৪৯. চন্দ্রনাথ

রাইমোহন ও তার দলবল চন্দ্রনাথকে উদ্ধার করলো নিমতলার শ্মশানঘাট থেকে। তিনদিন ধরে ওরা সারা কলকাতা শহর চষে ফেলেছিল। হীরা বুলবুলের প্রায় অধোম্মাদিনীর দশা। হিন্দু কলেজ থেকে চন্দ্রনাথ বিতাড়নের সংবাদ ছাপা হয়েছিল সংবাদপত্রে, এমনকি বাগবাজারের বোসেন্দের বাড়িতে চন্দ্রনাথই যে বাবুদের এক শ্যালককে পাথরের চাঙ্গাড় ছুঁড়ে মেরে মাথা ফাটিয়েছে, সে খবরও গোপন থাকেনি।

রাইমোহন বুঝেছিল, বাবুদের পাইক বরকন্দাজরা চন্দ্রনাথকে একবার ধরতে পারলে হাতে নাতে মেরেই ফেলবে। কোতোয়ালির সাহায্য নিয়েও তারা ওকে ধরবার চেষ্টা করবে। তার আগেই চন্দ্রনাথকে কোথাও সরিয়ে ফেলা দরকার।

চন্দ্রনাথকে প্ৰথমে চিনতেই পারেনি রাইমোহন। শ্মশানে ডোমেদের পাশে সেও ডোম সেজে ছিল। পরনে শুধু মালকোচা মারা ধুতি, সারা গায়ে কালি-বুলি মাখা, মুখখানাতেও ছাই মেখেছে, চুলগুলো আঠার মতন। নিজের চেহারার চেয়েও বড় একটা বাঁশ নিয়ে সে চুল্লি খোঁচায়, আর শ্মশানযাত্রীরা যে ভিজে আতপ চাল ও কলা বারাসা ফেলে যায়, সেইগুলি খেয়ে সে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করে।

রাইমোহন চেনার আগেই চন্দ্ৰনাথ তাদের চিনতে পেরে হাতের বাঁশটি ফেলে মেরেছিল এক দৌড়। তখন হারাণচন্দ্ৰ চেঁচিয়ে উঠেছিল, ঐ তো চাঁদু।

রাইমোহনের বয়েস হয়েছে, এক তাজা বয়েসী কিশোরের সঙ্গে সে দৌড়ে পারবে কী করে। তার সঙ্গীরাও মাতাল দাঁতাল মানুষ, দৌড় ঝাঁপে বিশেষ দড় নয়। তবু সবাই মিলে ধর ধর, ছোঁড়াটাকে ধর, বলে ছুটেছিল। কলকাতার মানুষ বড় হুজুগে, একটা কোনো উপলক্ষ পেলেই হলো। শ্মশান-মশানে অনেক পরগাছা ধরনের মানুষ থাকে, মড়াদের ওপর নির্ভর করেই তারা জীবন কাটায়। তারা অধিকাংশ সময়ই শুয়ে থাকে অথবা ইটের টুকরো দিয়ে বাঘবন্দী খেলে, হরিধ্বনি দিয়ে কোনো মড়া দাহের দল এলে তারা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এখন একটি জ্যান্ত ছেলেকে তাড়া করার দৃশ্য দেখে তারাও মজা পেল এবং অনুসরণকারীদের দলে যোগ দিল। নিশ্চয়ই কোনো চোর ধরার ব্যাপার, আর চোর ধরতে সকলেরই, এমনকি অন্য চোরেদেরও বিশেষ উৎসাহ থাকে।

এক সঙ্গে অনেকের তাড়া খেয়ে চন্দ্রনাথ প্রথমে কিছুক্ষণ ভীত ইঁদুরের মতন এদিক ওদিক করলো, তারপর দিশাহারা হয়ে সে বাঁপিয়ে পড়লো গঙ্গায়।

সে সাঁতার জানে না, কিন্তু ড়ুবে যাবার সুযোগ ঘটার আগেই শ্মশানের পরগাছারা কয়েকজন একসঙ্গে নেমে জল দাপিয়ে তুলে আনলো তাকে। এরা গঙ্গার জলের তলা থেকে শ্মশানবন্ধুদের ছুঁড়ে দেওয়া তামার পয়সা পর্যন্ত তুলে আনে, আর একজন মানুষকে তোলা তো এদের কাছে বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের যোগ্য কাজ।

ভিড় ঠেলে কাছে এগিয়ে এলো রাইমোহন, সে দারুণ ভাবে হাঁপাচ্ছে। চন্দ্রনাথকে বুকে জড়িয়ে ধরে সে আকুলভাবে বললো, চাঁদু চাঁদু, বাপ আমার, একি কল্লি তুই! তোর মা যে কেঁদে অন্ধ হয়ে যাচে রে!

নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য ছটফট করছে চন্দ্রনাথ। তার চোখ বৌজা, মুখখানা কুঁকড়ে আছে।

রাইমোহন বললো, ডোম চাঁড়ালদের সঙ্গে ছিলি তুই, ওরে তোর কি একটু ঘেন্নাও নেই! সোনার বন্ন একেবারে কালি হয়ে গেচে! বাপ আমার চল, ঘরে চল।

এক ঝটিকা মেরে রুক্ষ কণ্ঠে চন্দ্রনাথ বললো, ছাড়ো আমাকে। আমি যাবো না, বাড়ি যাবো না! আমি তোমাদের চিনি না!

তখন তিন চারজনে মিলে জোর করে চ্যাংদোলা করে তুলে ওকে চাপানো হলো একটি কেরাঞ্চি গাড়িতে। গাড়োয়ানকে রাইমোহন বললো, একটু শিগগির শিগগির চল বাবা! বখশিস পাবি! গাড়ির মধ্যে তারা চন্দ্রনাথকে চেপে ধরে রইলো। রাইমোহন পেছন ফিরে আড়াল করে রাখলো গাড়ির দরজাটি, যাতে পথের লোক কেউ দেখতে না পায়।

 

একখানা সাদা থান পরে দোতলার ঘরের মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল হীরা বুলবুল। এই তিনদিন সে এক কণা অন্ন মুখে তোলেনি। কেঁদে কেঁদে তার সুন্দর ডিমছাঁদের মুখটি এখন ফুলে যেন বার্তাপি লেবুর মতন হয়ে গেছে।

রাইমোহন ঘরে ঢুকে বললো, ও হীরে, ওঠ, চোখ মেলে দ্যাক কাকে এনিচি!

হীরা বুলবুল মুখ ফিরিয়েই চন্দ্রনাথকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে উঠে। পক্ষিমতার মতন ঝাঁপিয়ে পড়লো চন্দ্ৰনাথের ওপর।

কিন্তু চন্দ্রনাথের কাছে মাতৃস্নেহের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। সে মায়ের আলিঙ্গনে ধরা দিল না, তার আগেই এমন এক ধাক্কা দিল যে হীরা বুলবুল ঘুরে গিয়ে পড়লো দেয়ালে, ঠিক করে তার মাথা ঠুকে গেল।

তারপর চন্দ্রনাথ তীব্র গলায় বললো, তুই আমার মা না রাক্ষসী? আমায় কেন গর্ভে ধারণ করিছিলি? আর যদি ধারণ করেইছিলি, আতুর ঘরে আমার গলা টিপে মেরে ফেলিসনি কেন?

মাত্র এই তিনদিনেই চন্দ্রনাথের শুধু যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে তাই-ই নয়, তার কণ্ঠস্বর পর্যন্ত বদলে গেছে। সে এখন বয়স্কদের ভঙ্গিতে বয়স্কদের ভাষায় কথা বলে।

হীরেমণি ভেউ ভেউ করে কান্না জুড়ে দিল।

রাইমোহন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, কাঁদিসনি। হীরে, এই কি কাঁদবার সময়! ছেলে ফিরে পেয়েচিস, ভগবানকে পোন্নাম জানা। মায়ে-ছেলেতে এমন আথান্তর হয়ই, ছেলের কতা গায়ে মাকতে নেই।

তারপর সে চন্দ্রনাথের দিকে ফিরে বললো, চাঁদু সোনা, বাপ আমার, অমন কটু কতা বলিসনি! তোর অপমানে কি আমাদেরও কম অপমান হয়েচে? তোর মা একেবারে মরম মরে আচে। কাটা ঘায়ে এখুন। আর নুনেস ছিটে দিসনি!

চন্দ্রনাথ বললো, তুমি আমায় বাপ বলবে না! তুমি কে? তুমি আমার কিসের বাপ? কদিনের বাপ? তুমি আমায় কেন জোর করে ধরে এনোচো?

রাইমোহন বললো, সব কতার উত্তর দেবো। এখুন একটু ঠাণ্ডা হ! হাত মুক ধুয়ে কিচু পেটে দে।

চন্দ্ৰনাথ বললো, না!

হীরা বুলবুল বললো, ওরে চাঁদু রে, আমায় তোর যত ইচ্ছে বকিস। আমি আর পাপ কবো না কক্ষণো। আমি প্ৰচিত্তির কাবোঁ। তোকে নিয়ে আমি তীখে যাবো! পুরীর জগন্নাথের সোনার মুকুট গড়িয়ে দেবো। ব্রেন্দাবনে কৃষ্ণের হাতে সোনার বাঁশী তুলে দোবো। তাতেও আমার পাপ ধুয়ে যাবে না?

চন্দ্রনাথ বললো, তুই মাির। তুই যা খুশী কর। আমি তোদের কেউ না।

চন্দ্রনাথকে জোরজার করে পাঠিয়ে দেওয়া হলো তার ঘরে। সেখানেও চন্দ্রনাথ ক্রুদ্ধ সজারুর মতন রইলো রৌয়া ফুলিয়ে। ঘরে তার বইপত্র যা ছিল সব ছিঁড়ে একেবারে ধ্বংস করে ফেললো। খাবারের থালা সে ছুঁড়ে মারলো দেয়ালে। তার উগ্র উন্মাদের মতন মূর্তি দেখে কেউ ঘরে ঢুকতে সাহস পেল না।

সেই ভোর রাতেই চন্দ্ৰনাথ আবার পলায়ন করলো বাড়ি থেকে।

অনুসন্ধান পার্টি নিয়ে রাইমোহন আবার ঘুরতে লাগলো কলকাতার পথে পথে। সবকটি শ্মশান ঘুরে দেখা হলো, চন্দ্রনাথ এবার ওসব দিকে যায়নি। কালীঘাটের মন্দিরের কাছে। শয়ে শয়ে কাঙালী ঘুরে বেড়ায়। চন্দ্রনাথ সেখানে ওদের মধ্যে মিশে থাকতে পারে ভেবে রাইমোহন সারাদিন ওঁৎ পেতে রইলো, কিন্তু চন্দ্রনাথের সন্ধান মিললো না। বার সিমলেতে অষ্টপ্রহর হরি সংকীর্তন উপলক্ষে ভিখারীদের ফুটকড়াই ও আধলা বিলোনো হচ্ছে কিংবা পাথুরেঘাটার ঠাকুরদের বাড়িতে এক শ্ৰাদ্ধ উপলক্ষে তিনদিনব্যাপী দরিদ্রনারায়ণ সেবা হচ্ছে, সেসব জায়গাতেও খোঁজ করে দেখলে রাইমোহন। চন্দ্ৰনাথ নেই।

 

পাঁচ দিনের মাথায় তাকে পাওয়া গেল মেটেবুরুজে। সেখানে পর পর কয়েকটি পুকুর ভরাট করে রাস্তা তৈরি হবে, জনা পঞ্চাশেক মজুর খাটছে, তাদের মধ্যে চন্দ্রনাথ একজন।

এবার রাইমোহনকে দেখে চন্দ্ৰনাথ পালাবার চেষ্টা করলো না; একখানা লোহার শাবল তুলে সে তাকে মারতে তেড়ে এলো। আঘাতটা ঠিক মতন লাগলে রাইমোহনের মাথাটা চৌচির হয়ে যেত। ঠিক সময় রাইমোহন শরীরটা বাঁকিয়ে নিয়েছিল। শাবলের ঘা লাগলো তার কাঁধে, তাতে ভ্রূক্ষেপ না করে সে দুহাতে চন্দ্রনাথকে জড়িয়ে ধরে বললো, আর তোকে ছাড়চিনি, বাপ আমার! এবার সর্বক্ষণ তোকে বুকে আগলে রাকবো।

এক ফিরিঙ্গি ঠিকাদার সেখানকার কুলিদের কাজ দেখাশোনা করছিল, সে এই বিচিত্র ঘটনায় আকৃষ্ট হয়ে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, এসব কী হইতেছে?

রাইমোহন বললো, মাই চাইল্ড, স্যার! ভেরি ম্যাড, স্যার। পাগলা কুকুরে বাইট করেছেল স্যার। সেই থেকে মাথা ট্রাবলসাম, স্যার।

ফিরিঙ্গিটি আর কোনো বাক্য ব্যয় না করে ডান হাতের পাঞ্জাটি দুবার এমনভাবে নাড়ালো, যার অর্থ, নিয়ে যাও। শীঘ্ৰ বিদায় হও।

আবার জোর করে চন্দ্রনাথকে তোলা হলো গাড়িতে। এবার বাড়িতে এনে তাকে একটি ঘরে বন্ধ করে শিকলি তুলে দেওয়া হলো।

 

হীরা বুলবুলকে রাইমোহন বললো, আমি বলি কী হীরে, এ পাড়া থেকে এবার বাস তুলে দে। তুই তো বাবু-বসানো ছেড়েই দিতে চাইচিস, তবে আর এ পাড়ায় থেকে লাভ কী। শহর ছেড়ে চল খিদিরপুরের দিকে চলে যাই। কিংবা রসাপাগলায় বন কেটে অনেক বসত বাড়ি হচ্চে, সেখেনে একটা বাড়ি কিনে তোতে আমাতে স্বোয়ামী স্ত্রী সেজে থাকবো। ছেলের মাতা গরম হয়েচে, ওকে নিয়মিত কদিন মকরধ্বজের সঙ্গে মধু-তুলসীপাতা মেড়ে খাওয়ালেই আবার ঠিক হয়ে যাবে।

হীরা বুলবুল বললো, আমার ওতে কাজ নেই। তুমি ব্যবস্থা দ্যাকো, আমি তিথ্যি যাত্রায় বেরুবো। আমার পাপের প্রচিত্তির করতে হবে।

রাইমোহন বললো, পাপ আবার কী? তুই কোন পাপ করিচিস? মেয়ে মানুষে কখুনো একলা একলা পাপ করতে পারে না। তোর সঙ্গে যে-সব বড় মানুষরা পাপ করেচে, তারা কী তীর্থযাত্রা করে পাপ ধুতে যাচ্চে? প্ৰতিশোধ নিতে হবে, বুঝলি? যে বড়মানুষগুলোনের জন্য চাঁদুকে হিন্দু কলেজ থেকে তাড়ানো হয়েচে, সেই সব ব্যাটাদের দেকে নোবো। এর শোধ যদি না তুলি তাহলে আমার নাম রাইমোহন ঘোষাল নয়। না পারলে রূপী বাঁদরটার নামে আমার নাম রাকিস।

হীরা বুলবুল বললো, অত বড় বড় কতায় আমার কাজ নেই। ঐ ছেলে বৈ আমার আর কেউ নেই এ সংসারে।

রাইমোহন বললো, আর কেউ নেই? আমি তোর কেউ নাই? এতদিন লাথি ব্যাটা খেয়ে তোর পায়ের কাচে রইলুম, এখুন বলচিস, আমি তোর কেউ নই!

—ওমা, সে কতা কখুন বল্লম! আমি তিথ্যি কত্তে গেলে তুমিও তো আমার সঙ্গে যাবে। তবে আর এখেনে কখুনো ফিরচিনি। সে কতা আমি আগেই বলে দিলুম। ঘেন্না ধরে গ্যাচে এই কালকেতা শহরের ওপর।

—সে যে পালানো হবে রে। আমরা ভয় পেয়ে পালাবো কেন?

—তা হলে তুমি থাকে। আমরা মায়ে পোয়ে বেরিয়ে পড়বো।

—কোতায় যাবি?

—যেদিকে দুচোক যায়।

—এই জন্যেই না বলে মেয়েমানুষের বুদ্ধি। বেরিয়ে পড়বো বললেই হলো। বেরুতে গ্যালে অনেক বন্দোবস্ত লাগে।

—আমার কিচু লাগবে না। ছেলের হাত ধরে আমি চলে যাবো, কে আমার কী কর্বে!

—অমনি বললেই হলো। ওরে তোর এখুনো গতর আচে, চাঁদপানা মুখ আচে, ঢলো ঢলো যৌবন আচে, তোকে কেউ নির্ঝঞ্ঝাটে যেতে দেবে? পথের বাঁকে বাঁকে বাঘ নেকড়েরা ওঁৎ পেতে রয়েচে, তোকে ছিঁড়ে খাবে।

—সেইজন্যিই তো বলচি, তুমি চলো। তুমি আমাদের চোকে চোকে রাকবে। তোমায় ছেড়ে কি কোতাও যেতে পারি।

রাইমোহন নিজের প্রৌঢ় শরীরখানির দিকে তাকিয়ে ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আমার কি আর সে তাগাদ আচে রে। কোনোদিন লাঠি বন্দুকও ধরতে শিকিনি!

তারপর নিজের ললাটে দুটি টোকা দিয়ে বললো, আমার জোর এখেনে। এই বুদ্ধির জোরে কলকেতার বাবুদের সঙ্গে টক্কর দিতে পারি, কিন্তু ঠ্যাঙাড়ে-বোম্বোটেদের কাচে সুবিধে করতে পারবো না। তাই তো বলচি, পালাবি কেন? আমরা এইখেনে থেকেই লড়বো।

এই সময় বাড়ির সম্মুখস্থ পথে কয়েকটি ভারি পায়ের লোহা বাঁধানো জুতোর শব্দ হল। জানলার খড়খড়ি সামান্য ফাঁক করে উঁকি মেরে রাইমোহন দেখলো, কয়েকজন সেপাই এদিকেই আসছে। রাইমোহনের মুখ শুকিয়ে গেল।

সেপাইরা অবশ্য এ গৃহে প্রবেশ করলো না, তারা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। খড়খড়ি বন্ধ করে হাঁপ ছেড়ে ফিরে এসে রাইমোহন বললো, বাপরে বাপ! পিলে চমকে গিয়েছেল একেবারে! আমি ভাবলুম বুঝি সেপাইরা চাঁদুকেই ধরতে আসচে!

হীরা বুলবুল বললো, ওমা, চাঁদুকে ধরবে কেন? চাঁদু তো কারুর পাকা ধানে মই দেয়নি!

—বাগবাজারের বোসীবাবুদের এক শালার মাতা ফাটিয়ে দিয়েচে না চাঁদু? তারা সহজে ছাড়বে ভাবিস। পুলিশ ঠিক এ বাড়ি খুঁজে বার করবে একদিন না একদিন।

হীরা বুলবুল অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে বললো, ওগো আর এ বাড়িতে থেকে তবে কাজ নেই। তুমি আজই তীর্থযাত্রার ব্যবস্থা করে। ওগো বজরায় গেলে হয় না? যদি কয়েকজন পাইক ভাড়া করা যায়?

—তারপর রক্ষকই যদি ভক্ষক হয়? পাইকরাই যদি মাঝপথে মেরেকুটে সব কিছু নিয়ে চম্পট দেয়? ডাঁড়া, একটু চিন্তা করতে দে!

—তুমি যাই বলো, আমি তীখে যাবোই। —কালীঘাটও তো তীর্থ, সেখেনে গিয়ে থাক তবে। একটা বাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে, দুএকদিনে হবে না।

—না, কালীঘাটে না, এমন জায়গায় যাবো, যেখোনে কেউ আমাদের চেনে না।

—আঃ ডাঁড়া না, একটু ভাবতে দে। ও, এক কাজ করলে হয়। আজই এ বাড়ি থেকে সরে পড়া দরকার। এই তো কাচেই কমলা থাকে, ওর সঙ্গে আমার বেশ চেনা আচে। আমি বললে সে কয়েক রাত খুব আহ্লাদের সঙ্গে তোদের থাকতে দেবে। তারপর কাঁটা দিন কাটলে অন্য একটা ব্যবস্থা।

—কার বাড়ি?

-জানবাজারের কমলার।

আহত দলিত ফণিনীর মতন ফোঁস করে উঠলো হীরা বুলবুল। সে এবং কমলাসুন্দরী দুজনেই এই শহরের দুই ডাকসাঁইটে বারাঙ্গনা। হীরা বুলবুলের খ্যাতি যেমন সঙ্গীতে কমলাসুন্দরীর তেমনি নৃত্যে। এরা পরস্পরের প্রতিপক্ষ। তার বাড়িতে আশ্রয়ের প্রস্তাব এনে রাইমোহন হীরা বুলবুলের আঁতে ঘা দিয়েছে।

হীরা বুলবুল বললো, কী, আমি কমলির বাড়িতে গিয়ে নুকোবো? তার আগে তুই আমায়। থুতু ফেলে ড়ুবে মত্তে বললি না কেন? ড্যাকরা, খালভরা! এই তোর মনে ছেল! হাতি পাঁকে পড়লে ব্যাঙেও নাতি মারে। আজ আমার এমন বিপদ বলেই তুই এমনধারা কতা বলতে পারলি। কমলি যদি তোর এত পেয়ারের নাভী হয় তবে তুই যা না সেখেনে। এখুনি যা। বিদেয় হ। দূর হ। ডরপুক কাঁহিকা। এইজন্যই আমার সঙ্গে তিথ্যি কত্তে যেতে তোর এত ভয়। কমলি মাগীটা পাঁচজনের সামনে উলঙ্গ হয়, ছোট জাতের মেয়ে,তাকেই তোর মনে ধরেচে। নিমকহারাম, এতকাল আমি দুধ কলা দিয়ে সাপ পুষচি…

হীরা বুলবুল একবার গালাগালির স্রোত বহাতে শুরু করলে তাকে থামায় কার সাধ্যি। রাইমোহন দুহাত তুলে অসহায়ের মতন তাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করলো, তারপর হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলো, শেষ পর্যন্ত তার পায়ে পড়লো। তবু হীরা বুলবুল থামে না।

রাইমোহন সবলে হীরা বুলবুলের মুখ চেপে ধরে বললো, ওরে কমলি তোর অত শতুর বলেই তো তার কথাটা মনে এলো। সেখেনে তুই বা চাঁদু লুকোলে পুলিশ কেন, পুলিশের বাপের সাধ্যি নেই সন্দেহ করে। সবাই জানে, হীরে বুলবুল আর যে-জায়গাতেই লুকোক, মরে গেলেও সে কমলির কাচে আশ্রয় চাইবে নাকে। আমি বলি কি, ডাঁড়া, বলতে দে আগে আমাকে, তোর যাবার দরকার নেই, তুই কেন যাবি, পুলিশ তো তোকে ধরতে আসবে না। চাঁদু বরং দুচারদিন ওখেনে থাক। পুলিশও ওর খোঁজ পাবে না। চাঁদুও ওখেন থেকে সহজে পালাতে পারবে না।

মুখখানা একটু ছাড়া পেতেই হীরা বুলবুল বললো, সে মাগী আমার ছেলেকে নুকিয়ে রাকবে? তোর মাতায় কি শোয়া পোঁকা ঢুকেচে! সে রাকুসী। আরও সেপাই ডেকে চাঁদুকে ধরিয়ে দেবে।

রাইমোহন বললো, কক্ষণো না। তুই নিজের কতাই একবার ভেবে দ্যাক। কমলির যদি কোনো ছেলে থাকতো, আর সে যদি তোর কাচে আশ্রয় চাইতো, তুই থাকতে দিতিসনি? বিপদের দিনে নিজের জাতের লোকদের কি কেউ পায়ে ঠেলে দেয়?

—নিজের জাত? সে মাগীর জাতের কোনো ঠিক আচে? দ্যাগ গিয়ে, সে কোন মুদ্দোফরাসের মেয়ে। রঙের কী চেকনাই, কাঠ কয়লা বলে মারি মরি।

—আহা-হা, তোর থেকে তো সে নীচু জাতের বটেই। তবু বলচি, সেও তোর মতন পাঁচজন বড় মানুষের সঙ্গে ওঠা বসা করেচে, মনটা একটু খোলামেলা হয়েচে।

 

অনেক বোঝাবার পর এবং চন্দ্রনাথের আশু বিপদের সম্ভাবনায় শেষ পর্যন্ত রাজি হলো হীরা বুলবুল।

কিন্তু চন্দ্রনাথকে নিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। সে কারুকে কাছেই ঘেঁষতে দেয় না। কেউ তাকে ধরতে গেলেই ক্ষিপ্ত পশুর মতন দুহাত চালায়। শেষ পর্যন্ত তিন চারজনে মিলে চন্দ্রনাথের হাত, পা ও মুখ বেঁধে মধ্যরাত্রে একটি গাড়িতে তোলা হলো।

নিশুতি রাত, পথে লোক নেই, যাবার পথে গাড়িতে চন্দ্রনাথকে অনবরত বোঝাতে লাগলো রাইমোহন। চন্দ্ৰনাথ যদি বাড়ির সঙ্গে কোনো সংশ্ৰব না রাখতে চায়, বেশ তো, কয়েকদিন পর তার যেখানে খুশী চলে যাবে। আগে হাঙ্গামাটা মিটুক। সবাই এসব কথা ভুলে যাক। এখন বোসীবাবুদের লোকদের হাতে ধরা পড়লে চন্দ্রনাথ যে আরও বিপদে পড়বে। তাছাড়া, হিন্দু কলেজ ছাড়া কি পড়াশুনো করা যায় না? রাইমোহন তার জন্য সাহেব শিক্ষক রেখে দেবে বাড়িতে। কিংবা এমনিতেই চন্দ্রনাথ ঢের লেখাপড়া শিখেছে, এখনি সে কোনো হীসে চাকরি জুটিয়ে বাবু শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হতে পারে। চন্দ্ৰনাথ যদি রাইমোহনকে পিতা বলে মেনে নেয় তাহলে সে ঘোষাল পদবী নিতে পারে, তারপর এই সমাজে তাকে অবজ্ঞা করে কার সাধ্যি?

সেই রাত্রেও কমলাসুন্দরীর বাড়িতে একটি মজলিস বসেছিল। সুরার নেশায় কমলার নয়ন দুটি ঢুলু ঢুলু। ঘাঘড় ও কচুলি পরা। বয়েসের ফলে কমলাসুন্দরী এখন অনেকটা পৃথুলা হয়েছে, কোমরে মেদের স্তর, তবু সে এখনো নাচের ঠমকে শহরের অনেক বাবুরই হৃদয় আন্দোলিত করতে পারে।

রাইমোহন মজলিস ঘর থেকে বাইরে ডেকে কমলাসুন্দরীকে সব বৃত্তান্তটি জানালো। কমলাসুন্দরী প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতেই পারে না। নেশায় মগজ আচ্ছন্ন, সে বারবার বলতে লাগলো, কার ছেলে? বাপের নাম কী? শুধু হীরের ছেলে হি-হি-হি-হি! হি-হি-হি-হি! হীরের ছেলে! কী করেচে। সে, ডাকাতি? ফেরেববাজি? তা থাকো না বাবা, থাকো! যতদিন ইচ্ছে থাকো! তুমি যখন বলচো, তাতে আর আপত্যি কি! তা এতদিন কেন আসেনি, নাগর? কতদিন তোমার চাঁদ মুখ দেকিনি।

 

এ বাড়ির ছাদে একটি চিলে-কোঠা আছে, অনেকদিন ব্যবহৃত হয়নি। কোনোরকমে সেটিই সাফ সুতরো করে সেখানে এনে শোয়ানো হলো চন্দ্রনাথকে। তার মুখ ও হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে রাইমোহন বললো, তুই আমায় মারতে চাস, মার, যত খুশী। এই আমি দোরগোড়ায় বসে রইলুম। আমাকে একেবারে মেরে না ফেলে তুই যেতে পারবিনি।

কোণঠাসা বিড়ালের মতন দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে চন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলো, তুমি কতক্ষণ, কতদিন আমায় পাহারা দেবে?

হাই তুলে রাইমোহন বললো, এই ধর, আট দিন, কি দশ দিন, তারপর সবাই তোর কথা ভুলে যাবে। তখন তুই যা খুশী করিস!

চন্দ্ৰনাথ বললো, আমি আর এক দণ্ডও তোমাদের কাচে থাকতে চাই না! তোমাদের দেকলেই আমার গা জ্বালা করে!

—আমি পিঠ ফিরিয়ে বসি, আমায় দেকিসনি!

—তুমি দূর হয়ে যাও।

—কেন মিছে এত রাগ করাচিস, চাঁদু? মহাভারত পড়িসনি? কৰ্ণ কি বলেছেল? দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম, মদায়িত্তং হি পৌরুষম! মানুষ কোন কুলে, কোতায় জন্মায়, সেটা দৈব ঘটনা, তার ওপর তো কারুর নিজের হাত নেই। দ্যাক, সমাজের পাঁচজনের মধ্যে তুই যাতে মাতা তুলে দাঁড়াতে পারিস, তার জন্য আমরা কম চেষ্টা করিনি। একবার হারবি, পাঁচবার হারবি, তা বলে তো ভেঙে পড়লে চলবে না! আত্মোন্নতির চেষ্টা কক্ষণো ছাড়তে নেই।

—আঃ, চুপ করো, আমার বকবকানি ভালো লাগে না।

—শোন চাঁদু, তুই আমার ওপর রাগ করতে পারিস, তোর মায়ের ওপর রাগ করতে পারিস, কিন্তু আমরা কখনো তোর গায়ে কোনো ময়লা লাগতে দিইনিকো।

চন্দ্ৰনাথ একদলা থুতু থুঃ করে ছিটিয়ে দিল রাইমোহনের দিকে। সেই থুতু রাইমোহনের গালে লেগে গড়িয়ে পড়লো ঘাড়ে, রাইমোহন মুছলো না, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো চন্দ্রনাথের দিকে। সে দৃষ্টিতে রাগ নেই, বরং একটু পরে তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্র। কতদিন পর, বোধহয় পঁচিশ, তিরিশ, চল্লিশ বছরের মধ্যেও রাইমোহন কখনো কাঁদেনি। এ বোধহয় বার্ধক্যের ফল!

চন্দ্রনাথ খর চোখে চেয়ে রইলো, কারুর কান্না দেখে তার মন আর দুর্বল হবার নয়।

দোতলায় নাচ-গানের জড়িত হল্লা তখনো চলেছে, ওপরে দুজন সম্পূৰ্ণ নীরব। এরকমভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়। এক সময় চন্দ্রনাথ ঘুমে হেলে পড়লো। তারও পর অনেকক্ষণ জেগে বসে থেকে ভোর রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়লো রাইমোহন। দরজার চৌকাঠের কাছে আড়াআড়িভাবে শুয়ে।

রাইমোহনের ঘুম ভাঙলো বেশ বেলায়। ধড়ফড় করে উঠে বসেই সে দেখলো ঘর শূন্য। রাইমোহন একটা সশব্দ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চন্দ্রনাথকে আর খুঁজে লাভ নেই। তাকে আটকে রাখতে গেলে হাত পা বেঁধে রাখাই উচিত ছিল। মানুষকে মানুষ ডিঙ্গিয়ে যায় না, চন্দ্রনাথ সেই সৌজন্যটুকুও মানেনি, সে নিশ্চয়ই রাইমোহনকে ডিঙ্গিয়ে লাফিয়ে চলে গেছে। চন্দ্ৰনাথ সাবালক হয়েছে, বুদ্ধিবৃত্তি আছে, তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কী ভাবে আর আটকে রাখা যায়। চন্দ্ৰনাথের মধ্যে স্নেহ-ভালোবাসার চিহ্ন কখনোই তেমন দেখা যায়নি, এখন সে সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করেছে। হীরেমণিকে এই বাস্তব সত্য মেনে নিতেই হবে। এখন ছেলেটা বেঘোরে মারা না যায়! রাইমোহন নিজে অনেক গলাধাক্কা, অপমান সহ্য করেছে, কিন্তু চন্দ্রনাথের মনের কোন তন্ত্রীতে ধাক্কা লাগায় সে এমন বিগড়ে গেল, তা সে বুঝতে পারলো না!

সারা বাড়ি এখনো প্ৰায় ঘুমন্ত। হীরা বুলবুল এবং কমলাসুন্দরী দুজনেরই প্রতিপত্তি এখন পড়ন্ত। এর মধ্যে কমলাসুন্দরী আরও কয়েকটি যুবতীকে নিজের কাছে রেখে তালিম দিচ্ছে, যাতে তার পসার বজায় থাকে। সেই দু-তিনটি মেয়ে স্নান সেরে ঘোরাঘুরি করছে অলিন্দে। রাইমোহন। এদের চেনে না, এরাও চেনে না। রাইমোহনকে। সে একবার ভাবলো ওদের কাছে চাঁদুর কথা জিজ্ঞেস করবে কি না। পরীক্ষণেই মনে হলো, কোনো লাভ নেই। দ্বারবানদের প্রশ্ন করেও কোনো সুসার হবে না।

ভারাক্রান্ত মনে সে চলে এলো গৃহের পশ্চাদ্বতী বাগানে। এখন একটি কঠিন কাজ বাকি আছে, হীরা বুলবুলের কাছে সংবাদটি প্রকাশ করতে হবে। অবুঝ হীরা বুলবুলকে সামলানো যে কী প্রাণান্তকর ব্যাপার হবে, তা ভেবেই শিউড়ে উঠলো রাইমোহন। এক্ষুনি সে হীরার সম্মুখীন হতে চায় না। কোনো সন্দেহ নেই যে হীরা রাইমোহনকেই সম্পূর্ণ দায়ী করবে। এখানে চন্দ্রনাথকে নিয়ে এসে কি ভুল করলো সে? জীবনে এতবড় ভুল আর তার হয়নি। ঘরে শিকলি তুলে দিয়েই বা একটি সোমত্থ ছেলেকে কদিন আটকে রাখা যায়। তা ছাড়া পুলিশের হাতে পড়ার ভয়টি তো মিথ্যে নয়।

 

রাইমোহন আপনমনে বাগানে ঘুরছিল, এমন সময় কেউ একজন তাকে ডাকলো, ওহে এদিকে একবার শোনো তো!

রাইমোহন চমকিত হয়ে তাকিয়ে দেখলো, পার্শ্ববর্তী উদ্যানে ফেজ পরা খানদানী চেহারার একজন মুসলমানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ধুতি চাদর পরা এক বৃদ্ধ। সেই বৃদ্ধকে চিনতে পেরে রাইমোহন দ্বিতীয়বার চমকিত হলো। বিধুশেখর মুখুজ্যের এই চেহারা হয়েছে! বা চোখের ওপরে একটা কালো ঢাকনা দেওয়া, শরীরটা শুকিয়ে গেছে, হাতের ছড়ির ওপর ভর দিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে।

রাইমোহন কাছে আসতেই বিধুশেখর বললেন, তুমি রাইমোহন না?

রাইমোহন বিনয়ে গলে গিয়ে বিগলিত হাস্যে বললো, প্ৰণাম মুখুজ্যে মশাই। এতদিন পরেও ঠিক চিনেচেন। তা আপনি সর্বজ্ঞ ব্যক্তি, আপনার কখনো ভুল হতে পারে! আপনি এখেনে?

বিধুশেখর বললেন, তার আগে বলো, তুমি এখেনে কী করচো?

রাইমোহন শ্রদ্ধায় ভক্তিতে একেবারে নুয়ে গিয়ে বললো, আজ্ঞে, আমরা শখের পায়রা, যখন যেখানে দানা ছড়ানো থাকে। সেখানে খুঁটে খেতে যাই।

—তা। আপাতত কার দানা খাচ্চো?

—দোনা পাচ্চি, খাচ্চি, মালিকের খোঁজ রাখি না। আর সেরকম মালিকই বা কোতায়? রামকমল সিংগী মশাই মারা গিয়ে আমাদের একেবারে অনাথ করে দিয়ে গ্যালেন। বড় বৃক্ষের ছায়ায় থাকা আমাদের অভ্যোস।

-শোনো, ঝড় উঠবার উপক্রম হলে পিপড়েরা নড়বড়ে বাড়ি ছেড়ে সার বেঁধে চলে যায়, দেকোচো? তুমিও ও বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও সর্টকাও।। ও বাড়ির মাগীটার ভিটে মাটি চাঁটি করবো এবার। মামলা দায়ের হয়েচে!

মুনসী আমীর আলী বিধুশেখরকে ফাসীতে প্রশ্ন করলেন, এই চিড়িয়াটি কে?

বিধুশেখর বললেন, আপনি ঠিক চিনতে পারবেন না। আমাদের শাস্ত্রে এই পাখির উল্লেখ আছে, তার নাম গরুড়। দেখছেন না। সব সময় হাত জোড় করে আছে।

রাইমোহন সেই মুহূর্তে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। হীরা বুলবুল তার পেশা ছেড়ে দিতে চাইছে, কিন্তু রাইমোহন তার পুরোনো পেশাটিকে আবার চালু করবে। তবে, এই বুড়োকে দিয়ে কোনো কাজ হবে না, এ একেবারে ছিবড়ে হয়ে গেছে, নওজোয়ান ছোঁকরা চাই। চন্দ্রনাথের ওপর অবিচারের শোধ নিতে হবে তো!

বেড়া টপকে এদিকে এসে সে বললো, হুজুর, আপনি কমলিকে তাড়াবেন, সে তো বেশ ভালো কতা। আপনি ইচ্ছে করলে কী না পারেন! আমরা একটু আশ্রয় পেলেই হলো।

তারপর হেঁট হয়ে বিধুশেখরের পায়ের ধুলো নিয়ে সে আবার বললো, হুজুর, আশীর্বাদ করুন, কোনোরকমে যেন বেঁচে বর্তে থাকি। এই অধম আপনার সেবক, যখন যা হুকুম করবেন তা তামিল করবার জন্য আমি সব সময় তৈরি। যদি বলেন তো ঐ কমলী মাগীটার পেছুনে বিছুটে লাগিয়ে একেবারে দেশছাড়া করে দিই!

আশীর্বাদের ভঙ্গিতে ডান হাত তুলে বিধুশেখর বললেন, বেশ, বেশ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *