৪. অনেক অসম্ভবই সম্ভব হয়

জগতে অনেক অসম্ভবই সম্ভব হয়। নিতান্ত কল্পিত গল্পের মত ঘটনাও সত্যসত্যই ঘটিতে দেখা যায় মাঝে মাঝে। দৈবাৎ হইলেও হয়। সেই দৈবাতের ব্যাপার আজ ঘটিতে দেখা গেল হেমপ্রভার জীবনে।

স্পষ্ট করিয়াই বলি। নানা চিন্তার ঘাত-প্রতিঘাতে দিশাহারা হেমপ্রভা যখন স্নানান্তে মালাজপের’ ছুতায় বসিয়া ইতিকর্তব্য চিন্তা করিতেছিলেন, তখন হঠাৎ একটি ভদ্রমহিলা সামনে। আসিয়া সোজাসুজি প্রশ্ন করেন–একটা কথা বলব শুনবেন? কিছু মনে না করেন তো সাহস করে বলি!

বিস্মিতা হেমপ্রভা তাকাইয়া দেখেন–বার্ধক্যের ক্ষীণদৃষ্টি এবং সোজাসুজি রৌদ্রের ঝলসানি, দুটায় মিলিয়া চোখটা কেমন ধাঁধাইয়া দেয়। চিনিতে পারেন না মানুষটা কে?

ভদ্রমহিলা আবার বলেন–মনে হচ্ছে ভুল করিনি, তবু সন্দেহ ভঞ্জন করতে শুধোচ্ছি, কাশীতে আপনি কতদিন আছেন মা?

হেমপ্রভা গম্ভীরভাবে বলেন–তা অনেকদিন। কেন বল তো জানতে চাইছ?

–চাইছি আমার বিশেষ দরকারে মা। আচ্ছা আপনার দেশ কোথায়?

কৌতূহলী হেমপ্রভা এবার ঝোলামাল লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলেন–ঘাট ছেড়ে ছায়ার দিকে চলল তো বাছা, দেখি তুমি কে?

দুইজনেই ছায়ার দিকে সরিয়া যান। ভদ্রমহিলা এবারে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলেন নিজের পরিচয় দেবার মতন না হলেও দেব বৈকি মা, তবু আমার প্রশ্নের উত্তরটা আগে দিন।

হেমপ্রভা অতি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে অপরিচিতার আপাদমস্তক দেখিয়া লইয়া সংক্ষেপে বলেন–দেশ আমার বর্ধমান জেলায়।

–গ্রামের নাম? সাগ্রহ স্বর ধ্বনিত হয় ভদ্রমহিলার কণ্ঠে।

–কুসুমপুর। কেন বল তো? চিনতে তো পারছি না কই!

–আমি কিন্তু ঠিক চিনেছি মা। বিশ্বনাথ মুখ রেখেছেন মনে হচ্ছে। পরিচয় দিলে চিনবেন নিশ্চয়ই। আমি স্বর্গীয় কান্তি মুখুজ্জে মশায়ের ভাগ্নী, বুলুর পিসিমা। চেনেন তো কান্তি মুখুজ্জেকে?

‘চিনি না আবার’! একথা বলিতে ইচ্ছা হইলেও রসনায় যেন শব্দ যোগায় না হেমপ্রভার। এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হইয়া যান তিনি। সত্যই কি তবে ভগবান প্রত্যক্ষ আছেন? এই ঘোর কলিতেও? অন্তরের যথার্থ ব্যাকুলতা লইয়া যা কিছু প্রার্থনা করা যায়, হাতে তুলিয়া দেন তিনি? নাকি হেমপ্রভাকে ছলনা করিতে, ব্যঙ্গ করিতে বুলুর পিসির ছদ্মবেশ ধরিয়া সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন? এখনই আবার মিলাইয়া যাইবে এই মায়ামূর্তি?

বাকশক্তিকে ফিরাইয়া আনিয়া হেমপ্রভা যা বলেন, তাতে কিন্তু অন্তরের এই উচ্ছ্বসিত ব্যাকুলতা ধরা পড়ে না, নিস্পৃহ স্বরে বলেন-আমাকে তো চিনেছ, বলল দিকি কি সূত্রে আমার সঙ্গে পরিচয়?

রাজলক্ষ্মীর হেমপ্রভার মত আপন হৃদয়যন্ত্রের উপর এত নিয়ন্ত্রণ নাই, তাই অর্ধরুদ্ধ উচ্ছ্বসিত স্বরে বলেন–সেকথা আর জিজ্ঞেস করে লজ্জা দেবেন না মা। আপনার কাছে মস্ত অপরাধী আমরা। তবু বলি দশচক্রে ভগবান ভূত। অনেকবার অনেক মিনতি করে লোক পাঠিয়ে পাঠিয়ে হতাশ হয়ে তবেই না চুপ করে গিয়েছি মা! ঘরের লক্ষ্মী ঘরে না এলে কি ঘর মানায়? তা আমারই হতভাগ্যির দোষ, কোনো সাধই মিটল না!

হেমপ্রভা যে কলিকাতার কোন খবরই প্রায় রাখেন না, সেই হইতে নির্বাসিত জীবনযাপন করিতেছেন, সে ধারণা নাই রাজলক্ষ্মীর, থাকিবার কথাও নয়।

–ভাগ্যের দোষ বৈকি বাছা, বিধাতার বিধান রদ করবে কে! তা ভাইপোর আবার বিয়ে দিলে কোথায়? আপন মান বাঁচাইতে হেমপ্রভা এইরকম বাঁকা পথে প্রশ্নটা করেন।

‘আবার বিবাহ দাও নাই তো’–প্রশ্নটা বড় অপমানকর। দিলে কোথায়–এ যেন একটা নিশ্চিত ঘটনা সম্বন্ধে বাহুল্য প্রশ্ন। যেন বিবাহটা অতি সাধারণ একটা সংবাদ মাত্র। যেন ইহার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করিতেছে না হেমপ্রভার।যেন উত্তরের অপেক্ষায় রুদ্ধশ্বাস বক্ষে ইষ্টনাম জপ করিবার দরকার হয় না। যেন রাজলক্ষ্মীর ভাইপোর সম্বন্ধে বিশেষ কিছু মাথাব্যথা নাই হেমপ্রভার।

এ প্রশ্নটার পরেই দেশের ধানচালের ফলন অথবা মাছ-দুধের মূল্যবৃদ্ধি সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে কিছুমাত্র বিকার দেখা যাইবে না বোধ হয়।

রাজলক্ষ্মী এ চাল জানেন না। এইভাবে উৎকণ্ঠাকে দাবাইয়া নিস্পৃহতার ভান করার ‘চাল। তাই হেমপ্রভার প্রশ্নে তিনি যেন মনের আনন্দ চাপিয়া রাখিতে পারেন না। নিজেদের মহত্ত্বের পরিচয় দিবার এত বড় সুবর্ণ সুযোগ–এ কি কম কথা!

যে নিদারুণ ঘটনার জন্যই মনের দুঃখে দেশত্যাগী হইয়াছেন রাজলক্ষ্মী, পোড়ারমুখো বিধাতাকে কমপক্ষে লক্ষবার গালাগাল করিয়াছেন, সেই ঘটনাটাই এখন দেবতার আশীর্বাদ বলিয়া মনে হয়।

অতএব উচ্চাঙ্গের হাসি হাসিয়া অনায়াসেই বলিতে পারেন তিনি বিয়ে! না মা, আমার ভাইপো তেমন ছেলে নয়। মামা যা করে গেছেন, তার ওপর কলম চালানো- সে হতে পারে না। প্রায় পাকিয়া ওঠা বিবাহ’ ফলটি যে হঠাৎ রাজলক্ষ্মীর অজ্ঞাত কারণে পাকিবার পরিবর্তে খসিয়া গিয়াছে, সেটা আর প্রকাশ করেন না।

হেমপ্রভার হাতের মালা দ্রুত ঘুরিতে থাকে। গুরুদেব, মুখ রাখিয়াছ তবে! তাপসীর কাছে নূতন করিয়া অপদস্থ হইবার মত কিছুই ঘটে নাই দেখা যাইতেছে! এখন শুধু স্বভাব-চরিত্র বিদ্যা বুদ্ধি সম্বন্ধে সন্ধান নেওয়া–আছেই বা কোথায় কোনে? তবু প্রায় অবহেলাভরে বলেন–কি করছে এখন ভাইপো?

–বুলু? তা আপনার আশীর্বাদে মানুষের মতন মানুষ একটা হয়েছে। বড় দুঃখু যে মামা কিছুই দেখতে পেলেন না। কত সাধ ছিল তার, তা সে সাধ মিটত। বুলু আমার এখানে দুটো পাস করে জলপানি পেয়ে বিলেত চলে গিয়েছিল। সেখানেও কি সব ভাল ভাল পাস-টাস করে একেবারে চাকরি পেয়ে এসেছে। আটশো টাকা মাইনে। পরে আরো অনেক হবে। চাকরির নামটা বলতে পারলাম না বাপু, খুব ভাল চাকরি।

হেমপ্রভা হাসিয়া ফেলিয়া বলেন–আমার চাইতে তো ঢের ছোট তুমি, অমন সেকেলে বুড়ীর মত কথা কেন গা বাছা? তা যাক, বিলেত ঘুরে এসে মেজাজটি আছে কেমন–মেম চায় না তো?

রাজলক্ষ্মী জিভ কাটেন। অমন কথা বলবেন না। বুলু কি সেই ছেলে? এখনো বাড়ী গেলেই আমার রান্নাঘরের দোরে খুরসি পিঁড়িতে বসে নারকোলনাড়, ক্ষীরের ছাঁচ চেয়ে খায়, রাইবল্লভের আরতির সময়ে গরদের ধুতি পরে চামর পাখা ঢোলায়। বললে হয়তো ভাববেন বাড়িয়ে বলছি–তবু বলব হাজারে একটা অমন ছেলে মেলে না। আপনার ছেলে ইচ্ছে করে অবহেলা করলেন, এখন দেখলে বলবেন–

হেমপ্রভা বাধা দিয়া উদাসস্বরে বললেন–আমার ছেলে। সে দেখছে বৈকি, সেখানে বসে সবই দেখতে পাচ্ছে! হয়তো এতদিনে তার অপরাধী মাকে ক্ষমাও করেছে!

রাজলক্ষ্মী থতমত খাইয়া বলেন–কেন? তিনি কি—

হেমপ্রভা মাথা নাড়েন, এক যুগ হয়ে গেল। কেউ কারোর কোন খবরই তো রাখি না। আজ বিশ্বনাথ হঠাৎ তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন তাই। দেখি তার কি ইচ্ছে!

মান খোয়াইয়া বলেন না–এইবার তবে তোমাদের বৌ লইয়া যাও তোমরা। শুধু কথা ফেলিয়া রাজলক্ষ্মীর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেন।

রাজলক্ষ্মী হাঁ হাঁ করিয়া ওঠেন–আর কি বিশ্বনাথের ইচ্ছে বুঝতে ভুল করি! এবার আর কোনো বাধা শুনব না, আমার বুলুর হাতে পড়লে কোনো মেয়ে অসুখী হবে না এই ভরসাতেই জোর করে বলছি।

হেমপ্রভা মালাগাছটি কপালে ঠেকাইয়া মৃদু হাসির সঙ্গে বলেন–আমার নাতনী তো তার যুগ্যি নাও হতে পারে বাছা। কিছুই তো জানো না তুমি।

রাজলক্ষ্মী হাসিয়া ওঠেন, যেন ভারি একটা রহস্য করিয়াছেন হেমপ্রভা।

অতঃপর অনেক জ্ঞাতব্য এবং অজ্ঞাতব্য বিষয়ের আলোচনা হয়, শুধু তাপসী যে কাশীতেই হেমপ্রভার নিকট রহিয়াছে, সেটুকু সুকৌশলে চাপিয়া যান হেমপ্রভা। কেবল বলেন–চলো না, আমার বাড়ী এই তো কাছে। এবেলা আমার কাছেই দুটো দানাপানির ব্যবস্থা হোক।

রাজলক্ষ্মী সামান্য অনুরোধেই রাজী হইয়া যান। হেমপ্রভার সঙ্গে সম্বন্ধ বজায় রাখার গরজ যেন তাহারই বেশী। ‘দানাপানি’ ব্যতীতও রাজলক্ষ্মীর জন্য যে ‘তৃষ্ণার জল’ তোলা রহিয়াছে হেমপ্রভার ঘরে, সেকথা কি স্বপ্নেও ভাবিয়াছিলেন রাজলক্ষ্মী?

.

নানির সঙ্গে একটি বিধবা ভদ্রমহিলাকে আসিতে দেখিয়া তাপসী নিজে হইতে তেমন গ্রাহ্য করে নাই। এমন তো মাঝে মাঝে আসে কেউ কেউ। ঘরের ভিতর হইতে বাহির হইবার বা অপরের সঙ্গে ভদ্রতা রক্ষা করিয়া কথা কহিবার ইচ্ছাও করে না। অজানিত ব্যক্তির সেই চিঠিখানার অজ্ঞাত বিষয়বস্তু সম্বন্ধে আকাশপাতাল কল্পনা করিতে করিতে ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে বেচারা।

স্বাভাবিক দৃষ্টি লইয়া ঘরে ঢুকিলে ছেঁড়া চিঠির কুচিগুলা হেমপ্রভার দৃষ্টি এড়াইত না নিশ্চয়ই, কিন্তু বিশেষ ব্যস্ততা লইয়া ঘরে ঢোকেন তিনি, তাই লক্ষ্য করেন না।

-তাপসী শোন, একজন এখানে খাবে আজ। হ্যাঁ, এ বেলাই। একটু আয় দিকি আমার সঙ্গে –কুটনোবাটনা করে দিবি।

তাপসী অবাক হইয়া বলে–আমি? আমার হাতে খাবে তোমরা?

–ওমা কথা শোনো মেয়ের! তোর হাতে খাবো কিরে? সর্বদা আ-কাঁচা কাপড়ে থাকিস–তাই ছুঁইছুঁই করি, হাতে খাব না কেন? হাড়িদের বৌ নাকি তুই? নে চল্ দিকি, সেই সিল্কের কাপড়টা পরে–

উচ্ছ্বসিত আনন্দের ভাবটা নাতনীর কাছে আর লুকাইতে পারেন না হেমপ্রভা।

তাপসী বিস্মিত দৃষ্টিতে একবার তাকাইয়া দেখিয়া বলে–কে এসেছে নানি, খুব যে খুশী দেখছি! তোমার কোনো বন্ধু না আত্মীয় কেউ?

–আত্মীয় বন্ধু সবই। ভগবান বুঝি মুখ রাখলেন। যাক, তুই আর দেরি করিসনে, আমি যাচ্ছি–ওমা, ঘরভর্তি এত কাগজ ছড়ালে কে? কি এ?

–চিঠি।

–চিঠি! ও, সেই চিঠিখানা বুঝি? ছিঁড়েছিস কেন? কার চিঠি ছিল?

–জানি না।

–জানি না কি কথা! দেখিস নি?

–না।

হেমপ্রভা একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া নাতনীর কাছে আগাইয়া আসেন। তাহার মাথার উপর একটা হাত রাখিয়া আর্দ্রস্বরে বলেন–আমি জানতাম তাপস, ছোট হবার মত কাজ তুই করবি না। আশীর্বাদ করছি তোর দুঃখের দিন এইবার শেষ হোক। আমার সঙ্গে যে এসেছে, বিশ্বনাথ তাকে আজ হাতে তুলে দিয়েছেন। বুলুর পিসি হয় ও–তোর পিসশাশুড়ী। চমকে উঠিসনি, কিচ্ছুটি বলতে হবে না তোকে, শুধু গিয়ে প্রণাম করবি। খাঁটি সোনা বুলু আমার, এখনও তোরই পথ চেয়ে বসে আছে, কোনো ভয় নেই!

.

তাপসী আসিয়া প্রণাম করিয়া দাঁড়াইতেই একেবারের জন্য চমকাইয়া উঠিয়াই যেন স্তব্ধ হইয়া যান রাজলক্ষ্মী।

এই তাপসী? বুলুর বৌ? স্বপ্নের কল্পনাও হার মানে যে! এই বৌ হইতে বঞ্চিত হইয়া আছে বুল? বুলুর মত স্বামীকে লাভ করিয়া ধন্য হইতে পাইল না বলিয়া অপরিচিতা বধুর ভাগ্যেরই নিন্দা করিয়া আসিয়াছেন এতদিন! চিন্তার হাওয়াটা এবারে বিপরীতমুখী বহে।

উঃ, নির্দয়তার মধ্যেও কী অনন্ত দয়া ভগবানের! বুলুর সম্প্রতিকার বিবাহটা ফস্কাইয়া না গিয়া যদি সত্যই ঘটিয়া যাইত! কী সর্বনাশই হইত!!

এ বৌকে রাজলক্ষ্মী কোথায় রাখিবেন? বুকে না মাথায়? না, এবারে আর বোকামি করিবেন না বাবা, আঁচলে বাঁধিয়া লইয়া গিয়া তবে আর কাজ!!

হেমপ্রভার হাতে-পায়ে ধরিতে হয় তাও রাজী। দোষ কি? সম্পর্কে গুরুজন তো! মানের জন্য প্রাণ যাক–অত কুসংস্কার নাই রাজলক্ষ্মীর!

হেমপ্রভাকে অবশ্য হাতে-পায়ে ধরিতে হয় না, নিজেই তো হাত ধুইয়া বসিয়াছিলেন ভদ্রমহিলা। কাশীবাস’ করিবার সাধুসঙ্কল্প অবলীলাক্রমে বিসর্জন দিয়া রাজলক্ষ্মীও যেমন মহোৎসাহে দেশে ফেরার তোড়জোড় করেন, হেমপ্রভাও তেমনি আগ্রহেই দীর্ঘকালব্যাপী কাশীবাসে অভ্যস্ত জীবনকে আপাতত ত্যাগ করিয়া দেশে ফিরিবার ব্যবস্থা করিতে থাকেন।

মন জিনিসটা এমন, একবার ছুটিলে আর ধরিয়া রাখা শক্ত। চিরদিনের প্রিয় আবাসস্থল স্বামীর ভিটার ছবিখানি মনে ফুটিয়া ওঠা পর্যন্ত হেমপ্রভার আর এক ঘণ্টাও দেরি সহে না। কেবলমাত্র তাপসীর হিতার্থেই নয়, নিজের প্রীত্যর্থেও যাওয়ার ইচ্ছাটা এত প্রবল হয়।… হায়, কি মিথ্যা অভিমানেই তিনি সেই পুণ্যভূমিকে ত্যাগ করিয়া বসিয়া আছেন! এ অভিমানের মর্ম বুঝিল কে?…না, শেষ জীবনে একবার গিয়া এতদিনের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিয়া আসিবেন হেমপ্রভা।

.

অতএব ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’!

তাপসীর যাওয়া ছাড়া গতি কি? মান খোয়াইয়া মায়ের কাছে তো সত্যি ফিরিয়া যাওয়া যায় না–বিনা সাধ্য-সাধনায়–এমন কি বিনা আত্মানে!

অথচ চিত্রলেখার মনোভাব অনমনীয়।

তবে যাইবার গোছ করিতে করিতে এক সময় সে চুপি চুপি বলিয়া নেয়–দেখ নানি, দেশে গিয়ে আমি যে যার-তার বাড়ীতে থাকতে যাব, তা মনেও কোরো না, বুঝলে? তোমার বরের সেই যে একটা সেকেলে পুরনো ‘পেল্লায়’ বাড়ী আছে, তারই এককোণে থাকতে দিও!

হেমপ্রভা হাসিয়া ফেলিয়া বলেন–ইস্ তাই বৈকি! কেন, আমার বরের বাড়ী তোকে থাকতে দেব কেন রে? নিজের বরের বাড়ী সামলাগে যা! ·

–দরকার নেই নানি, বাজে জিনিস সামলে। নিজেকে সামলাতে পারলেই বাঁচি এখন আমি। পরিহাসচ্ছলে বলিলেও কথাটায় দুঃখময় সত্যের করুণ সুরটুকু ধরা পড়িয়া যায়। সত্যই তো–নিজেকে সামলানোই কি সোজা? এই দীর্ঘকাল যাবৎ নিজেকে সামলাইয়া চলিতে চলিতে যে কাহিল হইয়া গেল বেচারা!

.

ট্রেনে ‘ধকধক’ শব্দের সঙ্গে সুর মিলাইয়া তাপসীর হৃৎপিণ্ডটাও যেন ‘ধকধক করিতে থাকে। কি করিতে যাইতেছে সে? খেলাঘরের সেই বিবাহটাকে ঝালাইয়া লইয়া অপরিচিত বরের ঘর করিতে যাইতেছে–বিনা আমন্ত্রণে, বিনা আহ্বানে!

তাছাড়া কি? ভিতরে ভিতরে তেমনি একটা আকাঙ্ক্ষাই কি লুকাইয়া নাই?

কিন্তু রাজলক্ষ্মীর আমন্ত্রণটাই কি চরম? লুব্ধ ভিক্ষুকের মত সেইটুকু সুযোগ লইয়া কৃতার্থমুখে দাঁড়াইতে হইবে সেই উদাসীন–হয়তো বা আত্মম্ভরী লোকটার কাছে? শেষ পর্যন্ত তাহার একটু করুণা লাভ করিয়াই ধন্য থাকিতে হইবে হয়তো! কে বলিতে পারে তার কি মতিগতি? রাজলক্ষ্মীর কথাবার্তায় খুব বেশী আস্থা তাহার উপর রাখা চলে না! নেহাতই সাদামাটা বোকাসোকা মানুষ!

তবে? তাপসী এখন করিবে কি? সেই অজ্ঞাতস্বভাব লোকটার করুণার উপর জুলুম করিয়া, অথবা আইনের দাবি লইয়া নিজের ঠাঁই করিয়া লইতে হইবে তাহাকে? ফকির সেই সিংহাসনে বসিয়া থাকিবে দশের একজন সাজিয়া? গহনা কাপড়ের ঝিলিক মারিয়া চরিয়া বেড়াইবে সমাজের মাঠে? অস্বীকৃত সম্বন্ধের জের টানিয়া নির্লজ্জের মত ভিক্ষাপাত্র হাতে ধরিয়া কোন্ মুখে গিয়া দাঁড়াইবে তাপসী? বলিবে কি সে?

কি বলিবেন চিত্রলেখা? কি বলিবে ভাইয়েরা?

আত্মসম্মান-জ্ঞানটা ভারি টনটনে ছিল না তাপসীর।

আর–

আর একখানি মুখ? সেই কি একেবারে উড়াইয়া দেওয়া চলে? অজন্তার ছাঁদে গঠিত সেই ওষ্ঠাধরের ঈষৎ বাঁকা রেখায় যে বাঁকা হাসির ব্যঞ্জনা দেখা দিবে, তার তিক্ততা কল্পনাতেও সহ্য করিবার ক্ষমতা আছে কি তাপসীর?…ভাবিতে গেলেই বুকের ভেতরটা কেমন একটা যন্ত্রণায় মোচড় দিয়া ওঠে। কিরীটীর সঙ্গে সকল সম্বন্ধ ঘুচাইয়া ফেলিতে হইবে–এই কথাটা যতবারই মনে মনে উচ্চারণ করিতে চেষ্টা করে তাপসী, নিজেকে ভারি অসহায় লাগে!

বুলু কে? বুলুর সঙ্গে তাহার সম্বন্ধ কি? স্বামীত্বের দাবিতে বুলু আসিয়া অধিকার করিয়া লইবে তাহাকে?

‘স্বামী’ শব্দটার মোহই কি তবে বুদ্ধিবৃত্তিকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে তাপসীর? এই শব্দের মোহ আজ যে শক্তি যোগাইতেছে, সে কি চিরদিন যোগাইতে পারিবে? মোহ যখন মূর্তি ধরিয়া দেখা দিবে? মোহকে মনে মনে লালন করা এক, আর মূর্তিকে সহ্য করা আর। প্রায় জীবনব্যাপী সংগ্রাম সত্ত্বেও যে তাপসী হৃদয়ধর্মের কাছে পরাজিত হইয়াছে, একথা তো অস্বীকার করিয়া লাভ নাই! কিরীটীই যে আজ তাহার একান্ত প্রিয় প্রিয়তম, দূরে সরিয়া আসিয়া বড় স্পষ্ট হইয়াই ধরা পড়িয়া গিয়াছে সেইটা!

দুইটা বুড়ীর প্রভাবে পড়িয়া এ কোন্ পথে পা বাড়াইতে বসিয়াছে সে?

–ট্রেনের ধকলে বৌমার মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে, একটু জল খাও না মা! রাজলক্ষ্মী কাশী হইতে সংগৃহীত পেঁড়া ও চমচম বাহির করিতে বসেন।

ট্রেনে তৃষ্ণা তাহারও পায়, কিন্তু বিধবার অত ক্ষুধা-তৃষ্ণার ধার ধারিলে চলে না!

তাপসী প্রতিবাদের ভঙ্গিতে হেমপ্রভার দিকে তাকায়–ভাবটা যেন এত আত্মীয়তা বরদাস্ত হয় না বাপু!

হেমপ্রভা নাতনীকে চোখ টেপেন, অর্থাৎ করুক গে না বাপু, কি আর ফোস্কা পড়বে তোমার গায়ে?

রাজলক্ষ্মীর চোখে এসব ভাববিনিময় ধরা পড়ে না। তিনি সহ চিত্তে খাবার গুছাইতে গুছাইতে বলেন–বুলু আমার পেঁড়ার ভারি ভক্ত, বলে–চারটি বালি-ধুলো মিশানো হলেও জিনিসটা কিন্তু বেশ পিসিমা! নইলে এই তো বর্ধমানের সীতাভোগ মিহিদানা–ছোঁয়ও না!

বিরক্তি সত্ত্বেও হঠাৎ ভারি হাসি পায় তাপসীর। কারণে অকারণে বুলুর প্রসঙ্গের অবতারণা না করিলে যেন চলে না বুড়ীর! ওঁর বুলুর পছন্দ-অপছন্দ, রুচি-অরুচির সমস্ত তালিকা মুখস্থ করাইয়া যেন তৈরি করিয়া ফেলিতে চান তাপসীকে!

বুড়ী, তোমার আশায় ছাই!..আসলে কাহারও ঘর করিবার জন্য সৃষ্ট হয় নাই তাপসী। আপন হৃদয় লইয়া একপাশে পড়িয়া থাকাই তাহার বিধিলিপি। এতদিন স্বামী’ নামক যে দুরতিক্রম্য বাধাটাকে স্বীকার করিয়া লইয়া আপনাকে প্রিয়তমের কাছে নিঃশেষে সঁপিয়া দিবার। উদগ্র কামনাকে ঠেকাইয়া আসিয়াছে, সেই স্বামীর যখন সন্ধান মিলিল, দেখা যাইতেছে তাহার হাতে সঁপিয়া দিবার মত কিছুই আর অবশিষ্ট নাই। হয়তো বা নিজেরই অজ্ঞাতসারে বেনামী ডাকে নিলাম হইয়া গিয়াছে তাপসী।

.

আগে খবর দেওয়া ছিল।

স্টেশনে গাড়ী আসিয়াছিল–দু’পক্ষেরই।

নিজ নিজ আস্তানায় যাইবার প্রাক্কালে আবার একপালা সম্ভাষণশেষে রাজলক্ষ্মী তাপসীকে কোলের কাছে টানিয়া লইয়া যে কথাগুলি বলেন–তাহার সারার্থ এই, এই মুহূর্তেই তাপসীকে নিজের গাড়ীতে উঠাইয়া লইয়া পলাইবার দুর্দান্ত ইচ্ছাকে দমন করিয়া নিতান্তই শুকনো মুখে ফিরিতে হইতেছে তাহাকে, কারণ ঘরের লক্ষ্মীকে তো আর তেমন করিয়া লইয়া যাওয়া যায় না! শুভদিনে শুভলগ্নে বুল নিজে যাইয়া মাথায় করিয়া বহিয়া আনিবে! বুলুকে দেশে আসিবার আদেশ করিয়া চিঠি তিনি কাশী হইতেই পোস্ট করিয়া আসিয়াছেন, রহস্য কিছুই প্রকাশ করেন নাই, শুধু জানাইয়াছেন, বিশেষ কারণে কাশীবাসের সংকল্প ত্যাগ করিয়া ফিরিয়া আসিতে হইতেছে রাজলক্ষ্মীকে, বুলু যেন অবিলম্বে একবার আসে।

এমন ছেলে, চিঠি পাওয়া মাত্র মোটর গাড়ীতেই ছুটিয়া আসিবে ঠিক, আজকালই আসিয়া পড়িবে। অতঃপর সামনেই যে শুভদিন পাওয়া যাইবে–

–আহা, ভদ্রমহিলা ভাবছেন, ওঁর সেই সোনার চাঁদ ভাইপোটির আশায় পথ চেয়ে আছি আমি! গাড়ী ছাড়িবার পর মন্তব্যটি ব্যক্ত করে তাপসী।

যুগান্ত পরে দেশের মাটিতে পা দিয়া হেমপ্রভার উৎসুক দৃষ্টি যেন পথের দুপাশের মাঠঘাট গাছপালাগুলাকেও লেহন করিতেছিল। তাপসীর কথায় অন্যমনস্কভাবে বলেন– তবে কার আশায় আছিস?

–কারুর আশাতেই নয়। দেখো তোমার বরের সেই বিরাট অট্টালিকার গহ্বর থেকে কেউ টেনে. বার করতে পারবে না আমাকে।

হেমপ্রভা সচকিত হইয়া বলেন–এখন থেকে মেজাজ বদলাসনে তাপস, ঠাট্টার কথাই বলতে বলতে সত্যি হয়ে দাঁড়ায়। কথায় বলে–”হাসতে হাসতে কপাল ব্যথা”!

–তবে কি তুমি বলতে চাও নানি, “সেখো ভাত খাবি” বললেই হ্যাংলার মত ‘‘আঁচাবো কোথায়” বলে ছুটে যাব?

–কথার দশা দেখ! ছুটে তুই যাবি কেন–সেই-ই আসবে!

–সে রকম আসার মূল্য কি নানি? পিসির অঞ্চলনিধি সুবোধ বালক পিসির আদেশ পালন করতে আসবে

–তা গুরুজনের আদেশ পালন করা বুঝি খারাপ?

–খারাপ বলছি না নানি, তবু স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কিছু বদল হওয়া উচিত। কই, এতদিনের মধ্যে একবারও কি আমার জন্যে মাথাব্যথা হয়েছে ওর? আমিই না হয় নিরুপায়, ও তো নয় নানি। তবে আমি কেন–

হঠাৎ সমস্ত কৌতুকের ভাষা রুদ্ধ করিয়া ঝরঝর করিয়া জল ঝরিয়া পড়ে ডাগর কালো দুটি চোখের কোল বাহিয়া।

.

বাড়ী ঢুকিতেই নানা লোকের ভিড়ে, নানা কথায়, দীর্ঘ অনুপস্থিতির সুযোগে বাড়ীখানার দুর্দশার আলোচনায় হৃদয়-সমস্যা চাপা পড়িয়া যায়।

ঠাকুমা-নাতনী মহোৎসাহে গোছগাছে লাগিয়া যান। সারাদিনের গোলমালে কিছুই মনে থাকে না, মনে পড়ে রাত্রে বিছানায় যাইবার আগে।

হেমপ্রভা তখনও নীচের তলায়, সরকার মশায়ের সঙ্গে অনেক কথা অনেক আলোচনায় বিভোর। যেসব বিষয়-সম্পত্তি তাপসীর নামে দানপত্র করিয়া গিয়াছিলেন, কি তাহার ব্যবস্থা হইতেছে, আদায়পত্রের হিসাব ঠিক রাখা হয় কিনা, নাতিরা কখনও আসে কিনা, ইত্যাদি কত সহস্র প্রশ্ন।

দূরে সরিয়া গেলে মনে হয় যেন খুব ত্যাগ করিলাম, কাছে অসিলেই ধরা পড়ে–যথার্থ ত্যাগ করা কত কঠিন! চিরবিশ্বস্ত সাধুপ্রকৃতি সরকার মহাশয়কেও মাঝে মাঝে জেরা করিয়া বসিতেছেন।

তাপসীকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার জন্য সাধ্যসাধনা করা সত্ত্বেও সে ‘দায় পড়েছে। আমার, তোমার ওইসব কাগজপত্তর দেখলে গা জ্বলে যায় বাবা”–বলিয়া উপরে পলাইয়া আসিয়াছে।

পলাইয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছে বাগানের দিকের এই ছোট ছাদটায়।

সেকেলে বাড়ী। মাপিয়া জুপিয়া অঙ্ক কষিয়া করা নয়, অকৃপণ দাক্ষিণ্যে যেখানে সেখানে ছাদ, বারান্দা, চাতাল ইত্যাদি গাঁথিয়া রাখিয়া গিয়াছেন কর্তারা। বাগানের দিকের এই ছাদটি ভারি চমৎকার। আসিয়া দাঁড়াইতেই এলোমেলো বাতাসের সঙ্গে একটা দূরবিস্মৃত সুগন্ধভার যেন তাপসীর সর্বাঙ্গে আসিয়া আছাড় খায়।

কি এ-কোথায় ছিল এরা–এই চাপা মুচুকুন্দ মল্লিকার দল! যাহারা একদা তাপসীর ঘুমন্ত শিশুমনকে জাগাইয়া কৈশোরের সোনার দরজার চাবি দেখাইয়া দিয়াছিল!

সেই বৈশাখী রাত।… আশ্চর্য, তাপসীর বারো বছর বয়সের পর আর কি কোনোদিন বৈশাখ মাস আসে নাই! কত সময় তো কত জায়গায় ঘুরিয়াছে, কোথাও ফোটে নাই চাপা মুচুকুন্দ মল্লিকা!…মনে পড়িয়া গেল–ফুলের মালা পরার জন্য ছোট ভাইদের কাছে লাঞ্ছনা! আর আর সেইদিনই না–সেইদিনই তো বল্লভজীর মন্দিরে গিয়াছিল তাহারা!

এই পরিবেশ আর এই গন্ধসমারোহের দৌত্যে বড় বেশী স্পষ্ট করিয়া সব মনে পড়িয়া যাইতেছে। কই এতদিন তো এমন করিয়া চোখের উপর ভাসিয়া ওঠে নাই বল্লভজীর রৌদ্রালোকিত প্রাঙ্গণের মাঝখানে সেই ফুটন্ত কমলের মত বক্তাভ দুইখানি পায়ের পাতা, বেনারসীর জোড়ের আলোয় ঝলসানো আঁচলটার ঝকঝকানি, ঈষৎ কোঁকড়ানো রেশমী কালো চুলে ঘেরা উজ্জ্বল একখানি মুখ!…মুখ নয়–মুখের আভাস। মুখটা কিছুতেই মনে পড়ে না, স্মৃতির দরজায় মাথা কুটিয়া ফেলিলেও না।…সেই পায়ের নীচে নিজেকে বিকাইয়া দেওয়া, আজ কি এতই অসম্ভব! কে জানে হয়তো এই আবেষ্টনের মধ্যে নিজেকে আটকাইয়া রাখিলে খুব অসম্ভব নয়!

কোল্টা ধর্ম? কোন্টা ন্যায়?

মাথার উপর যে নক্ষত্রের দল নীচের মানুষের প্রতি অনুকম্পার দৃষ্টি মেলিয়া চাহিয়া আছে, তাহারা কি বলিয়া দিবে তাপসীর কর্তব্য কি?

অনেক রাত্রে হেমপ্রভা উপরে আসিয়া তাপসীকে ছাদে আবিষ্কার করিয়া অবাক হইয়া যান–এখনও ঘুমোসনি তুই? এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিস?

–ঘুম আসছে না নানি।

–হেমপ্রভা মনে মনে হাসিয়া ওঠেন। না আসাই তো উচিত! এই কি ঘুমের বয়স না ঘুমের রাত্রি! তবু তো মরুভূমির মত জীবন তাপসীর।

ছায়াচ্ছন্ন স্নিগ্নশীতল জীবনেও কি বিরহের রাত্রে ঘুম আসে চোখে? এই ছাদে এমনি শিথিল ভঙ্গীতে হেমপ্রভাও কি দাঁড়াইয়া থাকেন নাই কোনদিন? পরনে নীলাম্বরী-খোঁপায় ফুলের মালা-চোখে প্রতীক্ষার ক্লান্তি আর মুখে অভিমানভার। উৎকর্ণ হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন–ঘোড়ার খুরের শব্দের আশায় কান পাতিয়া। ঘোড়ায় চড়া ছিল ব্রজেন্দ্রর একমাত্র শখ।

মাথার উপরকার ওই নক্ষত্রের দল আজকের হেমপ্রভাকে দেখিয়া বিশ্বাস করিবে এ কথা-না একযোগে হাসিয়া উঠিবে!

কিন্তু থাক, আজকের সমস্যা হেমপ্রভার নয়–তাপসীর।

যার জীবনের কোন পরিচিত পদধ্বনি নাই।

.

–ঘুম সহজে আসবে না, নতুন জায়গা কিনা। চল্ শুয়ে শুয়ে গল্প করিগে। তোর মা’র আশা করি না, অভী সিধু যদি আসত তো বেশ হত! জীবনের পালা চোকাবার আগে একবার শেষ সাধ মিটিয়ে নিতাম!

হেমপ্রভার জীবনের পালা চুকিবার সময় হইয়াছে কিনা ভগবান জানেন, কিন্তু সাধ মিটাইবার দায়টা পোহাইবার ভার ভদ্রলোক স্বয়ং লইয়াছেন দেখা গেল।

পরদিনই দরজার গোড়ায় ছোটখাটো ঝকঝকে একখানি মোটরগাড়ী আসিয়া হাজির।

সরকার মশাই যে তোক পাঠাইয়া সংবাদ দিয়াছিলেন, সেকথা হেমপ্রভার জানা ছিল না। তিনি অবাক হইয়া যান।

অভী আসিয়াছে! সত্য না স্বপ্ন?

একা নয়–গাড়ীর মালিক এক বন্ধুকে লইয়া। ঠিক সমবয়সী বন্ধু নয়, তবে অসমবয়সী হইলেও মাঝে মাঝে বন্ধু হওয়া যায় বৈকি।

–নানি নানি, দেখছ তো তোমার টানে ছুটে এলাম।

–ওমা, আমার ভাগ্যি। গুরুদেব আমার মনের কথা কানে শুনেছেন। কে খবর দিলে? সরকার মশাই নিশ্চয়? একবার চাঁদমুখগুলি দেখবার জন্যে যে কি উতলা হচ্ছিলাম! সিধু আসেনি বুঝি?

–না, মা’র শরীর ভালো নয়, দু’জনে এলাম না। অবশ্য এক হিসেবে দু’জনেই এসেছি, সঙ্গে একটি বন্ধুলোক আছেন–বলতে পারি না তিনি আবার কার টানে এসেছেন! বলিয়া অমিতাভ দিদির দিকে একটা বাঁকা দৃষ্টি হানে–শ্লেষের নয়, কৌতুকের।

ধক করিয়া ওঠে তাপসীর বুকটা। কে আসিয়াছে সঙ্গে? তাই কি সম্ভব? না না, অমিতাভ যে দু’চক্ষের বিষ দেখে তাহাকে! নিজে সঙ্গে করিয়া আনিবে? পাল কি তাপসী? কিন্তু কে?

একেই তো বাড়ী ছাড়িয়া কাশী পালানোর লজ্জায় তাপসী ছোট ভাইটিকে দেখিয়া তেমন উচ্ছ্বসিত অভ্যর্থনায় ছুটিয়া আসিতে পারে নাই, প্রসন্নমুখে শুধু নানির পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল–এখন অভীর কথায় একেবারেই মূক হইয়া যায় বেচারা।

বেশীক্ষণ চিন্তা করিতে হয় না, অভী দু’এক কথার পরই ব্যস্তভাবে বলে–আরে, ভদ্রলোককে কি গাড়ীতেই বসিয়ে রাখা হবে! যাই ডেকে আনি–দিদি, মিস্টার মুখার্জি এসেছেন –বলিয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া যায়।

দিদি তো সেইখানেই জমিয়া হিম। যা আশঙ্কা তাই সত্য! কি সর্বনাশ! অভীটাই বা হঠাৎ এত বদলাইল কেমন করিয়া! কোন ধরনের ঘুষের দ্বারা অভীকে হাত করা যায়!

হেমপ্রভা সচকিত হইয়া বলেন কি বলে গেল অভী? কে এসেছে? সেই হতভাগাটা? আবার এখানেও ধাওয়া করেছে এসে? এ কি বেহায়া লোক গো! খবরদার, তুই সামনে বেরোবি না, বুঝলি?

তাপসীর কি বোধশক্তি আছে এখনও যে বুঝিবে! তাহার সমস্ত স্নায়ুশিরায় অণুপরমাণুতে যে ধ্বনিত হইতেছে শুধু একটা অবোধ্য হাহাকার! চিঠিটা না পড়িয়া ছিঁড়িয়া ফেলার চাইতেই যে দেখা না করিয়া ফিরাইয়া দেওয়া আরও কত কঠিন, সে বোধও আর নাই তাপসীর!

.

‘বেহায়া হতভাগা’টাকে সঙ্গে বহিয়া আনার জন্য মনে মনে অমিতাভর বুদ্ধিকে ধিক্কার দিতে দিতে হেমপ্রভা উঁকি মারিয়া দেখিবার জন্য সিঁড়ির কাছবরাবর যাইতে না যাইতেই অপরাধীযুগল উঠিয়া আসে উপরতলায়।

পর পর দুইটি পদধ্বনি। প্রথম পদধ্বনি তারুণ্যে উচ্ছল অকুণ্ঠ দাবীর, দ্বিতীয়টি যৌবন সংযত কুণ্ঠিত সংশয়ের।

–এই যে নানি আমার বন্ধু–এঁর গাড়ীতেই এলাম আমরা।

অমিতাভর কথার উত্তরে হেমপ্রভা বিরক্তি-তিক্ত স্বর কোনো প্রকারে সহজ করিয়া । বলেন–বেশ বেশ, নিয়ে গিয়ে বসাওগে ঘরে।

–বা রে! ঘরে বসাব মানে? তোমার সঙ্গে ভাব করবার ইচ্ছেতেই তো এখানে আসা এঁর, তাই না মিস্টার মুখার্জি?

অজন্তার ছাঁদে গঠিত ওষ্ঠাধরের ঈষৎ বাঁকা রেখায় একটি কৌতুকহাস্যের রেখা ফুটিয়া ওঠে।

হেমপ্রভা অবাক হইয়া ভাবেন, কোথায় যেন দেখিয়াছেন ছেলেটিকে। ঠিক মনে পড়ে না। কিন্তু ভারি সুকুমার মুখোনি। বিদ্বেষ রাখা কঠিন, তবু তাপসীর সঙ্গে যোগসূত্রের কল্পনায় জোর। করিয়া স্নেহকে আসিতে দেন না। নীরসকণ্ঠে বলেন-আমার সঙ্গে আবার ভাব-আলাপ! সেকেলে বুড়ী আমরা, ভদ্দর সমাজের অযোগ্য!

হো হো করিয়া হাসিয়া ওঠে অমিতাভ।

এদিকে তাপসীর অবস্থা শোচনীয়। দাঁড়াইয়া থাকাও যত অস্বস্তিকর, হঠাৎ চলিয়া যাওয়াও তার চাইতে কম অস্বস্তির নয়।

হেমপ্রভা নিতান্তই অমিতাভর মান বা মন রাখিতে কথা বলিবার জন্যই বলেন কি নাম ছেলেটির?

–কিরীটীকুমার মুখার্জি। উত্তর দেয় অমিতাভ।

-বাপ-মা আছেন তো? ক’টি ভাই-বোন তোমরা? পুনরায় এই একটি মামুলী প্রশ্ন করেন হেমপ্রভা। এবারে সরাসরি কিরীটীকেই করেন।

-না নানি, বাপ-মা ভাই-বোন কেউ নেই আমার। নানি!

হঠাৎ যেন কোথা হইতে এক ঝলক মমতা আসিয়া হেমপ্রভার হৃদয়ে আছড়াইয়া পড়ে।…কেউ কোথাও নাই? আহা! তাই অমন স্নেহ-কাঙাল মুখ! জোর করিয়াও বিদ্বেষ আনা যায় না। মুখেও সেই ‘আহা’ শব্দ উচ্চারিত হয়–কেউ নেই! আহা! বাড়ী কোথায় ভাই তোমার?

–এই পাশের গ্রামে।

তাপসী ততক্ষণে সরিতে সরিতে দালানের ওদিকে গিয়া প্রায় দেওয়ালের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে। তবু কথাটা শুনিয়া চমকিয়া যায়।…পাশের গ্রামে! কই একথা তো কোনোদিন জানা ছিল না! কিন্তু থাকিবেই বা কেন? তাপসী কি কোনোদিন জানিতে চাহিয়াছে, কিরীটীর ঘর-বাড়ী কোথায়? অনাগ্রহ দেখাইতে গিয়া ভদ্রতাবোধও থাকে নাই সব সময়। মা-বাপ যে নাই, সেটুকুই শুধু আলাপ-আলোচনার ফাঁকে জানা হইয়া গিয়াছে মাত্র।

হেমপ্রভা চমকান না, বরং প্রসন্নমুখে বলেন–তাই বুঝি? তাই ভাবছি কোথায় যেন দেখেছি। পাশের গ্রামের তো–ছেলেবেলায় কোনো সূত্রে দেখে থাকব!

–দেখেছেন অবশ্যই। নেহাত ক্ষীণ হলেও যোগসূত্র একটা রয়েছে যখন। বঙ্কিম ওষ্ঠাধরের ভঙ্গিমায় তেমনি বাঁকা হাসি। বিদ্রুপের নয়, কৌতুকের।

হাসিতেছে অমিতাভও। তাহার চাপাহাসির আভায় উজ্জ্বল মুখের পানে চাহিয়া দেখিয়া কেমন যেন বোকা বনিয়া যায় তাপসী।

কি ব্যাপার! যোগসূত্র যাহা আছে তাহাতে নানির সঙ্গে সম্বন্ধ কি আর ঘটা করিয়া বলিয়া বেড়াইবার মতই কথা কি সেটা? তবে? অমিতাভর মুখে যেন কি একটা ষড়যন্ত্রের রহস্য আঁকা। এরা এখানে আসিয়াছে কিসের ফন্দি আঁটিয়া–সেই বিবাহ ব্যাপারটাই আবার কোনোপ্রকারে বাধাইতে চায় নাকি? কিন্তু অভী–

হেমপ্রভা আপন মনেই উত্তর দেন–যোগসূত্র! সে কি? বুঝতে পারছি না তো! কে ভাই তুমি? বাবার নাম কি তোমার?

–বাবার নাম ছিল কনক মুখোপাধ্যায়। কিন্তু সে বললে কি চিনতে পারবেন আপনি? দাদুর নামটাই বরং জানতে পারেন!

–দাদু! কে তোমার দাদু বলো তো? এ অঞ্চলের পুরনো কালের সকলের নামই তো চিনতাম–তবে অনেকদিন দেশছাড়া–ভুলেও যাচ্ছি–

তাপসী অমন করিয়া তাকাইয়া আছে কেন? সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়াই উত্তরটা শুনিতে চায় নাকি–কি বলিবে কিরীটী? কি বলিতেছে?

–ভুলে যাবেন না দোহাই আপনার। আপনি সুদ্ধ ভুলে গেলেই সর্বনাশ! দাদুর নাম ছিল স্বৰ্গত কান্তিচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।…আমি বুলু।

কি চমৎকার হাসিমাখা মুখে কথাটা উচ্চারণ করিল! জিভে বাধিল না–গলায় আটকাইয়া গেল না। অনায়াস-লীলায় কিরীটী উচ্চারণ করিল–আমি বুলু!…এটা কি একটা বিশ্বাস করিবার মত কথা? পরিহাস করিবার আর ভাষা পাইল না?…নাকি অমিতাভর সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া নানিকে ঠকাইতে আসিয়াছে? অমিতাভ আবার কবে ওর বন্ধু হইল? তাপসী চলিয়া আসার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীটা উল্টাইয়া গিয়াছিল নাকি? নানিকে ঠকাইয়া ও কি তাপসীকে গ্রাস করিতে চায়? তাপসীকে ও ভাবিয়াছে কি?

কি বলাবলি করিতেছে ওরা? এসব কথার কোনো অর্থ আছে নাকি? কি বলিতেছে?

–আমার পিসিমা রাজলক্ষ্মী দেবীর চিঠি পেয়েই অবশ্য এসেছি আমি। তবে এখানে অমিতাভই জোর করে আগে এনে হাজির করেছে। চিনি না’ বলে তাড়িয়ে-টাড়িয়ে দেবেন না তো!

ও কি মানুষ? ও কি পাষাণ? তাপসী কি এখনও সজ্ঞানে আছে? কিরীটী নামটা তবে ছদ্মনাম–নাকি সত্য? এই দীর্ঘকালের মধ্যে কই স্বামীর নামটা তো জানিয়া রাখে নাই তাপসী! আশ্চর্য! আশ্চর্য! বুলু যে একটা সত্যকার নাম হইতে পারে না, নিতান্তই আদরের ডাক, তাও খেয়াল হয় নাই কোনোদিন! তাপসী মূর্খ, তাপসী অবোধ-তাপসী বাস্তববুদ্ধিহীন স্বপ্নজগতের জীব!

কিন্তু কিরীটী? সেও কি তাপসীর মত অবোধ? নাকি জানিয়া শুনিয়া বসিয়া বসিয়া মজা দেখিয়াছে! নির্দয় আমোদে এই নিদারুণ যন্ত্রণা দিব্য উপভোগ করিয়াছে! আর তাপসী ওর এই নিষ্ঠুর আনন্দের খোরাক যোগাইয়া আসিতেছে!

কিরীটীর সমস্ত ব্যবহারটাই পূর্বপরিকল্পিত, এইটুকু মাথায় খেলিয়া যাইতেই মাথার সমস্ত রক্ত যেন আগুন হইয়া উঠে। তাপসীকে লইয়া অবিরত কেবল খেলাই চলিবে? আচ্ছা, ওর মতলবটা তবে কি ছিল–ছদ্মবেশের আড়ালে নিজেকে ঢাকিয়া তাপসীকে পরীক্ষা করা নয় তো? তরলচিত্ত তাপসী পুরুষকণ্ঠের আহ্বান মাত্রেই সাড়া দিয়া বসে কিনা তারই পরীক্ষা? হয়তো–হয়তো সে সময় এমনও ভাবিয়াছে–এই-ই স্বভাব তাপসীর, যার-তার ডাকে আপনাকে বিকাইয়া দেওয়া! ভাবিয়াছে আর মনে মনে কতই না জানি হাসিয়াছে! হয়তো আজও ধিক্কার দিতেই আসিয়াছে।

দুরন্ত অভিমানে সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তি উগ্র হইয়া উঠে। বিদ্রোহী হইয়া উঠে। এই ব্যক্তির সঙ্গে নূতন করিয়া গাঁটছড়া বাঁধিতে হইবে? কৃতার্থচিত্তে ওর চরণচিহ্নের অনুসরণ করিয়া যাইতে হইবে ওর ঘর করিতে?

অসম্ভব!

তাপসীর ধ্যানের দেবতাকে ভাঙিয়া চুরি করিল কিরীটী–’বুলু’ বিলুপ্ত হইয়া গেল। কিন্তু তাপসীকে ইচ্ছা করিলেই অধিকার করা যাইবে, একথা মনে করিবার মত ধৃষ্টতা যেন কিছুতেই না হয় ওর! আত্মপরিচয় গোপনকারী কাপুরুষের সঙ্গে তাপসীর কোনো সম্বন্ধ নাই!

হেমপ্রভার বহু সাধ্যসাধনা, অমিতাভর কাটাছটা তীক্ষ্ণ শ্লেষবাক্য, কিছুই যখন টলাইতে পারিল না তাপসীকে, “শুধু একবার দেখা করার প্রস্তাবটা পর্যন্ত অগ্রাহ্য হইয়া গেল, অগত্যাই। তখন ম্লান হাসি হাসিয়া বিদায় লইতে হইল বুলুকে।

রাগ দেখাইয়া অভুক্ত অমিতাভও ফিরতি ট্রেনে ফিরিয়া গেল। দিদির ব্যবহার চিরদিনই তাহার কাছে বিরক্তিকর প্রহেলিকা। আগে অবশ্য নিজেই সে কিরীটীকে দুইচক্ষে দেখিতে পারিত না, কিন্তু সে তো পরিচয় জানা ছিল না বলিয়াই! এখন সব দিকেই যখন এত সুব্যবস্থা দেখা গেল, তখনই কিনা বাঁকিয়া বসিল দিদি! খামখেয়ালের কি একটা সীমা থাকা উচিত নয়? দিব্য তো প্রেমে পড়িয়াছিলে বাবা, এখন সত্যকার স্বামী জানিয়াই সে সব উবিয়া গেল? ঈশ্বর জানেন–সেই বিবাহ-প্রস্তাবের দিন তলে তলে কি মারাত্মক ঝগড়াঝাটি হইয়াছিল, তা নয় তো কখনো সেই আসর হইতে নিরুদ্দেশ হয় মানুষ?

তাপসীর নিরুদ্দেশ হওয়ার পর, পাটনা হইতে ঘুরিয়া আসিয়া কিরীটী যেদিন কেবলমাত্র অমিতাভর কাছেই আপন পরিচয় ব্যক্ত করিয়া ক্ষমা চাহিল, সেইদিন হইতে তাহাকে এত বেশী ভালবাসিতে শুরু করিয়াছে অমিতাভ যে ভালবাসাটা প্রায় পূজার পর্যায়ে উঠিয়াছে।… এ হেন ব্যক্তি, অমিতাভ যাহাকে দেবতার কাছাকাছি তুলিয়াছে, তাহাকে কিনা স্রেফ অপমান করিয়া তাড়াইয়া দিল দিদি! ‘পাকা দেখা’র দিন বাড়ী ছাড়িয়া পালানোর স্বপক্ষে তবু একটা যুক্তি আছে, কিন্তু এ যে না-হোক অপমান!… অপমান ছাড়া আর কি! কাহারও সঙ্গে দেখা করিতে আপত্তি জানানোই তো অপমান করা!

.

প্রকাণ্ড বাড়ীর নিতান্ত নির্জন একটি কোণ বাছিয়া স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া ছিল তাপসী।

স্তম্ভিত বৈকি। নিজের ব্যবহারে, কিরীটীর ব্যবহারে–বোধ করি স্বয়ং বিধাতাপুরুষের। ব্যবহারেও স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছে সে। তাপসীকে গড়িয়া জগতে পাঠানোর পর তাপসী সম্বন্ধে এত সচেতন কেন তিনি? ভুলিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন না–অবিরত তাহাকে পিটিয়া পিটিয়া আর কোনভাবে গড়িতে চান? আচ্ছা-সাবিত্রীর দেশের মেয়েদের গঠনকার্যটা কি তিনি ইট কাঠ দিয়া করেন? রক্ত-মাংস থাকে না? হৃদয়’ বলিয়া কোনো বস্তু থাকিবার আইন তাহাদের। নাই? সেই অন্যায় আইন অমান্য করে নাই কেন তাপসী? কেন হৃদয়ের অনুশাসন মানিয়া যা খুশী করে নাই এতদিন?

মন ভাসিয়া যায় অন্য স্রোতে।…চিরদিনের স্বপ্নময় ‘বুলু’ই কিনা মিস্টার মুখার্জি।–এত কাণ্ডের পরও ঠিক যেন বিশ্বাস হয় না!..আচ্ছা, কোন্ নামটা মানায় তাহাকে? ‘কিরীটী’ না ‘বুলু’? বুলু বুলু বুলু! তাপসীর আবাল্যের ধ্যানের মন্ত্র। কিরীটীর মূর্তিটা কিছুদিনের জন্য তাহার বুদ্ধিটাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু নাম?…নাঃ, নামটাকে কোনোদিন প্রাধান্য দেয় নাই তাপসী। “মিস্টার মুখার্জি” ছাড়া আর যে কোন সংজ্ঞা আছে তাহার, সে কথা মনেই পড়ে ই কোনোদিন। কিরীটী নামটা কবে কখন প্রাণে সাড়া জাগাইয়াছে! সে নামটা ছিল কেবল পরিচয় মাত্র! সত্য ছিল মানুষটা!

কিন্তু ‘বুলু’ শব্দটা তো কেবলমাত্র একটা নাম নয়, ওটা যেন একটা ধ্বনিময় অনুভূতি–যে অনুভূতি মিশাইয়া আছে তাপসীর সমস্ত সত্তায় সমগ্র চৈতন্যে।..সেই বুলু নাকি হেমপ্রভার কাছে অকপটে স্বীকার করিয়া গিয়াছে, সেও তাপসীকে সেই বিবাহের রাত্রি হইতেই রীতিমত ভালোবাসিতে শুরু করিয়াছিল। এই দীর্ঘকাল ধরিয়া তাপসীকে পাইবার স্বপ্নই ছিল তার ধ্যান জ্ঞান ধারণা।

তবু যে কৃতি হইয়া আসিয়া এক কথায় প্রার্থনা করিয়া বসে নাই, সেটা যদিও অনেকটাই চক্ষুলজ্জা, অথবা সাহসের অভাব, তবু গ্রহণ করিবার আগে একবার পরীক্ষা করিবার লোভটুকু সংবরণ করিতে পারে নাই সে। সেই লোভেই আপন পরিচয় গোপন করিয়া এ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করিয়াছে।

অর্থাৎ তাপসীর ধারণা ভুল নয়। যাচাই!

হেমপ্রভা বলিতেছেন, অন্যায় কিছুই করে নাই বুলু। সত্যই তো–অতকাল আগের সেই কচি কিশলয়টি এতগুলো বৎসরের রৌদ্রে তাপে হিমে ঝড়ে বিবর্ণ হইয়া যায় নাই, স্নান হইয়া যায় নাই, ঠিক তেমনই আছে, এ প্রমাণ সে পাইবে কোথায়! পরীক্ষা করিয়া দেখিবার ইচ্ছাটা স্বাভাবিক বৈকি। সেই ইচ্ছার বশেই চিত্রলেখার পরিবারের কাছাকাছি আসিবার সুযোগ সৃষ্টি করিয়া লইতে হইয়াছে তাহাকে অনেক চেষ্টায়, অনেক কৌশলে।…অবশ্য চিত্রলেখার চোখে পড়িবার পর আর বেশী পরিশ্রম করিতে হয় নাই তাহাকে। অজস্র সুযোগ তিনিই সৃষ্টি করিয়া দিয়াছেন।

.

হয়তো হেমপ্রভার কথাই ঠিক।

কিন্তু সেই নিদারুণ পরীক্ষা দিতে বুক যার ছিঁড়িয়া পড়িয়াছে–তিল তিল করিয়া পিষিয়া মরিতে হইয়াছে–সে কি বলিবে? বলিবে কাজটা খুব ন্যায্য-খুব ভাল হইয়াছে বুলুর? অহরহ যে যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছে তাপসী, সে যন্ত্রণা কি চোখে পড়ে নাই তাহার? দিনের পর দিন সেই যন্ত্রণা চোখে দেখিয়াও পরীক্ষা করিবার সাধ মেটে নাই? অবশেষে যখন সেই শ্রান্ত অবসন্ন মানুষটা হাল ছাড়িয়া পলাইয়া আসিয়াছে, তখন আসিলেন হাসিমুখে অভয়বাণী শোনাইতে। বিজয়ীর মহিমায় স্বচ্ছন্দ অবহেলায় বলিতে বাধিল না মিথ্যা এতদিন যুদ্ধ করিয়া মরিয়াছ, প্রয়োজন ছিল না! প্রয়োজন ছিল না এত কষ্টের! আমিই তোমার ইষ্টদেবতা, প্রলোভনের ছদ্মবেশে পরীক্ষা করিয়াছিলাম মাত্র!

দীর্ঘ পত্রের মারফৎ সেই কথাই নাকি জানাইয়া দিয়াছিল সে–যে চিঠি কাশীর বাড়ীতে তাপসী অপঠিত অবস্থায় ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছে। কে জানে খুলিয়া পড়িলে আজকের ইতিহাস। অন্যরূপ হইত কিনা। কিন্তু এখন আর বদলানো যায় না। . কোনো কিছুতেই আর প্রয়োজন নাই তাপসীরনা যুদ্ধে, না রাজত্বে। তাই বুক ছিঁড়িয়া পড়িলেও মুখের হাসি বজায় রাখিয়া সে হেমপ্রভার কাছে ঘোষণা করিয়া দিয়াছে–কেউ আমাকে যাচিয়ে বাজিয়ে অবশেষে গ্রহণ করে কৃতার্থ করবে, ওসব বরদাস্ত করতে পারব না বাপু। তোমার আদরের কুটুম্ব এসেছে, সন্দেশ রসগোল্লা খাইয়ে আপ্যায়িত করগে, আমার অন ছাড়ো।

হেমপ্রভা আর্তপ্রশ্ন করিয়াছিলেন–আর এই যে তুই ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলি বর খুঁজতে, সেই বরকে পেয়ে ছাড়বি? এমন করে ফিরিয়ে দিলে ওকি আর কখনো সাধতে আসবে?

হৃদয়ের সমস্ত শক্তিকে একত্র করিয়া মুখের হাসি বজায় রাখিয়াছিল তাপসী–তা কি করব বলো নানি? সকলের কি বর জোটে? আমার অদৃষ্টে বরের বদলে শাপ!

হেমপ্রভা কপালে ঘা মারিয়া বলিয়াছিলেন–এ কি সর্বনাশা বুদ্ধি তোর মাথায় খেলছে তাপস? ভগবান নিজে হাতে করে এত বড় সৌভাগ্য বয়ে এনে দিচ্ছেন, তুই এতটুকু ছুতোয় অবহেলা করে ফেলে দিবি সে সৌভাগ্য? অভিমানটাই এত বড় হল?

–অভিমান কিসের? শুধুই মান, নানি? মা বসুমতী যে আজকাল বুড়ো হয়ে কালা হয়ে গেছেন, ডেকে মরে গেলেও তো বেচারা মেয়েদের মানসম্রম বাঁচাতে দ্বিধা হয়ে কোল দেবেন না! তা নইলে তো পরীক্ষার জ্বালায় পাতালে প্রবেশ করেই বাঁচতাম!

.

অগত্যাই রাগ করিয়া উঠিয়া গিয়াছেন হেমপ্রভা। ওদিকে রাগ জানাইতে জলস্পর্শ না। করিয়াই চলিয়া গিয়াছে অমিতাভ। আর–আর নাকি ম্লান হাসি হাসিয়া বিদায় লইয়াছে বুলু।

তাপসী রহিয়া গিয়াছে একা। তাপসীকে যেন একযোগে ত্যাগ করিয়া গিয়াছে সকলে।

তবে কি তাপসীর ভুল? প্রচণ্ড যে দুইটো সমস্যার জট তাপসীর জীবনকে জটিল করিয়া তুলিয়াছিল, এত সহজে সে জট খুলিয়া যাওয়ায় ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞ হওয়াই উচিত ছিল তার? সকল দ্বন্দ্বের অবসানে কাম্য প্রিয়তমকে লাভ করিয়া কৃতার্থচিত্তে দশের একজন হইয়া বেড়াইতে পারিলেই স্বাভাবিক হইত?

না, তা হয় না। সুখের বদলে সম্মান বিকাইয়া দেওয়া যায় না। সুখ বিদায় হোক–সম্মান থাক জীবনে।

হেমপ্রভা আর কাশী ফিরিয়া যাইবার গোছগাছ করিতেছেন। মিথ্যা আর এখানে বসিয়া থাকিয়া লাভ কি! উঁচু মাথাটা তো হেঁট হইয়াই ছিল, তবু কি বিধাতার আশা মেটে নাই? মাটির সঙ্গে মিশাইয়া ছাড়িলেন? যাক, আর কেন? রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে অনেক পরামর্শ করিয়া অনেক আশা লইয়া দেশে আসিয়াছিলেন, সব আশায় ছাই দিয়াছে তাপসী নিজে!

এতদিনে হুঁশ হইতেছে হেমপ্রভার, তাপসী চিত্রলেখারই মেয়ে! দেখিতে যতই নিরীহ হোক, জিদে মার চাইতে একবিন্দুও খাটো নয়! যাক, হেমপ্রভার বিধিলিপি এই। তাপসীর ‘ভাল’ করিবার ভাগ্য তাহার নয়।

রাজলক্ষ্মীকে মুখ দেখাইবার মুখ আর নাই। দুই-দুইবার শুভদিন দেখিয়া গাড়ী পাঠাইয়াছিল রাজলক্ষ্মী বৌ লইয়া যাইত, শূন্য ফিরিয়া গিয়াছে সে গাড়ী।

তাপসীর নাকি স্বামীর ঘরে ‘বৌ’ হইয়া ঘর করিবার স্পৃহা আর নাই! কলিকাতায় ফিরিয়া গিয়া চাকরি করিবে সে!

আরও থাকিবেন হেমপ্রভা? গলায় দড়ি দিবার বয়স নাই, তাই বাঁচিয়া থাকা? যাত্রার আগের দিন একবার…হয়তো শেষবারের মতই বল্লভজীর মন্দিরে যাইবার ব্যবস্থা করিতেছিলেন হেমপ্রভা। গাড়ীর কথা বলা আছে, মালী ফুল ও মালা লইয়া আসিলেই হয়। বেলা হইয়া যাইতেছে বলিয়া ঘরবার করিতেছেন, হঠাৎ চাহিয়া দেখেন তাপসী আসিতেছে ছোট একটা ডালায় ফুল লইয়া, অর্থাৎ ভোর হইতে বাগানেই ছিল সে!

এ কয়দিন আর ঠাকুমা-নাতনীতে খুব বেশী কথাবার্তা ছিল না, দুইজনেই চুপচাপ গম্ভীর। আগে হইলে হয়তো তাপসী কলহাস্যে ছুটিয়া আসিয়া বাগানের ফুলসম্ভারের উচ্ছ্বসিত বর্ণনায় মুখর হইয়া উঠিত, নয়তো হেমপ্রভাই ফুলরাণী’র সঙ্গে তুলনা করিয়া মুখর হইয়া উঠিতেন নাতনীর রূপের প্রশংসায়। আজকের মনের অবস্থা অন্য। তাই হেমপ্ৰভা শুধু চোখ তুলিয়া চাহিয়া দেখেন, আর তাপসী ধীরে ধীরে কাছে আসিয়া ম্লানহাস্যে বলে–চলো নানি, তোমার সঙ্গে গিয়ে একটু পুণ্য অর্জন করে আসি।

-তুমি কোথায় যাবে? তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করেন হেমপ্রভা।

–সেই যে কোথায় তোমার সেই ‘রাইবল্লভ’ না ‘রাধাবল্লভ’ আছেন, দেখেই আসি একবার জন্মের শোধ!

–বালাই ষাই! নিজের অজ্ঞাতসারেই অতি ব্যবহৃত এই কল্যাণমন্ত্রটুকু উচ্চারণ করিয়া হেমপ্রভা বলেন–আর তার ওপর দয়া কেন? তার তল্লাট থেকে চলেই তো যাচ্ছ মুখ ফিরিয়ে।

–কে যে কার দিক থেকে মুখ ফেরায়, কে যে কখন বিমুখ হয়, সব কি আমরা বুঝতে পারি নানি? চলো না দেখেই আসি তোমাদের দয়াল প্রভুকে!

হেমপ্রভা ঈষৎ গম্ভীর হইয়া বলেন–ব্যঙ্গ করে দেবদর্শনে যেতে নেই বাছা, তোমার আর গিয়ে কাজ নেই!

-না নানি, ঘুরেই আসি। ব্যঙ্গ তোমার প্রভুকে করছি না, করছি তার নামটাকে! কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন আর কাকে বলে!

–নিজের চোখ কানা হলেই তাকে কানা দেখে মানুষ। হেমপ্রভা রাগিয়া ওঠেন–দয়ার সাগর তিনি, যা দয়া করেছিলেন তোমায়, হিতাহিত জ্ঞানের লেশমাত্র থাকলেও এমন করে সে দয়া অবহেলা করতে না। তাই বলছি–ভক্তি-বিশ্বাস যখন নেই তখন আর কেন যাওয়া!

–তা লোকে তো সং-এর পুতুল দেখতেও যায় বাপু, তাই না হয়, খুব চটছ বুঝি?

-হুঁঃ, আমার আবার চটাচটি! তাও তোমাদের কথায়! যাকগে যাবে বলছ চলো!–তা এই মুহূর্তেই যাবে, না একখানা পরিষ্কার কাপড়জামা পরবে ছেদ্দা করে?

–পরিষ্কার কাপড়! রোসো দেখি, স্টক তত তেমন ভারী নয়! বস্তুত ঝোঁকের মাথায় একবস্ত্রে কলিকাতা ছাড়ার পর, কাশীর বাজারে কেনা খানকতক সাধারণ শাড়ীই আপাতত ভরসা তাপসীর।

হেমপ্রভার প্রাণটা ‘হায় হায়’ করিয়া ওঠে–এ যেন “লক্ষ্মী হয়ে ভিক্ষে মাগা!” রাজার ঐশ্বর্য পায়ে ঠেলিয়া এখন কিনা–উঃ, আধুনিক মেয়েদের চরণে শতকোটি প্রণাম! সর্বস্ব হারাইয়া স্বচ্ছন্দে হাসিয়া বেড়ানো কেবল আজকালকার এই সব বুনো ঘোড়ার মত মেয়েদের পক্ষেই সম্ভব! বুলুর মায়ের দরুন এক বাক্স গহনা আর সোনা ঝলসানো জমকালো একখানা বেনারসী শাড়ী পাঠাইয়া দিয়া বৌ লইতে পাঠাইয়াছিলেন রাজলক্ষ্মী, গাড়ীর সঙ্গে সেগুলাও ফেরত দিতে হইয়াছে। নূতন করিয়া সেই শোক উথলাইয়া ওঠে হেমপ্রভার।

.

কিন্তু এ কি! সব শোক উড়াইয়া চোখ জুড়াইয়া দিলে যে তাপসী! এতকাল আগের শাড়ীখানা কোথায় পাইল সে? টুকটুকে লাল জর্জেটের উপর রূপালি জরির চওড়া ভারী পাড় বসানো সেই শাড়ী–যে শাড়ী পরা লক্ষ্মীরূপ দেখিয়া বুড়ো কান্তি মুখুজ্জের মাথা ঘুরিয়া গিয়াছিল! কে জানে কোথায় কোন্ দেরাজের কোণে পড়িয়াছিল? মূল্যবান জিনিস, এই দীর্ঘদিনের অব্যবহারেও ম্লান হয় নাই। প্রায় তেমনি উজ্জ্বল, তেমনি কোমল আছে।

হেমপ্রভার অনেক ভাবে-ভরা দৃষ্টির সামনে একটু কুণ্ঠিত না হইয়া পারে না তাপসী। ঝোঁকের মাথায় পরিয়া ফেলিয়া বেজায় লজ্জা করিতেছে যে!

–এ কাপড় কোথায় পেলি রে?

কথা কহার উপলক্ষ পাইয়া বাঁচে তাপসী। তাড়াতাড়ি বলে–এখানেই ছিল গো নানি, তোমার সেই প্রকাণ্ড সিন্দুকটার মধ্যে। কত সব শাল র‍্যাপার পুরনো পুরনো–দেখছিলাম। সেদিন। এ শাড়ীখানা কি করে ঢুকে গেছে তার সঙ্গে কে জানে! তবে দুঃখের বিষয়, পোকায় কেটে দিয়েছে অনেক জায়গায়।

–আহা রে! তাও বলি কাটবে না তো কি করবে? এতদিন যে রেখেছে এই ঢের! কিন্তু এ শাড়ী তোমরা পরলে তো মানায় না বাছা–তোমরা আপিসে যাবে, সাইকেল চড়বে, ট্রামগাড়ীর জন্যে ছুটোছুটি করবে, তোমাদের ওই সব খাকির কোট-পাজামা পরাই উচিত! এ তো বিয়ের কনের শাড়ী!

–ধ্যেৎ! শাড়ীতে যেন লেখা থাকে!…চলো বাপু, ফুলগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে!

–ফুল তো সবই শুকোলো তোমার, দেবতার চরণে আর দিলে কই? নারায়ণ! নারায়ণ! গাড়ী আসিয়া ডাকাডাকি করিতেছে।

.

আগামী কাল ফুলদোল। মন্দিরের সাজসজ্জায়, বিগ্রহের বেশবাসে আসন্ন উৎসবের সমারোহ। ধূপধুনা ও অজস্র সুগন্ধিপুষ্পের সম্মিলিত সুরভিতে বৈশাখী প্রভাতের চঞ্চল হাওয়া যেন কম্পিত মন্থর।

নিজেদের হাতের ফুলের ডালা বিগ্রহের সামনে নামাইয়া দিয়া ঠাকুমা-নাতনী সামনের চাতালের একধারে বসিয়া পড়েন। বৈশাখের শুচিস্নিগ্ধ নির্মল সকালের মতই শুভ্র নির্মল মার্বেলের পাথরের মেঝে–বসিতে লোভ হয়।

উৎসুক দৃষ্টি মেলিয়া চারিদিকে তাকাইয়া দেখে তাপসীবহুদিন আগে আর একবার যে আসিয়াছিল, সেও এমনি বৈশাখী পূর্ণিমার দিন ছিল না? কি অদ্ভুত যোগাযোগ! সেদিনের সেই সুরভিবাহিত এলোমেলো বাতাস কি এতদিন লুকাইয়া ছিল মন্দিরের খিলানে খিলানে, কার্নিশের খাঁজে খাঁজে? তাপসীর সাড়া পাইয়া আজ আবার বাহির হইয়া পড়িয়াছে?

সুগন্ধের মত বিস্মৃত স্মৃতির বাহক এমন আর কে আছে? কালের প্রাচীর অতিক্রম করিয়া মুহূর্তের মধ্যে অতীতকে ফিরাইয়া আনিবার এমন ক্ষমতা আর কার আছে? তাই বিস্মৃত দিনের সেই সোনালী সকালটি যেন সহসা এই ফুলচন্দন ধূপধুনার সৌরভজড়িত উত্তরীয় গায়ে দিয়া একমুখ হাসি লইয়া তাপসীর সামনে আসিয়া দাঁড়াইল।

–আচ্ছা নানি, সেই ঘোড়াটা আছে এখনো? রথের কাঠের ঘোড়াটা?

অকস্মাৎ এ-হেন অভিনব প্রশ্নে চমকিত হেমপ্রভা হাতের জপের মালাটা স্থগিত রাখিয়া বলেন–কি আছে? রথের ঘোড়া?

–হ্যাঁ গো, সেই যে বাবলুবাবুর যা দেখে বেজায় ঘূর্তি লেগেছিল!

–আ কপাল! এত বেশ থাকতে সেই কাঠের ঘোড়াটার চিন্তা! আছে অবিশ্যিই, যাবে আর কোথায়?

–তা চল না, ঘুরে ঘুরে সব দেখি।

হেমপ্রভা অসমাপ্ত মালাগাছটি আবার কপালে ঠেকাইয়া বলেন–দেখবার আর কি আছে? এই যা দেখছি জগতের সারবস্তু। তোর ইচ্ছে হয়, একটু ঘুরেফিরে দেখে আয়। এখুনি হয়ত জয়কেষ্ট গাড়ী এনে ডাকাডাকি করবে।’

তাপসী ইতস্তত করিয়া বলে–কেউ কিছু বলবে না তো?

–ওমা বলবে আবার কি! এই তো এত লোক আসছে, যাচ্ছে, বসছে, পুজো দিচ্ছে, মালা দিচ্ছে–কে কাকে কি বলছে!

–আমি একলা যাব? তুমি যাবে না নানি?

–না ভাই, আর ঘুরে বেড়াবার ইচ্ছেও নেই, সামর্থ্যও নেই। তুই একপাক দেখে আয় না। পিছনদিকে মস্ত নাকি বাগান করেছে।

তাপসী কুণ্ঠিতভাবে এদিক ওদিক চাহিয়া প্রাঙ্গণে নামে। কেন কে জানে–রংচটা রথ, কাঠের ঘোড়া ও মাটির সখী-পুতুল জড়ো করিয়া রাখা মন্দিরের সেই অবহেলিত দিকটা দেখিবার জন্য কৌতূহল প্রবল হইয়া উঠিয়াছে।

.

মন্দিরের পিছনে এদিকটা একেবারে নির্জন। মন্দিরে আসিয়া ভাঙা পুতুল দেখিবার শখ আবার কার হয় তাপসীর মত! টানা লম্বা একটা দালানের ভিতর গাদাগাদি করিয়া নূতন পুরানো ভাঙা আস্ত অনেক পুতুল। প্রমাণ মানুষের আকৃতিবিশিষ্ট এই পুতুলগুলি দেখিতে মজা লাগে বেশ। ছেলেমানুষের মত কৌতূহলী দৃষ্টি লইয়া দেখিতে থাকে তাপসী।

এত পুতুল সেবারে ছিল না তো কই! বৎসরে বৎসরে নূতন করিয়া যোগ হইয়াছে বোধ হয়! দালানের বাহিরে খোলা মাঠে কাত হইয়া পড়িয়া আছে ঘোড়াটা।

কি আশ্চর্য! এদের কি মায়া-মমতা বলিয়া কিছুই নাই?

‘এদের’ ভাবিতে অকস্মাৎ একটা কথা মনে পড়িয়া মুহূর্তে লজ্জায় লাল হইয়া ওঠে তাপসী।..মন্দিরটা কান্তি মুখুজ্জের না? বুলুর দাদুর?..আসিবার আগে অত খেয়াল হয় নাই তো?

হেমপ্রভা আসিতেছেন শুনিয়া মনটা কেমন চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। ওদের কেউ যদি এখানে উপস্থিত থাকে? কেউ আর কে–রাজলক্ষ্মী! দেখা হইয়া গেলে লজ্জায় মারা যাইবে কিন্তু তাপসী!

চোখের আড়ালে গাড়ী ফেরত দেওয়া যত সহজ, চোখোঁচাখি হইয়া প্রত্যাখ্যান তত সহজ কি? থাক বাবা, আর ভাঙা পুতুল দেখিয়া কাজ নাই! নিজের ভাঙা ভাগ্য লইয়া তাড়াতাড়ি সরিয়া পড়াই ভাল!

.

কিন্তু এ কী! ফিরিবার পথ কোথায়? পথ আগলাইয়া যে দাঁড়াইয়া আছে, মুখ ফিরাতেই চোখোঁচাখি হইয়া গেল তাহার সঙ্গে। মিস্টার মুখার্জি বলিয়া চিনিবার উপায় নাই। নিতান্তই বুলু। চওড়া জরির আঁচলাদার সাদা বেনারসীর জোড় পরা সুগঠিত সুঠাম দেহরক্তকমলের মত নগ্ন দুখানি পা–অবিন্যস্ত চুলের নীচে মসৃণ ললাটে সাদা চন্দনের একটি টিপ। যুগান্তর পূর্বের সেই কিশোর দেবতার মূর্তি ধরিয়া তাপসীকে কেউ ছলনা করিতে আসিল নাকি?

কি এক অজানা আশঙ্কায় বুক থরথর করিতেছে যে! হায় হায়, তাপসী কেন আসিয়াছিল এখানে? এখন কেমন করিয়া পালাইবে সে? ওর কাছ ঘেঁষিয়া যাওয়া ছাড়া তো আর উপায় নাই! তবে?

মাটির ওই পুতুলগুলোর মত শুধু নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিবে নিষ্পলক দৃষ্টিতে? কিন্তু তাপসী নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিলেই কি সকল সমস্যার সমাধান হইয়া যাইবে? তাপসীর সম্মুখবর্তী এই ছদ্মবেশী দেবমূর্তি তো মন্দিরে অবস্থিত চিরকিশোর মূর্তির মত স্থাণু নয়। সে যে চঞ্চল ব্যাকুল, নিতান্তই অস্থির।

তবে? তবে কেমন করিয়া নিজেকে সামলাইবে সে? কেমন করিয়া কঠিন হইয়া থাকিবে মানসম্ভ্রমের দুর্বহ ভার বহিয়া?

.

হায় ভগবান! সমস্ত মানসম্রম জলাঞ্জলি দিয়া এ কি করিয়া বসিল তাপসী? নিতান্ত অসহায়ের মত নিজেকে কোথায় সঁপিয়া দিল বিনা দ্বিধায়, বিনা প্রতিবাদে?

কোথায় লুকানো ছিল তাপসীর পরাজয়ের শৃঙ্খল? খসিয়া পড়া খসখসে বেনারসী চাঁদরের আবরণমুক্ত স্পন্দিত বক্ষের স্পর্শের ভিতর? আবেগতপ্ত বলিষ্ঠ বাহুবেষ্টনের মধ্যে?

পরাজয়! পরাজয়ে এত সুখ? এমন নিশ্চিন্ত শান্তি? বিজয়ীর নিবিড় আলিঙ্গনের মধ্যে নিজেকে নিঃশেষে সমর্পণ করিয়া দেওয়ায় এত তৃপ্তি?

একথা তো আগে কেউ বলিয়া দেয় নাই তাপসীকে!

আবাল্যসঞ্চিত ব্যর্থ বেদনার জ্বালা, সদ্য-প্রজ্বলিত অগ্নিপরীক্ষার জ্বালা, নিজেকে বশে রাখিবার অক্ষমতার জ্বালা সব কিছুই যে জুড়াইয়া গেল!

এই অনাস্বাদিত শাস্তি কি অবাস্তব? এই অজানিত অনুভূতি কি স্বপ্ন? এই নির্জন পরিবেশ, এই পুষ্পগন্ধবাহী চঞ্চল বাতাস, এই চির-আকাঙ্ক্ষিত উষ্ণ স্পর্শ–সমস্তই কি কল্পনা? সত্য হইলে কি এত অনায়াসে হার মানিতে পারিত তাপসী?

না না, মুহূর্তের বিহ্বলতাকে প্রশ্রয় দিবে না সে। পরীক্ষকের কাছে হার মানা যায় না।

.

–ছেড়ে দিন আমায়!

–ছেড়ে? না, না, আর ছেড়ে দেব না তোমায়। কোনদিন না, কখনো না।

তবু ছাড়াইয়া লয় তাপসী। মুক্ত করিয়া লয় নিজেকে পরম আকাঙ্ক্ষিত সেই বাহুবন্ধন হইতে। প্রায় কাঁদো কাঁদো হইয়া বলে–কেন আপনি অপমান করবেন আমায়?

–ছি তাপসী! ও কথা বলতে নেই!

–হ্যাঁ, হ্যাঁ, চিরদিন আপনি অপমান করেছেন আমায়। এততেও আশ মেটেনি? আবার চান আমি আপনার কাছেই–আবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসে তাপসীর।

কিরীটীর কণ্ঠস্বরও গভীর আবেগপূর্ণ–হ্যাঁ তাপসী, ‘আবার’ নয়–বরাবর চাই, চিরদিনই চাই। দিনেরাত্রে অহরহ চেয়েছি তুমি আমার কাছে এসে ধন্য করবে আমায়। সেই তীব্র আকাক্ষার বশে–ছেলেবেলায় কলেজ কামাই করে ঘুরে বেড়িয়েছি তোমার স্কুলের কাছে, কলেজের রাস্তায়। সন্ধ্যার অন্ধকারে তোমাদের বাড়ীর কাছের পার্কের বেঞ্চিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বোকার মত বসে থেকেছি দোতলার ঘরে জানালার আলোর দিকে তাকিয়ে। কোন ঘরে তুমি থাকো, কোনখানে তুমি বসো কিছুই জানতাম না–তবু বসে থাকা চাই। সাত বছর ধরে ঘুরে বেড়িয়েছি কত দেশ-বিদেশে, তবু সর্বদা মনে পড়েছে–কি এক অদৃশ্যসূত্রে বাঁধা আছি তোমার সঙ্গে। ফিরে এসে তাই লোভ সামলাতে পারলাম না, অথচ পারলাম না নিজের পরিচয় দিয়ে সোজাসুজি তোমাকে প্রার্থনা করতে। সাহস হল না। যে বন্ধন আমার কাছে সত্য, তা তোমার কাছে হয়তো নিতান্তই মিথ্যে, এই ছিল আশঙ্কা।

–আর, আর কি যন্ত্রণা আমি পেয়েছি, অহরহ কি যুদ্ধ করতে হয়েছে–তা কি বুঝতে পারেন নি?

–হয়তো পেরেছি, হয়তো পারিনি, বুদ্ধির বড়াই করতে চাই না তাপসী। তবু প্রতি মুহূর্তে চেষ্টা করেছি ছদ্মবেশ মোচন করতে, সহজ হয়ে নিজেকে ধরা দিতে, কিন্তু পারিনি। আমার এই অক্ষমতাই তোমার এই যন্ত্রণার মূল। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, যেদিন সমস্ত শক্তি একত্রিত করে প্রতিজ্ঞা নিয়ে গেলাম, ঠিক সেদিনই তুমি অভিমানে ঘর ছাড়লে। চিঠির ভেতর দিয়ে অপরাধ স্বীকার করে চাইলাম তোমার ক্ষমা, নানির কাছে শুনলাম তুমি সে চিঠি পড়লেই না, ছিঁড়ে ফেললে!

–কি লিখেছিলেন তাতে? হালকাভাবে প্রশ্ন করে তাপসী। কি লিখিয়াছিল সে সংবাদ তো নানির কাছে পাইয়াছে।

–কি আর, আমার দুষ্কৃতির কাহিনী। অবশেষে পরিচয় দিলাম অভীর কাছে। সে বেচারা অনুতাপানলে দগ্ধ হতে লাগল।

–আর মা?

–মা? মৃদু হাসে কিরীটীমা এত বেশী গুম হয়ে গেলেন শুনে যে সেই অবধি আর কথাই কইলেন না আমার সঙ্গে। বোধ হয় ভাবলেন আমি তাকে ঠকিয়েছি। কিন্তু আশ্চর্য, চিনতে যদিও না পেরেছিলে, আমার নামটাও কি সত্যি জানতে না তুমি? সেই অদ্ভুত রাত্রে মন্ত্র-উচ্চারণের সঙ্গেও কি কানে যায়নি একবার?

তাপসী মাথা নাড়ে। মুহূর্তে ছবির মত ভাসিয়া ওঠে সেই অদ্ভুত রাত্রের দৃশ্য তাপসীর দৃষ্টির সামনে। হায়, তাপসীর কি জ্ঞান চৈতন্য অনুভূতি কিছুই ছিল সেদিন!

–তাপসী, আজকের এই ঘটনাকে কি দেবতার দান বলে মনে হয় না তোমার? আমার তো আজ এদিকে আসবার কোনো ঠিকই ছিল না, সামান্য আগেও না। নিতান্তই পিসিমার উপরোধে পড়ে দেখতে এলাম পুতুলগুলোর অবস্থা–পোটো লাগিয়ে সংস্কার করতে হবে নাকি ওগুলো!…কিন্তু আমি কি ভেবেছিলাম–স্বপ্নেও ভেবেছিলাম–মাটির পুতুলের ঘরে দেখা মিলবে সোনার পুতুলের! এই বল্লভজীর মন্দিরেই প্রথম দেখেছিলাম তোমায়, তাই হয়তো বল্লভজীই ষড়যন্ত্র করে দুইজনকেই টেনে আনলেন তার এলাকায়। এ সৌভাগ্যকে অবহেলা কোরো না তাপসী।

কিন্তু তাপসী কেমন করিয়া বলিবে—’না, অবহেলা করিব না!’ মানসম্রম চুলায় যাক, কিন্তু লজ্জা? দুর্নিবার লজ্জায় যে কণ্ঠ চাপিয়া ধরিয়াছে তাহার। বলিতে পারিলে তো অনেক কথাই বলার ছিল। তাপসীর জীবনেই কি নাই ব্যর্থ সন্ধানের হাস্যকর ইতিহাসঃ পথে পথে, কলেজে, হোস্টেলে, আরো কত সম্ভব-অসম্ভব স্থানে? হায়, তেমন করিয়া গুছাইয়া বলিবার শক্তি তাহার কোথায়?

–উত্তর দেবে না? চুপ করেই থাকবে? বলল কি করবে তুমি?

দ্বিধা কাটাইয়া সহসা মুখ তুলিয়া যে উত্তর দেয় তাপসী, সেটা কেবলমাত্র কিরীটীকেই আহত করে না, যেন তাপসীর কানকেও আঘাত করে। এমন করিয়া তো বলিতে চাহে নাই সে! কিন্তু বলিয়াছে–

–আমাকে আপনারা সকলেই ছেড়ে দিন দয়া করে, যেমন করে হোক একটা কাজ খুঁজে নেব আমি।

–কাজ! কাজ করবে তুমি? কি কাজ? চাকরি?

–ক্ষতি কি?

–লাভ-ক্ষতির হিসেব সকলের সমান নয় তাপসী, কিন্তু থাক, অনুরোধ-উপরোধের চাপে আর বিব্রত করব না তোমাকে। আমার জন্যে তোমার মন প্রস্তুত হয়ে নেই, এই কথাটাই বুঝতে একটু দেরি হয়ে গেল বলে অনেক জ্বালাতন সইতে হল তোমায়। যাক ক্ষমা চাইছি। জানোই তো পৃথিবীতে নির্বোধ লোকের সংখ্যাই বেশী!

অজন্তার ছাঁদে গড়া রেখায়িত অধরে ম্লান একটু হাসি ফুটিয়া ওঠে।

–আচ্ছা চলি। আজকের এই অপ্রত্যাশিত দেখাটা মনে থাকবে, কি বলল? আমি অবশ্য আমার কথাই বলছি।…নানির সঙ্গে এসেছ বোধ হয়? অনেকক্ষণ আছ, খুঁজছেন হয়তো।…কবে ফিরবে কলকাতায়?

–কাল। অস্ফুট একটা শব্দ হইতে আন্দাজে ধরিয়া লইতে হয় উত্তরটা।

–বেশী লাভ করতে গিয়ে সবই হারাতে হল, তাই না তাপসী? এর পর দৈবাৎ কোনোদিন দেখা করতে গেলেও হয়তো ধৃষ্টতা হবে, কি বলল? মাটিতে লুটাইয়া পড়া উত্তরীয়ের আঁচলটা কুড়াইয়া লইয়া ধীরে ধীরে ফিরিয়া যায় কিরীটী।

.

অবাক নেত্রে চাহিয়া থাকে তাপসী। চলিয়া গেল? তাপসীর জীবনে আর কোনোদিন দেখা মিলিবে না ওর? ধূ ধূ মরুভূমির মত শুষ্ক শ্রীহীন জীবন লইয়া করিবে কি তাসী? না না, ছুটিয়া গিয়া ফিরাইয়া আনিবে সে, কিন্তু কেমন করিয়া ফিরাইবে? ছুটিয়া গিয়া পায়ে পড়িবে? নিতান্ত নির্লজ্জের মত দুই হাত দিয়া জড়াইয়া ধরিয়া আশ্রয় লইবে স্বর্গের দুয়ারে? সকল জ্বালা জুড়াইয়া দেওয়া সেই শান্তির স্বর্গে? ক্ষণপূর্বে মুহূর্তের জন্য যে স্বর্গের আস্বাদ পাইয়া আপনাকে হারাইতে বসিয়াছিল তাপসী?…না–কিছুই পারে না তাপসী, শুধু দাঁড়াইয়া থাকিবার মত ক্ষমতার অভাবেই দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া বসিয়া পড়ে ধূলার উপর।

.

কতক্ষণ বসিয়াছিল তাপসী? ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল নাকি? চৈতন্য ছিল তো? সময়ের জ্ঞান হারাইয়া গিয়াছে কেন? …পিঠের উপর আলগোছে একটু স্পর্শ কার হাতের?

–তাপসী চলো, তোমাকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে আসি। কি মমতা-স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর!–তোমাকে এখানে একা ফেলে চলে যেতে পারলাম না তাপসী, আবার এলাম নির্লজ্জের মত। চলো–শুধু তোমাকে বাড়ী পৌঁছে দেবার অনুমতিটুকু চাইছি।

কিন্তু অনুমতি দেবে কে? ভিতরে যাহার ভূমিকম্পের আলোড়ন চলিতেছে? শুধু কণ্ঠের স্বরে এত মমতা ভরা থাকিতে পারে? যে মেয়ে আবাল্য হাসির আড়ালে সব কিছু গোপন করিয়া আসিয়াছে, সে-ই কিনা কাঁদিয়া ভাসাইয়া দিল কণ্ঠস্বরের সামান্য একটু স্নেহস্পর্শে? হায় হায়! লজ্জা রাখিবার স্থান রহিল কই? লজ্জা সম্রম সবই যে গেল! অশ্রুকণিকাকে গোপন করা চলে, কিন্তু অসাগরকে?

–তাপসী ওঠো। তাপসী চলো লক্ষ্মীটি! কত লোক ঘোরাঘুরি করছে, হঠাৎ কেউ এদিকে এসে পড়লে হয়তো কি না কি ভাববে!

–কেন ভাববে? কিছু ভাববে না কেউ। যাব না আমি। এতক্ষণে কথা বাহির হয় তাপসীর মুখে।

–যাবে না? কিরীটী মৃদু হাসে–আমার পক্ষে তো শাপে বর! তাহলে এইভাবে বসে থাকা যাক, কি বলো? বলিয়া নিজেও বেনারসীর জোড়সমেত ধূলার উপর বসিয়া পড়ে, কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখিয়া।

–তাপসী, সত্যই যদি এমনি বসে থাকা যেত চিরদিন, চিরকাল!

ভাঙা মাটির পুতুলগুলার পানে নির্নিমেষ দৃষ্টি মেলিয়া কি দেখিতেছিল তাপসী কে জানে, বুলুর কথায় মুখ ফিরাইয়া এক নিমেষ চোখ তুলিয়া চায়।

.

আবার কিছুক্ষণ কাটে।

এক সময় সামান্য একটু হাসিয়া বুলু বলে–সত্যিই আমি বড় নির্লজ্জ তাপসী, তুমি আমাকে সহ্য করতে পারছ না, তবু জবরদস্তি করে বসে আছি কাছে। কিছুতেই যেন উঠে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আচ্ছা মাঝখানের এই বছরগুলো কিছুতেই মুছে ফেলা যায় না? সেই যেদিননতুন দৃষ্টি নিয়ে প্রথম তাকিয়েছিলাম পৃথিবীর দিকে–যেদিন জীবনের কোনো জটিলতা ছিল না, কোনো সমস্যা ছিল নাখন মান-অপমানের প্রশ্ন নিয়ে সব কিছুকে বিচার করতে বসতে হত না!

হায়, তাপসী কেন কিছুই বলিতে পারে না? . সমস্ত ভাল ভাল কথাগুলো বুলুই বলিয়া লইবে? সে কথা কি তাপসীও ভাবিতেছে না? তবু নিজেকে ধরা দিবার একান্ত বাসনাকে গলা টিপিয়া মারিয়া, নিজের মনকে যাচাই করিতে হইতেছে তাহাকে–এ ব্যক্তি যদি কিরীটী না হইয়া কেবলমাত্র বুলু’ হইত, কি করিত সে? স্বামী বলিয়া বিনা দ্বিধায় সমর্পণের মন্ত্র পড়িতে পারিত?

কিন্তু এ কথাও কি বলা যায় না–কিরীটীকে দেখিবামাত্র সমস্ত প্রাণ যে তাহার কাছে আছড়াইয়া পড়িতে চাহিত, সে বুলু’ বলিয়াই। কই, আর কবে কাহার উপর এ আকর্ষণ অনুভব করিয়াছে তাপসী?…অথচ এ-হেন অলৌকিক কথা কে বিশ্বাস করিবে? বিশ্বাস করিবার মত কথা কি?

বুলু বোধ করি কোনো একটু উত্তরের আশায় মিনিটখানেক চুপ করিয়া থাকিয়া বলে–আমি তোমাকে বুঝতে পারছি তাপসী, মনকে প্রস্তুত করে নেবার অবসর পাওনি তুমি। অপেক্ষা করে থাকব সেই আশায়। কিন্তু চলো তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসি। নানি হয়তো খুঁজবেন, নাটমন্দিরে বসে রয়েছেন।

নানি! ও তাই তো! তাপসী তো এখানে হঠাৎ আকাশ হইতে আসিয়া পড়ে নাই! আশ্চর্য, কিছুই মনে ছিল না!

বুলু উঠিতে বলিলে কি হইবে, তাপসীর কি উঠিবার ক্ষমতা আছে? উঠিয়া পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ই যে এই স্বর্গসুখ চিরদিনের মত ফুরাইয়া যাইবে! সত্যই যদি এমনই বসিয়া থাকা যাইত! অনন্ত দিন–অনন্ত রাত্রি।

বুলু আবার হঠাৎ একটু হাসিয়া উঠিয়া বলে–হঠাৎ যদি কেউ দেখে ফেলে কি ভাববে বলল দেখি? পারলে না বলতে? ভাববে সদ্য বিয়ের বর-কনে! তোমার শাড়ীটা ঠিক নূতন কনের মত–আর আমি–আমি তো বল্লভজীর বেগার খাটতে বরসজ্জা করেই বসে আছি। লোকে হয়তো ভাববে দু’জনে বাসর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে একটু নির্জন অবসরের আশায়, তাই না? মনে হচ্ছে যেন ঠিক অবিকল এই রকম শাড়ীতেই প্রথম দেখেছিলাম তোমায়। ওই কলকাতার বাড়ীতে তো কোনদিন এমন অপূর্ব মূর্তি নিয়ে দেখা দাওনি তাপসী! এ যেন এখানকার তুমি!

এত কথার উত্তরে তাপসী শুধু বলে–সেই শাড়ীটাই।

–সত্যি? আশ্চর্য তো! এখনও রয়েছে? এতদিন পরে আবার হঠাৎ এইখানেই আজ তোমার পরতে ইচ্ছা হল? সবটাই আশ্চর্য!

এবারে তাপসী মুখ তুলিয়া বড় স্পষ্ট করিয়া তাকায়। ম্লান হাসির সঙ্গে বলে–আমার জীবনের তো সবটাই আশ্চর্য! চলুন–কবে ফিরবেন কলকাতায়?

–ফেরবার দিনের প্রোগ্রাম যা কিছু ছিল, সবই তো বাতিল হয়ে গেল। পরে ভেবেছিলাম আজই চলে যাব, তাও ইচ্ছে হচ্ছে না। এই দেশটায় তুমি আছ ভাবতেও ভালো লাগে। একটু থামিয়া সামান্য হাসিয়া বলে–ফেরার সময়কার ছবিটা সম্বন্ধে কত কল্পনাই করেছিলাম বোকার মত!

সহসা আবার একটা আকস্মিক ভূমিকম্পের প্রবল আলোড়নে যত্নে-গঠিত অভিযানের প্রাসাদ বিদীর্ণ হইয়া গেল নাকি? নাকি স্বর্গচ্যুত হইবার আশঙ্কায় এতক্ষণে হুঁশ হইল তাপসীর? তাই পাতাল-প্রবেশের পরিবর্তে স্বৰ্গকে দুই হাতে আঁকড়াইয়া আগলাইতে চায়?

–কেন তবে সে ছবি ছিঁড়ে ফেলবে? কেড়ে নিয়ে যেতে পারো না? পারো না জোর করতে? সব দায়িত্ব আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে ফিরে যাবে?

–তাপসী! তাপসী! অজন্তার শিল্পছাঁদে গঠিত ওষ্ঠাধরযুগল নামিয়া আসিয়াছে, অর্ধচন্দ্রের ছাঁদে গড়া শুভ্র একখানি ললাটের উপর।

–তাপসী, এ সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারব তো? এ আমার কল্পনার ছলনা নয় তো?

আকাঙ্ক্ষিত নিতান্ত পীড়নে নিপীড়িত হইয়া অশ্রু-ছলছল চোখে হাসিয়া ফেলে তাপসী। হাসিয়া বলেউঃ, অত বেশী জোর করতে বলিনি তা বলে!

–ইস্ খুব লেগেছে। আমি একটা বুনোহঠাৎ সৌভাগ্যের আশায় দিশেহারা হয়ে ওজন রাখতে পারিনি। আচ্ছা ছেড়ে দিলাম–দেখি তো–তাকাও না একটু, শুভদৃষ্টির সময় তাকিয়ে দেখনি বলেই না এত বিপত্তি! কি হল আবার? মুখে মেঘ নামছে কেন?

–না, ভাবছি–ভাবছি তুমি যদি তুমি না হয়ে কেবলমাত্র ‘বুলু’ হতে, কি হতো!

–কিরীটী গভীর সুরে বলে–প্রায় এই রকমই হত তাপসী। হয়তো কেবলমাত্র ‘বুলু’ আমার চাইতে একটু কম বেহায়া হত। কিন্তু আমার ক্যাপাসিটি তো বারেবারেই প্রমাণ হয়ে গেছে, গৌরব যা কিছু বুলুরই। আমার ভাগ্যে বিয়ের ভয়ে বৌ পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। সত্যি তাপসী, যেদিন সেই উৎসব-বাড়ী থেকে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে তুমি, সেদিন যে কি অদ্ভুত অবস্থা আমার! তবু ভেবে ভেবে মনকে ঠিক দিলাম–আমার প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ রীতিমত প্রবল! তোমার মানসিক দ্বন্দ্বের ছবি চোখ এড়ায়নি–সে সময় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম যে তবু ভাল, ছদ্মবেশের আড়ালেই আছি। শুধু প্রার্থীর পক্ষে প্রত্যাখ্যান বরং সহনীয়, দাবীদারের পক্ষে বেজায় অপমান নয় কি? হায় হায়, তখন কি জানি আমার সেই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেউ নয়–দুগ্ধপোষ্য বুলু! জানলে এইরকম জোর করে ধরে শুনিয়ে ছাড়তাম ‘হতভাগ্য কিরীটীই সেই ভাগ্যবান বুলু’! আবার যেদিন হঠাৎ কলকাতার বাড়ীতে পিসিমার চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অমিতাভ গিয়ে জানালে–দেশের বাড়ীতে নানি এসেছে তোমাকে নিয়ে, কি জানি কেন আনন্দে অধীর হয়ে উঠলাম! মনে হল তোমাকে পেয়েই গেলাম বুঝিবা! শেষে আবার কি যে হল–

তাপসী মৃদু হাসির মাধ্যমে বলে–দুর্লভ বস্তু অত সহজে পাওয়া যায় না!

–ঠিক বলেছ তাপসী, খুব সত্যি। তাই এত কষ্ট, এত আয়োজনের দরকার ছিল। চলো দু’জনে গিয়ে প্রণাম করিগে তাকে, যিনি অনেক বুদ্ধি খাঁটিয়ে এমন নিখুঁত আয়োজনটি সম্ভব করেছেন।

সদ্যোলব্ধ সৌভাগ্যে বিভোর তাপসী সচকিত প্রশ্ন করে কাকে? কে?

–কেন, আমাদের বল্লভজী! পাকা খেলোয়াড় হয়েও হঠাৎ বেজায় একটা ভুল চাল’ দিয়ে ফেলে ভারী বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক! শোধরাতে এক যুগ লেগে গেল বেচারার! মাত হতেই বসেছিলেন প্রায়!

.

কথার মাঝখানে হঠাৎ সচকিত বুলু কাহাকে যেন দেখিয়া ঈষৎ অপ্রতিভ হাস্যে খানিকটা সরিয়া দাঁড়ায়।

দালানের সারি সারি খিলানের একটা থামের পাশে হেমপ্রভা দাঁড়াইয়া। কখন যে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন, এরা টেরও পায় নাই–পাইবার কথাও অবশ্য নয়।

বুলু তো সরিয়া দাঁড়াইয়া তার লাজুক মুখে অপ্রতিভ হাসি মাখাইয়া মুখরক্ষা করিল–কিন্তু তাপসী? নানির সামনে ধরা পড়িয়া যাওয়ায়, লজ্জায় আরক্তিম মুখখানা লুকাইবার মত জায়গার অভাবেই বোধ করি সরিয়া আসিয়া নানির কাঁধেই মুখটা চাপিয়া ধরে। তেমনি মুখ চাপিয়া বলিয়া ফেলে–আবেগবিহ্বল অর্থহীন অস্ফুট একটা কথা-নানি, নানি, কেন তুমি–

হেমপ্রভারও কি কথা বলিবার অবস্থা আছে? কিংবা হেমপ্রভা বলিয়াই আছে, তাই কণ্ঠ। পরিষ্কার করিয়া প্রায় হাসির সঙ্গে বলেন–কি আমি? কেন–কেন আড়ি পাতছি?

–ধ্যেৎ যাও!

–হ্যাঁ, যাব। এইবার যাব। এতদিনে ছুটি দিলেন বিশ্বনাথ, এইবার বড় শান্তি নিয়ে তার রাজ্যে ফিরে যাব। মুখ তো দিদি,বুলু এসো ভাই, কাছে এসো। চোখ ভরে একবার একসঙ্গে দেখি দু’জনকে। বৃথা অভিমানে এতদিন তার নামে কত কলঙ্ক দিয়ে এসেছি, আজ বুঝলাম এতটাই দরকার ছিল। যে বস্তু সহজে মেলে তার মূল্য বোঝা যায় না। ধরা যায় না খাঁটি ও অ-খাঁটি। কি জ্বালা, এ মেয়েটা মুখ তোলে না! কেন গা? ঘাড় ব্যথা হয়ে গেল যে আমার? ঠাকুর-মন্দিরে বসে থেকে থেকে ভেবে বাঁচি না নাতনী আমার গেল কোথায়! কাঠের ঘোড়া পক্ষীরাজ হয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেল নাকি! অধৈর্য হয়ে উঠে এলাম। নাও, এখন দু’জনে মনে মনে যত খুশি গাল দাও বুড়ীকে!

1 Comment
Collapse Comments
আরজু প‌নি July 28, 2021 at 3:12 pm

খুব সুন্দর।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *