মুহম্মদ জাফর ইকবাল
যখন আমি আর আব্বা নৌকা করে রওনা দিই তখন আর সবাই নদীতীরে দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে চুপচাপ রওনা দেওয়াটা আমার খারাপ লাগল। আমি ভাবলাম যাওয়ার সময় একটা কিছু আলাপ করে আবহাওয়াটা সহজ করি। শেফুকে জিজ্ঞাসা করলাম–আজ কয় তারিখ, পাঁচ না?
হ্যাঁ–পাঁচ।
লাকি ডেট, তাই না?
আমি জানতাম পাঁচ তারিখ নিউমোরলজি অনুযায়ী আমাদের জন্যে লাকি ডেট তবু সবার সামনে কথাটা বলে আতঙ্ক দুর্ভাবনা কমাতে চাইলাম। নৌকায় রওনা দিলাম। নৌকাটা ছিল ভাঙা–পানি উঠছিল সাংঘাতিক, একটু পরে পরে আমি পানি সেঁচছিলাম। বহুক্ষণ নৌকায় যেতে যেতে আব্বা একটাও কথা বলেন নি। একবার জিজ্ঞেস করলেন, সেকেন্ড আর ফোর্থ অফিসার কোনো গ্রামে আছে আমি জানি কি না? আমি গ্রামের নাম বললাম। আব্বা হিন্দু মাঝিটাকে জিজ্ঞেস করলেন, পথে পড়বে নাকি? মাঝি জানাল যে পড়বে না। আমার সঙ্গে আব্বার আর কোনো কথা হয়নি–পথে শুধু এক চেয়ারম্যান আব্বার সঙ্গে খানিক আলাপ করেছিল। চেয়ারম্যান তখন খুব ব্যস্ত, চারদিক ভয়ানক লুটপাট। আব্বা তাকে বললেন আপনারা এটা বন্ধ করেন বাকিটুকু আমরা ঠিক করব। তখন চেয়ারম্যান আরও খানিকক্ষণ আলাপ করল, নৌকা থামেনি, কাজেই আলাপ বেশিক্ষণ চলতে পারে নি। পথে আরেকজন লোকের সঙ্গে দেখা। শক্তসমর্থ শরীর, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। আব্বাকে দেখে ভারি অবাক হলো, স্যার? আপনি যাচ্ছেন?
আব্বা হাসলেন, বললেন, দেখে আসি। লোকটার বিশ্বাস হয় না, জিজ্ঞেস করল, সত্যি যাচ্ছেন? সাহস পান?
আলাপ চালানোর জন্যে সে নৌকার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল, মিলিটারি সম্পর্কে তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা জানাল। আমরা যাচ্ছি মিলিটারির কাছে, তাই তার সব কথা বিশ্বাস করলাম না।
আমাদের নৌকা যখন কালীগঙ্গা নদীতে পড়ল তখন চারিদিকে আঁতিপাতি করে খুঁজেও আমি আর একটাও নৌকা দেখলাম না। হুলারহাট ডকটা একেবারে নির্জন। আমার কেমন খারাপ লাগল–একটু ভয় ভয়ও। নদী দিয়ে একটা সাদা লঞ্চ আসছিল–ওপরে পাকিস্তানি পতাকা। দেড়মাস পরে আবার আমি ভাবলাম গানবোটই নাকি কে জানে। নৌকা হুলারহাটে পৌঁছালে আমরা উপরে উঠে দেখি রশিদ মাথায় একটা টুপি চাপিয়ে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ যে ভয় ভয় লাগছিল রশিদকে দেখে সেটা একটু দূর হলো। রিকশা চেপে রওনা দিলাম। রশিদ মাঝে সাইকেল চালাতে চালাতে মিলিটারির গল্প করছিল। তার মুখ থেকে শুনলাম সেকেন্ড অফিসার আর ফোর্থ অফিসার সকালেই এসে গেছেন। পিরোজপুরে পৌঁছে মিলিটারির পজিশন নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে এসেছে, ফাঁকা আওয়াজ করেছে, কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে অগ্রসর হয়েছে অর্থাৎ রীতিমত যুদ্ধাভিযান। আমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছে।
এস.ডি.পি.ও কাহা?
রশিদ জানাল, সে বলল, গ্রামে ট্যুরে গিয়েছেন।
মিলিটারি বলেছে, ও ভাগ গিয়া!
রশিদের মতে মিলিটারিরা টাউনে কোনো অত্যাচার করে নি–মেজর সাহেব নাকি খুব ভাল মানুষ! শুধু কয়েকজন হিন্দুর বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। বাসায় পৌঁছে দেখি প্রকাণ্ড একটা পাকিস্তানি পতাকা শোভা পাচ্ছে। শুধু বাসায় না যেদিকে তাকানো যায় শুধু পাকিস্তানের পতাকা, বাসায়, দোকানে, রিকশায় এমনকি মানুষের পকেটে!
বাসায় ড্রয়িংরুম ফাঁকা, আসবাবপত্র শোয়ারঘরে গাদা করা। দুটো পালঙ্ক জড়ো করে জোড়াবিছানা, সবমিলিয়ে এক শ্রীহীন অবস্থা। আব্বা ও.সি.কে ফোন করে জানতে চাইলেন এখন কি করা। ওসি অভয় দিয়ে অফিসে চলে আসতে বললেন। আব্বা পোশাক পরলেন রশিদ সাহায্য করল। আব্বার ডান হাতের বোম খানিকটা কি ভাবে ছিঁড়ে গিয়েছিল, কিভাবে সেটা কাউকে বলেন নি, রশিদ সেটা ম্যানেজ করে দিলো। আব্বা একটা ডাইরি নিয়ে অফিসে গেলেন।
বাসায় চারিদিক থেকে ধূয়া উড়ছে–দুমদাম শব্দে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ভাঙা হচ্ছে–সে এক বিশ্রী ব্যাপার। আমি খানিকক্ষণ হরিণটাকে আদর করলাম। গোসল করে Wodehouse-এর একটা বই বের করলাম। রশিদ চা তৈরি করে দিলো, তার সুট করে আনা সম্পত্তি দেখাল। তখনই আমি প্রথম জানতে পারলাম মিলিটারিরা লুট করাচ্ছে। এখন আর লুট করা অপরাধ নয়, আইনগতভাবেও নয় নৈতিকভাবেও নয়। আমার মনটাই তেতো হয়ে গেল।
ভাত রাঁধা হলো, তরকারী কুখাদ্য–কৃমির মতো লম্বা লম্বা আতপ চাউল। আমি একলাই খেয়ে ফেললাম, আব্বা কখন আসেন ঠিক নেই। কিন্তু আব্বা আসলেন একটু পরেই। ইজিচেয়ারে বসলেন, মুখটা ভারি চিন্তাক্লিষ্ট। কথা না বলে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। ডাক্তার সাহেব আসলেন, তার মুখও কেমন বিবর্ণ উদ্ভ্রান্ত-উদ্ভ্রান্ত। ডাক্তার সাহেব আরেক কথা বললেন, মিলিটারি এসেই দু-জনকে মেরেছে, দুজনকে গুলি করেছে দৌড় দেওয়ার অপরাধে ইত্যাদি ইত্যাদি। আব্বা কোনো আলাপে বেশি উৎসাহ দেখালেন না, বার বার জিজ্ঞেস করলেন সেকেন্ড আর ফোর্থ অফিসার কই, কী ব্যাপার?
ডাক্তার সাহেব জানালেন তারা দুজন এসেছে খুব সকালে, সারা গায়ে কাদামাখা পাগলের মতো চেহারা। প্রথমে দেখা করেছেন আফজাল সাহেবের বাড়িতে, তিনি পাঠিয়েছেন হাসপাতালে। হাসপাতালে ডাক্তার সাহেব তাদের পোশাক বদলে দিলেন বাসায় এনে খেতে দিলেন দুধ, তারা খেতে চাইল না। তারপর দিলেন চা। চা খেলেন, কিন্তু দু-জনের কেউই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। একটু পরে কয়েকজন মিলিটারি আসল তাদের খোঁজে। ডাক্তার সাহেব জানালেন, তারা অসুস্থ। মিলিটারিরা বলল, রিকশায় বসতে পারবে তো, তাহলেই হবে। তারপর রিকশায় বসিয়ে তাদের নিয়ে গেল।
রশিদকে আব্বা একই কথা জিজ্ঞেস করলেন, রশিদ, সেকেন্ড অফিসার আর ফোর্থ অফিসার কই?
কেন স্যার? তারা তো তাদের বাসাতেই আছে। সেকেন্ড অফিসারের বাসাতেই মিলিটারিরা আশ্রয় নিয়েছে, কাজেই সেখানে গিয়ে সন্দেহ মিটানো সম্ভব ছিল না। আব্বা বারবার জানতে চাইছিলেন, তারা কি অ্যারেস্ট হয়েছে নাকি বাসাতেই আছে। কিন্তু কেউই এর সঠিক উত্তর বলতে পারল না, মিলিটারির এখন পর্যন্ত খারাপ রিপোর্ট নেই। আমরা ধরে নিলাম তারা বাসাতে ভালোই আছে। সেকেন্ড অফিসার আর ফোর্থ অফিসার সম্পর্কে আব্বার কৌতূহল। ওদের সম্পর্কে আমার জিজের কৌতূহল ছিল না, তাই ও ব্যাপারে আমি বিশেষ গুরুত্ব দিই নি।
আব্বা গোসল করলেন, নামাজ পড়লেন, সেই অখাদ্য খাবার খেলেন। তারপর বিছানায় শুয়ে বললেন, বাবা আমায় চারটার সময় ডেকে দিবি। মিটিংয়ে যেতে হবে।
আমি বললাম, ঠিক আছে।
বারটার সময় আব্বাকে ডাকতে গিয়ে দেখি আব্বা মোটেই ঘুমাননি–বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে আছেন মাত্র। সারা দুপুর আব্বার মুখ চিন্তায় যে-রকম ভারাক্রান্ত হয়েছিল
এখন তা আর নেই, বরং সমস্যা মিটে গেলে যে-রকম প্রফুল্লতা ফিরে আসে সেরকম প্রফুল্ল। আব্বা নিজেই উঠলেন–নামাজ পড়লেন, তারপর পোশাক পরে নিলেন, আমি বোতাম লাগিয়ে ভাঁজ ঠিক করে আব্বাকে সাহায্য করলাম। আব্বা যাবার সময় বাইরের ঘরের দরজার কাছে এসে আমাকে বললেন, বাবা, আমার জন্যে দোয়া করিস।
ডাক্তার সাহেবও মিটিংয়ে যাবেন, আব্বা যাবার সময় তাকেও ডেকে নিলেন।
আমার কোনো কাজ নেই। রশিদ কার ঘর লুট করে পুরো এক ড্রাম চাল এনেছে। আমাকে মাথায় দেবার সুগন্ধি তেল সেধেছে, তালা, তাস, পুরানো র্যাদ, লুট করতে কিছু বাকি রাখে নি। বারান্দায় বসে দেখলাম, হাসপাতাল থেকে গুলি খেয়ে মৃত এক রোগির লাশ রিকশায় সরানো হলো।
আমি বিকেলে বাসার সামনে এসে বসলাম। ডাক্তার সাহেবের বাসা থেকে, বাবু আফরিন ওরা এতদিন পরে আমাকে দেখে ছুটে এল, আমার সঙ্গে তাদের হাজারো রকম ছেলেমানুষি গল্প।
একটু পরে দেখলাম কুলির মাথায় করে এক লাখ টাকা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ট্রেজারি লুটের টাকা! কোত্থেকে জানি জোগাড় করা হয়েছে। আরও কিছুক্ষণ পর দেখলাম রিকশা করে মিলিটারি আসছে। তারা নকশালদের ধরে আনছে। ফজলুর হাত পিছমোড়া করে বাঁধা আড়ষ্টভাবে বসে আছে–খালি গা। মুখের ভাব উদ্ধত। আরও কয়জন ছেলে, একজনের চোখ বাঁধা। সবাইকে চিনি না। খবর নিয়ে জানলাম কোননা বাড়িতে লুকিয়ে ছিল গ্রামবাসীরা ধরে দিয়েছে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। ডাক্তার সাহেবের বাসা থেকে এক গ্লাস দুধ পাঠালেন খালাম্মা। আমার গিয়ে দেখা করা উচিত কিনা ঠিক করতে পারলাম না। সন্ধ্যার দিকে কোর্ট ইন্সপেক্টর সাহেব রশিদকে দিয়ে তার বিছানা নিয়ে গেলেন।
বেশ আঁধার হয়ে এসেছে তখর। রশিদ এসে বলল, আফজল সাহেবের বাসায় যে মুনশি থাকে, সে বলেছে সেকেন্ড আর ফোর্থ অফিসারকে নাকি গুলি করে করে মেরে ফেলেছে।
ধ্বক করে আমার বুক কেঁপে উঠল। এই প্রথম আমার আব্বার জন্য চিন্তা হলো। আব্বা এখনো আসেন নি।
দৌড়ে গেলাম ডাক্তার সাহেবের বাসায়। ডাক্তার সাহেব হতচেতনের মতো বেঞ্চে শুয়ে আছেন। আমাকে দেখে উঠে বসলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, চাচা ওরা সেকেন্ড আর ফোর্থ অফিসারকে নাকি গুলি করে মেরেছে?
আমিও এ-রকম কথা শুনে এসেছি, এসেই শুয়ে পড়েছি।
আব্বা–তাহলে আব্বা–
তোমার আব্বা এখনো আসেননি?
তারপর রশিদকে পাঠালেন থানায় খবর আনতে। আমি খবরাখবর নিলাম। মিটিংয়ে কে কে ছিল, কে কী বলেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। রশিদ খবর আনল সবাই চলে এসেছে। আবার যাবে একটু পরে। আব্বা কর্নেলের সঙ্গে আলাপ করছেন এখনো আসেন নি। খালাম্মা তাদের বাসায় থাকতে বললেন, আমি বললাম, না-না, আব্বা আছেন তো, আমার ভয় করবে না–
—
কারফিউর সময় হয়ে আসছে আমি বাসায় চলে এলাম। যতই সময় পার হতে লাগল, ততই দুশ্চিন্তায় আমার হতে পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগল। আমি প্রতি মুহূর্তে আশা করছিলাম এই বুঝি দরজায় ধাক্কা শুনব, আর খুলেই দেখব আব্বা দাঁড়িয়ে আছেন। আস্তে আস্তে আটটা বাজল, এখনো আব্বার দেখা নেই। আমি মনকে প্রবোধ দিলাম, আব্বার কিছু হয় নি, আব্বা ভাল আছেন। কর্নেলের সঙ্গে আলাপ করছেন। হঠাৎ কর্কশ স্বরে এক ঝাঁক গুলির তীব্র আওয়াজ হলো, খুব কাছে। সাথে সাথে আঁ-আঁ-আঁ করে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল। আমি শিউরে উঠে পর মুহূর্তে বুঝতে পারলাম, মানুষের চীৎকার নয় কাক। আমার সারা শরীর শীতল হয়ে উঠল। আশে পাশে এখানে সেখানে গুলির আওয়াজ, প্রতিটা গুলির শব্দ আমার স্নায়ুকে ভয়ানক আঘাত দিয়ে দিয়ে একেবারে দুর্বল করে তুলল। আমি বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার দোয়া, দোয়া ইউনুস পড়তে চাইলাম, মনে পড়তে চাইল না, মুখে আটকে যেতে লাগল।
মনকে প্রবোধ দিচ্ছিলাম আব্বা কর্নেলের সঙ্গে আলাপ করছেন। আসবেন আরেকটুকু পরে। অশুভ চিন্তা মনে আসতে চাইলেই আমি সেটাকে জোর করে সরিয়ে দিচ্ছিলাম, এইভেবে যদি কয়েকজনকে গুলি করে মারতে চায় তাহলে এলোপাথাড়ি আওয়াজ হবে না, আওয়াজ করতে হবে সুনির্দিষ্ট। একটু পরে পরে। দশটার দিকে আটটা গুলির আওয়াজ শুনলাম, সুনির্দিষ্ট শব্দ, একটার পর একটা আমার মনে হলো আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাব।
আমার চিন্তা করার ক্ষমতা নেই, ভাববার সময় নেই, শুধু প্রার্থনা করছি–আল্লাহ বাঁচাও–তুমি প্রাণ ভিক্ষা দাও…
রশিদ আর ইসমাইল বারবার আমাকে ভাত খেয়ে নিতে বলল ভাবখানা আমাকে এখন ভাত খাওয়াতে পারলেই একটা মস্তকিছু কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে!
আমি থানায় ফোন করি নি, ভয় লাগছিল–যদি শুনতে পাই আর সবাই ফিরে এসেছে শুধু আব্বা আসেন নি। এমন সময় টেলিফোন বাজল, নাজিরপুরের ও. সি. আব্বাকে খুঁজছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের পরিবারকে নাজিরপুরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে নৌকা পাঠাতে হবে কি না–
আমি বললাম, না না এখন না। কি ভেবে বললাম, জানি না।
এগারোটার সময় আমি ফোন করলাম থানায়। জিজ্ঞেস করলাম, আব্বা সামনে আছেন?
না তো, এখনো আসেন নি!
না? ও.সি. সাহেব, সি.আই সাহেব…
তারা তো সবাই ও.সি. সাহেবের বাসায় ঘুমিয়ে আছে।
আমার সবকিছু জিজ্ঞেস করা ফুরিয়েছে।
বাকি রাতটা কেটেছে অবর্ণনীয় দুশ্চিন্তায়। লিখে সেটা প্রকাশ করা যায় না। দরকারও নেই— এদেশে একজন মানুষের দুঃখ কষ্ট দুশ্চিন্তার কোনো মূল্য নেই, এটা নতুন নয়, অভাবনীয়ও নয়।
সকালে রশিদ খবর আনতে গেল। খবর নিয়ে এল কাঁদতে কাঁদতে। চোখের পানিতে বুক ভেসে যাচ্ছে, আমার বুঝতে বাকি রইল না সে কি খবর এনেছে। বললো, ভাই আপনে বাড়ি যান। ছোটো জমাদার বলেছে গত রাতে সাহেবকে গুলি করেছে।
এরপরে বহুবার বহুভাবে এ-খবর শুনেছি কিন্তু প্রথম বার শুনে আমার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল একটু অদ্ভুত, আমি শুধু যন্ত্রের মতো মনে মনে নিজেকে বলছিলাম, পৃথিবীর সব দুঃখ সময়ের সাথে কমতে থাকে। দুঃখ সময়ের সাথে কমতে থাকে। আমার অবাক লাগছিল। এইভেবে সময়ও কি আমায় এই দুঃখের ওপর প্রলেপ বুলাতে পারবে?
আমি প্রথমে গেলাম ও.সি. সাহেবের বাসায়। ঢুকলাম অবাঞ্ছিতের মতো। সি.আই, কোর্ট ইন্সপেক্টর কিংবা ও.সি, সাহেব আমার দিকে তাকালেন নিরুৎসুকের মতো। আমার বক্তব্যেও তাদের যেন কোনো কৌতূহল নেই। আমি চেষ্টা করলাম, কান্না আটকিয়ে রাখতে, তবু গলার আওয়াজ হলো ভাঙা ভাঙা, চাচা, আব্বাকে নাকি গুলি করেছে, তাহলে ডেড বডি…
এ-খবরেও তারা চমকালো না। কোথা থেকে শুনেছ এ-ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল, আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর পেলাম না। এ ব্যাপারটা অসম্ভব এ-রকম আশ্বাসও দিলো না। একরকম উপেক্ষিত হয়ে বের হয়ে এলাম। রাস্তায় নেমে কান্না চাপতে পারলাম না।
কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এসে ঢুকলাম।
খালি বাসায় বারান্দায় বলে আমি কাঁদতে লাগলাম, হরিণটা বার বার এসে আমাকে শুঁকে শুঁকে গেল। রশিদ ইসমাইল আমায় সান্ত্বনা দিচ্ছিল—মানুষের কষ্টের সময় সান্ত্বনাবাক্য যে কি খারাপ লাগে আমি আগে জানতাম না।
ডাক্তার সাহেবের বাসা থেকে আমার জন্যে নাস্তা পাঠান হলো, ডাক্তার সাহেব আমায় ডেকে নিয়ে তাদের ঘরে বসালেন। খালাম্মা। খুবই সহজ সরল মানুষ, আমায় ছেলেমানুষ ভেবে অবাস্তব সব কথা বলে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। নিজের ছেলে মেয়েদের বলছিলেন, যাও, তোমার ইকবাল ভাইয়ের কাছে গিয়ে বসে গে। যে-শিশুরা গত বিকেলে সারাক্ষণ আমার কোলের ওপর বসে কাটিয়েছে, এখন তারাই আমার কাছে ঘেঁষল না, পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি মারতে লাগল।
আমি সারাক্ষণই কাঁদছিলাম। প্রথম সান্ত্বনা পেলাম ডাক্তার সাহেবের কাছে। আমায় একসময় বললেন তুমি এখনই কাঁদছ কেন? আগে সত্যি জেনে নাও তোমার আব্বা মারা গেছেন কি না। আমি চোখ মুছলাম, সত্যিই তো আমি কেন ভাবছি আব্বাকে গুলি করা হয়েছে? কী প্রমাণ আছে? ডাক্তার সাহেব আফজল সাহেবকে বললেন খবর আনতে, আমি অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। যখন ফিরে। এলেন আমি জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে তারা বললেন, তিনি জানতে পারেন নি। তবে কর্নেলকে বলে এসেছেন ট্রায়াল ছাড়া যেন বিচার করা না হয়।
আমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব তখনো বাকি। আম্মাদের কাছে এই খবর নিয়ে পৌঁছাতে হবে। কোনো পাকা খবর নেই আব্বাকে নিয়ে গেছে এতটুকু মাত্র জানি, তারপর কি হয়েছে কে জানে। দুপুরে ভাত খেলাম ডাক্তার সাহেবের বাসায়। নয় মাইল হেঁটে এই খবর নিয়ে যেতে হবে। শক্তির দরকার।
সব টাকা ছিল আব্বার কাছে। তাই ডাক্তার সাহেবের কাছ থেকে টাকা নিলাম। ট্রেজারি লুট হয়েছে কাজেই নতুন নোট কেউ নিতে চায় না। ডাক্তার সাহেব বেছে বেছে পুরানো নোট দিলেন। শার্টপ্যান্ট না পরে লুঙ্গি আর শার্ট পরলাম, রশিদ মাথায় পরিয়ে দিলো তার টুপি। তারপর রওনা দিলাম।
পিরোজপুর থেকে হুলারহাট পর্যন্ত সাড়ে তিন মাইল রিকশায় যাওয়া যায়, কিন্তু আমাকে এ-জায়গাটুকুও হেঁটে যেতে হলো। সব রিকশাওয়ালারা নাকি লুট করতে বের হয়েছে। রাস্তা চিনি না তাই সঙ্গে রয়েছে ইসমাইল।
নয় মাইল যেতে যেতে আমি কখনো কখনো হাঁটা ছাড়া আর সবকিছু ভুলে গেলাম, কিন্তু যখনই সব মনে পড়ত তখনই মনে হতো আমার বুক ফেটে যাবে। আমি কোন মুখে আম্মাদের এ-খবর জানাব, এ-খবরের পর তাদের কি অবস্থা হবে ভেবে আমি অস্থির হয়ে পড়লাম। আমি জেনেছি আস্তে আস্তে, তারা সেটা জানবে হঠাৎ করে একবারে। কি সাংঘাতিক একটা আঘাত পাবে।
যতই বাবলা গ্রাম কাছে আসতে লাগল ততই আমার পা আটকে আসতে লাগল। পথে ছিন্নমূল অসহায় হিন্দু পরিবারগুলোকে দেখেও আমার অনুভূতির কোনো তারতম্য হলো না। বাবলা খালের সাঁকোটা পার হতেই খাঁ সাহেবের একজন ছেলে সঙ্গ নিলো। জিজ্ঞাসা করল, কী খবর? আমি বললাম, ভালো।
বাড়িতে পৌঁছে আমার মনে হলো যদি এ-খবর আগেই পৌঁছে যেত তাহলে আমার কিছু বলতে হতো না। কিন্তু এখনো কোনো খবর পৌঁছেনি। খবর দেওয়ার জন্যে আমি ঘরে ঢুকলাম।
প্রথমে শেফু পরে আম্মা নামলেন। শেফু জিজ্ঞেস করল, কী। খবর?
খারাপ খবর। তোরা কিছু শুনিস নি? শেফুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, না! কী?
আমি এক নিশ্বাসে সব বলে দিলাম। আব্বা মিটিংয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেন নি, কেউ কেউ বলছে গুলি করে দেওয়া হয়েছে। আম্মা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর সিঁড়িতেই বসে পড়ে মুখে আঁচল গুঁজলেন, কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন, আমি নিজের হাতে মেরে ফেলেছি। আমি নিজের হাতেমেরে ফেলেছি।
প্রথমবারের মতো আমাদের পূৰ্বিারের সবার কান্নার শব্দ হাহাকার করে উঠল।*
[* স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বলেশ্বরী নদীর তীর থেকে ফয়জুর রহমানের দেহাবশেষ। উদ্ধার করে জানাজা পড়িয়ে পিরোজপুরের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।]