আরও আগের দিন
সলসবেরির একটা অতি প্রাচীন হোটেলের অতি আধুনিক ধরনে সাজানো খাবার ঘরে ব্রেকফাস্ট পরিবেশিত হচ্ছিল। কোনো টেবিলই খালি নেই দেখে সোম অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে ফিরে আসবে ভাবছে—একজন ওয়েটার এসে তাকে চাপা গলায় বলল, ‘আমার সঙ্গে আসুন স্যার।’
ওয়েটার তাকে যেখানে নিয়ে বসতে দিলে সেখানে সে কাল রাত্রে বসে ডিনার খেয়েছিল, সেই সূত্রে জায়গাটা তার হয়ে গেছে। এবং তার সম্মুখে আসনটা মিস স্কটের। মিস স্কট তার আগেই এসেছেন, তাঁর খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এল।
সোমকে দেখে মিস স্কট খাবার মুখে-থাকা অবস্থায় bow করলেন। সোমও bow করে কী কী খেতে চায় ওয়েটারকে ফরমাশ করল। ওয়েটার চলে গেল।
সোম বিনীতভাবে বলল, ‘কাল আপনাকে ভালো করে ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি, মিস স্কট।’
‘কী কারণে, মিস্টার সোম? এমন কী অপরাধ করেছি যার দরুন ধন্যবাদ আমার পাওনা?’—(কপট আতঙ্কের ভঙ্গিতে।)
‘আপনি ভুলতে পারেন, কিন্তু আমি কি ভুলতে পারি কাল আপনি যে উপকার করেছেন?’
‘বটে?’—মিস স্কট মুচকি হেসে রুটির সঙ্গে মার্মালেড মাখাতে লাগলেন।
সোমেরও পরিজ এসে গেছিল। কিছুক্ষণ সোম নীরব রইল। মিস স্কটের খাদ্য শেষ হয়েছিল, পানীয় ঈষৎ বাকি ছিল। তিনি কথা বলবার সুযোগ পেয়ে বললেন, ‘ঘর পছন্দ হয়েছে?’
(খেতে খেতে) ‘হুঁ।’
‘তা হলে এইখানেই কিছুদিন থেকে যাবেন?’
‘উঁহু।’
‘উঁহু? তবে ঘর পছন্দ হয়নি?’
‘হুঁ।’
‘ছিঃ ছিঃ, আমি কী অভদ্র! আপনার খাওয়াতে বাধা দিচ্ছি।’
কথা বলবার সুযোগ পাবার জন্যে সোম এক নিঃশ্বাসে খাওয়া শেষ করল। প্লেট থেকে হাত তুলে নিয়ে ও হাত থেকে চামচ নামিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল, ‘না, না, না। বাধা আপনি দিতে যাবেন কেন? দিচ্ছিল ওই পরিজটা। ওকে পরাস্ত করে উদরালয়ে পাঠিয়েছি। এখন আমি শত্রুশূন্য।’
ঠিক এমনি সময়ে ওয়েটার আরেক শত্রুকে সমরক্ষেত্রে অবতীর্ণ করল নিজে সারথি হয়ে। মিস স্কট মুচকি হাসলেন। সোম অপদস্থের কাষ্ঠ হাসি।
নিজের খাওয়া শেষ হলেও মিস স্কট উঠে গেলেন না। সোমের খাতিরে অপেক্ষা করতে থাকলেন। সোম অনুযোগ জানিয়ে বলল, ‘আমার মতো কুঁড়ে মানুষ কতক্ষণে উঠবে তার ঠিক নেই। মিথ্যে কেন একটা ঘণ্টা নষ্ট করবেন?’
মিস স্কট এর উত্তরে বললেন, ‘যেমন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে খাচ্ছেন এক ঘণ্টা বসে থাকলে আপনি কড়ি-বরগাও বাকি রাখবেন না। আমি পাহারায় বসলুম।’
‘কিন্তু যে মানুষ কড়ি-বরগা খেয়ে ক্ষুধা মেটাতে যায় সে সামনের মানুষকেও ছাড়বার পাত্র নয়। পাহারাওয়ালা, হুঁশিয়ার।’
মিস স্কট তাঁর নীল নয়নের কটাক্ষ হেনে বললেন, ‘ক্যানিবালরাও নারীমাংস খায় না শুনেছি, ওরাও শিভ্যালরি বোঝে।’
সোম বলল, ‘কিন্তু একালের নারী যে শিভ্যালরির অযোগ্যা। ট্রেনে ট্রামে বাসে নারীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও পুরুষ জায়গা ছাড়ে না, খবরের কাগজের উপর চোখ ফিরিয়ে নেয়।’ মিস স্কটের আরক্ত মুখ লক্ষ করে ‘বরঞ্চ বলতে পারা যায় নারীরা শিভ্যালরি দেখায় পুরুষদের জন্যে ট্রেনের দরজা খোলা রেখে, হোটেলে জায়গা জোগাড় করে দিয়ে।’
মিস স্কট বললেন, ‘নিন, ওটুকু খেয়ে নিন। তাড়াতাড়ির কোনো দরকার নেই। আমি পালাব না।’ (তাঁর মুখভাবে প্রসন্ন মমতা।)
দু-জনে লাউঞ্জে গিয়ে বসল। ঘরটার অস্থিকঙ্কাল পুরোনো কোন যুগের। রক্তমাংস আধুনিক। আরও অনেকে জটলা করছিলেন, কিংবা চশমা চোখে দিয়ে খবরের কাগজে মন দিয়েছিলেন, কিংবা চশমা চোখে দিয়ে পঞ্চাশবার সেলাই করা অকেজো মোজাকে অন্যমনস্ক হয়ে রিফু করছিলেন।
সোম সিগারেট কেসটা মিস স্কটের সামনে ধরে নীরব অনুরোধ জানাল। মিস স্কট মৃদু হেসে একটি নিলেন। বললেন, ‘আগেকার যুগে পুরুষরা স্মোক করবার আগে নারীদের অনুমতি ভিক্ষা করতেন। এখন নারীদের ঘুষ দেন।’
‘যাই বলুন, ঘুষ খেতে মিষ্টি লাগে।’
‘খাওয়াতেও।’
‘সকলকে না। তেমন তেমন নারীকে।’
