1 of 2

৪৯. বাংলার ছোট লাট স্যার রিভার্স টমসন

বাংলার ছোট লাট স্যার রিভার্স টমসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন মহারাজ বীরচন্দ্র। ফেরার পথে তিনি উৎকট গম্ভীর মুখ করে বসে রইলেন গাড়িতে। তাঁর জিভে একটা তিক্ত স্বাদ। লাটভবনে তাঁকে কোনও অপমান করা হয়নি, কোনওরকম রাজনৈতিক চাপ দেওয়া হয়নি, নিছক সাধারণ আলাপচারিতা ও চা-পান হয়েছে, মোট পঁচিশ মিনিট, তবু বীরচন্দ্রের মর্যাদা আহত হয়েছে, তাঁর চোখ ফেটে জল আসছে এখন।

মহারাজ বীরচন্দ্র ইংরেজিতে কথাবার্তা চালাতে পারেন, তবু তিনি শশিভূষণকেও সঙ্গে এনেছিলেন। একই গাড়িতে বসে আছেন শশিভূষণ, কয়েকবার মহারাজের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা কারও সক্ষম হলেন না, মহারাজ মুখ ফিরিয়ে রয়েছেন পথের দিকে। এমনিতে মহারাজ কৌতুকপ্রবণ, ত্রিপুরায় কখনও কোনও সাহেব-সুবো দেখা করতে এলে, তারা চলে যাবার পর তিনি নানারকম মশকরা করেন তাদের চাল-চলন নিয়ে। যখন তিনি গম্ভীর থাকেন, তখন তিনি দুর্বোধ্য হয়ে যান।

লাটভবনে মহারাজের সঙ্গে মহারানীরও আমন্ত্রণ ছিল। কিন্তু চন্দ্রবংশের কোনও রানী কখনও পরপুরুষের সামনে মুখ দেখায় না। মনোমোহিনী অবশ্য নেচে উঠেছিল, সে গড়ের মাঠ ও লাটপ্ৰসাদ দেখতে চেয়েছিল, তাকে কিছুটা কঠোরভাবেই নিবারণ করতে হয়েছে। ছোটলাট ঠিক জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার পত্নী আসেননি? মহারাজের বদলে শশিভূষণ উত্তর দিয়েছিলেন, তিনি ইনডিসপোজড।

ছোটলাটটি বেশ লম্বা, ঋজু শরীর। মহারাজের সামনে দাঁড়ালে তাকে প্রায় আধ হাত উঁচু মনে হচ্ছিল। মহারাজ বীরচন্দ্র কখনও খুব লম্বা লোকের কাছাকাছি দাঁড়ানো পছন্দ করেন না। তাঁকে মুখ তুলে কথা বলতে হয়। রিভার্স টমসন মাঝেমাঝেই তাকাচ্ছিল মহারাজের ভুঁড়ির দিকে, ঠোঁটে লেগেছিল সামান্য হাসি। না, কোনওরকম বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেনি ভুঁড়ি সম্পর্কে, হাসিটাও প্রায় অদৃশ্যই ছিল, তবু বোঝা যায়, ওর নিজের চেহারা নিয়ে বেশ গর্ব আছে, ও নাকি একসময় ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিল। নিজেই বলল সে কথা!

একটুক্ষণ থাকার পরই বীরচন্দ্রের মনে হয়েছিল, কেন এলাম? লাট সাহেব ডাকলেই আসতে হবে। যতই ছোট হোক তিনি একটি স্বাধীন রাজ্যের সিংহাসনের অধিকারী, আর এই টমসন সাহেবটি তো রানী ভিক্টোরিয়ার একজন কর্মচারী মাত্র, তার নিবাসে কেন আসতে বাধ্য হবেন তিনি! ইংরেজ রাজপুরুষদের আমন্ত্রণ মানেই আদেশের সমতুল্য। এরা অস্ত্রবলে বলীয়ান, তাই এরা আদেশ করতে পারে। তুচ্ছ ছুতো করে ইংরেজ সরকার ত্রিপুরায় একজন পলিটিক্যাল এজেন্ট চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করছে। রিভার্স টমসনের বিচ্ছিরি ঝোলা গোঁফ, বীরচন্দ্রের মতন বীরত্বব্যঞ্জন মোচ নয়, বীরচন্দ্র ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে মোচের ডগা পাকালেন কয়েকবার, কিন্তু ইংরেজটি তা গ্রাহ্যই করল না।

অভিযোগ জানাবার কিছু নেই, কাকেইবা জানানো যাবে। ইংরেজ শক্তি ইচ্ছে করলেই যে-কোনও দিন বীরচন্দ্রের মাথা থেকে রাজমুকুটটা ছিনিয়ে নিতে পালে। এখনও নিচ্ছে না, কিন্তু নিতে যে পারে, তা মাঝে মাঝেই বুঝিয়ে দেয়। আজকের আমন্ত্রণে সূক্ষ্ম অবজ্ঞা প্রদর্শন তারই নিদর্শন।

আমুদে স্বভাবের রাজা বীরচন্দ্রের মেজাজ যখন খারাপ হয়, তখন দু’তিন দিনেও মনের মেঘ কাটতে চায় না। সেদিন তিনি বাসস্থানে ফিরেও কথা বললেন না কারুর সঙ্গে। পরদিন কয়েকজন কবি ও গদ্যকারক ডাকা হয়েছে, সাহিত্যপ্রেমিক মহারাজ নিজেই আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। শিশিরকুমার ঘোষ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ বেশ কয়েকজন এসেছেন, দোতলার বৈঠকখানায় মহারাজ মধ্যমণি হয়ে বসলেন বটে, কিন্তু মুখমণ্ডল স্নান, কণ্ঠস্বরে একবারও পুলকের উচ্ছ্বাস ফুটে উঠল না, তিনি শুষ্কভাবে সকলকে আপ্যায়ন করলেন, তারপর একসময় ভেতরে চলে গেলেন।

পরদিন শশিভূষণ ডেকে আনলেন কীর্তনিয়ার একটি দলকে। মহারাজ কীর্তন বিশেষ পছন্দ করেন, এই দলটি শোভাবাজার নিয়মিত আসর বসায়। মহারাজের মনের জড়তা কাটেনি, এমন চমৎকার গান, তাও তাঁর পছন্দ হলো না!

গায়করা গেয়ে যাচ্ছে, মহারাজের কাছ থেকে কোনও বাহবা নেই। তারা রসের গান, প্রেমের গান, ভক্তির গান কতরকম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শোনাল, তারপর ধরল ইদানীং জনপ্রিয় এক শ্যামাসঙ্গীত।

জানো না রে মন, পরম কারণ

কালী কেবল মেয়ে নয়

মেঘের বরণ করিয়ে ধারণ

কখন কখন পুরুষ হয়

হয়ে এলোকেশী, করে লয়ে অসি

দনুজভনয়ে করে…

মহারাজ হাত তুলে সে গান থামিয়ে দিয়ে বললেন, হয়েছে, হয়েছে যথেষ্ট হয়েছে। এ আবার গান নাকি! ‘কখন কখন পুরুষ হয়’। কী কথার ছিরি! তোমাদের মধ্যে এখানি কে রচেছে?

অধিকারটি জিভ কেটে বলল, আজ্ঞে না মহারাজ, আমরা লিখব, এমন কী ক্ষমতা আছে! এটি সাধক কমলাকান্তর রচনা!

মহারাজ শশিভূষণকে বললেন, এঁদের পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দাও।

গায়কের দল বিদায় নেবার পর মহারাজ একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন শশিভূষণের দিকে। মনে মনে প্রমাদ গুণলেন শশিভূষণ। মহারাজের মেজাজ খুবই খারাপ। এখন এখানে আর কেউ নেই, মহারাজের মেজাজের সবটা ঝাল শশিভূষণের ওপরেই বৰ্ষিত হবে। কখনও কোনও ইংরেজ রাজপুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলেই মহারাজের এরকম অপ্ৰসন্নতার পালা চলে কয়েকদিন। মহারাজ বললেন, তোমাদের কলকাতায় এসব কী অরাজকতা চলছে! জগন্মাতা কালীকে নিয়ে এই সব ফচকেমির গান লেখা হয়, তোমরা তা সহ্য কর? কালী কেবল মেয়ে নয়, কখন কখন পুরুষ হয়,- এ সব কী যা-তা কথা! মা কালী কেন পুরুষ হবেন?

শশিভূষণ বুঝতে পারলেন, কমলাকান্ত কিংবা রামপ্রসাদের রচনার সঙ্গে পরিচিত নন মহারাজ। তিনি বৈষ্ণব পদাবলির অনুরক্ত। শাক্ত কবিরা কালীকে এমন আপন বোধ করেন যে, কালীকে ‘ন্যাকা মেয়ে’ বলতেও তাদের মুখে আটকায় না।

মহারাজকে এসব কথা সহজে বোঝানো যাবে না, বরং বকুনি খেতে হবে। শশিভূষণ বিনীতভাবে বললেন, পুরুষ মানে এখানে ঠিক পুরুষ বোঝানো হয়নি, পৌরুষের শক্তি। সবই তো একই শক্তির প্রকাশ।

মহারাজ আরও বিরক্ত হয়ে বললেন, একই শক্তি মানে? কলকাতায় এসে শুনছি, কাগজে পড়ছি, ঈশ্বর নাকি এক ও নিরাকার। ঠাকুর-দেবতারা সব মিথ্যে! এত বড় বড় মন্দির বানিয়ে কালী, দুর্গা, শিব, বিষ্ণুব পূজা করছি, তা সব মিথ্যের পূজা!

– আজ্ঞে ব্ৰাহ্মরা সে রকমই বলে বটে! ওঁরা মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করেন না।

-ব্ৰাক্ষরা বিশ্বাস করে না, তুমি বিশ্বাস করা?

– আমি ব্ৰাহ্মসমাজে এখন আর যাই না।

— তা জানতে চাইছি না। তুমি ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাস কর কি না, সেটা জানতে চাইছি। তোমার বাড়িতে গৃহদেবতার পূজা হয়? তুমি মন্দিরে গিয়ে গড় করা?

— মহারাজ, পারিবারিকভাবে আমরা বৈষ্ণব। সংস্কারবলে ঠাকুর-দেবতার মূর্তির সামনে বহুবার গড় করেছি তো বটেই। তবে, অপরাধ নেবেন না মহারাজ, আমার এখন মনে হয়, মূর্তিগুলি সব প্রতীক, কালী দূর্গ, লক্ষ্মী, সরস্বতী এঁরা সব এক একটি শক্তির প্রতীক।

— প্রতীক? এসব নাস্তিকের কথা। প্রতীক না ছাই! উদয়পুরের ত্রিপুরাসুন্দরী জাগ্রত দেবী! কালীঘাটের মন্দিরে হাজার বচ্ছর ধরে মানুষে পূজো দিচ্ছে কি এমনি এমনি? আমি বৃন্দাবনে রাধা-কৃষ্ণ মন্দিরে মূর্তির চোখে জল দেখেছি। আমাদের দেবতাদের যারা মিথ্যে বলে, তারা কুলাঙ্গার। কলকাতার শহরে স্লেচ্ছদের রাজত্ব, এখানে যো-যা খুশি বলতে পারে। আমার ত্রিপুরায় এমন কথা কেউ উচ্চারণ করে না। তোমরা ইংরেজদের পা চাটবে, একদিন সবাই খ্রিস্টান হয়ে যাবে!

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন মহারাজ। তাঁর ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে, মুখখানি রক্তিম।

আবার শশিভূষণের দিকে তাকিয়ে তিনি ঈষৎ সংযত স্বরে বললেন, আচ্ছা শশী মাস্টার, আমাকে একটা জিনিস বুঝিয়ে দাও তো! আমাদের হিন্দুদের ঈশ্বর যে নিরাকার, এটা বেরুল কার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে? আমাদের বাপ-ঠাকুর্দা, চোদ্দপুরুষ শিব, বিষ্ণু, কালী ঠাকুরের পুজো করে এল, তারা সব মুর্খ ছিল?

শশিভূষণ খুব নিচু গলায় বললেন, মহারাজ, এ বিষয়টা তো আমি ভালো জানি না। তবে যতদূর যা পড়েছি, আমাদের উপনিষদে তো ঈশ্বরের কোনও রূপের কথা নেই। ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, শিব এই তিন প্রধান দেবতাও কখনও কখনও ধ্যানে বসেন। এঁরা যার ধ্যান করেন, তিনিই পরমেশ্বর, তার তো কোনও শরীর বা মূর্তির কথা কোথাও পাওয়া যায় না।

মহারাজ বললেন, বেশ! হিন্দুর পরমেশ্বর নিরাকার। মোছলমান আর খ্রিস্টানরাও তো নিরাকারের ভজনা করে, তাই না? এই তিন নিরাকার কি আলাদা আলাদা, না এঁরাও এক? যদি এক হয়, তা হলে আলাদা আলাদা এতগুলি ধৰ্ম থাকার মানে কী?

শশিভূষণ বললেন, সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয়, কোনও মানে নেই। মানুষ মাত্রেই ঈশ্বরের সন্তান, তা হলে সব মানুষেরই এক ঈশ্বর। ধর্মও এক হওয়া উচিত। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কি, তাহলে পুরুত, মোল্লা, পাদ্রিদের ব্যবসার খুব অসুবিধে হয়। তাই তারা মানুষের মধ্যে এত বিভেদ তৈরি করে রাখে।

মহারাজ হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে জিজ্ঞেস করলেন, সেই মেয়েটি কোথায়?

শশিভূষণের মধ্যে বক্তৃতার আবেগ এসে গিয়েছিল, থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন।

মহারাজ আবার বললেন, সেই যে সুতো না দড়ি, কী নাম যেন মেয়েটির? তাকে ডাকো, আজ রাতে সে আমার শিয়রে বসে গান শোনাবে। দিব্যি ওর গানের গলা।

শশিভূষণ ইতস্তত করে বললেন, মহারাজ, সে তো অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছে।

মহারাজ বললেন, সে কী! এখনও অসুস্থ! ডাক্তার-কোবরেজ দেখাওনি? অমন গুণী ছুকরিটাকে মেরে ফেলবে নাকি? কী রোগ হয়েছে তার?

শশিভূষণ বললেন, জ্বর। মাঝে মাঝে ছাড়ে, মাঝে মাঝে বেড়ে যায়।

মহারাজ মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, এতদিন ধরে জ্বর! উহু, মোটেই ভালো নয়, মোটেই ভালো নয়! মহারাজ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো, তাকে দেখে আসি।

শশিভূষণের মুখখানি বিবৰ্ণ হয়ে গেল। ভূমিসূতার অসুখের ব্যাপারে তাঁকে মিথ্যে কথা বলতে হয়েছে অনেক। মহারাজ নিজে গিয়ে দেখলেই সব বুঝে যাবেন।

মরিয়া হয়ে তিনি বললেন, মহারাজ, আপনি কেন যাবেন? আমি বরং দেখি তাকে এখানে আনা যায় কি না।

মহারাজ বললেন, না, না, জ্বর গায়ে তাকে আসতে হবে না। আমি তার রোগটা একটু দেখে নিই, কিছু ওষুধও দিতে পারি।

শশিভূষণের ঘরের পাশ দিয়ে নীচে নামবার সিঁড়ি। মহারাজ জুতো খটখটিয়ে বারান্দা পার হয়ে সেই সিঁড়ির মুখে এসে থমকে দাঁড়ালেন। নীচের ভৃত্যমহল অন্ধকার, ওপর থেকে কিছুই দেখা যায় না।

শশিভূষণ বললেন, আমি একটা বাতি নিয়ে আসি বরং মহারাজ হেসে বললেন, বয়েস!

তিন দিন পর এই প্রথম মহারাজের ওষ্ঠে একটু হাসির রেখা দেখা গেল। তিনি শশিভূষণের পিঠে একটা হাত রেখে হাসতে হাসতে বললেন, নিজের বয়েসটার কথা এখনও মাঝে মাঝে ভুলে যাই বুঝলে মাস্টার, যৌবনকালে আমার খুব দৌরাত্ম্য ছিল, ভৃত্যমহলে গিয়ে প্রায়ই উঁকিঝুঁকি মারতাম। তেমন তেমন রূপসী দাসী দেখলে নিয়ে আসতাম ওপরে। কিন্তু যে-বয়েসে যা মানায়। এখন বুড়ো হচ্ছি, এখন একটা দাসীর ঘরে যাওয়াটা কি আমার পক্ষে শোভা পায়! ঝোঁকের মাথায় যাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু তুমি আমায় নিষেধ করোনি কেন! যে-সে লোক তো নাই, আমি একজন মহারাজ তো বটে, তোমার মনিব, আমি একটা ভুল করে ফেললে তোমার কি বাধা দেওয়া উচিত ছিল না? এই বয়েসে মান-সম্মানের ব্যাপারটা বড় হয়ে ওঠে হে!

কোনও উত্তর দেবার বদলে এখানে নীরব থাকাই শ্ৰেয়, শশিভূষণ ঘাড় হেট করে রইলেন।

মহারাজ তর্জনী তুলে বললেন, তিনদিনরে মধ্যে মেয়েটিকে সারিয়ে তোল। ভালো চিকিৎসক দেখাও, পয়সাকড়ির ব্যাপারে কার্পণ্য করো না। অমন একটি রত্ন কেন ছাইগাদায় পড়ে থাকবে। ওকে সুস্থ করে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিও!

মহারাজ নিজের মহলে ফিরে যাবার পর শশিভূষণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

সাময়িকভাবে নিষ্কৃতি পাওয়া গেল বটে, কিন্তু রীতিমতন একটা সংকট সৃষ্টি করে ফেলেছে। মহারাজ বীরচন্দ্ৰও ভূমিসূতার কথা ভুলে যাচ্ছেন না, ভূমি-সূতাও মহারাজের কাছে যাবে না। প্ৰথমে সে বলেছিল, বৈঠকখানা ঘরে সে গান শোনাতে যাবে না, এখন সে পুরোপুরি বেঁকে বসেছে। এখন সে বলছে, মহারাজের সামনেই সে আর যাবে না। কখনও। এর মধ্যে সে নিশ্চয়ই মহারাজ অনেক কিছু জেনেছে।

কিন্তু মিথ্যে অসুখের কথা বলে আর কতদিন চালানো যাবে? অন্য দাস-দাসীরা জানে। এমনকি মনোমোহিনীও জানে যে ভূমিসূতা অসুস্থ নয়। এ খবরটা কানে গেলে মহারাজ তো শশিভূষণের ওপরেই খড়গহস্ত হবেন। মিথ্যে ভাষণের জন্য দায়ী করবেন শশিভূষণকে।

ভূমিসূতা মেয়েটিও দারুণ জেদি। শশিভূষণ তাকে কিছু বোঝাতে গেলেই সে বলে, আমাকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিন।

কিন্তু কোথায় পাঠানো যাবে ওকে! শশিভূষণের পৈতৃক বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসার অন্য কোনও অসুবিধে ছিল না। কিন্তু মহারাজের নেকনজরে পড়ে গেছে, মহারাজ ওর খবর জানতে চাইলে কী উত্তর দেওয়া যাবে n এর মধ্যে মহারাজ একদিন শশিভূষণদের বাড়ি দেখতে গিয়েছিলেন। মেজ বউঠানের অনুরোধে রানী মনোমোহিনীকে একদিন ও বাড়িতে পাঠাবার কথা আছে। ওখানে ভূমিসূতাকে লুকিয়ে রাখা যাবে না। ভূমিসূতা এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, এ কথাটা বলা যেতে পারে, কিন্তু শশিভূষণের বাড়িতে তাকে আশ্ৰয় দেওয়া হয়েছে, এত বড় মিথ্যেটা ধর্মে সইবে না।

এই চিন্তাটা শশিভূষণের মনে সব সময় দংশন করে। ভূমিসূতা, ভূমিসূতা, সামান্য এক দাসী, তার কথা সারাদিন মনে রাখতে হবে কেন। শশিভূষণ অনেকগুলি বছর কোনও রমণীর চিন্তাই মনে স্থান দেননি।

সুহাসিনী চলে গেছে সাড়ে ছ’বছর আগে। মাত্র পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবন। কিন্তু সেই পাঁচ বছরেই নারী সম্পর্কে ধারণার বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে শশিভূষণের জীবনে। সুহাসিনী রূপ-লাবণ্যময়ী, কিছু কিছু লেখাপড়াও জানত, বিয়ের সময় সে নিতান্ত বালিকা ছিল না, তখন সে পঞ্চদশী। শশিভূষণ প্রাণ ঢেলে ভালোবেসেছিলেন, সুহাসিনীর কোনও সাধ কখনও অপূর্ণ রাখেননি, তাকে নিয়ে বেড়াতে গেছেন দাৰ্জিলিং, নেপাল। কাথবার্টসনের দোকানে বলা ছিল, নতুন কোনও ফরাসি সুগন্ধী এলেই বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে। প্রতি রাতে শশিভূষণ স্ত্রীকে ইংরেজি ও সংস্কৃত কাব্য পাঠ করে শোনাতেন। একজন স্বামী তার স্ত্রীকে যতখানি দিতে পারে, তা সব যদি উজাড় করে দেয়, তার পরেও যদি সে স্ত্রীর মন না পায়, তা হলে মানুষের ওপর বিশ্বাস থাকে কী করে!

শুধু ভালোবাসা নয়, শশিভূষণের পৌরুষেও কোনও ঘাটতি ছিল না, অন্য নারীরা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতো, কিন্তু তিনি সুহাসিনী ছাড়া আর কারুকে জানতেন না। তারপর যখন সুহাসিনীর হঠাৎ ভেদবমি শুরু হল, দু’দিনের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস পড়ল, তখন কিন্তু শশিভূষণ কোনও শোক অনুভব করলেন না, তার আগেই তাঁর মন সুহাসিনীর প্রতি অসাড় হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর তিন মাস আগে শশিভূষণ জানতে পেরেছিলেন, শুধু জানা নয়, স্বচক্ষে দেখেছিলেন, সুহাসিনী তার মামাতো ভাই অনঙ্গমোহনের প্রতি গভীরভাবে আসক্ত। গুপ্ত লীলা চলছিল তাদের মধ্যে।

প্রথম জানার পর আঘাতের তীব্রতায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন শশিভূষণ। তারপর তিনি আর কখনও সুহাসিনীর মুখের দিকে তাকাননি। অনঙ্গমোহন তার তুলনায় অতি সাধারণ একজন মানুষ, তবু সে রকম একজনের কাছে হেরে যাবার গ্লানি শশিভূষণ কখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। নারী জাতি সম্পর্কেই তাঁর বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছিল।

সুহাসিনীর জামা-কাপড়, ব্যবহৃত জিনিসপত্র সব বিলিয়ে দিয়েছেন। গয়নাগাটি বিক্রি হয়ে গেছে, ওর কোনও চিহ্নই আর রাখতে চাননি শশিভূষণ। সুহাসিনীর কোনও ছবিও নেই। শুধু শশিভূষণের বুকের মধ্যে রয়েছে একটা বিরাট ক্ষত। সে ক্ষতের কথা তিনি আর কারুকে জানতে দেননি, তাতে যে তারই পরাজয়।

সেই অনঙ্গমোহন কিন্তু এখনও দিব্যি হেসে খেলে বেড়ায়। সুহাসিনীর জন্য সে কতটা শোক করেছে কে জানে, তবে চিরকালের মধ্যেই সে যে সুহাসিনীর কনিষ্ঠ ভগ্নী, তরঙ্গিনীর সঙ্গে একই রকম গোপন প্রণয় সম্পর্ক পাতিয়েছিল, তা শশিভূষণ স্পষ্ট টের পেয়েছিলেন। ওই তরঙ্গিনীর সঙ্গে আবার শশিভূষণের বিবাহের প্রস্তাব উঠেছিল। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার! বিবাহের চিন্তা শশিভূষণ তার মন থেকে একেবারে মুছে ফেলেছেন!

প্রথম দিকে ভূমিসূতাকে নিয়ে কোনও ঝঞাট ছিল না। সে নিজে থেকে কোনও কথা বলে না, নিঃশব্দে ঘরের কাজ করে যায়। যথাসময়ে ঠিক ঠিক জিনিসটি গুছিয়ে রাখে শশিভূষণের জন্য। শশিভূষণ কোনওদিনই দাস-দাসীদের সঙ্গে প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটিও কথা বলেননি। ঘরের কাজ যে করে, সে দাস না দাসী, তাতেও কিছু আসে যায় না। বছর কয়েক আগেকার সেই বড় অসুখটার পর শশিভূষণ বেশি ঝাল বা তেল-মশলা দেওয়া খাবার খেতে পারেন না। তাঁর বড়বউঠান সেজন্যই ভূমিসূতাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, সে শশিভূষণের ঠিক উপযোগী খাদ্য রোধে দেয়। কিন্তু যার কাজ রান্না করা, তার আবার গান জানার দরকার কী! মহারাজের মহলে গিয়ে গান শুনিয়েই তো মেয়েটি যত বিপত্তি বুড়ি, রাঁধুনি বা দাসী থেকে মহারাজের রক্ষিতার পদ পেতে অনেকেই লালায়িত হয়, কিন্তু এ মেয়ের যে সেদিকেও ঝোঁক নেই।

রাত্তিরে এক গেলাস গরম দুধ দিতে আসে। যথারীতি অন্যদিনের মতন একটি টিপয়ের ওপর গেলাসটি রেখে তার ওপর একটি রেকাবি ঢাকনা দিয়ে যাচ্ছে ভূমিসূতা, বিছানায় আধশোওয়া হয়ে শশিভূষণ বললেন, দাঁড়াও।

ভূমিসূতা থেমে গেল, শশিভূষণের ঠিক মুখোমুখি দাঁড়াল না, এক পাশ ফিরে রইল। নীল রঙের শাড়ি পরা, পায়ে আলতা। একজন ফটোগ্রাফারের চোখ দিয়ে মেয়েটির মুখ ও দাঁড়াবার ভঙ্গি লক্ষ করল শশিভূষণ। ফুলের বাগানে দাঁড় করিয়ে একদিন ওর ছবি তিনি তুলছিলেন, তার চেয়ে এখন যেন বেশ কিছুটা পরিবর্তন ঘটে গেছে ওর শরীরে। কুসুমকলিটি এখন প্রস্ফুটিত হয়েছে।

শশিভূষণ বললেন, শোনো, মহারাজ আজও তোমার খোজ করছিলেন। আর কতদিন অসুখের ছুতো করে কাটাবে? মহারাজকে গান শোনাতে তোমার আপত্তি কী?

ভূমিসূতা বলল, না, আমি পারব না।

তাঁর কণ্ঠস্বর মৃদু অথচ দৃঢ়। যেন এর আর অন্যথা হবার নয়।

শশিভূষণ আবার বললেন, পারব না বললে কি চলে! মহারাজের যখন ঝোঁক চেপেছে, একদিন না একদিন তো যেতেই হবে।

ভূমিসূতা বলল, আপনি আমাকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিন।

শশিভূষণ বললেন, কোথায় পাঠাব?

ভূমিসূতা চুপ করে গেল। পৃথিবীতে যার কেউ নেই, যে মেয়ে কোনও পথই চেনে না, সে কী করে জানবে, অন্য কোথায় তার আশ্ৰয় জুটবে?

শশিভূষণ বললেন, মহারাজকে আমি কতদিন আটকে রাখতে পারব জানি না। উনি তিন দিন সময় দিয়েছেন, কাল ডাক্তার এসে তোমায় পরীক্ষা করবে।

ভূমিসূতা এবার শশিভূষণের দিকে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াল। দ্বিধাহীনভাবে তাঁর চোখে চোখ রেখে বলল, আমি একটা ছুরি জোগাড় করে রেখেছি। কেউ যদি আমাকে গান গাইবার জন্য জোর করে, আমি আমার গলার নলিটা কেটে দেব!

শশিভূষণ স্তম্ভিতভাবে তাকিয়ে রইলেন।

ভূমিসূতা যে বাঙালি নয়, তা হঠাৎ হঠাৎ এক-একটি ঝলকে প্রকাশ পায়। কোনও সাধারণ ঘরের বাঙালি মেয়ে কি এমনভাবে কথা কইতে পারে। পুরুষদের সামনে তো তাদের মুখই ফোটে না।

বেশ কিছুক্ষণ অপলকভাবে তাকিয়ে রইলেন শশিভূষণ। যেন বহুকাল পরে তিনি একটি নারীকে পরিপূর্ণভাবে দেখছেন। এ মেয়ে যেন ছদ্মবেশে এখানে লুকিয়ে রয়েছে। এ তো দাসী হতে পারে না!

হাত বাড়িয়ে তিনি বললেন, কই ছুরিটা কোথায় আমায় দাও।

ভূমিসূতা বলল, সেটা লুকিয়ে রেখেছি।

আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন শশিভূষণ। একবার ভাবলেন, এক্ষুনি নীচে গিয়ে ওর ঘর থেকে ছুরিটা উদ্ধার করা উচিত। হুট করে যদি ঝোঁকের মাথায় কিছু করে বসে!

কিন্তু বিছানা থেকে নামলেন না। শশিভূষণ। দ্বিতীয় চিন্তায় মনে হল, একটি ছুরি সঙ্গে থাকলেই যেন এই মেয়েকে মানায়।

আপন মনে বললেন, আমি কখনও তোমার গান শুনিনি। কেমন গাও তুমি? কার কাছে শিখেছি?

বলল, আমার বাবার কাছে।…এখন নিজে নিজে শিখি।

শশিভূষণ বললেন, নিজে নিজে গান শেখা যায়? কেন শেখ? কার জন্য?

ভূমিসূতা মুখ নিচু করে খানিকটা দ্বিধার সঙ্গে বলল, ভগবানের জন্য। আর নিজের জন্য!

শশিভূষণ অবাক হয়ে মেয়েটিকে দেখলেন সম্পূর্ণ ভাবে।

তিনি বললেন, মহারাজকে না হয় নাই শোনালে, তুমি আমাকে, শুধু আমাকে একটা গান শোনাবে, ভূমিসূতা? আমি জোর করব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *