কাটা দিয়েই আজকাল কাটা তুলতে হয়
‘প্রকৃত বিদ্যাশিক্ষা নারীর পক্ষে অমঙ্গলের কারণ। কেননা ইহার দ্বারা পুত্রপ্রসবযোগিনী শক্তিগুলো হ্রাস পায়। বিদুষী নারীর বক্ষদেশ সমতল হইয়া যায় এবং তাহদের স্তনে প্রায়ই দুগ্ধের সঞ্চার হয় না। তদুপরি লেখাপড়া শিখিলে বিধবা হওয়ার বিলক্ষণ সম্ভাবনা।‘ উনবিংশ শতাব্দীতে নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে এ জাতীয় বাণী কম সমাদৃত ছিল না। পরন্তু নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তও কেউ অস্বীকার করেনি যে ‘বালিকাগণকে বিদ্যালয়ে পাঠাইলে ব্যভিচার সংঘটনের আশঙ্কা আছে, কেননা বালিকাগণ কামাতুর পুরুষের দৃষ্টিপথে পড়িলে অসৎ পুরুষেরা তাহাদিগকে বলাৎকার করবে, অল্পবয়স্ক বলিয়া ছাড়িয়া দিবে না, কারণ খাদ্য-খাদক সম্পর্ক।‘
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এখন কেবল এই পরিবর্তন হয়েছে যে নারীশিক্ষার জন্য কিছু বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে কিন্তু খাদ্য-খাদক সম্পর্কের কোনও উন্নতি হয়নি। এখনও নারী-পুরুষের মধ্যে এই খাদ্য-খাদক সম্পর্কটিই প্রধান এবং অবিচ্ছেদ্য।
এক পুরুষ কবি লিখেছেন—স্বয়ং বিধাতাও বুঝি পুরুষ। তিনি স্ত্রীলোককে সৃষ্টিই করেছেন এমন করে যে তার এমন কোনও প্রত্যঙ্গই নেই যা পঞ্চশরের আসন বলে চিহ্নিত না হতে পারে। শঙ্কাকুল কবিচিত্ত শেষে স্বস্তি পেয়েছে এই ভেবে যে ভাগ্যিস বিধাতা স্ত্রীলোকের যোনিদেশ পাদমূলের অতি গোপন স্থানে সঙ্কুচিত করে রেখেছেন, যদি তা না করে স্ত্রী দেহের অন্য কোনও স্থানে যোনি সংস্থাপন করতেন তবে সমস্ত জগতই এককালে গ্রস্ত হয়ে পড়ত। কথাটি শ্রুতিকটু অবশ্যই কিন্তু পুরুষের কামুকতার কথা মনে রাখলে এই শ্লোকের বাস্তবতা অনুধাবন করা যায়।
শুনেছি গৌতম মুনি অহল্যা-কামুক ইন্দ্রকে নাকি শাপ দিয়েছিলেন যে তার সর্ব অঙ্গ স্ত্রী চিহ্নে ভরে যাবে। এটি অভিশাপ বলে গ্রহণযোগ্য হয় কারণ শরীরের একটি বা দুটি স্ত্রী চিহ্নের কারণে একজন নারীকে জীবনভর যে দুৰ্গতি পোহাতে হয়, সারা অঙ্গ স্ত্রী চিহ্নে ভরে গেলে কী ভীষণ দুর্ভোগ তার ভাগ্যে আছে তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। তাই শাপ হিসেবে স্ত্রীলোক সম্পর্কিত শাপই অধিক উপযোগী।
নারীকে নারী-অঙ্গের বাইরে কল্পনা করবার অভ্যেস কারও গড়ে ওঠেনি। অঙ্গই নারীর জন্য প্রথম এবং প্রধান বিষয়। এই অঙ্গকে পুরুষেরা বরাবরই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। যেন এই অঙ্গ নির্মিত হয়েছে পুরুষের প্রসাদ উপলক্ষে। এই অঙ্গ নিবেদিত হতেই হবে পুরুষের যুপকাষ্ঠে। এক নবজাত শিশুর শরীরে স্ত্রী-চিহ্ন দেখে ওই শিশুরই পিতা দা উঠিয়েছিল শিশুকে হত্যা করবার উদ্দেশ্যে। পিতাটি শুধু শিক্ষিতই নয়, উচ্চশিক্ষিত। স্ত্রী-চিহ্নের শরীরগুলোকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাদ্য হিসেবে ভক্ষণ করবার ইচ্ছে সকল পুরুষের মধ্যে বর্তমান, কিন্তু ননিটা ছানাটা খাইয়ে আদর যত্ন করবার অযথা আকাঙক্ষা কারও থাকে না। তার চেয়ে একটি লাউগাছকেই জল সার দিয়ে ডাঙর করা ভাল যেহেতু গাছটি মৌসুমে গিয়ে উপাদেয় ফল দান করবে।
নারী কিছু দান করবার ক্ষমতা রাখে না, কেবল গ্রহণ করে—এই ধারণা সাধারণের কাছে স্পষ্ট। তাই সংসারের ক্ষতিকর প্রাণী হিসেবে তাকে বিবেচনা করবার রীতি এই সমাজে প্রচলিত। কন্যার চেয়ে বাড়ির কুকুরটিকেও মূল্যবান মনে করা হয় যেহেতু কুকুরটি চোর ছেচড় তাড়ায়, বাড়ির গরুটিকেও মূল্যবান মনে করা হয় যেহেতু গরুটি হালচাষে গতর খাটায় এবং বাড়ির গাভীটিকেও অধিক মূল্যবান ভাবা হয় যেহেতু সে পুষ্টিকর দুধ নিঃসৃত করে।
নারীর নিঃসরণের কিছু নেই। সমাজ রায় দিয়েছে, মাসে মাসে ঋতুস্রাবের রক্ত ছাড়া নারীর নিঃসরণের কিছু নেই। নারীকে আদিম যুগে ভাবা হত সংসারের বর্জ্য পদার্থ, মধ্যযুগেও তাই ভাবা হয়েছে, আধুনিক যুগেও তাই। নারীকে অবর্জ্য করবার জন্য সামনে আরও কত সহস্ৰ বছর দরকার, কতগুলো যুগ দরকার আমার সাধ্য নেই তা হিসেব করি।
বুদ্ধিজীবিরা বেশ মাথা ঝাকিয়ে মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দিয়ে যায় নারীর কী করে অগ্রগতি হবে। কী করে সে শিক্ষিত হবে, কী করে তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসবে এবং তারপরই কী তালে ও লয়ে তার নারীমুক্তির বাদ্য বাজবে।
মিথ্যে কথা। আমি একজন শিক্ষিত স্বনির্ভর নারীর কথা জানি, যাঁকে সমাজের শেয়ালেরা ছিঁড়ে খেয়েছে। খাদক যদি এসে খেয়েই যায়, যদি শিক্ষা এবং স্বনির্ভরতা নারীকে খাদ্যের তালিকা থেকে রেহাই দিতে না পারে তবে যারা যাবতীয় নীতিফীতির ধুয়ো তুলে নারীকে মুক্তির কথা বলে তারা বাকরুদ্ধ হোক, তারা উত্থানরহিত হোক।
হ্যাঁ, আমি অভিশাপ দিচ্ছি। আমার পূর্বপুরুষ পুরুষদের শরীরে নারী-অঙ্গের অভিশাপ দিয়েছিল। নারীও অভিশাপ দেবার নতুন ভাষা আবিষ্কার করুক। আর খাদ্য নয়, নারী এবার খাদক হোক। পুরুষকে খাদ্য হবার অভিশাপ দিক সকল নারী কণ্ঠ। নারী যতদিন ছিড়ে-খুঁড়ে পুরুষ না খাবে, নারী যতদিন পুরুষ শরীরকে একদলা মাংসপিণ্ড হিসেবে ভোগের নিমিত্ত গ্রহণ না করবে ততদিন নারীর রক্তে-মাংসে-মজ্জায় নিহিত পুরুষকে প্রভু ভাববার সংস্কার দূর হবে না।
শিক্ষা, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার রদবদল করবার কথা বলা পুরুষেরই এক ধরনের গোপনে পাতা ফাদ। নারী যদি স্বাধীনতা নামক শব্দটি একবার উচ্চারণ করে তাকে ওই শত ব্যবস্থার নকশা দেখিয়ে নিশ্চুপ রাখা হয়। তারপর নানা রকম ব্যবস্থার নিয়ম অনিয়ম বুঝতে সময় লাগে অর্ধেক জীবন, বাকি জীবন যায় তাবৎ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভাষা-ব্যবহার শিখে। এতে অবশ্য কোনও ব্যবস্থারই কিছু যায় আসে না। মাঝখান থেকে নির্দেশক পুরুষেরা বেশ লাভবান হয় আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনে দরিদ্র দেশের শাখা-কর্মী নিযুক্ত হয়ে। আন্দোলন সফল হয়ে গেলে আন্তর্জাতিক সাহায্য আবার বন্ধ হয়ে যায় এই ভয়ে এমন এমন যুক্তি ও প্রসঙ্গ নারী আন্দোলনে দাড় করানো হয় যা কেবল পথের মত দীর্ঘ হয়—কোনও গন্তব্য যার নেই, খুঁজে দেখলে অধিকাংশ পথই দেখা যায় শেষ হয়েছে এক গভীর খাদে।
পতিতালয় তুলে দিলে সমাজে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাবে এই বাক্য আউড়ে সমাজের বুদ্ধিমানেরা আসলে দুটো মজা নিতে চায়। পতিতাভোগ এবং অপতিতা ভোগ। দেশে পতিতালয়ের সংখ্যা কম নয় এবং ধর্ষণের সংখ্যাও কম নয়। ব্যবহৃত এবং অব্যবহৃত দুই শরীরই ভোগ করবার একটি আলাদা আনন্দ আছে। তাই রাষ্ট্রের কোনও নীতি যেমন পতিতালয়ের বিপক্ষে যায় না, তেমন অবাধ ধর্ষণের বিপক্ষেও নয়।
নারী ধর্ষণ করতে শিখুক, ব্যভিচার করতে অভ্যস্ত হোক। নারী খাদকের ভূমিকায় না এলে তার খাদ্য নামের কলঙ্ক ঘুচবে না। এখন ভাল কথার যুগ নয়, নীতিবাক্যের সময় নয়। কাটা দিয়েই আজকাল কাটা তুলতে হয়।