তৃতীয়বার রিং হতে অপরপ্রান্তে রিসিভার তুলল কেউ।
সিনথিয়া বারো, প্রাক্তন স্ত্রীর কণ্ঠস্বর চিনতে পারল পিটার, উদ্বেগে ভরা। সিনথিয়া, আমি পিটার!
ওহ, থ্যাঙ্ক গড, পিটার! রুদ্ধশ্বাসে বলল সিনথিয়া। তোমাকে আমি দুদিন ধরে কোথায় না খুঁজছি! শুনেছ সব…?
না।
মেলিসা-জেইন কি তোমার সাথে, পিটার?
না। মনে হলো, গ্রহটা কাত হয়ে যাচ্ছে ওর পায়ের নিচে।
ও নেই, পিটার। হারিয়ে গেছে! আজ দুই রাত হলো! আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাব!
পুলিশকে জানিয়েছ?
হ্যাঁ, সিনথিয়ার গলায় হিস্টিরিয়ার ভাব।
যেখানে আছে, সেখানেই থাকো, আমি আসছি ইংল্যান্ডে। কোনো মেসেজ থাকলে ডরচেস্টারে পাঠাবে। ফোন কেটে দিল পিটার। দুঃখ-শোকে-আতঙ্কে বেসামাল হয়ে পরেছে।
ডেস্কের পাশে ফ্যাকাসে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ব্যারনেস ম্যাগডা, হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ করা। কোনো প্রশ্ন করার দরকার নেই, পিটারের চেহারাতেই সব লেখা রয়েছে। পিটারও কিছু না বলে শুধু ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল। ফোনের দিকে ঝুঁকে ছিল পিটার, ঝুঁকেই থাকল। আবার ডায়াল করছে।
কলিন নোবলস, রিসিভারে হুঙ্কার ছাড়ল পিটার। বল আমি জেনারেল স্ট্রাইড এবং জরুরি।
ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে অপরপ্রান্তে হাজির হলো কলিন। পিটার, তুমি?
ওরা মেলিসাকে নিয়ে গেছে।
কারা? বুঝলাম না!
শত্রুরা। কিডন্যাপ করেছে মেলিসাকে।
জেসাস, গড! ঠিক জানো?
হ্যাঁ, কোনো সন্দেহ নেই। বোতলে করে ওর একটা আঙুল পাঠিয়েছে ওরা।
অপরপ্রান্তে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকল কলিন। তারপর বলল, দ্যাটস সিক, ক্রীস্ট, দ্যাটস্ রিয়েলি সিক!
পুলিশের সাথে যোগাযোগ কর, ওরা কি করছে জানো। তোমার সমস্ত প্রভাব কাজে লাগাও। ওরা অনেক জিনিস চেপে যাচ্ছে। সমস্ত তথ্য জোগাড় কর। কুত্তাগুলোকে আমি নিজের হাতে পেতে চাই। এখুনি আমি রওনা হচ্ছি, কোন ফ্লাইটে পরে জানাচ্ছি।
এই নম্বরে চব্বিশ ঘণ্টা লিসনিং ডিভাইস রাখলাম, প্রতিশ্রুতি দিল কলিন। এয়ারপোর্টে ড্রাইভার পাঠাব, তোমাকে নিয়ে আসবে। ইতঃস্তত করল সে। পিটার, আমি দুঃখিত। তুমি জানো।
জানি, কলিন।
আমরা তোমার সাথে আছি, স্যার, সবটুকু পথ।
রিসিভার নামিয়ে রেখে মুখ তুলল পিটার। নিজেও জানে না চোখের কোণ চিকচিক করছে। কারও শুনতে পাবার কথা নয়, ওর শরীরের প্রতিটি অঙ্গ থেকে প্রতিটি লোমকূপ মেলিসা মেলিসা বলে নিঃশব্দে চিৎকার করছে। এগিয়ে এসে পিটারের সামনে দাঁড়াল ব্যারনেস ম্যাগডা। আমি তোমার সাথে লন্ডনে যাচ্ছি।
হাত বাড়িয়ে ব্যারনেসের কবজি ধরল ও। না, এই সময়ে তোমার কিছুই করার নেই।
পিটার, তোমার এই কষ্টের সময় আমি সাথে থাকতে চাই। মনে হচ্ছে গোটা ব্যাপারটার জন্যে আমি দায়ী।
তুমি কেন দায়ী হতে যাবে!
কী চমৎকার একটা মেয়ে!
মাথা নাড়ল পিটার। এখানে থাকলে আরো বেশি সাহায্য করতে পারবে আমাকে। তোমার উৎস থেকে তথ্য জোগাড় কর। সব জানাও আমাকে।
পিটারের দৃঢ় চেহারার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর মাথা নিচু করল ব্যারনেস। ঠিক আছে, তবে তাই হোক। কোথায় যোগাযোগ করব তোমার সাথে?
থোর কমান্ডে কলিন নোবলসের ব্যক্তিগত নম্বর দিল পিটার, বলল, এই নম্বরে কলিন নোবলকে, না হয় ডরচেস্টারের নম্বরে আমাকে পাবে।
ঠিক আছে। কিন্তু অন্তত প্যারিস পর্যন্ত তোমার সাথে যেতে দাও আমাকে।
.
হিথরো এয়ারপোর্টে নেমে নিউজ স্ট্যান্ড থেকে এক কপি ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড কিনল পিটার, ঘটনার পুরো বিবরণ ইতোমধ্যে ছাপা হয়েছে কাগজে। লন্ডনে যাবার পথে গাড়িতে বসে পড়ল পিটার।
বৃহস্পতিবার, ১১টার সময় ক্যামব্রিজে নিজের বাসভবন থেকে কিডন্যাপ করা হয় ভিকটিমকে। একজন প্রতিবেশী মেরুন রঙের স্যালুনে তাকে উঠতে দেখেছেন। আমার ধারণা, গাড়িতে দুজন লোক ছিল, বত্রিশ বছর বয়স্ক প্রতিবেশী, শার্লি ক্যালন বলেন, মেলিসা জেইনকে দেখে অতটা আতঙ্কিত মনে হয় নি। মনে হলো, সে ইচ্ছে করেই গাড়িতে উঠছিল। এর আগেও ওর বাবা, যিনি সামরিক বাহিনিতে আছেন, বিভিন্ন গাড়ি পাঠাতেন মেয়ের জন্যে, কাজেই আমি অতটা আশ্চর্য হইনি। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যাপারটা নিয়ে কোনো ধরনের হৈচৈ হয় নি। মেয়ের মা মনে করেছিলেন, মেয়ে তার বাপের সাথে আছে। মেয়ের বাবা, জেনারেল স্ট্রাইডের সাথে যোগাযোগে ব্যর্থ হওয়ার পরই কেবল তিনি পুলিশকে জানান। পুলিশ মেরুন গাড়িটা খুঁজে পেয়েছে। ক্যামব্রিজ রেলওয়ে স্টেশনের কাছে পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল ওটা। আগের দিন লন্ডন থেকে চুরি করা হয় ওটা। দেশব্যাপী সতর্কবার্তা পৌঁছে গেছে পুলিশের কাছে। চিফ ইন্সপেক্টর অ্যালান রিচার্ডস এই তদন্তের দায়িত্বে আছেন। কারো কাছে কোনো সংবাদ থাকলে এই নম্বরে জানাতে পারেন–
একটা নম্বর দিয়ে, সবশেষে মেলিসার বর্ণনা দেয়া হয়েছে, কিডন্যাপ হওয়ার সময় কি পরে ছিল তাও উল্লেখ করা হয়েছে। দুমড়েমুচড়ে কাগজটা গোল পাকিয়ে সীটের এক কোণে ফেলে দিল পিটার। সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল ও, প্রচণ্ড রাগ যেন আগুনের লেলিহান শিখা হয়ে পেঁচিয়ে ধরেছে গোটা শরীর।
.
ইন্সপেক্টর অ্যালান রিচার্ডস মানুষটা ছোটখাটো, কিন্তু পাকানো রশির মতো হাত পা। চ্যাপ্টা মুখে অস্বাভাবিক খাড়া নাক চেহারায় কমেডিয়ানের একটা ভাব এনে দিয়েছে। মাথায় টাক পড়ছে, তাই চুল খুব লম্বা রাখে, চকচকে অংশগুলো ঢাকার জন্যে। চোখ জোড়া চঞ্চল আর বুদ্ধিদীপ্ত, কথা বলে সরাসরি এবং দৃঢ় কণ্ঠে।
পরিচিত হবার সময় পিটারের সাথে করমর্দন করল সে আপনাকে আগেভাগেই জানিয়ে দিচ্ছি, জেনারেল, পরিষ্কার পুলিশী কেস এটা। তবে উপর মহল থেকে আরো পরিষ্কারভাবে আমাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, প্রয়োজনে আপনাদের সাহায্য আমাকে নিতে হবে।
ইতোমধ্যে তদন্তের কাজ কতটুকু এগিয়েছে তার বিশদ বর্ণনা দিল সে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চারতলায় দুটো কামরায় দুজন সাব-ইন্সপেক্টর বসানো হয়েছে, তথ্য যেখান থেকে যা আসছে সেগুলোর সত্যতা যাচাই করছে তারা। টেলিফোনগুলোও সেখানে, এরই মধ্যে চারশর মতো কল রিসিভ করা হয়েছে। যেহেতু কোনো সূত্র এখনো পাওয়া যায়নি, প্রতিটি কল চেক করে দেখতে হবে। এই কাজে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বেশ বড়সড় একটা বাহিনিকে মাঠে নামানো হয়েছে।
সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, জেনারেল। আরো কিছু ব্যাপার আছে–আসুন আমার সাথে। পিটারকে নিয়ে ভেতরের অফিসে চলে এল সে। ইউনিফর্ম পরা একজন লোক ওদেরকে চা পরিবেশন করল।
তিনটে গাড়িই পাওয়া গেছে পরিত্যক্ত অবস্থায়, প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করে দেখছে আমার লোকেরা। ল্যান্ড-রোভারে একটা পার্স পাওয়া গেছে, আপনার প্রাক্তন স্ত্রী সেটাকে মেলিসার বলে সনাক্ত করেছেন। ছয়শর মতো ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া গেছে, সবগুলো প্রসেস করা হয়েছে, তবে মিলিয়ে দেখতে কিছু সময় লাগবে। আপনার মেয়ের কামরায় এর দুটো মিলেছে। চিনি লাগবে, দুধ?
পিটারের কাছে কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলে চলেন ইন্সপেক্টর।
হাতি-ঘোড়া যাই হোক, টেলিভিশনে প্রচার করব আমরা। আসলে অপেক্ষা করছি আমরা, জেনারেল। কিডন্যাপাররা মুক্তিপণ চেয়ে যোগাযোগ করবে। কিংবা কেউ ওদের দেখতে পেয়ে ফোন করবে। আপনার প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে ওরা যোগাযোগ করবে বলে মনে করি না, তবু ফোনে আড়ি পাতা যন্ত্র ফিট করা হয়েছে। এবার আপনার পালা, জেনারেল স্ট্রাইড। আশা করছি আপনার কাছ থেকে মূল্যবান কিছু তথ্য পাব আমরা।
আড়চোখে একবার কলিনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল পিটার।
ইন্সপেক্টর রিচার্ডস বলে চলেন : আমার ধারণা, আপনি অততটা ধনী নন। কিন্তু আপনার পরিবার? ভাই?
পরিকল্পনা উড়িয়ে দিল পিটার। আমার ভাইয়ের নিজের ছেলেমেয়ে আছে। কিডন্যাপ করতে চাইলে ওদের করার কথা।
প্রতিশোধ-কোন ধরনের? আয়ারল্যান্ডে আপনার কাজের জন্যে? বা ০৭০ বোয়িং–এর ঘটনায়?
হতে পারে।
এখন আর আপনার সাথে আর্মির যোগাযোগ নেই বলেই আমার বিশ্বাস।
এই বিষয়ে বেশি কথা বলতে রাজি নয় পিটার।
এ ধরনের অনুমান নির্ভর কাজে কোনো ফল পাবেন না। কিডন্যাপাররা ডিমান্ড করলেই পুরো ব্যাপারটা খোলসা হবে।
এটা ঠিক, মেনে নিলেন ইন্সপেক্টর। ওরা কি আপনাকে মেয়েটার–মানে পিটারের মুখাবয়ব দেখে থেমে গেলেন তিনি। আমি দুঃখিত, জেনারেল। খুবই নোংরা একটা ব্যাপার। কিন্তু এতে করে একটা ব্যাপার প্রমাণ হয়, আপনার মেয়ে এখনো জীবিত আছে। আঙুলটা তার প্রমাণ। এটা একটা হুমকি—-কিংবা আর্নেস্ট ইনটেনশন।
ডেস্কের ফোন ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল, ছো দিয়ে রিসিভার তুলল ইন্সপেক্টর। খানিকক্ষণ কথা বলে রিসিভার নামি রাখল সে, কিছুক্ষণ মুখ ভার করে থাকল। তারপর পিটারকে বলল, ল্যাবরেটরি থেকে জানানো হলো আঙুলটা মেলিসারই। আপনি মনে হয় জানেন, আপনার মেয়ে একজন হোয়াইট সেল ডোনার?
মাথা নাড়ল পিটার। এই হলো মেলিসা। বাধা না থাকলে কবে নিজের বোন ম্যারো আর বালতি ভর্তি রক্তে দান করে দিত মেয়েটা।
ক্যামব্রিজ হাসাপাতালের রেকর্ড বলছে আঙুলটা ওরই। টিস্যু টাইপ মিলছে। অন্যকারো সাথে এটা মিলার কথা না।
মনে মনে ক্ষীণ একটু আশা ছিল পিটারের, আঙুলটা মেলিসার নাও হতে পারে, কিডন্যাপাররা হয়তো কোনো লাশের আঙুল কেটে পাঠিয়েছে। চেহারা কঠোর হয়ে উঠল ওর।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল ওরা, এক সময় ইন্সপেক্টর কিছু বলতে যাচ্ছে দেখে তাকে বাধা দিল কলিন। আপনি তো হোর কমান্ড সম্পর্কে শুনেছেন, তাই না, ইন্সপেক্টর?
শুনিনি মানে? এই তো কিছু দিন আগে জিরো-সেভেন-জিরো…
সন্ত্রাসবাদীদের হাত থেকে ভিকটিমকে ছিনিয়ে আনার ব্যাপারে আমরাই সম্ভবত দুনিয়ার সেরা টিম…।
কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি, মি. কলিন, শুকনো গলায় বিড়বিড় করে বলল ইন্সপেক্টর। কিন্তু আগে কিডন্যাপারদের সন্ধান পেতে দিন, সমস্ত উদ্ধার তৎপড়তা পুলিশ কমিশনারের আন্ডারে হবে।
.
রাত তিনটের সময় পার্ক লেনের ডরচেস্টার হোটেলে পৌঁছুল পিটার। নাইট রিসেপশনিস্ট বলল, স্যুইটটা আপনার জন্যে মাঝরাত থেকে রাখা হয়েছে, মি. পিটার।
দুঃখিত, বলল পিটার। ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত দেখাল ওকে। কিডন্যাপার আর মেলিসার সন্ধান পাবার জন্যে সম্ভাব্য সব কিছু করা হচ্ছে, এই উপলব্ধি নিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এসেছে ও। ইন্সপেক্টর কথা দিয়েছে, জরুরি যে কোনো খবর পাবার সাথে সাথে ফোনে পিটারকে জানাবে সে।
রেজিস্টার বুকে সই করে চাবি নিল পিটার, ক্লান্ত চোখের পাতা জোর করে মেলে আছে।
এই নিন, স্যার, কয়েকটা মেসেজ।
থ্যাঙ্ক ইউ এগেইন, অ্যান্ড গুড নাইট।
এলিভেটরে চড়ে এনভেলাপগুলোর ওপর চোখ বুলাল পিটার। প্রথমটা টেলিফোন মেসেজ, ক্লার্ক লিখে রেখেছে। ব্যারনেস ম্যাগডা অনুরোধ করেছেন তাকে আপনি ফোন করবেন। হয়তো প্যারিসে কিংবা রবুইলে-র নম্বরে।
দ্বিতীয়টাও টেলিফোন মেসেজ। মিসেস সিনথিয়া বারোউ ফোন করেছিলেন। তিনি সিক্স-নাইন-নাইন/থ্রী ওয়ান খ্রী তে ফোন করতে বলেছেন।
তৃতীয়টা সীল করা এনভেলাপ, দামি সাদা কাগজ। পিটারের নাম লেখা রয়েছে। গোটা গোটা অক্ষরে। কোনো স্ট্যাম্প নেই। তার মানে হাতে করে দিয়ে গেছে কেউ। বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করতে লাগল পিটারের।
এনভেলাপটা ছিঁড়ে ভেতর থেকে একটা চিরকুট বের করল ও। সেই একই গোটা গোটা অক্ষরে লেখা হয়েছে চিঠিটা। রুদ্ধশ্বাসে পড়তে শুরু করল পিটার।
একটা আঙুল ইতোমধ্যে পেয়েছেন, এরপর হাতটা পাবেন, তারপর একটা পা। এভাবে আরেকটা পা, দুটো চোখ, সবশেষে মাথাটা। বিশে এপ্রিলে দ্বিতীয় পার্সেলটা পাবেন। তারপর থেকে প্রতি সাত দিন অন্তর একটা করে পার্সেল। এটা ঠেকাতে হলে জীবনের বদলে জীবন চাই আমরা। যেদিন ডক্টর কিংস্টোন পার্কার খুন হবেন সেদিনই আপনার মেয়ে আপনার কাছে ফিরে যাবেন, জীবিত এবং সুস্থ। চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলুন, এটার কথা কাউকে জানাবেন না। জানালে অপেক্ষা না করে সাথে সাথে ডেলিভারি দিতে হবে মাথাটা। খলিফা।
সই করা নামটা দেখে পিটার যেন পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলো। স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করলেও, সারা শরীর কাঁপতে লাগল। দুবার কাগজটা ভাজ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো, অগত্যা মুচড়ে ছোট করে ভরে রাখল পকেটে। পোর্টার ওর দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু এলিভেটর থামার পর পিটারকে নামতে না দেখে ঘাড় ফেরাল সে। এতক্ষণে সংবিৎ ফিরে পেল পিটার। নিজের স্যুইটে ঢুকে টাকা দিল পোর্টারকে, কত বলতে পারবে না। দরজা বন্ধ হবার সাথে সাথে দোমড়ানো কাগজটা বের করে ভাজ খুলল সেটার।
বারবার পড়ল পিটার, এক সময় শুধু পড়ে গেল, শব্দগুলোর কোনো অর্থ পাচ্ছে না। উপলব্ধি করল, জীবনে এই প্রথম পরিপূর্ণ আতঙ্ক গ্রাস করেছে ওকে। সম্পূর্ণ দিকভ্রান্ত আর বোধবুদ্ধিহীন লাগছে নিজেকে।
বুক ভরে বাতাস টেনে চোখ বন্ধ করল পিটার। এক থেকে একশ পর্যন্ত গুনল ধীরে ধীরে, সমস্ত চিন্তা থেকে মুক্ত করল মাথাটাকে। তারপর নির্দেশ দিল নিজেকে :
ভাবো!
বেশ, ওর গতিবিধি সম্পর্কে খবর রাখছে খলিফা। এমনকি কখন ওর ডরচেস্টারে আসার কথা তাও তার জানা। কে কে জানত ব্যাপারটা? সিনথিয়া। কলিন নোবলস্। ব্যারনেস ম্যাগডা। রবুইলেতে ব্যারনেসের সেক্রেটারি, সেই তো স্যুইটটা রিজার্ভ করেছিল। আরো জানে ডরচেস্টার হোটেলের কর্মচারীরা। তার মানে অনেক লোক জানে, এদের কার কাছ থেকে খলিফা খবরটা পেয়েছে বের করা প্রায় অসম্ভব।
ভাবো!
