1 of 2

৪৭. নিজের ঘরে দু’জনকে বসাল তৃষা

নিজের ঘরে দু’জনকে বসাল তৃষা। দীপনাথ চেয়ারে, মণিদীপা তৃষার পাশে বিছানায়।

মণিদীপা আগের দিন যে পোশাক পরে এসেছিল তা তৃষার তেমন পছন্দ হয়নি। আজ মণিদীপার পরনে শাড়ি। চুলে নতুন করে ঘঁট দেয়নি বলে বব চুলও অনেক লম্বা হয়ে কাঁধ ছাড়িয়েছে। শুধু কপালের দু’পাশে কয়েকগাছি চুল ছাঁটা। সেগুলো সবসময়ে দু’দিকে ঝাপটার মতো দোলে। সিঁথিতে সিদুর না থাকায় দীপনাথের সঙ্গে ওকে যে-কেউ প্রেমিক-প্রেমিকা বলে গুলিয়ে ফেলবে। বয়সটাও কম। তার ওপর চেহারায় খুকির ছাপ প্রবল।

তৃষা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যা দেখার দেখে নেয়। বলল, আগের দিন কিন্তু বলে গিয়েছিলেন খুব তাড়াতাড়ি আবার আসবেন। আসতে কিন্তু বছর ঘুরে গেল।

পথটা ঠিক চিনি না তো! ট্রেনে আগেরবার আসিনি। নইলে ঠিক চলে আসতাম। একা কেন? দীপুই তো আনতে পারত।

ওঁর কত কাজ!—ছদ্মগাম্ভীর্যে মণিদীপা বলে, কতদিন ধরে সাধাসিধি করে আজ তবু সময় হল। আপনার এই খামারবাড়িটা এত ফ্যান্টাসটিক যে, আমার বারবার এ জায়গাটার কথা মনে পড়ে।

তৃষা এই প্রশংসায় একটু আনমনা হয়ে গেল। বলল, জায়গাটা তো এমনিতে সুন্দর হয়নি। কত ভালবাসা এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার। লোকে কেবল বাইরে থেকে দেখে, এ বাড়ির মালিকদের কত টাকা।

মণিদীপা তৃষার এই ভাবান্তর লক্ষ করল না। সে আলতো প্রশ্ন করল, আচ্ছা আপনি কি জোতদার?

জোতদার! কই কখনও কথাটা ভেবে দেখিনি তো! না বোধ হয়, আমি জোতদার-টোতদার নই।

তবে জোতদার কাদের বলে?

মণিদীপাকে তৃষার হাতে ছেড়ে দিয়ে দীপনাথ বাইরে এসে দাঁড়ায়। খাঁ খাঁ করছে দুপুর। গ্রীষ্ম ও বর্ষার রেশ এখনও কেটে যায়নি। তবু এই বারান্দায় দাঁড়ালে আকাশের পেঁজা মেঘ, উঠোনের ধারে কিছু কাশফুল আর রোদের রং দেখলে শরৎকাল টের পাওয়া যায়। খানিকক্ষণ প্রকৃতির দিকে চেয়ে দীপনাথ মাথা নিচু করে বারান্দার পাশে জুতোর রবার সোল ঘষতে থাকে। বউদিকে আজ একটু অন্যরকম লাগছে না? একটু যেন বিব্রত! একটু অন্যরকম।

দীপনাথ সিঁড়ি ভেঙে নেমে উঠোন পেলোল। বাবার ঘরের দরজা আবজানো। নিঃশব্দে ঢুকে দেখল, তিনি কাত হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছেন।

তাকে না জাগিয়ে বেরিয়ে এল দীপ। এ ঘর সে ঘর ঘুরে কাউকে না পেয়ে সে এল ভাবন-ঘরে। দরজা আবজানো দেখে ঠেলে ঢুকেই থমকে গেল সে। মেজদা! কী হয়েছে মেজদার?

চোখের পাতা মেলে অনেকক্ষণ ঘোর-ঘোর আচ্ছন্ন ভাবটায় ড়ুবে থাকে শ্রীনাথ। তারপর চেতনায় ফেরে।

মেজদা!

দীপু!

তোমার কী হয়েছে?

আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবি, দীপু?

কোথায় যাবে?

পালিয়ে যাব। এরা কী ভীষণ ডেঞ্জারাস তা জানিস না। এরা মানুষ মারে, বোমা বানায়।

এরা কারা?

তৃষা, সরিৎ।

কী যা-তা বলছ?

কেউ বিশ্বাস করবে না, জানি। তবু বলছি, দে আর মার্ডারার্স। সজলকে জিজ্ঞেস করিস, বোমা বানায় কি না।

বোমা বানানো অত সোজা নয়। আর বোমা দিয়ে কী হবে?

কাল রাতে সরিৎ এ বাড়িতে বোমা ফাটিয়েছে।

সরিৎ?

তোর বউদি অবশ্য বলেছে, দুটো ছেলে রাতের বেলা তাকে খুন করতে এসেছিল। পুলিসকেও তাই বলেছে। পরে সজলের কাছ থেকে জেনেছি, আসলে বোমা বানায় সরিৎ নিজেই। তৃষা তার জন্য টাকা দেয়।

একটু বিরক্তির গলায় দীপনাথ বলে, আচ্ছা, সেসব কথা পরে হবে। তোমার কী হয়েছে আগে বলো তো!

ওসব শুনে আজ সকালে আমি কেমন নার্ভাস হয়ে কোলাপস্ করলাম।

শোনো মেজদা, এখনও তোমার শ্বাসে অ্যালকোহলের গন্ধ আসছে। নার্ভাস তুমি এমনিতে হওনি, মদ খেয়ে কোলাপ করেছ।

না, না। বিশ্বাস কর। সে শুধু খোয়াড়ি ভাঙতে একটু খেতে হয় বলে খাওয়া। আসল কারণ অন্য।

অনেক আগেই তোমাকে ডাক্তার দেখাতে বলেছিলাম। আমার সন্দেহ ভিতরে ভিতরে তোমার ডায়াবেটিস পাকিয়ে উঠছে।

দূর! মদ খেলে কোনও অসুখ হয় না।

এ কথাটা মাতাল বন্ধুদের কাছে শিখেছ। কথাটা কিন্তু সত্যি নয়।

মরলে মরব। রামে মারলেও মারবে, রাবণে মারলেও মারবে।

রাবণটা কে?

আমাকে এখান থেকে নিয়ে যা, দীপু। আই বেগ টু দী।

শেষ কথাটা ছেলেবেলায় পড়া ইংলিশ সিলেকশনের কোনও পাঠ্যাংশ থেকে মুখস্থ বলল শ্রীনাথ। দীপনাথ অবশ্য হাসল না। গম্ভীর মুখে বলল, নিজের কী অবস্থা করেছ যদি নিজের চোখে একবার দেখতে!

এরা আমাকে স্লো পয়জন করেনি তো, দীপু?

তোমাকে কে স্লো পয়জন করেছে তা কি জানো না?—দীপনাথ সামান্য ঝঝ মিশিয়ে বলে। বলেই হেসে ফেলে। শ্রীনাথের দুর্বল ন্যাতানো একটা হাত মুঠোয় নিয়ে বলে, অন্যের ঘাড়ে কেন দোষ চাপাচ্ছ? আমি তো তোমাকে চিনি।

তোরা সবসময়ে কেন আমারই দোষ দেখিস? আর কোনও দিকে তাকাস না কেন? একটা কালো মেয়েমানুষ এতগুলো লোককে কী করে হিপনোটাইজ করে রাখে বল তো?

তোমাকে তো পারেনি!

আমাকে পারা খুব সোজা নয়। আই হ্যাভ ড্রাংক লাইফ টু দি লিজ।

এটাও কোটেশন। কিন্তু দীপনাথ এবারও হাসল না। বলল, তোমাকে পারেনি। বুলুকেও পারেনি।

বুলুকে গুন্ডা দিয়ে মার খাইয়েছিল কে জানিস?

আমি হলেও তাই করতাম।

নিজের মায়ের পেটের ভাইকে গুন্ডা দিয়ে মার খাওয়াতিস?

না। নিজের হাতেই মারতাম। বউদি মেয়েমানুষ নিজের হাতে মারতে পারেনি বলে অন্যকে দিয়ে মার দিয়েছে।

হতাশ শ্রীনাথ চোখ বুজে বলে, তোরা অন্ধ। তোরা কোনওদিন টুথটাকে ধরতে পারবি না। ও তোদের জাদু করে রেখেছে।

বউদি যদি জাদু চালিয়ে থাকে তবে তুমিও কিছু পালটা জাদু চালাও না! কে বারণ করছে?

ও হচ্ছে লেডি ম্যাকবেথ। অ্যামবিশাস, ক্রুয়েল..

সব বুঝলাম। তবু বউদি তার কর্তব্য করে যাচ্ছে। এ বাড়ির দরজা এখনও আমাদের মুখের ওপর বন্ধ করে দেয়নি। বাবাকে আমরা কোনও ভাই-ই দেখিনি। বউদি দেখছে। তোমার লজ্জা করা উচিত, মেজদা।

শ্রীনাথ চুপ করে থাকে। দীপনাথ খানিকটা সময় ছাড় দিয়ে বলে, কাল রাতে বোমা কীভাবে ফাটল তা জানো?

না। তৃষা মাঝরাতে এসে ঘুম থেকে তুলে আমার কাছেই জানতে চেয়েছিল বোমাটা কে বা কারা মেরেছে।

তার মানে বউদি তোমাকে সন্দেহ করে!

কে জানে! হয়তো করে।

তুমি জানো কিছু?

কী জানব? সকালে সজলের কাছে শুনে বুঝলাম, সরিৎ বোমা বানায়। হয়তো রাতে গোপনে বানাচ্ছিল, অ্যাকসিডেন্টালি ফেটে গেছে।

তাই যদি হয় তবে বউদি পুলিসে খবর দেবে কেন? খবর দিলে তো নিজেদেরই ধরা পড়ার সম্ভাবনা। পুলিস বাড়িটা তন্ন তন্ন করে দেখবেই।

শ্রীনাথ যুক্তিটা বোঝে। তবু মিনমিন করে বলে, কাল রাতে কী হয়েছিল তা জানি না। তবে সরিৎ যে বোমা বানায়…

দীপনাথ একটু বিরক্ত হয়ে বলে, সজলের সব কথা বিশ্বাস কোরো না। ও বলে বেড়ায় আমি নাকি কুংফু জানি, পঞ্চাশটা লোককে একা ঘায়েল করতে পারি। আসলে সজল একটু রোমান্টিক, অনেক কিছু কল্পনা করতে ভালবাসে।

সরিৎ এক নম্বরের গুন্ডা, তুই জানিস না। স্টেশনের কাছে দুটো ছেলেকে চেন দিয়ে এমন মেরেছিল!

তুমি সব কিছুকে গুলিয়ে ফেলছ। সরিৎ গুন্ডা হলেই বা তোমার কী? আর বউদিকেই বা ওর সঙ্গে এক করছ কেন?

তোদের কিছুই বোঝানো যাবে না। তারা বুঝতে চাস না।

তোমারই বা বেশি বোঝার দরকার কী? দিব্যি খাচ্ছ, দাচ্ছ, চাকরি করছ, বউদিকে বেশি না ঘাটালেই হল।

তোরা তো তা বলবিই।

বোমাটা কোথায় পড়ল জানো?

না। আমি ভিতরবাড়িতে যাইনি। শুনছি, তৃষার শোওয়ার ঘরের বারান্দায়।

কী সর্বনাশ!

বোমা পড়া নিশ্চয়ই বিপজ্জনক। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ের কথা, তৃষা বলেছে বোমা যারা ফেলেছে তাদের জ্যান্ত ধরতে না পারলে মরা অবস্থায় ধরবে। তৃষা যা বলে তা করে।

জানি, মেজদা।

ও কেমনধারা মেয়েমানুষ?

দীপনাথের একবার বলতে ইচ্ছে হয়েছিল তুমি যেমনধারা পুরুষ। কিন্তু তা বলল না দীপনাথ। সে লক্ষ করল, অসুস্থ শ্রীনাথের চোখে-মুখে আতঙ্কের গভীর একটা ছাপ পড়েছে। তাই একটু কষ্ট হল দীপনাথের। সে বলল, তুমি মনে মনে বউদির একটা ভয়ংকর চেহারা বানিয়ে নিয়েছ বলে কষ্ট পাচ্ছ। আসলে হয়তো মানুষটা অত ভয়ংকর নয়।

তুই কিছু জানিস না।

তা হবে। কাল রাতে বউদিকে কেউ বোমা মেরেছিল এ খবর বউদি নিজে কিন্তু আমাকে বলেনি। লোকে খামোখা বউদিকে কেনই বা বোমা মারবে তাও আমি বুঝি না।

খামোখা নয়। ওকে এখানকার কেউই পছন্দ করে না।

পছন্দ যদি না করে, তবে সেটা বউদির দোষ নয়।

তোর মাথাটা তৃষা একেবারে চিবিয়ে খেয়েছে। তোরা তৃষার ভাল দেখ, আমার তাতে কী? শুধু আমার জন্য একটু আলাদা ব্যবস্থা করে দে। আমি ওর কাছ থেকে দূরে চলে যেতে চাই।

বিরক্ত দীপনাথ বলল, এখন একটু ঘুমোও, মেজদা।

শোন যাস না। রাতে আমার কাছে কে থাকবে?

তার মানে?

বাতে কারও আমার কাছে থাকা দরকার। আমি তৃষা আর সরিৎকে বিশ্বাস করি না।

তোমার মাথাটা গেছে, মেজদা। কী আবোল-তাবোল বকছ?

মোটেই আবোল-তাবোল নয়। যখন আমার ভালমন্দ একটা কিছু ঘটে যাবে তখন বুঝবি।

বলতে বলতে শ্রীনাথ কয়েকবার উঠে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু ক্লান্তিতে পারল না। বালিশে আবার মাথা রেখে বলল, আমার কোনও অসুখ ছিল না। আজ সকালের চা-টা একটু তেতো তেতো লেগেছিল। চা খাওয়ার পর থেকেই–

দীপনাথ হাসল। বলল, তোমাকে মেরে বউদি বা সরিতের কী লাভ?

শত্রুর শেষ রাখতে নেই।

তুমি কি বউদির শত্রু?

ও তত তাই মনে করে।

কী করে বুঝলে?

আমি বুঝব না তো কে বুঝবে? কাল রাতে যখন তৃষা আমার কাছে এসেছিল তখন মাথাটা গোলমেলে ছিল বলে ওর কথার অর্থ ধরতে পারিনি। এখন ভেবে দেখলাম, আসলে বোমা মারার ব্যাপারে ও আমাকেই সন্দেহ করছিল।

দীপনাথ একটা মস্ত শ্বাস ছাড়ল। তারপর ঘড়ি দেখে বলল, তুমি আরও কয়েক ঘণ্টা ঘুমোও তো! ঘুমোলে উত্তেজনা, ভয় সবই কমে যাবে।

কিন্তু আজ রাতে আমার কাছে কে থাকবে?

খ্যাপা নিতাইকে ডেকে এনে মেঝেতে শুইয়ে রেখো, যদি একা নিতান্তই ভয় পাও।

নিতাই? নিতাই তো তৃষার লোক! এ বাড়িতে আমার লোক কেউ নেই, সবাই তৃষার। আমাকে তুই নিয়ে যা। তোর মেসে জায়গা হবে না?

দীপনাথ মেজদার মুখের ওপর কোনও কঠিন কথা বলতে পারল না। লোকটা ভয়ে সন্দেহে এত কাতর যে বেশি কিছু বললে আবার ভেঙে পড়বে।

দীপনাথ তাই মন-ভোলানো গলায় বলল, এ অবস্থায় তো যেতে পারবে না। শরীরটা সুস্থ হোক, আমি এসে নিয়ে যাব।

ঠিক বলছিস?

ঠিকই বলছি।

কিন্তু যদি স্লো পয়জন করে থাকে তবে সুস্থ হব কী করে? আর হয়তো বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারব না।

পারবে। একটু রেস্ট নাও, তা হলেই পারবে।

ওই কাঠের আলমারিতে একটা ব্র্যান্ডির বোতল আছে, এনে দে তো।

এই শরীরে ব্র্যান্ডি খাবে?

না খেলে যে ঘুম আসবে না। ডাক্তার একটা বোধহয় ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল সকালে। তার এফেক্টটা কেটে গেছে। দুশ্চিন্তায় মাথাটাও গরম।

দীপনাথ উঠল। ইচ্ছে ছিল ব্র্যান্ডির বোতলটা বের করে ইচ্ছে করেই হাত থেকে ফেলে দিয়ে ভাঙবে। কিন্তু কাঠের আলমারিটা খুলে বোতলটা খুঁজে পেল না সে। বলল, কই? নেই তো!

ভাল করে খুঁজে দেখ। ওপরের তাকে, ডানদিকে জামাকাপড়ের ভাঁজে ঢোকানো আছে।

দীপনাথ খুঁজল। পেল না। বলল, না নেই।

তাহলে সরিয়ে নিয়েছে। ওরা সব খোঁজ রাখে।

কেউ সরিয়ে নিলে তোমার ভালই করেছে। এ শরীরে খেলে তুমি বাঁচবে না।

এমনিতেও মরব। কথাটা তা নয়। ওরা আমার কিছুই গোপন বা ব্যক্তিগত থাকতে দেবে না। কেন যে আমার পিছনে লেগেছে! তুই মেসে আমার জন্য আজই একটা সিট বুক করবি গিয়ে।

করব। কিন্তু তোমার বাগান?

বাগান! —শ্রীনাথ হতাশায় চোখ বুজে বলে, সেই গিরিশবাবুর মতো বলতে হয়—আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল।

আবার কোটেশন শুনে দীপনাথ হাসল। বলল, বাগান শুকোবে কেন? তুমিই শুকিয়ে যাচ্ছ, মেজদা। এখন ঘুমোও।

বৃন্দা কোথাও গিয়েছিল। এখন ঘরে এসে ঢুকেই বলল, এ কী! বাবু জাগলেন কখন?

দীপনাথ একটু বিরক্তির সঙ্গে বলে, তুমি রুগির দেখাশুনো করছ নাকি?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কোথায় গিয়েছিলে? এরকম একা ঘরে ফেলে যাওয়া উচিত হয়নি।

বড় গোরুটা খোঁটা উপড়েছে শুনে ধরতে গিয়েছিলাম। বড় তেজি গাই। অন্য কাউকে মানে না।

আর যেয়ো না।

আচ্ছা। বাবু, একটু দুধ-টুধ কিছু আনি?

শ্রীনাথ আতঙ্কের সঙ্গে বলে, না, না। আমি কিছু খাব না। তুই কাজে যা, আমি ভাল আছি।

মা’ঠানকে একটা খবর দিই গে?

কোনও দরকার নেই। আমি এখন ঘুমোব।

বলে শ্রীনাথ পাশ ফিরে কোলবালিশ আঁকড়ে চোখ বোজে। আত্মরক্ষার এর চেয়ে ভাল পদ্ধতি সে আর খুঁজে পায় না।

দীপনাথ মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে বৃন্দাকে ঘরের বাইরে যেতে বলে। বৃন্দা চলে গেলে শ্রীনাথের কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বলে, কোনও ভয় নেই। ঘুমোও।

ঘুম আসবে না। দেখ তো টেবিলে ঘুমের কোনও ওষুধ আছে কি না।

দীপনাথ টেবিলে একটা ট্রাংকুইলাইজারের ছোট শিশি পেয়ে গেল। একটা বড়ি শ্রীনাথকে গিলিয়ে দিয়ে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল সে। শ্রীনাথ খুবই অবসন্ন ছিল। সকালের ঘুমের ওষুধের ক্রিয়াও রয়েছে ভিতরে। ফলে দশ মিনিটের মধ্যে শান্তভাবে ঘুমিয়ে পড়ে।

দীপ বেরিয়ে এসে দরজাটা টেনে দেয়। তার ভ্রু কোঁচকানো, মনটা ভার। মানুষের এরকম ভয়ংকর মানসিক যন্ত্রণার চেহারা সে খুব কমই দেখেছে, যতটা শ্রীনাথের মধ্যে দেখা গেল। শ্রীনাথের আর যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটুকু কুরে কুরে খেয়ে নেবে ওই অবিশ্বাস আর সন্দেহ।

ভেতরবাড়িতে যাওয়ার রাস্তার ধারে একটা গাছতলায় ঠেস মেরে বসে রইল দীপনাথ। সাড়ে চারটের সময় ফটক খুলে বইয়ের ব্যাগ কাঁধে সজল ঢুকল।

সজল! —দীপনাথ কোমল স্বরে ডাকে।

বড়কাকা!-সজলের ক্লান্ত মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, কখন এলে?

বেশিক্ষণ নয়।

সজল এসে তার হাত ধরে বলে, ভিতরে চলল! মা রোজ তোমার কথা বলে।

তোমার মার সঙ্গে দেখা হয়েছে।

বাবার খুব অবস্থা খারাপ, জানো? আজ সকালে বাবার স্ট্রোক হয়েছে। ডাক্তার বলেছে, অবস্থা এখন-তখন।

তোমার বাবার সঙ্গে এইমাত্র কথা বলে এলাম।

সজল অবশ্য এ কথায় অপ্রতিভ হয় না। হাসে। বলে, বাবা ভীষণ ভিতু।

তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে, সজল। তোমার জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলাম।

কী কথা?

তুমি কি তোমার বাবাকে বলেছ যে, সরিৎ বোমা বানায়?

বোমা! কই, না তো!

বলোনি?—দীপনাথ একটু অবাক হয়।

সজল ঠিক বুঝতে পারছিল না, সত্য কথাটা বলা উচিত হবে কি না। কিন্তু বড়কাকা তার ভীষণ প্রিয়। এই কাকার কাছে তার সব সত্যি কথা বলে দিতে ইচ্ছে করে। সে চোখ নামিয়ে বলে, আমি

আসলে বাবাকে একটু ভয় খাওয়ানোর জন্য বানিয়ে বলেছিলাম।

কাজটা ভাল করোনি। তোমার বাবা খুবই ভয় পেয়েছেন। তা ছাড়া কথাটা পাঁচ কান হলে তোমার মা আর ছোটমামাও বিপদে পড়বেন। তুমি কি তা চাও?

আমি আর কাউকে বলিনি।

বোলো না। এখন যাও হাত-মুখ ধুয়ে বাবার কাছে গিয়ে একটু বোসো। বাবাকে বোলো, তুমি বোমা বানানোর কথাটা বানিয়ে বলেছ।

বাবা যদি রাগ করে?

করবে না। বরং খুব খুশি হবে। আমিও ও-ঘরেই থাকব’খন, ভয় নেই।

আচ্ছা।-বলে মাথা নেড়ে চলে গেল সজল।

দীপ উঠে বাগানের মধ্যে হেঁটে বেড়াতে লাগল খানিক এলোমেলো উদ্দেশ্যহীনভাবে। অভিশাপ বলে কিছু মানে না সে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, বড়দা মল্লিনাথের এই গোটা বাড়ি এবং সম্পত্তির ওপর একটা অভিশাপ ছায়া বিস্তার করে আছে শকুনের মতো। এখানে আসার আগে অবধি শ্রীনাথ বা তৃষা সুখেই ছিল তো! যেই এ বাড়ির মৌরসি পাট্টা পেল তখন থেকে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠল ওদের জীবন। দুর্বহ হল বেঁচে থাকা। এখন তার সন্দেহ হচ্ছে, শ্রীনাথ হয়তো খুব বেশিদিন বাঁচবেও না। বড়দা মল্লিনাথ গেছে, এখন শ্রীনাথও যদি যায় তবে সেটা বড় দুঃখের হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *