সকালের দিকে বিদ্যাসাগরের বাড়ির লাইব্রেরি কক্ষে যথেষ্ট লোক সমাগম হয়। অনেকেই আসে কিছু সাহায্যের আশায়। ইতিমধ্যেই চারিদিকে রটে গেছে যে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছে বিপদের কথা জানিয়ে কেঁদে পড়তে পারলেই তিনি কিছু না কিছু সাহায্য করবেনই। এমনকি তিনি অনেকের জন্য সারা জীবন মাসিক সাহায্য বরাদ্দ করে দেন। এ ব্যাপারে তাঁর শত্ৰু-মিত্র ভেদ নেই। কলকাতায় মস্ত মস্ত ধনী আছে অনেক, কিন্তু তাদের কারুর কাছেই গিয়ে এরকম নিঃসঙ্কোচে হাত পাতা যায় না।
এক সময় নবীনকুমার সিংহ এসে সেই ভিড়ের মধ্যে এক পাশে আসন গ্রহণ করলো। বিদ্যাসাগর একটু বিস্মিত হয়ে তাকালেন তার দিকে। তিনি প্রায়ই বরাহনগরে নবীনকুমারের সারস্বতাশ্রমে যান মহাভারত অনুবাদের কাজ পরিদর্শনের জন্য, কখনো কোনো বিশেষ প্রয়োজন ঘটলে নবীনকুমার তাঁর কাছে লোক পাঠায়। অর্থাৎ নবীনকুমারের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ আছে। আজ এত সকালে নবীনকুমার যখন বিনা এত্তেলায় হাজির হয়েছে, তখন নিশ্চয়ই কোনো গুরুতর কারণ ঘটেছে।
তিনি ভুরু উত্তোলন করে প্রশ্ন করলেন, কী খবর হে, নবীন?
নবীনকুমার বললো, আপনি আগে অন্যদের সঙ্গে কতা শেষ করুন, আমি অপেক্ষা করছি।
লাইব্রেরি কক্ষটিতে কাঠের তাকে তাকে মূল্যবান গ্ৰন্থরাজি সুন্দরভাবে সাজানো। বইয়ের প্রতি যেমন যত্ন, তেমনই বই সংগ্রহের জন্য অর্থব্যয়েও কোনো কাপণ্য নেই বিদ্যাসাগরের। অধিকাংশ বই-ই মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো। একবার কে-যেন বলেছিল, আপনি বই-বাঁধাই-এর জন্য এত খরচ করেন কেন, এটা কি অপব্যয় নয়? উত্তরে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, তুমি বাপু পাঁচশো টাকা দামের শাল গায়ে দাও কেন? আমার তো পাঁচ সিকে দামের চাদরেই কাজ চলে যায়।
কক্ষের উত্তর দিকের দেওয়ালে এক রমণীর তৈলচিত্র টাঙ্গানো আছে। ছবিটি বিদ্যাসাগরের জননী ভগবতী দেবীর। ছবিটি নবীনকুমার আগেও কয়েকবার দেখেছে, আজ তার মনোযোগ যেন সেদিকেই বিশেষভাবে আকৃষ্ট হলো। কী নিরাভরণ সরল মূর্তি। ভগবতী দেবী গৌরবর্ণা, পরনে শুধু একটি অতি শস্ত কস্তা ড়ুরে শাড়ি, আর অলঙ্কারের মধ্যে হাতে শুধু শাঁখা। ঈষৎ লজ্জামিশ্রিত মুখখানি দেখলেই বোঝা যায়, এই রমণী কত মমতাময়ী। মাতৃমূর্তি দেখলেই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে। নবীনকুমারেরও মনে পড়লো। গত দু মাসের মধ্যে বিম্ববতীর কাছ থেকে কোনো সংবাদ আসেনি। যদিও বিম্ববতী আর কোনোদিন ফিরবেন না বলে গেছেন, তবু এবার একবার তাঁকে হরিদ্বার থেকে আনাবার চেষ্টা করতেই হবে। নবীনকুমারের জননীর এমন কোনো ছবি নেই।
নবীনকুমার বললো, আপনার মায়ের এই চিত্রটি আগেও দেকেচি তবে আজ যেন বেশী করে চোখ টানলো। ইটি কার তৈরি? কোনো সাহেব ছাড়া তো এমন মনোহর চিত্র আঁকতে পারে না!
বিদ্যাসাগর বললেন, তুমি ঠিকই ধরেছে। হডসন সাহেবের নাম শুনেছো? তিনিই এই ছবি বানিয়েছেন।
নবীনকুমার বললো, ঠিক বুজলুম না। না দেকে কি এমন পোর্ট্রেইট আঁকা যায়? একজন সাহেব আপনার মায়ের ছবি আঁকলেন কী ভাবে?
—না দেখে আর অ্যাকবে কেমন করে? সাহেব দেখেই এঁকেছেন।
—সাহেব আপনাদের গ্রামের বাড়িতে গোসলেন?
–না, আমার মা তখন এখানে। পাইকপাড়ার রাজারা হডসন সাহেবকে আনিয়েছিলেন। আমি সেখানে যাতায়াত করি, তা একদিন সাহেব ধরে বসলে আমার একটা চিত্র-মূর্তি গড়াবে। আমি না না করি, তো সে সাহেব কিছুতেই সে কথা কানে তোলে না। নাছোড়বান্দা হয়ে শেষ পর্যন্ত আমায় রাজী করিয়ে ছাড়লে। তারপর ভালো করে গিল্টি ফ্রেমে বাঁধিয়ে সেখানা আমায় উপটৌকন দিলে, কিছুতেই দাম লবে না। বলে কি-না বিধবা বিবাহের পক্ষে আমি যা লিখেছি তার ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করে সাহেব খুব খুশী হয়েছে। ঐ চিত্র তার কৃতজ্ঞতার নিদর্শন। তখন আমি মনে করলুম, তবে আমার জননীরও একটা চিত্র গড়িয়ে নিই না কেন?
–আপনার মা রাজী হলেন?
—আমার মায়ের সব কিছুই আমার উপর বরাৎ! তিনি বললেন, নিন্দা হলে লোকে তো আমার; নিন্দা করবে না, তোরই নিন্দা করবে। আমি বললুম, বেশ তাই। আমার কপালে তো নিন্দা কম জোটে নি, অধিকন্তু আর কী হবে! মাকে নিয়ে গেলেম সাহেবের বাড়ি!
—আপনি-হিন্দু ঘরের সধবাকে-সাহেবের বাড়ি নিয়ে গেলেন?
–সাহেবের বাড়িতে সব জিনিসের জোগাড় আছে, সে আড্ডা ভেঙে এখানে আনতে গেলে ছবি ভালো হয় না। আমি সাহেবসুবোদের বাড়ি যেতে পারি, আমার জননী গেলেই বা দোষ কী?
–দোষের কতা নয়, আমি ভাবচি সাহসের কতা।
–এবার বলো, তোমার কি সংবাদ!
—অ্যাঁ-ইয়ে—আজ্ঞে, আমাদের গৃহে একদিন কবিবর মাইকেল মধুসূদনকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করলুম, আপনি এলেন নাকো সেদিন। লোকমুখে শুনতে পেলুম, আপনি মেঘনাদবধ কাব্যখানা তেমন পছন্দ করেননি।
—তোমরা পছন্দ করেছে তো, তাতেই যথেষ্ট। কাব্যরুচি যার যা নিজস্ব। আমার ভালো লাগে ভারতচন্দ্র, ঐ রকম দিশী মতের বাংলাভাষা পড়ে আমি আনন্দ পাই। তোমরা যদি কাব্যে বিলিতি বাংলা চালাতে চাও তো চলুক!
