1 of 2

৪৭. শীত এখন তুঙ্গে

শীত এখন তুঙ্গে। পায়ের তলায় বরফের শরীর কাঠ। আস্তানার ছাদে তো বটেই, মাঝে মাঝে সিঁড়ির প্রথম ধাপেও বরফ উঠে আসে। ঝড় বা বৃষ্টির দেখা। নেই অনেকদিন। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া যখন বয়ে যায় তখন বরফের শরীরে আঁচড় পড়ে।

কিন্তু একটা পবিত্র রোদ তাপল্যাঙের ওপর মশারি টাঙিয়ে রাখে। শিশুরা সেই রোদে তুষার-বল নিয়ে খেলা করে, অশক্ত মানুষেরা আর একটা বছরের আশা নিয়ে সেই রোদে শরীর ড়ুবিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। এই সব মানুষের অঙ্গে শীতবস্ত্র বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে কোন তুলনাই চলে না য়ুরোপ আমেরিকার নির্বান্ধব কোন গ্রাম্য মানুষেরও। অথচ এরা বেশ আছে, অন্তত শীতের কষ্ট প্রবল একথা কেউ মুখ ফুটে বোঝায় না।

আনন্দ সুদীপ এবং জয়িতা এতদিনে একটা নিয়মের মধ্যে আনতে পেরেছে তাপল্যাঙের মানুষকে। আরাম পেতে গেলে পরিশ্রম করতে হবে। ব্যক্তিগত সুখের জন্যে যে একক পরিশ্রম তা কখনই ফলপ্রসূ হতে পারে না এ সত্য তারা ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেছে। যৌথগৃহেব সংখ্যা এখন বেড়েছে। মেয়ে শিশু এবং বয়স্ক মানুষেরা অনেক নিরাপদ বোধ করছে এখন। এমন কি সবল পুরুষেরা অনেক বেশি সহজ। শীতের সময় যখন একটা দিন কাটাতেই আর একটা দিনের শীতল নিঃশ্বাস গায়ে কনকনানি তোলে তখন এই যৌথগৃহে পরিবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। বরফ গললে যদি প্রাণ চায় তাহলে যে যার গৃহে ফিরে যাবে। নিজস্ব সংসারের টান যে বড় গভীরে তা বোঝা যায় এখন এই শীতের সময়েও মেয়েপুরুষেরা নিজেদের ঘর রোজ ঠিকঠাক করে আসে। নিজস্ব ঘরের এই বাঁধন ছিন্ন করতে পারলে ব্যক্তিগত স্বার্থের গণ্ডিটাকে দূর করা যেত। কিন্তু আনন্দ প্রথম থেকেই এত বড় আঘাতটা করতে চাইল না। এক শীতে অনেকটাই হল, আর এক শীত এলে এই তলানিটুকু দূর হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু এটা ঠিক, মানুষগুলো এর মধ্যে বুঝতে পেরেছে এভাবে কেউ জন্মাবধি নিশ্চিন্তে থাকেনি। কারও বাচ্চার অসুখ হলে অন্যের মা যে স্নেহের হাত বাড়ায়, সকাল-সন্ধ্যে পেট ভরাবার খাবার আসে যৌথ রান্না হয়ে, প্রবল শীতেও গায়ে উত্তাপ লাগে—এ তো স্বপ্নের মতো ব্যাপার কারও কারও কাছে।

কিন্তু সম্পন্ন নয় মানুষের সঙ্গে অন্তত দশটি পরিবার মেলেনি। তারা তুষারঝড়ের সময় থেকেই আলাদা, মজবুত ঘরের দরজা খুলে যৌথগুহের জোয়ারে গা মেশায়নি। এদের সবাই যে খুব আরামে আছে তা নয়, কিন্তু নিজেদের আলাদা দেখাবার একটা অহঙ্কারে ভুগছে। নিজস্ব মুরগী, ছাগল এবং সঞ্চিত শস্য নিয়ে কোনরকমে থেকে যাওয়া। এদের বিরক্ত করতে চায়নি আনন্দ। কিন্তু গ্রামের মানুষ এর মধ্যেই টের পেয়ে গেছে ওরা আলাদা। বহুযুগ একসঙ্গে থেকেও এতদিন এই বোধের শিকার হয়নি ওরা। এখন অর্থনৈতিক শ্ৰেণীবৈষম্যের ফসল হিসেবে দুটো জাত চিহ্নিত হল। সংঘাত শুরু হয়নি কিন্তু কথাবার্তায় খোঁচা দেবার প্রবণতা এসেছে। যৌথ রান্নাঘরের দায়িত্ব জয়িতার। যুবতী মেয়েদের নিয়ে সকাল থেকে তার কাজ শুরু হয়ে যায়। খচ্চরওয়ালাদের কাছ থেকে কেনা খাদ্যসামগ্রী এখন শেষের দিকে। সুদীপের টাকা যা এখনও রয়ে গেছে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এই বরফ ডিঙিয়ে খচ্চরওয়ালারা আসবে না। আজ অবধি বরফের সময় কেউ ওয়ালাংচুঙ কিংবা চ্যাঙথাপুতে কখনও যাওয়ার চেষ্টা করেনি। প্রাথমিক ইতস্তত কাটানোর পর যে যার ঘরে জমানো শস্য এনে দিয়েছে যৌথরান্নাগৃহে। যুবতী মেয়েরা এখানে বসে রান্না করে আর গল্প বানায়। জয়িতা লক্ষ্য করছিল অবিবাহিত যুবতী মেয়ের সংখ্যা এখানে খুবই কম। বিবাহিতারা গল্প করে আর হাসে। আর সেই হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাদের হাসি আরও বেড়ে যায়। নিমকিত নামের যুবতীটি বলল, ইনামিত বলছে ওর স্বামীর চেহারাটা ঠিক কিরকম তা এখন ভুলে গেছিল ও। কাল এই ঠাণ্ডার মধ্যে ঝরনার ধারে গিয়ে সেটা আবার জেনে এসেছে। কথাটা শেষ হওয়ামাত্র সম্মিলিত হাসির ঝড় উঠল। ইনামিত নামের মেয়েটি একটুও লজ্জা পেল না। তার সন্তান সবসময় পিঠেই বাঁধা থাকে। জয়িতা তার দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে দেখে সে বলল, আমি বাবা মাঝে মাঝে যাই। যদি তোমরা বন্ধ করতে বল তাহলে ভাঙাঘরেই ফিরে যাব।

জয়িতা কোন মন্তব্য করল না। কলকাতায় থাকলে হয়তো তার জিভে প্রতিবাদ ফুটত। পুরুষের শরীর ছাড়া নারীর আর কিছুতেই শান্তি পাওয়া সম্ভব নয় এটা ভাবতেই তার মনে ঘৃণা ফণা তুলত। কিন্তু এই না-সুন্দর, না-সচ্ছলা মেয়েটির মুখে যে অহঙ্কারের আরাম সেটাকেই বা এখন অস্বীকার করে কি করে?

নিমকিত বলল, তুমি বিয়ে করবে না? অমন সুন্দর দুটো পুরুষ তোমার সঙ্গে থাকে, ওদের তো মারপিটও লাগে না। ওদের মধ্যে কার সঙ্গে তোমার চলছে? প্রশ্নটা শেষ হওয়ামাত্র আবার হাসির ঝড় উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে মুখে রক্তের চলাফেরা টের পেল জয়িতা। সে কোনরকমে বলতে পারল, তোমরা যা ভাবছ তা নয়। আমরা বন্ধু।

নিমকিত বলল, বন্ধু! ছেলেতে মেয়েতে বন্ধুত্ব হয় কখনও শুনিনি বাবা! ওরা তোমার সঙ্গে শুতে চায় না?

জয়িতা রাগ করতে পারল না। এদের প্রশ্নের মধ্যে সাবল্য স্পষ্ট। সে নিজেকে নিচে টেনে আনল যেন, আমরা এই নিয়ে কখনও ভাবিনি।

ইনামিত বলল, এখন তো সব সোজা হয়ে গিয়েছে! তোমাদেব যে বন্ধুর মাথা খারাপ হয়েছিল মদ খেয়ে সে তো একটা জাহান পেয়ে গেছে। তাহলে থাকল শুধু বড়সাথী। ওর মত ভাম মানুষটাকেই তুমি মায়ালু বানিয়ে নাও। মেয়ে হয়ে জন্মেছ আর পুরুষের স্বাদ নেবে না?

জয়িতা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল, তার জন্যে তো অনেক সময় পড়ে আছে। আগে আমরা সবাই একটু ভালভাবে বাঁচি, তারপর।

ভালভাবে বাঁচা! তা আর এ জীবনে হবে না। তোমরা এসেছিলে বলে এখন দুবেলা খেতে পাচ্ছি।

কেন হবে না? সবাই মিলে কাজ করব, ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্যে যা যা প্রয়োজন তা যোগাড় করব। এবার বরফ গললেই এমন সব জিনিস তৈরি করতে হবে যা শহরে নিয়ে গেলে লোকে বেশি দাম দিয়ে কিনতে বাধ্য হবে। সেই টাকা দিয়ে জামাকাপড় খাবার ওষুধ কিনে নিয়ে আসা হবে। আমাদের সবসময় ভাবতে হবে এই গ্রামের সবাই এক পরিবারের।

জয়িতা কথা শেষ করতেই নিমকিত বলল, এসব কথা তো কেউ বলেনি। দেখা যাক, তোমরা রাস্তা দেখাচ্ছ, রাস্তাটা যদি ঠিক হয় তাহলে মন্দ কি!

এই সময় একটা বাচ্চা মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে উত্তেজিত গলায় খবর দিল একটা ইয়াকের বাচ্চা হয়েছে। আর বাচ্চাটা মেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। সবাই ছুটতে লাগল কাহুনের মন্দিরের দিকে। নিমকিত ধরে নিয়ে এল জয়িতাকে। ভিড় জমে গেছে সেখানে। এরই মধ্যে কাহুনের শিষ্যরা বিশাল বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শুরু করেছে। সদ্যজাত ইয়াক শিশুটি এখনও পা-সোজা করতে পারছে না। তার শরীর পরিষ্কার করছে মা চেটেচেটে। এই ভিড়, যন্ত্রের আওয়াজে বিন্দুমাত্র ভীত নয় সে। বরং এই গ্রামের মানুষের জন্যে একটা শুভকাজ সে করতে পেরেছে বলে হয়তো আন্দাজও করতে পেরেছে। জয়িতার অন্তত ওর ভাবভঙ্গিতে তাই মনে হল। হঠাৎ একটা গলা চিৎকার করে উঠল, এই যে এতদিন পরে একটা মেয়ে ইয়াক জন্মাল, কেন জন্মাল কেউ জানো? জয়িতা ছেলেটাকে চিনতে পারল। তুষারঝড়ের সময় খুব পরিশ্রম করেছিল ছেলেটা। ব্যবহার বেশ ভাল। আনন্দ বলে এই রকম ছেলে কয়েকটা পেলে আর চিন্তা নেই। ওর নাম সাওদের।

সাওদেরের কথার জবাব কেউ দিতে পারল না। সে আবার গলা তুলল, ইয়াকের বংশ তো এই গ্রাম থেকে লোপ পেয়েই যাচ্ছিল। এবার আমাদের নতুন সাথীরা এসেছে বলেই ভগবান মুখ তুলল।

একসঙ্গে সবকটা দৃষ্টি পড়ল জয়িতার ওপরে। সবাই খুশিতে গুঞ্জন শুরু করল। কাহুন বললেন, আমি জানতাম এবার মেয়ে বাচ্চা হবে। ভগবান আমাকে প্রায়ই স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন।

গুঞ্জনটা থামল। বিপরীত দুটো বক্তব্যের কোটে সত্য তা নিয়ে ফাপরে পড়ল যেন সবাই। জয়িতা ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল। এ সবই সংস্কার। মেয়ে-ইয়াকের জন্ম হওয়া প্রাকৃতিক ব্যাপার, এ তথ্য এদের বোঝানো মুশকিল। আর তাই কাহুনরা চিরকাল বহালতবিয়তে বেঁচে থাকেন।

 

আনন্দ এখন গ্রামে নেই। ভোরেই ও বেরিয়ে গেছে পালদেম লা-ছিরিদের সঙ্গে নিয়ে। খানিকটা নিচে চমৎকার জ্বালানি কাঠ ছড়ানো আছে। সেগুলো কেটে কেটে আনা দরকার। কাঠের সঞ্চয়ে টান পড়েছে। সুদীপের ওপর দায়িত্ব ছিল মুরগী-ছাগলগুলোর জন্যে বড়সড় একটা খাঁচা তৈরি করার। কয়েকটা ছেলে বরফ সরিয়ে মাটিতে খুঁটি পুঁতছে। তাদের জিজ্ঞাসা করে জয়িতা জানতে পারল সুদীপ একটু আগে একজনকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছে। বুনো চমরির একটা ঝাক নাকি এসেছে এদিকে। যদি দু-তিনটেকে মারতে পারে তাহলে সারা গ্রামের মানুষের পেটে মাংস পড়বে। ব্যাপারটা জয়িতার কাছে হঠকারিতার সমান মনে হল। চেতনা স্বচ্ছ হওয়ার পর সুদীপ আরও বেপরোয়া হয়ে গিয়েছে। বন্য জন্তুগুলোকে না মেরে বুদ্ধি খাটিয়ে যদি ধরতে চেষ্টা করত তাহলে আখেরে বেশি কাজ দিত। জয়িতা আস্তানায় ফিরে দরজা বন্ধ দেখল। সেই মেয়েটিও নেই—সুদীপের জাহান। আজকাল সব সময় সুদীপের সঙ্গে লেপটে থাকে ও। প্রথম দিকে যৌথরান্নায় হাত লাগাতে গিয়েছিল মেয়েটি। কিন্তু গ্রামের অন্য মেয়েরা তাকে প্রায় স্পষ্টই বলেছে ওখানে অনেক লোক, মেয়েটির সাহায্যের দরকার নেই। এখন বস্তুত গ্রামের অন্য মেয়েদের থেকে তাকে সবসময় আলাদা থাকতে হয়। এবং এজন্যে যেন ওর কোন আক্ষেপও নেই। সুদীপ যে কাজ করছে সেই কাজের সঙ্গী হচ্ছে সে আগবাড়িয়ে। সুদীপ ওকে ঠিক ভালবাসে কিনা বোঝা যায় না। যে গলায় কথা বলে তাতে আর যাই থাক ভালবাসা থাকে না। কিন্তু মেয়েটির ব্যবহারে কোন অস্পষ্টতা নেই। কাল রাত্রে সুদীপ আনন্দকে বলেছিল, আশা করি তোরা আমাকে ভুল বুঝছিস না। এ গ্রামের নিয়ম হল কোন নারীকে কেউ গর্ভবতী করলে স্ত্রীর সম্মান দিতেই হয়। এ জিন্দগীতে শালা আমার বিয়ে করার ধান্দা নেই, অতএব ঠিক আছি। মেয়েটার একটা শেলটার দরকার, দিয়ে যাচ্ছি।

জয়িতা চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। এবং তখনই রামানন্দ রায়ের কথা মনে পড়ল ওর। বাবা কেমন আছে এখন? বাবার কি ওর জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছে? নাকি ওরা জেনে গেছে জয়িতা বেঁচে নেই। তাই বা হবে কেন? কল্যাণের মৃতদেহ পাওয়ার পর পুলিশ নিশ্চয়ই খবরের কাগজে কৃতিত্বের কথা বলেছে। কল্যাণের ভাইরা নিশ্চয়ই একটা লোকদেখানো শ্রাদ্ধ করেছে। আর যে পুলিশবাহিনী এখানে এসে শূন্য হাতে ফিরে গেছে তারা তিনজনের অস্তিত্বের কথা জানিয়েছে। আর তাই জেনে রামানন্দ রায়ের কষ্ট কি খুব বেড়ে গেছে। ওর হঠাৎ মনে হল মদ খাওয়া পার্টিতে যাওয়া বা অন্য রমণীতে আসক্তি প্রকাশের নামে যে ফার্টিলাইজারের স্রোতে রামানন্দ রায় গা ভাসিয়েছিলেন সেটার পাশাপাশি আর একটা ভালবাসার কাঙালও বেঁচে ছিল। যেচে পরা মুখোশটা এত সেঁটে বসেছিল যে সেটা টেনে খোলা আর সম্ভব হয়নি। কি জানি হয়তো ভুল, এসব ধারণাই বেঠিক। হয়তো এর মধ্যে চলে যাওয়া সময়টা ভরিয়ে দিয়েছে মনের খাদগুলো। তবু একবার রামানন্দ রায় যখন মধ্যরাতে মাতাল হয়ে একাকী বসে থাকেন তখন সামনে আচমকা গিয়ে দাঁড়িয়ে ওঁর মুখোনা দেখতে বড় ইচ্ছে করে। এসব মাথার মধ্যে পাক খেতেই ওর হাসি পেল। সে একনাগাড়ে রামানন্দ রায়কে ভেবে চলেছে। অথচ সীতা রায়, তার মা? কল্যাণের একটা কথা মনে পড়ল, জানিস, আজকালকার মায়েরা না ঠিক মায়েদের মতন নয়, বলতে পারিস দিদির মত। ব্যবহারে চেহারায়। মা মা অনুভূতিটা যদি না আসে তো আর কি করা যাবে? জয়িতা জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন, তোর মা?

আমার মায়ের কেসটা আলাদা। অভাবের সঙ্গে লড়তে লড়তে ভদ্রমহিলাকে প্রায়ই বাড়িতে দলবদল করতে হয়। আর সেই কারণেই সন্তানদের শ্রদ্ধা থেকে বঞ্চিত হন। কল্যাণের এই বক্তব্য কতটা সত্যি ছিল তা সে-ই জানত কিন্তু সীতা রায়কে স্মরণ করে আজ জয়িতার মনে হল এখন পাশে থাকলে সে ওঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করার চেষ্টা করত। মানুষ বারংবার কেচ্যুত হয়, ঘরবদল করে যে আত্মিক অভাবের তাড়নায় সেটাকে বুঝতে চেষ্টা করত সে। এই কয়মাস, সময়ের হিসেবে কিছুই নয়, কিন্তু জয়িতার মনে হল অনেক দরজা তার কাছে খুলে গেছে।

জয়িতা পাশের পাহাড়ে চোখ রাখল। এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল বোলেনদের গ্রামে অনেকদিন যাওয়া হয়নি। আনন্দ অবশ্য এখনই ওখানে কোন উদ্যোগ নিতে রাজী নয়। রোলেনদের অর্থনৈতিক অবস্থা অবশ্যই তাপল্যাঙের মানুষের চেয়ে ভাল। একসঙ্গে দু-জায়গায় পরিশ্রম করা তিনটি মানুষের পক্ষে অসম্ভব। বরং সত্যি যদি তাপল্যাঙের চেহারা ওরা ফেরাতে পারে তাহলে রোলেনদের গ্রামের যারা নিঃস্ব মানুষ তারা নিজে থেকেই আকর্ষণ বোধ করবে। অন্তত একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত না রাখতে পারলে ওদের কাছে এগিয়ে যাওয়া অর্থহীন। জয়িতা ভগবানের পবিত্র জল উদ্ধার করে দিয়েছিল শুধু এই কারণেই সম্পর্কটা এখন সহজ হয়েছে। কিন্তু কাজ শুরু করতে চাইলে সংঘাত হবে না তা কে বলতে পারে।

তবু জয়িতা পা বাড়াল। ওর মনে হল রোলেনদের গ্রামটায় একবার যাওয়া উচিত। এতে আর যাই হোক সম্পর্কটা ঠিক থাকবে। পায়ের তলায় বরফ এখন শক্ত ইট। সাবধানে না হাঁটলে পিছলে পড়তে হবে। এই সময় সে সাওদেরকে দেখতে পেল। দ্রুতগতিতে পাশে এসে সাওদের জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওভাবে চলে এলে কেন? আমি কি কিছু খারাপ কথা বলছি?

একটা ইয়াকের বাচ্চা হওয়ার সঙ্গে কোন মানুষের সম্পর্ক থাকতে পারে না।

বাঃ, তাহলে যে কানও বলল, ভগবান ওঁকে স্বপ্ন দিয়েছেন। তার বেলা?

সেই স্বপ্ন তো উনি ছাড়া কেউ দ্যাখেননি!

তার মানে তুমি বলছ কাহুন সত্যি কথা বলেন নি?

হয়তো তিনি যেটা বিশ্বাস করেন সেইটেই বলেছেন।

তুমি কোথায় যাচ্ছ এখন?

রোলেনদের গ্রামের দিকে যাব ভাবছি।

সাওদের এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর বলল, আমি তোমার সঙ্গে যাব?

জয়িতা সম্মতি দিল। সঙ্গে কেউ থাকলে বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে সুবিধে হয়। বলা যায় না, যেখানে বরফ জমেনি সেখানে পা ফেলতে দুর্ঘটনা ঘটা বিচিত্র নয়। কিছুক্ষণ হাঁটার পর জয়িতা বলল, তুমি একা ওই গ্রামে কখনও গিয়েছ সাওদের?

লুকিয়ে লুকিয়ে গ্রামের পাশে গিয়েছি, ঢুকিনি। আমাদের মধ্যে মারপিট তো লেগেই ছিল এতদিন। কিন্তু তুমি যেভাবে হাঁটছ তাতে ওখান থেকে আজ রাত্রে ফিরে আসতে পারবে না। জোরে হাঁট, জোরে।

সাওদের গতি বাড়াতে জয়িতা চেঁচিয়ে উঠল, ওরে বাব্বা, অত জোরে আমি পারব না।

কেন? এইভাবে পা ফেল। সাওদের দেখিয়ে দিল শরীর কেমন রাখতে হবে।

জয়িতা অনুকরণ করতে চেষ্টা করল। গতি বাড়ছে কিন্তু অনভ্যাস তার পতন অনিবার্য করে তুলল। সে যখন হুমড়ি খেয়ে বরফের ওপর পড়ছে তখন ক্ষিপ্রহাতে সাওদের তাকে জড়িয়ে ধরল। বুকের ভেতর তখন হাতুড়ি পেটার শব্দ, নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হওয়ার আগেই সাওদেরের শরীরের বিদঘুটে গন্ধ টের পেল। এবং তারপরেই মনে হল যতটা সময় ধরে রাখা উচিত তার থেকে অনেক বেশি সময় এবং শক্তি ব্যয় করছে সাওদের। সেই অবস্থায় মুখ তুলল জয়িতা। সাওদেরের কিশোর মুখে যেন হোলি শুরু হয়ে গিয়েছে। নিঃশ্বাস ভারী। প্রবল অস্বস্তি নিয়ে জয়িতা বলল, ছেড়ে দাও সাওদের।

নাঃ, আর একটু, আর একটু থাকো। সাওদেরের গলার স্বর জড়ানো।

মানে? জয়িতার গলা থেকে শব্দটা ছিটকে এল।

এবার হাত শিথিল হল সাওদেরের, বিহুল দেখাল ওকে। তারপর বলল, তুমি কি নরম!

হতভম্ব হয়ে গেল জয়িতা, আমি নরম। নরম মানে?

সাওদের সরল হাসল, তোমাকে বাইরে থেকে দেখলে খুব শক্ত মনে হত, কিন্তু আজ বুঝলাম তা ঠিক নয়। এখন দূরত্ব এক হাতের। মাথায় ওরা সমান সমান। জয়িতা অবাক। সাওদেরের বয়স বোঝ মুশকিল। দাড়ি এদের সবার বের হয় না। ঠোঁটের ওপর হালকা গোঁফের রেখা। একমাথা চুল আর চমৎকার চামড়ার জন্যে বয়সটা বোঝাও দুস্কর হয়। তাছাড়া সব সময় ওর দিকে তাকালে যে ইংরেজী শব্দটা মনে পড়ে সেটা হল ইনোসেন্ট। যা বয়স্ক মানুষেরা কিছুতেই পেতে পারে না। কিন্তু ওর দিকে তাকাতেই আচমকা কম্পন এল জয়িতার শরীরে। সে নরম! তার শরীরে এখন শীতের ভারী পোশাক। যে কথা কখনও আনন্দ বা সুদীপের মাথায় আসেনি সেই কথা কি বেমালুম উচ্চারণ করল সাওদের! অথচ নিজেকে তার মোটেই নরম ভাবতে ইচ্ছে করছিল না।

হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল জয়িতা। আর হাসিটা যেহেতু শহুরে তাই সাওদের বুঝতে পারছিল না কি করা যায়। হাসি থামিয়ে জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তুমি বুঝি গ্রামের মেয়েদের জড়িয়ে ধরে পরীক্ষা কর কে নরম আর কে শক্ত?

দূর। গ্রামে আমার বয়সী মেয়েই নেই যে তাকে জড়িয়ে ধরব। বড় মেয়েরা আমাকে জড়িয়ে ধরতে চায় কিন্তু আমার ওদের মোটেই ভাল লাগে না। সরল গলায় জানাল সাওদের।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। ওরা সব কেমন বড় বড়। অবশ্য বোলেনদের গ্রামে একটা আমার বয়সী মেয়ে আছে।

আচ্ছা? তাই তুমি আমার সঙ্গে যেতে চাইছ?

না, তা ঠিক নয়। কিন্তু মেয়েটার মুখ খুব খারাপ। অত সুন্দর দেখতে অথচ এমন গালাগাল দেয় যে কি বলব! একবার ওই ঝরনার পাশে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

তখন ওকে জড়িয়ে ধরেছিলে?

উঃ, তুমি বুঝতে পারছ না! চেয়ে আছি দেখে মেয়েটা চিৎকার করল, মেয়ে দ্যাখোনি কোনদিন যে চোখ বড় করেছ? ক্ষেতি আছে কতখানি? রোজ রোজ শেলরুটি খাওয়াতে পারবে? এই সব বলে চলে গেল। আমার তো ওসব কিছু নেই তাই ওর কথা ভাবি না। সাওদেরকে মোটেই দুঃখিত দেখাচ্ছিল না। জয়িতা আবার হাঁটা শুরু করেছিল। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সাওদের চাপা শিস দিচ্ছিল। আর গতি বাড়াচ্ছে না সাওদের। ক্রমশ ওরা চুপচাপ ঝরনার পাশে চলে এল। এরমধ্যে কখন ঝরনা জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। এক ফোঁটা জল নেই কোথাও। এবং তখনই নিচে গুলির শব্দ পেল জয়িতা। শব্দটা প্রতিধ্বনিত হতে লাগল পাহাড়ে পাহাড়ে। সে সচকিত হল। সুদীপ! ব্যাপারটা খুব খারাপ লাগল জয়িতার। নিরীহ চমরী মারার জন্যে বন্দুকের গুলি খরচ করার কোন মানে হয় না। আওয়াজটা খুব দূরের নয়। সঙ্গে সঙ্গে মত পালটাল সে। সাওদের কান খাড়া করেছিল। ওর মুখের রেখাগুলো এখন অস্বাভাবিক। শব্দটা শোনার পর থেকেই আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, আওয়াজটা কোথেকে এসেছে তা কি তুমি বুঝতে পারছ সাওদের?

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল সাওদের। জয়িতা বলল, ওখানে আমাকে তুমি নিয়ে যেতে পারবে?

রোলেনদের গ্রামে যাবে না?

না। আগে দেখে আসি কি হচ্ছে ওখানে!

সাওদের বলল, এপাশ দিয়ে গেলে অনেক সময় লাগবে। এসো আমার হাত ধরো, ঝরনা পার হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব আমরা। সাওদেরের বাড়ানো হাত ধরল জয়িতা। স্পর্শ পাওয়ামাত্র কেঁপে উঠল জয়িতা। তার মনে হল সাওদের হয়তো আবার ভাবতে শুরু করেছে জয়িতা কি নরম। কিন্তু ওর হাতের স্পর্শে বা ব্যবহারে সেসব কিছুই দেখতে পেল না জয়িতা। অত্যন্ত সতর্ক হয়ে বরফ পরীক্ষা করে করে ওকে নিয়ে ঝরনা পেরিয়ে এল সাওদের। ওপারে পৌঁছে ঢালু পথে সামান্যই হাঁটা। রোলেনদের গ্রামের ঠিক উলটো পথ এইটে। গাছপালাগুলো বরফে ঢাকা। কোথাও কোন শব্দ নেই। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল, হঠাৎ সাওদের তার হাত চেপে ধরল। মুহূর্তেই তাকে অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। নিঃশব্দে সে দূরের একটা বরফের চাঁই দেখিয়ে দিল। প্রথমে ঠাহর করতে পারেনি জয়িতা। তারপর নজরে এল লম্বা একটা লোমশ লেজ অনেকটা আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে বরফের ওপর নেতিয়ে রয়েছে। শরীর দেখা যাচ্ছে না। সাদার ওপর কালো ছোপ ছোপ লেজ বরফের গায়ে যেন মিশে আছে। ঠোঁটে আঙুল চেপে কথা বলতে নিষেধ করে পেছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল সাওদেয়। কিন্তু জয়িতার মনে হল জন্তুটাকে না দেখে ফিরে যাওয়া বোকামি হবে। প্রায় মিনিটপাঁচেক সে সাওদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করল। এই সময় লেজটা একবারের জন্যেও জায়গা বদল করল না।

সময় সম্ভবত সাওদেরের সাহস ফিরিয়ে দিল। সে গোল করে অনেকটা জায়গা হেঁটে ঠিক উল্টোদিকে পৌঁছে গেল জয়িতাকে নিয়ে। এবং তখনই জন্তুটাকে স্পষ্ট দেখতে পেল ওরা। লম্বায় অন্তত ফুট সাতেক হবে। বরফের ওপর মুখথুবড়ে পড়ে আছে। এবং তার বুকের পাশ দিয়ে রক্তের ধারা বেরিয়ে থমকে দাঁড়াচ্ছে। শরীরে সামান্য কাঁপুনি নেই। স্নো-লেপার্ড? জয়িতা চমকে উঠল। সত্যি যদি স্নো-লেপার্ড হয় তাহলে এ তো প্রায় রূপকথার প্রাণী। হিমালয়ের চৌদ্দ পনেরো হাজার ফুট উঁচুতে এদের অবস্থান। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সাম্প্রতিক কালে এদের খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছেন। জয়িতা একমুঠো বরফ ছুঁড়ল। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া হল না। সাওদের দুহাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করল। জিম করবেটের বইতে জয়িতা জেনেছে আহত চিতার কাছে পৌঁছানো অত্যন্ত বিপজ্জনক। সে আর এগোতে সাহস পাচ্ছিল না। কিন্তু মৃতবৎ পড়ে থাকতে দেখে সাওদের সাহস পেয়ে গেছে এখন। নিষেধ না শুনে এগিয়ে যাচ্ছিল পায়ে পায়ে। তারপর কাছাকাছি হয়ে চিৎকার করল, মরে গেছে, মরে গেছে!

জয়িতা এবার ছুটে গেল। সত্যি এটা স্নো-লেপার্ড। এবং বেশ বড়সড়। সারা শরীরে মেরুভালুকের মত পুরু লোম এবং থাবাতেও লোমের গদি আছে যাতে বরফের ওপর সহজে হাঁটতে পারে। সাদাটে চামড়ার কালো ছোপ এদের লুকিয়ে থাকতে নিশ্চয়ই সাহায্য করে। জয়িতা পড়েছিল পৃথিবীতে ঠিক এই সময় কতগুলো স্নো-লেপার্ড আছে যার হিসেব নেওয়া সম্ভব হয়নি। একটা বিশেষজ্ঞ দল রাশিয়ার বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ে চারটে শীত কাটিয়েও একটি স্নো-লেপার্ডের দর্শন পায়নি। এই জন্তু সাধারণ বাঘ কিংবা চিতা নয় তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। এর মৃত্যু হয়েছে সামান্য আগে। এখন আসার পথে রক্ত ঝরিয়ে এসেছে ও। জয়িতার বুঝতে অসুবিধে হল না সুদীপ কার উদ্দেশ্যে গুলি খরচ করেছে। এই বিরল জাতের প্রাণীটিকে মারা সুদীপের উচিত হয়েছে কিনা এ নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে। কিন্তু তার আগেই সাওদের লেপার্ডটিকে ধরে টানতে লাগল। কিন্তু ওর একার পক্ষে ওজন অনেক বেশী। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, কি করতে চাইছ ওটাকে নিয়ে?

উঃ, তুমি বুঝতে পারছ না! এই এলাকাটা রোলেনদের। ওরা যদি এটাকে দ্যাখে তাহলে কিছুতেই আমাদের নিয়ে যেতে দেবে না। তুমি হাত লাগাও, তাড়াতাড়ি ঝরনার ওপারে নিয়ে যাব।

সাওদেরকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।

কি করবে এটাকে নিয়ে?

কি আর করব, খাব! এরকম বাঘের কথা শুধু শুনেই এসেছি। তোমরা আসার পর ইয়াকের মেয়ে বাচ্চা হচ্ছে, সাদা বাঘ এসে মরে পড়ে থাকছে। রো ধরো।

ঠিক সেই সময় অত্যন্ত সাবধানে সুদীপ নিচের জঙ্গল সরিয়ে বেরিয়ে এল রক্তচিহ্ন ধরে। জয়িতাকে লেপার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে হতভম্ব। জয়িতা চেঁচিয়ে বলল, কনগ্রাচুলেশন, পৃথিবীর রেয়ার একটা প্রাণীকে তুই মারতে পেরেছিস!

রেয়ার প্রাণী? ওটা তো বাঘ! মরে গেছে? সুদীপ দৌড়ে ওপরে উঠে এল।

এর নাম স্লো-লেপার্ড!

সুদীপ কাঁধ নাচাল। ততক্ষণে মেয়েটি আর একটি ছেলে ওপরে উঠে এল। সুদীপ বলল, খুব ভুগিয়েছে লেপার্ডটা। চমরী খুঁজতে বনে ঢুকেছিলাম, পেয়ে গেলাম এটাকে। গুলি খেয়ে এতটা ছুটে আসবে ভাবিনি। একেবারে হার্টে লেগেছে। শক্তি আছে বটে। কিন্তু তোরা এখানে?

পৃথিবীর সমস্ত চিড়িয়াখানায় এই প্রাণীর সংখ্যা মাত্র তিনশো।

তাতে আমার কিছু এসে যাচ্ছে না। আর একটু সময় পেলে ওটাই আমাকে এতক্ষণে আরাম করে খেত। ফালতু সেন্টিমেন্ট ছাড়। সুদীপ ওদের ইঙ্গিত করল। সাওদের তো তৈরি হয়েই ছিল। বাকি দুজন হাত লাগাতে লেপার্ডটাকে নড়ানো সম্ভব হল। টানতে টানতে ওরা ওকে ঝরনার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। সুদীপ হাসল, তোর চামচেটাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?

চামচে?

সুদীপ সাওদেরকে দেখাল।

চামচে বলছিল কেন?

তোকে দেখলে ওর মুখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে লক্ষ্য করেছিস?

জয়িতা দাঁড়াল না। তার মেজাজ খিচরে যাচ্ছিল। সম্প্রতি সুদীপের কথাবার্তায় সামান্য সৌজন্য থাকছে না। সুদীপ দৌড়ে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে থামাল, তুই এত ক্ষেপা হয়ে গেলি কেন?

ছেড়ে দে আমাকে। এক ঝটকায় নিজেকে আড়াল জয়িতা।

তুই শালা খুব কাঠখোটা। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সুদীপ বলল।

সঙ্গে সঙ্গে কাঁপুনিটা ফিরে এল। সুদীপ বলছে কাঠখোট্টা, অথচ একটু আগেই সে শুনেছে, তুমি কি নরম! কোটে সত্যি?

হঠাৎ সুদীপ বলল, শোন, মালপত্র কমে আসছে। আনন্দ বলছে চ্যাঙথাপু থেকে কিনে আনা দরকার। আমি নিজে যাব বলেছি। তোর জন্যে কিছু আনতে হবে?

তুই তাপল্যাঙের বাইরে যাবি? অজান্তে প্রশ্নটা মুখ থেকে বের হল।

হ্যাঁ। তার পরেই হো হো করে হেসে উঠল সুদীপ, তুই কল্যাণের কেসটা ভাবছিস? আমি শালা কখনও মরব না। তাছাড়া চ্যাঙথাপুতে পুলিশফাড়ি নেই।

জয়িতা কোন কথা না বলে নীরবে হাঁটছিল। সুদীপ বলল, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সোজা কলকাতায় চলে যাই। একবার দেখে আসি সেখানকার মানুষগুলো কে কেমন আছে!

কে কেমন আছে সেকথা জানতে যেতে হবে কেন? পুরু চামড়ার নখদন্তহীন চোখের পর্দা ছেড়া আত্মসম্মানহীন কয়েক লক্ষ বাঙালী গর্তে মুখ লুকিয়ে এ ওকে গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে। আমরা কি করেছিলাম তা অর্থহীন ওদের কাছে। আর এই যে আমরা তাপল্যাঙে যেজন্যে পড়ে আছি তা জানতে পারলে পেছনে একটা ধান্দ খুঁজবে। রগরগে মশলা না পেলে আমাদের কথা শুনতেও চাইবে না। ওদের দেখার জন্যে কষ্ট করার কি দরকার! জয়িতা ক্লান্ত গলায় বলল।

হঠাৎ সুদীপ বলল, জয়ী?

জয়িতা তাকাল। সুদীপ হাসল, তোকে অনেকদিন বাদে এই নামে ডাকলাম।

কি বলছিলি?

ধর, আমরা যা চাইছি সব হল। তাপল্যাঙের মানুষদের নির্দিষ্ট আয় হল। কো-অপারেটিভ ডেয়ারি, ফার্ম এবং অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে মানসিক সুস্থিতিও এল। তখন আমরা কোথায় যাব?

কোথায় যাব মানে? এখানেই থাকব, এদের সঙ্গে।

সুদীপ মাথা নাড়ল। কিন্তু কোন কথা বলল না। ওরা গ্রামে ফিরে আসছিল। এর মধ্যে খবর পৌঁছেছে। দলে দলে লোক ছুটছে মো-লেপার্ডটাকে নিয়ে আসার জন্যে। এবং তখনই জয়িতা আনন্দদের দেখতে পেল। দশ-বারোজন লোক কাঠের বোঝা বরফের ওপর দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। আনন্দ একটু ঝুঁকে হাঁটছে। জয়িতার মনে হল এই কয় মাসে আনন্দ যেন অনেক বয়স্ক হয়ে গিয়েছে। ওর শরীরেও ভাঙন এসেছে। সে চমকে সুদীপের দিকে তাকাল। এবং মনে হল সুদীপের চেহারায়ও সেই জেল্লা নেই। নিজেকে অনেকদিন দ্যাখেনি জয়িতা। সে এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছিল তার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবার কোন কারণ নেই। আনন্দর দিকে তাকিয়ে হঠাৎই বুকের মধ্যে একটা ছটফটানি টের পেল জয়িতা।

সে ছুটে এগিয়ে এল। আনন্দ হাসল, গ্রেট ডিসকভারি! কাঠ তো ছিলই, এই অঞ্চলে প্রচুর বড়এলাচের গাছ আছে। বরফ গললে বড়এলাচ সাপ্লাই দেওয়া যাবে। আর নিচের দিকে বেতের বন দেখতে পেলাম। এত ওপরে বেত, ভাবা যায় না। পালদেম বলছে গ্রামের অনেকেই বেতের কাজ জানে। ব্যাপারটা অর্গানাইজ করতে হবে।

তুই ভাল আছিস আনন্দ? জয়িতা প্রশ্নটা করে ফেলল।

কেন? আমাকে খারাপ দেখাচ্ছে? আনন্দ অবাক হল।

না, ঠিক আছে।

তোদের মাথায় কখন কি ঢোকে কে জানে! আর হ্যাঁ, চমরীদের একটা দল এসেছে এদিকে। পায়ের ছাপ দেখলাম। জ্যান্ত ধরব বলে ফাঁদ পেতে এলাম। রান্না হয়ে গেছে?

আমি দেখছি। জয়িতার মনে পড়ল তার কাজটার শেষ না দেখেই বেরিয়ে পড়েছিল।

এই সময় আনন্দর নজরে পড়ল। সে চিৎকার করে সুদীপকে ডাকল, কিরে, এখনও খাঁচাগুলো তৈরি করিসনি?

সুদীপ জবাব দিল, আমি একটু শিকারে গিয়েছিলাম।

শিকার! তোকে কে শিকারে যেতে বলেছিল? পশু মারার চেয়ে পশু বাঁচানোই তো জরুরী। আমরা যদি নিজেদের কাজগুলো না করি–। বিরক্তিতে আনন্দ মুখ ফেরাল। জয়িতা আশঙ্কা করছিল সুদীপ হয়তো একটা কড়া জবাব দেবে। কিন্তু সুদীপ কিছুই করল না। চুপচাপ চলে গেল খাঁচার কাছে। ব্যাপারটা অভিনব লাগল জয়িতার। আনন্দ ততক্ষণে চলে গেছে যৌথগৃহের দিকে।

জয়িতা খাবারের ব্যবস্থা দেখার আগে সুদীপের কাছে গিয়ে বলল, তুই হঠাৎ এত ভাল হয়ে গেলি কি করে রে?

সুদীপ বলল, ফোট! ন্যাতানো কথা বলিস না।

কথাটা খুব বিশ্রী লাগল জয়িতার। হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হল সুদীপ কখনও তাকে বলেনি সে ভিজে কথা বলে! সে কি তাই বলছে! এবং তখনই সেই তিনটে শব্দ কানের মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলল, তুমি কি নরম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *