1 of 2

৪৭. ঠুঠা বাইগা বানজার নদীর পাশে বসে ছিল

৪৭

ঠুঠা বাইগা বানজার নদীর পাশে বসে ছিল।

একা।

ঝরঝর শব্দে বয়ে চলেছিল বানজার। তার একটানা ঝরঝরানি শব্দে আনমনা হয়ে গেছিল ঠুঠা। নিজের অস্তিত্ব, নদীর অস্তিত্ব, এই সূর্যোজ্জ্বল বনের অস্তিত্ব সবই তার চোখের সামনে থেকে, চেতনার মধ্যে থেকে ভোরের শীত-সকালের ভোঁর ঘাসের মাঠের শিশিরের মতোই যেন বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছিল। সে তার অবচেতনে, অতীতের তার ছেলেবেলায় ফিরে যাচ্ছিল বহু বহু বছর মাড়িয়ে গিয়ে।

ঠুঠা বাইগার ভবিষ্যৎ বলে আর কিছুই নেই। চাকরি, সে ছেড়েই দিয়ে এসেছে। যে, তার চাকরি করে দিয়েছিল, তার নিজের ভবিষ্যই এখন পুরোপুরি অনিশ্চিত। যাকে, সে কোলে-কাঁখে করে মানুষ করেছে, সেই পৃথুকেই যখন একটা পা ছাড়া ক্রাচে ভর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বেঁচে থাকতে দেখতে হবে বাকি জীবন, তখন সেই জীবনের প্রতি ঠুঠা বাইগার আর কোনওই দুর্বলতা নেই।

দোষ তো তারই!

সে নাকি কালা-বাঘ! ফুঃ। সেই বদমাস ডাকু মগনলাল যদি আহির ছেদীলাল না সেজে “প্রীত ভইল মধুবনোঁয়া রামা, তোরা মোরা” গাইতে গাইতে তাকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে চলে না যেতে পারত তবে তো তার সঙ্গে মোকাবিলা হত ঠুঠারই! পৃথু হয়তো বেঁচে যেত তাহলে। ছিঃ! ছিঃ! এই খেদ রাখার জায়গা নেই ঠুঠার।

আহা! কতই বা বয়স পৃথুর! কী করবে সে তার অনেকখানি বাকি জীবন নিয়ে? কী করে বাঁচবে জঙ্গল, পাহাড়, নদী-নালা, আকাশ বাতাসকে এমন করে—ভালবাসা পৃথু?

বউটাও যদি অন্য মেয়েদের মতো হত! ছিঃ ছিঃ! অমন অদ্ভুত মেয়েছেলে দেখে তার পুরো মেয়ে জাতটার উপরই ঘেন্না ধরে গেছে। তবু গোন্দ বাইগা বা মারিয়া আদিবাসী মেয়েরা অনেক ভাল, অনেক সৎ ওই সব ইংরেজি-ফুটোনো শহুরে মেয়েদের চেয়ে।

তাদের সমাজেও নারীদের অবাধ স্বাধীনতা আছে, তা বলে সেই স্বাধীনতা নিয়ে এমন করে অন্যকে নষ্ট করে না কেউ। স্বাধীনতার মানে বিবেকহীনতা নয়। মেয়েরা হল ঘরের লক্ষ্মী। ঘরে থাকবে, উঠোন নিকোবে, গাই দোয়াবে, ছেলেমেয়ে বিয়োবে, গ্রীষ্মদিনে স্বামীকে গাছের মতো ছায়া দেবে; শীতের রাতে নাগিনীর মতো জড়িয়ে থাকবে, তবেই না? পৃথিবীটাই বদলে যাচ্ছে। বড় তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি যে, ঠুঠা তাল রাখতে পারেনি এই বেগের সঙ্গে। গাছ কেটে ফেলছে মানুষ। জঙ্গল সরে যাচ্ছে অভিমানে। মেয়েরাও তাদের কালো ঢলঢলে মুখ দেখায় না আর রাগ করে। ধর্‌তিমাতার গরম বেড়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি, প্রতি বছরই কমে যাচ্ছে। চারদিকে বড় তাপ, বড় ভাপ জ্বালা। ছেলেমেয়েরা বড়দের সম্মান করতে চাইছে না। সবাই সবই গোলমাল হয়ে যাচ্ছে এই পৃথিবীতে। এই পৃথিবী, আর মানুষের থাকার মতো জায়গা নেই!

একজোড়া বড় বাদামি কাঠবিড়ালি ঝাঁপাঝাঁপি করছিল একটা মস্ত ঝাঁকড়া চাঁরগাছের মাথার ডালে ডালে। সেই কাঠবিড়ালিদের ঘন বাদামি আর কালো চিকন শরীরে রোদ পড়েই তা চলকে যাচ্ছে কাঁপতে থাকা ঘন সবুজ পাতায় পাতায়। দৌড়াদৌড়িতে, ডাল ঝাঁকাঝাঁকিতে, পাতা কাঁপছে, কেঁপেই চলেছে—শ্রাবণের অবিশ্রান্ত ধারায় যেমন কাঁপে।

কে জানে! মাঝে মাঝে আবার মনে হয় পৃথিবীটা আছে ঠিক সেই রকমই! বদলে গেছে শুধু ঠুঠা বাইগা নিজেই। আর ঠুঠা বাইগার চারপাশের মানুষজন।

যে-বছর তাদের বান্‌জারি গ্রামটা ছেড়ে সকলে পালিয়ে গেল সেই বছরের নানা ঘটনা এই অলস গন্তব্যহীন অবসরে মনে আসছে একে একে। ছবির মতো। কেন যে এত পুরনো কথা একসঙ্গে মনে আসছে কে জানে?

ঠুঠা বাইগার কাকা “বাঘ দেও” হয়ে গেছিল। মানুষখেকো বাঘে খেয়েছিল তাকে তাইই। আর তার ছোটমামা? “নাগ দেও”। নাগে কেটেছিল, তাইই। তারা মাঝে মাঝেই এসে ভয় দেখাত ঠুঠাকে। পেঁচা আর বাঘ-ডাকা রাতে দেবদেবী ভূতপ্রেত যে কতরকমই ছিল তাদের ছোটবেলায়! নাঙ্গা-বাইগা আর নাঙ্গা বাইগীন। বড়হা দেব। চিচক্, মানে বসন্ত রোগ বাহিনী দেবী, বুর্‌হি মাতা। সিঙ্গার মাতা।

হাটচান্দ্রার আলো-ঝল্‌মল্‌ কারখানাতে এই কটা বছর থেকে ঠুঠা বাইগা আর ঠুঠা বাইগা নেই। ঠুঠা ছিল সাচ্চা মানুষ। মাটি, গাছ আর চাঁদ-সূর্যের আশীর্বাদে সম্পৃক্ত একজন সম্পূর্ণ মানুষ। বিজলি আলো, পাকা সড়ক, নানা আরামের লোভ মানুষের মনুষ্যত্বকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয়। ঠুঠাকেও দিয়েছে। একথা ঠুঠার মতো ভাল করে আর কেউই জানে না। ও এখন শহরে থেকে থেকে ঠুঠা বাইগা নেই; ঝুটা বাইগা হয়ে গেছে। শহরের খারাপ প্রভাবের মতো সর্বনাশা রোগ চিচকও নয়। এই রোগ মানুষের মুখে নয়, মনেরই মধ্যে কুৎসিত সব ক্ষতের সৃষ্টি করে। মানুষের মনের চোখদুটিকে নষ্ট করে দেয়।

“হাইজার” বা কলেরার প্রলয়ঙ্করী মড়কের বছরটার কথাও তার মাথার মধ্যে ফিরে আসছে। ভেসে ভেসে আসছে, যেমন করে ছোট্‌কি-ধনেশ পাখিরা নিষ্কম্প ডানা মেলে সূর্যাস্তবেলায় নীড়ে ফেরে।

গরমের শেষাশেষি লেগেছিল মড়ক। সে বছর, কে জানে কেন, কোনও শিমুলগাছেই ফুল ফোটেনি। এমন তোড়েই এল সেবারে “হাইজার” যে, সব শেষ হয়ে গেল বর্ষার প্রথম মাসেই। নর্মদার জলের ঢল নামল সব শাখা নদীতে ঢলঢলিয়ে। ঢলানি মেয়ের মতো। ওই বড় নদীর পারের গ্রামে গ্রামে আগেই মড়ক লেগেছিল। সেখানের সব আধ-পোড়ানো মড়া, নদীতে ফেলে দিচ্ছিল সেই সব গ্রামের লোকেরা। যথেষ্ট সুস্থ লোক ছিল না যে, ঠিকমত দাহ করবে। নদীর মাছ, সেই মড়ক-লাগা মড়াদের ঠুকরে খেল। আর বান্‌জার গ্রামের লোকে খেল সেই নদী থেকে ধেয়ে-আসা জল আর জলের মাছও। ব্যস্‌স্ শুরু হয়ে গেল বান্‌জারেও মড়ক। হায়! হায়! “হাইজার”! পাঁচ ছ’ ঘণ্টা ভেদবমি আর পায়খানার পর পটাপট মরে যেতে লাগল বুড়ো-বুড়ি, জোয়ান সব ছেলেমেয়ে, আণ্ডা-বাচ্চারা।

কোনও দেও-এর কোপেই এমন হয়েছিল নিশ্চয়ই! ঠুঠার মা বলতেন, দেও নয়; মাতা। মারাই-মাতা। যে-দেবী শুধু মারেনই। বান্‌জার গ্রামের মানুষদের অপরাধ না হলে মারাই-মাতা খামোকা চটবেনই বা কেন?

কত চেষ্টাই হয়েছিল। গ্রামের বুড়ো গাওয়ান-এর নির্দেশে “দেওয়ার”, মানে গ্রামের পুরুত একটা লালরঙা ছাগলের গায়ে লাল হলুদ সবুজ সব রঙ চড়িয়ে তাকে ফুলের মালা পরিয়ে, গলা থেকে মুক্তোর হার ঝুলিয়ে, নতুন দোহর ঝুলিয়ে শোভাযাত্রা করে গ্রামের এলাকার বাইরে নিয়ে এসে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। তারপর, সকলে মিলে তাড়িয়ে তাড়িয়ে পাঠিয়ে দিল যত দূরে পারে। ছাগল যখন অনেক দূরে চলে গেল তখন গ্রামের সীমানাতে দাঁড়িয়ে সকলে মিলে হাত জোড় করে বলতে লাগল, “হে মারাই-মাতা! এই ছাগলটাকে নিয়ে, আমাদের ছেড়ে দাও মা। বাঁচতে দাও এই ধর্‌তি মায়ের বুকে।”

ছাগলটা যেন আবার চরেবরে গ্রামে না ফিরে আসে তার জন্য চৌকি পর্যন্ত বসানো হল গ্রামের সব দিকে। কিন্তু লাভ হল না কিছু। তবু উজাড় হয়ে গেল গ্রাম। ঠুঠা বাইগার বান্‌জার।

সবাইই মরে গেল বলতে গেলে। হল না কিছুই শুধু ‘দেওয়ার’-এর। সে যে সব সময়ই মদে চুর হয়ে থাকত। মাতালদের ‘হাইজার’ অথবা কোনও জলবাহী রোগই বোধ হয় কখনও কাবু করতে পারে না।

যখন গ্রামের মানুষ সব প্রায় শেষ হয়ে এল, তখন টনক নড়ল সকলের। যারা বেঁচেছিল, তারা পালাল গ্রাম ছেড়ে। জঙ্গলে গিয়ে পাহাড়ের গুহাতে ঠাঁই নিল। ঠুঠা পালাল তার বাবার সঙ্গে। সেইই তার কাল হল। গ্রামকে তারা সকলে ছাড়ল বলে গ্রামও তাদের উপর অভিমান করে নিজেই গিয়ে বনের মধ্যে হারিয়ে গেল। খোঁজো এখন তাকে।

মাটি যখন অভিমান করে, তখন সে নারীর চেয়েও অনেক বেশি অভিমানী।

ঠুঠার বাবা বাতের ব্যথায় বড়ই কাবু হয়ে পড়ল। ‘হাইজার’-এর হাত থেকে বেঁচে মারা যাবে শেষে বাতে? পৃথুর বাবার বুড়ো মালী! সে বলল, বাঘের চর্বির সঙ্গে ‘আসারিয়া’ সাপের মাংস মিশিয়ে সর্ষে দিয়ে ভাল করে ভেজে নিয়ে খেলেই বাত-টাত সব গায়েব হয়ে যাবে। কিন্তু বড় বাঘ চাইলেই পায় কোথায়? সে তো আর আত্মহত্যা করবে বলে বসে থাকে না। তাছাড়া, পৃথুর বাবার সাগরেদি করে তার দোসরও হয়ে ওঠেনি ওরা তখনও। ঠুঠাও ছোট্ট তখন। শিকারি অবশ্য ছিলই, তবে তীর-ধনুকের শিকারি; বন্দুক রাইফেলের ব্যবহার জানত না। পৃথুদেরই খামারের একজন মজুর বলল, বড় বাঘের চর্বি না পেলে শেয়ালের চর্বি হলেও চলতে পারে। একথা শুনে সেই সন্ধেতেই ঠুঠার বাবা নিজেই কেত্‌রে কেত্‌রে গিয়ে নালার ধারে তীর-ধনুক দিয়ে মারল একটা কেঁদো-শিয়ালকে। ঠুঠাও ছিল বাবার সঙ্গে। সেও তীর ছুঁড়েছিল একটা। ঠুঠার বাবার তীরটা গিয়ে শেয়ালটার বুক এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিয়েছিল। তারপর সেখানেই শেয়ালটার চামড়া ছাড়িয়ে কয়েক খাবলা চর্বি বের করে শালপাতার দোনা বানিয়ে তাতে করে মুড়ে নিয়ে এল।

“আসারিয়া” সাপও তখন অনেকই ছিল চারপাশে। পৃথুর বাবার যে বুড়ো মালী, সেইই মেরে দিল একটা খুঁজে-পেতে। সেই যে বাত পালাল ঠুঠার বাবার, আর এমুখো হয়নি কখনও যতদিন বাবা বেঁচে ছিল।

ঠুঠার বড়মামা মারা গেছিল বান্‌জার গ্রামেই “ফুল্‌মি” রোগে। স্পষ্ট মনে আছে ঠুঠার। পেট ফুলে গেল, তো ফুলেই গেল। ফুলতেই লাগল। কিন্তু মরত না, যদি ঠুঠার বাবার কথা শুনত একবারটি। বড়মামা মানুষটা বড়ই একরোখা ছিল। ঠুঠার বাবা অনেকদিন আগেই একটা গোখ্‌রো সাপ মেরে, চামড়া ছাড়িয়ে ধিকিধিকি কাঠের আগুনে সেটাকে ভাল করে ঝলসে নিয়ে শুকনো করে রেখে দিয়েছিল। সেই শুকনো গোখ্‌রোর দু’ টুকরো দিয়ে একটা ক্কাথ মতো বানিয়ে বাবা কত সাধাসাধি করল বড়মামাকে মামাবাড়ি গিয়ে। কিন্তু মাথাটা দু’দিকে নেড়ে বড়মামা কয়েকবার কেশে, তার ফুলো টসটস পেটে দুটি হাত রেখে বলল, সময় যখন হয়েছে, পিছুটানে দরকার নেই। এসেছিলাম যখন, তখন যেতে তো হবে জানতামই। বড়মামার দাঁত সবই পড়ে গেছিল। বলেছিল, ফোকলাই এসেছিলাম, ফোকলাই যাচ্ছি।

তার বড়মামার কাছ থেকেই এই জেদ পেয়েছে ঠুঠা তার রক্তে। মামাবাড়ির প্রভাব বোধহয় মানুষের উপর সাংঘাতিক হয়। ঠুঠা কিন্তু চেয়েছিল তার বাবার মতোই হতে।

কিছুটা ছোলার ছাতু শালের দোনায় নিয়ে আঁজলা করে জল তুলে নিয়ে ভাল করে মেখে কাঁচালঙ্কা কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে খেল। তারপর আঁজলা ভরে আবারও জল। এইসব ছাতুটাতু সে খেতে শিখেছে বিহার থেকে আসা হাটচান্দ্রার কারখানার দারোয়ানদের কাছ থেকেই। ছেলেবেলায় এই দিকে ছাতুফাতুর তেমন চল ছিল না। মানুষ যখনই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছে রুজির খোঁজে, তখন তার খাওয়াদাওয়ার রকম বোধ হয় পালটে গেছে। হয়তো সব মানুষেরই যায়। পুরনো প্রথা ও রেওয়াজ ভেঙে নতুন জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে সুবিধেমতো করে নিতে হয়েছে তাকে। বাড়িতে না থাকলে আর বাড়ির আরাম পাওয়া যাবে কী করে?

ছাতু খেয়ে, জল খেয়ে পুঁটলিটা আর বন্দুকটাকে কাঁধে ফেলে রওয়ানা হল ঠুঠা।

নদীর পার থেকে যে জানোয়ার-চলা পথটা বনের গভীরে গিয়ে হারিয়ে গেছে মাইকাল, বিন্ধ্য আর সাতপুরা পর্বতশ্রেণীর পায়ের কাছে আসন-কেটে-বসা বুড়ো বুড়ো সব গাছেদের মস্ত “মিটিং”-এর মধ্যে, সেই পথ ধরেই এগুতে লাগল সে।

জবলপুরে পনেরো দিন ছিল ও। ডাক্তার বলেছে, তিন-চার মাস পৃথুকে হাসপাতালেই নাকি থাকতে হবে। পৃথু যতক্ষণ হাসপাতালে আছে ততক্ষণ দেখাশোনার লোকের অভাব হবে না। কিন্তু যখন ছেড়ে দেবে ওকে, তখনই গোলমাল। এই অদ্ভুত স্বার্থপর পৃথিবীতে কেইই বা কাকে দেখে? ঠুঠার গ্রাম হারিয়ে না গেলে, পৃথুকে ধরে সেখানেই নিয়ে আসত ঠুঠা। পাহাড়ে বনে মকাই, বাজরা আর তামাকপাতার কচি কলাপাতা-সবুজ, গাঢ়-সবুজ, হলুদ এবং লালের দিগন্তের সীমানায় এখনও যেসব গ্রাম বেঁচে আছে তাদেরও যে-কোনওটায় নিয়ে আসতে পারত ঠুঠা ওকে পৃথু যদি চাইত। একজন মানুষের বেঁচে থাকতে খুব বেশি কি লাগে? কিন্তু পৃথু কি শুনবে ঠুঠা বাইগার কথা? সে যে কারও কথাই শোনে না। হাটচান্দ্রার মানুষদের ভিতরে যদি একটা পা-হারানো পৃথু গিয়ে পড়ে তবে তাকে তারা জংলি-কুকুরের মতোই ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে তার কঙ্কালটুকুকেই শুধু ফেলে যাবে। এতদিন পৃথুরই দৌলতে শহরের মানুষদের ভিতরে, ভদ্রলোকদের সঙ্গে বাস করে করেই ঠুঠার এই ধারণা হয়েছে।

মানুষ, ‘মানুষ’ হতে গিয়ে আসলে বড়ই অমানুষ হয়ে গেছে। জঙ্গলের বুনো কুকুরের দল অথবা মৃত্যুর অপেক্ষায় চুপ করে বসে-থাকা তীক্ষ্ণ ভয়াবহ ঠোঁট আর ন্যাংটো, লম্বা, গোলাপি গলার জংলি শকুনরাও বোধ হয় শহরের মানুষদের মতো নিষ্ঠুর বা ভয়াবহ নয়। শহরের জানোয়ারদের দেখে দেখে বড়ই ক্লান্ত হয়ে গেছে ঠুঠা। তাইই, ও জঙ্গলে ফিরেছে আবারও সব পিছুটান ফেলে।

অবশ্য সবই ফেলতে পারল আর কই? পৃথু যে রয়ে গেছে পিছনে। সেইই একমাত্র পিছুটান। যেহেতু ঠুঠা এখনও শহুরে মানুষ হতে পারেনি, পৃথু ফিরে এলে তাকে তাই আবারও ফিরতে হবে শহরে, পৃথুর কাছে, পাশে পাশে তাকে থাকতে হবেই। যদি না, পৃথু জোর করে তাকে তাড়িয়ে দেয়। যে ক-মাস পৃথু হাসপাতালে, সে ক-মাসই এখন ছুটি ঠুঠার।

তারপর?

তারপর বড়হা দেব-এর যা ইচ্ছে।

তবে এই তিন চার মাস ঠুঠা জঙ্গলে জঙ্গলেই থাকবে। “বান্‌জারি”-কে খুঁজে বেড়াবে। যে গাছের শিকড় শুকিয়ে বা মরে গেছে, সে দাঁড়িয়ে থাকে বটে মাটির উপর, দূর থেকে তাকে দেখে বোঝাও যায় না, কিন্তু সে তো মৃতই। মড়াকে দড়ি-দড়া দিয়ে বেঁধে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলে যেমন হয়, তেমনই। তেমন বাঁচা, ঠুঠা বাইগা বাঁচতে চায়নি।

শিকড় যার নেই, তার কিছুই নেই। সংরক্ষণ করে রাখার মতো যার কিছু নেই, তার বাঁচা-মরায় তফাতও নেই। গাছে-গাছে, মানুষে-মানুষে, পাখিতে-পাখিতে, প্রজাপতিতে-প্রজাপতিতে শুধু এটুকুই তো তফাত। নইলে, বাইরের চেহারাতে এক-এক জাতের প্রাণী বা প্রাণ সবাইই তো একই রকম!

এতসব ভাবনা, ঠুঠা অবশ্য ভাবে তার নিজস্ব ভাষাতেই। সেই ভাষা শিক্ষিত মানুষদের বুদ্ধিগ্রাহ্য নয়। বিপদে-পড়া বুনো শুয়োর যেমন ভাষায় কথা বলে, ঘোঁক্-ঘাঁক-ফোঁৎ-ফাঁর্‌র্। অথবা, দীর্ঘ সঙ্গমের পরিতৃপ্তির পরই পুরুষ শোনচিতোয়া যেমন অস্ফুট আওয়াজ করে একরকম, কালা-বাঘ ঠুঠা বাইগার ভাষাও অনেকটা তেমনই। যতটা নিজে বোঝার জন্যে, ততটা বোঝাবার জন্যে নয়।

কত্ব দিন পরে জঙ্গলে এল ঠুঠা!

তার মৃতা মায়ের স্মৃতি মনে পড়ল। জঙ্গলই তো তার মা-বাপ। নাক ভরে নিঃশ্বাস নিল। এক এক করে পা ফেলে জানোয়ার-চলা শুঁড়িপথে চলেছে সে এখন আনন্দে ঝুঁদ হয়ে।

একটু এগিয়েই একদল বারাশিঙার খুরের দাগ পেল পথের ঝুরো-মাটিতে। খুব বড় একটা এক্‌রা শুয়োর পথ পার হয়েছে এখানে, তার খুরে খুরে ঝুরো মাটি ছিটকে গেছে। আর একটু এগোতেই ময়ূর আর বনমোরগের পায়ের দাগ। বাঁদিকে একটি খোলা মাঠ। মধ্যে একটা দোলা মতো আছে। ফরেস্ট ডিপার্ট খেতি করেছে এখানে। তার মানে, এখানে ফরেস্ট-গার্ডদের যাওয়া-আসাও আছে হয়তো। একথা ভেবেই, তাড়াতাড়ি পা চালাল ঠুঠা। তাদের সঙ্গে মোলাকাত হয়ে গেলেই ঝামেলা। অথচ কেন যে এমন হয়, ভেবে পায় না ও। জঙ্গলও তো সুন্দরী মেয়েরই মতো। তাকে ফরেস্ট ডিপার্টও যেমন ভালবাসে, ঠুঠাও তার চেয়ে কম ভালবাসে না। যে-দু’জন পুরুষ একই মেয়েকে ভালবাসে, তাদের দু’জনের মধ্যে তো খুব ভাবই থাকার কথা। অথচ ঠিক উল্টোটাই হয়! এতে ঝগড়া যে কিসের, তা বোঝে না ঠুঠা। ঝগড়াটা বোধ হয় এই কারণেই যে, মাটি আর নারীকে প্রত্যেক পুরুষ চিরদিনই নিজের একার মালিকানাতেই পেতে চেয়েছে। গায়ের জোরে। লাঠির জোরে। টাকার জোরে। অথচ, কখনওই ভালবাসার জোরে নয়। হয়তো সেই কারণেই কোনও পুরুষই কোনওদিনও কোনও নারীর পুরোপুরি মালিক হতে পারেনি। আহিররা তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, গরুদের প্রত্যেকের গায়ে যেমন ছ্যাঁকা দিয়ে দিয়ে নম্বর লিখে রাখে মালিকানা জাহির করার জন্যে, পুরুষরাও তেমনই করতে চায়। নারীর গায়ে নিজের তকমা এঁটে দিয়েই ভাবে যে, সে নারী তারই একারই বুঝি হয়ে গেল!

কিন্তু গাভী আর নারী তো এক নয়! একথা পুরুষ বুঝল আর কই? রুষাকে দেখে, কুর্চিকে। দেখে, বিজলী বাঈকে দেখে এবং তার নিজের জাতের অসংখ্য নারীকে দেখেও এই বিশ্বাসই দৃঢ় হয়েছে ঠুঠার। একজন নারীর মোকাবিলা করা আর পাঁচটি জখমি-বাঘের মোকাবিলা করা সমান বিপদের! বহত্ই খতরনাগ এই জাত। তবু। ভাবে ঠুঠা; এই নারীর মতো জঙ্গলকে তো ফরেস্ট ডিপার্ট তার সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে ভালবাসতেও পারত।

তা হল কই?

হঠাৎই একটা শব্দ শুনে থমকে দাঁড়াল ঠুঠা।

বাইসনের আওয়াজ।

বাইসনেরাও গরু-মোষের মতোই এক ধরনের ডাক ডাকে। কিন্তু খুব কমই শোনা যায় এই রকম ডাক। একবার এক সাহেবের ডাবল্-ব্যারেলের রাইফেল দিয়ে দূর থেকে একটি মস্ত একরা বাইসনকে গুলি করেছিল ঠুঠা সীওনীর জঙ্গলে। গুলিটা জায়গামতো লাগলে কোনও কথাই ছিল না। প্রায় দুশো গজ দূরে ছিল বাইসনটা। গুলি করার ঠিক আগের মুহূর্তেই এক কদম হেঁটে গেল বাইসনটা বাঁয়ে আর গুলিটা গিয়ে লাগল, যেখানে বুকের পাঁজর পেটে নেমেছে তারই ছ-আঙুল মত নিচে। সেই বাইসনটাও, এক্ষুনি ঠুঠা যেমন আওয়াজ শুনল; ঠিক সেই রকম আওয়াজ করেই লাফিয়ে উঠেছিল। সঙ্গে সঙ্গেই বাঁদিকের ব্যারেল ফায়ার করে মোক্ষম জায়গায় মেরে তাকে অবশ্য ফেলে দিয়েছিল ঠুঠা।

এতদিন জঙ্গলে ঘুরছে অথচ বাইসনের এই রকমের আওয়াজ মাত্র এই দ্বিতীয়বার শুনল। খুবই যন্ত্রণা বা দুঃখে বোধ হয় এমন আওয়াজ করে বাইসনেরা। কে জানে!

সাবধান হয়ে গেল ঠুঠা বাইগা। স্ট্যাচু হয়ে গেল। তারপর উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কান খাড়া করে শুনল। আওয়াজটা পশ্চিম দিকের গভীর শালবনের মধ্যে থেকেই আসছে। আর একবারও শুনল। সাহেব শিকারিরা ওই আওয়াজকে বলত “বেলোইং”। শুনেছে ও।

খুব সাবধানে কিছুটা পথ ঘুরে একটা টিলার আড়াল নিয়ে, পুবে গিয়ে সেই টিলাতে উঠেই দেখবে ঠিক করল ঠুঠা যে, ব্যাপারটা কী!

মিনিট দশেক পর টিলাটাতে উঠে শীতের সোঁদা-গন্ধ জঙ্গলের গভীর আন্ডারগ্রোথের আড়াল থেকে ঠুঠা ঠাহর করে দেখল, নীচের শালবনে একটি বাইসনের বাচ্চা পড়ে আছে। তার প্রায় সবটাই খেয়ে গেছে বাঘে। পেছন থেকে খেয়েছে। শুধু করোটি, ভাঙা কঙ্কাল এবং একটি নিটোল পা; ডান পাটি বাকি আছে শুধু। ডান পা? সেই মড়ির ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে বাইসনের পুরো দলটি। মাথা নিচু করে, অথচ উঁচুও করে। অর্দ্ধ-বৃত্তে।

অবাক হয়ে বাইসনের দলের দিকে চেয়ে ঠুঠা ভাবছিল যে, সম্ভ্রমবোধ ব্যাপারটা কিছু কিছু মানুষ আর কিছু কিছু জানোয়ারের মধ্যেই শুধু দিয়ে দিয়েছেন বড়হা দেব। সকলের মধ্যে কখনওই নয়। মৃত্যু, শোক, দুঃখ, ভীষণ রকম শারীরিক কষ্ট অথবা প্রচণ্ড দারিদ্র্যেও যে-মানুষ বা যে-জানোয়ার বেঁকে না যায়, কুঁজো না হয়ে যায়, তারাই তো সম্ভ্রান্ত! বাইসনেরা সেইরকমই জানোয়ার। বাঘও। আর মানুষের মধ্যে যেমন পৃথু। এবং রুষাও।

বাঘেই ধরেছিল বাইসনের বাচ্চাটাকে। বড় বাঘে। বোধ হয়, শেষ রাতে। বাচ্চা মানে, বছরখানেকের হবে। বড় বাঘ ছাড়া বাইসনের বাচ্চা ধরার সাহস আর কোনও জানোয়ারের দেখা যায় না সচরাচর। মায়ের বুক ফেটে একবারই শুধু এই শাঁখের মতো আওয়াজ বেরিয়েছিল। সে আওয়াজ যে শোনে, তারই বুক ফেটে যায়। আর যে করে; তার তো ফাটেই!

পুরো দলটিই দাঁড়িয়ে আছে, পেছনে, মাথা নিচু অথচ মাথা উঁচুও করে। এই নিচু অথচ উঁচু ব্যাপারটাই সম্ভ্রামবোধ। ভাবটা, ঠিক আছে, বনের রাজা বাঘ, তোমাকেও যদি কখনও পাই আমরা; তোমাকে ঘিরে ফেলে শিং আর খুরের গুঁতোতে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেব জেনো। সেকথা মনে রেখো। আমরাও বাইসন!

ঠুঠার মনে হল যেন ঠিক এই মা-বাইসনটার ভঙ্গিতেই রুষা দাঁড়িয়ে ছিল পৃথুর হাসপাতালের খাটের পাশে। হাঁটু থেকে অনেকই উপরে এবং কোমর থেকে আট ইঞ্চি মতো নিচ থেকে পৃথুর ডান পাটা কেটে ফেলার পর যখন সাদা চাদরের বুক অবধি ঢেকে পৃথুকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল, তখন।

রুষার চোখে জল ছিল না। আগুন ছিল। সেই আগুন, পৃথুকে যতখানি পোড়াত, পৃথুর জ্ঞান থাকলে; তার চেয়ে বেশি পোড়াচ্ছিল যে-মানুষটা পৃথুর এই অবস্থা করেছে সেই অদেখা ডাকু মগনলালকে। রুষার চোখের মধ্যে এই মা-বাইসনেরই মতো তীব্র রাগ তো ছিলই, সঙ্গে তীব্র দুঃখ ও অভিমানও মাখামাখি হয়ে ছিল। অথচ একটুও ভেঙে পড়ার ব্যাপার ছিল না। টুসু ও মিলিও তাদের মায়ের দু’ পাশে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাবার চোখ-বন্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে। আশ্চর্য! তাদের চোখেও জল ছিল না একফোঁটা। বাঘ ও বাঘিনীর বাচ্চারা তো বাবা মায়েরই মতন হবে! হওয়াই তো উচিত!

খুবই অবাক হয়ে গেছিল। শুধু ঠুঠা বাইগাই নয়। গিরিশদা, ভুচু, সাবির মিঞা, শামীম এবং হুদাও। সকলেরই খুব শ্রদ্ধা জেগেছিল এক ধরনের। রুষা এমন এক চরিত্রর নারী যে, তাকে তাচ্ছিল্য করা যায় না। তাকে ঠুঠা পছন্দ করুক কি নাইই করুক তার প্রতি এক ধরনের বিস্ময়-মেশানো শ্রদ্ধা জাগেই। একেই হয়তো বলে ব্যক্তিত্ব!

কে জানে!

রুষার চেহারাও বটে একখানা! আগুনের মতো রঙ। তারপর যেমন গড়ন, তেমনই চোখ, মুখ, চিবুক, ভুরু। যত লোক হাসপাতালে ছিল সেই সময়ে, সুন্দরী সব নার্সদের আর ডাক্তারদের সকলকে জড়ো করেও, ঠুঠা এবং অন্যান্যদের মতে রুষাকে সকলের চেয়েই সব দিক দিয়েই সুন্দরী এবং বড় বলে মনে হয়েছিল। বয়সে বড় নয়! এই বড়ত্বর মাপ বয়স দিয়ে হয় না।

ডাক্তার বলেছিলেন, ইংরিজিতে; সরি! রুষাকে। আরও কী সব বলেছিলেন। ঠুঠা বোঝেনি। ইংরিজি দু’-একটা শব্দই বোঝে ও। কিন্তু উত্তরে রুষা হেসে ডাক্তারকে বলেছিল, থ্যাঙ্ক উ্যু! আরও কী সব বলল, তাও বোঝেনি। কাটা-ছেঁড়ার এতবড় নামকরা ডাক্তারকেও রুষার সামনে কেঁচো বলে মনে হচ্ছিল। যখন ভীষণই কাঁদার কথা, ভেঙে পড়ার কথা, তখনও যারা ভদ্রতা বজায় রাখতে পারে, হেসে কথা বলতে পারে; তারা কি মানুষ? না, বোধ হয়। রুষাও বোধ হয় কোনও “মারাই” দেবী। কে জানে! দেবী বলেই ভয় হয়।

রুষা কি পৃথুর কেটে-ফেলা পা-টা দেখতে চায়?

ডাক্তার জিগ্যেস করেছিল।

ঠুঠার মনে হয়েছিল, এক থাপ্পড় কষায় ডাক্তারকে। বেয়াকুফ, শালার আক্কেল বলেও কি কোনও জিনিস নেই?

ভুচু আর শামীমও আগুনের চোখে তাকিয়েছিল ডাক্তারের দিকে।

রুষা মাথা নেড়েছিল দু’দিকে। আবার বলেছিল, নো। থ্যাঙ্ক য়্যু। তারপর বলেছিল, যা পৃথুর নেই; তা দেখার কোনও কৌতূহলই নেই আমার।

কিন্তু সেই বেয়াকুফ ডাক্তারের নির্দেশে, রুষা যখন দেখল না, তখন একটা মস্ত ট্রলিতে করে পৃথুর পা-টা ঠুঠাদেরই দেখাতে নিয়ে এল ওয়ার্ড বয়।

ঈস—স্—স্—স্…স্

ছেলেবেলায়, যখন পৃথুকে কাঁধে চড়িয়ে ঘুরিয়ে বেড়াত ঠুঠা তখন পৃথুর ছোট্ট ছোট্ট নরম পা-দুটো ঠুঠার গলার কাছে বাইসন-হর্ন-মারিয়া মেয়েদের মস্ত হারের লকেটেরই মতো ঝুলত। দুলত। পা-দুটিকে দু’ হাত দিয়ে আলতো করে ধরে থাকত ঠুঠা। পৃথু তার ছোট্ট ছোট্ট দুটি হাতে ঠুঠা বাইগার মাথাটা জড়িয়ে ধরে বসে থাকত ওর কাঁধে। বড় সুন্দর, দুধ-দুধ, ফুল-ফুল এক রকম গন্ধ বেরোত তখন শিশু-পৃথুর গা থেকে। সব শিশুর গায়েই কি ওইরকম গন্ধ থাকে?

কে জানে! তার পৃথুর গায়ে ছিল!

ঠুঠা বাইগার পৃথু।

হঠাৎই ঠুঠা তার গলার কাছে শিশু-পৃথুর সেই সুন্দর সুগন্ধি পা-দুটির স্পর্শ পেল। হঠাৎ। এবং পেতেই, ওর অজানিতেই; অনেকদিন আগের গুলি-খাওয়া সেই এক্‌রা বাইসনটারই মততা, গভীর ছায়াচ্ছন্ন শালবনের মধ্যের শিশু-হারানো বাইসন-মায়েরই মতো ঠুঠারও বুকের মধ্যে থেকে এক গভীর, অর্ধস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল, সমস্ত বুকটাকে কোনও হেভি-বোর রাইফেলের গুলির মতোই ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে। ঠুঠা বাইগার অনিচ্ছাকৃত ওই হঠাৎ-শব্দে বাইসনের দলও হঠাৎ মাথা তুলল তার দিকে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মাথার উপরের শিংগুলো এক ঝটকাতে নিচু করল। কিন্তু পরক্ষণেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গেল ওরা জঙ্গলের গভীরে। ভারী পায়ের খুরে খুরে জমিতে, পাথরে খটাখট আওয়াজ তুলে।

ওইখানেই দাঁড়িয়ে রইল ঠুঠা অনেকক্ষণ।

কী হল! কেন এমন হল? পৃথুর পা-টা তো গতকাল কাটা হয়নি। অনেকদিনই তো হয়ে গেছে। এই যন্ত্রণাটাকে, বুক-গুঁড়ানো এই চিৎকারটাকে এতদিন কী করে, কোন সান্ত্বনার পাথরে চাপা দিয়ে রেখেছিল ঠুঠা বাইগা?

এখন বাইসনগুলোকে আর দেখা যাচ্ছে না। আলোড়ন স্তব্ধ হয়ে গেছে। ওরা শিং নামিয়ে আক্রমণ করবার কথা একবার ভেবে, তবুও পালিয়ে গেল। আক্রমণ সত্যি সত্যিই করলে, ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যেত ঠুঠা। তার রক্ত-মাংস বাইসনদের খুরে খুরে ওপড়ানো ঘাস আর ছিটকানো মাটির সঙ্গে মিশে যেত। কিন্তু…

বাইসনের মতো শক্তিশালী জানোয়ার, বাঘের মতো বনের রাজা এবং আশ্চর্য! অনেক মানুষও, অন্য মানুষকে বড়ই ভয় পায়। বাইসন, বাঘ কী সেই মানুষগুলোও আসলে জানে না যে, মানুষের চেহারা ধরলেই মানুষ, মানুষ হয় না। মানুষের মতো মানুষ, বড় কমই আছে এই ধর্‌তি-মায়ের বুকে। লড়াই না করলে, বোঝাই বা যাবে কী করে; কে বেশি শক্তি ধরে?

টিলাটা থেকে নামতে নামতে আবারও আরেকবার পৃথুর কেটে-ফেলা ডান পা-টার ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল ঠুঠার।

ওয়াক্ ওয়াক্ থুঃ উ…।

মাটিতে উবু হয়ে বসে পড়ল ঠুঠা। দমকে দমকে বমি করল। উগরে দিল বনের ঘাসের মধ্যে ছোলার ছাতু, পৃথুর কাটা পায়ের দুঃস্বপ্ন-ভরা স্মৃতি এবং নিজের যন্ত্রণা। অথচ এই ঠুঠাই কতরকম এবং কত শ’ বিভিন্ন জানোয়ারের পা-ইই না, কুড়ুল দিয়ে, টাঙ্গি দিয়ে, ছোরা দিয়ে কেটেছে নিজে হাতে। চামড়া ছাড়িয়েছে। পিলে আর পিত্তি ছিঁড়ে এনেছে। ওদের বিরাট বিরাট ফুসফুস আর মাংসল হৃদয় দুটি কামার্ত হাতে চেপে ধরেছে নারীর স্তনেরই মতো। একটুও ঘেন্না তো হয়নি কোনওদিন? রক্তে স্নান করে উঠেছে শুয়োর, কোট্‌রা, চিতল, শম্বর, বারাশিঙ্গা, চৌশিঙ্গা, চিংকারা, কৃষ্ণসার আর বাঘ এবং লেপার্ডের রক্তে।

তবে? তবে কেন? রক্তাক্ত, গুলিবিদ্ধ, বেগুনি কালশিরে-পড়া কর্তিত পা কি দেখেনি কখনও আগে? তবে?

দেখেছে! দেখেছে! কিন্তু পরের পা আর নিজের পা, পরের রক্ত আর নিজের রক্তে যে তফাত অনেকই। পৃথু, ঠুঠা বাইগার ঔরসে জন্মায়নি বটে কিন্তু পৃথু ঠুঠার কাছে ছেলের চেয়েও বেশি। ঔরস এবং গর্ভ ছাড়াও অনেক কিছু জন্মায় এই ধর্‌তি-মায়ের বুকে।

কিন্তু কাকে এসব বলবে ঠুঠা? কী করে জানাবে? একমাত্র যে-মানুষ তার চোখের চাউনিকেও বুঝত; সে তো শুধু পৃথুই! সে কি আর এই পাহাড়ে জঙ্গলে কোনওদিন…। নাঃ..না…

ঠুঠার সব আনন্দ, দুঃখ, অনুভূতি, স্মৃতি—সবই ছাই হয়ে যাবে একদিন বান্‌জারের পাড়ের; চিতার আগুনে। যারা লেখাপড়া না জানে, তারা সত্যিই বড় অভাগা; নিঃসন্তান দম্পতিরই মতো, শিকড় বা বীজ বা দুইয়ের—জুড়ন ছেড়ে যে যাবে, তেমন কোনওই উপায় নেই তাদের…। বাজ-পড়া শিমুলেরই মতো; হঠাৎই শেষ-হয়ে-যাওয়া তাদের।

ঠুঠা আবারও নদীর দিকে ফিরে যেতে লাগল। যেদিক থেকে এসেছিল। ভাল করে মুখ-চোখ ধোবে। বমির গন্ধে গা গুলোচ্ছে। মুখ টক।

সারাটা জীবনই যতটুকু এগোল ঠুঠা বাইগা, জীবনের সমস্ত টুকরো-টাকরায়, ফালিতে; তার চেয়ে পেছোল অনেকই বেশি!

কোনও কোনও মানুষের ভাগ্যর লিখন এমনি করেই লেখে বড়হা-দেব; যতদিন না কোনও “মারাই-মাতা” এসে তা একেবারে মুছে দিচ্ছে চিতার আগুনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *