৪. আধুনিক ভারতীয় কৃষিতে পিছিয়ে-পড়া উৎপাদন-সম্পর্ক

চতুর্থ অধ্যায়

আধুনিক ভারতীয় কৃষিতে পিছিয়ে-পড়া উৎপাদন-সম্পর্ক

আমরা দেখেছি, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় কৃষিতে স্বাধীন ভারত সরকার যে-ভূমিসংস্কারের কর্মসূচি নিয়েছিল, বিভিন্ন ইউরোপিয়ান ও এশীয় দেশের ভূমিসংস্কারের সঙ্গে নানা বিষয়ে তার পার্থক্য যথেষ্ট স্পষ্ট। প্রথমত এই কর্মসূচির মধ্যে কোথাও ভাগ-চাষ প্রথা বা খাজনার বিনিময়ে জমি ভাড়ার প্রথায় ছেদ টানার কোনও পরিকল্পনা ছিল না। এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে তাকে মানুষের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য ভাগ-চাষ প্রথায় ভাগ-চাষি অথবা ভাড়াটে চাষির অধিকারের সুরক্ষা ও ভাগ-চাষির ফসলের ভাগ নির্দিষ্ট করার জন্য কিছু কিছু পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ভাগ-চাষ প্রথা অবসানের কোনও কর্মসূচিই নেওয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, ঊর্ধ্বসীমা বহির্ভূত জমি অধিগ্রহণ ও তার পুনর্বণ্টনের কর্মসূচিটি বিভিন্ন দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ ছিল। জমি অধিগ্রহণের পাশাপাশি সবক্ষেত্রেই নানা প্রকার ছাড় দেওয়া হয়েছিল যাতে ব্যক্তিগত কর্তৃত্বে চাষের উদ্দেশ্যে সীমা-বহির্ভূত অধিকৃত জমি মালিক তার নিজস্ব হেফাজতে রাখতে পারে। এই সুবিধাগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রেই এই ঊর্ধ্বসীমা আইন লঙ্ঘন করার সুযোগ থেকে গিয়েছিল। ঊর্ধ্বসীমা আইনটি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট দৃঢ়তার অভাব ছিল, ফলে বহু জমি-মালিক সীমা-বহির্ভূত জমি বেনামে রেখে দেওয়ার সুযোগ নেয়। সীমা-বহির্ভূত জমি পুনর্বণ্টনের বিষয়টি ছিল সবচেয়ে অবহেলিত। কৃষির ওপর মহাজন ব্যবসায়ীদের যুগ্ম চাপ থেকে চাষিরা যাতে মুক্ত হতে পারে সে জন্য ছোট কৃষি-জোতগুলিকে স্বাধীনভাবে প্রগতিশীল উৎপাদন পদ্ধতি গ্রহণে সাহায্য করার দরকার ছিল। এর উপায় ব্যাংক ঋণ ব্যবস্থাকে আরও ব্যাপকভাবে গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের কাছে সহজলভ্য করে তোলা, কিন্তু সেই লক্ষ্যে কোনও কর্মসূচি নেওয়া হয়নি। মহাজনি কারবার নিষিদ্ধ করার জন্যও কোনও আইন-নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হল না। বাজারে কৃষিজাত পণ্যের স্বাধীন ক্রয়-বিক্রয় সুনিশ্চিত করার জন্য উপযোগী কোনও সংগঠিত বাজার-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হয়নি। ভূমি সংস্কারের দীর্ঘকালীন কর্মসূচি হিসেবে সমবায়-ব্যবস্থায় উৎপাদন-ব্যবস্থাকে কখনওই গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হল না। এসবের পরিণামে সংস্কারের পরেও ভারতের কৃষি উৎপাদন-ব্যবস্থা নানাপ্রকার পিছিয়ে পড়া বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ফলে যে-বৈশিষ্ট্যগুলি ভারতের কৃষিকে দীর্ঘকালীন অনুন্নতির মধ্যে রেখে দিল সেগুলি হল: ১) বাণিজ্যিক ও মহাজনি পুঁজির দাপট। ২) জমি ও শ্রমের অবিচ্ছিন্নতা, অসংগঠিত শ্রমের বাজার। ৩) সংগঠিত ঋণের অপ্রতুল জোগান। ৪) সংগঠিত পণ্য-বাজারের অপ্রতুল উপস্থিতি, যার ফলে ছোট চাষির পণ্য বাজার-জাত করার প্রক্রিয়ায় উদ্বৃত্তের বড় অংশ বাণিজ্যিক পুঁজি হিসেবে আবদ্ধ থাকে। ৫) সংগঠিত ঋণের আয়োজন ছিল অপ্রতুল। ফলে ছোট চাষির ওপর মহাজনি শোষণ চলতে থাকে এবং তার ফলে পুঁজির একটা বড় অংশ মহাজনি পুঁজির আকারে মহাজনি কারবারে আবদ্ধ থাকে। ৬) উৎপাদন-সম্পর্কে এই সমস্ত প্রাক-পুঁজিবাদী বৈশিষ্ট্য থেকে যাওয়ায় উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটে ধীর গতিতে।

ভারতের মতো যেসব দেশ দীর্ঘকাল সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শাসনপ্রক্রিয়ার প্রভাবে ছিল, ফলত উন্নয়নের নিরিখে যারা পশ্চাদপর, তাদের সঙ্গে আজকের উন্নত পুঁজিবাদী অর্থনীতির অধীন দেশগুলির পার্থক্যের একটি বড় কারণ হল, দুই ধরনের দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় কৃষির অবদানের পার্থক্য। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিম ইউরোপের প্রথম সারির উন্নত দেশগুলির সমগ্র অর্থনীতিতে যে-নূতন বৈশিষ্ট্যের সূচনা হয়েছিল তার মূলে ছিল তার পূর্ববর্তী প্রায় একশো-দেড়শো বছরের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ইতিহাস। ইংল্যান্ড তথা বিভিন্ন পশ্চিম ইউরোপীয় উন্নত দেশগুলির সেই সময়কার অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীব্যাপী দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সেসব অঞ্চলে বহির্বাণিজ্য বিপুল প্রসারিত হয়েছিল, তার সঙ্গে সঙ্গে বণিকের হাতে জমে ওঠা পুঁজি ছোট উৎপাদন ক্ষেত্রগুলিতে বাণিজ্যিক ও মহাজনি পুঁজি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। এর মধ্য দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কেন্দ্রগুলির ওপর বণিক শ্রেণির প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়া চালু ছিল। ফলে ছোট উৎপাদন ক্ষেত্রগুলি সংযুক্ত হয়ে বড় উৎপাদন ক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয়। কৃষিপণ্যের উৎপাদনের ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণ ও কৃষিতে বাজারমুখি মুনাফাভিত্তিক উৎপাদন-প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটে। অপর দিকে একই সময়ে ছোট কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত চাষি, ছোট কারিগর ও ছোট কৃষি উৎপাদকরা নিজ নিজ উৎপাদন-ক্ষেত্র থেকে উচ্ছিন্ন হতে থাকে, উৎপাদন-উপকরণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয় এবং মুক্ত স্বাধীন শ্রমিক হিসেবে নিযুক্তির অপেক্ষায় থাকা বিপুল সর্বহারার দলে পরিণত হয়। এর বিপরীত প্রক্রিয়া হিসেবে জমি সমেত বিভিন্ন উৎপাদন-উপকরণ ক্ষুদ্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক উৎপাদন-ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কৃষি উপকরণের নবগঠিত বাজারের অংশে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়ার সমান্তরাল প্রক্রিয়া হল একদিকে বহির্বাণিজ্য থেকে আসা বিপুল আর্থিক পুঁজির সঞ্চয়, অন্যদিকে উৎপাদনের উপকরণের ওপর নিয়ন্ত্রণকারী এবং সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী নূতন বাণিজ্যিক পণ্যের উৎপাদক সম্প্রদায়ের প্রভাব বৃদ্ধি। এই দুই অবস্থার ফলস্বরূপ উৎপাদন-ক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগের অবস্থা সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে, সদ্য পুরনো উৎপাদন-ক্ষেত্র থেকে মুক্ত হয়ে আসা উৎপাদন-উপকরণের সমষ্টি এবং জমি ও পুরনো উৎপাদন-ক্ষেত্র থেকে উৎখাত হয়ে আসা, শ্রমের বিনিময়ে মজুরী প্রত্যাশী মানুষের বিপুল শ্রমের ভাণ্ডার কাজে লাগিয়ে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করে বিনিয়োগযোগ্য পুঁজি। নূতন মজুরি-শ্রমিকভিত্তিক অকৃষি উৎপাদন-কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ দেখা দেয়। সারা পৃথিবী জুড়ে, বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে, বাণিজ্যবিস্তারের ফলে এই ক্রমবর্ধমান বাজার ও কাঁচামালের উৎসের ক্রমবিস্তার আজকের উন্নত ধনতান্ত্রিক পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির পুঁজিবাদী উৎক্রমণ প্রক্রিয়ায় সহায়কের ভূমিকা নেয়। এইসব দেশের অভ্যন্তরে ক্রমবিকাশমান পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থার বিকাশের এই প্রক্রিয়া দেশের অভ্যন্তরে কৃষি-উৎপাদন ক্ষেত্রের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। শ্রমের ক্রমবর্ধমান চাহিদা কৃষিক্ষেত্র থেকে শ্রম বহির্গমনের পথকে আরও মসৃণ করে। ইতিমধ্যেই বাণিজ্যিকীকরণের মধ্য দিয়ে বৃহৎ জমির মালিকরা কৃষি-উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছিল। পৃথিবীব্যাপী বাজারের বিস্তারে উৎসাহিত বাণিজ্য-পণ্য উৎপাদনকারী শ্রেণিটি এবার কৃষি থেকে উৎখাত হওয়া শ্রম ও উৎপাদনের উপকরণগুলি একত্র করার মাধ্যমে সঞ্চিত আর্থিক পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ গ্রহণ করে পূর্ণ মাত্রায়। এই প্রক্রিয়ার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে কৃষিতে পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থার সূচনা ও বিস্তার ঘটে। পরবর্তী কালে এই কৃষি-উৎপাদন ক্ষেত্রগুলি এক-একটি বিরাট লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

আজকের উন্নত দেশ জাপানের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ইউরোপের পার্থক্য থাকলেও জাপানেও উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাহীন করার জন্য ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে কৃষির পশ্চাদপদ লক্ষণগুলিকে সম্পূর্ণ বিলোপ করা হয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি এবং জাপান, এই উভয় ক্ষেত্রেই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে কৃষি-জমি, কৃষি-উৎপাদনের উপকরণ, কৃষি-শ্রমিক, কৃষিপণ্য ও কৃষিঋণের সংগঠিত বাজার-ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। ভারতের উন্নয়নের ইতিহাস অনুরূপ উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়নি, ফলে এখানে উন্নয়নের প্রক্রিয়ার গতিকে সক্রিয় রাখার প্রয়োজনে কৃষিতে আমূল পরিবর্তন আনার অবস্থা তৈরি হয়নি। আমরা দেখেছি ষোড়শ–সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে ইউরোপ ও জাপানের কৃষিতে যে-আমূল ভূমিসংস্কার হয়েছিল, ভারতের কৃষিতে তেমন সফল কর্মসূচি নেওয়া হয়নি; ভূমিসংস্কারের যে-কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল তার পিছনে কৃষি-শিল্প সহ গোটা অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। কারণ প্রথমত এই গোটা প্রক্রিয়া শুরুর আগে বাণিজ্যিক কাজকর্মের মাধ্যমে বিপুল আর্থিক উদ্বৃত্ত জমা হতে পারেনি। এই দেশ বিদেশি শাসনের অধীনে থাকায় বিদেশি বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলি তাদের অসম বাণিজ্যিক নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে উদ্বৃত্তের বড় অংশ উৎপাদনশীল পুঁজি হিসেবে নিজ দেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে নিয়ে যেত। তাই দেশীয় উদ্যোগে উৎপাদনশীল বিনিয়োগে উৎসাহী কোনও শ্রেণি, তাদের হাতে জমা থাকা আর্থিক পুঁজি উৎপাদন-ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সুযোগ যারা খুঁজছে— এমনটা ঘটার মতো কোনও পরিস্থিতি তখন এ দেশে গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয়ত, একইরকম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল, এদেশের বাণিজ্যিক-মহাজন শ্রেণিটি ঝুঁকিপূর্ণ পুঁজিবাদী বিনিয়োগের পরিবর্তে কম ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্য ও মহাজনি কারবারে তাদের আর্থিক পুঁজি ব্যবহার করতে বেশি আগ্রহী ছিল। কারণ, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত অবস্থা এর অনুকূলে ছিল না। প্রথম স্তরের বড় মধ্যস্বত্বভোগীদের পুরনো ক্ষমতার অবসান হলেও গ্রামীণ রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতার বিন্যাসে দ্বিতীয় স্তরে অবস্থানকারী পুরনো স্থানীয় ক্ষমতাশালী ভূস্বামীদের কর্তৃত্ব খর্ব হয়নি। স্বাধীন শ্রমের ও উৎপাদনের উপকরণের বাজার গড়ে ওঠার পথে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল পুরনো ক্ষুদ্র চাষভিত্তিক উৎপাদন কাঠামোতে কৃষি-জমি, অন্যান্য উপকরণ ও কৃষি-শ্রমিকের জমির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকা। ফলে জমি, শ্রম ও উপকরণের মুক্ত বাজার ছিল অনুপস্থিত। এর সঙ্গে কৃষিঋণ ও কৃষিপণ্যের অসংগঠিত ও অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজার ব্যবস্থায় ঋণ উপকরণ ও পণ্যের বাজারের যুক্ত ক্রিয়ায় সম্ভাব্য কৃষি-উদ্বৃত্ত কৃষিতে উৎপাদনশীল বিনিয়োগের পথ থেকে সরে গিয়ে অনুৎপাদক বাণিজ্যিক মহাজনি পুঁজির কলেবরই বৃদ্ধি করে ও অনুৎপাদক ক্ষেত্রে চলাচল করতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে কৃষিক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ উৎপাদনশীল বিনিয়োগের তুলনায় বাণিজ্যিক মহাজনি পুঁজি পণ্য, উপকরণ ও ঋণের যুগ্ম বাজার-প্রক্রিয়ায় ঝুঁকিহীন বিনিয়োগের পথ খুঁজে নেয় এবং তার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীর হাতে বেশি সম্ভাব্য আয় সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং উৎপাদন ব্যবস্থাকে দীর্ঘকালীন জড়ত্বের মধ্যে আবদ্ধ রেখে সমস্ত সম্ভাব্য কৃষি-উদ্বৃত্ত উৎপাদনশীল বিনিয়োগের ক্ষেত্র থেকে সরে যায় এবং অনুৎপাদক বিনিয়োগের চক্রে আবদ্ধ থাকে।

ইংল্যান্ডে যৌথ মালিকানায় থাকা সাধারণের ব্যবহার্য গোচারণভূমিগুলিকে ব্যক্তিগত পৃথক মালিকানার আওতায় এনে ছোট পশুপালকদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, বড় বড় পশুচারণ ভূমিকে ব্যবসায়ী উৎপাদক শ্রেণির ব্যক্তিগত মালিকানায় এনে দূরদূরান্তের বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদন করা, এবং তার ওপর ভিত্তি করে বাণিজ্যের মাধ্যমে সঞ্চিত বিপুল আর্থিক পুঁজির পুজিবাদী ধরনের বিনিয়োগের পথ প্রস্তুত করা। এই প্রক্রিয়ার পরিণামে একদিকে শ্রম, জমি ও অন্যান্য উপকরণের স্বাধীন বাজার গড়ে উঠেছিল, অন্যদিকে বাণিজ্যিক, মহাজনি ও বড় ভূস্বামীর হাতে জমে থাকা উদ্বৃত্ত কৃষিতে বিনিয়োগ করে কৃষিকে পুঁজিবাদী উৎপাদনের নিয়মের আওতায় এনে ফেলেছিল। আর্থিক পুঁজির জোগানদাতা বাণিজ্যিক-মহাজনি কাজের মধ্য দিয়ে সঞ্চিত পুঁজির নিয়ন্ত্রক বিনিয়োগকারীদের ব্যক্তিগত উদ্যোগেই এসব ঘটেছিল। সমস্ত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত ব্যবস্থা এই পরিবর্তনকে বাস্তবায়িত করার উদ্যোগের পিছনে সহায়তার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। এই একই উদ্যোগী শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত অ-কৃষি উৎপাদনক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী শ্রেণিটি গিল্ডের বন্ধন থেকে ছোট অ-কৃষি উৎপাদককে মুক্ত করে প্রথমে এদের স্বাধীন উৎপাদকে পরিণত করে, পরবর্তীতে এদের বড় বড় উৎপাদন ক্ষেত্রে একত্রিত করে বড় পুঁজিবাদী উৎপাদন-সংস্থায় পরিণত করার প্রক্রিয়া চালু করেছিল। সর্বোপরি পশ্চিম ইউরোপের প্রায় সব দেশেই এই পরিবর্তনগুলি আনার জন্য যে রাজনৈতিক-সামাজিক ও আইনগত ব্যবস্থা পত্তনের প্রয়োজন ছিল তাকে বাস্তবায়িত করা হয়েছিল রাষ্ট্রক্ষমতায় পুরনো সামন্তবাদী প্রভুদের জায়গায় প্রথমে বণিকশ্রেণির প্রতিনিধিদের এবং পরবর্তীতে পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। আমাদের দেশে বিদেশি শাসনের অবসানের আগে বা পরে, কৃষি-উৎপাদন ব্যবস্থায় এই ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ভূমিসংস্কারের যে-কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল তা ভূমিসংস্কার আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে অজস্র ত্রুটি এবং সংস্কারের পিছনে দৃঢ় রাজনৈতিক প্রত্যয়ের অভাবের কারণে অনেকাংশে অকেজো হয়ে পড়ে। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সবথেকে ওপরের স্তরের মধ্যস্বত্বভোগীদের ক্ষমতা বিলুপ্ত করা হলেও তার নীচের অসংখ্য মধ্যস্বত্বভোগী নানাভাবে আইনের ফাঁক ও আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে তাদের পুরনো অবস্থাতেই থেকে যায়। পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের বিকাশের পূর্বশর্তগুলির মধ্যে প্রধান শর্তটি পূরণের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার ফলস্বরূপ আমরা দেখি একদিকে জমির আইনগত ঊর্ধ্বসীমা বহির্ভূত জমির মালিকানায় মোট জমির একটি বড় অংশ রয়ে গেছে, অন্যদিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতির নানা গতি-নির্ধারক শক্তির কার্যকারিতার অভাবে ভারতীয় কৃষি বিপুলসংখ্যক ক্ষুদ্র জোতের একটি গতিহীন কৃষি-অর্থনীতিতে পর্যবসিত হয়েছে।

পুঁজিবাদী অর্থনীতির গতিনির্ধারক শক্তিগুলির মধ্যে প্রধান হল স্বাধীন মুক্ত বাজার-ব্যবস্থা। পূর্বতন সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংগঠিত প্রাতিষ্ঠানিক মহাজনি পুঁজি ছিল অনুপস্থিত। শ্রম-উপকরণ-কৃষিপণ্যের মুক্ত বাজারও তাই। এর ফলে বাণিজ্যিক ও অসংগঠিত মহাজনি পুঁজির সংযোগে গঠিত আর্থিক পুঁজি ছোট উৎপাদকের উৎপাদনের ওপর কর্তৃত্ব করত, চড়া সুদে মহাজনি ঋণ ও অসম বাণিজ্যিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ছোট উৎপাদকের সমস্ত উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ করে তাকে নিঃস্ব করত। কৃষিতে সাম্রাজ্যবাদী বহিঃশক্তির উদ্যোগে যে-বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছিল, ছোট উৎপাদকের কাছে তা ছিল এক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তির দ্বারা তাদেরই নিজ স্বার্থে উপর থেকে চাপানো একটি ব্যবস্থা। কৃষির ওপর তার সর্বব্যাপী কর্তৃত্ব ছোট চাষির সমস্ত উদ্বৃত্ত ভারতীয় কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়, কৃষি উৎপাদন-ব্যবস্থা হয় গতিহীন। স্বাধীনতার পরেও দীর্ঘদিন কৃষি-উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এই অসংগঠিত মহাজনি পুঁজি-বাণিজ্যিক পুঁজির মিলিত প্রভাব ছিল। এদেশের বাণিজ্যিক কৃষি-উৎপাদন প্রক্রিয়ার ওপর সরাসরি ব্রিটিশ বণিকের কর্তৃত্বের কারণে ইউরোপীয় দেশগুলির মতো সেই সময় এদেশের কৃষিতে একটি বৃহৎ উৎপাদনশীল বিনিয়োগে উদ্যোগী মালিক-শ্রেণি গড়ে উঠতে পারেনি। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে ছোট উৎপাদকরা যুক্ত থাকায় জমিসহ অন্যান্য উপকরণের এবং শ্রমের মুক্ত বাজার গড়ে উঠতে পারে না। পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্ক গড়ে ওঠার অবস্থা তৈরি হয় না। স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতেও দীর্ঘদিন এই অবস্থা চলতে থাকে।

পুঁজিবাদী বিকাশের পূর্বশর্তগুলি পূরণের কী অবস্থায় আজকের ভারত রয়েছে সে সম্পর্কে আমরা আলোচনা করব পরবর্তী পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম অধ্যায়ে। তার আগে, ভারতীয় কৃষির কাঠামোগত বিন্যাস, জোতের মালিকানা ও ব্যবহারিক জোতের বিন্যাস, ভারতীয় কৃষিতে একদিকে ক্ষুদ্রজোতের প্রাধান্য ও অন্যদিকে ভাগচাষ ও স্থির খাজনায় লিজভুক্ত জমিতে চাষ, জমির ক্রমখণ্ডীকরণের প্রবণতা কী পরিমাণে ভারতীয় কৃষির উৎপাদন-ক্ষমতার ওপর বিপরীত ক্রিয়া করে তা নিয়ে আলোচনা থাকবে এই অধ্যায়ে। ভারতীয় কৃষির খণ্ডীকরণ প্রবণতা কতটা পরিমাণে তার প্রকৌশলগত উন্নয়নে বাধা দেয় এবং ক্ষুদ্র-চাষ ভিত্তিক ভারতীয় কৃষিতে পুঁজিবাদী বিকাশের সম্ভাবনা কতটা, তারও আলোচনা এখানে থাকবে।

ভারতীয় কৃষির প্রান্তিকীকরণ ও কৃষিতে দীর্ঘকালীন জাড্য

আমরা দেখেছি ১৯৪৭ সালের আগে সরাসরি বিদেশি শক্তির শাসনে থাকা ভারতের কৃষি-অর্থনীতিতে উৎপাদন-সম্পর্ক ছিল প্রাক্পুঁজিবাদী। একদিকে বিদেশি বাণিজ্যিক পুঁজির সঙ্গে যুক্ত বা সম্পর্কহীন এদেশি বণিকদের হাতে বাণিজ্যিক পুঁজির সূত্রে সৃষ্ট মহাজনি পুঁজির দাপট, অন্যদিকে কৃষি উৎপাদন ক্ষেত্রে স্থানীয় ছোট উৎপাদকের ওপর নানান স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী ও সবচেয়ে ওপরে অবস্থানকারী জমিদার, জায়গিরদার, ইত্যাদি বৃহৎ মধ্যস্বত্বভোগীর কর্তৃত্ব। ১৯৪৯–৫০ সালে সারা ভারতে ভূমিসংস্কার কর্মসূচি নেওয়ার ফলে সবচেয়ে ওপরের স্তরে অবস্থানকারী বৃহৎ মধ্যস্বত্বভোগীর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অবসান হলেও দ্বিতীয় স্তরের ক্ষমতাশালী সুবিধাভোগী শ্রেণিটির সামাজিক ক্ষমতার অবসান হয়নি। জমিতে ভাড়াটে চাষি বা ভাগ-চাষি ব্যবস্থায় চাষের অবসান হয়নি। ভাগ-চাষ সংক্রান্ত ভূমিসংস্কার আইনটির উদ্দেশ্য তা ছিলও না। জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনটি ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। অর্থাৎ কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রাথমিক শর্তটি পূরণের ক্ষেত্রে ভারতীয় ভূমিসংস্কার আইনটির ব্যর্থতা খুব স্পষ্ট। পূর্ববর্তী তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা এ বিষয়টি বিস্তৃত আলোচনা করেছি।

নীচের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, ’৫০ এর দশক থেকে ২০০১ অবধি প্রত্যেক দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গড় হারের তুলনায় গ্রামীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির গড় হার কম এবং সময়ের সঙ্গে এই হার আরও কমেছে। কিন্তু মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় ’৫০, ’৮০ ও ’৯০-এর দশকে কৃষিতে সরাসরি নিযুক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল অত্যন্ত বেশি।

সারণি ৪.১ দশক অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা, গ্রামীণ জনসংখ্যা ও সরাসরি কৃষিতে নিযুক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (শতকরা হিসেবে)

সারণি ৪.১ দশক অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা, গ্রামীণ জনসংখ্যা ও সরাসরি কৃষিতে নিযুক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (শতকরা হিসেবে)

Source: Registrar General of India

শতকরা বৃদ্ধির হার প্রতি দশ বছরের হিসেবে।

সরাসরি কৃষি উৎপাদন-ক্ষেত্র থেকে গ্রাম বা শহরের অ-কৃষি উৎপাদন ক্ষেত্রে মানুষের স্থানান্তরিত হওয়ার ও শিল্প-শ্রমিকে রূপান্তরিত হওয়ার বদলে কৃষিক্ষেত্রে আরও বেশি করে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ বাড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এইভাবে কৃষিতে নিযুক্ত জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কৃষি থেকে সরে গিয়ে শিল্পে যুক্ত হওয়ার পরিবর্তে কৃষিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ বেশিই থেকে যায়। একমাত্র ২০০১-১১-এর দশকে এসে এই হার অনেক কমেছে। উল্লেখযোগ্য, এই সময়ের পর থেকে গ্রামীণ অসংগঠিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও এইসব ক্ষেত্রে নিয়োগের পরিমাণ যথেষ্ট বেড়েছে। কিন্তু কৃষিতে সরাসরি কর্মরত জনসংখ্যার বৃদ্ধিহারে হ্রাস ঘটা সত্ত্বেও কৃষি-জোতের খণ্ডীকরণ ও প্রান্তিক জোতের সংখ্যা ও অনুপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছাড়াও মোট জনসংখ্যায় গ্রামীণ জনসংখ্যার অনুপাত, ও কৃষিতে সরাসরি নিযুক্ত জনসংখ্যার অনুপাত থেকেও এই পর্যবেক্ষণের সমর্থন পাই। দেখা যাচ্ছে মোট জনসংখ্যায় গ্রামীণ জনসংখ্যার অনুপাত ১৯৫১ থেকে ২০০১ এই পঞ্চাশ বছরে শতকরা ১০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে, অর্থাৎ প্রতি দশকে গড়ে গ্রামীণ জনসংখ্যার অনুপাত হ্রাস পেয়েছে শতকরা ২ ভাগ। সরাসরি কৃষিতে নিযুক্ত জনসংখ্যার অনুপাত ১৯৭১ সালের তুলনায় ২০০১ সালে খুব বেশি কমেনি। মোট গ্রামীণ জনসংখ্যায় সরাসরি কৃষিতে নিযুক্ত জনসংখ্যার অনুপাত ২০০১ সালে ছিল ১৯৭১, ‘৮১, ও ’৯১ সালের তুলনায় বেশি।

সারণি ৪.২ গ্রামাঞ্চলে ও কৃষিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি

সারণি ৪.২ গ্রামাঞ্চলে ও কৃষিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2003, 2016, Ministry of Agriculture

মোট জনসংখ্যায় গ্রামীণ জনসংখ্যার অনুপাত কমেছে ঠিকই, কিন্তু ’৮১ সালের তুলনায় ’৯১ সালে এই অনুপাত বাড়ে, এমনকী ’৮১ সালের তুলনায় ২০০১ সালে এই অনুপাতটি সামান্য বেশি ছিল। আবার ১৯৭১ থেকে ২০১১, এই ৪০ বছরে মোট জনসংখ্যায় ও গ্রামীণ জনসংখ্যায় কৃষিতে সরাসরি নিযুক্ত জনসংখ্যার অনুপাত বেড়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়ে শিল্পায়নের হারের দ্রুত বৃদ্ধি সত্ত্বেও ’৫১ সাল থেকে ’৬১ ও ’৭১ সালের মধ্যে গ্রামীণ জনসংখ্যার অনুপাত উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়নি অথবা ’৭১ সালের পর থেকে গ্রামীণ জনসংখ্যায় কৃষিতে সরাসরি নিযুক্ত জনসংখ্যার অনুপাতে উল্লেখযোগ্য হ্রাস ঘটেনি। এমনকী মোট জনসংখ্যায় সরাসরি কৃষিতে নিযুক্ত জনসংখ্যার অনুপাতও ’৮১ সালের পর থেকে হ্রাস পায়নি, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ এই সারণিগুলি থেকে যে-তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা থেকে এমন সিদ্ধান্ত করা যায় না যে, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে গ্রাম থেকে শহরে বা কৃষি থেকে অন্য জীবিকায় ব্যাপক হারে মানুষের বহির্গমন ঘটেছে। কৃষিতে জনসংখ্যার এই চাপের কারণে কৃষি-জোতের কী পরিমাণে খণ্ডীকরণ ঘটছে, নীচের সারণি থেকে আমরা সে সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা করতে পারি।

