1 of 2

৪৯. পাতলা করে মাছের ঝোল আর ভাত

৪৯

লাঞ্চে আজকে পাতলা করে মাছের ঝোল আর ভাত দিয়েছিল। সঙ্গে ডাল এবং আলু-টমেটোর তরকারি একটা।

কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। তবু খেতে হয়। হাসপাতালের রান্না তো!

আসলে দোষটা রান্নার নয়। হাসপাতালে যে-মানুষ আসে, তার সুস্থ মানুষের মানসিকতাই থাকে না। কোনও কিছুই ভাল লাগে না তখন। খাওয়ার বেলা তো ব্যতিক্রম হবার কথা নয়!

খাওয়ার পর রুষার দিয়ে-যাওয়া বইটা তুলে নিল।

“ক্রাকাটাও” সম্বন্ধে কেউই জানত না কিছু, সমুদ্রের মধ্যে এই ছোট্ট দ্বীপটি নিয়ে কোনও ভ্রমণপিপাসু বা আবিষ্কারকের মাথাব্যথাও ছিল না কোনও। আঠারশো তেত্রিশ খ্রীস্টাব্দে যখন এই ছোট্ট দ্বীপটাই সমস্ত পৃথিবীর কাছে খবর হয়ে উঠেছিল তখনই মানুষ প্রথম জানল এর অস্তিত্বর কথা।

জাভা আর সুমাত্রার মধ্যের সুণ্ডা প্রণালীতে আনুমানিক দশ হাজার বছর আগে এই তরুণ দ্বীপটি মাথা তুলেছিল, তার বুকের মধ্যে সর্বনাশের বীজ নিয়ে। পৃথুও যেমন, অনেক বছর আগে। এর পাশেই মাথা উঁচিয়ে ছিল আরও দুটি ছোট ছোট দ্বীপ। তাদের নাম ‘লাঙ্গ’ আর ‘ভের্‌লাটান্’। এই দুটি দ্বীপও জলের নীচের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতেরই ফল।

আঠারশো তিরাশি খ্রীস্টাব্দ অবধি আট মাইল লম্বা আর পাঁচ মাইল চওড়া এই দ্বীপটি বুকের মধ্যের সামান্য ধোঁয়া ওঠা তিনটি জ্বালামুখ নিয়ে পৃথিবীর মানুষের উৎসুক দৃষ্টির বাইরেই পড়ে ছিল। তার দাবি ছিল না কারও উপরই। অন্য কেউ দাবি করেনি তাকে। পৃথুর সঙ্গেই যেন মিল ছিল খুবই দ্বীপটির। ঘন সবুজ সতেজ ট্রপিকাল জঙ্গলে ‘ক্রাকাটাও’-এর প্রতিটি বর্গইঞ্চি জমি ঢাকা ছিল। সজীবতার সংজ্ঞা ছিল যেন। আগ্নেয়গিরির চূড়োগুলি থেকে তাদের পায়ের তলার সামুদ্রিক মেখলা পর্যন্ত সেই ঘন জঙ্গল বিস্তৃত ছিল। তার মধ্যে বাস করত অনেক রকম পাখি আর জন্তু-জানোয়ার।

অনেক অনেকদিন আগে, ক্র্যাকাটাওতে জাভা ও সুমাত্রার দণ্ডিত অপরাধীরা গিয়ে আস্তানা গাড়ত। কখনও কখনও-বা সুণ্ডা প্রণালীতে মাছ-ধরতে-যাওয়া জেলেরাও গিয়ে হাজির হত। তবে, তারা থাকত না সেখানে। যখন এই দ্বীপটিতে অগ্ন্যুৎপাত হয় সেই সময়ের বেশ কিছুদিন আগে থাকতেই কোনও মানুষের সঙ্গেই সংস্রব ছিল না ক্র্যাকাটাওয়ের।

ইন্দোনেশিয়ার রাজধানীর, আজকের জাকার্তার তখনকার নাম ছিল বাটাভিয়া আর বোগোর। সবুজ জাভা দ্বীপের সবচেয়ে বড় শহর ছিল এ দুটি। আঠারশ বিরাশির মে মাসের কুড়ি তারিখে বাটাভিয়া আর বোগোরের মানুষেরা হঠাৎ মেঘগর্জনের চেয়ে হাজার গুণ তীব্র ঘনঘন গর্জন শুনে ভয়ে কেঁপে উঠল। এমন শব্দ তারা আগে কখনও শোনেনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সেই আকাশব্যাপী গুরুগুরু ধ্বনি হতে লাগল আর কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে ফেলল। তাদের বুঝতে দেরি হয়নি যে, এ ক্র্যাকাটাও আগ্নেয়গিরিরই অগ্ন্যুৎপাত। বুঝতে পেরে, ভয়েরও অন্ত ছিল না তাদের। কারণ, পৃথিবীর একেবারে গোড়াসুদ্ধ টান মেরে উপড়ে ফেলতে চাচ্ছিল সেই আগ্নেয়গিরি। সমুদ্রের উপরও তার জের এসে পড়েছিল।

সেই রাতে, ক্রাকাটাওয়ের তিনশো মাইল দূরের কোনও জায়গার মানুষও চোখের পাতা এক করতে পারেনি।

ওই বছরেরই অগাস্ট মাসের সাতাশ তারিখে ভোর হবে-হবে যখন, ঠিক তখনই পর পর চারটি সাংঘাতিক অগ্ন্যুৎপাতে আকাশ বাতাস সব যেন বিদীর্ণ হয়ে ফালা ফালা হয়ে চিরে গেল। ক্র্যাকাটাও লাফিয়ে উঠল তার ভিত ছেড়ে এবং আকাশের অনেক উঁচুতে উৎক্ষিপ্ত হয়ে তার শরীরের সাড়ে চারশ কিউবিক বর্গমাইল জায়গা সমুদ্রের মধ্যে ছিটকে গিয়ে পড়ল। তার লাভা আর মাটি, গাছপালা, জঙ্গল, পাহাড় এবং পশুপাখি সমেত।

সেলেবিস্ দ্বীপপুঞ্জের ম্যাকাসারের লোকেরা ভাবল, কোনও জাহাজই বোধহয় বিপদে পড়েছে এবং বিপদ-সংকেত পাঠাচ্ছে ঘন ঘন কামান দেগে।

সুদুর অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেতে-ক্ষেতে উৎকৰ্ণ কৃষকরা একে অন্যকে জিজ্ঞেস করল, তাদের সেনাবাহিনী কোনও যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছে কি না! কেউ বলল, পাহাড়ে বোধহয় পাথর ব্লাস্টিং করা হচ্ছে। তারই আওয়াজ এ।

পাথর ব্লাস্টিং হচ্ছিল ঠিকই, তবে, মাত্র তিন হাজার মাইল দূরে।

সুদূর ভারত মহাসাগরের রড্‌রিগ্ দ্বীপপুঞ্জের পুলিশরা তাদের রিপোর্টে সেদিন লিখল যে, তারা খুব ভারী কামানের আওয়াজ শুনেছে পুবদিকে কোথাও। হয়তো বিপদে-পড়া কোনও জাহাজেরই বিপদ-সংকেত।

ক্র্যাকাটাওয়ের অগ্ন্যুৎপাতের ফলে হাওয়ার স্রোতেরও রদবদল হয়েছিল। সেই পরিবর্তিত বেগময় বায়ুস্রোত সমস্ত পৃথিবীকে বহুবার সামান্য সময়ের মধ্যে প্রদক্ষিণ করে গেল। ক্র্যাকাটাওয়ের চারপাশের বহু বর্গমাইল জুড়ে সমস্ত এলাকা উৎক্ষিপ্ত ছাইয়ে ভরে গেল। এত মাটি, পাথরই ছিটকে উঠে পড়েছিল সমুদ্রে যে, একদিনেই সুণ্ডা প্রণালী গভীরতা হারাল। বাটাভিয়া ও বোগোরে দিনের বেলাতেই এমন অন্ধকার ঘনিয়ে এল যে, ঘরে ঘরে আলো জ্বালতে হল সবাইকে।

পৃথু এই অবাধ অবধি পড়ে বইটা নামাল বুকের উপরে।

ভাবতে লাগল, ক্র্যাকাটাও পড়বার জন্যে এমন করে বলে গেল কেন রুষা? দশ হাজার বছর বয়সী এই দ্বীপ আর একশ বছর আগের ভূমিকম্পের কথা জেনে পা-হারানো পৃথু কী করবে? লাভ কী?

কিন্তু বইটি রুষা নিজে হাতে নিয়ে এসে যখন এই লেখাটিই বারবার করে পড়তে বলে গেল তখন এর তাৎপর্য নিশ্চয়ই আছে কিছু।

সিস্টার লাওয়ান্ডে ঘরের বড় আলোটা নিভিয়ে দিয়েছেন। পৃথুর মাথার কাছের টেবল-ল্যাম্পটি জ্বালানো আছে আর ঘরের কোণাতে সিস্টারের টেবল ল্যাম্পটি। একবার চেয়ে দেখল ও। গভীর মনোযোগের সঙ্গে বই পড়ছেন উনি।

মারাঠিদের সঙ্গে বাঙালিদের অনেকই ব্যাপারে মিল আছে। তার মধ্যে সাহিত্যপ্রীতিও একটি।

ওর ঠোঁটের কোণায় হাসির আভাস ফুটে উঠল। বুঝেছে। বুঝেছে পৃথু। রুষা কেন এই বইটি পাঠিয়েছে তাকে। পৃথু যে নিজেই আজ একটি ক্র্যাকাটাও। সবুজ-হারানো, শরীর-মনের যা পরম প্রাণ, সেই আনন্দ-হারানো ক্র্যাকাটাও। যেখানে পাখি ডাকে না, ফুল ফোটে না; যা বন্ধ্যা। পৃথুর শরীরের এবং মনের মধ্যেও বিস্ফোরণ ঘটে গেছে প্রচণ্ড। ক্র্যাকাটাওয়েরই মতো।

কিন্তু তারপর?

তারপর কী?

তারপর বিজ্ঞানীরা ক্র্যাকাটাওকে নজরে রাখলেন। একটি দল গিয়ে পৌঁছলেন অগ্ন্যুৎপাতের ঠিক দু’মাস পর। তখনও ক্র্যাকাটাও ফুঁসছে। তখনও গরম সে। ধুঁয়ো উঠছে তখনও।

ছ’মাস পর কোট্টো বলে একজন জীববিজ্ঞানী প্রথম আবিষ্কার করলেন প্রাণের অস্তিত্ব।

শ্মশান হয়ে যাওয়ার মাত্র ছ’ বছরের মধ্যেই ক্র্যাকাটাও আবার সুন্দর, সবুজ, ফুলে-ফলে ভরা একটি ছোট্ট দ্বীপে রূপান্তরিত হল। ফুলে ফুলে প্রজাপতি উড়ল আবার। মাছিরাও ঘুরে ঘুরে প্রাণ দিতে লাগল ফুল ফলের। পোকামাকড়, গুবরে পোকারা নড়েচড়ে বেড়াতে লাগল আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেই অসমসাহসী অ্যাডভেঞ্চারার ও প্রাচীনতম শিকারি মাকড়শাদের খাদ্যও হতে লাগল।

ক্র্যাকাটাওকে দেখে আরও কয়েক বছর পর আর বোঝারই উপায় রইল না যে, সে একদিন রিক্ত, দগ্ধ, সর্বস্বহৃত হয়ে গেছিল।

মিসেস লাওয়ান্ডে বললেন, আলোটা নিভিয়ে দিই এবার? নটা বাজে। ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন এবারে।

পৃথু জবাব দিল না কোনও। সিস্টার নিজের কাজ সব সেরে নিলেন। তারপর আলোটা নিভিয়ে দিলেন। উনি পৃথুর মাথার দিকে বসে থাকেন। ওঁর টেবলের আলোটাতে ঘরে একটা নীলচে আভা হয়। স্বপ্নিল পরিবেশ তৈরি হয় এই হাসপাতালেও।

ঘুম ভেঙে গেল পৃথুর। পুবের আকাশে সবে লালের ছোপ লেগেছে। বাইরের পথ দিয়ে ট্রাক যাবার শব্দ শোনা যাচ্ছে। দূর স্টেশানে ডিজেল ইঞ্জিনের গম্ভীর বাঁশি।

ঘুম ভাঙতেই পৃথুর ক্র্যাকাটাওয়ের কথা মনে হল। রুষার কথাও। মিলি ও টুসুর কথা। কুর্চির কথা। রুষার কথাও। ঠুঠা, শামীম, সাবিরসাহেব, গিরিশদা, দিগা পাঁড়ের কথা।

দিগা পাঁড়ের কাছে আর কি ও অমন হুট্‌হুট্‌ করে চলে যেতে পারবে? দিগা, পৃথুকে দুদিন দেখতে এসেছিল। কোনও ভালমানুষ কাছে এলেই মনটা বড় প্রসন্ন লাগে। ভাল আত্মা বোধহয় একেই বলে। আবার কিছু লোক কাছে এলেই মনে হয় অশুভ হবে। খুঁতখুঁত করতে থাকে মন। মনে হয়; কখন যাবে! সেই লোকগুলো বাজে। জাতকের খলের মতো। দিগার মধ্যে যে গভীর এক আধ্যাত্মিক সুখ আছে, সেই সুখ দিগার চারপাশের মানুষের মধ্যেও বিকিরিত হয়।

প্রকৃতিই পৃথুর কাল হল। মুক্তি চাইতে গিয়ে এক অদৃশ্য বন্ধনেই কেন জড়িয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতিই তাকে এক অদৃশ্য শক্তি সম্বন্ধে সচেতন করেছে। যে-শক্তি আকাশ থেকে খেয়াল-খুশিমত তারা খসিয়ে দিয়ে একটুও বিচলিত হয় না।

যে-শক্তিকে, পৃথু নীরবে অনুভব করেছে আশৈশব; সন্ধ্যাতারার নরম নীলাভ দ্যুতিতে, কিশোরীর অপাপবিদ্ধ চোখের উৎসুক চাউনিতে, রুষার মান্য, মানসিক দৃঢ়তায়, কুর্চির নিভৃত নমনীয়তায়, বিজলীর নিক্কণিত, নিবিড় নগ্নতায়; ঠুঠা বাইগার শিউলি-ঝরানো সারল্যে, ডাকু মগনলালের ক্রুর কিন্তু ভণ্ডামিহীন খলত্বে, চিতল হরিণীর দৌড়ে-যাওয়ার উড়াল ছন্দে; তাকেই বোধহয় অশিক্ষিত, অনাধুনিক, অকম্যুনিস্ট মানুষ ঈশ্বর বলে জানে।

কুর্চি, মা কালির পুজো করে। কুর্চির ঈশ্বরের বাস মন্দিরে, যে-মন্দিরে মধ্যরাতে এখনও শিবা-ভোগ হয়। প্রদীপের কম্পমান আলোয় শ্যামা মা মুখব্যাদান করে তাঁর কালো পাথরের শরীরী নগ্নতার বেগুনি জেল্লায় কুর্চিকে মন্ত্রমুগ্ধ করেন। দিগা পাঁড়ের ঈশ্বরের নিবাস ছিল অযোধ্যায়। রামই তার সব। আর শামীমের খুদাহ থাকেন বাজারের মোড়ের বড়া-মসজিদে। আর শুধুই কি বড়া মসজিদেই?

একজন লোক বসে মসজিদে মদ খাচ্ছিল। তাকে যখন বলা হল যে, খুদাহ্‌র পবিত্র স্থানে বসে মদ খেও না, তখন সে বলল: “পীনে দে মুঝে মস্‌জিদমে বৈঠ্‌কর, ইয়া উ জাগে বাতাঁদে যাঁহা খুদাহ্ না হো।”

মার্জা গালীব কি? না, জিগর মোরাদাবাদী? না অন্য কারও?

কিছুই মনে থাকে না আজকাল পৃথুর।

মানে, মসজিদেই বসে আমাকে পান করতে দাও হে, নইলে এমন কোনও জায়গা দেখিয়ে দাও আমাকে; যেখানে খুদাহ্ থাকেন না!

এই পৃথিবীর কোন্ ফালিতে থাকেন না খুদাহ্? দেখাও তাহলে?

যে-শক্তিকে পৃথু অন্তরে অনুভব করে দৃপ্ত সূর্যালোকে অথবা শান্ত চন্দ্রালোকে, যাকে সে পাহাড়ে, বনে, নদীতে, মনের চোখে প্রত্যক্ষ করে বারবার শিউরে ওঠে; যে-শক্তি নারীর সৌন্দর্য, ফুলের সুবাস, পাখির চিকন সুরে এই সুন্দর পৃথিবী ভরে দিয়েছে; তাকে কোন নামে যে ডাকবে, ভেবে পায় না পৃথু। পৃথুর সেই অনামা, অদৃশ্য জন, কালিও নন, রামও নন, খুদাহ্‌ও নন, নন পরমব্রহ্মও।

“ওদের কথায় ধাঁধা লাগে তোমার কথা আমি বুঝি। তোমার আকাশ তোমার বাতাস এই তো সবই সোজাসুজি হৃদয় কুসুম আপনি ফোটে জীবন আমার ভরে ওঠে দুয়ার খুলে চেয়ে দেখি হাতের কাছে সকল পুঁজি।—”

সকাল হয়ে গেল। প্রেমিকার প্রথম পরশের মতো অস্ফুট উষ্ণতার চুমু এঁকে দিচ্ছে রোদ; পৃথিবীর কপালে। রুষা কেন যে বইটি পাঠিয়েছে, তা এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছে পৃথু। বিরাট সমুদ্রের একটি ছোট দ্বীপ ক্র্যাকাটাও-ও যদি নতুন করে বাঁচতে পারে; তবে মানুষ পৃথু পারবে না কেন? কেন পারবে না? পারবে। পারবে। পারবে। রুষার বিরুদ্ধে পৃথুর অনেকই অভিযোগ। তবু তার বুদ্ধির কারণে তাকে স্তুতি না করেও পারে না। রুষা। কুর্চি। বিজলী। ঠুঠা। ভুচু। সাবির সাহেব। গিরিশদা। তোমাদের সকলের জন্যই বাঁচবে পৃথু। সত্যিই বাঁচবে। নিজের জন্যে যদি নাও বাঁচে, তোমাদের জন্যেই বাঁচবে। এত ভালবাসা, এত প্রীতি, এত সখ্য, চারিধারে এত গান, এত হাসি, এত চোখ-কাড়া সব দৃশ্য, কান ভরা সব সুর ছেড়ে যেতে কি ইচ্ছে করে? সরে থাকতে ইচ্ছে করে কি কারও, এই আনন্দভাণ্ডার থেকে?

আনন্দম! আনন্দম! আনন্দম!

নিশ্চয়ই বাঁচবে পৃথু।

সিস্টার লাওয়ান্ডে খাটের পাশে এসে বললেন, গুড মর্নিং মিঃ ঘোষ।

পৃথু বলল, গুড মর্নিং।

মনে মনে বলল, ভেরি গুড মর্নিং ইনডিড।

বুধবারে ভুচু এসেছিল। তারপর সারা সপ্তাহ আর কেউই আসেনি, কাছের মানুষরা।

কাছের মানুষ?

এখন সকাল ঝলমল করছে। ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে পৃথুর। আজ সকালের ডিউটিতে আছেন সিসটার লাওয়ান্ডে। ওদের নিজেদের সুবিধেমত ডিউটি বদল করে নেন, উনি আর সিস্টার জনসন।

ইনজেকশান এবং ওষুধ দিয়ে, পৃথুকে বলে, বাইরে গেছেন উনি অন্য ওয়ার্ডে গল্প করতে। ঘণ্টাখানেক পরে ফিরবেন বলে গেছেন। যাওয়ার আগে খাটটাকে মাথার দিকে অনেকটা উঁচু করে দিয়ে গেছেন। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে। ধবধবে সাদা বিছানায় আধো-শোয়া হয়ে জানালা দিয়ে বাইরের আলো-ঝলমল অশ্বত্থ গাছ, তাতে ঝাঁপাঝাঁপি করা হরিয়ালের ঝাঁক আর তার হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর সব রঙ, শব্দ ও গন্ধের দিকে লোভীর মতো তাকিয়ে আছে পৃথু।

পাখি উড়ে যাচ্ছে শীতের অস্পষ্ট ভোরের আকাশ থেকে মাঝ-সকালের আকাশে। অভ্রকুচির মতো রোদের নরম উজ্জ্বল টুকরোগুলি লাফিয়ে নেমেছে ঘরের সাদা টাইলের মেঝেতে গরাদের ফাঁক দিয়ে সোনালি বিড়ালছানাদের মতো।

কাল সন্ধের পর কোলাহল থেমে গেলে, গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরী এবং হেভী ভেহিকেলস-এর ফ্যাক্টরীর বাঁশি থেমে যাওয়ার পর হাসপাতালের কম্পাউন্ডের বাইরের ঝুপড়িতে কারা যেন বিয়ের গান গাইছিল। মানুষগুলো বিহারের। বোধহয় পালামৌ জেলার। নিস্তব্ধ রাতে মাদলের শব্দর সঙ্গে ওদের গান এক মধুর মোহাবরণের সৃষ্টি করেছিল। যে-পৃথিবী চিরদিনের মতো পৃথুর নাগালের বাইরে চলে গেছে, সেই পৃথিবীই সমুদ্রের অন্ধকারের মধ্যের ফস্‌ফরাসের মতো পৃথুকে হঠাৎ—আভাসিত করে দিয়েছিল। কিছুক্ষণের জন্যে।

একটি সুরেলা নারী কণ্ঠ দেঁহাতী আনসফিস্টিকেটেড গলায় গাইছিল:

“একোবি জান্‌মালা ভাইত্ বহিনিয়া

দুয়ো দুধা আয়ো পিওলি ডাঁফোর

ই কেক্‌রাকে লিখাল চান্না-চৌপারিরে

কেকারো লিখালই দুরীন দেশ

ভাইকে লিখালেই চান্না-চৌপার

বহিনিকে লিখালেই দুরীন দেশ।

কাহে লাগিন ইয়া বেটি জনম দেলাই

কাহে লাগিন ইয়া আইওগে দেলে বেনাবাস

ই দুনিয়া চরিতর বেটি জনম্‌ দেলি

চুটাকি সেঁন্দর বাদে দেলি বনবাস…”

রুষা হয়তো এই একরো-কেকরো ভাষা বুঝত না; কিন্তু বুঝলে খুশি হত এ কথা জেনে যে, এই গানের মধ্যেও “উইমেনস লিব”-এর বক্তব্য নিহিত আছে। সমসময়ের প্রত্যেক নারী: সে সমাজের বা দেশের যে-কোনও স্তর বা প্রান্ত থেকেই আসুক না কেন: নিজেদের মুক্তি খুঁজছে যে, তা বোঝা যায়।

এটা জেনে, ভাল লাগে পৃথুর।

ভাই আর বোন একই সঙ্গে জন্মাল, ডেঁটে (ডাঁফোর) দুধ খেল একই মায়ের বুকের অথচ, মেয়েকে সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে বনবাসে পাঠাতে হল আর ছেলে, নেহাৎ ছেলে বলেই; বাড়িতে চান্না-চৌপরে থেকে গেল।

তার পরে আরও একটি গান গেয়েছিল সেই অদৃশ্য, অপরিচিত বন-পাহাড়ের মেয়ে:

“কা লেকে যেবে মাইয়া আপন নইহার্

ঔর কা লেকে যেব্বে শ্বশুরার?

আওড়া চাওর লেকে যেব্বে নইহার

ঔর মাঙ্গমে সেঁদরা লেকে যেব্বে শ্বশুরার…

কাল রাতে শোনা গানের সুরগুলি মাথায় দুলছে এখনও। দোলানি সুরের দোলা।

হঠাৎই কে যেন বাইরে থেকে বলল, সাহাব!

কওন?

চমকে উঠে বলল, পৃথু।

দরজার বাইরের বডিগার্ডদের একজন মুখ বাড়াল পর্দার ফাঁক দিয়ে। বলল, ইক্ আওরাত আয়ী সাহাব, আপসে মিলনে।

চমকে উঠল পৃথু। ভিজিটিং আওয়ার্স কি শুরু হয়ে গেছে?

বলল, ভেজ দিজিয়ে অন্দর।

লোকটির মুখ মিলিয়ে গেল। পর্দা ঠেলে, ঘরে ঢুকল বিজ্‌লী।

পৃথু উত্তেজনায় উঠে বসতে যেতেই বুঝতে পারল এখনও ওঠার অবস্থা তার আসেনি। যন্ত্রণায় ডানদিকের পেট আর ডান পায়ের অবশিষ্টাংশ কঁকিয়ে উঠল। গুলি-খাওয়া বাঘের মতো নেতিয়ে গেল ও।

বিজ্‌লী পৃথুর অবস্থা বুঝে দৌড়ে এসে ভাল করে শুইয়ে দিল খাটে পৃথুকে। এবং ঘরে কেউ নেই দেখে পৃথুর খোঁচা-খোঁচা দাড়ি-গোঁফময় মুখে চুমুর পর চুমু খেতে লাগল, পাগলের মতো।

বানরী যেমন করে বানরকে খায়। প্রাগৈতিহাসিক গুহামানবী তার প্রিয় গুহামানবকে যেমন করে চুমু খেত; তেমন করে। নির্ভেজাল শরীরী উচ্ছ্বসে। তার মধ্যে মনের ভেজাল ছিল না কোনও।

চুমু খাওয়ার পর্ব শেষ করেই বিজলী পৃথুকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ রাখল। বিজলীর নরম অথচ দৃঢ় বুকের ছোঁওয়া লাগল পৃথুর বুকে। কম্বলের আড়াল ভেদ করে।

ছটফট করে উঠল পৃথু। ডাকু মগনলালের গুলি খেয়ে যে শরীরী-পৃথু অবশ হয়েছিল, সেই-ই দুরন্ত প্রমত্ততার হঠাৎ আবেগে আশ্চর্য হয়ে জেগে উঠল। তীব্র স্বস্তির সঙ্গে পৃথু হঠাৎই বুঝতে পারল যে, সবই শেষ হয়ে যায়নি তার এখনও। এখনও বাকি আছে কিছু।

বিজলীর চোখের জলে পৃথুর বুকের কাছের কম্বল ভিজে উঠল। ভিজে উঠল; বোধহয় পৃথুরও চোখের কোণও। কে জানে? শিশুকালের পর শেষ কবে যে কেঁদেছে মনে পড়ল না তা। আবারও শিশু হয়ে যেতে ইচ্ছে করল খুবই। যদি পারত শৈশবে ফিরে যেতে এই মিশ্র, রুদ্ধ গোলমেলে পরস্পরবিরোধী মানসিকতার কারাগার থেকে, মুক্তি পেত ও তাহলে। কিন্তু…

মুক্তি তো নেই। মুক্তি; শিক্ষিত, আধুনিক, তথাকথিত সংস্কারমুক্ত মানুষের জন্যে নয়। পৃথুর জন্যে নয়। রুষার জন্যেও নয়। মুক্তি; শুধুমাত্র বিজ্‌লীর জন্যে। হয়ত ভগবৎ-বিশ্বাসী কুর্চির জন্যেও। বিশ্বাসের যে কোনওই বিকল্প নেই। সহজ এবং স্বাভাবিক না হতে পারলে মুক্তির সব পথই বন্ধ। একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক মানুষ মুক্তি বলে যাকে জানবে, তাই হবে তার সবচেয়ে বড় বন্ধন। সেই বাঁধনের দড়ির চাপে সমস্ত সত্তা তার লাল হয়ে ফুলে ফুলে উঠবে। চিরদিনেরই মতো নিজের নিজের মনের কারাগারে হয়তো রুদ্ধ হয়ে থাকবে পৃথু আর রুষারা।

আবেগ, স্বাভাবিকতা যাদের চালিত করে, তারাই কেবল উছলে উছলে দৌড়ে যেতে পারে এই জীবনের পথ বেয়ে। পৃথুরা তাদের বিদ্যার গরিমা, অসাধারণত্বর শ্লাঘা, আধুনিকতার গর্বর গহ্বরেই পড়ে আছে। ছোট্ট হয়ে গেছে তাদের আকাশ; অনুভূতির বৃত্ত। নিরুপায়। ওরা নিরুপায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *