ঝোপড়ার দরজায় দীপনাথ উঁকি দিতেই মণিদীপা মুখ তুলে চাইল। একটু হেসে ইঙ্গিতে নিতাইকে দেখিয়ে বলল, হি ইজ এ কমপ্লিট ফ্রড।
সো অ্যাম আই অ্যান্ড সো ইউ অল আর। এখন চলুন তো, বউদি আপনাকে ভীষণ খুঁজছেন।
দীপনাথ কথা বলতেই ঝোপড়ার ভেতরকার চিমসে কটু বদখত একটা গন্ধ পেয়ে নাক কুঁচকে বলে, এই বিকট গন্ধের মধ্যে বসে আছেন কী করে?
মণিদীপা উঠে আসছিল। বাইরে এসে মিষ্টি হেসে বলল, আমি এক সময়ে কলকাতায় বস্তিতে বস্তিতে সোশ্যাল ওয়ার্ক করেছি। নোংরা, বদগন্ধ, আব্রুর অভাব, পভার্টি যদি সহ্য করতে পারেন তবে দেখবেন লোকগুলো খারাপ নয়। দে আর অল লাইক ইউ অ্যান্ড মি।
অভিজ্ঞতাবলে দীপনাথ জানে, কথাটা সত্যি নয়। তবু সে তর্কে না গিয়ে বলল, আপনি অনেক কিছু পারেন দেখছি। আমি খ্যাপা নিতাইয়ের ঝোপড়ায় এর আগেও বার কয়েক হানা দিয়েছি। ভিতরে ঢুকতেই গা ঘিনঘিন করেছে।
মণিদীপা দীপনাথের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলে, বেচারার একটা বউ ছিল, আপনি জানেন?
কে না জানে? বউ পালানোতেই তো নিতাই পাগল হল।
হাসছেন? লোকটা যে বউকে অতটা ভালবাসত তার জন্য কষ্ট হয় না আপনার?
হয়। আই অ্যাম অলওয়েজ উইথ দা হাজব্যান্ডস।
জানি। ব্যাখ্যা করতে হবে না।
এতক্ষণ পালিয়ে পালিয়ে আর কী কী করলেন?
ওই যা!–বলে থমকে দাঁড়ায় মণিদীপা।–আমার টেপ-রেকর্ডারটা পড়ে আছে জঙ্গলের মধ্যে।
কী সর্বনাশ! টেপ-রেকর্ডারও সঙ্গে এনেছেন নাকি?
আনব না তো কী? কলকাতায় বসে মৌমাছির শব্দ শুনব বলে… দাঁড়ান দেখে আসি।
বলে মণিদীপা কুঞ্জবনের দিকে প্রায় দৌড়তে থাকে। পিছনে দীপনাথ।
খাস জঙ্গলের ওপর ক্যাসেট শেষ হওয়া টেপ-রেকর্ডারটা পড়েই ছিল। স্পিকারের ওপর পাখি ননাংরা ফেলে গেছে। মণিদীপা রি-উইনড করে একটু শুনল শব্দটা। মুখ গোমড়া করে বলল, একদম ভাল সাউন্ড আসেনি।
দীপনাথ হেসে বলে, টেপ-রেকর্ডারটা যে চুরি হয়ে যায়নি সেটাই ভাগ্য বলে জানবেন।
আপনার সঙ্গে আমার তফাত কোথায় জানেন?
কোথায়?
আপনি সবসময়ে জিনিসটার কথা ভাবেন, তার পারপাসটার কথা ভাবেন না। আমার কাছে অনেক বেশি জরুরি হল মৌমাছির শব্দ, পাখির ডাক। আপনার কাছে তার চেয়ে ঢের বেশি দামি জিনিস এই যন্ত্রটা। আপনি এত অ্যান্টি-রোমান্টিক কেন বলুন তো!
তার মানে আমি আপনার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তববাদী।
আমি যে বাস্তববাদীদেরই সবসময়ে পছন্দ করি তা কিন্তু নয়।
তা জানি। সেই জন্যই বোধহয় আপনি আমাকে কোনওদিনই পছন্দ করেননি।
মণিদীপা মৃদু একটু হাসল। তারপর বলল, আপনি বাস্তববাদী এ কথা কিন্তু আমি স্বীকার করিনি। আপনি রোমান্টিকও নন তা বলে।
তা হলে আমি কী?
আপনি ভীষণ হাঁদারাম।
দীপনাথ হাসল বটে, কিন্তু এই খুকি চেহারার এঁচোড়ে পাকা মেয়েটাকে একটা গাঁট্টা মারবার জন্য তার হাত একটু নিশপিশও করছিল। ঘাসজঙ্গলে মিষ্টি ছায়ায় দু’জন মুখোমুখি হাঁটু গেড়ে বসে। মুখ নিচু করে মণিদীপা ক্যাসেটটা যন্ত্র থেকে খুলে আনল। নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে আর-একটা নতুন দামি ক্যাসেট বের করে ভরল টেপ-রেকর্ডারে।
আবার টেপ করবেন নাকি?
আগেরটা যে ভাল হল না। এই ক্যাসেটটা দিয়ে দেখি। যন্ত্রটা গাছের ডালে বসালে বোধহয় ভাল হয়, তাই না? ওই নিচু মৌচাকটার কাছাকাছি টেপ-রেকর্ডারটাকে একটু সেট করে দেবেন?
আমাকে গাছে উঠতে বলছেন?
গাছে ওঠেননি কোনওদিন?
বিস্তর। তবে সে ছেলেবেলায়। এই বুড়োবয়সে পড়ে গিয়ে মাজা ভাঙলে আপনি দায়ী।
আপনি হাঁদারাম হলেও পড়ে যাওয়ার লোক নন। কেরিয়ারের গাছটিতে তো দিব্যি তরতরিয়ে উঠে যাচ্ছেন। আর এ তো সামান্য গাছ।
মুখ শুকনো করে দীপনাথ বলে, দুনিয়ার যত খারাপ কি কেবল আমি?
আপনি ভীষণ খারাপ। এখন জুতো খুলুন তো। নিচু গাছ, উঠতে কোনও অসুবিধে হবে না।
উঠছি বাবা। কেরিয়ারিস্ট হওয়াও যে কী কষ্টের তা যদি বুঝতেন!–জুতো খুলতে খুলতে দীপনাথ বলে, বসকে তেল দিতে হয়, বসের বউকে তেল দিতে হয়। আর তেল দেওয়ার ছিরিটাও দেখুক লোকে। বসের ছিটিয়াল বউ মৌমাছির গান টেপ করবে বলে এই বারবেলায় মধ্যবয়সে গাছেও উঠতে হচ্ছে।
কেরিয়ারিস্ট দুরকমের আছে। হাঁদারাম আর বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমানদের খাটতে হয় না, কিন্তু হাঁদারামদের খাটা ছাড়া তো উপায় নেই।
দীপনাথ জুতো খুলে গাছে উঠল। খুবই সহজ গাছ। নিচুতেই অজস্র ডালপালা। দুটো ডাল ডিঙিয়ে একটু উপরে উঠতেই মণিদীপা বলল, বাঃ, বেশ পারেন তো। কিন্তু আরও ওপরে উঠে গেলে আমি টেপ-রেকর্ডারটা দেব কী করে? নাগাল পাব না যে! এইবেলা এটা ধরুন।–বলে দু’হাতে টেপ-রেকর্ডারটা উঁচু করে তুলে ধরল মণিদীপা।
ঝুঁকে যখন টেপ-রেকর্ডারটা নিতে হাত বাড়াল দীপনাথ তখন সন্দেহবাতিকগ্রস্ত একটা মৌমাছি ধেয়ে এল কোখেকে। বাঁ চোখের কোলে তার বিষাক্ত হুল কুট করে বিধল, টের পায় দীপনাথ। কিন্তু এ সময়ে নড়লে বা অসাবধান হলে দামি যন্ত্রটা পড়ে যেতে পারে। তাই সে একটুও শব্দ করল না । নীরবে টেপ-রেকর্ডার তুলে নিল।
মৌচাকটা খুব ওপরে নয়। আর দুটো ডাল উঠতেই সে প্রায় হাতের নাগালে পেয়ে গেল মৌমাছিতে বিড় বিড় করা চাকটাকে। বাঁ চোখের কোল মুহূর্তে ফুলে উঠছে। তীব্র জ্বালা। কিন্তু দীপনাথ শব্দ করল না। একটা মৌমাছির কামড় বই তো নয়! মৌচাকের কাছাকাছি যেতে হলে মুখ মাথা ঢেকে নিতে হয়, সে জানে। কিন্তু ঢাকনা দেওয়ার মতো কিছু নেই হাতের কাছে।
একটা ঘন পাতার চাপ ভেদ করে মাথা তুলতে-না-তুলতেই তার চুলের মধ্যে জেট প্লেনের মতো দুটো মৌমাছি এসে ঢুকল আর একটা হুল দিল কলারের নীচে, ঘাড়ে। প্রতিটি হুলই ইলেকট্রিক শকের মতো। দীপনাথ স্থির হয়ে রইল। নড়লে আবার কামড়াবে। খুব ধীরে ধীরে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে টেপ-রেকর্ডারটা ঝোলানোর অবলম্বন খুঁজে দেখল। পেয়েও গেল হাতের কাছে। একটা ভারবহনক্ষম ডাল বেরিয়ে আছে কাণ্ড থেকে। সে হাতলটা গলিয়ে দিল গাছের ডালে। তারপর সাবধানে রেকর্ডিং চালু করে দিল। টেপ ঘুরছে কি না তাও দেখে নিল ভাল করে। এখানে মৌমাছির শব্দ খুব ঝাঁঝালো। আশা করা যায় রেকর্ডিং ভালই হবে।
সাবধানে আবার নেমে আসে দীপনাথ। ভাগ্যে তার প্যান্টেব পকেটে একটা রোদচশমা ছিল। কালো চশমা পরতে তার ভাল লাগে না। সবকিছু মেঘলা দেখায় তাতে। তবু রোদের কথা ভেবে সঙ্গে এনেছিল। এতক্ষণ পরেনি। গাছ থেকে নেমেই সে মণিদীপার দিকে পিছন ফিরে চশমাটা পরে নিল।
মণিদীপা গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ধন্যবাদ না, কোনও কথাও না।
দীপনাথ হাতটা ঝেড়ে নিয়ে হাসি মুখে বলল, চলুন। বউদি বসে আছে।
মণিদীপার ভ্রু কোঁচকানো, নতমুখ। শুধু বলল, হুঁ।
দীপনাথের বাঁ চোখ ক্রমে আরও ফুলে উঠেছে, চশমার ফ্রেমের তলা দিয়েও সেটা দেখতে পাওয়ার কথা। কিন্তু মণিদীপা তাকাচ্ছে না তার দিকে। মৃদু পায়ে হাঁটছে আগে আগে, ভিতরবাড়ির দিকে। দীপনাথের ঘাড়ে মাথায় আরও গোটা তিনেক জায়গা ফুলে উঠেছে। পাগল-পাগল জ্বালা। তবু সে পিছন থেকে হাসিমুখে বলল, ম্যাডাম এই কুঞ্জবনটা খুঁজে বের করলেন কীভাবে?
মণিদীপা জবাব দিল না।
দীপনাথ অবাক হল না। মণিদীপা একটু মুডি। কখন ভাল থাকে বা কখন খারাপ থাকে তার তত কোনও ঠিক নেই। তাই সে আর কথা বলে উত্ত্যক্ত করল না। জ্বালাভরা চুলকোনি সামাল দিতে একবার চশমাটা তুলে হুলের জায়গাটা কচলায় সে। নরম জায়গাটা তো তেড়েফুঁড়ে আরও ফুলে উঠতে থাকে। চশমাটা আর রাখাই যাচ্ছে না। তবু সেই জ্বালাধরা জায়গার ওপর চশমাটা জোর করে বসিয়ে রাখল সে। মৌমাছির হুল, তার চেয়ে বেশি কিছু তো নয়। মানুষ এর চেয়ে ঢের বেশি যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে। প্রীতম করেনি? মুমূর্ষ পঙ্গু ওই প্রীতম তাকে জীবনে অনেক বেশি প্রেরণা দেয়। চাঙ্গা করে তোলে।
ঘরে পৌঁছতে পৌঁছতেই শরীরের জ্বালা-যন্ত্রণা প্রায় ভুলেই গেল দীপনাথ।
বউদি, এই যে ধরে এনেছি। উনি মৌমাছির টেপ-রেকর্ডিং করছিলেন, খ্যাপা নিতাইয়ের ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন।
তৃষা তার ঘরের টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিল। লুচি, ডিমের ডালনা, মিষ্টি আরও কী কী যেন। ফিরে না তাকিয়েই বলল, খুব ভাল। এ জায়গা যাদের কাছে ভাল লাগে আমি তাদের খুব পছন্দ।
করি।
মণিদীপা তৃষার কাছ বরাবর এগিয়ে গিয়ে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, মৌমাছি কামড়ালে কী লাগাতে হয় জানেন?
তৃষা চট করে মুখ তুলে বলে, তোমাকে কামড়েছে নাকি?
না।
মণিদীপা ইঙ্গিতে দীপনাথকে দেখিয়ে দিয়ে বলে, ওঁকে। দেখুন চোখ কেমন ফুলে আছে।
তৃষা দীপনাথের দিকে চেয়ে দেখল। তার মুখে কোনও উদ্বেগ ফুটল না। শুধু বলল, মধু।
বলে নিজেই গিয়ে একটা বেঁটে জালের মিটসেফ খুলে ঢাকনা দেওয়া পাথরের বাটি বের করে আনল। তাতে টলটল করছে টাটকা মধু।
হুলের জায়গাগুলোতে আঙুল দিয়ে মধু ঘষে দিতে দিতে প্রায় কানে কানে তৃষা জিজ্ঞেস করে, কী করে কামড়াল?
গোপনে জিজ্ঞেস করার মতো ব্যাপার নয়। তব দীপনাথও মৃদু স্বরে বলল, গাছে উঠতে হল যে।
কেন?
টেপ-রেকর্ডার ঝোলাতে।
তৃষাকে বেশি বলতে হয় না। প্রখর বুদ্ধিবলে সে সব বুঝে নেয়। বলল, বসের বউ, তার ওপর আবার প্রেমেও পড়েছে, এটুকু জ্বালা-যন্ত্রণা কিছু নয়।
তোমাকে একদিন এমন গাঁট্টা দেব না!
মণিদীপা বিছানার ধারে বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছে। কিছু দেখছে না, শুধু চোখটা সরিয়ে রাখছে মাত্র।
দীপনাথ বলল, টেপ-রেকর্ডারটা আবার নামাতে হবে কিছুক্ষণ বাদে। কিন্তু সেটা আর আমার কম্মো নয়।
তৃষা বলল, কম্মোটায় যাওয়ার দরকার কী ছিল? বাড়িভরতি কাজের লোক রয়েছে, যে কেউ ওটুকু করে আসতে পারত। তোমাকে ভাবতে হবে না, আমি লোক পাঠিয়ে নামিয়ে আনবখন।
মধু লাগানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্বালাযন্ত্রণা অনেক কমে গেল। শুধু ফোলাটা রইল। কিছুক্ষণ থাকবে। সে জিজ্ঞেস করে, মেজদা খেয়েছে বউদি?
না, অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
ঘুমোতে দাও। যত ঘুমোবে তত টেনশন কেটে যাবে।
তৃষা হাসল, বোমা মারল আমাকে আর টেনশন হল তোমার মেজদার। এসব পুরুষকে নিয়ে চলা যে কী মুশকিল!
কে পুরুষ? পুরুষ তো তুমি!
তৃষা মৃদু হেসে চাপা গলায় বলে, এখানকার লোকেরাও সেই কথা বলে। আহা, আমার কী গৌরবের ব্যাপার!
তুমিই আমাদের গৌরব।
যাঃ। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও তো। মেয়েরা মণিদীপার সঙ্গে গল্প করবে বলে বসে আছে। কেউ খেলতে পর্যন্ত যায়নি।
খাওয়ার সময়েও দীপনাথ লক্ষ করল মণিদীপা তার দিকে তাকাচ্ছে না, কথা বলছে না। দীপনাথ ঘটাল না। নিঃশব্দে খেয়ে নিল দু’জনে। বোস সাহেব দিল্লি থেকে আমেদাবাদ গেছেন। কবে ফিরবেন ঠিক নেই। মণিদীপা বোজ অফিসে ফোন করে দীপনাথকে জ্বালাচ্ছিল, কবে রতনপুর যাচ্ছেন বলুন! আমার যে কলকাতায় পাগল-পাগল লাগছে। দীপনাথ ঠিক করেছিল, এবার বোস সাহেবের অনুমতি ছাড়া মণিদীপাকে কোথাও নিয়ে যাবে না। বোস সাহেব অবশ্য প্রায়ই অফিসে ট্রাংকল করে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে। কিন্তু কোনওবারেই দীপনাথ কথাটা তুলতে পারেনি সংকোচের বশে। কিন্তু মণিদীপার তাড়ায় পরশুদিন সে কাজের কথা হয়ে যাওয়ার পর বোস সাহেবকে খুব বিনীতভাবে বলল, মিসেস বোস একটু রতনপুরে যেতে চাইছেন।
কোথায়?
রতনপুর। কাছে। সেখানে আমার মেজদার বাড়ি।
ওঃ, অফকোর্স। যাক না, কে আটকাচ্ছে?
আপনার একটা পারমিশান—
বোস সাহেব খুব হাসল। বলল, আজ পর্যন্ত কটা ব্যাপারে দীপা আমার পারমিশান নিয়েছে তা তো আমি জানি।
উনি না নিলেও আমাকে তো নিতেই হয়। আপনার পারমিশান ছাড়া আমি ওঁকে কোথাও নিয়ে যেতে পারি না।
বোস সাহেব বলে, ইটস অলরাইট, টেক হার এনিহোয়ার শি লাইক।
ধীর স্বরে তখন দীপনাথ বলল, ওভাবে বললে আমি সেটাকে পারমিশান বলে ধরতে পারি না মিস্টার বোস।
বোস সাহেব মেজাজ খারাপ করতে পারত। কিন্তু কোম্পানির বিজনেস খুব ভাল হওয়ায় বোসের মেজাজ শরিফ ছিল। খুব উদার গলায় বলল, এমনিতেও দীপা একাই বহু জায়গায় যাচ্ছে। এ তো আপনার মতো একজন চমৎকার গাইডের সঙ্গে যাবে। যাক না।
আমরা সকালে বা দুপুরে গিয়ে সন্ধেবেলাই ফিরে আসব।
ওঃ, আমি ভেবেছিলাম বুঝি উইক-এন্ড কাটাতে। তা হলে তো পারমিশনের দরকারই ছিল না চ্যাটার্জি। আপনি এত বেশি সংস্কার মেনে চলেন কেন বলুন তো! আচ্ছা ভদ্দরলোক মশাই আপনি! শুনলে দীপাও হাসবে।
আসার সময় হাওড়া স্টেশনে মণিদীপা বলেছিল, আমার যদি ভাল লাগে তা হলে আমি রতনপুরে দু’দিন থেকে যেতে পারি কিন্তু।
স্বচ্ছন্দে। কিন্তু আপনার ফ্ল্যাট পাহারা দেবে কে?
পাহারা দেওয়ার কিছু নেই। বেয়ারা বাবুর্চি আছে। আমি মানুষকে বিশ্বাস করতে ভালবাসি। আপনার দুশ্চিন্তা থাকলে আপনি গিয়ে পাহারা দিতে পারেন।
এখানে মণিদীপার কেমন লাগছে কিংবা সে থাকবে কি না তা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হলেও মুখের ভাব দেখে সাহস পেল না দীপনাথ। খেয়ে উঠে সে দীননাথের সঙ্গে দেখা করতে গেল। মঞ্জ আর স্বপ্না এসে ধরে নিয়ে গেল মণিদীপাকে।
দেখা হতেই দীননাথ বলেন, তোমরা কেউ বুলুর খবর নাও না। সে কেমন আছে, বউমার কী হল কেউ আমাকে বলে না।
সোমনাথের খবর দীপনাথ নেয়নি বহুদিন ঠিকই। তবে সোমনাথও তার সঙ্গে দেখা করে না। সে একটু লজ্জা পেয়ে বলে, খুব কাজ পড়েছে।
ভাইয়ের খবর নেওয়াটাও কাজ।
আপনি একটা চিঠি দিলেও তো পারেন।
চিঠি স্বপ্নকে দিয়ে বার দুই লেখালাম। আজকাল ডাকের পিয়নরা ঠিকমতো চিঠি দেয় না। বোধহয় পায়নি, তাই জবাবও দেয়নি।
আচ্ছা, আমি এবার গিয়ে খোঁজ নেব।
নিয়ো। বোলো, এখানে আমার ভাল লাগছে না।
কেন বাবা? এ জায়গা তো খুব ভাল।
ভাল আর কী? শ্রীনাথ খবরও নেয় না। তার কী সব খারাপ অভ্যাস হয়েছে শুনি। আমাদের বংশে এসব তো ছিল না। তার ওপর কাল বাতে নাকি ডাকাত পড়েছিল–এ ভারী গণ্ডগোলের জায়গা।
শীত পড়লে কলকাতায় যাবেন। এখন কিছুদিন থাকুন।
তুমি বিয়ে করলে আমার একটা আস্তানা হত। তিন ছেলের কাছে ঘুরেফিরে থাকতে পারতাম। বিলুও খোঁজ করে না। প্রীতম আছে কেমন?
ভাল। বিলু তো চাকরি করে।
শুনেছি। প্রীতম ভাল হয়ে গিয়ে থাকলে একবার যেন আসে। তার মুখটা তো ভুলতে বসেছি।
আসবে। এখানে আপনার আর কোনও অসুবিধে আছে?
এ আমার জুতের জায়গা নয়। কেমন সবই অচেনা অপরিচিত ঠেকছে। নিজের জায়গা বলে মনে হয় না।
দীননাথের সঙ্গে আর বেশিক্ষণ কথা বলল না দীপনাথ। মানিব্যাগ থেকে একশো টাকার নোট বের করে হাতে দিয়ে বলল, ইচ্ছেমতো খরচ করবেন।
দীননাথ সংকুচিত হয়ে বললেন, আমার আর খরচ কী? বরং বউমার হাতে দিয়ো।
না, আপনি রাখুন। কাউকে কিছু দিতে ইচ্ছে হলে দেবেন।
দীননাথ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, এই বিবেচনাটুকু অন্য ছেলেদের যদি থাকত।
দীপনাথ তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। ভাবন-ঘরে গিয়ে বৃন্দার কাছে খবর নিয়ে জানল, কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার এসে শ্রীনাথকে দেখে গেছে। আবার বোধহয় ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছে। অঘোরে ঘুমোচ্ছে শ্রীনাথ।
দীপনাথ শ্রীনাথের সুন্দর বাগানটার ভিতরে গিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইল। শরৎকাল আসতে না আসতেই শ্রীনাথের বাগানে শিউলি এসে গেছে। অনাদরে মাটিতে ঝরে পড়া অজস্র শিউলি বাসি হচ্ছে। একটা স্থলপদ্ম গাছে বেঁপে পদ্ম ফুটেছে। মৌমাছিরা গুঞ্জন তুলে উড়ছে। বউদি কি জানে শ্রীনাথের নিজের হাতে তৈরি করা ফুল থেকেই মৌমাছি কুঞ্জবনে গিয়ে চাক বাঁধে, আর সেই মধুই টলটল করছে তার পাথরের বাটিতে? কথাটা বউদিকে বললে কেমন হবে? ভেবে আপনমনেই মাথা নাড়ল দীপনাথ, লাভ নেই। কোনও কোনও স্বামী-স্ত্রী বোধহয় তাদের সম্পর্কের বিষকেই বেশি উপভোগ করে। মধুর কথা তারা কানে নেবে না।
বেল ঢলে পড়ল গাছগাছালির আড়ালে। চিকড়িমিকড়ি রোদ খেলছে বাগান জুড়ে।
দীপনাথ উঠে ভিতরবাড়িতে আসে।
বউদি, এবার যেতে হয়।
এক্ষুনি কী? আর-একটু থাকো। তোমার সঙ্গে কথাই তো হল না।
সঙ্গে বসের বউ, ফিরতে রাত হওয়া ঠিক নয়।
দীপু, তুমি কবে বুঝবে যে, আমি কত একা?
দীপনাথ একটু হেসে বলে, একদিন আমি আমার বসকে বলেছিলাম, বড় মানুষরা একটু একা একটু নিঃসঙ্গ হয়। তোমাকেও বলি বউদি, মহীয়সীরা চিরকাল একা। তাদের সঙ্গী হওয়ার মতো যোগ্যতা কজনের থাকে বলে?
আমি মহীয়সী? অবাক করলে দীপু!
কেন? লোকে বলে না?
তোমার মতো চাটুকার তো সবাই নয়! মহীয়সী হলে আমাকে লোকে মারতে চাইবে কেন বলো! কেনইবা আমার আপনজন বাজারে হাটে আমার কলঙ্ক রটিয়ে বেড়াবে?
লোকের কথা দিয়ে কী হবে বউদি! আমি যা মনে করি তা তো পালটে ফেলব না।
তৃষা একটু হাসল। মুখের বিষণ্ণতা তাতে কাটল না। খুব গম্ভীর গলায় বলল, কোনওদিন যেন আর না শুনি তোমার মুখে যে, আমি খারাপ, আমি ভাল নই।
শুনবে না বউদি।
তোমার কাছে যেন আমি চিরকাল ভাল থাকি।
থাকবে। যে ছেলে দুটো কাল বোমা মেরেছিল তারা ধরা পড়েছে?
না। তবে নাম জানা গেছে। দু’জনেই ভাড়াটে গুন্ডা। কাছাকাছি মাধবগঞ্জে থাকে।
কারা তাদের পাঠিয়েছিল? তোমার কাউকে সন্দেহ হয়?
কী করে বলব? তবে হয়তো একদিন এইভাবে আমার মরণ হবে, দীপু। তখন খুব কম লোকই কাঁদবে আমার জন্য। আর কেউ না কাঁদুক, তুমি একটু কেঁদো। কান্না এমনিতে না এলে নিজেকে চিমটি কেটো।