এই সারণি থেকে কৃষিতে বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক ও ছোট চাষির অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে এই প্রান্তিক চাষির মোট সংখ্যা ও মোট কৃষিজোতের মধ্যে এদের অনুপাত বেড়েই চলেছে। একই সঙ্গে মাঝারি জোতের সংখ্যা ১৯৮১ সালের পর থেকে কমে এবং বৃহৎ জোতের সংখ্যা ’৭১ সালের পর থেকেই কমতে থাকে। কৃষিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ ও তার পরিণামে জোতের এই ক্রমাগত খণ্ডীকরণের প্রবণতার কারণে কৃষি উৎপাদন থেকে আয় ক্রমাগত কমে। অথচ শিল্পের উন্নয়ন ও শিল্পে নিয়োগের পরিমাণ যথেষ্ট না বাড়ার কারণে এবং কৃষিতে মজুরি শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগের অভাবে অনেক সময়েই কৃষিতে যুক্ত এইসব অতি নিম্ন আয়ের মানুষ গ্রামীণ অসংগঠিত কাজকর্মে যুক্ত হচ্ছে। কৃষির দুর্দশাজনক অবস্থার কারণে কৃষি থেকে মানুষের সরে যাওয়ার প্রবণতা ঘটছে। কিন্তু এই প্রবণতা শিল্পের প্রসারের কারণে শিল্প-শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য ঘটেনি। কারণ গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে একবিংশ শতকের প্রথম দশকে শিল্পক্ষেত্র নিয়োগহীন বৃদ্ধির প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করছে; কৃষি ও শিল্প উভয় ক্ষেত্রেই আয় সৃষ্টিকারী কাজের অপ্রতুলতা মানুষকে গ্রামে ও শহরে অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রগুলি গড়ে তুলে কোনওভাবে জীবিকা অর্জনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই বিষয়টি আমরা আমাদের শেষ বা পঞ্চদশ অধ্যায়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছি। পরবর্তী ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম অধ্যায়ে আমরা যথাক্রমে ভারতে কৃষিশ্রমের বাজার, কৃষিঋণের বাজার, কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ে আলোচনা করেছি।

সারণি ৪.৩ ব্যবহারিক জোত ও কৃষি-জমির পরিমাণ ও বিন্যাস

সারণি ৪.৩ ব্যবহারিক জোত ও কৃষি-জমির পরিমাণ ও বিন্যাস

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2016 এবং Input Survey, 2018. Agricultural Census Department, Govt. of India. 2018

আমাদের শেষ বা পঞ্চদশ অধ্যায়ে আমরা দেখব গ্রামীণ অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি কৃষির তুলনায় অনেক কম। কিন্তু কৃষি উৎপাদনের ব্যয় অত্যন্ত বেশি হওয়ায় অনেক সময় ঋণভারাক্রান্ত ছোট চাষির পক্ষে উৎপাদন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। অনেক সময় কৃষি থেকে আয় তার জীবনযাত্রা চালানোর ব্যয়ের তুলনায় কম, ফলে মানুষ কৃষির ওপর নির্ভর না করে কৃষির পরিবর্তে অথবা কৃষির সহায়ক হিসেবে অসংগঠিত কাজের ক্ষেত্র গড়ে তুলে স্বনিযুক্ত কাজে যুক্ত হয়। ভারতীয় কৃষি-শিল্পে এটি একটি বিশেষ পরিস্থিতি।

প্রান্তিক জোতনির্ভর কৃষিতে পুঁজিবাদী ধরনের মজুরি-শ্রমিকনির্ভর উৎপাদন-সম্পর্ক দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা কতটা সেই প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করা জরুরি। এই প্রসঙ্গে ওপরের সারণি ৪.৩কে আমরা আর একবার আলোচনায় আনতে পারি। ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় কৃষি অতিমাত্রায় প্রান্তিক জোত-নির্ভর। শুধু তাই নয়, দশকের পর দশক এই প্রান্তিক জোত-নির্ভরতা বেড়ে চলেছে। ১৯৭০–’৭১ সালে প্রান্তিক জোতের সংখ্যা ছিল ৩৬.২০ মিলিয়ন যা ছিল মোট জোতের শতকরা ৫১ ভাগ। দশকের পর দশক প্রান্তিক জোতের সংখ্যা বেড়ে ১৯১০–১১ সালে দাঁড়িয়েছে ৯২.৮৩ মিলিয়নে যা মোট জোতের শতকরা ৬৭.২৩ ভাগ। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে ১৯১৫–১৬ সালে প্রান্তিক জোতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৯.৮৬ মিলিয়ন এবং প্রান্তিক জোতের আওতায় ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ৩৭.৯৬ মিলিয়ন হেক্টর। অর্থাৎ ২০১৫–১৬ সালে প্রান্তিক জোত মোট জোতের শতকরা ৬৮.৫৪ ভাগ, প্রান্তিক জোতের আওতায় জমির পরিমাণ মোট জমির শতকরা ২৪.০৭ ভাগ। ছোট জোতের সংখ্যাও একই রকমে বেড়েছে। ফলে ২০১৫–১৬ সালে দেখা যায়, মোট জোতের শতকরা ৮৬.২৩ ভাগ হয় প্রান্তিক জোত, নয় ছোট জোত এবং মোট জমির শতকরা ৪৭.২৫ ভাগ ছোট ও প্রান্তিক জোতের আওতায় চাষ হচ্ছে। অপরপক্ষে আধা-মাঝারি জোতের সংখ্যা ২০০০–০১ সাল পর্যন্ত স্বল্প বৃদ্ধি পেলেও ২০১০–১১ সালে কমে। মাঝারি জোতের সংখ্যা ১৯৮০–৮১ সাল অবধি বৃদ্ধি পাওয়ার পর ক্রমাগত কমেছে। বৃহৎ জোতের সংখ্যা ১৯৭০–৭১ সালের পর থেকেই কমতে শুরু করে। ২০১০–১১ সালে আধা-মাঝারি, মাঝারি ও বড় জোত মেলালে দাঁড়াত মোট জোতের শতকরা ১৫ ভাগ এবং মোট জমির শতকরা ৫৫ ভাগ ছিল এদের আওতায়। ২০১৫–১৬ সালে আধা-মাঝারি, মাঝারি ও বড় জোতের আওতায় চাষ হত শতকরা ১৩.৭৭ ভাগ জোত ও শতকরা ৫২.৭৫ ভাগ জমি। অর্থাৎ বড়, মাঝারি ও আধা-মাঝারি জোতের মোট সংখ্যা ও এইসব জোতের আওতায় থাকা জমির পরিমাণ ক্রমশ দশকের পর দশক কমেছে ও জোতের গড় মাপ কমেছে। পুঁজিবাদী সচলতায় জমির কেন্দ্রীভবনের যে-বাজার-তাড়িত প্রবণতা থাকে এক্ষেত্রে তার ঠিক উলটো প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

সারণি ৪.৪ ভারতের কৃষিতে জমির কেন্দ্রীভবনের মাত্রা

বছরকেন্দ্রীভবনের মানশতকরা পরিবর্তন
১৯৭০–৭১২৯০.১২ 
১৯৭৬–৭৭২৪০.৮০–১৭.০০
১৯৮০–৮১২০১.০২–১৬.৫১
১৯৮৫–৮৬১৬৭.৮৪–১৬.৫০
১৯৯০–৯১১৩৬.৬৫–১৮.৫৮
১৯৯৫–৯৬১১১.৪১–১৮.৪৭
২০০০–০১৯৫.৬৯–১৪.১০
২০০৫–০৬৮৪.৯০–১১.২৭
২০১০–১১৭১.৩০–১৬.০২
২০১৫–১৬৬১.২৬–১৪.০৭

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017, Ministry of Agriculture

ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, ভারতে ব্যবহারিক জমির কেন্দ্রীভবনের মাত্রা ক্রমাগত কমেছে।

আমরা দেখেছি, স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতের কৃষিতে ভূমিব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন না ঘটায় ছোট চাষ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল, পিছিয়ে পড়া কৃষিতে চড়া সুদে মহাজনি পুঁজি ও অসংগঠিত বাণিজ্যিক পুঁজির যৌথ প্রভাব কর্তৃত্ব করে, চাষিরা নিঃস্ব হয় এবং জমির সঙ্গে ব্যাপকভাবে যুক্ত থাকে। ব্যাপক শিল্পোন্নয়ন প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতিতে জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া ছোট চাষি অসংগঠিত ছোট উৎপাদন বা ব্যবসাক্ষেত্রে যুক্ত থেকে অসংগঠিত উৎপাদন-কাঠামোর বিপুল বৃদ্ধি ঘটায়। কৃষি-শ্রমের মুক্ত বাজার ব্যবস্থার বিকাশের অভাবে কৃষিতে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের উদ্ভবের অবকাশ সীমিত ছিল। ১৯৬৫–৬৬ সালে আমরা ভারতীয় কৃষিকে একটি সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে পড়া কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে দেখি। এর পরবর্তীতে ভূমিসংস্কার ও কৃষি অর্থনীতির সামগ্রিক কাঠামোগত পরিবর্তন কর্মসূচির যথার্থ প্রণয়ন ও রূপায়ণের ক্ষেত্রে এই অনীহাজনিত অপূর্ণতার প্রেক্ষাপটেই ১৯৬৫–৬৬ সালে সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি নেওয়া হয়। নব আবিষ্কৃত উচ্চফলনশীল বীজ, হেক্টর পিছু বৈজ্ঞানিক ভাবে নির্দিষ্ট উপযুক্ত পরিমাণ সার ও নিয়ন্ত্রিত জলের সরবরাহ নিয়ে একটি নতুন ভাবে উদ্ভাবিত কৃষি-উপকরণের প্যাকেজ ব্যবহারই ছিল এই নতুন প্রযুক্তির মূল কথা। কিন্তু এই প্রযুক্তির প্রয়োগে ধান ও গমের ক্ষেত্রে বীজ রোপণের পর থেকে ফসল ওঠা পর্যন্ত কৃষি উৎপাদনের সময় অনেক সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এর ফলে একই জমিতে একাধিক বার চাষ করা সম্ভব হয় ও মোট উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ে। তাই উচ্চফলনশীল বীজের প্যাকেজ ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে ট্রাক্টর, হারভেস্টর প্রভৃতি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ে। কিন্তু ভূমিসংস্কার সম্পূর্ণ না হওয়ায় জমির মালিকানা ও জমির সঙ্গে প্রকৃত উৎপাদক চাষির অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক— যা প্রান্তিক চাষের প্রাধান্য ও নিজ জমিতে নিজে চাষ ব্যবস্থায় ছোট উৎপাদকের কৃষিকাজ ছেড়ে ব্যাপক হারে বহির্গমনের প্রবণতার অভাব থেকে স্পষ্ট— কৃষিতে দীর্ঘকালীন জাড্য বজায় রাখে। ফলে বাইরে থেকে আসা ভারতীয় কৃষি-উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর চাপিয়ে দেওয়া নতুন প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে কৃষি উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়। আমূল ভূমিসংস্কারের অভাব এবং কৃষিতে পুরানো উৎপাদন-সম্পর্কের বৈশিষ্ট্যগুলির উপস্থিতি অনেকাংশেই এই অবস্থা বজায় রাখতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। এই কারণেই বাণিজ্যিক ও মহাজনি পুঁজির সর্বব্যাপক প্রভাব থেকে ভারতীয় কৃষিকে মুক্ত করার মতো শক্তি ভারতীয় কৃষিতে কার্যকর হতে পারে না। নতুন প্রযুক্তির কার্যকারিতা শুধুমাত্র ভারতের মতো উদ্বৃত্ত শ্রম-অর্থনীতির পক্ষে অনুপযুক্ত তাই নয়, ভারতীয় কৃষি অর্থনীতির কাঠামোগত পিছিয়ে পড়া বৈশিষ্ট্যগুলি এই প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেকাংশেই বাধা হয়ে দেখা দেয়। কৃষিতে শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত পশ্চাদপদতা বজায় থাকে তাই নয়, ভারতীয় কৃষি এক দীর্ঘকালীন স্থবিরতায় আবদ্ধ থাকে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক, যে-কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভারতীয় কৃষির সংকটে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। ভারতীয় কৃষির পুঁজিবাদী উত্তরণের প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে থাকে। ভারতের কৃষিতে পিছিয়ে থাকা প্রাক্পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের লক্ষণগুলি আজও কী পরিমাণে বিদ্যমান, অথবা ভারতীয় কৃষিতে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের লক্ষণগুলি কতটা স্পষ্ট তার আলোচনা থাকবে এই অধ্যায়ে। পরবর্তী পঞ্চম অধ্যায়ে ভারতীয় কৃষিতে সবুজ বিপ্লব, শস্যবৈচিত্র ইত্যাদি উৎপাদন-পদ্ধতিগত, প্রকৌশলগত বা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করব। পুঁজিবাদী বিকাশের পক্ষে জরুরি অন্তর্দেশীয় বাজার তৈরির জন্য প্রয়োজন ছিল সামাজিক শ্রম বিভাজনের। ইউরোপের কৃষিতে পুঁজিবাদ বিকাশের প্রথম পর্বে আমরা দেখি অকৃষি-ক্ষেত্রে নিযুক্ত জনসংখ্যা ক্রমশ কৃষিক্ষেত্রে নিযুক্ত জনসংখ্যার তুলনায় বাড়তে থাকে এবং ক্রমশ জনসংখ্যার বেশি বেশি অংশ কৃষি উৎপাদন-ক্ষেত্র থেকে শিল্প উৎপাদন-ক্ষেত্রে স্থানান্তরিত হতে থাকে। উৎপাদনের উপকরণের সঙ্গে উৎপাদকের বিচ্ছিন্নতার ফলে একদিকে শ্রম অন্যদিকে জমিসহ অন্যান্য উপকরণ পণ্যে পরিণত হয় ও স্থির পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়। ছোট উৎপাদকের ন্যূনতম ভোগ্যদ্রব্যগুলিও বাজারে ক্রয়বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হয়। আমাদের দেশে জমির সঙ্গে চাষির বিচ্ছিন্নতা ঘটতে পারে না। কৃষিতে প্রান্তিক ও ছোট জোতের প্রাধান্য ও বিপুল সংখ্যক চাষির এই প্রান্তিক ও ছোট জোতে আটকে থাকার কোনও পরিবর্তন হয় না। শ্রমের বাজার প্রসঙ্গে আলোচনায় আমরা পরে দেখব, ভারতের কৃষি উৎপাদন-ব্যবস্থায় এখনও বিপুল সংখ্যক পারিবারিক শ্রমিকের প্রাধান্য রয়ে গেছে।

ছোট জোতের মাধ্যমে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনা

আমরা জানি পুঁজিবাদী উৎপাদন পর্বের বিকাশের আদিপর্বে সামন্ততান্ত্রিক খামার ভেঙে দিয়ে ছোট পরিবারভিত্তিক জোত গঠিত হতে থাকে। সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের অন্তর্নিহিত স্ববিরোধিতা এমন এক স্তরে এসে পৌঁছায় যে এটাই তখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। পুঁজিবাদী উৎক্রমণের স্তরে কৃষি-উৎপাদনের বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া যত দ্রুত বাড়তে থাকে ততই বাণিজ্যিক পুঁজি পারিবারিক শ্রমনির্ভর ছোট কৃষক ও কারিগর-উৎপাদককে তার নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসে। সাম্রাজ্যবাদের অধীন পশ্চাদপদ দেশে সাম্রাজ্যবাদ তার নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য বাণিজ্যিক পুঁজির মাধ্যমে উৎপাদনকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে সামন্ততান্ত্রিক খাজনার মাধ্যমে শোষণকে টিকিয়ে রেখে ও উদ্বৃত্ত আহরণের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। একইসঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ পশ্চাদপদ দেশকে পুঁজি বিনিয়োগের একটি লাভজনক ক্ষেত্র হিসেবে দেখে। এইসব দেশের শিল্পে বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিতেও উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে তা পদক্ষেপ করতে পারে নিজের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের তাগিদ থেকেই। কিন্তু এই কাজটি সাম্রাজ্যবাদ করে সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামীকে সহযোগী রেখে, কারণ পদানত দেশে স্বাধীন বুর্জোয়া বিকাশ তার অভিপ্রেত নয়। এই বৈপরীত্যমূলক ক্রিয়াকলাপের মধ্য থেকে দু’ভাবে পুঁজিবাদী বিকাশের সম্ভাবনা দেখা যায়। প্রথমটিতে সামন্ততান্ত্রিক শোষণের মূল রূপ, নিরপেক্ষ ভূমি-খাজনা বজায় রেখে ধীরে ধীরে উৎপাদনে নানাপ্রকার রূপান্তর ঘটানো হয়, সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামীর আওতাভুক্ত উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যেই অতি ধীর গতিতে মূলধন বিনিয়োগের অবস্থা সৃষ্টি করা হয়। আর দ্বিতীয়টিতে স্বাধীন কৃষক-উৎপাদক পুঁজিগঠন ও পুঁজির পুনর্বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী শোষকে রূপান্তরিত হয়। পুঁজিবাদ বিকাশের ঐতিহাসিক পর্যায়ের এই মার্কসীয় ব্যাখ্যায় প্রাক্পুঁজিবাদী পর্যায়ের সরল পুনরুৎপাদন ব্যবস্থায় থাকা ছোট কৃষক থেকে পুঁজিবাদী কৃষকে রূপান্তরের ইঙ্গিত রয়েছে। মার্কস স্বাধীন পুঁজিবাদী দেশে পুঁজিবাদ গড়ে ওঠার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এই বিশ্লেষণ রেখেছেন: এই বিশ্লেষণ অনুযায়ী একদিকে প্রাক্পুঁজিবাদী পারিবারিক শ্রমনিবিড় ক্ষুদ্র কৃষক অর্থনীতির অবসান ঘটানোর মধ্য দিয়ে পুঁজির কেন্দ্রীভবন, অন্যদিকে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ছোট উৎপাদকের উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে উৎপাদনের উপকরণের কেন্দ্রীভবন— এই দু’টি সমান্তরালভাবে ঘটতে থাকা প্রক্রিয়া একত্রে পুঁজিবাদী বর্ধিত পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়ার সূচনার আবশ্যিক পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করে। এই দু’টি প্রক্রিয়ার মিলিত কার্যকারিতার মধ্য দিয়ে একদিকে পুঁজি ও উৎপাদনের উপকরণের ওপর নিয়ন্ত্রণকারী পুঁজিপতি শ্রেণি ও অন্যদিকে উৎপাদনের উপকরণের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ভূমিমালিকানা-বন্ধনহীন, মুক্ত শ্রমিক শ্রেণি পরস্পর মুখোমুখি হয়ে পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার দু’টি আবশ্যিক উপাদানে পরিণত হয়। অবশ্য মার্কস ও এঙ্গেলসের লেখায় এই ইঙ্গিতও পাওয়া যায় যে, পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়া গড়ে ওঠার এটিই একমাত্র পথ নাও হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ক্ষুদ্র জোতের অবলুপ্তির মধ্য দিয়ে বৃহদাকার কৃষি উৎপাদন গড়ে ওঠাকে যখন পুঁজিবাদী কৃষি উৎপাদন গড়ে ওঠার শর্ত হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে তখন এই প্রারম্ভিক যুক্তি গ্রহণ করা হচ্ছে যে, ছোট জোতের প্রতি এককে উৎপাদন খরচ বড় জোতের তুলনায় বেশি এবং ছোট জোতের তুলনায় বড় জোত বৃহদায়তন উৎপাদনের সুবিধাগুলি অনেক বেশি পরিমাণে ভোগ করতে পারে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বাজারে প্রতিযোগিতার নিয়ম বজায় থাকলে ক্ষুদ্র জোত বৃহৎ জোতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে বাধ্য হয় ও ক্ষুদ্র ও বৃহৎ জোতের মধ্যে অসম ক্ষমতার কারণে এই প্রতিযোগিতায় ক্ষুদ্র জোত টিকে থাকতে পারে না, অচিরে বিলুপ্তির পথে যায়, যার মধ্য দিয়ে বৃহৎ উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। অচিরেই পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য হিসেবে পুঁজির বিনিয়োগ ও পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই অপেক্ষাকৃত বড় জোতগুলি শক্তিশালী পুঁজিবাদী উৎপাদন সংস্থায় পরিণত হতে থাকে। কিন্তু প্রারম্ভিক অনুমানের একটি দুর্বলতা এই ব্যাখ্যাটিকেও দুর্বল করে। এখানে মনে করা হচ্ছে, ক্ষুদ্র জোতে উৎপাদনের অর্থই ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদন। এই অনুমানটি সবসময় সঠিক নয়। ক্ষুদ্র জোতে উন্নত ধরনের উৎপাদন-প্রক্রিয়া চালু করলে নিবিড় চাষের মাধ্যমে বিনিয়োগ অধিক উৎপাদনশীল হয়ে উঠতে পারে এবং তা থেকে বৃহদায়তন চাষের বাড়তি সুবিধা আদায় করতে পারে। এইভাবে বৃহদায়তন উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করে পুঁজিবাদী উৎপাদন-প্রক্রিয়া চালু করা যায়। কার্ল কাউৎস্কি পুঁজিবাদ বিকাশের এই ধরনটি ব্যাখ্যা করেন। কাউৎস্কির এই মতের সমর্থন পাওয়া যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি সংক্রান্ত ‘নতুন তথ্য’-র ওপর লেনিনের বিখ্যাত আলোচনা থেকে। লেনিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষি-সংক্রান্ত তথ্যের তুলনামূলক আলোচনা ও বিশ্লেষণ করেন। ছোট জোতে নিবিড়তর উৎপাদন-পদ্ধতি প্রয়োগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে পুঁজির যে-বিকাশ ঘটেছিল লেনিন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, ক্ষুদ্র জোতে নিবিড়তর চাষ বৃহৎ জোতে বর্ধিত হারে চাষের চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক ও ফলপ্রসূ। এই কারণে এই পথে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে দীর্ঘকালীন বিকাশের পথে পুঁজির কেন্দ্রীভবন প্রক্রিয়ার উল্টো প্রবণতা অর্থাৎ বড় জোতের খণ্ডীকরণ ও জোতের গড় আয়তনের হ্রাসপ্রক্রিয়া কৃষি-জোতের বিন্যাসের পরিবর্তন প্রক্রিয়ার একটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা দিতে পারে।

সারণি ৪.৫ থেকে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় কৃষিতে জোতের বিন্যাসের পরিবর্তন গাঁথা আছে এই ক্রমাগত খণ্ডীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে। কিন্তু শুধুমাত্র এই বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি থেকেই ভারতীয় কৃষিতে পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের বিকাশ সংক্রান্ত প্রশ্নে কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিতে পুঁজিবাদের বিকাশ সংক্রান্ত লেনিনের এই ব্যাখ্যা এবং কাউৎস্কির ক্ষুদ্র জোতের মাধ্যমে পুঁজিবাদী সম্পর্কের বিকাশ সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ পশ্চাদপদ দেশের কৃষি অর্থনীতির পক্ষে কতটা প্রযোজ্য সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এটি আরও নানা দিক থেকে অনুসন্ধান দাবি করে। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে কৃষি-অর্থনীতি বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদ কৃষি-অর্থনীতির স্বাভাবিক বিকাশকে খর্ব করে রেখেছিল সামন্তবাদী, মহাজনি ও ব্যবসায়ী শোষণ চাপিয়ে। কৃষিতে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত উৎপাদনশীল বিনিয়োগের পথ থেকে সরে গিয়ে অনুৎপাদনশীল মহাজনি ও ব্যবসায়ী পুঁজি হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। কৃষিতে আমূল ভূমি-সংস্কারের মাধ্যমে কৃষির পশ্চাদপদ সম্পর্কগুলিকে নির্মূল করা যায়নি। এর পরিণামে ভারতীয় কৃষিতে সামন্ততান্ত্রিক ভূমি খাজনার দাপট কমলেও, নানা ধরনের পশ্চাদপদ সম্পর্ক বহাল থাকে, ক্ষুদ্র উৎপাদকের পক্ষে স্বাধীনভাবে উদ্বৃত্ত আহরণ ও এই উদ্বৃত্তের উৎপাদনশীল ব্যবহার সীমায়িত থেকে যায়। এই পশ্চাদপদ উৎপাদন সম্পর্কগুলির মধ্যে কৃষিপণ্য, কৃষি-শ্রমিক, কৃষিঋণ ও কৃষি উপকরণের অনুন্নত বাজার ব্যবস্থা ও এইসব বাজারের নানা ধরনের প্রতিকূল কার্যকারিতার ফলে কৃষি উৎপাদনে উৎপাদিত সম্ভাব্য উদ্বৃত্ত কৃষিতে উৎপাদনশীল ভাবে বিনিয়োজিত হতে পারে না, অনুন্নত বাজারব্যবস্থার চৌহদ্দির মধ্যেই আবদ্ধ থেকে যায়। এইসব দেশে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুদ্র জোতে নিবিড়তর চাষের মাধ্যমে পুঁজিবাদ কতটা বিকশিত হতে পারে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হওয়ার আবশ্যিক পূর্বশর্ত হল কৃষিতে উৎপাদনমূলক বিনিয়োগে ইচ্ছুক মানুষের হাতে বিনিয়োগোপযোগী আর্থিক পুঁজির সঞ্চয়। কৃষি-উৎপাদনে যুক্ত মানুষের ক্রমাগত কৃষি থেকে সরে গেলে ও এর পরিণামে কৃষি থেকে বিচ্ছিন্ন অকৃষি উৎপাদনকে কেন্দ্র করে নগরায়ণ ঘটতে থাকলে কৃষিপণ্যের অন্তর্দেশীয় বাজার সম্প্রসারিত হয়, ফলে কৃষিতে উৎপাদনশীল বিনিয়োগের তাগিদ তৈরি হয়। শিল্পবিকাশের সূচনা ঘটলে ও কৃষি উৎপাদন-ক্ষেত্র থেকে শহরের সদ্য গড়ে ওঠা শিল্পক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবীর বহির্গমনের অবস্থা তৈরি হলে এই তাগিদ আরও তীব্র হয়। এই প্রক্রিয়ার সূচনা হলে কৃষিতেও মুক্ত মজুরি-শ্রমিক নিয়োগ করে পুঁজিবাদী ধরনের লাভের জন্য বাজারমুখী চাষের সূচনা হতে পারে। অর্থাৎ কৃষিতে পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের বিকাশের আবশ্যিক শর্ত হিসেবে শ্রম, জমি ও অন্যান্য কৃষি-উপকরণের মুক্ত বাজার-প্রক্রিয়ার সূচনা হওয়া আবশ্যিক। যতদিন বাণিজ্যিক পুঁজি ও মহাজনি পুঁজি ছোট ছোট দুর্বল উৎপাদন ক্ষেত্রগুলির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে উৎপাদন-ক্ষেত্র থেকে উদ্বৃত্তের বিশাল অংশ আহরণ করে উৎপাদন ক্ষেত্রকে দুর্বল করে রাখে, যতদিন অবধি উৎপাদন ক্ষেত্রগুলিকে বাণিজ্যিক ও মহাজনি কাজকর্ম অবাধে চালানোর জন্য বাণিজ্যিক ও মহাজনি উদ্বৃত্ত আহরণের সহজ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের অবাধ সুযোগ বজায় রাখার চেষ্টা চলে, ততদিন কৃষি-উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আসা শক্ত। তা এক সময়সাপেক্ষ দীর্ঘ প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা দেয় ও এই উত্তরণও হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদীর পদানত কোনও দেশে এই পিছিয়ে পড়া অবস্থা দীর্ঘদিন বজায় থাকতে পারে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সরাসরি প্রভাবের বাইরে আসার পরও দীর্ঘদিন উৎপাদন ব্যবস্থায় পিছিয়ে পড়া বৈশিষ্ট্যগুলি রয়ে যায়। বিশেষ করে নতুন শাসকশ্রেণি আমূল ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে পুরানো উৎপাদন-সম্পর্কের প্রগতিবিরোধী বৈশিষ্ট্যগুলিকে নির্মূল করতে না পারলে, শিল্প ও অকৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদনের যথেষ্ট সম্প্রসারণ না ঘটলে, জমির সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন ছোট দুঃস্থ চাষির কৃষি-উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে যথেষ্ট সংখ্যায় বর্হিগমন না ঘটলে ও একই সঙ্গে স্বাধীন শ্রম ও কৃষিঋণ কৃষিপণ্য সহ কৃষি-উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণগুলির মুক্ত বাজার সম্প্রসারিত হওয়ার অবস্থা তৈরি না হলে কৃষি-উৎপাদন সম্পর্কে পুরানো বৈশিষ্ট্যগুলি টিকে থাকা স্বাভাবিক বলেই মনে হয়।

