সারাদিন ধরে একটা গানের কলি মনের মধ্যে ঘুরছে। এক এক দিন হয় এ রকম। কোথা থেকে চলে আসে একটা গান, তারপর ভোমরার মতন ঘুরতেই থাকে, অন্য কোনও গানকে আর কাছে আসতে দেয় না। সংসারে শত কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও সেই গান ঠিক খুঁটি ধরে বসে থাকে, স্নানের সময় জলের ধারাপাতেও শোনা যায় সেই সুর, এমনকী রান্নাঘরের ছ্যাঁকছ্যাঁকানি শব্দের মধ্যেও সেই গান গুঞ্জরিত হয়।
নয়নমণি গানটি শুনেছিল তিন দিন আগে। যাদুগোপালের বাড়িতে ওদের দশম বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাকে যেতে হয়েছিল। নয়নমণি থিয়েটারের নটী, তার মানে মেয়েদের কোনও সামাজিক জীবন থাকতে নেই। সমাজের সব স্তরের মানুষ থিয়েটার দেখতে আসে, নট-নটীদের অভিনয়-ছলাকলা দেখে মুগ্ধ হয়, হাততালি দেয়, কিন্তু কেউ তাদের বাড়িতে ডাকে না। বিলাসী ধনীরা সুন্দরী নটীদের রক্ষিতা রাখতে চায়, উৎসবে-অনুষ্ঠানে কোনও নৃত্যগীত পটিয়সীকে মুজরো দিয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু বিয়ে-শ্রাদ্ধ-অন্নপ্রাশনে আর পাচক্ষনের মত নিমন্ত্রণ করে পঙক্তিভোজে কিছুতেই বসাবে না। নয়নমণি সেই যে প্রথমেই প্রতিজ্ঞা করেছিল, মঞ্চের বাইরে আর কোথাও সে কারুকে নাচ দেখাবে না, গান শোনাবে না, সে প্রতিজ্ঞা এখনও অক্ষুণ্ন রেখেছে, তাকে মুজরো দেবার কথা বলতেও কেউ সাহস করে না।
কিন্তু যাদুগোপালের পরিবারের সঙ্গে তার প্রায় আত্মীয়তার বন্ধন স্থাপিত হয়ে গেছে। সেখানে তাকে মাঝে মাঝে যেতেই হয়। ওরা সমাজের অনেক রীতিনীতির তোয়াক্কা করে না, নয়নমণিকে ওরা নাচ গানের জন্যও ডাকে না, অন্যান্য আমন্ত্রিতদের মতনই এক টেবিলে খানা খেতে বসায়, সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় সুনেত্রা নয়নমণির হাত ধরে বলে, আমি বকুল ফুল পাতিয়েছি।
বিবাহ, শ্রাদ্ধ, অন্নপ্রাশন ছাড়াও আরও নানারকম অনুষ্ঠান হয় যাদুগোপালদের বাড়িতে। প্রত্যেক ছেলেমেয়ের জন্মদিন পালন করে, স্বামী-স্ত্রীর বিবাহবার্ষিকীর দিনটিতে আত্মীয় বন্ধুদের ডেকে সবাই মিলে গান-বাজনায় মেতে ওঠে, অনেক খাওয়া-দাওয়া হয়। এই সব অনুষ্ঠানের কথা নয়নমণি আগে কখনও শোনেইনি।
দোতলার বড় হল ঘরটিতে কার্পেট পাতা হয়েছিল সেদিন। যাদুগোপাল আদালতে যায়নি, মক্কেলদেরও বাড়িতে আসতে মানা করে দেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য দিন যাদুগোপালকে সাহেবি পোশাক ছাড়া দেখাই যায় না, সেদিন পরেছিল কোচানো ধুতি আর সিঙ্কের কুর্তা, হাতে জড়ানো গোড়ের মালা। জনা চল্লিশেক অতিথি, তাদের সাজ-পোশাক দেখলে চোখ ধাধিয়ে যায়। বোঝাই যায় যে, তারা সমাজের ওপর মহলের মানুষ। নয়নমণি গিয়েছিল একটা গরদের শাড়ি পরে, মঞ্চের বাইরে সে শরীরে কোনও অলঙ্কার ধারণ করে না।
সবাই সে কার্পেটের ওপর বসেছিল গোল হয়ে, তারপর দুঘন্টা ধরে চলেছিল গান ও কাব্যপাঠ। বড় ভাল লেগেছিল নয়নমণির, যেন সর্ব সঙ্গ দিয়ে সে সেই ভাল-লাগা অনুভব করেছিল। সে যে একজন থিয়েটারের অভিনেত্রী তা নিশ্চয়ই চিনেছি অনেক, কিন্তু কেউ কোন ভাবান্তর দেখায়নি, সহজ সুরে কথা বলেছে তার সঙ্গে। গান-কবিতার ফাঁকে ফাঁকে রঙ্গ-রসিকতাও করছিল কেউ কেউ, কিন্তু সবই উঁচু তারে বাঁধ, স্থূল রুচির কোনও চিহ্ন ছিল না। যাদুগোপালের অনুরোধে নয়নমণিও গান গেয়েছিল, থিয়েটারের গান নয়, তার পূর্ব জীবনে শেখা জয়দেবের গীতগোবিন্দের পদ, সবাই খুব তারিফ করেছিল।
সেই আসরে একটি চোদ্দ-পনেরো বছরের কিশোরীর দুটি গান সবচেয়ে ভাল লেগেছিল নয়নমণির। কিশোরীটির যেমন অপরূপ মুখের লাবণ্য, তেমনই তার বীণা-নিন্দিত কণ্ঠস্বর। যে কোনও গান একবার শুনলেই তুলে নিতে পারে নয়নমণি। এই গানটির সুর তেমন কঠিন কিছু নয়, অনেকটা কীর্তনাঙ্গের।
নয়ন তোমারে
পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে…
এই গানটি বেশ বড়, পরের কথাগুলি নয়নমণির মনে নেই। দ্বিতীয় গানটি ছোট, অনবদ্য, যেন একটি হিরের টুকরো। এরকম গান জীবনে শোনেনি নয়নমণি। খেয়াল-ঠুংরি মতন নয়, তাল নেই, অন্তরা নেই, মাত্রা চারটি পঙক্তি, যেন কারুর হৃদয়ের ব্যাকুল আর্তি মিশে আছে সুরের ঝরণাধারায়
বঁধূ,
তোমায় করব রাজা তরুতলে
বনফুলের বিনোদমালা দেব গলে।
সিংহাসনে বসাইতে হৃদয়খানি দেব পেতে,
অভিষেক করব তোমায় আঁখিজলে।
শুনতে শুনতে চোখ বুজে গিয়েছিল নয়নমণির, সে একটু একটু দুলছিল। তার মনে হচ্ছিল, এরকম একটি গানের তুলনায় আর সব কিছু তুচ্ছ। কেউ যদি বলে, তোমার যাবতীয় বিষয়-সম্পত্তি, টাকা পয়সা সব কিছু নিতে পারো এই গানের বিনিময়ে, সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাবে।
এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল গানটি! আর নেই? সে সহজভাবে চেয়ে রইল কিশোরীটির দিকে। কিশোরীটি তানপুরা সরিয়ে রাখল, আর গাইবে না। নয়নমণি তার পাশে বসা সুনেত্রাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, এই গান কে রচেছেন?
