আটচল্লিশ
বেলগাছিয়ার ট্রাম ডিপোর কাছে পৌঁছেই অর্ক বুঝতে পারল হাওয়া খারাপ। মোড়ের দোকানপাট বন্ধ। ঈশ্বরপুকুর লেন অন্ধকারে ঢাকা। চারপাশে একটা থমথমে ভাব। শুধু জনা পাঁচেক মানুষ ফুটপাথের একপাশে জড় হয়ে মৃদু গলায় কথা বলছে। লোকগুলোর চেহারা দেখেই বোঝা যায় সারাদিন খেটেখুটে বাড়ি ফিরছে। ঝামেলার মুখোমুখি হয়ে বিপর্যস্ত। এরা এখন ঘরে ঢুকে পেটে কিছু দিয়ে শুয়ে পড়তে পারলে বেঁচে যায়। কিন্তু গলিতে পা দেওয়ার সামর্থ্য কারো নেই। খাঁচায় পোরা জন্তুর মত শুধু পিটপিটিয়ে তাকাচ্ছে।
ঠিক সেইসময় যেন দেওয়ালি শুরু হয়ে গেল, ঈশ্বরপুকুর লেনে বোম পড়ছে। একটার শব্দ না মেলাতেই আর একটা। সঙ্গে সঙ্গে ফুটপাথের লোকগুলো সরে গেল খানিকটা তফাতে। অর্ক ভেবে পাচ্ছিল না আজকের গোলমালটা কি নিয়ে। খুরকি কিলা চলে যাওয়ার পর ঈশ্বরপুকুরে মাস্তান বলতে একমাত্র কোয়া। তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের কথা সেদিন কোয়া বলছিল বটে কিন্তু তারা তো ঠিক মাস্তান নয়। অর্ক অন্ধকার গলিটার দিকে তাকাল। ওখানে ঢুকলে অজান্তেই আক্রান্ত হতে হবে। যারা ছুঁড়ছে তারাও জানবে না কাকে ছুঁড়ল। খোঁজ নেওয়া দরকার। এইসময় অর্ক রিকশাঅলাটাকে দেখতে পেল। জ্ঞান হওয়া ইস্তক একে ঈশ্বরপুকুরে রিকশা চালাতে দেখেছে। বুড়ো লোকটা রিকশা তুলে দিয়ে একটা বন্ধ দোকানের খাঁজে উবু হয়ে বসেছিল। দ্রুত পা চালিয়ে তার কাছে পৌঁছতেই লোকটা ভীতুচোখে তাকাল। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে ভেতরে?’
‘ঈশ্বরপুকুরকে শ্মশান করে দেবে বলেছে ওরা।’
‘কারা?’
লোকটা অর্কর মুখের দিকে তাকিয়ে নীরব হল। অর্ক আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কারা?’
‘কয়লা।’
চমকে উঠল অর্ক। কয়লা নিজেকে বলে শেরকে শো। তার আধিপত্য রেললাইন এলাকায়। সমস্ত ওয়াগন ব্রেকার ওর চামচে। সাধারণত কোন পাড়ার দখল নেবার চেষ্টা করেনি কয়লা। দুটো রিভলভার কোমরে গুঁজে হাঁটে কয়লা। সঙ্গে বডি গার্ডও থাকে। প্রচণ্ড ক্ষমতাবান মাস্তান কয়লা। ওপর মহলেও খুব খাতির আছে। কিন্তু এই লোকটিকে কখনও চোখে দ্যাখেনি অর্ক। নানারকম গল্প শুনেছে। ঈশ্বরপুকুর লেন কয়লার আওতায় নয় যদিও রেললাইন খুব কাছে। তবে এটুকু জানে খুরকির সঙ্গে ওয়াগনের ব্যাপারে কয়লার যোগাযোগ ছিল। সেই সুবাদেই খুরকির রোয়াবি বেড়ে গিয়েছিল অত। সেই কয়লা ঈশ্বরপুকুরে এসেছে শ্মশান করতে। কেন? অর্ক রিকশাঅলাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কতজন আছে ওরা।’
‘অনেক। একটা গাড়িও আছে।’
এইসময় গলির মধ্যে হৈ হৈ উঠল। রিকশাঅলাটা দোকানের খাঁজে যেন আরো সেঁধিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বসে পড়ো।’ অর্ক দেখল যে লোকগুলো গলিতে ঢুকবে বলে দাঁড়িয়েছিল তারা দৌড়ে যাচ্ছে পাকপাড়ার দিকে। নিশ্চয়ই কয়লারা ফিরে আসছে এবং এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক কাজ হবে না। অর্ক চট করে দোকানের পেছনে চলে এল। এবং তখনই ঈশ্বরপুকুর থেকে বেরিয়ে এল জনা বারো ছেলে। দু’তিনজনের হাতে খোলা সোর্ড, পেটোর ঝোলা, দুটো রিভলভারও চোখে পড়ল। উত্তেজিত ছেলেগুলো মুখে বিকট শব্দ করতে করতে রেললাইনের দিকে চলে যাওয়ার পর অর্ক আবার সামনে ফিরে এল। চিৎকার মিলিয়ে যাওয়ার পর নিস্তব্ধ হয়ে গেছে চারধার। যে ঈশ্বর পুকুর রাত দুটোর আগে ঘুমোয় না দশটায় তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু ছুটে যাওয়া দলটার মধ্যে কয়লাকে আলাদা করতে পারেনি অর্ক। সে রিকশাঅলাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কয়লা কোনটা?’
রিকশাঅলা দমবন্ধ করে পড়ে ছিল। এবার যেন খানিকটা সাহস পেল, ‘কেউ না।’
‘কেউ না মানে?’ অর্ক অবাক হল, ‘এই তো বললে কয়লা এসেছে।’
‘এসেছে কিন্তু যায়নি। কয়লা খোলা গাড়িতে করে গিয়েছিল। গাড়িটা তো আসেনি।’
অর্ক মাথা নাড়ল। সত্যি তো, কোন গাড়ি তো দলটার সঙ্গে বেরিয়ে আসেনি। কিন্তু দল চলে গেলে কয়লা একা থাকবে ঈশ্বরপুকুরে? এত সাহস? অর্ক দেখল বেশ দূরে সেই লোকগুলো আবার ফিরে এসে উঁকি দিচ্ছে এদিকে। সে হাত উঁচু করে তাদের ডাকলো। লোকগুলো যেন তাকেই সন্দেহের চোখে দেখছে। সে এবার গলা তুলে চেঁচাল, ‘কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকবেন? চলে আসুন, একসঙ্গে পাড়ায় ঢোকা যাক।’
এ সত্ত্বেও কোন প্রতিক্রিয়া হল বলে অর্কর মনে হল না। এক পা এগোনো দূরের কথা কেউ কোন শব্দ পর্যন্ত করছে না। অর্ক বুঝতে পারছিল বেশ কিছু মানুষ একসঙ্গে গেলে খানিকটা সুবিধে হবে। সে নির্জন রাস্তায় এগিয়ে গেল। লোকগুলো ওকে পুরোপুরি সন্দেহ করছে না কারণ সে যখন প্রথম এল কেউ কেউ তাকে দেখেছে। কাছাকাছি হয়ে অর্ক বলল, ‘চলুন, আমরা একসঙ্গে যাই।’
ইতস্তত করে একজন বলল, ‘না ভাই, আমরা পাবলিক। ঝামেলার মধ্যে আমরা নেই।’
‘ওরা সবাই চলে গেছে। এখন আর ঝামেলা নেই। আমি তিন নম্বরে থাকি। আমাকে আপনাদের কেউ চেনেন?’ অর্কর প্রশ্নের উত্তরে দুজন মাথা নাড়ল। একজন আর একজনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘যাবেন?’ দ্বিতীয়জন উত্তর দিল, ‘ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি ভাই, মরে গেলে ওরা সবাই পথে বসবে। তার চেয়ে গলিটা স্বাভাবিক হোক তখন না হয় ধীরেসুস্থে যাওয়া যাবে, কি বলেন?’
কথাটা প্রত্যেকের বেশ মনের মত বুঝতে পেরে অর্ক বলল, ‘কিন্তু ওরা পাড়ায় হামলা করেছে। সেটা তো আপনার বাড়িতেও হতে পারে। তাছাড়া যে কোন মুহূর্তে ওরা ফিরে আসতে পারে। তখন বাঁচতে পারবেন? তার চেয়ে নিজের পাড়ায় যাওয়াটা তো নিরাপদ। আমরা অনেকে একসঙ্গে গেলে কেউ ঝামেলা করতে সাহস পাবে না।’ অর্ক কথাগুলো বলে বুঝল এটা খুব কাজের হল না। এইসময় একটা গাড়ির আওয়াজ হতেই লোকগুলো দৌড় শুরু করল। অর্ক লক্ষ্য করল, গাড়িটা গলি থেকে নয় উল্টোদিক থেকে আসছে। ওটা যে পুলিসের ভ্যান সেটা বুঝে অর্ক রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াল। ছুটন্ত লোকগুলো দেখে ভ্যানটা মুখ ঘুরিয়ে তাদের দিকে ধাওয়া করল। লোকগুলো প্রাণভয়ে ছুটছে। ফাঁকা রাস্তায় দৃশ্যটা সিনেমার মত দেখতে পাচ্ছিল অর্ক। ভ্যান থেকে লাফিয়ে নামল জনা আটেক পুলিস। লাঠি হাতে তারা ছুটে গেল লোকগুলোর দিকে। ওই দুর্বল নিরক্ত মানুষগুলোকে ধরতে সামান্য সময় লাগল না। একই সঙ্গে হাঁউমাউ শব্দ আর চিৎকার শুনল অর্ক। ‘আমাদের ধরছেন কেন? আমরা কিছু করিনি। আমরা পাবলিক।’
একটা পুলিস বাজখাঁই গলায় চেঁচালো, ‘শালা পাবলিকের—করি।’ অশ্লীল শব্দটা রাত্রের নিস্তব্ধতা ভেঙে থিকথিক করতে লাগল। লোকগুলোকে টেনে হিঁচড়ে ভ্যানে তোলা হয়ে যাওয়ার পর সেটা আবার ফিরে গেল। অর্ক অবাক হতে গিয়ে হেসে ফেলল। যাচ্চলে! ওরা কাদের ধরে নিয়ে গেল? লোকগুলোর অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছিল তার। পাবলিক কেন ঝামেলায় থাকবে? ভালই হল, রাতটায় ওদের কোন ঝুঁকির মধ্যে যেতে হচ্ছে না। অবশ্য পুলিসরা যদি না প্যাঁদায়।
আবার চারধার চুপচাপ। হঠাৎ অর্কর মনে হল সে নিজে কি করছে? গলিতে ঢোকার সাহস না থাকায় সে কতগুলো ভীতু মানুষকে নিয়ে দল গড়তে চেয়েছিল। বিপদ এলে সেটা অন্যদের মধ্যে ভাগ করে দেবার কৌশল করেছিল। তার মানে, নিজের পাড়ার চেনা চৌহদ্দির মধ্যে পা বাড়ানোর ক্ষমতা তার লোপ পেয়েছে। অর্ক মাথা নাড়ল। তারপর একরোখা ভঙ্গীতে হাঁটতে লাগল ঈশ্বর পুকুরের দিকে। গলির মুখে দাঁড়িয়ে সে অন্ধকারে সামান্য আলো দেখতে পেল না। গলিতে ঢুকে সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। এবং তাতেই অন্ধকার ক্রমশ হালকা হয়ে গেল চোখের সামনে। গলিতে এখনও বারুদের গন্ধ আছে। অর্ক সতর্ক হয়ে হাঁটছিল রাস্তার ধার ঘেঁষে। অন্যদিন এইসময় ধার ঘেঁষে প্রচুর লোক পড়ে থাকে, আজ কেউ নেই। নিঃশব্দে সে হেঁটে এল তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুরের সামনে। এবং তখনই সে মানুষের অস্তিত্ব টের পেল। তিন নম্বরের সবক’টা দোকানপাট বন্ধ। নিমুর চায়ের দোকানের সামনে ছোটখাটো ভিড়। কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। এবং এখানেই বারুদের গন্ধ বেশি।
অর্ককে আসতে দেখে ভিড়টা পাতলা হতে হতে আবার রয়ে গেল। ভিড়টার দিকে এগিয়ে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল অর্ক। গলির মুখে চিৎ হয়ে পড়ে আছে মোক্ষবুড়ি। দুটো হাত মুঠো করে দুপাশে লোটানো! ময়লা কাপড়ের স্তূপ রক্তাক্ত। আধো অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে ওর মুখের কিছুটা অংশ উড়ে গেছে। কঙ্কালের মত শরীরটা এলিয়ে আছে মাটিতে। ভিড়টা ওকে ঘিরেই।
কোন প্রশ্ন করার দরকার হল না। মোক্ষবুড়ির প্রাণহীন শরীরটার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল অর্ক। কিন্তু ভিড়টা বাড়ছে অথচ কোন কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মোক্ষবুড়ির জন্যে কেউ কাঁদবার নেই। অর্ককে দেখে ন্যাড়া কাছে এল, ‘মোক্ষবুড়ি ভোগে চলে গেল।’ হাসল ন্যাড়া, ‘কোয়াদা খুব জোর বেঁচে গিয়েছে।’
‘কি হয়েছিল?’ অর্ক শীতল গলায় জিজ্ঞাসা করল।
‘তুমি জানো না?’
‘না। আমি এইমাত্র এসেছি।’
‘বিলুদাকে খুঁজতে এসেছিল কয়লা। না পেয়ে পাড়া জ্বালিয়ে দেবে বলেছিল। কোয়াদা তখন মাল খেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে কয়লার একটা ছেলেকে খিস্তি করতে সে পেটো ছুঁড়েছিল। কোয়াদার গায়ে লাগেনি কিন্তু মোক্ষবুড়ি ভোগে গেল।’ ন্যাড়া আবার হাসল।
‘কোয়া কোথায়?’
‘হাওয়া হয়ে গিয়েছে।’ তিন নম্বরের পেছনের দিকটায় ইঙ্গিত করল ন্যাড়া।
‘বিলুকে খুঁজছিল কেন ওরা?’
‘বিলুদা নাকি দারোগাবাবু হয়েছে।’
‘দারোগাবাবু?’
‘হাঁস ডিম দেয় আর দারোগাবাবু সেই ডিম খায়।’ তারপর নিচু গলায় বলল, ‘কয়লা এখনও পাড়ায় আছে।’
’কোথায়?’
‘নুকু ঘোষের বাড়িতে। বডি গার্ড নিয়ে। ওর চামচেরা চলে গিয়েছে।’
এইসময় দুটো হেডলাইট ঈশ্বরপুকুরকে আলোকিত করল। ইঞ্জিনের শব্দ হওয়ামাত্র মানুষগুলো গলির মধ্যে পিলপিল করে ঢুকে যাচ্ছিল। অর্কর হাত ধরে টানল ন্যাড়া, ‘কেটে পড়, পুলিস আসছে।’
‘কি করে বুঝলি?’ জিজ্ঞাসা করতেই পুলিসের ভ্যানটা এসে দাঁড়াল তিন নম্বরের সামনে। টপাটপ লাফিয়ে নামল কিছু পুলিস লাঠি এবং বন্দুক হাতে। দুজন অফিসার খোলা রিভলভার নিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘কি হয়েছে এখানে? কেউ পালাবেন না, বলুন, কি হয়েছে?’
এবার তিন নম্বরের লোকগুলো থিতিয়ে গেল। তারপর একটু একটু সাহসী হয়ে এগিয়ে এল তারা। হাঁউমাউ করে সকলে মিলে কয়লার অত্যাচারের কথা বলতে লাগল। সেটা স্পষ্ট না হওয়ায় কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। জনতা আঙ্গুল দিয়ে মোক্ষবুড়ির মৃতদেহ দেখাচ্ছিল পুলিসদের। একজন অফিসার টর্চের আলো ফেলল মোক্ষবুড়ির ওপর, ‘এটা কে?’
জনতা চেঁচালো একসঙ্গে, ‘মোক্ষবুড়ি।’
‘এ কি করে ইনভলভড হল? বুড়ি মেয়েছেলেরাও অ্যাকশন করে নাকি?’
‘ও এখানে বসেছিল স্যার, কোয়াকে যে পেটো ছুঁড়েছিল সেটা ওর গায়ে লেগেছে।’
‘আই সি! হোয়ার ইজ কোয়া! তাকে আমার চাই। বলুন, বলুন কোথায় কোয়া?’
‘জানি না স্যার। কোয়া পালিয়ে গেছে।’
অফিসার জনতার দিকে তাকালেন তারপর দুজন কনস্টেবলকে বললেন মোক্ষবুড়ির শরীরটাকে ভ্যানে তুলে নিতে। এইসময় ঈশ্বরপুকুরের আলো জ্বলে উঠল। অর্ক দেখল উল্টোদিকের দোতলা বাড়িগুলোর জানলা ঈষৎ ফাঁক করে ভদ্রলোকেরা এই দৃশ্য দেখছেন নিজেদের অস্তিত্ব না জানিয়ে। অফিসারটি আবার রিভলভার উঁচিয়ে চিৎকার করলেন, ‘কোয়াকে আমাদের হাতে তুলে দিন। ওর জন্যেই এই বুড়ি মরেছে। নইলে এই বস্তির কাউকে আমি ছাড়ব না।’ জনতা নীরবে এই হুমকি শুনল। অর্ক বুঝতে পারছিল না কোয়ার কি দোষ, কেন তাকে পুলিস অফিসার চাইছে।
কিন্তু সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল অফিসারটির কাছে, ‘কোয়াকে কি দরকার?’
অফিসার অর্কর দিকে অবাক চোখে তাকালেন, ‘তুমি কে?’
‘আমি এখানে থাকি। কোয়া তো আজ কোন অন্যায় করেনি। যারা গুণ্ডামি করতে এসেছিল সে তাদের গালাগাল দিয়েছিল। ওরাই বোমা ছুঁড়েছে বলে মোক্ষবুড়ি মারা গিয়েছে। এতে কোয়ার অন্যায় কোথায়?’ সরাসরি প্রশ্ন করল অর্ক।
‘ন্যায় অন্যায়ের জ্ঞান তোমার কাছে নেব না। ওর নামে অনেক অ্যালিগেশন আছে।’
‘কিন্তু যারা অন্যায় করেছে তাদের আপনারা ধরছেন না কেন?’
‘কারা অন্যায় করেছে খোকা?’ ব্যঙ্গ ঝরল অফিসারের গলায়।
‘কয়লা দলবল নিয়ে পাড়া জ্বালাতে এসেছিল। ওরাই মোক্ষবুড়িকে খুন করেছে।’
‘কে কয়লা?’
অর্ক অবাক হয়ে গেল। পুলিস অফিসার কয়লার নাম শোনেনি? সে তাকিয়ে দেখল বস্তির সমস্ত মানুষ তার দিকে বেশ সম্ভ্রমের চোখে তাকিয়ে আছে। অর্কর উত্তেজনা বাড়ল, ‘কে কয়লা তা আপনি জানেন না?’
পুলিস অফিসার কাঁধ ঝাঁকালেন। তারপর হাতের রিভলভারটা নাচিয়ে বললেন, ‘এই ছোকরা, নিজের কাজ কর গিয়ে। যা, ভাগ্।’
অর্ক গলা তুলল, ‘চমৎকার। একঘণ্টা ধরে এখানে হামলা হল, মানুষ মরল আর আপনারা চুপ করে বসেছিলেন, আসার দরকার মনে করেননি। এখন যখন সব থেমে গিয়েছে তখন উল্টে চোখ রাঙাচ্ছেন। কোথায় ছিলেন আপনারা এতক্ষণ?’
‘মেরে বদনা পাল্টে দেব হারামজাদা। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? আমার কাজের কৈফিয়ৎ তোমাকে দেব বাঞ্চোত?’ তারপর জনতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি কোন কথা শুনতে চাই না। কোয়াকে আমার চাই।’
অফিসারকে ভ্যানের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে অর্ক কাছে গেল, ‘আপনি কয়লাকে অ্যারেস্ট করবেন না? সে এখানে এসে দলবল নিয়ে হামলা করে গেল সেটা দেখবেন না?’
‘কয়লা? কয়লা কোথায়?’
’ওদিকে, নুকু ঘোষের বাড়িতে।’
হঠাৎ মুখ চোখ পাল্টে গেল অফিসারের, ‘অ্যাই, তোর নাম কি রে?’
‘তোর বলছেন কেন? ভালভাবে কথা বলতে শেখেননি?’
এরকম প্রশ্ন যেন স্বপ্নেও ভাবেননি অফিসার। তাঁর হুঁশ ফেরার আগেই অর্ক জবাব দিল, ‘অর্ক মিত্র।’
‘নেতা হবার সাধ হয়েছে না? জন্মের মত সাধ ঘুচিয়ে দেব বদমাশ।’ এক লাফে যেন জায়গাটা অতিক্রম করতে চাইলেন অফিসার। বিপদ বুঝতে পারল অর্ক। কিন্তু একটা জেদ এবং ক্রোধ তাকে খাড়া দাঁড় করিয়ে রাখল। এইসময় একটি লোক ছুটে এল অফিসারের দিকে, ‘প্লিজ, ওকে মারবেন না। শান্ত হোন।’
অর্ক অবাক হয়ে দেখল সতীশদা অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে। অফিসার যেন সতীশদাকে চিনতে পারলেন, ‘ও আমাকে অপমান করেছে। এইটুকুনি ছেলে কিন্তু কি ব্যবহার? নো নো, আমাকে বাধা দেবেন না। সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়ার সময় আপনারা ইন্টারফেয়ার করবেন না। আই উইল টিচ হিম এ গুড লেশন।’
দুপাশে দু’হাত বাড়িয়ে সতীশদা বললেন, ‘আমি আপনাকে রিকোয়েস্ট করছি আপনি শান্ত হোন। ছেলেটি মোটেই সমাজবিরোধী নয়। তাছাড়া ও যেসব অভিযোগ করেছে সেগুলো সাধারণ মানুষের মনের কথা।’
‘আপনি এসব বোঝাবেন না সতীশবাবু। আমি ওকে অ্যারেস্ট করছি।’
‘অ্যারেস্ট করবেন? ওর অপরাধ?’
‘আমাকে অপমান করেছে, কর্তব্য করতে বাধা দিয়েছে।’
‘আপনি বাজে কথা বলছেন?’
‘আচ্ছা! নিশ্চয়ই আপনার স্বার্থ আছে! কিন্তু আমি আপনার সঙ্গে এত কথা বলছিই বা কেন? যদি প্রয়োজন মনে করেন থানায় আসবেন।’
সতীশদা একবার অর্কর দিকে তাকালেন। তারপর অফিসারকে নিচুগলায় বললেন, ‘ওকে অ্যারেস্ট করলে আপনার অসুবিধে হবে অফিসার।’
‘তার মানে?’
‘কিছুদিন আগে মিনিস্টার এসেছিলেন এখানে। ওর বাবা মিনিস্টারের বন্ধু। আমাকে খোঁজ খবর নিতে বলেছিলেন। আপনি গায়ের জোরে অ্যারেস্ট করলে আমি এখনি তা মিনিস্টারকে জানাবো।’ সতীশদাকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল।
সতীশদার চোখে চোখ রেখে অফিসার যেন কিছু পড়তে পারলেন, ‘কিন্তু ওকে সাবধান করে দেবেন। একজন সরকারী অফিসারের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা শেখা উচিত।’
কথা শেষ করেই অফিসার ভ্যানে ফিরে গেলেন। ওদের চোখের সামনে ভ্যানটা পিছু ফিরে মুখ পাল্টে ঈশ্বরপুকুর থেকে বেরিয়ে গেল।
এবার সতীশদা অর্কর দিকে তাকালেন, ‘তোমার সাহস আছে। কিন্তু সাহসী হলেই সবসময় কাজ হয় না। সময় এবং পরিস্থিতি বুঝে এগোতে হয়।’
এতক্ষণ অর্ক চুপচাপ সমস্ত ব্যাপারটা দেখছিল। সতীশদা যে অফিসারকে মন্ত্রীর ভয় দেখিয়ে থামালো সেটাও কান এড়ায়নি। তার মনে পড়ল আজ সন্ধ্যায় সে একজন সাধারণ পুলিসকে ডি সি নর্থের নাম করে ভয় পাইয়েছিল। সেটা যে এত দ্রুত তার ক্ষেত্রেও ফিরে আসবে—! সতীশদা কথা শেষ করতেই অর্ক বলল, ‘লোকটা বদমাশ।’
‘হতে পারে। কিন্তু ওইভাবে বলা ঠিক হয়নি।’
‘কেন?’
‘তোমাকে ও অ্যারেস্ট করতে পারত, প্রচণ্ড মারত। তুমি কিছুই করতে পারতে না।’
‘কিন্তু আপনি এসব সমর্থন করছেন? ওরা কোয়াকে বোমা মারতে গিয়ে মোক্ষবুড়িকে মেরে ফেলল। খুন করল ওরা আর পুলিস কোয়াকে ধরতে চাইছে। কোয়ার কি দোষ?’
সতীশদা মাথা নাড়লেন, ‘কিন্তু কোয়া তো ধোওয়া তুলসীপাতা নয়।’
‘তা হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে তো কোন অন্যায় করেনি। তাছাড়া কয়লারা ঈশ্বরপুকুরে ঢুকে একটা খুন করল, অত্যাচার করল, অনেক পরে পুলিস এসে আমাদের ছেলেকেই গ্রেপ্তার করতে চাইল অথচ আপনি কিছু বলছেন না!’ অর্ককে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। এবং এইসব কথাবার্তার মধ্যে তিন নম্বরের সাধারণ মানুষ যে উপচে পড়েছে তা সে লক্ষ্য করেনি।
সতীশদা বললেন, ‘কিছু বলব না তাই বা জানলে কি করে? আমরা পার্টি থেকে অ্যাকশন নেব। পুলিসের কাছে কৈফিয়ৎ চাইব।’
অর্ক বলল, ‘আর তার মধ্যে কয়লাদের মত গুণ্ডারা এসে একটার পর একটা খুন করে যাক আর আপনারা চেয়ে চেয়ে তাই দেখবেন।’
এবার সতীশদার কণ্ঠে উত্তেজনা এল, ‘তুমি কি বলছ তা জানো না!’
‘জানি সতীশদা। আমি রাজনীতি বুঝি না কিন্তু আপনাকে আমার ভাল লাগে। কয়লারা মোক্ষবুড়িকে খুন করেছে আর পুলিস কিছু বলছে না এটা মেনে নিতে পারি না। আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন, আমরা সবাই মিলে প্রতিবাদ করি।’ অর্কর কথা শেষ হওয়ামাত্র তিন নম্বরের সমস্ত মানুষের গলা থেকে সমর্থনসূচক শব্দ বেরিয়ে এল। সতীশদা এবার অস্বস্তিতে পড়লেন। তারপর অর্কর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘আমার পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। দলের নির্দেশ নিতে হবে।’
‘আপনি এর মধ্যে দলকে টানছেন কেন?’
‘কারণ আমি চব্বিশঘণ্টার রাজনীতি করি। আমি মনে করি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা ও আনুগত্য ছাড়া একটি মানুষ পূর্ণতা পায় না। যাহোক, এ ব্যাপারে তোমরা একটা কাজ করতে পারো। এ পাড়ার নাগরিক কমিটির মিটিং যাতে তাড়াতাড়ি ডাকা হয় সে ব্যবস্থা করতে পারি। সেখানে তোমরা বক্তব্য রাখতে পারো। নাগরিক কমিটি পল্লীর শৃঙ্খলা রাখতে অরাজনৈতিকভাবে কাজ করতে পারে।’
কিন্তু সতীশদার কথা শেষ হওয়ামাত্র একজন চিৎকার করে উঠল, ‘ওখানে তো মাথাভারী লোক গিয়েছেন, তাঁরা কোনদিন আসেন না। পাড়ার কটা লোক নাগরিক কমিটির খবর রাখে বলুন?’
সতীশদা বললেন, ‘আপনাদের কমিটি আপনারা যদি খবর না রাখেন—!’
‘না আমাদের কমিটি নয়। আপনারা ক্ষমতায় এসেছেন এত বছর, নাগরিক কমিটি তৈরি হয়েছে কিন্তু সেই কমিটি কোন কাজ করে না, নামেই রয়েছে। সাধারণ মানুষ তাদের খবর জানেই না।’ ছেলেটি এসব বলেই জুড়ে দিল, ‘একথা বলছি বলে ভাববেন না আমি কংগ্রেস করি। সমালোচনা করলেই তো চক্রান্তের গন্ধ পান।’
সতীশদা মাথা নাড়লেন, ‘তুমি প্রতিক্রিয়াশীল সংবাদপত্রের ভাষায় কথা বলছ সুবল। তোমাকে আমি অনেকবার বলেছি দলের ভেতরে এসে এসব কথা বল। শরীরে আঁচ না লাগিয়ে যারা ফলভোগ করে তাদের সুবিধেবাদী বলা হয়।’
অর্ক দেখছিল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছে তারা। সে বলল, ‘ওসব আমি বুঝি না সতীশদা। তিন নম্বরে আমরা পশুদের মত আছি। এখানে দিনদুপুরে মাস্তানি হয়, অশ্রাব্য খিস্তির বন্যা বয়ে যায়, মাতলামি চলে দিন রাত আর আপনাদের নাগরিক কমিটি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোয়। কি, ঠিক বলছি?’
সতীশদা মাথা নাড়লেন, ‘অনেকটাই ঠিক।’
‘কেন এমন হবে? কেন আপনারা রাজনীতি করেন সাধারণ মানুষের কাছে না গিয়ে! সতীশদা, শুধু বড় বড় শব্দ দিয়ে কদ্দিন মানুষকে বোঝানো যায়? না, সতীশদা, আমি এসব বুঝতে পারি না। কয়লা অন্যায় করে শাস্তি পাবে না কেন?’ অর্ক কথাগুলো বলামাত্র সমস্ত মানুষ হৈ চৈ করতে শুরু করল। সবাই উত্তেজিত।
সতীশদা চিৎকার করলেন, ‘তোমরা কি করতে চাও?’
‘আমরা কয়লার শাস্তি চাই।’
সতীশদা চিৎকার করলেন, ‘কিন্তু শাস্তি দেবে আদালত। আমরা আইন হাতে নিতে পারি না। অর্ক, তুমি এদের উত্তেজিত করছ। ভুল করছ। এতে এদেরই ক্ষতি হবে।’
কেউ একজন চেঁচালো, ‘কয়লা নুকু ঘোষের বাড়িতে বসে মাল খাচ্ছে। নুকুর বাড়ি জ্বালিয়ে দাও।’ হঠাৎই মানুষগুলো পাল্টে গেল। যারা এতক্ষণ বোমের ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল ঘরে তারা উত্তেজনায় রাস্তায় ছোটাছুটি করতে লাগল। সতীশদা কিংবা অর্ক চেষ্টা করেও সামলাতে পারল না তাদের। সবার লক্ষ্য নুকু ঘোষের বাড়ি।
বাড়িটার সামনে একটা জিপ দাঁড়িয়ে। তিন নম্বরের মানুষের টানে আশেপাশের একটা বিরাট জনতা এই মাঝরাত্রে নেমে এসেছে পথে। অর্ককে নিয়ে সতীশদা কোনরকমে ভিড়ের সামনে চলে এলেন। সতীশদা চিৎকার করলেন, ‘আপনারা এমন কিছু করবেন না যাতে আইন বিঘ্নিত হয়।’
কিন্তু অর্ক সতীশকে বলল, ‘সতীশদা, আপনি আড়ালে চলে যান। নইলে নুকু ঘোষ বলবে আপনার পার্টি ওর বাড়ি ঘেরাও করেছে। আপনি সাধারণ নাগরিক হিসেবে পিছনে থাকুন।’
‘কিন্তু পাড়ায় কোন গোলমাল হলে আমাকে জবাবদিহি দিতে হবে।’
‘সে নাহয় দেবেন। এখন সামনে থাকবেন না।’
সুবল বলল, ‘ঠিক কথা। এটা আমাদের ননপলিটিক্যাল মুভমেন্ট।’
মানুষেরা চিৎকার করছে কয়লার নাম ধরে, নুকু ঘোষের পিণ্ডি চটকে। দু-একটা ঢিল ছিটকে গেছে বাড়ির দিকে। এইসময় দরজা খুলে গেল। নুকু ঘোষ বেরিয়ে এল টালমাটাল পায়ে, ‘কি ব্যাপার? এখানে কি হচ্ছে?’ জনতা দেখে লোকটার মুখ চুপসে গেলেও সামলে নিল।
‘কয়লাকে চাই। বের করে দিন কয়লাকে।’ জনতা একসঙ্গে বলে উঠল।
‘কয়লা! কেন তাকে কি দরকার?’ নুকু ঘোষের গলার স্বর জড়ানো।
সুবল উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে, ‘কয়লা তিন নম্বরে হামলা করে একজনকে খুন করেছে। আপনি তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। ওকে বের করে দিন আমাদের হাতে।’
নুকু ঘোষ চিৎকার করল, ‘বের করে দিন! যেন বাবার সম্পত্তি! কে তোদের লেলিয়েছে? অ্যাঁ, কে লেলিয়েছে?’
সঙ্গে সঙ্গে জনতা ফুঁসে উঠল। উন্মত্ত ঢেউ আছড়ে পড়ল নুকু ঘোষের ওপর। নুকুর লোকেরা তাকে টেনে নিয়ে গেল ভেতরে। তারপর দরজা বন্ধ করে দিল। ততক্ষণে কয়লার গাড়িতে আগুন জ্বলেছে। জনতা এবার নুকুর বাড়িতে সে আগুন ছড়াতে চাইল। অর্ক এক লাফে বারান্দায় উঠল। তারপর দু’হাত ওপরে তুলে চিৎকার করল, ‘আপনারা শুনুন। মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। আমরা কয়লাকে চাই। নুকু ঘোষের বাড়ি ঘিরে রাখুন কিন্তু কেউ ভেতরে ঢুকবেন না। যতক্ষণ নুকু কয়লাকে বের না করে দেয় ততক্ষণ আমরা এখান থেকে নড়ব না।’
সুবল বলল, ‘ঠিক কথা। আজ সারা রাত আমরা ঘেরাও করে থাকব। আপনারা সবাই বসে পড়ুন। গুণ্ডাটাকে চাই-ই চাই।’
জনতা তখনও অশান্ত ঘোড়ার মত ছটফট করছিল।