ভারতীয় কৃষিতে জোতের মাপের সঙ্গে জমির উৎপাদনকুশলতার বিপরীতগামী সম্পর্ক: ছোট জোত মারফত ভারতীয় কৃষিতে পুঁজিবাদ বিকাশের সম্ভাব্যতা

ভারতীয় কৃষিতে জোতের মাপের সঙ্গে উৎপাদনকুশলতার বিপরীতধর্মী সম্পর্কটি একটি বহু আলোচিত ও বিতর্কিত প্রশ্ন। ১৯৬২ ও ১৯৬৪ সালে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ‘ইকনমিক উইকলি’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধে ফার্ম ম্যানেজমেন্ট সংস্থার সমীক্ষা থেকে পাওয়া কৃষক পরিবারভিত্তিক পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে উল্লেখ করেছিলেন যে, সাধারণভাবে জোতের আয়তন বাড়লে জমির উৎপাদনশীলতা কমে। তারপর পরপর দীপক মজুমদার (১৯৬৫), সি এইচ হনুমন্ত রাও (১৯৬৬), এ পি রাও (১৯৬৭), এ এম খুস্র (১৯৬৮), অশোক রুদ্র (১৯৬৮) প্রমুখ অর্থনীতিবিদদের পরিসংখ্যানভিত্তিক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণগুলি প্রকাশিত হতে থাকে। পরবর্তী পর্যায়ে জি আর সাইনি (১৯৭১), অশোক রুদ্র (১৯৭৩), কৃষ্ণা ভরদ্বাজ (১৯৭৪) দ্বিতীয়বার বিতর্কটির সূচনা করেন। আরও পরে ভারতের বাইরের বিভিন্ন দেশের গ্রামভিত্তিক ও অঞ্চলভিত্তিক পরিসংখ্যানকে ভিত্তি করে বিশ্লেষণ আসতে থাকে। করনিয়া (১৯৮৫) ১৫টি উন্নয়নশীল দেশের পরিসংখ্যান থেকে সিদ্ধান্তে আসেন, এইসব দেশে বড় জোতের তুলনায় ছোট জোতের অধিক উন্নয়নশীলতা একটি সাধারণ সত্য।

জোতের পরিমাপের সঙ্গে উন্নয়নশীলতার বিপরীতধর্মী সম্পর্কটি এ পি রাও (১৯৬৭)১০-এর পর্যবেক্ষণে সমর্থিত। এ পি রাও একই গ্রামের জোতভিত্তিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এবং কয়েকটি গ্রামে অনুরূপ সমীক্ষা চালিয়ে দেখান যে, তাঁর সমীক্ষার অধীন সব গ্রামেই জোতের মাপ নির্বিশেষে জমির উৎপাদনশীলতার কোনও পার্থক্য নেই। এই সিদ্ধান্তটি অশোক রুদ্র (১৯৬৮)-র পর্যবেক্ষণেও সমর্থিত হয়েছে। আরও পরে মানবেন্দু চট্টোপাধ্যায় দেখান যে, পুরনো ধরনের উৎপাদন-পদ্ধতি ও কৃৎকৌশল ব্যবহারকারী জোতে বড় ও ছোট জোতের মধ্যে কোনও তফাত নেই, একর পিছু উৎপাদনেও না। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারকারী জোতে একর পিছু উৎপাদনে বড় ও ছোট জোতের মধ্যে পার্থক্য আছে। ছোট জোতে বড় জোতের তুলনায় একর প্রতি উৎপাদনের হার বেশি। দেবজিৎ রায় (২০১২)১১ তাঁর অপ্রকাশিত গবেষণাপত্রে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান ও বীরভূমের কয়েকটি গ্রামসমীক্ষা থেকে জানান যে, গ্রামগুলিকে পরিকাঠামোর দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা, কিছুটা এগিয়ে থাকা ও একেবারেই পিছিয়ে পড়া, এই তিন প্রকারে ভাগ করলে দেখা যায় প্রত্যেক ভাগের বড় জোত ও ছোট জোতের মধ্যে একর প্রতি উৎপাদনে পার্থক্য অকিঞ্চিৎকর। যদিও, সবধরনের জোতকে একত্রিত করলে দেখা যায় জোতের আয়তন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একর প্রতি উৎপাদন বাড়ে। দেবজিৎ রায় প্রতিটি জোতের বিভিন্ন উপকরণের ব্যবহার এবং কৃৎকৌশলগত দক্ষতার পরিসংখ্যান বিবেচনায় রেখে রিগ্রেসান সমীকরণ গঠন করে তার পরিসংখ্যানগত মাপ থেকে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, জোতগুলির মধ্যে এই উপকরণগুলির ব্যবহারের পরিমাণের পার্থক্য ও কৃৎকৌশলগত পার্থক্য না থাকলে জোতের পরিমাপের সঙ্গে উৎপাদনশীলতার পার্থক্যের ঋণাত্মক প্রবণতাটি সঠিক বলেই প্রমাণিত হয়।

আমাদের দেশে রাজ্যভিত্তিক পরিসংখ্যান কাজে লাগিয়েও জোতের মাপ ও একর-প্রতি উৎপাদনশীলতার সম্পর্কটি আলোচিত হয়েছে।

আমাদের নিজস্ব একটি গবেষণায়১২ আমরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের জোতের গড় মাপের ক্রম অনুযায়ী একর-প্রতি উৎপাদনশীলতা সমেত বিভিন্ন প্রগতিসূচকের পরিসংখ্যানগত আন্তঃসম্পর্ক হিসাব করেছি। আমরা জোতের মাপের সঙ্গে শ্রমের উৎপাদনশীলতা ও তার বৃদ্ধির হারের ধনাত্মক সম্পর্ক দেখেছি। উৎপাদন বৃদ্ধির হার ও একর-প্রতি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হারেও এই সম্পর্ক ধনাত্মক। কিন্তু কর্ষণের নিবিড়তা ও জমির একক-পিছু উৎপাদনের প্রকৃত মূল্য— এই দু’টি সূচকের ক্ষেত্রে সম্পর্কটি ঋণাত্মক। অর্থাৎ আমাদের বিশ্লেষণ থেকে আমরা দেখছি জোতের গড় আয়তন অনুযায়ী যে-রাজ্য যত এগিয়ে, শ্রমের উৎপাদনশীলতা, তার বৃদ্ধির হার ও একর প্রতি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার এই রাজ্যগুলিতে তত বেশি। অন্যদিকে জোতের গড় আয়তনের দিক থেকে যে-রাজ্য যত পিছিয়ে, কর্ষণের নিবিড়তা ও একর প্রতি উৎপাদনের প্রকৃত মূল্যের দিক থেকে সেই রাজ্য তত এগিয়ে। অর্থাৎ ছোট জোত সংবলিত রাজ্যে চাষিরা জমির কর্ষণের নিবিড়তা বাড়িয়ে প্রতি একর জমিতে গড়ে বেশি উৎপাদন করে। আমাদের জোতের মাপ ও একর-প্রতি উৎপাদনশীলতার সম্পর্ক বিষয়টি আমাদের দেশে রাজ্যভিত্তিক পরিসংখ্যান নিয়েও আলোচিত হয়েছে।

জোতের মাপের সঙ্গে জমির উৎপাদনশীলতার ঋণাত্মক সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে। কিন্তু অপর একটি সমীক্ষায়১৩ আমরা দেখেছি, উৎপাদনে কৃৎকৌশলগত দক্ষতার পার্থক্যের ক্ষেত্রে জোতের মাপের কোনও ভূমিকা নেই। অপরদিকে পুঁজিবাদী বিকাশের অন্যান্য সূচক হিসাবে আমরা প্রতি হেক্টরে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, গ্রস সেচসেবিত এলাকার ভাগ, হাজার হেক্টর-প্রতি ট্রাক্টর ও পাম্পসেটের রাজ্যওয়ারি সংখ্যার সঙ্গে গড় জোতের আয়তনের ক্রমের পরিসংখ্যানগত আন্তঃসম্পর্ক দেখেছি। আমরা দেখেছি, জোতের গড় আয়তনের সঙ্গে হাজার হেক্টর-প্রতি ট্রাক্টর ও পাম্পসেটের আন্তঃসম্পর্ক ধনাত্মক। অর্থাৎ জোতের আয়তন বাড়লে এইসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ে। ছোট জোতে হাজার হেক্টর-প্রতি ট্রাক্টর, পাম্পসেটের ব্যবহার বড় জোতের তুলনায় কম। আবার ছোট জোতে জমির উৎপাদনশীলতা বেশি হলেও বড় জোত জমির পরিমাণের তুলনায় অধিক পরিমাণে মূলধনি উপকরণ ব্যবহার করে, হেক্টর-প্রতি শ্রমের ব্যবহার কম করে, অথচ বড় জোতে বৃদ্ধির হার ছোট জোতের তুলনায় তুলনামূলকভাবে বেশি। অর্থাৎ যেসব অঞ্চলে কিছুটা পরিমাণে পুঁজিবাদী মূলধনি বিনিয়োগ বেশি সেখানে বড় জোতের মাধ্যমেই পুঁজিবাদী ধরনের বিকাশ সম্ভব হতে পারে, ছোট জোতের মাধ্যমে নয়।

আমরা নীচে সারণি ৪.৪ ক, ৪.৪ খ এবং ৪.৪ গ এই তিনটি সারণিতে ভারতের প্রদেশগুলিকে কৃষি-উৎপাদনশীলতার বিভিন্ন মাপ অনুযায়ী ভাগ করে দেখিয়েছি। আমরা দেখছি (সারণি ৪.৪ ক), সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীলতা (>৫০০০০টাকা/ হেক্টর) যে-রাজ্যগুলিতে, তাদের মধ্যে পঞ্জাব, হরিয়ানা, কর্ণাটক, ঝাড়খণ্ড ও অন্ধ্রপ্রদেশে জোতের মাপ ১ হেক্টরের বেশি, এর মধ্যে পঞ্জাবে জোতের মাপ ৩ হেক্টরের বেশি ও হরিয়ানায় ২ হেক্টরের বেশি। এই রাজ্যগুলিতে কেন্দ্রীভবনের সূচকের (বড়+মাঝারি জোতের আওতায় জমি/ছোট+প্রান্তিক জোতের আওতায় জমি) মাপও সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ এইসব সবচেয়ে বড় জোত অধ্যুষিত রাজ্যগুলিতে বড় জোতের আওতায় জমির তুলনায় ছোট জোতের আওতায় জমি যথেষ্ট কম। এই রাজ্যগুলি সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল। সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল গ্রুপটি, যাদের উৎপাদনশীলতার মূল্য একর-প্রতি ৫০০০০ টাকার উপরে, এমন রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে উৎপাদনশীল রাজ্য কেরালায় কিন্তু জোতের গড় মাপ মাত্র ০.২২ হেক্টর এবং কেন্দ্রীভবনের মাত্রার দিক থেকেও কেরালা অনেক পিছনে। কিন্তু এই সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল রাজ্যগুলির মধ্যে আরও দু’টি রাজ্য রয়েছে, তামিলনাড়ুু ও পশ্চিমবঙ্গ। এদের জোতের মাপও যথেষ্ট ছোট, যথাক্রমে ০.৮০ ও ০.৭৭।

সারণি ৪.৪ খ-তে আমরা যে-রাজ্যগুলিতে মাঝারি উৎপাদনশীলতা রয়েছে, অর্থাৎ যাদের উৎপাদনশীলতার মূল্য হেক্টর-পিছু ৪০০০০ টাকার বেশি এবং ৫০০০০ টাকার কম, সেই রাজ্যগুলিকে তাদের কেন্দ্রীভবনের সূচক ও জোতের মাপ সহ উপস্থিত করেছি। সারণিটিতে মাঝারি উৎপাদনশীলতার রাজ্যগুলিকে নেওয়া হয়েছে। এই রাজ্যগুলিতে গড় জোতের মাপ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যথেষ্ট বেশি হলেও এই গ্রুপের মধ্যে এমন রাজ্যও রয়েছে (ত্রিপুরা ও উত্তরপ্রদেশ) যাদের গড় জোতের মাপ খুবই ছোট, কিন্তু উৎপাদনশীলতার নিরিখে উত্তরপ্রদেশ সবচেয়ে এগিয়ে, আর কেরালা, মহারাষ্ট্র ও অরুণাচল প্রদেশের তুলনায় এগিয়ে।

সারণি ৪.৪ গ সবচেয়ে কম উৎপাদনশীল রাজ্যগুলিকে দেখাচ্ছে। এই সবচেয়ে কম উৎপাদনশীল (<৪০০০০ টাকা প্রতি হেক্টরে) গ্রুপটিতে ১২টি রাজ্য আছে। এদের মধ্যে চারটি রাজ্য, উত্তরাখণ্ড, বিহার, জম্মু-কাশ্মীর ও হিমাচল প্রদেশ রাজ্যগুলিতে জোতের মাপ ১ হেক্টরের কম। তাছাড়া বাকি সব রাজ্যেই জোতের মাপ ১ হেক্টরের বেশি এবং গুজরাত ও রাজস্থানে জোতের মাপ যথাক্রমে ২ ও ৩ হেক্টরের বেশি। সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল, মাঝারি উৎপাদনশীল ও সবচেয়ে কম উৎপাদনশীল, এই তিন ধরনের জোতের গ্রুপগুলির গড় মাপ যথাক্রমে ১.৪৪ হেক্টর, ২.২২ হেক্টর ও ১.৩২ হেক্টর। আপাতভাবে মাঝারি উৎপাদনশীল রাজ্য গ্রুপটির গড় মাপ সবচেয়ে বেশি মনে হচ্ছে বটে, তবে তার কারণ এই গ্রুপে নাগাল্যান্ডের অন্তর্ভুক্তি। নাগাল্যান্ডের গড় জোতের মাপ অস্বাভাবিক বেশি। নাগাল্যান্ড বাদ দিয়ে এই গ্রুপের বাকি পাঁচটি রাজ্যের জোতের গড় মাপ দাঁড়ায় ১.৪৬ হেক্টর, অর্থাৎ অন্য দুটি গ্রুপের, বিশেষ করে প্রথম গ্রুপটির অনুরূপ। অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রুপটিকে শুধু বিবেচনায় রাখলে মনে হয় উৎপাদনশীলতার তফাতের সঙ্গে জোতের মাপের তফাতের সম্পর্ক অতি ক্ষীণ, কিন্তু তৃতীয় গ্রুপটিকেও আলোচনায় আনলে দেখা যায় এই সবচেয়ে কম উৎপাদনশীল গ্রুপটির জোতের গড় মাপ সবচেয়ে কম। অর্থাৎ সবচেয়ে কম উৎপাদনশীল রাজ্যগুলির জোতের গড় মাপ সব চেয়ে ছোট।

সারণি ৪.৪ ক উৎপাদনশীলতার সঙ্গে জোতের মাপের সম্পর্ক (উৎপাদনশীলতা >৫০০০০টাকা)

সারণি ৪.৪ ক উৎপাদনশীলতার সঙ্গে জোতের মাপের সম্পর্ক (উৎপাদনশীলতা >৫০০০০টাকা)

সারণি ৪.৪ খ (মাঝারি মাপের জোতের উৎপাদনশীলতা = >৪০,০০০ – <৫০০০০)

সারণি ৪.৪ খ (মাঝারি মাপের জোতের উৎপাদনশীলতা = >৪০,০০০ – <৫০০০০)

সারণি ৪.৪ গ (সর্বনিম্ন উৎপাদনশীলতা: <৪০০০০)

সারণি ৪.৪ গ (সর্বনিম্ন উৎপাদনশীলতা: <৪০০০০)

উৎপাদনশীলতার পরিসংখ্যান: Key Indicators of Situation of Agricultural Household in India (NSS 70th round)

রাজ্যভিত্তিক মোট শস্যাধীন জমি: Key Indicators of Situation of Agricultural Household in India (NSS 70th round)

কেন্দ্রীভবন সূচক: (বড়+মাঝারি জোতের আওতায় জমি)/(প্রান্তিক+ছোট জোতের আওতায় জমি) Agricultural Census–এর ভিত্তিতে আমাদের হিসাবে।

সারণি ৪.৫ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ব্যবহারিক জমি ও জোতের কেন্দ্রীভবনের মাত্রা

সারণি ৪.৫ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ব্যবহারিক জমি ও জোতের কেন্দ্রীভবনের মাত্রা

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017, Ministry of Agriculture

জমির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভবনের মাত্রা (X) যে-সব রাজ্যে ২০১০ সালে সবচেয়ে বেশি ছিল (X>১০) সেগুলি হল পঞ্জাব, অরুণাচল প্রদেশ, রাজস্থান, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ। জমির কেন্দ্রীভবন তার চেয়ে কম কিন্তু অন্য রাজ্যের চেয়ে বেশি (৫<X<১০) সেই রাজ্যগুলি হল মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড। তার থেকে আরও কম (১<X<৫) কেন্দ্রীভবন যে-রাজ্যগুলির সেগুলি হল: হিমাচল প্রদেশ, অসম, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওডিশা, তামিলনাডু, তেলেঙ্গানা, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড। সবচেয়ে কম (X<১) কেন্দ্রীভবন যে-রাজ্যগুলিতে সেগুলি হল: বিহার, জম্মু-কাশ্মীর, কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ। উৎপাদনশীলতার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে উৎপাদনশীলতার সঙ্গে কেন্দ্রীভবনের কোনও সম্পর্ক নেই। ২০১৫–১৬ সালে প্রায় সব রাজ্যেই কেন্দ্রীভবনের মাত্রা ২০১০–১১র তুলনায় অনেকটা পরিমাণে কমেছে, কিন্তু কয়েকটি রাজ্যে কমার অনুপাত খুবই কম। যেমন পঞ্জাবে সময়ের সঙ্গে কেন্দ্রীভবনের মাত্রা কমেছে খুবই সামান্য। সেইরকম জমির কেন্দ্রীভবনের মাত্রা খুবই কম কমেছে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড ও হরিয়ানায়। কেন্দ্রিকতার মাত্রা যথেষ্ট কমেছে অরুণাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, অন্ধ্রপ্রদেশে। জম্মু-কাশ্মীরে এই পাঁচ বছরে কেন্দ্রীভবনের মাত্রা বেড়েছে।

উৎপাদন-দক্ষতার সঙ্গে জোতের মাপের সম্পর্ক: একটি জোত-স্তর বিশ্লেষণ

আমরা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান ও বীরভূম জেলার ছয়টি ব্লকের ৩৬০টি জোতের উৎপাদন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছি। সনাতন আউস, আমন এবং বোরো ধান ও সবজি চাষে জোত স্তরে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদানের পরিমাণ আলাদাভাবে নিয়ে সবচেয়ে দক্ষ জোতের সাপেক্ষে প্রতিটি জোতের তুলনামূলক উৎপাদন দক্ষতার সূচকের পরিমাপ করেছি১৪। এই সূচকটি উৎপাদনের বিভিন্ন উপকরণ যেমন, সার, বীজ, কীটনাশক ও জল, শ্রম দিবস এবং জোতের মাপ ইত্যাদির প্রভাবে কতটা প্রভাবিত তা দেখার জন্য টবিট রিগ্রেশন মডেল গঠন করে উৎপাদনকুশলতার ওপর এদের প্রভাবকে পরিসংখ্যানগতভাবে পরিমাপ করেছি। আমরা দেখেছি, উৎপাদনকুশলতার ওপর জমি বাদে অন্যান্য সব উপকরণের প্রভাব ঋণাত্মক। অর্থাৎ এইসব উপকরণকে কুশলতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হলে এদের ব্যবহার আরও কমানো দরকার। কিন্তু আউস ও আমন ধানের ক্ষেত্রে জোতের মাপের প্রভাব সূচকটির মান ধনাত্মক। এর অর্থ, অন্যান্য উপকরণগুলির মাপ একই রেখে জোতের মাপ আরও বাড়িয়েই কেবলমাত্র আমন ও আউস ধানের উৎপাদনকুশলতা বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এই মাপটির পরিসংখ্যানগত মানটির নির্ভরযোগ্যতা যথেষ্ট নয়। তেমনই বোরো ধানের ক্ষেত্রে সূচকটির মান ঋণাত্মক, যার অর্থ বোরো ধানের ক্ষেত্রে জোতের মাপ কমলে অধিক কুশলতা অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু এক্ষেত্রেও আউস ও আমনের মতোই মানটির পরিসংখ্যানগত নির্ভরযোগ্যতা গ্রহণযোগ্য স্তরের নীচে আছে, তাই এটিকে একটি অত্যন্ত দুর্বল ইঙ্গিতের থেকে বেশি কিছু গণ্য করা ভুল হবে। কিন্তু সবজি চাষের ক্ষেত্রে এই সূচকটির মান পরিসংখ্যানগত ভাবে অকিঞ্চিৎকর। অর্থাৎ সবজি চাষের ক্ষেত্রে উৎপাদনকুশলতা্র ওপর জোতের মাপের উল্লেখযোগ্য কোনও প্রভাব নেই। অন্যদিকে পরিসংখ্যান অনেকটা নিশ্চিতভাবে দেখাচ্ছে যে, প্রায় সব ধরনের চাষে, উৎপাদনকুশলতার ওপর জোতের মাপের কোনও প্রভাব নেই। কিন্তু বিশেষ করে বোরো চাষে, সার, কীটনাশক বা জলের জন্য খরচ অতিরিক্ত এবং এই উপকরণগুলির একক বাড়িয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায় না। বরং উৎপাদনকুশলতার স্বার্থে এই উপাদানগুলির ব্যবহার আরও কমানো উচিত।

উপরের বিশ্লেষণ থেকে আমাদের কাছে দু’টি বিষয় পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে। তার প্রথমটি হল, পশ্চিমবঙ্গ মূলত একটি ধান উৎপাদন-প্রধান রাজ্য হলেও এখানে উৎপাদনে বিভিন্ন উপকরণের ব্যবহার মোটেই উৎপাদনকুশল নয়। এই সমস্ত উপকরণ, বিশেষত সার ও কীটনাশকের ব্যবহারের ধরনে চাষির অজ্ঞানতার ও অদক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার শুধু যে উৎপাদনব্যয় অহেতুক অতিরিক্ত বাড়িয়ে দেয় তাই নয়, এই উপকরণগুলির রাসায়নিক অন্তর্বস্তু ফসল ও জমি উভয়েরই ক্ষতি করে। উৎপাদনকুশলতাকে সর্বোত্তম স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য এগুলির ব্যবহার কমানো জরুরি। এই সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার ভারতীয় কৃষিতে একটি ক্ষতিকারক প্রবণতা, যা শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, পঞ্জাব, মহারাষ্ট্র ইত্যাদি অন্যান্য এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলিতেও বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় একটি সমস্যা। পঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশে চাষিদের আত্মহত্যা প্রসঙ্গে সৃজিত মিশ্র ও অন্যান্যদের পর্যবেক্ষণ১৫ থেকে জানা যায়, চাষিদের এই অতিরিক্ত সার, কীটনাশক ইত্যাদি ব্যবহারের প্রবণতার পিছনে রয়েছে এগুলির ব্যবহার বিষয়ে উপকরণ-বিক্রেতাদের পরামর্শ। উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক ব্যবহারের জন্য চাষিরা এই উপকরণগুলির বিক্রেতা ব্যবসায়ী, কমিশন এজেন্ট ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। এরাই উপকরণের সঠিক পরিমাণ ও বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে সঠিক অনুপাত বিষয়ে চাষিদের পরামর্শ দেয়। এরাই অনেক সময়ে উপকরণের অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে অপারগ চাষিকে চাষ ওঠার পর শোধ করার শর্তে ধারে এইসব উপকরণ জোগান দিয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়া উপকরণগুলির অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি করে এবং অতিরিক্ত ব্যবহারের দিকে নিয়ে যায়। গোটা ঘটনাটি উপকরণ জোগানদাতার উদ্যোগের পরিণাম।১৬

সারণি ৪.৬ উৎপাদনকুশলতায় বিভিন্ন সূচকের অবদানের পরিসংখ্যানগত গুরুত্ব

সারণি ৪.৬ উৎপাদনকুশলতায় বিভিন্ন সূচকের অবদানের পরিসংখ্যানগত গুরুত্ব

উৎস: নিজস্ব গবেষণা [ব্র্যাকেটের মধ্যে T-এর মান] তৃণমূল স্তরে সংগৃহীত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে মাপ।

Aparajita Mukherjee(2015): ‘Evalution of the Policy of Crop Diversification as a Strategy for Reduction of Rural Poverty in India’in Poverty Reduction Policies and Practices in Developing Asia ed by A.Heshmati, E.Maasoumi and G.Wan,ADB and Springer International Publishing AG.

অপর এক অনুসন্ধানে আমরা জমির উৎপাদনকুশলতার মতো হেক্টর-প্রতি উৎপাদনের ওপর জোতের মাপের কোনও প্রভাব আছে কিনা এবং সার, বীজ, জল, শ্রম ইত্যাদি উপকরণের প্রভাব স্থির রেখে জমির হেক্টর-প্রতি উৎপাদনশীলতার ওপর জোতের মাপের প্রভাব কী দেখার চেষ্টা করেছি। এ জন্য উৎপাদনশীলতাকে একটি প্রভাবিত চলরাশি হিসেবে দেখে উৎপাদনের বিভিন্ন উপকরণকে প্রভাব সৃষ্টিকারী চলরাশি হিসেবে ধরে একটি রিগ্রেশন সমীকরণ গঠন করা হয় এবং উৎপাদনশীলতার ওপর বিভিন্ন উপকরণের প্রভাব-মাত্রার পরিসংখ্যান নির্ধারণ করা হয়। এইসব উপকরণকে স্থির রেখে শুধুমাত্র জোতের মাপ পরিবর্তন করলে উৎপাদনশীলতা কীভাবে প্রভাবিত হতে পারে তার মাত্রারও পরিসংখ্যান নির্ধারণ করা হয়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই উৎপাদনের উপকরণগুলি পরিবর্তনের ফলে রাজ্যে রাজ্যে উৎপাদনশীলতার যে-তফাত হয় সেটিকেই আমাদের এই আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে নিয়ে সমগ্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পরিসংখ্যান সূত্রে প্রাপ্ত রিগ্রেশন সমীকরণটি চতুর্থ অধ্যায়ের সংযোজনে দেওয়া হল।

বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে (অন্য সব উপাদানের ব্যবহার একই স্তরে রেখে) সেচের এলাকা বাড়িয়ে এবং চাষের নিবিড়তা বাড়িয়ে হেক্টর-প্রতি উৎপাদন বাড়ানো যায়। অর্থাৎ যদি কোনও রাজ্যে এই দু’টি সূচকের মান অন্য রাজ্যের তুলনায় বেশি থাকে তাহলে প্রথমোক্ত রাজ্যগুলিতে হেক্টর-প্রতি গম উৎপাদনের পরিমাণ দ্বিতীয়োক্ত রাজ্যের তুলনায় বেশি হবে। কিন্তু রাজ্যগুলির মধ্যে মোট গম উৎপাদন এলাকার তুলনায় গ্রামীণ রাস্তার দৈর্ঘ বেশি হলে গমের হেক্টর-প্রতি উৎপাদন কম হবে। অর্থাৎ উৎপাদনের পরিমাণের তুলনায় প্রয়োজনীয় রাস্তা অনেক বেশি তৈরি হয়ে গেছে। ফলে রাস্তা বাড়িয়ে উৎপাদন বাড়ানো যাবে না, বরং তুলনায় রাস্তার দৈর্ঘ যে-সব রাজ্যে তুলনামূলকভাবে কম, সেখানে উৎপাদনের মাত্রা খানিকটা বেশি। অন্যান্য উপাদানগুলি ব্যবহারের স্তর সব রাজ্যের ক্ষেত্রেই এত বেশি যে, এই উপাদানগুলি আরও বাড়া বা কমার জন্য রাজ্যগুলির মধ্যে হেক্টর-প্রতি উৎপাদনে কোনও প্রভাব পড়বে না। রাজ্যগুলির মধ্যে হেক্টর-প্রতি উৎপাদনের পার্থক্য নির্ণয়ে জোতের মাপের ভূমিকা আছে। জোতের মাপ বেশি হলে উৎপাদনশীলতার মাত্রা বেশি হবে। এই শেষোক্ত পর্যবেক্ষণটির অর্থ হল, বড় চাষ অধিক উৎপাদনশীল। এই পর্যবেক্ষণটি, আমাদের আলোচিত রাজ্যগুলির প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অন্তত গমচাষের ক্ষেত্রে সত্যি না হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমাদের এই পর্যবেক্ষণটি বহুদিনের পুরনো জোতের মাপ ও উৎপাদনশীলতার মধ্যে ঋণাত্মক সম্পর্কের সিদ্ধান্তটির সরাসরি বিরোধিতা করছে। অবশ্য আমাদের এই পর্যবেক্ষণটি শুধুমাত্র একটি শস্য, গমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বহুদিনের পুরনো ও বহুচর্চিত জোতের মাপ ও উৎপাদনশীলতার মধ্যে বিপরীতগামী সম্পর্ক, অর্থাৎ বড় জোতের তুলনায় ছোট জোত বেশি উৎপাদনশীল, এই বিষয়টি প্রাক্‌সবুজ বিপ্লব যুগের একটি পর্যবেক্ষণ। কৃষিতে প্রকৌশলগত উন্নয়নের পর এই পর্যবেক্ষণের যাথার্থ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, এবং সিদ্ধান্তটির সমর্থনে ও এর বিরুদ্ধে যেতে পারে এমন বহু নতুন নতুন আলোচনা উঠে এসেছে। আমাদের এই পর্যবেক্ষণটি ২০১৬–১৭ সালের তথ্য ব্যবহার করে ২৬টি প্রধান রাজ্য নিয়ে করা হয়েছে। নতুন ধরনের বীজ, সার ও অন্য উপকরণের সর্বব্যাপী ব্যবহার, সেইসঙ্গে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে জমির উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করার প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জোতের মাপ অন্তত গম চাষের ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতাকে কীভাবে ও কতটা প্রভাবিত করে সে বিষয়ে আলোকপাত করেছে আমাদের পর্যবেক্ষণটি। উৎপাদন-প্রক্রিয়ার ওপর নতুন প্রযুক্তির প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, বড় জোতের রাজ্যগুলির পক্ষে গমচাষের উৎপাদনশীলতায় এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আমরা শুধুমাত্র গমচাষের ক্ষেত্রে নয়, সমগ্র অভ্যন্তরীণ কৃষি-উৎপাদন ক্ষেত্রেও ২০১৪ সালের রাজ্যভিত্তিক অভ্যন্তরীণ নিট উৎপাদন ও বিভিন্ন উপাদানের ব্যবহারের পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করেছি। পরিসাংখ্যিক পরিমাপ থেকে পাওয়া রিগ্রেশন সমীকরণটি চতুর্থ অধ্যায়ের সংযোজনে দেওয়া হল।

আমাদের এই পরিসাংখ্যিক পর্যবেক্ষণটি আর-একবার কৃষি-উৎপাদনের ওপর জোতের মাপের ধনাত্মক প্রভাব প্রমাণ করল। আমাদের বিশ্লেষণটি থেকে দেখা যাচ্ছে যদি অন্যান্য সমস্ত সংশ্লিষ্ট পরিকাঠামো ও উপকরণের ব্যবহার, রাস্তাঘাট, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ইত্যাদি একই স্তরে থাকে তাহলে জোতের মাপের সঙ্গে নিট অভ্যন্তরীণ কৃষি উৎপাদনের সম্পর্ক ধনাত্মক, অর্থাৎ জোতের মাপ বেশি হলে নিট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাত্রা বেশি হয়। জোতের মাপ ছাড়াও নিট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাত্রা আর যেসব উপাদানের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয় সেগুলি হল, গ্রামীণ রাস্তা ইত্যাদি পরিকাঠামো ও সারের ব্যবহার ইত্যাদি প্রকৌশল। এই উপাদানগুলি বাড়লে কৃষি-উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গ্রামীণ রাস্তা যেমন ফসল বাজারজাত করার সুবিধা বোঝায়, তেমনই গ্রামীণ রাস্তা সামগ্রিক উন্নয়নের সূচক। গ্রামীণ রাস্তাঘাট বেশি থাকার অর্থ ওই রাজ্যে সামগ্রিক সুযোগ-সুবিধা বেশি তৈরি হওয়ায় চাহিদা ও আয় সংস্থানের উপায় বেড়েছে। রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বাজার যেসব রাজ্যে বেশি বিস্তৃত, সেখানে যেমন সারের অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহার হয়ে থাকে, তেমনই কোনও কোনও রাজ্যে সারের ব্যবহার যথোচিত স্তরে পৌঁছাতে পারেনি। এই দ্বিতীয় স্তরের রাজ্যগুলিতে সারের ব্যবহার বাড়লে অবশ্যই উৎপাদন বাড়বে। আর-একটি উপাদান হল শস্যবৈচিত্র। আমরা শস্যবৈচিত্রের সূচকটিকে একটি প্রভাব সৃষ্টিকারী উপাদান হিসেবে ধরে পরিসাংখ্যিক গণনা করে দেখেছি, নিট কৃষি উৎপাদনের ওপর এই উপাদানের প্রভাব ধনাত্মক, অর্থাৎ শস্যবৈচিত্রের মাত্রা বেশি হলে কৃষি উৎপাদনের মাত্রা বাড়ার সম্ভাবনা বেশি।

সারণি ৪.৪, ৪.৫ ও ৪.৬ দেখাচ্ছে, বড় জোতের রাজ্যগুলির মধ্যে যেমন পঞ্জাব, হরিয়ানার মতো প্রযুক্তি-প্রয়োগে এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলি আছে, তেমনই রাজস্থান, অরুণাচল প্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যের মতো অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলিও আছে।

এই বিষয়টিকে আরও একটু স্পষ্ট ভাবে বোঝার জন্য আমরা ভারতের বাছাই করা ২৭টি প্রধান রাজ্যকে জোতের মাপ অনুযায়ী তিনটি ভাগে ভাগ করেছি: ১) যে-রাজ্যগুলির গড় জোতের মাপ ২ হেক্টর বা তার বেশি, ২) যে-রাজ্যগুলির গড় জোতের মাপ ১ হেক্টরের বেশি কিন্তু দুই হেক্টরের কম, এবং ৩) যে-রাজ্যগুলিতে গড় জোতের মাপ ১ হেক্টরের থেকে কম। এই ভাগ অনুযায়ী তিনটি দলের অন্তর্ভুক্ত রাজ্যের সংখ্যা যথাক্রমে ৬টি, ১২টি এবং ৯টি। নীচের সারণিতে রাখা হল এই রাজ্যগুলিতে জমির কেন্দ্রীভবন সূচক ও সেই রাজ্যের সবক’টি প্রধান ফসলের উৎপাদন-সমষ্টির হেক্টর-প্রতি পরিমাণের গড় (অর্থাৎ সব শস্য বিবেচনায় এনে গড় উৎপাদনশীলতা)।

সারণি ৪.৭ জোতের গড় মাপ অনুযায়ী তিন ভাগে বিন্যস্ত রাজ্যগুলিতে জমির কেন্দ্রিকতার সূচক ও প্রতিটি ভাগের অন্তর্গত রাজ্যগুলির গড় উৎপাদনশীলতা।

সারণি ৪.৭ জোতের গড় মাপ অনুযায়ী তিন ভাগে বিন্যস্ত রাজ্যগুলিতে জমির কেন্দ্রিকতার সূচক ও প্রতিটি ভাগের অন্তর্গত রাজ্যগুলির গড় উৎপাদনশীলতা।

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017

সারণি ৪.৬ থেকে ধরা পড়ছে যে, সবচেয়ে বড় জোতের রাজ্যগুলিতে উৎপাদনশীলতা সবচেয়ে বেশি। ছোট জোতগুলির গড় উৎপাদনশীলতার তুলনায় মাঝারি জোতের উৎপাদনশীলতা অনেকটা নীচে থাকলেও সবচেয়ে বড় জোতের রাজ্যগুলির সর্বোচ্চ গড় উৎপাদনশীলতা থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইঙ্গিত মেলে। সারণি ৪.৪ ক, ৪.৪ খ ও ৪.৪ গ এই তিনটি সারণিতে আমরা রাজ্যগুলিকে তাদের উৎপাদনশীলতার মাত্রার ভিত্তিতে তিনটি ভাগে ভাগ করে তাদের জোতগুলির গড় মাপ বিচার করেছিলাম। আমরা দেখেছি, একটি ব্যতিক্রমী রাজ্যকে (নাগাল্যান্ড, তার জোতের গড় মাপ অস্বাভাবিক বেশি, ৬.০২ হেক্টর) বাদ দিয়ে হিসাব করলে তিন দলের রাজ্যগুলির গড় জোতের পরিমাপ দাঁড়ায় (সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন উৎপাদনশীলতা, এই ক্রমে) ১.৪৫, ১.৪৬ এবং ১.৩২ হেক্টর। স্পষ্টতই সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল এবং মাঝারি উৎপাদনশীল রাজ্যগুলির মধ্যে জোতের মাপের দিক থেকে বিশেষ পার্থক্য নেই। তবে সবচেয়ে কম উৎপাদনশীল রাজ্যগুলির জোতের গড় মাপ অন্যান্য রাজ্যগুলির জোতের গড় মাপের তুলনায় বেশ কম। এই পরিসাংখ্যিক পর্যবেক্ষণটি যে-সিদ্ধান্তের দিকে আমাদের নিয়ে যেতে পারে তা হল, রাজ্য অনুযায়ী উৎপাদনশীলতার পরিমাণের পার্থক্য নির্ণয়ে জোতের মাপের খুব বেশি ভূমিকা নেই।

উপরের সারণি ৪.৬ থেকে আমরা দেখছি সবচেয়ে বড় জোতের রাজ্যগুলিতে জমির কেন্দ্রীভবন প্রবণতা সবচেয়ে বেশি এবং মাঝারি ও সবচেয়ে ছোট জোতের রাজ্যগুলিতে কেন্দ্রীভবনের মান ক্রমশ কমেছে। কিন্তু সারণি ৪.৫ এবং ৪.৬ ভালভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, যে-রাজ্যগুলিতে কেন্দ্রীভবনের মাত্রা খুব বেশি, সেগুলি যে সবসময়ে অধিক উৎপাদনশীল এমন নয়। অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশের জোতের কেন্দ্রীভবনের মাত্রা যথেষ্ট বেশি, এদের জোতের মাপও বেশি, কিন্তু এরা উৎপাদনশীলতার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। আবার পঞ্জাব-হরিয়ানায় কেন্দ্রীভবনের মাত্রার সঙ্গে উৎপাদনশীলতার মাত্রাও বেশি। কেরালা ও অন্ধ্রপ্রদেশ উৎপাদনশীলতার দিক থেকে যথেষ্ট এগিয়ে থাকা রাজ্য হলেও কেন্দ্রীভবনের মাত্রা বা জমির মাপের দিক থেকে এরা বেশ নীচে। অর্থাৎ জমির কেন্দ্রীভবনের মাত্রার সঙ্গেও উৎপাদনশীলতার সবসময়ে সরাসরি সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে না। এই ধরনের ঘটনাকে শুধুমাত্র ওপর থেকে দেখলে সাযুজ্যহীন মনে হয়। কিন্তু একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাব যে, সবচেয়ে বড় মাপের জোতগুলির মধ্যে এমন কিছু রাজ্য রয়েছে যেগুলি উৎপাদনশীলতার দিক থেকে যথেষ্ট পিছিয়ে পড়া। এর কারণ, এই রাজ্যগুলি, যেমন, অরুণাচল প্রদেশ, রাজস্থান, নাগাল্যান্ড, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত ইত্যাদি বড় জোতবিশিষ্ট ও সেইসব রাজ্যে বেশি কেন্দ্রীভবনও ঘটেছে। কিন্তু এই রাজ্যগুলি উৎপাদনশীলতার নিরিখে একেবারে পিছনে রয়েছে। উপরন্তু এই রাজ্যগুলি অন্যান্য নানা দিক থেকে পিছিয়ে পড়া, পুরনো উৎপাদন-সম্পর্কের অবশেষ এইসব রাজ্যে প্রবলভাবে বিদ্যমান। শুধু প্রকৌশলের দিক থেকেই নয়, শ্রম ও অন্যান্য উপকরণ এবং পণ্যের মুক্ত বাজার-প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতিতে উৎপাদন ও উৎপাদিত পণ্য চলাচলের ওপর বিভিন্ন অর্থনীতি-বহির্ভূত শক্তির প্রভাব সমগ্র উৎপাদন প্রক্রিয়াকে গতিহীন করে রাখে। এই রাজ্যগুলিতে এখনও বড় জোতের চাষে মুক্ত মজুরি-শ্রমিক ব্যবহারের বদলে নিঃস্ব, দুঃস্থ, ঋণগ্রস্ত বাঁধা-শ্রমিকের ব্যবহার উৎপাদন-সম্পর্কের প্রধান অঙ্গ হিসেবে রয়ে গেছে। পঞ্জাব, হরিয়ানা, কর্ণাটক ইত্যাদির মতো কিছু কিছু রাজ্যে অংশত প্রকৌশলগত উন্নতি এবং প্রগতিশীল বাজার-নির্ধারিত শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের ভিত্তিতে শ্রম-প্রক্রিয়া ও উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু থাকলেও ভারতের বিস্তীর্ণ গ্রামীণ এলাকায় এখনও কৃষি উপকরণ, পণ্য ও ঋণের বাজার-প্রক্রিয়া যথাযথ চালু নয়, ফলে বড় জোত ও জমির অতিরিক্ত কেন্দ্রীভবন অনেক সময়েই প্রাক্পুঁজিবাদী সামন্ততান্ত্রিক ধরনের উৎপাদন-সম্পর্কের বৈশিষ্ট্যগুলিকে ধরে রাখে। আবার এমন কিছু বড় জোতের রাজ্যও আছে, যেমন, পঞ্জাব ও হরিয়ানা, যারা অধিক উৎপাদনশীল রাজ্য, জমির কেন্দ্রীভবনের মাত্রাও এসব ক্ষেত্রে সারা দেশের গড় কেন্দ্রীভবনের মাত্রার থেকে বেশি। উৎপাদনশীলতার একই বৈশিষ্ট্য দেখা যাবে জোতের মাপের দিক থেকে এদের কিছুটা নীচে, কিন্তু সারা দেশের গড় জোতের মাপের থেকে অনেকটা উপরে থাকা ও জমির কেন্দ্রীভবনের মাত্রার দিক থেকেও এগিয়ে থাকা কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, তামিলনাডু ইত্যাদি রাজ্যে। কিন্তু পাশাপাশি কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ ইত্যাদি হল ছোট জোত ও তুলনায় কম মাত্রায় জমির কেন্দ্রীভবন ঘটেছে এমন রাজ্য, তবু সেগুলিও অধিক উৎপাদনশীল রাজ্য, যাদের হেক্টর-পিছু উৎপাদনের মূল্য ৫০,০০০ টাকার বেশি।

পঞ্জাব, হরিয়ানা, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, তামিলনাডু ইত্যাদি ভারতের কয়েকটি রাজ্য আধুনিক প্রযুক্তি, নতুন ধরনের স্থির পুঁজি বিনিয়োগ ইত্যাদির মাধ্যমে আধুনিক চাষপদ্ধতি প্রয়োগ করে উৎপাদনশীলতার দিক থেকে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে গেছে। এই রাজ্যগুলিতে পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের বিকাশের অনুকূল পরিস্থিতি আছে। কিন্তু এই রাজ্যগুলিতেও ২০০০ সালের আগে-পরে কয়েকটি বছরে চাষিদের আত্মহত্যা এইসব রাজ্যে কৃষি-অর্থনীতির বাস্তবতা নিয়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে এনে ফেলেছে। এইসব এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলিতে মহাজন-ব্যবসায়ীদের কর্তৃত্বে থাকা কৃষি-ঋণ, কৃষি-উপকরণ, কৃষি-পণ্যের মিলিত বাজার-প্রক্রিয়া কীভাবে উদ্বৃত্তের একটি বড় অংশকে প্রকৃত উৎপাদকের কাছ থেকে সরিয়ে এনে ব্যবসায়িক-বাণিজ্যিক কাজে যুক্ত শ্রেণিটির নিয়ন্ত্রণে এনে দেয়, নতুন কিছু অনুসন্ধানে তার ইঙ্গিত মিলেছে। একই সঙ্গে ধরা পড়েছে যে, ভারতের কৃষি-অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলছে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার-বিশ্বব্যাংক নির্দেশিত বিশ্বায়ন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা নির্দেশিত বাণিজ্য সংক্রান্ত নতুন নিয়মগুলি এবং আন্তর্জাতিক মেধা-স্বত্ব আইন। এগুলির মিলিত প্রয়োগে ভারতীয় কৃষি নিজ দেশের বাজারে অসম প্রতিযোগিতার দাপটে সংকটে পড়ছে এবং ভারতীয় চাষি আত্মহত্যার পথে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ক্রমাগত পুঁজি সঞ্চয়নের যে-প্রক্রিয়া কৃষিকে চলমানতার দিকে নিয়ে যেতে পারে তার গতি স্তব্ধ হয়ে যায় কারণ পণ্য, উপকরণ ও ঋণের বাজারের মিলিত কার্যকারিতা আহরিত উদ্বৃত্তকে দ্রুত উৎপাদন ব্যবস্থার বাইরে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু এই বড় জোত অধ্যুষিত কৃষির বাইরে যে বিস্তীর্ণ ভারতীয় কৃষি রয়েছে তা প্রান্তিক- ও ছোট জোত-নির্ভর। ভারতের কৃষিতে ছোট জোত-নির্ভর চাষের মাধ্যমে পুঁজিবাদী উত্তরণ সম্ভব কিনা সে বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। কিন্তু আমাদের সামনে অন্যান্য দেশের কিছু কিছু উদাহরণ আছে। আমরা জানি, ছোট জোতে চাষ মানেই ক্ষুদ্রায়তন চাষ নয়। ছোট জোতে চাষের নিবিড়তা বাড়িয়ে, পুঁজি-ঘন চাষের মাধ্যমে ছোট জোতে পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্ক বিকশিত হতে পারে। আমেরিকান কৃষি-অর্থনীতিতে ছোট জোতে বৃহদায়তন উৎপাদন মারফত ধনতান্ত্রিক কৃষির বিকাশ ঘটেছিল। আমেরিকার কৃষি-অর্থনীতির এই বিকাশের ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেনিন এই যুক্তিটি খণ্ডন করতে চেয়েছিলেন যে, আমেরিকায় ছোট জোতের মাধ্যমে এই পুঁজিতন্ত্রের বিকাশ, ছোট জোতের প্রাধান্য বৃদ্ধি, বা কৃষিতে জোতের গড় আয়তন হ্রাসের অর্থ এই নয় যে, কৃষিতে পুঁজিবাদের ভাঙন দেখা দিয়েছে। বরং এটি ধনতন্ত্রের দ্রুত বিকাশকেও সূচিত করতে পারে। কিন্তু লেনিনের এই পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রটি ছিল আমেরিকার অর্থনীতি, যেখানে ঐতিহাসিকভাবে সামন্ততন্ত্রের কোনও অস্তিত্বই ছিল না। ফলে উৎক্রমণের সময় সামন্ততন্ত্রের অবশেষগুলি পুঁজিবাদের বিকাশের পথে যে-বাধার সৃষ্টি করে, এক্ষেত্রে সেগুলি ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। প্রাক্-পুঁজিবাদী বাণিজ্য-পুঁজির কর্তৃত্বের যুগে বাণিজ্য-পুঁজি কৃষি-পণ্যের বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বিচ্ছিন্ন ছোট উৎপাদকের পুঁজিকে একত্রিত করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিকাশের পথে কিছুটা ইতিবাচক ভূমিকা নেয়। অন্যদিকে পুঁজিবাদের বিকাশের প্রক্রিয়ায় ক্ষুদ্র কৃষি অর্থনীতির উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে সদ্যবিকশিত পুঁজিবাদী উৎপাদন পুঁজিবাদী ক্ষেত্রে উৎপাদিত পণ্যের বাজারকে বিস্তৃত করে এবং পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমের জোগানকে সুনিশ্চিত করে। ফলে সরল পণ্য উৎপাদন-ব্যবস্থা থেকে পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থায় উৎক্রমণের প্রক্রিয়ায় একদিকে ক্ষুদ্র কৃষি-অর্থনীতির উচ্ছেদ, অন্যদিকে সংযুক্তির মধ্য দিয়ে বৃহৎ পুঁজির ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিণত হওয়া একটি আবশ্যিক শর্ত হিসাবে দেখা দেয়। আমেরিকান অর্থনীতিতে এই আদিম পুঁজি সঞ্চয়নের প্রক্রিয়া বা এই প্রক্রিয়ায় ক্ষুদ্র কৃষি-অর্থনীতির ভূমিকা এবং ক্ষুদ্র পুঁজির সংযুক্তি বা উচ্ছেদের প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যিক পুঁজির বিশেষ ভূমিকা, কোনওটিই আবশ্যিক শর্ত হিসেবে দেখা দেয়নি।

অন্যদিকে জাপানের উদাহরণটি লক্ষ করলে আমরা দেখি, জাপানে সংস্কারের ফলে ক্ষুদ্র কৃষি অর্থনীতির ওপর থেকে সমস্ত প্রাক্-পুঁজিবাদী সম্পর্কের বোঝা নির্মূল হয়ে গিয়েছিল, সেখানে কৃষির সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে মাঝারি মাপের জোতের ভিত্তিতে যে কৃষি-অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করা হয়েছিল তাকে অপ্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক-মহাজনি পুঁজির কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত করা হয়েছিল এবং মুক্ত শ্রম, ঋণ, ও পণ্যের বাজারের সঙ্গে তাকে যুক্ত করে কৃষিতে অবাধ পুঁজিগঠনের রাস্তা উন্মুক্ত করা হয়। পুঁজিসঞ্চয়নের প্রক্রিয়ায় দেখা যায়, বৃহদায়তন চাষের সুবিধাগুলি ছোট জোতের তুলনায় বড় জোতেই অনেক বেশি পরিমাণে থাকে। ফলে মুক্ত বাজার-ব্যবস্থায় অচিরেই ছোট জোতগুলি প্রতিযোগিতায় পিছু হটতে থাকে, আয়তন বৃদ্ধির মাধ্যমে বড় জোতগুলি আরও বড় আকার নেয়। শেষ পর্যন্ত কৃষিতে পুঁজিগঠনের প্রক্রিয়াকে অবাধ রাখার জন্য প্রয়োজন পড়ে বড় জোতগুলির ওপর থেকে ঊর্ধ্বসীমা সরিয়ে তার বৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত করার। ১৯৬১ সালে জাপানে কৃষি-সংস্কারের দ্বিতীয় স্তর হিসাবে প্রথমে কৃষি সমবায় গঠনের মাধ্যমে বৃহৎ আয়তনে চাষ শুরু করা ও পরবর্তীতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বৃহদায়তন চাষ সংগঠিত করা আইনগত অনুমতি পায়।

কিন্তু জাপানে কৃষি-পুঁজিবাদ গঠনের এই প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পূর্বশর্ত শুধু কৃষি-অর্থনীতির আমূল সংস্কারের মাধ্যমে কৃষিতে উপস্থিত পুরনো সম্পর্কের আমূল উচ্ছেদ নয়, কৃষির পাশাপাশি শিল্প-পুঁজিবাদের বিকাশ, শ্রম ও জমিসহ সমস্ত উপকরণের মুক্ত বাজার গঠন, দ্রুত শিল্পবিকাশের ফলে শ্রম ও কৃষি-পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি, এগুলিই জাপানে কৃষি-পুঁজিবাদ গঠনের আবশ্যিক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। ভারতীয় কৃষির অবস্থা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা গঠনের জন্য আরও যে-প্রশ্নগুলি নিয়ে আলোচনা জরুরি, এখানে সেগুলির পুনরাবৃত্তি করছি: ক) ভারতীয় কৃষি-অর্থনীতিতে উৎপাদন কি মজুরি-শ্রম নির্ভর হয়ে উঠেছে ও এই প্রয়োজনের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের কৃষিতে কি মুক্ত শ্রমের একটি সুসংগঠিত বাজার প্রক্রিয়া চালু হয়েছে? খ) ভারতে কৃষিঋণের বাজার কতটা স্বাধীনভাবে ক্রিয়া করে? স্থানীয় মহাজন শ্রেণিটি ঋণের জোগান কতটা নিয়ন্ত্রিত করে? গ) কৃষি-পণ্যের বাজার কতটা সুসংগঠিত ও তা কতটা স্বাধীনভাবে ক্রিয়া করে? স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ছোট উৎপাদকের উৎপাদন ও কৃষি-পণ্যের দাম কতটা নিয়ন্ত্রণ করে? খোলা বাজারের ভূমিকা কতটা? ঘ) কৃষিতে উৎপাদনের উপকরণের বাজার কতটা ব্যবসায়ী-মহাজনদের নিয়ন্ত্রণাধীন?

আমরা পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে এই বিষয়গুলির ওপরেই আমাদের আলোচনা নিবদ্ধ রাখব। এর মাধ্যমে আমরা এটাই দেখতে চাই যে, ভারতীয় কৃষি কী পরিমাণে তার দীর্ঘকালের সনাতন বৈশিষ্ট্য কাটিয়ে উঠে একটি গতিশীল উৎপাদন ক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার আবশ্যিক পূর্বশর্তগুলি পূরণ করতে পারছে।

সংযোজন

ক. গমের পরিসংখ্যানগত পরিমাপ

Y = −1513.97 − 2.04X1 + 384.31X2 + 0.26X3 − 1.34X4 − 2.42X5

+ 18.67X6 + 18.16X7

t = (−1.10) (−2.90) (2.08) (0.43) (−0.28) (−1.34) (2.01) (2.40)

R2 = 0.93 adj R2 = 0.84

Y = প্রতি হেক্টর গম চাষে মোট উৎপাদনের পরিমাণ।

X1 = গ্রামীণ রাস্তা (কিলোমিটার) হেক্টর-প্রতি মোট কর্ষিত এলাকা-পিছু।

X2 = গড় জোতের মাপ।

X3 = বৃষ্টিপাতের পরিমাণ।

X4 = সার কেজি (প্রতি হেক্টর)।

X5 = পারিবারিক শ্রম-ঘণ্টা (প্রতি হেক্টর)

X6 = সেচ: মোট কর্ষিত এলাকায় সেচ এলাকার শতকরা ভাগ।

X7 = কর্ষণের নিবিড়তা।

খ. নিট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিসংখ্যানগত পরিমাপ

Log Y = 8.745 + 0.399logX1 + 0.679logX2 + 0.571logX3 + 0.004logX4

+ 0.002logX5

T = (4.12) (2.10) (6.20) (3.14) (0.81) (0.05)

+ 0.171X6 – 0.172X7 + 1.492X8

T = (0.62) (-1.82) (2.24)

R2 = 0.91 adj R2 = 0.86

Y = কৃষি থেকে বিভিন্ন রাজ্যের নিট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন।

X1 = গড় জোতের মাপ।

X2 = গ্রামীণ রাস্তা।

X3 = সারের ব্যবহার প্রতি হেক্টর জমিতে।

X4 = চাষের নিবিড়তা।

X5 = বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রতি হেক্টর জমিতে।

X6 = সেচের শতকরা।

X7 = কৃষি-শ্রমিক প্রতি হেক্টরে।

X8 = শস্যবৈচিত্র

তথ্যসূত্র

১. Marx, K. 1971. Capital. vol. 3. Moscow: Progress Publishers.

২. Marx, K. and F. Engels. 1971. “The Class Struggles in France 1848 to 1850.” Selected Works. vol. 1. Moscow: Progress Publisher.

৩. Kautsky, K. 1987. The Agararin question. vol. 1. Pluto Press, 1987 from রতন খাসনবিশ. 1986. আধা সামন্ততন্ত্র ও ভারতের কৃষি অর্থনীতি. পিবিএস (মার্চ ১৯৮৬)।

৪. Lenin, V. I. 1977. “New Data on the Laws Governing the Development of Capitalism In Agriculture.” Collected Works. vol 22, Moscow: Progress Publishers.

৫. Sen, A. K. 1964. “Size of Holding and Productivity.” Economic Weekly.

৬. Mazumdar, D. 1965. “Size of Farm and Productivity: A Problem of Indian Peasant Agriculture.” Economica.

৭. Rudra, A. 1968. “Farm Size and Yield Per Acre.” Economic and Political weekly. Special Issue, July, 1968.

৮. Saini, G. R. 1971. “Holding Size, Productivity and Some Related Aspects of Indian Agriculture.” Economic and Political Weekly. vol. 6. 26th June 1971.

৯. Bharadwaj, K. (1974). “Notes on Farm Size and Productivity.” EPW. (30th March) and Rao, A. P. 1967. “Size of Holding and Productivity.” EPW. vol 2, (11th November).

১৹. Rao, A. P. 1967. “Size of Holding and Productivity.” Economic and Political Weekly.

১১. Roy, D. 2012. Some Aspects of Indian Agriculture under New Agricultural Policy Regime: A Case Study of some District of West Bengal.

১২. অপরাজিতা মুখার্জি, রতন খাসনবিশ, প্রবীর সিংহরায়. ২০০৭. “অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি, অশোক রুদ্র স্মরণে.” পিপলস বুক সোসাইটি।

১৩. Mukherjee, A. 2015. “Evaluation of the Policy of Crop Diversification as a Strategy for Reducton of Rural Poverty in India.” in Almas Heshmati, Esfandiar Maasoumi, Guanghua Wan (ed.) Poverty Reduction Policies and Practices in Developing Asia. Springer.

১৪. তদেব

১৫. Mishra, S. 2006. “Farmers’ Suicides in Maharashtra.”, Economic and Political Weekly. (22nd April, 2006).

১৬. Mukherjee, A. 2015. “Evaluation of the Policy of Crop Diversification as a Strategy for Reducton of Rural Poverty in India.” in Almas Heshmati, Esfandiar Maasoumi, Guanghua Wan (ed.) Poverty Reduction Policies and Practices in Developing Asia. Springer.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *