1 of 2

৪৮. মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের গেট

মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের গেট থেকে বড়বাবু আস্তে আস্তে ফিরে যাচ্ছেন। আজও সূর্যর সঙ্গে দেখা হল না।

বড়বাবুর দৃষ্টি কোনও দিকে নেই, মুখ নিচু করা। হাতের চুরুটটা অনেকক্ষণ নিভে গেছে, ধরাবার কথা মনে নেই। কিছু দূরে সাইকেল রিকশা স্ট্যান্ডের কাছে আসতেই তিন-চারটে রিকশা এগিয়ে এল তার দিকে। সবাই তাঁকে নিতে চায়। বড়বাবু একটাতে চড়ে বসলেন, কোথায় যাবেন তা বলতে হল না–রিকশা ছুটতে লাগল। এই কয়েক মাসেই বড়বাবু এই শহরে বেশ পরিচিত হয়ে গেছেন। অনেকেই তার সঙ্গে কথা বলতে উৎসুক।

রিকশা এসে থামল একটা সাদা রঙের নতুন একতলা বাড়ির সামনে। এ শহরে ভালো হোটেল নেই বলে বড়বাবু এই বাড়িটা ভাড়া নিয়ে রেখেছেন। বাড়িটার পেছনেই একটা মস্ত বড় দিঘি, দিঘিতে এক ঝাঁক হাঁস।

একজন মাঝ বয়সি লোক বড়বাবুর জন্য রান্নাবান্না করে। সে এসে বলল, বাবু, বেলা। তো অনেক হয়ে গেল, খাবেন না।

বড়বাবু শুকনো গলায় বললেন, দাও!

দাদাবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছে?

বড়বাবু দু’ দিকে মাথা নাড়লেন।

দাদাবাবুর খাবার নিয়ে যেতে দেবে?

না।

মেঝেতে আসন পেতে জল ছিটিয়ে বড়বাবুর খাবার জায়গা করে দেওয়া হল। লোকটি রান্নায় একেবারেই পারদর্শী নয়। শুকনো কড়কড়ে ভাত, ছাকরা ছাকরা খেসারির ডাল, কালো রঙের কী একটা তরকারি আর মাছ।

বড়বাবু খাদ্যদ্রব্য সম্পর্কে একটিও মন্তব্য করলেন না। সামান্য কিছু মুখে দিলেন। লোকটি সর্বক্ষণ কাছাকাছি বসে থেকে নানা রকম মন্তব্য করে গেল, বড়বাবু উত্তর দিচ্ছিলেন একটি বা দুটি শব্দে।

খাওয়া শেষ হতেই লোকটি বড়বাবুর সামনে পান এগিয়ে দিল। বড়বাবু পান মুখে দিয়ে বললেন, তুমি এবার যাও, আমার আর কিছু লাগবে না।

লোকটি বলল, আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি হাওয়া করি। বড্ড গরম আজ।

বড়বাবু বললেন, তার দরকার নেই। আমি শোব না।

একটা নতুন চৌকির ওপর বিছানা পাতা হয়েছে। ঘরের আসবাবপত্র অতি সামান্য, কিন্তু সবকিছুই নতুন বলে বেশ একটা পরিচ্ছন্নতার ভাব আছে। গত তিন-চার মাস ধরে বড়বাবু প্রায়ই এসে এখানে থাকছেন।

এর মধ্যে মাত্র দু’বার সূর্যর সঙ্গে দেখা হয়েছে তার। সরকারের কাছ থেকে আর অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না। বড়বাবু তবু প্রতি সপ্তাহে এসে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এখানকার জেলার সুরথ চক্রবর্তীর কাকার এক বন্ধুকে তিনি এলাহাবাদে থাকার সময় চিনতেন। অনেক খুঁজে খুঁজে সেই সূত্র বার করে তিনি জেলারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। লোকটি খুব মুখ-মিষ্টি এবং ধুরন্ধর। সাধারণ সময়ে তিনি এইসব লোককে কথা বলার যোগ্য বলেও মনে করেন না। অথচ এখন খাতির করে কথা বলতে হচ্ছে। জেলার সুরথ চক্রবর্তী বড়বাবুকে নিরাশ করছে না কিছুতেই, সব সময়ই জেল সুপারিনটেন্ডেন্ট বেইলির নামে দোষ চাপাচ্ছে। বড়বাবু বেইলি সাহেবের সঙ্গেই দেখা করতে চান কিন্তু জেলার কিছুতেই সে ব্যবস্থা করবে না।

জেলার সুরথ চক্রবর্তী অত্যন্ত অর্থলোলুপ। কয়েদিদের বরাদ্দ থেকে বেশ মোটা। অংশ তার নিজের বাড়িতে আসে। বড়বাবু তার সঙ্গে একটা চেনাশুনো সম্পর্ক ধরে। এলেও সে আকারে ইঙ্গিতে টাকাপয়সা খরচের প্রসঙ্গ তুলছে প্রথম দিন থেকেই। বড়বাবু জলের মতন টাকা খরচ করে যাচ্ছেন।

বড়বাবু জেলারের কোয়ার্টারেই দেখা করতে গিয়েছিলেন। লোকটি স্ত্রী-পুত্র-কন্যা। নিয়ে থাকে, বাগান করার শখ আছে। কিন্তু রাজনৈতিক বন্দিদের সম্পর্কে সামান্যতম। সমবেদনা নেই। বড়বাবুর সামনেই তার ছেলের নামে গালমন্দ করে। এবং মাঝে মাঝে এমন ভাবে তাকায় যেন অধঃপতিত সন্তানের পিতা হিসেবে বড়বাবুও সমান অপরাধী।

এই কয়েক মাসেই বড়বাবু বুঝে গেছেন যে জেলখানায় কী রকম টাকার খেলা চলে। সুরথ চক্রবর্তীকে পুরো বিশ্বাস করতে পারেন না বলে আর একজন ওয়ার্ডারকেও তিনি নিয়মিত টাকা দিয়ে যাচ্ছেন, যাতে সূর্যর জন্য একটু ভালো খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সেসব কিছু সূর্যর কাছে পৌঁছেছে কিনা তা জানার কোনও উপায় নেই। মানুষের মধ্যে এমন চতুর শ্রেণির মানুষও তো আছে, যারা ঘুষও নেয় আবার কাজও করে না। চোরডাকাতের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে এদের অনেকেরই হৃদয় বলে কোনও পদার্থ নেই।

বড়বাবু জানলার কাছে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে চুরুট ধরালেন। দিঘির হাঁসগুলো জলের ওপর সরল রেখা টেনে টেনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও এক দিকে তিনটি, আর এক দিকে তিনটি, আবার কখনও এক দিকে পাঁচটা আর একটা অন্য দিকে একলা একলা–এই রকম নানা ডিজাইন তৈরি করে তারা দুপুর কাটায়। হাঁসের গলায় বেশ জোর আছে, কিন্তু সহজে ডাকে না। চারদিক অসম্ভব নিস্তব্ধ।

যে-লোকটি রান্না করে, সে দুটি ডেকচি হাতে নিয়ে দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। বোঝা যায়, ডেকচিদুটি বেশ ভারী। বড়বাবু তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিলেন–লোকটির সঙ্গে চোখাচোখি না হয়ে যায়। লোকটি এমনিতে ভালো, কিন্তু রোজই কিছু কিছু খাদ্যদ্রব্য চুরি করে। হয়তো ওর সংসারে খুব অভাব, এ ছাড়া আর কী-ই বা করবে। চতুর্দিকে অন্নের জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। এই যুদ্ধ দেশটাকে একেবারে ছারখার করে দিয়ে যাবে।

বালিশের তলা থেকে বড়বাবু একটা মোটা খাতা টেনে বার করলেন। ওলটাতে লাগলেন কয়েকটি পাতা। তার নিজের হাতের লেখা কিছু কিছু রয়েছে। খানিকক্ষণ বাইরের দিকে চুপ করে তাকিয়ে তিনি একটা নতুন পাতায় লিখতে শুরু করলেন।

.

৭ই জুন, ১৯৪৩

আজও ব্যর্থ হইয়া ফিরিয়া আসিলাম। সূর্য আমার সহিত দেখা করিতে চাহে না। মাসের পর মাস চেষ্টা করিতেছি তাহার সহিত দেখা করিবার জন্য। জেলখানায় অসংখ্য নিয়মের গ্রন্থি শিথিল করিয়া আনিয়াছিলাম প্রায়। অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘটনার পরিবর্তন হইল। এখন জেল কর্তৃপক্ষই সাগ্রহে আমার সহিত আমার পুত্রের সাক্ষাৎকার করাইয়া দিতে চাহে। কিন্তু সূর্য তাহাতে রাজি নয়।

না, এ জন্য সূর্যকে দোষ দিতে পারি না। দোষ দিতে হইলে আমাকেই দিতে হয়। আমার এই দৌর্বল্যে কাহারও গৌরব বৃদ্ধি হইবে না। যুক্তিতর্ক সবই জানি। তবু নিজের অন্তরকে বুঝ মানাইতে পারিতেছি না।

সূর্যর জেদ বড় বেশি। সে কাহারও কথা শুনিবে না। আমার অনুরোধেও সে কর্ণপাত করিবে না–এ কথাও আমি ভালোই জানি। জেলার সুরথ চক্রবর্তীর ধারণা আমি আমার ছেলেকে ফিরাইতে পারিব। আমিই বা কেন তাহাতে নাচিয়া উঠিতেছি?

উপবাসী পুত্রের মুখোনি বার বার আমার চোখের সম্মুখে ভাসিতেছে। কতই বা তাহার বয়স, এই কি উপবাসে থাকিবার সময়?

আজ লইয়া নয় দিন হইল, মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে সাতান্ন জন বন্দি অনশন করিয়া আছে। সূর্যও তাহাদের মধ্যে একজন। অপর সকলে অনশন না ভাঙিলে সূর্য একলা ভাঙিতে পারে না–তাহা সঙ্গতও নয়। এ অন্যায় অনুরোধ আমি তাহাকে করিবই বা কী রূপে? আমি এই সুযোগে তাহার সঙ্গে শুধু একবার দেখা করিতে চাহিয়াছিলাম। অনশন ভাঙিবার অনুরোধ করিতাম না, নিজের চক্ষে দেখিয়া তাহার স্বাস্থ্যের অবস্থা বুঝিতাম। নানা লোকে নানা কথা বলিতেছে। অধিকাংশ লোকই বড় নীচ শ্রেণির। নিজের চোখে না দেখিলে কিছুই বিশ্বাস নাই।

সূর্য নিশ্চয়ই আমাকে ভুল বুঝিয়াছে। সেই কারণেই আমার সহিত দেখা করিতে কিছুতেই সম্মত হইতেছে না। সে ভাবিতেছে আমি তাহাকে অন্যায় অনুরোধ করি। সে তাহার দলের লোকদের চোখে হেয় প্রতিপন্ন হইবে।

যে যাহাই বলুক, বাপ হইয়া আমি ছেলের এই অনশনের ব্যাপার কী করিয়া সমর্থন করিতে পারি? নয় দিন সে না খাইয়া আছে। একেই তো জেলখানায় পশুর খাদ্য দেয়। তাহার পর, দিনের পর দিন উপবাসে থাকিলে শরীর যে ভাঙিবে–সে ভাঙা কি আর কোনও দিন জোড়া লাগে? বিপ্লবীরাও মহাত্মা গান্ধীর অনুসৃত পথে অনশনকে একটি অস্ত্র করিতে চায়। লাহোরে যেবার রাজবন্দিরা দীর্ঘকাল ধরিয়া অনশন করিয়াছিল– সেবার সারা দেশে কী বিপুল উত্তেজনা। কার্য উপলক্ষে আমাকেও তখন লাহোরে যাইতে হইয়াছিল। তেষট্টি দিন অনশনের পর যতীন দাস প্রাণত্যাগ করিল, তবু পণত্যাগ করিল না। কলিকাতার যুবক যতীন দাস প্রাণ হারাইল লাহোরে–আমি তাহার মৃতদেহ এক ঝলকের জন্য দেখিয়া ছিলাম। মানুষ বলিয়া চেনাই যায় না। বার বার সেই দৃশ্যটি মনে পড়িতেছে আর সূর্যর কথা ভাবিয়া বুক কাঁপিতেছে। যতীন দাসের পিতামাতার মনের অবস্থা কী রূপ হইয়াছিল–তাহা কেহ কল্পনাও করিতে পারিবে কি? মহাত্মা গান্ধীকে একটি টেলিগ্রাম পাঠাইয়াছি–এই অনশনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিবার জন্য। কাগজে এখনও তাহার কোনও বিবৃতি দেখি নাই। গতকল্য ছোটলাটকেও একটি টেলিগ্রাম পাঠাইলাম।

কী করিয়া উহারা দিনের-পর-দিন না খাইয়া থাকিতে পারে? এত মনের জোর কোথা হইতে আসে? সূর্যর অনশনের সংবাদ পাইয়া আমিও খাওয়াদাওয়া পরিত্যাগ করিয়াছিলাম। দুই দিন পরই আমার মাথা ঘুরিতে লাগিল, সব সময় বমি বমি ভাব, পায়ে জোর পাই না। আর দুই-চারি দিন এই ভাবে থাকিলে আমি আর বাঁচিতাম না। আমি এখন মরিলে সূর্যর কী হইবে তাহা জানিয়া যাইতে পারিব না।

কংগ্রেসি সত্যাগ্রহী ছাড়া আর কাহাকেও রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদা দেয় নাই। সূর্য এবং তাহার মতন অনেককে আন্ডার ট্রায়াল সি ক্লাস প্রিজনার করিয়া রাখিয়াছে। দস্যু, প্রতারক ও নারী নির্যাতনকারীদের সমপর্যায়ভূক্ত। টুকরা টুকরা যাহা খবর শুনিতে পাই–তাহাতেই বুঝিতে পারি যে অকথ্য অত্যাচার হয় উহাদের উপর। খাওয়ার জন্য সরকারের যাহা সামান্য বরাদ্দ আছে, তাহার সিকিভাগও উহাদের ভাগ্যে জোটে না। রাত্রি বারোটার সময় ঘরের বাহিরে আসিয়া হাঁটু গাড়িয়া বসিতে হয়–সেই সময় একবার সংখ্যা গণনা হয়। ইহার মধ্যেই দুই বার জেলের মধ্যে বিশৃঙ্খলার অজুহাতে লাঠি চার্জ করিয়া কয়েদিদের উত্তম মধ্যম দিয়াছে। কয়েক জনের নাকি হাত-পা ভাঙিয়াছে। তদন্ত কমিশন বসিবে তো শুনিতেছি। বেয়াল্লিশের দাঙ্গায় সরকারের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হইয়াছে–তাই ইহাদের প্রতি সরকার কোনও দয়ামায়া দেখাইতে রাজি নয়। বাধ্য হইয়াই উহারা অনশনে নামিয়াছে।

কিন্তু কে যে ইহাদের অভাব অভিযোগের প্রতিকার করিবে, তাহাও তো বুঝিয়া উঠিতে পারি না। কংগ্রেস ইহাদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করিয়াছে এবং প্রকাশ্যে ইহাদের সম্পর্কে বিরক্তি প্রকাশ করিতেছে। বাংলায় এখন মুসলিম লিগ সরকার– তাহাদের কোনও মাথাব্যথা নাই স্বদেশি যুবকদের জন্য। অনশন ভঙ্গ করাইবার জন্য জোর জুলুমের আশ্রয় লইতেছে। মাটিতে শোওয়াইয়া জোর করিয়া চাপিয়া ধরিয়া মুখে খাদ্যদ্রব্য ঢুকাইতে চায়। নাকের মধ্যে নল ভরিয়া দেয়। জলের কলসেও জল না রাখিয়া ঘোল কিংবা দুধ রাখিয়া দেয়–নিদারুণ জল তৃষ্ণা পাইলেও অনশনকারীরা জল পান করিতে পারে না। নিজেরাই সব কলস ভাঙিয়া ফেলিতেছে–এসব ভাবিতে গেলেও বুক কাপে।

বিচার কবে শেষ হইবে, তাহাও জানি না। হাজার বন্দিতে কারাকক্ষগুলি ভরতি– ইহাদের বিচার পর্ব নমো নমো করিয়া শেষ করিতেও দীর্ঘ দিন লাগিয়া যাইবে। আবার শুনিতেছি, ইহাদের অন্য কোনও জেলে স্থানান্তরিত করিবে। সেই স্থানটি যে কোথায় সে সংবাদ এখনও সংগ্রহ করিতে পারি নাই। সূর্যকে যে-দিন আদালতে আনে, সে-দিন একটি অদ্ভুত কথা শুনিয়া ছিলাম। দলীয় কার্যের সময় ইহাদের প্রত্যেকেরই কয়েকটি ছদ্মনাম থাকে। সূর্যর নাম বলিয়াছিল, সূর্যকুমার ভাদুড়ী অ্যালিয়াস অমর অ্যালিয়াস কুইক সিলভার। যখন ঘোষিত হইল যে উহার বাবার নামও অমর, তখন আদালতে একদল লোক উচ্চহাস্য করিয়াছিল। বাবার নামটিই ছেলে নিজের ছদ্মনাম লইয়াছে। আমিও একটু অবাক হইয়া ছিলাম। ছেলের মনের গতি যে কোন দিকে, তাহা বুঝিতে পারি না। অবশ্য বিলাতে অনেক সময় পিতা ও পুত্রের একই নাম হয়–সিনিয়র জুনিয়র হিসাবে পরিচিত থাকে।

জেলার সুরথ চক্রবর্তীর কোন কথাটা সত্য, কোন কথাটা মিথ্যা-তাহা কিছুই বুঝিতে পারি না। সূর্য সম্পর্কে সে আমাকে প্রায়ই অকথা কুকথা শুনায়। সূর্যকে সে ক্রিমিনাল মাইন্ডেড প্রতিপন্ন না করিয়া ছাড়িবে না। সূর্য নাকি কাহারও সহিত কখনও ভালো ভাবে কথা বলে না। ইহার মধ্যেই তাহাকে তিনবার ডান্ডা বেড়ি পরাইয়া সেলে রাখিয়াছে। সেল কাহাকে বলে, জানি না। সুরথ চক্রবর্তীর একটি দশ-এগারো বছরের পুত্র আছে, ভারী সুন্দর চেহারা। ছেলেটি মধ্যে মধ্যে তাহার বাবার কাছে আসিয়া দাঁড়ায়। সুরথ চক্রবর্তী তাহার ছেলেকে আদর করিতে করিতেই আমার সম্মুখে সূর্যর নামে গালাগালি করে। সে নিজে পিতা হইয়া অপর একজন পিতার হৃদয়ে আঘাত দিতে দ্বিধা করে না। মানুষ কত প্রকার হয়! সে এক বারও ভাবে না যে সূর্য অনেক আরামে বিলাসবহুল জীবন যাপন করিতে পারিত–এত কষ্ট যে সে স্বীকার করিতেছে, প্রাণের মায়াও তুচ্ছ করিয়াছে তাহা শুধু এই দেশকে শৃঙ্খলমুক্ত করিবার জন্য। যে-দেশ আমার এবং সুরথ চক্রবর্তীরও। এক এক বার মনে হয়, গত বছরের হাঙ্গামায় আমিও কেন নিজে জড়াইয়া পড়িলাম না! তাহা হইলে হয়তো জেলখানায় সূর্যর সহিত একসঙ্গে থাকিতে পারিতাম। সে যে কষ্ট ভোগ করিতেছে, তাহা কি আমারও প্রাপ্য ছিল না?

মধ্যে কিছুদিন এক সি আই ডি’র পাল্লায় পড়িয়া ছিলাম। সে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত করিয়া ছাড়িয়াছিল। সূর্যর সহচরবৃন্দ এবং দলের লোকদের সম্পর্কে খবরাখবর জানাই ছিল তাহার উদ্দেশ্য। আমি তো সত্যই কিছু জানি না। বলিব কী করিয়া। সূর্য সম্পর্কে কোনও প্রকার কলঙ্ক দিতেই সে বাকি রাখে নাই। দেশ সেবার জন্য নয়, দুশ্চরিত্রতা এবং গুন্ডামির প্রবৃত্তিবশেই নাকি সূর্য এইসব কার্য করিয়াছে। সি আই ডি-টি বলিল, সূর্য নাকি। কোন গ্রামের এক চাষির কন্যাকে এবং পরে একজন সহকর্মীর স্ত্রীকে বলাৎকার করিয়াছে এবং ডাকাতির টাকায় ফুর্তি করিয়াছে। এইরূপ জঘন্য মিথ্যাও মানুষের মুখে আসে। এই বৃদ্ধ বয়সেও শরীর ক্রোধে জ্বলিয়া ওঠে ইচ্ছা হয় লোকটির মাথা দেওয়ালে ঠুকিয়া ভাঙিয়া দিই।

আমি বেশি দুর্বল হইয়া পড়িতেছি। এত দুর্বলতায় কোনও দিকেই লাভ নাই। আমার তো একার ছেলে নয়–আরও কত বাপ-মায়ের স্নেহের দুলাল জেল খাঁটিতেছে, ফাঁসির দড়ি গলায় দিয়াছে। আমি এতটা উতলা হইব কেন? কিংবা অন্য পিতা-মাতাদের মনের অবস্থাও এরূপ হয়? একটা বয়স আসিলে সন্তানের সঙ্গে স্নেহের বন্ধন একটু একটু আলগা করিয়া দিতে হয়। নহিলে দুঃখের বোঝা বাড়ে। সন্তান দূরে চলিয়া যাইবেই। সূর্য সম্পর্কে আমার যে এতখানি মায়ার বন্ধন ছিল–নিজেও কখনও জানিতে পারি নাই। বাল্যকাল হইতেই তাহাকে বোর্ডিংয়ে রাখিয়াছি, নিজে আপন খেয়ালে ঘুরিয়াছি। সূর্যর জন্য ব্যারিস্টার নিয়োগ করিয়াই যদি কর্তব্য সম্পন্ন করিতে পারিতাম! কিন্তু রাত্তিরে ঘুমাইতে পারি না। বার বার মনে পড়ে, সারা পৃথিবীতে সূর্য ছাড়া আমার আর কেহ নাই। আমার কেহ নাই! নিজের পিতাকে দেখি নাই, মাতাকে জন্মের দিনে হারাইয়াছি, পত্মীদ্বয় অকালে আমাকে ছাড়িয়া গিয়াছে, বড় মা-ও নাই, একে একে সকলে ছাড়িয়া গিয়াছেন। আর যে কয়দিন বাঁচিব, কাহাকে লইয়া বাঁচিব? আমি ছাড়া এ পৃথিবীতে সূর্যরও আর কেহই প্রকৃত আপনজন নাই। কিন্তু তাহার বয়স অল্প, যদি জেলখানা হইতে বাহির হইতে পারে সে একা হইয়াও রক্তের তেজে বাঁচিতে পারে। কিন্তু আমি? সি আই ডি-টি আভাস দিয়াছিল, সূর্যর ফাঁসির দণ্ড হওয়াই অবধারিত–যদি তা নাও হয়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হইবেই। এ-জীবনে সে কিছুই পাইল না।

সূর্য এত জেদি হইল কী করিয়া? আমার চরিত্র তো সে পায় নাই। যুবা বয়সে আমিও কম জেদি ছিলাম না কিন্তু লোকজনের সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া থাকিবার ক্ষমতা আমার ছিল। ব্যবসায়ের সূত্রে নানা লোকের সংস্পর্শে আসিতে হইয়াছে–অনেক ক্ষেত্রে আমাকে বাধ্য হইয়া মত পরিবর্তন করিতে হইয়াছে। না, ভালো করিয়া ভাবিয়া দেখিতে গেলে সূর্যর মায়ের সঙ্গেই তাহার একটা অন্তর্নিহিত মিল আছে। বুলবুল বাহিরে হাসিখুশি ও ছেলেমানুষিতে ভরা থাকিলেও কী অসম্ভব ছিল যে তাহার জেদ–তাহা আমিই শুধু জানি। তাহার ক্রোধ কিংবা অভিমান এত তীব্র ছিল যে বাহিরের কাহাকেও সে বুঝিতে দিত না। আমার উপর কতখানি অভিমান তাহার জন্মাইয়াছিল যে তাহার পরেও সে পূর্ণিমার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলিয়াছে এবং বিষ খাইয়া মরিয়াছে। বুলবুল, বুলবুল, তুমি কি আমাকে ক্ষমা করিতে পারিতে না? নারীচরিত্র আমি বুঝি না, আমি তোমাকেও বুঝিতে পারি নাই। সেই অপরাধে আমাকে এত গুরুতর শাস্তি দান করিলে?

মনে হইতেছে যেন বুলবুল আমার চোখের সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। এতগুলি বছর কাটিয়া গেল, তবু তাহার মুখচ্ছবি এতটুকু মলিন হয় নাই। স্মৃতিপটে সে চিরযুবতী থাকিয়া যাইবে।

বুলবুলের সহিত আমার সম্পর্কের কথা এখন আর বিশেষ কেহ জানে না। জানিলেও কেহ সে-প্রসঙ্গ তোলে না। লোকচক্ষে উহা শুধু আমার জীবনের একটি কলঙ্কজনক। অধ্যায়। আমি কখনও সেরূপ মনে করি নাই। বুলবুলকে ভালো বাসিয়াছিলাম বলিয়া আমি কখনও অনুতাপ করিব না। নিজের স্ত্রীকে সাময়িক কষ্ট দিয়াছি বটে কিন্তু বুলবুলকে ভালো না বাসিয়া আমার উপায় ছিল না। এক এক জন মানুষের জীবনে ধ্রুবতারার মতন একটি নারী আসে। বুলবুল আমার সেই ধ্রুবতারা। বুলবুলকে বলিয়াছিলাম, তোমার হাতের মুঠোয় আমার ভবিষ্যৎ তুলিয়া লও। শুধু রূপমুগ্ধ হইয়া এই কথা বলি নাই–সে আমার হৃদয়সর্বস্ব ছিল। তবু আমার পথ ভুল হইল। বুলবুল, তুমি আমাকে আর একবার সুযোগ দিলে না কেন? নিজে মরিয়া এ কী নির্মম প্রতিশোধ লইলে? সারা জীবন আমি অপরাধী হইয়া রহিলাম। তোমার সন্তান–আমি তাহার জন্য কিছুই করি নাই। জানি না স্বর্গ কিংবা বেহেস্ত বলিয়া কিছু আছে কিনা–তুমি কি সেথা

হইতে সব দেখিতেছ?

বড়বাবুর হাত থেকে কলম পড়ে গেল। তিনি খাতা বন্ধ করে গুম হয়ে বসে রইলেন।

বড়বাবুর সঙ্গে সূর্যর আর একবার দেখা হল রেল স্টেশনে। সাত জন কয়েদিকে এই জেল থেকে অন্য কোথাও সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। খবর পেয়ে বড়বাবু আগে থেকেই রেল স্টেশনে এসে বসেছিলেন।

মাত্র সাত জন কয়েদিকে নিয়ে যাবার জন্য প্রায় দু’ডজন সেপাই ঘিরে আছে। কয়েদিদের প্রত্যেকের হাতে হাতকড়া এবং কোমরে দড়ি বাঁধা। এদের দেখবার জন্য। স্টেশন কয়েক মুহূর্তেই মানুষের ভিড়ে ছয়লাপ হয়ে গেল। সেপাইরা হঠ যাও হঠ যাও বলে চাঁচালেও লোকে কাছাকাছি গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে, ওদের নানা রকম প্রশ্ন করছে। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছে, দাদা আপনাদের নাম কী? জয়প্রকাশ নারায়ণ কি সত্যিই ধরা পড়েছেন? জেলে আপনাদের কী খেতে দেয়? কেউ কেউ আর একটু দুঃসাহসী হয়ে বলছে, দাদা, আপনাদের কারওর বাড়িতে কোনও খবর দেওয়ার থাকলে চেঁচিয়ে বলে। দিন। আমরা খবর পৌঁছে দেব।

অত ভিড় ঠেলে বড়বাবু কাছে যেতে পারবেন না। তিনি অন্য একটি উপায় বার করলেন। কয়েদিদের যখন ওভারব্রিজে ভোলা হল, বড়বাবু দ্রুত লাইনের ওপর দিয়ে

অন্যদিকে গিয়ে ওভার ব্রিজের উলটো দিক থেকে আসতে লাগলেন।

ওই সাতজনের মধ্যে একজন ছাড়া নাকি সবারই বয়স আঠারো থেকে পঁচিশের মধ্যে। বাকি লোকটির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। কেউ কোনও কথা বলছে না। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চুল রুক্ষ, চোখ জ্বলজ্বলে। এদের মধ্যে দু’জনের হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা।

সূর্যর ঠিক মুখোমুখি এসে বড়বাবু কোনও কথা বলতে পারলেন না। শব্দ আটকে গেল। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে।

সূর্য মুখ তুলে বাবাকে দেখে শান্ত ভাবে বলল, বাবা, আমি ভালো আছি। আপনি কোনও চিন্তা করবেন না।

বড়বাবু ভালো করে নিশ্বাস নিয়ে বললেন, তুই, তোরা কোথায় যাচ্ছিস?

সে কথা আমাদের বলেনি।

তোর হাত…ব্যান্ডেজ…কী হয়েছে?

বিশেষ কিছু না। সামান্য মচকে গেছে–দু-এক দিনেই ঠিক হয়ে যাবে।

সেপাইরা পেছন থেকে গুঁতো দিচ্ছে। সূর্য আবার চলতে লাগল। বড়বাবুও তার পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, তোরা কোনও কিছু স্বীকার করবি না–আমি আরও বড় ব্যারিস্টার লাগাব–

সূর্য মুখ নিচু করে জানাল, আপনি ও-সব কথা নিয়ে বেশি চিন্তা করবেন না।

একজন আই বি’র লোক বড়বাবুর পাশে এসে বলল, এদের সঙ্গে কথা বলা তো বেআইনি। আপনি কি এদের কারওর আত্মীয় হন।

আমি এর বাবা।

তা হলে প্রপার চ্যানেলে অ্যাপ্লাই করুন ইন্টারভিউর জন্য।

বড়বাবু রেগে গিয়ে বললেন, আমাকে আর প্রপার চ্যানেল দেখাবেন না মশাই। ও আমার ঢের জানা আছে।

এখন এখান থেকে সরে যান!

ওভার ব্রিজ দিয়ে হাঁটাও কি বেআইনি?

কথা না বলে বড়বাবু সূর্যর সঙ্গে এলেন কিছু দূরে। হঠাৎ তার দারুণ ইচ্ছে হল ছেলের শরীরটা একবার ছুঁতে। ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতেও হাতকড়ি পরিয়েছে–এদের শরীরে কি দয়ামায়া বলে কিছুই নেই।

সূর্য নিজে থেকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না, কারওর খোঁজখবরও জানতে চাইল না। মাঝে মাঝে সে শুধু বাবার চোখের দিকে তাকাচ্ছে। বড়বাবু আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না হাত বাড়িয়ে দিলেন সূর্যকে একবার ছোবার জন্য।

আই বি’র লোকটি এক ঝটকায় বড়বাবুর হাত সরিয়ে দিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, কী হচ্ছে কী? এ রকম অপমানজনক পরিস্থিতি বড়বাবুর জীবনে কখনও আসেনি। তিনি অপ্রতিভ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সেইখান থেকেই যতক্ষণ দেখা যায়, দেখতে লাগলেন সূর্যকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *