অষ্টম পরিচ্ছেদ
ভক্তিযোগের গূঢ় রহস্য — জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয়
[মুখুজ্জে, হরিবাবু, পূর্ণ, নিরঞ্জন, মাস্টার, বলরাম ]
মুখুজ্জে — হরি (বাগবাজারের হরিবাবু) আপনার কালকের কথা শুনে অবাক্! বলে, ‘সাংখ্যদর্শনে, পাতঞ্জলে, বেদান্তে — ও-সব কথা আছে। ইনি সামান্য নন।’
শ্রীরামকৃষ্ণ — কই, আমি সাংখ্য, বেদান্ত পড়ি নাই।
“পূর্ণজ্ঞান আর পূর্ণভক্তি একই। ‘নেতি’ ‘নেতি’ করে বিচারের শেষ হলে, ব্রহ্মজ্ঞান। — তারপর যা ত্যাগ করে গিছিল, তাই আবার গ্রহণ। ছাদে উঠবার সময় সাবধানে উঠতে হয়। তারপর দেখে যে, ছাদও যে জিনিসে — ইট-চুন-সুরকি — সিঁড়িও সেই জিনিসে তৈয়ারী!
“যার উচ্চ বোধ আছে, তার নিচু বোধ আছে। জ্ঞানের পর, উপর নিচে এক বোধ হয়।
“প্রহ্লাদের যখন তত্ত্বজ্ঞান হত, ‘সোঽহম্’ হয়ে থাকতেন। যখন দেহবুদ্ধি আসত ‘দাসোঽহম্’, ‘আমি তোমার দাস’, এই ভাব আসত।
“হনুমানের কখনও ‘সোঽহম্’, কখন ‘দাস আমি’, কখন ‘আমি তোমার অংশ’, এই ভাব আসত।
“কেন ভক্তি নিয়ে থাকো? — তা না হলে মানুষ কি নিয়ে থাকে! কি নিয়ে দিন কাটায়।
“‘আমি’ তো যাবার নয়, ‘আমি’ ঘট থাকতে সোঽহম্ হয় না। সমাধিস্থ হলে ‘আমি’ পুছে যায়, — তখন যা আছে তাই। রামপ্রসাদ বলে, তারপর আমি ভাল কি তুমি ভাল, তা তুমিই জানবে।
“যতক্ষণ ‘আমি’ রয়েছে ততক্ষণ ভক্তের মতো থাকাই ভাল! ‘আমি ভগবান’ এটি ভাল না। হে জীব, ভক্তবৎ এটি ভাল না। হে জীব, ভক্তবৎ ন চ কৃষ্ণবৎ! — তবে যদি নিজে টেনে লন, তবে আলাদা কথা। যেমন মনিব চাকরকে ভালবেসে বলছে, আয় আয় কাছে বোস আমিও যা তুইও তা। গঙ্গারই ঢেউ, ঢেউয়ের গঙ্গা হয় না!
“শিবের দুই অবস্থা। যখন আত্মারাম তখন সোঽহম্ অবস্থা, — যোগেতে সব স্থির। যখন ‘আমি’ একটি আলাদা বোধ থাকে তখন ‘রাম! রাম!’ করে নৃত্য।
“যাঁর অটল আছে, তাঁর টলও আছে।
“এই তুমি স্থির। আবার তুমিই কিছুক্ষণ পরে কাজ করবে।
“জ্ঞান আর ভক্তি একই জিনিস। — তবে একজন বলছে ‘জল’, আর-একজন ‘জলের খানিকটা চাপ’।”
[দুই সমাধি — সমাধি প্রতিবন্ধক — কামিনী-কাঞ্চন ]
“সমাধি মোটামুটি দুইরকম। — জ্ঞানের পথে, বিচার করতে করতে অহং নাশের পর যে সমাধি, তাকে স্থিতসমাধি বা জড়সমাধি (নির্বিকল্পসমাধি) বলে। ভক্তিপথের সমাধিকে ভাবসমাধি বলে। এতে সম্ভোগের জন্য, আস্বাদনের জন্য, রেখার মতো একটু অহং থাকে। কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি থাকলে এ-সব ধারণা হয় না।
“কেদারকে বললুম, কামিনী-কাঞ্চনে মন থাকলে হবে না। ইচ্ছা হল, একবার তার বুকে হাত বুলিয়ে দি, — কিন্তু পারলাম না। ভিতরে অঙ্কট-বঙ্কট। ঘরে বিষ্ঠার গন্ধ, ঢুকতে পারলাম না। যেমন স্বয়ম্ভু লিঙ্গ কাশী পর্যন্ত জড়। সংসারে আসক্তি, — কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি, — থাকলে হবে না।
“ছোকরাদের ভিতর এখনও কামিনী-কাঞ্চন ঢোকে নাই; তাইতো ওদের অত ভালবাসি। হাজরা বলে, ‘ধনীর ছেলে দেখে, সুন্দর ছেলে দেখে, — তুমি ভালবাস’। তা যদি হয়, হরিশ, নোটো, নরেন্দ্র — এদের ভালবাসি কেন? নরেন্দ্রের ভাত নুন দে খাবার পয়সা জোটে না।
“ছোকরাদের ভিতর বিষয়বুদ্ধি এখনও ঢোকে নাই। তাই অন্তর অত শুদ্ধ।
“আর অনেকেই নিত্যসিদ্ধ। জন্ম থেকেই ঈশ্বরের দিকে টান। যেমন বাগান একটা কিনেছ। পরিষ্কার করতে করতে এক জায়গায় বসানো জলের কল পাওয়া গেল। একবারে জল কলকল করে বেরুচ্ছে।”
[পূর্ণ ও নিরঞ্জন — মাতৃসেবা — বৈষ্ণবদের মহোৎসবের ভাব ]
বলরাম — মহাশয়, সংসার মিথ্যা, একবারে জ্ঞান, পূর্ণের কেমন করে হল?
শ্রীরামকৃষ্ণ — জন্মান্তরীণ। পূর্ব পূর্ব জন্মে সব করা আছে। শরীরটাই ছোট হয়ে আবার বৃদ্ধ হয় — আত্মা সেইরূপ নয়।
“ওদের কেমন জান, — ফল আগে তারপর ফুল। আগে দর্শন, — তারপর গুণ-মহিমাশ্রবণ, তারপর মিলন!
“নিরঞ্জনকে দেখ — লেনাদেনা নাই। — যখন ডাক পড়বে যেতে পারবে। তবে যতক্ষণ মা আছে, মাকে দেখতে হবে। আমি মাকে ফুল চন্দন দিয়ে পূজা করতাম। সেই জগতের মা-ই মা হয়ে এসেছেন। তাই কারু শ্রাদ্ধ, — শেষে ঈষ্টের পূজা হয়ে পড়ে। কেউ মরে গেলে বৈষ্ণবদের মহোৎসব হয়, তারও এই ভাব।
“যতক্ষণ নিজের শরীরের খপর আছে ততক্ষণ মার খপর নিতে হবে। তাই হাজরাকে বলি, নিজের কাশি হলে মিছরি মরিচ করতে হয়, মরিচ-লবণের যোগাড় করতে হয়; যতক্ষণ এ-সব করতে হয়, ততক্ষণ মার খপরও নিতে হয়।
“তবে যখন নিজের শরীরের খপর নিতে পাচ্ছি না, — তখন অন্য কথা। তখন ঈশ্বরই সব ভার লন।
“নাবালক নিজের ভার নিতে পারে না। তাই তার অছি (Guardian) হয়। নাবালকের অবস্থা — যেমন চৈতন্যদেবের অবস্থা।”
মাস্টার গঙ্গাস্নান করিতে গেলেন।