লায়ালপুরের (বর্তমান নাম ফয়সলাবাদ) জেলের একটি বিশেষ কক্ষ। সেই বিশেষ কক্ষে আটকে রাখা হয়েছে। একজন বিশেষ বন্দিকে। তার উপর কঠিন খবরদারি। সশস্ত্র প্রহরীদের একটি দল সার্বক্ষণিক নজর রাখছে। বন্দি এখন কী করছেন? তার অভ্যাসমতো সেলের ভেতর হাঁটাহাটি করছেন? নাকি সেলের জানালায় বাইরের আকাশ দেখার চেষ্টা করছেন?
বন্দির কর্মকাণ্ড তিনে সীমাবদ্ধ। কোরান শরীফ পাঠ করা। সেলের জানালায় আকাশ দেখার চেষ্টা করা এবং হাঁটাহাটি করা। প্রহরীদের কেউ কেউ বন্দিকে সালাম দেয়। বন্দি তাদের সালামের জবাব দেন। সেই খবর আবার তাৎক্ষণিকভাবে জেলারকে দিতে হয়। বন্দির কর্মকাণ্ডের প্রতিটি খুঁটিনাটি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়াকে জানাতে হয়।
বন্দির অবস্থান, তাঁর দিনযাপন বিষয়ে পৃথিবীর কোনো মানুষ কিছু জানে না। চরম গোপনীয়তা। তবে নানান গুজব দেশী এবং বিদেশী পত্রপত্রিকায় আসছে। পাকিস্তান সরকার এইসব গুজবের সত্য-মিথ্যা নিয়েও কিছু বলছে না। শেখ মুজিবর রহমান বিষয়ে তাদের কিছু বলার নেই।
একটি জোর গুজব যা কোলকাতার স্টেটমেন্ট পত্রিকাতেও এসেছে তা হলো–শেখ মুজিব অনশন করছেন। অনশন শুরু হয়েছে জুন মাস থেকে। তিনি জানিয়েছেন, স্ত্রী এবং সর্বকনিষ্ঠ সন্তান রাসেলের সঙ্গে দেখা হলেই তিনি অনশন ভঙ্গ করবেন। তিনি এখন দিনরাত লিখে চলছেন। পাতার পর পাতা লেখা হচ্ছে। কী লেখা কেউ জানে না।
এমনও রটনা হলো যে, শেখ মুজিব পাগল হয়ে গেছেন। তিনি সারাদিন সারারাত দুর্বোধ্য বক্তৃতা করেন। যখন বক্তৃতা করেন না। তখন বিড়বিড় করেন।
শেখ মুজিবর রহমান অস্থির সময় কাটাচ্ছিলেন। যে চিন্তা তাঁকে গ্ৰাস করে রেখেছিল তা হচ্ছে–তাকে মেরে ফেলা হবে, না জীবিত রাখা হবে? পাইপ টানতে টানতে তিনি প্রায়ই এই হিসাব করেন (কারাগারে তাকে তামাক নামক একমাত্র বিলাসদ্রব্যটি সরবরাহ করা হতো)। পাকিস্তানি মিলিটারি যদি যুদ্ধে জয়লাভ করে, তাহলে অবশ্যই তাকে হত্যা করা হবে। যদি পরাজিত হয় তাহলে কী হবে? পরাজিত হলেও তাকে হত্যার সম্ভাবনা। প্ৰতিশোধ নেবার তীব্ৰ আকাঙ্ক্ষা থেকেই এটা করা হবে। সেই হত্যা প্রক্রিয়াটি কী রকম হবে? তাঁকে কি ফাঁসি দেয়া হবে, নাকি ফায়ারিং স্কোয়াডে নেয়া হবে? পুত্র রাসেলের প্রিয়মুখ কি মৃত্যুর আগে দেখে যেতে পারবেন না? তাঁর বড়মেয়েটির সন্তান হবার কথা। তা কি হয়েছে?
নিজের পুত্রকন্যাদের কথা যখনই তাঁর মনে হয়, তখনি তিনি খানিকটা লজ্জিত বোধ করেন। এ-কী, দেশের কথা একপাশে সরিয়ে তিনি কিনা নিজের প্রিয়মুখগুলির কথা ভাবছেন! একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার রূপকার তিনি। দেশের প্রতিটি মানুষ তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। আর তিনি কি-না তাঁর মৃত্যু কীভাবে হবে তাই নিয়ে ভাবছেন?
মাঝে-মাঝে তার ঘোরের মতো হয়। তিনি শুনতে পান। তার জীবনের মধুরতম শব্দ জয় বাংলা। হৃদয়ের গভীর গোপন কোনো জায়গা থেকে কেউ একজন বলে, ভয় পেও না। এই মধুর শব্দ তুমি আবারো শুনবে। তাঁর নিজের ভাষ্যমতে— একে বলতে পারেন স্বজ্ঞা, টেলিপ্যাথি, ইন্দ্ৰিয় কিংবা অন্য যা খুশি তাই। কিংবা সম্ভবত এটা এক ধরনের ঐশী প্রেরণা, আমি যেটা জানি তা হলো আমার মন বলছিল বিজয় আমাদের হবেই।
আগষ্ট মাসের তিন তারিখ টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা করেন–রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে শেখ মুজিবকে বিচার করা হবে।
অতি দ্রুত বিচারপর্ব শুরু হলো। তারিখ ৯ আগস্ট। প্রধান বিচারক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার। তার সঙ্গে আছেন দুজন কর্নেল, একজন উইং কমান্ডার, একজন নেভাল কমোডর ও একজন (একমাত্র সিভিলিয়ন) জেলা সেশন জজ।
শেখ মুজিব আত্মপক্ষ সমর্থনে অস্বীকৃতির কথা জানান এবং কোনো আইনজীবীর সঙ্গে বসতে রাজি হন না। বিচার চলতে থাকে। প্রতিদিন ভোরবেলা শেখ মুজিবকে কঠিন পাহারায় বিচারকক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল পাঁচটায় আবারো সেলে ফিরিয়ে আনা হতে থাকে।
বিচারকক্ষটি লায়ালপুর জেলের ভেতরই। লাল ইটের দালান। বন্দিকে লোহার চারটি ভারি দরজা পার হয়ে লম্বা সরু করিডোর দিয়ে আদালতে প্ৰবেশ করতে হতো। পাহারা থাকত সাব-মেশিনগান হাতে যুদ্ধসাজে সজ্জিত একদল কমান্ডো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে দেখে সবসময়ই নেশাগ্ৰস্ত মনে হয়। মনে হয় তিনি তার প্রিয় সুরা ব্ল্যাকডগে আকণ্ঠ ড়ুবে আছেন। অতি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়েও তার কথাবার্তা থাকে জড়ানো। এতে তিনি কোনো অস্বস্তি বোধ করেন না।
আজ তাকে নেশাগ্ৰস্ত মনে হচ্ছে না। তিনি একগাদা ফাইল নিয়ে বসেছেন। দ্রুত ফাইল ক্লিয়ার করা হচ্ছে। তার হাতে সময় নেই। চীনা রাষ্ট্রদূত প্রেসিডেন্ট ভবনে তার সঙ্গে দেখা করার জন্যে আসছেন। দশ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য চীনের কাছ থেকে পাওয়া গেছে। এখন আলাপ আলোচনা চলছে এক জাহাজ বােঝাই সমরাস্ত্র নিয়ে, এর মধ্যে হালকা চৈনিক ট্যাংকও আছে। চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আজকের আলোচনা এই কারণেই অতি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রেসিডেন্টের অতি ব্যস্ততার মধ্যে ঘরে ঢুকলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো। প্রেসিডেন্ট এক ঝলক ভুট্টোর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার যা বলার বলুন। আমি কাজ করতে করতে আপনার কথা শুনব। আজ আমার সীমাহীন ব্যস্ততা।
জুলফিকার আলি বললেন, শেখ মুজিবকে কি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে?
প্রেসিডেন্ট কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললেন, অবশ্যই।
ফর গডস সেক। ডোন্ট ড়ু দ্যাট।
না কেন?
আপনার হাতে মৃত্যুর চেয়ে সে বড় মাপের মানুষ।
জুলফি, আপনার ধারণা তাকে হত্যা করার মতো বড় আমি না?
তাকে হত্যা করলে সারা পৃথিবী আমাদের উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়বে। বিশেষ করে আমেরিকানরা। আমেরিকানরা আপনাকে যত খুশি বাঙালি মারতে দেবে, কিন্তু নট শেখ মুজিব।
জুলফি, আপনি কি মনে করেন আমেরিকানদের মনোভাব আমি জানি না? খুব ভালো যোগাযোগ তাদের সঙ্গে আমার আছে। শেখের কী হলো নিক্সন তার পরোয়া করে না। আমি নিক্সনকে ভালোমতো জানি। আমরা যোগাযোগ রেখে চলি। আপনার সঙ্গে আমি এখন আর কথা বলতে পারছি না, চীনা রাষ্ট্রদূত আসছেন। শুনুন জুলফি, আমি শেখকে অবশ্যই ফাঁসির দড়িতে ঝুলাব। যে ঝামেলায় সে আমাকে ফেলেছে তাকে তার মূল্য দিতে হবে। Good bye.