ডাক্তার সাহেবের চেহারা রাশভারী। মাথাভর্তি নজরুল ইসলামের মতো বাবরি চুল। কথাও বলেন খুব কম। ঘন-ঘন নিজের মাথার চুল টানেন। দেখে মনে হয়, কোনো কারণে খুব রেগে আছেন। কণ্ঠস্বরটি খুব সুন্দর। শুনতে ভালো লাগে। এই জন্যেই বোধ হয় নিজের গলার স্বর বেশি শোনাতে চান না।
তিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে টুনিকে দেখলেন। আজকালকার ব্যস্ত ডাক্তাররা এত সময় রোগীদের দেন না। ইনিও ব্যস্ত। এর ওয়েটিং রুমে রোগী গিজগিজ করছে। তবু প্রতিটি রোগীকে অনেকখানি সময় দিচ্ছেন।
ওর জ্বর-জ্বর ভাব, এটা প্রায়ই হয় বলছেন?
জ্বি।
এর আগে কোনো ডাক্তার দেখিয়েছেন?
না। বাবা হোমিওপ্যাথি করেন। টুকটাক ওষুধ দেন, সেরে যায়।
ও, আচ্ছা। আপনার মেয়ে তো খুব রূপবতী। পুতুল-পুতুল দেখাচ্ছে। কি খুকি, তুমি কি পুতুল?
টুনি হেসে ফেলল। ডাক্তার সাহেব কাগজে অতি মনোযোগের সঙ্গে কী-যেন লিখতে লাগলেন। আগের মতো সুরেলা মিষ্টি স্বরে বললেন, আমি এখানে কিছু স্পেসিফিক টেস্টের কথা লিখে দিচ্ছি। টেস্টগুলি করাতে হবে। সব জায়গায় টেস্ট ভালো হয় না। কোথায় করাবেন তাও লিখে দিচ্ছি।
আপনার সঙ্গে আবার তাহলে কখন দেখা করব?
আপনি আজই দেখা করবেন। রাত আটটা পর্যন্ত আমি বাসায় থাকব। আপনি রিপোর্টগুলি নিয়ে বাসায় চলে আসবেন।
শফিক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ডাক্তার সাহেব বললেন, বাসার ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। টেস্টগুলি জরুরি ভিত্তিতে করানোর জন্যে যা প্রয়োজন, আপনি অবশ্যই করবেন।
আপনি কী আশঙ্কা করছেন?
কিছুই আশঙ্কা করছি না। যা বলার রিপোর্টগুলি দেখে তারপর বলব।
ওর তো তেমন কিছু না, সামান্য জ্বরাজুরি সর্দি।
আমি খুবই আশা করছি। ওর কিছু না, সামান্য ব্যাপার। তবু আপনাকে যা করতে বললাম করবেন। মেয়েকে সন্ধ্যাবেলা আনার দরকার নেই।
আপনার কথায় কেমন জানি ভয়-ভয় লাগছে।
সরি। আপনাকে যা করতে বললাম করবেন।
ডাক্তার সাহেবের বাসায় পৌঁছাতে-পৌঁছাতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় যেন বেরুচ্ছিলেন। শফিককে দেখে বললেন, আমি ভাবছিলাম, আসবেন নাবুঝি।
ব্লাড রিপোর্টটা পেতে একটু দেরি হয়ে গেল।
বসুন আপনি।
ডাক্তারের স্ত্রী তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললেন, কতক্ষণ লাগাবে তুমি?
অল্প কিছুক্ষণ। পাঁচ মিনিট। তুমি গাড়িতে অপেক্ষা কর।
ভদ্রমহিলা তিক্ত গলায় বললেন, বাসাতেও যদি তুমি এসব ঝামেলা কর, তাহলে আমি যাব কোথায়?
বললাম তো, পাঁচ মিনিট।
ডাক্তার সাহেব সব কটি রিপোর্ট টেবিলে বিছিয়ে দিলেন। তিনি কিছু দেখছেন বলে মনে হল না। রিপোটিগুলি আবার একটির উপর একটি সাজিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথার চুল টানলেন। শফিক বলল, কী দেখলেন? ডাক্তার কিছু বললেন না। শফিক আবার বলল, কী দেখলেন?
আপনার মেয়ের একটা খুব খারাপ অসুখ হয়েছে। হজকিন্স ডিজিজ। এক ধরনের লিউকেমিয়া। লোহিত রক্তকণিকাঘঠিত সমস্যা। অসুখটা খুবই খারাপ। এর বিরুদ্ধে আমাদের হাতে এখনও তেমন কোনো অস্ত্রশস্ত্র নেই। তবে বিদেশে প্রচুর কাজ হচ্ছে, ইফেকটিভ কেমি থেরাপি ডেভেলপ করেছে। এতে লাইফ এক্সপেকটেনসি অনেকখানি বাড়িয়ে দেওয়া গেছে। এই ফিল্ডে প্রচুর গবেষণাও হচ্ছে। যে-কোনো মুহুর্তে মোক্ষম ওষুধ বেরিয়ে আসবে। সেই আগামী কালও হতে পারে।
বাইরে ভদ্রমহিলা ক্রমাগত গাড়ির হর্ন দিচ্ছেন। পাঁচ মিনিট সম্ভবত হয়ে গেছে। তিনি আর দেরি সহ্য করতে পারছেন না। ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি এনে দিই?
তিনি পানি এনে দিলেন। শান্ত স্বরে বললেন, আপনার যদি টাকা পয়সা থাকে, মেয়েকে জার্মানি পাঠিয়ে দিন। জার্মানির এক হাসপাতালে। আমি দীর্ঘ দিন পোস্টডক করেছি, আমি সব ব্যবস্থা করব।
আমার মেয়ে ভালো হবে?
হতে পারে। তবে এটা কালান্তক ব্যাধি, এটা আপনাকে মনে রেখেই এগুতে হবে। মেডিক্যাল সায়েন্স প্রাণপণ করছে। আমার মন বলছে খুব শিগগিরই কিছু একটা হবে। আগামী কাল, আগামী পরশু, আগামী মাস কিংবা আগামী বৎসর। আশা হারাবার মতো কিছু নয়।
ডাক্তার সাহেবের স্ত্রী এসে ঢুকলেন। তীব্র গলায় বললেন, তুমি কি যাবে-না যাবে না?
যাব। চল, আমার দায়িত্ব শেষ হয়েছে।
শফিক উঠে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ঠিকমতো পা ফেলতে পারছে না। ডাক্তার সাহেব গভীর মমতায় শফিকের হাত ধরলেন। বললেন, আসুন, আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব।
দরকার নেই। আপনাদের দেরি হয়ে যাবে।
হোক দেরি।
ডাক্তার সাহেবের স্ত্রী বিড়বিড় করে কী বললেন। শফিক তা শুনল না, শুধু শুনল ডাক্তার সাহেব বলছেন, আমি প্রথম একে বাসায় পৌঁছে দেব। তোমার পছন্দ হোক না-হোক, আমার কিছু করার নেই।