আজ যারা এ কাহিনী পড়বেন তারা কিছুতেই সেকালের পরিস্থিতি অনুভব করতে পারবেন না। পৃথিবীতে দেশের পর দেশ বিদেশি শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছে। কাছাকাছি ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়েছে। শুধু পাকিস্তান আর মায়ানমারের লোক কোনোদিন শাস্তি দেখেনি। তবে পাকিস্তানের পরিস্থিতি আরো দুঃখজনক। এখানে জাতপাতের প্রশ্ন প্রধান হয়ে উঠেছিল। একটি দেশের মানুষ স্বাধীন হয়েছিল পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে যাবার শর্তে।১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮। এ পরিস্থিতি আমরা মেনে নিয়েছিলাম। তাই ১৯৪৮ সালের জেলের চেয়ে ১৯৫৮-৫৯ সালের জেল ছিল সেদিন থেকে অনেক নির্ভয় কিন্তু অনিশ্চিত। কারো ধারণা নেই রাজনীতির কী হবে। ১৯৫৪ সালে বিরোধী দল জিতেছিল স্বতঃস্ফূর্ততায় এবং আবেগে। রাজনৈতিক দিক থেকে দেশ তেমন এগোয়নি। শ্রমিক বা কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেনি। এক সময় শুধু বামপন্থী দলগুলো নিষিদ্ধ ছিল। এবার সকল দল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংসদ সংবিধান সবই বাতিল করা হয়েছে। তাহলে কী হবে?
জেলখানায় কেউ কোনো কিছু নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না। শুধু সকলের ধারণা ছিল এবারো জেলে থাকতে হবে দীর্ঘদিন। এবারো একমাত্র ভরসা ছাত্র আন্দোলন।
তবে আন্দোলন থাক বা না থাক গ্রেফতারের বিরাম ছিল না। ইতোমধ্যে জেলে এলেন ফরিদপুরের শ্যামেন ভট্টাচার্য, চুনী মুখার্জি এবং ফরিদপুরের ডিঙ্গামানিকের পণ্ডিত মশাই বিভূতিভূষণ ভট্টাচার্য।
পণ্ডিত মশাইয়ের পরিবার বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ। পিতা মহামহোপাধ্যায়ের ছিল ধর্ম সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান। কিন্তু তিনি কমিউনিস্ট। পণ্ডিত মশাইয়ের মেজাজ তিরিক্ষি। একবার জেলখানার অফিসে একজন গোয়েন্দা অফিসার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, পণ্ডিত মশাই কেমন আছেন? পণ্ডিত মশাই জবাব দিয়েছিলেন–এক চোপারের সকল দাঁত ভাঙবো। ব্যাডা জেলে রাখছো আর জিয়াও কেমন আছি, জেলে কেউ ভালো থাকে? এরপর আর তাদের কথা জমেনি এবং পণ্ডিত মশাইয়ের কাছে কোনোদিন গোয়েন্দা এসেছে বলে শুনিনি।
জেলখানায় দিন ভালোই চলছে। মাঝে মাঝে মুক্তি পাবার সম্ভাবনার কথা শুনি। তারপর আর কোনো কথা শুনতে পাই না। আমার মনে হতো পরীক্ষার আগে জেলে থাকাই ভালো। বাইরে গেলে ঝামেলা। শুধু জেলখানায় অসুবিধা বই নিয়ে। অগতির গতি শহীদুল্লাহ কায়সার। তিনি জেলখানায় জনপ্রিয় ব্যক্তি। দীর্ঘদিন জেলে থাকায় পরিচিত। তিনি ঘুরছেন। সকলের সঙ্গে কথা বলছেন। আবার রুমে ঢুকে লিখছেন। তাঁর সংশপ্তক এবং সারেং বৌ ওই সময় জেলে বসে লেখা। মাঝে মাঝে তিনি মামলার জন্যে বাইরে যান। একের পর এক তারিখ পড়ে। ফিরে আসেন।
আমার সঙ্গে জেল সুপারিন্টেনডেন্টের সম্পর্ক ভালো হলেও অন্যান্য জেল কর্মকর্তারা আমার ওপর খুশি নন। আমি সুপারিন্টেনডেন্টের সঙ্গে মুখেমুখে তর্ক করি। জেলখানার সব এলাকার খবর রাখি। জেল সিপাইকে পড়াই বলে সকলে কৃতজ্ঞ। ফলে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বেজার।
হঠাৎ একদিন ডেপুটি জেলার কাজী আলতাফ হোসেনের নেতৃত্বে একদল সেপাই আমাদের ওয়ার্ডে এল। আমার পাশে এক বন্ধুর কাছে এক টুকরো সাদা কাগজ পাওয়া গেল। জেলখানায় অনুমোদিত কাগজ ছাড়া কোনো সাদা কাগজ রাখার নিয়ম নেই। আলতাফ সাহেব তর্ক জুড়ে দিলেন। আমি বললাম, এতে তর্ক করার কী আছে। সাদা কাগজ পেয়েছেন নিয়ে যাবেন। এ নিয়ে হইচই করছেন কেন? মনে হলো আলতাফ সাহেব আমার কথায় অখুশি হয়েছেন; উনি কোনো কথা না বলে পটপট করে পুলিশ বাহিনী নিয়ে চলে গেলেন।
আমি এ নিয়ে তেমন কিছু ভাবিনি। বিকেল বেলা মোগাসন করছিলাম। সেদিন শনিবার। জেল অফিস থেকে নজির জমাদার এল। তার হাতে একটি চিরকুট। চিরকুটে লেখা আছে আমাকে জেল অফিসে যেতে হবে। নজির জমাদার বলল–আপনাকে অন্য জেলে যেতে হবে। আপনাকে এ জেলে রাখা যাবে না। সবকিছু গুছিয়ে নিন। তবে কোন জেলে আপনাকে পাঠানো হবে তা আমি জানি না।
আমি খানিকটা চমকে গেলাম। কারণ এটা জানুয়ারি মাস। এপ্রিল মাসে আমার পরীক্ষা। পরীক্ষার অনুমতি এখনো পাইনি। সব বই আমার নেই। অথচ আমাকে অন্য জেলে যেতে হবে। আমার বলার বা করারও কিছু ছিল না। সকল বন্ধুর সঙ্গেই কথা বললাম। তাদের বললাম, আমার সিট যেন ঠিক থাকে। আজকে ১২ জানুয়ারি শনিবার। আগামী ১৯ জানুয়ারি শনিবার এই জেলে ফিরে আসব। জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে চিনে না।
জেলগেটে ডেপুটি জেলার কাজী আলতাফের সঙ্গে দেখা হলো। দেখা হলো জেলারের সঙ্গে। আমি বললাম, জেলার সাহেব, একটা ভুল করলেন। আগামী শনিবার আমি আবার ফিরে আসছি। তারা দু’জনেই হাসলেন। আমার বিশ্বাস ছিল সুপারিন্টেনডেন্ট নিয়ামত উল্লাকে না জানিয়ে এ নির্দেশ স্বাক্ষর করানো হয়েছে। তিনি ঘটনা জানলে এ নির্দেশ স্বাক্ষর হতো না। আর ওরা জানত না ঢাকা জেল থেকে পরীক্ষার্থী ছাত্র বন্দিকে অন্য জেলে পাঠাবার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আছে। পরীক্ষার্থী বন্দিরা ঢাকাতেই থাকবে।
কিছুক্ষণ পরে দেখলাম আর তিনজন বন্দি জেলেগেটে এসেছেন। তাদেরও আমার সঙ্গে রাজশাহী জেলে পাঠানো হবে। সঙ্গ পাওয়ায় আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। সন্ধ্যার পরে জেলগেট থেকে ঘোড়ার গাড়িতে আমরা ফুলবাড়ি স্টেশনে এলাম। ট্রেন রাত সাড়ে দশটায়–উত্তরবঙ্গ মেইল। আমাদের স্টেশনে এসে বসে থাকতে হবে।
কিন্তু আমাকে নিয়ে বিপদ দেখা দিল জেলগেটে। আমাদের এক জেল থেকে অন্য জেলে নেয়া হবে। আমাদের কোমড়ে দড়ি বাঁধতে হবে। হাতে হাতকড়া লাগাতে হবে। এ ব্যাপারে সবাই বিদ্রোহ করে। আমার কিন্তু কোমড়ে দড়ি বাঁধতে এবং হাতে হাতকড়া লাগাতে মজা লাগে। কোমড়ে দড়ি আর হাতে হাতকড়া থাকলে লোকের চোখে পড়ে। মানুষ জানতে চায় আমরা কারা? কোথায় যাচ্ছি? কেন আমাদের গ্রেফতার করা হয়েছে? দেশে তখন সামরিক শাসন। অনেকেই জানেন যে, আমাদের মতো হাজার হাজার ছাত্র এবং যুবক পাকিস্তানের জেলখানায় তখন বন্দি। তবে আমার যুক্তি যাই হোক না কেন, ওই তিন রাজবন্দি কিছুতেই রাজি হলেন না কোমড়ে দড়ি দিতে। ঠিক হলো আমাদের হাতে হাতকড়া দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু কোনো হাতকড়াই আমার হাতে লাগছে না। সব হাতকড়াই বড়। আমার হাতে হাতকড়া লাগাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি হাত বের করে আনছি। এবার ঠিক হলো প্রতীক হিসেবে আমার হাতে একটা হাতকড়া থাকবে। তবে কখনোই আমি হাত বের করব না।
রাত সাড়ে দশটায় ঢাকার ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ল। আমাদের সঙ্গেই রাজবন্দি শ্যামেন ভট্টাচার্য। রাশভারী চেহারা। লেখাপড়া করেছেন বিস্তর। তাঁকে তর্কে হারানো মুশকিল। রাতভর তাঁর সঙ্গে তর্ক হলো অন্যান্য যাত্রীর। বিষয় পরিবার পরিকল্পনা। শ্যামেন বাবু সবাইকে বুঝিয়ে ছাড়লেন যে, এ সমাজের মৌলিক পরিবর্তন না করে পরিবার পরিকল্পনা করতে গেলে সমাজে বিকৃতি ঘটবেই।
আমি ভাবছিলাম ভিন্ন কথা। আমাকে সাত দিনের মধ্যেই ঢাকা ফিরতে হবে। আমি আমার সাথে গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম। ট্রেন ছাড়বার আগে স্টেশনে বসে গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তার কাছে চিঠি লিখলাম। লিখলাম, পরীক্ষার জন্যে আমার ঢাকা ফিরে আসা দরকার। তিনি ছিলেন ডিএসটি। যতদূর মনে আছে নাম আবদুল মজিদ। তাঁর এক ছেলে কামাল ছাত্রলীগের সদস্য ছিল। পরবর্তীকালে চাকরি নিয়েছিল বিমানে। এই মজিদ সাহেবকে আমি কোনোদিন চোখে দেখিনি। অথচ তিনি আমাকে সাহায্য করেছেন বারবার। ওই চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছেছিল কিনা তাও জানি না। তবে এ কথা সত্য, ৭ দিনের মধ্যে আমি ঢাকা জেলে ফিরেছিলাম।
রাজশাহী জেলে পৌঁছতে পৌঁছতে পরের দিন অর্থাৎ রোববার বিকেল হয়ে গেল। আমি জেলগেটে ঢুকেই বললাম আমি সুপারিন্টেনডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে চাই। তিনি আমাকে চিনতেন। তিনি দীর্ঘদিন বরিশাল জেলের সুপারিন্টেনডেন্ট ছিলেন। আমি তখন বিএম কলেজের ছাত্র। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে খুন মামলার আসামী। তাঁর ছেলে ভানু। পরবর্তীকালে প্রখ্যাত প্রকৌশলী নূরুল উল্লা। যিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে জগন্নাথ হলের হত্যাকাণ্ডের ছবি তুলেছিলেন। ভানুর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। যদিও ভানু তখন মুসলিম লীগ করত। আমার কথা শুনে ভানুর বাবা জেলগেটে এলেন। আমি তাকে আমার পরীক্ষা ও জেল বদলির কথা বললাম। বললাম, আমাকে তিনখানা দরখাস্তের কাগজ দিতে হবে। আমি আইজিপি, ঢাকা জেলের সুপার এবং ডিআইজি, আইবির কাছে দরখাস্ত করতে চাই। আমাকে আপনার জন্যে ঢাকায় রেডিওগ্রাম করতে হবে। আমি তিনখানা দরখাস্তের কাগজ নিয়ে জেলে ঢুকে গেলাম। তখন সন্ধ্যা নেমেছে। রাজশাহী জেলে তখন অনেক রাজবন্দি। সকল জেলখানা তালাবদ্ধ হলেও রাজবন্দি হিসেবে তাদের কিছুটা বাড়তি সুবিধা আছে। তারা তখন তালাবদ্ধ হননি। আমরা তখন ওয়ার্ডে পৌঁছে গেলাম।
পরদিন জেল সুপার এলেন ওয়ার্ডে। বললেন, ঢাকার সঙ্গে কথা হয়েছে। আপনাকে পাঠাতে হবে। ঢাকা জেলের সুপার নিয়ামত উল্লাহ জানত না যে, আপনাকে বদলি করা হয়েছে। নির্দেশ এসেছে আপনাকে ফেরত পাঠাবার। তবে আমাদের এখন পুলিশ নেই। কদিন পরে আপনাকে পাঠালে কেমন হয়? আমি বললাম না। আমাকে শনিবার ১৯ জানুয়ারি পৌঁছাতে হবে। রাজশাহী জেলের সুপার বললেন, ঠিক আছে, জরুরি ভিত্তিতে আপনাকে পাঠাব।
মাত্র রাজশাহী জেলে এসেছি। তেমন চিনি না। সঙ্গে শ্যামেন ট্টাচার্য, চুনী মুখার্জি এবং পণ্ডিত মশাই। পথে তেমন আলাপ হয়নি। রাজশাহী জেলে এসেও তেমন আলাপ করার সুযোগ হয়নি। আমি যাবার জন্যে ব্যস্ত। শুধু চেনাদের মধ্যে বগুড়ার দুর্গাদাস মুখার্জীর কথা মনে আছে, যিনি দীর্ঘদিন ঢাকা জেলে ছিলেন আমার সঙ্গে। আরো চেনা ছিল ছাত্র আন্দোলনের জন্যে। রাজশাহী জেলের স্মৃতি ঝাপসা থেকে গেল। আমার সেখানে থাকা হলো না। ইচ্ছে ছিল খাপড়া ওয়ার্ড দেখব। ঐ ওয়ার্ডে ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজবন্দিদের ওপর গুলি হয়েছিল। আমি তখন ঢাকা জেলে। এ দিনটি আমার কাছে মনে আছে। মনে আছে খুলনার আনোয়ারের কথা। খুলনার আনোয়ার। ১৯৪৯ সালে ঢাকা জেলে এসেছিল। মাত্র কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ছোটখাটো ছেলেটি। কম বয়সের দিক থেকে আমরা তখন ঢাকা জেলে তিনজন বন্দি ছিলাম। তিনজন হচ্ছি আমি, এক সময়ের মফস্বল সাংবাদিকদের নেতা শফিউদ্দিন আহমেদ ও খুলনার আনোয়ার। বয়স কম বলে জেলখানায় তিনজন খাওয়ার দিক থেকে সুবিধা পেতাম। পাশাপাশি সেলে থেকে অনশন ধর্মঘট করেছি দিনের পর দিন।
আনোয়ারকে ১৯৪৯ সালেই মুক্তি দেয়া হয়েছিল। তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল এলাকায়। পরে একদিন খবর পেয়েছিলাম আনোয়ার আবার গ্রেফতার হয়েছে। এবার তাকে রাজশাহী জেলে পাঠানো হয়েছে। সেই রাজশাহী জেলে গুলি হয়েছিল ১৯৫০ সালের এপ্রিলে। প্রথমে জানতে পারি নি এ গুলির কথা। যেদিন ঢাকা জেলে এ খবর পৌঁছাল তখন আমাদের প্রতিবাদ করার শক্তি পর্যন্ত নেই। দিনের পর দিন অনশন ধর্মঘট পালন করে সকলের স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত আর তখন কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক লাইনের পরিবর্তন হয়েছে। জেলখানা থেকে এখন আর সংগ্রাম নয়। আপোষ আলোচনার মাধ্যমে এ দাবি দাওয়ার নীতি গৃহীত হয়েছে। অথচ আজ সে হিসেবে ধরলে ঐ লাইনের জন্যে কত কমরেড জীবন দিয়েছে। কত কমরেড জীবন র ভুগেছে। এখন মনে হয় যদি ঐ অনশন ধর্মট না হতো তাহলে অনেক ভালো থাকতাম।
সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন কথাও মনে হয়। মনে হয় কেউ আমাদের কথা জানল না। কেউ আমাদের মনে রাখল না। পাকিস্তানের প্রথম দিকের অন্ধকার দিনগুলোতে এই যে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ অমানুষিক জীবন যাপন করেছিল- যাদের সঙ্গে আচরণে পাকিস্তান সরকার ব্রিটিশ সরকারকেও হার মানিয়েছিল যাদের পাকিস্তান সরকার দিনের পর দিন নাস্তিক, পাকিস্তানের শত্রু বলে গালি দিয়েছে, ভিটে-মাটি উচ্ছেদ করেছে–যাদের দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করেছে তাদের অধিকাংশই ছিল ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের পরীক্ষিত সৈনিক। ব্রিটিশকে তাড়ানোর জন্যে তারা ঘর ছেড়েছিল। তাদের জন্যে ব্রিটিশ ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। আর ব্রিটিশ চলে যাবার পর পাকিস্তানে তাদের পুরস্কার মিলেছিল জেল আর জুলুম। পাকিস্তানে ক্ষমতায় এসেছিল ব্রিটিশ আমলের খয়ের খাঁ–খান সাহেব আর খান বাহাদুরের দল। আজ যারা সঠিক ইতিহাস লিখতে চান তাদের স্মরণে রাখতে হবে ১৯৭১ সাল একদিনে আসেনি। শুধুমাত্র কোনো দল বা ব্যক্তির জন্যে দেশ স্বাধীন হয়নি। সেদিন যারা প্রাণ দিয়েছিল তাদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন একজন। জানি না খুলনার মানুষ আজ এ নামটি স্মরণ করে কি না। আদৌ জানে কি না এ নামের পরিচয়। আমি মাত্র ৬ দিন রাজশাহী জেলে ছিলাম। আমার খাপড়া ওয়ার্ড দেখা হয়নি।
১৮ জানুয়ারি শুক্রবার রাজশাহী জেল থেকে রওনা হলাম। এবার একা। শ্যামল বাবু, চুনী বাবু, পণ্ডিত মশাই রাজশাহী জেলে থেকে গেলেন। পরবর্তীকালে এদের কারো সঙ্গে আর দেখা হয়নি। তিনজনেই এখন লোকান্তরে।
রাজশাহী থেকে ঢাকার ট্রেন বিকেলে। তাই বিকেলের দিকে আমাকে নিয়ে পুলিশবাহিনী জেলখানা থেকে বের হলো। স্টেশনে পৌঁছাতে ভিড় জমে গেল। আমার হাতে হাতকড়া, সঙ্গে পুলিশ। সকলেই উৎসুক। হিমশিম খেয়ে গেল পুলিশ। ট্রেনে প্রথম কথা বলল মিহির গোস্বামী। সঙ্গে তার বোন বেলা গোস্বামী। নামটা আমারও মনে ছিল। ইত্তেফাঁকের কঁচিকাঁচার মেলার সদস্য। গান গায়। এদের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। রাজশাহী এসেছে ঢাকা যাবে বলে। জেলখানা থেকে বের হয়ে এতদিনে তাদের আর খোঁজ করা হয়নি। শুধু শুনেছি বিরাট ঝড় বয়ে গেছে ঐ পরিবারের ওপর দিয়ে। মিহির চলে গেছে। ভারতে।
আমাকে কেন্দ্র করে ভিড় বাড়তে থাকায় বিপাকে পড়ল পুলিশ। সিরাজগঞ্জে এসে ফেরিতে আমার কাছে কাউকে এগুতে দিল না। আমি নির্বাক বসে থাকলাম। কিন্তু বিপদ দেখা দিলো জগন্নাথগঞ্জ এসে। আমার জন্যে রিজার্ভ কোনো আসন নেই। সব বগিতে অসংখ্য যাত্রী। শেষ পর্যন্ত পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী মিলে আমাকে মহিলাদের কক্ষে ওঠাল। মহিলারা প্রতিবাদ করে উঠল। দেখা গেলো ইতোমধ্যে অনেক পুরুষ যাত্রী ঐ কক্ষে উঠে গেছে। কিছুক্ষণ পর এক প্রবীণ ভভদ্রলোক কক্ষে উঠলেন তাঁর কন্যাকে নিয়ে। মনে হলো কন্যাটির ঢাকায় চাকরি হয়েছে। তাকে তিনি পৌঁছে দিতে চলেছেন ঢাকায়। এরপর উঠলেন এক পদস্থ কর্মচারি। তিনি আমাকে এবং পুলিশ দেখে বুঝতে পারলেন আমার পরিচয় কী এবং তড়িঘড়ি করে কারো সঙ্গে কথা না বলে বাঙ্কারে উঠে শুয়ে পড়লেন।
ট্রেন চলতে শুরু করতেই প্রবীণ ভভদ্রলোক কথা বলতে শুরু করলেন। মনে হলো তিনি কোনো কলেজের অধ্যক্ষ। এককালে বাড়ি ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। তিনি তীব্র ভাষায় সরকারকে গালি দিচ্ছিলেন ট্রেনের দুর্গতির জন্যে। সরকারের সমালোচনা করছিলেন, বলছিলেন গণতন্ত্রের কথা। বাকস্বাধীনতার কথা। বলছিলেন যে দেশে বাকস্বাধীনতা নেই সে দেশের মানুষ বর্বর।
কক্ষের সকলেই অবাক বিস্ময়ে তাঁর কথা শুনছিলেন। তিনি সামরিক আইনের তীব্র সমালোচনা করছিলেন। কখনো ইংরেজিতে আবার কখনো বাংলায়। আমার সঙ্গের পুলিশ এবং গোয়েন্দা বাহিনীর ভভদ্রলোকদের বিব্রতকর অবস্থা। আমি আদৌ তার দিকে তাকাচ্ছিলাম না। আমার সাথে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের লোকায়ত দলিল। আমি মনোযোগ দিয়ে পড়বার চেষ্টা করছি। হঠাৎ সে প্রবীণ ভভদ্রলোক জোরালো কণ্ঠে ইংরেজিতে বলতে থাকলেন সামরিক সরকার ভেবেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো এদেশে কেউ নেই। এদেশের মানুষ আজও জানে না শয়ে শয়ে তরুণ সামরিক আইনের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে রাজশাহী, ঢাকা, কুমিল্লা জেলে আছে। ওরা বেঁচে থাকবে এবং জিতবে।
এ সময় বাঙ্কার থেকে হঠাৎ সেই পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা নিচে নামলেন। বললেন, আপনি কি লক্ষ করেছেন আপনার সামনে এমন এক তরুণ বসে আছে হাতকড়া নিয়ে। এবার প্রবীণ ভভদ্রলোক আমার দিকে তাকালেন। বললেন, কী বই পড়ছে। এবার আমার হাত থেকে বইখানা নিয়ে বললেন, এ বই না পড়লে রাজনীতি শিখবে কী করে? কী করে কষ্ট করতে শিখবে।
তারপর সকলে চুপচাপ। তিনি সারারাত লোকায়ত দর্শন পড়লেন। একটি কথাও বললেন না। পরদিন ঢাকা স্টেশনে পৌঁছলে আমাকে বইটি ফেরত দিয়ে বললেন, ভয় নেই। এদেশের মানুষ তোমাদের সঙ্গে। আমার ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত। এ মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় এসেছি। আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এ কোন স্বাধীনতা পেলাম?
আমি নির্বাক। কৈশোরে বাড়ি ছেড়েছি। দীর্ঘদিন জেল খেটেছি। পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। খুনের আসামী হয়েছি। কতদিন নিয়মিত খাবার জোটেনি। কিন্তু এমন কথা আমাকে কেউ বলেনি। ১৯৬১ সালের সেই কঠিন সামরিক শাসনের মুখে এদিন আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া। এ প্রবীণ মানুষটির সঙ্গে আমার আর কোনোদিন সাক্ষাৎ হয়নি। কখনো আমি তাকে খোঁজ করিনি। কত লোক চিনেছি, দেখেছি। কত ভালোবাসা পেয়েছি। কারো ধোঁজ কোনোদিন পিছু ফিরে করিনি। মনে হয় সর্বত্র হেঁটে যাচ্ছি পায়ে জল মেখে। যেন আমার সঙ্গে আমার পায়ের পাপও মিলিয়ে যায়।
তবে সেদিন ঐ প্রবীণ ভভদ্রলোক আমার একটা উপকার করেছিলেন। তাঁর আচরণে আমার সঙ্গের পুলিশ এবং গোয়েন্দা বাহিনী অভিভূত। তারা ভাবল ভবিষ্যতে আমি বড় কোনো কিছু হয়ে যেতে পারি। ঢাকা স্টেশনে পৌঁছে তাদের আচরণ পাল্টে গেল। বলল, স্যার মাফ করে দিন। বুঝতে পারিনি। আপনি ইচ্ছে হলে ঢাকা শহরে জেলে যাবার আগে যে কোনো বাসায় যেতে পারেন। আপনার কোনো আত্মীয়ের বাসায় যেতে পারেন। আমরা জানি আপনি পালাবেন না। আপনাকে আমরা সন্ধ্যার আগে জেলে পৌঁছে দেব। কোনো অসুবিধা হবে না।
এ ঢাকা শহরে তখন আমার আত্মীয় বলতে কেউ নেই, আছে পরিচিত ব্যক্তি। তাদের বাসায় পুলিশ নিয়ে গেলে তারা বিব্রত হবেন। হয়তো এ সুযোগে গোয়েন্দারা জেনে যাবে আমার আত্মীয়ের ঠিকানা। আমি গোয়েন্দাদের বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বললাম, চলুন জেলখানায়।
জেলগেটে ঢুকতেই জেলার সাহেবের সাথে দেখা। তিনি যেন ভূত দেখছেন। বললাম, জেলার সাহেব, আজ ১৯ জানুয়ারি শনিবার। আমার কথা রেখেছি। সাতদিন পরেই ঢাকা জেলে ফিরেছি। জেলার সাহেব বললেন, আপনার জন্যে আমার চাকরির খাতায় প্রথম কালো দাগ পড়ল। নিরাপত্তা রক্ষীদের ওয়ার্ডের জমাদার নজির আহমদ বললেন, চলুন আপনাকে ওয়ার্ডে দিয়ে আসি।
দেশের রাজনীতিতে তখন এক ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সারাদেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচন হয়েছে। ১৯৬০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান আস্থা ভোট গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ পাকিস্তানে চালু হয়েছে সেই অভিনব ‘হ্যাঁ’ বা ‘না ভোটের প্রক্রিয়া। এ অভিনব পদ্ধতিতে সমর্থন আদায়ের প্রক্রিয়া ভালোভাবে ব্যবহার করেছেন জিয়াউর রহমান। তিনি সংবিধান সংশোধন করেছেন, এই হ্যাঁ/না ভোট অনুষ্ঠান করে। এই ভোটে কোনোদিন কেউ অংশগ্রহণ করে না। আর সরকার পক্ষও কোনোদিন পরাজিত হয় না। লক্ষ কোটি ভোটে জয়লাভ করেন ক্ষমতাসীনরা।
শুধু তাই নয়, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালান। রাজনীতিকদের কোণঠাসা করার জন্যে পাবলিক অফিস ডিসকোয়ালিশন অর্ডিন্যান্স জারি করলেন। এ অর্ডিন্যান্স বলে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে ১৯৬৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কেউ কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না। জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান, আবু হোসেন সরকারসহ অসংখ্য রাজনীতিকের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা দায়ের করা হয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবু হোসেন সরকার অপরাধ অস্বীকার করলেও তাদের ১৯৬৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে দাঁড়াবার অধিকার বাতিল করা হয়। মরহুম আতাউর রহমান মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে ১৯৬৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে না দাঁড়াবার মুচলেকা দিয়ে রেহাই পান।
সারাদেশে অত্যাচারের স্টিম রোলার চালানো হয়। সীমান্ত প্রদেশে তিন হাজার নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। রাজবন্দিদের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। কোয়েটায় বন্দি শিবিরে ৪শ বেলুচিকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় পায়ে দড়ি বেঁধে টান দিয়ে রাখা হয়। সিন্ধু প্রদেশের হায়দারাবাদে ৭ জন ফাঁসি দেয়া হয়। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ন্যাপের দফতর সম্পাদক হাসান নাসির ১৯৬০ সালে ১৩ নভেম্বর নির্যাতনের ফলে লাহোর জেলে মৃত্যুবরণ করেন। এ পরিস্থিতিতে আমাকে ঢাকা জেল থেকে রাজশাহী জেলে পাঠানো হয়েছিল। আমি ঢাকা জেলে ফিরে এলাম। ১৭ এপ্রিল আমার পরীক্ষা। কিন্তু বই কোথায়? কে দেবে?
১৯৬১ সালে জানুয়ারিতে ঢাকা ফিরে এলাম মাত্র ৭ দিন পর। সতেরো এপ্রিল আমার বিএ পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চূড়ান্ত অনুমতি তখনও আসেনি। বাইরে থেকে আমার টাকা জমা দেয়া হয়েছিল। জেলখানা থেকে পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করেছিলাম। কিন্তু পরীক্ষা দিতে পারছি কিনা সে সিদ্ধান্ত আমাকে জানানো হলো না।
এদিকে ইংরেজি, বাংলার কোনো বই নেই বললেই চলে। দর্শনের বই আছে। অর্থনীতির প্রাথমিক জ্ঞান পাবার মতো বইও আছে। পাঠ্য তালিকার দুটি বই আমার পড়া হয়েছিল। বিশ্বাস ছিল রচনা ও ব্যাকরণে ভালো নম্বর পাব। সুতরাং ইংরেজি নিয়ে তেমন ভয় ছিল না। ভয় ছিল না বাংলা নিয়েও। বাংলা গদ্যের একখানা বই ছিল। কবিতা বা অন্য কোনো বই ছিল না। আমার একটা ধারণা ছিল শুদ্ধ বাংলা ও ইংরেজি লিখতে পারলে বিএ পাস করা তেমন কঠিন নয়।
এভাবেই বিএ পরীক্ষায় বসেছিলাম। প্রথম দিনেই আমার কাছে বিস্ময়কর একটি ঘটনা ঘটল। জেলখানার ডেপুটি জেলার ছিলেন আমাদের পরীক্ষার পরিদর্শক। এক সময় তিনি আমাদের কক্ষে ঢুকলেন। জিজ্ঞাসা করলেন কোনো সাহায্য প্রয়োজন আছে কিনা। তাঁর কথায় পরীক্ষার হলে বই দেখেও লেখা যায়। জেলখানায় নাকি এ ধরনের পরীক্ষা হয়। আমার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেল। আমি বললাম, আপনি চলে যেতে পারেন, এ হলে আপনার প্রয়োজন নেই। ভভদ্রলোক ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে গেলেন। আমার বন্ধুরাও সমালোচনা করলেন। তারা বললেন, ওই ভভদ্রলোককে রাগানো ঠিক হয়নি। তিনি আপনার ক্ষতি করতে পারেন। কারণ পরীক্ষার সবকিছুই তার দায়িত্বে। তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো হলো না। কোনো মতে পরীক্ষা পর্ব শেষ হলো। বিশ্বাস ছিল পরীক্ষায় পাস করব। কিন্তু ভালো ফল করতে পারব না। অথচ সবাই আশা করেছিল জেলখানা থেকে পরীক্ষা ভালোই হবে। কিন্তু আমি জানতাম, তা হতে পারে না। আমার এখনও মনে আছে ইংরেজি বই না থাকায় আমি আন্দাজে ইংরেজি কবিতার ব্যাখ্যা লিখেছি। শশ্চন্দ্র সম্পর্কে লিখেছি বাইরে পড়া বইয়ের জ্ঞান দিয়ে। তবুও শেষ পর্যন্ত পাস করে গেলাম। এ পাসের পর সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল আমার জেলখানার ছাত্র এককালের বিহারের অধিবাসী আব্দুর রহিম। পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একদিন জেল অফিসে ডাক এল। আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা। এ ভভদ্রলোককে আমি চিনতাম। এর আগেও আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তিনি বললেন, আপনি শিগগিরই বাইরে খবর দিন। আনোয়ার জাহিদ ও জহিরুল ইসলামকে সাবধান হতে বলুন। তারা কিছুদিন আগে ফজলুল হক হলে সভা করেছে। সে সভার খবর আমরা জানি। ওরা সাবধান না হলে যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতার হয়ে যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন করে আন্দোলন শুরু হতে পারে।
আমি ওয়ার্ডে ফিরে এলাম। ভাবলাম কী করা যায়। কিন্তু আমাকে ভাববার অবসর দেয়া হলো না। ইতোমধ্যে আনোয়ার জাহিদ ও জহিরুল ইসলাম গ্রেফতার হয়ে আমার ওয়ার্ডেই এল। সেদিন আমার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই আনোয়ার জাহিদ জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কামরুন্নাহার লাইলীকে চেনেন কিনা। আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। লাইলী ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী। প্রায় সর্বজন-পরিচিত। মিছিলের আগে থাকে। আমি ছাত্রলীগ করলেও আমার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। এই একটি মেয়েকেই আমার রাজনীতির মেয়ে বলে মনে হতো। জাহিদের প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম, লাইলীকে আমি ভালোভাবে চিনি এবং মনে করি ঐ একটি মাত্র মেয়েই আমার দেশের রাজনীতি করছে। আমি তখনও জানতাম না লাইলীর সঙ্গে আনোয়ার জাহিদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এবং শেষ পর্যন্ত ঢাকা জেলের গেটেই লাইলী ও জাহিদের বিয়ে হয়েছিল। সে বিয়েতে কেউ বাসর ঘরে যায়নি। লাইলী ফিরে গিয়েছিল তার গোপীবাগের বাসায়। আর জাহিদ ফিরে গিয়েছিল আমাদের ওয়ার্ডে।
জাহিদ ও জহির জেলখানায় আসায় আমার খুব সুবিধা হলো। এছাড়া জেলখানায় ছিল তখন আলী আকসাদ, বগুড়ার ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছদর উদ্দীন আহম্মদ। অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন মহিউদ্দীন আহম্মদ, ময়মনসিংহের বতুরায় চৌধুরী, বরিশালের হিরণ ভট্টাচার্যসহ আরো অনেকে।
ইতোমধ্যে আবদুস সামাদ সাহেব জেলখানায় এলেন (যিনি পরবর্তী সময়ে আবদুস সামাদ আজাদ নামে পরিচিত হন)। তিনি আসার পর জেলখানার রাজনীতির আবহাওয়া পাল্টে গেল। প্রশ্ন দেখা দিল জেলখানার নেতৃত্ব নিয়ে। জেলখানায় আমাদের প্রতিনিধি হবেন জনাব মহিউদ্দীন আহম্মদ। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত দেবার জন্যে ছিল একটি ছোট কমিটি। এ কমিটিতে চার পাঁচ জন সদস্য থাকত। সামাদ সাহেব আসায় প্রশ্ন দেখা দিল মহিউদ্দীন সাহেব না সামাদ সাহেব প্রতিনিধিত্ব করবেন।
ঘটনাটি আমার কাছে চমকপ্রদ মনে হলো। জেলখানায় আমি এ ধরনের রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত নই। কে নেতা থাকল না থাকল সে প্রশ্ন আমার কাছে মুখ্য নয়। জেলখানায় মোটামুটি ভালো থাকবার জন্যে আমাদের একজন প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হয়, এর বেশি নয়।
তবুও দেখলাম সবকিছু পাল্টে যাচ্ছে। জেলখানায় প্রশ্ন উঠলো, কোন ভিত্তিতে কমিটি গঠন করা হয়েছে, প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়েছে, এ কমিটি বা প্রতিনিধির মেয়াদকাল কত। বলা হলো সবকিছু গঠনতন্ত্র মাফিক করা হয়েছে কিনা।
আমার হাসি পেল। দেশে সামরিক শাসন, সংসদ নেই, সংবিধান নেই। আর জেলখানায় আমরা বিতর্ক করছি গঠনতন্ত্রের। তবে আমরা শেষ রক্ষা করতে পারলাম না। আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হলো, নতুন কমিটি এবং নতুন প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে। অনির্দিষ্টকালের জন্যে কোনো কমিটি বা প্রতিনিধি থাকতে পারবে না।
এবার আমি, জহির, আনোয়ার জাহিদ এবং আলী আকসাদ ভিন্ন। আলোচনা করলাম। আমরা জানতাম আমাদের ওয়ার্ডের রাজবন্দিরা এক সঙ্গে বৈঠক করবে এবং নিশ্চয়ই নতুন কমিটির নাম প্রস্তাব করবে। আজ ঐ কমিটিতে আমাদের কোনো একজনের নাম থাকবেই। তখন আমরা নাম প্রত্যাহার করব। ফলে অচল অবস্থার সৃষ্টি হবে। তখনি আনোয়ার জাহিদ একটি বক্তৃতা দেবে এবং তারপরেই আমি নতুন প্রস্তাব তুলব। ঘটনা তেমনই ঘটল। কমরেড বতুরায় চৌধুরী সভাপতির আসন গ্রহণ করলেন। তিনি অন্ধ। একের পর এক প্রস্তাব এল। সব প্রস্তাবেই আমার কিংবা জাহিদের নাম থাকত। আমরা দাঁড়িয়ে নাম প্রত্যাহার করতাম। ফলে অচল অবস্থার সৃষ্টি হলো। এবার জাহিদ উঠে একটি ছোট বক্তৃতা দিল। আমি উঠে একটি প্রস্তাব দিলাম। আমি বললাম, আমি যে প্রস্তাব করব সে প্রস্তাবের কোনো সংশোধন হবে না। সংযোজন যা বিয়োজন হবে না। আমার প্রস্তাব পুরোপুরি মেনে নিতে হবে। আলী আকসাদ, আনোয়ার জাহিদ, জহিরুল ইসলাম আমার প্রস্তাব সমর্থন করল। ময়মনসিংহের কাজী আব্দুল বারীও আমার প্রস্তাব সমর্থন জানাল। আমার প্রস্তাব ছিল এই বৈঠকে সাতজনকে নিয়ে একটি কমিটি হবে। এই কমিটির বৈঠক বসবে। কমিটিতে নতুন সদস্য নিতে হলে এই কমিটির কাউকে পদত্যাগ করতে হবে। এই কমিটিই প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। আমার প্রস্তাব গৃহীত হলো। ঐ কমিটিতে মহিউদ্দীন আহম্মদ এবং আবদুস সামাদ আজাদ দুজনই ছিলেন। ঐ কমিটি মহিউদ্দিন আহম্মদকেই আবার প্রতিনিধি নির্বাচন করল। আমাদের কাছে এক দুঃসহ প্রহরের অবসান হলো।
যারা জেলে যায়নি তারা এ পরিস্থিতি বুঝতে পারবে না। জেলখানা সীমাবদ্ধ এলাকা। বন্দির সংখ্যাও সীমিত। সেখানে দলাদলি ও কোন্দল থাকলে পরিবেশ বিষাক্ত হয়। স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায় না। এরকম ঘটনা এ উপমহাদেশে বারবার ঘটেছে। জেলখানায় দল ভেঙেছে। দল গড়েছে। এক দল অন্য দলের মুখ দেখাদেখি করেনি। অগ্নিযুগের বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন ভেঙে যুগান্তর হয়েছে। বিপ্লবী দল ভেঙে নতুন গ্রুপ হয়েছে। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স (বি.বি) ঢাকার শ্রীসংঘ। এমনি করে অসংখ্য বিপ্লবী গ্রুপ গড়ে উঠেছিল। তাদের তাত্ত্বিক অনুশীলন হয়েছিল জেলখানায়। জেলখানায় সিদ্ধান্ত নিয়ে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের একটি অংশ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়। অপর একটি অংশ কংগ্রেস, সমাজতন্ত্রী দল সিএসপিতে যোগ দেয়। পরবর্তীতে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল আরএসপি গঠন করে। কেউ গঠন করে আরসিপি (বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি)। জেলখানার কমরেডদের সিদ্ধান্তের ফলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জনযুদ্ধ তত্ত্ব গ্রহণ করে। জেলখানার এ তাত্ত্বিক বিতর্ক সর্বকালে ছিল এবং অনিচ্ছা সত্বেও মেনে নিতে হয়েছে। কিন্তু সে কালের সঙ্গে এ কালের অনেক তফাৎ। আমরা সে দিন তর্ক করছিলাম জেলখানার নেতৃত্ব নিয়ে। তার সঙ্গে দেশের রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না।
সামরিক শাসন জারি হয়েছে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর। আমরা গ্রেফতার হয়েছিলাম ১৯৫৯ সালের ২৪ অক্টোবর। ১৯৬১ সালে ঢাকা জেল থেকে শেষ পর্যন্ত ডিগ্রি পাস করি। এটাই আমার ছিল সবচেয়ে বড় পাওয়া।
প্রথম থেকেই সামরিক শাসনকে মানুষ অভিনন্দন জানিয়েছিল। সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর এক বছর বাইরে ছিলাম। এই এক বছরের সামরিক শাসনের বহুরূপ দেখেছি। সামরিক শাসন জারি হলে অসংখ্য আইন প্রণীত হয়। দেয়াল পরিষ্কার থেকে মাঠ পরিষ্কার রাখা পর্যন্ত সবকিছুকেই আইনের আওতায় নেয়া হয়। ঘোষণা করা হয় দরে বিধান। প্রায় সব অপরাধের জন্যে নিম্নতম দণ্ড ছিল চৌদ্দ বছর। এমনকি ইশারায় ক্ষতিকারক কথা বলা ছিল দণ্ডনীয়। আমরা বলতাম। সব অপরাধেই নিম্নতম দণ্ড হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে ‘ক’ অক্ষরটির বড় বিপদ ছিল। ‘ক’ হচ্ছে কেরানি, কনস্টেবল এবং কুকুর। তখন কেরানিদের মাথাওঁজে কাজ করতে হতো, কনস্টেবলদের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। বেওয়ারিশ কুকুরগুলো মেরে ফেলা হতো। সামরিক শাসকেরা ক্ষমতায় এসে জনপ্রিয় হবার চেষ্টা করত। তারা দুর্নীতি ও মজুদদারের বিরুদ্ধে কড়া কথা বলত। মজুদদারেরা ভয় পেত। তাই মজুদ মাল বাজারে ছেড়ে দিত। প্রথম দিকে সব পণ্যই সস্তা হয়ে যেত। ফলে মানুষ কিছুটা খুশি হতো। দু’একজন দুর্নীতিবাজকে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিত। সামরিক শাসকরা জানত তাদের গণভিত্তি নেই। তাই কিছু চমকপ্রদ কাজ করার চেষ্টা করত। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে রাস্তায় হাঁটা যেত না। সেনাবাহিনীর লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত। তখন থেকেই শুরু হয় সিনেমায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন। সিনেমায় জাতীয় পতাকা দেখাবার সময় কেউ বসে থাকলে তার শাস্তি পেতে হতো। আইয়ুব খান তার অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ জায়েজ করার জন্যে সিনেমায় জাতীয় পতাকা দেখিয়ে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কৌশলই কাজে আসেনি। প্রতিবারই সামরিক আইন জারি হবার পর এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এরশাদের আমলে সামরিক শাসন জারি হবার পর সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলেদের বড় চুল কেটে দিয়েছে। অনাবৃত উদরের মহিলাদের উদরে আলকাতরা মাখিয়ে দিয়েছে।
আইয়ুব খান আমলে প্রথম দু’বছর এ ধরনের অনেক ভচিক্কি করা হয়েছে। কাজে আসেনি। আইয়ুব খান বিখ্যাত হয়েছিলেন কমিটি গঠনের জন্যে। সব ব্যাপারেই তিনি একটি কমিটি গঠন করতেন। এসব কমিটির রিপোর্ট কোনোদিনই বের হতো না। সে ঐতিহ্য এখনো অটুট।
আইয়ুব খানের আমলে উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, ভারতের সিন্ধুনদের পানি চুক্তি। ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
লক্ষণীয়, এই চুক্তির ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু নদের পানি বণ্টনের ব্যবস্থা হয়। অথচ সেকালে গঙ্গার পানি বণ্টনের কোনো ব্যবস্থাই গৃহীত হয়নি।
আইয়ুব খানের আমলে অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে–পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন। পাকিস্তান সম্রাজ্যবাদী যুদ্ধজোটে থাকলেও ১৯৬১ সালের ৩ এপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে তেল অনুসন্ধান চুক্তি স্বাক্ষর করে। তবে এর একটি ভিন্ন পটভূমি ছিল। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হবার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার। তখন বিমানঘাঁটি থেকে বিমান সোভিয়েত ইউনিয়নের আকাশে উড়ে যায়। সোভিয়েত সামরিক বাহিনী বিমানটি ধ্বংস করে। সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চেভ সুস্পষ্ট ভাষায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে জানিয়ে দেন যে, এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দেয়া হবে। অপরদিকে ১৯৬০ সালে নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জন এফ কেনেডি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ডেমোক্রেটিক পার্টি ঐতিহ্যগতভাবে ভারতের সমর্থক। এই পরিপ্রেক্ষিতেই পররাষ্ট্রনীতি ঢেলে সাজাবার চেষ্টা করতে হয়। এই পররাষ্ট্রনীতি ঢেলে সাজাতে গিয়ে তাকে বিশেষ করে সতর্ক হতে হয়।
ইতোমধ্যে পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরোধীদলীয় তৎপরতা শুরু হয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কিছুটা তৎপর হতে থাকেন এবং নতুন করে ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে। এ সময় জেলখানায় একটি ভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হই।
জেলের বাইরে থাকতে শুনেছিলাম ভারত-পাকিস্তান এক করার চেষ্টা হচ্ছে। নাগাল্যান্ডে স্বাধীনতা আন্দোলনে পাকিস্তান নাকি সহায়তা করছে। ঢাকা জেলে এই দুটি ব্যাপারেই আমার ভিন্ন অভিজ্ঞতা হলো। পরস্পর জানতে পারলাম নাগাল্যান্ড বাহিনীর প্রধান সেনাপতি (সিএনসি) ঢাকা জেলের ২০ নম্বর সেলে আছেন। তাকে নাকি জেলখানায় রেখেই আলোচনা করা হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান সম্পর্কে ভারত সরকার প্রতিবাদ জানালে তাঁকে নাকি গ্রেফতার করে জেলে রাখা হয়।
জেলখানায় আমার তিন রাজবন্দির সঙ্গে দেখা হয়। তারা বৃহত্তর ময়মনসিংহের অধিবাসী। এই তিনজন হচ্ছেন আবদুর রহমান সিদ্দিকী, হাবিবুর রহমান এবং আরএম সাঈদ। দেশ স্বাধীন হবার পর আরএম সাঈদের সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল। শুনেছি গফরগাঁওয়ের আরএম সাঈদ রক্ষী বাহিনীর গুলিতে মারা গেছেন।
জেলখানায় আরএম সাঈদ ও হাবিবুর রহমানের সঙ্গে আমি এক ওয়ার্ডে ছিলাম। হাবিবুর রহমানকে আমি পড়াতাম। তাদের কথা কতটুকু সত্য জানি না। তারা বলেছিলেন, ভারত-পাকিস্তান এক করার জন্যে তারা নয়াদিল্লিতে নেহেরুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। নেহেরু তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাত করেননি। তাদের পাঠিয়েছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রীর কাছে। লালবাহাদুর শাস্ত্রী তাদের পাঠিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতা কালাচরণ ঘোষের কাছে? এর বেশি কিছু তাঁদের কাছে জানতে পারিনি। তাঁদের নাকি পাঠিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আবুল মনসুর আহমেদ। আজকে যারা স্বাধীনতার অবিকৃত ইতিহাস লিখতে চান, জানি না তারা এ ঘটনা জানেন কিনা।
আইয়ুব খানের আমলে জেলখানায় অনেক বাহিনী ছিল। জেলখানায় তখন তর্ক বিতর্কের শেষ ছিল না। তবে এ তর্ক-বিতর্কের মধ্যেও একজন হাসিমুখী মানুষ ছিলেন। তিনি নরসিংদীর আবুল হাশিম মিয়া। তিনি আমাদের সঙ্গে একই দিনে গ্রেফতার হয়েছিলেন। জেলখানায় ঢুকতেই তিনি গল্প করলেন–ভাই আমি গণতন্ত্রের কথা বলেছি। আমাকে গ্রেফতার করা একান্তই অন্যায় হয়েছে। হাশিম সাহেবের কাহিনী হচ্ছে, সামরিক শাসন জারি হবার পর কর্নেল ভাট্টি নরসিংদীতে আসেন। তিনি সকল রাজনৈতিক দলকে নিয়ে এক আলোচনা সভা করেন। ঐ আলোচনা সভায় ন্যাপের পক্ষ থেকে বক্তা হিসেবে ছিলেন হাশিম সাহেব। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন–সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের গণতান্ত্রিক অধিকার আছে। পাকিস্তান গণতন্ত্রের দেশ। এক সময় মুসলিম লীগ ক্ষমতায় ছিল। রিপাবলিকান পার্টি ক্ষমতায় ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। এবার সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় এসেছে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা থেকে চলে গেলে অন্য কোনো দল ক্ষমতায় আসবে, এটাই গণতন্ত্রের নিয়ম।
মনে হয় কর্নেল ভাট্টি হাশিম সাহেবের এ গণতন্ত্রের ভাষণ হজম করতে পারেননি। তাই তাঁকে জেলে পাঠিয়েছেন আমাদের গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রাখার জন্যে। কারণ জেলখানায় আলাপ আলোচনায় কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। সে ব্যাপারে জেলখানায় একেবারেই অবাধ স্বাধীনতা।
একটি ব্যাপারে হাশিম সাহেবের কথা এখনও মনে পড়ে। তিনি ঢাকা জেলা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক। ঢাকা জেলা ন্যাপের সম্মেলন হচ্ছে ঢাকা শহরে। সম্মেলন শেষে প্রস্তাব পাঠ শুরু হয়েছে। প্রস্তাব পাঠের প্রথম প্রস্তাব হচ্ছে-বিশ্বশান্তি সম্পর্কে। এই প্রস্তাব উত্থাপিত হলো, হাশিম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ভাইসব, আগেই বিশ্ব শান্তির প্রস্তাব তুললেন। আগে দেশের কথা বলা ভালো নয় কি? এ রাজনীতি দেশের মানুষ গ্রহণ করবে কি?
বিভিন্ন প্রসঙ্গে হাশিম সাহেব এ ধরনের কথা বলতেন। আমরা চুপচাপ শুনতাম। হালকা হতাম। হাসতাম। সে হাশিমকে একদিন হঠাৎ ঢাকা জেল থেকে বদলি করে দেয়া হলো। মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
কিছুদিন পরে গোয়েন্দা বিভাগের এক ভভদ্রলোক এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর প্রশ্ন ছিল এক রাতে ঢাকা হলে ময়মনসিংহের কাজী বারী আপনার কক্ষে এসেছিলেন। আপনি সে রাতে হলে আসেননি কেন? অথচ কাজী বারী আমার কক্ষে গিয়েছিল এ কথা আমি প্রথম শুনলাম।
কে এই কাজী বারী? কেন সে আমার টাকা হলের রুমে গিয়েছিল? কাজী বারী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। প্রকাশ্যে ন্যাপ নেতা। এককালে এক সঙ্গে আমরা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ করেছি। কাজী বারী ছিলেন ছাত্রলীগের ময়মনসিংহ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। আমরা এক সঙ্গে ১৯৫৭ সালে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করি।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হবার পর আমার কাজী বারীর সঙ্গে দেখা হয়নি। তাই জানতাম না কেন কাজী বারী সেদিন আমার কক্ষে এসেছিল। গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা বিশ্বাস করতে চাইলেন না যে কাজী বারী সম্পর্কে আমি কিছু জানি না বা সে দিনের ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছু জানতাম না। অবিশ্বাস নিয়েই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আমার কাছ থেকে বিদায় নিলেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজী বারীর সঙ্গে আমার ঢাকা জেলে দেখা হলো। জেলে তখন বন্দির সংখ্যা বেড়েছে। ঢাকার রিকশা শ্রমিক নেতা সেলিম, ন্যাপের গোলাম মোস্তফা, কমিউনিস্ট পার্টির মৃণাল বাড়ুরী, ন্যাপের সর্দার হালিম, পীর হাবিবুর রহমান, তারা মিয়া, রংপুরের মোহাম্মদ আফজালসহ অনেকে। বাইরের জগতে সামরিক শাসকদের ভয় বাড়ছে। আর একের পর এক গ্রেফতার হচ্ছে। শহীদুল্লাহ কায়সারের সাজা হয়ে গেছে। তিনি চলে গেছেন সাত নম্বর সেলে। আমাদের সরিয়ে আনা হয়েছে দু’নম্বর ওয়ার্ডে। এখানে টেবিল টেনিস এবং ভলিবল খেলার ব্যবস্থা আছে। এই ওয়ার্ডে একদিন কাজী বারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার কক্ষে কেন গিয়েছিলেন? কাজী বারী তার স্বভাবসিদ্ধ ময়মনসিংহের ভাষায় বললেন–কি আর কমু আপনারে পাইলাম না, তাই শুইয়া থাকলাম।
সামরিক শাসন আমলে কাজী বারীর সাজা হয়েছিল দশ ঘা বেত। ঢাকা জেলে কাজী বারীকে বেত্রাঘাত করা হয়। সেদিনের ঘটনা এখনো আমাকে উদ্বেলিত করে। কাজী বারীকে রাজনৈতিক অপবাদে সামরিক শাসক যে এভাবে মারবে আমরা তো কিছুতেই ভাবতে পারি না। ১৯৪৮-৪৯-৫০ সালের জেল হলে জেলখানায় তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যেত।
কাজী বারী বেত খাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বহুমূত্র তাকে আচ্ছন্ন করে। কাজী বারী এমনিতে কানে কম শুনতেন। এবার যেন একবারে বধির হয়ে যান। জেলখানায় থাকতে থাকতে কাজী বারীর সঙ্গে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়। আমি তাকে আশ্বাস দিই, যদি আমি তাঁর আগে জেলখানা হতে মুক্ত হই তাহলে আমার মুক্তির এক মাসের মধ্যে আমি তাকে মুক্ত করবই। সে কথা আমি রক্ষা করেছিলাম। সে কাহিনী পরে বলব। অথচ রাজনীতির দিক থেকে আমরা দুই মেরুতে। কাজী বারী কট্টর স্টালিনপন্থী। আর আমিও কট্টর স্টালিনবিরোধী-লেনিনবাদী। কাজী বারী কমিউনিস্ট পার্টির লোক। আমি বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের লোক। কাজী বারীকে মুক্ত করতে গেলে পুলিশ প্রশাসনও অবাক হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টি বা ন্যাপের কেউ নয়, কাজী বারীকে মুক্ত করবে আরএসপির নির্মল সেন।
এ সময় একদিন গভীর রাতে বড় জমাদার এসে বলল, বাবু আপনাকে সামসুদ্দিন খোঁজ করছে। সামসুদ্দিন ঢাকা হলের বাবুর্চি। আমি ঢাকা হলের ছাত্র ছিলাম। শুনলাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে সামসুদ্দিনসহ ঢাকা হলের অনেক কর্মচারী। গভীর রাতে ওদের জেলে আনা হয়েছে। সারাদিন খাওয়া হয়নি। তাই ওরা আমাকে খুঁজছে। আমি বড় জমাদারকে বললাম, বেআইনি কাজ করতে হবে। গুদামের লোক এনে চিনি ডাল বের করতে হবে। নাইট গার্ডদের দিয়ে রান্না করে ওদের রাতেই খাওয়াতে হবে। কীভাবে বড় জমাদার এ কাজটি করেছিল তা আমি জানি না। শুধু জানতাম জেলখানায় রাজবন্দিদের সেকালে একটি বিশেষ মর্যাদা ছিল। সেকালে যারা বিনা বিচারে বন্দি হতাম আমাদের বিরুদ্ধে আজকের অনেক রাজনীতিকদের মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগ থাকত না। আজকাল অনেক রাজবন্দি টাকা দিয়ে জেলখানায় সম্মান কেনে। আর আমাদের ছিল ভিন্ন মর্যাদা। জেলখানা কর্তৃপক্ষ এ মর্যাদা আমাদের দিতে কুণ্ঠিত হতেন না।
শুধু ঢাকা হলের কর্মচারী সামসুদ্দিন নয়, জেলে এসেছেন অনেক ছাত্র। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি করাচিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয়। ৩১ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতারের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট হয়। ৬ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাঁকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) আবার গ্রেফতার হন। ৭ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হন শেখ মুজিবুর রহমান। একই সময় গ্রেফতার হন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমেদ।
ঢাকা জেল তখন জমজমাট। জেলখানার বিভিন্ন এলাকায় সকলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শেখ সাহেব ঢাকা জেলেই আছেন। আমাদের ওয়ার্ড থেকে সকালের খাবার যায়। আমাদের ম্যানেজার জহিরুল ইসলাম তখন সারাদিন ব্যস্ত। ছাত্রদের মধ্যে তখন অনেকে জেলে এসেছে। অনেকের নাম আমার স্মরণ নেই। স্মরণ আছে রাশেদ খান মেনন ও হায়দার আকবর খান রনোর কথা। মনে আছে ঢাকা হলের দিলীপ দত্তের কথা। মনে আছে রায়েরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র কাজী হাতেম আলীর কথা। কাজী হাতেম আলী ছিল আমাদের দলের অন্যতম নেতা মরহুম রুহুল আমিন কায়সারের প্রিয় ছাত্র । রুহুল আমিন কায়সার তখন রায়েরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আন্দোলনে অসংখ্য স্কুলের ছাত্র গ্রেফতার হয়েছিল। তাদের মুক্ত করার জন্যে রুহুল আমিন সাহেব সকল শিক্ষকদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই শিক্ষকরা ছাত্রদের পক্ষে আদালতে মামলা জুড়েছিল। ফলে ছাত্ররা কারাগার থেকে মুক্তি পায়।
জেলখানায় তখন রটে গেল শেখ সাহেব নাকি আগরতলায় গিয়েছিলেন। তিনি নাকি সেখানে ভারত সরকারের সাথে আলাপ করেছেন। জেলখানায় শেখ সাহেবের কাছাকাছি ছিলাম না। তাই এ ব্যাপারে কোনো আলাপই হয়নি। পরবর্তীকালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হলে মনে হয়েছিল সে খবরের কিছুটা হলেও সত্যতা ছিল।
এ সময় একদিন একটি ঘটনা ঘটল জেল গেটে। আমাকে জিজ্ঞাসা করার জন্যে গোয়েন্দা বাহিনীর এক লোক এসেছেন। তিনি আমার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন জেল অফিসে। ঐ সময় অসংখ্য ছাত্র জেলে থাকায় তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা প্রতিনিধি জেল অফিসে আসত। সেদিনও এসেছিল। সেদিন একজন সামরিক বাহিনীর অফিসার একজন ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। ছাত্রটিকে আমি চিনতাম। তার ডাক নাম হিরু। এক সময় শুনলাম সামরিক বাহিনীর ঐ অফিসার হিরুকে ধমকাচ্ছে। বলছে, সত্যি কথা না বললে ১৪ বছর সাজা হবে। আমি বললাম, আপনি সাজা দেয়ার কে। ভভদ্রলোক এবার আমার ওপর চটে গেলেন। বললেন, আপনি কে? কেমন কথা বলছেন। আমি বললাম, আমি রাজনীতি করি আর আপনি সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারি। সাজা দিতে পারে আদালত। আপনি নন। আপনাকে বারণ করছি, আপনি ওকে ধমকাবেন না।
এবার আমার সাক্ষাৎ গ্রহণকারী গোয়েন্দা একটু ভড়কে গেলেন। তিনি বললেন, আপনি কথা বলছেন কেন? আমি আপনার সঙ্গে আর কথা বলবো না। আমি ওয়ার্ডে ফিরে যাব। আমি ডেপুটি জেলারকে বললাম আমাকে ওয়ার্ডে নিয়ে আসুন।
সন্ধ্যার দিকে ডেপুটি জেলার এলেন। বললেন, আপনাকে নিয়ে বিপদ হয়েছে। আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছে। নির্দেশ হয়েছে আপনাকে অন্য
জেলে পাঠাবার। আমরা জানিয়েছি, উনি ছাত্র তাই অন্য জেলে পাঠানো যাবে না। তিনবার নির্দেশ এসেছে আপনাকে ছাত্রদের থেকে দূরে অন্য কোনো সেলে রাখবার। আমরা বলেছি, ঢাকা জেলের সব সেলে ছাত্ররা আছে। সুতরাং তাকে জেলে পাঠানো যাবে না। অর্থাৎ আমি ওয়ার্ডেই থেকে গেলাম। আমাকে বদলি করা গেল না।
কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্য ক্ষেত্রে। বাইরে ছাত্র আন্দোলন। ছাত্ররা দাবি করেছে পরীক্ষার তারিখ পিছাবার। তারা নির্ধারিত দিনে পরীক্ষা দেবে না। ঢাকা জেলে আমরা তিনজন পরীক্ষার্থী। আমি অর্থনীতি এমএ প্রথম পর্বে। আমরা জেলখানার কমিটির কাছে সিদ্ধান্ত চাইলাম। বললাম, আপনারা সিদ্ধান্ত দিন আমরা পরীক্ষা দেব কিনা। বাইরে ছাত্ররা আমাদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করেছে। তারা পরীক্ষা দিচ্ছে না। তাই আমাদের পরীক্ষা দেয়া কি ঠিক হবে?
জেলের বন্ধুরা কোনো সিদ্ধান্ত দিলেন না। বললেন, এ সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত। কারণ আপনার শিক্ষাঙ্গনের সঙ্গে জড়িত। এতে আমি পড়লাম বিপদে। প্রথম দিনে আমার পরীক্ষা। তাই আমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি পরীক্ষা না দিলে অপর দু’জনও পরীক্ষা দেবে না। এমনকি আমার পরীক্ষা দেয়া হয় না। জেলের বাইরে থাকতে পরীক্ষা দেবার সুবিধা হয় না। শেষ পর্যন্ত জেলে এসে বিজ্ঞানের পরিবর্তে কলা নিয়ে বিএ পাস করলাম। এবার জেলেও পরীক্ষা দিতে পারব না। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার হলে গেলাম। গিয়ে বললাম, আমি পরীক্ষা দেবো না। জেল কর্তৃপক্ষ অবাক হলেন। খুশিও হলেন। জেলার সাহেব বিকালে জানালেন, ভাইস চ্যান্সেলর আপনার পরিচয় জানতে চেয়েছেন–তিনি বলেছেন এ ছেলের পরিচয় কী যে, জেলখানায় পরীক্ষা দিতে অস্বীকার করে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন ড. মাহমুদ হোসেন–ভারতের তখনকার রাষ্ট্রপতি ড. জাকির হোসেনের ভাই- যার জন্যে পরবর্তীকালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পেরেছিলাম।
বাইরে আন্দোলন শুরু হয়েছে। ১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খানের পূর্ব পাকিস্তানে সফর শুরু করার কথা। গোয়েন্দা রিপোর্ট হচ্ছে ছাত্ররা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজনীতিকরাও গোপনে বৈঠক শুরু করেছে। এ বৈঠক হচ্ছে বিয়ের দাওয়াতে বা এ ধরনের কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে। এ রিপোর্টের ভিত্তিতেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ৩০ জানুয়ারি গ্রেফতার করা হলো। কারণ তিনিই তখন পাকিস্তানের দু’অংশের মধ্যে একমাত্র গ্রহণযোগ্য নেতা। তিনি ইতোমধ্যে দু’অংশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং যে কোনো মুহূর্তে তার আলোচনার ওপর ভিত্তি করে নতুন আন্দোলন শুরু হতে পারে। শেষ পর্যন্ত সে আন্দোলন সরকারই শুরু করলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করে।
বাইরে আন্দোলন শুরু হলে ভেতরে আশা আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়। আন্দোলন দানা বাঁধে, সরকার নরম হয় এবং এক সময় রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে শুরু করে। আন্দোলন শুরু হবার পর এমন একটি চিন্তা আমাদের সকলকে পেয়ে বসেছিল। কারণ শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে জেলে রেখে আইয়ুব খানের ক্ষমতায় থাকা যে সম্ভব নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু জেলখানায় সকলের জীবন সমান যায় না। যাদের পুত্র পরিজন আছে জেল তাদের জন্যে এক দুর্বিসহ জগৎ। যাদের বাইরে থাকা স্ত্রী-পুত্রের অন্নের সংস্থান নেই, তাদের জেলখানায় বিনিদ্র রজনী কাটে। জেলখানা থেকে মুক্তি পাবার চিন্তাও তাদের পাগল করে দেয়। কারণ তারা জানে না জেলখানা হতে বের হয়ে কোন অবস্থায় দেখবে তার অসহায় স্ত্রী-পুত্রকে।
এমনি এক রাজবন্দি ছিলেন প্রখ্যাত রিকশা শ্রমিক নেতা সেলিম। সেলিম সাহেবের কাহিনী আছে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখায়। সেলিম সাহেব আমাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন। তিনি ঢাকাইয়া ভাষায় উপন্যাস এবং ইতিহাস লিখতেন। আমাদের শোনাতেন। আর এক সময় বিষণ্ণ হয়ে যেতেন। কারণ জানতেন না তার স্ত্রী-পুত্র খেয়ে-পরে আছে কিনা।
জেলে আসার প্রথম দিকে সেলিম সাহেবের স্ত্রী জেলগেটে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। তাঁর আসা শুরু হলো বিলম্বিত লয়ে। সেলিম সাহেব চিন্তিত, উদ্বিগ্ন। তাঁর স্ত্রী আর তার সাথে দেখা করতে আসেন না।
এইতো রাজনীতি। এইতো জীবন। আজ যারা পূর্বসূরিদের গালমন্দ করেন, যাঁরা নির্বিপাকে আত্মসমর্পণ করেন, আত্মসমর্পণকে আজকের জগতের একমাত্র রাজনীতি বলে মনে করেন, তাঁরা জানেন না রাজনীতি কাকে বলে, জানেন না আত্মত্যাগ কাকে বলে। তারা সমাজের উচ্ছিষ্ট ভোজন করে প্রাসাদোপম অট্টালিকা নির্মাণ করে মনে করেন সেলিম সাহেবরা ছিল বোকা। কারণ তারা রাজনীতিকে মনে করেছিলেন আদর্শের বাহুল্য। আজকের রাজনীতির বাণিজ্যের যুগে তাঁরা বেমানান।
বাইরে আন্দোলন শুরু হলে সকলের মনে আশার সৃষ্টি হয়, হয়তো মুক্তি পাওয়া যাবে। আমরা সামরিক শাসনের এক বছর পর গ্রেফতার হয়েছিলাম। প্রবীণ রাজনীতিকরাও জানতেন না কবে আমরা মুক্তি পাব। এবার ধারণা হলো বেশি দিন জেলে থাকতে হবে না।
তবে জেল থেকে মুক্তি পাবার দুটি ঐতিহ্য আছে। সাধারণত শেষে যারা গ্রেফতার হয় তারা আগে মুক্তি পায়। আবার দীর্ঘদিন যারা জেলে থাকে তাদের মধ্যে নেতারাই আগে মুক্তি পায়। অনেক সময় সাধারণ সদস্যদের দীর্ঘদিন জেলে কাটাতে হয়। এ অবস্থা দীর্ঘদিন থেকেই চলছে। পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসনের বিশেষ কিছু চিত্র আছে। ১৯৫৮ সালে ৭ অক্টোবর রাতে সামরিক শাসন জারি হয়। সামরিক সরকারের প্রেসিডেন্ট হলেন ইস্কান্দার মীর্জা। তিনিই প্রথম সামরিক আইন প্রশাসক। প্রধানমন্ত্রী হলেন জেনারেল আইয়ুব খান। এই দুই নেতৃত্ব বেশিদিন টেকেনি। ২৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মীর্জা পদচ্যুত হলেন। আইয়ুব খান হলেন প্রেসিডেন্ট।
ইতোমধ্যে গ্রেফতার শুরু হয়ে গেছে। ১৭ অক্টোবরের মধ্যে আব্দুল গাফফার খান, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ হাজার হাজার নেতা কর্মী গ্রেফতার হলেন। ১৫ অক্টোবর সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়। সামরিক শাসনের প্রথম দিনে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা আত্মগোপন করেন। কারো সামনে কোনো কর্মসূচি ছিল না। বছর ঘুরতে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসেছিলেন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে। তিনি প্রধান সেনাপতি থাকাকালে পাকিস্তানের জন্যে একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ১৯৬২ সালে সেই সংবিধানই জারি হয়েছিল। সংবিধান প্রণয়নের জন্যে কমিশন গঠন ছিল একটি লোক দেখানো ব্যাপার।
তখন বিশ্বে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের যুগ। একদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের শিবির। অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শিবির। মাঝখানে যুগোস্লাভিয়া, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার নেতৃত্বে নিরপেক্ষ জোট। এই পরিবেশে পাকিস্তানের অবস্থান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ভারত, চীন এবং সোভিয়েত সীমান্তের কাছাকাছি পাকিস্তান। তাই ভৌগোলিক রাজনীতিতে পাকিস্তান ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের যুগে পাকিস্তান ছিল পাশ্চাত্য শিবিরের পক্ষে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে আইয়ুব খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন, পাকিস্তানই হবে পশ্চিমা শক্তির একমাত্র বন্ধু। তাই পাকিস্তান ছিল পাশ্চাত্য শিবিরের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রতিহত প্রভাব ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতে, পূর্ব পাকিস্তান ছিল কমিউনিস্ট প্রভাবিত। তাই পাকিস্তান শাসন করার জন্যে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী কেন্দ্র। এছাড়া পাকিস্তানে পাশ্চাত্যের ধরনের গণতন্ত্র অচল। নতুন ধরনের গণতন্ত্র চালু করে ক্ষমতা বজায় রাখা হবে সামরিক প্রকারের লক্ষ্য।
এই লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে সামরিক সরকার দুটি আইন জারি করল। একটি হচ্ছে, নির্বাচনে অযোগ্যতা অধ্যাদেশ, অপরটি মৌলিক গণতন্ত্র। নির্বাচনে অযোগ্যতা অধ্যাদেশ বলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অসংখ্য রাজনীতিককে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হলো। আর মৌলিক গণতন্ত্র অধ্যাদেশ বলে ইউনিয়ন বোর্ড ভেঙে নাম করা হলো মৌলিক গণতন্ত্র। সারা পাকিস্তানে আশি হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচিত হবে। পূর্ব পাকিস্তানে ৪০ হাজার এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ হাজার। এরা নির্বাচিত হবে ইউনিয়ন বোর্ডের পরিবর্তে মৌলিক গণতন্ত্র সদস্য হিসেবে। সহজে বলা যায় বোর্ডগুলোকে মৌলিক গণতন্ত্রে পরিণত করা হলো। পাকিস্তানের দুই অংশে ৪০ হাজার করে মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচিত হবে। এরাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। এরাই প্রাদেশিক পরিষদ এবং জাতীয় পরিষদ-এর ভোটার হবে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে সাধারণ পরিষদ এবং জাতীয় পরিষদ নির্বাচন থেকে বঞ্চিত করা হলো। সব নির্বাচনের মালিক হলো এই ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী। এই ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীকে কেনা-বেচা খুব কঠিন নয়। এদের ভিত্তিতেই নির্বাচনী এলাকা নির্বাচিত হবে।
১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মৌলিক গণতন্ত্র নির্বাচন দেয়া হলো। পূর্ব পাকিস্তানে এ নির্বাচনে ৭৮,৮৭৬ জন প্রার্থী ছিল। ১৪টি নির্বাচনী এলাকায় কোনো প্রার্থী ছিল না। দল হিসেবে এ নির্বাচনে কারোরই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের ৪০ হাজার নির্বাচিত প্রার্থীর মধ্যে ৫,৮১০ জন ছিল ব্যবসায়ী, ২,৮০০ জন ছিল রাজনৈতিক কর্মী, ৪৩৪ জন কন্ট্রাক্টর, ২৫৭ জন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারি, ২৯৮ জন আইনজীবী। বাদবাকি সকলেই ছিল কৃষক। এই মৌলিক গণতন্ত্রীদের হা এবং না ভোটে জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
লক্ষণীয় যে, ১৯৫৮ কিংবা ‘৫৯ সালে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন তেমন জোরদার ছিল না। ছাত্ররা তেমন তৎপর ছিল না। এই সুযোগে সামরিক শাসকরা মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচন দেয় এবং শিক্ষা নিয়ন্ত্রণের জন্যে শরীফ কমিশন নিয়োগ করে ।
১৯৬১ সালের দিকে ছাত্ররা কিছুটা তৎপর হতে শুরু করে ২১ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে। প্রথম ছাত্রসভা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬১ সালে ৫ এপ্রিল। প্রতীক ধর্মঘট হয় পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্রদের কারাদণ্ড দেয়ার প্রতিবাদে।
মোটামুটিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হবার পর। ৩০ জানুয়ারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হন। ১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা মিছিল করে সামরিক আইন ভাঙে। ২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মঞ্জুর কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাঞ্ছিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। আমি আগেই বলেছি আমাদের পূর্বে গ্রেফতার হলেও শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক নেতাই আমাদের আগে মুক্তি পেয়ে যান। শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হবার পর এবার আবার গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হয় ১২৮ জন ছাত্র আর ইতোমধ্যে আইয়ুব খাব তার নতুন শাসনতন্ত্র জারি করলেন, যে শাসনতন্ত্র বাতিলের দাবি শেষ পর্যন্ত মুখ্য দাবিতে পরিণত হয়।
মার্চ মাসের পর প্রদেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রদের তিনটি দাবি ছিল–এক, নতুন শাসনতন্ত্র বাতিল, দুই, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, তিন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি।
ছাত্রদের তিন দফা প্রকাশের পর সঙ্কট দেখা দিল নির্বাচন নিয়ে। ইতোমধ্যে আইয়ুব খান ২৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদ এবং ৬ মে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ছাত্রদের পক্ষ থেকে বিরোধিতা করা হয়। তারা নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয়। কিন্তু সফল হয়নি।
নির্বাচন বর্জন করার জন্যে পূর্ব পাকিস্তানে এক শ্রেণির নেতৃবৃন্দ বিবৃতি প্রদান করেন। এর মধ্যে ছিলেন নূরুল আমিন, আবু হোসেন সরকার, আতাউর রহমান খান, মাহমুদ আলী, পীর মহীউদ্দিন দুদু মিয়া প্রমুখ। কিন্তু তাদের বিবৃতিও কাজে আসেনি।
২৮ এপ্রিল জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে নির্বাচিত হন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী প্রমুখ। এঁরা নির্বাচিত হবার পর ছাত্রদের পক্ষ থেকে তাদের কাছে অনুরোধ জানানো হয় সরকারের বিরোধিতা করার। কিন্তু তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ আইয়ুব খানকে সহযোগিতা করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ময়মনসিংহের মোনায়েম খান এবং চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী।
এসময় উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে–নয় নেতার বিবৃতি । তারিখ ১৪ জুন। জেলখানায় খেতে বসেছি। সেই সময় সংবাদপত্র এল। সংবাদপত্রে নয় জন নেতার বিবৃতি দেখলাম। এই নয় নেতার মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হোসেন সরকার, শেখ মুজিবুর রহমান, ইউসুফ আলী চৌধুরী, মাহমুদ আলী, সৈয়দ আজিজুল হক এবং পীর মহসীন উদ্দিন আহম্মদ।
আমার পাশে খেতে বসেছিলেন ন্যাপের আবদুল হালিম। নয় নেতার বিবৃতি পড়ে তিনি বললেন, এ বিবৃতি নিশ্চয়ই আমাদের নেতারা সমর্থন করবেন। কিন্তু বলে দিতে হবে আমরা কবে কোনদিন এ বিবৃতির প্রতিবাদ করব।
বামপন্থীদের কাছে এটা এক সমস্যা। বামপন্থীরা মিছিল করবে। মার খাবে, জেল খাটবে আর আন্দোলনের সব ফসল চলে যাবে ডানপন্থীদের ভাণ্ডারে। সামরিক শাসন জারি হবার পর প্রকাশ্যে নয় জন নেতা বিবৃতি দিলেন–গণতন্ত্রের দাবিতে। আইয়ুবের সংবিধান বাতিলের দাবিতে। এই বিবৃতিদানকারীদের মধ্যে একজনও বামপন্থী নেতা নেই। অথচ এই আন্দোলন সফল করার দায়িত্ব মুখ্যত বামপন্থী কর্মীদের। নেতারা বলবেন, এ মুহূর্তে জাতীয় স্বার্থে নয় নেতার বিবৃতি সমর্থন করতে হবে। বিবৃতি অনুযায়ী কাজ করতে হবে। তারপর একদিন দেখা যাবে-আন্দোলনের নামে ডানপন্থী নেতারা আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। আন্দোলন আপোষ পর্যবসিত হচ্ছে। তখন বামপন্থী নেতারা বলবেন–আমাদের ভুল হয়েছে। কমিউনিস্ট আন্দোলনে এই ভুলের পুনরাবৃত্তি চলছে বছরের পর বছর। এই অভিজ্ঞতা থেকে সরদার আব্দুল হালিম সেদিন প্রশ্ন তুলেছিলেন কবে আমাদের আবার এই নয় নেতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। খুব বেশিদিন গেল না। কিছুদিন পরে সরদার হালিমের বক্তব্যের সত্যতা আমাদের হাড়ে হাড়ে টের পেতে হলো।
এর পরবর্তীকালে ১৯ আগস্ট শহীদ সোহরাওয়ার্দী কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুক্তি পাওয়ার পরে আন্দোলন নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়। নয় নেতার বিবৃতিতে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি ছিল। ছাত্ররা দাবি করেছিল আইয়ুবের সংবিধান বাতিলের। আইয়ুবের সংবিধান বাতিল করতে হলে জঙ্গি আন্দোলন করতে হয়। সে আন্দোলনের রূপ হতে পারে সহিংস। এ সত্যটি বুঝেছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। তিনি জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়েই বললেন–সংবিধান বাতিল নয়, সংবিধানকে গণতন্ত্রায়ন করতে হবে। অর্থাৎ আন্দোলন করতে হবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে। সরদার হালিমের কথাই সত্যি হলো। ডানপন্থী নেতৃত্ব তাদের নিজের কথায় আন্দোলন নিয়ে গেল এবং পুরনো নয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী নেতৃত্বেরই আন্দোলনে শরিক হন। তারাও বললেন, সংবিধান বাতিল নয়। সংবিধানে গণতন্ত্রায়ন করতে হবে।
এবার আমাদের মুক্তি পাবার পালা। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুক্তি পাবার পর রাজবন্দিদের মুক্তি পাওয়া শুরু হলো। প্রথম দিকে ছাত্ররা চলে গেল। নেতারা আগেই চলে গেছেন। আমাদের অনেকেরই বিশ্বাস, আমাদের অনেকদিন জেলখানায় থাকতে হবে। এবং এর মধ্যে একদিন ভোরের দিকে জেল গেটে আমার ডাক এল। গোয়েন্দা বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এসেছিল, কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। তিনি বললেন, আপনি মুক্তি পাবেন সবার শেষে।
প্রকৃতপক্ষে আমি মুক্তি পাবার চিন্তা করছিলাম না। বাইরের ছাত্ররা পরীক্ষা না দেয়ায় আবার পরীক্ষার তারিখ সরে গেছে। পরীক্ষার সময় জেলখানায় থাকা আমার পক্ষে ভালো। কারণ ছাড়া পেলে কোথায় যাব জানি না। নিমতলীর হোটেল ডিলাক্স থেকে গ্রেফতার হয়েছিলাম। শুনেছি সে হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে। অজয় বাবু ঢাকা হলে কোয়ার্টারে চলে গেছেন। গ্রামের বাড়ির সাথে সম্পর্ক নেই দীর্ঘদিন। কলকাতা থেকে মাঝে মাঝে মায়ের চিঠি পাই। পুরনো এক বন্ধু কলকাতা থেকে একখানা অর্থনীতির বই কিনে পাঠিয়েছে। সে লিখেছে–তুই অর্থনীতির বই দিয়ে কী করবি। লাইব্রেরি থেকে বলেছে এ বই এমএ ক্লাসের পাঠ্য। তুই আমাদের সাথে বিএসসি পড়তি। এ বই দিয়ে কী করবি।
আমার পত্র লেখক বন্ধু বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। বরিশালে এক সঙ্গে বিএসসি পড়তাম। সে বিএসসি পাস করে শিবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। তাকে জানানো হয়নি যে জেল খাটতে খাটতে আর জেল পালাতে পালাতে পড়াশুনা আর হয়নি। জেলখানায় এসেছি বলে শেষ পর্যন্ত বিএ পাস করা হয়েছে। ভাবছি এমএ প্রথম পর্ব জেলখানায় শেষ করতে পারলেই ভালো হতো। কারণ জেলখানা থেকে মুক্তি পেলে কোথায় যাব? কার কাছে যাব? কী করে পড়াশুনা চালাব, তার কোনো হদিস আমার কাছে ছিল না। অথচ ওই দিনই রাত ন’টার দিকে আমাকে জেলগেটে ডেকে পাঠানো হলো। ডেকে পাঠানো হলো মহিউদ্দীন আহমদ এবং নারায়ণগঞ্জের হাসান জামিলকে। এই তিনজনই ১৯৫৯ সালে একই দিনে গ্রেফতার হয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের শফি খান। তাকে জেলগেটে ডাকা হলো না। আমাদের জেলগেটে নিয়ে বলা হলো, আপনাদের মুক্তির আদেশ এসেছে। আমি বললাম, মুক্তি! এতরাতে আমি কোথায় যাব?
মাস-তারিখ মনে নেই। জেলগেটে ডেকে এনে বলা হলো, আপনি মুক্তি পাচ্ছেন। রাত বাড়ছে। হাতে টাকা নেই। ঢাকা থেকে গ্রেফতার হয়েছিলাম–তাই জেল কর্তৃপক্ষ রিকশা ভাড়া দিতে পারে। গ্রামের বাড়ি কোটালীপাড়া থেকে গ্রেফতার হলে যাবার খরচ-খাবার খরচ পেতাম। এখন যাব কোথায়? বন্ধুরা কে কোথায় আছে জানি না। একই সঙ্গে মহিউদ্দিন সাহেব এবং হাসান জামিল মুক্তি পাচ্ছে। লক্ষ করলাম একজন অচেনা লোক তাদের সঙ্গে কথা বলছে এবং তাদের হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিচ্ছে। আমার সন্দেহ হলো, হয়তো আমাদের অন্তরীণ করা হচ্ছে।
আমি জেলার সাহেবকে ডাকলাম, বললাম, ওই অচেনা ভভদ্রলোক কে? কী তাঁর পরিচয়? এরমধ্যেই ওই ভভদ্রলোক আমার কাছে এলেন–বললেন, আপনার একটি অর্ডার আছে। আমি বললাম, আপনি কে আপনাকে আমি চিনি না। জেলার সাহেবকে বললাম–এ ভভদ্রলোককে বের করে দিল। আমি তাঁর কাছ থেকে কোনো অর্ডার নেব না। অর্থাৎ জেলগেটেই আবার গোলমাল শুরু হলো। মহিউদ্দীন সাহেব, জামিল সাহেব ওই অর্ডার নিলেন। তাঁদের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ অন্তরীণ করা হলো। আমাকে ঢাকায় অন্তরীণ করার নির্দেশ দিলেন। আমি গ্রহণ করলাম না। ওই ভভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন–আপনাকে কোথায় পাওয়া যাবে? আমি বললাম–আগামীকাল ইত্তেফাক অফিসে। আমি ইত্তেফাঁকের সহকারী সম্পাদক হিসেবেই গ্রেফতার হয়েছিলাম।
শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম ঢাকা হলে অজয় রায়ের খোঁজ করব। ঢাকা হলে গিয়ে অজয় বাবুকে পেলাম না। তিনি নেই। পরের দিন অজয় বাবুর বিয়ে। তবে ভার কক্ষে আশ্রয় পেলাম। জেলখানা থেকে খেয়ে এসেছিলাম। তাই রাত ভালোভাবেই কাটল।
পরের দিন ইত্তেফাক অফিস গেলাম। আমার প্রথম কাজ একটি আশ্রয় খুঁজে পাওয়া এবং আয়ের সূত্রের সন্ধান। ভাবলাম জেল থেকে এলেও ইত্তেফাঁকে আমাকে চাকরি দেবেই। আইয়ুববিরোধী এ আন্দোলনে ইত্তেফাঁকের সহকারী সম্পাদক আলী আকসাদ গ্রেফতার হয়েছিলেন। জেল থেকে মুক্তি পাবার পর তার চাকরি হয়েছে। আন্দোলনের সময় আহমেদুর রহমান আত্মগোপন করেছিলেন। তিনিও চাকরিতে যোগ দিয়েছেন।
ইত্তেফাক অফিসে ঢুকে মনে হলো আমার চাকরি হচ্ছে না। আমি চাকরিতে ঢুকবার সময় এমএ আউয়াল সহকারী সম্পাদক ছিলেন। আউয়াল এক সময় ছাত্রলীগের সম্পাদক ছিল। জেল থেকে শুনেছি আউয়াল ইত্তেফাক ছেড়ে দিয়েছে। কারণ ইত্তেফাঁকের মালিকানা নিয়ে বিরোধিতা। ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া গ্রেফতার হয়ে গেলে আউয়াল নাকি পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক ওমরাও খানের কাছে ইত্তেফাঁকের মালিকানা দাবি করে দরখাস্ত দিয়েছিল। এ বিতর্কে তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। আমি আউয়ালের সঙ্গে দেখা করলাম। আউয়াল বলল, তোর চাকরি হবে না। আমি বললাম, কেন। আউয়ালের জবাব হলো, তোকে মানিক ভাই বিশ্বাস করবে না। কারণ তুই আমার বন্ধু।
ইত্তেফাঁকে চাকরির জন্যে অনেকেই দেনদরবার করলেন। তেমনি কাজ হলো না। শেষ পর্যন্ত বলা হলো নির্মল সেনের বার্তা বিভাগে চাকরি হতে পারে, সম্পাদকীয় বিভাগে নয়। তাও হলো না। বার্তা বিভাগের নেতা বার্তা সম্পাদক সিরাজউদ্দীন হোসেন আমাকে আশ্বাস দিলেন। দু’দিন টেবিলে বসতে বললেন। পরে বুঝলাম, এ চাকরি হবে না। কারণ সকলে জানে সম্পাদকের পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় সকলে আমাকে সমীহ করে। এরপর আমি চাকরিতে ঢুকলে আমার ক্ষমতা আরো বাড়বে। সুতরাং বার্তা বিভাগেও আমাকে নেয়া হবে না এবং হলো না।
বুঝলাম আমাকে আবার টিউশনিতে ফিরে যেতে হবে। খবর এলো তোয়াহা সাহেবের কন্যাকে পড়াতে কেউ সাহস পাচ্ছে না। তোয়াহা সাহেব আত্মগোপন করে আছেন। আমাদের বিপ্লবী বন্ধুরা কেউ রাজি নয়। আমি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করলেও তোয়াহা সাহেবদের রাজনীতি সঠিক মনে করি না। তবুও বললাম, আমি পড়াব।
এ টিউশনি এবং তোয়াহা সাহেব নিয়ে আমার জীবনে আর একটি কাহিনী আছে। তখন ঢাকা হলে থাকি। একদিন রাতে হলে ফিরে দেখি তোয়াহা সাহেব এবং অধ্যাপক মোজাফফর সাহেব আমার অপেক্ষায় বসে আছেন। তাদের প্রস্তাব মওলানা ভাসানীর পুত্র আবু নাসের খান ভাসানী ওরফে বাবুকে পড়াতে হবে। তাকে ম্যাট্রিক পাস করানো দরকার।
আমি রাজি হলাম। আমার শর্ত ছেলেটি আমার হলে এসে পড়তে হবে এবং আমাকে বেতন দিতে হবে। কারণ মওলানা সাহেব গরিব নন। এ শর্তে বাবুকে পড়িয়েছিলাম। বাবু পাস করেছিল এবং অনেক পরিবর্তন করে মওলানা সাহেবের কাছ থেকে এক মাসের বেতন আদায় করেছিলাম।
এবার তোয়াহা সাহেবের কন্যাকে পড়াতে হবে। তিনি আত্মগোপন করে আছেন। তাই বেতন নেয়া ঠিক হবে না। আমার সমস্যা মিটল না। তবে ভিন্ন একটি টিউশনি জুটে গেল এসএনকিউ জুলফিকার আলীর বাসায়। তিনি ঢাকা হলে প্রভোস্ট নিযুক্ত হলে প্রথম এক বছর আমরা তাঁকে হলে ঢুকতে দিইনি। আবার তিনিই আমাকে ১৯৫৯ সালে ২৪ ঘন্টার নোটিসে ঢাকা হল থেকে বের করে দিয়েছিলেন। যদিও ১৯৮৪ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে মাসের পর মাস তার বাসায় আশ্রয় পেয়েছি।
অজয় বাবু বিয়ে করেছেন। শ্বশুর বাড়ি কুমিল্লায়। অজয় বাবুর কোয়ার্টার আজিমপুরে। তাঁর সঙ্গে কোয়ার্টারে আছি। তার স্ত্রী ফেরা পর্যন্ত থাকব। ইতোমধ্যে অর্থনীতি প্রথম পর্ব পরীক্ষা দিয়েছি। মৌখিক পরীক্ষায় সকলের জিজ্ঞাসা, জেল থেকে কোন সাহসে অর্থনীতি নিয়েছি।
সেকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে প্রাইভেট হিসেবে পরীক্ষা দিতে দেয়া হতো না। আমি হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ছাত্র। আমার পূর্বে পটুয়াখালীর এক আইনজীবী অর্থনীতির প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রি পেয়েছিলেন।
পরীক্ষার ফল বের হলো। ভালো হলো না। এবার বিপদ দেখা দিল। আমি জেল থেকে প্রথম পর্ব পাস করেছি প্রাইভেট হিসেবে। এবার দ্বিতীয় পর্ব পড়তে হলে আমাকে হলের মারফৎ ভর্তি হতে হবে। কিন্তু আমাকে ভর্তি করবে কে? ঢাকা হলের ছাত্র ছিলাম। ঢাকা হলের প্রভোস্টের কাছে গেলাম। তিনি রাজি হলেন না। প্রভোস্ট ড, মুশফেকুর রহমান আমার বিরুদ্ধে ১৯ পৃষ্ঠা রিপোর্ট দিলেন। আমার সিদ্ধান্ত, আমি জগন্নাথ হলে যাবো না। কসমোপলিটন হল ঢাকা হলে থাকব। ভাইস চ্যান্সেলর ড, মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে দেখা করলাম। আমি বললাম, স্যার জেলের বাইরে আসলে আমাকে পড়ার অনুমতি দেয়া হয় না। জেলে গেলে অনুমতি পাই। ১৯৪৮ সালে প্রথম জেলে গিয়ে শুরু করেছি এ সংগ্রাম। এখন ১৯৬২ সাল। এ সংগ্রাম শেষ করতে চাই।
ড. হোসেন আমাকে চিনলেন। বললেন, তুমি জেলখানা থেকে পরীক্ষা বর্জন করেছিলে। আমি তোমার জন্যে চেষ্টা করব।
তবে পরের ঘটনা নিম্নরূপ-ভাইস চ্যান্সেলর প্রভোস্টদের বৈঠক ডেকেছিলেন। সকলে আমার বিরুদ্ধে বলেছেন। ভাইস চ্যান্সেলর তখন জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ড. গোবিন্দ দেবকে বললেন–It is my request. ড. দেব বললেন–আপনাকে লিখিত নির্দেশ দিতে হবে। আপনি নির্দেশ দিলে। নির্মলকে ভর্তি হতে দেব । কিন্তু সে কোনোদিন হলে সিট পাবে না। ড. মাহমুদ হোসেন আমাকে জানালেন, চুপচাপ ভর্তি হয়ে যাও। পড়ে পাস করো। হলে সিট পাবার চেষ্টা করো না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রশ্নে সুরাহা হলেও রাজনৈতিক দিক থেকে গুছিয়ে ওঠা সহজ হলো না। কাজী বারীকে কথা দিয়ে এসেছিলাম যে আমি মুক্তি পাবার এক মাসের মধ্যে তাকে মুক্ত করবো। কাজী বারীকে মুক্ত করেছিলাম। সে ছিল আর এক অধ্যায়। জেলখানায় জেনেছিলাম এসবি’র স্পেশাল সুপারিন্টেনডেন্ট হচ্ছেন জনাব আব্দুর রহিম। তিনি ঢাকার এডিশনাল এসপি থাকাকালীন তাঁর স্ত্রীকে আমি পড়াতাম। জেল থেকে এসে তাঁকে ফোন করলাম। তিনিই চাইছিলেন আমার সঙ্গে কথা বলতে। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে তিনি প্রথমেই বললেন, দেখুন আপনি আমাকে বিপদে ফেলেছেন। আমার জন্যে আপনি মুক্তি পেয়েছেন। আপনার তখন মুক্তি পাবার কথা ছিল না। ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের সব ছাত্র নেতাকে মুক্তি দেয়া হলো। অফিসে গিয়ে দেখি আপনার নামে একটি ফাইল। জানতাম না আপনি জেলে। বাসায় স্ত্রীকে ফোন করলাম। জিজ্ঞাসা করলাম–তোমার স্যার কোথায়? বলল, স্যার জেলে। আমি সকল ইন্সপেক্টরদের ডাকলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, সব ছাত্রনেতা মুক্তি পেলে নির্মল সেন কেন পাবে না? কোনো ইন্সপেক্টর আপনার পক্ষে কথা বলল না। আমি বিপদে পড়লাম। তবুও আপনার ফাইলের এক কোনায় লিখলাম If this case can be considered… ফাইল ডিআইজি সাহেবের কাছে পাঠালাম। তিনি অফিসে ডেকে পাঠালেন। বললেন, আমি ভভদ্রলোককে চিনি দীর্ঘদিন ধরে। পূর্বে একবার এর জন্যে তদবির করেছি অনেক বছর আগে। আপনি ঝুঁকি নিলে ছেড়ে দেব। তাই আপনাকে ঢাকায় অন্তরীণ করার শর্তে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। আর আপনি জেল গেটেই অন্তরীণ আদেশ অগ্রাহ্য করলেন। এখন বুঝুন আমার অবস্থা।
আমি রহিম সাহেবের কথায় বিস্মিত হলাম। বললাম, ঠিক আছে আপনার কথা মানব। তবে আমার একটি কাজ করে দিতে হবে। কাজটি হচ্ছে এক মাসের মধ্যে ময়মনসিংহের কাজী আব্দুল বারীকে মুক্তি দিতে হবে।
রহিম সাহেব বললেন, অসম্ভব। কাজী বারী দশ ঘা বেত খেয়েছেন। আসলে তাকে মুক্তি দেয়া সহজ নয়। আর বারী সাহেব কমিউনিস্ট পার্টির লোক, আপনি আরএসপি করেন। আপনি কেন তার জন্যে দেন-দরবার করছেন?
আমি বললাম, আমি কোন দল করি তা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে আমি তাকে কথা দিয়েছি। আমার কথা রাখতে হবে। রহিম সাহেব রাজি হলেন। বললেন, তিনি চেষ্টা করবেন। তিনি কথা রেখেছিলেন। কাজী বারী মুক্তি পেয়েছিল। রহিম সাহেব দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আইজি হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সচিব হয়েছিলেন।
জেলখানায় দলের তেমন খবর পাইনি। জেল থেকে বেরোবার পর রুহুল আমিন সাহেব খবর পাঠালেন। তিনি রাষ্ট্রেরবাজারে বাসা নিয়েছেন। রায়ের বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমি জেলে যাবার আগে তিনি মিডফোর্ড হাসপাতালের টিবি ওয়ার্ডে ছিলেন। রাজনীতির ক্ষেত্রে তারা ইতোমধ্যে কিছুটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট এনডিএফ-এর নামে কাজ করছেন। দল অর্থাৎ আরএসপির নামে কাজ কছেন না। তখন এনডিএফ-এর নেতা জনাব নূরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান, মাহমুদ আলী প্রমুখ। পাকিস্তানে সংবিধান জারি হবার সঙ্গে সঙ্গে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হয়েছিল। প্রকাশ্যে রাজনৈতিক দল করার সুবিধা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সকল দলের সিদ্ধান্ত হলো কোনো দলকেই পুনরুজ্জীবিত করা হবে না। তবে এ সিদ্ধান্ত বেশি দিন টেকেনি। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়।
এ সময় আমরা নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। দলের সঙ্গে প্রকাশ্যে কাজ না করে শ্রমিক সংগঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বরিশালের আব্দুল মান্নান তখন বিজি প্রেসে কাজ করতেন। দলের প্রবীণ নেতা কমরেড নেপাল নাহা কুমিল্লায় শিক্ষকতা করতেন। দলের অন্যতম নেতা মিসির আহম্মদ চট্টগ্রামে শিক্ষকতা করতেন। সিদ্ধান্ত হলো নেপাল নাহা ও মিসির আহম্মদকে ঢাকায় আনা হবে। আমি ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে দেব।
এ সময় একটি প্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। আমি জেলে যাবার আগে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিলাম। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হিসেবে গ্রেফতার হয়েছিলাম। জহুরুল ইসলাম, আহম্মদ হুমায়ুন, আব্দুল হালিম, আজিজুর রহমান খানসহ অনেকেই তখন ছাত্রলীগ থেকে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিলেন। আমি পূর্বে উল্লেখ করেছিলাম আমার ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেয়া ছাত্রদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও কমিউনিস্ট পার্টি ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। আমরা জেলে যাবার পর মোহাম্মদ ফরহাদ ও আনোয়ার জাহিদ ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে আসেন। জেলখানা থেকে আসার পর একদিন শুনলাম পুরান ঢাকার স্বামীবাগে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন হচ্ছে। অথচ আমাদের কাউকে কোনো খবর দেয়া হয়নি। সম্মেলনে সেন্ট্রাল উইম্যান্স কলেজের একজন ছাত্রী আমাদের অনুপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন, সামরিক শাসন জারি হওয়ার পূর্বে সম্মেলনে গঠিত কমিটির সভাপতি ছিলেন ডা. আলমগীর। সম্পাদক ছিলেন সাদউদ্দীন আহম্মদ, দফতরবিহীন সম্পাদক ছিলেন আহম্মদ হুমায়ুন, আর সদস্যদের মধ্যে ছিলেন নির্মল সেন, জহুরুল ইসলাম প্রমুখ। কিন্তু এ সম্মেলনে তাঁদের দেখছি না কেন?
এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন ফরহাদ। ফরহাদ সাহেব বলেছিলেন এ ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে অতীতের ছাত্র ইউনিয়নের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা নতুন করে সংগঠন করছি। আজকের ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধুরা নিশ্চয়ই এ খবর রাখেন না। আর ফরহাদ সাহেবের কথা মেনে নিতে হলে ধরে নিতে হয় যে এখনকার ছাত্র ইউনিয়নের ১৯৬২ সালে জন্ম হয়েছিল।
তবুও আমাকে নিয়ে ছাত্র ইউনিয়নে ভয় গেল না। ১৯৬৩ সালে ডাকসু নির্বাচন। তখন ডাকসুতে সরাসরি নির্বাচন ছিল না। সেবার জগন্নাথ হল থেকে ডাকসুর ভিপি হবার কথা। আমি জগন্নাথ হলের ছাত্র। কমিউনিস্ট পার্টির ধারণা হলো, আমি প্রার্থী হলে আমাকে ঠেকানো মুশকিল হবে। হঠাৎ একদিন মহিউদ্দিন সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলতে আসলেন। তাঁর অনুরোধ হলো আমি যেন ভিপি পদে না দাঁড়াই। আমি হেসে ফেললাম। তাকে বললাম আমার দলের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আমি আর ছাত্র আন্দোলনে থাকছি না। সুতরাং আপনাদের ভয় নেই।
মহিউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে কথা বলে মধুর ক্যান্টিনে আসতেই শাহ মোয়াজ্জেম ও শেখ ফজলুল হক মণির সঙ্গে দেখা। তারা বলল, আপনি ভিপি পদে দাঁড়াতে পারবেন না। আপনি ভিপি পদে দাঁড়ালে আমাদের অসুবিধা হবে। আপনার বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেয়া যাবে না। কারণ আপনি ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। মনি বলল, এমনিতেই গতরাতে এসএম হলে আপনার বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা বক্তৃতা দিয়েছি। বলেছি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় অফিসের ড্রয়ারে আরএসপির প্রচারপত্র পাওয়ার অভিযোগে নির্মল সেনকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মনির কথায় আমার বলার কিছু ছিল না। কারণ আমি যখন ছাত্রলীগে ছিলাম তখন মনি ছাত্রলীগের সদস্য ছিল কিনা সন্দেহ। তবে শাহ মোয়াজ্জেমের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদে তাকে নির্বাচিত করার জন্যে আমি একদিনের জন্যে ঢাকা কলেজের ছাত্র সেজেছিলাম। আমি ওদের বললাম, আমি কোনো নির্বাচনেই দাঁড়াচ্ছি না। তবুও ছাত্রলীগ জিততে পারেনি। ডাকসুর ভিপি হয়েছিল ছাত্র ইউনিয়নের শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ।
ইতিমধ্যে আমার একটা চাকরির সংস্থান হয়েছে। চাকরির ব্যবস্থা জাম্মেল দা। তখন সরকারের সমর্থনে নতুন একটি পত্রিকা বেরোচ্ছিল। পত্রিকার নাম জেহাদ। আমি তখন আজিমপুরে থাকি। একদিন। ভোরবেলা মোজাম্মেল দা এসে হাজির। বললেন, আমার সঙ্গে চলো। তোমার চাকরি হয়েছে দৈনিক জেহাদে। সর্বকনিষ্ঠ সহ-সম্পাদক। আমি ইত্তেফাঁকের সহকারি সম্পাদক ছিলাম। জেহাদের সহ-সম্পাদক হবার আমার কোনো ইচ্ছা ছিল না। আমি মোজাম্মেল দাকে বললাম, আমি সরকারি কোনো কাগজে চাকরি করব না। মোজাম্মেল দা বললেন, তোমাকে একটু প্রাকটিক্যাল হতে হবে। পাকিস্তানে তোমার জন্মগত একটা বাধা আছে। তুমি নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি যে জেলখানা থেকে এসে সবাই ইত্তেফাঁকে চাকরি পেয়েছে, কিন্তু তুমি পাওনি। এ অপ্রিয় সত্যটি তোমাকে বুঝতে হবে। আমি বললাম, আমি সংবাদে শহীদুল্লাহ কায়সারের কাছে যাচ্ছি। শেষ চেষ্টা করে দেখব ইত্তেফাঁকে চাকরি হয় কিনা। এই বলে আমি মোজাম্মেল দাকে বিদায় করে দিয়ে সংবাদ অফিসে গেলাম। শহীদুল্লাহ কায়সার ফোনে মানিক মিয়ার সঙ্গে কথা বললেন। অনুনয়, বিনয় করলেন। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। শহীদুল্লাহ কায়সার বললেন, আপনাকে সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। পত্রিকার কে মালিক তা নিয়ে প্রশ্ন করে লাভ নেই। আমরা রাজনীতি করি, সংবাদপত্র আমাদের আশ্রয়। কোন পত্রিকায় চাকরি করি তা আদৌ মুখ্য নয়। আপনি জেহাদে যোগ দিন। জেহাদের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। সহকারি সম্পাদক আবদুল গাফফার চৌধুরী। জেলখানা থেকে আসার পর আবার নতুন করে সাংবাদিকতার জীবন শুরু হলো।
জেহাদে চাকরি পেলাম। কনিষ্ঠতম সহ-সম্পাদক। আমার নিচে কেউ স্বাক্ষর করত না। ইত্তেফাঁকে সহকারি সম্পাদক ছিলাম। জেহাদে যোগ দিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব হচ্ছে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করা। এবং সংবাদটি সংক্ষেপে গ্রহণযোগ্য করে শিরোনাম দেয়া। আমি শিরোনাম দিতে জানতাম না। আর টাইপ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। বার্তা সম্পাদক মোসলেম আলী বিশ্বাস। এডিসন সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী। প্রধান বার্তা পরিবেশক ছিলেন আসাদুজ্জামান বাচ্চু।
পত্রিকাটি মোনেম খানের সমর্থক। অর্থাৎ সরকারি পত্রিকা। মোনেম খান আইয়ুব খানের লোক। আর আইয়ুব খানের আমলেই আমি দীর্ঘদিন জেলে ছিলাম। তাই চাকরি কিছুতেই ভালো লাগছিল না। এ পত্রিকায় যোগ দেয়ার আগে ইউনিয়নের নেতা কে জি মোস্তফাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, পেশাদার সাংবাদিক হবার চেষ্টা করুন। মালিকের কথা ভেবে লাভ নেই। এ পত্রিকায় যোগ দেয়ার কিছুকাল আগে শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে মিছিল করেছি। ১৭ সেপ্টেম্বর গুলিতে ছাত্র নিহত হতে দেখেছি। সেই সরকারের আমলে সেই সরকারের কাগজে চাকরি করার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। কিন্তু এই জেহাদের চাকরিতে এসে আমার জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে গেল।
মাসটা মনে নেই। ১৯৬৩ সালের প্রথম দিকে হবে। ১৯৫৩ সালে বাড়ি থেকে এসেছি। বছর দশেক বাড়ি যাওয়া হয়নি। তাই দু’দিনের জন্যে বাড়ি গিয়েছিলাম। দুদিন পর ঢাকা এসে অফিসে গিয়ে শুনলাম একটি ছেলে আমার জন্যে ঘন্টাচারেক বসে থেকে চলে গেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না ছেলেটি কে হতে পারে। ছেলেটি বলেছিল, আমাকে নাকি তার বিশেষ দরকার।
অফিস শেষে আমি আমার ঢাকা হলের প্রাক্তন প্রভোস্ট জুলফিকার আলীর বাসায় পড়াতে গেলাম। এক সময় তার দুই কন্যা ও এক পুত্রকে পড়াতাম। পুত্রের নাম বাবু। সেই বাবুকে পড়াতে গিয়ে অনেক ঘটনাই ঘটেছে। সে ঘটনার একমাত্র সাক্ষী আমি। বাবু আইএ পাস করেছে। ইংরেজিত অনার্স পড়ছে। আমি এবার পড়াচ্ছি বাবুর তৃতীয় বোন মনুকে। পড়াতে গিয়ে দেখলাম বাড়িটা যেনো থমথম করছে। মনুকে জিজ্ঞেস করলাম বাবু কোথায়। মনু বললো, বাবু ঘুমুচ্ছে। অতবেলা পর্যন্ত ঘুমুচ্ছে কেন। আমার সন্দেহ হলো । শুনলাম বাবু তার বাবার সঙ্গে ঝগড়া করেছে। আমার আর পড়াতে হলো না। জুলফিকার আলী সাহেবের বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। কিছু দূর এগোতেই ঐ বাসার কাজের ছেলেটি ছুটতে ছুটতে এল। বললো, সাহেব আপনাক ডেকেছেন। জুলফিকার সাহেবের বাসায় ফিরে বাবুর কক্ষে ঢুকলাম। দেখলাম বাবু শুয়ে আছে। বাবু নীল হয়ে গেছে। তার টেবিলে অসংখ্য ঘুমের ট্যাবলেট পড়ে আছে। জুলফিকার সাহেবকে বললাম, স্যার আমি চলে যাচ্ছি। বাবুকে হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা করুন। বাবুকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তার জ্ঞান ফেরেনি।
দুদিন পর ঐ বাসা থেকে আমাকে ফোন করল আমার কনিষ্ঠ ছাত্রী রেনু। রেনু বলল, আপনার একটা চিঠি আছে। বাবুর ড্রয়ারে পাওয়া গেছে। আপনার নামে লেখা দশ পৃষ্ঠার চিঠি।
চিঠিটা পড়েছিলাম। বাবু লিখেছিল, স্যার আপনি বলেছিলেন আত্মহত্যা করতে হলেও আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। আপনাকে জিজ্ঞাসা করার জন্যে জেহাদ অফিসে গিয়েছিলাম। চার ঘণ্টা বসেছিলাম। শুনলাম আপনি নাকি বাড়ি চলে গিয়েছেন। তাই অনুমতি নেয়া হয়নি।
বাবু লিখেছে–এ চিঠি লেখার আমার প্রয়োজন ছিল। নইলে সকলে ভাববে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য তরুণের মতো আমি প্রেমের জন্যে আত্মহত্যা করেছি।
এরপর অনেক কথা লেখা ছিল। সে কথা পারিবারিক এবং সামাজিক। বাবু একটা ভেঙে যাওয়া সংসারের শিকার। সেই ভাঙা সংসারের কাহিনী সে দশ পৃষ্ঠায় লিখেছে। সে লেখা বড়ো করুণ, বেদনার্ত। আজকের সমাজ জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ঐ চিঠি আমি বারবার পড়েছিলাম। ফেরত দিয়েছি ঐ পরিবারকে। কারণ ঐ চিঠি রাখা বড় জ্বালা।
এ সমাজে আমি বইয়ের মানুষ। শৈশবে আমি সকল আত্মীয়-স্বজন ছেড়েছি। কারো সঙ্গে গ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। বই পুস্তকে ভালো ভালো কথা পড়েছি। আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এ জীবন বড় কঠিন। পুস্তকের উপদেশে জীবন চলে না। জীবন অনেক বাস্তব এবং কঠিন। তাই আমার কাছে যারা এসেছে তাদের বলেছি ব্যক্তি বা বাস্তব জীবনে আমাকে অনুসরণ করতে যেও না। এ সমাজ বড় নিষ্ঠুর এবং নির্দয় । তোমার কাছ থেকে ভালো ব্যবহার আশা করবে। তোমাকে ভালো থাকতে বলবে। কিন্তু তোমাকে বিশ্বাস প্রবে না। নিজেও কোনোদিন সে জীবন যাপন করবে না। এ সমাজের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই আট ঘাট বেঁধে নামতে হবে। শিশুর কোমলতা নিয়ে এ সামজের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে না। এ সমাজ কপটতায় ভরা। সংসারে থেকে সংসারের নিত্যদিনের দুঃখ দৈন্য স্নেহ ভালোবাসার সঙ্গে সমঝোতা করে এ সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা যায় না।
নিশ্চয় সে বয়সে বাবুর এ কথা বুঝবার কথা ছিল না। আর আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগে আমিও তেমন আবেগমুক্ত ছিলাম না। তাই আমার কাছে পড়তে এসে অনেকেই সামাজিক সঙ্কটের শিকার হয়েছে।
এর মধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটে গেল। একদিন জেহাদ অফিসে এসে দেখি সম্পাদকসহ দশ বারো জনের চাকরি গেছে। আমি ভাবলাম আমার চাকরিও চলে গেছে। তাই জেহাদ থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কিছু দূর যেতেই জেহাদ অফিস থেকে পিয়ন এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। আমাকে বলা হলো-আপনার চাকরি যায়নি। আমি বললাম–আমি চাকরি করব না। এতো লোকের চাকরি কেন গেল জানতে চাই। আমি প্রেস ক্লাবে কেজি মুস্তাফাকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, আপনাকে ঐ কাগজে থাকতে হবে–এটা ইউনিয়নের আদেশ।
কিন্তু পত্রিকা কে চালাবে? আমার উপরে কেউ নেই। এমনকি সালেহ দাদু পর্যন্ত নেই। ব্যক্তিগত জীবনে সালেহ সাহেব অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের বড় ভাই। জীবনে অনেক কিছু করেছেন। চাকরি করেছেন সার্কাসে। শেষ বয়সে বিয়ে করেছেন। যোগ দিয়েছেন সংবাদপত্রে। আমি সালেহ সাহেবের পাশে বসে অনুবাদ শিখতাম। হেডিং শিখতাম। আমার অন্যতম শিফট ইনচার্জ ছিলেন জনাব ফজলুল করিম। পরবর্তীকালে তিনি দৈনিক বাংলায় বার্তা সম্পাদক এবং এবং নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। টিপটপ, ছিমছাপ ভভদ্রলোক। না বুঝে কোনো কিছু করেন না। সবকিছু ভালো করে বুঝিয়ে দেন। তবে খবরদারিও করেন। অথচ তারা কেউই দৈনিক জেহাদে থাকলেন না। শুরুতেই সব প্রাচীন সাংবাদিকদের বিদায় করে দেয়া হলো।
রাতের দিকে দেখলাম তিনজন নতুন লোক এসেছেন। তাঁরা হলেন দফতরের মীর নুরুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা ও কাজী জহুরুল হক। এরা নেতৃত্ব দিয়ে কাগজ চালাতে শুরু করলেন। সবকিছুর তত্ত্বাবধায়ক আবদুল গাফফার চৌধুরী।
এর মধ্যে একদিন অঘটন ঘটল। রাতে গিয়ে দেখি কেউই আসেনি। কিন্তু কাগজ চালাবে কে? গাফফার এল। বসে বলল, আপনাকেই রাতের কাগজ চালাতে হবে, কারণ কেউ নেই। সেদিন সংবাদপত্র জগতের একটি বড় খবর ছিল। খবরটি হচ্ছে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের তাপরাধ আইন বাতিল। এ আইনটি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মতোই পুরনো। ব্রিটিশ সরকার এ আইনটি জারি করে সীমান্ত প্রদেশে। এ আইনের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন হয়েছে। অসংখ্য মানুষ জেল খেটেছে। এ আইনের বলে নির্যাতন চলেছে অব্যাহতভাবে। কিন্তু ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পরেও এ আইন বাতিল হয়নি। প্রায় দেড়শ বছর পর ১৯৬৩ সালে এ আইন বাতিল হওয়া ছিল ঐতিহাসিক ঘটনা।
আমি রাজনৈতিক তাৎপর্যের প্রেক্ষিতে এ খবরটি প্রধান খবর করলাম। হেডিং দিলাম ছ’কলাম। কিন্তু ঘাবড়ে গেলাম পরের দিন ভোরে । ঢাকার কোনো কাগজে এ খবরের দু’কলামের বেশি হেডিং করা হয়নি। আবার কোনো কোনো কাগজে এক কলামের হেডিং করা হয়েছে। দুপুরের দিকে জেহাদ অফিসে গিয়ে দেখলাম অনেকের মুখ ভার ভার ।
বিকেলের দিকে গাফফার পশ্চিম পাকিস্তানের কাগজ নিয়ে এল। পশ্চিম পাকিস্তানের কাগজে ঐ খবরটি আট কলামের ডাবল হেডিং হয়েছে। গাফফার বলল, আপনি ঠিক হেডিং দিয়েছেন। আজ রাত থেকে আপনি জেহাদের ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক। চার মাস আগে যে পত্রিকায় সর্বকনিষ্ঠ সহসম্পাদক হয়ে ঢুকেছিলাম সে পত্রিকায় ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক হওয়া সাধারণভাবে আনন্দদায়ক হলেও আমি আদৌ খুশি হতে পারিনি। কারণ এর আগে অনেক প্রবীণ সাংবাদিকের চাকরি গিয়েছে এ কাগজ থেকে। চাকরি যাওয়া আদৌ কোনো ভালো কথা নয়। আর তাঁরা চাকরিতে থাকলে ঐ পত্রিকায় আমার ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক হওয়ার প্রশ্নই উঠত না।
১৯৬২ সাল ছিল ছাত্র আন্দোলনের এক নতুন প্রস্তুতির যুগ। আমার নিজের ধারণা ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আগের যুগের ছাত্র আন্দোলনের অধ্যায় শেষ হয়ে যায়। আমাদের যুগেও সুস্পষ্ট দুটি ভাগ ছিল। আমাদের মধ্যে একটি ভাগ এসেছিল বিভাগ পূর্ব ভারতবর্ষে ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহ্য নিয়ে। আমাদের সময়কার ছিল কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি ও আরএসপির ছাত্র প্রতিষ্ঠান। অপরদিকে ছিল মুসলিম লীগের ছাত্র প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৮ সালে মুসলিম লীগের ছাত্র প্রতিষ্ঠান ভেঙে দু’ভাগ হয়ে যায়। একটি ধারা হচ্ছে আদি অকৃত্রিম মুসলিম লীগ অপর ধারাটি হচ্ছে বিদ্রোহী মুসলিম লীগ যারা ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠন করে। আসামের মুসলিম লীগ নেতা মওলানা ভাসানী পূর্ব বাংলায় আসার পৰু এ গ্রুপের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এই ভাগাভাগির ফলে ছাত্র আন্দোলনের ৩ বার তিনটি ধারার সৃষ্টি হয়। একটি ধারা হচ্ছে–আদি অকৃত্রিম মুসলিম লীগের ধারা। দ্বিতীয়টি আওয়ামী মুসলিম লীগ ধারার সঙ্গে বামপন্থী ধারার ঐক্য হয়ে সগ্রামের ক্ষেত্র। মুসিলম লীগের ধারা ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে পরাজয়ের পর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পরবর্তীকালে এই ধারা গড়ে ওঠে ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন অর্থাৎ এনএসএফ এবং অসাম্প্রদায়িক ধারার প্রতিষ্ঠান। ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। এ সকল সংগঠনের নেতাদের সংগঠনের বাইরেও একটি রাজনৈতিক স্বীকৃতি ছিল। এদের সঙ্গে ১৯৫২ সালের পর আর একদল ছাত্র, ছাত্র রাজনীতিতে আসে। তারাও পুরানো নেতৃত্বকে পরিহার করতে পারেনি। আমার ধারণা পুরনো নেতৃত্বের অবসান ঘটে সামরিক শাসন জারি হবার পর।
আজকের বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ছাত্ররা অনেক সময় জাতীয় নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছে। বিরোধী রাজনীতির অঙ্গনে শূন্যতার ফলে ছাত্রদের অনেক সময় বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এ ভূমিকা খুব স্পষ্ট ছিল। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর নির্বাচিত নেতারাই রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। আমাদের ভূমিকা তখন গৌণ হয়ে যায়। ছাত্ররা জাতীয় রাজনীতির পরিবর্তে দলীয় রাজনীতির অঙ্গে পরিচিত হয়। যার ফলে ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী বনাম মওলানা ভাসানীর বিতর্ককে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে মারামারি হয়। এভাবে ছাত্র প্রতিষ্ঠানের নেতারা সামগ্রিক অর্থে ছাত্রদের নেতা না হয়ে গ্রুপ নেতায় পরিণত হয়।
এ পরিস্থিতি চলতে থাকে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সামরিক শাসনকে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়। তল্কালীন ছাত্র নেতৃত্বও সামরিক শাসনবিরোধী কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। ১৯৫৯ সালে জেলে য়াবার পূর্বে আমিই লক্ষ্য করেছি প্রতিটি সংগঠনের অনাস্থা সামরিক শাসন ছিল তাদের কাছে অপ্রত্যাশিত। এ সামরিক বাহিনীকে মোকাবেলা করার কোনো কৌশল তাদের জানা ছিল না।
এর প্রতিফলন ঘটে ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন কোনো সরকার উচ্ছেদের আন্দোলনের মুখোমুখি দাঁড়ায়নি। কোনো নির্দিষ্ট দাবির জন্যে লড়েচ্ছে এবং সবশেষে পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচনে যুক্ত ফ্রন্টকে জিতিয়ে আনতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের মুখোমুখি দাঁড়ায়নি। ১৯৫৩ সালের পূর্ব পর্যন্ত ছাত্র প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ব্রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলেও সর্বক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শ মতো চলত না। তাদের কিছুটা স্বকীয়তা এবং স্বাধীনতাও ছিল। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হবার পর এ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র ছাত্র আন্দোলনই যথেষ্ট নয়। এ আন্দোলন রাজনৈতিক দলের সার্বিক সহযোগিতা এবং নেতৃত্ব প্রয়োজন। এই দোদুল্যমানতায় পড়ে ছাত্র আন্দোলন যেমন থমকে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক নেতৃত্বও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে।
এমনি করে ৬২ ও ৬৩ সাল কেটে যায়। এই দু’টি বছরের ইতিহাস রাজনীতির ক্ষেত্রে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস। সামরিক সরকার তখন ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। বিভিন্ন আইনে রাজনীতিবিদদের আটকে ফেলছে। রাজনীতি করা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কারণ আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজনীতিকদের আন্দোলনের তেমন ঐতিহ্য ছিল না। বামপন্থী ছাড়া ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এদের ভূমিকা ছিল গৌণ। অনেকেরই জেলে যাওয়া শুরু হয় ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। মুসলিম উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সন্তানেরা তখন আন্দোলনের সামনে আসতে থাকে। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত হাজার হাজার রাজবন্দি ছিল পূর্ব পাকিস্তান জেলে। এর মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। সে অর্থে মুসলিম সম্প্রদায়ের জেলে যাওয়া শুরু হয় ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। সে ইতিহাসও খুব দীর্ঘ নয়। দীর্ঘ নয় বলে ত্যাগ তিতিক্ষার প্রশ্নটি গৌণ হয়ে যায়। সরকারি হামলা এলেই শুরু হয় পিছু হাঁটা। শুরু হয় আত্মসমর্পণ। তাই দেখা যায় ভাষা আন্দোলনের অনেক সংগ্রামী নেতাকে সরকারি চাকরি নিতে। এমনকি পূর্ব বাংলার এককালীন প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে দেখা যায় সামরিক সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করতে। এই পটভূমিতেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে ওঠা ছিল সময়সাপেক্ষ।
অপরদিকে প্রথম থেকেই সামরিক শাসকেরা ছিল শংকিত। সামরিক শাসন উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়। তাই তাতে জনসমর্থন থাকার কথা নয়। তারা ভয় দেখিয়ে অর্থ এবং পদ দিয়েই রাজনীতিকদের দলে ভেড়াতে চেষ্টা করে। আইয়ুব খানেরা ক্ষমতায় এসে সে কাজটি করেছিলেন।
কিন্তু জনসমর্থনহীন কোনো সরকারই দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে পারে না। সে ঘটনাই ঘটল ১৯৬২ সালে। এ সময় আমার চাকরির অবস্থানের পরিবর্তন হয়। জেহাদের মালিক পরিবর্তন হয়। নতুন মালিক ইব্রাহিম তাহা। এককালে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের প্রার্থী। তাই আমার সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত। তাহা সাহেবের বড় ভাই এটিএম মোস্তফা তখন আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভার সদস্য। সুতরাং চাকরিটি আমার জন্যে সুখকর ছিল না। ইচ্ছে হলেই সবকিছু লেখা বা ছাপানো যেত না। আবদুল গাফফার চৌধুরী তখন চাকরি ছেড়ে গেছে। সম্পাদক তখন আবুল কালাম শামসুদ্দিন। এই মানুষটিকে তখন আমি বড় কাছ থেকে দেখেছিলাম।
১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাস। ভারতে দাঙ্গা শুরু হয়েছে কাশ্মীরের হযরত বাল মসজিদ নিয়ে। প্রতিদিন দাঙ্গার খবর আসছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার আগে শামসুদ্দিন সাহেব আমার দরজায় দাঁড়াতেন। বলতেন, নির্মল বাবু, সাবধানে থাকবেন। পত্রিকার প্রথম পাতায় দাঙ্গার খবর দেবেন না। দাঙ্গা হলে সকলের সর্বনাশ হবে। ধীরলয়ে কথাগুলো বলে শামসুদ্দিন সাহেব বাড়ি চলে যেতেন। আমি ভাবতাম, এ লোকটি কি সত্যি সত্যি আমার চেনা? শৈশব থেকে জেনেছি আবুল কালাম শামসুদ্দিন আজাদের সম্পাদক। আজাদ মুসলিম লীগের পত্রিকা। আজাদের ভূমিকা সাম্প্রদায়িক। সুতরাং শামসুদ্দিন সাহেব অসাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। পরে জেনেছিলাম শামসুদ্দিন সাহেব অসহযোগ আন্দোলনের সময় ব্রিটিশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি ডিগ্রি নিয়েছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
এর মধ্যে একদিন একটি ভিন্ন ঘটনা ঘটল। গভীর রাতে খবর এল দাঙ্গার জন্যে মধ্য কলকাতায় সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। আমি একটু হতচকিয়ে গেলাম। সম্পাদক সাহেবকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, খবরটি প্রথম পাতার প্রথম সংবাদ করুন। কিন্তু দু’কলামের বেশি হেডিং করবেন না।
দাঙ্গা থামানো গেল না। পূর্ব পাকিস্তানেও দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল। পূর্ব পাকিস্তানের দাঙ্গার পেছনে একটি ভিন্ন রাজনৈতিক লড়াই ছিল। লড়াই ছিল খুলনার সবুর খান ও গভর্নর মোনেম খানের সঙ্গে নেতৃত্বের। মোনেম খান তখন রাওয়ালপিন্ডিতে। অনেকের ধারণা এই সুযোগে সবুর খান খুলনার খালিশপুর শিল্প এলাকায় অবাঙালিদের নিয়ে দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়। সে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে আদমজী এলাকায় এবং ঢাকার আশপাশে। দাঙ্গা থামাবার জন্যে সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদদের সভা বসে প্রেস ক্লাবে। সিদ্ধান্ত হয় দাঙ্গাবিরোধী সামবেশ ও মিছিল করার। সিদ্ধান্ত হয় দাঙ্গার বিরুদ্ধে একটি আহ্বান জানাবার। সে আহ্বান সকল পত্রিকায় ছাপানো হয় এবং রাজনৈতিক ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ দেখা করবেন গভর্নর মোনেম খানের সঙ্গে।
সেদিন রাতে ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’–এই শিরোনামে সেই আহ্বান জানানো হয়। আমাদের পত্রিকা জেহাদে সেই আহ্বান ছাপানো সম্ভব হয়নি মালিকের নির্দেশে। সেদিন দাঙ্গা আরো ছড়িয়ে পড়ে। সেদিনই গভর্নর মোনেম খান ঢাকায় ফিরে আসেন। রাতে সম্পাদকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে অবিলম্বে দাঙ্গা থামানোর অনুরোধ জানান। রাজনীতিবিদদের নেতৃত্ব করছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি গভর্নর মোনেম খানকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে দাঙ্গা থামাবার চরমপত্র দেন। সত্যি সত্যি ২৪ ঘন্টার মধ্যে মোটামুটিভাবে দাঙ্গা থেমে গিয়েছিল। প্রমাণিত হয়েছিল দাঙ্গা লাগানো এবং থামানো সবকিছুই মুখ্যত সরকারের ওপর নির্ভর করে।
এ সময়ের দুটি ঘটনা আমার এখনও মনে আছে। সেদিন রাতে আমি দৈনিক জেহাদের কাজ করছিলাম। গভীর রাতে অগ্নিযুগের নেতা মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর একটি বিবৃতি এলো। উপমহাদেশের জীবিত বিপ্লবীদের মধ্যে তখন মহারাজ ছিলেন বয়োজ্যষ্ঠ নেতা। তিনি ব্রিটিশ আমলে ৩০ বছর জেল খেটেছেন। তিনি হেমেন দাশ রোডে থাকতেন। দাঙ্গায় আশ্রয়হীন হয়ে শিবির থেকে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন নিজের দেশ আশ্রয় শিবিরে থাকার জন্যে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন করিনি। তাঁর এ বিবৃতিও আমি ছাপাতে পারিনি।
ভোরবেলা সান্ধ্য আইন এড়িয়ে জগন্নাথ হলের দিকে যাচ্ছিলাম। পথে দেখলাম সান্ধ্য আইনের মধ্যেই ড, আবু মাহমুদের লাল গাড়িটি দক্ষিণ দিকে ছুটছে। ড, মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। আমাদের প্রিয় শিক্ষক। আমি গাড়িটি থামালাম। স্যার চিৎকার করে উঠলেন। বললেন, নির্মল সাবধানে হলে যাও। আদমজীতে দাঙ্গা হচ্ছে। আমি আদমজীর দিকে যাচ্ছি। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক একেবারে একা একটি গাড়ি নিয়ে ছুটছেন দাঙ্গা থামাতে। তিনি যাচ্ছেন আদমজীতে। আদমজীর শ্রমিকেরা দাঙ্গা করছে। আর ঐ আদমজীর শ্রমিকদের নিয়েই মাত্র ৬ মাস পরে ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে আমরা পাকিস্তানের বৃহত্তর ধর্মঘট করেছিলাম এবং সে ধর্মঘটে জিতেছিলাম।
আমি তখন জগন্নাথ হলে থাকি। এই উপকারটুকুও ড. মাহমুদ হোসেন করেছিলেন। ভাইস চ্যান্সেলর ড. মাহমুদ হোসেনের সহযোগিতায় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ভর্তি হতে পারব কিন্তু হলে থাকতে পারব না। এ পরিস্থিতিতে আমি ঢাকায় হলের বাইরে পুরনো মোগলটুলিতে থাকতাম। এক সময় গভর্নর মোনেম খানের সঙ্গে ভাইস চ্যান্সেলরের অনুমতি না নিয়ে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকে পড়ে। প্রতিবাদে ড. হোসেন পদত্যাগ করেন। ঢাকা ছেড়ে যাবার আগে তিনি ড. গোবিন্দ দেবকে ফোন করেন এবং বলেন, নির্মল খুব অসুবিধায় আছে। পারলে তাকে একটা সিট দেবেন। ড. গোবিন্দ দেব আমাকে ডেকে একথা জানালেন এবং বললেন, তুমি সিট পাবে কিন্তু হলে যেতে পারবে না।
ড. গোবিন্দ দেব কেনো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা আমি কোনোদিন জানতে চেষ্টা করিনি। ড. হোসেন কেন এ ধরনের অনুরোধ করেছিলেন তাও আমি জানি না। কারণ ড. হোসেনের সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হয়নি। তবে সিট পেয়েও আমার সঙ্কট কাটেনি। সকাল সাড়ে আটটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে যেতে হতো। ১২টায় জেহাদ অফিসে যেতে হতো। হলে ফিরতে রাত তিনটায়। হলের গেটে তালা দেয়া থাকত। কী করে প্রতিরাতে ঐ হলে আমি ঢুকতাম আমি ব্যতীত ঐ হলের দারোয়ানও তা জানত না। তবে আমি এ পরিস্থিতিতে পড়াশুনা চালিয়ে গেলেও সরকার আমাকে কোনোদিনও করুণা করেনি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো জেহাদে সরকারি পত্রিকা হওয়া সত্ত্বেও ঐ পত্রিকায় আমি বিরোধী দলের খবর বেশি দিচ্ছি।
পত্রিকার নাম জেহাদ। পত্রিকার মালিক ইব্রাহিম তাহা। তার বড় ভাই এটিএম মোস্তফা কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী। সুতরাং এ কাগজে বিরোধী দলের খবর বড় হতে পারবে না। বড় করে ছাপাতে হবে সরকারি খবর। রাওয়াল পিন্ডিতে খবর দিয়েছেন, আমি সে নীতি অনুসরণ করছি না। পরপর চল্লিশটি বিরোধী দলের খবর বড় করে ছাপিয়েছি। ছোট করেছি সরকারি খবর। এ খবর উচ্চ মহলে দিয়েছেন মরহুম সাদেকুর রহমান। তিনি তথ্য দফতরের অধিকর্তা।
একদিন তাহা সাহেব আমাকে একথা বললেন। বললেন, মন্ত্রিসভায় কথা উঠেছিল। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছিলেন জেনারেল আইয়ুব খান। তিনি নাকি মোস্তফা সাহেবকে বলেছেন, নির্মল সেন বার্তা সম্পাদক থাকলে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাবে। এ কথা মোস্তফা সাহেব তাহা সাহেবকে জানিয়েছেন। তাহা সাহেব বলেছেন, নির্মল সেন বার্তা সম্পাদক থাকবে। সরকারি চাপে তাকে আমি সরাব না।
ইতোমধ্যে একদিন একটি পার্টিতে আমি আমন্ত্রণ পেলাম। পার্টি হচ্ছিল শাহবাগ হোটেলে। বর্তমানে পিজি হাসপাতাল। সে পার্টি ছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় তথ্য সচিব আলতাফ গওহরের সম্মানে। আলতাফ গওহর পাকিস্তানে তখন জাদরেল আমলা। সাদেকুর রহমান সাহেবও ছিলেন। এক সময় শহীদুল্লাহ কায়সার আলতাফ গওহরের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সাদেকুর রহমান তখন সামনেই ছিলেন। আমাকে দেখে আলতাফ গওহর বললেন, আপনিই সেই নির্মল সেন। এরপর কথায় কথা উঠল। আমি বললাম সাদেকুর রহমান সাহেবের অভিযোগ সত্য নয়। কোনো পক্ষেরই গুরুত্বহীন খবর আমি গুরুত্ব দিয়ে ছাপাতে অভ্যস্ত নই। সাদেকুর রহমান সাহেব তাঁর অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে আমি চাকরি ছেড়ে দেব। সাদেকুর রহমানের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি আমতা আমতা করতে থাকলেন। তবে এতে জেহাদের অবস্থার উন্নতি হয়নি। পরবর্তীকালে জেহাদ বন্ধ হয়ে গেল নানা কারণে।
তখন জেহাদ অফিস থেকে সোনার বাংলা নামে একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ শুরু হলো। এই সাপ্তাহিকের সকল দায়িত্বে ছিলেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী। ঐ কাগজে চাকরি করতেন অভিনেতা নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুন ও এককালের চিত্রালী সম্পাদক জনাব আহমেদুজ্জামান চৌধুরী। কাগজটি সেকালের সাপ্তাহিকদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।
হঠাৎ কাগজটির মালিকানা পরিবর্তন হলো। মালিক হলেন আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক হাফেজ হাবিবুর রহমান। তাহের উদ্দীন ঠাকুর তখন ইত্তেফাঁকের স্টাফ রিপোর্টার। তিনি একদিন আমার সঙ্গে কথা বললেন। বললেন, আমাকে বিকালের দিকে পুরানা পল্টনে আওয়ামী লীগ অফিসে শেখ মুজিবুর রহমান ডেকেছেন। বিকেলে আমি আওয়ামী লীগ অফিসে গেলাম। শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি বললেন–হাবিবুর রহমান সাহেব আমার বন্ধু। তিনি সোনার বাংলা কিনেছেন। আপনাকে একটু সহযোগিতা করতে হবে। আমি সোনার বাংলায় যোগ দিলাম। আমিই সর্বময় কর্তা। কিন্তু পেছনের কর্তা জনাব তাহের উদ্দীন ঠাকুর। সোনার বাংলায় লিখতেন জনাব তাহের উদ্দীন ঠাকুর এবং ইত্তেফাঁকের মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী। নীতি নির্ধারণও তাঁরা করতেন।
সোনার বাংলায় যোগ দেবার দিন আমার নিজেকে বড় ছোট মনে। হয়েছিল। আমি যাবার পরে আবদুল্লাহ আল মামুন ও আহমেদুজ্জামান চৌধুরীকে সোনার বাংলা ছেড়ে যেতে হয়। এ কথা আগে জানলে আমি হয়তো সোনার বাংলায় যেতাম না।
তবে সোনার বাংলায়ও আমার বেশিদিন থাকা হয়নি। সামরিক শাসনের আট বছর চলছে। ১৯৬৪ সালে এসে আইয়ুব খান বুঝতে পেরেছিল পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। তাই সংবাদপত্র জগতকে নিজেদের কজায় রাখার জন্যে সামরিক শাসকেরা এক নতুন কৌশল অবলম্বন করল। পাকিস্তানের বৃহৎ পুঁজিপতিদের সমন্বয়ে সৃষ্টি হলো পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্ট। এই প্রেস ট্রাস্টের অধীনে এলো পশ্চিম পাকিস্তানের ৯টি সংবাদপত্র ও পূর্ব পাকিস্তানের মর্নিং নিউজ এবং একটি নতুন বাংলা দৈনিক বের করার সিদ্ধান্ত হলো ঢাকা থেকে। এই দৈনিকের নাম দৈনিক পাকিস্তান। দৈনিক পাকিস্তানের বার্তা সম্পাদক হয়ে এলেন মোজাম্মেল হক। তিনি ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে প্রথম জীবন পর্যন্ত সার্বক্ষণিক রাজনীতিক ছিলেন। তিনি বরিশালে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল আরএসপি করতেন। তার কাছেই আমার। রাজনীতির হাতেখড়ি। তার জীবনে তখন অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। দেশ। ভাগ হবার পর তিনি ভারতে চলে যান। এক সময় আরএসপির মুখপত্র দৈনিক গণবার্তার প্রধান প্রতিবেদক হন। ১৯৫২ সালে ভারত ও পাকিস্তান থেকে ফিরে আসেন এবং সংবাদপত্রে যোগ দেন। এক সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তখন তিনি দৈনিক আজাদে কাজ করতেন। দৈনিক আজাদের মালিকের সঙ্গে বিরোধ হওয়ায় তিনি চাকরি হারান। দীর্ঘদিন সংবাদপত্রের বাইরে থাকার পর তিনি দৈনিক পাকিস্তানের বার্তা সম্পাদক হয়ে আসেন। সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। এ পত্রিকায় আমাকে নেয়ার ইচ্ছা থাকলেও মোজাম্মেল দা কোনোদিনই দৈনিক পাকিস্তানের চাকরির কথা বলেননি। তিনি জানতেন আমাকে নিতে অনেক বাধা আছে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত দৈনিক পাকিস্তানের মালিকদের গরজেই আমাকে নেয়ার প্রস্তাব এল। প্রস্তাব করলেন আইয়ুব খানের একজন একান্ত ব্যক্তি জামালউদ্দিন আলী ও পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের এককালের সভাপতি সালাউদ্দীন মোহাম্মদ। তাদের বক্তব্য হচ্ছে–সাধারণত সরকারপন্থী পত্রিকা সাম্প্রদায়িক হয়। সে ক্ষেত্রে নির্মল সেনকে টেবিলে বসিয়ে রাখলে হয়তো সাম্প্রদায়িকতার ঝাঁঝ একটু কম থাকবে। অপরদিকে এ পত্রিকায় বামপন্থীদের নেয়া হলে এর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। তাই এ পত্রিকায় প্রথম থেকেই এসেছিলেন শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আহম্মেদ হুমায়ুন, তোয়াব খান প্রমুখ। আমি চাকরি পেলাম, শিফট-ইন-চার্জ।
কিন্তু দৈনিক পাকিস্তানে যোগ দেয়ার আগে আমি অন্যত্র কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দলের সিদ্ধান্ত ছিল শ্রমিক ফ্রন্টে কাজ করার। ঢাকায় নেপাল নাহা চলে এলেন। এলেন মিসির আহম্মদ। গঠিত হলো পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশন। প্রেসিডেন্ট হাসেম মোল্লা, ভাইস প্রেসিডেন্ট মওলানা সাইদুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার আব্দুল কাদের, সহকারি সম্পাদক আবদুল মান্নান, কোষাধ্যক্ষ হলেন রুহুল আমিন কায়সার। এই আব্দুল মান্নানই পরে লালবাহিনী মান্নান বলে খ্যাত। এই চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকেই ১৯৬৪ সালের ২ জুলাই পাঁচ দফা দাবির প্রেক্ষিতে ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। এই হরতাল ২২ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এই হরতালকে কেন্দ্র করে অনেক ঘটনা ঘটে। তখন আমার চাকরি ছিল না। দৈনিক পাকিস্তানে যোগ দেয়ার প্রশ্নই ওঠেনি।
১৯৫৪ সালের ১৪ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। এ দাঙ্গায় আমাদের দেশের শ্রমিক সমাজ অংশগ্রহণ করেছিল। আদমজী শ্রমিকদের ভূমিকা আদৌ গৌরবজনক ছিল না।
জুলাই মাসে এ চটকল শ্রমিকদের নিয়েই আমরা আন্দোলন শুরু করলাম। আগে চটকল শ্রমিকদের নিম্নতম বেতন ছিল মাসে ৬৫ টাকা। আমরা দাবি করলাম মাসিক বেতন ৮১ টাকা হতে হবে। আমাদের দাবির ভিত্তি ছিল ৫ মণ চালের দাম। তখন চাল ছিল ১৫ টাকা মণ। ৮১ টাকা বেতন হলে ৫ মণ চাল কিনেও ৬ টাকা হাতে থাকে। আজো দাবি দাওয়ার আন্দোলনে শ্রমিকরা নিম্নতম মজুরি হিসেবে ৫ মণ চালের দাম দাবি করে থাকে। এ ভিত্তি নির্ধারিত হয় আমাদের আন্দোলনে।
১৯৬৪ সালে ২ জুলাই দেশবাসী বিস্মিত হয়ে যায়। কঠিন সামরিক শাসনের মধ্যে ৫টি চটকলে ধর্মঘট হয়ে গেল। নেতৃত্ব করছে পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশন। একেবারেই নতুন এবং অচেনা। ইতোপূর্বে পূর্ব পাকিস্তানে চটকল শ্রমিকদের নেতা ছিলেন আলতাফ আলী ও ফয়েজ আহমদ। তাদের সঙ্গে ছিলেন খোন্দকার আব্দুল কাদের। কাদের সাহেব তাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমাদের সঙ্গে আসেন। চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সভাপতি ছিলেন হাশেম মোল্লা। ধর্মঘট শুরু হবার আগে হাশেম মোল্লা পদত্যাগ করেন। সহসভাপতি মওলানা সাইদুর রহমান সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৬৪ সালের ধর্মঘট ছিল অভূতপূর্ব। পরদিন ইংরেজি দৈনিক অবজারভার লিখেছিল–গতকাল আদমজীর আকাশে একটি কাকও উড়েনি। ৫টি চটকলের ধর্মঘট ছিল সর্বাত্মক। এই পাঁচটি চটকল হলো আদমজী, ঢাকা, করিম, ফেব্রিকস এবং রাওয়া। এ ধর্মঘট সবাইকে হতচকিত করে দিল। প্রশ্ন দেখা দিল এ ধর্মঘটের নেতৃত্বে কারা। সকলের ধারণা ছিল এদেশ বামপন্থী আন্দোলন মানে কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলন। সব ধর্মঘটই কমিউনিস্ট পার্টি করে থাকে। কিন্তু দেখা গেলো এ ধর্মঘটে তাদের পাত্তা নেই। তাদের সঙ্গে ধর্মঘটের কোনো সম্পর্ক নেই। সেকালের কমিউনিস্ট পার্টি একটি শ্রমিক সংগঠন গড়ে তুলেছিল। সে সংগঠনের নাম পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক পরিষদ। এ সংগঠনের সভাপতি ছিলেন মরহুম মোহাম্মদ তোয়াহা এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জনাব সিরাজুল হোসেন খান। এদের চটকল নেতা ছিলেন আবুল বাশার। এ সংগঠন পরবর্তীকালে মস্কোপন্থী এবং পিকিংপন্থী হিসেবে ভাগ হয়ে যায়। মস্কোপন্থীরা সহিদুল্লাহ চৌধুরী ও সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিকের নেতৃত্বে ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র গঠন করেন। অপরদিকে পিকিংপন্থীরা গঠন করেন পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন। এই ফেডারেশনের পরবর্তীকালে একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। নেতৃত্বের কোন্দলে কাজী জাফর ও আবুল বাশার ভিন্ন সংগঠন গঠন করেন।
এদের রাজনীতির সঙ্গে আমাদের বা পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমরা যারা এককালে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল (আরএসপি) করতাম তাদের ইতিহাস এদের লেখায় কোনোদিন স্থান পায়নি। অথচ বিভাগ পূর্ব যুগেও গোদনাইল এলাকায় বস্ত্র মিলগুলোতে আরএসপির শক্তিশালী সংগঠন ছিল। ১৯৬৪ সালের চটকল ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে শ্রমিক ফ্রন্টে আরএসপির অভ্যুদ্বয়ে এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
উল্লেখ্য, ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের নেতৃত্বে ৩টি বড় ধর্মঘট হয়। এই ধর্মঘট ছিল। ৬৯-এর শ্রমিক এলাকার গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে আমাদের বিভিন্ন বামপন্থী লেখকেরা চটকল ধর্মঘটের এ যুগটিকে আদৌ বিবেচনায় আনেন না। আমাদের দেশে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যসহ অনেকেই শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস লিখেছেন কিন্তু এ পর্বটি সমতলে বাদ দিয়েছেন। কোনোমতে পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশন সম্পর্কে দু’এক লাইন লিখে ইতিহাস শেষ করেছে। আরএসপি বা আমাদের কোনো উল্লেখই এ লেখাগুলোতে নেই। অথচ পাকিস্তানের ২৩ বছরে উল্লেখ করার মতো শ্রমিক আন্দোলন তেমন হয়নি। উল্লেখযোগ্য ছিল ঐ ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত চটকল শ্রমিক আন্দোলন। এই আন্দোলনই পরবর্তীকালে অন্য আন্দোলনের জন্ম দেয়। তবে শ্রমিক আন্দোলনের জন্য এই আন্দোলনেরই অবশ্যাম্ভাবী পরিণতি টঙ্গী শিল্প এলাকায় কাজী জাফরদের আন্দোলন এবং খুলনা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত আমাদের চটকলের আন্দোলনই ছিল শিল্পাঞ্চলে বড় ধরনের ঘটনা। কিন্তু রাজনৈতিক সংকীর্ণতার ফলে সেকালে চটকল আন্দোলন কাহিনী কোনো দিনই সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি।
উপরের ঘটনা থেকে পরিষ্কার যে আমরা এককভাবেই ধর্মঘট শুরু করেছিলাম। আমরা আরএসপির সদস্যরা তখন তেমন সংগঠিতও ছিলাম না। তাই প্রতি পদে পদে আমাদের বিপদে পড়তে হচ্ছিল। ধর্মঘট শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেশনের সম্পাদক খোন্দকার আবুল কাদের গ্রেফতার হয়ে যান। ধর্মঘট ১২ দিন অতিবাহিত হলে তিনি জেলখানা থেকে বিবৃতি দিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন এবং মুক্তিলাভ করেন। আমরা সেদিন ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিলাম। পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার আবুল কাদেরকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হলো। অস্থায়ী সম্পাদক হলেন সহকারি সম্পাদক আব্দুল মান্নান। আমরা ধর্মঘট চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের এ সিদ্ধান্ত সকল মহলে আর এক দফা বিস্ময়ের সৃষ্টি করল। ইতোমধ্যে আমরা বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলাম। পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক পরিষদের সিরাজুল হোসেন খান, রেল শ্রমিক নেতা মাহবুবুল হক সমঝোতার জন্যে একটি কমিটি গঠনের চেষ্টা করলাম। তারা বৈঠক করলেন গভর্নর মোনেম খানের সঙ্গে। কিন্তু আলোচনা সফল হলো না। পরবর্তীকালে আমরাই গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে বসলাম। মালিক পক্ষ এলেন। ২০ দিন ধর্মঘটের পর ২২ জুলাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। মালিক পক্ষ রাজি হলেন আপাতত ৮ টাকা বেতন বৃদ্ধি করা হবে। শ্রমিকদের কাছে ছিল এটা এক অপ্রত্যাশিত বিজয়। ইতিপূর্বে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার আমলে শেখ মুজিবুর রহমান শ্রমমন্ত্রী থাকাকালে চটকল শ্রমিকদের বেতন বেড়েছিল ১ টাকা ২৫ পয়সা। আর ১৯৬৪ সালে বেতন বৃদ্ধি হলো ৮ টাকা। ইত্তেফাক আট কলাম হেডিং লিখলেন চটকল শ্রমিকদের কাছে মালিক পক্ষের নতি স্বীকার। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এ বিজয় আমাদের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসের বইতে নেই।
তবে আন্দোলন এখানেই শেষ হলো না। মালিকপক্ষ দু’মাসের মধ্যে আমাদের দাবি-দাওয়া মেনে নিল। অক্টোবরে আমাদের দ্বিতীয়বারের জন্যে ধর্মঘটে যেতে হলো।
এবার শুধু ৫টি কলেই নয়, দেশের অধিকাংশ চটকলেই ধর্মঘট হয়েছিল। এ ধর্মঘট চলছিল দীর্ঘ ৫৫ দিন।
তবে এর পরেও ধর্মঘট করতে হলো। এবার ধর্মঘট হলো ১৯৬৫ সালে। এবারও দাবি বেতন বৃদ্ধির। ১৯৬৪ সলের দ্বিতীয় ধর্মঘটে বাকি ৮ টাকা বেতন বৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ করা গেলো বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই পণ্য মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। চালের দাম বাড়ছে। ৮১ টাকায় আর ৫ মণ চাল পাওয়া যায় না এবং সেই প্রেক্ষিতেই ১৯৬৫ সালে আবার ধর্মঘটে গেল চটকল শ্রমিকরা। এবার সারাদেশে চটকল শ্রমিক ধর্মঘট। পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশন তখন অসম্ভব জনপ্রিয়। কোথাও আমাদের যেতে হয় না। শ্রমিকেরা আমাদের সঙ্গে ইউনিয়ন নির্বাচন করে এবং জয়লাভ করে। চট্টগ্রামের কিছু কিছু এলাকা ব্যতিত খুলনা থেকে শুরু করে আদমজী, কাঞ্চন, নরসিংদী, ঘোড়াশাল সর্বত্রই পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশন-এর অপ্রতিহত প্রভাব। তাই এবারের ধর্মঘটে সকল প্রতিষ্ঠানকে সমর্থন দিতে হলো। ফয়েজ আহমেদের শ্রমিক প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। বাকি ছিল চট্টগ্রামের আবুল বাশারের চটকল শ্রমিক সংগঠন। শেষ পর্যন্ত তারাও আমাদের সমর্থন দেয়।
তবে এই ধর্মঘটে তারা ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করে। ধর্মঘট পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশন আহ্বান করেছিল। আমরাই এ ধর্মঘটের নেতৃত্ব ছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে আমি সংবাদপত্রের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলাম। আমি তখন দৈনিক পাকিস্তানে কাজ করি। হঠাৎ একদিন শোনা গেলো তোয়াহা সাহেব এবং বাশার সাহেব চট্টগ্রামে বাওয়ানী জুটমিলের মালিক ওয়ানির সঙ্গে বসেছেন এবং একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছেন। এই চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছেন রাশেদ খান মেননের ভাই জনাব আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। তিনি তখন চট্টগ্রামের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তাঁর দফতরেই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো অথচ আমাদের কিছুই জানানো হলো না। শুনেছি মেনন ছাত্রনেতা হিসেবে এ চুক্তির বিরোধিতা করেছিল।
আমার কাছে ঘটনাটি খুব অস্বাভাবিক মনে হয়নি। তখন কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্ব হচ্ছে জাতীয় গণতান্ত্রিক ও জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব। এই দুই বিপ্লবের সহযোগী জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি। এই জাতীয় বুর্জোয়াদের অন্যতম নেতা ইস্পাহানির সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্ক বহুল আলোচিত। ইস্পাহানিরও চটকল আছে। সেই চটকলেও ধর্মঘট হচ্ছে। সুতরাং জাতীয় বুর্জোয়ার প্রতিনিধি হিসেবে বাওয়ানীর সঙ্গে কমিউনিস্ট প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠনের চুক্তি আমার কাছে খুব বিষ্ময়কর মনে হয়নি। তবে বিস্মিত হয়েছিলাম একটি কারণে–কী করে আমাদের না জানিয়ে যারা আমাদের ধর্মঘট সমর্থন করলো তারাই চুক্তি স্বাক্ষর করল। এটা কোন ধরনের শ্রমিক রাজনীতি! এ জন্যে চট্টগ্রাম চুক্তির নেতাদের আজও কথা শুনতে হয়। সেটা ছিল চটকল শ্রমিক আন্দোলনের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়।
তবে ঐ চুক্তি আমরা মানিনি। তোয়াহা সাহেব ধর্মঘট প্রত্যাহার করার জন্যে প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। একজন সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিল যে ধর্মঘট আপনারা ডাকেননি সে ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন কী করে? তোয়াহা সাহেব কোনো জবাব দিতে পারেননি। সাংবাদিক সম্মেলন থেকেই এক বন্ধু আমাকে ফোন করে জানান যে তোয়াহা সাহেব ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন আর সঙ্গে সঙ্গে আমি পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে ঘোষণা করি যে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়নি, ধর্মঘট চলছে। ফলে চট্টগ্রামে শ্রমিক কাজে যোগ দিলেও আদমজীতে ধর্মঘট চলতে থাকে।
আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে আমরা চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করব না কিন্তু কাজে যোগ দেব। প্রয়োজন হলে পরবর্তীকালে আবার ধর্মঘটে যাব। সরকার পক্ষে চারজন মন্ত্রী লিখিতভাবে আমাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানান। জানান যে আপনারা চুক্তি স্বাক্ষর না করলেও আপনাদের দাবি নিয়ে আলোচনা করা হবে। আমরা আদমজীতে ৫০ হাজার শ্রমিকের জনসভা করে চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর না করেই কাজে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু মালিক পক্ষ চুক্তি স্বাক্ষর না করে মিলে ঢুকতে দিতে অস্বীকার করেন। এরপরও ৭ দিন ধর্মঘট চলে। মালিক আমাদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়। শর্ত হচ্ছে আমাদের কোনো শ্রমিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। আমরা চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করব না। আমাদের সঙ্গে নতুন করে আলোচনায় বসতে হবে।
এ ধর্মঘটের সময় আমাদের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়। আমরা এই অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি যে রাজনীতির জগতে আমরা নিতান্তই একাকী। শ্রমিক আন্দোলনে সবাই সহযোগিতা করলেও রাজনীতির সঙ্গে আমাদের আবির্ভাব কেউ পছন্দ করছিল না। এসময় বিপদে পড়ে আমরা কাগমারিতে মওলানা ভাসানীর কাছে লোক পাঠিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন–কোনো সাহায্য করার ক্ষমতা আমার নেই। একটি বিবৃতিও আমরা তাঁর কাছ থেকে আদায় করতে পারিনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এক বন্ধুকে নিয়ে এক ভোরে শেখ মুজিবের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি অক্ষমতা জানিয়ে দিলেন সাহায্য সহযোগিতা করতে। আমাদের সামান্য কিছু টাকা সাহায্য হিসেবে দিতে চেয়েছিলেন। সে টাকা না নিয়ে আমরা ফিরে এসেছিলাম। এ খবর আদমজীতে জানাজানি হবার পরে আদমজীর শ্রমিকদের পক্ষ থেকেই দাবি উঠেছিল আমাদের নিজেদেরই রাজনৈতিক দল গঠন করতে হবে।
১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল। এ দুবছর আমাদের ব্যস্ত থাকতে হয়েছে চটকল শ্রমিকদের নিয়ে। অনেক শ্রমিক এলাকায় আমাদের পরিচিতি ছিল রূপকথার মতো। আইয়ুব খানের আমলে আমরাই বিদ্রোহ করেছিলাম প্রথমে, ষাটের দশকে এবং জিতেছিলাম। আমাদের চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন আদমজীর মওলানা সাইদুর রহমান। তখনও তেজগাঁও শিল্প এলাকা শ্রমিক অসন্তোষ চলছিল। তেজগাঁওয়ে আমাদের শ্রমিক সংগঠন নেই। তবুও তেজগাঁওয়ের শ্রমিকদের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হলো একবারের জন্যে মওলানা সাইদুর রহমানকে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ঘুরিয়ে আনতে। মওলানা সাহেব একদিন শ্রমিকদের নিয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় শুধুমাত্র পায়ে হেঁটে এলেন। পরের দিন মালিকেরা শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসল।
আমাদের প্রভাব আমাদের কাল হলো। আওয়ামী লীগের একটি মহল যারা পরবর্তীকালে জাসদ গঠন করেছিল তারা আমাদের সংগঠনে তাদের লোক ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করল এবং কাজ করতে শুরু করল। তখনো শ্রমিক লীগ গঠিত হয়নি। আওয়ামী লীগ চেষ্টা করতে শুরু করল আমাদের সংগঠনকে ভিত্তি করে নতুন সংগঠন দাঁড় করাতে। আমাদের ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় অফিস ছিল ১৬ বাহাদুরপুর লেনে। বাহাদুরপুর লেনের এই অফিসে আমাদের কেন্দ্রীয় নেতা প্রয়াত কমরেড নেপাল নাহা ও শ্রমিক নেতা মরহুম আব্দুল মান্নান ও মিসির আহমদ থাকতেন। এখানেই শুরু হলো ছাত্রলীগের তৎপরতা।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি ঘোষণা করলেন। এই ছ’দফা ব্যাখ্যা এবং গ্রহণ ও বর্জন নিয়ে আমাদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিল। তখন আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন বামপন্থী গ্রুপের নেতারা কথা বলেছেন। কথা বলেছেন ছাত্রলীগের নেতারা। তাঁদের সকলের কথা দেশ স্বাধীন করতে হবে। পাকিস্তানে থাকা যাবে না। আমাদের কথা হলো স্বাধীন বাংলাদেশ কেমন হবে আমরা আগে জানতে চাই। তার কোনো চিত্র ছ’দফায় নেই। ছ’দফা হচ্ছে পাকিস্তান থেকে চলে আসার দলিল। এতে ভবিষ্যৎ সমাজ সম্পর্কে কোনো বক্তব্য নেই। আমাদের এই আলোচনার সময়টা সারা দেশে এক নতুন আবেগ সৃষ্টি হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে। একদিন এক ব্যবসায়ী এলেন আমার কাছে। তিনি মনে প্রাণে নির্ভেজাল আওয়ামী লীগ বিরোধী। আমাকে বললেন, আমি নিউমার্কেটে একটা হোটেল দেব। হোটেলের নাম হবে বাঙালি। বাঙালি খাবার ব্যতিত অন্য কোনো খাবার থাকবে না।
এ ভভদ্রলোক দেশ স্বাধীন হবার পর দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেছিলেন এবং জেল খেটেছিলেন। এ ভদ্রলোকের সঙ্গে দিনের পর দিন আলোচনা হয়েছে। অপরদিকে প্রায় প্রতিদিন শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হচ্ছেন। আইয়ুব খান ধমক দিচ্ছেন। সব মিলে সারাদেশে যে একটি আবাহওয়ার সৃষ্টি হয়েছে। আজ মনে হচ্ছে কালের সে পরিস্থিতি আমরা হৃদয় দিয়ে নয়, শুধুমাত্র যুক্তি দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করেছি। আমরা বুঝতে পারিনি, আমাদের সংগঠনেও এক নতুন আবেগের সৃষ্টি হয়েছে এবং তারই সুযোগ নিয়েছে আওয়ামী কর্মীরা। ১৯৬৬ সালের ৬ জুন আওয়ামী লীগ ছ’দফা দিবস ঘোষণা করে। তেজগাঁওয়ে মনু মিয়াসহ ১১ ব্যক্তি নিহত হয়। প্রথম ধরপাকড় শুরু হয় সারাদেশে। এ সময় গ্রেফতার হয়ে যায় আমাদের ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান ও আমাদের নেতা কমরেড নেপাল নাহা। আমার আজকে মনে হচ্ছে ছ’দফার প্রশ্নে নেপাল দা আমাদের সঙ্গে একমত ছিলেন না। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এ আন্দোলনের সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক ছিল? আপনি কেন মান্নানকে আমাদের দলীয় সিদ্ধান্তের কথা জানাননি। নেপালদা বলেছিলেন, তাঁর ধারণা ছিল এ আন্দোলন দানা বাঁধবে। তাই মান্নানকে আন্দোলনের সঙ্গে থাকতে বলেছিলেন। জেলখানায় নেপালদার সঙ্গে শেখ সাহেবের আলোচনা হয়েছিল। শেখ সাহেব বলেছিলেন আসুন একসঙ্গে আন্দোলন করি। নেপাল দা জবাব দিয়েছিলেন আমরা তো আন্দোলনে আছি, আমাদের আন্দোলন সমাজ পরিবর্তনের জন্যে। আপনারা আসুন।
১৯৬৯ সালে শেখ সাহেব জেল থেকে বের হয়ে আসার পর আবার আমাদের ডেকেছিলেন। তার প্রস্তাব ছিল এক সঙ্গে শ্রমিক ফ্রন্ট গঠনের । তিনি আলোচনা করেছিলেন আমাদের অন্যতম নেতা রুহুল আমিন কায়সারের সঙ্গে তাঁর ৩২ নম্বর সড়কের বাসায়। রুহুল আমিন সাহেবও জবাব দিয়েছিলেন আমরা আন্দোলনে আছি। আপনার প্রস্তাব বিবেচনা করব।
১৯৬৬ সালের নভেম্বরের দিকে হঠাৎ নেপাল দা এসে হাজির। তিনি জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কেন মুক্তি পেলেন আমাদের বোধগম্য হলো না। তার সঙ্গে আমার দেখা হলো রায়েরবাজারে রুহুল আমিন সাহেবের বাসায়। দেখলাম নেপাল দা কাশছেন। কাশতে কাশতে তাঁর মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। বললাম, নেপাল দা আপনি কি অসুস্থ? তিনি বললেন, একটু কাশি হয়েছে। পকেটে কিছু ওষুধ আছে। ভাববার কিছু নেই।
আমি বললাম, নেপালদা আপনি বাড়ি যান। সকলের সঙ্গে দেখা করুন। আপনি ফিরে এলে দেখা করব।
নেপাল নাহার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার শ্রীঘর গ্রামে। রায় বাহাদুর অনঙ্গমোহন নাহার পরিবারের সদস্য তিনি। জেলখানা থেকে এমএ পাস করেছেন। নরসিংদী থেকে লঞ্চে নবীনগর যাবার পথে মানিকনগর স্টেশনে নামতে হবে। কিছুদূর হেঁটে গেলে যতদূর চোখ যায় সব জমির মালিক হচ্ছে নাহা পরিবার। নেপাল দা ছাত্রজীবনে অনুশীলন সমিতির সংস্পর্শে আসেন। পরে আরএসপিতে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় তিনি পাকিস্তান থেকে যান। ৫০-এর দশকের নিখিল পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবারের সহকারি সম্পাদক ছিলেন। ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন ফয়েজ আহম্মদ। ৫০-এর দশকে তিনি গ্রেফতার হয়ে যান। জেল থেকে ছাড়া পাবার পর তিনি কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে দলের নির্দেশে তিনি ঢাকায় আসেন। সদরঘাট ইস্ট বেঙ্গল ইন্সটিটিউশনে শিক্ষকতা গ্রহণ করেন। তার বাসস্থান ফরিদাবাদের ১৬ বাহাদুরপুর লেনে ছিল পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের অফিস। নেপাল দার বাড়ি যাবার সঙ্গী হচ্ছে গামছায় জড়ানো একটি লুঙ্গি, হাতে কাঁচা একটি জামা ও দাঁতনের জন্যে একটি নিমের ডাল।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নেপাল দা একবার কলকাতায় বেড়াতে যান। কলকাতায় নেপাল দার ভাই এক বড় হোটেলের মালিক। সেই হোটেলে আরএসপির শ্রমিক ইউনিয়ন ছিল। একবার শ্রমিক-মালিক বিরোধ দেখা দিলে পার্টির তরফ থেকে নেপালদাকে তার ভাইপোর সঙ্গে আলোচনা করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। নেপাল দা বলেছিলেন মালিক কোনোদিন ভাই হয় না। তারপর নেপাল দা চলে এলেন পূর্ব পাকিস্তানে।
কিছুদিন পরে নেপাল দা ফিরে এলেন শ্রীঘর থেকে। উঠলেন বাহাদুরপুর লেনে। নেপাল দা অসুস্থ, মুখ থেকে রক্ত উঠছে। নেপাল দার ছাত্র কুমিল্লার আশফাকুর রহমান তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়ছিল। তার সন্দেহ হলো নেপাল দা হয়তো ক্যান্সারে ভুগছেন।
নেপাল দাকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হলো। ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা গেল নেপাল দার গলায় ক্যান্সার এবং শেষ অবস্থা। ক্যান্সার জেনেই আইয়ুব সরকার নেপাল দাকে মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু কাউকেই জানায়নি যে নেপাল দা ক্যান্সারে ভুগছেন।
পূর্ব পাকিস্তানে ক্যান্সারের চিকিৎসা নেই। ডাক্তাররা বলল কোলকাতায় পাঠাতে। নেপালদাকে জানানো হলো তাঁর অসুখের কথা। নেপাল দা কিছুতেই কলকাতায় যাবেন না। নেপাল দা বললেন, দেশ ভাগের পর কলকাতার বন্ধুরা
আমাকে ভারতে থাকতে বলেছিল। আমি বলেছিলাম আমি মাতৃভূমিতে ফিরে যাব। বিপ্লব আমাদের দেশেই আগে হবে। এখন যদি আমি কলকাতায় যাই, বন্ধুরা বলবে আমি পরাজিত হয়েছি। কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় নেপাল দা বললেন–আমি ডিফিট হইতাম চাই না।
সেদিনের কথা আমার এখনো মনে আছে। আমি ও রুহুল আমিন সাহেব বারবার বোঝাতে চেয়েছিলাম এতে পরাজয়ের কিছু নেই। আপনি চিকিৎসার জন্যে যাচ্ছেন। আমি বন্ধুদের চিঠি লিখে দেব। পরিষ্কার করে সব জানাব। আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না। হঠাৎ নেপাল দা আমার হাত জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, সত্যি সত্যি আপনি লিখে দেবেন। সবাইকে বোঝাতে হবে আমি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসিনি। আপনি চিঠি লিখুন, আমি যাব ।
কিন্তু নেপাল দাকে পাঠাবো কী করে। তার পাসপোর্ট নেই। পাকিস্তান সরকার তাঁকে পাসপোর্ট দেবে না। সিদ্ধান্ত হলো আগরতলা সীমান্ত দিয়ে তাকে ভারতে পাঠানো হবে। আমাদের মধ্যে কেউ তাঁর সঙ্গে যাবে। সব কথা শেষ করে দৈনিক পাকিস্তানে ফিরে গেলাম। তখন আমি রাতের পালায় কাজ করি। গভীর রাতে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে আমাকে ফোন করল-নেপাল দার অবস্থা খারাপ। তাকে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। গভীর রাতে হাসপাতালে ছুটে গেলাম। নেপালদা ঘুমুচ্ছেন। অবস্থা একটু ভালো। নেপালদার কাছে আছেন তার ভাই।
পরের দিন দুপুরে দৈনিক পাকিস্তানে আবার ফোন এল। এবারো আশফাঁক ফোন করেছে। নেপাল দা নেই। দুপুরের দিকে তিনি ভালোই ছিলেন। ওয়ার্ডে কোনো ডাক্তার ছিল না। নেপাল দা অক্সিজেনের নলটা খুলে অন্যান্য রোগিদের সেবা করছিলেন, হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যান। নেপাল দা অন্যের সেবা করতে করতেই মারা গেলেন। তাঁকে মাতৃভূমি ছাড়তে হলো না।
পরের দিন নেপাল দাকে নিয়ে আমি আর কাজী হাতেম আলী শ্রীঘর গিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় শ্রীঘরের নাহা বাড়িতে কান্নার রোল উঠল। নেপাল দার মায়ের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি বললেন, তোমাদেরও এমনি করেই মরতে হবে। কথাগুলো আজো আমার মনে বাজছে।
কমরেড নেপাল দা অর্থাৎ কমরেড নেপাল নাহার মৃত্যুতে আমরা চরম বিপদে পড়ে গেলাম। নেপাল দার সঙ্গে শ্রমিক নেতা আবুল মান্নান ও মিসির আহমদ থাকতেন। তারা দুজনেই আমাদের দলের লোক। তবে ৬ দফা নিয়ে কিছুটা মতান্তর আছে। আমাদের মত হচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে কেমন সমাজ হবে তা বুঝেই ৬ দফাঁকে সমর্থন করতে হবে। মিসির আহমদ আমাদের সঙ্গে একমত। মান্নানের ভিন্ন মত থাকলেও সে খুব সোচ্চার নয়। তাদের সঙ্গে নেপাল দা থাকায় একটা ভারসাম্য ছিল। তাই নেপাল দার মৃত্যুতে আমরা কিছুটা বিপদে পড়ে গেলাম। আমরা অবিভক্ত ভারতবর্ষের আরএসপির লোক হলেও ১৯৫০ সালের পর আরএসপি নামে কাজ করা সম্ভব ছিল না। পাকিস্তানে সমাজতন্ত্রের কথা বলা ছিল দণ্ডনীয় অপরাধ। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাধারণ নির্বাচন হয়। যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। কিছুদিনের জন্যে আমরা স্বস্তিলাভ করি। আর তার পরেই যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়া হয়। সারাদেশে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়। আবার আমাদের বেছে নিতে হয় জেলে যাওয়া ও আত্মগোপনের জীবন।
এ সময় যুক্তফ্রন্ট নেতৃত্বের দেউলেপনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুক্তফ্রন্টের বড় দু’টি দলের নাম আওয়ামী লীগ এবং কেএসপি। আওয়ামী লীগের নেতা মওলানা ভাসানী ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কেএসপির নেতা ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। আওয়ামী লীগের গায়ে কিছুটা প্রগতিশীল ছাপ ছিল। কিন্তু ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে কেএসপির সঙ্গে কোনো পার্থক্য ছিল না। এ দু’টি দলই ক্ষমতায় যাবার দ্বন্দ্ব লড়াইয়ে ক্রমাগত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে খুশি করার চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৮ সালে রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই দেউলেপনার জন্যে পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি হয়েছে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় এসেছে। এ পটভূমিতে আরএসপি নামে প্রকাশ্যে কাজ করার কোনো সুযোগই ছিল না।
এ সময় আমরা সিদ্ধান্ত নিই শ্রমিক ফ্রন্টে কাজ করার। পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশন গড়ে তুলি। আমাদের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক চটকল ধর্মঘট হয়। এর পরে আসে ১৯৬৬ সালের আন্দোলন। চারদিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রবল আবেগ। শ্রমিক এলাকায় কাজ করলেও আমাদের রাজনৈতিক দলের তেমন পরিচিতি নেই। স্বীকৃতি নেই কোনো মহলে। সকল মহলেরই ধারণা ছিল সকল শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি জড়িত। মার্কসবাদ, লেনিনবাদ বা সমাজতন্ত্র একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিরই কথা। কমিউনিস্ট পার্টি ব্যতিত সমাজতন্ত্র বিশ্বাসী অন্য কোনো দলের অস্তিত্বের ধারণাই ছিল না।
এর একটা ঐতিহাসিক কারণ ছিল, বিশেষ করে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল অর্থাৎ আরএসপির প্রশ্নে। কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছিল বিশের দশকে। আরএসপি গঠিত হয়েছিল ১৯৪০ সালের ১৯ মার্চ। আরএসপি গঠন করেছিল অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা। এদের অধিকাংশ এসেছিল অনুশীলন সমিতি থেকে। ১৯১৭ সালের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপ্লবের পর অগ্নিযুগের এই বিপ্লবীরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সংস্পর্শে আসেন। ব্রিটিশের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে এদের একটি অংশ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়। অপর অংশের দ্বন্দ্ব দেখা দেয় লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিনের নেতৃত্ব নিয়ে। অনুশীলনের এই অংশ মনে করে স্ট্যালিন সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারছে না। স্ট্যালিনের নেতৃত্ব তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ভুল নির্দেশ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ত্রিশ দশকের কংগ্রেসের নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলন সমর্থন করেনি। আবার ১৯৩৫ সালে এসে একই তৃতীয় আন্তর্জাতিকের নির্দেশে কংগ্রেসকে সমর্থন করেছে এবং সুভাষ বসুকে সমর্থন করেনি গান্ধীর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে।
এই পটভূমিতে ১৯৪০ সালের ১৯ মার্চ বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল আরএসপি গঠিত হয়। ইতোমধ্যে ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
আরএসপির মধ্যে থেকে ঘোষণা করা হলো এ যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। এ যুদ্ধ সমর্থন করা যাবে না। আরএসপি গঠনের ৬ মাসের মধ্যে প্রথম সারির নেতারা গ্রেফতার হয়ে গেলো। দলটির নাম প্রচার হবার পূর্বেই ভয়াবহ নির্যাতন শুরু হয়ে গেল। এই দলের অজস্র কর্মী আত্মগোপন করে ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। গ্রেফতার বরণ করে এবং নিহত হয়। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হবার পর এ দলের কর্মী ও নেতাদের মুক্তি দেয়া শুরু হয়। দলের প্রধান নেতা সাধারণ সম্পাদক যোগেশ চট্টোপাধ্যায় তখন বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত। তিনি কাদরি ষড়যন্ত্র ও আন্তঃপ্রদেশ ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন। যোগেশ চট্টোপাধ্যায়ের সহযোগী ছিলেন শহীদ রাজনারায়ণ লাহিড়ী, জগৎ সিংহ ও আশফাঁক উল্লাহ প্রমুখ। যোগেশ চট্টোপাধ্যায় হিন্দুস্তান রিপাবলিকান সোসালিস্ট আর্মির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এই সংগঠনটি ১৯২৩ সালে কুমিল্লার নবীনগর থানার ভোলাচং গ্রামে জন্ম হয়। তখন এই সংগঠনের নাম ছিল হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মি। ভোলাচং ছিল অনুশীলন সমিতির অন্যতম নেতা বিপ্লবী অতীন্দ্রমোহন রায়ের বাড়ি। বিপ্লবী অতীন্দ্রমোহন রায় আরএসপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন।
১৯৪০ সালে গঠিত আরএসপির অবস্থা দাঁড়াল এমন যে ৬ মাসের মধ্যে তাদের নেতারা গ্রেফতার হয়ে গেলেন। ১৯৪২ সালে এই অবস্থা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হলো। ১৯৪৬ সালে নেতারা মুক্তি পেলেন। ১৯৪৭ সালে আরএসপির সাধারণ সম্পাদক যোগেশ চট্টোপাধ্যায় বাংলাদেশে ঢুকবার অনুমতি পেলেন। এ সময় সারা ভারতবর্ষে টালমাটাল অবস্থা। নৌবাহিনীতে বিদ্রোহ। বিমান বাহিনীতে বিদ্রোহ। আজাদ হিন্দু ফৌজের বিচার। সব মিলে এক রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের পরিবেশ। ব্রিটিশ সরকার, কংগ্রেস এবং মুসিলম লীগ সকলেই ভীত এবং সন্ত্রস্ত। এ অবস্থা চলতে থাকলে অভ্যুত্থানের মারফৎ ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্রিটিশ বেনিয়া ও ভারত ধনিক, বণিকগোষ্ঠী–যাদের নেতৃত্বে পরিচালিত কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ।
১৯৪৬-এর এই অভ্যুত্থানের পরিবেশ এড়ানোর জন্যে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে নামলো এই বেনিয়ারা। সারা দেশ রক্তাক্ত হলো ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গায়। সাধারণ মানুষকে বুঝানো হলো হিন্দু মুসলমান দু’জাতি। এরা এক সঙ্গে থাকতে পারে না। সুতরাং ভারত বিভাগ চাই। এ তত্ত্বে শেষ পর্যন্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও সায় দিল।
এ পরিবেশে ৬ বছর জেল খেটে আরএসপির নেতৃবৃন্দ বাইরে এলেন। দেশ বিভাগের বিরুদ্ধে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভায় জোর প্রতিবাদ জানালেন। সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের জন্যে নেতাজীর অগ্রজ শরৎ বসুর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হলেন। এই প্রয়াসে সঙ্গী হয়েছিলেন মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেম। কিন্তু শেষ মুহূর্তের প্রয়াস কোনো কাজে আসেনি। কংগ্রেস আর মুসিলম লীগ হাইকমান্ডের সহয়েগিতায় বিভক্ত হয়েছে ভারতবর্ষ।
এই বিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত পূর্ব বাংলা পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানে মুখ্যত আরএসপির সংগঠন ছিল বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, বরিশাল, রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, পাবনা এবং দিনাজপুরে। এ সংগঠনের নেতৃত্ব এসেছিল শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। দেশ বিভাগের পর নেতৃত্বের অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় চলে যায়। যারা আজকের বাংলাদেশে থেকে যায় তাদের মোকাবেলা করতে হয় চরম নির্যাতন। দল হিসেবে পরিচিত নেই, অথচ সমস্ত নির্যাতনের ভাগীদার হয়ে শ্রমিক ফ্রন্ট ভিত্তি করে সামনে আসতে আসতে ১৫ থেকে ২০ বছর কেটে যায়।
১৯৬৬ সালে চটকল আন্দোলনের মধ্যদিয়ে অনুভূত হয়, রাজনৈতিক দল গঠন না করে শুধুমাত্র শ্রমিক সংগঠনের নাম নিয়ে সর্বহারার নেতৃত্ব করা যাবে না। আরএসপির পক্ষ থেকে তখন নতুন করে চিন্তাভাবনা হয় নতুন নামের সংগঠন করা এবং এ সময় শুরু হয় ৬ দফা দাবি ভিত্তি করে সুতীব্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।
এ আন্দোলনে শ্রমিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিকদের মধ্যেও এ আন্দোলনের প্রতি ঝোঁক লক্ষ করা যায়। এ সময় নেপাল দা মারা যান। তবে লক্ষণীয় যে শ্রমিক এলাকায় এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লেও আদমজীসহ অধিকাংশ পাটকলে আমাদের নেতৃত্ব অটুট থাকে। সংগ্রামের মধ্যদিয়ে একাত্ম হবার ফলে আমাদের ওপর শ্রমিকদের অগাধ বিশ্বাস ছিল। সেই বিশ্বাসকে রাজনৈতিক রূপ দিতে গিয়ে প্রতি পদে পদে আমাদের হোঁচট খেতে হয়েছিল।
তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে একের পর এক ঘটনা ঘটছিল। কিন্তু শিল্প এলাকা ছাড়া রাজনৈতিকভাবে আমাদের কোনো চাপ ছিল না। আরএসপির কিছু ব্যক্তি হিসেবে আমরা রাজনৈতিক মহলে পরিচিত। এক সময় আমরা ছাত্রলীগ করলেও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আমলে ছাত্রলীগের কমিউনিস্ট বিরোধী পাশ্চাত্যঘেষা নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আমরা ছাত্রলীগ ত্যাগ করি । আমরা ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিলেও কমিউনিস্ট পার্টি কখনই আমাদের ছাত্র ইউনিয়নে কাজ করতে দেয়নি। ন্যাপ গঠনের পর মাওলানা ভাসানী ন্যাপে যোগ দেবার জন্যে আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা রাজি হইনি।
আমরা বলেছি নিজের আত্মপরিচয় গোপন করে সমঝোতা করে অন্য দলে যোগ দিলে একদিন আদর্শচ্যুত হবই। কোনোদিন আর নিজের দলে ফিরে আসা যাবে না। কারণ শ্রেণিসংগ্রাম আর শ্রেণি সমন্বয়ের অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে। শ্রেণি সমন্বয়ের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে শ্রেণি সংগ্রামের রাজনীতি অংশগ্রহণ করা যায় না। আমাদের দলগত বিশ্বাস ত্রিশের দলকে। বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট নেতা দিমিট্রসের পপুলার ফ্রন্টনীতি এ সর্বনাশা রাজনীতির জন্ম দিয়েছে। এ নীতি অনুসরণ করে বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ধনিক শ্রেণির বিভিন্ন দলে ঢুকে রাজনীতি করার চেষ্টা করে প্রকৃতপক্ষে নিজেদের নিঃশেষ করেছেন। নিজেদের রাজনীতি করা হয়নি। এই উপমহাদেশেও তার নজির নেই। এই নীতি অনুসরণ করে এই উপমহাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতা হয়েছেন। কেউই শেষ রক্ষা করতে পারেনি।
আরএসপির কাছে দিমিট্রসের এ তত্ত্ব ছিল ভুল এবং পরিত্যাজ্য। তাই আমরা সংখ্যায় কম হলেও আরএসপির সদস্য হিসেবে বেঁচে থাকতে চেয়েছি। অন্য কোনো দলে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করিনি এবং নেপাল দাও সেভাবেই মারা গেলেন। এগিয়ে এল ১৯৬৭, ৬৮ এবং ৬৯ সাল। আমাদের রাজনীতিতে এক অগ্নিগর্ভ যুগ।
ষাটের দশক শেষ হয়ে যাচ্ছে। সেকালের পূর্ব পাকিস্তানে ষাটের দশক এসেছিল একটি ভিন্ন রূপ নিয়ে। ৫০-এর দশকে শিশু রাষ্ট্র পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হবে, ইসলামকে রক্ষা করতে হবে–এটাই ছিল বড় কথা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসিলম লীগ পরাজিত হলে এ বিশ্বাসে প্রাথমিকভাবে ধস নামে। তবুও সাধারণভাবে মুসলিম জনতার পাকিস্তানের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে ভেঙে দিলেও পাকিস্তান বিরোধী মনোভাবের তেমন প্রকাশ তখনও ছিল না। ১৯৫৬ সালে সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেয়ায় ভাষা আন্দোলনের একটি পর্ব শেষ হয়ে যায়।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পরে প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণ মানুষের কাছে সামরিক শাসন অভিনন্দিত হলেও ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের মনে ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো। সর্বক্ষেত্রে বাংলা এবং বাঙালিকে পিছু হটাবার একটা প্রচেষ্টা লক্ষ করা গেল। আইয়ুব খান সরকারের প্রথম শিকার হলো আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও অন্যান্য বামপন্থীরা। সামরিক সরকার সখ্য গড়ে তুলল ১৯৫৪ সালে পরাজিত শক্তি মুসলিম লীগের সঙ্গে।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির বিবর্তন হতে থাকল। এক এক করে নেতারা জেলখানা থেকে মুক্তি পেতে থাকলেন। কড়া সামরিক শাসনের মধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দী রাজনীতিকদের ঐক্যবদ্ধ থাকার চেষ্টা করলেন। আর এই সময়ই সবচেয়ে বড় ভুল করল পাকিস্তান সরকার শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করে। পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী রাজনীতিকদের একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম করার গড়ে তুলল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ)। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে মারা গেলেন। এবারে রাজনীতি ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করল। পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম থেকেই দাবি উঠেছিল আইয়ুবের সংবিধান বাতিল করতে হবে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে ভিন্ন পথ নিয়েছিলেন। তিনি দাবি তুললেন সংবিধান বাতিল নয়, সংবিধান গণতন্ত্রায়ন করতে হবে। শহীদ সোহরাওয়াদী মারা যাওয়ায় পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়। সংবিধান বাতিলের দাবি জোরদার হয়।
ইতোমধ্যে সরকার এক ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটালো। ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্র ধরে পূর্ব পাকিস্তানে দাঙ্গা শুরু হয়। পাকিস্তান সরকারের ভাবনা ছিল এই দাঙ্গা তাদের সঙ্কট সমাধান করবে। একদিনের জন্যে হলেও বিরোধী দলের দাবি স্তিমিত হবে। কিন্তু দাঙ্গার ফল হলো উল্টো। বাঙালিদের ধারণা হলো এ দাঙ্গা পাকিস্তানি সরকারের ষড়যন্ত্র। এ দাঙ্গার জন্যে দায়ী ভারত থেকে আসা এক শ্রেণির অবাঙালি। পূর্ব পাকিস্তানে এ দাঙ্গার সূত্র ধরে বাঙালিবিহারী সংঘর্ষ দেখা দিল বিভিন্ন এলাকায়।
ইতোমধ্যে আইয়ুব খানের সামরিক সরকার নিজের মসনদ পোক্ত করার ব্যবস্থা করেছে। ইউনিয়ন কাউন্সিলের নাম দিয়েছে মৌলিক গণতন্ত্র। ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যের নাম হচ্ছে মৌলিক গণতন্ত্রী। এই মৌলিক গণতন্ত্রীর ভোটে জাতীয় বা প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন হবে। সাধারণ মানুষের কোনো ভোটাধিকার থাকবে না।
সকল রাজনৈতিক দল এই মৌলিক গণতন্ত্রের বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছিল। বলা হয়েছিল মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনে কেউ অংশগ্রহণ করবে না। আর রাজনৈতিক দল হিসেবে মৌলিক গণতন্ত্র নির্বাচনে প্রার্থী হবার কোনো সুযোগ ছিল না। মৌলিক গণতন্ত্রের সদস্য সংখ্যা ছিল দুই পাকিস্তানে ৪০ হাজার করে মোট ৮০ হাজার। ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দেন। ইতোমধ্যে তিনি পুরনো মুসলিম লীগ সদস্যদের ডেকে একটি কনভেনশন করেন। গঠিত হয় কনভেনশন মুসলিম লীগ। তিনি হলেন–সভাপতি। এ কাউন্সিলে আর একটি মুসলিম লীগ গঠিত হয়। অর্থাৎ কনভেনশন মুসলিম লীগ ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ নামে দুটি মুসলিম লীগ গঠিত হয়। জেনারেল আইয়ুব কাউন্সিল লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল কম্বিনিশন অব অপজিশন পাটি অর্থাৎ কপ গঠন করেন। কপের সদস্যদের মধ্যে এনডিএফ ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক দল ছিল। নির্বাচনে এদের প্রার্থী হলেন মিস ফাতেমা জিন্নাহ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি। এ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ৫৩ দশমিক ১ ভাগ ভোট পেয়েছিলেন। আর কপ প্রার্থী মিসেস ফাতেমা জিন্নাহ পেয়েছিলেন ৪৬ দশমিক ৯ ভাগ ভোট। কিন্তু লক্ষণীয়, প্রাদেশিক পরিষদ ও জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান মুসিলম লীগ শতকরা ৭২ আসন পেলেও ভোট পেয়েছিল শতকরা ৫০ ভাগেরও কম। অধিকাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিল স্বতন্ত্র ও বিরোধী দলীয় প্রার্থিদের। বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধ ছিল না। এমনকি নির্বাচনে অংশগ্রহণ সম্পর্কে একমত ছিল না। ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে আবার প্রমাণিত হয়, মিস ফাতেমা জিন্নাহকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানে যে আবেগ সৃষ্টি হয়েছিল তাও স্থায়ী নয়।
এই অবস্থার আর এক পরিবর্তন হয় ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে। এ যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল ১৯৬৫ সালের ৭ সেপেটম্বর থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ ১৭ দিন। প্রকৃতপক্ষে এই ১৭ দিন পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানিদের কাছে সাধারণভাবে মনে হয়েছিল পাকিস্তান সরকারের যেনো পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। অর্থাৎ প্রতিরক্ষার জন্যেও পূর্ব পাকিস্তান যে স্বাধীন হওয়া দরকার, এ যুদ্ধের পর সে কথা সামনে চলে আসে।
ষাটের দশকের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং পুনরুজ্জীবিত করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের ভাঙন। ১৯৬৭ সালের ২ মে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন (পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট অর্থাৎ পিডিএম) গঠিত হয়। এই পিডিএমকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ভেঙে যায়।
১৯৬৭ সালে ন্যাপ ভেঙে ভাসানী ন্যাপ ও মোজাফফর ন্যাপ গঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই ভাঙনের কারণ ছিল আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সোভিয়েত ইউনিয়ন বনাম চীন বিভেদ। ভাগ বাটোয়ারার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে মোজাফফর আহমদ ন্যাপকে মস্কো ন্যাপ এবং ভাসানী ন্যাপকে পিকিং ন্যাপ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই ষাটের দশকেই পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধ নতুন আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামী করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেন। এবার রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তন ঘটে।
১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ৬ দফাঁকে অন্তর্ভুক্ত করে ১১ দফা দাবি প্রণয়ন করে এবং ১১ দফার ভিত্তিতে নতুন আন্দোলন শুরু হয়। এ সময় নিজেকে বড় অসহায় মনে হতো। দৈনিক পাকিস্তান-এ কাজ করছি। সরকার পক্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী পত্রিকা। অথচ এ পত্রিকার অধিকাংশ সাংবাদিক সরকার বিরোধী এবং বামঘেঁষা। এ পত্রিকায় আমি সরকারি টাকা পেলেও এ পত্রিকায় আমার অভিভাবক ছিলেন প্রথম বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হক। ১৯৬৫ সালের কায়রো বিমান দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান।
এই দৈনিক পাকিস্তানে চাকরিকালে আমি প্রেস ক্লাবের সদস্য হই। চাকরি গ্রহণের শুরুতে ইউনিয়নের সদস্য হয়েছিলাম ইত্তেফাকে থাকতে। ইত্তেফাকে আমার চাকরি হয়েছিল আহমেদুর রহমানের সহযোগিতায়। আহমেদুর রহমান তখন শক্তিশালী কলাম লেখক। ইত্তেফাকে ভীমরুল নামে ‘মিঠেকড়া’ কলাম লিখতেন। এই আহমেদুর রহমানও মারা গেলেন ১৯৬৫ সালের কায়রোতে বিমান দুর্ঘটনায়। পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পিআইএ বিমান চালু করছিল কায়রো পর্যন্ত। সেই বিমানের উদ্বোধনী যাত্ৰায় ১২৮ জন যাত্রী ছিলেন। তার মধ্যে ৪ জন পূর্ব পাকিস্তানের সাংবাদিক ছিলেন। এরা দৈনিক পাকিস্তানের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হক, ইত্তেফাকের সহকারি সম্পাদক আহমেদুর রহমান, পাকিস্তান অবজারভারের সহকারি সম্পাদক ফরিদউদ্দিন আহমদ এবং মর্নিং নিউজের আব্দুল হান্নান।
ষাটের দশকের মাঝে এসে দৈনিক পাকিস্তান মোটামুটি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বলা যেতে পারে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিল সাংবাদিকতায়। অপরদিকে ট্রাস্টের কাগজ বলে বিরোধী দলের সকল খবর দিতে সীমাবদ্ধতা ছিল। একদিকে চাকরি অপরদিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জোয়ার আমাকে প্রতি মুহূর্তে বিব্রত করত। আমি তখন টেবিলে শিফট ইনচার্জ। স্টাফ রিপোর্টার নই। তবুও প্রতিটি মিছিল সভায় যেতাম রাজনীতির খবরের জন্যে। সহকর্মীরা অখুশি হতো। শ্রমিক এলাকায় কাজ করলেও রাজনৈতিক দল হিসেবে কোনো পরিচিতি না থাকায় অসুবিধা হতো প্রতি পদে পদে।
এ পরিস্থিতিতে একদিন রাতে এক ঘটনা ঘটল। ৩০ ডিসেম্বর ১৯৬৮ সাল। রাতে আমি শিফট ইনচার্জ। রাত ১০/১১টার দিকে এক তরুণ আমার সামনে এসে বলল। তার মাথায় কাপড় বাঁধা। বললো আমি আসাদ। আসাদুজ্জামান। আমি হাতিরদিয়া থেকে এসেছি। ঢাকা জেলার শিবপুর থানার হাতিরদিয়া। মাওলানা ভাসানীর ডাকে আজ হরতাল করেছি, ঘেরাও করেছি। পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে।
আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আসাদ বলল, আপনি বিশ্বাস করছেন। দেখুন আমার মাথায় রক্তের দাগ। আসাদ তার মাথার কাপড় খুলে ফেলল। দেখলাম তার মাথায় চাপ চাপ রক্ত।
আমি বললাম, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি। কিন্তু তোমার খবর ছাপা যাবে না। সব সত্য সংবাদপত্রের জন্যে সত্য নয়। এ সংবাদপত্রে মালিকের নির্দেশ আছে। সরকারের আইন আছে। তোমার খবর ছাপতে হলে ঢাকায় এসপি-ডিসিকে ফোন করতে হবে। তারা তোমার খবর মেনে নিলেই তোমার খবর ছাপা যাবে। আসাদ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আস্তে আস্তে এক সময় চলে গেল। আমি সেদিন আসাদের খবর ছাপাতে পারিনি। কারণ ঢাকায় পুলিশ, জেলা কর্তৃপক্ষ এ খবরের সত্যতা স্বীকার করেনি।
আর আমার সাংবাদিক জীবনে আসাদই বলে গেল খবর কাকে বলে। বলে গেল দেখি আমার খবর কী করে ছাপা না হয়।
২০ জানুয়ারি ১৯৬৯ সাল। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থমথম করছে। পুলিশের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মিছিল বের হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজের কাছে গুলি বর্ষণ করেছে পুলিশ। এক তরুণ মারা গেছে হাসপাতালে।
খবরটি নিয়ে এল আমাদের দলের এক ছাত্র নরসিংদীর কাজী হাতেম আলী। হাতেম আলীকে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গেলাম। লাশের মুখে ঢাকা কাপড় তোলা হলো। কাজী হাতেম আলী বললো, এ আমাদের আসাদ। হাতিরদিয়ার আসাদ। আপনি তাকে চেনননি। সেদিন ২০ জানুয়ারি। দৈনিক পাকিস্তানের রাতে অফিস শিফট ইনচার্জ ছিলাম। আসাদ খবর হয়ে এলো। আমি সেদিন পুলিশ আর ডিসিকে ফোন করিনি। আসাদ খবর হলো নিজের রক্তের বিনিময়ে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বলতে পারিনি ৩০ ডিসেম্বর আসাদকে আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।
আমাদের রাজনীতিতে সত্তরের দশকে আর একটি আঘাত আসে। আওয়ামী লীগের কোনো শ্রমিক সংগঠন ছিল না। তাই তারা আমাদের শ্রমিক সংগঠনের দিকে হাত বাড়িয়েছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার হবার আগে শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেন। কমরেড রুহুল আমিন কায়সার বলেছিলেন আমরা শ্রমিক আন্দোলনে আছি। আওয়ামী লীগের নিজস্ব সংগঠন করার অধিকার আছে। তাতে আমাদের কিছু বলার নেই। ফলে আলোচনা ভেঙে যায়।
আমাদের তখন মুখ্য সংগঠন ছিল পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশন। এই সংগঠনকে ভিত্তি করে আমরা জাতীয় ভিত্তিতে শ্রমিক সংগঠন গঠনের চেষ্টা করেছিলাম। লক্ষ্য ছিল সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠনের।
আমাদের পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আব্দুল মান্নান। ৬ দফা আন্দোলনে সে জেলে গিয়েছিল। মনে হয় ওখানেই তার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হয়। এছাড়া ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান চেষ্টা করছিলেন আমাদের সংগঠনের জায়গা করে নেবার। কিছু কিছু ছাত্রলীগ কর্মী এ জন্যে আমাদের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিল। তারা আমাদের দলের কর্মীর মতোই আচরণ করত। একথা সত্য, সিরাজুল আলম খান আমাদের সংগঠনকে ভাঙতে পেরেছিলেন। তবে তার সকল কর্মী নিজ দলের ফিরিয়ে নিতে পারেননি। এছাড়াও তাদের মান্নান হালদার যিনি পরবর্তীকালে এমপি হয়েছিলেন এবং লাল বাহিনীর নেতা হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন–তাঁর সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল দীর্ঘদিনের। মান্নান সাহেব চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগকে নিয়েই আমরা এক সংগঠন গড়ে তুলি। কিন্তু স্বাভাবিক কারণে আমাদের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। রাজনীতিতে আমাদের তফাৎ ছিল আকাশ-পাতাল।
এ সময় শেখ সাহেবের সঙ্গে রুহুল আমিন কায়সারের আলোচনা ভেঙ্গে গেল। ইতোপূর্বে নেপাল দা মারা গেলেন। নেপাল দার সঙ্গে মান্নান সাহেব এক বাসায় থাকতেন। নেপাল দাকে মান্নান সাহেব উপেক্ষা করতে পারতেন না। কিন্তু নেপাল দার মৃত্যুতে মান্নান সাহেবের কাছে দলের বাইরে যাবার শেষ বাধা কেটে গেল। আমাদের মনে হলো আওয়ামী লীগ নতুন শ্রমিক সংগঠন করবে এবং এর আগেই আমাদের ভয় ছিল যেকোনো মুহূর্তে আমাদের শ্রমিক নেতাদের নাম দিয়েই আওয়ামী লীগ একটি সংগঠন করে ফেলতে পারে।
তাই আমি ও রুহুল সাহেব একটি ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত ছিল আমাদের শ্রমিক সংগঠনের নাম হবে সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ২৪ ঘন্টার মধ্যে এ নামে একটি সংগঠন হয়েছে বলে পত্রিকায় সংবাদ দিতে হবে। তখন রুহুল আমিন সাহেব আদমজীর শ্রমিক সংগঠনের প্রিয় নেতা। তাকে বললাম, আপনি আদমজী চলে যান। আমি রাতে পত্রিকার খবর দিয়ে দেব, সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন নামে একটি নতুন শ্রমিক সংগঠন গঠিত হয়েছে। সংগঠনের কমিটির সভাপতি হয়েছেন আদমজীর মওলানা সাইদুর রহমান। সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন রুহুল আমিন কায়সার।
সেদিনের কথা আজকেও আমার স্পষ্ট মনে আছে। রুহুল আমিন সাহেব জ্বরে কাঁপছিলেন। দীর্ঘদিন যাবত টিবিতে ভুগছেন। একটি ফুসফুস শেষ। অপরটির তিন ভাগের এক ভাগ নেই। কিন্তু ছিল অদ্ভুত মনোবল আর সাহস। বললেন, কমরেড, আমার যে শরীরের অবস্থা তাতে ফিরতে পারব কিনা জানি না। তবুও আমি আদমজী যাচ্ছি। আপনি পত্রিকায় খবর দিয়ে দেবেন। পরের দিন পত্রিকায় খবর বের হলো সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন গঠনের। রুহুল আমিন সাহেব ঢাকায় ফিরলেন তীব্র জ্বর নিয়ে। বিকালে মান্নানের সঙ্গে দেখা হলো। খুব বেশি কথা বলছে না। শুনেছি শেখ সাহেব তাকে কথা শুনিয়েছেন। কারণ মান্নান সাহেব তাকে কথা দিয়েছিলেন আমরা তাঁদের সঙ্গে না থাকলেও আদমজীর শ্রমিক তাঁদের সঙ্গে থাকবেই।
এই আদমজীর শ্রমিকরাই ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল আমাদের সঙ্গে থেকেই। আর গণঅভ্যুত্থানের মাসগুলো আমাদের কাছে ছিল বিব্রতকর। আন্দোলন কোন দিকে ঘোরে, কী হবে কেউ কিছু বলতে পারছে না। প্রতিদিন সংবাদপত্রে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানির খবর বের হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হচ্ছে। সরকার পক্ষে সাক্ষী বৈরী ঘোষিত হচ্ছে আদালতে। নিত্য নতুন ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে।
ইতোমধ্যে ৬ দফা আন্দোলন ১১ দফার আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন ঘটনা পাল্টাচ্ছে। সব ঘটনাই এক অভ্যুত্থানের রূপ নিল ২৪ জানুয়ারি ১৯৬৯ সাল।
২৪ জানুয়ারি দুপুরের দিকে ঘরে ছিলাম। হঠাৎ দুয়ারে ধাক্কা পড়ল। আমি তখন সেগুনবাগিচায় ড. কাজী মোতাহার হোসেনের বাসায় থাকি। দুয়ার খুলে দেখলাম মেসবাহ। মেসবাহ ছাত্রলীগের কর্মী। মেসবাহ শাহবাগ হোটেলের মোড়ে একটি দোতলা বাসে বোমা ছুঁড়েছে। রমনার রেসকোর্স হয়ে ছুটে আমার বাসায় এসেছে। মেসবাহ বলল, তাদের সিরাজ ভাই অর্থাৎ সিরাজুল আলম খান নাকি তাকে বলেছেন বোমা ছুঁড়ে সোজা ছুটে দাদার বাসায় যাবি। ঐ এলাকা নিরাপদ। কিছুক্ষণ থেকে মেসবাহ সুবোধ বালকের মতো চলে গেল।
আবার দুয়ার ধাক্কা পড়লো। দরজা খুলে দেখি সামনে দাঁড়ানো দৈনিক বাংলার সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। জামায় রক্তের ছাপ। সে জামাটা খুলে ফেলল। বললো আমাকে একটা জামা দিন। পুলিশের গুলিতে নবাবপুর স্কুলের ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক নিহত হয়েছে। এতক্ষণ সে মতিউরের লাশ কাঁধে নিয়ে মিছিল করেছে। এবার এসেছে জামা পাল্টাতে।
সালেহ চৌধুরী আমার একটা জামা গায়ে দিয়ে বের হয়ে গেল। আমি গেলাম প্রেস ক্লাব। প্রেস ক্লাবে গিয়ে শুনলাম একদল শ্রমিক আমাকে খুঁজে গেছে। ওরা দৈনিক পাকিস্তান ভবনে আগুন দিয়েছে। তারপর তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে আমি কোথায়। আমি ঐ ভবনে আছি কিনা। সেখানে আমাকে না পেয়ে প্রেস ক্লাবে এসেছে। ওরা নাকি এখনো আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
প্রেস ক্লাব থেকে নামলাম। সংবাদপত্র হকার্স ইউনিয়নের এক নেতা, নোয়াখালী বাড়ি, তার সঙ্গে দেখা হলো। বলল, স্যার আপনাকে খুঁজছিলাম। দৈনিক পাকিস্তানে আগুন দিয়েছি। ভয় ছিল আপনি ঐ ভবনে আছেন কিনা। তাই প্রেস ক্লাব হয়ে আপনার বাসা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। আপনাদের ওপর আমাদের প্রচণ্ড রাগ। কারণ আপনারা দৈনিক পাকিস্তানের প্রথম পাতায় একদিন বড় করে লিখেছিলেন, শেখ মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্রের প্রধান হোতা।
ওদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে দৈনিক পাকিস্তানের দিকে গেলাম। বায়তুল মোকাররম থেকে এগিয়ে দেখলাম বায়ে লসকরদের পেট্রোল পাম্প পুড়ে গেছে। দুরে জ্বলছে প্রেস ট্রাস্ট ভবন অর্থাৎ দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ ভবন। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুড়বার দৃশ্য দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল মানুষের ক্রোধ কত তীব্র। আমরা বছরের পর বছর যা লিখেছি ওরা একদিন। তার জবাব দিয়েছে। দুঃখ পাইনি। তবে ভেবেছি চাকরিটা গেল। কাল কী হবে জানি না। এ সংগ্রামে নিরপেক্ষ থাকা যাবে না সাধারণ মানুষ তা বুঝিয়ে দিল।
২৪ জানুয়ারির পর ঘটনার দ্রুত পরিবর্তন শুরু হয়। এর আগেই পশ্চিম পাকিস্তানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। জেনারেল আইয়ুবের সঙ্গে ভুট্টোর গোলমাল ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের কাল থেকে। আইয়বের ধারণা ভুট্টোর হঠকারিতার জন্যে পাকিস্তান এই অবস্থায় পড়ে। আর ভুট্টোর বক্তব্য হলো রাশিয়ার নেতৃত্বে তাসখন্দে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা করে আইয়ুব পাকিস্তানকে পক্ষে ফেলেছে। আইয়ুব-ভুট্টো মতানৈক্য চরমে পৌঁছলে ভুট্টো পদত্যাগ করে আইয়ুনের মন্ত্রিসভা থেকে। সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।
পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ডাক-এর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। ডাক গঠিত হয়েছিল নির্বাচনের জন্যে। ডাক-এ ছিল পিডিএম পন্থী আওয়ামী লীগ, ছ’দফা পন্থী আওয়ামী লীগ, এনডিএফ, জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও মোজাফফর ন্যাপ ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ। এ জোটে ভাসানীর ন্যাপ ও ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ছিল না। এক সময় ডাক-এর পক্ষ থেকে বলা হয়, জ্বালাও-পোড়াও বলা যাবে না। পাকিস্তানি পতাকা ছাড়া অন্য কোনো পতাকা থাকতে পারবে না। ২৪ জানুয়ারির ঘটনার পর ডাক নয়, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদই সব আন্দোলনের নেতায় পরিণত হয়। ২৭ জানুয়ারি লাহোরে হরতাল হয়। ইতোমধ্যে বিমান বাহিনী সাবেক প্রধান আসগর খান রাজনীতিতে যোগ দেন। ২৭ জানুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে জাতীয় পরিষদে তুমুল বাক বিতণ্ডা হয়। এক সময় স্পিকার পরিষদের ৫ জন বিরোধীদলীয় সদস্যকে বহিষ্কার করেন। করাচী ও লাহোরের বিক্ষোভ দমন করতে সেনাবাহিনী তলব করা হয়।
জানুয়ারির ঘটনায় পিন্ডির সামরিক বাহিনী নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। প্রেসিডেন্ট আইয়ব ঘোষণা করেন যে, সংবিধান সংশোধন করা যেতে পারে এবং সমঝোতার জন্যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে আলোচনায় ডাকবেন। ৪ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক ধর্মঘট পালন করে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ১৭ ফেব্রুয়ারি গোল টেবিল বৈঠক ডাকেন। নবাব হাজী নসরুল্লাহ খানকে গোলটেবিল অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দেন। ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর মিছিল হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা করে গোলটেবিলের পূর্ব শর্ত হচ্ছে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি দান। ৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার দেশ রক্ষা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রয়োগ বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়। ডাক ১৪ ফেব্রুয়ারি হরতাল আহ্বান করে। হরতাল নিয়ে ডাক ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মতানৈক্য হয়। ডাক-এর আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ ব্যতীত সকল দলই ছ’দফার বিরোধিতা করে। ৮ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী গোল টেবিলের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। ডাক-এর দাবিতে স্বায়ত্তশাসন না থাকায় ১৪ ফেব্রুয়ারি হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করেন। ১০ ফেব্রুয়ারি ডাক-এর বৈঠক বসে। আওয়ামী লীগ থেকে দাবি করা হয় আগতলা মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি। এ প্রস্তাব নিয়ে মতানৈক্য হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি হরতাল পালিত হয়।
হরতালের পর পল্টনেন জনসভায় এক ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সভায় সভাপতিত্ব করছিলেন নূরুল আমিন। ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ তার বক্তৃতায় জ্বালাও-পোড়াও-এর বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখলে সমগ্র জনসভায় প্রতিবাদ ধ্বনি ওঠে। শ্লোগান ওঠে জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো, গোল টেবিল না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ। ১১ দফা ও ৬ দফা মানতে হবে মানতে হবে। শেষ পর্যন্ত জনসভা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় পরিণত হয়। ঐদিন জাতীয় রাজনীতি শেষ হয়ে যায়।
১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্টে সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়। সারা বাংলাদেশে সহিংস প্রতিবাদ হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করে। দেশের প্রতি জেলায় কনভেনশন মুসলিম লীগের দফতর পুড়িয়ে দেয়া হয়। চট্টগ্রামে আধা সামরিক বাহিনী ইপিআর তলব করা হয়। শেখ মুজিব প্যারোলে যেতে অস্বীকার করেন। তাজউদ্দিন-মুজিব বৈঠক হয় জেলে। বলা হয়ে থাকে আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী অংশ গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের পক্ষে ছিল। এমন কি তারা প্যারোলেই গোলটেবিল বৈঠকে যেতে রাজি ছিল। কিন্তু মাওলানা ভাসানী এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর চরম বিরোধিতা করে। তখন মুখ্য ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিব পত্নী ফজিলাতুন্নেসা বেগম। এ সময় করাচিতে বিক্ষোভ হয়। গুলিতে দুজন নিহত ও ২৬ জন আহত হয়। ঢাকায় সান্ধ্য আইনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। করাচিতে সেনাবাহিনী তলব করা হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠক শুরু হয়। তারপর ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯। কদিন ধরে ঢাকায় কার্য্য চলছে। মানুষ বের হতে পারছে না। দোকানপাট বন্ধ। কোনো যানবাহন চলছে না। মানুষ অভুক্ত। সর্বত্র একটা ক্ষোভ বিক্ষোভ দানা বাঁধছে শহরের সব এলাকায়। কাফুর দিনগুলোতে আমি প্রায় সব শিফটেই কাজ করি। আমার বাসা সেগুন বাগিচা। এ গলি সে গলি করে কোনো মতে অফিসে পৌঁছাই। প্রায় দিনই রাতে বাসায় ফেরা হয় না। অফিসেই খেতে হয়। আমাদের সহকর্মী শহীদুল্লাহ প্রতিরাতে অফিস থেকে বের হয়ে যান। কী করে খাবার জোগাড় করেন তা কেউ জানে না। শহীদুল্লাহ অফিসে থাকলে আমরা সকলে নিশ্চিত। মোটামুটিভাবে এমনি করে দিন চলছিল। পরপর পাঁচদিন আমি একনাগাড়ে ডিউটি করছি। অন্যান্য বন্ধুরা আসতে পারছে না।
১৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার দিকে মনে হলো এমন করে আর চলবে না। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এক সময় মানুষ কাফু মানবে না। কার্ফ ভেঙে রাস্তায় নামবে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কার্জন হল কম্পাউন্ডে প্রায় সারারাত ধরে মিছিল। সেদিনও মিছিল হচ্ছিল।
হঠাৎ রাত দশটায় টেলিভিশনের খবরে বলা হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ইপিআর হামলা করেছে। গুলিতে নিহত হয়েছে প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা। জোহা জনপ্রিয় শিক্ষক। আমারও চেনা। সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র ছিল। জোহার মৃত্যু সংবাদ বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে গেল। কার্জন হল প্রাঙ্গণে মিছিলের কণ্ঠ জোরদার হলো। মনে হচ্ছিল কার্টু ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজপথে নামছে। দৈনিক পাকিস্তান থেকে উত্তরে তাকালাম। দেখলাম ফকিরাপুলে একটির পর একটি মশাল জ্বলছে। কাওরানবাজার থেকে আমাদের দলের কাজী হাতেম আলী খবর দিল-তেজগাঁও, নাখালপাড়া, গ্রিনরোডে মশাল মিছিল নেমেছে। মশাল নেমেছে রায়েরবাজারে সর্বত্র। সামরিক বাহিনীর টহল। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মানুষ সংঘর্ষে নেমেছে গ্রিনরোডে। সর্বত্রই যেন নামবার পালা। মনে হয় সকলেই নামবার জন্যে প্রস্তুত ছিল। জোহার মৃত্যু সকল বাঁধ ভেঙে দিল। সে এক অদ্ভুত পরিবেশ। সামনে কোনো নেতা নেই, কোনো নেতৃত্ব নেই। কেউ প্রস্তুত ছিল না এ ঘটনার জন্যে। ক্রুদ্ধ, বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ নেমেছে পেটের ক্ষুধায় এবং অত্যাচারের আস্ফালনের বিরুদ্ধে।
সেদিন রাতে বাসায় ফেরা হলো না। পাঞ্জাবি বাহিনী নেমেছে রাজপথে। আমার ঘুম হলো না। সারারাত ভাবলাম নেতৃত্ব থাকলে কী হতে পারত। লেনিন গণঅভ্যুত্থানের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন গণবিপ্লবের কথা। তিনি বলেছিলেন, একটি বিপ্লবী তত্ত্ব চাই। এই তত্ত্ব বাস্তবায়নের জন্যে একটি বিপ্লবী দল চাই। একটি দলের নেতৃত্ব চাই। একটি অভ্যুত্থানের মুহূর্ত চাই। একটি বিপ্লবী তত্ত্বে বিশ্বাসী দল না থাকলে বিপ্লবের মুহূর্ত কাজে লাগানো যাবে না। বিপ্লবী তত্ত্বে বিশ্বাসী দল থাকলেই অভ্যুত্থানের পরিবেশ আসবে। মানুষের মনে বিপ্লবের আকাক্ষা সৃষ্টি হবে। কিন্তু বিপ্লবী দল না থাকলে বিপ্লব হবে না।
১৮ ফেব্রুয়ারি তেমন একটি বিপ্লবের মুহূর্ত এসেছিল। অথচ তখন কোনো বিপ্লবী দল ছিল না। নেতারা জানতেন না কী করতে যাচ্ছেন। সর্বত্রই অচেনা এবং স্বতঃস্ফূর্ততা। কেউই ১৮ ফেব্রুয়ারির মানসিকতা অনুধাবন করতে পারেনি। ১৮ ফেব্রুয়ারি একটি গণবিপ্লবের মুহূর্ত এসেছিল। অসংখ্য প্রাণের মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যুকে তোয়াক্কা না করে সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমেছিল। সেদিন রাজপথে প্রাণ দেয়াটাই বড় হয়ে উঠেছিল। ঐ প্রাণ দেয়াকে সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারলে একটি গণবিপ্লব হতে পারত।
১৮ ফেব্রুয়ারি সারারাত দৈনিক পাকিস্তানের বার্তা বিভাগের টেবিলে শুয়ে শুয়ে ছটফট করেছি। ভেবেছি আন্দোলনের মোড় ঘোরাতে হলে রাজনৈতিক দল গঠন করতে হবে। পাকিস্তানের সামরিক শাসনে তখনো রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা বাতুলতা মাত্র। কিন্তু দল গঠনের বিকল্প কোনো পথ আমার কাছে সেদিন ছিল না। ১৯ ফেব্রুয়ারি ভোর থেকে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা শুরু হলো। সকলে মিলে একমত হলাম। একটি বিপ্লবের মুহূর্ত হারিয়েছি। আর নয়। এবার দল গঠন করতেই হবে।
১৯ ফেব্রুয়ারি ১৮ ফেব্রুয়ারির রেশ চলতে থাকে। পুলিশের গুলিতে ২০ জন নিহত হয়। সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস নিয়ে। ঢাকায় সান্ধ্য আইন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সান্ধ্য আইন প্রত্যাহারের দাবি জানায়। ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার দিকে একবার সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়। এক ঘন্টা পর পুনরায় সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। সান্ধ্য আইন ভেঙে মিছিল শুরু হয়। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হয় সান্ধ্য আইন তুলে নেবার। ১৪৪ ধারাও প্রত্যাহার করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান ঘোষণা করেন তিনি আর নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি লাভ করেন। মনি সিংহসহ ৩৪ জন রাজন্দিও মুক্তি পান। সকলেই ১১ দফার প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন।
এবার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মতানৈক্য শুরু হয় মুক্ত রাজবন্দিদের সংবর্ধনা নিয়ে। ছাত্রলীগ কিছুতেই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে অন্য কাউকে সংবর্ধনা দিতে রাজি হলো না। তাই শেখ মুজিবের সংবর্ধনা দেয়া হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে। এ জনসভায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কোনো শরিক ছাত্র প্রতিষ্ঠানকে না জানিয়ে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভায় জনাব তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেন। মনি সিংহসহ অন্যান্য সকলকে ২৪ ফেব্রুয়ারি স্টেডিয়ামে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এদিন থেকে বঙ্গবন্ধু শব্দটিকে বিতর্কিত করা হয়।