সেদিন চাঁদনীর হাসপাতালে শুয়ে ভূতনাথ আবার এই সক কথাই ভেবেছিল। হয় তো বৌঠান নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিল সেদিন। ভূমিপতি চৌধুরীর আমল থেকে বংশপরম্পরায় যে-পাপ জমে-জমে পাহাড় হয়ে উঠেছিল, তার বুঝি সন্ধান রাখতে না বৌঠান। ১৮২৫ সালে প্রথম যেদিন কলের জাহাজ এসেছিল, প্রথম রেল লাইন পাতা হয়েছিল দেশের মাটিতে, সেই নতুন যুগের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারলে না বলে একটা বংশ এমন করে ধাপেধাপে নেমে এসেছিল। তখন বুঝি আর তার ওঠবার উপায় নেই। বৌঠান একা চেষ্টা করে কী করবে! হাসপাতালে শুয়ে-শুয়ে সমস্ত ইতিহাসটা আলোচনা করতে গিয়ে বার-বার কেবল পটেশ্বরী বৌঠানের মুখটি মনে পড়তো! অমন করে এত ভালোবাসা ভূতনাথ আর কারোর কাছ থেকে জীবনে পায়নি! কোথায় কেমন করে কবে যে বৌঠানের মনের কোণে একটু ঠাঁই করে নিতে পেরেছিল তা আজ আর মনে নেই। তার জন্যে যতটুকু কৃতিত্ব তা পুরোপুরি বৌঠানেরই। ভূতনাথ তার সামান্যতম অংশও দাবি করতে পারে না যেন।
আজো মনে আছে সেদিন পথ দেখিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনিই বুঝি প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন—আমাদের জাতির, আমাদের ইতিহাসের, আমাদের সভ্যতার সমস্ত ব্যর্থতা আর অভাব। তিনিই নতুন করে আবিষ্কার করলেন গীতাকে। নতুন ব্যাখ্যা দিলেন গীতার। চারিদিকে নৈরাশ্য আর পরাধীনতার গ্লানির মধ্যে গীতার শ্লোকে সবাই দেখতে পেলে জয়ের আশ্বাস। ককে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুদ্ধবিমুখ অর্জুনকে উৎসাহ দিয়ে শক্তিমন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ, শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে গিয়েছে, তবু তার মন্ত্র বুঝি সজীব হয়ে আবার তরুণ মনে শক্তির আশ্বাস এনে দিলে। শ্রীকৃষ্ণের সে-বাণী আত্মবোধের বাণী, নিজেকে চেনবার বাণী। শ্রীঅরবিন্দ এই গীতাকেই তুলে ধরলেন নতুন করে। তিনি শোনালেন—এই যুদ্ধ, এই মৃত্যু, এই অস্ত্র, এই ধর্ম, এই তীর আর এই ধনুক এ-ও ঈশ্বরের সৃষ্টি। তিনি বললেন—‘We do not want to develop a nation of women who know only how to weep and how not to strike.’
তারপর আলিপুর বোমার মামলার সময় অরবিন্দ বুঝি তার মহা-জিজ্ঞাসার উত্তর পেলেন—‘Man shall attain his Godhead.’
জানালার পাশেই ছিল ভূতনাথের খাটিয়া। ওখানে শুয়ে-শুয়ে খোলা আকাশটা দেখা যেতো। সেইখানে শুয়ে-শুয়েই আকাশপাতাল কত কী ভেবেছিল। সেইদিকে চেয়ে-চেয়ে অনেকদিন ভেবেছে ভূতনাথ–কোথায়ই বা গেল বোঠান! কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে রইল এতদিন! আকাশের নীলের মধ্যে বার-বার প্রশ্ন করেও সে-উত্তর পাওয়া যায়নি সেদিন।
তবু সেদিন বার-শিমলেয় যাবার সময় বংশী ধরেছিল—খেয়ে যাবেন না শালাবাবু?
ভূতনাথ বলেছিল—আজ আর খাওয়ার সময় নেই আমার।
–রান্না হয়ে এসেছে, আর বেশি দেরি নেই কিন্তু, ঝোলটা নামলেই দিয়ে দেবো।
—তা হোক, আমি বরং ফিরে এসে খাবো।
অগত্যা বংশীকে রাজী হতেই হয়েছিল। কিন্তু বারবার বলেছিল—যেন রাত করবেন না শালাবাবু, বেণীর কথা শোনবার পর থেকে আমার বড় ভয় করে আজ্ঞে।
-কীসের ভয়?
বংশী বলেছিল—বলা তো যায় না, মেজবাবু গুণ্ডা লাগিয়েছে শুনেছি, গুণ্ডা দিয়ে মেজবাবু সেকালে কত কাণ্ড করেছে দেখেছি, নটে দত্ত দেখলেন না সেবার ছোটবাবুকে কী কাণ্ড করলে। সেই থেকেই ছোটবাবু তো আর উঠতে পারলে না।
—না রে বংশী, ভয় পাসনে, আমার কিছু হবে না, তুই আমাদের পান আর সুপুরি এনেছিস তত?
—তা এনেছি, কিন্তু আজকে আর কখন যাবেন বরানগরে? বেলা পড়ে এল যে?
—তা আজ যদি না হয় তো কালই যাবো।
বংশী বললে—সেই ভালল শালাবাবু, আজ সারাদিন যে-হুজ্জত গেল সকাল থেকে, ভাবুন তো একবার, যাক, তবু হাঙ্গামা যে চুকলো এই ভালল, বড় ভাবনায় ছিলাম আজ্ঞে। ননীবাবু যে শেষ পর্যন্ত রাজী হলেন এইটেই ভালল—কতদিন থেকে যে মহাপ্রেভুর কাছে মানত করে রেখেছি—এবার দেশে গেলে পূজো দিয়ে আসবে।
সেদিন বড়বাড়ি থেকে বেরিয়েও যেন পা আর চলতে চায়নি ভূতনাথের। জবাকে সে কেমন করে তার দাবি জানাবে। কেমন করে সে জানাবে–সে-ই তাহার স্বামী! কেমন করে জানাবে অতুল আর কেউ নয়—ভূতনাথেরই আর একটা নাম। বাবার দেওয়া নাম। যে-নামে এক নন্দজ্যাঠা ছাড়া এখন আর কেউ ডাকে না! বাবার মৃত্যুর পর সে নীলমণি পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু সে তো ভূতনাথ নামে। এত কথা জানানোর মধ্যে কোথায় যেন একটা ভিক্ষুক-বৃত্তি লুকিয়ে আছে। কেমন ভাবে জবা তাকে গ্রহণ করবে কে জানে! এ ক’দিনের মধ্যে জবার যদি কোনো পরিবর্তন হয়ে গিয়ে থাকে!
বাড়ির সামনে গিয়েও দ্বিধা যেন কাটতে চায় না ভূতনাথের। সেদিন বেলগাছিয়ার খালের ধারে মনের যে সংযম সঞ্চয় করেছিল ভূতনাথ, আজ যেন তা হারিয়ে গিয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে যেন জানতে পারলে ভালো হতো-ভেতরে জবা কেমন আছে! কী করছে।
চারিদিকে চেয়ে দেখলে ভূতনাথ–পবিত্র আছে নাকি কোথাও রাস্তায় দাঁড়িয়ে। বিকেল বেলার গলিতে রাস্তা দিয়ে লোক চলাচল করছে নিজের-নিজের কাজে। ছোট সরু গলি, দু’পাশে নর্দমা। মশা উড়ছে ভনভন করে। দরজার কড়া নাড়তে গিয়েও যেন হাতটা সরিয়ে নিলে ভূতনাথ। জবা যদি বাড়িতে না থাকে। যদি ভূতনাথের দেরি দেখে সে হাসপাতালেই কাজ নিয়ে থাকে এতদিনে। এ ক’দিন এ-বাড়িতে আসেনি ভূতনাথ। কেবল ভেবেছে। ভেবেছে শুধু নিজের কথা! বড়বাড়ির এত গণ্ডগোল, রূপচাঁদবাবুর আপিস, সমস্ত কাজের মধ্যেও একটু ফাঁক পেলেই ভেবেছে। নিজের কথা ভেবেছে আর নিজের পরিপ্রেক্ষিতে ভেবেছে সুপবিত্রর কথা। আর সঙ্গে-সঙ্গে জবার কথা।
সেদিনও যখন ভূতনাথ এ-বাড়িতে ঢুকছিল হঠাৎ দেখলে জবার ঝি একটা ঝুড়িতে করে নানা জিনিষপত্র রাস্তায় ফেলতে যাচ্ছে। কিন্তু ঝুড়িটার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখেই যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল ভূতনাথ।
ভূতনাথ বললে—ক্ষুদির মা, ঝুড়িতে ওসব কী গো?
ক্ষুদির মা বললে—দিদিমণি এগুলো রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসতে বললে দাদাবাবু।
—দেখি, দেখি, ওতে কী? বলে ঝুড়িটা নামাতেই ভূতনাথ দেখে অবাক হয়ে গেল। ভালো ভালো দামী-দামী সব জিনিষ। একটা ফুলদানি, একটা বই, ছোট ঘড়ি একটা, নানারকম কাজের জিনিষ। একটা ফটো ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করা। সুপবিত্রর ছবি।
জবা বলেছিল—ওগুলো আর রেখে কি হবে ভূতনাথবাবু, ও-ই আমাকে নানা সময়ে উপহার দিয়েছিল—ও আমার কাছে এখন না রাখাই ভালো।
—কিন্তু রাস্তায় ফেলে দেবে তা বলে?
জবা বলেছিল—রাস্তাতে ফেলাই হোক, আর কাউকে দিয়ে দেওয়াই হোক, আমার কাছে সে একই কথা।
—কিন্তু মন থেকেও কি মুছে ফেলতে পারবে?
—মুছে ফেলাই তো উচিত।
—উচিত অনুচিতের কথা বলছি না, কিন্তু তা পারবে কি?
-মানুষের অসাধ্য কিছু নেই বলেই তো বাবার কাছে শুনেছি, চেষ্টা করে দেখি।
ভূতনাথ বলেছিল—চেষ্টা করলেই যদি ভোলা যেতে তা হলে তো পৃথিবীতে এত দুঃখ-কষ্ট থাকতে না জবা, সেইজন্যেই তো আমাদের হিন্দুদের এক দেবতারই নাম হলো ভোলানাথ—ভাঙ খেয়ে সমস্ত বিশ্বসংসার ভুলে আছেন—কিন্তু সেই ভোলানাথও শেষে সতীর মৃতদেহ নিয়ে কী কাণ্ড করলেন জানো তো?
সেদিন যত কথাই বলুক, ভূতনাথ কিন্তু জবার এই ভোলবার আপ্রাণ চেষ্টা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। সে-চেষ্টায় কোথাও ফাঁকি নেই। কোথাও শিথিলতা নেই।
জবা বলেছিল—হয় তো আমার এ সংস্কার বলতে পারেন আপনি —কিন্তু মন যা চায় তা তো পশুতেও করে, তা হলে মানুষের বৈশিষ্ট্য কোথায়। সংযম, সাধনা, শৃঙ্খলা এ সব ত মানুষেরই জন্যে।
ভূতনাথ তাড়াতাড়ি দরজার কড়া নাড়লে। ভেতর থেকে ক্ষুদির মা’র জবাব এল-কে?
—আমি ক্ষুদির মা, আমি।
—ওমা, দাদাবাবু—বলে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিয়েছে।
—দিদিমণি কোথায়? বাড়িতে আছে?
—দিদিমণির যে ভারী অসুখ দাদাবাবু—আপনি আসেন নি, আমি একা মানুষ…
—অসুখ? কী অসুখ?
ক্ষুদির মা বললে–হঠাৎ কাল থেকে এমন জ্বর, গা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে, সমস্ত রাত্তির জ্ঞান নেই দিদিমণির, কাকে ডাকি, কী. করি, ভেবে অস্থির। কেঁপে জ্বর এল, আর তার পর থেকেই কথা বন্ধ।
—তারপর?
-তারপর আজ সকালে ভাবলাম, কাকে ডাকি, কাকেই বা চিনি, তা গেলাম ছোটদাদাবাবুকে ডাকতে।
—ছোটদাদাবাবু কে? সুপবিত্রবাবু?
-হ্যাঁ, তাঁর বাড়িটা চিনতাম, তাকেই ডেকে আনলাম, তিনি এসে ডাক্তার ডেকে আনলেন, ওষুধ খাচ্ছেন, তবে জ্ঞান আসেনি এখনও। সেই রকম ঝিম হয়ে আছেন—ভেবে অস্থির হয়ে গিয়েছি—একলা মেয়েমানুষ–
—সুপবিত্রবাবু ওপরে আছেন নাকি?
—আছেন, উনি আছেন বলেই তো এখন এদিকটা দেখতে পারছি, নইলে যা ভাবনা হয়েছিল।
আজো মনে আছে সেদিনের সে-দৃশ্যটা। তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গিয়ে ভূতনাথ দেখেছিল পালঙ-এর ওপর জবা অচৈতন্য হয়ে শুয়ে আছে। গায়ের ওপর চাদর ঢাকা। পাশের টেবিলের ওপর ওষুধের একটা শিশি। আর সুপবিত্র সামনে ঝুঁকে পড়ে পাখার বাতাস করছে। ভূতনাথের পায়ের শব্দ পেয়েই সুপবিত্র যেন চমকে উঠেছে। আজো সে-দৃশ্যটা চোখ বুজলেই ভূতনাথ দেখতে পায়। সুপবিত্রবাবু যেন একটা মহা অপরাধ করে ফেলেছে এমনি করে চেয়েছিল সেদিন।
ভূতনাথকে দেখেই বাইরে এসে সুপবিত্র বলেছিল—আপনি এসেছেন, আমার বড় ভয় করছিল।
সুপবিত্রর চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। বেচারিকে যেন বড় অসহায় দেখাচ্ছে। বিপদ-আপদের মধ্যে সুপবিত্র একেই দিশেহারা হয়ে যায়। ভারী কাজ করতে তাল ঠিক রাখতে পারে না। ভুলো মানুষ। সব কাজেই ভুল করে। লেখাপড়া করে-করে বাস্তব প্রত্যক্ষ জগৎটার সঙ্গে বরাবরই তার অপরিচয়ের সম্পর্ক। সে যেন এতক্ষণ কূল পাচ্ছিলো না।
—কোন্ ডাক্তারকে ডেকেছিলেন?
—কী ওষুধ দিয়েছেন তিনি।
—কী হয়েছে বললেন?
অনেক প্রশ্ন করেছিল ভূতনাথ সেদিন একসঙ্গে। ডাক্তার বলেছিল—অনেকদিন অনিয়ম, উপোস, অত্যাচার করাতে শরীর দুর্বল ছিলই। এখন হঠাৎ দেখা দিয়েছে লক্ষণগুলো। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে বহুদিন আগে থেকেই নিশ্চয়ই এ বিষ ছিল, বাইরে বোঝা যায়নি। ওষুধ পড়েছিল সময় মতো তাই রক্ষা।
—বিকেলবেলা ডাক্তার কি আসবে একবার?
–বলেছিলেন, যদি জ্ঞান না হয় তো খবর দিতে। কিন্তু জ্বর বোধ হয় এখন কমেছে, একটু আগে ঘাম হচ্ছিলো খুব, ছটফট করছিলেন খুব, এখন ঘুমোচ্ছেন—পাছে ঘুম ভেঙে যায় তাই হাওয়া করছিলাম।
ভূতনাথ বললে—তা হলে আমি তাকে ডেকে নিয়ে আসছি। আপনি জবার কাছে বসুন।
সুপবিত্র বললে—বরং, আমি যাই, আপনি বসুন।
-না, না, আপনি বসুন।
শেষ পর্যন্ত কিছুতেই সুপবিত্র রাজী হয়নি বসতে। ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসে বাইরে দাঁড়িয়েছিল। কেমন যেন এড়িয়ে চলেছিল সমস্তক্ষণ! ডাক্তার এসে আবার নতুন একরকম ওষুধ লিখে দিয়ে গেলেন। সে-রাত্রিটা যে কেমন করে কেটেছিল আজো মনে আছে ভূতনাথের। বার-শিমলের সে-বাড়িতে সুবিনয়বাবুর অসুখের সময় আরো কয়েকটা রাত কাটাতে হয়েছিল আগে। রাত্রের নির্জন আবহাওয়াতে ট্রেনের সেই বাঁশীর শব্দ, আর তারপর বাইরের গভীর অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ একটা নিশাচর পাখীর ডেকে আবার থেমে যাওয়া—এ-অভিজ্ঞতা আছে ভূতনাথের। কিন্তু এবার যেন অন্যরকম। জবা নির্জীব হয়ে শুয়ে আছে। নিস্তব্ধ ঘরের পরিবেশ। শুধু সেইদিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কাজ কী?
সুপবিত্র পাশে দাঁড়িয়েছিল। বললে—আমি চলে যাই আপনি তো রইলেন।
ডাক্তার পরীক্ষা করে বলে গিয়েছিলেন—এখন নাড়ীর অবস্থা ভালো-ভয় কেটে গিয়েছে। সকাল বেলার দিকে কিছু দুধ বা চা খেতে দিতে পারেন—আর ওষুধ তো রইলই।
রাত গভীর হয়ে এল। একটা মাকড়সা দেয়ালের কোণে বাসা করেছে। ভূতনাথ সেই দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিল। ধূসর রঙের বাসাটা। তারই ওপর নিশ্চল হয়ে বসে আছে। নড়ছে না, চড়ছে না। ঘরে যে এতবড় একটা অসুখের ক্রিয়া চলেছে, যেন খেয়ালই নেই সেদিকে। ওর চোখ দুটো এখান থেকে দেখা যায় না। কিন্তু অমন একাগ্রতাও যেন ভূতনাথ জীবনে দেখেনি। একনিষ্ঠতাও বলা যায়। যেন ধ্যানে বসে আছে। সেখান থেকে, চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ভূতনাথ আবার অন্যদিকে চাইলে। ঘরের দেয়ালের প্রত্যেকটা খুটিনাটি যেন দেখবার ইচ্ছে হলো ভূতনাথের। কোথায় একটা কালির অস্পষ্ট দাগ, একটা আলোর পোকা নড়ছে–অন্য সময় হলে হয় তো এসব এত নজরে পড়তো না। আজ তার নিজের ছায়াটাকেও যেন অদ্ভুত মনে হলো। বাতির অল্প আলোয় ছায়াটা পড়েছে। খানিকটা দেয়ালে, খানিকটা মেঝের ওপর। বাঁকা-চোরা ভাঙা ছায়া। কিন্তু বড় বীভৎস মনে হলো ছায়াটাকে। তারই তো নিজের ছায়া! মানুষের ছায়া কেন এতো বীভৎস দেখায়! ভূতনাথও কি এমনি বীভৎস। পাশেই সুপবিত্রর ছায়াটা পড়েছিল। কিন্তু সে-ছায়াটা সোজা পুরোপুরি দেয়ালের ওপর স্পষ্ট। কোথাও ভাঙা-চোরা নয়। পাশাপাশি পড়েছে একেবারে। সুপবিত্রর নাকটা যেন সোজা একটা সাবলীল রেখায় সুন্দর হয়ে উঠেছে। সুপবিত্রকে যেন বড় সুন্দর মনে হলো। সত্যিই বড় সুন্দর দেখতে সুপবিত্রকে। জবার পাশে সুপবিত্রকে যেন মানায় ভালো। আর একবার দেখলে ছায়াটার দিকে। সুপবিত্র স্থির নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বোধ হয় পলকও পড়ছে না চোখের। হয় তত জবার দিকেই চেয়ে আছে একদৃষ্টে। এতদিন ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হতো। আজ জবার অসুখের সুযোগে এ-ঘরে আসতে পেরেছে। ছায়াতে সুপবিত্রর চুল গুলো উড়ছে। মাথাভরা চুল। নিয়ম করে চুল ছাঁটার কথা হয় তো মনে থাকে না তার। কিন্তু বেশ দেখায় ওই চুলগুলো। সুপবিত্র হয় তো সংসারপটু নয়, কিন্তু তাতে কী। সুপবিত্র সুন্দর তো! সমুদ্রের ঢেউ হয় তো নয় সে, কিন্তু রামধনু তো সে। কালো আকাশের কোণে অমন করে সাত রঙের প্রকাশ যে করতে পারে, তারই কি দাম কম! রামধনুর রঙে সমস্ত পৃথিবী যখন রঙিন হয়ে ওঠে, তখন তার চেয়ে সুন্দর আছে কিছু? ভূতনাথের এবার যেন হঠাৎ মনে হলো— দেয়ালের কোণের ওই একনিষ্ঠ মাকড়সা, ওই দেয়ালের ওপর একফোটা কালির দাগ আর নিশ্চল সুপবিত্রর সুন্দর ছায়াটা যেন হঠাৎ সব সজীব হয়ে উঠেছে। সব যেন হঠাৎ সচল হয়ে নড়তে শুরু করেছে। সমস্ত দেয়ালটা যেন কালো হয়ে উঠলো এক নিমেষে, মাকসাটা হঠাৎ বাসা ছেড়ে ঘুরতে শুরু করেছে পাগলের মতো। আর সুপবিত্রর ছায়াটা যেন আর দেখা যায় না।
হঠাৎ সুপবিত্র যেন কথা বললে এবার।-আমার আর থাকবার দরকার আছে ভূতনাথবাবু?
কেন? সুপবিত্র বললে—না, কিন্তু চোখ মেলে যদি আমায় দেখে জবা… হয় তো রাগ করতে পারে—আমাকে আসতে বারণই করেছিল।
-না, না, রাগ করবে কেন, অসুখের সেবা করতে এসেছেন আপনি—কিন্তু আপনাকে আজ কি জবা দেখেনি?
সুপবিত্র বললে—আমি এসেছি জানতেও পারেনি এখনও জ্বরের ঘোরে বড় কাতর ছিল কি না।
–ওষুধ খাওয়াবার সময়ও দেখতে পায়নি?
সুপবিত্র বললে—অনেক কষ্টে মুখটা চেপে ধরে ওষুধ খাওয়াতে হয়েছিল—বিকারের ঝোক ছিল তখন,জ্ঞান ছিল না ঠিক।
ভূতনাথ বললে—আচ্ছা, আপনি যাবেন না, তবে পাশের ঘরে গিয়ে আপনি একটু বসুন। যদি প্রয়োজন হয় আমি খবর দেবো আপনাকে।
সুপবিত্র চলে গেল।
ভূতনাথ জবার দিকে চেয়ে দেখলে। জবা জানতেও পারেনি সুপবিত্র এসেছে। মনে হলো—জবার যেন অসুখের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে। একদৃষ্টে জবাকে দেখতে লাগলো ভূতনাথ। বড় অসহায় মনে হলো যেন তাকে। সমস্ত বিশ্বসংসারে যেন জবা কেউ নেই। আশ্চর্য। ভূতনাথের মতো অসহায় লোকের সঙ্গে যে-দুজনের পরিচয় হয়েছে ঘনিষ্ঠভাবে, তারা দুজনই অসহায়। এক পটেশ্বরী বৌঠান আর এক জবা। এমন করে এত ঘনিষ্ঠতা করা হয় তো ভালো হয়নি। তাতে না ভালো হয়েছে বৌঠানের, না জবার, না তার নিজের। কী প্রয়োজন ছিল ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে চাকরির! অন্য কোনো আপিসেও তো হতে পারত! হতে পারতো ব্ৰজরাখালের আপিসে। হতে পারতো প্রথম থেকেই রূপচাঁদবাবুর আপিসে। তা হলে এমন করে জড়িয়ে পড়তে হতো না ভূতনাথকে। এমন করে নিজেকে নায়ক হতে হতো না উপন্যাসের। একবার মনে হলো জবা যেন আপন মনে স্বপ্নের ঘরে বিড়বিড় করে কী বলছে। মুখটা জবার মুখের কাছে নিয়ে এল ভূতনাথ। শোনবার চেষ্টা করলো। কিন্তু বড় অস্পষ্ট। খানিকক্ষণ পরে মনে হলো যেন একটু বুঝতে পারা গেল। যেন অস্পষ্টভাবে বিকারের ঝেকে সুপবিত্রর নামটা উচ্চারণ করলো। কান পেতে আবার শুনলে ভূতনাথ। আর ভুল নেই। মনে হলো সুপবিত্রর সঙ্গে যেন কিছু কথা বলছে। আবার কান পেতে শুনতে লাগলো ভূতনাথ। এবার আর কথা বলেছে না। আবার অঘোরে ঘুমোচ্ছে জবা। লম্বা নিঃশ্বাস পড়ছে। চেতনার কোনো লক্ষণ নেই।
হঠাৎ সেইভাবে বসে থাকতে-থাকতে ভূতনাথের মনে হলো—কেন সে বসে আছে এখানে। সে যেন সুপবিত্র আর জবা দুজনের মধ্যে প্রকাণ্ড একটা বাধা হয়ে আছে এতক্ষণ! সে কেন এখনও তার অস্তিত্বের বোঝা নিয়ে এখানে পীড়া দিচ্ছে এদের। সে তো নিজেকে অনায়াসে লোপ করে দিতে পারে। জবার জীবনে ভূতনাথ তো একটা আকস্মিকতা। ধরে নেওয়া যাক না, কোনো দিন কোনো অবসরে সে তার হৃদয়-মনকে কারো কাছে বিকিয়ে দেয়নি। কোনো সম্পর্কের গ্রন্থি দিয়ে বাঁধা হয়নি তাদের জীবন। একথা সত্যি বলে ধরে নিলেই হয়। যা ছিল তার দূরাশা, এখন তা আয়ত্তের মধ্যে হলেও আবার দূরাশা মনে করে দূরে চলে গেলেই হয়। কেউ কিছু বলবার নেই। কারো অভিযোগ করার কিছু নেই। কেউ ব্যথা পাবে না। ব্যথা যদি কেউ পায় তো সে নিজে। সে মনে করবে এটা জলের দাগ। জলের দাগকে চিরস্থায়ী বলে যে বিশ্বাস করে সে তো নির্বোধ। ভূতনাথ এ জীবনে অনেক দেখলে অনেক পথ মাড়িয়ে আজ এখানে এসে সে দাঁড়িয়েছে। ভূতনাথ জানে দুঃখ কাকে বলে, জানে আঘাত কী প্রচণ্ড, আশ্রয়ের প্রয়োজন যখন সব চাইতে বেশি তখন আশ্রয় কী দুর্লভ। কিন্তু। ‘এ-ও জানে আসল সুখ পাওয়ার মধ্যে নেই। মানুষের আত্মা সত্যকে নানার মধ্যে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে।—সে যখন আত্মীয় বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যুক্ত হয় তখন সে নিজের একটা সার্থকতার রূপ দেখতে পায়। তাই সুবিনয়বাবু বলতেন—“আত্মার পরিপূর্ণ সত্যটি আছে পরমাত্মার মধ্যে। আমার আমি সেই একমাত্র মহাআমিতেই সার্থক। তেমনি আমরা যখন সত্যকে জানি তখন সেই অখণ্ড সত্যের মধ্যেই সমস্ত খণ্ডতাকে জানি।” আর একদিন বলেছিলেন—“খণ্ডের মধ্যে দিয়ে অখণ্ডকে যে উপলব্ধি করতে পেরেছে সে-ই সুখী। তখন যে আনন্দ সেই আনন্দই প্রেম। সেপ্রেম বেঁধে রাখে না। নির্মল নির্বাধ প্রেম। সেই প্রেমই মুক্তি সমস্ত আসক্তির মৃত্যু। সেই মৃত্যুরই সৎকার মন্ত্র হচ্ছে—
‘মধুবাতা ঋতায়তে
মধুক্ষরতি সিন্ধবঃ—
বায়ু মধু বহন করছে, নদী সিন্ধু মধু ক্ষরণ করছে, ওষধি বনস্পতি সকল মধুময় হোক, উষা মধু হোক, পৃথিবীর ধূলি মধুমৎ হোক, সূর্য মধুমনি হোক। আসক্তির বন্ধন যখন ছিঁড়ে গিয়েছে, তখন জল, স্থল, আকাশ, জড়, মানুষ সমস্ত অমৃতে পূর্ণ-তখন বুঝি আর আনন্দের শেষ নেই। সেই আনন্দই হলো প্রেম।”
জবার ঘরে বসে সেই শেষ রাত্রে ভূতনাথের মনে হলো—এখন সে সমস্ত ত্যাগ করতে পারে এই মুহূর্তে। কোনো আকর্ষণ আর নেই কোথাও। জবাকে ভালোবাসে বলেই জবাকে এত সহজে হারানো যায়। খণ্ডকে সে অখণ্ডের মধ্যে নতুন করে পাবে। নতুন করে মহাজীবন লাভ করবে।
জবা যেন এবার হঠাৎ জেগে উঠলো। একটু নড়ছে। ঠোট দুটো একটু কেঁপে উঠলো। একবার চোখ খুলতে চেষ্টা করলো। মুখ দেখে মনে হলো সে যেন হঠাৎ সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
ভূতনাথ আস্তে-আস্তে জবার টেবিলে গিয়ে বসলো। একটা কাগজ নিয়ে তার ওপর কলম দিয়ে লিখতে লাগলো একটা চিঠি।
তখন তার ঘোরে জবা একটু যেন এপাশ ওপাশ করছে। এখনি চেতনা ফিরবে তার। চোখ চাইছে। অল্প-অল্প আলোয় তার দৃষ্টি যেন ঠিক জায়গাটায় নিবদ্ধ হতে পারছে না।
পাশের ঘরে সুপবিত্র ঘুমোচ্ছিলো। ভূতনাথ তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে ডাকলে—সুপবিত্রবাবু—সুপবিত্রবাবু
সুপবিত্র ধড়ফড় করে উঠলো। বললে—কী হলো? জবা কেমন আছে?
ভূতনাথ বললে–জবা আপনাকে ডাকছে।
—আমাকে ডাকছে? সুপবিত্র ভালো করে চোখ মুছেও যেন ভালো করে জাগেনি। যেন জবাকেই স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ। যেন সে ভুল শুনছে! বললে—আমাকে?
-হ্যাঁ, আপনাকে।
–কিন্তু আপনি ঠিক শুনেছেন, আমাকে?
—আমি ঠিক শুনেছি।
–কিন্তু, তা কেমন করে হয়, আমাকে দেখে হয় তো অসুখ আরো বেড়ে যেতে পারে ভূতনাথবাবু। আমাকে আসতে নিষেধ করেছিলো বার-বার করে, আমি যে এসেছি তা-ই এখনো জানে না যে।
—তা হোক, আমি বলছি আপনি যান।
সুপবিত্র যেন এতখানি আশা করতে পারেনি। যেন আশার অতিরিক্ত সে পেয়েছে। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তার। মুখখানা ছোট শিশুর মতো লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। নতুন অনুরাগের লজ্জা। সুপবিত্র রুমাল দিয়ে চোখ-মুখ মুছতে লাগলো আবার। যেতে গিয়েও যেন দ্বিধা করতে লাগলো খানিকক্ষণ। তারপর বললে আপনি যাবেন না?
–না, আপনাকে একলা ডেকেছে।
–একলা?
–হ্যাঁ, কিন্তু ভয় নেই, জবা সুস্থ হয়ে উঠেছে এখন, যদি পারেন সকাল বেলা একটু গরম দুধ খেতে দেবেন। বড় দুর্বল মনে হচ্ছে যেন।
সুপবিত্র যাচ্ছিলো।
ভূতনাথ আবার ডাকলে। বললে-শুনুন।
সুপবিত্র ফিরে এসে দাঁড়াতেই ভূতনাথ বললে-জবা একটু সুস্থ হয়ে উঠলে, এই চিঠিটা ওর হাতে দেবেন তো!
—আপনার চিঠি?
-হ্যাঁ, আমার বিশেষ কাজ আছে, তাই চললুম এখন, কাল আসবো আবার, আপনি ওকে এ ক’দিন একটু চোখে-চোখে রাখবেন, আর জবা বড় অভিমানী, জানেন তো, সব কথার বাইরের মানে নিয়ে বিচার করবেন না ওকে, আপনার হাতেই ওকে দিয়ে গেলাম।
দরজা খুলে দেবার সময় ক্ষুদির মা বলেছিল—আবার কখন আসবেন দাদাবাবু?
—আর আসবো না আমি ক্ষুদির মা। কিন্তু বলতে গিয়েই সামলে নিয়েছে নিজেকে। বললে-কালই আসবো।
ক্ষুদির মা দরজা বন্ধ করে দিলে।
বাইরে তখন বেশ রাত। ভোর হতে অনেক দেরি। কলকাতার প্রাণসমুদ্র নিঝুম নিস্তরঙ্গ। ভূতনাথ সেই অদৃশ্য অপরূপকে মনে-মনে প্রণাম করে বললে-হে অমৃত তোমায় প্রণাম করি। তোমার বিচিত্র আনন্দরূপের মধ্যে সেই অপরূপ অরূপকে প্রণাম করি। তোমাকেই আমি পেলাম। পেলাম তোমার অনন্ত প্রেম। সুখে-দুঃখে বিপদে-সম্পদে ললাকে-লোকান্তরে তোমাকে পেলাম। সংসার আমাকে আর পীড়া দিতে পারবে না, ক্লান্তি দিতে পারবে না। এই সৃষ্টি-সংসারই আমার প্রেম। এখানেই নিত্যের সঙ্গে অনিত্যের যোগ, আনন্দের সঙ্গে অমৃতের। এইখানেই বিচ্ছেদ-মিলনের মধ্যে দিয়ে, পাওয়া-না-পাওয়ার অনেক ব্যবধানের ভেতর দিয়ে নানা রকমে তোমাকে পেয়েছি, তোমাকে পেয়েও পেয়েছি, হারিয়েও পেয়েছি-এ-পাওয়া আমার নানা রসে নানা রঙে অক্ষয় অব্যয় হয়ে থাক। নমস্তেহস্তু…