‘খাওয়াবেন তো একটা আধ পেনি দামের সিগারেট। তাও তেমন তেমন নারীকে? আমি হলে charwoman-কে ডেকে এক প্যাকেট সিগারেট এবং এক বাক্স দেশলাই উপহার দিতুম।’
সোম কপট ধিক্কার দিয়ে বলল, ‘মিস স্কট! Charwoman কাকে বলছেন? Charlady। সেও আপনাকে এক প্যাকেট সিগারেট উপহার দেবার স্পর্দ্ধা রাখে।’
‘ও হো হো। ভুল হয়ে গেছিল। Charlady! শুনবেন একটা গল্প? এক ভদ্রমহিলার বাড়ি এক washer-woman কাপড় নিতে গেছে। বাইরে থেকে চেঁচিয়ে বলছে, ‘Maid! maid! house assistant. Is that woman at home? It is the washer-lady calling।’
সোম হাসতে লাগল। সিগারেটের ছাই ঝেড়ে বলল, ‘এ গল্পটা শুনে আরেকটা গল্প মনে পড়ল। বিশ্ববিখ্যাত নর্তকী পাভলোভা নিউ ইয়র্কের কোনো হোটেলে উঠেছেন, খাবার ঘরে খেতে বসেছেন। তাঁর একটু দূরে তাঁর অর্কেস্ট্রার কণ্ডাক্টার—কী নাম? মনে পড়ছে না, ধরে নিন Stier—ওয়েটারের জন্যে অপেক্ষা করছেন, ওয়েটার আসেই না। বেশ একটু দেরি করে সেজেগুজে এল, এসে বলল, ‘হ্যালো, ম্যান, কী দিতে হবে তোমাকে?’ Stier লোকটা অস্ট্রিয়ান, ইউরোপের সবচেয়ে কেতাদুরস্ত দেশের লোক। অবশ্য এখন অস্ট্রিয়া সোশ্যালিস্ট হয়েছে। তখন অস্ট্রিয়ার সম্রাটরা ইউরোপের অভিজাততম।’
মিস স্কট বাধা দিয়ে বললেন, ‘আমাদের রাজাদের চেয়ে!—’
সোম অপ্রতিভ হয়ে বলল, ‘আহা, এমন করে বাধা দিলে গল্প এগোবে কেন?’
মিস স্কট আবার বাধা দিয়ে বললেন, ‘আর এগিয়ে কাজ নেই। অত লম্বা গল্প কে শুনতে চায়?’
গল্পটা সোমের পেটে গজগজ করছিল। মিস স্কটকে শোনাবেই। পুনরায় আরম্ভ করল, ‘তা, Stier তো হতভম্ব। কোথায় তাঁকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করবে ও বিলম্বের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করবে—’
মিস স্কট বললেন, ‘আপনি আজ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন?’
‘আপনাকে তো আমি কথা দিইনি অমুক সময় আপনার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট খাব?’
‘তা হলে Stier-কেও সেই ওয়েটার কথা দেয়নি যে অমুক সময়ে ব্রেকফাস্ট খাওয়াবে।’
‘আহা, অমন করলে গল্পটা মাঠে মারা যাবে, মিস স্কট। শুনুন শেষ পর্যন্ত। মজার কথা আছে শেষের দিকে।’
মিস স্কট চোখ বুজে হাত-পা অসাড় করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। যেন প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
সোম বলল, ‘আমি কি আপনার উপর অপারেশন করতে চাইছি?’
‘আমার তন্ময় ভাব নষ্ট করবেন না, মিস্টার সোম। গল্পটা একদৌড়ে বলে যান।’
ওয়েটার তার কার্ডখানা Stier-এর হাতে দিয়ে বলল, ‘আমার নাম জেরেমায়া ওয়াশিংটন স্মিথ। যখন আমাকে দরকার হবে তখন কারুর হাতে এই কার্ডটা পাঠিয়ে দিলে আবার আমি আসব’।’
মিস স্কট সকৌতূহলে চোখ মেলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সত্যি?’
‘সত্যি। কিন্তু কার্ডের উপরকার নামটা আমার ঠিক মনে নেই। বানিয়ে বললুম।’
মিস স্কট আবার চোখ বুঁজলেন।
‘যাবার সময় ওয়েটার বাবাজি পাভলোভার দিকে আঙুল উঠিয়ে বলল, ‘ওই womanটাকে এতগুলো মানুষ ঘিরে বসেছে। Womanটা কেউ হবে টবে?’
মিস স্কট লাফ দিয়ে উঠে বসলেন।
সোম বলল, ‘Stier নিজের অপমান সইতে পারেন, কিন্তু মনিবের অপমান। বিশেষত তিনি যখন মহিলা, রানির মতো সম্মানে অভ্যস্তা! তারপর—’
মিস স্কট এবার দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তারপর যা হল তা কাল শুনব, মিস্টার সোম। আপনি তো এখানে কাল পর্যন্ত থাকছেন।’
সোম চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, ‘কে বলল, মিস স্কট? আমি আজকেই ব্রিস্টল যাচ্ছি।’
‘ওমা, তখন যে বললেন থাকছেন।’
‘বলেই যদি থাকি, তাই শেষ কথা নয়। এখানে আমার ভালো লাগছে না। বড়ো বেশি মানুষ এ বাড়িতে।’
‘ইস্টারের মলয় কোনখানেই বা কম?’
‘তবু ব্রিস্টল আমি যাব। ওখানে আমার দেশের একজন শ্রেষ্ঠ মানুষের সমাধি আছে।’
‘তিন দিন পরে গেলেও তো থাকবে।’
‘তিন দিন কার খাতিরে এখানে কাটাব? আপনার?’
‘বেশ! আমার। আমার কি একটা কৃতজ্ঞতার দাবি নেই ভাবছেন?’
সোম পুলকিত হল।
মিস স্কট সোমের পুলক অনুমান করে কথাটা ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমার সঙ্গিনীর ঘরটা সঙ্গিনীর অনুপস্থিতি হেতু আপনি পেয়েছেন। আপনি ছেড়ে দিলে ভাড়াটা আমার সঙ্গিনীর ঘাড়ে পড়বে। কাজেই আমার স্বার্থ হচ্ছে আপনাকে আটকানো।’
‘এতই সঙ্গিনীর প্রতি দরদ?’
‘দরদটা কি অস্বাভাবিক?’
‘তবু সর্বদা দরদ সঙ্গিনীটির পাওনা নয়। তিনি অনুপস্থিত যখন হয়েছেন জেনেশুনে, ভাড়াও দিতে প্রস্তুত আছেন। আর আমি বেচারা এক রাত্রি তাঁর স্থানে officiate করেছি বলে আর তিন রাত্রি করতে বাধ্য হব?’
‘সে কি আপনার কম সৌভাগ্য?’
‘তবে সৌভাগ্যটাকে আরও অপ্রত্যাশিত করুন। আসুন আমার সঙ্গিনী হয়ে ব্রিস্টলে।’
‘ব্রিস্টলে আমার এক মাসিমা থাকেন। সে-কথা জানা আছে মশাইয়ের?’
‘মাসিমা তো বাঘ ভাল্লুক নয়।’
‘সেই-জাতীয়। ছুটিটা মাটি করতে চাই নে, মিস্টার সোম।’
মিস স্কট চলে যাচ্ছিলেন! সোম বলল, ‘মাসিমার বাড়ি ফাঁসি যেতে কে আপনাকে বলছে মিস স্কট? ছোটোখাটো হোটেল কি ব্রিস্টলে নেই?’
মিস স্কট উত্যক্ত হয়ে বললেন, ‘পারব না আপনার সঙ্গে তর্ক করে। ব্রিস্টলের ট্রেন ওবেলা ধরলেও চলবে। আমার সঙ্গে বেরোবেন দয়া করে, না, এই ঘরে বসে সবাইকে নিউ ইয়র্কের গল্প শোনাবেন? বাড়ি কোথায় আপনার? নিউ ইয়র্কে?’
‘ইন্ডিয়ায়।’
‘তা হলে নিগার নন?’
‘নিগার না হই, নিগারের মতো রঙিন। দেখে ঘৃণা হয়?’
‘কখনো না, বরঞ্চ শ্রদ্ধা হয়।’
‘হবেই তো। সূর্যদেব কত যত্নে আমার দেহের চামড়া ট্যান করেছেন, আমি যেন মূর্তিমান সূর্যালোক। লোকে আমাদের বুদ্ধি-বিদ্যার নিন্দা যত খুশি করুক, সভ্যতার অভাব দেখাক, কিন্তু চামড়ার অগৌরব রটায় কেন বলুন তো?’
মিস স্কট হেসে বললেন, ‘লোকগুলো হিংসুটে। আপনাদের বর্ণাঢ্যতা দেখে ওদের গাত্রদাহ হয়।’
‘লাঙুলহীন শৃগাল। নিজেরা শীত বরফের দেশে বাস করে বর্ণসম্পদ খুইয়েছেন। যাদের আছে তাদের বলেন কি না রঙিন মানুষ। গৌরবের কথা নয়, যেন কত বড়ো একটা তামাসার কথা।’
দু-জনেই হাসতে লাগল। সোম জানত কালো রঙের প্রতি মেয়ের সহজ পক্ষপাত। কিন্তু সমাজের চাপে এই পক্ষপাত বিরূপভাবে পরিণত হয়ে থাকে। মিস স্কটের সহজ পক্ষপাতকে পাছে সলসবেরির এই হোটেলের গণ্যমান্যদের সমাজ বিকৃত করে দেয়, পাছে মিস স্কট তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে গিয়ে চোখে চোখে উপহসিত হন, সেই জন্যে সোম তাঁকে নিয়ে ব্রিস্টলের মতো বৃহৎ শহরের জনতায় অলক্ষিতভাবে ফিরতে ও নির্জন বোর্ডিং হাউসে অনিন্দিতভাবে থাকতে চায়।
সলসবেরির ক্যাথিড্রাল কুতবমিনারের সমসাময়িক। ইংল্যাণ্ডের বৃহত্তম ক্যাথিড্রালদের অন্যতম। তার nave, তার choir, তার aisles ইত্যাদি পরিদর্শন করবার সময় মিস স্কটের উচ্ছ্বাস উদ্দাম হয়ে ওঠে—তাঁর স্বদেশের কীর্তি! কালের শাসনকে তুচ্ছ করে এসেছে সাত শত বছর!
সোমও নীরব হয়ে ভাবে। ইংল্যাণ্ড দেশটা ভারতবর্ষকে পেয়ে হঠাৎ বড়ো মানুষ হয়নি। তিন-শো বছর আগে তার শেকসপিয়র ছিল, সাত-শো বছর আগে তার সলসবেরি ও লিংকন ক্যাথিড্রাল ছিল। ভারতবর্ষকে পাবার আগে সে পাবার যোগ্য হয়েছে।
সোম কাব্য করে বলল, ‘মিস স্কট, সলসবেরির নির্মাতারা যে সময় ক্যাথিড্রালের ভিত্তিপাত করছিল নিজেদের অজ্ঞাতসারে সেই সময় সাম্রাজ্যেরও ভিত্তিপাত করছিল। যারা ক্যাথিড্রাল গড়তে শুরু করে তারা সাম্রাজ্য না গড়ে শেষ করে না।’
কথাটা বলে ফেলেই সোম মনে মনে ভ্রম স্বীকার করল। ক্যাথিড্রাল বেলজিয়মও গড়েছে, কই তার সাম্রাজ্য?
মিস স্কট বললেন, ‘এক-শোবার। আমাদের সাম্রাজ্য কি একদিনের সৃষ্টি! এইসব নাম-না-জানা স্থপতি তার পরিকল্পনা আমাদের জাতীয় মনের মধ্যে রোপণ করেছিল, সন্দেহ নেই। বৃহৎ কীর্তির অভিলাষ আমরা চিরকাল মনে রেখে এসেছি, মিস্টার সোম।’
মিস স্কটকে ব্যথা দেবার ইচ্ছা ছিল না সোমের। নতুবা জ্ঞাপন করত যে বৌদ্ধ যুগের স্তূপ, হিন্দু যুগের মন্দির ও মুসলমান যুগের মসজিদ ভারতবর্ষের অলিতে গলিতে আছে, এবং তাদের মধ্যে অন্তত হাজারটা সলসবেরির ক্যাথিড্রালকে আকারে ও সৌন্দর্যে লজ্জা দিতে পারে। সোমকে মুগ্ধ করছিল ইংরেজের স্বদেশপ্রীতি। ভারতবর্ষের লোক দিল্লির মসজিদে দাঁড়িয়ে সম্প্রদায়কে স্মরণ করে, কালিদাস বাঙালি কিনা তারই গবেষণায় জীবন ক্ষয় করে। ছোটো ভাবনা ভাবতে ভাবতে মানুষগুলো খর্বকায় বামন হয়ে কুঁড়ে ঘরে বাসা বেঁধেছে। কীর্তিও হয়েছে সেই অনুপাতে ক্ষীণ।
সোম বলল, ‘আসুন মিস স্কট, বেশিক্ষণ দেখলে শুনলে ক্যাথিড্রালের সঙ্গে প্রেমে পড়ে যাবেন। তাহলে পুরুষ জাতটা ঈর্ষায় বুক ফেটে মরবে।’
‘গোটা পুরুষ জাতটা?’
‘গোটা পুরুষ জাতটার প্রতিনিধি হিসেবে কোনো একজন পুরুষ।’
‘বটে?’
‘বটে!’
‘ক্যাথিড্রালের উপর প্রেমিকের ঈর্ষা, এমন অদ্ভুত কথা জন্মে শুনিনি। (কলহাস্য)। আপনি শুধু প্রেম করে বেড়ান, না কাব্যও করে থাকেন?’
(Bow করে) ‘না, ম্যাডাম। আমি অতটা শৌখিন নই। কাজের মানুষ বলে আমার সুখ্যাতি আছে।’
‘আমিও তো কাজের মানুষ। কই আমার তো ওসব আসে না?’
‘কীসব আসে না?’
(সরলতার ভান করে) ‘ওই সব। প্রেম করা। কাব্য করা। ক্যাথিড্রালকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে তার সঙ্গে ডুয়েল লড়তে চাওয়া।’
‘আপনি এতই নিরীহ মানুষটি? দেখি, দেখি একবার আপনার মুখখানা? হ্যাঁ, ছেলেমানুষের মুখ বটে।’
‘যান। ছেলেমানুষ বললে আমরা অপমান বোধ করি, জানেন?’
‘আপনারা কারা?’
‘আমরা একেলে মেয়েরা।’
‘তবে কি বুড়োমানুষ বলব?’
‘বুড়োমানুষ বললে খুন করব বলে রাখছি।’
‘তবে—?’
‘বলবেন ‘Bright young thing.’
‘তা আপনাকে বলতে রাজি আছি, বললে মিথ্যে বলা হয় না। কিন্তু সবাইকে—!’
‘আপনি দেখছি মিষ্টি কথার ময়রা। চকোলেটের বদলে আপনার compliment খেলেও চলে। আশা করি সবাইকে খাইয়ে থাকেন?’
‘আমি একনিষ্ঠ ময়রা।’
‘আমাকে ছেড়ে ক-জনের কাছে একথা বলেছেন?’
‘মিথ্যা বলব, না, সত্য বলব?’
‘আগে মিথ্যাটা শুনি।’
‘কারুর কাছে না।’
‘এবার সত্যটা।’
‘জন পাঁচেকের কাছে।’
‘আমি তা হলে আপনার ষষ্ঠ?’
‘এবং শ্রেষ্ঠ।’
‘প্রত্যেকবারেই সেটা মনে হয়ে থাকে বটে।’
‘আপনার অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন?’
‘যান!’
‘তবে কি এই আপনার প্রথম অভিজ্ঞতা?’
‘ভারি দুষ্টু তো! নিজের মনের কথা বেফাঁস করে ফেলেছেন। তা বলে আমার মনের কথা কাড়তে পাচ্ছেন না। বুঝলেন?’
‘অনুমান করতে কতক্ষণ?’
‘করুন না অনুমান?’
‘এই করলুম। আমার ছয়, আপনার ছয় ছক ছত্রিশ।’
(উল্লাস গোপন করে) ‘আমি কিন্তু অত্যন্ত অন্যায় করছি। একজন অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে—বিদেশির সঙ্গে—ইয়ার্কি দিচ্ছি। মা যদি জানতে পান ভয়ানক ঠাট্টা করবেন।’
‘আজকালকার মায়েরা রাগ করেন না বুঝি?’
‘রাগ করবেন। কেন, আমি কি তাঁর খাই না ধারি? আমি তাঁর কোনো ক্ষতি করছি নে। আমার যথেষ্ট বয়সও হয়েছে।’
‘কত বয়স? আঠারো?’
‘ভারি বেয়াদব তো? মেয়েমানুষের বয়স জানতে চায়!’
‘Sorry, আমার প্রশ্নটা ফিরিয়ে নিচ্ছি।’—অভিনয়ের ভঙ্গিতে সোম আবার bow করল।
ততক্ষণে তারা ক্যাথিড্রালের বাইরে এসেছে। বাইরে থেকে ক্যাথিড্রালটিকে কেমন দেখায় দু-জন মিলে তাই দেখতে লাগল। দু-জনের কারুর কাছেই ক্যামেরা ছিল না বলে তারা পরস্পরকে দুষতে লাগল। সোম বলল, ‘প্রেমিকের ছবি তুলে নিয়ে গেলেন না। বাড়ি ফিরে টেবিলের উপর কী সাজিয়ে রাখবেন?’
মিস স্কট বললেন, ‘আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী। আপনারই কর্তব্য ছবি তুলে নিয়ে আয়নার কাছে রাখা এবং তুলনা করে দেখা কে কার চেয়ে সুন্দর।’
‘আমি যে ওর চেয়ে সুন্দর এ সম্বন্ধে আমার তো কোনো সন্দেহ নেই। আপনার যদি থাকে আপনার উচিত একসঙ্গে ওর আর আমার ছবি তোলা।’
‘বাস্তবিক ছবির পক্ষে আইডিয়াল ব্যাকগ্রাউণ্ড! কে জানত আপনি আসবেন ক্যাথরিনের জায়গায়; ক্যাথরিন হতভাগী শেষকালে প্ল্যান বদলে বসল।’
‘তাঁকে আমার গভীর কৃতজ্ঞতা জানাবেন। তিনি থাকলে আমার কি কোনো আশা থাকত!’—সোম মিস স্কটের দু-টি চোখের সঙ্গে দু-টি চোখ মেলাল।
মিস স্কট চোখ নামিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, বলুন দেখি মেয়েরা মেয়েদের এমন করে অপমান করে কেন? ক্যাথরিন কথা দিল আমার সঙ্গে ছুটিটা কাটাবে, দু-জনে কিছু আগাম দিয়ে হোটেলে ঘর বুক করে রাখলুম। পোড়ারমুখী আমাকে আর মুখ দেখায়নি—দেখালে দুই চড় মারতুম—ফোন করে জানিয়েছে আরেকজনের সঙ্গে ব্ল্যাকপুল যাওয়া তার অতি অবশ্য দরকার। (ক্যাথরিনের স্বর অনুকরণ করে) অতি অবশ্য দরকার!’
সোম বলল, ‘ক্যাথরিনকে আমি দোষ দিই নে। ধরুন, ক্যাথরিন যদি আপনার ডান হাত ধরে টানে আর আমি টানি আপনার বাঁ-হাত ধরে, তবে আপনিই বলুন না আপনি কার সঙ্গে যাবেন?’
‘ক্যাথরিনের সঙ্গে।’
‘সত্যি?’
‘না, ক্যাথরিনের সঙ্গে আমার জন্মের মতো আড়ি। ওর সঙ্গে যাব না। কিন্তু আপনার সঙ্গে যে যাব একথা ভাবলেন কীসে?’
‘আমি অন্তর্যামী।’
‘কী অহংকার!’
‘অহংকার নয়, ম্যাডাম! নিজের ক্ষমতায় বিশ্বাস। জানেন আমি একজন Self-made man?’
‘আমিও তো self-made.’
‘তবে তো আমাকে আপনার ভুল বোঝবার কথা নয়, মিস স্কট।’
‘আমি আপনার জীবনের কী জানি বলুন। ওই ক্যাথিড্রালটার সম্বন্ধে যা জানি তার চেয়ে ঢের কম।’
‘তা হলে ক্যাথিড্রালেরই জিত?’
‘না। ক্যাথিড্রালটা self-made নয়। Self-made man-এর উপর আমার পক্ষপাত আছে।’
‘আর আমার পক্ষপাত সুন্দরী নারীর উপর।’ (চোখে চোখ মিলিয়ে)
‘তা হলে আমার বাঁ-হাত ধরে কেন অকারণে টানবেন?’
‘আপনার ‘ভ্যানিটি’ ব্যাগে যদি আয়না না থাকে তবে আমার চোখে আপনার মুখের প্রতিচ্ছায়া দেখতে পারেন। নিজের রূপ সম্বন্ধে সংশয় টিকবে না।’
‘আপনার ওটা মুখ নয় তো, ময়রার দোকান।’
‘ময়রার দোকানে মুখ দেবার নিমন্ত্রণ রইল। যখন আপনার সুবিধে হবে তখন।’ (মুখ টিপে টিপে হাসা)।
‘যান। আমার সুবিধে কোনোদিন হবে না।’
‘তা হলে দোকানদার তার মাল আপনার দ্বারে পৌঁছে দিতে পারবে।’
‘পেরে কাজ নেই। মিষ্টি জিনিস প্রায়ই অন্তঃসারশূন্য হয়ে থাকে।’
‘Proof of the pudding is in the eating. একবার পরখ করে দেখুন না?’
‘দেখে কাজ নেই, মশাই। ধন্যবাদ।’
‘আচ্ছা, দেখা যাবে ক-দিন আমার দাবি এড়াতে পারবেন!’
‘ক-দিন কী, মশাই! আজকেই না আপনি ব্রিস্টল যাচ্ছেন?’
‘নিশ্চয়। কিন্তু একা যাচ্ছি নে।’
‘জবরদস্ত মানুষ তো! জোর করে টেনে নিয়ে যাবেন নাকি?’
‘বাঁ-হাতখানি বগলে পুরে।’—সোম মিস স্কটের বাঁ-হাতখানি তুলে নিয়ে বগলে পুরল। মিস স্কট বাধা দিলেন না।
ব্রিস্টল যাত্রী ট্রেনে দু-জনে মুখোমুখি বসেছিল। মিস স্কট বলছিলেন, ‘এত দূর এসে ব্রিস্টলে না গেলে মাসিমা মন খারাপ করতেন। সেই জন্যেই যাওয়া।’
সোম বলছিল, ‘মাসিমা মহারানি কী জয়! আমার জোরের সঙ্গে তাঁর জোর না মিলে থাকলে আমি কি সলসবেরির ক্যাথিড্রালের সঙ্গে পেরে উঠতুম!’
‘বহুকাল তাঁকে দেখিনি। বড়ো মন কেমন করছিল।’
‘তাঁকে পেয়ে যেন সেই মানুষটিকে ভুলে যাবেন না যে তাঁর পান্ডার কাজ করেছে।’
‘পান্ডার কাজ করেছে গুণ্ডার মতো জবরদস্তি করে!’
‘বলবেন সে-কথা মাসিমাকে। হয় তো কিছু বখশিশ মিলে যেতে পারে।’
‘বখশিশ না কানমলা। মাসিমার হাতের কানমলা খাননি কখনো, না?’
‘নাঃ। আমার মাসিমা ছিলেন অত্যন্ত লক্ষ্মী। তাঁর হাতের সন্দেশ মোরব্বা ও ক্ষীরপুলি খাওয়া আজও মনে আছে।’
‘আপনার বাড়ির কথা জানতে ইচ্ছে করে। সেই মাসিমা এখনও আছেন?’
সোমের মুখের উপর শোকের ছায়া পড়ল। মিস স্কট বললেন, ‘মা আছেন নিশ্চয়ই?’
সোম মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জানালার বাইরে তাকাল।
মিস স্কট সমবেদনায় নির্বাক হয়ে পা দিয়ে সোমের পা স্পর্শ করলেন। পায়ে পায়ে বাণী বিনিময় চলতে লাগল।
কিন্তু কখন একসময় দেখা গেল পায়ে পায়ে লুকোচুরির খেলা চলেছে। দু-জনেরই দৃষ্টি বাতায়নের বাইরে চাষের জমির উপর, চাষার বাড়ির উপর, বার্চ বিচ এলম ওক পাইন গাছের উপর। কিন্তু দু-জনেরই মুখে ও চোখে দুষ্টু হাসি। যেন নিজেদের পাগুলোর জন্যে নিজেরা দায়ী নয়।
গাড়িতে এত লোক ছিল যে সকলে সকলের সঙ্গে গল্প করতে ও ছেলেপুলে সামলাতে ব্যস্ত। দু-টি মানুষ অন্যমনস্কভাবে বাতায়নের বাইরে চেয়ে আছে এই পর্যন্ত তারা দেখল। দু-টি মানুষের অতি মন্থর চরণলীলা তাদের চক্ষু এড়িয়ে গেল।
ব্রিস্টলে যখন গাড়ি দাঁড়াল সোম বুদ্ধি করে মিস স্কটের সুটকেসটার ভার নিল। মিস স্কট ভাবলেন নিছক ভদ্রতা। তিনি ভদ্রতা করে সোমের হাতব্যাগটির ভার নিলেন। সোমের আপত্তিতে কান দিলেন না।
স্টেশনের বাইরে গিয়ে মিস স্কট বললেন, ‘মাসিমার ঠিকানাটা আপনাকে দিই! কাল সকালে একবার দেখা করলে খুশি হব, মিস্টার সোম।’ এই বলে তিনি একটা ট্যাক্সিকে আসতে ইঙ্গিত করলেন।
সোম বলল, ‘আমার হাতব্যাগটা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু আপনার সুটকেসটি ফিরে পাচ্ছেন না।’
‘সে কী মিস্টার সোম! দিনেদুপুরে ডাকাতি?’
‘শুধু ডাকাতি করেই ক্ষান্ত হলুম। Abduction-এরও ইচ্ছে ছিল, মিস স্কট।’
‘কী ভয়ানক মানুষ! এখন ট্যাক্সিওয়ালাকে আমি কী বলে ফিরিয়ে দেব?’
‘ফিরিয়ে দেবেন কেন? উঠে বসুন। আমিও উঠছি। এই শোনো তো? একটা ছোটো বোর্ডিং হাউসে নিয়ে যেতে পার? আমরা বিদেশি। পার? ধন্যবাদ। বখশিশ পাবে।’
ট্যাক্সিওয়ালা তার বন্ধুদের শুধোল। পুলিশের কনস্টেবল-এর কাছে পরামর্শ চাইল। তারপরে অনতিদূরস্থিত একটি বোর্ডিং হাউসে দু-জনকে পৌঁছে দিয়ে নিজেই এগিয়ে গেল মালিককে ডাকতে।
বোর্ডিং হাউসটি খুব ছোটো নয়। আসলে বোর্ডিং হাউসই নয়। একটা রেসিডেনশিয়াল হোটেল। তার দু-টি ঘরে দু-জনে জায়গা পেল। ইস্টারের মরসুম। তাই ঘর দু-টি কিছু দামি। সস্তা ঘরগুলো খালি নেই।
সোম মনে মনে একটু ক্ষুণ্ণ হল। মিস স্কট বিনা ব্যয়ে তাঁর মাসিমার বাড়ি থাকতেন। তাঁকে অপহরণ করে এনে এতটা ব্যয় করানো সোমের উচিত হয়নি।
আহারাদির পর সোম কথাটা পাড়ল। বলল, ‘মিস স্কট, আমার প্রতি যদি আপনার কিছুমাত্র প্রীতি থাকে তবে আমাকে অনুমতি দিন, আমি আপনার এখানকার খরচটা বহন করি।’
এর উত্তরে মিস স্কট এমন একটা কথা বললেন যা সোমের মাথা ঘুরিয়ে দিল। বললেন, ‘মিস্টার সোম, আমি রাস্তার ছুঁড়ি নই, আমাকে কেনা যায় না।’
তারপরে সোম একটিও কথা কইল না। উঠে বিদায় না নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ল। ভাবল, মেলামেশার একটা সীমা আছে। সেই সীমাটা যে ঠিক কোনখানে কিছুতেই সেটা আমার মালুম হয় না। সেইজন্যে যার সঙ্গে বেশি মিশতে গেছি তার কাছে গলাধাক্কা খেয়েছি। তবু আমার চেতনা হল না।
সোম তার নিজের দুই হাতে নিজের দুই কান মলল, বালিশের উপর নাক ঘষল।
আজকেই সকাল বেলা সে ক্যাথিড্রাল দেখবার সময় মনকে বলছিল, আমার মতো সাকসেসফুল ছেলে ক-জন আছে? জীবনে যখন যে পরীক্ষা দিয়েছি তখন তাতে ফার্স্ট হয়েছি। যখন যে মেয়েকে চেয়েছি তখন তাকে পেয়েছি। এই যে পেগি স্কট মেয়েটি একেও তো প্রায় পেয়েছি বললে হয়। দেখো একে ব্রিস্টলে নিয়ে যাই কি না।
তারপরে সত্যিই যখন ব্রিস্টলের গাড়িতে পেগি স্কটকে তুলল তখন মনকে বলল, দেখলে তো, মিস্টার মন? যা মুখে বলি তা কাজে করি কি না? পেগি স্কটকে তার মাসির বাড়ি যদি যেতে দিয়েছি তবে আমার নাম কল্যাণকুমার সোম নয়।
সোম নিজের ক্ষমতার প্রতি সন্দিহান হয়ে নিজেকে গালাগালি দিল। মনকে বলল, হ্যালো শুনতে পাচ্ছ? মন বলল, পাচ্ছি। সোম বলল, দেখো, আমার অনুতাপ হচ্ছে। নিজেকে আমি অতিশয় ধূর্ত মনে করেছিলুম! সেটা খারাপ। মন বলল, একটু কাঁদো। সোম বলল, আরেকটা দুর্বলতার কথা তোমাকে বলি। মেয়েটিকে আমার সত্যি সত্যি ভালো লেগে গেছে। বলতে পারব না কেন। সুন্দরী নয়, সুদর্শনা। তার বিশেষত্ব হচ্ছে সে খুব সপ্রতিভ। যেন কত কাল আমার সঙ্গে পরিচয়। অনেক মেয়ে আছে তারা ছ-মাসের পরিচয়কেও যথেষ্ট মনে করে না, ভয়ে ভয়ে কথা বলে, ভব্যতার সীমা লঙ্ঘন করে অশ্রদ্ধা পায়। এ মেয়েটি শ্রদ্ধার জন্যে কেয়ার করে না, অশ্রদ্ধা পেলেও কেয়ার করবে না। কেউ একে ভালোবাসুক না বাসুক বিয়ে করুক না করুক তাতে এর কিছুই আসে যায় না। সেই জন্যেই কি একে আমার ভালো লেগে গেছে?
মন জবাব দিল না।
কিন্তু দরজায় কে টোকা মারল বাইরে থেকে। সোম ভাবল, বোধ হয় হোটেলের কেউ হবে। বোধ হয় জিজ্ঞাসা করতে চায় কাল সকালে ঘুম ভাঙাতে হবে কি না। সোম উঠে বসল বলল, ‘ভিতরে আসতে পার।’
মিস স্কট।
মিস স্কট আগে জানালার কাচটা তুলে দিলেন। বললেন, ‘দিনটা যদিও বেশ উজ্জ্বল ও উত্তপ্ত ছিল রাতটাও তেমনি হবে এর মানে নেই।’
তারপর সোমের হাতব্যাগটাকে টিপুনি দিয়ে খুলে তার ভিতরকার জিনিসগুলিকে একে একে বের করলেন। মুখ-হাত ধোবার টেবিলের উপর রাখলেন কামাবার সরঞ্জাম, চুলের ব্রাশ ও ক্রিম, দাঁতের ব্রাশ ও পেস্ট। দেরাজের ভিতর রাখলেন শার্ট, গেঞ্জি, মোজা, কলার টাই। নীচে গুঁজে দিলেন স্লিপিং সুট। চটিজোড়াটিকে রাখলেন খাটের কাছে যে স্ট্যাণ্ড থাকে তারই ভিতরে।
তারপর একটি চেয়ার টেনে নিয়ে সোমের দিকে মুখ করে বসলেন।
সোমের রাগ পড়ে গেছিল। রাগের স্থান অধিকার করছিল মমতা। আহা, এই মেয়েটি যদি আমার ঘরনি হত। তবে আমার বইয়ের টেবিলের উপর টাই, বিছানার উপর শার্ট ও মেজের উপর মোজা গড়াগড়ি যেত না, চটিজোড়াটাকে দরকারের সময় খুঁজে পাওয়া যেত। তাহলে আমাকে আমার ল্যাণ্ডলেডি বুড়িকে auntie বলে তোয়াজ করতে হত না।
মিস স্কট বললেন, ‘কী ভাবা হচ্ছে!’
সোম অভিমানের সুরে বলল, ‘জেনে আপনার লাভ! আরেক দফা অপমান করবেন?’
‘কবে আপনাকে অপমান করলুম, মশাই?’
‘নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন।’
‘সত্যি আমি সজ্ঞানে অপমান করিনি। অজ্ঞানে যদি করে থাকি তবে মাফ চাইছি, মিস্টার সোম।’
সোমের অভিমান জল হয়ে গেল। সে বলল, ‘ওই যে বললেন আপনাকে কেনা যায় না!’
‘সে তো ঠিকই। আমাকেও কেনা যায় না, আপনাকেও না, কেউ কারুর খরচ দেবে কেন?’
‘কিন্তু মিস স্কট, আমার জন্যেই যে আপনাকে খরচ করতে হল। নইলে আপনার তো মাসির বাড়ি রয়েছে।’
‘খরচ করবার জন্যে ছুটিতে বেরিয়েছি, খরচ হল তো বয়ে গেল। ধরুন আজ যদি সলসবেরিতে থাকতুম।’
‘সেখানেও তো ক্যাথরিনকে ও আপনাকে জরিমানা দিতে হয়েছে পুরো দিন রাত থাকলেন না বলে।’
‘না গো মশাই, আমরা অত কাঁচা মেয়ে নই। ইস্টারের ভিড়, হোটেলওয়ালাকে জায়গার জন্যে যাত্রীরা চেপে ধরেছে। আমি ওদের মধ্যে দু-জনকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললুম, ‘আমার বন্ধুর ও আমার দুটো ঘর আমরা আপনাদের ছেড়ে দিতে পারি আপনারা যদি দু-রাত থাকবেন প্রতিশ্রুতি দেন।’ ওরা আবেগের সঙ্গে বলল, ‘How kind of you! How noble of you’!’
সোম শেষের কথাগুলি শুনে সশব্দে হেসে উঠল। বললে, ‘আমাকে ওকথা আগে বলেননি কেন? সেজন্যে আপনার উপর রাগ করব।’
‘করুন রাগ। আমি বসে বসে দেখি।’
সোম বলল, ‘এত রাত্রে একজন ব্যাচেলরের ঘরে বসে আছেন, আপনার সাহস কম নয়!’
‘কেন, ভয় করব কাকে?’
‘যদি বলি, লোকনিন্দাকে?’
‘লোকনিন্দার ভিত কাঁচা, যতক্ষণ আমি নিজে খাঁটি আছি।’
‘যদি বলি, আমাকে?’
(আতঙ্কের সঙ্গে) ‘আপনাকে?’
(কৌতুকের সঙ্গে) ‘আমার হাতের কাছে সুইচ। আপনার হাতের কাছে নয়। এই মুহূর্তে ঘর অন্ধকার করে দিতে পারি।’
(সাহস ফিরে পেয়ে) ‘চিৎকার করে রাজ্যের লোক জড় করব।’
‘ভীরুরাই চিৎকার করে থাকে। ছিঃ ছিঃ, মিস স্কট!’
‘আমার গায়ের জোর আপনার থেকে কম নয়, মিস্টার সোম।’
‘ছেলেমানুষের মতো কথা হল মিস স্কট। জানেন না যে অতিশয় দুর্বল মানুষও দুর্দান্ত হয়ে ওঠে যদি একতাল সোনা পড়ে রয়েছে দেখে?’
(ফিক করে হেসে) ‘আমি কি একতাল সোনা?’
‘নিশ্চয়, কিন্তু দেশ-কাল-পাত্র অনুসারে। অপরিসর ঘর, এগারোটা রাত, যুবা পুরুষ। এমন সুযোগ জীবনে এক-আধবার আসে। এ-কথা যখন ভাবা যায় তখন শশকের দেহতেও সিংহের বল সঞ্চার হয়, মিস স্কট।’
‘তাহলে আমি এই বেলা পালাই, মিস্টার সোম।’
‘না, না, আরেকটু বসুন।’
‘না না, আমার আর সাহস থাকছে না।’
‘সত্যি?’
‘সত্যি।’
‘কেলেঙ্কারি, মিস স্কট! ঠাট্টাও বোঝেন না!’
‘এসব বিষয়ে ঠাট্টা যে গড়াতে গড়াতে কতদূর যায় তার দু-একটা দৃষ্টান্ত জানা আছে, মিস্টার সোম। দুটো দিনের পরিচয়ে আমরা বড়ো বেশি দূরে এগিয়েছি।’
‘সে তো শুধু বাক্যে। ফ্রান্সের মতো দেশে যা ধুলোর মতো সস্তা, যা যেকোনো যুবক যেকোনো যুবতীকে দিতে পারে, আপনাকে তাই আমি এ পর্যন্ত দিইনি—আমার এই সংযম, এই আত্মনিগ্রহ যেন আমার উপর আপনার আস্থাকে অটুট রাখে, মিস স্কট।’
(লজ্জারুণ বদনে) ‘সেই মূল্যহীন উপঢৌকনটির নাম জানতে পারি কি?’
‘আপনিই আন্দাজ করুন না?’
‘ফুল?’
‘ফুলের তো দাম আছে।’
‘তবে কী?’
‘চুম্বন।’
মিস স্কট শরমে রাঙা হয়ে দু-হাতে মুখ ঢাকলেন। তৎক্ষণাৎ সপ্রতিভভাব ফিরে পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘এর জন্যে এত দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা?’
সোম কী বলবে ভেবে পেল না। সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।
মিস স্কট তার পাশটিতে গিয়ে বসলেন। বললেন, ‘আর দেরি না। ঘুম পাচ্ছে। দিন।’
সোম ঘাবড়ে গেল। এতটা প্রসন্নতা প্রত্যাশা করেনি। তার অত্যন্ত লজ্জাবোধ হচ্ছিল।
মিস স্কট হাসতে হাসতে বললেন, ‘দিন, দিন, দিন।’
সোম লজ্জায় জড়সড়। অপ্রস্তুতের একশেষ। চিরকাল যে অযাচিতভাবে দিয়েছে। কদাচিৎ অযাচিতভাবে পেয়েওছে। কিন্তু কোনোদিন কেউ তার কাছে চুম্বন ভিক্ষা করেছে বলে তো মনে পড়ে না।
তখন মিস স্কট স্প্রিং-এর মতো লাফ দিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘গুড নাইট, মিস্টার সোম।’ দরজার কাছ অবধি গেছেন এমন সময় সোম দিল সুইচটা টিপে।
সোমের বুক ঢিপ ঢিপ করছে। সে যে কী চায় স্পষ্ট করে বুঝতে পারছে না। তবু মিস স্কটকে সে যেতে দেবে না। অন্ধকারে তার লজ্জা সংকোচ রইল না। সে কাঁপতে কাঁপতে মিস স্কটের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল।
মিস স্কটের পলায়নের ত্বরা ছিল না। তিনি স্তম্ভের মতো স্তব্ধ হয়ে কী জানি কী ভাবছিলেন। সোম তাঁকে হিড় হিড় করে টেনে এনে বিছানার উপরে বসাল ও বসল। ঠিক সেই আগের জায়গা দু-টিতে। সুইচ আর টিপল না।
অন্ধকার ঘর। হোটেল নিঃশব্দ। সোম ও মিস স্কট কেউ কোনো কথা বলে না। পরস্পরকে স্পর্শ করে না পর্যন্ত। একজন থরথর করে কাঁপছে, অন্যজন মর্মর-মূর্তির মতো নিঃস্পন্দ। পাঁচ মিনিট কেটে গেল। যেন একটা যুগ।
মিস স্কট উঠে দাঁড়ালেন। তখন সোমও উঠে দাঁড়াল। মিস স্কট দরজার দিকে পা বাড়ালেন। তখন সোম তাঁর গতিরোধ করে তাঁকে দুই বাহু দিয়ে বাঁধল। তাঁর মাথাটি তার গলার উপর ঢলে পড়ল। সোম তাঁর কেশের উপর চুম্বন বৃষ্টি করে চলল।
অনেকক্ষণ চলে গেলে পর তিনি মুখ তুললেন। ‘Have you finished?’
এতক্ষণ যেন একটা বস্তুকে চুম্বন করছিল। মানুষের গলার সুর শুনে মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে সোম আবার লজ্জায় ম্রিয়মাণ হল। তখন তার বাহুপাশ খুলে মিস স্কট প্রশান্ত পদক্ষেপে ঘর থেকে বাহির হয়ে গেলেন।