যদুপতি গাঙ্গুলী ব্ৰাহ্মদের এক প্রার্থনা সভায় হঠাৎ ঘোষণা করলো, আগামী বৈশাখ মাসের পয়লা তারিখে সে তার উপবীত বিসর্জন দেবে। সে তারিখটি বেশী দূর নয়, আর মাত্র এগারো দিন বাকি।
বাতাসে আগুনের ফুলকির মতন খবর রটে যায় সর্বত্র। সারা শহরে শোরগোল পড়ে গেল একেবারে। এ যে ঘোর কলি! কুলীন ব্ৰাহ্মণের সন্তান পৈতা ত্যাগ করবে, তা হলে আর সর্বনাশের পাঁচ পোয় পূর্ণ হতে বাকি থাকে কী? এই সব পাপ তো শুধু একজনের ওপর অসায় না, গোটা সমাজের প্রতিই অভিশাপ নেমে আসে। দলে দলে লোক যদুপতি গাঙ্গুলীর বাড়ির সামনে এসে তর্জন গর্জন করতে লাগলো। একদল লোক রাধাকান্ত দেবের কাছে ধর্না দিয়ে পড়লো। এর একটা বিহিত করতেই হবে।
পৈতা পরিত্যাগের চেষ্টা এর আগেও কয়েকজন নবীন ব্ৰাহ্ম করেছে কিন্তু সার্থক হতে পারেনি। হয় সেই সব নবীন ব্ৰাহ্মদের মাতা আত্মঘাতিনী হবার ভয় দেখিয়েছেন অথবা পিতা পানাহার বন্ধ করে ছেলেকে আবার ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করেছেন। মানুষ জন্মায় শুধু একবার, শুধু ব্ৰাহ্মণেরই এক জীবনের মধ্যে দ্বিতীয় জন্ম হয়। তাই তিনি দ্বিজ, আর সেই দ্বিজত্বের চিহ্ন ঐ যজ্ঞসূত্র। ব্ৰাহ্মণের কাজ ধৰ্মরক্ষা করা, আর সেই ব্ৰাহ্মণই যদি অধৰ্মচারী হয়, তা হলে হিন্দুসমাজের সর্বনাশ রোধ করবে কে?
যদুপতির আত্মীয় পরিজন কেউ কলকাতায় নেই, সে একা বাসা ভাড়া করে থাকে। সে বিপত্নীক এবং গোঁয়ার প্রকৃতির। একবার জেদ ধরলে সে কিছুতেই ছাড়বে না। ব্ৰাহ্ম ধর্ম গ্ৰহণ করার পর থেকেই তার মধ্যে এই বিবেক দংশন চলছিল। ব্রাহ্মেরা একেশ্বরবাদী নিরাকার পরম ব্ৰহ্মের উপাসক, তবু তাদের মধ্যে জাতিভেদ থাকে কী প্রকারে? এখনো ব্ৰাহ্মদের পুত্র-কন্যাদের বিবাহের সময় অনুলোম-প্রতিলোমের কথা চিন্তা করা হয়। এ তো কুসংস্কারকেই প্রশ্রয় দেওয়া। যদুপতি সেই জন্যই একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়।
যদুপতির কিছু কিছু শুভার্থী বন্ধু তাকে পরামর্শ দিল এ ব্যাপার থেকে নিবৃত্ত হতে। স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একদিন তাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, এখনই এ রকম হঠকারিতার প্রয়োজন নেই, তা হলে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ আরও মারমুখী হয়ে উঠবে। ব্ৰাহ্মধর্ম প্রচারে বিঘ্ন ঘটবে। কিন্তু যদুপতি অনমনীয়। তার ধারণা আপোসের মনোভাব নিয়ে কোনো বড় কাজ করা যায় না। ব্ৰাহ্মধর্মের প্রকৃত স্বরূপ কী, তা সারা দেশের কাছে স্পষ্টভাবে উপস্থাপিত করা উচিত। সনাতন হিন্দুধর্মের মতন এতে যে জাতিভেদের স্থান নেই তার প্রমাণ রাখার প্রয়োজন আছে। এতে যদি সংঘর্ষ বাধে তো বাধুক। কেশবচন্দ্র ও আরও কয়েকজন তরুণ ব্রাহ্মের কাছ থেকে এ ব্যাপারে উৎসাহ পেল যদুপতি।
নির্দিষ্ট দিনে যদুপতির সমর্থকরা সমবেত হয়েছে তার গৃহের অভ্যন্তরে। আর বাইরে একদল লোক টিটকারি ও কুৎসিত মন্তব্য করছে। যদুপতির কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, একবার সে অলিন্দে এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখে বাইরের লোকগুলি উচ্চগ্রামে গালিগালাজ শুরু করে দেওয়ায় যদুপতি পাশ ফিরে তার এক বন্ধুকে বললো, যারা এমন কুরুচিপূৰ্ণ কুবাক্য বিনা দ্বিধায় উচ্চারণ করতে পারে, তারাই ধর্মের রক্ষক। হায় হিন্দুধর্ম, এই তোমার দশা!
ঘরের মধ্যে ফিরে এসে সে গলা থেকে উপবীতখানি খুলে হাত জোড় করে তার স্বর্গীয় পিতৃদেবের উদ্দেশে বললো, পিতঃ, আমাকে মার্জন করুন! আমি সজ্ঞানে যাহা সৎকর্ম বলিয়া বিবেচনা করি তাহাই পালন করি। আপনি শৈশবে আমাকে এমনই শিখাইয়াছিলেন।
তারপর মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে তার বাঁকুড়া নিবাসিনী মাতার উদ্দেশে বললো, মা, তুমি জানো, আমি কখনই ভালো বই মন্দ কাজ করবো না। পরের কথায় তুমি কান দিও না, আমার ওপর বিশ্বাস রেখো, তুমি জানো যে তোমার যদু কোনোদিন কোনো অনেয্য কাজ করবে না।
তারপর সেই নগাছি সুতো মালার মতন হাতে দুলিয়ে আবেগ কম্পিত কণ্ঠে সে বললো, বিদায়। আজ থেকে আমার কণ্ঠ বন্ধনহীন হলো।
এই সময় একটি আন্দোলনের সৃষ্টি হলো। এক যষ্টিধারী হৃষ্টপুষ্ট চেহারার মধ্যবয়েসী ব্যক্তি ভিড় ঠেলে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে বললো, একি সৰ্ব্ববুনেশে। কতা। মাতায় বাজ ভেঙ্গে পড়বে, ভূমিকম্প হবে, তিরিশ সালের মত আবার বন্যা হবে। ওরে বাপ রে বাপ, ওরে বাপ রে বাপ!
লোকটি দ্বিতলে যদুপতির কক্ষের মধ্যে ঢুকে পড়ে বললো, আমার ওপর এ অত্যাচার কেন, আমি পুত্র কলাত্র নিয়ে ঘর করি, ও মোয়াই, আমার এ সব্বোনাশ কচ্ছেন কেন? আপনাকে ভালো মানুষের ছেলে জেনেই তো বাড়িভাড়া দিইচিলুম। ও মোয়াই, এ কী কল্লেন?
আদর্শ ব্রাহ্মের মতন বিনীত, সুভদ্র কণ্ঠে যদুপতি বললো, কী হয়েচে, নয়নচাঁদবাবু? আপনি এত বিচলিত কেন?
গৃহস্বামী নয়নচাঁদ হঠাৎ যেন থমকে গেলেন। তারপর ঘরের চারদিক তাকিয়ে আবার যদুপতির মুখে দৃষ্টি স্থাপন করে মহা বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, ও বাবা, এ যে সুস্থ মানুষের মতন কতা বলে! তবে যে সবাই বলে, দাঁত কিড়মিড় করে বক রাক্ষসের মতন চক্ষু ঘুরোচ্চে! বামুন পৈতে ত্যাগ কল্লে ব্ৰহ্মদৈত্যি হয়ে যায়।
যদুপতি সমেত সেখানকার সকলেই উচ্চহাস্য করে উঠলো। কৃষ্ণদাস পাল বললো, এ পারফেক্ট স্পেশিমেন অব ইমবেসিলিটি।
যদুপতি বললো, ভয় পাবেন না নয়নচাঁদবাবু, আমি ব্ৰহ্মদৈত্য হইনি। এখোনো। বসুন। আমি শুধু গলা থেকে এই সুতোগাছি খুলে ফেলিচিল।
নয়নচাঁদ প্ৰায় ছটফটিয়ে লাফাবার ভঙ্গি করে বললো, বসবো, এখেনে বসবো, বলেন কী? নেহাৎ প্ৰাণের দায়ে এয়িচি, আমার গিয়ী বল্লেন, যাও, এখুনি যাও, সারা বাড়ি গঙ্গাজল দিয়ে ধুইয়ে এসো গে, তারপর পুরুত ডেকে-মোয়াই, এই হাতজোড় কচ্চি, আমার ঘাট হয়েচে, কোন পাপে আপনাকে দিইচিলুম জানি না, এবার। এখেন থেকে পাট তুলুন। আজি, বলেন তো আমি গাড়ি ডেকে দি–
তারপর সেখানে এক মহা কোলাহল শুরু হলো। নয়নচাঁদ সেই দণ্ডেই যদুপতিকে বাড়িছাড়া করতে চায়। যদুপতির বন্ধুরা তা কিছুতেই মেনে নেবে না। কৃষ্ণদাস পাল চোখা চোখ বাক্য বলতে খুব ওস্তাদ, সে ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে যুক্তিজালে নয়নচাঁদকে একেবারে ফাঁদে পড়া পশুর মতন বেঁধে ফেললো। উপায়ান্তর না দেখে তখন হাপুসা নয়নে কাঁদতে লাগলো নয়নচাঁদ। শান্তিপ্রিয় যদুপতিই শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল গৃহত্যাগ করতে। তার এক বন্ধু অবনীভূষণ তাকে আশ্রয় দিতে রাজি। তখনই একটা কেরাঞ্চিগাড়ি ডেকে তোলা হলো মালপত্র। বাইরের বিরুদ্ধবাদী জনতা মনে করলো, এতে যদুপতির যথেষ্ট হেনস্থ হয়েছে। তারা দুয়ো দিয়ে উঠলো।
মালপত্র নিয়ে চলে গেল অবনীভূষণ। যদুপতি তার অন্য বন্ধুদের নিয়ে সারবদ্ধভাবে চললো গঙ্গার ঘাটের দিকে। হাজার হাজার লোক অনুসরণ করতে লাগলো তাদের। গঙ্গার ঘাট একেবারে ভিড়ে ভিড়াক্কার। সকলের সব মন্তব্য উপেক্ষা করে যদুপতি তাঁর পৈতেগাছা ছুঁড়ে ফেলে দিল জলস্রোতে। তারপর সে মুখ ফেরালো যুদ্ধজয়ী বীরের মতন।
পরদিনই যদুপতি গেল বিদ্যাসাগর মহাশয়কে এই সংবাদ জানাতে। যদুপতি যেমন দেবেন্দ্রবাবুর ব্ৰাহ্মসভায় যায়, তেমনই আবার সে বিদ্যাসাগরের চ্যালা। বিদ্যাসাগর খুশী বা অখুশী-কোনো রকমই ভাব প্ৰকাশ করলেন না। তিনি বললেন, কে কেমনভাবে ধামাচরণ করবে, সে তার নিজস্ব ব্যাপার। তবে, বাপু, হুজুগে পড়ে করোনি তো? সমাজকে ধাক্কা দিলে সমাজ যে প্রতিশোধ নেয়। তার ধাক্কা সামলাতে পারবে তো? তখন যেন পেছুপা হয়ে না!
যদুপতি বললো, আজ্ঞে না। আমি সব জেনেশুনেই একাজ করিচি।
বিদ্যাসাগর বললেন, এখন দিন-কাল অনেক পাল্টেছে, তেমন দুর্বিষহ অবস্থা নাও হতে পারে। তুমি খুব একটা নতুন কিছু করো নি। রামতনু লাহিড়ী মশায়ের নাম শুনেছো?
—আজ্ঞে সেই শিক্ষাব্ৰতী মহাত্মার নাম কে না শুনেচে!
—আজ থেকে বোধ করি বছর দশেক আগে ঐ রামতনু লাহিড়ীও উপবীত ত্যাগ করেছিলেন। তখন তোমরা নিতান্ত বালক, তাই সে ঘটনা তোমরা জানো না। কী কোন্দলই না শুরু হয়েছিল সেই উপলক্ষে। রামতনুর কৃষ্ণনগরের বাড়িতে তো ধোপা-নাপিত বন্ধ হলোই, তিনি উত্তরপাড়ায় চলে এলেন শিক্ষকতা নিয়ে। সেখানেও অত্যাচারের শেষ নেই। কোনো লোক তাঁর বাড়িতে কাজ করে না। দোকানদার তাঁর কাছে চাল-ডাল পর্যন্ত বেচে না। মহা-দুৰ্দৈব। রামতনু পৈতে ত্যাগ করে মহৎ কাজ করেছিলেন। কিনা সে প্রশ্নে আমি যাই না। কিন্তু বন্ধু মানুষ বিপদে পড়েছেন। তাই আমি কলকাতা থেকে নৌকায় তার জন্য চাল-ডাল পাঠিয়ে দিতুম। রাঁধুনী বামুনও পাঠিয়েছি। সে বেটা দুদিন কাজ করার পরই স্থানীয় লোকের তাড়নায় ভোগে যায়। আমি আবার পাঠাই। এইভাবে মোট পাঁচটি রাঁধুনী বামুন পাঠিয়েছিলুম। তবে নাপিত পাঠাতে পারিনি। সেই কারণে কিছু দিন লাহিড়ী মশায় লম্বা দাড়ি রেখেছিলেন।
বিদ্যাসাগর সেই দৃশ্য যেন চোখের সামনে দেখতে পেয়ে হা-হা করে হেসে উঠলেন। একটু থেমে আবার বললেন, ইদানীং আর তেমন উৎপাত নেই। তোমার বিশেষ বিপদের কারণ দেখি না। লোকে অবশ্য পশ্চাতে গালি দেবে ঠিকই, গালি না দিলে যে এদেশের লোকের পেটের ভাত হজম হয় না।
নবীনকুমারের সঙ্গেও দেখা হলো যদুপতির। নবীনকুমার সব শুনে বললো, তা করেচো বেশ করেচো! আমার ওপর টেক্কা দিলে হে। আমার তো পৈতে নেই যে তোমার মতন সেটি ত্যাগ করে দশজনের বাহবা নেবো! তা একটা কথা জিগ্যেস কচ্চি, পৈতে খুলে ফেল্লে বেশ কতা, কিন্তু সিটিকে আবার ঘটা করে গঙ্গায় বিসর্জন দিতে গেলে কেন? তার মানে গঙ্গাজল যে পবিত্র তা মানো! আর একথাও মানো যে পৈতে জিনিসটা খুলে ফেল্পেও যেখোনে সেখেনে সেই জিনিসটে ফেলা যায় না, গঙ্গায় বিসর্জন দিতে হয়।
একটু অপ্ৰস্তুত হলো যদুপতি। তারপর আমতা আমতা করে বললো, তা নয়, তা নয়। আমি পৈতে পায়খানার মধ্যেও ফেলে দিতে পাতুম। কিন্তু রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো, সব্বাই দেখলে, এই প্রচারই তো দরকার। যত প্রচার হবে, ততই লোকে সাহস করে এগিয়ে আসবে।
নবীনকুমার হাসতে হাসতে বললো, তা যা বলোচো। এ রকম একটা দুঃসাহসিক কাজ কি ঘরের মধ্যে চুপেচাপে সারা উচিত? দশজনের বাহবা না পেলে মন ভরবে কেন!
শুধু বাহবা পাওয়া নয়। যদুপতির উপবীত ত্যাগের মূলে যে একটি অন্য উদ্দেশ্যও আছে। সে কথা নবীনকুমার টের পেল কয়েকদিন পরে।
রাত্রে শয়নকক্ষের দরজা এঁটে দিয়েই সরোজিনী দৌড়ে তার স্বামীর পালঙ্কের কাছে এসে এক দারুণ সংবাদ জানাবার ভঙ্গিতে বললো, আপনি ঠিকই বলিচিলেন, আপনার কতাই মিলে গেল।
নিদ্রার আগে কিছুক্ষণ সেজবাতির আলোকে পুস্তক পাঠ নবীনকুমারের অভ্যাস। তবে বড্ড পোকার উৎপাত হয়। আর মশার ঝাঁক তো আছেই। একে গ্ৰীষ্মকাল, তায় কদিন ধরে নিদারুণ গুমোট চলছে। দুজন পাঙ্খ-বরদার পালা করে। সারা রাত্রি জেগে বাইরে বসে এ-ঘরের পাখার দড়ি টানে। তাতেও মশা যায় না। ইদানীং সাহেবদের বাড়ির অনুকরণে নবীনকুমার তার শয়নকক্ষের জানলাগুলিতে মশারির মতন সূক্ষ্ম তারের জাল লাগিয়েছে। তবু যে কোথা থেকে ঢুকে পড়ে মশা, তার ঠিক নেই।
নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েচে? কোন কতা মিললো আমার?
সরোজিনীর ওষ্ঠাধর পানের রসে লাল। রাতের জন্য অতি সূক্ষ্ম নীলরঙের তাঁতের শাড়ি পরে এসেছে। পালঙ্কের ওপর উঠে বসে সে তার মাথার চুল খুলতে খুলতে বললো, ঐ যে আপনি বলিচিলেন না। কুসোমদিদির আবার বের কতা? ছি, ছি, কী ঘেন্না, এক পরপুরুষের সঙ্গে ঐ বেধবা মেয়েমানুষ আবার শোবে!
নবীনকুমার তাড়াতাড়ি উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো, তোমায় কে বল্লে। এ কতা?
সরোজিনী বললো, হাঁ গো, আমি তো আজই শুনিচি, আপনি বিশ্বোস কচ্চেন না? আমার মা তো শুনেই কাঁদতে বসলেন। মা বললেন, ওরে বাবা, কী হবে। আমাদের পাশের বাড়িতে এত অনাচার-হতভাগিনী কুসোমের পরকাল বলে কিচু রইলো না।
নবীনকুমার এক ধমক দিয়ে বললো, তোমার মা কী বল্লেন, তা আমি শুনতে চাই না। ও-বাড়িতে তুমি কী শুনোচো তা বলো।
কথাটা আসলে সত্যি। কুসুমকুমারীর দাদাদের উদ্যোগ সার্থক হয়েচে। রামতনু লাহিড়ী কালীঘাটের নিকটবর্তী রসাপাগলা গ্রামে শিক্ষকতা করতে এসেছেন সম্প্রতি। কুসুমকুমারীর দাদারা গিয়ে ধরে তাঁকে। তিনি প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছেন কৃষ্ণনাথ রায়ের কাছে। কুসুমকুমারীর পিতা কৃষ্ণনাথ রামতনুবাবুকে খুবই মান্য করেন। সুতরাং তিনি এককথায় উড়িয়ে দিলেন না, বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন কিছুক্ষণ। কৃষ্ণনাথ বৈষয়িক ও ঐতিহাবিশ্বাসী পুরুষ। কিন্তু গোঁড়া নন, যুক্তিবাদী। সব কথা শুনে তিনি বললেন, আপনার কতা আমি অস্বীকার কত্তে পারি না। কুসুম আমার প্ৰাণাধিক, সে জীবনে সুখী হয় আমি সবান্তঃকরণে চাই। ভুল করে তার বিবাহ দিয়েচিলুম এক পাগলের সঙ্গে—এখন এই প্রকার বিবাহ যদি শাস্ত্রসম্মত হয়, তবে তাইহোক। আপনি সুপাত্র দেকুন।; আর হ্যাঁ, আর একটা কতা আচে, তার জননীর মত করাতে হবে, তিনি বেঁকে বসলে সেখেনে আমি জোর খাটাতে পারবো না।
কুসুমকুমারীর জননী পুণ্যপ্রভার ওপর জোর খাটাতে হলো না। নৃপেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য ভাইরা জননীকে ঘিরে বসে বললো, মা, তোমার মত কত্তেই হবে, বাবা মশায় যখন হ্যাঁ বলেচেন—। পুণ্যপ্ৰভা অশ্রু বিসর্জন করে বললেন, ওরে, অবলা বেধবা নারীদের যখন বিদ্যেসাগর বে দিয়েচেন তখন আমি মনে মনে দু হাত তুলে বিদ্যেসাগরকে আশীর্বাদ করিচি। এখন নিজের মেয়ের বেলায় কি আমি অমত কত্তে পারি। সে পাগোলের কতা ভেবে বাছা যে এখনো শিউড়ে শিউড়ে ওটে।
এখন চতুর্দিকে কুসুমকুমারীর জন্য পাত্রের অনুসন্ধান চলেছে।
কয়েকদিন মহাভারত অনুবাদের কাজে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ায় নবীনকুমার এ সব কিছুই জানতো না। সে সরোজিনীর চিবুক ছুঁয়ে আদর করে আনন্দের সঙ্গে বললো, সরোজ, তুমি আজ একটা বড় ভালো খপর শোনালে। তোমার কুসোমদিদির একটা বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা কত্তে হবে।
সরোজিনী বললো, ওমা, কুসোমদিদির বিয়ের ব্যবস্থা। আপনি করবেন কেন, সে তো অন্য বাড়ির মেয়ে! আমার মা বলেচেন, ও বিয়ে যদি হয়ও আমরা কেউ নেমুন্তন্ন খেতে যাবো না। আপনার পায়ে ধচ্ছি, আপনিও যাবেন না। ঐ পাপের সঙ্গে আপনি নাম জড়াবেন না।
—সরোজ, এ রকম কতা আর দ্বিতীয়বার বলে না। আমার সামনে! তোমায় কতবার বুঝিয়িচি যে বিধবার বিয়ে পাপ নয়? বিধবার যদি আরেকজনের সঙ্গে বিয়ে হয়, তবে সে আর পরপুরুষ থাকে না। সেও ঐ বিধবার ধর্মপতি! তোমার কুসুম দিদি সারাজীবন এ দুঃখ পাক, তুমি তাই চাও!
নবীনকুমারের কণ্ঠস্বরে উম্মার পরিচয় পেয়ে সরোজিনী তাড়াতাড়ি বললো, না, না, তা আমি চাই না। আপনি যখুন বলচেন, তখন পাপ নয়!
—অনেক পণ্ডিতলোক বিধবা বিবাহ করেচেন, তারা স্বামী-স্ত্রীতে সুখে আচে!
—কুসোমদিদির সঙ্গে বুঝি কোনো পণ্ডিতের বে হবে? তাই হেমু বলছেল।
—পণ্ডিত মানে কি তুমি টুলো পণ্ডিত ভেবেচো? তা কেন? তোমার কুসুম দিদির জন্য আমরা বিদ্বান, বুদ্ধিমান, রূপবান পাত্র জোগাড় করবো। বুঝলে না, বাগবাজারের রায় বাড়ির মেয়ে, অত বড় বংশের কোনো বিধবা মেয়ের এ পর্যন্ত বিয়ে হয়নি। সেইজন্যই তো আমার এত উৎসাহ। এতদিনে বিদ্যেসাগর মশায়ের সত্যিকারের জয় হবে। দাঁড়াও, কাল থেকেই আমি পাত্রের সন্ধানে লেগে পড়েছি।
—শুনুন, হেমু বললো, আপনার এক বন্ধু, ঐ যে যদুপতি গাঙ্গুলী না কে, যে নাকি পৈতে পুড়িয়ে চাঁড়াল হয়েচে, সে কুসোমদিদিকে বে কত্তে চায়!
—অ্যাঁ?
—ঐ যদুপতি না ফদুপতি লোকটা তো নেপেনদাদার ছেলেদের পড়ায়। ও বাড়িতে যায়। কী জানি কখুনো কুসোমদিদিকে দেখে ফেলেচে কি না!
নবীনকুমার আপন মনে হেসে উঠলো।
সরোজিনী উৎকণ্ঠিতভাবে বললো, আপনি হাসচেন? মা বলছেল, কুসোমদিদির এমন ধিঙ্গিাপনা করা বড়ই দোষের কতা! থ্যাটারের মহড়ার সময় বসে থাকে—
—আবার ঐ রকম কত?
—মা বলছেল যে!
—তোমার মাকে বলবে, ঐ রকম কতা শুনলে আমার হাড়পত্তি জ্বলে যায়! বুঝলে? ফের যদি তুমি তোতাপাখির মতন তোমার মায়ের কতা আমায় শোনাও, তোমায় খাঁচায় আটকে রাখবো!
—আর বলবেন না, আপনি রাগ কবেন না!
—যদুপতির মনে তা হলে এই ছেল! হা-হা-হা-হা—
পরদিন যদুপতি নিজেই এসে উপস্থিত। মুখখানি স্নান, বিষণ্ণ। তাকে দেখেই সরোজিনীর কথার সত্যতা বুঝতে পারলো নবীনকুমার।
যদুপতি অন্য লোক মারফত কুসুমকুমারীর জ্যেষ্ঠভ্রাতা নৃপেন্দ্রনাথের কাছে বিবাহের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। নৃপেন্দ্রনাথ রাজি হন নি, ব্ৰাহ্মণের সঙ্গে কায়স্থ বিধবার বিবাহ, এতখানি বৈপ্লবিক কাজ করতে তাঁর পিতাও সম্মত হবেন না! মাঝখান থেকে যদুপতির লাভের মধ্যে হয়েছে এই যে রায়বাড়িতে তার ছেলে পড়বার চাকুরিটিও গেছে। বিবাহের উমেদারকে আর গৃহশিক্ষক হিসেবে রাখা যায় না।
নবীনকুমারের কাছে খোলাখুলি সব কথা স্বীকার করে যদুপতি বললো, ভাই, এ যে মহাজ্বালা। উপবীত ত্যাগ করলুম, তাও আমায় বলে ব্ৰাহ্মণ? আর কিসে ব্ৰাহ্মণত্ব ঘোচাতে পারি বলো তো!
নবীনকুমার বললো, তা হলে এই জন্যেই ঢাক ঢোল পিটিয়ে পৈতে ফেলে দিয়েচিলে?
যদুপতি নবীনকুমারের হাত চেপে ধরে বললো, বিশ্বাস করো, আমার কোনো অশুচি মতলোব নেই। কন্যাটিকে আমি একবারও চক্ষে দেখিনি। আমি যে বালক দুটিকে পড়াতুম তারাই অনেক গল্প করেচে ঐ মেয়েটির গুণপনার। তাই শুনে আমি মুগ্ধ হয়চি!
নবীনকুমার বললো, তাকে চক্ষে দেখলে তুমি বুঝি তা হলে মুচ্ছে যেতে! সে মেয়েটি সাক্ষাৎ সরস্বতী ঠাকরুণটি যেন।
যদুপতি বললো, আমি মরে গেলেও কোনো বামুনের মেয়েকে বিবাহ করবো না! আমি যে প্রকৃতই জাত মানি না, তার প্রমাণ দিতে চাই। সেই জন্যই তো আমার এত আগ্ৰহ এই কন্যাটি সম্পর্কে! ভাই, তুমি একটু চেষ্টা করে দেকবে। তোমার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে ওঁদের কুটুম্বিতে আচে—
নবীনকুমার বললো, আচ্ছা দেকি!
নবীনকুমার অবশ্য আগেই জানে যে ওখানে যদুপতির কোনো আশা নেই। ব্ৰাহ্মণ-কায়স্থের তফাত তো, কৃষ্ণনাথ রায়ের বাড়িতে একটা বড় ব্যাপার বটেই, কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যাপার আছে, সেটা যদুপতি বুঝবে না। যদুপতির কোনো বংশ মর্যাদা নেই। সে সাধারণ গ্ৰাম্য পরিবারের সন্তান। বিদ্যাশিক্ষা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। বনেদী রায় পরিবারের সঙ্গে এমন পাত্রের বিবাহ রূপা হয় না। ওরা নিশ্চই চাইকা নিজেদের সমান সমান কোনো বাড়ির সঙ্গে কন্যার বিবাহ
যদুপতি তো খারিজ হয়ে গেলই, কুসুমকুমারীর জন্য আর যে চার পাঁচজন পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেল, তাদের কারুকেই মনঃপূত হলো না। নৃপেন্দ্রনাথ এবং তাঁর অন্যান্য ভাইদের। একবার ভুল বিবাহ হয়েছিল, দ্বিতীয়বার তাঁরা অতি সতর্ক হয়ে সম্বন্ধ পাকা করতে চান। রূপে ও স্বভাবে অনিন্দিতা কুসুমকুমারীকে তো আর যার তার হাতে দেওয়া যায় না। তার চেয়ে কুসুমকুমারীর বৈধব্য দশাও ভালো। বাপের বাড়িতে তার যত্নের কোনো অভাব নেই।
নবীনকুমারও অনেক চেষ্টা করে কুসুমকুমারীর যোগ্য পাত্র সংগ্ৰহ করতে পারলো না। পরিচিতদের মধ্যে সে রকম কেউ নেই। কোথাও কোনো বিবাহযোগ্য উপযুক্ত যুবকের সন্ধান পেলে সে নিজেই উদ্যোগ নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে যায়। যেন সে নিজেই কন্যাকত। এদিকে ক্রমশ সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। এরপর যদি কুসুমকুমারীর বিয়ের কথাটা চাপা পড়েই যায়। বিয়েসেরও তো একটা ব্যাপার আছে। বেশি দিন ধৈর্য ধরে থাকা নবীনকুমারের ধাতে নেই, কুসুমকুমারীর বিবাহ সঙ্ঘটিত না হওয়া পর্যন্ত নবীনকুমারের শান্তি নেই।
তারপর একদিন যেন তার দিব্য দর্শন হলো। মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে শয্যার ওপর উঠে বসে সে ভাবলো, আশ্চর্য এমন সহজ কথাটাই তার মনে পড়েনি! কুসুমকুমারীর জন্য সুযোগ্যতম পাত্র আর কে হতে পারে? দু-একদিনের মধ্যেই এবার ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে, এই ভেবে সে ঘুমিয়ে পড়লো আবার।