সুনেত্রা বলল, প্রথমটা তো জানি, দ্বিতীয়টা আমি আগে শুনিনি। কী জানি, জ্যোতিকাকার নাকি! এটা কার রে মণি?
কিশোরটি বলল দুটোই রবিকাকার।
সুনেত্রা বলল, আমাদের রবিকাকা কে জানে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নাম করা কবি। নিজেদের কাকা বলে বলছি না, কবিবর নবীনচন্দ্র সেনও ওঁর প্রশংসা করেছেন। তুমি হয়তো ওঁর নাম শোনোনি, তোমাদের থিয়েটারে কিন্তু ওঁর একখানা নাটক চলেছিল কিছু দিন।
নয়নমণির মুখমণ্ডলে এক ঝলক রক্ত এসে গেল। রবীন্দ্রবাবুকে কি তাকে চেনাতে হবে? সে এর মধ্যে ওঁর সব বই পড়ে ফেলেছে, ওর নাম শোনা মাত্র চোখের সামনে ভেসে উঠেছে, সেই দেবদুর্লভ কাক্তি। তিনি নয়নমণির আরাধ্য দেবতা। নয়নমণি এর মধ্যে নিজের নাম না দিয়ে কত চিঠি লিখেছে তাঁকে।
নয়নমণি মুখ নিচু করে রইল একটুক্ষণ। তার মনের মধ্যে এখন কী যে চলছে, কী প্রণয়ানুভূতির আলোড়ন, তা কেউ বুঝে ফেলবে না তো!
একটু পরে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ওঁর গান কে শেখান?
সুনেত্রা বলল, উনি নিজেই শেখান। একটা গান লিখে, সুর বসিয়ে রবিকাকা কাছাকাছি যাকে পান তাকে শিখিয়ে দেন। প্রতিভাদিদি, সরলাদিদি, ইন্দিরাদিদি এরা অনেক গান সঞ্চয় করে রেখেছেন। ব্রাহ্মসমাজের অনেককেও রবিকাকা নিজের গান শিখিয়েছেন। এর বাইরে আর তো বিশেষ কেউ ওঁর গান জানে না। রবিকাকার গানের মজা কী জানো, উনি পত্র-পত্রিকায় গানগুলোকে কবিতা হিসেবে ছাপিয়ে দেন, সেগুলোর যে সুর আছে তা পাঠকরা বুঝতে পারে না। আমি জানি, নিজেদের মধ্যে আনন্দ করে গাই।
নয়নমণি বলল, যারা এই গান শোনে না, তারা যে কত বঞ্চিত হয়ে রইল!
সুনেত্রা একটুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল নয়নমণির দিকে। তারপর ভেতর থেকে কেউ ডাকাডাকি করতে সে উঠে গেল, আর কথা হল না।
এর পর দু দিন দুপুর থেকে রাত নটা পর্যন্ত টানা রিহার্সাল ছিল বলে ওই গানের কথা নয়নমণির আর মনে আসেনি। আজ সকাল থেকে প্রথম গানটি তাকে পেয়ে বসেছে। নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে নয়ন মানে কার নয়ন? নয়নমণির নয়ন, তার দেখা না পেলেও তিনি যে রয়ে গেছেন নয়নমণিরই নয়নে নয়নে। তিনি নয়নমণির হৃদয়ে এত গোপনে রয়েছেন যে তিনি নিজেও তা জানেন না।
গানের বাকি কথাগুলি মনে নেই। দুটি পঙক্তিই ঘুরে ঘুরে আসছে।
পরের গানটা মনে পড়ছে না কেন? বঁধু, তোমায় করব রাজা, তারপর, তার পর, যে গানটি সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছিল, সেটাই মনে নেই! মনের এ কী বিচিত্র স্বভাব? সুরটা অস্পষ্ট মনে আসছে, অথচ বাণী হারিয়ে গেছে, বিস্মৃতির গহন থেকে সেই বাণীকে ফিরিয়ে আনবার জন্য আকুলি-বিকুলি করছে নয়নমণি।
আজও রিহার্সালে যাবার কথা, একটু পরে গাড়ি আসবে, কিন্তু নয়নমণির একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না। ওই গানের জন্য নয়নমণি থিয়েটার ছেড়ে দিতেও পারে।
ব্রাহ্মরা রবিবাবুর গান জানে। নয়নমণি সে রকম ব্রাহ্ম পাবে কোথায়, থিয়েটারের সংস্রবে ব্রাহ্মরা আসে না। অজানা-অচেনা কোনও পুরুষের কাছে গান শিখতেও যাবে না নয়নমণি। স্বয়ং রবিবাবুর কাছাকাছি সে কোনও দিনই যেতে পারবে না। যাদুগোপালের বাড়িতে মণি নামে যে কিশোরীটি গান শোনাল, তার কাছে শেখা যায় না? তোক না সে অল্পবয়সী, তবু তার কাছ থেকে গান তুলে নিতে নয়নমণির কোনও লজ্জা নেই। সেদিন ওই গান দুটি শোনার পর অন্য সব গান নয়নমণির কাছে অকিঞ্চিৎকর হয়ে গেছে।
যাদুগোপালের বাড়িতে নয়নমণি নিজে থেকে কখনও যায় না। উৎসব-অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সুনেত্রা লোক পাঠায়। না, হুট করে অযাচিতভাবে যাওয়া চলে না। যাদুগোপাল ব্যস্ত মানুষ, তিনি বিরক্ত বোধ করতে পারেন। যাদুগোপাল অবশ্য সব সময়ই নয়নমণির সঙ্গে সহৃদয় ব্যবহার করেন, বরং তার ব্যবহারে নয়নমণিই মাঝে মাঝে বিব্রত বোধ করে। নয়নমণিকে দেখলেই কোনও না কোনও প্রসঙ্গে ভরতের নাম উচ্চারণ করেন যাদুগোপাল, যেন নয়নমণি তার চোখে এখনও ভূমিসূতা, এবং তার বন্ধুর পত্নী। ছি ছি ছি। ভরত যে ভূমিসূতাকে প্রত্যাখ্যান করে চলে গেছে, তা কেউ জানে না। সে কথা কি কারুকে জানানো যায়! সেই গ্লানির বোঝা নিয়ে ভূমিসূতা বাঁচত কী করে! তাই ভূমিসূতাকে মুছে ফেলে সে এখন নয়নমণি হয়েছে। এখন ভরত তার কেউ না!
মণি নামের ওই কিশোরীটি কি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেই থাকে? সেখানে কি নয়নমণির মতন এক থিয়েটারের নটীর প্রবেশ অধিকার আছে? হায় রে দুরাশা! সবাই জানে, থিয়েটারের নটী মানেই কলঙ্কিনী। নামের সঙ্গেই উল্কি দাগা আছে। এ জীবনে নয়নমণির আর সেই কলঙ্ক ঘুচবে না। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দেউড়ি সে পার হতে পারবে না কখনও। সারা শরীর ভরে সে অনুভব করতে লাগল সেই গানের তৃষ্ণা।
শরীর খারাপ বলে সে রিহার্সালে যাবে না জানিয়ে গাড়ি ফিরিয়ে দিল, সেই গাড়িতে আবার স্বয়ং নেপা বোস এল তাকে নিতে। লাল-নীল-হলুদ রং মেশানো সঙের মতন পোশাক পরা নেপা বোস হাত-পা নেড়ে বলল, তুই কি পাগল হয়েছিস নয়ন? আর তিনদিন বাদে নতুন প্লে নামবে। তুই মহড়ায় যাবিনি? সবাই হাঁ করে বসে আছে। কীসের শরীর খারাপ তোর? গিরিশবাবু কতবার এক গা জুর নিয়ে স্টেজে নেমেছেন। কুসুমকুমারীর সেই যে পা মচকে গেল মনে নেই? ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে পার্ট করতে পারবে না বলে কেঁদে ফেলেছিল। কেলোবাবু তবু কি তাকে ছেড়েছিল? ডায়ালগের মধ্যে তার পা মচকাবার কথা জুড়ে দিল, ব্যাস, বেশ রিয়েলিস্টিক হয়ে গেল! তোর এমন কী হয়েছে? থিয়েটার থেকে ছুটি নেবার দুটোই মাত্র উপায়, যখন দর্শক ছ্যা ছা করবে, আর যখন যমদূত এসে ডেকে নেবে। চ, শিগগির তৈরি হয়ে নে!
অগত্যা যেতেই হল নয়নমণিকে! মহড়ায় একবার জুড়ে গেলে মন খারাপের অবকাশ থাকে না। ক্লাসিকে এখন চলছে ‘দেলদার’ নাটক, শীঘ্র শুরু হবে বঙ্কিমবাবুর ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ অবলম্বনে ‘ভ্রমর’। নাট্যরূপ নিয়েছে অমর দত্ত নিজে। দত্ত বাড়ির এই বয়াটে ছেলেটির যে এত গুণ তা কে জানত। ভাল অভিনয় করে, জোরালো কন্ঠস্বর, চেহারা সুন্দর, এসব ছাড়া সে নাটকও লিখতে পারে। ‘ভ্রমর’ নাটকে সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হবে, ঘোড়ায় চড়ে মঞ্চে আসবে অমরেন্দ্রনাথ, বারুণী দিঘিতে নিমজ্জমানা রোহিণীকে সে উদ্ধার করবে!
অমল দত্তর সঙ্গে নয়নমণির বেশ একটা খেলা চলছে। অভিনেতা ও থিয়েটাৱের ম্যানেজার হিসেবে অমরেন্দ্রনাথ মহড়ার সময় কিংবা মঞ্চে সংযত থাকে। কিন্তু ছুটির দিনে তার উচ্ছৃঙ্খলতা সব মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। যেন একই মানুষের দুটি সম্পূর্ণ আলাদা রূপ। মানিকতলার বাগানবাড়িতে নেশায় উন্মত্ত হয়ে, চক্ষু লাল করে বিকৃত কণ্ঠে সে যখন রাশি রাশি অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করে, তখনই বিশ্বাসই করা যায় না যে, এই মানুষটিই আদর্শ নায়ক রূপে মঞ্চের পাদপ্রদীপের সামনে দাঁড়িয়ে। হাজার হাজার দর্শকের চিত্ত জয় করতে পারে। অমরেন্দ্রনাথ নিজেই বলে যে মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল না হয়ে গেলে তার মাথায় সৃষ্টি ক্ষমতা ঠিক বিকশিত হয় না।
যে-সব দিন থিয়েটার বন্ধ থাকে, সে সব দিনে এক একটি অভিনেত্রীকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলাও তার শখ। অনেক মেয়েই তাতে স্বেচ্ছায় রাজি হয়, যাদের তেমন ইচ্ছে থাকে না তারাও অমরেন্দ্রনাথের দাপটের ভয়ে রাজি হয়ে যায়। একমাত্র নয়নমণিকেই সে আজও বাগে আনতে পারেনি, এই পরাজয়টা সে মেনে নিতে পারছে না। নয়নমণি জানিয়ে দিয়েছে, সে আর কোনও দিনই মানিকতলার বাগানবাড়িতে মহড়া দিতে যাবে না। নয়নমণিকে জব্দ করার কোনও উপায়ই খুজে পাচ্ছে না অমরেন্দ্রনাথ। এ মেয়েকে থিয়েটার থেকে তাড়িয়ে দেবার হুমকি দেখিয়েও কোনও লাভ নেই। যে-কোনও দিন সে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতে রাজি। টাকা-পয়সার লোভ দেখালে সে ঠোঁট বাঁকায়, স্বর্ণালঙ্কার দিতে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কী চায় এই মেয়ে, কীসে সে আকৃষ্ট হবে, তা বোঝা যায না কিছুতেই।
জোর-জুলুম করার বদলে কাকুতি-মিনতিও করেছে অমরেন্দ্রনাথ, তাতেও কোনও ফল হয়নি। সে বলেছিল, নয়ন, মা কালীর দিব্যি করে বলছি, তোর গায়ে আমি হাতও ছোঁয়াব না। তুই শুধু আমাকে এক সন্ধ্যেবেলা একা একা নাচ দেখাবি, ব্যস, আর কিছু না।
নয়নমণি বলেছিল, অর্থাৎ তুমি সবাইকে জানাতে চাও, আমিও অন্যদের মতন একা একা তোমার বাগানবাড়িতে গেছি, তাই না? নইলে, আমার নাচ তো স্টেজেই তুমি কতবার দেখেছ!
অমরেন্দ্র নাথ বলেছিল, স্টেজের নাচ আর একা একা নাচ কখনও এক হয়? আমি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে ব্র্যান্ডি পান করব, আর তুই একা আমার জন্য শুধু নাচবি, দেখতে দেখতে আমার চক্ষে ঘোর লাগবে, তারপর আমি অজ্ঞান হয়ে যাব, আহা, সেই বেশ মজা হবে।
নয়নমণি বলেছিল, কেন এই কথা বার বার বলো? অন্যরা তোমায় নাচ দেখায়, তাতে তোমার সাধ মেটে না? আমি তো বলেইছি, আমার শপথ আছে, আমি কখনও বাইজিদের মতন নাচ-গান করব না। আমি নাচ দেখাতে পারি শুধু আমার প্রাণের ঠাকুণকে আর আমার মনের মানুষকে। আমার ঘরে কেষ্টঠাকুরের একটা মূর্তি আছে, সেই মূর্তির সামনে আমি রোজ নাচি।
অমরেন্দ্রনাথ বলেছিল, তা নাচিস, বেশ করিস! আমি সব খবর রাখি, তোর মনের মানুষ তো কেউ নেই। তোর রে কেউ যায় না। আমি তোর মনের মানুষ হতে পারি না?
নয়নমণি হেসে ফেলে বলেছিল, ঘরে এলেই বুঝি মনের মানুষ হয়? কী বুদ্ধি! তুমি আমার থেকে বয়েসে ছোট, তুমি কী করে আমার মনের মানুষ হবে?
অমরেন্দ্রনাথ চটে উঠে বলছিল, খবরদার, আমার বয়সের কথা কখনও তুলবি না। বয়সে কী আসে যায়! আমি সবাইকে বলি, আকবর বাদশা আমার চেয়েও ছোট বয়সে এত বড় হিন্দুস্থানের অধীশ্বর হয়েছিল। আকবর বাদশার হারেমে কত বয়সের কত মেয়েমানুষ ছিল।
নয়নমণি বলেছিল, তুমিও হারেম বানাও না, অনেককে পেয়ে যাবে। আমি সামান্য স্ত্রীলোক,আমাকে বাদ দাও!
অমরেন্দ্রনাথ বলেছিল, তুই বুঝি কুসুম-টুসুমদের বলে বেড়াস, যে তুই মানিকতলায় কখনও যাস না? তোর বড় গুমোর!
নয়নমণি বলেছিল, বুঝেছি, ওইখানেই তোমার আঁতে ঘা লাগে। তোমার থিয়েটারের একজন মাত্র মেয়ে তোমাকে ভয় পায় না। তোমার খেয়াল মেটাতে রাজি হয় না। এটাই তুমি সহ্য করতে পার না! না, আমি কারুকে কিছু বলে বেড়াই না। তবে না বললেও তো অনেকে অনেক কিছু জেনে যায়। অমরবাবু, তুমি বরং এক কাজ কর। আমি ইচ্ছে করলে কাল থেকেই তোমার থিয়েটার ছেড়ে দিতে পারি। তুমি সবার সামনে তর্জন-গর্জন করে আমাকে ছাড়িয়ে দাও, লোকে ভাববে আমি ইচ্ছে করে যাইনি, তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছ। তাতে তোমার মান বাড়বে।
অমরেন্দ্রনাথ বলেছিল, খবরদার, এ কথা একবারও উচ্চারণ করবি না। ক্লাসিক এখন জমজমাট। এখন কেউ ছেড়ে যাবে না। তোর পার্টে দর্শকদের ঘন ঘন ক্লাপ পড়ে। আমার থিয়েটারের কোনও ক্ষতি আমি সহ্য করব না। আচ্ছা নয়ন, তুই বয়সের কথা তুললি। এই থিয়েটারে সবাই আমার চেয়ে বয়সে বড়, তা হলে তো সবাইকেই আমার আপনি-আজ্ঞে করে চলতে হয়। শিল্পীদের কোনও বয়স নেই, জাত নেই। তুই আর আমি নায়ক-নায়িকা সাজি না? তখন কে বয়সের কথা ভাবে?
নয়নমণি বলেছিল, তখন আমরা মুখে রং মাখি, কত রকম বেশ বদলাই। কখনও রাজা-রানি সাজি, কখন চাকর-চাকরানি, তখন তো আমরা নকল মানুষ। অমরবাবু, একটা কথা বলব? যখন প্রথম ক্লাসিকে যোগ দিই, তোমাকে দেখে আমার খুব ভাল লাগত। তুমি অন্যদের মতন নও। আমি ভেবেছিলাম, তোমার সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হবে। তখনও আমি তোমার মানিকতলার বাগানবাড়ির কথা জানতাম না। এখন বুঝেছি, পুরুষমানুষ আর মেয়েমানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় না।
অমরেন্দ্রনাথ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছিল, কোনও মেয়েমানুষের মুখে আমি এরকম অদ্ভুত কথা শুনিনি। বন্ধুত্ব আবার কী! পুরুষে পুরুষেই বা বন্ধুত্ব হয় কোথায়? সামনা সামনি একরকম, পেছন ফিরলেই আর এক মূর্তি। ওসব হলো কথা বাদ দে। হ্যাঁ রে নয়ন, তুই একদিন বলেছিলি, কেউ তোর ওপর জোর করতে গেলে দুই তাকে খুন করবি। তুই অবলা মেয়েমানুষ, তুই কী করে পুরুষদের সঙ্গে পারবি? গায়ের জোর আর টাকার জোরে পুরুষমানুষরা সব কিছু পেতে পারে। মেয়েমানুষ তো কোন ছার। যদি সত্যি সত্যি আমি তোর পর একদিন জোর করি?
নয়নমণি বলেছিল, গায়ের জোরে আর টাকার জোরে সব কিছু পাওয়া যায়? কী জানি। আমাকে অবলা ভেবো না, আমার কাছে সব সময় একটা ছুরি লুকোনো থাকে, তার ডগায় বিষ মাখানো, গোখরা সাপের বিষ। কেউ আমার ওপর জবরদস্তি করতে এলে তার বুকে আমি সেই ছুরি বসিয়ে দেব। তারপর ফাটকে যাবার আগে আত্মঘাতিনী হব।
অমরেন্দ্রনাথ ব্যগ্রভাবে বলেছিল, সত্যি সত্যি, কই দেখা তো ছুরিটা একবার!
নয়নমণি বলেছিল, না, না, দেখতে চেয়ো না। পাঞ্জাবের শিখ বীরপুরুষদের কথা জানো? তাদেরও সঙ্গে সব সময় কৃপাণ থাকে। খাপ থেকে একবার সেই কৃপাণ বার করলে রক্ত দর্শন না। করে আর কোষবদ্ধ হয় না। আমারও সেইরকম।
অমরেন্দ্রনাথ বলেছিল, বাপ রে, তোর কি মদ্র দেশে জন্ম নাকি রে?
এই সব কথা একদিনে হয়নি। মাঝে মাঝেই অমরেন্দ্রনাথের ঝোঁক চাপে, নয়নমণিকে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে নিজের আর্জি জানায়। মহড়া দেবার সময়ও সে হঠাৎ নয়নমণির দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। কিন্তু তার অন্তর্দৃষ্টি নেই, এই রমণীর মানসলোকে সে প্রবেশ করতে পারে না।
সখীদের সঙ্গে একটা নাচের দৃশ্য মহড়া দিচ্ছে নয়নমণি, এক সময় নেপা বোস ধমক দিয়ে বলল, আজ তোর কী হয়েছে রে, নয়ন? সব সময় মাটির দিকে চোখ, মুখখানা দেখাই যাচ্ছে না। একে নাচ বলে!
নয়নমণি লজ্জা পেয়ে গেল। সত্যি সে আজ বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। নাচের সঙ্গে গান হচ্ছে একরকম, আর মে মনে মনে গাইছে, ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে…’।
কুসুমকুমারী ঠেস দিয়ে বলল, তা কী হবে বাপু! শরীল খারাপ হলে তো তোমরা রেহাই দেবে না। নয়নের বোধহয় মাথা ধরেছে। হ্যাঁ লা নয়ন, কে তোর মাথা ধরল! আমাদের তো কেউ মাথা ধরে, গাল টিপে, হাত ধরে টানে, তোর তো সে রকম কেউ নেই বলেই জানি!
সখীরা খিলখিল করে হেসে উঠল। কুসুমকুমারী আবার বলল, ওই ন্যাপাদাদা, এবার ক্ষ্যামা দাও। নয়ন স্টেজে মেরে দেবে। ওর মহড়া লাগে না।
নয়নমণি নৃত্য শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে বলল, নাও, আবার শুরু কর।
অমরেন্দ্রনাথ এগিয়ে এসে বলল, সখীরা এখন বসুক। আগে শুধু নয়নের নাচটা তুলে দাও। ও একলা নাচুক।
নয়নমণি অমরেন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তারপর পায়ের ঘুঙুর ঝমঝমিয়ে এগিয়ে গেল মঞ্চের একেবারে সামনে। প্রেক্ষাগৃহ আধো অন্ধকার, দর্শকদের সব আসনগুলি শূন্য। তবু সেদিকে তাকিয়ে সে দু’হাত জোড় করে প্রণাম জানাল। কল্পনায় সব আসনগুলি সে পুর্ণ দেখতে পেল, এবং একেবারে শেষে দেয়াল ঘেঁষে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের একটি মূর্তি। নাচ শুরু করল নয়নমণি। প্রথম থেকেই বিদ্যুৎ গতির নাচ, যেন তার শরীরটা হাওয়ার সঙ্গে মিশে গেছে, মঞ্চে যেন একটা ঘূর্ণি ঝড় বইছে, আর সবাই স্তম্ভিত, স্তব্ধ হয়ে রইল।
শেষ হবার পর নেপা বোস বলল, এ কী নাচ নাচলি রে নয়ন! তোর মতন আর কেউ পারবে না। এত দ্রুত লয়, সখীরা পা মেলাতে হিমসিম খেয়ে যাবে।
নয়নমণি বসে পড়ে বলল, আজ আর থাক।
অমরেন্দ্রনাথ বলল, দশ মিনিটের বিরতি। তারপর অন্য সিন হবে।
একটি বাচ্চা ছেলে এসে মাটির খুরিতে চা দিয়ে গেল। গল্প-গুজব শুরু করে দিল অনেকে, কেউ বা গা এলিয়ে দিল মেঝেতে। অমরেন্দ্রনাথ একটা কৌটো থেকে সিগারেট বার করে ধরিয়ে বলল, আমি আর একটা নতুন নাটকের কথা ভেবেছি। কাল রাতেই আইডিয়াটি এসেছে মাথায়, তাতে একটা ডাকাতের দল থাকবে। একটা-দুটো দুশো সেই ডাকাতরাও লাঠি-তরোয়াল নিয়ে নাচবে। আমি যতগুলো প্লে দেখেছি, সবগুলোতেই মেয়েদের নাচ থাকে। কেন, ছেলেরা কি নাচতে জানে না? আজকাল তো কিছু কিছু মেয়েমানুষও নাটক দেখতে আসছে, তারা পুরুষদের নাচ দেখলে খুশি হবে।
নেপা বোস বলল, দারুণ আইডিয়া। কোনও সমস্যা নেই। আমি কটা ব্যাটাছেলেকেও নাচ শিখিয়ে দেব! ক’জন চাই?
অমরেন্দ্রনাথ বলল, ডাকাতের দল, মালকোচা মারা ধুতি পরে থাকবে, খালি গা, তেল চকচকে বুক, কিন্তু সে কম বুক আর হাতের গুলি থাকা চাই। আমাদের এখানে যারা পার্ট করে, হয় রোগা হাড় ডিগডিগে, নয় তো ভুড়িওয়ালা। ডাকাতের চেহারা পাব কোথায়? আর এরা কি লাঠি খেলা শিখতে পারবে?
ধর্মদাস সুর বলল, বঙ্কিমবাবু লিখে গেছেন না, হায়-লাঠি, তোমার দিন গিয়াছে। বাঙ্গালি লাঠি খেলা ভুলে গেছে কবে। এখন শেখাবারও লোক পাওয়া দুষ্কর। গ্রামে ট্রামে হয়তো হাড়ি বাগদিরা কিছুটা জানে।
অমরেন্দ্রনাথ বলল গ্রামে-গঞ্জে তো এখনও ডাকাতি হয়। তারা লাঠি-তরোয়াল নিয়েই তো আসে। জমিদারদের পাইক-লেঠেল থাকে। খোঁজ নাও না, কোনও গ্রাম থেকে যদি গোটা দশেক ওই রকম তাগড়া-জোয়ান আনা যায়।
ধর্মদাস বলল, গ্রামের লোক এনে তুমি থিয়েটারে নামাবে? তারা কোনও দিন বিজলি বাতি দেখেনি, মঞ্চে উঠে ভিরমি খাবে!
নেপা বোস বলল, আর এক জায়গাতে চেষ্টা করা যেতে পারে। কলকাতাতেই একটা আখড়া আছে শুনেছি।
এই সময় প্রচার সচিব প্রমথ দাস এসে বলল, কেলোবাবু, কাল থেকেই তো হ্যান্ডবিল ছাড়তে হবে। বিজ্ঞাপনের বয়ানটা ঠিক মতন সাজানো হয়েছে কি না, একবার দেখে দেবেন?
অমরেন্দ্রনাথ হ্যান্ড বিলের প্রুফটা নিয়ে একবার চোখ বুলালো। খুশি হয়ে মাথা নেড়ে বলল, বাঃ, বেশ হয়েছে, শুধু শেষ লাইনটা বড় টাইপ দিয়ে দাও। তোমরা শুনবে কী লিখেছি? ইংরিজি-ফিংরিজি নয়, বাংলা।
দু’তিনজন বলে উঠল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, পড়ে শোনান।
অমরেন্দ্রনাথ উচ্চস্বরে পড়লঃ
হই হই
রই রই ব্যাপার!
নাট্যজগৎ
স্তম্ভিত!
নাটকের ঘাত প্রতিঘাতে মানবজীবন দোদুল্যমান!
সারি সারি সখীর সারি!
নাচে
গানে ধুল পরিমাণ!
ষোড়শী রূপসীর যৌবন তরঙ্গে সন্তরণ!!
সখীরা ষোড়শী, ষোড়শী বলে হেসে গড়াগড়ি যেতে লাগল। প্রমথ তাদের ধমক দিয়ে থামিয়ে বলল, ওরকম দিতে হয়। আগে গিরিশবাবুদের নাটকে ইংরিজি বিজ্ঞাপন দিয়ে বিদ্যে ফলাতেন। কেন রে বাপু, বাংলা নাটক, বাঙালিরা দেখবে, তার বিজ্ঞাপন ইংরিজি হবে কেন?
অমরেন্দ্রনাথ বলল, সাহেবদের কাছে জাতে ওঠার চেষ্টা! ইংরিক্তি কাগজে ক্লাসিকের কী সমালোচনা বেরুল না বেরুল তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি বিজ্ঞাপনের জোরে দর্শক টেনে আনব।
প্রমথকে বিদায় দিয়ে অমরেন্দ্রনাথ নেপা বোসকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ, তুমি কী বলছিলে? কলকাতায় লাঠি খেলার আখড়া আছে?
নেপা বোস বলল, আছে। সরলা ঘোষালের আখড়া। ভদ্রঘরের ছেলেরা সেখানে লাঠি খেলা, তলোয়ার খেলা শেখে। শরীর চর্চা করে।
অমরেন্দ্রনাথ ভুরু কুচকিয়ে বলল, মেয়েছেলে আখড়া খুলেছে? বাপের জন্মে এমন কথা শুনিনি। সরলা ঘোষাল কে? বয়েস কত?
নেপা বোস বলল, বাঃ, সরলা ঘোষালের নাম শোনেননি? দেবেন ঠাকুরের নাতনি, ওর বাপের নাম জানকীনাথ ঘোষাল, কংগ্রেসের বড় লিডার। সরলার বয়স এই আমাদের নয়নমণির মতনই হবে, এখনও বিবাহ করেননি।
অমরেন্দ্রনাথের বিস্ময় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে আবার হল, বলিস কী রে! অত উঁচু ঘরের মেয়ে, এত বয়স পর্যন্তও বিয়ে শাদি করেনি! এমন হয় নাকি? সেই সরলা ঘোষাল হঠাৎ লাঠি খেলার আখড়া খুলতে গেল কেন খামোকা? অমন মানী বংশ, ওর বাপ-মা অ্যালাও করল কী করে?
নেপা বোস বলল, ও মেয়ে কারুর কথা শোনে না। তবে এটা সাধারণ আখড়া নয়। সরলা ঘোষাল বিয়ে না করে দেশোদ্ধারের ব্রত নিয়েছে। এ দেশের মানুষ অস্ত্র ধরতে ভুলে গেছে। তাই উনি চান, ছেলে ছোকরারা বাজে আড্ডা-মস্করায় সময় নষ্ট না করে শরীর গঠন করুক। লাঠি-তরোয়াল চালাতে শিখুক। দেশের জন্য প্রাণ দিতে তৈরি হোক। সরলা ঘোষালের মধ্যে জাদু আছে, তার কথায় দলে দলে ছেলে ওঠে বসে।
অমরেন্দ্রনাথ এবার সম্ভ্রমের সঙ্গে বলল, এমন মেয়েও আমাদের দেশে জন্মায়? টাকা পয়সার অভাব নেই, বিলাসব্যসনের অসুবিধে নেই, তবু দেশের কথা ভাবে? আখড়া চালাবার খরচা কে দেয়?
নেপা বোস বলল, উনিই দেন। মাঝে মাঝে উৎসব করেন। ওই আখড়া থেকে গোটা কতক ছেলেকে আনা যেতে পারে। বেশি শেখাতে হবে না। শহরের ছেলে, স্টেজে উঠে ঘাবড়াবে না।
অমরেন্দ্রনাথ বলল, শুনে ওনার ওপর ভক্তি হচ্ছে রে। মেয়েমানুষ হয়েও পুরুষের উপর টেক্কা দিলে দেখছি। কিন্তু উনি কি রাজি হবেন, দেশের কাজের জন্য যারা তৈরি হচ্ছে, তারা থিয়েটারে নামতে চাইবে কেন?
নেপা বলল, বাঃ, থিয়েটারও কি দেশের কাজ নয়? আমাদের থিয়েটারে নাচ গান থাকে বটে, দেশের গৌরবের কথাও কি ফুটে ওঠে না? এর সঙ্গে গিয়ে কথা বলা যেতে পারে।
অমরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করল, উনি কি দেখা করেন সকলের সঙ্গে? বনেদি বাড়ির মেয়ে, এখনও কুমারী, ব্রাহ্ম না হয়ে হিন্দু হলে সমাজ থেকে কবে পতিত করত ওঁর বাপ-মাকে।
নেপা বোস বলল, আমি যতদূর শুনেছি, ঘোষালদের বাড়ি অবারিত দ্বার। কত উটকো লোক পকেটে এক তাড়া পদ্য বুজে সরলা ঘোষালের সঙ্গে দেখা করতে যায়। উনি যে একটা পত্রিকাও চালান।
নয়নমণি প্রথম দিকটায় নিরাসক্তভাবে দূরে বসেছিল। সরলা ঘোষাল সম্পর্কে আলোচনা শুনে আকৃষ্ট হয়ে কাছে চলে এল। সুনেত্রার কাছে সে বেশ কয়েকবার তার সরলাদিদির কথা শুনেছে। সেই সরলা কি এই সরলা ঘোষাল? দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি যখন, তখন নিশ্চিত সেই। কিন্তু সুনেত্রার সরলাদিদি তো গায়িকা, রবীন্দ্রবাবুর অনেক গান জানেন, তিনিই আবার বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানীর মতন একদল লাঠিয়ালের নেত্রী? ঠিক যেন মেলানো যায় না। ভদ্রঘরের মেয়েরা অনাত্মীয় পুরুয়ের সঙ্গে কথাই বলে না, আর ইনি যে-কোনও অচেনা লোকের সঙ্গে দেখা করেন।
বাড়ি ফেরার পথে নয়নমণি আবার গুনগুন করতে লাগল, নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে…। পরের গানটা কী? বঁধু, তোমায় করব রাজা… তারপর? ছোট গান, সবটাই সে তুলে নিয়েছিল, তবু মনে পড়ছে না কিছুতেই। গানটা যেন হৃদয়ের অনেক গভীরে কোথাও বন্দিনী হয়ে আছে, কিছুতেই বেরুতে পারছে না। সরলা ঘোষালের কাছে অনুরোধ করলে তিনি গানটা শিখিয়ে দেবেন না? এ রকম আরও গান।
দুদিন বাদে নয়নমণি নেপা বোসকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ গো, সেই যে লাঠিয়াল ছেলে জোগাড় কবার জন্য তোমাদের যাওয়ার কথা ছিল সরলা ঘোষালের কাছে গিয়েছিলে?
নেপা বোস বলল, দাঁড়া, এখুনি কী? সবে একটা নতুন প্লে নেমেছে, এটা জমুক আগে। কেলোবাবু যে-নাটকটার কথা বলছিল, সেটা তো এখনও লেখাই হয়নি। চরিত্র কটা, কটা নাচ, আগে সেসব দেখে নিই।
নয়নমণির যেন গরজ বেশি। সে প্রায়ই নেপা বোসকে তাড়া দেয়। মাসখানেক বাদে সত্যি নেপা বোস ও প্রমথ গেল অমরেন্দ্রনাথের চিঠি নিয়ে। ফল হল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। সরলা ঘোষাল এই প্রস্তাব তো রাজি হয়নি বটেই, উল্টে অনেক কটু কথা শুনিয়ে দিয়েছে। তার সঙ্গে দেখা করার কোনও অসুবিধে হয়নি ঠিকই, কিন্তু চিঠিটি পড়া মাত্র সে ভ্রূকুঞ্চিত করেছে। না, সে তার আখড়ার ছেলেদের কোনওক্রমেই থিয়েটারের সংস্পর্শে যেতে দিতে রাজি নয়। এখানকার যুবকরা শুধু লাঠি-তরোয়াল চালনা শিখছে না, তারা মহৎ আদর্শে দীক্ষিত। উচ্চ নৈতিকতা ছাড়া সে আদর্শ ধরে রাখা সম্বব নয়। থিয়েটারের আবহাওয়া অত্যন্ত দূষিত। গিরিশবাবু অর্ধেন্দুশেখররা তবু নাটকে কিছুটা দেশাত্মবোধের কথা প্রচার করতেন, কিন্তু ক্লাসিক থিয়েটার শুধু পয়সা রোজগারের জন্য নাটক জমাচ্ছে। নিম্নরুচির প্রশ্রয় দিচ্ছে। ক্লাসিকের একটা হ্যান্ডবিল হাতে এসেছে সরলার। ছি ছি ছি, পাবলিক থিয়েটার এত নীচে নেমে যাচ্ছে। দেশের মানুষের কাছে কদর্য, স্থূল রুচির আমোদ-প্রমোদ পরিবেশন করছে!
সরলা নিজের মুখে উচ্চারণ না করে হ্যাণ্ডবিলের শেষ লাইনটির ওপর আঙুল রেখেছিল। ‘ষোড়শী রূপশীর যৌবন তরঙ্গে সন্তরণ!!’ আরক্ত হয়ে গিয়েছিল তার মুখ, ক্রোধ ও দুঃখ মেশানো কণ্ঠে সে বলেছিল, নারীর শরীর প্রদর্শন করা যাদের মুখ্য উদ্দেশ্য, তাদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখার প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের ছেলেরা কেউ ওই সব নাটক দেখতে যাবে না!
এই বিবরণ শুনে বেশ দমে গেল নয়নমণি। পাবলিক থিয়েটারের উপর সরলার এত বিতৃষ্ণা। তা হলে তার কাছে যাওয়া যাবে কী করে? শেখা হবে না এই গান?
দোতলায় গঙ্গামণি পল্লীর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের গান শেখায়। সেই গানের সুর ওপরে উঠে আসে, নয়নমণির কানে আঙুল নিতে ইচ্ছে করে। ‘ফুটলো কলি, জুটলো অলি, ছুটলো নতুন প্রেমের ধারা’ এই ধরনের গানে তার আর একেবারেই শুনতে ভাল লাগে না। ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে—’, এ গানের কাছে পুরনো সব গানই যেন নস্যাৎ হয়ে গেছে। এ গান কত সহজ, অথচ কত গভীর!
দুদিন পর নয়নমণির মনে হল, সে থিয়েটারের অভিনেত্রী হতে পারে, তার বাইরেও তো সে একজন মানুষ। সেই পরিচয়ে কি সরলা ঘোষালের কাছে যাওয়া যায় না? সে তো থিয়েটারের জানা ওই গান শিখতে চাইছে না, সে শিখতে চায় প্রাণের তাগিদে। একবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী? বড়জোর প্রত্যাখ্যান করবে, সে অপমান গায়ে মাখবে না নয়নমণি।
একটা ঠিকে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে একদিন বিকেলবেলায় ঘোষালদের বাড়িতে চলে এল নয়নমণি। দেউড়ির সামনে জটলা করছে চার পাঁচজন যুবক। নয়ন একটা লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে এসেছে, মাথা অর্ধেক ঘোমটায় ঢাকা। গাড়ি থেকে সে নামতেই যুবকেরা তার দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল, ফিসফিস করতে লাগল নিজেদের মধ্যে। সরলা ঘোষাল যা-ই বলুক, তার আখড়ায় যুবকরা অনেকেই নিয়মিত থিয়েটার দেখতে যায়, তারা দেখা মাত্র নয়নমণিকে চিনেছে।
নয়নমণি দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল, শ্রীমতী সরলা ঘোষালের সঙ্গে একবার দেখা করা সম্ভব হবে কী? যদি তিনি অনুগ্রহ করে সামান্য সময় দেন—
যুবকের দল বলল, বিলক্ষণ, বিলক্ষণ। তিনি অবশাই দেখা করবেন, ভেতরে আসুন।
যুবকেরা তাকে পথ দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল।
সরলা বৈঠকখানা ঘরের পাশের একটি ছোট ঘরকে ভারতী পত্রিকার দফতর বানিয়েছে। সম্পাদকের টেবিলে সে বসে আছে, সেখানেও তাকে ঘিরে রয়েছে কয়েকজন পুরুষ। অন্য যুবকরা সমস্বরে বলে উঠল, দিদি, আপনার কাছে নয়নমণি এসেছে, নয়নমণি!
সরলা মুখ তুলে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল।
পাশের একটি কেদারায় বসে আছে ভারতী পত্রিকার নিয়মিত লেখক ও সরলার প্রণয়প্রার্থী প্রভাত মুখুজ্যে। মুখে জ্বলন্ত চুরুট। সে বলল, দ্যাট রিনাউনড অ্যাকট্রেস। স্টার অফ ক্লাসিক থিয়েটার!
থিয়েটারের কথা শুনেই সরলার ললাটে ভাঁজ পড়ল।
নয়নমণি একটুক্ষণ দেখল সরলাকে। প্রায় তারই সমবয়সিনী, গৌরবর্ণা, টানা টানা চোখ, মুখমণ্ডলে অভিজাত সুলভ খানিকটা দূরত্ব রক্ষার ভাব। সরলা লাল রঙের শাড়ি বেশি পছন্দ করে, মহীশূর থেকে, সে ওই রঙের কয়েক ডজন সিল্কের শাড়ি এনেছে।
নয়নমণি গলায় আঁচল জড়িয়ে বিনীত ভাবে বলল, নমস্কার।
প্রতি নমস্কার জানিয়ে সরলা খানিকটা রূঢ় গলায় বলল, ক্লাসিক থিয়েটার থেকে আপনাকে পাঠিয়েছেন? কোনও লাভ হবে না। আমার উত্তর আমি জানিয়ে দিয়েছি। আমার মতের কোনও নড়চড় হবে না।
প্রভাত মুখুজ্যে নয়নমণিকে বলল, বসুন, আপনি বসুন।
নয়নমণি তবু দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, আমি থিয়েটারের পক্ষ থেকে আসিনি। আমাকে কেউ আসতে বলেনি।
সরলা অন্যদিকে চেয়ে বলল, আমার কাছে একজন অ্যাকট্রেসের আর কী প্রয়োজন থাকতে পারে, তা তো বুঝতে পারছি না! আপনি কী জন্য এসেছেন বলুন!
হঠাৎ নয়নমণির নিজেকে খুব অসহায় মনে হল। সে যেন নিতান্তই এক অকিঞ্চিৎকর প্রাণী, এত বড় প্রাসাদে, এই সংস্কৃত পরিবেশের সে সম্পূর্ণ অযোগ্য। থিয়েটারের সময়টুকু ছাড়া সে আপন মনে নিজের ঘরে বসে থাকে, কারুর সঙ্গে মেশে না, সেটাই তো তার ভাল ছিল। কেন সে এখানে এল?
তার মুখ দিয়ে আর কোনও কথা বেরুল না। তার বুকের মধ্যে অসম্ভব একটা চাপ লাগছে, নিজেকে আর সে সামলাতে পারছে না, চোখ ফেটে তার জল বেরিয়ে এল, সঙ্গে সঙ্গে সে আঁচল দিয়ে চাপা দিল মুখ।
অভিনেত্রীরা ইচ্ছে মতন যখন তখন কাদতে পারে, আবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠতে পারে। তাদের কান্না মানেই কৃত্রিম। নয়নমণিকে ভুল বোঝার সাধনা এখন আরও বেশি।
সরলা কয়েক পলক তাকিয়ে রইল তার দিকে। তারপর ঘরের অন্য পুরুষদের ইঙ্গিত করল বাইরে যাবার জন্য। নয়নমণির কাছে এসে সে খুব কোমল কন্ঠে বলল, তোমার কী হয়েছে বোন? তুমি বসো, আমাকে তোমার সব কথা বলো–।
চোখ মুছে, নিজেকে খানিকটা সামলে নেবার পর নয়নমণি বলল, আমায় ক্ষমা করুন, এমনভাবে এসে পড়া আমার উচিত হয়নি। আমি চলে যাই।
সরলা জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন এসেছিলে, সে কথা বলবে না?
নয়নমণি বলল, গ্রহের ফেরে আমি থিয়েটারের নটী হয়েছি, কিন্তু তা ছাড়াও আমি একজন সামন্য রমণী।
সরলা বলল, তা তো অবশ্যই। মেয়েরা ইচ্ছার বিরুদ্ধেও কত রকম পরিবেশে পড়তে বাধ্য হয়, তা কি আমি জানি না? এ দেশের নারীরা পুরুষদের হাতের পুতুল। তোমার ওপর প্রথমেই রাগ করা আমার ভুল হয়েছে। তোমার কী হয়েছে বল!
নয়নমণি বলল, আমাদের মতন মেয়েদের অযাচিতভাবে কোথাও যেতে নেই, তা আমি জানি। এর আগে আমি এমনভাবে কারুর বাড়িতে যাইনি। কিন্তু শুনেছি, আপনি অন্যদের মতন নন, আপনি অসাধারণ। তাই আপনার কাছে এসেছিলাম একটা প্রার্থনা নিয়ে।
সরলা বলল, কী চাও, বলো। যদি তুমি কোন বিপদে পড়ে থাকো, আমার সাধ্য মতন প্রতিকারের চেষ্টা অবশ্যই করব।
নয়নমণি বলল, না, বিপদ কিছু নয়। আপনার কাছে এসেছি একটা প্রার্থনা নিয়ে। আপনি আমাকে একটি-দুটি গান শেখাবেন?
সরলা অবাক হয়ে বলল, গান? আমি তো থিয়েটারে গাওয়ার মতন গান গাই না।
নয়নমণি বলল, থিয়েটারের গান নয়, অন্য গান। ‘বঁধু, তোমায় করব রাজা–‘
সরলা আরও অবাক হয়ে বলল, এ তো রধিমামার গান। তার গান তিনি কোনও নাটকে ঢোকাতে দেবেন কি না, তা তো জানি না। মনে হয়, রাজি হবেন না।
নয়নমণি ব্যাকুল মিনতির সুরে বলল, আপনাকে আমি আবার বলছি, বিশ্বাস করুন, কোনও নাটকের জন্য নয়, স্টেজে গাইবার জন্য নয়, শিখতে চাই শুধু নিজের জন্য। এমনকী অন্য কারুকেও শোনাব না, একা একা ঘরে বসে গাইব। তাতে আমার মনটা জুড়োবে।