আজ এপ্রিলের চার তারিখ। ষোল দিন পর খলিফা মেলিসার হাতটা পাঠাবে। আতঙ্কে আবার কাঁপতে শুরু করল পিটার, মনের সমস্ত ইচ্ছাশক্তি দিয়ে শান্ত করল নিজেকে।
ভাবো!
খলিফা ওর ওপর নজর রাখছিল, খুঁটিয়ে মাপছিল, ওর মূল্যায়ন করছিল। পিটারের মূল্য হলো, কারও মনে সন্দেহের উদ্রেক না করে ওপর মহলে আসা যাওয়া করতে পারে। ইচ্ছে করলেই একটা অনুরোধের মাধ্যমে অ্যাটলাসের প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করতে পারে ও। শুধু কি তাই, ইমার্জেন্সি দেখা দিলে যে কোনো বন্ধু রাষ্ট্রের সরকার প্রধানের সাথেও অল্প সময়ের নোটিশে দেখা করতে পারবে ও।
কেবিনেট থেকে বোতল বের করল, গ্লাস বা বরফ খোঁজার ধৈর্য হলো না, বোতল থেকে সরাসরি গলায় ঢালল খানিকটা স্কচ হুইস্কি। আয়নায় অচেনা মুখ, ওকে যেন ভেঙচাচ্ছে। বিষম খেয়ে খকখক করে কাশল পিটার। বোতল রেখে দিয়ে আবার পড়ল চিঠিটা।
ভাবো, পিটার!
খলিফা তাহলে এভাবে কাজ করে। নিজে কখনো আত্মপ্রকাশ করে না। দক্ষ, প্রফেশনাল লোকদের দিয়ে কাজ করায়। লোকগুলো বেশিরভাগ ফ্যানাটিক, ইনগ্রিডের মতো। ট্রেনিং পাওয়া খুনি, লা পিয়েরে বেনিতের নদীতে যাকে মারা হয়েছে ও তার মতো।
পুরানো একটা কথা আছে, তাতে পিটারের বিশ্বাস ছিল না। কথাটা হলো সব মানুষেরই একটা মূল্য আছে। নিজেকে আর সবার চেয়ে আলাদা ভাবত ও। এখন জানে, তা নয়। এই নতুন উপলব্ধি অসুস্থ করে তুলল ওকে।
খলিফা ওর, পিটার স্ট্রাইডের, মূল্য জেনে গেছে। মেলিসা, ওর মেয়ে!
নিজের অজ্ঞাতেই কাগজটা মুঠোর ভেতর দলা পাকিয়ে ফেলল পিটার। সামনে রাস্তা দেখতে পেল, যে পথে নিয়তি ওকে টেনে নিয়ে যাবে। মনের চোখে দেখতে পেল, ইতোমধ্যেই রাস্তাটায় প্রথম পা ফেলা হয়ে গেছে তার। জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টের টার্মিনাল ভবনে ইনগ্রিডকে মেরে ফেলে এই প্রথম পদক্ষেপটা নিয়েছে সে।
রাস্তাটা ওকে খলিফা দেখিয়েছে। খলিফাই ওকে সেই রাস্তা ধরে সামনে টেনে নিয়ে যাবে।
অকস্মাৎ যেন দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পেল পিটার, ডক্টর পার্কার প্রাণ হারালেই ওর পথ চলা ফুরাবে না। খলিফার ফাঁদে একবার পা দিলে চিরকালের জন্যে বাঁধা পড়ে যাবে ও। কিংবা দুজনের একজন, পিটার বা খলিফা, পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।
আবার বোতলটা তুলে নিল পিটার।
হ্যাঁ, মেলিসা হলো পিটারের মূল্য। সঠিক মূল্যই নির্ধারণ করেছে খলিফা। মেলিসার বদলে অন্য কেউ হলে পিটার বোধ হয় তার দেখানো পথে বেরুতে না।
কাগজটা পুড়িয়ে ফেলল পিটার। কাপড়চোপড় না ছেড়ে জানালার সামনে সোফায় বসে পড়ল ধপাস করে, গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল। এতক্ষণে বুঝতে পারল কি রকম ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ঊরুর নার্ভগুলো থরথর করে কাঁপছে।
ডক্টর পার্কারের কথা ভাবল পিটার। এ ধরনের একটা মানুষ মানবসভ্যতাকে অঢেল দিতে পারেন, মানবকল্যাণে অপরিসীম অবদান রাখতে পারেন। আমি কি করব জানি না, কিংবা জানি কিন্তু স্বীকার করছি না। যদি ঠিক করি মেলিসার জন্যে অন্যায় কাজ করব, তাহলে ব্যাপারটাকে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে মনে হয় খুন করার চেষ্টা করা হয়েছিল আমাকে, ডক্টর পার্কারকে নয়। ঘটনাচক্রে মারা গেছেন তিনি। গুলিটা আমাকে না লেগে, লেগেছে তাকে।
বোমা হলে ভালো হয়, ভাবল পিটার। বোমার প্রতি একটা ঘৃণা আছে ওর মনে। বোমা যেন বিবেকহীন ভায়োলেন্সের প্রতীক। বোমা ছাড়া উপায় নেই। গুলির মতো সরাসরি ছুঁড়তে হয় না।
শেষপর্যন্ত খলিফারই জিত হলো। পিটার জানে, খলিফার মতো লোক মেলিসার সন্ধান পাবার কোনো সুযোগ রাখেনি।
সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারল না পিটার। ভোরের আলো ফোঁটার পর হকচকিয়ে গেল ও। এখনো প্ল্যান করছে, কিভাবে খুন করা যায় ডক্টর পার্কারকে।
.
ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না! ভ্রু কুঁচকে বিস্ময় প্রকাশ করল ইন্সপেক্টর রিচার্ডস। এখনো ওরা মুক্তিপণ চেয়ে যোগাযোগ করছে না কেন! আজ পাঁচ দিন, তাই না?
অথচ ওরা জানে কোথায় পাওয়া যাবে পিটারকে। দামি ডাচ চুরুট ধরাল কলিন নোবলস, তারপর অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।
বি.বি.সি. টিভি থেকে কিডন্যাপারদের উদ্দেশে একটা আবেদন প্রচার করেছে পিটার, ওর মেয়ে মেলিসাকে যেন আর নির্যাতন করা না হয়। জনসাধারণকেও সহযোগিতা করার আহ্বান জানানো হয়েছে, মেলিসা-জেইনকে উদ্ধার করার সহায়ক যে কোনো তথ্য সরাসরি যেন স্ট্রাইড পিটারের নামে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়া হয়। একজন কিডন্যাপারের পুলিশ আইডেনটিকিট পোর্টরেট-ও দেখানো হয়েছে দর্শকদের। মেরুন রঙের একটা স্যালুনে মেলিসাকে তোলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে ড্রাইভারের ছবিটা তৈরি করে পুলিশ বিভাগের শিল্পী।
সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল সাড়া পাওয়া গেল। চব্বিশ ঘণ্টা বাজতে লাগল টেলিফোনগুলো। উৎসাহের সাথে তৎপর হয়ে উঠল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড পুলিশ। মেলিসা-জেইনের সাথে চেহারার মিল আছে এই খবর পেয়ে বিভিন্ন জায়গায় হানা দিল তারা। কিন্তু হানা দেয়ার পর জানা গেল, লোকটা মেক্সিকান, বউকে খুন করে ইংল্যান্ডে পালিয়ে এসেছে, ড্রাগ খেয়ে লুকিয়ে আছে হোটেলে। তার সঙ্গিনীর সঙ্গে মেলিসার মিল আছে বটে।
আরেক হোটেলে হানা দিয়ে চৌদ্দ বছরের একটা কিশোরীকে পাওয়া গেল তেত্রিশ বছরের এক লোকের সাথে বিছানায়।
মেরুন স্যালুনের ড্রাইভারের সাথে এক লোকের চেহারার মিল আছে, এই খবর পেয়ে উত্তর স্কটল্যান্ডের একটা পরিত্যক্ত বাড়ি ঘেরাও করা হলো। পরে জানা গেল, লোকটা বাড়িতে এল.এস.ডি. তৈরি করে। চারজন খদ্দের সহ গ্রেফতার করা হলো তাকে। তার এক সহকারীর চেহারা অনেকটা মেলিসার মতো বটে!
সবগুলো ফলস অ্যালার্ম, ছুটোছুটিই সার হলো।
ইন্সপেক্টর অ্যালান রিচার্ডসের ওপর রেগে গেছে পিটার। প্ৰটিটা জায়গায় দেরি করে পৌঁছেছে আপনার লোকজন। মেলিসা ও-সব জায়গায় থাকলেও তাকে আমরা উদ্ধার করতে পারতাম না। এরপর হানা দেয়ার জন্যে যাবে হোর কমান্ডোরা থোর কমিউনিকেশনস নেটওয়র্কের সাহায্যে সরাসরি ডক্টর কিংস্টোন পার্কারের সাথে কথা বলল পিটার।
আমরা আমাদের সমস্ত ক্ষমতা কাজে লাগাব, ডক্টর পার্কার পিটারের সাথে একমত হলেন, তার চেহারায় দরদ এবং উদ্বেগ ফুটে উঠল।
পিটার, এই দুঃসময়ে প্রতিটি মুহূর্ত তোমার সাথে আমি। কেউ অভিযোগ না করলেও আমি জানি তোমার এই বিপদের জন্যে আমিই দায়ী। কল্পনাও করিনি হামলাটা ওরা তোমার মেয়ের ওপর করবে। আমি ব্যবস্থা করছি, এখন থেকে হানা দেবে থোর কমান্ড। তুমি জানো, যে কোনো সাহায্য চাইলেই আমার কাছ থেকে পাবে তুমি।
ধন্যবাদ, ডক্টর পার্কার। একটা অপরাধবোধ দুর্বল করে ফেলল পিটারকে। আজ থেকে দশ দিনের মধ্যে এই ভদ্রলোককে খুন করার কথা ওর। তা না হলে কিডন্যাপাররা মেরে ফেলবে মেলিসাকে।
ডক্টর পার্কারের প্রভাবে কাজ হলো সাথে সাথে। পুলিশ কমিশনারের মাধ্যমে নির্দেশটা ছয় ঘণ্টা পর ডাউনিং স্ট্রীট থেকে পৌঁছে গেল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে। এরপর সন্দেহবশত কোথাও হানা দেয়ার দরকার হলে দায়িত্বটা নেবে থোর কমান্ড।
রয়্যাল এয়ারফোর্স থেকে একজোড়া হেলিকপ্টার দেয়া হয়েছে হোর কমান্ডকে, দুর্গম এবং বৈরী পরিস্থিতিতে অবরোধ ভেঙে ভেতরে ঢোকার ও প্রাণ বা মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসার কঠিন ট্রেনিংয়ে সেগুলো ব্যবহার করছে থোরের অ্যাসল্ট ইউনিট। পিটারের সাথে কলিনও কাজ করছে ট্রেনার হিসেবে।
ট্রেনিংয়ের ফাঁকে দিনের বাকি সময়টা ঘেরাও করা পিস্তল রেঞ্জে কাটায় পিটার এবং ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ রেখে অপেক্ষা করে। কিন্তু এক এক করে পেরিয়ে যাচ্ছে দিনগুলো ফলস অ্যালার্ম আর বিপথু সূত্রের মধ্যে দিয়ে।
রোজ রাতে অল্প পরিমাণে হলেও হুইস্কি খেতে হয় পিটারকে, তা না হলে ঘুম আসে না। হাতে গ্লাস নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় ও। দিনে দিনে বদলে যাচ্ছে চেহারা-ঝুলে পড়ছে মুখ, চোখের নিচে কালি, দৃষ্টিতে সন্ত্রস্ত ভাব।
ডেডলাইনের ছয় দিন বাকি, ব্রেকফাস্ট না করেই হোটেল কামরা থেকে বেরিয়ে এল পিটার। গ্রীন পার্কের কাছে টিউব ধরে নেমে এল ফিনসবারি পার্কের কাছে। স্টেশনের কাছাকাছি একটা দোকান থেকে বিশ পাউন্ড অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট গার্ডেন ফার্টিলাইজার কিনল। ডরচেস্টারে নিজের কামরায় ফিরে এসে প্লাস্টিক ব্যাগে ভরা নাইট্রেট সুটকেসে রেখে তালা দিল, সুইকেসটা রাখল ক্লজিটের ভেতর ট্রেঞ্চ কোটের পিছনে।
সে রাতে ব্যারনেস ম্যাগডার সাথে আবার কথা হলো পিটারের। আগের মতোই লন্ডনে পিটারের পাশে আসার অনুমতি চাইল সে।
আমি কি তোমার কোনো সাহায্যেই আসব না? সাহায্যে না আসি, তোমার পাশে দাঁড়াবার অধিকারটুকুও কি নেই আমার? শুধু তোমার হাত দুটো ধরার সুযোগ পেলেও মনে হবে তোমাকে একটু সান্ত্বনা দিতে পারলাম…
না, ম্যাগডা। ও ধরনের ছেলেমানুষি করার পর্যায় আমরা পেরিয়ে এসেছি। গলার সুরটা যে নিষ্ঠুর আর কর্কশ পিটার নিজেও তা টের পেল। জানে, সংযমের শেষ কিনারায় পৌঁছে গেছে, যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফারিত হতে পারে। তোমার উৎস থেকে তুমি কিছু জানতে পেরেছ কিনা বল?
দুঃখিত, পিটার। কিছু জানা যাচ্ছে না, একদম কিচ্ছু না। তবে আমার লোকেরা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করছে না…।
মাথায় স্ক্রু লাগানো একটি কন্টেইনারে করে পাঁচ লিটার ডিজেল কিনে আনল পিটার। বাথরুমে বসে নাইট্রেট আর ডিজেল নিয়ে কাজ করতে বসল। এক সময় তৈরি হয়ে গেল একুশ পাউন্ড হাই এক্সপ্লোসিভ। কন্টেইনারটাই বোমা হয়ে গেল, মুখে থাকল একটা ফ্ল্যাশলাইট বালব। পুরো একটা সুইট ধ্বংস করবে এই বোমা, স্যুইটে কেউ থাকলে তার বাঁচার কোনো উপায় নেই।
মনে মনে একটা হোটেলও বেছে রেখেছে পিটার। হোটেল ডরচেস্টার। আগেই একটা স্যুইট ভাড়া করে রাখবে ও। খলিফা সম্পর্কে জরুরি একটা তথ্য আছে, এই কথা বলে ডক্টর পার্কারকে ডরচেস্টারে আনানো সম্ভব। বলবে, তথ্যটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে সাক্ষাতে এবং গোপনে দিতে হবে।
সে রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আয়নায় নিজের চেহারা দেখে চমকে উঠল পিটার। মনে হলো দুরারোগ্য কোনো ব্যাধিতে ভুগছে লোকটা। হুইস্কির বোতলটা। শেষ করল পিটার। এতে করে যদি ঘুমানো সম্ভব হয়।
.
আইরিশ সী থেকে তীরের তীক্ষ্ণতা নিয়ে ছুটে আসছে হিম বাতাস, বাতাসের আগে আগে উইকলো পাহাড় শ্রেণির ওপর দিয়ে ছুটছে সীসা রঙের মেঘমালা।
মেঘের স্তরে কোথাও কোথাও ফাঁক দেখা গেল, সেই ফাঁক গলে প্রায় নিপ্রভ সূর্যের মান আলো পড়ল সবুজ গাছপালা ঢাকা ঢালগুলোয়। তারপরই শুরু হলো বৃষ্টি।
দুর্যোগ মাথায় করে গ্রামের নির্জন পথে বেরিয়ে এল একটা লোক।
ট্যুরিস্টরা এখনো আসতে শুরু না করলেও তাদের স্বাগত জানানোর জন্যে রাস্তার দুপাশে বাড়িগুলোর ফটকে রঙচঙে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে—ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল, ড্রিঙ্ক গিনিস।
রাস্তার ডান পাশে পাব, সেটাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে চলল লোকটা। তার পরনে টকটকে লাল কোট, দৃষ্টিতে পীড়া দেয়। গ্রামটাকে দুভাগে ভাগ করেছে ব্রিজটা, মাথা নিচু করে সেটা পেরোল সে। ব্রিজের গায়ে বড় বড় হরফে শ্লোগান লেখা। রয়েছে, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা নিপাত যাক। ব্রিজের নিচে খরস্রোতা নদী তুমুল বেগে ছুটে চলেছে সাগরের দিকে। চওড়া কার্নিস সহ সুতি ক্যাপ লোকটার মাথায়, প্রায় ঢেকে রেখেছে চোখ দুটোকে। চোরাচোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সে। পায়ে গোড়ালি ঢাকা বুট, কিন্তু হাঁটছে বিড়ালের মতো সতর্কতার সাথে। গ্রামে মাত্র দুএকটা বাড়ি দোতলা বা তিনতলা, বৃষ্টি আর বাতাসের মধ্যে পরিত্যক্ত বলে মনে হলো। কিন্তু তার জানা আছে, পর্দা ঘেরা জানালা দিয়ে নজর রাখা হচ্ছে তার ওপর।
উইকলো পাহাড়ের নিচের ঢালে এই গ্রাম ডাবলিন থেকে মাত্র ত্রিশ মাইল দূরে। বড় শহরের এত কাছাকাছি আশ্রয় নেয়া উচিত হয়নি। কিন্তু সিদ্ধান্তটা তার নয়। এখানে লোকজন কম, যে কোনো আগন্তুককে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। হয় শহরের ভেতর নাহয় শহর থেকে অনেক দূরে নির্জন কোনো এলাকায় থাকতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়নি।
গ্রামে ওরা আসার পর আজ নিয়ে তিনবার বাইরে বেরুল সে। প্রতিবার জরুরি কোনো জিনিসের প্রয়োজন দেখা দেয়ায় বেরুতে হয়েছে। বুদ্ধি করে আগেই যদি জিনিসগুলোর ব্যবস্থা করে রাখা হতো তাহলে আর বেরুতে হতো না। এমন অব্যবস্থার শিকার হতে হবে জানলে কাজটা হয়তো নিত না সে। তবে হ্যাঁ, স্বীকার করতে হবে টাকাটা খুব বেশি। এত টাকা একসাথে দেখেনি সে। এই টাকায় সারাজীবন বসে খেতে পারা যায়। স্বপ্ন বলে মনে হয়–এক লাখ পাউন্ড! পঞ্চাশ হাজার অগ্রিম দেয়া হয়েছে, বাকি পঞ্চাশ হাজার পাবে কাজ শেষ হলে।
কিন্তু তবু কয়েকটা ব্যাপার মেনে নিতে মন চায় না। সহকারী একজন দরকার ছিল তা ঠিক, কিন্তু তাই বলে একজন বদ্ধ মাতালকে গছিয়ে দেয়ার কি দরকার ছিল! দায়িত্বটা তাকে দিলে সেইতো যোগ্য একটা লোক বেছে নিতে পারত।
অসন্তুষ্ট লোকটার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। কদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল, আজ একেবারে মুষলধারে শুরু হয়েছ। বাড়িটায় সেন্ট্রাল হিটিং থাকলেও সেটা তেলে চলে, এবং কাজ করছে না। ছোট একটা ফায়ার প্লেস আছে, কিন্তু কয়লা থেকে ধোঁয়া ওঠে। বাড়িটা সঁতসেঁতে, দেয়াল আর ছাদ থেকে পানি পড়ে। প্রতিটি কোণে মাকড়সার জাল। টিকটিকি, ইঁদুর, তেলেপোকা আর পিঁপড়েদের রাজত্ব। কে জানে, সাপও থাকতে পারে, গর্ত তো আর এক-আধটা নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা ঠাণ্ডা, আর সময় কাটানো। হাফ-বুড়ো একটা মাতালের সাথে কি কথা বলবে সে!
নিজের কাজে সে দক্ষ, আন্ডারগ্রাউন্ডে তার সুনামও আছে। কিন্তু কাজটা নেয়ার পর দেখা যাচ্ছে, চাকরের ভূমিকা দেয়া হয়েছে তাকে। কিছু কেনার জন্য মাতালটাকে বাইরে পাঠানো সম্ভব নয়, কাজেই বাধ্য হয়ে তাকেই বারবার বেরুতে হচ্ছে।
মুদি দোকানদার তাকে আসতে দেখল। চাপা গলায় বউকে ডাকল সে, অ্যাই, দেখে যাও, দেখে যাও, পোড়াবাড়ির লোকটা আবার আজ আসছে!
পিছনের দরজা ঠেলে দোকানে বেরিয়ে এল দোকানদারের কুমড়োমুখী চোখ জোড়া চকচক করছে কৌতূহলে। শহুরে লোক গ্রামে ঠাঁই নিয়েছে, তারপর আবার এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বাইরে না বেরিয়ে পারেনি। তুমি যাই বল, আমি কিন্তু একটা কেচ্ছার গন্ধ পাচ্ছি!
পোড়োবাড়ির নতুন বাসিন্দাদের সম্পর্কে এরই মধ্যে নানা রকম গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, যদিও গ্রামবাসীরা এই একজনকে ছাড়া আর কাউকে দেখেনি এখনো। স্থানীয় এক্সচেঞ্জের টেলিফোন অপারেটর মেয়েটা প্রথম জানায়, পোড়োবাড়িতে একাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। দেশের বাইরে টেলিফোন কল করা হয়েছে দুটো। পরবর্তী খবর পাওয়া গেল মিউনিসিপ্যালিটির ট্রাক ড্রাইভারের কাছ থেকে, ডাস্টবিন থেকে শুধু ক্যান পাওয়া গেছে। তার মানে পোড়োবাড়ির লোকেরা তাজা শাক সবজি বা মাংস খায় না, টিনজাত খাবার খেয়ে বেঁচে আছে। ডাস্টবিনে কিছু তুলো আর গজ পাওয়া গেছে, কারণটা অজ্ঞাত। কারও কারও ধারণা, বাড়িটায় অসুস্থ কোনো লোক আছে, বা হয়তো আহত হয়েছে কেউ।
আমার ধারণা, বাড়িটায় কোনো খারাপ কাজ হচ্ছে, কনুই দিয়ে স্বামীর পাঁজরে মৃদু গুঁতো দিয়ে বলল দোকানদারে বউ।
চুপ, চুপ! স্ত্রীকে সাবধান করল দোকানদার। বিপদ ডেকে আনতে চাও নাকি, আঁ?
দোকানে ঢুকে শহুরে লোকটা ক্যাপ খুলল, দরজার ফ্রেমে আছাড় মেরে পানি ঝাড়ল। ওদের দিকে ফিরে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সে।
গুড মর্নিং, মি. ব্যারি। সব ভালো তো?
পোড়োবাড়ির ব্যারি জবাব না দিয়ে শুধু মাথা ঝাঁকাল। শেলফের ওপর চোখ বুলিয়ে দেখে নিচ্ছে কি কি আছে।
তা বইটা কত দূর লেখা হলো, স্যার? ব্যারি দুধওয়ালাকে জানিয়েছে, সে নাকি একটা বই লিখছে। অসম্ভব নয়, ভাবল দোকানদার। উইকলো পাহাড়ে সারা বছরই কিছু লেখক আসে লেখার কাজ শেষ করার জন্যে। এলাকাটা নিরিবিলি তো বটেই, তাছাড়া আয়ারল্যান্ড সরকার লেখক-শিল্পীদের ট্যাক্স কনসেশন দিয়ে থাকে।
একটু একটু করে লিখছি, বলে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেল ব্যারি। কি কি লাগবে মুখস্থ করে এসেছে সে, দোকানদার জিনিসপত্র নামাতে শুরু করল শেলফ থেকে।
সবগুলো নামানো শেষ হলে খাতা পেন্সিল হাতে নিল দোকানদার, নাম আর দাম লিখবে। একটা জিনিস হাতে নিয়ে ব্যারির দিকে তাকাল সে চোখে প্রশ্ন। কিন্তু ব্যারি কোনো জবাব দিল না, বরং তার চেহারা কেমন যেন কঠোর হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি জিনিসটা নামিয়ে রেখে লেখা শেষ করল দোকানদার। যোগ করল সে, বলল, তিন পাউন্ড বিশ পেন্স।
দাম চুকিয়ে বেরিয়ে গেল ব্যারি। পিছন থেকে দোকানদার বলল, ঈশ্বর আপনার সহায় হোন, মি. ব্যারি। কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া গেল না।
স্বামীর পাজরে আবার গুতো মারল দোকানদারের বউ। কেমন বদমেজাজী, তাই না? নিশ্চয়ই কোনো মেয়েকে জোর করে আটকে রেখেছে বাড়িটায়।
হু, চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল দোকানদার। প্যাড, ব্রেসিয়ার, প্যান্টি–চিন্তারই কথা।
দ্রুতহাতে চুলে চিরুনি চালাতে শুরু করে দোকানদারের বউ বলল, যাই, পাশের বাড়ির নতুন বউটার সাথে একটু দেখা করে আসি। কোনো সন্দেহ নেই, এক ঘণ্টার মধ্যে খবরটা গোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়বে। শুধু মেয়েলি জিনিসই নয়, অ্যান্টিসেপটিক মলম আর ব্যান্ডেজ কিনেছে পোড়োবাড়ির লোকটা।
সরু একটা গলির শেষ মাথায় বাড়িটা, গলির দুপাশে বারো ফুট উঁচু পাঁচিল। বাড়ির সামনের পাঁচিলও বারো ফুট উঁচু, বাইরে থেকে ভেতরের কিছুই দেখা যায় না। দরজা পুরানো হলেও, তালাটা নতুন। সেটা খুলে ভেতরে ঢুকল ব্যারি। ভেতরে প্রথমে একটা একচালা, গ্যারেজ বলা যেতে পারে। গ্যারেজে গাঢ় নীল রঙের একটা অস্টিন রয়েছে, দুসপ্তাহ আগে বহু দূর এক শহর থেকে চুরি করা চুরি করার পর রঙ বদলানো হয়েছে গাড়িটার, বদলানো হয়েছে নম্বর প্লেট। রোজ দুবার করে স্টার্ট দেয় ব্যারি, দরকারের সময় ঠিকমতো কাজ করবে কিনা চেক করে রাখে। তার যা পেশা, এক সেকেন্ড এদিক-ওদিক হয়ে গেলে প্রাণ হারাতে হতে পারে। ইগনিশনে ঢুকিয়ে চাবি ঘোরাতেই স্টার্ট নিল অস্টিন। আধ মিনিট ধরে ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনল সে, সন্তুষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকাল। স্টার্ট বন্ধ করার আগে অয়েল প্রেশার আর ফুয়েল গজও চেক করল। গাড়ি থেকে নেমে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল কিচেনের সামনের উঠানে।
আগাছায় ভরে আছে উঠানটা, চারদিকে ব্যাঙের ছাতা। কিচেনে ঢুকে ক্যাপ আর ব্যাগ মেঝেতে নামিয়ে রাখল ব্যারি। একটা দেরাজ খুলে পিস্তলটা বের করল। ভালো মতো পরীক্ষা করে নিয়ে বেল্টে গুঁজে রাখল সেটা। পকেট ফুলে থাকবে বলে সাথে করে নিয়ে যায়নি বাইরে, ফলে এতক্ষণ অসহায় বোধ করছিল। গ্যাসের চুলো জ্বেলে তাতে কেটলি চাপাল সে। পাশের ঘর থেকে মাতালটার গলা ভেসে এল।
ফিরলে নাকি?
ব্যারি জবাব দিল না। দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল বিশালদেহী ডাক্তার, দুহাতে দরজার ফ্রেম ধরে থাকলেও একটু একটু দুলছে সে। লোকটার ফোলা ফোলা মুখ দেখেই বলে দেয়া যায়, নেশাখোর।
সব পেয়েছ?
ব্যাগটার দিকে হাত তুলল ব্যারি। যা পেয়েছি ওতে আছে, ডাক্তার।
খবরদার! রাগে ফেটে পড়ল মাতাল লোকটা। ওই নামে আমাকে ডাকবে না! অনেক দিন থেকে আমি আর ডাক্তার নই!
ডাক্তার নও? ঠোঁট-বাঁকা হাসি দেখা দিল ব্যারির মুখে। কিন্তু মেয়েরা যে বলে তুমি তাদের বোঝা নামাও?
দেখ, ভালো হবে না কিন্তু…! টলতে টলতে ঘুরে দাঁড়াল মাতাল লোকটা। হ্যাঁ, এককালে সত্যি খুব ভালো একজন ডাক্তারই সে ছিল বটে। কিন্তু এখন শুধু গর্ভপাতের জন্যে ডাকা হয় তাকে। কিংবা ফেরারী কোনো আসামী বন্দুক যুদ্ধে আহত হলে তার খোঁজ করা। মদের কারণে পসার, খ্যাতি, নিরাপত্তা, সবই হারাতে হয়েছে তাকে। কয়েক সেকেন্ড পর আবার দোরগোড়ায় ফিরে এল সে। উবু হয়ে বসে ব্যাগটা খুলল। তোমাকে না আমি অ্যাডেসিভ টেপ আনতে বলেছিলাম?
দোকানে নেই। ব্যান্ডেজ আর মলম এনেছি।
তা তো দেখতেই পাচ্ছি। অবাক চোখ তুলে তাকাল সে।
কিন্তু অ্যাচেসিভ টেপ ছাড়া তো…
ডাক্তারকে থামিয়ে দিয়ে ব্যারি, বলল, এবার থেকে তোমার যা দরকার তুমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসবে, আমি এনে দিতে পারব না!
কি আশ্চর্য, আমি কি জানতাম আহত একজন লোকের চিকিৎসা করতে হবে!
কানের কাছে ফ্যাচফ্যাচ কোরো না তো! কাপে কফি ঢালল ব্যারি। পারলে ব্যান্ডেজ দিয়ে আঙুলটা বাঁধো, না পারলে যেমন আছে তেমনি থাক–পচে যাক আঙুল, আমার কি!
ঘরে ঢুকে আবার ফিরে এল ডাক্তার, হাতে রক্ত মাখা তুলো। মেয়েটার অবস্থা ভালো নয়, ব্যারি। ওর ওষুধ দরকার। অ্যান্টিবায়োটিক দরকার। মরফিন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখছি বলে মনে কোরো না…
অ্যান্টিবায়োটিকের কথা ভুলে যাও।
পাশের ঘর থেকে অস্ফুট গোঙানির আওয়াজ ভেসে এল।
মেয়েটা মারা গেলে আমাকে দায়ী করতে পারবে না।
তুমিই দায়ী হবে।
হঠাৎ দাঁত বের করে হাসল ডাক্তার, চেহারায় কাঙালের মিনতি ফুটে উঠল। এবার দেবে নাকি? বেশি না, মাত্র দুটোক।
ঘড়ির ওপর চোখ বুলিয়ে মাথা নাড়ল ব্যারি। পরে।
বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে তুলোগুলো পানি দিয়ে ধুতে ধুতে মাথা নাড়ল ডাক্তার। হাতটা আমার দ্বারা কাটা সম্ভব বলে মনে হয় না। তার হাত কাঁপছে।
একটা আঙুল কেটেছি তাই যথেষ্ট। হাত-টাত কাটতে পারব না।
তোমার বাপ কাটবে, কর্কশ কণ্ঠে বলল ব্যারি। টাকা নিচ্ছ, কাজ করবে না কেন? আমি যা বলব তাই করতে হবে তোমাকে।
.
স্যার স্টিভেন স্ট্রাইড ঘোষণা করলেন, কিডন্যাপারদের সম্পর্কে কেউ কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারলে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড পুরস্কার দেয়া হবে। ঘোষণাটি টেলিভিশন, রেডিও আর খবরের কাগজে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হলো।
টেলিফোন রিসিভ করার জন্যে দুজন লোক রাখা হয়েছিল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে, সংখ্যা বাড়িয়ে চারজন করা হলো। অসংখ্য টেলিফোন কল আসছে, বেশিরভাগই ভুয়া বা ভিত্তিহীন খবর নিয়ে। এক বুড়ি মহিলা ফোন করে জানাল, মেলিসা জেইনকে সে তার ঘরে আটকে রেখেছে, ৫০ লাখ পাউন্ড দিলে স্কটল্যানড ইয়ার্ডের গেটে রেখে আসবে তাকে। মহিলা পাগল, রোজই একবার ফোন করে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে, বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিন। আরেক লোক জানাল, মেলিসা-জেইনকে কিডন্যাপাররা কোথায় রেখেছে সে জানে, কিন্তু তার ছেলেকে জামিনে খালাস দেয়া না হলে বলবে না। মুশকিল হলো, সবগুলো কল চেক করে দেখতে হচ্ছে।
আপনার সাথে যোগাযোগ…? পিটারকে জিজ্ঞেস করল ইন্সপেক্টর অ্যালান রিচার্ডস। নিজেও জানে, শুধু শুধু জিজ্ঞেস করা। পিটারের টেলিফোনে আড়ি পাতা যন্ত্র বসানো হয়েছে–থোর কমান্ডের হেডকোয়ার্টার আর হোটেলে।
না, মিথ্যে কথা বলল পিটার। এখন খুব সহজেই মিথ্যে বলতে পারছে ও, যেমন খুব সহজেই ভাবতে পারছে মেলিসাকে উদ্ধার করার জন্যে কি করতে হবে ওকে।
ব্যাপারটা আমার একদম পছন্দ হচ্ছে না, জেনারেল। ওরা যোগাযোগ করছে না কেন? চুপচাপ থাকার একটাই অর্থ হতে পারে–মুক্তিপণের জন্যে নয়, আপনার মেয়েকে ওরা কিডন্যাপ করেছে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে।
পিটার কোনো মন্তব্য করল না।
কাল ডেপুটি-কমিশনার ফোন করেছিলেন। জানতে চাইছিলেন, স্পেশাল ইউনিট আর কতদিন রাখতে হবে আমাকে?
আপনি কি বললেন?
বললাম, দশ দিনের মধ্যে কোনো দাবি না জানানো হলে আমরা ধরে নেব মেলিসা-জেইন বেঁচে নেই।
হু। সম্পূর্ণ শান্ত থাকল পিটার। আসল ব্যাপার শুধু একা সে জানে। খলিফার দেয়া সময়ের মধ্যে এখনো বাকি রয়েছে চারদিন।
কবে কি করতে হবে ঠিক করে ফেলেছে পিটার।
ফোনে কাল সকালে ডক্টর পার্কারের সাথে কথা বলবে ও। জরুরি খবর আছে, দেখা হওয়া দরকার। আশা করা যায় বারো ঘণ্টার মধ্যে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। প্রস্তাবটা যথেষ্ট লোভনীয় করে তুলবে পিটার, ফলে না এসে উপায় থাকবে না ডক্টর পার্কারের।
কিন্তু যদি কোনো কারণে ডক্টর পার্কার না আসেন, ডেডলাইনের আগে পিটারের হাতে আরো তিনটে দিন থাকছে। বিকল্প প্ল্যানের জন্যে যথেষ্ট সময়। বিকল্প প্ল্যান মানে ওকেই ডক্টর পার্কারের কাছে যেতে হবে। অবশ্য প্রথম প্ল্যানটাই সব দিক থেকে ভালো। কিন্তু সেটায় যদি কাজ না হয়, যে কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি আছে পিটার। হঠাৎ ওর খেয়াল হলো, ইন্সপেক্টর অ্যালান রিচার্ডস হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি দুঃখিত, জেনারেল। আপনার মনের অবস্থা কি রকম বুঝতে পারি। কিন্তু আমি চাইলেও ইউনিটকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে আটকে রাখতে পারি না। এমনিতেই আমাদের লোকজন কম…
আমি জানি, ইন্সপেক্টর। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছল পিটার। বিধ্বস্ত চেহারায় পরাজয়ের ভাব ফুটে উঠল।
এই, আমাদের কফি দাও! পিটারের হাত ধরে একটা চেয়ারের দিকে এগোল ইন্সপেক্টর। বসুন আপনি, জেনারেল। চিন্তা করে কোনো লাভ নেই, যা হবার তা তো হবেই…।
পাশের ঘর থেকে মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, মহিলা পুলিশরা কথা বলছে ফোনে। দুজনের বয়স বিশ থেকে বাইশের মধ্যে, বাকি দুজন মাঝবয়েসী। চারজনের মধ্যে একজনের চুল সোনালি।
শান্ত মিষ্টি গলা তার। গুড মর্নিং। দিস ইজ পুলিশ স্পেশাল ইনফরমেশন ইউনিট। আজ বারো দিন এই চেয়ারে বসে একই কাজ করছে সে।
অপরপ্রান্ত থেকে কথা বলল কেউ, কথার সুরে বিদেশি টান, আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন পরিষ্কার?
ইয়েস, স্যার।
তাহলে মন দিয়ে শুনন। জিলি ও’ শওনেসি তাকে আটকে রেখেছে,… না, লোকটা বিদেশি নয়, ইচ্ছে করে গলা বিকৃত করছে।
জিলি ও’ শওনেসি? জিজ্ঞেস করল সোনালি-চুল মেয়েটা।
হ্যাঁ, জিলি ও’ শওনেসি। মেয়েটাকে লারাগ-এ আটকে রেখেছে সে।
শব্দটা বানান করুন, প্লিজ।
লারাগ বানান করার সময় আবার বিদেশি টানটুকু থাকল না কণ্ঠস্বরে।
লারাগ জায়গাটা কোথায়, স্যার?
কাউন্টি উইকলো, আয়ারল্যান্ড।
ধন্যাবাদ, স্যার। আপনার নামটা যেন কি বললেন?
লোকটা তার নাম বলেনি, বললও না, রিসিভার নামিয়ে রাখল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে মেসেজটা প্যাডে লিখল মেয়েটা, লেখার সময় চোখ তুলে হাতঘড়িতে সময় দেখল। সাত মিনিট পর টি-ব্রেক, বলে প্যাড থেকে কাগজটা ছিঁড়ে মাথার ওপর দিয়ে পিছন দিকে বাড়িয়ে ধরল। পিছনে বসে আছে অল্প বয়েসী মোটাসোটা সার্জেন্ট, হাতে তুলে নিল সেটা।
চলো, তোমাকে স্যান্ডউইচ খাওয়াব, প্রস্তাব দিল সার্জেন্ট।
আমি সুন্দরী বলে, নাকি আমাকে আরো মোটা দেখতে চাও? ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।
কাগজটা পড়ছে সার্জেন্ট। জিলি ও’ শওনেসি। নামটা আমার চেনা চেনা লাগছে কেন?
বয়স্ক আরেক সার্জেন্ট মুখ তুলল। জিলি ও’ শওনেসি? হাত বাড়িয়ে দিল সে। দেখি, আমাকে দেখতে দাও! কাগজটা পড়ে ঝট করে মুখ তুলল। নামটা চেনো কারণ ওয়ান্টেড পোস্টারে দেখেছ, টিভিতেও দেখে থাকতে পার। জিলি ও’ শওনেসি, একজন টেরোরিস্ট। বোমাবাজ। সন্দেহ করা হয় বেলফাস্টের চীফ কনস্টেবলকে সেই বোমা মেরে খুন করেছে।
মোটাসোটা সার্জেন্ট ঠোঁট গোল করে শিস দিল। তাহলে তো রুই। জাল ফেললেই…।
দ্বিতীয় সার্জেন্ট তার কথা শুনছে না, নক না করেই ইনার অফিসে ঢুকে পড়ল ঝড়ের বেগে।
.
সাত মিনিটের মধ্যে ডাবলিন পুলিশের সাথে যোগাযোগ করল ইন্সপেক্টর অ্যালান রিচার্ডস। তার কানের কাছে মাছির মতো ভনভন করল পিটার, কঠোর ভাষায় কথা বলুন, ওদের কানে যেন পানি ঢেকে-কোনো অবস্থাতেই হামলা করা যাবে না…
ইন্সপেক্টর ওকে থামিয়ে দিল, আমার ওপর ভরসা রাখুন, কি করতে হবে আমার জানা আছে। কানেকশন পাওয়া গেল, এক মিনিট পর একজন ডেপুটি কমিশনারের সাথে কথা বলতে শুরু করল সে। শান্তভাবে দশ মিনিট কথা বলার পর রিসিভার নামিয়ে রাখল। স্থানীয় কনস্টেবলরাই ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখবে, ডাবলিন থেকে লোক পাঠালে শুধু শুধু সময় নষ্ট হবে। তদন্তে যাই জানা যাক, ওরা হানা দেবে না।
মাথা ঝাঁকিয়ে নিঃশব্দে ধন্যবাদ জানাল পিটার। জায়গার নামটা আগে কখনো শুনিনি। লারাগ। সম্ভবত ছোট একটা জায়গা…
ম্যাপ আনতে পাঠিয়েছে, বলল ইন্সপেক্টর, তারপর ম্যাপ এসে পৌঁছুবার সাথে সাথে দুজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেটার ওপর। লারাগ-উইকলো পাহাড়ের ঢালে, উপকূল থেকে দশ মাইল ভেতরে। লার্জ-স্কেল ম্যাপ থেকে তার বেশি কিছু জানা গেল না। আবার ডাবলিন পুলিশ যোগাযোগ না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।
মাথা ঝাঁকাল পিটার। না। আমি চাই আপনি যোগাযোগ করুন। ওদের বলুন ওরা যেন সার্ভেয়ার-জেনারেলের সাথে কথা বলে। তার কাছে ডিটেলড় ম্যাপ পাওয়া যাবে-গ্রামের ম্যাপ, এরিয়াল ফটোগ্রাফস, স্ট্রীট লে-আউট। ওদের বলুন, এ-সব একজন লোককে দিয়ে যেন এনিসকেরী এয়ারফিল্ডে পাঠিয়ে দেয়া…
এখুনি কি এতটা ব্যস্ত হওয়া উচিত হবে? এটাও যদি ফলস অ্যালার্ম হয়?
স্থির হয়ে বসে থাকতে পারল না পিটার, লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে পায়চারি শুরু করল। এক গ্যালন পেট্রল আর ড্রাইভারের সময় খরচ হবে, তাই না? ফলস অ্যালার্ম? হতে পারে, কিন্তু আমার তা মনে হয় না। জানোয়ারটার গন্ধ পাচ্ছি আমি।
হতভম্ব হয়ে পিটারের দিকে তাকাল ইন্সপেক্টর।
সেটা লক্ষ্য করে তাড়াতাড়ি বাতাসে হাত ঝাপটা দিল পিটার, ও কিছু না, এ ম্যানার অভ স্পীচ। পরমুহূর্তে মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল। হেলিকপ্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু তাতেও সমস্যা আছে, মাঝপথে রিফুয়েলিংয়ের দরকার হবে। তিন সেকেন্ড চিন্তা করে একটা সিন্ধান্তে পৌঁছুল ও। ইন্সপেক্টরের ডেস্কের সামনে থেমে ক্রেডল থেকে ফোনের রিসিভার তুলে থোর কমান্ডে কলিনের প্রাইভেট নম্বরে ডায়াল করল।
কলিন, উত্তেজনায় অধীর হয়ে পড়েছে পিটার, চাপা গলায় কথা বলছে। এইমাত্র একটা ইনফরমেশন পাওয়া গেছে। এখনো কনফার্মড় কিছু নয়। তবে আমার মন বলছে, এখানেই।
কোথায়? ব্যগ্রকণ্ঠে জানতে চাইল কলিন।
আয়ারল্যান্ড।
মাই গড, এত থাকতে ওই নরকে!
এনসিকেরীতে পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগবে হেলিকপ্টারের?
এক সেকেন্ড। পিটার শুনতে পেল, কার সাথে যেন পরামর্শ করছে কলিন, সম্ভবত রয়্যাল এয়ারফোর্সের কোনো পাইলটের সাথে। ত্রিশ সেকেন্ড পর লাইনের ফিরে এল সে। মাঝপথে ফুয়েল নিতে হবে ওদের, পিটার।
হ্যাঁ?
চার ঘণ্টা তিরিশ মিনিট, কলিন জানাল।
দশটা বিশ এখন, তাই না? এনিসকেরীতে পৌঁছুতে প্রায় তিনটে বেজে যাবে। আবহাওয়ার যা অবস্থা, পাঁচটার মধ্যে অন্ধকার হয়ে যাবে। দ্রুত চিন্তা করছে। পিটার। আয়ারল্যান্ড অনেক দূরের পথ, থোর কমান্ডকে পাঠানো উচিত হবে কি? ওখানে পৌঁছুবার পর যদি জানা যায় ব্যাপারটা ফলস অ্যালার্ম আর ঠিক তখনই যদি সঠিক কোনো খবর স্কটল্যান্ড বা ইংল্যান্ড থেকে আসে? উঁহু, এত কথা ভাবলে চলবে না। মনের কথা শুনতে হবে। জানোয়ারটার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ব্রাভো কন্ডিশন ঘোষণা করার জন্যে কলিনকে অর্ডার করতে পারে না ও। ডক্টর কিংস্টোন পাকার মুখে যাই বলুন, থোর কমান্ডের কমান্ডিং অফিসার এখন পিটার নয়, কলিন।
কলিন, বলল পিটার, আমার একটা অনুরোধ রাখবে? আমরা যদি আধ ঘণ্টাও দেরি করি, অন্ধকার হবার আগে মেলিসাকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। তুমি কি কন্ডিশন ব্রাভো ঘোষণা করবে?
অনেকক্ষণ কথা বলল না কলিন। শুধু তার হালকা নিঃশ্বাসের আওয়াজ পেল পিটার। তারপর শুনতে পেল, খুব বেশি হলে চাকরিটা হারাতে হবে। ঠিক আছে, স্যার, কন্ডিশন ব্রাভো ঘোষণা করা হলো। পনেরো মিনেটের মধ্যে হেলিপ্যাড থেকে আমরা তোমাকে তুলে নেব, তৈরি থেকো।
.
মেঘের রাজ্যে ভাঙচুর শুরু হয়েছে, কিন্তু আগের চেয়ে আরো চঞ্চলমতি হয়ে উঠেছে বাতাস। খোলা হেলিপ্যাডে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডায় হি হি করছে পিটার আর ইন্সপেক্টর অ্যালান রিচার্ডস। ট্রেঞ্চ কোট, ব্লেজার, আর রোলনেক জ্যাকেট পরে আছে পিটার, সব ভেদ করে চামড়ায় হুল ফোঁটাচ্ছে হিম বাতাস। অশান্ত টেমস নদীর ওপারে, দিগন্তরেখার দিকে তাকিয়ে আছে ওরা, যে কোনো মুহূর্তে হেলিকপ্টারগুলোকে দেখা যাবে।
এনিসকেরীতে আপনারা পৌঁছুবার আগেই এখানে বসে আমি যদি কনফার্ম নিউজ পেয়ে যাই?
রয়্যাল এয়ারফোর্সের ফ্রিকোয়েন্সিতে পাবেন আমাদের, বলল পিটার।
বাতাসে উড়ে যাবার ভয়ে হ্যাটটা এক হাতে চেপে ধরে আছে ইন্সপেক্টর। তার জ্যাকেটের কিনারা পতাকার মতো পতপত করে উড়ছে। আশা করি আপনাকে কোনো দুঃসংবাদ দিতে হবে না।
বাড়িগুলোর ছাদ প্রায় ছুঁয়ে ছুটে এল কপ্টার দুটো। একশ ফিটের মধ্যে আসার পর একটা কপ্টারের দোরগোড়ায় কলিন নোবলকে চিনতে পারল পিটার।
গুড হান্টিং, রোটরের আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠল ইন্সপেক্টরের কণ্ঠস্বর। এদিকে কাজ না থাকলে আপনাদের সাথে আমিও যেতাম।
হালকা পায়ে ছুটল পিটার, কংক্রিট প্যাডে হেলিকপ্টারের নামার আগেই লাফ দিল। ওকে ধরে ফেলল কলিন, দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে ভেতরে ঢোকাল, বরাবরের মতো দামি ডাচ চুরুট ঠিকই ঝুলে আছে ঠোঁটে।
ধন্যবাদ, বাড়ি, নিঃশব্দে হেসে বলল সে। ট্রেনিং নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে গেছি, এবার দেখা যাক অ্যাকশন দেখাবার সুযোগ পাই কিনা। তার কোমরে শোভা পাচ্ছে একটা ৪৫ পিস্তল।
.
ভেতরের কামরা থেকে বেরিয়ে এসে সিঙ্কের সামনে দাঁড়াল ডাক্তার, প্লেটের খাবার সিঙ্কের নিচে একটা বালতিতে ফেলে দিল। কিছুই খাওয়াতে পারলাম না। ঝট করে ঘাড় ফেরাল সে। নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে তারপর আবার হাত পা বেঁধে রাখার দরকারটা কি বলতে পারো আমাকে?
একমনে খাচ্ছে জিলি ও’ শওনেসি, প্লেট থেকে মুখ তুলল না। সে ভাবছে, এরকম একটা দুর্বলচিত্তের লোককে কেন তার ঘাড়ে চাপানো হলো। মেয়েদের গর্ভপাত ঘটায়, আহত টেরোরিস্টদের চিকিৎসা করে, কিন্তু লোকটার মধ্যে ন্যায় অন্যায় বোধ আর বিবেক পুরোমাত্রায় রয়ে গেছে এখনো অন্তত কোনো কোনো ব্যাপারে। তার ওপর, নেশাখোর। মদ না পেলে এমনিতেই এই লোকের পাগল হবার কথা। সাবধান হওয়া দরকার, যে কোনো মুহূর্তে উদ্ভট কিছু একটা করে বসতে পারে ডাক্তার।
তার নিজের অবস্থাও বিশেষ সুবিধের নয়। গোটা ব্যাপারটা এত অগোছাল যেন মনে হয় একটা ষড়যন্ত্রের জালে ফেলা হয়েছে তাকে। ডাক্তার একটা উপদ্রব। লারাগের এই পোড়াবাড়িতে আশ্রয় নেয়াটা হাস্যকর রকম বোকামি। খেতে খেতেই চিন্তায় মাথাটা নুয়ে এল শওনেসির। গ্রাম থেকে বেরিয়ে যাবার একটাই মাত্র পথ, পালাতে হলে ওই পথ ধরেই যেতে হবে। কেন, এরকম একটা গ্রামে আসতে বলার কি দরকার ছিল? এক জায়গায় গাট হয়ে বসে না থেকে বারবার জায়গা বদল করা অনেক বেশি নিরাপদ, কিন্তু তা করতে নিষেধ করা হয়েছে কেন?
আর এই বৃষ্টি!
উচিত ছিল হাত, পা আর মাথা কেটে রেখে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, তারপর দেহটা মাটির নিচে পুঁতে ফেলা। সেক্ষেত্রে ডাক্তারকে সঙ্গে রাখা দরকার হতো না।
তারপর ভাবল সে, আচ্ছা, এই খলিফা লোকটা কে?
মেক্সিকোয় ওরা তার সাথে যোগাযোগ করে। বলল, কাজটা খলিফার, বিশ হাজার পাউন্ড পুরস্কার। এমনভাবে বলল, খলিফা যেন এই দুনিয়ার হর্তা-কর্তা বিধাতা। কাজটা ও নেবে কিনা সেটা জানার জন্যে অপেক্ষা করেনি ওরা, তার আগেই ওর ছবিসহ পাসপোর্ট জোগাড় করে ফেলেছিল। প্রফেশনাল, কোনো সন্দেহ নেই। শুধু যে টাকার লোভে কাজটা নিয়েছে জিলি ও’ শওনেসি তা নয়, ভয়েরও একটা অবদান আছে। লোকগুলো তার মনে খলিফার ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কে এই খলিফা?
খাওয়া শেষ করে সিগারেট ধরাল জিলি ও’ শওনেসি। নামটা কেমন যেন। দ্রু কুঁচকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে কেন যেন শিউরে উঠল সে। মারামারি কাটাকাটি করে অনেক বছর কাটাল সে, বিপদের গন্ধ আগে থেকেই পেয়ে যায়।
কাজটায় অনেক ত্রুটি রয়েছে, সেগুলোর পিছনে গুরুতর কারণ না থেকে পারে না। সুতি ক্যাপটা তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল জিলি ও’ শওনেসি।
কোথায় যাচ্ছ শুনি? জিজ্ঞেস করল ডাক্তার।
একটু হেঁটে আসি।
তোমার ভাবসাব আমার ভালো লাগছে না। এত ঘন ঘন বাইরে যাবার কি দরকার?
জ্যাকেটের ভেতর থেকে পিস্তলটা বের করে চেক করল জিলি ও’ শওনেসি, তারপর গুঁজে রাখল আবার। তোমার কাজ সেবিকার ভান করা, তুমি তাই কর। পুরুষের কাজটা আমাকে করতে দাও। কামরা থেকে বেরিয়ে গেল সে।
.
বৃষ্টির মধ্যে আরোহীদের দেখা গেল না, ছোট একটা কালো অস্টিন এসে থামল গ্রামের একমাত্র মুদি দোকানের সামনে। রাস্তার দুপাশে জানালার পর্দাগুলো নড়ে উঠল, আরোহীদের নামতে দেখে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল ঘরে ঘরে। শীতকালীন নীল ইউনিফর্ম পরে আইরিশ পুলিশ বিভাগের দুজন লোক নামল, মাথার হ্যাঁটে হাত রেখে ছুটে ঢুকে পড়ল দোকানের ভেতর। গুড মর্নিং, মেইভ, ওল্ড লাভ, দোকানদারের কুমড়োমুখী বউকে বলল সার্জেন্ট।
ওয়েন ও নীল, আমি তোমাকে সাবধান করে দিয়ে বলতে চাই…, দোকানদারের বয়স্কা বউ হেসে কুটিকুটি হলো। ত্রিশ বছর আগে ওরা দুজন একজন প্রিস্টের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের পাপ স্বীকার করেছিল, সেই থেকে বিচ্ছেদ, এবং পদস্থলনের ইতি। তা কি মনে করে আমাদের এই অজ পাড়াগাঁয়ে…?
তোমার হাসি, মেইভ, তোমার হাসি-মনে পড়লেই চলে আসতে হয়। তা নতুন কিছু ঘটল নাকি এদিকে? দু-একটা অচেনা মুখ চোখে পড়ে?
নতুন মুখ কোত্থেকে আসবে…ওহে, রসো-পোড়োবাড়িতে একজন উঠেছে বটে। একজন কি কজন তা বাপু বলতে পারব না…
একটা নোটবুক খুলে মেইভের সামনে ধরল সার্জেন্ট ও নীল, ভেতরে একটা ফটো রয়েছে। দেখ তো, ওল্ড লাভ, এই লোকটা কিনা।
কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর মাথা নাড়ল মেইভ। উঁহু। আমরা যাকে দেখেছি এ সে লোক নয়। মি. ব্যারির বয়স আরো বেশি, গোঁফ আছে, তবে গার্ল ফ্রেন্ডের বয়স বেশি হবে বলে মনে হয় না…
ছবিটা দশ বছর আগে তোলা।
দোকানদার তার বউয়ের পাশে এসে দাঁড়াল, ফটোটা দেখে কথা বলার জন্যে হাঁ করল সে। তার বউ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি থামো! সার্জেন্ট ও নীল, কথাটা তোমার আগেই বলা উচিত ছিল। হ্যাঁ, তাহলে এটা মি, ব্যারির ছবি।
পোড়োবাড়ি বলছ? টেলিফোনটা ব্যবহার করতে পারি তো?
পুলিশী কাজে? জিজ্ঞেস করল দোকানদার। তাহলে তোমাকে পয়সা দিতে হবে।
তোমাকে আমি বলিনি, গোটা ব্যাপারটার মধ্যে একটা রসাল কেচ্ছা আছে? স্বামীকে বলল বুড়ি।
.
ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে কেউ কোথাও নেই, তবু বাগানের ভেতর দিয়ে পাথরে পাঁচিল ঘেঁষে শিকারি বিড়ালের মতো সন্তর্পণে এগোল জিলি ও’ শওনেসি। বাগানের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে একটা আপেল গাছে চড়ল, পাঁচিলের ওদিকে রাস্তায় তাকাল।
বিশ মিনিট নড়ল না জিলি ও’ শওনেসি। রাস্তায় কোনো লোককে দেখেনি সে, কোনো জানালার পর্দাও নড়ছে না। গাছ থেকে পাঁচিলের মাথায়, সেখান থেকে রাস্তার ধারে নেমে পড়ল সে। তারপর রাস্তার দুদিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল।
বিপদের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু খুঁতখুঁতে ভাবটা থেকেই যাচ্ছে। কয়েক পা হেঁটে একটা লোহার গেট টপকে আরেক বাগানে ঢুকল সে, ঝোঁপের ভেতরে দিয়ে এক কোণে চলে এল, তারপর উঁকি দিয়ে নিচু পাঁচিলের ওদিকে তাকাল। এখানটায় বাঁক নিয়েছে রাস্তা, বহুদূর পর্যন্ত নির্জন, তারপর সব ঝাপসা।
কেন মনে হচ্ছে বিপদ বেশি দূরে নয়?
সমস্ত ঘটনা এক এক করে স্মরণ করল জিলি ও’ শওনেসি। খলিফার কাছে একটামাত্র পার্সেল পাঠিয়েছে, সে বোতলে ভরা লোকটার আঙুল। টেলিফোন করেছে দুবার।
বোতলটা পাঠানো হয় মেয়েটাকে কিডন্যাপ করার দুঘণ্টা পর, ওষুধের প্রভাবে মেয়েটা তখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ডাক্তার, মি. ওয়াইন নাম দিয়েছে সে, লাল একটা পুরানো ফোর্ড ডেলিভারি ভ্যানে বসে কাজটা সারে। ভ্যানটা নিয়ে কেমব্রিজ রেলওয়ে স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছিল ওরা, মেয়েটাকে নিয়ে একটা স্যালুন এল। তখন সন্ধে লাগছে, রাস্তার ধারের একটা কফি শপের পার্কিং লটে ছিল ওরা। ডাক্তারের সাথে যন্ত্রপাতি আর ঘুমের ওষুধ ছিল, কিন্তু অন্যান্য ওষুধ কিছু ছিল না। মাতাল ডাক্তারের হাত কাঁপছিল, কাজটা ভালোভাবে সারতে পারেনি। ভরপেট মদ খাওয়া অবস্থায় ছিল সে, তার ওপর পিস্তলের মুখে কাজটা করানো হয়। টাকার লোভ দেখিয়েও প্রথমে আঙুল কাটতে রাজি করানো যায়নি ব্যাটাকে। অবশ্য আঙুল কাটার পর রোগীকে ছেড়ে পালাবার কোনো লক্ষণ তার মধ্যে দেখা যায়নি। কাটা অংশে ইনফেকশন দেখা দিয়েছে।
একটা পিকআপে কারে বোতলটা পৌঁছে দিয়ে আসে জিলি ও’ শওনেসি। ঠিক জায়গাতেই ছিল গাড়িটা, আগে থেকে ঠিক করা সঙ্কেত পেয়ে এগিয়ে যায় সে। পাশে ভ্যানটা দাঁড় করিয়ে বোতলটা ছুঁড়ে দেয় ভেতরে, তারপর সবেগে চলে আসে। সরাসরি আয়ারল্যান্ডের লারাগে।
লারাগে পৌঁছেই প্রথম ফোনটা করে সে। ইন্টারন্যাশনাল কল ছিল ওটা, আগেই নির্দেশ দেয়া ছিল তাকে, শুধু একটা বাক্য উচ্চারণ করতে হবে। আমরা নিরাপদে পৌঁছেছি।
এক সপ্তাহ পর ওই একই নম্বরে ডায়াল করে সে, সেবারও তাকে শুধু একটা বাক্য উচ্চারণ করতে হয়, সময়টা আমরা উপভোগ করছি।
জিলির মনে আছে, লোকাল এক্সচেঞ্জের অপারেটর মেয়েটা দুবারই তাকে পাল্টা ফোন করে জিজ্ঞেস করে, কলটা সন্তোষজনক হয়েছে কিনা। ইন্টারন্যাশনাল কলে কম কথাই বলে মানুষ, তাই বলে এত কম? সন্দেহ নেই হতভম্ব হয়ে পড়েছিল মেয়েটা।
চারদিকে সন্দেহের বীজ ছড়ানো হচ্ছে, বুঝতে পেরেছিল জিলি ও’ শওনেসি। এধরনের ভুল-ভাল করে বলেই তো পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় অপরাধীরা। প্রতিবাদ করার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ ছিল না তার, খলিফাকে সে পাবে কোথায়? ইন্টারন্যাশনাল ফোন নম্বরটা ছাড়া তার সাথে যোগাযোগ করার আর কোনো মাধ্যম নেই।
গাছ থেকে নেমে গেটের পাশে দাঁড়াল জিলি ও’ শওনেসি, সিদ্ধান্ত নিল তৃতীয় ফোনটা চারদিন পর করার কথা থাকলেও করবে না সে। কিন্তু তারপরই তার মনে পড়ল, হাতটাও ডেলিভারি দেয়ার কথা চারদিন পর। সে ফোনে যোগাযোগ করলে তাকে জানানো হবে কোথায়, কিভাবে ডেলিভারি দিতে হবে হাতটা।
অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল তার। এভাবে জেনেশুনে নিজেকে জালে জড়াবার কোনো মানে হয় না! হতে পারে টাকা অনেক বেশি, তাই বলে বোকার মতো ধরা পড়ার ঝুঁকি কেন নিতে যাবে সে! তার মনে হতে লাগল, গোটা ব্যাপারটার ভেতর গোপন কিছু একটা আছে, তাকে জানানো হয়নি।
তবে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড পাবার সাথে সাথে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে রেখেছে সে, ধরা পড়লেও সে টাকায় হাত দেয়ার সাধ্য কারও নেই। এমনকি খলিফাও এখন আর তার ওই টাকা কেড়ে নিতে পারবে না।
গেটের পাশ থেকে উঁকি দিয়ে আবার রাস্তায় তাকাল জিলি ও’ শওনেসি। চোখের কোণে কি যেন একটা নড়ে উঠতে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটা ঢেউ নেমে গেল।
প্রায় চারটে বাজে, কালচে খয়েরি আর ঠাণ্ডা সবুজাভ পাহাড়ে অন্ধকার নামছে। পাহাড়ের মাথায়, আঁকাবাঁকা রাস্তার ওপর ছারপোকা আকৃতির সচল কি যেন একটা দেখা গেল। ঢালু রাস্তা দিয়ে সবেগে নেমে আসছে ব্রিজের দিকে। তারপর চিনতে পারল জিলি ও’ শওনেসি। ছোট একটা সেলুন কার। একটু পর ঝোঁপের ভেতর হারিয়ে গেল সেটা।
ফোন কলগুলোর কথা ভেবে আবার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল সে, গাড়িটার ব্যাপার তেমন আগ্রহ নেই। ফোনগুলো করার কোনো প্রয়োজন ছিল কি? খলিফা কি কারণে এ ধরনের ঝুঁকি নিতে গেল?
ব্রিজ পেরিয়ে সোজা ছুটে এল গাড়িটা। কালো একটা অস্টিন। বৃষ্টির জন্যে আরোহীদের দেখা গেল না। হঠাৎ আবার শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল জিলির। গাড়ির গতি কমে গেছে। তারপর দাঁড়িয়ে পড়ল। দরজা খুলে বেরিয়ে এল দুজন লোক। ছুটতে ছুটতে মুদি দোকানে ঢুকল তারা।
পুলিশ!
বাগানের ভেতর দিয়ে ঝেড়ে দৌড় দিল জিলি ও’ শওনেসি। যতক্ষণ বিপদের আশঙ্কা ছিল উত্তেজনায় ছটফট করছিল সে, কিন্তু বিপদ এসে গেছে দেখে সম্পূর্ণ উভ্রান্ত হয়ে পড়ল। বাড়িতে ফিরে এসে কিচেনে কাউকে দেখল না, দড়াম করে পাশের ঘরের দরজার খুলে ভেতরে ঢুকল সে।
রোগীর সেবা করছে ডাক্তার, বিরক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে। তোমাকে না বলেছি ভেতরে ঢোকার আগে নক করবে?
ঝাঁঝটুকু গায়ে না মেখে জিলি ও’ শওনেসি বলল, আমরা পালাচ্ছি।
ওঁর অবস্থা দেখছ? মেলিসার দিকে তাকাল ডাক্তার। ওষুধের প্রভাবে অঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। ইনফেকশন মারাত্মক হয়ে ওঠায় তার গায়ের রঙ বদলে গেছে। কাটা আঙুলের ক্ষতটা দগদগ করছে, ফুলে চাপা কলার মতো দেখাচ্ছে পাশেরটাকে। হাতটার অন্যান্য আঙুল সহ কনুই পর্যন্ত সবটুকু ফুলছে। পচন ধরতে আর বেশি দেরি নেই। রোগী কি রকম কষ্ট পাচ্ছে তা শুধু ডাক্তারই আন্দাজ করতে পারে। মরফিনের মাত্রা বাধ্য হয়ে বাড়াতে হয়েছে তাকে, তা না হলে ঘুম ভেঙে গিয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিত। এই অবস্থায় ওকে নড়ানো যাবে না।
তাহলে আর কি করা, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল জিলি ও’ শওনেসি। ওকে এখানে রেখেই যেতে হবে। বেল্ট থেকে পিস্তলটা বের করল সে, তালুর ধাক্কায় হ্যাঁমার টেনে বিছানার দিকে এগোল।
খুন করবে? জিলির পথ আটকে দাঁড়াল ডাক্তার।
তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল জিলি ও’ শওনেসি, দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খেল ডাক্তার।
তুমি ঠিকই বলছ। এ একটা বোঝাই বটে। মেলিসার কপালের পাশে পিস্তলের মাজুল ঠেকাল জিলি ও’ শওনেসি।
না! আর্তনাদ করে উঠল ডাক্তার। তোমার পায়ে পড়ি, মেরো না ওকে! নেব, আমি ওকে নিয়ে যাব!
অন্ধকার হবার সাথে সাথে বেরিয়ে পড়ব আমরা, পিছিয়ে এসে বলল জিলি ও’ শওনেসি। তৈরি থাকো।
.
নিচে আইরিশ সী যেন ক্ষতবিক্ষত সীসার পাত। লীডারের চেয়ে একটু পিছনে আর ওপরে রয়েছে দ্বিতীয় হেলিকপ্টারটা। সিরনারভো থেকে নতুন করে ফুয়েল নিয়েছে ওরা, ওয়েলশ কোস্ট ছাড়ার পর অনুকূল বাতাস থাকায় অল্প সময়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে আসতে পেরেছে। তবু সময়ের আগে পৌঁছুনো সম্ভব হবে না, চারদিক কালো করে ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। কয়েক সেকেন্ড পরপরই হাতঘড়ি দেখছে পিটার।
খোলা সাগরের ওপর দিয়ে মাত্র নব্বই মাইল পেরোতে হবে, পিটারের কাছে মনে হলো গোটা আটলান্টিক পাড়ি দিচ্ছে ওরা। হোল্ডের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত লম্বা বেঞ্চটা, পিটারের পাশে বসে একমনে চুরুট টানছে কলিন নোবলস্, যদিও অনেক আগেই নিভে গেছে সেটা। থোর টিমের বাকি সবাই হাত পা ছড়িয়ে শুয়েবসে আছে, কেউ কেউ অস্ত্রগুলোকে ব্যবহার করছে বালিশ হিসেবে।
একা শুধু পিটারই অস্থির। জানালায় উঁকি দেয়ার জন্যে আবার একবার উঠল ও। অবশিষ্ট দিনের আলো পরীক্ষা করল, যাচাই করল দিগন্তরেখার কতটা ওপরে রয়েছে মেঘে ঢাকা সূর্য।
বেঞ্চে আবার ফিরে এল পিটার, কলিন সান্ত্বনা দিল ওকে, সব ঠিক হয়ে যাবে।
কলিন, আমাদের একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। এই হামলায় প্রয়োরিটি কি হবে?
কিসের প্রয়োরিটি, স্যার? এই অপারেশনে একটাই অবজেক্ট–মেলিসাকে ছিনিয়ে নেয়া, নিরাপদে।
কিন্তু বন্দীদের ইন্টারোগেট করব না?
কাউকে বন্দী করতে চাওয়া মানে মেলিসার প্রাণের ওপর ঝুঁকি নেয়া। তার ক্ষতি করার কোনো সুযোগ কেন আমরা দেব শত্রুদের? টার্গেট এরিয়ার ভেতর কিছু নড়তে দেখলেই গুলি করে উড়িয়ে দেব।
এক সেকেন্ড চিন্তা করে মাথা ঝাঁকাল পিটার। ওখানে অবশ্য চুনোপুঁটি ছাড়া নেই কেউ, ইন্টারোগেট করলেও পালের গোদার সাথে কোনো যোগাযোগ বের করা যাবে না। কিন্তু ডক্টর পার্কারকে জবাব দেবে কিভাবে তুমি? কাউকে বন্দী করা হয়নি শুনে রেগে যাবে না?
ডক্টর পার্কার? ঠোঁটের কোণ থেকে চুরুট নামাল কলিন। কই, নামটা শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না। এখানে সিদ্ধান্ত নেয় চাচা কলিন। ঠোঁট টিপে হাসল সে। এই সময় কেবিনে ঢুকে চিৎকার করে উঠল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার।
সামনে আইরিশ কোস্ট-সাত মিনিটের মধ্যে আমরা এনিসকেরীতে নামছি, স্যার।
.
এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এনিসকেরী এয়ারপোর্টে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। ল্যান্ড করার জন্যে পৌঁছে গেছে তিনটে প্লেন, পাইলটদের নির্দেশ দেয়া হলো। সার্কিট অলটিচ্যুডের কিছুটা ওপরে উঠে গিয়ে অপেক্ষা কর। যে কোনো মুহূর্তে পৌঁছে যাবে রয়্যাল এয়ারফোর্সের একজোড়া হেলিকপ্টার, সাথে সাথে ল্যান্ড করার সুযোগ দিতে হবে ওগুলোকে।
মেঘের ভেতর থেকে অকস্মাৎ বেরিয়ে এল কপ্টার দুটো। সাবলীল ভঙ্গিতে হ্যাঙ্গার অ্যানে নামল। সাথে সাথে দুই হ্যাঙ্গারের মাঝখান থেকে ছুটল একটা পুলিশ কার। রোটরের ব্লেড তখনো পুরোপুরি থামেনি, লীডার কপ্টারের পাশে ঘ্যাঁচ করে থামল কার। আইরিশ পুলিশের একজন অফিসার আর সার্ভেয়ার জেনারেলের একজন প্রতিনিধি নামল টারমাকে।
জেনারেল স্ট্রাইড, নিজের পরিচয় দিল পিটার। থোর কমান্ডের ড্রেস পরে রয়েছে ও–একপ্রস্থ কাপড়ে তৈরি কালো স্যুট, সফট বুট। উরুর কাছে ওয়েরিং বেল্টে রয়েছে পিস্তলটা।
জেনারেল, কনফার্ম খবর পাওয়া গেছে, হ্যান্ডশেক করার সময় বলল পুলিশ ইন্সপেক্টর। ফটো দেখে গ্রামবাসীরা জিলি ও’ শওনেসিকে চিনতে পেরেছে। কোনো সন্দেহ নেই গ্রামে ঠাই নিয়েছে জিলি ও’ শওনেসি।
গ্রামের কোথায়?
কিনারায়, স্যার। পোড়ো একটা বাড়িতে। চশমা পরা সার্ভেয়ারকে কাছে ডাকল ইন্সপেক্টর। ফাইলটা বুকের সাথে চেপে ধরে আছে সার্ভেয়ার হেলিকপ্টারের খোলা কোনো চার্ট টেবিল নেই, সার্ভে ম্যাপ আর ফটোগ্রাফগুলো ডেকের ওপর মেলা হলো।
দ্বিতীয় হেলিকপ্টার থেকে ডেকে নেয়া হলো অন্যান্যদের। বিশজন কমান্ডো হুমড়ি খেয়ে পড়ল ম্যাপ আর ফটোর ওপর। এই যে, এখানে বিল্ডিংটা। নীল পেন্সিল দিয়ে ম্যাপের একজায়গায় ছোট একটা বৃত্ত আঁকল সার্ভেয়ার।
ভালো, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল কলিন। নদী বা রাস্তা ধরে যেতে পারব আমরা, ব্রিজ বা চার্চ পর্যন্ত-বাড়িটা ও-দুটোর মাঝখানে।
বাড়িটার ব্লো আপ নেই, ভেতরের কোনো প্ল্যান? থোর কমান্ডের একজন জানতে চাইল।
দুঃখিত, ভালো করে খুঁজে দেখার সময় পাইনি আমরা, ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল সার্ভেয়ার।
কমিনিট আগে লোকাল পুলিশ রেডিওতে আবার রিপোর্ট করেছে। উঁচু পাথরের পাচিল দিয়ে ঘেরা বাড়িটা, ভেতরে কাউকে দেখা যায়নি।
কি! প্রায় আঁতকে উঠল পিটার। কড়া নির্দেশ ছিল বাড়িটার কাছাকাছি যাওয়া চলবে না!
পাবলিক রোড দিয়ে মাত্র একবার গাড়ি চালিয়ে গেছে ওরা। ইন্সপেক্টরকে অপ্রতিভ দেখাল। জানার দরকার ছিল…
লোকটা যদি জিলি ও’ শওনেসি হয়, গাড়িটাকে একবার দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছে সে! পাথরের মতো স্থির হয়ে গেছে পিটার, চোখ দুটো রাগে জ্বলছে। কেউ যদি কোনো নির্দেশ মানে! পাইলটের দিকে তাকাল ও। হলুদ লাইফ জ্যাকেট, হেলমেট আর বিল্ট-ইন মাইক্রোফোনসহ ইয়ারফোন পরে আছে সে। তুমি আমাদের সরাসরি ওখানে নিয়ে যেতে পারবে?
সাথে সাথে উত্তর না দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল পাইলট। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার। দশ মিনিটের মধ্যে অন্ধকার হয়ে যাবে। এখানে আমরা এয়ারপোর্ট ভি, ও. আর. বীকনের সাহায্যে পৌঁছুতে পেরেছি,—-তাকে সন্দিহান দেখাল। টার্গেট চেনে এমন কেউ থাকবে না। কপ্টারে…। ধেত্তেরি, ঠিক জানি না। এটুকু বলতে পারি, কাল সকালে প্রথম আলোয় আপনাদের আমি পৌঁছে দিতে পারব…
আজ রাতে, এখনই। পারবে?
লোকাল পুলিশ যদি টার্গেট দেখিয়ে দেয় তাহলে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি–টর্চ বা ফ্লেয়ার দরকার হবে।
আলোর ব্যবস্থা করা যাবে না, বলল পিটার। শত্রুরা টের পেয়ে যাবে।
কপ্টারের ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এল।
এখানে বসে দেরি করা মানে…. কথা শেষ না করে কাঁধ ঝাঁকাল পিটার। মনে কর মস্ত একটা ঝুঁকি নিতে হবে তোমাকে, নেবে কি? প্রায় আবেদনের সুরে কথা বলছে পিটার। একজন পাইলটকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য করতে পারে না ও।
মাথা নিচু করে পাইলট বলল, এই আবহাওয়ায় ঢাল পেরোতে হবে, তাই না?
একবার চেষ্টা করে দেখ না, বলল পিটার। প্লিজ।
আরো পাঁচ সেকেন্ড ইতস্তত করল পাইলট। লেটস গো! আওয়াজটা হঠাৎ তার গলা থেকে বেরুতেই কমান্ডোদের মধ্যে ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। দ্বিতীয় কপ্টারের লোকেরা লীডার কপ্টার থেকে বেরিয়ে গেল দ্রুত। তাদের পিছুপিছু নামল পুলিশ ইন্সপেক্টর আর সার্ভেয়ার।
.
বাতাসের প্রবল চাপ আর ঝাপটায় ইতস্তত করতে করতে এগোল হেলিকপ্টার। শক্ত কিছু হাতে যে যা পেয়েছে ধরে আছে, তবু গড়াগড়ি খাওয়া থেকে রেহাই পেল না। নিচে ঘর-বাড়ি, খেত-খামার, বনভূমি খুব কাছে মনে হলো, সবেগে পিছন দিকে ছুটছে কিন্তু দুর্যোগময় কালো রাতে পরিষ্কারভাবে কিছুই দেখার উপায় নেই। গ্রাম্য এলাকার নির্জন পথে নিঃসঙ্গ একজোড়া হেডলাইটের আলোয় কোনো বাড়ির বারান্দা হয়তো একপলকের জন্যে আলোকিত হয়ে উঠল, পাইলট আন্দাজ করে নিল কোনো লোকবসতির ওপর দিয়ে যাচ্ছে তারা। মাঝেমধ্যে নিচেটা চকচকে লাগল, আন্দাজ করে নিতে হয় ওখানে কোনো খাল-বিল বা নদী আছে। নিকষ কালো অন্ধকারের বিস্তৃতি দেখে বুঝে নিতে হলো, জঙ্গলের ওপর দিয়ে যাচ্ছে তারা, কিংবা মাটি আর কপ্টারের মাঝখানে ঘন মেঘের স্তর রয়েছে।
মেঘের আড়াল থেকে যতবারই বেরুল ওরা, দিনের ক্ষীণ রশ্মি আরো একটু করে কম লাগল চোখে? এনিসকেরী এয়ারকন্ট্রোলের সাথে রেডিও যোগাযোগ রাখা দরকার, কপ্টারগুলো তাই খুব বেশি উঁচুতে উঠতে পারছে না। মাঝখানের দূরত্ব যত বাড়ছে ততই নিচে নামতে হলো। অন্ধকারে কোথায় কি আছে বোঝার উপায় নেই, মেঘ মনে করে ভেতরে ঢোকার সময় কোনো ঢালের গায়ে ধাক্কা খেলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
দুই পাইলটের মাঝখানের জাম্প সীটে বসে আছে পিটার, ওর পিছনে ঠাই করে নিয়েছে কলিন। সবাই ওরা নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। উত্তেজনায় টান হয়ে আছো পেশি, চার জোড়া চোখ উপকূলরেখা খুঁজছে।
তীর দেখা গেল, মাত্র পনেরো ফিট নিচে সাদা ফেনা টগবগ করে ফুটছে যেন। তীর রেখা ধরে দক্ষিণ দিকে কোর্স বদল করল পাইলট। কয়েক সেকেন্ড পরই উজ্জ্বল আলোর একটা মালা দেখা গেল।
উইকলো, বলল পাইলট, সে থামতেই কো-পাইলট নতুন দিকনির্দেশনা দিল। একটা চিহ্ন যখন পাওয়া গেছে, এবার সরাসরি লারাগের দিকে যেতে পারবে ওরা।
উপকূল থেকে অল্প দূরে রাস্তা, সেটাকে অনুসরণ করল ওরা।
চার মিনিট পর টার্গেট, পিটারের কানের কাছে চেঁচাল পাইলট, আঙুল দিয়ে খোঁচা মারার ভঙ্গিতে সামনের দিকটা দেখাল ওকে।
কোনো মন্তব্য না করে কুইক-রিলিজ হোলস্টার থেকে ওয়ালথারটা টেনে বের করল পিটার।
.
ছোট একটা এয়ারব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভরে নিল জিলি ও’ শওনেসি। বিছানাসহ খাটটা সরিয়ে দেয়াল খানিকটা উন্মুক্ত করল সে, হার্ডবোর্ডের আবরণ এক টানে নামাতেই বেরিয়ে পড়ল গোপন একটা শেলফ।
শেলফে ছোট একটা প্লাস্টিকের মোড়ক রয়েছে, নতুন পাসপোর্ট আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে ওটায়। খলিফা এমনকি ভিকটিমের কাগজপত্রও জোগান দিয়েছে–হেলেন ব্যারি, তার মেয়ে। প্লাস্টিকের প্যাকেট খুলে কাগজগুলো পকেটে ভরল সে। প্যাকেটে পিস্তলের জন্যে অতিরিক্ত কিছু অ্যামুনিশন আর পনেরোশ পাউন্ড ট্রাভেলার্স চেক রয়েছে। সেগুলোও পকেটে চালান করল সে। তারপর বেরিয়ে এল কিচেনে।
রেডি?
সাহায্য কর।
এয়ারব্যাগ মেঝেতে ফেলে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল জিলি ও’ শওনেসি। দিনের অবশিষ্ট আলো দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে, মেঘগুলো এত কাছে মনে হলো যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। বনের ভেতর দৃষ্টি চলে, অন্ধকার হয়ে গেছে।
আমি একা ওকে বয়ে নিয়ে যাব কিভাবে! ঘ্যানঘ্যান করে উঠল ডাক্তার, ঝট করে তার দিকে ফিরল জিলি ও’ শওনেসি।
আবার ছোটা শুরু হলো। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল জিলি ও’ শওনেসি। পালিয়ে পালিয়ে যতদিন বেঁচে থাকা যায়। অদ্ভুত এবং রোমাঞ্চকর জীবন, কোনো কাজ না করে প্রচুর মালপানি কামানো যায় এই পেশায়। কিন্তু ভুল করলে তার খেসারত দিতে হয় জীবনের বিনিময়ে। এবার একসাথে অনেকগুলো ভুল হয়ে গেছে। সে নয়, আর কেউ দায়ী।
কি হলো, একটু ধরবে না?
একাই বিছানা থেকে মেলিসাকে কাঁধে তোলার চেষ্টা করেছিল ডাক্তার, পারেনি। ঘুমে অচেতন শরীরটা বিছানা থেকে ঝুলে আছে অর্ধেক।
সামনে থেকে সরো! হেঁড়ে গলায় ধমক লাগাল জিলি ও’ শওনেসি, ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ডাক্তারকে। মেলিসার ওপর ঝুঁকে পড়ল সে।
মেলিসার চোখ বন্ধ, ভেতরে মণি দুটো একটু একটু নড়ছে। মুখ খোলা, কেঁপে উঠল ঠোঁট জোড়া। ফুলে ফুলে উঠল নাকের ফুটো। দয়া করে আমার ড্যাডিকে বল, আমি এখানে। বিড়বিড় করে বলল সে।
ইতোমধ্যে গ্যারেজে ঢুকে গাঢ় নীল অস্টিনের দরজা খুলে ফেলেছে ডাক্তার। কোথায় যাচ্ছি আমরা? ফাঁসফেঁসে গলায় জিজ্ঞেস করল সে।
গাড়িতে মেলিসাকে তুলে ড্রাইভিং সীটে বসল জিলি ও’ শওনেসি। এখনো ঠিক করিনি। উত্তরে একটা সেফ হাউস আছে, কিংবা সাগর পেরিয়ে ইংল্যান্ডেও চলে যেতে পারি…
কিন্তু আমরা যাচ্ছি কেন, এমন হুট করে?
উত্তর না দিয়ে আবার গাড়ি থেকে নামল জিলি ও’ শওনেসি। ওরা যে এখানে ছিল, তার কোনো চিহ্ন রাখা চলবে না। কিচেনে ঢুকে দরজা বন্ধ করল সে, বন্ধ দরজার গায়ে এলোপাতাড়ি লাথি মারতে শুরু করল। পুরানো কাঠ, ভেঙ্গে গেল কবাট। পাশের ঘর থেকে চেয়ার আর টেবিল নিয়ে এসে জড়ো করল এক জায়গায়। সেগুলোর ওপর খবরের কাগজ রাখল। তারপর আগুন ধরাল। বাকি দরজা আর জানালাগুলো খুলে দিল সে।
গ্যারেজের সামনে ফিরে এসে স্থিরভাবে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকল জিলি ও’ শওনেসি। উপকূলের দিক থেকে কি রকম যেন একটা যান্ত্রিক আওয়াজ আসছে। হয়তো পাহাড়ি পথ বেয়ে কোনো ভারী ট্রাক যাচ্ছে। উৎ। বড় বেশি দ্রুত বাড়ছে শব্দটা। মনে হলো মেঘে মেঘে ছড়িয়ে পড়ছে যান্ত্রিক গুঞ্জন।
তারপর চিনতে পারল জিলি ও’ শওনেসি আওয়াজটা। রোটরের শব্দ। পরমুহূর্তে বিদ্যুৎ খেলে গেল তার শরীরে। পিস্তলটা বেরিয়ে এসেছে হাতে। ছুটল গাড়ির দিকে। ওহ ঈশ্বর! কেন? বহুদিন পর খোদার নাম নিল সে।
.
বৃথা চেষ্টা! ঘাড় বাঁকা করে পিটারের উদ্দেশে চিৎকার করল পাইলট, ফ্লাইট ইন্সট্রুমেন্ট থেকে চোখ সরায়নি। দ্বিতীয় কপ্টারটাকে হারিয়ে ফেলেছে ওরা। অন্ধ হয়ে গেছি, দেখতে পাচ্ছি না কিছু। জানালা আর উইন্ডস্ক্রীনের ঠিক বাইরে কিনারা উপচানো দুধের মতো ফুটছে মেঘ। মেঘের ওপরে উঠে এনিসকেরীর দিকে ফিরে যেতে হবে আমাকে। যে অবস্থায় আছি, যে কোনো মুহূর্তে নাম্বার টুর সাথে ধাক্কা লাগতে পারে।
সাত মিনিট হলো মেঘ ওদেরকে পুরোপুরি গ্রাস করেছে, তারও বেশ কমিনিট আগে হারিয়ে গেছে দ্বিতীয় কপ্টারটা। হারিয়ে গেছে মানে হয়তো আশপাশেই কোথাও আছে সেটা, কিন্তু মেঘের স্তর আর বৃষ্টির পর্দার জন্যে দেখতে পাচ্ছে না ওরা। কপ্টারের মাথায় বীকন লাইট দপদপ করছে, কোমল মেঘে প্রতিফলিত হচ্ছে আলো, কিন্তু দ্বিতীয় কপ্টারের পাইলট সময় থাকতে আলোটা দেখতে পাবে না।
আরেকটু দেখি। আর শুধু এক মিনিট, ইঞ্জিন আর রোটরের আওয়াজের সাথে পাল্লা দিয়ে গলা ফাটাল পিটার। ইট্রুমেন্ট প্যানেলের আলোয় ভূতের মতো দেখাল ওর চেহারা। গোটা অপারেশন ওর চোখের সামনে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। জানে, যে কোনো মুহূর্তে মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হতে পারে ওরা। কিন্তু তবু ওকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। নিচে দুর্পাঁচ মাইলের মধ্যে কোথাও আছে প্রাণপ্রিয় মেয়ে। এত দূর এসে কিভাবে তাকে ফেলে যায় ও?
কোনো লাভ নেই, শুরু করল পাইলট, পরমুহূর্তে শিউরে উঠল সে, গলা থেকে আর্তনাদ বেরিয়ে এল, একই সাথে বিদ্যুৎ খেলে গেল দুহাতে। অকস্মাৎ কাত হলো হেলিকপ্টার, দ্রুত এক পাশে সরে যাবার সাথে সাথে লাফ দিয়ে ওপরেও উঠল খানিকটা–মনে হলো নিরেট কিছুর সাথে যেন ধাক্কা খেয়েছে ওরা।
মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে ওদের দিকে লাফ দিয়েছিল চার্চের একটা মিনার। ফ্লাইট ডেকে ওরা যেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে সেখান থেকে মাত্র কয়েক ফিট দূরে একঝলক দেখা গেল সেটাকে, সগর্জনে পাশ কাটাল হেলিকপ্টার। দেখা দিয়েই চোখের পলকে পিছন দিকে অদৃশ্য হয়ে গেছে মিনারটা।
চার্চ! চার্চ! পাইলটের কাঁধ খামচে ধরল পিটার। পেয়েছি! ঘোরো!
কপ্টারের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার চেষ্টা করছে পাইলট, মেঘ, বাতাস, আর বৃষ্টির মধ্যে অন্ধের মতো কোথায় চলেছে ওরা কেউ জানে না। তার চিৎকার শুনতে পেল পিটার, ঘোরাতে গিয়ে মারা পড়ব নাকি! কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না!
রেডিও অলটিমিটার-একশ সত্তর ফিট, বলল কো-পাইলট। মাটি থেকে কপ্টারের এটাই সঠিক দূরত্ব, তবু নিচের দিকে কিছুই ওরা দেখতে পাচ্ছে না।
গেট আস ডাউন। ফর গডস সেক, গেট আস ডাউন, অনুরোধ করল পিটার।
এরকম ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়। কোনো ধারণাই নেই কি আছে নিচে। ইন্সট্রুমেন্টের আলোয় পাইলটের চেহারা ফ্যাকাসে গোলাপি আর অসুস্থ দেখাল, চোখ দুটো যেন খুলির গায়ে গভীর গর্ত। মেঘের ওপরে উঠে ফিরে যাচ্ছি আমি…
হাতটা নিচের দিকে বাড়াল পিটার, আঙুলের ভেতর লাফ দিয়ে উঠে এল ওয়ালথারটা জ্যান্ত একটা প্রাণীর মতো। মনের অবস্থা উপলব্ধি করে নিজেই অবাক হয়ে গেল পিটার-পাইলটকে খুন করার মানসিক প্রস্তুতি রয়েছে ওর, তারপর কো পাইলটকে বাধ্য করবে ল্যান্ড করতে। ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘের স্তরে একটা ফাঁক দেখা গেল, নিচের কালচে মাটির খানিকটা পরিষ্কার ধরা পড়ল চোখে।
নামো, নামো, নামো! উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ল পিটার, সিলিংয়ে মাথা ঠুকে যেতে বসে পড়ল আবার। সরাসরি নিচের দিকে খসে পড়ার ভঙ্গিতে নামতে শুরু করল হেলিকপ্টার, হঠাৎ করেই বেরিয়ে এল মেঘের গ্রাস থেকে।
ওই তো নদী, চকচকে পানি দেখতে পেল পিটার। ব্রিজ, ব্রিজ!
চার্চের উঠান ওটা? ব্যগ্র কণ্ঠে ঘোষণা করল কলিন। আর ওই যে, ওই যে টার্গেট!
টালির ছাদ ধোয়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, খোলা জানালা-দরজার দিয়ে ধোয়ার সাথে বেরিয়ে আসছে আগুনের গোলাপি শিখা। বাড়িটার দিকে ডাইভ দিল কপ্টার।
হামাগুড়ি দিয়ে কেবিনের দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল কলিন। ডেল্টা! আমরা ডেল্টা কন্ডিশনে যাচ্ছি! ডেল্টা কন্ডিশন মানে কাজে বাধা পেলে দেখামাত্র শত্রুকে খুন করা যাবে। কলিনের ঘোষণা শেষ হতেই ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার কেবিন হ্যাচের কাভার খুলে ফেলল, রোটরের বাড়ি খাওয়া বৃষ্টির মিহি ছাঁট ছোট ছোট মেঘের মতো ঢুকে পড়ল কেবিনের ভেতর।
থোর কমান্ডোরা দাঁড়িয়ে পড়েছে, খোলা হ্যাচের দুদিকে পজিশন নিচ্ছে তারা। কলিন রয়েছে সবার আগে, তার পজিশনের নাম পয়েন্ট।
কালচে মাটি ছুটে উঠে এল ওদের দিকে, থো করে চুরুট ফেলে দোরগোড়া আঁকড়ে ধরল কলিন। যা নড়বে তাই বাধা, গুলি করে সরিয়ে দেবে, নির্দেশ দিল সে। বাট ফর গডস সেক, ওয়াচআউট ফর দ্য গার্ল! লেটস গো, গ্যাং। লেটস গো!
জাম্প সীটে আটকে গেছে পিটার, পা ছাড়াতে গিয়ে মূল্যবান কয়েক সেকেন্ড নষ্ট করল, তবে উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে সামনেটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে।
বাড়িটায় আগুন জ্বলছে দেখে বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল ওর। জ্যান্ত পুড়িয়ে মারছে ওরা মেলিসাকে? উঠানটা অন্ধকার, মনে হলো কি যেন নড়ছে। ছুটে গেল একটা মানুষের আকৃতি, নাকি ভুল দেখল?
খোলা উঠানের দশ ফিট ওপরে ঝুলে থাকল হেলিকপ্টার, মৃদু দুলছে এদিক ওদিক। বাড়ির পিছন দিক এটা। কালো পোশাক পরা থোর কমান্ডোরা ঝুপ ঝুপ করে নামল, বাড়িটার জানালা দরজা দিয়ে পিলপিল করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। ধোয়ার ভেতর হারিয়ে গেল ওরা।
সবশেষে নামছে পিটার। লাফ দেয়ার আগে কেন যেন খোলা হ্যাচের সামনে দাঁড়িয়ে চারদিকটা একবার দেখে নেয়ার ইচ্ছে হলো ওর। খানিক আগে সামনের উঠানে কিছু একটা নড়তে দেখেছিল, সম্ভবত সেটা ভোলেনি বলেই। তাকাবার সাথে সাথে পাথুরে পাঁচিলের মাঝখানে সরু রাস্তা উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। কোনো গাড়ির হেডলাইট জ্বলে উঠেছে। অন্ধকার বাড়িটা থেকে সগর্জনে বেরিয়ে এল গাড়িটা।
খোলা হ্যাচের কিনারায় টলমল করতে লাগল শরীরটা, লাফ দিতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়েছে পিটার। তাল সামলে নিয়ে দরজার ওপর হাত তুলে নাইলন লাইনটা খপ করে ধরে ফেলল। বাঁক নেয়ার জন্যের মন্থর হলো গাড়ির গতি, তারপর ব্রিজের দিকে ছুটল। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের কাঁধ খামচে ধরে ঝাঁকি দিল পিটার, অপর হাতটা তুলে ধাবমান গাড়িটাকে দেখাল। লোকটার কান থেকে ওর ঠোঁট মাত্র দুইঞ্চি দূরে।
গলার রগ ফুলে উঠল পিটারের, পালাচ্ছে, থামাতে হবে!
মাইক্রোফোনে দ্রুত কথা বলল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার, সরাসরি পাইলটের সাথে। ইতস্তত না করে কপ্টার ঘুরিয়ে নিল পাইলট, বদলে গেল রোটরের আওয়াজ। তীরবেগে ব্রিজের দিকে ছুটল যান্ত্রিক ফড়িং।
সামনেটা দেখার জন্যে হ্যাচ ধরে ঝুলে থাকতে হলো পিটারকে, তীব্র বাতাস নির্মম কৌতুকে মেতে উঠল ওকে নিয়ে। হেডলাইট অনুসরণ করছে পাইলট। ব্রিজ পেরিয়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরেছে গাড়ির ড্রাইভার, উপকূলের দিকে যাচ্ছে।
মাঝখানে দুশ গজ ব্যবধান, গাছের কালো মাথাগুলো যেন হ্যাচের সমান উঁচু, তীরবেগে ছুটে আসছে পিটারের দিকে। ব্যবধান নেমে এল, আর একশ গজ। হেডলাইটের আলোয় ঘন ঝোঁপ আর পাথুরে পাচিল আলোকিত হয়ে উঠল। এদিকে দুই খেতের মাঝখানে প্রায়ই একটা করে পাঁচিল দেখা যায়।
গাড়িটা ছোট, নীল রঙের। দক্ষ ড্রাইভার, বেপরোয়াভাবে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বীকন লাইট অফ করতে বল, নির্দেশ দিল পিটার, চায় না গাড়ির ড্রাইভার বুঝতে পারুক তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। কিন্তু ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার মাউথপীস মুখে তুলতেই নিচের রাস্তা অন্ধকার হয়ে গেল। হেডলাইট অফ করে দিয়েছে ড্রাইভার।
আলোর পর গাঢ় অন্ধকারে সবকিছু ঢাকা পড়ে গেল। নিচে যেন গাড়ির কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
হতাশায় ক্লান্তি বোধ করল পিটার। এই অন্ধকারে গাছের মাথা ছুঁয়ে উড়ে যাওয়া ভয়ানক বিপজ্জনক। কপ্টার ঝাঁকি খেল একবার, তারপর সিধে হলো। পর মুহূর্তে নিচের দিকে চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলোর বন্যা বয়ে গেল। ল্যান্ডিং লাইট জ্বেলেছে পাইলট, বুঝতে পারল পিটার। ফিউজিলাজের দুদিকে দুটো উৎস থেকে আলো পড়ল রাস্তায়, গাড়ির একটু সামনে।
আলোর জালে আটকা পড়ল নীল অস্টিন।
আরো নিচে নামল কপ্টার। টেলিগ্রাফ পোল আর গাছ দিয়ে ঘেরা সরু রাস্তার মাঝখানে ঢুকছে।
গাড়ির ছাদে র্যাক দেখল পিটার। বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। র্যাক থাকায় ঝুঁকিটা নেয়া যায়।
.
ব্যাক সীট থেকে ডাক্তারই প্রথম দেখল হেলিকপ্টারটাকে। বৃষ্টি আর বাতাসের শব্দে রোটরের আওয়াজ চাপা পড়ে ছিল, চেহারা গম্ভীর হলেও মনে মনে নিজের প্রশংসা করছিল জিলি ও’ শওনেসি। যোদ্ধা লোকগুলোকে হেলিকপ্টার থেকে নামার সুযোগ ইচ্ছে করে দিয়েছে সে, সবাই নেমে গেছে দেখে তারপর হেডলাইট জ্বেলে বেরিয়ে এসেছে গ্যারেজ থেকে। জানে, প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে সময় লাগবে অ্যাসল্ট টিমের। প্রথমে আবিষ্কার করবে, বাড়ি খালি। হৈ-হাঙ্গামার মধ্যে সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করা সহজ নয়। সবশেষে আবার হেলিকপ্টারে চড়ে খুঁজতে বেরুতে হবে। ততক্ষণে বহু দূরে সরে আসবে সে। ডাবলিনে তার একটা সেফ হাউস আছে–অন্তত এক সময় ছিল, চার বছর আগে। বলা যায় না, সেটার অস্তিত্ব হয়তো ফাঁস হয়ে গেছে এত দিনে। সেক্ষেত্রে ভিকটিম আর ডাক্তারকে ত্যাগ করবে সে। দুটো বুলেট খরচ করলেই ঝামেলা শেষ। তারপর অস্টিনটাকে আইরিশ সাগরে ফেলে দিলেই চলবে।
ব্যাক সীটে ব্যথায় গোঙাচ্ছে মেয়েটা, তার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে ডাক্তার। ঘাড় ফিরিয়ে একবার তাকাল জিলি ও’ শওনেসি, দৃশ্যটা দেখে হেসে উঠল সে। বাঁক নেয়ার সময় ঝোঁপের সাথে ঘষা খেল গাড়ি। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ি সিধে করল ও।
ওরা আসছে, আর্তনাদ করে উঠল ডাক্তার।
রিয়্যারভিউ মিররে তাকাল জিলি ও’ শওনেসি, তারপর ঘাড় ফিরিয়ে পিছনের রাস্তায়। কিছুই দেখতে পেল না। কি বললে?
হেলিকপ্টার…।
পাশে জানালার কাঁচ নামাল জিলি ও’ শওনেসি, এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে বাইরে মাথা বের করল। বীকন লাইটটা খুব কাছে আর গাড়ির সামান্য পিছনে দেখতে পেল সে। ঝট করে মাথা টেনে নিল ভেতরে। অফ করে দিল হেডলাইট।
গাঢ় অন্ধকারেও গাড়ির স্পীড কমাল না সে। এবার তার হাসির শব্দ বেপরোয়া আর উন্মত্ত শোনাল ডাক্তারের কানে।
তুমি পাগল হয়ে গেছ, ছটফট করে উঠল ডাক্তার। আমাদের সবাইকে খুন, করবে!
খুন করাই তো আমার পেশা, ডাক্তার জেমসন! আবার হাসল জিলি ও’ শওনেসি। তোমার যেমন মেয়েদের বোঝা নামানো। চোখে সয়ে আসছে অন্ধকার, শেষ মুহূর্তে দেখতে পেয়ে একটা পাথরে পাঁচিলকে এড়িয়ে যেতে পারল। বেল্ট থেকে পিস্তল বের করে পাশের সীটে রাখল সে। ওরা যদি ভেবে থাকে… উজ্জ্বল আলো ঘুসির মতো আঘাত করল তাকে, হেলিকপ্টারের ল্যান্ডিং লাইট জ্বলে উঠেছে। সামনের রাস্তা দিনের মতো আলোকিত। পরবর্তী বাঁক নেয়ার সময় কংক্রিটের সাথে ঘষা খেল চাকা।
থামো, দোহাই লাগে! মেলিসাকে দুহাতে জড়িয়ে রেখে আবেদন জানাল ডাক্তার। প্রতি মুহূর্তে আঁকি খাচ্ছে গাড়ি, ঘুমন্ত মেয়েটাকে ছেড়ে দিলে সীট থেকে পড়ে যাবে। ধরা দিলে বেঁচে যাব! তা না হলে মেরে ফেলবে ওরা…!
শুধু পাইলট, যারা মারতে পারে তারা কেউ নেই ওটায়, খেঁকিয়ে উঠল জিলি ও’ শওনেসি। ওরা আমাদের কিছুই করতে পারবে না!
ধরা দাও! কাঁদো কাঁদো গলায় বলল ডাক্তার। তোমার পায়ে পড়ি, এসো সবাই আমরা বাঁচি!
তিনটি বুলেট আছে–আমাদের তিনজনের জন্যে।
ছোঁ দিয়ে পিস্তলটা তুলে মাথা আর ডান কাধ জানালা দিয়ে বাইরে বের করে দিল জিলি ও’ শওনেসি, ঘাড় বাঁকা করে ওপর দিকে তাকাল। চোখ-ধাঁধানো আলো ছাড়া কিছুই দেখল না সে। সেই আলোর দিকেই গুলি ছুঁড়ল। রোটর আর বাতাসে শব্দে চাপা পড়ে গেল পিস্তলের আওয়াজ।
.
খোলা হ্যাচের কিনারায় দাঁড়িয়ে গোলাপি মাজ্ব ফ্ল্যাশ গুনল পিটার। পাঁচটা গুলি হলো, কিন্তু বুলেটের পাশ ঘেঁষে ছুটে যাবার আওয়াজ পেল না।
গেট লোয়ার! শুধু চিৎকার নয়, জরুরি ভঙ্গিতে হাত নেড়ে সঙ্কেতও দিল পিটার। ছুটন্ত অস্টিনের দিকে আরো খানিকটা নামল হেলিকপ্টার।
সাবধানে লাফ দেয়ার একটা ভঙ্গি নিল পিটার, রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে থাকল সঠিক মুহূর্তটির জন্যে। তারপর যখন লাফ দিল মনে হলো হ্যাচওয়ে থেকে কেউ বোধ হয় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে ওকে।
চার হাত-পা ছড়িয়ে পড়ল শূন্যে, পতনের সমাপ্তি ঘটার আগে পিটারের মনে হলো সময়ের হিসেবে ভুল হয়ে গেছে–অস্টিনের পিছনে রাস্তায় পড়বে সে। কিসের সাথে যেন ধাক্কা খেল অস্টিন, মুহূর্তের জন্যে মন্থর হলো গতি, ছাদের ওপর দড়াম করে পড়ল পিটার। অনুভব করল, শরীরের নিচে দেবে গেল ছাদ। গড়িয়ে কিনারার দিকে চলে এল, শরীরের বা দিকটা পুরোপুরি অসাড় হয়ে গেছে ছাদের সাথে বাড়ি খেয়ে। শুধু ডান হাত দিয়ে ছাদ হাতাড়াচ্ছে, নখ দিয়ে চেঁছে রঙ তুলে ফেলার জোগাড় করল ছাদের। কিন্তু কোনোভাবেই পিছলে যাওয়াটা থামানো গেল না। গাড়ির বাইরে শূন্যে ছটফট করছে পা দুটো।
রাস্তায় খসে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে র্যাকের ফ্রেম আঙুল প্যাচাতে পারল পিটার, এক হাতের ওপর বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকল গাড়ির কিনারায়। এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে নিজেকে তুলে নিল, কিন্তু ড্রাইভার টের পেয়ে গেছে ছাদে লোক। সাথে সাথে নিষ্ঠুর কৌতুকে মেতে উঠল সে। ঘন ঘন হুইল ঘুরিয়ে গাড়িটাকে রাস্তার এদিক-ওদিক ফেরাতে লাগল সে, একদিক থেকে আরেক দিকে ছোটার সময় একপাশের চাকা রাস্তা ছেড়ে শূন্যে উঠে পড়ল। তীব্র, কর্কশ প্রতিবাদ জানাল চাকাগুলো, ছাদে ঘষা খেয়ে বারবার এদিক-ওদিক ছিটকে গেল পিটারের শরীর। ডান হাতের পেশি আর জয়েন্টে প্রচণ্ড টান পড়ল, মনে হলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তবে অসাড় হয়ে যাওয়া বাঁদিকটায় দ্রুত স্পর্শবোধ ফিরে আসছে।
এভাবে গড়াগড়ি খেলে ছাদে বেশিক্ষণ টেকা যাবে না। গাড়ির মতিগতি আন্দাজ করে নিয়ে খালি হাতটা লম্বা করে দিল পিটার, একই সাথে নরম বুটের ডগা রুফ ক্যারিয়ারের একটা ফাঁকে ঢুকিয়ে আটকে ফেলল আঙটার মতো।
হেলিকপ্টারের আলোয় সামনে একটা প্রায় খাড়াভাবে নেমে যাওয়া বক দেখল ড্রাইভার। গাড়ি সিধে করতে বাধ্য হলো সে। বাকের পর রাস্তাটা ঘন ঘন এঁকেবেঁকে নেমে গেছে উপকূলের দিকে।
মাথা তুলল পিটার, উঠে বসতে যাচ্ছে, এই সময় নাকের ঠিক ছয় ইঞ্চি সামনে ছাদের ছোট্ট একটা অংশ ওপর দিকে বিস্ফোরিত হলো। নিখুঁত একটা গর্ত তৈরি করে বেরিয়ে গেল বুলেট। সেই সাথে কানের পর্দায় জোর ধাক্কা দিল পিস্তল শটের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। ড্রাইভিং সীটে বসে আন্দাজের ওপর নির্ভর করে ছাদে গুলি করছে ড্রাইভার, প্রথমবার মাত্র কয়েক ইঞ্চির জন্যে লক্ষ্য ভেদে ব্যর্থ হয়েছে সে।
কোণঠাসা বিড়ালের মতো বেপরোয়া হয়ে উঠল পিটার, সমস্ত শক্তি এক করে ছাদের কিনারায় সরে যাবার চেষ্টা করল। মুহূর্তের জন্যে রুফ ক্যারিয়ার থেকে ছুটে যাচ্ছিল পা। ছাদ ফুটো করে আরেকটা বুলেট বেরিয়ে এল, এইমাত্র যেখানে পেট ছিল পিটারের।
মরিয়া হয়ে উঠল পিটার। গাড়ির পিছন দিকে গুটিয়ে নিয়েছে শরীরটা, এক কিনার থেকে আরেক কিনারায় ঘন ঘন জায়গা বদল করছে। পরবর্তী বিস্ফোরণের সাথে সাথে চুল পোড়ার গন্ধ পেল ও, গরম আঁচ অনুভব করল খুলিতে।
কিছুটা কৌশল, বাকিটা ভাগ্যগুণে বেঁচে যাচ্ছে পিটার। কিন্তু ভাগ্য প্রতিবার সহায়তা করবে না। প্রতিমুহূর্তে আশঙ্কা করছে এই বুঝি লাগল একটা বুলেট। কিন্তু না, ড্রাইভার আর গুলি করছে না।
এতক্ষণে মনে পড়ল পিটারের, হেলিকপ্টারের দিকে ছুঁড়ে কয়েকটা বুলেট বাজে খরচ করেছে ড্রাইভার। ধীরে ধীরে আরেকটা ব্যাপারে সজাগ হলো পিটার, ইঞ্জিন আর রোটরের আওয়াজকে চাপা দিয়ে একটা শব্দ বাড়তে চেয়েও পারছে না। দুই সেকেন্ড দিশেহারা বোধ করল পিটার। তারপর শব্দটা কোত্থেকে আসছে বুঝতে পেরে শরীরে অসুরের শক্তি অনুভব করল। ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর, অনেকটা গোঙানির মতো। ওষুধের প্রভাব কেটে যাওয়ায় চারপাশে কি ঘটছে আন্দাজ করতে পারছে মেলিসা। চিৎকার করে কি যেন বলার চেষ্টা করছে সে, কিন্তু গলা চড়াতে পারছে না।
বাঁ-পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে বিড়ালের মতো সিধে হলো পিটার, হামাগুড়ি দিয়ে সামনের দিকে এগোল। ড্রাইভিং সীটের ঠিক ওপরে থামল ও।
আবার চিৎকার করার চেষ্টা করল মেলিসা। এবার তার কণ্ঠস্বর নিঃসন্দেহে চিনতে পারল পিটার। কুইক-রিলিজ হোলস্টার থেকে ওয়ালথার বের করে এক ঝটকায় হ্যাঁমার কক করল ও, একই সময় চোখ তুলে দেখে নিল দ্রুত ছুটে আসা আরেকটা বাঁককে। দুহাতে হুইল ধরে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ঠিক রাখতে হবে ড্রাইভারকে।
ছাদের সামনের কিনারা থেকে নিচের দিকে ঝুলে পড়ল পিটার। মাথা নিচের দিকে, তাকিয়ে আছে পিছন দিকে, হতভম্ব ড্রাইভারের চোখ, মাঝখানে মাত্র আঠারো ইঞ্চির ব্যবধান।
দুজোড়া চোখের দৃষ্টি এক সেকেন্ড বাধা পড়ল। শওনেসির ফটো দেখেছে পিটার, নির্দয় খুনির ঠাণ্ডা চোখে ঘৃণা আর আক্রোশ ফুটে উঠতে দেখল।
দুহাতে গাড়ি চালাচ্ছে জিলি ও’ শওনেসি, পিস্তলটা এখনো এক হাতে ধরা চেম্বার খোলা, কিন্তু রিলোডিঙের সময় পায়নি। খাঁচায় বন্দী হিংস্র পশুর মতো মুখ ঝামটা দিল সে, উইন্ডশীল্ডের কাছে মাজল ঠেকিয়ে গুলি করল পিটার।
ঝাপসা হয়ে গেল সামনের দৃশ্য, অসংখ্য চিড় ধরে সাদা হয়ে গেছে কাঁচ। পরমুহূর্তে খসে পড়ল উইন্ডশীল্ডের ফ্রেম থেকে। চকচকে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে পড়ল অস্টিনের ভেতর।
দুহাতে মুখ ঢেকেছে জিলি ও’ শওনেসি, আঙুলের ফাঁক গলে হড়হড় করে বেরিয়ে আসছে উজ্জ্বল রক্ত, কয়েকটা ধারায় ঝরে পড়ছে কালো লোম ঢাকা বুকে।
এখনো ওপর দিকে পা আর নিচের দিকে মাথা নিয়ে ঝুলে আছে পিটার। বিধ্বস্ত উইন্ডস্ক্রীনের ভেতর ওয়ালথার ধরা হাতটা লম্বা করে দিল ও, মাজুল ঠেকাল জিলির গায়ে। বুকের ওপর, পাজরে গুলি করল, পর পর দুটো। এক্সপ্লোসিভ ভেলেক্স বুলেট হাড়ে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে যাবে, শরীর থেকে বেরিয়ে আর কাউকে আহত করবে না। মেলিসার গলা নিস্তেজ হয়ে এলেও, পরিষ্কার শুনতে পেল পিটার। এখন আর কিছু বলার চেষ্টা করছে না, শুধুই গোঁ গোঁ করে গোঙ্গাছে। বুলেটের ধাক্কায় সীটের গায়ে হেলান দিল জিলি ও’ শওনেসি, মাথাটা এদিক-ওদিক দুলছে। ইঞ্জিনের আওয়াজ কমে যাবে বলে আশা করল পিটার, লাশের পা অ্যাকসিলারেটর থেকে নেমে আসার কথা।
কিন্তু তা ঘটল না। লাশটা সামনের দিকে নেমে গেছে, পা আরো চেপে বসেছে অ্যাকসিলারেটরে। ঢালু রাস্তা ধরে তীরবেগে ছুটছে অস্টিন, দুপাশে উঁচু পাথরে পাঁচিল থাকায় মনে হলো টানেলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে ওরা।
লক্ষ্যহীনভাবে এদিক-ওদিক ঘুরছিল হুইল, একটা হাত দিয়ে সেটা ধরে ফেলল পিটার। পাঁচিলের সাথে ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা দূর হলো, কিন্তু গতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
এভাবে পায়ের পাতা আর হাটুর ওপর বেশিক্ষণ ঝুলে থাকা সম্ভব নয়। উইন্ডস্ক্রীনে থেকে যাওয়া ভাঙা কাঁচে হাত ঠেকে রয়েছে। তীব্র টানা বাতাস প্রবল শক্তিতে গাড়ির মাথার সাথে চেপে রেখেছে শরীরটা। সময় মতো হুইল ঘোরাতে পারেনি পিটার, ডান দিকের পাঁচিলে ঘষা খেল গাড়ি। পিছন দিকে আগুনের ফুলকি দেখল পিটার, সেই সাথে কর্কশ আওয়াজে রী রী করে উঠল সারা শরীর। হুইল ঘুরিয়ে রাস্তার মাঝখানে আবার ফিরিয়ে আনল পিটার গাড়িটাকে। কিন্তু আবার হুইল ঘোরাবার আগেই বাঁ দিকের পাঁচিলের সাথে ঘষা খেল। হুইল থেকে ছিটকে পড়ল পিটারের হাত। ভাঙা কাঁচের ওপর হাতের চাপ লেগে কেটে গেল মাংস। পঁচিল ভেঙে খাদের কিনারায় চলে এল অস্টিনের নাক। পিটার আবার ধরার আগে নিজেই ঘুরতে শুরু করল হুইল, খাদের কিনারা আর ভাঙা পাচিলের ভেতর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় ফিরে এল গাড়ি।
শেষ রক্ষা হবে না, এক সময় খাদে পড়বেই অস্টিন, জানে পিটার। ওর উচিত ঝুঁকি নিয়ে লাফ দিয়ে পড়া, প্রথমে নিজের জান বাঁচানোর চেষ্টা করা। কিন্তু উদভ্রান্ত গাড়ির ছাদে তবু সেঁটে থাকল ও, কারণ মেলিসাকে বিপদের মধ্যে ফেলে যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়।
হুইলটা আবার ধরেছে পিটার, গাড়ির বাইরে মাথা বের করে তাকাতেই পাঁচিলের গায়ে কাঠের একটা ফটক দেখতে পেল। ফটকের দিকে চোখ রেখে হুইলটা আস্তে আস্তে ঘোরাতে শুরু করল। তীরবেগে ছুটে এল ফটক।
ধাক্কা লাগল, কাঠের কবাট ভেঙে ভেতরে ঢুকল অস্টিন। বিস্ফারিত রেডিয়েটর থেকে গরম পানি ছড়িয়ে পড়ল পিটারের হাত আর মুখে। খোলা মাঠে খ্যাপা ষাড়ের মতো ঢুকে পড়ল গাড়ি, ছড়ানো পাথরের ওপর দিয়ে ঝাঁকি খেতে খেতে ছুটছে। পাথরগুলোর মাঝখানে নরম মাটি, চাকা বসে যেতে লাগল, সেই সাথে কমে এল গতি। সরু একটা নালার মধ্যে অস্টিন, দুবার ড্রপ খেয়ে স্থির হয়ে গেল।
শরীরটা গড়িয়ে দিয়ে গাড়ির পাশে নামল পিটার। হ্যাচকা টানে দরজা খুলতেই ক্যাব থেকে মাটিতে ঢলে পড়ল একজন লোক, বিড়বিড় করে কি যেন বলছে সে। ডান হাঁটু দিয়ে তার চিবুকে প্রচণ্ড আঘাত করল ও, জ্ঞান হারিয়ে স্থির হয়ে গেল। ডাক্তার জেমসন। তাকে টপকে অস্টিনের ভেতর মাথা ঢোকাল পিটার।
দুহাতের ওপর মেলিসাকে নিয়ে সিধে হলো পিটার, হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে। পা টলছে পিটারের, থেমে থেমে হেলিকপ্টারের দিকে হাঁটছে ও। খানিক দূরে মাটিতে নেমেছে সেটা।
ঠোঁট নড়ছে মেলিসার, কিন্তু আওয়াজ বেরুচ্ছে না। চোখ বন্ধ। পিটারের কাঁধ আর পিঠ খামছে ধরে আছে সে।
কপ্টার থেকে ছুটে এল থোর ডাক্তার। পিটারের অস্ফুট কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে, আর কোনো চিন্তা নেই, ডার্লিং! সব ঠিক হয়ে গেছে। তুমি এখন আমার কাছে
হঠাৎ লজ্জা পেল পিটার। উপলব্ধি করল, গাল বেয়ে ওটা ঘাম নয়, চোখের পানি নামছে। শেষ কবে কেঁদেছে ওর মনে পড়ল না। কবে কেঁদেছে, এখন কেন কাঁদছে, এসব কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখন যখন ওর আদরের মেয়ে তার বুকের মাঝখানে ফিরে এসেছে।
.
লন্ডনে মেলিসাকে দেখতে এল সিনথিয়া। ওর গলায় অনুযোগ, তোমার সাথের লোকেদের কেন এত ভুগতে হয়–পিটার? মেলিসাও বাদ গেল না!
কিছু না বলাই সঙ্গত মনে হলো পিটারের। এই দুই বছরে একদম লাবণ্য হারিয়ে ফেলেছে সিনথিয়া; কখনো মনে হয় না ওর মধ্যে প্রাণশক্তি ছিল। মেয়ের বিছানার পাশে বসে সারাক্ষণ অনুযোগ করে গেল সে।
অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়েছে মেলিসাকে, সুফল ফলতে দেরি হলো না। তিন দিন পর ডাক্তার জানাল, বিপদ কেটে গেছে। প্রতিদিন নতুন করে ব্যান্ডেজ বাধা হলো আঙুলে, হাতটা ঝুলে থাকল গলার সাথে মিঙে। দুঘণ্টা পর পর জোরজার করে কিছু না কিছু খাওয়াচ্ছে সিনথিয়া, ধীরে ধীরে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠছে। মেলিসা।
মা, আমার খুব ভয় লাগে। আমি কি ক-দিনের জন্যে বাবার সাথে যেতে পারি?
অনেক অনুরোধের পর ভারাক্রান্ত মনে রাজি হলো সিনথিয়া। নিজেকে অপরাধি মনে হতে লাগলো পিটারের। মেলিসার আরোগ্য লাভের আগপর্যন্ত অ্যাবটস ইউ-তে, নিজের এস্টেটে ওকে থাকার জন্যে বলেছেন চাচা স্যার স্টিভেন।
সব সময় মনে হতো–তুমি আসবে। এর বেশি কিছু মনে নেই। সবকিছু কেমন ধোয়াটে। মনে করতে পারি না। দুই একটা মুখ, ধীর সময়–এই, জানায় মেলিসা।
তোমাকে ওরা যে ওষুধটা দিয়েছিল, ওটার প্রভাবে অমন হচ্ছিল। পিটার বলে।
তা জানি। সুঁইয়ের খোঁচা টের পেয়েছি। কিন্তু তাও, অন্ধকারে শুয়ে ভাবতাম কখন আসবে তুমি।
ধীরে ধীরে ওর থেকে পুরো গল্পটা বের করে নিতে চায় পিটার।
একটা, লোকের দৃষ্টি ভয়ঙ্কর। ভীষণ খারাপ সে। অপরজনকে আমার ভালোই লাগত, ওর নাম ডাক্তার জেমসন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিটার ভাবল, ওই লোকটাই তোমার আঙুল কেটেছে, হয়তো সময় পেলে পুরো হাতটাই কাটত।
কিন্তু আরেকজনকে আমি দেখিনি।
আরেকজন? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চায় পিটার। দুজন ছিল ওখানে।
মৃদু হেসে মাথা নাড়ল মেলিসা, পিটারের সাথে দ্বিমত পোষণ করল। দুজন নয়, তিনজন ছিল, বলল সে। হ্যাঁ। কিন্তু তাকে আমি দেখিনি। তবে বুঝতে পারছিলাম, ওরা দুজনেই তাকে ভীষণ ভয় করে।
দেখনি, তো বুঝলে কিভাবে?
ওদের কথা শুনে বুঝলাম, বলল মেলিসা। মঝেমধ্যে ওষুধের প্রভাব কমে এলে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করতাম। ওরা দুজন তর্ক করত, অপর লোকটা কি করবে না করবে…
নাম কি তার?
মনে পড়ছে না! স্মরণ করার চেষ্টা করল মেলিসা। আসলে ঘুমের ঘোরে কি শুনেছি মনে নেই। ক্যাসপার বা ওরকম কিছু একটা হবে।
ক্যাসপার?
উঁহু, না। ধ্যেৎ, মনে করতে পারছি না। হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মেলিসার চেহারা। পেয়েছি! হ্যাঁ, কোনো সন্দেহ নেই–খলিফা!
এর কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে গেল মেলিসা। যেন ওই একটা নাম উচ্চারণ করে সমস্ত ভার নামিয়ে দিয়েছে বুক থেকে। ভয়ঙ্কর ক্রোধে গনগন, পিটার ঠায় বসে রইল মেয়ের মাথা কোলে নিয়ে।
.
অ্যাবোটস ইউ থেকে দুবার ফোন করল পিটার ব্যারনেস ম্যাগডাকে, দুবারই তার ব্যক্তিগত নম্বরে, কিন্তু তাকে পাওয়া গেল না। কেউ তার কোনো খোঁজ দিতে পারল না, পিটারের জন্যে কোনো মেসেজও রেখে যায়নি সে। ডেল্টা কন্ডিশনে মেলিসাকে উদ্ধার করার পর পাঁচ দিন পেরিয়ে যাচ্ছে, ব্যারনেস ম্যাগডার কোনো হদিস নেই।
এর আগে ডক্টর কিংস্টোন পার্কার একবার দেখে গেছেন মেলিসাকে, তার রাশভারি ব্যক্তিত্ব আবার একবার মুগ্ধ করেছে পিটারকে। স্টিভেন সম্পর্কে পিটার আর কলিনের কাছ থেকে আগেই কিছু কিছু জেনেছিলেন ডক্টর পার্কার, বাড়িতে এসে তার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করা থেকে বোঝা গেল স্টিভেনকে তার পছন্দ হয়েছে। সুযোগ পেয়ে ডক্টর পার্কারের মতো তাত্ত্বিককে নিজের ধ্যানধারণার খানিকটা আভাস দিতে ভুল করেনি স্যার স্টিভেন স্ট্রাইড। ডক্টর পার্কার শুনে চমৎকৃত হলেন যে পুজিবাদের সমর্থক হয়েও পিটারের ভাই মানবকল্যাণে সাধ্য মতো অবদান রাখতে আগ্রহী। স্টিভেন তাকে আরো বলল, পশ্চিমী দুনিয়ার নিরস্ত্রীকরণে বিশ্বাসী নয় সে, কারণ প্রতিপক্ষরা নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি মেনে চলছে কিনা পরীক্ষা করে দেখার নিচ্ছিদ্র কোনো উপায় আসলে নেই। তার সাথে একমত হয়ে ডক্টর পার্কার যোগ করলেন, যেহেতু শ্বেতাঙ্গরাই সব দিক থেকে এগিয়ে আছে তাই তাদেরকেই বাকি দুনিয়ার কল্যাণ সাধনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে যেতে হবে, তবে আরো অনেক দ্রুতগতিতে এবং দক্ষতার সাথে। বি-১ বোমারু বিমান আর নিউট্রন বোমার আশঙ্কা নিয়ে আলোচনা করলেন দুজন।
এমনকি মেলিসা পর্যন্ত পছন্দ করে ফেলল পার্কারকে। ডিনার শেষ হতে পিটার এবং তিনি–দুজনে মিলে লম্বা টেবিলে বসে আলাপে মগ্ন হলো।
পাঁচ দিন হলো ইংল্যান্ডে রয়েছি। বেশিরভাগ সময় হোয়াইট হলে কেটেছে আমার।
পিটার জানে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টারের সাথে কথা বলেছেন ডক্টর পার্কার, সম্ভবত দুয়েক বার।
শুধু যে অ্যাটলাস সম্পর্কে কথা হয়েছে তা নয়, আরো অনেক বিষয়ে আলাপ করেছি। তবে অ্যাটলাস সম্পর্কে বেশি কথা হয়েছে। তুমি জানো, আটলান্টিকের অদূরেই আমাদের বিরোধিতা করা হচ্ছে। তাদের যুক্তি ফেলে দেয়ার মতো তা আমি বলি না। আমাদের অর্গানাইজেশন বা অ্যাটলাস এককভাবে অন্য যে কোনো সংগঠনের চেয়ে বেশি ক্ষমতা ভোগ করছে-আমাদের সামরিক শক্তিও তুলনাহীন। ওরা বলছে, একজন বা মাত্র কয়েকজন এলিট লোকের হাতে এত ক্ষমতা থাকা মানে একটা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করা। যা তুমি ধ্বংস করতে চাও এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তার চেয়েও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। তুমি কি বল, পিটার?
নির্ভর করছে যিনি সংগঠনটা নিয়ন্ত্রণ করছেন তাঁর ওপর, ডক্টর পার্কার। আমার ধারণা, যোগ্য এবং সঠিক ব্যক্তির ওপরই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
ধন্যবাদ, পিটার। অ্যাটলাস বিস্ময়কর কিছু সাফল্য অর্জন করেছে জোহানেসবার্গে, তারপর এবার আয়ারল্যান্ডে। কিন্তু তার ফলে সংগঠনটা আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। লোকে এখন জানে, আমরা যদি আরো বেশি ক্ষমতা চাই, দ্বিধা না করে তা বরাদ্দ করা হবে। আর মুশকিল কি জানো, সত্যি যদি আমরা কাজ করতে চাই, আরো বেশি ক্ষমতা আমাদের দরকারও বটে। এই ব্যাপারটা নিয়ে বড়ই দুর্ভাবনায় আছি আমি…।
কাজ বলতো, অশুভ কোনো শক্তিকে ধ্বংস করা। ঠিক, তার সাথে পাল্লা দিতে হলে আরো ক্ষমতা আমাদের দরকার।
কিন্তু ভেবে দেখেছ কি, খুব বেশি ক্ষমতা পেলে আমরা সেটাকে ব্যবহার করব কিভাবে? কিভাবে বুঝব ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে না? ঠিক কখন আইনের শাসনকে শক্তির শাসন ছাড়িয়ে যাচ্ছে তা বোঝা উপায় কি?
বর্তমান দুনিয়ায় আইনের শাসন অনেক ক্ষেত্রেই অকেজো হয়ে গেছে, কারণ কিছু লোক প্রায় অজেয় শক্তির অধিকারী হয়ে উঠেছে, আইনের প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। সে-সব লোককে চিহ্নিত করা এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। তাদেরকে সামলাতে হলে শক্তি দিয়েই সামলাতে হবে।
আরেকটা ধারণার কথা বলি, পিটার। বহু বছর ধরে বিষয়টা নিয়ে ভাবছি আমি। মানুষের ওপর যদি অন্যায় আইনের শাসন চাপিয়ে দেয়া হয়? কেউ যদি নির্যাতনের আইন চালু করে? একজন লোক কালো রঙ নিয়ে জনেছে বা সে তার স্রষ্টাকে অন্য নামে ডাকে বলে কেউ যদি তাকে নিকৃষ্ট ভেবে শাসন ও শোষণ করার চেষ্টা করে? জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত একটা পার্লামেন্ট যদি বর্ণ-বৈষম্যের পক্ষে আইন পাস করে, কিংবা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ যদি ঘোষণা করে যে, ইহুদি ধর্ম আসলে সাম্রাজ্যবাদেরই অন্য এক রূপ, তাহলে?
ধরো যদি মুষ্টিমেয় কিছু লোক দুনিয়ার তাবৎ সম্পদের মালিক বনে যায় বা সে সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে এবং তাদের তৈরি আইনের দ্বারা যদি ব্যক্তিগত উচ্চাশা বা লোভ চরিতার্থ করার চেষ্টা করে, তখন? আরো পরিষ্কার করে বলি-ওপেক কমিটি যদি সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের হাতে তেল আছে, তেলটাই অস্ত্র এবং এই অস্ত্র দিয়েই তারা মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, তখন? ওপেকের, বা শাহ বা সৌদি আরবের রাজা এ ধরনের চিন্তা করা অসম্ভব কিছু নয়। অসহায় একটি ভঙ্গি করে হাত নাড়লেন ডক্টর পার্কার। তখন কি আমরা তাদের তৈরি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাব? যদি বুঝি ওদের তৈরি আইনগুলো অন্যায় আইন, তাহলেও?
তার মানে, এককভাবে কোনো সংগঠন যত ক্ষমতা রাখে তার চেয়ে বেশি ক্ষমতা পেতে হবে আমাদের, তাই না?
ডক্টর পার্কার একটু হাসলেন, সোফা ছেড়ে পিটারের সামনে পায়চারি শুরু করলেন তিনি। অ্যাটলাসের জন্যে আরো ক্ষমতা চেয়েছি আমি, আশা করছি পেয়ে যাব। ক্ষমতা না বলে এটাকে আসলে সুযোগ বলা উচিত। অনেক রকম সুযোগ দেয়া হবে আমাদের, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের আমরা ক্ষমতাবান এবং দুর্জয় করে তুলতে পারি। কিন্তু সেজন্যে যোগ্য অন্যায় আইন কোনোটা নয়। যারা বুঝবে কেন, কিসের বিরুদ্ধে লড়ছে তারা। পিটারের সামনে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে একটা হাত রাখলেন তিনি।
মুখ তুলে তাকাল পিটার।
তুমি তেমন একজন মানুষ, পিটার। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। পিটারের কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে সিধে হলেন ডক্টর পার্কার, তার চেহারা বদলে নির্লিপ্ত হয়ে গেল। ব্যবস্থা করেছি, কাল কলিনের সাথে আমাদের দেখা হবে। আইরিশ অপারেশনের গোটা ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখছে সে। তার রিপোর্ট পাবার পর বিষয়টা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারব। থোর কমান্ডে, বেলা দুটোয়, ঠিক আছে?
জ্বী।
তাহলে এসো মেজবান ভদ্রলোককে একটু সঙ্গ দিই এবার…, দরজার দিকে এগোলেন ডক্টর পার্কার।
ডক্টর পার্কার, এক মিনিট, তাকে থামিয়ে দিল পিটার। আপনাকে একটা কথা বলার আছে আমার। সব শোনার পর আমার সম্পর্কে আপনার এখনকার ধারণা পাল্টেও যেতে পারে।
ইয়েস?
দরজার দিকে পিছন ফিরে পিটারের দিকে তাকালেন ডক্টর পার্কার।
আপনি জানেন, মেলিসাকে যারা কিডন্যাপ করেছিল তারা মুক্তিপণ চায়নি, বা কারও সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি।
হ্যাঁ, এবং ব্যাপারটা এখনো আমার কাছে একটা রহস্য হয়ে আছে।
কথাটা সত্যি নয়। ওরা যোগাযোগ করেছিল।
তোমার কথা বুঝলাম না। চিন্তার ভাঁজ পড়ল ডক্টর পার্কারের কপালে, তীক্ষ্ণ চোখে পিটারের দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি, পিটারের মুখে কি যেন খুঁজছেন।
কিডন্যাপাররা আসলে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। চিঠিটা আমি পুড়িয়ে ফেলি।
কেন? ডক্টর পার্কারের কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল।
বলছি। মেলিসাকে ছাড়ার ব্যাপারে একটা মাত্র শর্ত দিয়েছিল ওরা, শর্তটা দু সপ্তাহর মধ্যে পূরণ করতে হবে। তা না হলে ওরা মেলিসাকে মেরে ফেলবে। প্রথমে আঙুল কেটে পাঠায়, তারপর হাত কাটবে, তারপর পা এবং সবশেষে মাথা পাঠাবে বলে জানায়।
কি স্পর্ধা? বিড়বিড় করে বললেন ডক্টর পার্কার। কি অমানবিক! শর্তটা কি ছিল?।
জীবনের বদলে জীবন, বলল পিটার। মেলিসাকে ফেরত পেতে হলে আপনাকে আমার খুন করতে হবে।
আমাকে? চমকে উঠলেন ডক্টর পার্কার, বিস্ময়ের ধাক্কায় তার মাথা পিছন দিকে ঝাঁকি খেল। ওরা আমাকে চেয়েছিল?
উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে থাকল পিটার। ডক্টর পার্কারও তাকিয়ে থাকলেন। তারপর নড়ে উঠলেন তিনি, আঙুল চালালেন মাথার চুলে।
গোটা ব্যাপারটা তাহলে বদলে গেল। সব কিছু সাবধানে, নতুন করে ভেবে দেখতে হবে আমাকে। মাথা নাড়লেন ডক্টর পার্কার। আমাকে? অ্যাটলাসের প্রেসিডেন্টকে? কেন? অ্যাটলাসে এককভাবে আমি সবচেয়ে বেশি ক্ষমতার অধিকারী, তাই? উঁহু, তা নয়।
তাহলে? জিজ্ঞেস করল পিটার।
সম্ভাব্য মাত্র একটাই ব্যাখ্যা আছে। মনে আছে, তোমাকে আমি বলেছিলাম নির্দিষ্ট একটা কেন্দ্র বা সেন্টার থেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চলছে, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদকে? কেউ একজন প্রচণ্ড ক্ষমতা নিয়ে মাথা চাড়া দিচ্ছে, পিটার। জ্ঞাত অজ্ঞাত সমস্ত টেরোরিস্ট গ্রুপগুলোকে এক করছে সে, একজন পাপপটমাস্টার। তোমাকে তাহলে বলেই ফেলি, পিটার-এই লোকটাকে খুঁজছি আমি। তোমার সাথে শেষবার দেখা হবার পর তার সম্পর্কে আরো অনেক খবর পেয়েছি আমি–তার অস্তিত্ব সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ নেই।
অ্যাটলাসের জন্যে আরো ক্ষমতা সেজন্যেই চেয়েছি আমি, লোকটা বাড়তে বাড়তে নাগালের বাইরে চলে যাবার আগে তাকে আমি ধ্বংস করতে চাই। একটু থেমে কি যেন ভাবলেন। তারপর আবার বললেন, আমি যেমন তার সম্পর্কে সচেতন, এখন জানা গেল সেও আমার সম্পর্কে সচেতন। আমি যে তার বিরুদ্ধে লাগতে যাচ্ছি, সে জানে। তোমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার ভান করে আমি যখন তোমাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করলাম, ভেবেছিলাম শত্রু তোমার সাথে যোগাযোগ করবে। কিন্তু, গড নোজ, যোগাযোগটা এ ধরনের হবে তা আমি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করিনি।
নিভে যাওয়া পাইপে আগুন ধরালেন তিনি। আবার পায়চারি শুরু করলেন। অবিশ্বাস্য! যাকে আমি ভুলেও সন্দেহ করতাম না–তুমি। ওহ পিটার, যে কোনো সময় অনায়াসে আমার কাছে পৌঁছুতে পারো তুমি। আর হয়তো দুই কি তিনজন এই সুযোগ ভোগ করে। এবং দেখ, লিভার হিসেবে কি ব্যবহার করেছে ওরা! তোমার আদরের মেয়ে! ওহ্ গড়, শত্রুকে আমি ছোট করে দেখেছি!
আপনি কি কখনো খলিফা নামটা শুনেছেন? জিজ্ঞেস করল পিটার।
কর্কশ কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করলেন ডক্টর পার্কার, তুমি কোত্থেকে শুনলে?
চিঠিটায় সই ছিল, জিলি ও’ শওনেসি আর ডাক্তারের মুখে মেলিসাও নামটা শুনেছে।
খলিফা। মাথা ঝাঁকালেন ডক্টর পার্কার। হ্যাঁ, নামটা আমি শুনেছি, পিটার। তোমার সাথে শেষবার দেখা হবার পর। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ পাইপ টানলেন তিনি, তারপর মুখ তুললেন। কাল থোরে দেখা হলে কিভাবে, কখন, সব তোমাকে বলব। আজকের মতো যথেষ্ট হয়েছে, তাই না? অন্তত আমার রাতের ঘুম হারাম করার জন্যে যথেষ্ট। বিরাট একটা ফাড়া কাটল মনে হচ্ছে!
দরজার কাছে পৌঁছে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন ডক্টর পার্কার। পিটার, কাজটা কি তুমি করতে? শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে উত্তর দিল পিটার, করতাম, ডক্টর পার্কার।
যদি করতে, কিভাবে করতে পিটার?
এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করতাম।
বিষের চেয়ে ভালো, ঘোঁৎ করে বললেন ডক্টর পার্কার। তবে পিস্তলের চেয়ে খারাপ। পরমুহূর্তে রেগে গেলেন তিনি। লোকটাকে আমাদের থামাতে হবে, পিটার! এ এমন একটা দায়িত্ব যেটাকে সবকিছুর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
এইমাত্র আমি যা বললাম, তাতে আমাদের সম্পর্ক কি আগের মতো থাকছে? জানতে চাইল পিটার। আমি আপনাকে খুন করতে পারতাম, এটা জানার পর আপনি কি আমাকে আগের মতো বিশ্বাস করতে পারবেন?
মজার কথা কি জানো, তোমার সম্পর্কে আমার যে ধারণা, এই ঘটনা থেকে সেটা আরো দৃঢ় হলো। আমাদের যেমন দৃঢ়, নির্দয় লোক দরকার তুমি ঠিক তাই। সভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে তোমার মতো লোক ছাড়া আমার চলবে না। ক্ষীণ একটু হাসলেন তিনি। কথাটা ভেবে আজ রাতে আমি হয়তো ঘেমে গোসল হব বিছানায় কিন্তু বিশ্বাস কর, তোমার আমার কাজ বা দায়িত্ব তাতে বদলাবে না।
.