জোড়াসাঁকোর বাড়ির সামনের চত্বরে একটি ঝকঝকে নতুন জুড়িগাড়ি সাজানো হচ্ছে, সেখানে ভিড় জমিয়েছে দ্বারবান ও সহিসেরা। ঘোড়াদুটি তরুণ ও তেজস্বী, ঘাড় বাঁকিয়ে বুঝে নিচ্ছে নতুন পরিবেশ। আরও পাঁচ-সাতখানা গাড়ির ঘোড়াগুলিকে দলাই মলাই করা হচ্ছে অদূরে। এই পিঙ্গল রঙের গাড়িটির গায়ে নতুন বার্নিস, ভেতরে মরোক্কো চামড়ায় মোড়া গদির আসন। দাস-দাসীরা পাশ দিয়ে যেতে যতে বলাবলি করছে, হ্যাঁ গা, এ গাড়িটে কার হল? কোন বাবুর!
খানিক পরে খাজাঞ্জিখানার পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল রবি। চব্বিশ বৎসর বয়স্ক এক সুঠাম যুবা, গালের দু পাশে সরু দাড়ি, মাথার চুল ঘাড় পর্যন্ত ঢেউ খেলানো। পায়ে মোজা পোম্প শু, পরনে কোঁচানো ধুতি ও বেনিয়ান, তার ওপর একটি চাদর জড়ানো। কাছে এসে সে গাড়িটিকে ভালো করে দেখল, মুখের লেখায় বোঝা গেল পছন্দ হয়েছে। মৃদু গলায় সহিসকে জিজ্ঞেস করল, আর কিছু বাকি আছে? এখন যেতে পারবে?
সহিস মাথা হেলাতে রবি উঠে বসল।
এই প্রথম রবির একটি নিজস্ব জুড়িগাড়ি হয়েছে। এটা তার পিতার উপহার। অবশ্য নিছক উপহার বলা যায় না, তার পদমর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলেই দেবেন্দ্রনাথ এই গাড়ির খরচ দিয়েছেন।
চুঁচড়োয় বসে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর বংশের প্রতিদিনের খুঁটিনাটি ব্যাপারেরও খবর রাখেন। সবাই তাঁকে মহর্ষি বলে, সত্যিকারের প্রাচীন ঋষিদের মতনই তিনি যেন সব সুখ-দুঃখের ঊর্ধ্বে। আবার তিনিই অতীব হিসেবি ও সংসারী। গত এক-দেড় বৎসরের মধ্যে এই পরিবারে কত বিপর্যয়ই না ঘটে গেল! পুত্রবধূ কাদম্বরী আচম্বিতে আত্মহত্যা করায় সবাই যখন বিহ্বল তখন কোনওরকম পারিবারিক কেলেঙ্কারি যাতে বাইরে না ছড়াতে পারে তার সবরকম ব্যবস্থা দৃঢ়হাতে করেছেন দেবেন্দ্রনাথ। কাদম্বরী সম্পর্কিত যে-কোনও আলোচনাও তিনি নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। তাঁর দুই কন্যা সৌদামিনী ও সুকুমারী এর মধ্যে বিধবা হয়েছে। সবচেয়ে বড় শোক, বজ্রশেলের মতন আঘাত, তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথের অকালমৃত্যু, তাও পাহাড়ের মতন অটল থেকে নীরবে সহ্য করেছেন পিতা।
এতগুলি মৃত্যুর পরও যিনি সমুদ্বিগ্বমনা, তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জাহাজি ব্যবসায়ের সমূহ ব্যর্থতায়। এ তো শুধু বিপুল পরিমাণ অর্থদণ্ড নয়, পারিবারিক সম্মানহানি, ঠাকুরদের ব্যবসায়-বুদ্ধি নিয়ে লোকে করছে। জ্যোতির ওপরেই দেবেন্দ্রনাথ সবচেয়ে বেশি ভরসা করতেন, তিনি ভেবেছিলেন এই পুত্রটিই হবে ঠাকুর পরিবারের কর্ণধার, সেই জ্যোতিই বারবার তাঁকে নিরাশ করেছে। এবার তিনি নির্দয়ভাবে জ্যোতিকে শাস্তি দিতে উদ্যত হয়েছেন, তাঁর হাত থেকে সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন। জমিদারি আয়-ব্যয়ের হিসেব রক্ষার দায়িত্ব ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের, তাঁকে সরিয়ে দিয়ে সে দায়িত্ব আবার দেওয়া হয়েছে দ্বিজেন্দ্রনাথের ওপর। আদি ব্ৰাহ্ম সমাজের সম্পাদক পদ থেকেও তিনি চ্যুত। দু-একজন পার্ষদ অবশ্য দেবেন্দ্রনাথকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন যে, স্ত্রী-বিয়োগ ও ব্যবসায়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার মতন দুটি এত বড় আঘাতে ভেঙে পড়েছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, এখন তাঁকে ব্ৰাহ্মসমাজের কাজ ও অন্যান্য দায়িত্বের মধ্যে রাখলে তিনি আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ এবারে ক্ষমাহীন।
আদি ব্ৰাহ্মসমাজের সম্পাদক পদে নিযুক্ত হয়েছে রবি। সম্পাদকই দলের প্রধান মুখপাত্র। সম্পাদককে অনেকরকম সামাজিকতা রক্ষা করতে হয়। সুতরাং তার নিজস্ব জুড়িগাড়ি না থাকলে মানায় না। দেবেন্দ্রনাথ রবির মাসোহারার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন, তার পত্নীকেও আলাদা হাত খরচ দেওয়া হয়, ওদের জন্য আলাদা মহলটি অকৃপণভাবে সাজিয়ে দেবার জন্য খাজাঞ্চিখানায় নির্দেশ দেওয়া আছে। রবি প্রতি মাসে চুঁচড়োয় এসে সমস্ত কাজকর্মের রিপোর্ট দেয়, দেবেন্দ্ৰনাথ তার দায়িত্বজ্ঞানে সন্তুষ্ট, তবু তিনি রবিকে আরও চাপের ওপর রাখতে চান, আরও ব্যস্ত রাখতে চান, যাতে সে ফাঁকা সময় না পায়! দু-একটা প্রশংসাবাক্যের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঈষৎ ভৎসৰ্নাও করেন মাঝে মাঝে। সমাজের প্রার্থনা সভার জন্য রবি একটি নতুন হারমোনিয়াম কিনতে চায়, দেবেন্দ্ৰনাথ সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে বললেন, যন্ত্রের অবশ্যই প্রয়োজন, লও পাঁচশো টাকা। কিন্তু পুরনোটাকে মেরামতের জন্য পাঠালে কেন? ওটা দিয়ে আর কি হবে? এটা অপব্যয়। এদিকে খেয়াল রাখবে!
জুড়িগাড়িটি চিৎপুর ধরে চলল সার্কুলর রোডের দিকে। তিনটি ব্ৰাহ্মসমাজকে এক করে মেলাবার জন্য সম্প্রতি একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সূত্ৰধার হয়েছেন নববিধান-এর ভাই প্রতাপচন্দ্র মজুমদার। ব্ৰাহ্মরা এখন সঙ্ঘবদ্ধ না হলে হিন্দু পুনর্জাগরণের বন্যায় যে ভেসে যাবে তা সবাই অনুভব করলেও মিলন অত সহজ নয়। সবাই মিলন চায়, কিন্তু নিজস্ব শর্তে, কেউ ছাড়তে পারে না আত্মম্ভরিতা। রবি তবু সেই আলোচনা চালাতেই চলেছে।
আদি ব্ৰাহ্ম সমাজের সম্পাদকের পদ পেয়ে রবি প্রথম দিকে দারুণ অস্বস্তিতে পড়েছিল। এ কাজ তার পছন্দ, কিন্তু জ্যোতিদাদা এখন কলকাতায় রয়েছেন, আপাতত আর বাইরে কোথাও যাবেন না, তা সত্ত্বেও তাকে সরিয়ে দিয়ে রবিকে এই সম্মানের আসন দেওয়া হল! রবি কি করে এটা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করবে? অথচ পিতার আদেশ অমান্য করারও প্রশ্ন ওঠে না। রবি এখন পারতপক্ষে জ্যোতিদাদার সামনে যায় না, এড়িয়ে এড়িয়ে চলে।
খোলা গাড়িতে চলেছে রবি, কিন্তু পথের দুপাশে তার মন নেই।
গত সপ্তাহে সে চুঁচড়োয় গিয়েছিল, তখন দেবেন্দ্রনাথ নানান বিষয়ের মধ্যে হঠাৎ এমন একটা উক্তি করেছিলেন যার মর্ম সে বুঝতে পারেনি, মনের মধ্যে একটা খটকা রয়ে গেছে। দেবেন্দ্রনাথের হাতে ছিল রবির একটি কবিতার বই ‘শৈশব সঙ্গীত’। উৎসর্গের পৃষ্ঠাটি খোলা। বইয়ের দিকে চোখ রেখে দেবেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তুমি ব্রাহ্মযন্ত্রে বৎসরে তোমার কখানি বই ছাপাবে ঠিক করেছ? তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করে দেবেন্দ্রনাথ চলে গিয়েছিলেন অন্য প্রসঙ্গে।
পিতা বরাবরই এই কনিষ্ঠ পুত্রটির কবিত্ব-শক্তির অনুরাগী। সমাজের প্রার্থনা সভার জন্য, বিভিন্ন উৎসবের জন্য রবি গান রচনা করেছে, সেগুলি শুনে দেবেন্দ্রনাথ বিশেষ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রবিকে তিনি পুরস্কার দিয়েছেন, তাকে উৎসাহিত করেছেন আরও নতুন গান রচনা করার জন্য। তবু দেবেন্দ্রনাথ ওই কথা বললেন কেন? তবে কি ব্ৰহ্মসঙ্গীত ছাড়া প্রণয়নের কবিতাগুলি তাঁর পছন্দ নয়! নিছক আধ্যাত্মিক গান আর মানুষ কত লিখতে পারে! প্রেম ছাড়া কাব্য হয়!
বালক বয়েসে রবির কবিতাগুলি একত্র করে তার দাদারা উৎসাহ নিয়ে বই ছাপিয়ে দিত। ছাপাবার খরচ তো বিশেষ নেই! আদি ব্ৰাহ্মসমাজের নিজস্ব প্রেস আছে, কাগজের দাম দাদাদের মধ্যে কেউ নিজস্ব তহবিল থেকে দিয়ে দিতেন। এখন দাদাদের সেই উৎসাহ স্তিমিত, রবিও তো আর বালকটি নেই! এখন সে নিজেই প্ৰকাশ করতে পারে। কিছু কবিতা জমে গেলেই রবির আর ফেলে রাখতে ইচ্ছে করে না, বই হিসেবে প্রকাশ করতে ইচ্ছে হয়। দুই মলাটের মধ্যে আবদ্ধ না হলে কবিতাগুলির যেন নিজস্ব রূপ খোলে না। পত্রপত্রিকায় ছাপা হলেও কেমন যেন একটা অস্থায়ী ভাব থাকে, কাব্যগ্রন্থের মধ্যে স্থান না পেলে, তা সামগ্রিক কাব্যপ্রবাহের অন্তর্গত হয় না।
রবি পরপর বই ছাপিয়ে চলেছে। গত তিন মাসে তার চারখানা বই বেরিয়েছে। তার কিছুদিন আগে বেরিয়েছিল ‘ছবি ও গান’। এত বই বুঝি আর কোনও কবির বেরোয় না? এই চব্বিশ বছর বয়েসেই রবির গ্রন্থ সংখ্যা ষোল! ব্ৰাহ্মসমাজ প্রেসে রবি এই যে পরপর নিজের বই ছাপিয়ে চলেছে, এ কি রবির স্বার্থপরতা! সে এখন সমাজের সম্পাদক, কেউ কি বলবে, সম্পাদক হয়েছে বলেই সে নিজের যত ইচ্ছে বই ছাপিয়ে যাচ্ছে!
দেবেন্দ্রনাথ কি সেই ইঙ্গিতই দিলেন!
দেবেন্দ্রনাথ শৈশব সঙ্গীতের উৎসর্গের পৃষ্ঠাটি খুলেছিলেন। তা দেখে রবির বুক শিরশির করছিল। এই কবিতা পুস্তকগুলি সে পিতাকে দেখাতে চায় না, কিন্তু সব কিছুই তাঁর কাছে পৌঁছে যায়!
এই বইয়ের উৎসর্গও নতুন বউঠানকে। ‘এ কবিতাগুলিও তোমাকে দিলাম। বহুকাল হইল তোমার কাছে বসিয়াই লিখিতাম, তোমাকেই শুনাইতাম..’।
নতুন বউঠানের স্মৃতি আর সর্বক্ষণ আঁকড়ে থাকতে চায় না রবি। সে এখন নিজেকে সৰ্বক্ষণ ব্যস্ত রাখতে চায়। বাড়িতে বন্ধু-বান্ধব ডেকে আনে। ‘ভারতী’ পত্রিকার ভার স্বর্ণকুমারী দেবী নিয়ে নিয়েছেন, তিনি ভাইদের ওপর নির্ভরশীল নন, এখন সম্পাদনায় তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন স্পষ্ট। আগে রবি একাই ‘ভারতী’র অনেকগুলি পৃষ্ঠা লিখে ভরাত, এখন স্বর্ণকুমারী রবির কাছে বেশি লেখা চান না। জ্ঞানদানন্দিনী এখন “বালক” নামে একটি নতুন পত্রিকা বার করছেন, তার প্রায় সবটাই দায়িত্ব নিতে হয়েছে রবিকে। ব্ৰাহ্ম সমাজের কাজ, পত্রিকার কাজ এই সব রবি খুবই ব্যস্ত, শোক নিয়ে বিলাসিতা করার তার সময় কোথায়!
কিন্তু বই ছাপার সময় উৎসর্গ করার জন্য যে আর কারুরই নাম মনে আসে না। কবিতাগুলির প্রুফ দেখার সময় অবধারিত ভাবে মনে পড়ে, কোন কবিতাটি কোথায় বসে কাদম্বরীকে পড়ে শুনিয়েছিল সে, শুনতে শুনতে তাঁর মুখের ভাব কেমনভাবে বদলে যেত, কখন তিনি হেসে উঠতেন, কখন সজল হয়ে উঠত। তাঁর গভীর দুটি চোখ, হঠাৎ মাথা নেড়ে নেড়ে বলতেন, না, না, এই শব্দটা ভালো লাগছে না, এখানটায় তুমি একটু বদলাও রবি…
এসব কবিতা কি অন্য কারুকে দেওয়া যায়! ‘ছবি ও গান’-এর উৎসর্গে রবি লিখেছিল, “গত বৎসরকার বসন্তের ফুল লইয়া এ বৎসরকার বসন্তে মালা গাঁথিলাম। যাহার নয়ন-কিরণে প্রতিদিন প্ৰভাতে এই ফুলগুলি একটি একটি করিয়া ফুটিয়া উঠিত, তাহারি চরণে ইহাদিগকে উৎসর্গ করিলাম।”
এরপর ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’-এর উৎসর্গে আর এত কথা নয়, শুধু “তোমাকে দিলাম।”
কিছু কিছু লোকের এমনই অসুস্থ কৌতূহল থাকে যে, তারা বারবার জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাকে’ মানে কে? কেউ কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না। ঠোঁট টিপে হাসে।
এর পরের বই ‘নলিনী’র উৎসর্গ পৃষ্ঠায় কিছু লিখতে গিয়ে রবি সাবধান হয়ে গেল। একবার ভেবেছিল, অন্য কারুর নাম দেবে? কিন্তু কার নাম? ওই সাদা পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে যে নতুন বউঠানের মুখ! সে বইয়ের উৎসর্গ পৃষ্ঠায় কিছু লেখাই হলো না শেষ পর্যন্ত। ‘শৈশব সঙ্গীত’ প্রকাশের সময় সে আবার ভাবল, ভাবের ঘরে চুরি করবে কেন? কাদম্বরী উৎসাহ না দিলে এর অনেক কবিতা লেখাই হতো না। এ বই একমাত্র তারই প্রাপ্য।
এর এক মাস পরেই ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ প্রেসে গেল। রবি যথেষ্ট সচেতন যে পরপর সব বইগুলি মৃত নতুন বউঠানকেই প্রাকারান্তরে উৎসর্গ করা হচ্ছে বলে চারপাশে একটা ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেছে। জ্ঞানদানন্দিনী ভুরু কুঁচকেছেন, বাঁকা মন্তব্য করেছেন স্বর্ণকুমারী। কিন্তু এ বই তো অন্য কারুকে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ভানু নামটাই যে তাঁর দেওয়া। এই কবিতাগুলি নিয়ে দুজনের মধ্যে কত গোপন কৌতুক ছিল, তা অন্য কেউ বুঝবেই না। নতুন বউঠান নেই, তবু তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কি করে করবে রবি!
এ বইয়ের উৎসর্গ পৃষ্ঠাতেও রবি কোনও নাম লিখল না। শুধু লিখল, ‘ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই। আজ ছাপাইয়াছি, আজ তুমি আর দেখিতে পাইলে না।’
রাস্তার খন্দে চাকা পড়ে যাওয়ায় রবির যেন ঘোর ভাঙল। তার দু চোখ দিয়ে অশ্রুর ধারা গড়াচ্ছে। ইস, দিনের বেলা, পথের মানুষ দেখতে পেয়ে গেল নাকি? তাড়াতাড়ি সে মুখ মুছল। আজকাল এই হয়েছে, যখন তখন তার চোখ দিয়ে জলের রেখা নেমে আসে! বাড়িতে, পরিচিত লোকজনদের সামনে সে সচেতন থাকে, কিন্তু পথে, কিছুক্ষণের একাকীত্বে, তার কোনও সংযম থাকে না।
বাবামশাই ওই কথাটা বললেন কেন? ব্ৰাহ্মসমাজ প্রেসে তার আর বই ছাপানো উচিত নয়? অন্য প্রকাশক তার বই চায় না। নিজে যে বইগুলি ছাপিয়েছে, তা রাশিকৃতভাবে জমে আছে, বিক্রি হয় অতি সামান্য। বঙ্কিমবাবুর বইগুলির দারুণ কাটতি, এমনকি জাল সংস্করণ পর্যন্ত বেরোয়। আর রবির লেখা পছন্দ করে না পাঠকেরা। বিক্রিই যদি না হয়, তা হলে একটার পর একটা বই ছাপিয়েই বা লাভ কি? পিপলস লাইব্রেরি, সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটারি, ক্যানিং লাইব্রেরি এই সব দোকানে অনেক বই জমা দেওয়া আছে, তারা একটা পয়সাও দেবার নাম করে না।
হঠাৎ রবির মনে পড়ল, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় নামে এক ভদ্রলোক ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরি’ নামে একটা দোকান খুলেছেন, গল্প-কবিতার বইও সেখান থেকে বিক্রি করার কথা বলছিলেন একদিন। তবে খুচরো বিক্রেতা নন, তিনি হোলসেলার হতে চান। তাঁর সঙ্গে কথা বলা দরকার।
প্ৰতাপ মজুমদারের কাছে পরে গেলেও চলবে, রবি কোচোয়ানকে নির্দেশ দিল কলেজ স্ট্রিট যেতে। সে রাস্তার সাতানব্বই নম্বর বাড়িতে বেঙ্গল মেডিকেল লাইব্রেরির বেশ প্রশস্ত দোকান। কাচের শো কেসে নতুন নতুন বই শোভা পাচ্ছে, বঙ্কিম বাবুর বইই জুড়ে আছে অনেকখানি স্থান, মাইকেল মধুসূদনের দু-তিনখানি, হেম বাঁড়ুজ্যের বৃত্রসংহার দু খণ্ড, হুতোম প্যাঁচার নকশা, তারেক গাঙুলির স্বর্ণলতা, এমনকি নবীন সেনের পলাশির যুদ্ধ। রবি বাইরে দাঁড়িয়ে সাজানো বইগুলি দেখল। তার একটি বইও নেই। পলাশীর যুদ্ধের পাঠক আছে। তার ‘প্রভাত সঙ্গীত’-এর সমাদর করার মতন কেউ নেই। লোকে কি এখনও কাহিনীমূলক কাব্যই চায়, লিরিকের মর্ম বোঝে না! কেউ কেউ রবিকে উপদেশ দেয়, তুমি মহাকাব্যের স্টাইলে একটা কিছু লেখো না কেন?
গুরুদাসবাবু খাতির করে রবিকে নিয়ে ভেতরের একটি ছোট ঘরে বসলেন। হুঁকো-কলকে আনা হল তার জন্য, আর একটা পিরিচে কয়েক খিলি পান। লেখক হিসেবে তেমন কিছু দরের না হলেও দেবেন ঠাকুরের ছেলে তো বটে! তা ছাড়া গায়ক হিসেবেও রবির বেশ নাম হয়েছে।
নানা কথার পর গুরুদাসবাবু এক অভিনব প্রস্তাব দিলেন। রবির বই তেমন বিক্রি হয় না, তিনি নিজস্ব উপায়ে, নিজের সুবিধেমতন দামে বিক্রির ব্যবস্থা করবেন, তবে কমিশনের ভিত্তিতে নয়, তিনি একসঙ্গে রবির সব কটি বইয়ের সমস্ত অবিক্রিত কপি কিনে নেবেন কিছু থোক টাকা দিয়ে। রবির ১৬টি বইয়ের মধ্যে কয়েকটি নেহাতই পুস্তিকা, ১২টি বেছে নেওয়া হল, ব্ৰাহ্মসমাজ প্রেসের গুদামে ও জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কত বই জমে আছে তার একটা মোটামুটি হিসেব কষা হল, প্রায় আট হাজার বই, তার জন্য গুরুদাসবাবু দিতে চাইলেন দু হাজার তিনশো ন টাকা।
দরাদারির প্রশ্নই ওঠে না। লাভ-লোকসানেরও হিসেব কষায় কোনও প্রয়োজন নেই, কারণ আর কিছুদিনের মধ্যেই তো এইসব ছাপানো পৃষ্ঠা উইপোকার খাদ্য হতো। তৎক্ষণাৎ চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হল, রবির হাতে অগ্রিম হিসেবে দেওয়া হল। নগদ এগারোশো টাকা।
রবির প্রায় বিহ্বল অবস্থা। এতগুলো টাকা! তার বই বিক্রির টাকা! এ পর্যন্ত লিখে সে কোনও জায়গা থেকে একটা পয়সাও পায়নি। রবি যেন কল্পনায় দেখতে পেল, এবার তার বইগুলি পৌঁছে যাচ্ছে পাঠকদের ঘরে ঘরে, দূর দূরান্তের মানুষ তার লেখা পড়ছে, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে।
এই খবর সর্বপ্রথম যাঁকে দেওয়া যেত, যিনি সবচেয়ে খুশি হতেন, তিনি আজ কোথায়? ‘অসীমে সুনীলে শূন্যে / বিশ্ব কোথা ভেসে গেছে / তারে যেন দেখা নাহি যায় / নিশীথের মাঝে শুধু / মহান একাকী আমি। অতলেতে ডুবি রে কোথায়…’
এ টাকার সদব্যবহার করতে হবে, বন্ধুবান্ধবদের ডেকে রবি একটা ভোজ লাগিয়ে দিল। প্রিয়নাথ সেন, শ্ৰীশ মজুমদার, অক্ষয় চৌধুরী এলেন, নগেন গুপ্তকে পাওয়া গেল না। তিনি করাচিতে একটি পত্রিকার সম্পাদনার চাকরি নিয়ে চলে গেছেন। রবির বালিকা বধূটি এর মধ্যেই রান্নার ব্যাপারে বেশ দক্ষতা দেখিয়েছে। জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে সে আর ফিরে যায়নি, জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকেই সে রোজ ফ্রক পরে স্কুলে যায়, আবার বাড়িতে যখন সে শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ায়, তখন আর তাকে তেমন ছোটটি মনে হয় না, রান্নাঘরের ঠাকুরদের সে পাকা গিন্নির মতন নির্দেশ দেয়।
আহারাদির আগে আড্ডা বেশ জমল সেদিন। কথায় কথায় বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসঙ্গ এসে গেল। বঙ্গদর্শন বন্ধ হয়ে গেছে, বঙ্কিমবাবুর এক জামাই ‘প্রচার’ নামে একটি পত্রিকা শুরু করেছে শ্বশুরের পৃষ্ঠপোষকতায়, অক্ষয় সরকার বার করছেন ‘নবজীবন’, এই দুই পত্রিকায় প্রাবন্ধিক হিসেবে এক নতুন ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন বঙ্কিম, তিনি এখন ধৰ্মধ্বজ। ঠিক নতুন ভূমিকাও নয়, সদ্য প্রকাশিত হয়েছে “দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাস, তার আগে ‘আনন্দমঠ’-এও তিনি প্রচারকের ভূমিকা নিয়েছেন।
আজ বঙ্কিমকে সমালোচনা করার ব্যাপারে রবির কোনও আড়ষ্টতা নেই। তারও বই বিক্রি হয়েছে, ব্ৰাহ্ম সমাজের সম্পাদক হিসেবে সে হিন্দুত্বের প্রবক্তা বঙ্কিমের বিরুদ্ধে কলম শানাচ্ছে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সে বলতে লাগল, আনন্দমঠকে মোটেই উৎকৃষ্ট উপন্যাস বলা চুলে না। চরিত্রগুলি একঘেয়ে, সব আনন্দগুলিই যেন একরকম, রক্তমাংসের মানুষ নয়, সংখ্যা। আর শান্তিকে নিয়ে যে কি অতিনাটকীয় বাড়াবাড়ি করা হয়েছে, তার ঠিক নেই!
শ্ৰীশচন্দ্র আবার বঙ্কিমের প্রবল ভক্ত, তিনি শুরু করে দিলেন তর্কযুদ্ধ।
খাওয়াদাওয়া শেষ করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল। অতিথিদের রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এল রবি। ফেরার সময় সে দেখল, তাদের এত বড় বাড়ির কোনও মহলেই এখন আর বাতি জ্বলছে না। একদা জ্যোতিদাদার মহলে আরও অনেক রাত পর্যন্ত গান-বাজনা ও আমোদ চলিত, এখন সেখানকার দ্বার বন্ধ। মাঝে মাঝে রবি সেই বন্ধ দ্বারের দিকে তাকায়, লক্ষ করে, সেখানে একটু একটু ধুলো জমছে।
নিজের মহলে এসে রবি দেখল, এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে মৃণালিনী। মস্ত বড় পালঙ্কের এক পাশে সে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে, তাকে প্রায় দেখাই যায় না। সে ঘুম-কাতুরে, প্রায় দিনই সে আগে আগে ঘুমোয়, রবির সঙ্গে তার প্রায় কথাই হয় না। ভোরে উঠেই আবার ইস্কুলে যাবার তাড়া থাকে। আজ তার বেশ ধকল গেছে। আজ সে অতিথিদের জন্য নিজের হাতে বাটিতে বাটিতে দ্বাদশব্যঞ্জন সাজিয়ে দিয়েছে।
রবির চক্ষে এখনও ঘুম নেই। ইদানিং ঘুম খুব কমে গেছে তার। অন্ধকারে বিছানায় জেগে থাকতে তার ভালো লাগে না, চক্ষে ভ্রম হয়, যেন সে নতুন বউঠানকে দেখতে পায়। কিন্তু যে মানুষটা চলে গেছে, তার ছায়ামূর্তি দেখে লাভ কি! ছায়ার সঙ্গে কথা বলা যায় না, ছায়া কোনও সান্ত্বনাও দিতে পারে না।
রবি বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
সহসা সমুখ দিয়া কে গেল ছায়ার মতো
লাগিল তরাস
কে জানে সহসা যেন কোথা কোন দিকে হতে
শুনি দীর্ঘশ্বাস।
কে বসে রয়েছে পাশে? সে ছুঁইল মোর দেহ
হিমহস্তে তার?
ও কি ও? এ কি রে শুনি। কোথা হতে উঠিল রে এ
ঘোর হাহাকার? …
সত্যিই যেন পেছনে সে কার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পায়। কে যেন চট করে সরে গেল একপাশে। গা ছমছম করে। নিজের ওপরেই সে বিরক্ত হয়। শেষ পর্যন্ত কি নতুন বউঠানকে ভয় পেতে শুরু করবে। সে! এত প্রিয় স্মৃতি, এত কান্না, এত অভিমান…
দ্রুত বিছানার কাছে চলে এল রবি। এ ঘরে একটা মৃদু গ্যাসের বাতি সারা রাত জ্বলে। স্বচ্ছ মশারি দিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট একটি পাশ বালিশ জড়িয়ে এক পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে মৃণালিনী, গোলাপি ডুরে শাড়ি পরা, খানিকটা চুল এসে পড়েছে মুখের ওপর, তার ফাঁক দিয়ে ঝিকঝিক করছে কানের হীরের দুল।
মশারি তুলে ভেতরে ঢুকুল রবি, অন্যদিন যাতে মৃণালিনীর ঘুম না ভাঙে তাই সে সন্তৰ্পণে অনেকটা দূরত্ব রেখে শোয়, আজ সে পাশে আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিল ওর মুখের চুল। সেই সামান্য স্পর্শেই চোখ মেলে তাকাল মৃণালিনী, চমকে উঠল না, উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল। রবি তার ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে দিল, তারপর তার নাক ও চোখের পাশে পাশে আঙুল দিয়ে যেন আঁকতে লাগল ছবি। মৃণালিনী তার আঙুলটা এক সময় চেপে ধরতেই রবি তাকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করতে লাগল।
ছায়ার থেকে শরীর অনেক বেশি আপন হতে পারে। শরীর অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়, এমনকি শোকও ভুলিয়ে দেয়।