অপশন দিয়ে পাকিস্তানে এসে এ এস আই পোস্টে প্রমোশন পেয়ে ও বাপকে দিয়ে ইসমাইল হোসেনকে ধরে নিজের জেলা সদর থানায় বদলি হবার পর তো বটেই, এর আগেও চাকরি জীবনে তহসেনউদ্দিনকে এমন কি হিন্দু বড়োবাবুদের হাতেও এরকম বিপাকে পড়তে হয় নি। বৈশাখের শুরুতে মাঝিদের উৎপাতে তার মেজাজটা খিচড়ে যায়। দিনে দিনে, মাসে মাসে এবং ঋতুতে ঋতুতে তার মেজাজ চড়ে চক্রবৃদ্ধিহারে। এটা কেমন কথা?—নিজের গাঁটের পয়সা খরচা করে রীতিমতো রশিদ নিয়ে তাদের লিজ নেওয়া বিল, সেখানে কাকে দিয়ে মাছ ধরাই আর নৌকা বাওয়াই আর পানি সেঁচি,-সেটা আমার ব্যাপার। তাতে কার কী করার আছে? বাবাকে তহসেন অনেকবার বলেছে, যমুনা পাড়ের মাঝিদের ডেকে একদিন শিমুলতলায়, একদিন ফকিরের ঘাটে, একদিন পাকুড়তলায় আরেক দিন কালাম মাঝির বাড়ির ঘাটে জাল ফেলা হোক। কিন্তু কালামের এক কথা, ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো। আরে ধৈর্যের তো একটা সীমা আছে।-মণ্ডলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে সপ্তাহে অন্তত তিন দিন, হয় ভোরবেলা, নয়তো সন্ধ্যায়, এমনকি বর্ষার সময় ভরদুপুরে এখানে ওখানে ঝুপঝাপ করে কেউ না কেউ জাল ফেলছেই। বাবা বলে, বাপু, লিজেগোরে মানুষ, এরা নিনজর দেয় তো গাঁওত মানইজ্জত লিয়া থাকা যাবি? লিজের মানুষের বল না থাকলে মণ্ডলেক আঁটো করা। কঠিন। কখনো সে আবার আশ্বাস দেয়, সবুর করো। মাঝির জাত, এই কোদ্দো করে, আবার এই দরদ করে। এই আগুন, এই পানি। হামিও তো বাপু মাঝির বেটা, মাঝির রগ হামার জানা আছে।
কালাম মাঝি এরকম কথায় কথায় নিজেকে মাঝির বেটা বলে ঘোষণা করে, তহসেনের এটা পছন্দ হয় না। আবার বাপকে কষ্ট দিতেও মন থেকে সায় পায় না। ছেলের ওপর সন্মায়ের জুলুম সহ্য করতে না পেরেই কালাম মাঝি তাকে নিয়ে দিয়ে এসেছিলো তার প্রথম পক্ষের দূর সম্পর্কের এক বোনের বাড়ি। বোনাই ছিলো খেতলালের কনস্টেবল, পরে বদলি হয়ে চলে যায় অনেক দূরে, মালদা জেলার ইংরেজবাজার থানায়। খালার বাড়িতে থেকে তাদের কুয়ার পানি তুলে দিয়ে, বাজারঘাট করে, খালাতো ভাইদের চোপার বাড়ি খেয়ে তহসেন লেখাপড়াটা চালিয়ে গেছে অনেক কষ্টে। এক বছর বাদ দিয়ে দিয়ে সে ফেল করতো, কিন্তু বাপের মানি অর্ডার ফেল করে নি কোনোদিন। ক্লাস নাইনে একবার ফেল করতেই তার খালু পুলিস সাহেবকে ধরে তাকে পুলিসে ঢুকিয়ে দিলো, আবার ওই সঙ্গে বিয়েও দিলো নিজের মেয়ের সঙ্গে। বৌ তার মাঝির বংশের মেয়ে হলে কী হয়, মানুষ হয়েছে দূরে দূরে। তার ভাষা প্রায় ভদ্দরলোকদের মতে, সে উর্দু বলতে পারে ভাঙা ভাঙা এবং শ্বশুরবাড়ি এসে চালচলন দেখে নাক সিঁটকায়। ছেলেমেয়েরাও পেয়েছে মায়ের ধাত। এখন বাপদাদাকে তারা। যদি মাঝির বংশের মানুষ বলে শোনে তো তারাও কি ছোটো হয়ে যায় না?
আর এই মাঝির বংশ কালাম মাঝিকেও কম মুসিবতে ফেলে নি। এদের সে চেনে হাড়ে হাড়ে। চাষাদের সাথে বিবাদ বাধাও তো এরা থাকবে তোমার পাশে, ইশারা পাওয়া মাত্র দশটা চাষার মাথা ফাটিয়ে দেবে। যদি কলুর ঘরে আগুন লাগাতে চাও, ইঙ্গিত দিলেই কাম হাসিল। আবার এমনিতেই নরম স্বভাবের মানুষ, এক মাছ ছাড়া অন্য কোনো জীবের গায়ে আঁচড় লাগাতে গেলে এদের ঠ্যাঙে ঠ্যাঙ ঠেকে। কিন্তু একবার চেতে যায় তো মাছ মারার বর্শা দিয়েই পাঁচটা দশটা লাশ ফেলে দেবে পলকের মধ্যে। তহসেন এসব বুঝবে কোত্থেকে?
আবার তমিজের মতিগতি বোঝা তো কালাম মাঝির জন্যেও দিন দিন মুশকিল হয়ে পড়ছে। এর ওপরেই সে ভরসা করছিলো বেশি। তমিজের বাপ কম করে যায় নি। ঐ বছর পোড়াদহ মেলার মাছ ধরতে মণ্ডলের হাতে মানুষটার এতো হেনস্থা হওয়াতেই
মাঝিদের দখল এসেছে কালাহার। তারই বেটা, মণ্ডলের সঙ্গে লাগতে গিয়ে জেলও খাটলো। তাকে হাতে রাখাটা কালাম মাঝির খুব দরকার।
কয়েকবার তার ঘরে উঁকি দেওয়ার পর তমিজের দেখা মিললো। ভাত খেয়ে উঠে সশব্দে সে কুলকুচো করছিলো দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। পেছনে কুপি হাতে কুলসুম। খোলা দরজা দিয়ে ঢোকা হাওয়ায় তার হাতে কুপির শিখা কাঁপে! এই ভরযুবতি মেয়েমানুষটা ঘরে থাকে একলা, পাশে তার সৎবেটা। তবে এই নিয়ে আরো কিছু ভাববার আগেই কালামের নাকে লাগে মাগুর মাছের গন্ধ। তার মগজে মাগুরের কাঁটা ফুটলে সে বলে, তমিজ মাছ ধরিস চুরি করা? খাবার হাউস করে হামাক কলেই তো হয়। মানষে তোক মাছচোর কয়, হামার গাওত লাগে!
কাৎলাহার বিল থ্যাকা মাছ নিলে চুরি করা হয় ক্যাংকা করা? বিল না মাঝিগোরে এ সোগলির?
সবই তো জানিস। কালাম মাঝি তাকে একটু বোঝাতেই এসেছিলো, কিন্তু এসেই কালাহারের মাগুরের গন্ধে এবং কুলসুমের কুপির আলোয়-কাঁপা মুখ দেখে তার গলা হঠাৎ চড়ে যায়, তোরা কি হামাক পুলিস ডাকবার কোস? তহসেনেক তো হামি বুঝসুঝ দিয়া রাখিছি। এখন তুই কি হামার লিজের চাচা ভাই জ্ঞাতিগুষ্টির কমোরেত দড়ি বান্দিবার কোস?
তমিজ জবাব না দিয়ে ভেতরে চলে গেলে কালাম মাঝি বলে, বাপের বুড়া বয়সের জোয়ান বৌটাক লিয়া একলা থাকিস, কিছু কই না। আবার বিলের মাছও চুরি করিস। কতো সহ্য করমু? কালাম মাঝি ফিরে যেতে যেতে কুলসুম ও তমিজের এভাবে একসঙ্গে থাকা নিয়ে কীসব বলে, তমিজ ওসব পাত্তাই দেয় না।
তমিজের ভাবনা এখন ফুলজানকে নিয়ে। সেদিন মোষের দিঘির ঢালে অনেকটা আমন কেটে সন্ধ্যাবেলা তমিজ দাঁড়িয়ে ছিলো দিঘির ধারে। রোজকার মতো ফুলজান এসেছে, কিন্তু কাজকামে তমিজের ভুল ধরার বদলে সে হঠাৎ ঢলে পড়ে তার বুকের ওপর। তমিজের হাতে তখন ধান কাটার কাস্তে, ভাগ্যিস সেটা পড়ে গিয়েছিলো তার হাত থেকে, নইলে ফুলজানের হাত পা বুক পেট যে কোনো জায়গায় জখম হয়ে যেতো। ফুলজান তার বুক থেকে মাথা ফিরিয়ে নিয়ে কাঁদতে শুরু করে। সে কাঁদে, কেবলি কাঁদে। তমিজ হতভম্ব হয়ে বলে, কান্দো কিসক? বারবার এই প্রশ্ন করলে ফুলজান বলে, আজ মা হামক পিঠেত খড়ি দিয়া পিটিছে। কেন? তার মা তাকে মারবে কেন? ফুলজান ফের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে এবং জানায় যে, কয়েকদিন হলো ভাতে তার রুচি নাই। নতুন চালের ভাত সর্ষের তেল পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে মেখেও সে মুখে তুলতে পারে না। তার খালি বমি বমি লাগে। এক পোড়া মাটি আর তেঁতুল ছাড়া আর কিছুই তার রোচে না।
তা তেঁতুল জোগাড় করা তমিজের জন্যে এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। মোষের দিঘির দক্ষিণে ভবানীর মাঠেই জোড়া তেঁতুল গাছ। দুটোতেই ভূত পেত্নী থাকে বলে লোকে ঐ গাছ থেকে তেঁতুল সহজে পাড়ে না। তা ফুলজানের জন্যে না হয় ভূত পেত্নীর সঙ্গে মারামারি করবে। তবে ভয়ও তার হয় বৈ কি। চুপচাপ বাজার থেকে তেঁতুল এনে দিলেই বা ফুলজান কি আর জিগ্যেস করতে যাবে? কিন্তু ফুলজান তাকে ধিক্কার দেয়, তুমি এক আবোর মাঝির আবোর বেটা, কিছুটা বোঝে না? এখন গলাত দড়ি দেওয়া ছাড়া হামার গতি নাই। তুমি হামাক একটা দড়িই না হয় কিন্যা দাও।
তখন ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে তমিজের শরীর কাঁপে। তার বাপ কি তাহলে মরতে না মরতে এসে ঢুকে পড়েছে ফুলজানের পেটের ভেতরে? পাকুড়গাছ যদি চিরকালের জন্যে হারিয়ে গিয়ে থাকে তো লোকসান নাই, বাপ তার ঠাঁই একটা ঠিকই বেছে নিয়েছে। উত্তেজনা তার এতোই বাড়ে যে ফুলজানকে জড়িয়ে নিজের বুকের সঙ্গে সে আঁকড়ে ধরে প্রবল বেগে। তার মুখে, চোখে, কপাল, ঘ্যাগে ও বুকে নিজের মুখ ঘষতে ঘষতে তার মনে হয়, মাঝির বেটার সঙ্গে এবার বেটির বিয়ে না দিয়ে হুরমতুল্লার আর পথ নাই। তবে বিয়ের আগে জমির ব্যাপারটা সে ফয়সালা করে নেবে।
আজ কালাম মাঝির ঝাঝালো কথাবার্তা শোনার পর নিজের ঘরে শুয়ে তার বাম চোখের পাতা কাঁপতে থাকে প্রবল বেগে। লক্ষণ তো ভালো নয়। মেলার আর বাকি। দুইদিন। কাল বাদে পরশু কাৎলাহার বিলে ঝাঁপিয়ে পড়বে মাঝিপাড়ার সব মানুষ, সেখানে কালামের পক্ষে সে যদি দাঁড়ায় তো ফ্যাকড়া মিটে যায়। ফুলজানকে নিয়ে এখানে চলে এলে তাদের আগলে রাখবে কালাম মাঝিই।
কিন্তু ভোরবেলা কালাম মাঝির বাড়ি গিয়েও সে ফিরে আসে বাইরে থেকেই। তাকে সোজাসুজি না বলাই ভালো। কেরামত আলিকে বললে হতো! কিন্তু ফুলজানের সঙ্গে তার বিয়ের খবর কি কেরামতকে বলাটা ঠিক হবে? বুধাকে বলা যায়?—এসব ভাবতে ভাবতে দেখা হয়ে যায় কুদুস মৌলবির সঙ্গে। মৌলবি তাকে দেখে আক্ষেপ করে, কালাম মিয়া মসজিদের বেড়া নতুন কর্যা দিলো। তাও তোমরা জুম্মাঘরের দিকে একবার পাও দাও না? বাপু খাটাখাটনি যতোই করো, একদিন তো যাওয়াই লাগবি, ঐদিন কী লিয়া যাবা, কও তো?
তমিজ সঙ্গে সঙ্গে ওয়াদা করে, জমিতে যাবার আগে ফজরের নামাজটা সে জুম্মাঘরেই পড়ে যাবে। কিন্তু আপাতত সে যে একটা বিপদে পড়েছে, হুজুর ছাড়া তাকে উদ্ধার করবে আর কে? বিপদের কথায় কুদুস মৌলবি ঘাবড়ায়, আবার কাউকে উদ্ধার করার সাবাশি নেওয়ার লোভও তার কম নয়। মাঝিপাড়ার অসুখ বিসুখে সে পানিপড়া দেয়, কিন্তু নেমকহারামের বাচ্চাগুলো পয়সা দিয়ে মানত যা করার সব করে আসে পোড়াদহ মাঠে। তমিজের দিকে তাকিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, মানষের কাম করা লাভ নাই। এটিকার মানুষ বড়ো নেমকহারাম। কাম হলে আর ফিরাও দ্যাখে না।
তমিজ জানায়, তার দেওয়া থোওয়া সব আগাম-কাজটা কী?-হুরমতুল্লার বেটির সঙ্গে বিয়ে হলে তার বড়ো উপকার হয়। কিন্তু মণ্ডলের ভয়ে পরামাণিক সাহস পায় না। এক কালাম মাঝি যদি অভয় দেয় তো কাজটা সে করতে পারে, তার আর মুসিবত হবে না। সব শুনে কুদুস মৌলবি গম্ভীর হয়ে যায়। দাড়িতে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে বলে, ঠিক আছে। আমার কথা কালাম মিয়া কোনোদিন ফালাবার পারে না। তুই মগরেবের পরে জুম্মাঘরত আয়।
দুপুরবেলা হুরমতুল্লার বৌ তাকে দেখে প্রথমে কটমট করে তাকায়। কিন্তু রাগী চোখে দেখতে দেখতে পানি জমে এবং এদিক ওদিক তাকিয়ে হুরতমুল্লার অনুপস্থিতি সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে কাঁদে আর বলে, তুমি আমাগোরে কী সব্বোনাশ করলা বাবা? ছোটোজাতের মানষেক ঘরত ঢুকবার দিয়া ফুলজানের বাপ ইগলান কী করলো? তোমার আর কী, হামাগোরে সব গেলো!
তমিজ মাথা নিচু করেই বলে, সব্বোনাশ কিসের? তোমার বেটিক বিয়া করমু। কও তো আজই করবার পারি। ফুলজানের বাপোক কও। ফুলজানের মা তবু চুপচাপ কাঁদতে থাকলে তমিজ আশ্বাস দেয়, বিয়া করার কথা ভো হামি আগেই কয়া রাখিছি।
মাঝির বেটার সাথে বিয়া দিলে হামরা এটি থাকবার পারমু?
তালে বিয়া দিও না, হাটোত যায়া সব কথা কয়া দেই তো কী হবি?
হুরমতুল্লাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে তমিজ হনহন করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। নবিতন তার পিছে পিছে গিয়ে তাকে আটকায়। চাপা গলায় বলে, তোমার কান একটা বোগদাক দেখ্যা বুবু যে ক্যাংকা করা আটক্যা গেলো হামি বুঝি না। তারপর শক্ত করে চেপে চেপে বলে, মাঝির বেটা, বুবুক লিকা তোমার করাই লাগবি। না হলে বুবু গলাত ফাঁস দিবি। হামি বাপজানেক কয়া বুঝ দেমো। বাপজান হামার কথা শুনবি। এই মেয়েটির প্রতি হুরমতুল্লার একটু বেশি দুর্বলতার কথা ফুলজানও তাকে নালিশ করে বলেছে। এই দুর্বলতা এখন ফুলজানেরই কাজে আসছে দেখে তমিজ হুরমতুল্লার এর প্রতি পক্ষপাতিত্ব অনুমোদন করে। নবিতন ফের বলে, আজ সকাল সকাল বাড়িতে যাও। আজ রাতে ভালো কাপড় পরা আসবা। বিয়া আজই হওয়া লাগবি।–
সারাটা দিন তমিজ ধানের আঁটি বয়ে বয়ে এই বাড়ির উঠানে গাদা করে রাখলো। আর গোনাগুনতি চললো, আজ তার সঙ্গে সঙ্গে থাকলো নবিতন। ফুলজানের কোনো দেখাই পাওয়া গেলো না। নবিতনের দাঁতগুলো উঁচু, কিন্তু নাক বেশ চোখা আর তার। গলায় ঘ্যাগের আভাস মাত্র নাই। কিন্তু ফুলজানকে না দেখে দেখে তমিজের কাজে ভুল হয়, গুনতে ভুল হয়, আঁটি সাজানো এলোমেলো হয়ে যায়। ফুলজানকে না হলে তার। চলবে কী করে?
জুম্মাঘরে যেতে যেতে তমিজের রাত হয়ে গেলো। এশার নামাজ শেষ করে মুসল্লিরা বাড়ি ফিরছে। কালাম মাঝি তাকে দেখে শব্দ না করে কেবল দাঁত ফাঁক করে হাসে।। তার হাসি মোলায়েম দেখাচ্ছে কি অন্ধকারে? না-কি তমিজকে সে অভয় দিচ্ছে বলে হাসিতে তার ছায়া পড়লো, তমিজ ঠিক বুঝতে পারে না। কুদুস মৌলবি বলে, আসার কথা কলাম মগরেবের বাদে, আর তোর সময় হলো এখন? নামাজ পড়ার ভয় কি তোরগোরে এতোই? আখেরাতে কী লিয়া যাবু, ক তো বাপু।
তমিজ কাচুমাচু হয়ে থাকলে কুদুস মৌলবি আসল কথা ছাড়ে, তোর কাম হবি। আরে কালাম মিয়া হামার কথা ফালাবার পারে? কলো, তুই বিয়া কর্যা বৌ লিয়া বাড়িতে উঠবু। মণ্ডলের ভয় করিস না। তোর বাপের কথা কয়া কালাম মিয়া কান্দিলো। কয়, তার বেটা, হামার দায়িত নাই? বিয়ার খরচও কিছু দিবার চাছে। চিন্তা করিস না। উপরে আল্লা, নিচে কালাম মিয়া।
তো আপনে চলেন। কালাম মাঝির এরকম আশ্বাস যেন তমিজ আশাই। করছিলো। তাই কোনো উচ্ছ্বাস দেখায় না। তার এখন দরকার মৌলবিকে, নিজগিরিরডাঙাত চলেন। লিকা আজই পড়ান লাগবি। মণ্ডলের জামাতের কোনো মুনসি লিকা পড়াবার রাজি হবি না। চলেন।
এখনি? ক্যাংকা করা? কুদুস মৌলবির আজ দাওয়াত আছে আবিতনের বাপের বাড়িতে। আজ হয় না। কালাম মিয়া কলো, মেলাটা পার হোক। মেলার দিন তোক থাকা লাগবি কালাম মিয়ার সাথে। মাঝিরা হুজ্জত করলে তোক সামলান লাগবি। মেলাটা পার হোক।
তা কালাম মাঝির পক্ষে থাকতে তমিজ তো একশোবার রাজি। কিন্তু হুরমতুল্লা বুড়াক তো হামি জবান দিয়া আসিছি। লিকা পড়ান লাগবি।
তোর শ্বশুর হবি, তাক তুই কোস বুড়া, তার নাম ধরিস? নাম তমিজ, কিন্তু কথাবার্তা বেতমিজি।
আদব ও তমিজ এস্তেমাল করার জন্যে কিংবা বিরক্ত হয়ে তমিজ কয়েক পুলক চুপ করে থাকে। কুদুস মৌলবি বলে, জবান দিলেই রাখা লাগবি, এমন কোনো কথা নাই। আল্লা সব বোঝে, বান্দার সুবিধা অসুবিধা তার নজর এড়ায় না।
না হুজুর। অপনাগোরে কথা আলাদা। নামাজ রোজা করেন, আল্লা আপনার। অসুবিধা দেখবি। আমার নামাজ নাই, বন্দেগি নাই, আল্লা হামাক দেখবি কিসক? জবান দিছি, হামাক আজ বিয়া করাই লাগবি।
কুদুস মৌলবি তমিজের সমস্যাটা বোঝে। কিন্তু কালাম মিয়ার সাথে একটু বোঝা লাগে।
বোঝার দরকার কী হুজুর? আজ আপনে খালি লিকা পরায় আসেন। বৌ তো হামি ঘরত লিয়া আসিচ্ছি না।
লিকা পড়ার খরচপাতি আছে, জানিস তো?
হুরমতুল্লার ঘরের মেঝেতে মাদুর পাতা হয়েছে, মাদুরের ওপর নবিতনের বোনা কাঁথা, সেখানে ফুল আছে, মাছের ছবিও আছে। আবার ছোটো একটা কথা, তার ওপর বসলো তমিজ আর মৌলবি। হুরমতুল্লার ছোটো শালা এসেছিলো ভাগ্নীদের মেলায় নাইওর নিতে, ছেলেটা প্রথমে গম্ভীর হয়ে বসেছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই নবিতন আর ফালানির সঙ্গে সে বিয়ের আমোদে মেতে ওঠে। অতো রাতে হুরমতুল্লা তাকে দিয়ে গোলাবাড়ি হাট থেকে বাতাসা কিনে আনায়।
নবিতনের বোনা মিনারের আর চাঁদ তারা আঁকা ছবির ছোটো কথায় বসে তমিজ অদ্ভুত বায়না ধরে, বড়ো বেটির নামে হুরমতুল্লা জমির ভাগ লিখে না দিলে সে বিয়ের আসর থেকে উঠে যাবে।
হবু জামায়ের আচরণে হুরমতুল্লা আহত হয়, উৎকণ্ঠিত হয় আরো, রাগও হয় তার। মাঝির ঘরে মেয়েকে দিচ্ছে বলে শরাফত এবারেই তার বর্গা কেড়ে নেবে। আর মাঝির বেটাকে সে জমি লিখে দিচ্ছে শুনলে নিজগিরিরডাঙার চাষাপাড়ার লোকদের দিয়ে তার বাড়িঘর সব উচ্ছেদ করিয়ে ছাড়বে।
কুদুস মৌলবিও বিরক্ত হয়, বৌ লিয়া তোক ভাগা লাগবি মাঝিপাড়াত তোর লিজের বাড়িত। এটিকার জমি তুই রাখবার পারবু?
হামার জমি ক্যাড়া লেওয়া অতো সোজা লয় হুজুর। তমিজ জেদ করে, হামি জেলখাটা মানুষ, হামার সাথে লাগার ক্ষমতা মণ্ডলের বাপেরও হবি না।
কুদুস মৌলবির দেরি হয়ে যাচ্ছে। আশে পাশে কোনো বাড়ি নাই। ভবানীর মাঠ পার হলেই চাষীপাড়া। মণ্ডল কোনোমতে খবর পেয়ে যদি একটু ইশারা দেয় তো তমিজ তো তমিজ, মৌলবি নিজেও জান নিয়ে ফিরতে পারবে কি-না সন্দেহ। সে তাই একটা সমঝোতার চেষ্টা করে, হুরমতুল্লা পরামাণিকের বেটা নাই। তার জমিজমা যা আছে, পাবি কেটা? তার তিন বেটিই তো? হামরা আছি? কালাম মাঝির জোর কি মণ্ডলের চায়া কম? তহসেন দারাগা তার বেটা লয়? মণ্ডল খালি খালি নাফ পাড়ে। তুই নিশ্চিন্ত থাক।
নিশ্চিন্ত না হলেও তমিজ মেনে নেয়। তবে মেয়ের ভালোমন্দ, বিয়েশাদির ব্যাপারে মণ্ডলের মাথাব্যথা নিয়ে হুরমতুল্লা জানায়, বাপু, হামরা একই গুষ্টি, ছোটোজাতের কাছে বেটি দিলে খানদান লষ্ট হয়, তাই মণ্ডল ইংকা কোদ্দ করে। আর কিছু লয়। ধরো শরাফত মণ্ডলের দাদার মামু আর হামার খালার মামুশ্বশুর, না, হামার মামুশ্বশুরের খালা আছিলো মামাতো ফুপাতো ভাইবোন, না, আমার মামুর—। সম্পর্কটি খুঁজতে খুঁজতে সে হয়রান হয়ে পড়লে কুদুস মৌলবি তাগাদা দেয়, লেও, হছে। এখন বিসমিল্লা করি। * বাতাসা দেওয়ার পরেও লাউ দিয়ে রাধা শলুক দেওয়া শোল মাছ দিয়ে পেট ভরে ভাত খায় সবাই। মৌলবির সঙ্গে তমিজও বাড়িই ফিরে যেতো কিন্তু ফুলজান আর নবিতনের থাকার ঘরটি আজ নবিতন সাজিয়েছে বড় সুন্দর করে। অনেক রাত্রে তাকে একরকম ঠেলে ঢুকিয়ে দেয় ফালানি। তমিজ দেখে, ফুলজানের চোখে খুব পুরু করে কাজল লাগিয়ে দিচ্ছে নবিতন। ফুলজান আপন মনে তার নিজের ঘ্যাগে হাত বুলাচ্ছে। হাত দিয়ে চেপে ধরে ঘ্যাগটাকে সে যতোটা পারে সমান করার চেষ্টা করছে কি-না বলা মুশকিল। তমিজ ঘরে ঢুকতেই নবিতন খিলখিল করে হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করতে করতে সে আরো হাসে, ও দুলাভাই, আবার মাছ মনে এই কর্যা বুবুর মুখের মধ্যে বড়শি আটকায়া দিবেন না কলাম।