ছোট ছোট শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভর্তি হওয়ার সমস্যার চেয়েও সেখানে থাকার জায়গা পাওয়া কম কঠিন নয়। দেশের ছাত্রাবাসগুলোকে বলে হস্টেল বা হল, এখানে সেগুলোর নাম ডর্ম। কোনো ডর্মে অলি জায়গা পায়নি। অনেক প্রাইভেট বাড়ি ছাত্র-ছাত্রীদের ভাড়া দেওয়া হয়, সেরকমও খালি নেই একটাও। একটিমাত্র অ্যাপার্টমেন্ট খালি আছে। কিন্তু তার অনেক ভাড়া, সাধারণত দু’জন ছাত্র বা ছাত্রী এরকম অ্যাপার্টমেন্ট ভাগাভাগি করে নেয়। অন্য কোনো মেয়ে আপাতত পাওয়া যাচ্ছে না, একজন বিদেশী অধ্যাপক এ অ্যাপার্টমেন্টের অর্ধেক নিতে আগ্রহী। পিটার মেয়ার সেটাই ধরে রেখেছিলেন অলির জন্য। এখানে ছেলে-মেয়েদের একসঙ্গে থাকা মোটেই বিচিত্র কিছু নয়। দুটি বেডরুমের মাঝখানে কিচেন, টয়লেট, ডাইনিং রুম, সেগুলো দু’জনের ব্যবহারের জন্য, আবার বেডরুমের দরজা বন্ধ করলে দুটো দিক সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। দু’দিক দিয়েই ঢাকা-বেরুনোর ব্যবস্থা আছে। নরোয়েজিয়ান অধ্যাপকটি মাত্র ছ’ মাসের জন্য এসেছেন। সেইজন্যই তিনি বেশি দামের বাড়ি ভাড়া নিতে চান না।
কিন্তু প্রস্তাবটি শুনেই অলি বেঁকে বসলো। সে একজন অচেনা সাহেবের সঙ্গে এক ফ্ল্যাটে থাকবে? অসম্ভব! লজ্জাতেই সে মরে যাবে। বস্টনে দু’দিন কাটাবার পর শর্মিলা আর অতীন অলিকে পৌঁছে দিতে এসে এই সমস্যায় পড়ে গেল। অলি তাহলে থাকবে কোথায়? পরের দিনই রেজিস্ট্রেশন, অলির পক্ষে বস্টনে ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়।
শর্মিলার মামা ও মামিমার বাড়ি রাজধানী ওয়াশিংটন ডি সির উপকণ্ঠে, সেখানে অলি স্বচ্ছন্দে থেকে যেতে পারে। মেরিল্যান্ড থেকে খুব বেশি দূর নয়। তবে যাতায়াতে রোজ অনেকটা সময় চলে যাবে, পয়সাও তো খরচ হবে। তবু আপাতত কিছুদিন তো এইভাবেই চলুক। শর্মিলার এই প্রস্তাবেও অলি চুপ করে ছিল, মন থেকে সায় দিতে পারেনি। শর্মিলার মামা তার কাছ থেকে পয়সা নেবেন না। সে কেন একজনের বাড়িতে আশ্রিতের মতন থাকতে যাবে?
অলির অধ্যাপক পিটার মেয়ার বললেন, আর দুটি অল্টারনেটিভ আছে। কী বলো তো? প্রথমত, অন্তত দিন দশেক কোনো মোটেলে থাকো, তার মধ্যে আমি নিশ্চয়ই কোনো ডর্মে ব্যবস্থা করতে পারবো। দু চারদিন কাটলেই বোঝা যাবে যে কোন কোন পুরোনো ছাত্র-ছাত্রী এই সেমেস্টারে আর ভর্তি হচ্ছে না। তখন সীট খালি পাওয়া যাবে।
অলি কিছু বলার আগে অতীনই আপত্তি জানালো। যেন সে অলির অভিভাবক। মোটেল মানে সরাইখানা। সেখানে সাধারণত এক রাতের অতিথিরা আসে। দীর্ঘ পথ গাড়ি চালিয়ে
এসে শ্রান্তি অপনোদনের জন্য তাদের কেউ কেউ মদ খেয়ে হল্লা করে। সে রকম জায়গায়। একা থাকবে অলি? তার চেয়ে ওয়াশিংটন ডি সি-তে শর্মিলার মামার বাড়ি অনেক ভালো। কত আর দূর? কলকাতার অনেক ছেলে মেয়ে তো বর্ধমান থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে।
পিটার মেয়ার বললেন, তা হলে দ্বিতীয় অলটারনেটিভ হচ্ছে…চলো, বরং জায়গাটা দেখে আসি আগে।
জিন্স আর হলুদ গেঞ্জি পরা, মাথার কাঁচা-পাকা চুলে কোনোদিন চিরুনি পড়েনি মনে হয়, মুখে পরিচর্যাহীন দাড়ি-গোঁফ, রোগা আর লম্বা চেহারা, এতই লম্বা যে একটুখানি কুঁজো দেখায়, রয়েস প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি, পিটার মেয়ারকে অধ্যাপক বলে মনেই হয় না। মনে হয়, কোনো ঐতিহাসিক কাহিনী চিত্রের পার্শ্ব অভিনেতা। তিনি শুধু অধ্যাপকই নন, কিছু লোক নাম জানে এমন একজন লেখকও বটে, মোট তিনখানি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে এ পর্যন্ত, গত চার বছর ধরে তিনি আর একটি উপন্যাস রচনা করেছেন, তার মাত্র সত্তর পৃষ্ঠা তিনি লিখে উঠতে পেরেছেন, সেটুকুও তৃতীয় খসড়া।
প্রথম কয়েকবার তিনি অলিকে আলি, আলি বলে ডাকছিলেন, যখন তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো যে আলি মুসলমান পুরুষদের নাম হয়, তারপর থেকে তিনি বেশ যত্ন করে ওলি বলতে লাগলেন। বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের থাকা-টাকার দায়িত্বও যে একজন অধ্যাপক স্বেচ্ছায় ঘাড় পেতে নেন, তা দেখে অলি গোড়া থেকেই মুগ্ধ।
পিটার মেয়ারের একটা ঝরঝরে পুরোনো গাড়ি আছে, উনি সেটাকে কার না বলে বলছিলেন। জ্যালোপি। শর্মিলা এক সময় অলির কানে কানে বলে দিয়েছে যে, এদেশে যার পুরোনো গাড়ি, তাকেই কিন্তু গরিব ভেবো না। এ বছর পুরোনো ধরনের গাড়ি চালানোটাই ফ্যাশান। গত বছর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ফ্যাশান ছিল ময়লা কেডস জুতো পরা। অনেকেই নতুন কেডস কিনে তাতে গাড়ির মোবিল একটুখানি লাগিয়ে নিত।
সেই গাড়িতে ওঠার পর পিটার মেয়ার বললেন, তোমাদের ক্যালকাটার খবর এখন প্রায় এখানকার টেলিভিশান আর খবরের কাগজে থাকে। তোমাদের ঐ ওভার ক্রাউডেড সিটিতে নাকি আবার মিলিয়ানস অফ রেফিউজিস এসেছে? এই বাংলাদেশ সমস্যাটা নিয়ে তোমরা কী মনে করো? শিগগির মিটবে?
অলির থাকার জায়গা এখনো ঠিক হয়নি, তাই নিয়ে ওরা তিনজনেই উদ্বিগ্ন, এখন বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করায় ওদের আগ্রহ নেই। তবু কিছু তো একটা উত্তর দিতে হবে, তাই অতীন প্রথমে নিরুত্তাপ গলায় বললো, সহজে মিটবে না, অনেকদিন চলবে। একদিকে ধর্মীয় উন্মাদনা আর সামরিক নিষ্পেষণ আর অন্যদিকে জাতীয়তাবাদের সেন্টিমেন্ট আর ভাষা নিয়ে উচ্ছাস, এর কোনোটাতেই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কিছু যায় আসে না, এটা বিপ্লব কিংবা বিদ্রোহ নয়, একটা ভাবাবেগের লড়াই, এতে কোনো সমস্যারই সমাধান হবে না।…
বলতে বলতে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে অতীন বললো, তোমরা অ্যামেরিকানরাই তো পাকিস্তানকে গাদা গাদা অস্ত্র দিচ্ছো, আর সেই অস্ত্রে সাধারণ মানুষ মরছে! ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে-কোনো ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে থাকে।
পিটার মেয়ার বললেন, সেটা অস্বাভাবিক তো নয়। তোমাদের ইন্ডিয়ার সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ানের সামরিক চুক্তি হয়েছে। আগে থেকেই অনেকটা ছিল, এখন তো বলতে গেলে ইন্ডিয়া পুরোপুরি সোভিয়েত শিবিরে। তা হলে অ্যামেরিকা তো পাকিস্তানকে হাতে রাখতে চাইবেই।
শর্মিলা বললো, সোভিয়েত ইউনিয়ানের সঙ্গে ইন্ডিয়ার সামরিক চুক্তি হয়নি, কুড়ি বছরের বন্ধুত্ব চুক্তি হয়েছে।
পিটার মেয়ার হেসে বললেন, অস্ত্রের কথা বাদ দিয়ে কি দুই রাষ্ট্রের মধ্যে কখনো বন্ধুত্ব হয়? সোভিয়েত ইউনিয়ানের সেনাপতিরা দিল্লিতে ঘন ঘন যাতায়াত করছে কেন? ইন্ডিয়া মিগ বিমান পেয়েছে কার কাছ থেকে?
অতীন প্রায় ধমক দিয়ে বললো, তোমরা অ্যামেরিকানরা গণতন্ত্রের গর্ব করো, কিন্তু পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলিকে বাদ দিয়ে তোমরা ভাব জমাও যত সব সামরিক একনায়কতন্ত্রের সঙ্গে। জঘন্য ব্যাপার। আসলে তোমাদের মতলব, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর চার পাশে কামান বসিয়ে রাখা।
পিটার মেয়ার বললো, অনেকদিন ধরে সামরিক শাসন চলছে যে পাকিস্তানে, তার সঙ্গে চীনেরও তো বেশ বন্ধুত্ব। পাকিস্তানের মধ্যস্থ করে এখন চীনের সঙ্গে অ্যামেরিকারও ভাব জমতে শুরু করেছে। নিক্সনের দূত কিসিংগার এই মহুর্তে পিকিং-এ। রাষ্ট্রপুঞ্জে তাইওয়ানকে হঠিয়ে দিয়ে কম্যুনিস্ট চীনকে সদস্য করা হলো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইন্ডিয়া এখন অনেকটা একঘরে হয়ে পড়লো, তাই না?
শর্মিলা বললো, ভারত একটা গরিব দেশ, তবু তাকে অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য করেছে এই পাকিস্তান আর চীন। ক্ষুধার্ত শিশুরা খেতে পায় না, আর অস্ত্রের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে যায়। ধনী দেশগুলো সেই সব অস্ত্র বিক্রি করে আরও ধনী হয়। আমেরিকা। এক ধমক দিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, শেখ মুজিব আর ভুট্টোকে আবার আলোচনার টেবিলে বসাতে পারতো না? ওরা রাজনৈতিক ভাবে মিটিয়ে নিলে ভারতকে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর ভার বহন করতে হতো না, সীমান্তের সংঘর্ষও এড়ানো যেত, এত নিরীহ মানুষেরও প্রাণ যেত
পিটার মেয়ার বললো, তা বলে ভেবো না যেন আমি রাষ্ট্রপতি নিক্সনের সব নীতি সমর্থন করি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ঐ লোকটা একটা গোঁয়ার ও নিবোধ!
অলি একটাও কথা বলছে না, সে জানলা দিয়ে দেখছে এই নতুন দেশ। অবশ্য সব কথা তার কানে আসছে। সে লক্ষ করলো, চীনের প্রসঙ্গ ওঠার পর বাবলুদা কেমন যেন চুপসে গেল, আর কোনো মন্তব্য করছে না। সে আরও লক্ষ করলো, আন্তজাতিক রাজনীতি সম্পর্কে শর্মিলার বেশ পরিষ্কার মতামত আছে, সে দ্বিধাহীন ভাবে কথা বলতে পারে, এবং তার মতামতের সঙ্গে অলির অনেকটাই মেলে।
একটু পরে পিটার মেয়র আবার বললেন, নিউ ইয়র্কের ভিলেজ ভয়েস নামে একটা পত্রিকায় অ্যালেন গীত্সবার্গের সাক্ষাৎকার ও একটা কবিতা পড়লাম। সে এর মধ্যে ইন্ডিয়ায় ঘুরে এলো। গীনসবার্গ আমার বন্ধু। সে বলেছে যে কলকাতার একজন কাউকে সঙ্গে নিয়ে সে পূর্ব-পাকিস্তান সীমান্তে গিয়েছিল। কবিতাটার নাম সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড। তাতে উদ্বাস্তু শিবিরগুলোর দুর্দশার যে বর্ণনা আছে, তা পড়ে আমি চোখের জল সামলাতে পারিনি। গীনসবার্গের মা নাওমি-কে নিয়ে লেখা কাদিস’ কবিতাটার পর এইটাই তার দ্বিতীয় মর্মান্তিক কবিতা। আচ্ছা, যশোর রোডটা ঠিক কোথায়? কবিতাটা পড়ে আমার সেখানে যেতে ইচ্ছে করছে।
এতক্ষণ পরে অলি বললো, স্যার, যশোর রোডটা কলকাতা থেকে শুরু হয়ে চলে গেছে পূর্ব-পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের যশোর শহর পর্যন্ত। দেশ ভাগ হবার পরেও রাস্তাটার ঐ একই নাম আছে। এখন ঐ রাস্তার দু’পাশেই উদ্বাস্তু শিবির। আপনি দেখতে যাবেন স্যার? তা হলে কলকাতায় আমার বন্ধুদের চিঠি লিখে দিতে পারি।
পিটার মেয়ার হো-হো করে হেসে উঠে বললো, তুমি আমাকে এত স্যার স্যার বলছো কেন, ওলি? তোমরা খুব ব্রিটিশ কায়দা মানো, তাই না? তুমি আমাকে শুধু পিটার বলবে। হ্যাঁ, আমার ইচ্ছে তো হয় একবার ইন্ডিয়ায় যাওয়ার, কিন্তু আমার উপন্যাসটা শেষ করতে না পারলে গাড়িটা বড় রাস্তা ছেড়ে ছোট রাস্তায় ঢুকে কয়েকটা বাঁক ঘুরে একটা বাড়ির সামনে থামলো। নীলাভ সাদা রঙের দোতলা কাঠের বাড়ি, সামনে একটা বড় বাগান। দেখলেই বোঝা যায় বাড়ির মালিকের বেশ যত্ন আছে বাগানের প্রতি, চমৎকার গোলাপ আর। চন্দ্রমল্লিকা ফুটে আছে। পার্কের ধারে সারি সারি ক্যাকটাসের টব। দোতলার একটা ছোট্ট বারান্দাতেও অনেক রকম ফুল গাছ। বাইরে থেকে প্রথম দর্শনে বাড়িটাকে একটা সুন্দর ছবি ছবি মনে হয়।
গাড়িটাকে বাইরে পার্ক করে পিটার মেয়ার বাগানের গেট খুলে সদলবলে ভেতরে চলে এলেন। পার্কে উঠে বেল-এ আঙুল ছোঁয়াতেই শোনা গেল একটা কুকুরের গম্ভীর গর্জন। ঠিক দু’বার। পিটার মেয়ার কুকুরটির পরিচয় দিয়ে বললেন, এর নাম ফ্রাইডে।
দরজা খুলে দিলেন একজন মধ্য বয়স্কা মহিলা মাথায় চুল ঠিক পাকা বলা যায় না, বরফের মতন সাদা, স্বাস্থ্য বেশ ভালো, চোখে পাতলা রঙীন কাচের চশমা। পিটার মেয়ারের সঙ্গে এতজন অচেনা লোক দেখেও তিনি বিস্মিত হলেন না। হাসিমুখে বললেন, হাই!
পিটার মেয়ার অলিদের তিনজনেরই পদবী সুষ্ঠু নাম প্রায় সঠিক ভাবে উচ্চারণ করে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অলি ভাবলো, এতগুলো বিদেশী নাম উনি মনে রাখলেন কী করে?
মহিলাটির নাম মেরি উইলসন। পিটার মেয়ার তাঁকে জড়িয়ে ধরে দু গালে তিনবার চুমো খেয়ে বললো, মেরি, এরা আমার ভারতীয় বন্ধু। তোমার সঙ্গে আলাপ করাতে নিয়ে এলাম।
বসবার ঘরটিতে পুরু কার্পেট পাতা, তিনটি বেশ জানলা, জানলার পাশে রঙীন টবে রবার গাছ, চীনে বাঁশ ও নানান রকমের ফান। একদিকের দেয়ালে একটা বিশাল জাপানী ছবি। ঘরটির সাজসজ্জার মধ্যে ঐশ্বর্য ও সুরুচি একসঙ্গে মিশে আছে।
সকলে সোফায় বসবার পর পিটার মেয়ার অলিদের বললেন, মেরি আগে আমাদের সহকর্মিনী ছিলেন, ওঁর স্বামী ছিলেন একটা করপোরেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট, আমাদের খুব বন্ধু। দু বছর চার মাস আগে একটা সাংঘাতিক দুর্ঘটনায় ওঁর স্বামীকে হারাতে হয়, মেরিরও একটা পা বাদ যায়। চোখ দুটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এখন অনেকটা ঠিক হয়েছে।
ওরা তিনজনই মেরির পায়ের দিকে তাকালো। একটা পা নেই? একটা হালকা নীল রঙের লম্বা গাউন পরে আছেন মহিলা, পা অনেকটা ঢাকা, কিন্তু দুটি পায়েরই জুতো দেখা যাচ্ছে। নকল পা?
পিটার মেয়ার ওদের মনের প্রশ্নটা বুঝেই আবার বললেন, একটি পা কৃত্রিম, তাতে এখন ওর বিশেষ অসুবিধে হয় না। কিন্তু কৃত্রিম পা থাকলে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায় না। সেইজন্য মেরি কলেজের কাজ ছেড়ে দিয়েছে, আমরা একজন অতি সুযোগ্যা সহকর্মিণীকে হারিয়েছি। মেরি এখন বাড়িতে বসে ছবি আঁকে। শুধু ফুলের ছবি। মাই গড, এর মধ্যেই মেরির খুব নাম হয়েছে। মেরিল্যান্ডে যারাই নতুন বাড়ি কেনে, তারাই তাদের লিভিং রুমে মেরি উইলসনের একটা ফুলের ছবি টাঙায়। মেরি, তোমার স্টুডিয়োতে নতুন আঁকা ছবি আমাদের দেখাবে না?
মেরি হেসে বললেন, দাঁড়াও, পরে হবে। পিট, তুমি তো শুধু আমার সম্পর্কেই অনেক কথা বলে যাচ্ছো, এদের পরিচয় দাও!
শর্মিলা আর অতীন নিজেরাই বললো কেমব্রিজে তাদের পড়াশুনোর কথা। অলি যে সদ্য এদেশে এসে পৌঁছেছে, সে কথাও জানানো হলো।
পিটার মেয়ার বললেন, ওলি যে দেশ থেকে এসেছে, মেরি সেই দেশেই বেড়াতে যাচ্ছে আগামী শনিবার। মেরি নেপালে যাচ্ছে হিমালয়ান ফ্লোরা অ্যান্ড ফনা স্টাডি করতে। ফুলের ছবি আঁকে তো, ও সব সময় নতুন নতুন ফুল দেখতে চায়।
নেপালের কথা শুনে অতীন খুব আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, কাঠমাণ্ডু? তা হলে আপনি নিশ্চয়ই কলকাতা হয়ে যাবেন?
মেরি বললেন, দিল্লি থেকে কলকাতায় শুধু প্লেন বদল করবো। ঐ শহরে ঢুকছি না। আমার ট্রাভল এজেন্ট কলকাতায় থাকতে বারণ করেছে। কলকাতা নোংরা শহর, যখন তখন বোমা ফাটে, রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য দিল্লি আর আগ্রা ভালো করে দেখবো।
অলির সঙ্গে অতীনের চোখাচোখি হলো। শমিলা কলকাতার মেয়ে নয়, তবু কলকাতার নিন্দে তারও খারাপ লেগেছে।
পিটার মেয়ার বললেন, তা ছাড়া কলকাতায় এখন লক্ষ লক্ষ রেফিউজি, তোমার সেখানে না। যাওয়াই ভালো। মেরি, তুমি তো হার্ড ড্রিংকস কিছু রাখো না, বীয়ার আছে? বড় তেষ্টা ৩৮২
পেয়েছে, একটা বীয়ার পেলে মন্দ হতো না।
মেরি বললো, আমার বাড়িতে কোনো অ্যালকহলিক বীভারেজ রাখি না। নরম পানীয় ( দিতে পারি।
পিটার মেয়ার বললেন, আমি নিয়ে আসছি। কোথায় আছে দেখিয়ে দাও!
ওঁরা দু’জনেই উঠে চলে গেলেন একটা ভেতরের ঘরে। অ্যামেরিকায় এসে অলি এই প্রথম কোনো অ্যামেরিকানের বাড়ি দেখছে। এই এক পা-ওয়ালা মহিলাটি এতবড় বাড়িতে একা থাকেন? ওঁর ছেলেমেয়ে নেই? গাড়ি চালাবার লাইসেন্স নেই বলে উনি অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, এটা একটা অদ্ভুত কথা।
শর্মিলা বললো, আমাদের এখানে কেন নিয়ে এলো বুঝতে পারছি না ঠিক। উনি কি পেয়িং গেস্ট রাখবেন? দেখে মনে হচ্ছে বেশ বড়লোক, সাধারণত এত বড়লোকরা পেয়িং গেস্ট রাখে
অলি বললো, আমাকে এমনি এমনি থাকতে বললে আমি থাকবো না।
অতীন বললো, শর্মিলার মামা বাড়িতে থাকাটাই ভালো হবে। এখান থেকে বেরিয়ে স্ট্রেট সেখানে চলে যাবো।
পিটার মেয়ার ও মেরি যখন ফিরে এলো, তখন তাদের সঙ্গে এলো একটা কুকুর। লম্বা, সাদা রঙের, সারা গায়ে ফুটকি ফুটকি, জাতে ডালমেশিয়ান। কুকুরটা ওদের তিনজনের পাশ দিয়ে একবার ঘুরে উল্টোদিকে গিয়ে বসলো।
মেরি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কেউ কুকুর অপছন্দ করো না তো?
অলিদের বাড়িতে এক সময় কুকুর ছিল। বিমানবিহারী এক সময় অ্যালসেশিয়ান পুষতেন, বাচ্চা বয়েসে অলি সেই কুকুরের সঙ্গে অনেক খেলা করেছে। সেই প্রিয় অ্যালসেশিয়ানটি মারা যাবার পর আর বাড়িতে কুকুর আনা হয়নি। কুকুর সম্পর্কে অলির ভয় নেই, কিন্তু সে জালে বাবলুদা কুকুর পছন্দ করে না। বড় কুকুর দেখলে আড়ষ্ট হয়ে যায়। সে চোরা চোখে চেয়ে দেখলো, অতীন কাঁধ দুটো উঁচু করে শক্ত হয়ে বসে আছে, কুকুরটাও চেয়ে আছে অতীনেরই দিকে।
সকলের হাতে কোকের টিন দিয়ে পিটার মেয়ার বললেন, আমাদের একটা প্রস্তাব আছে। মেরি আর দুদিন পরেই নেপাল চলে যাচ্ছে, তারপর সিঙ্গাপুর, জাপান হয়ে ফিরবে প্রায় এক মাস পরে। ওর বাড়িতে ফুল গাছে জল দেওয়া আর কুকুরটিকে খেতে দেওয়া একটা সমস্যা। আমাকে মেরি অনুরোধ করেছিল, কিন্তু আমি রোজ আসার সময় পাবো না। ওলি, তুমি কি সেই ভার নিতে পারবে।
মেরি উইলসন অলির দিকে চেয়ে বললেন, তুমি যদি অনুগ্রহ করে সেই ভার নাও, তাহলে আমি কৃতজ্ঞ বোধ করবো। আমি ফ্রাইডে-কে কেনেল ক্লাবে পাঠাতে চাই না, এই বাড়িতেই ও বাচ্চা বয়েস থেকে আছে, একজন কেউ ওর দেখাশুনোর ভার নিলে আমি নিশ্চিন্তে যেতে পারবো। ফ্রাইডে খুব শান্ত কুকুর, তোমার কোনো অসুবিধে ঘটাবে না। এর মধ্যেই ও তোমাদের পছন্দ করেছে।
পিটার মেয়ার বললেন, অফ কোর্স তোমার এই সার্ভিসের জন্য মেরি তোমাকে কিছু পে করবে। সেটা পরে ঠিক করে নিলেই হবে।
মেরি বললেন, আমি তো আরও দুদিন থাকছি, এ বাড়ির কোথায় কী আছে সব বুঝিয়ে দেবো।
পিটার মেয়ার বললেন, তাহলে এটাই ঠিক হলো? গাড়ি থেকে ওলির লাগেজ নিয়ে আসা যাক, কী বলো?
ওরা তিনজনই চুপ। এত সহজে অলির থাকার সমস্যা মিটে গেল! এত বড় বাড়ি ঐ। মহিলা অলির হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে যাবেন? এই প্রস্তাবে হ্যাঁ কিংবা না, কোনোটাই যেন বলা যায় না।
মেরি যেন অলিকে একটু তোষামোদ করার সুরে বললেন, তুমি ইচ্ছে মতন আমার টেলিফোন ব্যবহার করবে, তুমি তোমার বন্ধুদেরও উইক এন্ডে নেমন্তন্ন করতে পারো
অতীন উঠে দাঁড়িয়ে বললো, এ তো খুব ভালো ব্যবস্থা। চলুন, সুটকেসটা নিয়ে আসি।
পিটার মেয়ার সব ব্যবস্থা করে বিদায় নিলেন একটু পরে। শর্মিলা আর অতীন আরও কিছুক্ষণ রয়ে গেল।
অলিকে মেরি দেখিয়ে দিয়ে গেলেন দোতলায় গেস্ট রুম। সেই ঘরটিও খুব পরিচ্ছন্ন ভাবে সাজানো। ধপধপে সাদা বিছানা, লেখার টেবিল, ফোন, একটা ছোট টি ভি, একটা র্যাক ভর্তি বই, পাশে ব্যালকনি। সংলগ্ন বাথরুম মস্ত বড়, সঙ্গে ড্রেসিং রুম, ওয়ার্ড রোব, আসল পোর্সিলিনের বাথ টাব। সব কিছু ঝকঝকে তকতকে। বাড়িতে ঐ মহিলা ছাড়া আর কোনো লোক নেই, তবে এত সব পরিষ্কার করে কে?
শর্মিলা বললো, গেস্ট রুমটাই কী দারুণ। অনেক দামি হোটেলেও এত সুন্দর ঘর পাওয়া যায় না। অলি তুমি খুব লাকি।
অতীন বললো, দু দিন বাদে ঐ ভদ্রমহিলা চলে গেলে এতবড় বাড়িতে একা একা থাকতে তোর ভয় করবে না তো?
অলি অন্যমনস্কভাবে দু দিকে মাথা নাড়লো!
অতীন বললো, মালিনী! অলিকে রোজ বাগানে জল দিতে হবে, তার জন্য আবার মাইনেও পাবে! তুই যেন টাকা নিতে অস্বীকার করিস না। অ্যামেরিকানরা যে-কোনো কাজের বদলেই টাকা দেয়। এমনকি বাবা তার ছেলেকে দিয়ে কোনো কাজ করালেও টাকা দেয়।
শর্মিলা বললো, বাগানে জল দেওয়া মোটেই খারাপ কাজ। এরা কোনো কাজকেই ছোট। কাজ মনে করে না।
অতীন বললো, আমি নিউইয়র্কে বেশ কিছুদিন কুলিগিরি করেছি। অলি তো সেসব জানে না।
শর্মিলা বললো, তুমি আবার বড় বেশি বাড়িয়ে বলো। তুমি শপ অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলে, আমি সিদ্ধার্থর কাছে শুনেছি। আমাকেও মাঝে মাঝে বেবি সিটিং করতে হয়েছে। অলি, ভদ্রমহিলা
তো পারমিশান দিয়েছেনই, আমরা এখানে মাঝে মাঝে এসে উইক এন্ড কাটিয়ে যাবো। এত সুন্দর বাড়িতে আমি কখনো থাকিনি।
অতীন বললো, ভদ্রমহিলা কিন্তু আমাদের ডিনার খেয়ে যেতে বলেননি। আর বেশিক্ষণ আমাদের এখানে থাকাটা ঠিক হবে না।
অলির সুটকেসের চাবি পাওয়া যায়নি, শেষ পর্যন্ত তালা ভাঙতে হয়েছে। সুটকেস থেকে জিনিসপত্র বার করে শর্মিলা দ্রুত হাতে অলির ঘর গুছিয়ে দিল। তারপর নিজের কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে বার করলো একটা প্যাকেট। তার মধ্যে রয়েছে একটা নতুন বিছানার চাঁদর আর বালিশের ওয়াড়। এ ঘরের বালিশের ওয়াড়টা খুলতে খুলতে শর্মিলা বললো, যতই পরিষ্কার দেখাক বাবা, অন্যের ব্যবহার করা বেড শীট আর বালিশের ওয়াড়ে শোওয়া যায় না!
অলি অবাক হয়ে বললো, এগুলো তুমি আমার জন্য কিনে এনেছো?
অতীন হাসতে হাসতে বললো, তোমাকে কখনো হোটেলে থাকতে হলে তুমি কী করবে বলো তো?
শর্মিলা ব্যাগ থেকে আরও বার করলো একটা বিস্কুটের প্যাকেট, দু-তিন রকম চকোলেট আর বাদাম, একটা ছোট পারফিউমের শিশি।
অলি প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠলো, এসব তুমি কী করেছো? এত জিনিস আনতে গেলে কেন?
শর্মিলা বললো, প্রথম দু একদিনেই তুমি দোকান টোকানে গিয়ে কেনাকাটি করতে যাবে নাকি? সব চিনতে কয়েকদিন সময় লাগবে না? এসব জিনিসের দরকার লাগে। আগে অবশ্য ভেবেছিলুম, তুমি ডর্মে থাকবে। চলো এবার যাই!
বিদায় নেবার সময় শর্মিলা অলির একটা হাত জড়িয়ে ধরে বললো, যখন যা দরকার হবে, আমাদের ফোন করবে। লজ্জা করো না কিন্তু! ভার্জিনিয়ায় অনেক বাঙালী আছে, তাদের সঙ্গে এ তোমার আস্তে আস্তে যোগাযোগ হয়ে যাবে!
অতীন শর্মিলাকে তাড়া দিয়ে বললো, চলো, চলো। ছটার বাস ধরবো। অলি, খুব ভালোই ব্যবস্থা হয়েছে তোর, চিন্তার কিছু নেই। আমরা তোর খবর নেবো সব সময়। পিটার মেয়ার লোকটা ভালো।
শর্মিলা বললো, যখন এ বাড়িতে প্রথম নিয়ে এলো, আমি ভাবলুম, পিটার মেয়ার বুঝি নিজের বাড়িতেই অলিকে থাকতে দিচ্ছেন।
অতীন বললো, এখানকার প্রফেসাররা বাড়িতে কোনো ছাত্র-ছাত্রী রাখে না। তবে বাড়িতে ডাকবে, ডিনার খেতে প্রায়ই ডাকবে।
অলি ওদের সঙ্গে নীচে নেমে বাগানের গেট পর্যন্ত এলো। শর্মিলা বললো, এই, তুমি ভেতরের দরজাটা খুলে রেখে এসেছা, কুকুরটা যদি বেরিয়ে যায়? আর এসো না, যাও, তুমি ভেতরে যাও!
অলি প্রায় দৌড়ে বাড়ির মধ্যে চলে এলো। মেরিকে দেখা গেল না, তিনি স্টুডিওতে গেছেন, সন্ধে আটটার সময় অলির সঙ্গে আবার দেখা করবেন বলেছেন। কুকুরটা চুপ করে শুয়ে আছে বসবার ঘরে। অলি উঠে এলো ওপরে। ব্যালকনিটার দরজা খুলে সেখানে দাঁড়ালো। এখানেও অনেক রকম ফুলের গাছ, দেয়াল বেয়ে উঠেছে আইভি লতা।
এটা বাড়ির পেছন দিক। এদিকেও রয়েছে খানিকটা বাগান, তারপর অন্য রাস্তা। খানিকটা দূরে সে দেখতে পেল শর্মিলা আর অতীনকে, ওরা সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে, হাত ধরাধরি করে। একটু পরেই ওদের আর দেখা গেল না।
হু হু করে জল এসে গেল অলির চোখে।
বাবলুদা একবারও তার হাত ছোঁয়নি। সে আর জীবনে কখনো বাবলুদাকে স্পর্শ করবে না। বাবলুদা আর তার কেউ নয়। না, না, সে আর এই রকম কথা চিন্তাও করবে না কোনোদিন। শর্মিলা কী ভালো মেয়ে, বাবলুদার সঙ্গে তাকে চমৎকার মানিয়েছে।
শৌনক, আমার শৌনক আছে। সে কোনোদিন আমাকে ভুলে যাবে না বাবলুদার মতন। শৌনক শুধু আমার, শুধু আমার! মনে মনে এই কথা বারবার বলতে বলতে অলি চোখ মুছতে লাগলো। তবু কান্না থামছে না। তার হেঁচকি উঠে আসছে।
সে বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুলো ভালো করে। বুকের মধ্যে ব্যথা করছে, বুকটা মুচড়ে যাচ্ছে। কেন হচ্ছে এরকম, বাবলুদার ওপর তো তার রাগ অভিমান নেই। মনটা অন্যদিকে ফেরানো দরকার।
চিঠি লিখলে সময় কাটবে। অনেক চিঠি লিখতে হবে। মা-বাবাকে, পমপমকে, বর্ষাকে, প্রতাপকাকাকে। সবচেয়ে আগে শৌনককে চিঠি লেখা উচিত না? শৌনিকের ঠিকানা কী? তার চোখ দুটো এখনো স্পষ্ট হয়নি। তার গলার আওয়াজ কী রকম? পিগম্যালিয়ান যেরকম একটা মূর্তিকে জীবন্ত করেছিল, সেইরকম অলি একজন পুরুষকে সৃষ্টি করতে পারবে না, যে তার সারা জীবনের সঙ্গী হবে!
চিঠি লেখার সাদা পাতায় টপটপ করে পড়ছে চোখের জল। অলি একটা লাইনও লিখতে পারছে না। শর্মিলা আর বাবলুদা হাত ধরাধরি করে মিলিয়ে গেল রাস্তার বাঁকে, এই দৃশ্যটা দুলছে তার চোখের সামনে, কান্নায় ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে, ফিরে আসছে আবার। অলি মুখে আঁচল। চাপা দিল।
নাঃ, অন্যদিকে মন ফেরাতেই হবে। এই বাড়ির ভদ্রমহিলাটির কী মনের জোর। অ্যাকসিডেন্টে স্বামী মারা গেছেন, নিজের একটা পা নেই, তবু একলা একলা তিনি নিজের জীবনটাকে সার্থক করার চেষ্টা করছেন। একটা পা নেই, তবু ইনি নেপালে যাচ্ছেন হিমালয়ের ফুল দেখবেন বলে? সাহস আছে বটে! ভদ্রমহিলা অসম্ভব ভদ্র। এটা তো বোঝাই গেল যে অলি কোথাও থাকার জায়গা পায়নি, তার অসহায় অবস্থার জন্যই মেরি তাকে এ বাড়িতে থাকতে দিলেন। নেপালে যাবার টিকিট কাটা হয়ে গেছে, দু দিন পরে চলে যাবেন। এ বাড়ির বাগানে জল দেওয়া আর কুকুরকে খাওয়ানোর অন্য ব্যবস্থা ছিল নিশ্চয়ই, তিনি তো আর অলির অপেক্ষায় বসেছিলেন না! কিন্তু এমন অনুরোধের সুরে বললেন, যেন অলি থাকতে রাজি হলে। তিনি ধন্য হয়ে যাবেন! আবার টাকা দিতে চান। অলি কিছুতেই সে টাকা নেবে না।
ভদ্রমহিলা ছবি এঁকে নাম করেছেন। অনেকে তাঁর ছবি কেনে ঘর সাজাবার জন্য, উনি যখন। খুশী পৃথিবীর যে-কোনো জায়গায় চলে যেতে পারেন। উনি আবার বিয়ে করেননি কেন? কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যান, গলার আওয়াজটা বিষণ্ণ হয়ে যায়, একটা নিঃসঙ্গতা বোধ যেন চাঁদরের মতন জড়িয়ে আছে ওঁর সারা গায়ে। এই বাড়িটা এত সুন্দর, তবু যেন অসম্ভব রকমের শূন্য।
কখন অন্ধকার হয়ে গেছে অলি খেয়ালও করেনি। টেবিল ছেড়ে উঠে অলি আলো জ্বালতে গেল। সুইচ কোথায়? আগে দেখে রাখেনি। দেয়ালে হাত বুলোত বুলাতে হঠাৎ থেমে গেল অলি। তাকে এখানে একা ফেলে শর্মিলার হাত ধরে চলে গেল বাবলুদা। আজই অলি চিরবিদায় দিয়ে দিল বাবলুদাকে। এখন এই গোটা অ্যামেরিকা মহাদেশটাই অলির কাছে শূন্য। কী হবে আর এখানে থেকে?
অন্ধকার ঘরে, দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে ছটফট করে কাঁদতে লাগলো অলি। মানুষের চোখের কত গভীরে এত অশু জমা থাকে? অলি কাঁদতে চায় না, তবু তার চোখ দিয়ে জল ঝরছে। যাতে কোনো শব্দ না শোনা যায় তাই সে শক্ত করে চেপে ধরে আছে নিজের মুখ।