1 of 2

৪৭. শ্রীলেখার সঙ্গে সান্ত্বনার

শ্রীলেখার সঙ্গে সান্ত্বনার স্বভাবের কোনও মিল নেই। ওরা দুজনে একসঙ্গে বড় হয়ে। উঠেছে, দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্বও আছে, কিন্তু চরিত্র একেবারে আলাদা। শ্রীলেখা সরল ও নম্র স্বভাবের মেয়ে তার চোখের চাহনিতে সব সময়ই এই ভাবটা থাকে, কেউ কিছু মনে করছে না তো?

সান্ত্বনার চোখের দিকে তাকালে কিছুই বোঝা যায় না। কোনও অচেনা লোকও তার। চোখের দিকে তাকালে সে চোখ ফিরিয়ে নেয় না কখনও। ছেলেবেলা থেকেই সে খুব চাপা ও গম্ভীর স্বভাবের। এক এক সময় মনে হয় তার শরীরে দয়ামায়াও খুব কম। বাদল। তার নিজের দিদির চেয়ে শ্রীলেখার কাছেই বেশি আবদার করেছে।

শ্রীলেখার বিয়ের আগে সূর্যর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা আর যারই চোখে পড়ুক বা না পড়ুক, সান্ত্বনা সবই জানত। কিন্তু কোনও দিন সে এ-সম্পর্কে একটাও কথা উচ্চারণ করেনি, শ্রীলেখাকেও কিছু বলেনি। শেষের দিকে বাড়ির বড়রা যখন এ নিয়ে আলোচনা করতেন, সান্ত্বনা সেখান থেকে উঠে যেত নিঃশব্দে। সূর্যর সঙ্গে সান্ত্বনারও একসময় বেশ ভাব ছিল, অথচ একসময় সে সূর্যর সঙ্গে কথা বলাই প্রায় বন্ধ করে দেয়।

সান্ত্বনার কতকগুলো স্বাভাবিক দক্ষতা আছে। সেলাই টেলাই বা বোনার কাজ সে অনেক মেয়ের চেয়েই বেশি ভালো পারে। কিন্তু এদিকে তার কোনও ঝোঁক নেই। শখ করে সে কখনও সেলাই নিয়ে বসে না। রান্নাবান্নার দিকেও তার উৎসাহ নেই, কখনও দরকারে পড়ে বাধ্য হলে সে মোটামুটি ভালোই উতরে দেয়। পড়াশুনোতেও সে

শ্রীলেখার চেয়ে ভালো ছিল, কিন্তু সারা বছর বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে পরীক্ষার কয়েক দিন আগে রাত জেগে পড়ে পাশ করবে। বাড়িতে অনেক লোকজন থাকলে সান্ত্বনার উপস্থিতি টেরই পাওয়া যায় না। সেই জন্যই সে এতদিন শ্রীলেখার আড়ালে চাপা পড়ে ছিল। গ্রামের বাড়িতে নিরিবিলি পরিবেশে তাকে আলাদা ভাবে চেনা গেল।

সান্ত্বনা এখন যুবতী। হঠাৎ তাকে দেখলে চমকে যেতে হয়। অল্প বয়সে তার চেহারা ছিল বৈশিষ্ট্যহীন, হঠাৎ সে ধাঁ ধাঁ করে লম্বা হয়ে উঠেছে, স্বাস্থ্যে এসেছে চাকচিক্য, যেন সান্ত্বনার খোলস ভেঙে বেরিয়ে এসেছে অন্য একটি মেয়ে। তার মুখের আকৃতির সঙ্গে তার মা, বাবা বা বাদলের কোনও মিল নেই। বাদলকে দেখে সবাই বলবে ঠিক যেন তার মায়ের মুখখানা বসানো। সেই জন্যই তখনও বাদলের মুখে একটা মেয়েলি ভাব আছে। সে যখন লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে–তাকে কোনও কিশোরীর মতন মনে হয়। সান্ত্বনার মুখটা অনেকটা অবাঙালি ধরনের। চওড়া কপাল, টিকোলো নাক, লম্বাটে চিবুক, ঠোঁটদুটো খুব পাতলা। তার গায়ের রং অবশ্য খুব ফরসা নয়, মাথার চুলে কিছুটা কোকড়া ভাব আছে। তার চাপা স্বভাবের সঙ্গে এখন যেন মিশেছে একটু একটু অহংকার। বয়সের তুলনায় সান্ত্বনাকে আরও বড় দেখায়।

গ্রামদেশে অসচ্ছল পরিবারের মেয়ের যদি স্বাস্থ্য ভালো হয়, তা হলে সে মেয়ে তো গলার কাঁটা। মেয়ের দিকে তাকালেই হিমানীর আজকাল বুক টিপটিপ করে। সব সময় মেয়েকে চোখে চোখে আগলে রাখার চেষ্টা করেন। হিমানী এমনিতেই একটু নৈতিক শুচিবায়ুগ্রস্ত, একটু কিছু অসমীচীন ব্যাপার ঘটলেই তার মনে হয়, পৃথিবী বুঝি রসাতলে গেল। তা ছাড়া মায়ের প্রাণ, সব সময়েই মেয়ের বিপদের আশঙ্কা করে। মেয়ের বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলেই সবচেয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারতেন হিমানী। কিন্তু এ পোড়ার দেশে সে রকম ভালো পাত্র কোথায়? বাপের বাড়িতে থাকতে থাকতেই যদি বিয়েটা দিতে পারতেন!

সান্ত্বনাকে তার বাবা-মা কেউই শাসন করতে পারে না। তার গাম্ভীর্যকে তার বাবা মা-ও সমীহ করে। এক একজন থাকে, যাদের দেখলেই মনে হয় এরা কখনও কোনও অন্যায় করতে পারে না-সান্ত্বনা সেই রকম। সান্ত্বনা যদি একা একা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় এবং বেশ কিছুক্ষণ পরে ফেরে–কেউ তাকে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারবে না, এতক্ষণ কোথায় ছিলি? সে রকম জিজ্ঞেস করলে, জানা কথাই যে সান্ত্বনা কোনও উত্তর দেবে না। মিষ্টি গলায় কিংবা কথার কথা হিসেবে প্রশ্ন করলে সে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিতে পারে।

সান্ত্বনা নিঃশব্দে বাড়ির কাজ করে, জল আনে, বাসন ধোয়, কাপড় কাঁচে। কোনও কিছুই তাকে বলতে হয় না। লঘু হাতে সে ঝটপট কাজ সেরে নেয়। খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে তার বাছবিচার বড্ড বেশি। সে বেগুন খায় না, ট্যাংরামাছ খায় না, পুঁইশাক খায় না। ইলিশমাছের তেল দিয়ে ভাত মেখে খেতে বাঙাল মাত্রেরই জিভে জল আসে কিন্তু সান্ত্বনা তাতে আঁশটে গন্ধ পায়–সে নাক কুঁচকে দূরে সরিয়ে দেয়। কোনও রান্নায় সামান্য ঝাল হলেই সে মুখে তুলতে পারে না। খেতে বসে যখন তখন সে ভাতসুদ্ধ থালা ঠেলে দিয়ে বলে, ভালো লাগছে না। আর খাব না! হিমানী হয়তো ঝঝের সঙ্গে বলে ওঠেন, তোর কোনটা ভালো লাগে বল তো? সান্ত্বনা তা বলবে না। তার নিজস্ব কোনও দাবি নেই। ইদানীং খাবার ঘরে অনটন দেখা দিয়েছে, চাল প্রায় পাওয়াই দুষ্কর, ভাতের অভাবে বাদল কান্নাকাটি করে সান্ত্বনা কোনও অভিযোগ জানায় না। প্রতি দিনের রান্নার পদ পর্যবেক্ষণ করে সে প্রায়ই আগে থেকে বলে দেয়, আজ আমার খিদে নেই, কিছু খাব না!

মা জিজ্ঞেস করেন, কী খেয়েছিস যে খিদে নেই বলছিস?

সান্ত্বনা বলে, বাঃ সন্ধেবেলা যে দুটো পেয়ারা খেলাম!

সত্যিই তাই, সে দুটো পেয়ারা খেয়েছে বলেই রাত্রে আর কিছু খাবে না। প্রায় কিছুই খেয়েও যে তার স্বাস্থ্য দিন দিন কী করে এত ভালো হচ্ছে, সেটাই এক রহস্য।

সান্ত্বনা বেশিক্ষণ বাড়িতে বসে থাকতে চায় না। একটু ফাঁক পেলেই সে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ে, কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়। সকাল দুপুর সন্ধ্যা যে-কোনও সময়েই হোক। সান্ত্বনা যে-কোনও গোপন জায়গায় যায় বা অবৈধ কিছু করে তাও না। হিমানী মেয়েকে সরাসরি নিষেধ না করে নিজে থেকে খোঁজ নিয়েছেন। একদিন শুধু মিষ্টি ভাবে সান্ত্বনাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, তুই যে যখন তখন বেরিয়ে যাস এতে লোকে নিন্দে করবে। এইসব গ্রামদেশে মেয়েরা একা একা বেরোয় না।!

সান্ত্বনা উত্তর দিয়েছিল, আমি ছেলে হলে তোমার খুব ভালো লাগত, তাই না মা? আর দু-এক বছর পরেই আমি বেশ চাকরি করতাম।

সান্ত্বনা তবু বাড়ি থেকে বেরোয়। গ্রাম্য রাস্তায় সে রীতিমতন একটি দ্রষ্টব্য ব্যাপার। এ রকম পরিচ্ছন্ন সুঠাম স্বাস্থ্যবতী মেয়েকে একা একা গ্রামের রাস্তায় আগে কেউ দেখেনি। তার নবোদিত স্তনদুটি সত্যিই যেন শব্দ করে যৌবনের বার্তা ঘোষণা করে, তার ভরাট ঊরুতে একটা যেন ছন্দ আছে। সবাই তাকে দেখে, সান্ত্বনা সে কথা বোঝে না। একমাত্র মল্লিকবাড়ির ফরসা ফরসা মেয়েরা তার মতন সুন্দরী, কিন্তু তারা বেশির ভাগ সময়েই শহরে থাকে। আবদুর রহমানের বাড়ির জেনানারা নাকি পটের বিবির মতন–কিন্তু তাদের কক্ষনও বাইরে দেখা যায় না। সান্ত্বনাকে নিয়ে এক এক সময় গ্রামের প্রায় সমস্ত পুরুষই রসালো গল্পে মেতে ওঠে। বুড়োদের আড্ডাতেই কথা ওঠে বেশি। কে না জানে, ছোকরাদের চেয়ে বুড়োরাই অশ্লীল কথা বেশি পছন্দ করে। বাদল নিজেও দু-এক বার তার দিদি সম্পর্কে খারাপ কথা শুনে ফেলেছে।

সান্ত্বনা সচরাচর বাদলকে সঙ্গে নিতে চায় না। বাদল কখনও সখনও বাগানে কিংবা পাটখেতের ধারে সান্ত্বনাকে দেখে জিজ্ঞেস করেছে, দিদি, আমি তোর সঙ্গে যাব?

সান্ত্বনা একটুক্ষণ চিন্তা করে বলেছে, আয়।

তারপর বাদলকে সেনানা রকম কঠিন কঠিন কাজ করতে বলেছে। তাকে সে বলেছে কুঁচগাছ থেকে কুঁচফল পেড়ে আনতে, পুকুরের মাঝখান থেকে পদ্মফুলের কুঁড়ি তুলে আনতে কিংবা ফড়িং ধরতে। বাদল কি এসব পারে?

একদিন সে বাদলকে হাসান গাজি দিঘির দক্ষিণ পারের কোণটায় দেখে বলল, এই শোন, এই খেজুর গাছটায় উঠতে পারবি?

খেজুর গাছটা বাঁকা হয়ে উঠে গেছে অনেকখানি, গাছের বেশ খানিকটা অংশ জলের ওপরে। ডগার কাছে একটা হাঁড়ি বাঁধা। গাজিভাই ভোরবেলা একটা হাড়ি খুলে নিয়ে আর একটা হাঁড়ি বেঁধে রেখে যায়। দিনের রসের নাম ঝরা রস।

বাদল ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, গাছে উঠে কী করব?

সান্ত্বনা বলল, হাঁড়িটা পেড়ে আনবি।

ওই রস তো খায় না।

তুই আনতে পারবি কি না বল!

খেজুর গাছটা বাকা বলে ওপরে ওঠা খুব শক্ত নয়। বাদল তবু ভয় পাচ্ছে। সান্ত্বনা বলল, তুই পারবি না? আমি পারি, দেখবি?

দিদি গাছে উঠবে–এটা বাদলের পছন্দ হয় না। সে নিজেই উঠতে শুরু করে। বেশ অবলীলাক্রমেই তরতর করে উঠে যায়। উপরে উঠে যেই হাঁড়িটা খুলেছে, তখনই নীচের দিকে চোখ পড়তে তার মাথা ঘুরে গেল। নীচেই জল–আর এই দিঘিতে যা শ্যাওলা, সহজে সাঁতার কাটা যায় না। বাদল হাঁড়িটা গলায় ঝুলিয়ে সন্তর্পণে নামতে লাগল আস্তে আস্তে। একবার তার পা পিছলে যেতেই এমন বুক কাঁপতে লাগল যে তার হাতের জোর কমে গেল একেবারে। এখন সে কী করবে? নীচের দিকে তাকালেই মাথা ঘোরে। হাঁড়ি সুন্ধু যদি জলে পড়ে যায়–

বাদল চেঁচিয়ে বলল, দিদি, আমি নামতে পারছি না!

উৎকণ্ঠিত হবার বদলে সান্ত্বনা হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, নামতে পারছিস? তা হলে কী হবে?

দিদি, আমি সত্যি নামতে পারছি না!

বেশ হয়েছে! বেশ হয়েছে।

তুই তো আমাকে উঠতে বললি!

উঠতে পারিস, আর নামতে পারিস না, বোকা ছেলে!

সত্যি পারছি না। বাবাকে ডাক। কিংবা কার্তিকাকে।

সান্ত্বনা কারোকেই ডাকল না। শাড়ি গাছকোমর করে বেঁধে নিজেই উঠতে শুরু করল। তার দিকে তাকিয়ে বাদলের আরও ভয় করতে লাগল।

উত্তেজনার মাথায় বাদলের হাত থেকে রসের হাঁড়িটা পড়ে গেল জলে। ঝপাং করে শব্দ হল, পুকুরে তাল পড়লে এই রকম শব্দ হয়, অনেকে সেই শব্দে ছুটে আসে। সান্ত্বনা তাড়াতাড়ি আবার নেমে পড়ল গাছ থেকে। অন্য লোকজন এসে দেখল, বাদল খেজুর গাছের মাঝখানে কাদো কাঁদো মুখে বসে আছে। শুধু শুধু সে বকুনি খেয়ে মরল। সেই থেকে সে আর দিদির সঙ্গে একেবারেই যেতে চায় না।

অন্য পাড়ার দুটি মেয়ে সান্ত্বনার সঙ্গে দেখা করতে প্রায়ই আসে। একজনের নাম নীলি আর একজনের নাম শংকরী। মেয়েদুটি সান্ত্বনার খুব অনুরাগিনী হয়ে পড়েছে। অবশ্য সান্ত্বনা বিশেষ কোনও কথা বলে না–ওরাই সান্ত্বনাকে রাজ্যের কথা শোনায়। নীলা শংকরী কেউ কোনও দিন স্কুলে পড়েনি, সামান্য বাংলা জানে কিন্তু তাদের বলার অনেক কথা আছে। নীলার এখনও বিয়ে হয়নি, শংকরীকে তার স্বামী নেয় না। শংকরী। অবশ্য বলে তার স্বামী বার্মায় গেছে যুদ্ধ করতে, কিন্তু গ্রাম সুষ্ঠু সবাই জানে তার স্বামী ব্রজের একটি মেয়েকে বিয়ে করে গয়াতে থাকে। নীলার রাক্ষস গণ এবং সিংহ রাশি বলে কোনও পাত্রর সঙ্গেই তার কুষ্ঠি মেলে না, সেই জন্য বিয়েও হতে পারছে না।

নীলা আর শংকরীর সঙ্গে সান্ত্বনা মাঝে মাঝে বেরোয়। লিচুবাগানে চড়ুইভাতি করে। কিন্তু এদের সঙ্গেও সান্ত্বনার ঠিক মেলে না। ওই দুটি মেয়ের মধ্যে নীলা মেয়েটি বিশেষ করে সান্ত্বনার খুবই ভক্ত হয়ে পড়েছিল। সে প্রায়ই বলত, ইস, আমি যদি তোর মতন হতাম।

সান্ত্বনা শুধু জিজ্ঞেস করত, কেন?

নীলা বলত, তোকে দেখে মনে হয়, তুই যেন এই পৃথিবীর মেয়ে না। অন্য কোনও জগৎ থেকে এখানে বেড়াতে এসেছিস!

একদিন সান্ত্বনা একলা একলা বেড়াতে বেড়াতে অনেক দূর চলে গিয়েছিল। খালধারের অন্য দিকটায় অন্য গ্রাম। একটা মস্ত বড় অশত্থ গাছের নীচে কখনও কখনও কোনও সাধু-সন্ন্যাসী এসে বসে–এখন সে জায়গাটা ফঁকা, কিছু ভাঙা হড়িকুড়ি ছড়ানো রয়েছে। সান্ত্বনা দেখল, দুটি বয়সে বড় ছেলের সঙ্গে বাদল বসে আছে। একটি ছেলে বাদলের কঁধ জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে একটি জ্বলন্ত সিগারেট আনছে তার মুখের কাছে। বাদল খাবে না, মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, অন্য ছেলেটি জোর করে বাদলের মুখ ঘুরিয়ে দিচ্ছে। বাদল শেষ পর্যন্ত সিগারেটে দু’ টান দিয়ে খক খক করে কাশতে লাগল।

সান্ত্বনা আড়াল থেকে দেখছিল, অনেকক্ষণ কোনও সাড়া শব্দ করেনি। কাশতে কাশতে যখন বাদলের চোখে প্রায় জল এসে গেছে–তখন সান্ত্বনা ডাকল, এই বাদলা–

বাদল চমকে উঠল, অন্য ছেলেদুটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। সান্ত্বনা এগিয়ে এসে বাদলের হাত ধরে বলল, বাড়ি চল।

বয়স্ক একটি ছেলে হুইল দিয়ে উঠল। সান্ত্বনা ছেলেটির দিকে তাকালও না। হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেল বাদলকে।

খানিকটা দূর এসে বাদল ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, দিদি, তুই মাকে বলে দিবি?

সান্ত্বনা কোনও উত্তর দিল না। বাবা-মাকে বললও না সেদিন। তার দু দিন বাদে সান্ত্বনা কোথা থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট এনে বাদলকে দিয়ে বলল, এই নে খাবি?

প্যাকেটে দুটো সিগারেট ছিল। বাদল দেখেই চিনতে পারল সেটা তার বাবার প্যাকেট। বাবা ছাড়া এ-গ্রামে সেই সিগারেট কেউ খায় না। কখন রাস্তায় বাবার পকেট থেকে সেটা পড়ে গিয়েছিল, সান্ত্বনা কুড়িয়ে এনে বাবাকে দিল না, বাদলকে দিল। বাদল রেগেমেগে বলল, আমি কি সিগারেট খাই নাকি!

সান্ত্বনা বলল, মিথ্যে কথা বলিস না। কক্ষনও মিথ্যে কথা বলবি না!

সান্ত্বনা কেন একা একা ফাঁকা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, তার কোনও যুক্তিসিদ্ধ কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। একটি মাত্র কারণ মোটামুটি অনুমান করা যেতে পারে। সান্ত্বনা যখন কোনও নিরালা জায়গায় থাকে, তখন তাকে গুণগুণ করে গান গাইতে শোনা যায়। বাড়িতে কিংবা লোকজনের সামনে সে কখনও মুখ খোলে না। অথচ সে গান গাইতে ভালোবাসে। সান্ত্বনার গলা তেমন সুরেলা নয়, কোনও দিন সে গায়িকা হতে পারবে না, তবু সে মোটামুটি নির্ভুল সুরে গান গাইতে পারে।

গান গাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা পাটখেত। আধ মাইল, এক মাইল ছড়ানো পাটখেতের মধ্যে একবার ঢুকে গেলে আর খোঁজ পাওয়া যায় না। এক মানুষ, দেড় মানুষ উঁচু পাটগাছ, বহুদূর বিস্তৃত একটা আবছা হরিৎ জগৎ সৃষ্টি করে রেখেছে। সান্ত্বনা এদিক-ওদিক তাকিয়ে সেই পাটখেতের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তারপর শোনা যায় তার কান্না কান্না মতন গানের আওয়াজ।

সান্ত্বনা সেই রকম গান গাইতে গাইতে আসছে, হঠাৎ পাটখেতের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল। এইসব খেতের মধ্যে প্রায়ই শেয়াল লুকিয়ে থাকে, সাপ আর নেউলের যুদ্ধ দেখা যায়। কিন্তু এই আন্দোলন অন্য রকম। সান্ত্বনা সে-দিকে এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।

একটি দাড়িওয়ালা স্থূলকায় লোকের আলিঙ্গন ছাড়িয়ে শংকরী উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। শংকরীর গায়ে এক টুকরো সুতো পর্যন্ত নেই। অন্য যে-কোনও মেয়ে সেই দৃশ্য দেখলে ছুটে পালাত, কিন্তু সান্ত্বনার সবকিছুই অদ্ভুত। সান্ত্বনা গভীর বিস্ময়ে শংকরীর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, এই শংকরী, কী করছিস রে?

শংকরী কোনও উত্তর দিল না। দাড়িওয়ালা লোকটি লুব্ধ ভাবে হেসে বলল, এ কে?

সান্ত্বনা লোকটির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে অপলক ভাবে কয়েক মুহূর্ত দেখল। তারপর বলল, শংকরী, চলে আয়! এ-লোকটা ভালো নয়?

লোকটি খপ করে সান্ত্বনার হাত চেপে ধরে বলল, তুমিও বোস না!

শংকরী হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল। লোকটি বেখাপ্পা ভাবে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই সান্ত্বনা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, শংকরী, তুই এত অসভ্য কেন রে? ছিঃ, তোর লজ্জা করে না?

গ্রামে এইসব ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু সান্ত্বনার চরিত্রের মধ্যে খানিকটা অস্বাভাবিকত্ব আছে। এই রকম আরও দু-একটা ব্যাপারের পর অনেকেই সান্ত্বনাকে পাগল মনে করতে লাগল। ক্রমে ক্রমে সেই সব কথা এসে পৌঁছোল হিমানীর কাছে, হিমানী প্রথমে কোনও গুরুত্ব দেননি। কিন্তু একদিন মাঝ রাত্তিরে সান্ত্বনা বিছানায় উঠে বসে বলল, মা, আমায় ডাকছে! আমায় ডাকছে!

হিমানী জিজ্ঞেস করলেন, কে? কে?

সান্ত্বনা বলল, সেই দাড়িওয়ালা লোকটা!

সান্ত্বনার দাঁতে দাঁত লেগে গেছে, চামচ দিয়েও তার মুখ ফাঁক করা যায় না। পাড়া-প্রতিবেশীরা এসে মত প্রকাশ করল, সান্ত্বনাকে ভূতে ভর করেছে।

সেই নিয়ে অনেক কাণ্ড চলল। চিররঞ্জন ভূত প্রেত বিশ্বাস করেন না। তিনি ঠিক করে ফেললেন, মেয়েকে বাঁচাতে হলে কলকাতায় নিয়ে যেতেই হবে। তা ছাড়া, এখানে আর সংসার চলছে না। কলকাতায় তবু একটা আশ্রয় আছে। আবার বাক্সবিছানা বাঁধাছাদা শুরু হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *