৪৮
দুনিয়াটা চারদিকে হাঁ-হাঁ করা খোলা। কিন্তু কোনদিকে যাওয়া যায় সেইটে মাঝে-মাঝে ঠিক করা বড় শক্ত হয়ে ওঠে। দুনিয়ায় এমন কেউ নেই যে তাকে দেখলে খুশি হয়। সে গেলে ‘এসো বোসো’ করার লোক নেই। পালপাড়ায় শুধু বুড়োবুড়ি আছে। কিন্তু তাদের মুখে হাসি ফোটানোর মতোই বা কোন্ সুসংবাদ নিয়ে যাচ্ছে সে?
ভোরবেলা শ্বশুরমশাই শীতলাতলার মোড় অবধি এগিয়ে দিয়ে গেলেন। বটতলায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথাও হল দুজনের।
কি করবে বাবা, এবার?
নিমাই বড় নীরস গলায় বলে, দেখি।
পুরুষমানুষ বসে গেলে তার আর জাত থাকে না। বসা-পুরুষের বড় কষ্ট। এই আমাকেই দেখ না। তবে বুড়ো হয়েছি বলে ক্ষ্যামা-ঘেন্না আছে। তোমার বয়সটা তো কিছু নয়। এই বয়সে বসা হলে কষ্ট বেশি।
আজ্ঞে, সে বড় ঠিক কথা। বসে থাকতে কে চায় বলুন! কিন্তু কিছু যে হয়ে ওঠে না। বীণা দানাপানি দেয়, তাই টিকে আছি। বড় লজ্জার ব্যাপার।
বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তোমাকে দেওয়ার মতো বুদ্ধিও আমার নেই। দুনিয়ার হালচাল মাথায় সেঁধোয় না। নিজেই ভেবেটেবে ঠিক করে নিও। তারপর ভাগ্য।
আজ্ঞে। আমার জন্য ভাববেন না।
তোমার জন্য ভাবি না বাবা, মেয়েটার জন্য ভাবি। তার আর কোনও আড়াল রইল না। পুরুষ ছাড়া মেয়েরা হল লোভানী জিনিস। চারা গাছের চারদিকে বেড়া না থাকলে যা হয়।
আমাকে দিয়ে সেই কাজটাই কি ঠিকমতো হয় বাবা? আমি কি একটা তেমন পুরুষ?
কেন বাবা, বীণার কি চরিত্রের দোষ হয়েছে?
জিব কেটে নিমাই বলে, ছিঃ ছিঃ, বীণা সেরকম মেয়ে নয়। বলছিলাম বেড়ার কথা যা বললেন ওসব হল শক্ত-সমর্থ পুরুষের কাজ। আমার নয়।
নিজেকে অত ছোটো ভেবো না বাবা, তাতে আমার কষ্ট হয়। তোমার মুখে সুলক্ষণ আছে। কপালের ফেরে নানারকম হচ্ছে। লাগাম তো সবসময়ে মানুষের হাতে থাকে না। শুধু একটা কথা বলে দিই।
বলুন বাবা।
রাগ করে আবার আত্মঘাতী হয়ে বোসো না। খাস যতক্ষণ আশ ততক্ষণ। শেষ অবধি চেষ্টা কোরো বাবা। কথা মনে থাকবে?
যে আজ্ঞে। মাঝে মাঝে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে যায় না বটে। তবে কিনা শেষ অবধি ভগবানে মনটা ফেলে দিলে খানিক জুত পাই।
তাই কোরো বাবা। ভক্তরা চিরকাল কষ্ট পায়। নতুন কথা আর কি?
আসি তাহলে?
এসো গিয়ে। জবরদস্তি তোমাকে আটক করলাম না। তার কারণও একটা আছে। শুনে যাবে নাকি?
শুনেই যাই।
বীণার বছ থেকে পৃথক হলে তোমার নিজের ওপর ভরসা আসবে। রাগ-অভিমান তখন উল্টোপথে ধেয়ে গিয়ে গোঁ হয়ে দাঁড়াবে। যদি সেটা হয়ে ওঠে তবে মঙ্গলই হবে বাবা।
আপনার আশীবাদ। আসি তাহলে।
প্রণাম করে নিমাই অন্ধকারে পা বাড়াল। না, অন্ধকার আর ততটা ছিল না। আকাশ ম্যাদাটে আলোয় কিছু ফিকে হয়েছে। একা হয়েই নিমাইয়ের সমস্যা দেখা দিল, এখন সে কোথায় যাবে? কার কাছে?
যাওয়ার জায়গা বলতে আপাতত পালপাড়াই আছে। বুড়োবুড়ির সঙ্গে দেখাও হয় না অনেক দিন। ভাঙা হোক, ধসা হোক, নিমাইয়ের ভদ্রাসন বলতে ওই পালপাড়ার বাড়িখানাই। বাপ-মায়ের ভিটে।
স্টেশন অবধি হেঁটে গেলে ট্রেন পাওয়া যাবে। বাসও আছে। হাঁটা পথ ধরে কয়েক পা এগোনোর পরই হঠাৎ পিছুটানটা টের পেল নিমাই। বীণাপাণি এখনও ঘুমে অচেতন। জেগে কি কাঁদবে নিমাইয়ের জন্য? না কাঁদুক, একটু কি দাপাবেও না? তেমন দরের বর না হলেও এতকালের সম্পর্ক কি এমন ঠুনকো হয়ে ভেঙে যাবে?
পা ধীর হয়ে এল নিমাইয়ের। একবার ভাবল, দুর ছাই, মরুক গে আত্মসম্মান, বীণার কাছে ফিরেই যাই।
তারপর নিমাই আবার বিজ্ঞ হল। সংযম এল। না, চলে যাওয়াই ভাল। মেয়েমানুষের হাততোলা হয়ে বেঁচে থাকাকে কি বেঁচে থাকা বলা যায়? বড় অপমান হচ্ছিল তার। বড় গঞ্জনা সইতে হচ্ছিল। তার চেয়ে কষ্ট আর বেশী কী আছে?
কতবার চোখের জল মুছল নিমাই তার হিসেব নেই। কতবার বেভুল হয়ে থেমে গেল। কতবার ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে হল। ঘর-সংসার ভেসে গেল তার। ছিড়ল সুতোর বাঁধন। সামনে এক দিশাহারা ভবিষ্যৎ। কে জানে কী হবে?
ক্রমে রোদ উঠল। চারদিক স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠল সোনালি আলোয়। স্টেশন দেখা যেতে লাগল।
চা খাওয়ার বাতিক নেই নিমাইয়ের। কখনও খায়, কখনও খায় না। আজ স্টেশনের চত্বরে একটা দোকানে বসে এক ভাঁড় চা খেল সে। সঙ্গে দুখানা ময়দার বিস্কুট। খেয়ে বাইরের বেঞ্চে অনেকক্ষণ উদাস হয়ে বসে রইল।
এখান থেকেই বাস ধরে পালপাড়া যাওয়া যায়। অনেক বাস। নিমাই তাড়াহুড়ো করল না। পালপাড়া তার জন্য সোনার থালায় ভাত বেড়ে বসে নেই। দু মাস আগে একশটি টাকা পাঠানো হয়েছিল বুড়োবুড়ির কাছে। সে টাকা কবে উড়ে গেছে। সংসারে এখন হাঁড়ির হাল। খুব দুঃখকষ্টের মধ্যে গিয়ে পড়তে হবে তাকে। সেটা ধীরে সুস্থে হোক।
বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল নিমাই। সে বড় ভালবাসে বীণাপাণিকে। বীণা ছাড়া জীবন কি এখন থেকেই আলুনি লাগতে শুরু করল? তার হাতে-পায়ে যেন সাড় নেই, বুকে একটুও জোর পাচ্ছে না। বড় ন্যাতানো লাগে যে নিজেকে।
বেলা বাড়ছে বলে জোর করেই একসময়ে উঠে পড়ল নিমাই। বাস ধরল। বাসে বসেই হঠাৎ তার নদেরচাঁদের কথা কেন মনে হল কে জানে।
নদেরচাঁদই বীণাকে যাত্রা দলে নিয়ে এসেছিল। বোধহয় বীণার সঙ্গে একটু আশনাইও হয়ে থাকবে। নদেরচাঁদ মেয়েবাজ মানুষ। তবে কিনা শেষ অবধি নাগালে পায়নি। ফুঁসেছিল কিছু দিন। তারপর অন্য ধান্ধায় লেগে পড়ল। সম্পর্কে একটু দূরের ভাই হয় নিমাইয়ের। অবস্থা ভাল।
পালপাড়ায় বাস থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে ভরদুপুরে সে নিজের বাড়ি না গিয়ে নদের বাড়িতে হাজির হল গিয়ে। বেশ বড় পাকা বাড়ি, ফলন্ত গাছপালা আছে। গোয়াল আছে, গরু আছে। ধানের মরাই আছে। নদের মা সম্পর্কে তার কাকিমা। তার সঙ্গে প্রথমে দেখা।
নিমাই নাকি রে? কী খবর তোদের? অনেক দিন দেখি না।
নিমাই দাওয়ায় বসে একটু দম নিয়ে বলল, এবার থেকে দেখবে। খুব দেখবে। নদে কোথায়?
ছিল তো। দেখ গে ভিতরের ঘরে।
নদে ঘরেই ছিল। জানালার ধারে বসে গোঁফে কেয়ারি করছে। শৌখীন মানুষ।
নিমাইদা যে! খবরটবর কি?
আমি তোর কাছে একটু কাজে এসেছি।
কী বলল তো! বোসো না চেয়ারটায়। হল কী তোমার? মুখচোখ ওরকম দেখাচ্ছে কেন?
নিমাই সামলাতে পারল না নিজেকে। চেয়ারে বসে দু হাতে মুখ ঢাকা দিয়ে আচমকা কেঁদে ফেলল।
আরে দেখ দেখ! হল কি গো নিমাইদা?
নিমাই মাথা নাড়ল শুধু। কিছু বলতে পারল না। তার বুকে অনেক কান্না জমে আছে। টইটুম্বুর। টুসকি লাগলেই চলকে পড়ছে আজ।
ঝগড়া করে এসেছে নাকি বীণার সঙ্গে? না কি অন্য কিছু?
নিমাই জবাব দিল অনেকক্ষণ বাদে। ধরা ফোঁপানো গলায়। বলল, নদে, আমাকে একটা কাজ জোগাড় করে দে। যেমন-তেমন কাজ।
কাজ! বলে নদেরচাঁদ চুপ করে রইল। তারপর বলল, বুঝেছি।
কী বুঝলি?
ঝগড়াই করেছে।
ঝগড়া নয়।
তবে?
সে অনেক কথা। পরে শুনিস।
বাড়ি যাও নিমাইদা। মাথা ঠাণ্ডা করো। তোমার বউ কিন্তু খারাপ মেয়ে নয়।
খারাপ কি বলেছি? বীণা খারাপ নয় তা আমার চেয়ে ভাল কে জানে? খারাপ হল কপাল।
বাড়ি যাও। আমি একটু বেরোচ্ছি। বিকেলে যাবো’খন তোমার বাড়ি। শুনব সব।
ক্লান্ত শ্রান্ত নিমাই উঠল। বলল, যাই।
শ্রীহীন, পড়ো-পড়ো টিনের ঘরের বাড়িতে যখন এসে চুল নিমাই তখনই টের পেল, তার অভ্যাস কত পাল্টে গেছে। তারাও গরিব বটে, কিন্তু এখানে যেন আরও বড় অভাবের বাঘ হানা দিয়ে গেছে।
মায়ের সঙ্গে উঠোনেই দেখা। রোদে বসে কুলোয় করে খুদকুঁড়ো কিছু বাছছে। মাটির দাওয়ায় সিঁড়িতে চাদর মুড়ি দিয়ে বসা তার জরাজীর্ণ বাবা। দৃশ্যটা খানিক দাঁড়িয়ে আগে দেখল নিমাই।
নিমাইকে দেখে মা চোখ কপালে তুলে বলে, ওমা গো! তুই!
এই এলাম একটু।
মায়ের চোখে কি একটা প্রত্যাশা, একটু লোভ চকচক করে উঠল নাকি? বনগাঁ থেকে ছেলে। এসেছে, পকেটে হয়তো মেলা টাকা!
বাবা চোখে ভাল দেখে না। ঘড়ঘড়ে গলায় যেন একটু আহ্লাদ উথলে উঠল, নিমাই নাকি রে! উরেব্বাস, কী কাণ্ড!
কাণ্ডটা যে কী তা নিমাই এদের কাছে প্রকাশ করতে পারবে না। বীণাপাণি এ বাড়ির প্রাণভোমরা। সেই বীণার সঙ্গে ছাড়ান-কাটান হয়েছে শুনলে বুড়োবুড়ি মূর্ছা যাবে।
মা বলল, খাবি তো এবেলা? চালের জোগাড় দেখতে হয় তাহলে।
কেন, চাল নেই?
মা একটু দমিত গলায় বলল, আমরা তো খুদ সেদ্ধ করে জাউ-ভাত খাই। সঙ্গে শাকপাতা, পেঁপে, ধুঁধুঁল সেদ্ধ দিয়ে দিই। সে তুই খেতে পারবি না।
খুব পারব। ওতেই হবে।
বীণাকে আনলি না বাবা?
না মা, সে বাপের বাড়ি গেছে।
ঘরদোরের অবস্থা ভাল নয়। চালের টিন ঝুরঝুর করছে। আগে বেড়ার ঘর ছিল, পরে মেটে ঘর তুলেছিল তারা। মাটির ঘরের পিছনে খিদমত দিতে হয়। লেপা-পোঁছা, মাঝে মাঝে কাদামাটি চাপান দেওয়া। তা সেসব আর মা পেরে ওঠে না। মেলা গর্ত, খন্দ তৈরি হয়েছে দেয়ালে আর ভিটেতে। তাদের বনগাঁর ঘর এর চেয়ে আর একটু ভাল, পয়-পরিষ্কার। তফাতটা দেমাক করার মতো নয়, কিন্তু তফাত একটু আছে।
বেশি কথা কইলে বিপদ। নিমাই আবার পেটে কথা রাখতে পারে না। তাই সে ঘরে এসে ধুতি জামা ছেড়ে গামছা পরে নিল। তারপর লেগে পড়ল ঘরদোর সারতে। সকালের চা আর বিস্কুট পেট থেকে অনেকক্ষণ আগে উধাও হয়ে গেছে। খিদে আঁচড়া-আঁচড়ি করছে পেটে বনবেড়ালের মতো৷ নিমাই এক ঘটি জল খেয়ে নিল। তারপর লোহার বালতি নিয়ে পুকুরে নেমে পড়ল কাদামাটি তুলতে।
মা বলল, ওরে, করিস কি? হা-ক্লান্ত হয়ে এলি, একটু জিরিয়ে নে। কিছু তো দাঁতেও কাটিসনি বাবা।
দাঁতে কাটার মতো জিনিস যে ঘরে নেই তা নিমাই জানে। চাট্টি মুড়ি খেতে হলেও দোকান থেকে বাকিতে আনতে হবে। নিমাইয়ের পকেটে এখনও কয়েকটা টাকা আছে। কিন্তু বাবুগিরি করে। নষ্ট করা যাবে না। সে বলল, শ্বশুরবাড়ি থেকে আসছি, তারা কি আর খালি মুখে ছাড়ে?।
তোর রোগা শরীর।
শরীর কি বসিয়ে রাখার জন্য মা? ঘরদোরের যা ছিরি হয়েছে, না সারালে তোমরা দেয়ালচাপা পড়ে মরবে যে।
মা শুধু বলল, তা ঠিক। আমরা কি পারি আর ওসব?
নিমাই অবশ্য পারল। অনেক বেলা অবধি বালতি বালতি মাটি টেনে ঘর সারল, উঠোনের চারধার থেকে আগাছা সাফ করল, ঘরদোর উঠোন সব নিকিয়ে ফেলল। তারপর আগুনের মতো খিদে নিয়ে বসল জাউ-ভাত খেতে।
মনে হল, অমৃত কি এর চেয়ে ভাল?
এ সবের ফাঁকে ফাঁকে বুকের মধ্যে কি বিরহের কোকিলটা ডাকেনি? ডাকছে, থেকে থেকে ডাকছে। হু-হু করে জ্বলে যাচ্ছে বুকের ভিতর শুকনো পাতা। বড় মোলায়েম করে ডাকতে ইচ্ছে যাচ্ছে, বীণাপাণি! ও বীণাপাণি!
টপ করে এক ফোঁটা চোখের জল পড়ল হাতের গরাসে। সেটা খেয়ে ফেলল নিমাই। খিদের আগুনে বিরহের আহুতি হোক। জন্মের শোধ আহুতি হয়ে যাক।
বেলা পড়ার আগেই নদে এল।
চলো নিমাইদা, একটু কোথাও গিয়ে বসি।
পালপাড়ায় বসার জায়গা মেলা। তারা গিয়ে মাঠের ধারে ঘাসে বসল।
এবার বলল, বৃত্তান্তটা কী।
নিমাই কিছুক্ষণ থম ধরে থেকে বলে, তুই আমাদের মেলা উপকার করেছিস। তোর জন্যই বীণার একটা হিল্লে হল।
সে আর বেশি কথা কিসের? তোমাকে অত গদ হতে হবে না।
বলি কি, এবার আমারও একটা হিল্লে করে দে।
সে কি কথা গো! শুনলাম যে বনগাঁয়ে তুমি মনোহারী দোকান দেবে।
সে প্রস্তাব ভেসে গেছে। সে আর হবে না।
কেন, হলটা কী?
তোকে সব বলব’খন। তবে কথাগুলো একটু আগে গুছিয়ে নিই। আমি তো ভাল কইতে পারি। হড়হড় করে সব কথা যদি বেরিয়ে যায় তাতে ভাল হবে না। কিছু কথা চাপতে হয়, কিছু ছাড়তে হয়। না গুছিয়ে কি বলতে পারি। কয়েকটা দিন সময় দে।
তা বটে। সকালে কেঁদে ফেলেছিলে, তখনই বুঝেছি ব্যাপার গুরুচরণ।
আমার একটা কাজ না হলেই নয় রে নদে। চেষ্টা করবি?
নদে একটু চিন্তিত হয়ে বলে, কাজ তো মেলা নিমাইদা, কিন্তু সেসব তোমার জন্য নয়। তুমি হলে সাধ মানুষ। মিথ্যে কথা কইবে না, চুরি করবে না, অন্য পথে যাবে না। তোমার জন্য কি এই কলিকালে কোনও কাজ আছে? তবে একটা খবর দিতে পারি তোমায়। ভাল খবর।
কী খবর রে?
তোমার সেই পুরোনো ঠিকাদারবাবু আবার এ তল্লাটে কাজ করছে।
নিমাই অবাক হয়ে বলে, তাই?
কাঁচড়াপাড়ার দিকে কি সব সরকারী ভবন-টবন হচ্ছে। একবার গিয়ে দেখতে পারো।
নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, বড় ভালবাসতেন আমায়। কিন্তু এখন কি আর চিনতে পারবেন। তাঁর মেলা লোক-লস্কর, কত জনকে মনে রাখবেন?
গিয়ে একবার পেন্নাম ঠুকে দাঁড়াও সামনে। কিছু হলে হল, নইলে মনে করে নেবে, চেষ্টা তো করেছিলাম, হয়নি তো কি করা যাবে?
খবরটা ভাল। খুবই ভাল। কিন্তু নিমাইকে মনে রাখা শক্ত। সে ছোটোখাটো, রোগাভোগা, ক্ষয়া মানুষ। মনে রাখার মতো চেহারাখানাও তো নয়।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, নিরঞ্জনবাবু তাকে মনে রেখেছেন। পরদিন সকালবেলায় যখন নিরঞ্জনবাবুর কাছে কাঁচড়াপাড়ায় গিয়ে হাজির হল নিমাই তখন নিজের নামধামও বলতে হল না। নিরঞ্জনবাবু তার দিকে চেয়েই বলে উঠলেন, নিমাই না?
নিমাই তাড়াতাড়ি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, যে আজ্ঞে।
বলেই তার চোখে জল এল কৃতজ্ঞতায়।
তা কি করছো এখন?
কিছু নয়। বসে আছি।
বিয়ে করেছিলে না?
আজ্ঞে।
তবে তো সংসার হয়েছে। চলছে কিসে?
নিমাই মাথা চুলকোলো। চোখে ফের জল আসছে।
দৈববাণীই যেন শোনা গেল নিরঞ্জনবাবুর গলায়, কাজ চাও নাকি?
নিমাই মরমে মরে গেল। উনি আসামে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, নিমাই যায়নি। সেই লজ্জা আজ তাকে অধোবদন রেখেছে।
নিরঞ্জনবাবু বললেন, তুমি ধর্মভীরু সৎ লোক। আমি এখানে আরও বছরখানেক কাজ করব। বেশিও হতে পারে। লেগে পড়তে পারো কাজে।
নিমাই নিরঞ্জনবাবুর দিকে চেয়ে জলভরা চোখে ধরা গলায় বলল, আপনার বড় দয়া।
কাঁদছো কেন? কী হয়েছে?
আজ্ঞে, কিছু হয়নি। আমার মনটা বড় দূর্বল। দয়া-মায়া দেখলে চোখে জল আসতে চায়।
পাগল আর কাকে বলে! তুমি একটা দোকান দিয়েছিলে না?
সে টেকেনি।
নিরঞ্জনবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন, চৌকিদারের চাকরি যেমন করার করবে, সঙ্গে আর একটা কাজও করতে পারো। গোডাউনের ধারেই কাজ হচ্ছে। সাইটে একটা চা-বিস্কুটের দোকানও খুলতে পারো। কাল থেকেই লেগে পড়ো কাজে। আগে যা দিতাম তার চেয়ে কিছু বেশিই পাবে। ঢাকার দাম কমছে।
নিজের কানকে, নিজের ভাগ্যকে যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না নিমাইয়ের! কলিকালে সৎ হওয়া হয়তো আহাম্মকি, কিন্তু সে বুকের মধ্যে ওইটুকু পুষে রেখেছিল বলেই নিরঞ্জনবাবুর তাকে চিনতে ভুল হল না। ওইটুকুর জন্যই ফের পুরোনো চাকরি ফিরে এল।
সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে নিমাই আজ কীর্তন করতে বসল। গাইতে গাইতে চোখ ভেসে গেল জলে। ভগবানের নামে কত জয়ধ্বনি দিল সে। এই যে মরতে মরতেও বেঁচে থাকা, এই যে প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে গিয়েও ফের ফিরে আসে, এটুকুই তাঁর দয়া।
মা বলল, আহা, কী গলাখানা তোর। শুনলে বুক জুড়োয়। গা বাবা, খুব গা।
শোওয়ার আগে আজ ঠাকুরকে উদ্দেশ করে ভক্তিভরে প্রণাম করল নিমাই। বলল, বীণাকে ভাল রেখো ঠাকুর। তার সুমতি হোক।
রাতে তার ঘুমের মধ্যে বিরহের কত ঢেউ যে এসে ভাঙল তার ঠিকঠিকানা নেই। বীণাপাণিকে স্বপ্নে দেখল। কী যে দেখল তা জাগার পর আর মনে রইল না।
সকালে পকেটের টাকা বেশিরভাগই মায়ের হাতে দিয়ে বলল, এ দিয়ে কষ্ট করে কয়েকটা দিন চালাও। আমার কাজ হয়েছে। আর তেমন কষ্ট হবে না।
ওরে, বীণাপাণির খবর কি? তোকে যে কেমনধারা দেখছি।
বললাম তো বাপের বাড়ি গেছে।
সে তো শুনলাম। কিন্তু তুই লুকিয়ে কাঁদিস কেন?
অত খতেন নিও না তো মা। নিমাই রাগ করে বলে।
খতেন নেবো না? ঝগড়া করেছিস নাকি?
না গো, ঝগড়া করার মুরোদ কি আমার? তারটা খাই, তারটা পরি, ঝগড়া করলে চলবে?
তাহলে হল কী?
কিছু হয়নি।
বড় ভয় হয় যে বাবা।
ভয় পেয়ো না। ভগবান এখনও আছেন।
নিরঞ্জনবাবু কিছু আগাম দিলেন। চাকরির পাশাপাশি দিন তিনেকের মধ্যে দোকানটাও ঠুকে দিল নিমাই। চা, বিস্কুট, কোয়ার্টার পাঁউরুটি আর ঘুগনি। লেবারাররা খুব খেতে লাগল দোকানে।
এত সব ঘটে যেতে মাত্র দিন দশেক লাগল। মাত্র দিন দশেক আগেই না এক ভোরবেলা শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে তার মনে হয়েছিল দুনিয়ায় তার আর যাওয়ার জায়গা নেই? চোখের জলে দুনিয়াটাকে ডুবজল করে ফেলেনি নিমাই? ভগবান যে এখন টাকাটা-সিকেটার বৃষ্টি নামিয়ে দিলেন সে কি এমনি?
এগারো দিনের মাথায় পুরোনো খোলটা ভাল করে ছেয়ে নিল নিমাই। সন্ধের পর সেটা ডুগডুগ করে বাজিয়ে, কখনও করতাল নিয়ে কীর্তনে বসে যায়। আজকাল নাম গান করতে তার সহজেই চোখে জল আসে। বুকের মধ্যে বিরহের কোকিলটাও বড় ডাকে। আর বুকের মধ্যেই আরও একটা ব্যাপার হয়। উত্তরে বাতাসে নাড়াবন যেমন আগুনে হু হু করে পুড়ে যায় তেমনি একটা কিছু পোড়ে। বড় জ্বালা।
বীণাপাণি ত্যাগই দিল তাহলে? খবরটাও নিল না তো! নিমাইও খবর করল না। বুকের যেখানটায় সেই রাতে খামচে ধরেছিল বীণা, সেখানটায় যেন আজও ব্যথাটা থাবা গেড়ে আছে।
এই যে নিমাইদা, কেমন খবরটা দিয়েছিলাম তোমায়?
নদে! আয়, বোস।
দুপুরের টিফিনের সময়। দম ফেলার ফুরসত নেই নিমাইয়ের। তবু ভারি কৃতার্থ লাগে নদের কাছে। যত্ন করে এক প্লেট ঘুগনি তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, খা। কেমন হয়েছে বল দেখি।
আর একটু ঝাল দিয়ে কষা করলে খুব জমত।
ওরে, কষা করলে পাঁউরুটি ডোবাবে কিসে? ঝোল না হলে হয়? দেখ না কেমন ডুবিয়ে খাচ্ছে।
তা বটে। তা কেমন হচ্ছে তোমার?
তোর জন্যই হল।
আরও বড় কিছু ধরলে পারতে। ক’টা টাকাই বা হয়।
জিব কেটে নিমাই বলে, এর বেশি চাইতে নেই। আমার তো এতেই মনে হয় রাজা-গজা হলাম। বুঝি। বুড়োবুড়ি চাট্টি খেতে পাচ্ছে, আমারও দুবেলা জুটে যাচ্ছে। আমার মত মানুষ আর কী চায় রে? এটুকু জুটলেই হল।
তোমার দ্বারা কিছু হবে না নিমাইদা। তোমার মনটাই এইটুকুন।
তা বটে। আমিও যে এইটুকুন।