জানবাজারের বিখ্যাত ধনী প্রীতিরাম মাড়ের পুত্ৰবধু রাসমণি বিধবা হবার পর নিজেই তাঁদের বিপুল সম্পত্তি ও বৃহৎ সংসারের হাল ধরেন। মাহিষ্য বংশীয়া এই রমণীটি বিদ্যাশিক্ষা করেননি বটে, কিন্তু তাঁর জাগতিক জ্ঞান অতি প্রখর। তাঁর স্বামী রাজা ছিলেন না, কিন্তু স্বামীর নাম ছিল রাজচন্দ্ৰ, সেই সুবাদে রাজচন্দ্রের পত্নীকে অনেকে রানী বলে অভিহিত করেন। এবং তিনি রানী নামের যোগ্যও বটে। শ্ৰীমতী রাসমণি যেমন রূপবতী, তেমন তেজস্বিনী।
রূপের জন্যই সামান্য দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি এত সম্পদশালী পরিবারের বধু ও কর্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিতা হন। জন্মস্থান হালিশহরের কাছে গঙ্গাতীরে কিশোরী রাসমণি একদিন স্নান করতে এবং জল তুলতে এসেছিলেন। তখন তাঁর বয়েস এগারো। সেই সময় যুবক রাজচন্দ্ৰ গঙ্গাবক্ষে বজরায় বন্ধুবান্ধব সমভিব্যাহারে যাচ্ছিলেন কোনো তীর্থে। রাজচন্দ্রের তখন হৃদয় ভগ্ন, জীবনে শান্তি নেই। পর পর দুটি স্ত্রী পরলোকগমন করায় রাজচন্দ্রের আর বিবাহে মতি নেই। কিন্তু নদীকূলে ঐ রূপলাবণ্যবতী কিশোরীটিকে তাঁর চোখে লেগে গেল। রাজচন্দ্রের বন্ধুবান্ধবরাও বললো, সত্যি, এমনটি আর হয় না। তারা অনুসন্ধান করে জানলো যে, জাতের অমিল নেই, কন্যাটি পালটি ঘরের। পুত্রের বন্ধুদের মুখে সব কথা জানতে পেরে প্রীতিরাম ঐ মেয়েটিকে পুত্রবধু করে নিয়ে এলেন। বন্ধু সুলক্ষণা, তিনি আসবার পর এই পরিবারের উত্তরোত্তর শ্ৰীবৃদ্ধি হতে লাগলো।
রাজচন্দ্রের মৃত্যুর আগে রানী রাসমণির নাম সর্বসাধারণের মধ্যে বিশেষ পরিচিত ছিল না। স্বামীর শ্রাদ্ধের সময়ই তাঁর খানিকটা পরিচয় পাওয়া গেল। এমন দানশীলা রমণী কেউ আর আগে দেখেনি। দানসাগর শ্রাদ্ধে পর পর দুদিন ধরে তিনি মুঠো মুঠো ধন দান করতে লাগলেন। তাঁর নির্দেশ, কোনো প্রার্থই যেন ফিরে না যায়। তৃতীয় দিনে তিনি করলেন তুলট। শুদ্ধ বস্ত্ৰ পরে রানী রাসমণি বসলেন দাঁড়িপাল্লার একদিকে, অন্যদিকে চাপানো হলো শুধু রূপোর টাকা। তাঁর দেহের ওজন হলো ছ হাজার সতেরোটি রৌপ্যমুদ্রা, সেগুলি সেই দণ্ডেই বিতরণ করা হলো পণ্ডিত ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে। তারপর থেকে যে কোনো মহৎ কর্মের উদ্দেশ্যে কেউ প্রার্থী হয়ে এলে রানীর কাছ থেকে আশাতীত দান পেয়ে যায়।
রানী রাসমণি যেমন একদিকে অকাতরে দান করেন তেমনি অন্যদিকে বিষয় সম্পত্তিও বাড়িয়ে চলেছেন। কী জমিদারি পরিচালনায়, কী ব্যবসায় কাৰ্যে, তিনি পরিচয় দেন অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার। অর্থ উপার্জনে তাঁর যেমন আনন্দ, তেমনি ব্যয়ে। কলকাতার অন্য ধনীদের প্রায় সবার সঙ্গে রাসমণির একটি পরিষ্কার পার্থক্য চোখে পড়ে। অন্যরাও অনেক সময় দান ধ্যান করেন বটে, কিন্তু বিলাসে প্ৰমোদেও তাঁরা কম অর্থব্যয় করেন না। কিন্তু রানী রাসমণি শুদ্ধাচারিণী, বিশেষ বিশেষ তিথিতে তিনি ভূমিশয্যায় নিদ্রা যান।
কলকাতার ধনীদের মধ্যে একমাত্র ঠাকুর বাড়ির দেবেন্দ্ৰবাবু সমস্ত বিলাসিত পরিত্যাগ করে ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেছেন। এক হিসেবে দেবেন্দ্ৰবাবুও রানী রাসমণির প্রতিপক্ষ। দেবেন্দ্ৰবাবু প্রচার করছেন, দেশবাসী পুতুল পূজা পরিত্যাগ করে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করুক। আর রানী রাসমণি পূজা করেন সাকার ঈশ্বরের। সমস্ত দেব-দেবীর প্রতি তাঁর অচলা ভক্তি। হিন্দু ধর্মের মহিমা বিস্তারের জন্য তাঁর ধনভাণ্ডার উন্মুক্ত। প্রিন্স দ্বারকানাথ তাঁর স্বামীর কাছ থেকে এক সময় দু লক্ষ টাকা কার্জ নিয়েছিলেন, যথাসময়ে তা শোধ করতে পারেননি বলে ঠাকুরদের জমিদারির একটি পরগণা এখন রানী রাসমণির অধীনে। সুতরাং, প্রকারান্তরে দ্বারকানাথেরই জমিদারির টাকায় দেবেন্দ্ৰবাবু ও রানী রাসমণি পরস্পরবিরোধী দুই ধৰ্মকর্মে ব্যাপৃত।
আতুরালয় স্থাপন, গঙ্গায় ঘাট নিমণি, বিভিন্ন তীর্থের দেবদেবীর অলঙ্কার সজ্জা, এ সব তো আছেই, তা ছাড়া এই নগরের উন্নতিকল্পেও তাঁর যত্নের অন্ত নেই। জানবাজারে রানী রাসমণির প্রকাণ্ড অট্টালিকায় দোল-দুর্গোৎসবের জাঁকজমকও কয়েক বৎসরের মধ্যে প্রবাদ-প্রসিদ্ধি পেয়ে গেল। দুর্গোৎসব করতেন বটে পোস্তার রাজা সুখময় রায়, তারপর এই রানী রাসমণি। এই সব উৎসবে সারা শহরের লোক ভেঙে পড়ে তাঁর বাড়িতে। রথের দিন পথে বেরোয় প্রাসাদতুল্য সম্পূর্ণরূপোয় নির্মিত রথ, তার পিছনে প্ৰায় আধ ক্রোশব্যাপী শোভাযাত্রা, তাতে অবিরাম শোনা যায় গীত, বাদ্য আর হারি বোল ধ্বনি।
দুর্গোৎসব উপলক্ষেই রানী রাসমণির অন্য একটি রূপ প্রকাশিত হলো একবার। মহালয়ার দিনের বোধন থেকে শুরু হয় উৎসব। সপ্তমীর দিনে খুব ভোরে ব্ৰাহ্মণরা নব পত্রিকা নিয়ে গঙ্গায় স্নান করাতে যায়, তাদের পেছনে পেছনে বাজনাদাররা ঢাকা, ঢোল, সানাই, করতাল বাজাতে বাজাতে চলে।
সেই তুমুল বাদ্যরবে এক সাহেবের নিদ্রার খুব ব্যাঘাত হলো।
তিনি গবাক্ষ খুলে দেখলেন একদল অর্ধ উলঙ্গ নেটিভ বিকট শব্দ করে লাফাতে লাফাতে চলেছে। নেটিভদের অনেক প্রকার উদ্ভট মুখামির পরিচয় এর আগে পাওয়া গেছে, কিন্তু সূযোদয়ের আগে সকলকার ঘুম ভাঙিয়ে একি উৎকট আনন্দ!
মুখ রক্তবর্ণ করে সাহেব দারুণ চেঁচামেচি করতে লাগলেন এবং তখনই হুকুম দিলেন বাজনা বন্ধ করার। কিন্তু রানী রাসমণির লোকেরা শুনবে কেন? তারা কর্ণপাত না করে তেমনভাবেই ড্যাং ড্যাং করে চলে গেল।
ক্ৰোধে অগ্নিশর্মা হয়ে সাহেব খবর দিলেন কোতোয়ালিতে। পুলিসের সাহায্য চাইলেন, যাতে ফেরার পথে ঐ নেটিভরা তাঁর শান্তি ভঙ্গ করতে না পারে।
দু-একজন অনুচর। এ সংবাদ জানালো রানী রাসমণিকে। তিনিও দপ করে জ্বলে উঠলেন রাগে। তিনি বললেন, আমরা হিন্দু, আমাদের ধর্মকর্মে বাধা দেবার কী অধিকার আছে সাহেবের? সাহেবরা যে খৃষ্টীয় পরবে। সারারাত্রব্যাপী হিল্লা করে, তখন কি আমরা বাধা দিতে যাই? যা, আরও বেশী করে ঢাক ঢোল বাজা গে যা তোরা! শুধু তাই নয়, আজ সারাদিন ধরে এই পথ দিয়ে বাজাতে বাজাতে যাবি আর আসবি।
তিনি কয়েকজন পাইকও পাঠিয়ে দিলেন ওদের সঙ্গে।
দুচারজন পুলিস সেই শোভাযাত্রাকে বাধা দিতে পারলো না। রাসমণির কর্মচারীরা বললো, আমাদের মা বলে দিয়েছেন, এ রাস্তা আমাদের, এখানে আমরা যা খুশী করবো। সাহেব হাত পা কামড়াতে লাগলেন, সারাদিন ধরে অসহ্য ঢাকের বাজনা তাঁর কান ঝালাপালা করে দিল।
সাহেব একটি মামলা ঠুকলেন রাসমণির নামে। ইংরেজের আদালতে ইংরেজ আনীত মামলার ফলাফল যা হবার তাই হলো, পঞ্চাশ টাকা জরিমানা হলো রাসমণির। কিন্তু এ রমণী বড় জেদী, কিছুতেই হার স্বীকার করার পাত্রী নন। জরিমানার টাকা জমা দিয়ে রাসমণি বললেন, বেশ, এর পর থেকে যে রাস্তা আমি বানিয়েছি, সে রাস্তা দিয়ে অন্য কারুর হাঁটা চলার এক্তিয়ার থাকবে না। বড় বড় গরাণ কাঠের গুড়ি দিয়ে তিনি জানবাজার থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত রাস্তার দুদিকে শক্ত বেড়া দিয়ে দিলেন। সব যানবাহন বন্ধ হয়ে গেল, নগর পরিচালকরা পড়লেন মহা অসুবিধেয়। শেষ পর্যন্ত তাঁরা আপোস করলেন রাসমণির সঙ্গে, ক্ষমা চেয়ে তাঁরা জরিমানার টাকা ফেরত দিলেন। রাসমণিও তুলে নিলেন পথের বেড়া। এক স্ত্রীলোকের এই জয় কাহিনীতে খুব আমোদ পেল নগরবাসীরা।
রানী রাসমণি আর একবার কোম্পানী বাহাদুরকে জব্দ করেছিলেন।
সরকার থেকে হঠাৎ আদেশ জারি করা হলো, গঙ্গায় আর জেলেরা ইচ্ছে মতন মাছ ধরতে পারবে না। মাঘে সরস্বতী পূজার পর থেকে সেই আশ্বিন মাস পর্যন্ত গঙ্গা থাকে ইলিশ মাছে ভরা, তখন গঙ্গাবক্ষ জেলে ডিঙিতে ছেয়ে যায়। এর ফলে জাহাজ চলাচলে অসুবিধা হয় বলে ঠিক হলো যে যার খুশী সে আর এখানে মাছ ধরতে পারবে না। এজন্য কর দিতে হবে। কর দিতে গেলেই জেলে ডিঙির সংখ্যা যাবে অনেক কমে।
মৎস্যজীবীরা গিয়ে কেঁদে পড়লো রানী রাসমণির পায়ে। অনেকের জীবিকা নষ্ট হবার উপক্ৰম। এখন রানী না বাঁচালে তাদের কে বাঁচাবে? তিনি ছাড়া তাদের জাতের দুঃখে আর কে সমব্যাথী হবে?
রাসমণি তখন আবার এক চমকপ্ৰদ বুদ্ধির পরিচয় দিলেন। সরকার মাছ ধরার জন্য কর চেয়েছেন, ঠিক আছে, সেই কর তিনি একাই দেবেন। দশ হাজার টাকা দিয়ে তিনি ঘুষুড়ি থেকে মেটেবুরুজ পর্যন্ত গঙ্গা ইজারা নিয়ে নিলেন সরকারের কাছ থেকে। তারপর জাহাজ লঙ্গর করার মোটা দড়ি দিয়ে ঘিরে ফেললেন গঙ্গার সেই এলাকা, জেলেদের বলে দিলেন, এবার তোরা মাছ ধর, যত খুশী মাছ ধর।
দড়ি দিয়ে ঘেরার ফলে সব জাহাজ আটকে গেল। কলকাতার বন্দরে আর কোনো জাহাজ ভিড়তে পারে না, কলকাতার জীবন অচল হয়ে যাবার উপক্ৰম। কলকাতার লোক সবাই সেদিন গঙ্গার কুলে গিয়েছিল রানী রাসমণির কীর্তি দেখতে। দুলালচন্দ্রকে নিয়ে নবীনকুমারও গিয়েছিল। সে বড় অদ্ভুত দৃশ্য। মোটা দড়ির ওধারে সার বেঁধে থমকে আছে ইংরেজের জাহাজ, তার নাবিকরা সব হতভম্ব, আর এদিকে পতঙ্গের মতন অজস্র জেলে ডিঙি ভাসছে, জেলেরা উল্লাসে হো হো হা হা করছে। এই দৃশ্যে বড় মজা পেয়েছিল নবীনকুমার। সে তখন খুবই বালক, তবু ইচোড়ে পাকার ভঙ্গিতে সে দুলালকে বলেছিল, দ্যাক দ্যাক, জানবাজারের জমিদারণী ইংরেজের মুখে চুনকালি দিয়েচে।
ব্যতিব্যস্ত হয়ে সরকার রাসমণির কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করলেন। রাসমণির উত্তর অতি সরল। মাছ ধরার জন্য তিনি গঙ্গার অংশ ইজারা নিয়েছেন, এখন সেই অংশ তিনি জেলেদের মধ্যে বিলি করতে পারেন, সে অধিকার তাঁর আছে। এখান দিয়ে জাহাজ চলাচল করলে মাছ ধরায় বিঘ্ন হবে। সরকার তাঁকে ইজারা দিয়েছেন। এখন তাঁর সুবিধে অসুবিধে দেখার দায়িত্ব তো সরকারের। পুকুর জমা নিয়ে যখন বেড়া জাল ফেলে মাছ ধরা হয়, তখন কি পাড়া-প্রতিবেশীরা সেই পুকুরে আর নাইতে আসে?
অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হলো, রানীও দড়ি কাছি গুটিয়ে নিলেন।
রানীর বয়েস এখন ষাট, কিন্তু স্বাস্থ্য অটুট, আর তেজও এক বিন্দু কমেনি। পরিণত বয়সে তাঁর রূপ আরও মহিমান্বিত হয়েছে, এখনো তিনি স্বয়ং জমিদারি পরিচালনা করেন, প্রজাদের দুঃখ দুৰ্দশার কথা শোনেন। তাঁর জীবনের প্রধান ব্ৰত দুটি। প্রজাদের প্রতি অবিচার রোধ এবং সনাতন হিন্দু ধর্মের সংস্থাপন। খৃষ্টানী এবং নিরাকার ব্রহ্মের পূজা, তাঁর দুই নয়নের বিষ। হিন্দু ধর্মের গৌরব তিনি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে যাবেনই।
সম্প্রতি তিনি একটি অতি বৃহৎ কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন এবং সেই ব্যাপারেই প্রবল আঘাত পেলেন দেশবাসীর কাছ থেকে।
রানী স্বাবলম্বিনী। বিধবা হবার পর তিনি প্রায়ই এক সঙ্গে অনেক বজরা সাজিয়ে, পাইক বীরকন্দাজ সঙ্গে নিয়ে নানান তীর্থ ভ্ৰমণে গেছেন। একবার তিনি কাশীধামে গিয়ে বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণা দর্শন করে আসবেন মনস্থ করেছিলেন। কাশী অনেক দূরের পথ, দস্যু-তস্করের উপদ্রবের ভয় আছে, কিন্তু একবার কোনো কথা মনে এলে রানী আর নিরস্ত হন না। তিনি এক সঙ্গে পঁচিশখানা বজরা সাজালেন, তাতে নিলেন ছ মাসের উপযোগী খাদ্যদ্রব্য আর প্রচুর লোকলস্কর ও অস্ত্ৰধারী প্রহরী।
মধ্য রাত্রে জোয়ারের পর বজরার বহর ছাড়বে। আত্মীয় পরিজনদের নিয়ে রানী আগেই নিজস্ব বজরায় উঠে শুয়ে পড়েছেন। ঘুমের মধ্যে কখন বজরা ছেড়েচে, তিনি খেয়াল করেননি। এমন সময় রানী একটি স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্ন নয়, রানীর মনে হলো দৈব দর্শন। স্বয়ং জগজননী মা কালী তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়ে ভর্ৎসনার সুরে বলছেন, তোর সন্তানতুল্য ছেলেরা খেতে পরতে পাচ্ছে না, তাদের ছেড়ে তুই কোথায় চললি? কাশী? এদের সেবা কর, তাতেই আমাকে পূজা করা হবে। এখানে এই গঙ্গাতীরেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে সেবার ব্যবস্থা কর, সেখানেই আমি তোর হাতের পূজা গ্রহণ করবো।
স্বপ্ন ভেঙে যেতেই রানী রাসমণি ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। তাঁর সর্বাঙ্গ ঘামে সিক্ত। স্বপ্ন নয়, যেন একেবারে সত্য। মা তাঁকে আদেশ দিয়ে গেছেন। একটুক্ষণ আচ্ছন্ন ভাবে বসে রইলেন তিনি। তারপর বাইরে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বললেন, ওরে, বজরা থামা, বজরা থামা!
পরদিন প্ৰভাতে সবগুলি বজরার অন্ন বস্ত্ৰ স্থানীয় দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে রানী ফিরে এলেন জানবাজারে। তাঁর যাত্ৰা ভঙ্গের কারণ আর কারুর কাছে ব্যক্ত না করে তিনি ডেকে পাঠালেন মথুরকে।
রানীর পুত্ৰ সন্তান নেই। চারটি কন্যা। এর মধ্যে তৃতীয়া কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন এই মথুরের সঙ্গে। সেই কন্যাটি অকালে মারা যায়। তারপর চতুর্থ কন্যাটির সঙ্গেও মথুরেরই বিবাহ দিয়ে তাঁকে তিনি ঘরজামাই করে রেখেছেন। এই মথুর বেশ বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান, রানীর বিষয়কর্মের ডান হাত। মথুরকে ডেকে তিনি বললেন, তুমি গঙ্গার কুলে জমি দেখো, আমি মন্দির প্রতিষ্ঠা করবো।
গঙ্গার পশ্চিম কূল, বারানসী সমতুল, সুতরাং পশ্চিম পারে জমি পেলেই ভালো হয়। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেদিকে পছন্দমতন এক লপ্তে অনেকখানি জমি পাওয়া গেল না, বরং পূর্বপারে দক্ষিণেশ্বর গ্রামে জমি বিক্রয় আছে। সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটনী হেস্টি সাহেবের কুঠি, মুসলমানদের একটি পরিত্যক্ত কবরখানা ও এক গাজী সাহেবের পীরের আস্তানা, সব মিলিয়ে সাড়ে চুয়ান্ন বিঘা জমি, মূল্য সাড়ে বেয়াল্লিশ হাজার টাকা। সেখানে শুরু হলো একালের বৃহত্তম মন্দিরের নির্মাণের কাজ। গঙ্গার কুলে পোস্তা বেঁধে আগাগোড়া বাঁধিয়ে দেওয়া হলো, তৈরি হলো বৃহৎ স্নান ঘাট, তারপর দ্বাদশ শিব মন্দির, বিষ্ণু মন্দির, নবরত্ন চূড়াযুক্ত কালী মন্দির ও নাট মন্দির। যত লক্ষ টাকা লাগে লাগুক, তবু সব কিছু রানীর মনোমতন হওয়া চাই।
মন্দির গঠনের কাজে যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সেইজন্য রানী কঠোর কৃচ্ছতা অবলম্বন করলেন। ত্রি-সন্ধ্যা স্নান, হবিষ্যান্ন গ্রহণ, ভূমিতে শয়ন এবং নিশিদিন ইষ্টদেবতার কাছে প্রার্থনা। কয়েক বছর ধরে চললো মন্দির নির্মাণের কাজ, প্রতিদিন তিনি মথুরের কাছ থেকে খবরাখবর নেন। এবং মাঝে মাঝে নিজে দক্ষিণেশ্বর গ্রামে গিয়ে কাজের প্রগতি দেখে আসেন। আর বেশি বাকি নেই, বৎসরকালের মধ্যেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে, রানী এর মধ্যেই দিনক্ষণ দেখতে শুরু করেছেন।
তবু বাধা এলো অন্য দিক থেকে।
একদিন মথুর এসে বিষণ্ণ মুখে জানালেন সেই দুঃসংবাদ। ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতেরা ফতোয় দিয়েছেন, জানবাজারের জমিদার-পত্নী রাসমণি দাসী দক্ষিণেশ্বর গ্রামে মন্দির প্রতিষ্ঠা করলে, সে কাজ হবে অশাস্ত্রীয়।
রানী একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। অশাস্ত্রীয়? তিনি শুদ্ধচিত্তে, ফলের প্রত্যাশী না হয়ে, তাঁর সমস্ত সম্পদ উজাড় করে মন্দির স্থাপন করতে চান, সে কাজ অশাস্ত্রীয় কেন হবে?
মথুর জানালেন যে, ব্ৰাহ্মণরা বলেছেন, শূদ্রের কোনো অধিকার নেই দেবদেউল প্রতিষ্ঠার। শূদ্রের হাতের পূজা কোনো দেব-দেবী নেন না। টাকার গরম থাকলেই কি শাস্ত্ৰ উল্টে যাবে! এই বলে পণ্ডিতরা ঘোঁটি পাকাচ্ছে।
রানী হাহাকার করে বললেন, কিন্তু মা যে স্বয়ং আমায় দেকা দিয়ে বলেচেন যে তিনি আমার হাতের পূজা নেবেন!
ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতেরা সে স্বপ্নের কথা বিশ্বাস করবে না। স্বপ্নের কথা বলে শাস্ত্ৰ পাল্টানো যায় না।
রানী রাসমণি গুম হয়ে বসে রইলেন। তাঁর শ্রদ্ধাভক্তি, ধর্ম সংস্থাপনের জন্য তাঁর ব্যাকুলতা, এ সবই তুচ্ছ? তিনি শূদ্র বংশীয়া, এটাই বড় কথা? তা ছাড়া, কে বলেছে। শূদ্র? মাহিষ্যরা মোটেই শূদ্ৰ নয়। ব্ৰাহ্মণরা যে-কোনো একটা ফতোয়া দিয়ে দিলেই হলো! জমিদারির কাগজপত্রে তাঁর নামের শিলমোহরে লেখা থাকে, কালীপদ অভিলাষী শ্ৰীমতী রাসমণি দাসী। পণ্ডিতেরা তাঁর মায়ের পদ বন্দনা করতে দেবে না। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির বিগ্রহহীন শূন্য পড়ে থাকবে? ব্রাহ্মণরা অশাস্ত্রীয় বলে ঘোষণা করলে পাপের ভয়ে কেউ তো সে মন্দিরে যাবে না।
একটু পরে রানী চোখের জল মুছে বললেন, তা বলে তো ভেঙে পড়লে চলবে না, মথুর। হেরে যেতে আমি শিখিনি। কলকাতার পণ্ডিতরা বলেচে বলে সেটাই তো শেষ কতা নয়। তুমি লোক পাঠাও, কাশীতে, মারহাট্টাদের দেশে, দক্ষিণ ভারতে। সেখানেও বড় বড় পণ্ডিত থাকে, তেনাদের মত আনাও।
কিন্তু দূর দূর দেশ থেকেও নৈরাশ্যজনক সংবাদ আসতে লাগলো। শূন্দ্রের মন্দির প্রতিষ্ঠার অধিকার ভারতের ব্ৰাহ্মণ সমাজ মেনে নেবে না কিছুতেই। কলকাতার পণ্ডিতরা প্রকাশ্যে আন্দোলন শুরু করলো। তারা প্রচার করলো, রাসমণি দাসীর এই স্পর্ধা কিছুতেই সহ্য করা হবে না। এই ঘোর অনাচার মেনে নিলে হিন্দু সমাজে প্রবল বিকার দেখা দেবে। টাকা দিয়ে আর সব কেনা যায়, ধর্ম কেনা যায় না। রাসমণি দাসী আবার সেখানে অন্নভোগ দিতে চায়! শূদ্রের অন্ন দেওয়া হবে দেবতাকে! এর মধ্যেই কি কলির পাঁচ পা বেরুলো!
ধর্মপ্ৰাণা রানী রাসমণি ইংরেজের বিরুদ্ধে কূট কৌশলে লড়েছেন, কিন্তু ব্ৰাহ্মণ তাঁর চোখে দেবতুল্য, সেই ব্ৰাহ্মণের বিরুদ্ধে তিনি লড়বেন কী ভাবে! তাঁর মন ভেঙে গেল। তিনি ভূমিশয্যায় শুয়ে অনবরত রোদন করেন আর মাঝে মাঝে কাতর ভাবে বলে ওঠেন, মা, মা, আমি শূদ্র বংশে জন্মে কী অপরাধ করেছি মা, যে তোমার সেবা করতে পারবো না? তুমি কি শূদ্রেরও মা নাও?
রানীর এক এক সময় মনে পড়ে যায় নবদ্বীপের কথা। কয়েক বছর আগে তিনি নবদ্বীপে গিয়েছিলেন তীর্থ দর্শনে। চন্দ্রগ্রহণের রাতে নবদ্বীপের গঙ্গাতীরে দাঁড়িয়ে তিনি কল্পতরু হয়েছিলেন। ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতদের তিনি রক্তবর্ণ পট্টবস্ত্র ও রৌপ্যমুদ্রা দান করেছেন। বিশিষ্ট সব শিরোমণি, তর্কসিদ্ধান্ত, ন্যায়রত্ন ও বিদ্যারত্নদের নিমন্ত্রণ করে তাঁদের প্রত্যেককে দিয়েছেন পঞ্চাশটি করে টাকা ও লাল রঙের বনাত। পণ্ডিতরা দু হাত তুলে তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন।
সেই কথা মনে পড়ায় রানী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ব্ৰাহ্মণরা তাঁর দান গ্ৰহণ করতে পারেন, সেজন্য খুশী হয়ে আশীর্বাদ করতে পারেন, অথচ তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেই ব্ৰাহ্মণদের আপত্তি! এ কেমন কথা? এ যে স্বার্থপর, লোভীদের মতন মনোবৃত্তি! পর মুহূর্তেই রানী আবার তিরস্কার করেন নিজেকে। না, ব্ৰাহ্মণদের সম্পর্কে এমন চিন্তা করাও যে পাপ!
রানীর মুশকিল। এই যে, তিনি ব্ৰাহ্মণদের শত্ৰু বলে মনে করতে পারছেন না। নইলে তো লাঠি কিংবা বুদ্ধির জোরেই তিনি কলকাতার ব্ৰাহ্মণ সমাজকে শায়েস্তা করতে পারতেন। টাকা দিয়ে কিছু ব্ৰাহ্মণকে কিনেও ফেলা যায়। কিন্তু পণ্ডিতসমাজ পুরো ব্যাপারটিকেই অশাস্ত্রীয় বলে ঘোষণা করলে জনসাধারণ তাঁর দিকে আসবে না। তাঁর চাই শাস্ত্রের সমর্থন। ব্ৰাহ্মণ ছাড়া পূজা হয় না। দেবেন্দ্র ঠাকুরের দল পূজা আচ্চা তুলে দিয়ে বেদ পাঠ করাচ্ছে। সে সবের বিরুদ্ধেই তো রানী রাসমণি পূজার মহিমা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চান। অথচ ব্ৰাহ্মণরাই তাঁকে প্রতিহত করছেন!
মথুর মাঝে মাঝে সান্ত্বনা দিতে আসেন, কিন্তু রানী কিছুতেই প্ৰবোধ মানেন না। তিনি কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। মা কালী নিজে এসে তাঁকে অন্নভোগ দিতে বলেছিলেন, আদেশ দিয়েছিলেন মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দরিদ্রনারায়ণের সেবা করতে, তা আর ইহজীবনে সম্পন্ন হবে না!
একদিন মথুর হস্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, মা, মা, একটি সুসংবাদ আছে! এবার বুঝি একটা উপায় হয়েচে।
রানী বিশেষ গরজ করলেন না, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, কী বলো?
মথুর বললেন, মা, আপনি উঠে বসুন। অনেক কথা আচে।
রাসমণি উঠে মথুরের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ঠাণ্ডাভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কী উপায় হয়েচে, আগে শুনি!
মথুর বললেন, এক চতুষ্পাঠীর পণ্ডিত জানালেন যে, আপনি যদি মন্দিরের যাবতীয় সম্পত্তি কোনো ব্ৰাহ্মণকে আগে দান করেন। আর সেই ব্ৰাহ্মণ যদি মন্দিরে বিগ্ৰহ প্ৰতিষ্ঠা করে অন্নভোগের ব্যবস্থা করেন, তা হলে আর শাস্ত্রের কোনো বাধা থাকে না।
রাসমণি বললেন, এ আর এমন কি কথা। আমার গুরুদেবের নামে ঐ সব সম্পত্তি ব্ৰহ্মোত্তর করে দেবো, আমি হবো তাঁর কর্মচারী। আমি তো নাম চাই না, মায়ের সেবার অধিকার পেলেই হলো।
মথুর বললেন, বেশ, এই তো উত্তম বন্দোবস্ত।
রানী জিজ্ঞেস করলেন, এই পণ্ডিতের বিধান সবাই মানবে? ইনি কে? কোথায় থাকেন?
মথুরবাবু বললেন, কেন মানবে না? ইনিও যে-সে। পণ্ডিত নন। আমি নিজে এই মাত্র তেনার সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে আসচি। তিনি আমায় শাস্ত্রের বচন উদ্ধার করে শোনালেন।
রাসমণি আবার প্রশ্ন করলেন, পণ্ডিতটি কে?
পণ্ডিতের নাম রামকুমার ভট্টাচার্য। হুগলীর কামারপুকুরে বাড়ি। কলকাতায় এসে ঝামাপুকুরে টোল খুলেছেন। তাঁর সঙ্গে থাকে তাঁর সতেরো বছর বয়সী এক ভাই, তার নাম গদাধর। ছেলেটি বেশ ভালো গান গায়।