প্রতিমার গায়ে রং লাগানো হয়ে গেছে, গর্জন তেল মাখিয়ে পালিশও করা হয়েছে। আজ চোখ ফোঁটাবার দিন। আজকের দিনটাই আসল। এতদিন ছিল নিছক মাটির প্রতিমা, আজ তিনি হবেন মা দুর্গা।
জায়গাটা চট দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। দুগ-লক্ষ্মী-সরস্বতী কোনো মূর্তিকেই এখনো কাপড় পরানো হয়নি, তাই বাইরের লোকদের দেখতে নেই। শুধু বাচ্চারা সেই চট সরিয়ে উঁকিঝুঁকি মারে, তারা বারণ শোনে না। শিশুদের আর শিল্পীদের দোষ হয় না।
ব্যানার্জিবাবুদের বাড়ির প্রতিমা গড়ার বায়না পেয়েছে হলধর পাল, তার সহকারী হয়েছে হারীত মণ্ডল। ব্যানার্জিরা এ তল্লাটের অবস্থাপন্ন মানুষ, তাদের পাটের কারবার আছে। তাদের যৌথ পরিবারে এখনও পুরোনো চাল বজায় আছে, প্রতি বছর এ বাড়িতে দুর্গা পূজা হয়। এখন পারিবারিক দুর্গাপূজা উঠেই যাচ্ছে প্রায়, এখন বারোয়ারি দুর্গোৎসব হয়। বসিরহাটের ব্যানার্জিরা কলকাতার কুমোরটুলি থেকে মূর্তি আনেন না। নিজেদের বাড়িতেই কুমোর ডেকে মূর্তি গড়ান, এটাও তাঁদের অনেক কালের পারিবারিক প্রথা। বাড়ির উঠোনে মণ্ডপ তৈরি হয়, কয়েক বছর আগেও পাঁঠা বলি হত, সম্প্রতি এ বাড়ির ছোটবাবু তা বন্ধ করেছেন, নিয়ম রক্ষার জন্য হাঁড়িকাঠে বলি দেওয়া হয় চালকুমড়ো আর আখ।
প্রতিমার দৃষ্টিদান হয় পঞ্চমীর দিন বিকেলে। এ বাড়ির কুমারী ও সধবা মহিলারা ওই দিন সুতির শাড়ি পরে না। সকালেই স্নান সেরে পট্টবস্ত্র ধারণ করে সারাদিন উপবাসে, শুদ্ধভাবে থাকে। আজকাল অবশ্য কুমারী মেয়েরা লুকিয়ে লুকিয়ে বাতাসা বা তেতুলের আচার খেয়ে নেয়, সধবারা প্রকাশ্যেই চা খায়।
হারীত মণ্ডল ধ্যানে বসেছে। না, লোক দেখানো ভান নয়, সে সত্যিই চোখ বুজে ধ্যানের মধ্যে দেখতে চাইছে একজোড়া চোখ। সে নিজেও আজ সারাদিন কিছু খায়নি। হলধর জেদ ধরেছে যে মা দুর্গার চোখ হারীতকেই আঁকতে হবে।
হারীতের তুলনায় হলধরের বয়েস খুব বেশি না হলেও তার চোখে ছানি পড়ে গেছে, চশমা নিয়েও সে ভাল দেখতে পায় না। লক্ষ্মী-সরস্বতী, কার্তিক-গণেশের চোখ তারা দু’জনে ভাগাভাগি করে আঁকলেও মা দুর্গার চোখ হলধর আঁকতে সাহস পায় না। এ চোখ তো একবার একে আর মোছা যায় না। একটানে আঁকতে হয়।
হারীত বেশ বিপদেই পড়ে গেছে। সে পেশাদার কুমোর কোনও কালেই ছিল না। শখ করে সে মূর্তি গড়া শিখেছে, কাঠের পুতুলও বানাতে পারে, তাও তো অনেকদিন অভ্যেস নেই। আজ যখন সে তুলি হাতে নিয়েছে, তাকে কাজ শেষ করতেই হবে। কিন্তু তার ভয় করছে, এ তো সামান্য কোনও পুতুল তৈরি করা নয়, এ যে মায়ের মুখ। চোখ বুজে, মনটাকে দুই ভুরুর মাঝখানে এনে হারীত একটি দুগা প্রতিমার মুখ দেখতে চাইছে, মনে আসছেও সে রকম ছবি, কিন্তু স্থির নয়, বড় চঞ্চল। তার মনে পড়ে যাচ্ছে সুলেখার কথা, তার জীবনে যে একমাত্র নারীকে সে দেবীর স্থানে বসিয়েছিল, সেই শান্ত, সুন্দর দুটি চোখ, তালতলার বাড়িতে হারীত যেদিন গ্রেফতার হয় সেদিন সুলেখা খালি পায়ে রাস্তায় নেমে এসে পুলিশের কাছে মিনতি করেছিলেন না, না, কোনও জীবিত মানুষের চোখের আদলে কি ঠাকুরের চোখ আঁকা যায়, তাতে পাপ হবে না? হারীতের আরও মনে পড়ছে গোলাপীর মুখ, তার স্ত্রীর মুখ, আরও অনেক রোগা, গাল তোবড়ানো নারীদের মুখ, কিছু কিছু নিষ্প্রভ চোখ… এতো বড় জ্বালা!
হারীত তার মনটাকে নাড়া দিয়ে ফিরে যেতে চাইল তার বাল্য-কৈশোরে, যখন দুগা ঠাকুরের মুখের দিকে সে সত্যিকারের বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত, মনে হত ডান দিকে বা বাঁ দিকে, যেদিকেই সে সরে যাক, মা তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। তাদের বাড়িতেও চৌধুরীবাড়ির পুজোয় একমাস আগে থেকে প্রতিমা একমেটে, দোমেটে হত। তারপর সাদা রং, প্রতিটি স্তরে হারীত দেখত হাঁ করে… আশ্বিন মাসের মাঠভরা সবুজ ধান, সেই ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছে এক কিশোর, আকাশে, বাতাসে ঢাকের বাজনা বাজছে, দূরে দেখা যাচ্ছে তাদের বাড়ি, ডাল-পালা মেলে টিয়া তুটি আম গাছটা যেন ডাকছে, হারী, হারীত
হলধর তাকে একটা ঠেলা দিয়ে বলল, কী হইলো, তোমার চক্ষু দিয়া জল পড়ে ক্যান? ঘুমাইয়া পড়লা নাকি?
হারীতের ঘোর ভাঙল। হা, সে প্রায় এক স্বপ্নের দেশেই চলে গিয়েছিল।
তুলি হাতে নিয়ে হারীত উঠে দাঁড়াল। কালো রঙের মধ্যে সেটা ডোবাতে ডোবাতে সে কয়েক পলক চেয়ে রইল দুগার মুখের দিকে। এখন দেখলে মনে হয় এক সুন্দরী অন্ধ যুবতী। হারীত ভাবল, কী হবে চোখ একে? ঠাকুর-দেবতারা তো সব অন্ধই! তাঁরা কি মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখতে পান? এই যে এত মানুষ ভিটে-মাটি ছাড়া হয়ে হা-ঘরের মতন ঘুরছে, অনাহারে, রোগে ভোগে মরছে, দেবতারা কি তার প্রতিকারের কিছু চেষ্টা করেন কখনও?
তুলিতে বেশি রঙ নিয়ে হারীত প্রায় বিদ্যুৎ বেগেই ভুরু জোড়া আঁকল। তারপর চোখের দুটি মণি। তারপর সরু করে চোখের রেখা।
হলধর ব্য গ্রভাবে দেখছিল, হারীত একটু পিছিয়ে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরে হলধর বলল, গুরুবল আছে তোমার, হারীত! বড় সুন্দর হইছে। মা হাসতেছেন, দ্যাখো হারীত, মা তোমারে আশীবাদ করতেছেন।
হারীত চোখ কুঁচকে দেখতে লাগল। সে খুশি হয়নি। তার চোখে খুঁত ধরা পড়ছে, ভুরু দুটো সমান নয়, সে দৈবী প্রেরণা পায়নি, শিল্পী হিসেবে সে সন্তুষ্ট নয়। তবে চলে যাবে, ঠাকুরের মূর্তি কেউ অত খুঁটিয়ে দেখে না, এখন মাথায় জরির মুকুট ও গায়ে চকচকে রং করা পাটের কাপড় পরিয়ে দিলেই অনেক জমকালো দেখাবে।
হলধর বলল, এবার তুমি বিশ্রাম নাও। যেটুকু বাকি আছে, আমি সাইরা দেবো অ্যানে।
হারীত বলল, অসুরের চক্ষু দুইটাও আমিই কইর্যা দেই। ঐ দুটা আরও ভাল পারুম। সারাজীবনে অসুর তো কম দ্যাখলাম না।
চটের পর্দা সরিয়ে হলধর একটি বাচ্চা মেয়েকে বলল, ভিতরে গিয়ে খবর দায় তো মা, চক্ষুদান হইয়া গ্যাসে।
বাচ্চারা হাততালি দিয়ে উঠল, পর্দা ঠেলে একবার উঁকি মেরে সবাই প্রণাম করল। তারপর ছুটে গেল বাড়ির মধ্যে।
ব্যানার্জিদের মেজোবাবু চটি ফটফটিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে হলধর?
হলধর বলল, আর শুধু সাজ পরানো বাকি। বড় জোর এক-দ্যাড় ঘণ্টা লাগবে বাবু! মেজোবাবু বললেন, আগে তোমরা কিছু খেয়ে নাও। বেশ বেলাবেলিই তো হয়ে গেল। তিনি চক্ষুষ্মণা প্রতিমা দেখার জন্য কোনও আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। পুরুত এসে ঘটে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার আগে মায়ের মুখ দেখেন না এ বাড়ির পুরুষেরা।
একটি যোল-সতেরো বছরের তথী মেয়ে দুটি থালায় করে লুচি-আলুর দম আর মিষ্টি দিয়ে গেল দু’জনের জন্য। অন্যদিন এরা খোরাকির টাকা পায়, শুধু আজকের দিনটাতেই বাড়ির ভেতর থেকে খাবার আসে। হলধর ভাল করে হাত না ধুয়েই খেতে শুরু করে দিল। হারীত একটা বিড়ি ধরিয়ে বারবার দেখছে দুর্গা প্রতিমার চোখের দিকে। শিল্প সৃষ্টির অতৃপ্তি তার খিদে ভুলিয়ে দিয়েছে। খুব খারাপ হয়নি। কিন্তু আরো অনেক ভাল হতে পারত।
সব কাজ সারতে সন্ধে হয়ে গেল। এখন যেতে হবে দু-আড়াই মাইল দূরে। হাঁটতে হাঁটতে ইলধর নিজের বুকে হাত বুলাতে লাগল মাঝে মাঝে। কথাও সে কম বলছে। একটু বেশি বয়স হলে অনেক মানুষেরই বেশি কথা বলা রোগ হয়, হলধর কিন্তু চুপচাপ স্বভাবের মানুষ। হারীতও আপনমনে বিড়ি টেনে যাচ্ছে। তার বগলে একটা নতুন ধুতি।
হলধরকে কয়েকবার বুকে হাত বুলোতে দেখে হারীত জিজ্ঞেস করল, কী হইলো গো দাদা, বুক ব্যথা করে নাকি?
হলধর বলল, না, ব্যথা নাই। তয় বুকখানা কেমন য্যান খালি খালি লাগে।
হারীত বলল, আতদিনের পরিশ্রম আইজ শেষ হইল, আইজ তো ফুর্তি করার কথা। তুমি মুখ শুকনা কইরা রইলা?
হলধর বলল, হ। ঠিকই।
–কিসের কী ঠিকই?
–আইজ ফুর্তি করার কথা। তবু বুকখান খালি খালি লাগে। পিরতিমার কাজ সম্পূর্ণ হইল, তবু আমার খালি খালি লাগে।
হারীত যেন এবার খানিকটা বুঝল। সে নিজেও ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারবে না, তবে কোনও একটা কাজ খুব মন দিয়ে সম্পূর্ণ করার পর একধরনের শূন্যতাবোধ তারও হয় কখনও কখনও। একটা অতৃপ্তির স্বাদ মুখে লেগে থাকে।
যেতে হবে বাজারের পাশ দিয়ে। এখন দোকানপাট অনেক রাত্তির পর্যন্ত খোলা থাকে। পথে মানুষজন অনেক, বেশ একটা পুজো পুজো ভাব এসে গেছে। এক জায়গায় কয়েকজন ঢাকী-টুলি জড়ো হয়ে আছে, বারোয়ারির পুজো কমিটিগুলি তাদের এখনও নিতে আসেনি, মাঝে মাঝে তারা ঢাকে কাঠি দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। ঐ ঢাকের আওয়াজ শুনলেই উৎসব উৎসব মনে হয়।
হলধর এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার কিছু কেনাকাটি আছে? এখন টাকা নিবা?
হারীত দুদিকে মাথা নাড়ল। কার জন্য সে পুজোর বাজার করবে, তার তো কেউ নেই এখানে? নবাকে নিয়ে যোগানন্দ ফিরে গেছে, হারীত পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পরেই। কাশীপুর কলোনিও সার্চ হয়েছিল, সেখানকার লোকজন প্রায় জোর করেই নবা আর যোগানন্দর টিকিট কেটে তাদের ট্রেনে তুলে দিয়েছিল। পুলিশের ভয়ে তারা হারীতের সঙ্গে কোনও সংস্পর্শ রাখতে চায় না। তারা ভেবেছিল, হারীত সহজে ছাড়া পাবে না।
নবার জন্য একটু মনঃকষ্ট হল হারীতের। ছেলেটা থাকলে একটা নতুন জামা কিনে দিত হারীত, ওর বেলুন আর আইসক্রিমের খুব শখ ছিল…
হারীত নিজে কতকাল পর পুজোর সময় নতুন বস্ত্র পরবে।
হারীতের হাত ধরে টেনে হলধর বলল, আস এদিকে। এখনই বাড়ি যাওনের তাড়া নাই। এটু মনডারে জুড়াই।
বাজারের পেছনদিকে একটা দেশী মদের আখড়া। প্রত্যেকদিনই ভিড় থাকে, আজ একেবারে মাছির মতন মানুষের মাথা। সিগারেট-বিড়ির ধোঁয়ায় টালির ঘরটা ভরে গেছে। বসার জায়গা নেই, তাই কাউন্টারে অন্যদের ঠেলেঠুলে ওরা দু’জনে দাঁড়াল। হলধর আঙুল দেখিয়ে বলল, দুইটা ফাইল!
হারীত একটু অস্বস্তি বোধ করছে। সে যে কোনওদিন মদ স্পর্শ করেনি, তা নয়। এই আখড়াতেই হলধরের সঙ্গে বারতিনেক এসেছে। খানিকটা খেয়েই হলধর বেসামাল হয়ে পড়ে, তার পায়ের জোর কমে যায়। এখানে প্রায় প্রত্যেকদিনই বন্ধ হবার একটু আগে ঝগড়াঝাঁটি-মারামারি শুরু হয়ে যায়। কেউ কেউ সোডার বোতল ছোঁড়ে, কেউ ছুরি বার করে। মারামারিটা অবশ্য বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবু বলা তো যায় না। আজ হলধরের কাছে অনেক টাকা, ব্যানার্জিবাবুরা মোট এগারো শো টাকায় চুক্তি করেছিলেন, তার মধ্যে ছ শো টাকা আগেই নেওয়া হয়ে গিয়েছিল, আজ চুকিয়ে দিয়েছেন বাকি টাকা। এছাড়া দু’খানা ধুতি দিয়েছেন।
এই বারের মালিক ইসমাইল মিঞা, জঙ্গলের শিমুল গাছের মতন চেহারা। গলার আওয়াজও বাজখাই। গণ্ডগোল-মারামারির সময় সে অকুতোভয়ে মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়, দু’দিকে চড়-চাপড় চালায়। ইসমাইল মিঞার গায়ে কেউ হাত তুলতে সাহস করে না। এমনকি কোনও মাতাল খুব নেশামিশ্রিত রাগে ছুরি বার করলেও ইসমাইল মিঞা তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে, কী রে, খুব গরম খেয়ে গেছিস, না? লবাবী করছিস এখানে? দাঁত ক’খানা সব ফেলে দেব?
আজ ইসমাইল মিএই ভরসা। ঘামে তার সারা মুখ চকচক করছে, যেন গর্জন তেল মাখানো হয়েছে। চোখ দুটো ধোঁয়ায় লালচে, সে একফোঁটাও মদ খায় না। ম্যানেজার মকবুল আজ একা এত খদ্দের সামলাতে পারছে না, তাই ইসমাইল মিঞাও মাল ঢালার কাজে হাত লাগিয়েছে।
হলধর বলল, এই যে, মে ভাই, আমাগো দুইটা গেলাস!
ইসমাইল মিঞা বলল, দিচ্ছি, দিচ্ছি, সবুর করো! আজ গেলাস শর্ট আছে। ভাঁড় চলবে?
তাই সই। একটা বাচ্চা ছেলে কয়েকটা মাটির ভাঁড় এনে রাখল কাউন্টারে। এই ছেলেটাই ঘুগনি আর মেটের চাঁট বিক্রি করে। হলধর তাকেও আঙুল দেখিয়ে বলল, দুটো স্পেশাল। অর্থাৎ দু’প্লেট মেটে। হলধর অসম্ভব ঝাল খেতে পারে।
নিজের ভাঁড়টা নিয়ে হারীত প্রথমে তাতে কড়ে আঙুল ডুবিয়ে একটু মদ তুলল। সেটা ছিটিয়ে দিল ভূমিতে, বিড় বিড় করে বলল, জয় বাবা কালাচাঁদ, জয় বাবা কালাচাঁদ। তার দেখাদেখি আজকাল হলধরও গুরু কালাচাঁদের নাম নেয়।
অন্যরা হল্লা করছে, কেউ ঘরের এক কোণ থেকে অন্য কোণের একজনকে কোনও গোপন খবর শোনাচ্ছে, কেউ কেউ গান ধরেছে। হলধর গল্প করার লোক নয়, তার নেশা হলেই সে আরও গুম হয়ে যাবে। হারীত এদিক ওদিক তাকিয়ে চেনা মানুষ খোঁজে।
হারীতের ডানপাশেই যে রুখু দাড়িওয়ালা লোকটি দাঁড়িয়েছে, সে খাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে, তার কান্নার দশা এসে গেছে। সে হারীতকে চেনে না, তবু আপনজনের মতন তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এবার আমাগো দ্যাশে একখানাও পূজা হবে না! বরিশাল-ফরিদপুর-খুলনা, মায়ের পূজা নাই।
পাশ থেকে তার সঙ্গী কাঁধে চাপড় মেরে বলল, আরে শালা, কবে বরিশাল ছেড়ে এসেছিস, সেই পঞ্চাশ সনে, এখনও বলিস আমাগো দ্যাশ! তাদের লজ্জা করে না?
রুখু দাড়িওয়ালা লোকটি বলল, আলবাৎ কমু। আমার বাপ-দাদারা সেহানে জন্মগ্রহণ করছে, সেহানেই মরছে। আমাগো সাত পুরুষের ভিটা আছিল।
সঙ্গীটি ভেঙচিয়ে বলল, তুই-ও সেখানে জন্মগ্রহণ করিছিস। তুইও সেখানে মরতে যা তা হলে? এখানে ভিড় বাড়াচ্ছিস কেন?
লোকটি ঠিক উত্তর খুঁজে না পেয়ে হারীতের দিকে তাকাল। হারীত জিজ্ঞেস করল, বরিশাল-ফরিদপুরে পূজা হবে না কেন এবার?
লোকটি এবার হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, খান সেনারা খুন করবে। মা দুগারে দ্যাখলে তারেও খুন করবে। হিন্দুরা সব পলাইছে!
একটু দূর থেকে একজন বলল, ও বুড়োদা, আজ তিনজন খান সেনা ধরা দিয়েছে, দেখেছেন? নদীর ওপর দিয়ে নৌকো করে নিয়ে এল, হাত বাঁধা ছিল। কী ইয়া ইয়া চেহারা, মুখগুলো লাল।
আর একজন বলল, ওরা পাঠান। বুঝলেন। পাঠানরা অনেকে বাঙালিদের ওপর অত্যাচার করতে চায় না। তারা পালিয়ে এসে বি এস এফ-এর কাছে ধরা দিচ্ছে। ইছামতী নদীর ওপর দিয়ে তা প্রায় রোজই দুটো-তিনটে আসছে।
আগের লোকটা বলল, বাঙালিদের ওপর অত্যাচার করতে চায় না। কে বললে? আসলে এখন উল্টো হুড়কো খাচ্ছে যে! মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের হাতে ধরা পড়লে কচুকাটা হবে তাই বি এস এফএর হাতে ধরা দিচ্ছে।
ইসমাইল মিঞা একজনকে জিজ্ঞেস করল, অ্যাইলে তাই, তাদের পাড়ার পুজোয় কোন্ যাত্রাপাটি আসছে রে?
নিতাই নামের লোকটি বলল, সত্যম্বর অপেরা। সব কলকাতার আর্টিস্ট। ‘পতিঘাতিনী সতী’ আর ‘বিদ্রোহী বাদশা’। ফিমেল আর্টিস্ট আছে, ঝর্ণাকুমারী দুলালী চ্যাটার্জি, ছন্দা পাল। মিঞাদাদা, তোমার কিন্তু এবার পঞ্চাশ টাকা চাঁদা।
–যা ভাগ। পঞ্চাশ দোব না ইয়ে দেব! গতবারে তিরিশ দিয়েছি।
–সব জিনিসের দাম বেড়েছে এবারে! তুমি মালের দাম বাড়াওনি? পঞ্চাশ দিও, তোমার সামনের দিকে সীট রিজার্ভ থাকবে।
–হ্যাঁ রে, ঐ ঝণাকুমারী নাকি মোছলমানের মেয়ে!
–মোছলমানের মেয়ে নয় গো, হিন্দুবাড়ির বউ ছিল। আর একজনকে বিয়ে করবে বলে মোছলমান হয়েছে। ঐ যেমন সিনেমার শর্মিলা টেগোর।
কেউ একজন এই তথ্যে আপত্তি জানাল। অন্য দু-তিনজন পূর্ববর্তী বক্তাকে সমর্থন জানিয়ে বলল যে, এ খবর কাগজে বেরিয়েছে।
আর একজন চিৎকার করে বলল, আরে শালা ঝণাকুমোরীকে পেলে আমিও এক্ষুনি মোছলমান হতে রাজি আছি। যা দু’খানা হেভী হেভী:-ঝণাকুমোরী কাবাব বেঁধে খাওয়াবে একদিন, আমি পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকব, কত টাকা লাগে বল তো?
ইসমাইল মিঞা বলল, আরে তোর যে মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে, ঝণাকুমোরীকে পেলে তুই আগে কেই কাবাব বানিয়ে খাবি।
একটা হাসির ঢেউ বয়ে গেল।
হারীত অনেকক্ষণ থেকেই হাসছে মুচকি মুচকি। এ এক বিচিত্র জগৎ। এখানে হিন্দু-মুসলমান, বাঙাল-ঘটির কোনও তফাত নেই। এখানে ঝগড়া হয় বটে, আবার পরের দিন তারাই গলা জড়াজড়ি করে। শুড়িখানায় কোনও হিন্দুস্থান-পাকিস্তান নেই। সীমান্তের ওপার থেকে পালিয়ে আসা মানুষ এখানে আসে, আবার এই বাজারের বিহারী মুসলমান পাইকাররাও আসে।
হলধরকে একটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে হারীত জিজ্ঞেস করল, কী দাদা, কদ্দুর?
হলধর বলল, বুকখান এহোনও খালি খালি লাগত্যাছে রে!
-–ও আর আইজ ঠিক হবে না, চলো বাসায় যাই!
হলধর যেতে চায় না। হারীত একটা পাঁইট কিনে নিয়ে প্রায় জোর করেই তাকে টেনে বাইরে এনে রিকশায় তুলল। হাঁটিয়ে নিতে গেলে হলধর মাঝে মাঝে বসে পড়বে। নতুন ধুতি দুখানা ঠিক আছে, হলধরের কোমরে টাকার গেজেটা ঠিক আছে।
একটুখানি যেতে না যেতেই হলধর হারীতের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। একটু পরেই নদীর ওপারে বুম বুম করে দুটো জোর শব্দ হল। বোমা হতে পারে, গুলির শব্দ হতে পারে। এরকম শব্দ শুনলে এখন কেউ বিশেষ চমকায় না। হলধরের ঘুমও ভাঙল না।
রিকশাওয়ালাটিও রিফিউজি। সে আপনমনেই বলল, আইজ আবার মুক্তির পোলারা বড়ার অ্যাটাক করছে।
এখান থেকে মাত্র দশ-পনেরো মাইল দূরে যুদ্ধ চলছে একটা। মানুষ মরে, মানুষই মানুষকে মারে। মাত্র দুটো-তিনটে লোক আলাপ-আলোচনায় বসে একমত হতে পারলে এই অসংখ্য খুনোখুনি বন্ধ হতে পারত।
হলধরের বাড়িতে এসে হারীত ভাড়া মিটিয়ে দিল। দুখানা মাত্র টিনের চালের ঘর, বিজলি বাতি নেই, সামনের এক চিলতে বারান্দায় হলধরের পাগল বউ হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছে।
বসিরহাট থানা থেকে ছাড়া পেয়ে ঘুরতে ঘুরতে হারীত একদিন এই বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিল। সেদিন এই বারান্দায় ছড়ানো ছিল অনেকগুলো মাটির পুতুল, তখনও বেশিরভাগই রং করা বাকি। বাইরে তুমুল ঝড়বৃষ্টি। হারীত এই বারান্দায় উঠে এসে এক কোণে বসেছিল, হলধর একবার মাত্র মুখ তুলে তাকিয়েছিল তার দিকে, কোনও কথা বলেনি। তখন প্রায় বিকেল, হারীত সারাদিন কিছু খায়নি, এক কাপ চাও না। খানিকক্ষণ বসে বসে হলধরের পুতুল। রং-করা দেখতে দেখতে হারীত এক সময় চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে বলেছিল, আমারে এক গাল। মুড়ি খাইতে দেবেন? আমি রং দেওয়ায় আপনারে সাহায্য করতে পারি।
নানা জায়গা থেকে বিতাড়িত, মাকর্মিরা উদ্বাস্তু হলেও হারীত ভিখিরি হতে পারে না। তার পরনে গেরুয়া লুঙ্গি, তবু সন্ন্যাসীর ভেক ধরে সে কারুর কাছে হাত পাতেনি। এখানে, এই লোকটির বাড়িতে এসে সে কাজের বিনিময়ে কিছু খাবার চেয়েছিল।
হলধর জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি রঙের কাজ জানো?
হারীত বলেছিল, একখান আগে করি, আপনে দ্যাখেন।
পুতুলগুলো ছিল অতি সাধারণ ছাঁচে ঢালা লক্ষ্মী। একটা তুলে নিয়ে তাতে যত্ন করে রং লাগাবার পর হলধর জিজ্ঞেস করেছিল, বাড়ি কোথায়?
হারীত হাত তুলে বলেছিল, আগে ছিল ঐ পারে। এখনে, এখনে, কোথাও নাই।
-–তাই বুঝি গেরুয়া নিছো? তবু ভাত জোটে না?
সেই থেকে বন্ধুত্ব। হলধররাও হারীতের মতনই বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে এসেছে, তবে অনেক আগে, সেই পঞ্চাশ সালে। রিফিউজি ক্যাম্পে থাকেনি হলধর। তার সামান্য কিছু মূলধন ছিল, তা ছাড়া জাতে কুমোর, হাতের কাজ বিক্রি করে কোনওরকমে পেট চালিয়ে নিতে পারে। কুপার্স ক্যাম্পে থাকার সময় হারীতকে তার স্ত্রী পারুলবালা অনেকবার বলেছিল ক্যাম্প ছেড়ে পালাতে। তারাও কি অন্য কোনও জায়গায় কোনও রকমে মাথা গুঁজে জীবিকা চালিয়ে নিতে পারত না? রিফিউজি পরিচয়টা মুছে ফেলে মিশে যেতে পারত পশ্চিম বাংলার অগণ্য মানুষের মধ্যে। কিন্তু হারীত যে পাকেচক্রে রিফিউজিদের একটা দলের নেতা হয়ে গিয়েছিল। সবাই ভরসা করত তার ওপরে। সে কী করে অন্যদের ছেড়ে পালায়।
নেতা হবার যে কী মূল্য, তা তো হারীত বুঝেছে অনেকবার। কাশীপুরের বাগানবাড়িটা তো তারই জেদে দখল হয়েছিল, সে মার খেয়ে নিজের মাথা ফাটিয়েছে। খুনের অপবাদ নিয়ে পুলিশের কাছে শুয়োর-পেটা হয়েছে। সেই কাশীপুর কলোনির লোকজনরা এখন তার। নাতিটাকেও আশ্রয় দিল না! এতখানি জীবনের অভিজ্ঞতায় হারীত দেখেছে, গরিবরাও গরিবদের শত্রু হয়, গরিবরাও গরবিদের কম ঠাকায় না!
হলধরের স্ত্রী যে পাগল তা হারীত প্রথম কয়েকদিন বুঝতেই পারেনি। সে ভেবেছিল বোবা! চুপচাপ বাড়ির কাজকর্ম করে, রাঁধে, মাঝে মাঝে দেওয়ালের দিকে ফিরে চুপ করে বসে থাকে। হলধরের এক বিধবা দিদিও আছে এ বাড়িতে, সেই সংসার চালায়। পরে হারীত জেনেছিল, দেশ ছেড়ে আসার সময় হলধরের দুই ছেলেমেয়েই হারিয়ে যায়।
এখানে কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে হারীতের। দণ্ডকারণ্যে ফিরে যেতে মন চায় না, যে-জন্য সে এসেছিল, তার তো কিছুই হল না। সেই পাথুরে-জঙ্গলের দেশ থেকে সবাইকে সে কি এই বাংলায় ফিরিয়ে আনতে পারবে? এখনকার সীমান্তে সে নতুন শরণার্থীদের অনেক ক্যাম্প ঘুরে দেখেছে, এদের অবস্থা মোটেই ঈর্ষা করার মতন কিছু নয়। পূর্ব বাংলায় ফেরার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। এই নৈরাশের সংবাদ সে ফিরে গিয়ে দেবে কী করে? পারুলবালাকে অবশ্য সে পোস্টকার্ড লিখেছে দু’খানা।
পুজোর মধ্যেই হলধর আর হারীত আবার কাজে লেগে গেল। এবার লক্ষ্মী ঠাকুর গড়তে হবে, তারপর কার্তিক ঠাকুর। আশ্বিন মাস থেকেই শুরু হয় একটার পর একটা পুজো, চলবে সেই বৈশাখের আগে পর্যন্ত। হারীত ঠিক করেছে, এই কয়েকটা মাস এখানেই থেকে গিয়ে কিছু রোজগার করে তারপর সে ক্যাম্পে ফিরবে। কোনও আশার বাণী নিয়ে যেতে না পাক, নিজের হাতে তো কিছু থাকা চাই। হলধর তাকে ভালই পয়সা দেয়।
মোল্লাখালিতে চারখানা লক্ষ্মী ঠাকুরের অর্ডার ছিল, সেখানকার লোক এসেছে নিয়ে যাবার জন্য। হলধর আর হারীত দ্রুত হাত চালিয়ে কাজ শেষ করতে লাগল, খদ্দের দুটি বিড়ি টানছে বারান্দার এককোণে বসে। তারা সুন্দরবনের গল্প শোনাচ্ছে। ওরা জঙ্গলে ঢুকে মধু আনতে যায়, তার আগে বনবিবির পুজো করে। হলধর ওদের বনবিবির মূর্তি গড়ে দিয়েছে এক আগে। একবার বাঘের মুখে পড়ে গিয়েও বনবিবির মন্ত্র পড়তে পড়তে ওদের গুণিন সামনে এগিয়ে যেতেই সুন্দরবনের সেই ভয়ংকর বাঘ মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেছিল, এই রোমহর্ষক গল্প শুনতে শুনতে হাতের কাজ বন্ধ হয়ে যায় হারতের।
সে জিজ্ঞেস করল, মধু ভাঙতে গিয়া কেউ বাঘের প্যাটে যায় না?
গল্পের বক্তাটি উদাসীন ভাবে বলল, যায় দু-একজনা। যখন তাদের সময় ফুরায়। সময় ফুরাইলে কেউ কি আর পৃথিবীতে থাকতে পারে রে দাদা! চির কাল কে আর বাঁচে?
হারীত বলল, জঙ্গলে যারা যায়, তারা তো সব অপনেগো মতনই জোয়ান-মদ্দ। বুড়াধুড়ারা তো কেউ যায় না। তাগো দিন ফুরাবে কেন?
লোকটি বলল, তেমন তেমন জোয়ান হইলে বাঘের ঘাড়েও কোপ বসায়। জঙ্গলের বাঘ ও মাইনসেরে ডরায়।
তারপর সে তার সঙ্গীটি দেখিয়ে বলে, এই বাসুদাই তো একবার সাক্ষাৎ যমের মুখে পড়েছিলো, পিছন থিকা কান্ধের ওপর আইস্যা পড়ছিল বাঘ, তা এই বাসুদা টাঙ্গির কোপ মারল, একেবারে চক্ষুর উপর। বাঘের সে কি চিকখৈর! ও বাসুদা, জামা খুইল্যা তোমার জখমি দাগটা দ্যাখাও না!
বলিষ্ঠকায় লোকটি জামা খুলে দেখালো বটে কিন্তু সে বিশেষ গল্পবাজ নয়, নিজের বীরত্বের কোনও অহংকারও তার নেই। সে বলল, বনবিবির দয়ায় বাঘের হাত থেকেও বাঁচা যায়, কিন্ত মা মনসা বড় নিষ্ঠুর। সাপের কামড়েই তো বেশি মানুষ মরে।
সুন্দরবনের গল্প শুনতে শুনতে হারীত উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। হলধরের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে। সেও মোল্লাখালির লোক দুটির সঙ্গে চেপে বসল লঞ্চে।
এই দিককার, সব লঞ্চেই মাছের আঁশটে গন্ধ। ভোরবেলা মাছচালানীদের ঝুড়িতে প্রায় গোটা লঞ্চ ভরা থাকে, বিকেলবেলা তারা খালি ঝুড়ি নিয়ে ফেরে। এত যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেও জয়বাংলা থেকে মাছ ব্যবসায়ীরা চলে আসে এপারের বাজারে। সাপ ও বাঘের মতনই তারা পুলিশ বা মিলিটারিকে আর এক রকম প্রাকৃতিক উপদ্রব মনে করে, তার বেশি কিছু না।
একটার পর একটা নদী-নালা পার হয়ে সেই লঞ্চ এসে পড়ে বিরাট রায়মঙ্গল নদীতে। এবারের প্রবল বর্ষায় নদী একেবারে সমুদ্রের মতন চওড়া। বড় বড় ঢেউ। ধু-ধু করা ওপারের তটরেখাই জয়বাংলা। এত জলের দৃশ্যে হারীতের মনটা হু হু করে, মাছের গন্ধমাখা বাতাসে সে বারবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। লঞ্চ যেসব গ্রামে থামে, সেইসব গ্রামের নাম তার খুব চেনা মনে হয়।
নদীর একদিকে চোখে পড়ে চাষের খেত, অন্যদিকে জঙ্গল। মাছধরা ছোট ছোট নৌকোগুলো ওপারের জঙ্গল ঘেষে জাল ফেলছে। যাত্রীবোঝাই ফেরী নৌকো যাচ্ছে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। জীবন চলেছে নিজস্ব নিয়মে।
ছোট ছোট গাছপালা ভর্তি একটা দ্বীপের দিকে হাত তুলে হারীত তার এক সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করল, ঐ গ্রামটার নাম কী?
লোকটি বলল, ঐটার নাম মরিচঝাঁপি। ওখানে গ্রাম নাই। অরও আউগাইলে পাইবেন সাতজেলিয়া গ্রাম। আর এইদিকে দ্যাখেন, ডাইন দিকে, মোল্লাখালি আইয়া পড়ছে।
মোল্লাখালিতে দিন কতক থেকে গেল হারীত। ডিঙ্গি নৌকোয় করে ধারেকাছের আরও কয়েকটি গ্রাম ঘুরল। এখানে যুদ্ধের কোনও চিহ্ন নেই। এখানে মানুষজনের সংমিশ্রণও বিচিত্র। মুসলমান আছে, মেদিনীপুরের হিন্দু আছে, পূর্ব বাংলার কিছু প্রাক্তন উদ্বাস্তু আছে, উড়িষ্যা থেকে আসা কিছু মানুষও বসতি নিয়েছে, এমনকি কিছু সাঁওতালও রয়েছে। কারুর সঙ্গে কারুর কোনও দ্বন্দ্ব নেই। যে-যার আপনমনে চালিয়ে যাচ্ছে জীবন-সংগ্রাম।
এই সজল গ্রাম্য প্রাকৃতিক পরিবেশ ছেড়ে হারীতের আর যেতে ইচ্ছে করে না। অথচ নবার জন্য, গোলাপীর জন্য, নিজের স্ত্রীর জন্য, কলোনির অন্য মানুষজনের জন্য মাঝে মাঝে মন কেমন করে। তার একা পেট চালাবার কোনো চিন্তা নেই কিন্তু সকলকে নিয়ে বেঁচে থাকাতেই তার আনন্দ। তাকে ফিরতে হবেই। সুচরিতের আর কোনো খোঁজ সে পায়নি। সে বেঁচে আছে না মরে গেছে তা কে জানে। হয়তো তার খোঁজ করতে যাওয়াটাই বিপজ্জনক। পুলিশ আবার তার পেছনে লাগবে। খবরের কাগজে এর মধ্যে একদিন হারীত পড়েছিল, পাতিপুকুর আশ্রমের সেই সন্ন্যাসিনী চন্দ্রাকেও পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। তিনি কি জানেন সুচরিতের খবর? থাক, সুচরিত যদি বেঁচে থাকে, সে নিজে সুখে থাকার চেষ্টা করুক!
হারীত মনঃস্থির করে ফেলল। এখানে এখনও অনেক এমন দ্বীপ রয়েছে, যেখানে-মনুষ্যবাস। নেই। তার ক্যাম্পের কয়েক হাজার মানুষ তো অনায়াসেই এখানে এসে আশ্রয় নিতে পারে। জঙ্গল তো কারুর জমিদারি বাগানবাড়ি নয়। জবরদখলের প্রশ্ন নেই। সরকার বাহাদুরকে তারা বলবে, আমাদের র্যাশন কিংবা ক্যাশ ডোল দিয়া সাহায্য করার দরকার নাই। আমাদের। শুধু বাংলার মাটিতে থাকতে দিন। এই নরম মাটিতে আমরা চাষ করব, নদীতে মাছ ধরব, লতেই আমাদের চলে যাবে। সরকারের গলগ্রহ হবার বদলে আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ দিন। এতে বাঁচতে পারি বাঁচব, নয় যদি কপালে মরণ থাকে তো মরব।
সরকার বাহাদুর এই আবেদন শুনবেন না? নিশ্চয় শুনবেন। তাঁদের ক্ষতি তো কিছু নাই। তাঁদের অনেক ব্যাট বেচে যাবে, বছরের পর বছর রিফিউজিদের খরচ টানতে হবে না।
অনেকদিন পর হারীত বেশ প্রফুল্ল বোধ করল।