—মাইকেলের কাব্যে আপনি বিলিতি বাংলা কী দেকালেন? সবই তো সংস্কৃত ভাঙা শব্দ।
—তুমি কি এই সাত সকলে আমার সঙ্গে কাব্য-আলোচনা করতে এসেছে? আমার তো হাতে এখন সময় নেই, বাপু। একবার প্রেসে যেতে হবে। আমি কালিদাসের কুমারসম্ভব সম্পাদনা করে ছাপাচ্ছি, সেই কাজ আছে।
—আমি আপনাকে একটা সুখবর দিতে এয়েচি।
—বটে? শুনি, শুনি, আজকাল সুখবরের বড় আকাল পড়েছে।
—আপনি বাগবাজারের কৃষ্ণনাথ রায়ের নাম শুনেচেন নিশ্চয়ই।
—তিনি একজন বুনিয়াদী ধনী। এইটুকু মাত্র জানি।
—ধনী তো বটেই। ত্রিপুরার রাজ-সরকারের দেওয়ান। হিন্দুসমাজের একজন প্রধান ব্যক্তি। তাঁর এক কন্যা। সদ্য বিধবা হয়েচে। তিনি সেই কন্যাটির আবার বিবাহ দেওয়ায় রাজি হয়েচেন। বিধবা বিবাহ এদানি খুব কমে গেচে বলে আপনি মনঃকষ্ট পাচ্চিলেন। এই বিবাহটি হলে আবার খুব জোর একটা সাড়া পড়ে যাবে। এ রকম বড় বংশে বিধবা বিবাহ একটিও হয়নি। দেশের লোক আবার ভরোসা পাবে।
—যদি হয় তবে তো সুখবর ঠিকই।
—নিশ্চয় হবে। কন্যাটি যেন রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। তার যোগ্য পাত্র পাওয়া যাচ্চে না বলে বিয়েটা আটকে রয়েচে। যদুপতি গাঙ্গুলী পৈতে ত্যাগ করেচে। আপনি জানেন বোধ করি, সে ঐ কন্যাটিকে বিবাহ করতে চায়। কিন্তু কন্যাপক্ষ তাতে রাজি নয়। পৈতে না থাকলেও যদুপতি বামুনের ছেলে। তায় আবার ব্ৰাহ্ম। ওঁরা অতটা বাড়াবাড়ি করতে চান না।
—যদুপতির অমন প্রস্তাব দেওয়া উচিত হয় নি। বিধবা বিবাহের নামেই এত বাধা। তার ওপর যদি বর্ণাশ্রম ভাঙ্গতে যাওয়া হয়, তা হলে একেবারে ধুন্ধুমার কাণ্ড লেগে যাবে।
—শেষ পর্যন্ত কন্যাটির জন্য আমি একটি পাত্র ঠিক করিচি, তাই আপনার অনুমতি নিতে এলুম।
—পাত্রটি কে?
–আজ্ঞে, আমি!
–তুমি?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। কন্যাটি আমার স্বৰ্গত পত্নীর সখী ছিল। বাল্যকাল থেকেই ওকে আমি দেকচি; ওদের সঙ্গে আমাদের পালটি ঘর। সব দিক থেকেই এ বিবাহ মানানসই হবে।
বিদ্যাসাগর যেন কিছুতেই কথাটা বিশ্বাস করতে পারলেন না। সুবিখ্যাত সিংহ পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকারী নবীনকুমার সিংহ করবে বিধবা বিবাহ? রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ এটা মেনে নেবে? বিধবা বিবাহের পক্ষে এত বড় জয় যে কল্পনাই করা যায় না। এ রকম একটি বিবাহ সত্যিই সঙ্ঘটিত হলে তার প্রচার হবে সমস্ত ভারতবর্ষে।
তিনি বললেন, তুমি-তুমি পারবে? তোমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন-রাধাকান্ত দেবের সঙ্গেও তোমাদের কী রকম আত্মীয়তা আছে শুনেছি–।
নবীনকুমার দৃঢ়কণ্ঠে বললো, আপনি যদি আশীর্বাদ করেন, আমি কোনো বাধাই গ্রাহ্য করি না। আমি মনে মনে বহুকাল যাবৎ আপনার শিষ্যত্ব গ্ৰহণ করে আচি, আমি সর্বদা আপনার প্রদর্শিত পথে চলতে চাই!
এরপর উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন বিদ্যাসাগর। এই চঞ্চল যুবকটি বারবার তাঁকে বিস্মিত করছে। এত ধনী পরিবারের এই বয়েসের সন্তানরা তো আর কেউ এ রকম নয়। এর চাঞ্চল্য ও উদ্দীপনা সবই যেন দেশের মঙ্গলের জন্য! প্রেসের কাজ ভুলে গিয়ে তিনি অনেকক্ষণ কথা বললেন নবীনকুমারের সঙ্গে।
দারুণ উৎফুল্ল হয়ে বাড়ি ফিরে এলো নবীনকুমার। বিদ্যাসাগরকে খুশী করতে পেরেছে। এতেই তার বেশী আনন্দ। ভাগ্যিস ঠিক সময় কথাটা মনে পড়েছিল। কুসুমকুমারীর জন্য অন্য পাত্র খোঁজার কোনো মানে হয়? কুসুমকুমারীর অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানি এবং নীলবৰ্ণ চক্ষু দুটি বারবার তার মনে আসে। সেই কুসুমকুমারীকে সে নিজেই পরের ঘরণী করতে পাঠাচ্ছিল? এমন আহামুক্কি কেউ করে? কুসুমকুমারী শুধু তার হবে, সে আর কারুর হতে পারে না।
নবীনকুমার অবশ্য এখনো এ প্রস্তাব আর কারুকে জানায়নি। সে যেন ধরেই নিয়েছে এ বিষয়ে কারুর কোনো আপত্তির প্রশ্নই উঠতে পারে না। এমন কি কুসুমকুমারীর পিতার বা অন্যান্যদের মতামত নেবার যে প্রয়োজন আছে, তাও সে ভাবলো না। সে, নবীনকুমার সিংহ, ধনে-মনে-গুণে এই সমাজের শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত। তার যোগ্যতা সম্পর্কে কে প্রশ্ন করবে? সে প্ৰস্তাবটি জানানো মাত্র সকলেই নির্বাক হয়ে যাবে! এই বিবাহে এমন জাঁকজমক করবে নবীনকুমার, যে রকমটি কলকাতার মানুষ বহুদিন দেখেনি।
স্নান-আহারাদি সেরে সে বরাহনগরে যাবার জন্য প্ৰস্তুত হতে লাগলো। আজ রাতটি সে শ্বশুরালয়ে কাটাবে। রাত্রেই সরোজিনীকে সুসংবাদ দিয়ে আগামীকাল সকালে কৃষ্ণনাথ রায়ের সঙ্গে দেখা করবে। অথবা, সে কি নিজেই যাবে না কোনো লোক মারফৎ আগে খবরটি জানাবে? প্ৰথমে দূত পাঠানোই বুঝি শ্ৰেয়।
শয়নকক্ষের বিশাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নবীনকুমার নিজেকে দেখতে পেল না। দেখলো কুসুমকুমারীকে। আবেগকম্পিত কণ্ঠে সে বললো, বন-জ্যোৎস্না, তুমি আমার হবে! আমি সহকার তরু, তুমি মাধবীলতা। আমি সরোবর, তুমি আমার বক্ষে পঙ্কজিনী হয়ে ফুটে থাকবে।
সেদিন অপরাহ্নেই যদুপতি গাঙ্গুলী চলে এলো বরাহনগরে। খুব ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে বললো, ভাই, তোমাকে বিদ্যাসাগর মশাই আজই একবার ডেকে পাঠিয়েছেন। যথাসম্ভব শীঘ্ৰ গেলে ভালো হয়।
নবীনকুমার বললো, কী ব্যাপার?
যদুপতি বললো, তা তো জানি না। তবে উনি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েচেন মনে হলো। তুমি বিদ্যাসাগর মশাইকে আমার নামে কী বলেচো? হঠাৎ আমাকে একচেটি বকাঝকা কল্লেন।
শ্বশুরবাড়ি আর যাওয়া হলো না। নবীনকুমার তখনই চলে এলো বাদুড়বাগানে। সদ্য সন্ধ্যা হয়েচে। বিদ্যাসাগর নিজের কক্ষে একলা রয়েছেন, মুখখানি থমথমে। যদুপতিকে সঙ্গে নিয়ে নবীনকুমার প্রবেশ করতেই তিনি বললেন, যেদো, তুই বাইরে যা, নবীনের সঙ্গে আমার সবিশেষ কথা আছে। যাবার সময় দরজাটা টেনে দিবি।
দরজাটা বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যাসাগর রাগে একেবারে ফেটে পড়লেন। নবীনকুমারের দিকে অগ্নিবৰ্ষী নেত্ৰে চেয়ে তিনি বলতে লাগলেন, তোমার মনে এই ছিল? তুমি আমার সঙ্গেও তঞ্চকতা করতে চাও! তোমাদের বড়মানুষদের রক্তে রয়েছে লাম্পট্য আর ভণ্ডামি! সে তোমরা কখনো ছাড়তে পারবে না জানি, তবু এর সঙ্গে আমার নাম না জড়ালে বুঝি তোমাদের সুখ হয় না? আমি তো তোমায় সাধ করে কখোনো ডাকি নি, তুমি কেন আস আমার কাছে?
সারা জীবনেই নবীনকুমারের কখনো ধমক খাবার অভ্যেস নেই। অভিমানে তার ওষ্ঠ কম্পিত হতে লাগলো। অতি কষ্টে সে বললো, আমি-আমি তো কিছুই বুঝতে পাচ্চি না…আপনি আমায় কেন এ সব কতা বলচেন…?
—তমি কিছুই বুঝতে পারো না? তুমি সেয়ানা দুষ্ট। তুমি অম্লানবদনে আমার কাছে মিথ্যা কথা বলে যেতে পারো, আর আমার কথা বুঝতে পারো না। তোমাদের অর্থ আছে, লাম্পট্য করতে চাইলে তোমাদের কে বাধা দেবে। যদি বিবেক না বাধা দেয়! তোমার বিবেক বলে যদি কিছু থাকতো, তবে তুমি আমায় এমন মিথ্যা বুঝ দিয়ে যেতে না! লাম্পট্য করতে চাও, করো, কিন্তু তার মধ্যে একজন বিধবা কন্যাকে জড়াতেই হবে!
—লাম্পট্য? মিথ্যে কতা! বিধবা বিবাহ কত্তে চেয়ে আমি অন্যায় করিচি? আপনাকে কী মিথ্যে কতা বলিচি?
—তুমি বলেছে, এই বিধবা কন্যাটি তোমার স্বৰ্গতা পত্নীর সখী? কেন এই তঞ্চকতা? তোমার পত্নী জলজ্যান্ত বর্তমান নেই? আমারও জানা ছিল সে কথা, কিন্তু তোমার কথার ফেরে পড়ে ভুলে গিয়েছিলুম।
—যে বিধবা কন্যাটির কথা আপনাকে বলিচি, সে সত্যিই আমার স্বাগত পত্নীর সখী ছেল। এর মধ্যে মিথ্যে কিছু নেই। তবে আমি আর একটি বিবাহ করিচি বটে, সে কতার উল্লেখ প্রয়োজন মনে করিনি, কারণ তা সবাই জানে, ভেবিচিলুম, আপনিও জানেন।
—এক পত্নী বর্তমান থাকতেও তুমি একটি বিধবাকে বিবাহ করতে চাও?
—একাধিক পত্নী রাখা কি শাস্ত্ৰমতে নিষিদ্ধ না দেশাচার বিরুদ্ধ?
—বিধবাদের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে উপপত্নী রাখার বদলে লোকে কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য একটি করে বিধবাকে বিয়ে করবে, আমি কি এই উদ্দেশ্যে বিধবা বিবাহ প্ৰচলন করতে চেয়েছি? কচি বয়েসের বিধবা মেয়েগুলি যাতে সম্মানের সঙ্গে সংসারে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, যোগ্য সহধর্মিণীর পদ পায়, সেই ছিল আমার আশা। তোমার যা খুশী করো গে যাও, আমি তোমার আর মুখ দর্শন করতে চাই না।
—আপনি আমার ওপর অকারণে রাগ কচ্চেন। আমি আপনার সঙ্গে কোনো তঞ্চকতা কত্তে চাইনি। একাধিক বিবাহ যে অন্যায়, সে কতা আমার মনে আসেনি!
—ছি, ছি, ছি, কোনোক্রমে এই বিবাহের সঙ্গে আমার নাম জড়ালে সকলে মনে করতো, আমি বড়মানুষদের লোভ চরিতার্থ করার সুযোগ করে দিয়েছি। তোমার একটি পত্নী রয়েছে, তাকে তুমি বঞ্চনা করবে কোন অধিকারে? এক বিধবার মুক্তির জন্য এক সধবার সর্বনাশের কোন যুক্তি?
—আমি জানি, আমার পত্নী এ বিবাহে আপত্তি কত্তেন না। তিনি এই বিধবা কন্যাটিকে খুব ভালোবাসেন, দুজনে মিলেমিশে থাকতেন!
—তোমাদের মতন বংশের বধূদের আবার আপত্তি সম্মতি কী? তাদের মতামতের কোনো মূল্য আছে? তোমরা যা করবে, তাই তাঁরা মেনে নিতে বাধ্য হবেন! তোমরা যখন উপপত্নী রাখো, বারবনিতা-গমন করো, তখন বাড়ির বউদের আপত্তির কোনো তোয়াক্কা করো? নাকি সব বউরাই সাগ্রহে সম্মতি দেন? তোমার সঙ্গে আমি আর কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না! তোমার ঐ মহাভারত অনুবাদও একটা ভড়ং মাত্র! নাম কেনার হুজুগ! আমি সোমপ্রকাশে ছাপিয়ে দেবো যে তোমার কোনো কীর্তির সঙ্গে আমার কোনো সংযোগ রইলো না। তোমার এই বিবাহেও আমি প্ৰকাশ্যে বিরোধিতা করবো। এখন থেকে আমি বহু বিবাহ নিরোধ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে লাগবো! নবীনকুমার নতমস্তকে নীরব হয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বিদ্যাসাগর সবেগে পায়চারি করছেন ঘরের মধ্যে। এক একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছেন নবীনকুমারের দিকে।
নবীনকুমার আস্তে আস্তে বললো, আমার স্ত্রীর কোনো সন্তান হয়নি এ পর্যন্ত। যদি সে আমাদের বংশে কোনো উত্তরাধিকারী দিতে না পারে–
বিদ্যাসাগর দু হাতে কান চাপা দিয়ে বললেন, উঃ, এসব কথা শুনলেও গাত্রদাহ হয়। তোমার কত বয়েস, যে এর মধ্যেই নিজেকে অপুত্রক ভাবছো? তোমার পিতার কত বয়েসের সন্তান তুমি? তুমি আমায় আর উত্তেজিত করো না। তুমি নিজের পথ দেখো।
নবীনকুমার বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তার বুকটা বিষম দমে গেছে। আজ সকালেই সে আনন্দ সাগরে ভাসছিল, এখন এ কী হলো? দেশের এতগুলি মানুষের মধ্যে সে একমাত্র বিদ্যাসাগর মশাইকেই আঁকড়ে ধরেছিল, তিনিও তাকে দূরে ঠেলে ফেলে দিলেন।
যদুপতি উন্মুখভাবে অপেক্ষা করছিল, সে জিজ্ঞেস করলো, কী হলো?
উত্তর না দিয়ে নবীনকুমার তীক্ষ্ণভাবে তাকালো যদুপতির দিকে। যদুপতির ঠোঁটে যেন বিদ্রূপের হাস্য লেগে আছে! সে নিশ্চয়ই সব জানে। সে কুসুমকুমারীকে বিবাহ করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে, তাই সে চায় নবীনকুমারও যেন তাকে না পায়। সেই তা হলে বিদ্যাসাগরের কানে এই সব কথা তুলেছে।
নবীনকুমার আবার ফিরে এলো কক্ষের মধ্যে। বিদ্যাসাগর পিছনে ফিরে দাঁড়িয়ে আছেন, সে তাঁর কাছে গিয়ে বললো, আপনি আমাকে আর একবার সুযোগ দিন।
বিদ্যাসাগর মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আবার—?
—একজন সামান্য নারীর জন্য আমি আপনার কৃপা থেকে বঞ্চিত হতে পারি না কিছুতেই। আমার এই অভিপ্ৰায়ের কথা আমি আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে জানাইনি, আর কেউ জানবেও না।
—তুমি এই বিবাহ করবে না?
—আমি আপনার কাচে শপথ করে বলতে পারি। এর আগে শপথ করে গেচি, মহাভারতের অনুবাদ বিষয়ে, জীবন থাকতে সে কাজ আমি সম্পূর্ণ করবোই, আজ ফের শপথ করে যাচ্চি, ইহজীবনে আর দার পরিগ্রহের চিন্তা স্বপ্নেও স্থান দেবো না। আপনি একবার আপনার পদম্পর্শ করার অনুমতি দিন!
বিদ্যাসাগরের সারা শরীরে অস্বস্তির চিহ্ন ফুটে উঠলো, মুখখানা কুঁকড়ে গেল। তিনি বললেন, আঃ, কেন যে তোমরা আমাকে দিয়ে এত কঠিন কথা বলাও…আগে থেকেই…যদি-লোকে কুকথার জন্য মুখিয়ে আছে, একটা ছিদ্র পেলেই…তুমি মনে নিশ্চয়ই আঘাত পেয়েছে…আহা থাক, থাক—
বিদ্যাসাগরের চক্ষু দিয়ে জলের ফোঁটা ঝরে পড়তে লাগলো!
এবারেও বেরিয়ে এসে নবীনকুমার যদুপতির প্রতি ভ্রূক্ষেপও না করে সোজা উঠে গেল জুড়ি গাড়িতে। দুলালকে নির্দেশ দিল, বাড়ির দিকে চ!
কিছুদূর যাবার পরই সে আবার দুলালকে ডেকে বললো, থাক, গাড়ি ফেরাতে বল, আমি বাগবাজারে যাবো।
সেখানেও গেল না নবীনকুমার, খানিকটা যাবার পরই সে আবার মত বদলালো। সে যাবে গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে। বেশ রাত হয়েছে, এ সময় গঙ্গার ধার নিরাপদ স্থান নয়। তবু সে আমেনিয়ান ঘাটের কাছে এসে গাড়ি থেকে নেমে এলো। সর্বক্ষণের সঙ্গী দুলালচন্দ্ৰকে সেখানেই অপেক্ষা করতে বলে সে হাঁটতে লাগলো একা। তার মাথার মধ্যে ঝড়, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস সব যেন একসঙ্গে চলছে। মাঝে মাঝে ক্ৰোধে ওষ্ঠ কামড়ে ধরছে সে। তার নিশ্বাস ছুটন্ত অশ্বের মতন উষ্ণ।
গঙ্গার ধারে ধারে জাহাজ থেমে আছে অনেক। আজকাল অধিকাংশই কলের জাহাজ আসে, সেগুলির চোঙা দিয়ে ভোঁ ভোঁ শব্দ হয়। বেশ কয়েকটি জাহাজে জ্বলছে সার সার রঙীন লণ্ঠন, সেখান থেকে ভেসে আসছে নেশাগ্ৰস্ত নাবিকদের হল্লা। তীরেও চলছে নাবিকদের আনাগোনা, কেউ কেউ এক একটি বারবনিতার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে হিড়হিড় করে। এ সময় কোনো ভদ্র নাগরিক এ তল্লাটে আসে না।
নবীনকুমারের সেসব দিকে কোনো খেয়ালই নেই। সে ভাবছে, একটা জাহাজ ক্রিয় করে নিরুদ্দেশে ভেসে পড়লে কেমন হয়? এখুনি, এই মুহূর্তে! সেই জাহাজে আর কেউ থাকবে না, একজন নাবিকও না, শুধু সে একা। পৃথিবীর অজানা প্রান্তে যেসব দ্বীপে এখনও মানুষের পদম্পৰ্শ ঘটেনি, সেখানে সে একটি কুটির বানাবে।
একটু পরে নবীনকুমার জাহাজঘাট ছেড়ে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে হেঁটে এসে কেল্লার প্রাস্তবতী গড়খাইয়ের পাশে একটি গাছের নিচে দাঁড়ালো। তারপর সম্পূর্ণ অকারণে সে লাফিয়ে লাফিয়ে ধরার চেষ্টা করতে লাগলো। সেই গাছের একটি ডাল। সে ডালটি তার নাগাল পাবার কথা নয়, তবু সে চেষ্টা করে যেতে লাগলো, এক-আধবার নয়, অন্তত পঞ্চাশবার।
গাড়ির কাছে ফিরে এসে সে দুলালকে বললো, ভবানীপুর!
দুলাল সভয়ে বললো, ছোটবাবু, অনেক রাত হলো, বাড়ি যাবেন না?
নবীনকুমার দুলালের দিকে এমন ভাবে চাইলো যেন তাকে ভস্ম করে ফেলবে।
হিন্দু পেট্রিয়ট অফিসে হরিশ মুখুজ্যের খোঁজ করে পাওয়া গেল না। কার্যালয় তখন বন্ধ হয়ে গেছে। নবীনকুমার তখন চলে এলো জানবাজারে মুলুকচাঁদের আখড়ায়। সেখানে হরিশ রয়েছেন। বিরাট আসর বসেছে, এক দঙ্গল অচেনা লোকের সঙ্গে হরিশ প্রায় নেশায় উন্মত্ত। নবীনকুমারকে দেখে সকলে রই রই করে উঠলো, টলতে টলতে উঠে এসে হরিশ আলিঙ্গন করলেন তাকে। হাতের ব্র্যাণ্ডির বোতলটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী, চলবে?
নবীনকুমার হাত বাড়িয়ে বোতলটি গ্রহণ করে ওষ্ঠে ছোঁয়ালো।
হরিশ বললেন, কী বেরাদর, ফিরে এলে যে? বিদ্যেসাগরের চ্যালা হয়ে তো ভিজে বেড়ালটি সেজেচিলে? আর্ট-কালচার দিয়ে দেশোদ্ধার কর্বে! এসব গৰ্হিত নেশা তো তোমাদের করার কতা নয়?
ব্র্যাণ্ডির বোতলে একটা বেশ বড় চুমুক দিয়ে এবং অনেকদিন অনভ্যাসের ফলে দু-একবার বিষম খেয়ে সামলে নিয়ে নবীনকুমার বললো, আমি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাচে দুটি ব্যাপারের শপথ করিচি, আমার প্রাণ দিয়েও তা আমি রক্ষা কবো। আর সব ব্যাপারে আমি মুক্ত।