কিছু কিছু গল্প আছে, যা কখনো শেষ হয় না। এই সব দিনরাত্রির গল্প তেমনি এক শেষ না-হওয়া গল্প। এই গল্প দিনের পর দিন, বৎসরের পর বৎসর চলতেই থাকে। ঘরের চার দেয়ালে সুখ-দুঃখের কত কাব্যই না রচিত হয়। কত গোপন আনন্দ, কত লুকানো অশ্রু। শিশুরা বড়ো হয়। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা যাত্রা করে অনির্দিষ্টর পথে। আবার নতুন সব শিশুরা জন্মায়।
আজ এই বাড়িতে নতুন একটি শিশু জন্মাবে। সে রহস্যময় এই পৃথিবীতে পা রাখার জন্যে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। মাতৃগর্ভের অন্ধকার তার অসহ্য বোধ হয়েছে।
শিশুটি শাহানার। শাহানা এই বিরাট খবরটা এখনও টের পায় নি। তার বোধহয় ধারণা, এমনিতেই তার খারাপ লাগছে। তবু সে নীলুকে এসে বলল, ভাবী, আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। নীলু আঁৎকে উঠে বলল, ভালো লাগছে না। মানে? কেমন লাগছে?
বুঝতে পারছি না ভাবী, কেমন যেন পিপাসা লাগছে। আর…
আর কী?
জানি না ভাবী, বড়ো ভয় লাগছে।
নীলু পাশের বাড়ি থেকে জহিরকে টেলিফোন করল। সে তার চেম্বারে নেই, বাসায়ও নেই। বাসায় ফিরবে সন্ধ্যার পর। কিংবা কে জানে হয়তো সরাসরি চলে আসবে। এ বাড়িতেই। কী সর্বনাশা। কাণ্ড! নীলু, অস্থির হয়ে পড়ল। হোসেন সাহেব এবং মনোয়ারা—দু জনের কেউই বাসায় নেই। যাত্রাবাড়ি গিয়েছেন। ফিরতে-ফিরতে রাত নটা।
শাহানা বলল, ভাবী, আমার কি সময় হয়ে গেছে?
বুঝতে পারছিনা। শুয়ে থােক। এখনো কি আগের মতো খারাপ লাগছে?
না, এখন আর আগের মতো খারাপ লাগছে না। তুমি আমার পাশে বসে থাক।
নীলু বসল। তার পাশে। শাহানা লাজুক স্বরে বলল, আমি জানি আজই সেইদিন।
কী করে জানলে?
দেখছ না, বাসায় একটা মানুষ নেই, শুধু তুমি আর আমি। টুনির জন্মের সময়ও তো এ রকম হল। তোমার মনে নেই, ভাবী?
নীলু জবাব দিল না। বিকেলের স্নান আলোয় তার চেহারাটা দ্রুত অন্য রকম হয়ে গেল। টুনির কোনো কথা সে মনে করতে চায় না। কিন্তু কেউ তা বুঝতে পারে না। কারণে-অকারণে এই প্রসঙ্গ নিয়ে আসে।
টুনি দু বছর আগে জার্মানির এক হাসপাতালে মারা গেছে। নিঃসঙ্গ মৃত্যু অবশ্যি হয় নি। রুইনবাৰ্গ শহরের সব কটি বাঙালি পরিবার হাসপাতালে উপস্থিত হয়েছিলেন। আত্মীয়-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ছোট্ট বালিকাটিকে ঘিরে বসে ছিলেন। টুনি যত বার বলেছে আমার আমি, আমার আমি, ততবারই তাঁদের চোখে অশ্রুর বন্যা নেমেছে। এইসব প্রবাসী বাঙালিরা চাঁদা তুলে নীলুর জার্মানি আসার টিকিট পাঠিয়েছিলেন, যাতে নীলু তার মেয়েটির পাশে থাকতে পারে। অহঙ্কারী নীলু তাতে রাজি হয় নি। বারবার বলেছে, ভিক্ষার টাকায় আমি যাব না। নীলু এবং শফিক এই দু জনের জার্মানী যাওয়া-আসা এবং থাকার যাবতীয় খরচ শারমিনের বাবা দিতে চেয়েছিলেন। তাতেও কেউ রাজি হয় নি। ওর টাকা কেন নেবে? শারমিন এবং রফিকের ডিভোর্স হয়ে গেছে। এই পরিবারটির সঙ্গে তাদের এখন আর কী সম্পর্ক? কিন্তু একেবারেই কি সম্পর্ক নেই?
শারমিন থাকে আমেরিকায়। টুনির মৃত্যুর আগের দিন আমেরিকা থেকে সে জার্মানি চলে এল। টুনি মারা গেল শারমিনের কোলে মাথা রেখে। তার ছোট-ছোট হাতে সে সারাক্ষণই তার ছোট চাচীকে জড়িয়ে ধরে ছিল। যেন হাত ছাড়লেই চাচী কোথায়ও চলে যাবে। সেইসব হৃদয় ভেঙে-দেওয়া কাহিনী খুব গুছিয়ে শারমিন লিখেছিল। নীলু প্রায়ই ঐ চিঠি বের করে পড়ে। পড়তে-পড়তে তার কাঁদতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কান্না আসে না। টুনির মৃত্যুর পর কী-যে হয়েছে, সে কাঁদতে পারে না। স্মদিও প্রায়ই তার কাঁদতে ইচ্ছে করে।
কত দিন হয়ে গেল টুনি নেই, তবু তার ছোট্ট ফুল-আঁকা বালিশ প্রতি রাতেই বিছানায় পাতা হয়। বালিশটা মাঝখানে রেখে একপাশে শোয় শফিক, অন্য পাশে নীলু তারা দু জনই কল্পনা করে, মেয়েটি দুজনের মাঝখানেই শুয়ে আছে। শফিক মেয়ের গায়ে হাত রাখতে যায়। নীলুও হাত বাড়িয়ে দেয়। টুনিকে তারা খুঁজে পায় না। একজন হাত রাখে অন্য জনের হাতে। শব্দহীন ভাষায় দু জন দু জনকে সান্ত্বনার কথা বলে।
কত বদলে গেছে সব কিছু। সবচে বেশি বদলেছে। রফিক। প্রায় রাতেই মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে। কারো চোখের দিকে তাকায় না। মাথা নিচু করে নিজের ঘরে ঢুকে যায়। সারা রাত তার ঘরে বাতি জ্বলে। বাতি নেভালেই সে নাকি কী-সব দেখে। কবির মামা নাকি তার ঘরে হাঁটাহাঁটি করেন। এক দিন নাকি টুনিকেও দেখেছে। টুনি তাকে বলেছে, তুমি এমন হয়ে গেছ কেন, সবাই তোমাকে খারাপ বলে!
কী করব রে মা, আমি মানুষটাই খারাপ।
তোমাকে খারাপ বললে আমার খুব খারাপ লাগে।
না, আর খারাপ হব না। তোকে কথা দিলাম। মদ ছেড়ে দিলাম। নো লিকার।
কিন্তু পরদিন আরো বেশি করে খায়, ঘোর মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে ফিসফিস করে বলে, সব বাতি জ্বেলে রাখবে ভাবী। বাতি নেভালেই ওরা আসে। বড়ো বিরক্ত করে। সবচে বেশি বিরক্ত করে টুনি। কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান অসহ্য।
টুনির কথা নীলু মনে করতে চায় না। তবু বারবার সবাই তাকে টুনির কথা মনে করিয়ে দেয়। হোসেন সাহেব প্রায় রাতেই ঘুমের ঘোরে চেঁচান-ও টুনি, টুনি। নিজের চিৎকারে তাঁর নিজেরই ঘুম ভেঙে যায়। বাকি রাতটা তিনি ছেলেমানুষের মতো চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে কাঁদেন। নীলু ও শফিক সেই কান্না শোনে। আহ, কী কষ্ট! কী কষ্ট! বেঁচে থাকা বড়ো কষ্টের।
শাহানা বলল, ও ভাবী, আবার যেন কেমন লাগছে। ওরা তো কেউ এল না। আমার বড়ো ভয় লাগছে। আমাকে তুমি হাসপাতালে নিয়ে যাও।
নীলু উদ্বিগ্ন হয়ে ঘর থেকে বেরুল আনিস কোত্থেকে যেন ফিরছে। নীলু বলল, আনিস, একটা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আস তো, মনে হচ্ছে শাহানাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
আমি এক্ষুণি নিয়ে আসছি। আপনি ওর কাছে গিয়ে বসুন।
শাহানার কাছে বসতে ইচ্ছা করছে না। নীলু বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রফিকের ঘর হাট করে খোলা। এই সময় সে কখনও ঘরে থাকে না থাকলে ভালুড় প্রয়োজনের সময় কাউকেই পাওয়া যায় না।
ভাবী!
নীলু চমকে তাকাল। রফিক দাঁড়িয়ে আছে। কখন যে সে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেছে।
হচ্ছে কী ভাবী?
শাহানার পেইন উঠেছে। তুমি সবাইকে খবর দাও।
অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসব?
অ্যাম্বুলেন্স লাগবে না। আনিস আনতে গেছে। তুমি জহিরকে খবর দেবার ব্যবস্থা করে যাত্রাবাড়িতে চলে যাও। বাবা-মাকে নিয়ে এস।
রফিক চলে যেতে গিয়ে থমকেও দাঁড়িয়ে লাজুক গলায় বলল, শারমিন এগার তারিখে দেশে ফিরছে। ভাবী। আমাকে চিঠি লিখেছে।
হঠাৎ তোমাকে চিঠি?
আমার কাছে আবার ফিরে আসবে। চিঠিতে তাই লেখা। আবার সব আগের মতো হয়ে যাবে।
ভালো, খুব ভালো।
রফিক হাসছে। কত দীর্ঘ দিন পর নীলু ওর মুখে হাসি দেখল। নীলু ভুলেই গিয়েছিল রফিক হাসতে পারে ভেতর থেকে শাহানা ভয়ার্ত গলায় ডাকছে, ভাবী, তাবী। নীলু নড়ছে না। অবাক হয়ে দেখছে, অনেক দিন পর তাদের পাশের জলা জায়গাটায় বীকে বীকে বালিহাঁস নামছে। পাখিরা শহর পছন্দ করে না। এবার কী হল তাদের। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি নামছে কেন? বিদ্যুৎ চমকের মত নীলুর মনে হল, টুনির জন্মের সময়ও ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস নেমেছিল।
নীলু ঘরে ঢুকল। নতুন শিশু আসছে। কত দীর্ঘ দিন সে এই থাকবে। হাসবে, খেলবে, গাইবে। তার আগমনের সমস্ত প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। আয়োজনের কোনো ত্রুটি থাকা চলবে না।
শাহানা কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, তুমি বারবার কোথায় চলে যাচ্ছ, ভাবী?
আর যাব না। এই বসলাম তোমার পাশে।
বড়ো ভয় লাগছে, ভাবী।
নীলু কোমল স্বরে বলল, কোনো ভয় নেই।
ঘরের জানালা খোলা। ঘন হয়ে সন্ধ্যা নামছে। বালিহাঁসের পাখার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। অনেক দিন পর ওরা আবার এল।
নীলু লক্ষ করল, তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। ভুলে যাওয়া কান্না সে আবার ফিরে পেয়েছে। ব্যথায় ছটফট করছে শাহানা। মাতৃগর্ভে বন্দী শিশু মুক্তির জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে। কত না বিস্ময় অপেক্ষা করছে শিশুটির জন্যে!
W T F