৪. আমি স্বেচ্ছা কারাবন্দি

আমি স্বেচ্ছা কারাবন্দি। নিজের ঘরে সারা দিন কাটাই। আমার এই নতুন ঘরটা বেশ বড়, সঙ্গে বাথরুম আছে। টিভি আছে। বড় মামা তাঁর বাড়ি থেকে দুটা ডিভিডি প্লেয়ার এনেছিলেন। একটা আমি নিয়ে নিয়েছি। ডিভিডি প্লেয়ারে ছবি দেখি। ছাদে যাই না, আহসান সাহেবের ঘরে যাই না। ঠিক করেছি তিন মাস এইভাবে থাকব। তবে আহসান সাহেব ডেকে পাঠালে ভিন্ন কথা। তখন সেজেগুজে যাব। শাড়ি পরব, ঠোঁটে লিপস্টিক দেব, চোখে কাজল দেব। যারা কখনো সাজে না, তারা হঠাৎ সাজলে খুব সুন্দর দেখায়। আর আমি তো যথেষ্ট রূপবতী। মা কথায় কথায় বলেন, “আমার পরীর মতো মেয়ে। আমরা কেউ কখনো পরী দেখি নি, কিন্তু কথায় কথায় পরীর সঙ্গে তুলনা দেই। মহিলা জ্বিনকেই নাকি বলে পরী। তাই যদি হয় আমরা কেন বলি না “জ্বিনের মতো ছেলে? বিষয়টা নিয়ে আহসান সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তিনি যেদিন ডেকে পাঠাবেন সেদিনই এই প্রসঙ্গ তুলব। বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দশ দিন কেটেছে এখনো তিনি ডাকেন নি। মনে হয় ডাকবেন না। না ডাকলে নাই।

ডাকলে নাই
তাই তাই তাই ॥

দুপুরে খাওয়ার সময় হয়েছে। মা আমার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললেন, লিপি, খেতে আয়।

আমি বললাম, খেতে আসতে পারব না। তুমি একটা ট্রেতে করে এই ঘরে খাবার দিয়ে যাও।

কেন?

এখন থেকে আমি এই ঘর থেকে বের হব না। ঘরেই খাওয়াদাওয়া করব।

কারণ কী?

মা, আমার তিন মাসের জেল হয়েছে। এই ঘরটা হলো আমার জেলখানা।

কে তোকে জেল দিয়েছে?

আমি নিজেই নিজেকে দিয়েছি। বিনাশ্রম কারাদণ্ড।

দরজা খোল, তোর সঙ্গে কথা বলি।

আমি দরজা খুলব না মা।

কিছুক্ষণ পর সকিনা খাবার দিতে এসে মুখ বাঁকা করে হাসল। আমি বললাম, হাসছ কেন?

সকিনা বলল, হাসি না তো আপা। আমার মুখটা বেঁকা। এইজন্যে মনে হয় হাসতেছি।

আমাদের বাসায় খাবারের মান এক ধাপে অনেকটা উন্নত হয়েছে। বড় মামার অবদান। আজ দুপুরের আইটেম হলো, ছোট আলু দিয়ে কই মাছ, ইলিশ মাছ ভাজি, সরিষা বাটা দিয়ে মানকচুর একটা ঝোল। এই আইটেমটা সবচেয়ে ভালো। তিন পদের তরকারি দিয়ে আমাদের বাসায় এর আগে কখনো রান্না হতো না। এখন হচ্ছে। মাঝে মাঝে চার পদেরও হয়।

বড় মামা ভালো আছেন এবং সুখে আছেন। তিনি সারা সকাল খবরের কাগজ পড়েন। বাসায় চারটা পত্রিকা রাখা হয়। একটা ইংরেজি, তিনটা বাংলা। বড় মামা ইংরেজি পত্রিকা পড়া দূরের কথা, ভাঁজও খুলেন না। যে পত্রিকা পড়া হয় না, সেই পত্রিকা কেন রাখা হয় আমি জানি না। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। আহসান সাহেব বলেন, আমাদের পৃথিবী হলো কার্যকারণের পৃথিবী। সব ঘটনার পেছনে কারণ থাকবে। অকারণে কিছুই ঘটবে না। Cause and effect.

মামার কাছে সপ্তাহে তিন দিন গোঁফওয়ালা অত্যন্ত বলশালী বেঁটে এক লোক আসছে। বড় মামাকে প্রায় নেংটো করে সারা গায়ে তেল মালিশ করে দলাই মলাই করছে। এই সময় মামা আহ্ উহ্ করে ব্যথা এবং আরামের মিলিত ধ্বনি তুলছেন। অতি কুৎসিত দৃশ্য।

আমি মামাকে একদিন বললাম, বড় মামা! তুমি তো ঘোড়া হয়ে যাচ্ছ।

বড় মামা খরখরে গলায় বললেন, ঘোড়া হয়ে যাচ্ছি মানে কী?

ঘোড়াকে প্রতিদিন দলাই-মলাই করতে হয়, তোমাকেও করতে হয়, এইজন্যে বললাম। সরি, ঠাট্টা করেছি।

আমি কি তোমার ঠাট্টা-সম্পৰ্কীয় কেউ?

জি-না মামা।

নিজের চরকায় তেল দাও। পরের চরকায় না।

জি আচ্ছা মামা।

বড় মামা মনে হয় কলেজের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছেন। কলেজে যান না। কলেজের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্যেই হয়তো আগের মতো মাস্টারি প্রশ্ন করেন না।

বড় মামার বিষয়ে আমি এখন ভয়ংকর একটা কথা বলব। পুরোপুরি ভোলাসা করে বলব না। রাখঢাক করে বলব। যার বোঝার সে বুঝবে। না বুঝলে নাই।

না বুঝলে নাই
তাই তাই তাই।

বড় মামার ড্রয়ারে আমি একটা প্যাকেট দেখেছি। কিসের প্যাকেট? এই তো হলো সমস্যা। একটা বড় প্যাকেটে অনেকগুলো ছোট ছোট প্যাকেট। ছোট প্যাকেটে বেলুনের মতো একটা জিনিস থাকে। ফুঁ দিলে বেলুন হয়ে যায়। এখনো পরিষ্কার হয় নি? না হলে কিছু করার নাই।

প্রথম যেদিন প্যাকেট দেখলাম সেদিন তেরটা ছোট প্যাকেট ছিল। এখন আছে এগারটা। অর্থাৎ দুটো ব্যবহার হয়েছে। খুবই ভয়ংকর।

প্যাকেটের সন্ধান কীভাবে পেলাম বলি। মামা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ঘর সবসময় তালা দিয়ে যান। বেশ ভারী তালা।

আমি আমার ঘরের তালাচাবি ঠিক করার সময় একজন চাবিওয়ালাকে খবর দিলাম। মামা তখন ঘরে ছিলেন না। আমি চাবিওয়ালাকে দিয়ে মামার ঘরের তালার চাবি বানিয়ে নিলাম। এখন ইচ্ছা করলেই মামার ঘরে আমি ঢুকতে পারি। মাঝে মাঝে ঢুকি। মামার ঘরে বড় একটা স্টিলের ট্রাংক আছে। সেটাতেও তালা। চাবিওয়ালাকে দিয়ে আমি এই ট্রাংকও খোলাব। সুযোগ পাচ্ছি না। চাবিওয়ালাকে তাহলে মামার ঘরে ঢোকাতে হবে। মা বা সকিনা দেখে ফেলবে।

 আমি অপেক্ষা করছি কোনো একদিন মা তার এক বান্ধবীর বাসায় যাবেন। মার এই বান্ধবী মিরপুরে থাকেন। মা তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে সকিনাকে সঙ্গে নিয়ে যান এবং সারা দিন থাকেন। মার এই বান্ধবীর নাম মরিয়ম। তিনি নাকি মহিলা পীর। দুনিয়ার মহিলা তাকে ঘিরে থাকে। যেদিন দেখব মা নেই, সকিনা নেই, তারা গেছে মহিলা পীরের দরবারে এবং বড় মামা বাইরে গেছেন, সঙ্গে সঙ্গে চাবিওয়ালাকে টেলিফোন করব। চাবিওয়ালার মোবাইল ফোনের নম্বর আমি রেখে দিয়েছি। বাংলাদেশে বাস করার এই সুবিধা, এখন সবার কাছে মোবাইল ফোন। একসময় দেখা যাবে সব ভিক্ষুকের হাতেও মোবাইল ফোন। তারা ভিক্ষা করতে আসার আগে মোবাইলে কল দিবে–মা, ভিক্ষা নিতে কি। আসব? কিছু মিলবে?

বড় মামাকে আমি ভৌতিক ট্রিটমেন্ট দেব বলে ঠিক করেছি। তিনি চাবি খুলে ঘরে ঢুকে দেখবেন–বিছানায়, মেঝেতে এবং বাথরুমে টাটকা রক্ত। কয়েকবার এ রকম দেখলে তার খবর হয়ে যাবে। এখন টাটকা রক্ত পাওয়াই সমস্যা। বাজারে তো আর মানুষের রক্ত প্যাকেট করে বিক্রি করে না। তবে মানুষের রক্তই যে লাগবে তা না, গরু-ছাগলের রক্ত হলেও চলবে।

আমি লেখক হুমায়ূন স্যারের পিওনকে দিয়ে রক্ত জোগাড় করার পরিকল্পনা করেছি। তার সঙ্গে ভালো খাতির জমিয়েছি। তার নিজের মোবাইল নম্বর সে আমাকে দিয়েছে। মাঝে মাঝে খেজুরেটাইপ কথা বলে খাতির বজায় রাখছি। গতকাল রাত নটার সময় টেলিফোন করে বললাম, মোস্তফা ভাই, কেমন আছেন? সে বিগলিত গলায় বলল, ভালো আছি আপা।

আপনার স্যার কি রেস্টে আছেন?

না। স্যার ম্যাডামের সঙ্গে মুভি দেখেন।

মুভির নাম কী?

নাম তো জানি না।

মোস্তফা ভাই! নামটা জেনে দিবেন। আমিও ওই মুভিটা দেখব। আপনি মনে হয় জানেন না, আমিও আপনার স্যারের মতো লেখক। উনি যেসব মুভি দেখেন। আমারও সেসব দেখা প্রয়োজন। বুঝেছেন?

জি আপা!

আপনার ছেলে কেমন আছে?

ভালো আছে।

নাম বাবু, তাই না?

তার মা বাবু ডাকে। আমি ডাকি হিমু। স্যারের বই থেকে নাম নিয়েছি।

ভালো করেছেন। আপনার কোনো মেয়ে হলে আমাকে বলবেন। আমি আমার বই থেকে নাম দিয়ে দিব।

জি আচ্ছা।

আপনার ছেলে হিমুর ডায়রিয়া হয়েছিল বলেছিলেন, এখন সেরেছে?

জি।

ওরস্যালাইন খাওয়াচ্ছেন? ডায়রিয়ায় বডি ডিহাইড্রেটেড হয়ে যায়। ওরস্যালাইন খেয়ে ঠিক করতে হয়। বুঝেছেন?

জি আপা।

পরেরবার যখন দেশে যাবেন আমার সঙ্গে দেখা করে যাবেন। আমি হিমুর জন্যে একটা গিফট কিনে রেখেছি। গিফট নিয়ে যাবেন। হলুদ পাঞ্জাবি, হলুদ পায়জামা।

জি আচ্ছা আপা।

ভালো কথা মোস্তফা ভাই আমাদের স্কুলের একটা সায়েন্স প্রজেক্টে গরু বা ছাগলের রক্ত লাগে। জোগাড় করে দিতে পারবেন?

রক্ত কই পাব আপা?

কী আশ্চর্য মোস্তফা ভাই! আপনি এমন একজন বুদ্ধিমান মানুষ হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, রক্ত কই পাব? আমি জানি নাকি? নিউ মার্কেটের কসাইদের কাছে খোঁজ নিয়ে দেখেন।

জি আচ্ছা আপা। কতটুক রক্ত লাগবে?

প্রথম দফায় এক লিটার লাগবে। পরে আবার লাগবে। রক্ত জোগাড় হলেই মোবাইলে আমাকে মিসকল দিবেন।

জি আচ্ছা আপা।

রক্তের জন্যে অপেক্ষা। রক্ত এলেই বড় মামার চিকিৎসা শুরু হবে। জল চিকিৎসার মতো রক্ত-চিকিৎসা।

.

বড় মামার বিষয়ে বাবার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আরে না ছোট প্যাকেট বিষয়ে না। বাবার সঙ্গে এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলা যায় নাকি? মার সঙ্গে কথা বলা যায়। তবে এখনো না। সময় হোক তখন বলব।

বাবা আমার ঘরে ঢুকে দরজা ভিজিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, তোমার বড় মামা বিষয়ে কিছু কথা বলব।

আমি বললাম, বলো। তবে আজেবাজে কিছু বলবে না। উনি সুফিটাইপ মানুষ।

বাবা অবাক হয়ে বললেন, সে সুফি?

আমি বললাম, মার তা-ই ধারণা। বড় মামা উল্টাপাল্টা কাজ যা করেন, মামির ঠেলাঠেলিতে করেন। এখন মামি যেহেতু সঙ্গে নেই, বড় মামা পুরোপুরি সুফি।

তোমার মার এই ধারণা?

হুঁ।

তাহলে তো আর বলার কিছু নাই।

আমি বললাম, তারপরেও কিছু বলার থাকলে বলো।

বাবা বললেন, ডেভেলপারকে দিয়ে তোমার মামা যে দশতলা দালান তুলছে। এটা নিয়ে খটকা।

বলো, শুনি কী খটকা?

ডেভেলপারেরা তো জমির মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করবে। তোমার মা-ও তো জমির মালিক। তার সঙ্গে তো কোনো চুক্তি হয় নাই।

তাহলে মা মনে হয় জমির মালিক না। বড় মামাই মালিক।

সেটা কীভাবে সম্ভব?

এই দুনিয়ায় সবই সম্ভব।

তুমি কি বিষয়টা নিয়ে তোমার বড় মামার সঙ্গে আলাপ করবে?

আমি আলাপ করব কোন দুঃখে! তোমার খটকা তুমিই আলাপ করো।

আমাকে লোভী ভাববে।

তোমাকে লোভী ভাবলে ক্ষতি তো কিছু নাই। তুমি তো লোভী। লোভীকে লোভী ভাবা দোষের কিছু না। তারপরেও লজ্জা লাগলে মাকে বলো জিজ্ঞেস করতে।

তোমার মাকে বলেছিলাম, সে কান্নাকাটি করে বিশ্রী অবস্থা করেছে। আমাকে ছোটলোক বলেছে। এখন কী করা যায় বলো তো?

ঝিম ধরে থাকো। আর কী করবে?

বাবা কিছুক্ষণ ঝিম ধরে থেকে বের হয়ে গেলেন। মনে হচ্ছে আজ সারা দিন তিনি ঝিম ধরেই থাকবেন।

নিম ফুলের মৌ পিয়ে ঝিম ধরেছে ভোমরা
ঝিম ধরেছে ভোমরা
ঝিম ধরেছে ভোমরা।
বাবা এখন ভোমরা!

.

আজ সোমবার।

আমার খারাপ দিবস। আজও নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু ঘটবে। ঘটুক। আমিও বাবার মতো ভোমরা হয়ে যাব। অনেকদিন পর উপন্যাস লিখতে বসলাম।

আমার বড় মামার ঘরে ভূতের উপদ্রব হয়েছে। তিনি বাইরে থেকে ফিরে ঘরের তালা খুলে দেখেন–ঘর রক্তে ভেজা। মেঝেতে রক্ত, বিছানায় রক্ত, এমনকি বাথরুমেও রক্ত। বড় মামা চোখ কপালে তুলে বললেন, কী ব্যাপার? এইসব কী?

আমি বললাম, মনে হচ্ছে রক্ত।

বড় মামা বললেন, ঘরে রক্ত আসবে কেন?

আমি বললাম, তুমি যখন থাকো না তখন মনে হয়। কোনো ড্রাকুলা এসেছিল…।

এই পর্যন্ত লিখে আমি কেটে ফেললাম। লেখা পছন্দ হয় নি। সত্যি সত্যি রক্ত ঢেলে দেখতে হবে বড় মামা কী বলেন। তারপর লিখতে হবে। নয়তো লেখায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা পাবে না।

দুপুরে আহসান সাহেবের গাড়ির নতুন ড্রাইভার এসে আমাকে বলল, স্যার আপনারে আইজ দুপুরে তাঁর সঙ্গে খানা খেতে বলেছেন!

আমি বললাম, উনাকে গিয়ে বলল সোমবার আমি ঘর থেকে বের হই না। আচ্ছা থাক কিছু বলতে হবে না।

মা রান্না করছিলেন, আমি মাকে বললাম, মা তোমার একটা সুন্দর শাড়ি দাও তো। হালকা সবুজ রঙের শাড়ি থাকলে ভালো হয়।

কী করবি?

আমি বললাম, শাড়ি দিয়ে মানুষ কী করে মা? হয় সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে সুইসাইড করে, আর না হলে পরে। আমি পরব।

শাড়ি এখন পরবি?

হ্যা এখন। বাবার বন্ধু এবং বস আহসান সাহেব আমাকে আজ দুপুরে খেতে বলেছেন। সেজেগুজে যেতে হবে।

সেজেগুজে যেতে হবে কেন?

উনি বলেছেন এইজন্যে। বিশেষভাবে বলেছেন আমি যেন শাড়ি পরে যাই। শাড়ি পরলে আমাকে কেমন দেখায় তা তিনি দেখতে চান।

আমার কথা শুনে মার হাতের খুন্তি মেঝেতে পড়ে গেল। আমি বললাম, মা, তোমার কাজলদানিতে কি কাজল আছে? উনি বলেছেন আমি যেন অবশ্যই চোখে কাজল দেই। মেয়েদের চোখে কাজল তার নাকি খুব পছন্দ।

মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, লিপি! মা, এইসব কী বলছিস?

আমি হাই তোলার মতো ভঙ্গি করে বললাম, যা সত্যি তা-ই তোমাকে বলেছি। তবে তুমি যদি বলো না যেতে তাহলে যাব না।

মা বললেন, যাওয়ার দরকার নেই। বলে দে তোর জ্বর, শুয়ে আছিস।

তারপর যদি ডাক্তার নিয়ে চলে আসেন তখন কী হবে? উনি আমাদের ওপর রাগ করলেও তো বিরাট সমস্যা।

কী সমস্যা?

বাবার চাকরি চলে যাবে। আমাদের এই বাসা ছেড়ে দিতে হবে।

মা করুণ চোখে তাকিয়ে আছেন। তাকে দেখে মায়া লাগছে।

আজ সোমবার, কিন্তু আজকের সোমবার অন্য দিনের মতো না। আমার জীবনে ভালো ভালো জিনিস ঘটছে। মোস্তফা ভাই কোকের বোতলে করে প্রায় এক বোতল রক্ত নিয়ে এসেছেন। এখন রক্ত-চিকিৎসা শুরু করতে পারব।

আহসান সাহেব এই প্রথম আমাকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখলেন। তিনি যে খানিকটা থতমত খেয়ে গেছেন তা বুঝতে পারছি। মেয়েরা কিছু কিছু জিনিস বুঝতে পারে। থতমত খাওয়া পুরুষ চোখ নামিয়ে নেয়। তখন তার দৃষ্টি হয়। এলোমেলো। থতমত ভাব কাটানোর চেষ্টার কারণে চেহারায় বিরক্তি চলে আসে। এই বিরক্তি নিজের ওপর।

আহসান সাহেব বললেন, উপন্যাস লেখা কি বন্ধ?

বন্ধ কেন? আধাপৃষ্ঠা লিখেছিলাম। পছন্দ হয় নি বলে ফেলে দিয়েছি।

ভালো করেছ। ফেলে দেওয়া অভ্যাস করতে হবে। লেখকের সবচেয়ে বড় বন্ধু হলো ডাস্টবিন। অপছন্দের লেখা ডাস্টবিনে ফেলতে পারা ভালো গুণ। কেউ কেউ আছে কিছুই ফেলতে পারে না।

আমি মিষ্টি করে হাসলাম। উনি আবারও থতমত খেলেন। বুঝতেই পারছি তিনি কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। যাক, শেষ পর্যন্ত কথা খুঁজে পেলেন।

আধাপৃষ্ঠা কী লিখেছিলে যে ফেলে দিতে হলো?

ভৌতিক কিছু করতে চেয়েছিলাম। তালাবন্ধ ঘর খুলে দেখা গেল ঘরের মেঝেতে, বিছানায়, বাথরুমে রক্ত।

তিনি বললেন, ইন্টারেস্টিং!

লেখাটা ইন্টারেস্টিং হয় নি। ফালতু হয়েছে।

আবার লেখো। রবার্ট ব্রুস হয়ে যাও।

আমি বললাম, আচ্ছা।

তিনি বললেন, শাড়িতে তোমাকে মানিয়েছে। মাঝে মাঝে শাড়ি পরবে। শাড়ির যে ক্ষমতা আছে পৃথিবীর অন্য কোনো পোশাকের এই ক্ষমতা নেই।

কী ক্ষমতা?

শাড়ি একটা মেয়ের পার্সোনালিটি বদলে দিতে পারে।

আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, যাই।

তিনি অবাক হয়ে বললেন, যাই মানে! তোমাকে দুপুরে আমার সঙ্গে লাঞ্চ করার জন্যে ডেকেছি।

আমি বললাম, মা খুব দুশ্চিন্তা করছেন তো, এইজন্যে চলে যেতে হবে। দুশ্চিন্তা করছেন কেন?

আমি বললাম, মা মোটামুটি নিশ্চিত, আমি আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। এইজন্যেই দুশ্চিন্তা করছেন। পাত্র খুঁজছেন আমাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্যে। মার ধারণা বিয়ে হলে আমার পাগলামি সেরে যাবে। পাত্র খোঁজা হচ্ছে, একজন পাওয়া গেছে।

তিনি বললেন, লিপি, পাঁচ মিনিট বসো। আমার কথা শুনে চলে যেয়ো। আমার সঙ্গে লাঞ্চ করতে হবে না। তোমার খাবার পাঠিয়ে দেব।

আমি বসলাম। তিনি বললেন, তোমার মা বলছেন বিয়ের পর তোমার পাগলামি সেরে যাবে। কথা কিন্তু ঠিক। তবে বিয়ে না করলেও পাগলামি সারবে। তোমার যা হয়েছে তার নাম Calf love, বাংলায় বাছুর প্রেম। Calf love-এ তীব্র আবেগ থাকে, তবে তা হয় ক্ষণস্থায়ী।

আমি বললাম, ও আচ্ছা।

তিনি বললেন, বাছুর প্রেমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তোমার কল্পনাশক্তি। নানান কিছু তুমি কল্পনা করছ। এডোলেসেন্ট পিরিয়ডে কল্পনা মানুষকে রিয়েলিটির বাইরে নিয়ে যায়। বুঝেছ?

হুঁ।

তোমার জন্যে যে পাত্র পাওয়া গেছে, সে কী করে?

সে দর্জি।

আহসান সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, কী বললে? দর্জি?

আমি বললাম, মেয়েদের ব্লাউজ বানানো টাইপ দর্জি না। স্যুট কোট এইসব কাটে। মাস্টার টেইলর। ময়মনসিংহে তাদের বিশাল দোকান। ছেলের বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পাঁচ নম্বর সেক্টরে বাবার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন।

বাড়ি কোথায় বললে? ময়মনসিংহ?

জি। লেখক হুমায়ূন স্যারের দূরসম্পর্কের আত্মীয় হন। হুমায়ুন স্যার বলেছেন, ছেলে খুবই ভালো।

তার সঙ্গে কি এখন তোমার খাতির হয়ে গেছে?

তা না। আমার লেখা নিয়ে তাঁর কাছে গিয়েছি। তখন থেকে পরিচয়। আমার উপন্যাসের একটা নাম তিনি দিয়েছেন। তিনি নাম রেখেছেন দাঁড়কাকের সংসার। নামটা ভালো হয়েছে না?

তোমার লেখা উনি পড়েছেন?

হুঁ। যা-ই লিখি তাঁকে পড়াই। শাওন আপুকেও পড়াই।

 শাওন আপুটা আবার কে?

উনার স্ত্রী। ভৌতিক যে অংশটা লিখে ফেলে দিয়েছি, সেটা শাওন আপু খুবই পছন্দ করেছিলেন। হুমায়ূন স্যার যেই বললেন, ভালো হয় নি, সঙ্গে সঙ্গে ফেলে দিয়েছি। শাওন আপু তো আর লেখক না। তাঁর কথায় গুরুত্ব দেব কেন?

আহসান সাহেব কিছুই বললেন না, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তবে আমার কথায় বড় রকমের ধাক্কা যে তিনি খেয়েছেন তা বুঝলাম যখন দুপুরে আমার জন্যে কোনো খাবার এল না। খাবার পাঠানোর মতো মনের অবস্থা হয়তোবা তার ছিল না। কিংবা এও হতে পারে যে, তিনি ভুলে গেছেন।

সন্ধ্যাবেলা বড় মামা আমাকে ডেকে পাঠালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ফরিদার কাছে শুনলাম তুমি নাকি আজ সেজেগুজে চোখে কাজল দিয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছ?

ঠিকই শুনেছেন। ফটোসেশন ছিল তো, এইজন্যেই সেজেগুজে যাওয়া।

ফটোসেশন মানে?

আমার ছবি তোলা হলো। ফটোগ্রাফার হলেন মবিন সাহেব। গ্ল্যামার ফটোগ্রাফিতে তাঁর মতো কেউ বাংলাদেশে নাই।

ফটোসেশন হলো কেন?

কারণ আছে। এখন বলা যাবে না।

কেন বলা যাবে না? তোমার এবং বাড়িওয়ালা বুড়োটার মধ্যে সম্পর্কটা কী আমাকে বলো। ঝেড়ে কাশো।

আমি বললাম, কাশি থাকলে তবেই না ঝেড়ে কাশার প্রশ্ন আসে। আমার কোনো কাশি নেই।

বড় মামা বললেন, তুমি অবাধ্য, দুর্বিনীত বখাটে একটি মেয়ে। A spoiled Girl, বুঝেছ?

আমি বললাম, এখনো বুঝতে পারি নি। আপনি বুঝিয়ে দিন।

মা পুরো বিষয় ধামাচাপা দেওয়ার জন্যে বললেন, ভাইজান, বাদ দিন। লিপির বয়স কম। সে কী বলে না বলে নিজেও জানে না।

বড় মামা বললেন, তোমরা জানতে দাও না বলে জানে না। এই মেয়ে আমার ঘরে জন্ম নিলে সরলরেখা বানিয়ে ছেড়ে দিতাম।

রাতে বড় মামা দুই দফা মিটিং করলেন। মার সঙ্গে মিটিং, বাবার সঙ্গে মিটিং।

রাত সাড়ে এগারটার দিকে বাবা আমার ঘরে ঢুকলেন। তাঁর চিন্তিত শুকনা মুখ দেখে আমার খুব মায়া লাগল। তাঁকে খুশি করার জন্যে বললাম, বাবা! তোমাদের তাহেরপুর অপারেশনের গল্পটা আরেকবার বলো তো।

কেন?

আমাকে একটা রচনা লিখতে হবে–মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন।

বাবার মুখের চিন্তিতভাব মুহূর্তে দূর হয়ে গেল। তিনি তাহেরপুর অপারেশনের গল্প শুরু করলেন।

তারপর ঘটনা শোনো। চব্বিশ ঘণ্টা পর প্রথম পেটভর্তি খিচুড়ি খেলাম। খিচুড়ি আর মোরগের সালুন। খাওয়াদাওয়ার পর ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, এমন সময় আমাদের কমান্ডার সালেহ চৌধুরী বললেন, অস্ত্র হাতে নাও। আমরা তাহেরপুর যাব।…

বাবার গল্প পুরোটা শোনা গেল না। প্রতিমা এসেছে। সে দরজার ওপাশ থেকে চোখে ইশারা করছে।

আমি বাবাকে বললাম, তোমার তাহেরপুর অপারেশনের গল্প শোনার জন্যে প্রতিমাও চলে এসেছে। বাবা আমাকে দশ মিনিট সময় দাও। প্রতিমার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা বলব, তারপর দুজনে মিলে তোমার গল্প শুনব।

বাবা বললেন, অবশ্যই। মনে করিয়ে দিস, গৌরাঙ্গের কথা বলব। সব সময় তার কথা মনে থাকে না। অসাধারণ চরিত্র। বীর উত্তম পদক পাওয়া উচিত ছিল। কিছুই পায় নি। এখন শুনেছি সুনামগঞ্জ শহরে রিকশা চালায়। আফসোস আফসোস।

প্রতিমা আমার কাছে বিশেষ কাজে এসেছে। সে আমার উপন্যাসের শুরুটা লিখে এনেছে। তার শুরু এ রকম–

আমাদের বাড়ির রেলিংয়ে একটা দাঁড়কাক এসে বসেছে।
দাঁড়কাকটা সাইজে যথেষ্টই বড়। তার চোখ টকটকে লাল।
সে লাল চোখে আমাকে দেখছে।

আমার খানিকটা লজ্জা লজ্জা লাগছে। কারণ আমার
গায়ে কোনো কাপড় নেই। আমি সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে আমার ঘরে
অপেক্ষা করছি। কার অপেক্ষা? শুভ্রর জন্যে অপেক্ষা। শুভ্র
এখন মার সঙ্গে রাজনীতির গল্প করতে করতে চা খাচ্ছে।
তার বাসায় ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। ফিরে যাওয়ার
আগে সে আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসে দেখবে
নেংটো কন্যা বসে আছে।

 প্রতিমা বলল, এই পর্যন্ত লিখেছি। ঠিক আছে?

আমি বললাম, ঠিক আছে। তবে শুভ্র নাম দেওয়া যাবে না। শুভ্র হুমায়ূন আহমেদের ক্যারেক্টার। অন্যের চরিত্র নিয়ে কাজ করব না। এখন চল মুক্তিযুদ্ধ সেশান। বাবা গল্প বলার জন্যে জিহ্বা শাণ দিয়ে বসে আছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *