৪৭
প্রফেসর শর্মা তার কটেজের পলকা দরজাটা বারকয়েক টেনে এবং ঠেলে দেখে নিয়ে কৃষ্ণজীবনের দিকে চেয়ে বললেন, ইউ থিংক ইট ইজ সেফ?
কৃষ্ণজীবন মৃদু হেসেছিল। জবাবে বলেছিল, বাইরে একটা ফ্লাডলাইট সারা রাত জ্বলে। বন্যজন্তুরা আসে না আলো দেখলে।
শর্মা সন্তুষ্ট হননি। ভ্রূ কুঁচকেই ছিল।
এখানকার জঙ্গলমুখী নিরালা কটেজ মোটেই খুশি করেনি ডঃ পটেলকেও। লনে পাতা বেতের চেয়ারে বসে পাইপ টানতে টানতে বললেন, ইট সিমস্ এ হন্টেড প্লেস। ইট গিভস্ মি শিভারস।
ডঃ স্বামী ধার্মিক বিজ্ঞানী। তিনি কোনও মন্তব্য করেননি। কিন্তু এই প্রাচীন নির্জন জঙ্গলের মাঝমধ্যিখানে তৈরি হোয়াইট টাইগার লজকে তাঁরও বিশেষ পছন্দ হচ্ছিল না। তিনি বিরক্তিমাখা মুখে পায়চারি করছিলেন লনে।
মধ্যপ্রদেশ সরকারের যে-টুরিস্ট অফিসারটি তাঁদের সঙ্গে এসেছেন, তিনি কৃষ্ণজীবনকে একবার গাড়ির মধ্যেই বলেছিলেন, টোয়েন্টি সিক্স টাইগারস—ইয়েস, বাট নো ম্যান-ইটারস্।
জঙ্গলের নিবিড়তা আর নির্জনতা মুগ্ধ করেছে শুধু কৃষ্ণজীবনকেই। লোকালয় ছাড়িয়ে অনেকটা ভিতরে ঢুকে তবে এই লজ। ছড়ানো ছিটোনো ডিটাচড্ এক একটি কটেজ। পিঠোপিঠি দুটি করে ঘর। কৃষ্ণজীবনের ভাগ্যে জুটেছে সবচেয়ে দূরবর্তী ঘরখানা। মুখোমুখি জঙ্গল। তাতে সে খুব খুশি। যদিও সরকারি অফিসারটি তাকে চুপি চুপি বলেছিল যে বান্ধবগড় জঙ্গলের বাঘেরা প্রায়ই লজের ভিতর দিয়ে যাতায়াত করে।
জব্বলপুরে সরকার আয়োজিত সেমিনারটি ছিল পৃথিবী জুড়ে এরকম হাজার হাজার নিষ্কর্মা সেমিনারের একটি। আলোচনা হয়, কাজের কাজ কিছুই হয় না। যাতায়াত ভাড়া, ফি বাবদ কিছু টাকা আর ফাউয়ের মধ্যে একটু দেশভ্রমণ। কৃষ্ণজীবন এসব সেমিনারে যাওয়া একদিন ছেড়ে দেবে। আপাতত ছাড়েনি। কারণ সেমিনারগুলি কেন অসাড় ও নিস্ফলা সেটাও তার ভালভাবে জানা দরকার। মাঝবয়েসী বা বৃদ্ধ, সফল ও সুখী, প্রতিষ্ঠিত ও পরিবার-বৎসল বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে যে আর নতুন দিগন্তের তালা খোলা যাবে না সেটা সে যেমন বোঝে তেমন কি বোঝে সরকার বা প্রশাসন? এদের মাথা আছে কিন্তু দেশ বা পৃথিবীর জন্য তেমন মাথাব্যথা নেই। কিছু সুখসুবিধা ও প্রতিষ্ঠার মধ্যে এরা গুটি পাকিয়ে থাকতে চান। ডানা মেলতে চান না আর। বুঝে গেছেন, আর করার কিছু নেই।
বিকেলে তাঁরা বান্ধবগড় পৌছেছেন সরকারি বদান্যতায়। সেমিনারের পর ফাউ হিসেবে জঙ্গলে একটু বিশ্রাম। জব্বলপুর থেকে রাস্তা বড় কম নয়। স্বামী চেয়েছিলেন খাজুরাহো যেতে। সেটা মনঃপূত ছিল শর্মারও। তিনি একটু এরোটিকার ভক্ত। শুধু কৃষ্ণজীবন চেয়েছিল জঙ্গল। পটেল তাকে সমর্থন করেছিলেন বটে, কিন্তু লজটি দেখে তাঁর বিশেষ ভাল লাগছে না।
অথচ ভাল না লাগার কারণ নেই। সরকারি লজের সব ব্যবস্থাই এখানে রয়েছে। লাগোয়া বাথরুম, গরম-ঠাণ্ডা জল, রুম হিটার। এসব না হলেও কৃষ্ণজীবনের চলত।
কৃষ্ণজীবন যখন তার ঘরে পোশাক পাল্টে পায়জামার পর পাঞ্জাবি চড়িয়ে আলোয়ান জড়াচ্ছিল তখনই সরকারী অফিসার আনোয়ার বিনীতভাবে এসে দাঁড়াল দরজায়।
স্যার, একজনকে মীট করবেন?
কে বলুন তো?
লোকটা রাজবাড়িতে থাকে। পঁচিশ মাইল সারকামফারেন্সে জনমনিষ্যি নেই। রাজবাড়ি, এখন ভূতের বাড়ি।
বিস্মিত কৃষ্ণজীবন বলে, থাকে কেন? তান্ত্রিক নাকি?
না স্যার, ঠিক তান্ত্রিক নয়। তবে পুরোহিত। পরিত্যক্ত রাজবাড়িতে একটা বিগ্রহ আছে, তার পুজো করে রোজ। চল্লিশ টাকার মতো পায় মাসকাবারে। ব্যস, ওই জন্যই থাকে।
মাত্র ওই ক’টা টাকার জন্য?
সেইটাই তো আশ্চর্যের। বউ বাচ্চা সব গাঁয়ে থাকে, বিশ পঁচিশ মাইল দূরে। জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ের ওপর কেল্লায় লোকটা একা থাকে। লোকে বলে জিন পরীরা ওকে খাওয়ায়।
লোকটা বেশ সাহসী বলতে হবে। তার সঙ্গে দেখা করা যায়?
নিশ্চয়ই। রোজই আসে এদিকে। কালকেই দেখতে পাবেন সকালবেলায়।
বাঘের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেঁটে আসে রোজ?
আজ্ঞে হ্যাঁ। হাতে লাঠিও থাকে না।
সাবাস!
সাধুবাদটা তার মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে এল। যে মানুষ জঙ্গল, শ্বাপদ, একাকিত্ব ও নির্জনতাকে ভয় পায় না তেমন মানুষকে তার খুব পছন্দ।
লোকটা কি খুব গরিব?
খুব। জঙ্গল থেকে আতা, বেল এইসব ফল-টল তুলে এনে বিক্রি করে। এখানে টুরিস্ট লজে যারা আসে তারাই কখনও কখনও কেনে। গাঁয়ের লোক তো পয়সা দিয়ে ফল কেনে না।
লোকটার কেমন করে চলে তা আর জিজ্ঞেস করল না কৃষ্ণজীবন। এ দেশের কোটি কোটি গরিবের কী করে চলে সে রহস্য ভেদ করতে কে পারবে? কেউ জানে না।
সন্ধের পর লজের ম্যানেজার সম্মানিত অতিথিদের জন্য ছোট্ট একটা ককটেলের আয়োজন করলেন লজের রিসেপশনে। কৃষ্ণজীবন জীবনে কখনও মদ খায়নি। সে একটা সফট ড্রিঙ্ক নিয়ে বসে রইল। সর্বদাই তার বিচরণ চিন্তার রাজ্যে। বাস্তবতার মধ্যে সে কমই থাকে। তার সামনে আস্তে আস্তে চারজন মানুষ নরমাল থেকে হাই হয়ে যেতে লাগল। মদ খাওয়া মানে যেন বেলুনে চড়ে কিছুক্ষণের গগনবিহার। স্বাভাবিকতা থেকে কিছুক্ষণের ছুটি। অনেক পয়সা খরচ করে এই ছুটিটুকু কিনতে হয় মানুষকে। আবহমানকাল ধরে গরিব-দুঃখী থেকে রাজা-গজা অবধি এই জিনিসের নেশা করে আসছে। সস্তা বা দামী—যে যেমন পারে। সুরার বন্দনা কিছু কম হয়নি পৃথিবীতে। কিন্তু কেন, সেই কারণটা কৃষ্ণজীবন আজও খুঁজে পায়নি।
পটেল একটু বেশিই মাতাল হয়ে গেলেন। বোধহয় ইচ্ছে করেই। মদ খেতে খেতেই বলছিলেন, আমার ভীষণ ভূতের ভয়। আমার ঘরে আর কাউকে শুতে হবে রাতে।
কিন্তু পটেল এতই মাতাল হয়ে পড়লেন যে, ভূতের ভয় গৌণ হয়ে গেল। তাকে ধরাধরি করে নিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল ঘরে।
এই নির্জন অরণ্যাবাসে নিশুত রাত্তির হয়ে গেল সন্ধের কিছু পরেই। ডিনারের পর যখন যে যার শশাওয়ার ঘরে গিয়ে দরজা দিলেন তখনও ন’টা বাজতে দু’এক মিনিট বাকি।
হেমন্তের শেষ। যথেষ্টই শীত পড়েছে এখানে। একটু রাতের দিকে যখন চাঁদ উঠল তখন বাইরের ফ্লাড লাইটটা নিবিয়ে দিয়ে কৃষ্ণজীবন একটি বেতের চেয়ার বাইরে টেনে এনে বসল। অল্প কুয়াশায় মাখা কী বন্য ভয়ংকর জ্যোৎস্না! জঙ্গলে নীল গাইয়ের ডাক, পাখির ডাক, হরিণের গলা খাঁকারি শোনা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে পাতায় পাতায় শিশির পড়ার শব্দ। চারদিককার গাছপালা যেন কৃষ্ণজীবনকে একা দেখে একটু ঘন হয়ে সরে এল কাছাকাছি। যেন কৃষ্ণজীবনের কাছে তারা কিছু শুনতে চায়।
এইসব রাতের সৌন্দর্য দেখে গড়পড়তা বাঙালি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে ওঠে বা আহা উহু করে চাঁদের নানাবিধ প্রশংসা করে। কবিতাও মনে পড়ে কারও কারও। সৌন্দর্য ওভাবেও দেখা যায়। কিন্তু অরণ্যের জ্যোৎস্না বা অন্ধকার, গ্রীষ্ম বা শীত বরাবর অন্যভাবে মূক করে দেয় কৃষ্ণজীবনকে। সে যেন হাজার হাজার বছর পিছিয়ে চলে যায় মানুষের আদিম আরণ্যক একাকিত্বে। চারদিকে সভ্যতার নানা নির্মাণ মিথ্যে হয়ে যায়। মুগ্ধ, সম্মোহিত, ভূতগ্রস্ত কৃষ্ণজীবন তার অধীত সব বিদ্যা বিস্মৃত হয়। ভাষা অবধি ভুলে যায়, তার মন মাথা সব কিছু হয়ে যায় মূক ও বধির। না, কৃষ্ণজীবনের ভয় করে না। একটুও ভয় করে না। জঙ্গলের অনেক গভীরে পাহাড়ের ওপরকার পরিত্যক্ত কেল্লায় যে লোকটা একা থাকে কৃষ্ণজীবন তার চেয়ে কিছুমাত্র কম সাহসী নয়।
কত রাত অবধি বসে রইল কৃষ্ণজীবন তা তার নিজেরও খেয়াল ছিল না। সময় যেন এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হয়তো আড়াল থেকে বাঘের চোখ তাকে লক্ষ করে গেল লাভ দেখে গেল ভালুক ও নীল গাই, তাকে নজর করল রাতচরা পাখি।
যখন অবশেষে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় ঢুকল সে, তখন তিনটে বাজতে সামান্যই। বাকি। সকালে হাতির পিঠে চড়ে এবং লানচের পর জীপ নিয়ে তাদের জঙ্গলে দু দফা ঘটে। বেড়ানোর কথা। সেসব বেড়ানোর মধ্যে শৌখিন বাবুয়ানা আছে। কৃষ্ণজীবনের ভাল লাগে পায়ে হেঁটে, একা গভীর গভীর জঙ্গলে দিশাহীন ঘুরে বেড়াতে, গাছপালার মধ্যে নিথর হয়ে চুপ করে বসে। থাকতে।
সকালে ব্রেকফাস্টের পরই শর্মা এবং স্বামী হাতির পিঠে চড়ে বাঘ দেখার জন্য কিছু উদ্বেল হলেন। পটেলের হ্যাংওভার, সম্ভবত প্রেশারটাও বেড়েছে। সুতরাং যাবেন না।
হাতির পিঠে যখন কাঠের মস্ত তক্তা পাতা হয়েছে এবং রওনা দেওয়ার তোড়জোড় চলছে ঠিক সেই সময়ে নোকটা এল। সাধারণ গ্রামবাসীর মতোই চেহারা। কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। হেঁটো ধুতি, গায়ে মোটা আধময়লা সাদা একটা জামা, তার ওপর সুতির চাদর, পায়ে রবারের চটি। হাতের ব্যাগে কিছু কতবেল।
আনোয়ার তাকে ধরে এনে মান্য অতিথিদের সামনে দাঁড় করাল।
এই সেই লোকে স্যার, কেল্লায় থাকে।
লোকটাকে সবাই দেখল, বিশেষ গুরুত্ব দিল না। দু-চারটে মামুলি প্রশ্ন করে ছেড়ে দিল।
কৃষ্ণজীবন তাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করল, কেল্লাটা কেমন?
লোকটা কম কথার মানুষ। হয়তো বা লাজুক বা কথা ভালবাসে না। সামান্য মাথা নেড়ে বলল, ভালই।
দেখতে যাওয়া যায়?
অনেকেই যায়।
আপনি ওখানে একা থাকেন কেন?
এমনিই।
একা থাকতে ভালবাসেন?
হ্যাঁ।
কিরকম লাগে?
ভাল।
গাছপালা ভালবাসেন?
হ্যাঁ।
নির্জনতা ভাল লাগে?
হাঁ।
আমি যদি কেল্লায় যেতে চাই তাহলে নিয়ে যাবেন?
আপনাদের হাতি আছে, নিয়ে যাবে।
কৃষ্ণজীবন লোকটাকে দেখে খানিকটা হতাশই হল। এ ঠিক প্রাকৃত বিভূতিভূষণ নয়। হয়তো দজ্জাল বউয়ের ভয়ে পালিয়ে থাকে।
ভূতে বিশ্বাস করেন?
কেন করব না?
ভূত দেখতে পান?
না।
লোকে বলে জিন আর পরীরা আপনাকে খাবার দিয়ে যায়। না।
এ লোকের সঙ্গে কথা বলে কোনও উন্মোচন ঘটানো যাবে না। কৃষ্ণজীবন তাই ক্ষান্ত হল। জঙ্গলে নির্জন কেল্লায় দীর্ঘকাল একা বসবাস করেও এর মধ্যে কোনও কিছুর সঞ্চার হয়নি। লোকটা যেমন ভোঁতা ও কল্পনাহীন ছিল তেমনই রয়ে গেছে। বোকা মানুষেরা ওকে নিয়ে কিংবদন্তী বানিয়ে চলেছে। তবে হয়তো অরণ্যের কাছ থেকে ও একটা জিনিস শিখেছে। সেটা হল নিচুপ থাকা, কথা কম বলা।
কতবেল কেউ কিনল না, লোকটা একটু দাঁড়িয়ে থেকে গাঁয়ের দিকে চলে গেল।
হেলেদুলে সকালটা কাটল হাতির পিঠে। অজস্র প্রাচীন গুহা, সম্বর, নীল গাই, বহু পুরোনো এক শায়িত বিষ্ণুমূর্তির ওপর দিয়ে নেমে আসা ঝরনা ইত্যাদি দেখা হল বটে, কিন্তু যাকে দেখতে আসা সেই বাঘের দেখা পাওয়া গেল না কোথাও। বাঘ ছাড়াও যে জঙ্গলে আরও অনেক কিছু দেখার আছে সেটা বুঝতে চাইলেন না শমা বা ডঃ স্বামী। একটু খুঁতখুঁত করছিলেন, ছাব্বিশটা বাঘের একটারও তো দেখা মিলবে!
তবে “কিল” পাওয়া গেল। হরিণের সদ্যভুক্ত দেহাবশেষ। এক জায়গায় বাঘের পদচিহ্নেরও হদিশ মিলল। কিন্তু বাঘ নয়।
দুপুরে লানচের পর আর এক দফা বেরোনো হল। কিন্তু বাঘহীন ভ্রমণই সার হল শুধু। বেলা পড়বার আগেই খানিকটা ক্লান্ত হয়ে ফিরে এল তারা।
গাইডেড সরকারি ভ্রমণ শেষ হয়েছে। কাল সকালে তারা ফিরে যাবে। কৃষ্ণজীবন চায়ের টেবিলে বসল বটে, কিন্তু মনটা বড় চনমন করছিল তার। এভাবে নয়, এই অরণ্যকে অন্তত কিছুক্ষণের জন্যও তার একা পাওয়া দরকার।
ক্লান্ত বিশেষজ্ঞরা ঘরে গেছেন। আনোয়ারকেও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। শুধু বেয়ারা দুজন বিষন্ন গম্ভীর মুখে টেবিল পরিষ্কার করছে। এই সুযোগ।
কৃষ্ণজীবন উঠল এবং পায়ে পায়ে লজের সীমানা ডিঙিয়ে চলে এল মুক্ত জঙ্গলের ভিতরে। জীপ-রাস্তাটি সযত্নে এড়িয়ে সে ঘাসজঙ্গলের ভিতরে ঢুকে গেল একা। শেষবেলার রঙিন আলোয়। কী অপার্থিব যে দেখাচ্ছে চারদিক।
সে শব্দ করছিল না। শব্দ করছিল বিচিত্র পাখিরা। শব্দ করছিল দূরবর্তী নীল গাই। হরিণের পায়ের দ্রুত শব্দ।
একটা মস্ত গাছের বেড় পেরিয়ে পাথরের চাতাল। উচ্চাবচ একটা জায়গা। ক্ষয়া পাথরের একটা প্রাকৃতিক স্থাপত্য। যাকে সারাদিন এত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খোঁজা হল তার দেখা যে এত অপ্রত্যাশিত পাওয়া যাবে কে জানত?
সামনেই খোলা চাতালের ওপর নিজের বর্ণের আগুনে যেন দাউ দাউ করে জ্বলছিল বাঘ। পায়ের তলায় সদ্য শিকার করা হরিণ। বোধহয় তখনও হরিণের হৃৎপিণ্ড ধক ধক করছিল। বিশাল বাঘটা অবহেলায় একখানা পা হরিণের ওপর রেখে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো দম নিচ্ছে। ভঙ্গিটা তাচ্ছিল্যের। অবজ্ঞাভরে সে একবার কৃষ্ণজীবনের দিকে তাকাল।
চোখে চোখ। কৃষ্ণজীবন চোখ ফেরাতেই পারল না। বিস্ময়ে মুগ্ধতায় চেয়ে রইল।
পালানোর কথা বা লুকিয়ে পড়ার কথা মনেই হল না কৃষ্ণজীবনের। সে শুধু অরণ্যের পটভূমিতে স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী রাজাকে দেখছিল। রাজা জ্বলে যাচ্ছে নিজের দাউদাউ গাত্রবর্ণে। শেষবেলার পড়ন্ত আলো যেন তাকে ঘিরে নেচে উঠছে উল্লাসে।
কৃষ্ণজীবন আরও কয়েক পা এগিয়ে গেল। মাত্র পনেরো বিশ ফুটের তফাতে বাঘ দাঁড়িয়ে। কৃষ্ণজীবনের কোনও আড়াল নেই, অন্ত্র নেই। কৃষ্ণজীবন পালাচ্ছেও না। চোখ অবধি সরাল না।
বাঘ চকিতে একবার পিছু ফিরে কী যেন দেখে নিল। তারপর ফের কৃষ্ণজীবনের দিকে তাকাল।
কৃষ্ণজীবন চাপা স্বরে বলল, নমস্কার।
বাঘ একটা হাই তুলল মাত্র।
আপনাকে বিরক্ত করলাম। মাপ করবেন।
বাঘ চেয়ে রইল তার দিকে।
আমি আপনার একজন বন্ধু।
আবেগে, আনন্দে কৃষ্ণজীবনের গলা বন্ধ হয়ে আসছিল। সে মৃদুস্বরে বলল, আসি।
সামান্য, খুব সামান্য একটা ভু-র-র শব্দ এল বাঘের গলা থেকে।
কৃষ্ণজীবন ধীরে ঘুরে গিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে লজে ফিরতে লাগল। একটু দূর থেকেই সে সোরগোল শুনতে পাচ্ছিল একটা। লজের এলাকায় ঢুকতেই দেখল, সবাই সার বেঁধে দাঁড়িয়ে। উত্তেজিত কথাবার্তা হচ্ছে।
তাকে দেখেই ছুটে এল আনোয়ার, স্যার! আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?
কৃষ্ণজীবন একটু অবাক হয়ে বলে, কাছেই! কেন?
বাঘ বেরিয়েছে স্যার! বাঘ। শিগগির ঘরে ঢুকে যান।
কৃষ্ণজীবন স্মিত মুখে বলল, তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, আনোয়ার সাহেব। হি ওয়াজ এ নাইস জেন্টলম্যান।
তিন দিন বাদে গল্পটা সে দোলনকে বলছিল রাতে, তার বিছানার পাশে বসে। দোলনের ঠাণ্ডা লেগে একটু জ্বর হয়েছে। অসুখ হলেই সে বাবাকে আরও বেশি করে চায়। দুটো হাতে সে। কৃষ্ণজীবনের একটা হাত শক্ত করে ধরে আছে। চোখ বড় বড়। মুখখানা হাঁ।
বাঘটা যদি তোমাকে খেয়ে ফেলত বাবা?
কৃষ্ণজীবন সামান্য উদাসভাবে বলল, ওরা মানুষখেকো বাঘ নয় বাবা।
যদি কামড়ে দিত?
কথাটা তো তখন আমার মনেই হয়নি। এত সুন্দর দেখাচ্ছিল বাঘটাকে, আগুনের মতো, আলোর মতো, আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম। কী ভদ্র, কী সহবত! আর কী সাংঘাতিক অহঙ্কার!
দোলন ভয়ার্ত গলায় বলে, আর কখনও ওরকম করো না বাবা।
কৃষ্ণজীবন একটু হেসে তার প্রিয় পুত্রটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, বাঘ তো মানুষের করুণার পাত্র বাবা। সারা পৃথিবীতে কয়েকটাই মাত্র বেঁচে আছে। মানুষেরই দয়ায়। বাঘ-মারা বীরদের কত গল্প আছে, আমি যখন পড়ি তখন চোখে জল আসে। কেন জানো? বাঘের দাঁত, নখ আর খিদে ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু মানুষের কত কী আছে। বন্দুক, বুদ্ধি, অকারণ হিংস্রতা।
কিন্তু বাঘ যখন মানুষ মারে বাবা?
বাঘ যত মানুষ মেরেছে, মানুষের হাতে মারা পড়েছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। তুমি ভেবো না বাবা, বাঘের দেখা পাওয়া এখন ভাগ্যের কথা।
খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল দোলন। বাবার সব কথা সে আকণ্ঠ বিশ্বাস করে। তুমি খুব চিন্তিতভাবে সে বলল, বাঘটা কি তোমার বন্ধু হয়ে গেল বাবা? আবার যদি দেখা হয় কিছু করবে না তোমাকে?
চিন্তিত হল কৃষ্ণজীবনও। খানিকক্ষণ ভেবে বলল, বাঘ তত বুদ্ধিমান নয়। তার খিদেই তাকে চালায়। মানুষের নিষ্ঠুরতা তার চেয়ে ঢের বেশি।
তাহলে বাঘ কি মানুষের চেয়ে ভাল?
এ প্রশ্নের জবাব কলকাতার সাততলার ফ্ল্যাটে বসে খুঁজে পায় না কৃষ্ণজীবন। এ প্রশ্নের জবাব রয়েছে দূরের বান্ধবগড় জঙ্গলে, যেখানে এই রাতের অন্ধকারে এখন আদিম পৃথিবীর নিয়মে চলছে সব কিছু।
দোলন ঘুমিয়ে পড়লে কৃষ্ণজীবন উঠে আসে নিজের ঘরে। চুপচাপ বসে থাকে চেয়ারে। দুখানা বাঘের চোখ বহু দূর থেকে নিষ্পলক চেয়ে থাকে তার দিকে।
না, এ তার কোনও বীরত্বের গল্প নয়। বরং এ এক করুণ কাহিনী। লুপ্তপ্রায় ব্যাঘ্র-প্রজাতির একজনের সঙ্গে তারই স্বক্ষেত্রে দেখা হয়েছিল কৃষ্ণজীবনের। দুজনের মধ্যে একটু দৃষ্টি বিনিময় হয়েছিল মাত্র। তারা কেউ কাউকে আক্রমণ করেনি, এইমাত্র।
সাতদিন পর অনু নাগাল পেল তার। অনুরই জন্মদিনে, তার বাড়িতে। ইদানীং তারা কয়েকটি প্রতিবেশী পরিবার নিকটস্থ হয়েছে পরস্পরের। এর-ওর বাড়িতে ওর বা এর নিমন্ত্রণ হয় প্রায়ই। অনুর বাড়িতে কৃষ্ণজীবনের আসা এই প্রথম। রিয়া আসে, ছেলেমেয়েরা আসে। সে কখনও আসেনি। অনুর বাবা নিজে নিমন্ত্রণ করে এসেছিলেন বলে আসা।
আপনি কী বলুন তো?
কৃষ্ণজীবন বাচাল মেয়েটির দিকে চেয়ে হেসে বলে, কী হল?
শুনলাম আপনি বাঘের মুখে পড়েছিলেন ইচ্ছে করে?
গল্পটা খুব ছড়িয়েছে দেখছি।
গল্প নাকি? এটা তো ঘটনা।
ইচ্ছে করে পড়িনি। মুখেও পড়িনি।
তাহলে?
যেমন বন্ধুর সঙ্গে পথেঘাটে দেখা হয় ঠিক তেমনিই দেখা হয়ে গিয়েছিল।
অনু গোলাকার চোখে চেয়ে বলে, বাঘের সঙ্গে দেখা হয় নাকি? ওকে দেখা-হওয়া বলে? কী পাগল আপনি!
রিয়া শুনতে পেয়ে এগিয়ে এল, কাকাবাবুকে আচ্ছা করে শাসন করো তো! সত্যিই পাগল। আমাদের কাছে তোত এসব বলেন না, দোলনের কাছে শুনে ভয়ে মরি।
রিয়া সরে যেতেই অনু মুখ ভেংচে বলে, কাকাবাবু না হাতি! আপনি আমার বন্ধু না?
তাই তো।
আমি কাকাবাবুটাবু ডাকতে পারব না কিন্তু। বন্ধু বলে ডাকব। কাকাবাবু ডাকলে কি বন্ধুত্ব হয়?
আমি অত জটিল ব্যাপার বুঝতে পারি না।
কেন পারেন না? বাঘের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারেন আর আমার সঙ্গে পারেন না?
কে বলে পারি না!
কেমন এড়িয়ে চলেন আমাকে।
এড়িয়ে চলি না তো?
খুব অ্যাভয়েড করেন আমাকে। এই যে মধ্যপ্রদেশে গেলেন একবারও বলেননি তো!
বলা উচিত ছিল, না?
বন্ধুকে বলতে হয়। আমি কত খোঁজ করেছি আপনার। এবার থেকে যখন যাবেন আমাকে একটু খবর দেবেন।
অপর্ণা একটা খাবার ভরা প্লেট নিয়ে এগিয়ে আসে, আমার মেয়ে আপনাকে জ্বালাচ্ছে তো খুব? ও ভীষণ টকেটিভ?
বেশ ভাল মেয়েটি আপনার।
মাথা তো শার্প, কিন্তু পড়ে না একদম।
পড়বে। ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
আপনি এত বিদ্বান মানুষ। আমার মেয়েটা বোধহয় আপনার সঙ্গে সমানে সমানে কথা বলে! আপনি নাকি ওর বন্ধু।
অপর্ণা হাসছিল। ভারী সুন্দর হাসিটি। একটু দুষ্টুমি মেশানো, কিন্তু সত্যিকারের হাসি। অনেকটা অনুর মতোই।
আসুন, একটা মেয়ের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিই। ইউ উইল লাইক হার। এই আপা, এদিকে এসো।
রোগা, ক্ষয়া, কালো চেহারার একটি মেয়ে হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল, ওকে আমি চিনি। উনি বিখ্যাত লোক। আর আমি তো সামান্য একটা মেয়ে, দেওয়ার মতো পরিচয়ই নেই।
অপর্ণা হেসে বলে, খুব সামান্য হলে আর ভাবনা ছিল কি? বুঝলেন, এ মেয়েটি কিন্তু সাংঘাতিক।
কৃষ্ণজীবন আপার দিকে চেয়ে ছিল। তার জহুরির চোখ নেই। কিন্তু অনেক দিন বাদে সে একটি পরিষ্কার ও স্পষ্ট মেয়েকে দেখল। লাবণ্য নেই, স্বাস্থ্য নেই, কিন্তু চোখে এক গহিন গভীরতা আছে যেন।