো সে চোখ বুলিয়ে। ‘এত বড় হয়ে গেছিস! মনে আছে, কিভাবে তীর-ধনুক ছুঁড়তে হয়, কিভাবে লাঠি ধরতে হয় শিখিয়েছিলাম আমি তোকে?’
‘সব মনে আছে,’ বললো উইল। ‘ছোটবেলা থেকে তোমাকেই দুনিয়ার সেরা বীরপুরুষ বলে জেনে আসছি। সত্যিই, তোমার পরিচয় জানলে তোমার বিরুদ্ধে লাঠি ধরার সাহস হতো না আমার আজ। খুব বেশি ব্যথা লাগেনি তো, মামা?’
‘আরে না, না,’ চট করে আড়চোখে লিটল জনকে দেখে নিয়ে বললো রবিন, ‘কিচ্ছু লাগেনি। ওসব কথা থাক। তবে, প্রার্থনা করি, ওরকম প্রচণ্ড মার ঠেকানোর মন্দ ভাগ্য যেন জীবনে আর না হয়। ওরেব্বাপ, আঙুলের মাথা থেকে কনুই পর্যন্ত কনকন করছে এখনও! আমারই আপন ভাগনের গায়ে এত জোর দেখে গর্ব হচ্ছে এখন, কিন্তু তখন হাত-পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়ার দশা হয়েছিল, ওকের চারা টেনে উপড়ে আনতে দেখে শুকিয়ে গিয়েছিল কলজেটা। যাই হোক, স্যার এডওয়ার্ড আর তোর মাকে ছেড়ে চলে এলি যে?’
‘খুনের অপরাধে খোঁজা হচ্ছে আমাকে, তাই পালিয়ে এসেছি। আমাদের স্টুয়ার্ড গ্রিমকে মনে আছে তোমার?’
‘মনে আছে। খুবই পাজি লোক। ওকে যদি মেরে থাকো, আমার ধারণা ঠিক কাজই করেছো।
‘শোনোই না,’ বললো উইল। ‘আমাদের প্রতিবেশী ব্যারন ডি লেসির অনেকদিন থেকেই চোখ ছিল আমাদের জমি-জমার ওপর। এগুলো দখল করতে পারলে বিরাট এক এস্টেটের মালিক হতে পারবে সে। বাবা বুড়ো হয়ে গেছেন, একমাত্র সন্তান আমি, কাজেই আমাকে খুন করতে পারলে উত্তরাধিকারীর অভাবে আমাদের সবকিছু চলে যাবে তার হাতে। এই ভেবে টাকা পয়সা দিয়ে হাত করে গ্রিমকে লাগিয়েছিল সে আমার পেছনে।‘
গম্ভীর ভাবে মাথা ঝাঁকালো রবিন। ‘তারপর?’
‘একদিন শিকারে গেছি, গ্রিমও সাথে এলো। ওর উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোন রকম সন্দেহ জাগেনি আমার মনে। একটা ফাঁকা জায়গার কাছাকাছি অপেক্ষা করছি, হরিণ দেখা গেলেই তীর ছুঁড়বো, হঠাৎ কেমন যেন একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো। নিজের অজান্তেই পিছন ফিরলাম। দেখি, ধনুকে তীর লাগিয়ে টেনে ছিলাটা কানের পাশে নিয়ে গেছে গ্রিম-তীরের লক্ষ্যস্থল আমি। এক লাফে সরে গিয়ে ওকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করার চেষ্টা করলাম, আর সেই একই সঙ্গে চট্ করে একটা তীর জুড়ে ফেললাম ধনুকে। একই সাথে তীর ছুঁড়লাম দুজন। ওরটা আমার ডাবলেট (এক ধরনের প্রাচীন আঁটো পোশাক) ভেদ করে সামান্য আহত করলো আমাকে, কিন্তু আমারটা সোজা গিয়ে বিধলো ওর বুকে-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মারা গেল গ্রিম। মরার আগে ডি লেসির নীচ চক্রান্তের কথা সব স্বীকার করে গেছে ও।’
‘তারপর?’
‘গ্রিমের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া মাত্র শেরিফকে লেলিয়ে দিল ডি লেসি আমার পেছনে। গ্রেফতারী পরোয়ানা নিয়ে শেরিফের লোক রওনা হয়েছে জানতে পেরে পালিয়ে এসেছি আমি তোমার কাছে।’
‘ভাল করেছো,’ বললো রবিন। ‘কিন্তু ওই কি পালাবার নমুনা? আমরা তো ভেবেছিলাম বেড়াতে বেরিয়েছে কোনো বড়লোকের বখে যাওয়া বিলাসী নন্দন। অমন ধীরেসুস্থে…’
আমার শরীরের অস্বাভাবিক শক্তিই হয়তো এর কারণ,’ বললো উইল। ‘তাড়াতাড়ি নড়তে চড়তে পারি না। এই দেখো না, একটু আগে তিন তিনবার মেরেছো তুমি আমাকে, অথচ আমি একবারও একটা বাড়ি লাগাতে পারিনি তোমার গায়ে, শেষ পর্যন্ত কৌশল বা ক্ষিপ্রতায় না পেরে গায়ের জোরে মারতে মারতে….’
‘থাক, থাক,’ ব্যস্ত কণ্ঠে বললো রবিন। ‘ওসব কথা থাক। তোমাকে পেয়ে খুবই খুশি হয়েছি আমি। দলের সবাই খুশি, হবে তোমাকে দেখে। কিন্তু, আইনের লোক যখন খুঁজছে তোমাকে, তোমার নামটা একটু পরিবর্তন করে নেয়া ভালো। এখন থেকে তোমাকে ডাকবো আমরা উইল স্কারলেট বলে। কেমন?’
‘উইল স্কারলেট,’ এগিয়ে এলো লিটল জন করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে, ‘বাহ্, চমৎকার হয়েছে নামটা। স্কারলেট রঙের পোশাক পরে এসেছো তুমি, তাই তোমার নাম উইল স্কারলেট। আমি লিটল জন। আর এ হচ্ছে তোমারই মত রবিন হুডের নতুন অনুচর, আর্থার এ-ব্ল্যাও। আমি বলে দিচ্ছি, দারুণ নাম করবে তুমি উইল, তোমাকে নিয়ে গাথা রচনা করবে এই অঞ্চলের কবিরা, ঘরে ঘরে বয়ান হবে তোমার কাহিনী, চারণ কবিরা গাইবে গান। সবাই হাসবে, বড়াই করে বীরত্ব দেখাতে গিয়ে কিরকম পিট্টি খেয়েছিল দস্যু রবিন হুড তার আপন ভাগ্নের হাতে, সেই উপাখ্যান শুনে।’
‘এই, না, লক্ষ্মী জন,’ মিনতির সুরে বললো রবিন, এসব নিয়ে কাউকে কিছু বলার কি দরকার? তোমাকে নিয়েও তো হাসবে লোকে। তারচেয়ে আজকের এই সামান্য ঘটনাগুলো আমরা নিজেদের মধ্যে চেপে রাখলেই তো পারি। কি বলো?’
‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই,’ বললো লিটল জন। ‘বারণ করলে কাউকে কিচ্ছুটি বলবো না। আমি ভেবেছিলাম হাসির গল্প বুঝি খুব পছন্দ করো তুমি। এই যেমন খানিক আগে বলছিলে আর্থারের হাতে আমার পিট্টি খাওয়ার গল্পটা দারুণ জমবে, মনে মনে সাজাচ্ছিলে কি রকম ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলবে কাহিনীটা সবাইকে।’
‘না, না। ভুলে যাও। ওসব সামান্য কথা। কাউকে বলবো না আমি, কথা দিচ্ছি।’
‘কাল সন্ধ্যার সেই মেঘের ব্যাপারটা নিয়েও কি কি সব রসিকতা যেন আসছিল তোমার মাথায়, আর…’
‘কিসের রসিকতা?’ ঝাঁঝালো গলায় বললো রবিন। আসলে ভুল হয়েছিল আমারই। এখন স্পষ্ট মনে পড়ছে, মেঘ ছিল আকাশে, ঝড়-তুফানের খুবই আশঙ্কা ছিল কাল।’
এক গাল হাসলো লিটল জন। ‘আমারও তাই মনে হয়েছিল। তার মানে, তুমি স্বীকার করছো ওই ঝড়-তুফানের মধ্যে ভিজে অ্যাংকাস্টারের দিকে না গিয়ে ব্লু-বোরে রাত কাটিয়ে ভালই করেছি, তাই না?’
‘মর তুই, ব্যাটা!’ সরোষে বললো রবিন। হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভালই করেছিলে।’
‘ঠিক আছে, ওস্তাদ,’ বললো লিটল জন। ‘আজকে কিচ্ছু দেখিনি আমি। তোমাকে মার খেতে দেখিনি, ডিগবাজী খেয়ে ধুলোয় গড়াগড়ি করতে দেখিনি, আরো পিট্টির ভয়ে কাকুতি-মিনতি করে হার মানতে দেখিনি। যদি কোন দুষ্ট লোক এই ধরনের কোন বানোয়াট মিথ্যা কথা বলে, আমার নাম লিটল জন, টেনে ছিঁড়ে ফেলে দেবো তার জিভ!’
খুক খুক করে হেসে উঠলো সবাই, কিন্তু রবিন গম্ভীর। ‘চলো,’ বললো সে, ‘আর এগোবো না আমরা আজ। অ্যাংকাস্টারে আরেক সময় গেলেই হবে। শেরউডে ফিরবো আমরা এখন।’
এই বলে কারও দিকে না চেয়ে ভ্রু কুঁচকে পা বাড়ালো সে ফিরতি পথে।