৪. ইমাম আবু হানিফা (রঃ) (৭০২–৭৭২ খ্রি:)
অধঃপতনের যুগে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নিয়ে যে সকল মনীষীগণ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, পার্থিব লোভ লালসা ও ক্ষমতার মোহ যাদেরকে ন্যায় ও সত্যের আদর্শ থেকে বিন্দু মাত্র পদখলন ঘটাতে পারেনি; যারা অন্যায় ও অসত্যের নিকট কোন দিন মাথা নত করেননি, ইসলাম ও মানুষের কল্যাণে সারাটা জীবন যারা পরিশ্রম করে গিয়েছেন, সত্যকে আঁকড়ে থাকার কারণে যারা জালেম সরকার কর্তৃক অত্যাচারিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত; এমনকি কারাগারে নির্মমভাবে হারিত হয়েছেন, ইমাম আবু হানিফা (রঃ) তাঁদের অন্যতম।
ইমাম আবু হানিফা (রঃ) উমাইয়া খলিফাগণের দুঃশাসন, কুশাসন ও স্বৈরাচারী কার্যকলাপে সমগ্র মুসলিম জাহান আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। তাদের দ্বারা এমন সব জঘন্য কাজ সম্পাদিত হয়েছিল যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। তাদের নিষ্ঠুর কার্যকলাপ কেবল মাত্র নাগরিকদের ধন-সম্পদ ও জীবনের উপর দিয়েই প্রবাহিত হয়নি, নারী জাতির মান-সম্মান ও সতীত্বও ধূলায় ধূসরিত হয়ে গিয়েছিল। মহানবীর আদর্শ ও খোলাফায়ে রাশেদীনের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে শুধু মাত্র ভুলুণ্ঠিতই করা হয়নি; চতুর্থ খলিঠা হযরত আলী (রাঃ) এর নামে রীতিমত জুমআর নামাজে প্রকাশ্য মিম্বরে দাঁড়িয়ে অভিশাপ বর্ষণ করা হত। খিলাফতের স্থান দখল করেছিল রাজতন্ত্র। অত্যাচারের মূর্ত প্রতীক, যুগের অভিশাপ ও কলঙ্ক ইয়াযিদ ইবনে যিয়াদ ও হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নিষ্ঠুর তরবারির আঘাতে সামান্য কথার জন্যে হাজার হাজার মুসলমানের মস্তক দেহ হতে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। লৌহ দণ্ডের প্রতাপে উমাইয়া বংশীয় খলিফাগণ এমন সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল যেখানে কোন প্রতিবাদ তো দূরের কথা কোন প্রকার সংশোধনের কথা মুখে উচ্চারণ করাই ছিল নিজের মৃত্যু ডেকে আনা। তরবারির ভয় দেখিয়ে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করার সমস্ত পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এক কথায় উমাইয়া বংশীয় শাসকগণ ও তাদের বর্বর গভর্নরগণ মুসলিম জাহানে নিষ্ঠুরতার এমন এ নজির স্থাপন করেছিল যা পৃথিবীর ইতিহাসে আজও বিরল।
ঠিক এমনি এক যুগসন্ধিক্ষণে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইসলামের বিবেকী কণ্ঠ ও অন্যায়ের প্রতিবাদী ইমাম আবু হানিফা (রাঃ)। উল্লেখ্য যে উমাইয়া বংশীয় খলিফাগণের। মধ্যে কেবল মাত্র ওয়ালিদ এবং খলিফা ওমর বিন আবদুল আজীজ (রঃ) এর শাসনকালই ছিল ইসলাম ও ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বর্ণযুগ।
ইমাম আবু হাসিফা (রঃ) ৮০ হিজরী মোতাবেক ৭০২ খ্রিস্টাব্দে কুফা নগরীতের জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম হল নুমান। পিতার নাম ছাবিত এবং পিতামহের নাম জওতা। তাঁর বাল্যকালের ডাক নাম ছিল আবু হানিফা। তিনি ইমাম আজম নামেও সর্বাধিক পরিচিত। তাঁর পূর্ব পুরুষগণ ইরানের অধিবাসী ছিলেন। পিতামহ জওতা জন্মভূমি পরিত্যাগ করে তৎকালীন আরবের সমৃদ্ধশালী নগর কুফায় এসে বাসস্থান। নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ইমাম আবু হানিফা (রঃ) বাল্যকালে লেখাপড়ার কোন সুযোগ পাননি। কারণ তখন কুফায় এসে মারওয়ানী খিলাখতের যুগ। আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান ছিলেন খিলাফতের প্রধান এবং যুগের অভিশাপ, নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ছিলেন ইরাকের শাসনকর্তা। দেশের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ইমাম আবু হানিফা (রঃ) ১৪/১৫ বছর বয়সে একদিন যখন বাজারে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে তকালীন বিখ্যাত ইমাম হযরত শাবী (রঃ) তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হে বালক, তুমি কি কোথাও লেখাপড়া শিখতে যাচ্ছো? উত্তরে তিনি অতি দুঃখিত স্বরে বললেন, “আমি কোথাও লেখাপড়া শিখি না।” ইমাম শা’বী (রঃ) বললেন, “আমি যেন তোমাকে মধ্যে প্রতিভার চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। ভাল আলেমের নিকট তোমার লেখাপড়া শিখা উচিত।” ইমাম শা’বী (রঃ) এর উপদেশ ও অনুপ্রেরণায় ইমাম আবু হানিফা (রঃ) ইমাম হাম্মাদ (রঃ) ইমাম আতা ইবনে রবিয়া (রঃ) ও ইমাম জাফর সাদিক (রঃ) এর মত তৎকালীন বিখ্যাত আলেমগণের নিকট শিক্ষা লাভ করেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কুরআন, হাদিস, ফিকাহ, ইলমে কালাম, আদব প্রভৃতি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। জ্ঞান লাভের জন্যে তিনি মক্কা, মদীনা, বসরা এবং কুফার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানরত আলেমগণের নিকট পাগলের ন্যায় ছুটে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থান হতে হাদিসের অমূল্য রত্ন সংগ্রহ করে স্বীয় জ্ঞান ভাণ্ডার পূর্ণ করেন। উল্লেখ্য যে, তিনি প্রায় চার সহস্রাধিক আলেমের নিকট শিক্ষা লাভ করেছিলেন। ইমাম মালেক (রঃ) এর নিকটও তিনি হাদিস শিক্ষা লাভ করেন। ইমাম মালেক (রঃ) যদিও বয়সের দিক থেকে তার চেয়ে ১৩ বছরের ছোট ছিলেন; তথাপি ইমাম আবু হানিফা (রঃ) তাঁকে অশেষ সম্মান করতেন এবং ইমাম মালেক (রঃ) ও ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কে শিক্ষকের ন্যায় সম্মান দেখাতেন। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের আদব কায়দা এমনই হয়ে থাকে। শিক্ষকগণের প্রতি ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এর এত ভক্তি শ্রদ্ধা ছিল যে, তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন, “আমার শিক্ষক ইমাম হাম্মাদ (রঃ) যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন আমি তার বাড়ির দিকে পা মেলে বসিনি। তার কারণ, আমার ভয় হতো শিক্ষকের প্রতি আমার বেয়াদবি হয়ে যায় কিনা।”
কারো কারো মতে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) তাবেয়ী ছিলেন। সাহাবাগণের যুগ তখন প্রায় শেষ হলেও কয়েকজন সাহাবী জীবিত ছিলেন। ১০২ হিজরীতে তিনি যখন মদীনা গমন করেন তখন মদীনায় দু’জন সাহাবী হযরত সোলাইমান (রাঃ) ও হযরত সালেম ইবনে সুলাইমান (রাঃ) জীবিত ছিলেন এবং ইমাম আবু হানিফা (রঃ) তাঁদের দর্শন লাভ করেন। কিন্তু অনেকের মতে তিনি কোন সাহাবীর দর্শন পাননি। তবে তাবে’ তাবেয়ী হবার ব্যাপারে কোন মতবিরোধ নেই। ইমাম আবু হানিফ (রঃ) এর শিক্ষকগণ প্রায় সবাই ছিলেন তাবেয়ী। ফলে হাদিস সংগ্রহের ব্যাপারে তাদের মাত্র একটি মধ্যস্থতা অবলম্বন করতে হত। তাই তাঁর সংগৃহীত হাদিস সমূহ সম্পূর্ণ ছহীহ বলে প্রমাণিত হয়েছে।
তাফসীর ও হাদিস শাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ অভিজ্ঞতা ও পান্ডিত্য থাকা সত্ত্বেও ফিকাহ শাস্ত্রেই তিনি সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে বিবিধ বিষয়ে ইসলামী আইনগুলোকে ব্যাপক ও পুত্থানপুঙ্খ ভাবে আলোচনা করেছেন। বর্তমান বিশ্বের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মুসলমান হানাফী মাজহাবের অনুসারী। ফিকাহ শাস্ত্রে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও অবদানের জন্যেই মুসলিম জাতি সত্যের সন্ধান অনায়াসে লাভ করতে পেরেছে। ফিকাহ শাস্ত্রের উন্নতির জন্যে তিনি ৪০ সদস্য বিশিষ্ট একটি সমিতি গঠন করেন। ইমাম আবু হানিফা (রঃ) ছিলেন সমিতির প্রধান। সমিতির সদস্যদের মধ্যে ইমাম জাফর সাদিক, হাব্বান, ইমাম মুহাম্মদ, ইউসুফ, ইয়াহ ইয়া ইবনে আবি জায়েদা, হাব্বান, ইমাম মুহাম্মদ, ইউসুফ ইবনে খালেদ এর নাম উল্লেখযোগ্য। ইসলামের বিভিন্ন আইন নিয়ে সমিতিতে স্বাধীন ভাবে আলোচনা হত। প্রত্যেকই কোনআন ও হাদিসের ভিত্তিতে নিজ নিজ মতামত ব্যক্ত করতেন। অতঃপর সর্বসম্মতি ক্রমে সঠিক সিদ্ধান্ত গৃহিত হত এবং তা লিপিবদ্ধ করা হত। সুদীর্ঘ ৩০ বছর কাল ইমাম আবু হানিফা (রঃ) ও অন্যান্যদের আপ্রাণ চেষ্টা ও সাধনার ফলে ফিকাহ শাস্ত্রের উন্নতি সাধিত হয়। তিনি তাঁর শিক্ষকতা জীবনে পৃথিবীতে হাজার হাজার মুফাচ্ছির, মুহাদ্দিস ও ফকীহ তৈরি করে গিয়েছেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে যারা ইসলামের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে ইমাম মুহাম্মদ (রঃ), ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ) ও ইমাম যুফার (রঃ) অন্যতম।
ইমাম আবু হানিফার (রঃ) চরিত্র ছিল বহু গুণে গুণান্বিত। তিনি ছিলেন আত্মসংযমী, মহান চরিত্রবান, পরহেজগার, উদার, দানশীল, অতিশয় বিচক্ষণ এবং মুত্তাকিন। তিনি ছিলেন, হিংসা, লোভ, ক্রোধ, পরনিন্দা ইত্যাদি থেকে পবিত্র। বিনা প্রয়োজনে কোন কথা বলতেন না। তিনি সুদীর্ঘ চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত এশার নামাজের ওজু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করতেন। এতে এটাই বুঝা যায় যে, তিনি সারা রাত আল্লাহর ইবাদত ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণায় মগ্ন থাকতেন। তিনি কাপড়ের ব্যবসা করে নিজের এবং পরিবারের জীবিকা উপার্জন করতেন। কতিপয় কর্মচারীর দ্বারা ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ব্যবসায় যাতে হারাম অর্থ উপার্জিত না হয় সে জন্যে তিনি কর্মচারীদের সব সময় সতর্ক করতেন। একবার তিনি দোকানে কর্মচারীদের কিছু কাপড়ের দোষ ত্রুটি দেখিয়ে বললেন, “ক্রেতার নিকট যখন এগুলো বিক্রি করবে তখন কাপড়ের এ দোষগুলো দেখিয়ে দিকে এবং এর মূল্য কম রাখবে।” কিন্তু পরবর্তীতে কর্মচারীগণ ভুল ক্রমে ক্রেতাকে কাপড়ের দোষত্রুটি না দেখিয়েই বিক্রি করে দেন। এ কথা তিনি শুনতে পেরে খুব ব্যথিত হয়ে কর্মচারীদের তিরষ্কার করেন এবং বিক্রিত কাপড়ের সমুদয় অর্থ সদকা করে দেন। তাঁর সততার এ রকম শত শত ঘটনা রয়েছে।
তিনি কখনো সরকারি কোন অনুদান গ্রহণ করেননি। নিজের ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতাকে ঊর্ধ্বে স্থান দিতেন তিনি। উমাইয়া বংশীয় খলিফাঁদের অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আস্তে আস্তে সারা দেশে তীব্র আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে মারওয়ানের শাসনামলে আব্বাসীয় খিলাফতের দাবিদারদের আন্দোলন ছিল তুংগে। এ আন্দোলন সমগ্র ইরাক ও কুফায় উমাইয়া বংশীয় খলিফা মারওয়ানের সিংহাসন কাঁপিয়ে তুলেছিল। ১২৯ হিজরী মারওয়ান তাঁর বিচক্ষণ আমলা ইয়াজিদ ইবনে ওমর ইবনে হুরায়রাকে কুফার গভর্নর নিযুক্ত করেন। ইয়াজিদ ইবনে হুরায়রা শাসন কার্যে ধর্মীয় নেতাদের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। তাই তিনি ক্ষমতা ও অর্থের লোভ দেখিয়ে ধর্মীয় নেতাদের শাসন কার্যে জড়িত কারার চেষ্টা চালান এবং ইতিমধ্যে কয়েকজনকে বড় বড় রাজকীয় পদও দান করেন। তখন সমগ্র ইরাক ও কুফায় ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এর সুনাম, সততা ও জনপ্রিয়তা ছিল সর্বাধিক। ইয়াজিদ ইবনে হুরায়রা ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কে প্রধান বিজারপতির (কাজী) পদ গ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানান। ইমাম আবু হানিফা (রঃ) বুঝতে পেরেছিলেন যে, এটা হল উমাইয়া খিলাফতকে দীর্ঘায়িত করার একটি গভীর ষড়যন্ত্র। তিনি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, প্রাদেশিক জালিম গভর্নরদের অধীনে কাজীর পদ গ্রহণ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বিচার কার্যে উমাইয়া শাসকদের প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের অধীনে কাজীর পদ গ্রহণ করার অর্থ হবে সত্য ও ন্যায়কে জলাঞ্জলী দিয়ে ক্ষমতা ও অর্থের মোহে উমাইয়া জালিম শাসক গোষ্ঠীর গোলামী করা। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, তিনি সরকারী কোন সাহায্য গ্রহণ করতেন না এবং অবৈধ ক্ষমতা ও অর্থের লোভ লালসা তাকে কোনদিন স্পর্শ করতে পারেনি। তাই সত্যকে প্রকাশ করতে তিনি কাউকে কখনো ভয় করতেন না। ইয়াজিদ ইবনে হুরায়রার আমন্ত্রণ পেয়ে শুধুমাত্র প্রত্যাখ্যানই করলেন না বরং সুস্পষ্ট ভাষায় বলেদিলেন, “প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করতো দূরের কথা, মোটা অংকের বেতন দিয়ে ইয়াজিদ যদি মসজিদের দরজা জানালাগুলো গুণবার মত হালকা দায়িত্বও দেয়, তথাপি এ জালেম সরকারের অধীনে আমি তা গ্রহণ করব না।” এতে ইয়াজিদ ক্ষিপ্ত হয়ে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দী করেন। এরপর কারাগারে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করার জন্যে অনুরোধ জানান। কিন্তু এতেও তিনি রাজি না হওয়ায় কারাগারে প্রতিদিন তাঁকে বেত্রাঘাত করা হত। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (রঃ) নির্যাতনের ভয়ে জালিম সরকারের নিকট মাথা নত করেননি। অবশেষে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি মক্কায় চলে আসেন।
১৩১ হিজরীতে উমাইয়া শাসনের অবসান ঘটলে আব্বাসীয় খিলাফতের সূচনা হয়। ইমাম আবু হানিফা (রঃ) মক্কা থেকে কুফায় ফিরে আসেন। আব্বাসীয়গণ ইতিপূর্বে আহলে বাইয়াতদের পক্ষে আন্দোলন করলেও, ক্ষমতা লাভের পর আহলে বাইয়াতদের প্রতি খড়গহস্ত হয়ে উঠেন এবং ধর্মীয় নেতাদের প্রতি নিষ্ঠুর ও অমানবিক নির্যাতন চালাতে শুরু করেন। আব্বাসীয়গণ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী উমাইয়া বংশীয়দের প্রায় সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এমন কি উমাইয়া খলিফাঁদের কবর খুঁড়ে তাদের অস্থি পাজর তুলে এনে জ্বালিয়ে ফেলেছিল। আব্বাসীয় বংশীয় খলিফা মনসুর সিংহাসনে বসে আহলে বাইয়াত ও আলেম সমাজের প্রতি অত্যাচারের স্টীম রোলার চালান।
১৪৫ হিজরীতে মুহাম্মদ নাফসে জাকিয়া খলিফা মনসুরের অনৈসলামিক ও অমানবিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং যুদ্ধে শহীদ হন। ইমাম মালেক (রঃ) ও ইমাম আবু হানিফা (রঃ) সহ প্রায় সকল ধর্মীয় নেতাগণ মুহাম্মদ নাফসে জাকিয়ার পক্ষে ছিলেন। নাফসে জাকিয়া শহীদ হবার পর তাঁর ভ্রাতা ইব্রাহীম বিদ্রোহের পতাকা স্বহস্তে তুলে নেন এবং তঙ্কালীন দীনদার মুসলমান ও আলেম সমাজ ইব্রাহীমের পতাকাতলে সমবেত হতে লাগলেন। জানা যায়, একমাত্র কুফা নগরেই বিশ লক্ষ মুসলমান মনসুরের বিরুদ্ধে মুহম্মদ ইব্রাহীমের পক্ষে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত গ্রহণ করেছিল। ইমাম আবু হানিফা (রঃ) মুহাম্মদ ইব্রাহীমকে গোপনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্যে প্রচুর অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। যুগের নিষ্ঠুর ও জালেম মনসুর গোপনে বহু উপঢৌকন পাঠিয়ে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কে হাত করতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অবশেষে ১৪৬ হিজরীতে খলিফা মনুসুর ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কে বাগদাদে খলিফার দরবারে তলব করেন। তিনি খলিফার দরবারে উপস্থিত হলে তাঁকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করার অনুরোধ জানান। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (রঃ) জালেম সরকারের অধীনে এ পদ গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে একটা মনসুরের গভীর ষড়যন্ত্র। এছাড়া এ পদ গ্রহণ করার অর্থ হবে ন্যায়, ইনসাফ ও ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে জালেমের পূজারী করা। তাই ইমাম আবু হানিফা (রঃ) খলিফা মনসুরকে বললেন, “আমি প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করার যোগ্য নই।” এতে খলিফা রাগান্বিত স্বরে বললেন, আপনি মিথ্যাবাদী। প্রতুত্তরে ইমাম সাহেব বললেন, “আপনার কথা যদি সত্যি হয় (অর্থাৎ আপনার কথানুযায়ী আমি যদি মিথ্যাবাদী হই) তাহলে আমার কথাই সঠিক। কারণ একজন মিথ্যাবাদী রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি পদের যোগ্য নয়।” অতঃপর খলিফা মনসুর কোন উত্তর দিতে না পেরে ক্রুদ্ধ হয়ে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দী করার নির্দেশ দেন। কারাগারে বসেও ইমাম আবু হানিফা (রঃ) ফিকাহ শাস্ত্রে তাঁর কঠোর সাধনা চালিয়েছিলেন। কারাগারে বসেই তিনি বিভিন্ন কঠিন মাসআলার জবাব দিতেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে শত শত মানুষ এসে কারাগারেই মাসআলা শিক্ষা লাভ করে যেতেন। ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ) লিখেছেন, ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কেবল মাত্র কারাগারে বসেই ১২ লক্ষ ৯০ হাজারের অধিক মাসআলা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এরপর খলিফা মনসুর একদিন খাদ্যের সাথে বিষ মিশিয়ে দেন। ইমাম আবু হানিফা (রঃ) বিষ ক্রিয়া বুঝতে পেরে সিজদায় পড়ে যান এবং সিজদা অবস্থায়ই তিনি ১৫০ হিজরীতে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।
ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এর মৃত্যুর সংবাদ বিদ্যুতের গতিতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশের সর্বস্তরের লোকজন মৃত্যুর সংবাদ শুনে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। কথিত আছে, তার জানাজায় পঞ্চাশ হাজারের অধিক লোক অংশ গ্রহণ করেছিল; কিন্তু লোকজন আসতে থাকায় ৬ বার তাঁর জানাজা পড়া হয়েছিল। তাঁর অছিয়ত অনুযায়ী বিজরান গোরস্তানে তাকে দাফন করা হয়।