এ বাড়িটা অভিশপ্ত কি না তা অনেক ভেবেও স্থির করতে পারল না দীপনাথ। প্রকৃতপক্ষে অভিশাপ-টাপ গোছের কিছুকেই সে বিশ্বাস করে না। তার ঈশ্বরবিশ্বাস বলেও তেমন কিছু নেই। সে ভূত-প্রেতও মানে না বহুকাল। তবু বড়দা মল্লিনাথের এই শখের বাড়ির বাগানে বসে সে আজ এক দীর্ঘশ্বাস ও অভিশাপকে টের পায়।
যখন গরিব ছিল তখনই ভাল ছিল মেজদা। যেই বড়দার সম্পত্তি পেল অমনি সত্যিকারের গরিব হয়ে গেল। আজ শ্রীনাথ ও তৃষার সমস্যা বোধ হয় চিকিৎসার অতীত। দুটো মানুষের মধ্যে ফেনিয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত ও বিচিত্র শত্রুতার জটিলতা। তার মধ্যে তৃতীয় কোনও মানুষ ঢুকতেই পারবে না।
আজ মেজদার জন্য খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ে দীপনাথ। মাথা নিচু করে ঘাস ছিড়ছিল সে। এমন সময় সজল খুব কাছ থেকে ডাকল, বড়কাকা!
দীপ মুখ তুলে হাসে, বলো।
সজলের মুখশ্রীতে তার মায়ের আদল। কিন্তু লম্বাটে গড়ন আর চোখমুখে নির্ভীক এক দৃঢ়তার ভাব থাকায় তাকে ঠিক শ্রীনাথের ছেলে বলে মনে হয় না বটে। এটুকু মল্লিনাথের। বউদি কথাটা সেদিন স্বীকার করেনি। স্বীকার করার দরকারও নেই। সজল বড় হলে কথাটা আপনি স্বীকৃতি পেয়ে যাবে।
আগে দীপ, পিছনে সজল ভাবন-ঘরের বারান্দায় উঠে এল। দরজা ভেজানো। ঠেলে ঢুকবার মুখে বৃন্দা পথ আটকাল, কোথায় ঢুকেছ এসে বাবুরা? রুগির ঘর যে! অমন হুটহাট ঢুকলে হবে কেন?
দীপ মৃদু স্বরে বলে, রুগির ভালর জন্যই আসা।
পিছন থেকে সজল হুমকি দিয়ে ওঠে, তোমার সব তাতেই অত সর্দারি কেন বলল তো বৃন্দাদি! মারব একদিন ঝাপড়।
সজলের একখানা হাত নিঃশব্দে চেপে ধরে দীপনাথ এবং সজল চুপ করে যায়।
বৃন্দা বলে, বাবু এখন ঘুমোচ্ছে। একটু আগে ওষুধ দিয়েছি, কিন্তু খেল না।
কেন খেল না?—দীপনাথ জিজ্ঞেস করে।
ঠোঁট উলটে বৃন্দা বলে, ভগবান জানে। ঘুমের ঘোরে ভুল বকছিল না কী, বলল তো ওষুধে বিষ আছে।
সত্যিই ঘুমিয়েছে তো?
মটকা মেরে পড়ে থাকলে ঠিক বুঝতাম। তা নয়। নাক ডাকছে। পা টিপে টিপে এসে দেখে যাও।
দীপনাথ আর সজল নিঃসাড়ে ঘরে ঢোকে। শ্রীনাথ বাঁকাতে শুয়ে বাস্তবিকই ঘুমোচ্ছ। শিশুর মতো অসহায় গভীর ঘুম।
দু’জনে আবার নিঃসাড়ে বেরিয়ে আসে।
সজল বলে, বড়কাকা, তা হলে কী হবে?
তোমার বাবা যখন ঘুম থেকে উঠবেন তখন এসে সত্যি কথাটা এক ফাঁকে জানিয়ে যেয়ো ওঁকে।
আচ্ছা।
বাবাকে ভালবাসো তো সজল?
সজল হাসে। মাথা নিচু করে বলে, বাসি। তবে বাবা একটু কেমন যেন। আর সকলের মতো নয়।
তা হোক। সবাই তো সমান হয় না। বাবাকে একটু ভালবেসো। দুনিয়ায় খুব কম লোকই তোমার বাবাকে ভালবাসে। তুমি কিন্তু বেসো।
আচ্ছা।
আর-একটা কথা।
কী?
তোমার বাবা কাল রাতের ওই বোমার পর থেকে খুব ভয়ে ভয়ে আছে। ওঁর সন্দেহ কেউ ওঁকেও খুন করবে। তুমি এখন থেকে বাবার কাছে থেকো। পারবে?
মাকে রাজি করাও, পারব।
তোমার মাকে আমি বলে যাব।
কিন্তু মা রাজি হবে না।
কেন?
বাবা যে মদ খায়। মাতাল হলে যা-তা বিশ্রী গালাগাল দেয়।
সে অন্য সময়ে। এখন তোমার বাবা অসুস্থ। মদ খাওয়া বা গালাগাল দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।
বলছি তো, মা বললে থাকব।
সজলকে ভিতরবাড়ি পর্যন্ত আর টেনে নিল না দীপ। মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে বলল, এবার খেলতে যাও।
সজল এক ছুটে ফটক পেরিয়ে পালাল।
দীপনাথকে খুঁজতে হল না। ভিতরবাড়িতে ঢুকবার মুখেই বউদির সঙ্গে দেখা। ট্রেতে তোয়লের ঢাকনা দেওয়া খাবার চাকরের হাতে সাজিয়ে নিয়ে তৃষা ভাবন-ঘরে যাচ্ছে।
দীপ বলল, দাদা ঘুমোচ্ছে। অঘোর ঘুম।
তৃষা একটু শুকনো মুখ করে বলল, দুপুরেও প্রায় কিছু খায়নি।
এখন জাগিয়ে খাবার দিতে যেয়ো না। জাগলে বরং দিয়ো। দীপনাথ সতর্কভাবে বলে। সে জানে বিষপ্রয়োগের ভয়ে শ্রীনাথ খাবার দেখলে ভয় পাবে, চেঁচামেচিও করতে পারে। দীপনাথ মণিদীপার উপস্থিতিতে ঘটনাটা ঘটতে দিতে চায় না।
তৃষা চাকরকে বলে তবু, ট্রে-টা বৃন্দাকে পৌঁছে দিয়ে আয়। বলিস বাবু জাগলে দুধটা যেন গরম করে দেয়।
শোনো বউদি।–দীপনাথ খুব সিরিয়াস মুখে বলে।
কী? বলল।
আজ থেকে দাদার কাছে রাত্রিবেলা সজলকে রেখো।
সজলকে! কেন বলো তো?
দাদা তো ভিতু মানুষ জানোই।
তা খুব জানি। কিন্তু তার জন্য সজল কেন? সরিৎ আছে, মংলা আছে, নিতাই আছে।
দাদার কাছে সজলের থাকাই ভাল।
সজল! না না। তা হয় না।
কেন হয় না?
সজল ছেলেমানুষ, সে কী করবে?
কিছু করতে হবে না, শুধু থাকবে।
রুগি পাহারা দেওয়া কি ছেলেমানুযের কাজ? বরং আমি নিজেই থাকবখন। আমার তো ভয়ভীতি বলতে কিছু নেই।
তবু সজলকে রাখবে না?
তুমি আচ্ছা এক ছেলেমানুষ। বলছি না যে, রুগি দেখাশোনা করতে হলে সজলকে দিয়ে হবে না।
তা অবশ্য ঠিক। তবু সজল যদি ঘরে থাকে তবে দোষ কী? দাদা যখন ভাল হয়ে উঠবে তখন প্রতি রাতেই যদি সজল ওঁর কাছে থাকে তবে বোধহয় ভালই হবে। মেজদাকে একটু বুঝতে দেওয়া দরকার যে ওর আপনজন কেউ আছে।
এ কথায় স্পষ্টতই তৃষার চোখেমুখে একটা দুর্ভাবনা ফুটে ওঠে। সে বলে, পাগল হয়েছ? বোজ রাতে গিয়ে ও-ঘরে থাকলে একদিন সজলের গলা টিপে ধরবে না!
অবাক দীপনাথ বলে, কে ধরবে? মেজদা?
তৃষা একটু লজ্জা পায়। বলে, সজল আমার একটামাত্র ছেলে, জানোই তো। ওকে কোনও রিস্কের মধ্যে ফেলতে চাই না।
রিস্ক কিসের?
আছে। সব তুমি বুঝবে না।
একটু বিরক্তির গলায় দীপনাথ বলে, রিস্কই যদি থাকবে তবে সজল সন্ধের পর মেজদার কাছে পড়া বুঝতে যায় কী করে?
যায়, কিন্তু কখনও একা যায় না। সজল নিজেও জানে না, ওর পিছনে লোক থাকে। ঘরের আশেপাশেও আমি পাহারা রাখি। চোখের আড়াল হতে দিই না।
এ কথাটার মধ্যে যেন মেজদাকে জড়িয়ে তাদের পুরো বংশের ওপরেই একটা কলঙ্ক আবোপ করা হল। অপমানে হঠাৎ দীপনাথ তেতে ওঠে, লাল হয়। কিন্তু মুখে জবাবও আসে না। শ্রীনাথ তাদের পুরো পরিবারকে এত দূর অধঃপাতে টেনে নামিয়েছে।
তৃষা মুখ তুলে ভিখিরির মতো গলায় বলে, দোষ নিয়ো না। ওকে বিশ্বাস করার উপায় আমার নেই। আমি অনেক ঠকে, অনেক ঠেকে অনেক শিখেছি।
দীপনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল, ঠিক আছে।
তোমার মেজদা কি তোমাকে কোনও ভয়ের কথা বলেছে?
বলেছে।
কী বলেছে?
দীপনাথ আনমনে বলে, ওই ভয়টয়ের কথা।
তৃষা আর প্রসঙ্গটা বাড়ায় না। বলে, এসো। উনি বসে আছেন।
থাকুন না। উনি তত তোমাদের কাছেই এসেছেন।
তৃষা বলল, তা বটে। তবু তোমার একেবারে বেপাত্তা থাকা ভাল নয়। কিছু ভাববে।
ওরা অত ভাবে না।
তুমি তবে কী করবে এখন?
একা একা একটু ঘুরে বেড়াই।
আজ এখানে এসে তোমার ভাল লাগছে না!
না বউদি। মনটা ভাল নেই।
তোমার বউদির কপালটাই খারাপ।
কাল রাতে কারা এসে নাকি তোমাকে বোমা মেরেছিল! কই, বলোনি তো!
তৃষা মুখ টিপে হেসে বলল, মরলে তো বাঁচতাম।
গেঁয়ো মেয়েদের মতো কথা বোলোলা না। কী হয়েছিল?
কী করে বলব? কুকুরটা চেঁচাচ্ছিল শুনে উঠে দরজা খুলতেই ভীষণ কাণ্ড।
তোমার কোথাও লাগে-টাগেনি তো?
না। আমার কইমাছের প্রাণ। লাগলেও মরতাম না।
তুমি কাউকে সন্দেহ করো?
তৃষা চিন্তিত মুখ করে বলে, কাকে সন্দেহ করব? আমার শত্রুর অভাব তো নেই, কিন্তু এতটা কেউ করবে বলে ভাবিনি কখনও।
মেজদার কোনও হাত আছে বলে সন্দেহ হয়?
তৃষা বড় বড় চোখে দীপনাথের মুখের দিকে অকপটে চেয়ে বলে, হঠাৎ এ কথা কেন?
মেজদাই বলছিল, তুমি নাকি ওকে সন্দেহ করছ!
তৃষা মাথা নেড়ে ধীরে কেটে কেটে বলে, না। সে প্রথম একটু সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, মেজবাবুও অতটা করবে না। তার সেই সাহস নেই। তবে ওর শুভাকাঙ্ক্ষী তো অনেক। তারা কেউ এ কাণ্ড করেছে কি না কে বলবে?
মেজদা লোক ভাল নয় বউদি, সবাই জানে। তবু বলি, আমাদের চার ভাইয়ের মধ্যে মেজদা আর সোমনাথের কোনও কিলার-ইনস্টিংক্ট নেই। ওরা রক্ত দেখতে ভয় পায়। বাকি দু’জন? বলে তৃষা চিকচিকে চোখে তাকায়। মুখ টিপে হাসে।
বড়দার ছিল। ইনফ্যাক্ট বড়দা এক-আধটা খুনখারাপি করেছে বলে শুনলেও আমি অবাক হব না।
আর তুমি?
আমার কথা আমি নিজে বলি কী করে? তবে আমাকে যদি কেউ কোণঠাসা করে ফেলে, যদি মরিয়া করে তোলে তা হলে কাউকে খুন করা আমার পক্ষে হয়তো তেমন অসম্ভব নয়।
মাগো! বোলো না, শুনলে ভয় করে।
দীপনাথ খুব কষ্ট করে মুখে হাসি টেনে বলল, ঢং কোরো না বউদি, আমি তোমাকে জানি। ভয়ডর তোমার কুষ্ঠিতে লেখা নেই। বোমা মারার ব্যাপারে তোমার মেজদাকে সত্যিই সন্দেহ হয় না তো?
বললাম তো, না।
তা হলে সজলকে মেজদার কাছে রেখে স্বস্তি পাও না কেন?
তৃষা একটু থমকে গিয়ে বলে, তুমি আজকাল বড় জেরা করো, দীপু। সব কথা তোমাকেও বলা যায় না। তবু জেনে রাখো, আক্রোশ মানুষকে অনেক দূরে টেনে নামাতে পারে।
দীপনাথ চিন্তিত মুখে বলে, তাই দেখছি।
আমার মতো বয়স হোক, আরও অনেক কিছু দেখবে।
দীপনাথ ভ্রুকুটি করে বলে, তোমার বয়স কত?
তোমার চেয়ে পাঁচ-ছ’ বছরের বড়।
ইয়ারকি কোরো না। বিয়ের সময় তুমি নিতান্ত ছুকরি ছিলে। খুব বেশি হলে তুমি আমার সমান বয়সি বা এক-আধ বছরের ছোটই হবে।
খুব টেক্কা মারার শখ, না?
তোমারই বা অত বুড়ো সাজার বাই কেন? এই সেদিনও রঙিন শাড়ি পরা নিয়ে ঝামেলা করছিলে।
বয়স হয়েছে গো। তুমি যতই আমাকে খুকি দেখতে চাও না কেন, বয়স বসে নেই। এখন ঘরে চলো তো!
তোমার ঘর খুব সুন্দর বউদি, কিন্তু আমার বাইরেটাই বেশি ভাল লাগছে।
তুমি কি মণিদীপাকে লজ্জা পাও, দীপু?
যাঃ, কী যে বলো! লজ্জার ব্যাপার নয়, তবে অনারেবল ডিসট্যান্স বজায় রাখি মাত্র।
আমার রিপ্রেজেনটেটিভ হয়ে একটু গিয়ে ওঁর কাছে বোসো। আমি গিয়ে তোমাদের খাবারদাবারের ব্যবস্থা দেখি।
খাওয়ার দরকার নেই। যত দূর জানি মিসেস বোস ডায়েটিং করছেন, আর আমার আজকাল খিদে পায় না।
তবু। বহুদুর থেকে এসেছ। এসো, গুরুজনদের কথা শুনতে হয়।
কিন্তু ঘরে মণিদীপা ছিল না। আশেপাশে কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
নিজের মস্ত ভ্যানিটি ব্যাগে লুকিয়ে দুটো জিনিস এনেছিল মণিদীপা। একটা ছোট ক্যামেরা আর একটা টেপ-রেকর্ডার।
তৃষা গৃহকর্মে গেলে সে ফাঁকা ঘরে একটুক্ষণ বসে ছিল। তারপর পায়ে পায়ে বেরিয়ে এল বাইরে।
আগেরবার এসে একটা ছোটখাটো আম্রকুঞ্জে বিস্তর মৌমাছির চাক দেখে গিয়েছিল। গাছের জড়াজড়ির মধ্যে নীচে ঘন ছায়া। সেই জায়গায় সারাক্ষণ সেতারের ঝালার মতো মৌমাছির গুঞ্জন। তা ছাড়া চারদিক থেকে আচমকা আচমকা অদ্ভুত পাখির ডাক চলে আসে। গাছের পাতার ভিতর দিয়ে দমকা বাতাস বয়ে যাওয়ার রহস্যময় শব্দ ওঠে।
জায়গাটা খুঁজে বের করতে কষ্ট হল না তার। বাড়ির পিছন দিকে একটু চোখের আড়াল জায়গা। কেউ তেমন নজর দেয়নি বলে এদিকটায় ঝোপঝাড় গজিয়ে উঠেছে। এখনও মাঝে মাঝে শরতের খেয়ালখুশির বৃষ্টি আসে বলে মাটি সঁতসেঁতে ভেজা।
কুঞ্জবনের মধ্যে বড় বড় ঘাস, ঘন ছায়া। জমজমাট শব্দের আসর বসেছে। নাক-মুখ ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে মৌমাছি। মণিদীপার গায়ে একটু কাটা দেয়। টেপ-রেকর্ডারটা বের করে ঘাসের ওপর রাখে সে। বোতাম টিপে যন্ত্রটা চালু করে সে সরে আসে বাইরে।
পঁয়ত্রিশ মিলিমিটারের ক্যামেরায় এলোপাথাড়ি ছবি তুলতে থাকে। চারদিকে শুধু গাছপালা। এই জঙ্গলের ছবি তুলে তেমন লাভ নেই ভেবে মণিদীপা একটা জুতসই পাখি খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির বিশাল সীমানার মধ্যে অনেকটা চলে গিয়েছিল। আচমকা কে ডাকল, সেলাম মেমসাহেব।
মণিদীপা তাকিয়ে দেখে একটা অত্যন্ত হতদরিদ্র কুটিরের দরজায় সাধুগোছের একটা লোক দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোচ্ছে।
গরিব দেখলেই মণিদীপার আবেগ জেগে ওঠে। সে বলে, তুমি কি এই বাড়ির কাজের লোক?
ঠিক কাজের লোক নই মেমসাহেব, আমি হচ্ছি যোগী নিত্যানন্দ। অনেকে নিতাই অবধূতও বলে। মারণ উচাটন বশীকরণ যা দরকার বলবেন, কাজ হয়ে যাবে।
মণিদীপা সাধু-সন্তদের পাত্তা দেয় না। শুধু এ লোকটা গরিব বলেই তার যা কিছু কৌতূহল। সে দু’পা এগিয়ে গিয়ে বলে, এই ঘরে তুমি থাকো?
আজ্ঞে।–নিতাই এক পা পিছিয়ে যায়।
দেখি তো তোমার ঘরটা।
এই চোস্ত মেয়েটা তার ঘরে ঢুকবে ভেবে নিতাই একটু বিপদে পড়ল। এ বাড়িতে যারা আসে তাদের তো এ ঘরে ঢোকার কথা নয়। বউদি শুনলে আবার না তার বাপান্ত করে ছাড়ে। তাই সে বলল, আজ্ঞে ভিতরে ভয়ের জিনিস আছে। করোটি, কঙ্কাল আরও কত কী! মেয়েদের ঢোকা বারণ।
তুমি ওই সব বুজরুকি করে বেড়াও?
এসব কথা নিতাই অনেক শুনেছে। মাথা চুলকে বলল, বুজরুকি হবে কেন মেমসাহেব, খাঁটি জিনিস লোকে সহজে চিনতে চায় না। একটা কথা বলব, রাগ করবেন না?
না, রাগের কী? বলল।
আমার একটা ফোটো খিঁচে দেবেন?
মণিদীপা হাসে, দেব না কেন? এসো, আর একটু আলোর দিকে সরে এসো।
দাঁড়ান তা হলে, জিনিসপত্র সব নিয়ে আসি।
বলে নিতাই মুহূর্তে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। কয়েক মিনিট বাদে যখন বেরিয়ে এল তখন তাকে আর চেনা যায় না। সর্বাঙ্গে ধুনির ছাই মাখা, গলায় হাড়ের আর রুদ্রাক্ষের দু’গাছি মালা, এক হাতে নরকরোটি পানপাত্র, অন্য হাতে সিদুর মাখা ত্রিশুল।
মণিদীপা হেসে ফেলে বলে, তোমাকে একদম ক্লাউনের মতো দেখাচ্ছে।
খুব জুত করে তুলবেন। সবটা যেন ওঠে।
বলে খুব গম্ভীরভাবে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় নিতাই।
মণিদীপা তার গোটা তিনেক ছবি তুলে নিয়ে বলে, তুমি তো সাধু মানুষ, ফোটো দিয়ে কী করবে?
যজমানদের দেব। তারা পুজো করবে।
বলো কী?
নিতাই খুব লজ্জার সঙ্গে হেসে বলে, আজ্ঞে তারা খুব মানে আমাকে।
ধর্মটর্ম সব নির্মাদের ব্যাপার। তুমি আর কোনও কাজটাজ করো না?
এই করেই বলে সময় পাই না। আর কাজ করব কখন?
মণিদীপা বলল, চলো তোমার ঘরটা দেখাবে আমাকে।
এবার নিতাই খাতির করে বলল, আসুন আজ্ঞে। সাধু-সন্নিসির ঘর আপনার হয়তো অসুবিধে হবে।
না, না, আমার কোনও অসুবিধে নেই।
সারা বাড়ি আর বাগান তোলপাড় করে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে যখন দীপনাথ নিতাইয়ের ঘরে উঁকি দিল তখন চোখ কপালে উঠল তার। নিতাইয়ের পঞ্চমুণ্ডীর আসনের ওপর মণিদীপা বাবু হয়ে আঁট করে বসে আছে। নিতাই তার সামনে মাটিতে ছক কেটে বাণ মারার কায়দা দেখাচ্ছে।