অনেকদিন পর বিধুশেখর একটু সামলে উঠেছেন। ইতিমধ্যে কঠিন পীড়ায় তাঁর প্রাণাশঙ্কা হয়েছিল। কয়েকদিনের জন্য তাঁর কথা বলার শক্তিও চলে গিয়েছিল, তিনি শুধু তীব্ৰ চোখ মেলে চেয়ে থাকতেন। বহুমূত্র বড় দুষ্ট ব্যাধি, কখন কাকে ছোঁ। মেরে নিয়ে যাবে, তার কোনো ঠিক নেই। অসীম মানসিক বলেই আবার উঠে বসেছেন বিধুশেখর। কণ্ঠস্বরও ফিরে পেয়েছেন, কিন্তু সব কটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ফিরে পাননি, তাঁর বা পা ও বাঁ হাত প্ৰায় অসাড় হয়ে গেছে, বা চোখের দৃষ্টিশক্তি একেবারেই নেই, তাঁর নিশ্বাসও এখন নাসিকার ডান ফুটো দিয়েই নিতে হয়। যে-কোনো কারণেই হোক, শরীরের বাম দিকটাই তাঁর অধিকতর প্রিয় ছিল।
প্রথম কিছুদিন অপরের স্কন্ধে ভর দিয়ে চলাফেরা করতে হতো। ক্রমে ক্রমে তিনি আবার নিজেই নিজের ভার বইতে সক্ষম হলেন। ডান হাতে একটি মোটা লাঠি থাকে, বা পা-টি সামান্য হেঁচড়ে হাঁটতে হয়, কিছু দূরে গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ে বিশ্রাম নেন। এই ক্ষুদ্র অসুবিধেগুলি অগ্রাহ্য করা অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর অভ্যোস হয়ে গেল, এখনো তিনি তাঁর নিজস্ব পরিমণ্ডলে পূর্ণ আধিপত্য বজায় রাখতে চান।
ইতিমধ্যে স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে বিধুশেখরের। আদালতে যাওয়াও তিনি বন্ধ করেছেন। এখন গৃহই তাঁর বিশ্ব। একটি গৃহ নয়, দুটি।
তাঁর নিজগৃহে বর্তমানে কিছু অশান্তি চলছে। জ্যেষ্ঠা কন্যা নারায়ণীই এখন সংসারের কর্ত্রী। বিধবা হয়ে নারায়ণী তিনটি সন্তান সমেত চলে এসেছিল। পিত্ৰালয়ে, তিনটিই মেয়ে। তাদের মধ্যে দুটির বিবাহ হয়ে গেছে, একটির এখনো বাকি। বিধুশেখরের কনিষ্ঠা কন্যা সুহাসিনীর মৃতপিতৃক পুত্রসন্তানটির বয়েস এখন পাঁচ বৎসর। এই নাতিটি বিধুশেখরের প্রাণাধিক প্রিয়, এর নামও তিনি রেখেছেন প্ৰাণগোপাল। অসুস্থ অবস্থায় এই প্ৰাণগোপালকে দেখেই তিনি শান্তি পেয়েছেন, এর জন্যই তিনি চেয়েছেন বেঁচে থাকতে। যেন তাঁদের গৃহদেবতাই মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছেন এই বংশে, ওকে গোপাল গোপাল বলে ডাকলেই বিধুশেখরের হৃদয় জুড়িয়ে যায়, মৃত্যুকালেও তিনি এই নাম উচ্চারণ করতে করতেই শেষ নিশ্বাস ফেলবেন।
প্ৰাণগোপালকে তার পিতৃকুল নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে চায়। অসুস্থ অবস্থাতেই এ সংবাদ শুনে বিধুশেখর ক্ৰোধে জ্বলে উঠেছিলেন। পূজারী ব্ৰাহ্মণদের এত দূর স্পর্ধা! অকৃতজ্ঞতা আর কাকে বলে! ঘরজামাই করবেন বলেই তিনি গরিব বংশ থেকে একটি সচ্চরিত্র মেধাবী যুবককে বেছে নিয়ে সুহাসিনীর সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন। সে সময় তিনি পার্বতীচরণের সংসারে অর্থসাহায্যও করেছিলেন প্রচুর। আজ সেই পার্বতীচরণের বাপের এত সাহস যে প্রাণগোপালকে বিধুশেখরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চায়! পার্বতীচরণের ভাগ্যে নেই, তাই সে বেঁচে থেকে এ সংসারের সুখ ভোগ করে যেতে পারলো না। কিন্তু সে ছিল এই পরিবারের প্রতিশ্রুত ঘরজামাই, সুতরাং তার পুত্রসন্তানের ওপর তো বিধুশেখরেরই সম্পূর্ণ অধিকার।
এদিকে পার্বতীচরণের বাপ শিবলোচন বারবার এসে বলাবলি করছেন, নাতি তো তাঁরাও, নাতিকে না দেখে তাঁরও প্ৰাণ পোড়ে। শিবলোচনের গৃহিণী এখনও পুত্ৰশোক ভুলতে পারেননি, এখনও প্রতিদিন কান্নাকাটি করেন, পার্বতীচরণের ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে তিনি তবু কিছুটা সান্ত্বনা পাবেন।
বিধুশেখর খুব ভালোভাবেই জানেন যে, এই প্ৰাণ পোড়া কিংবা কান্নাকাটির কথা সব মিথ্যে, এসবই স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভণ্ডামি। ঐ শিবলোচনটা একদিনের তরেও ছেলে-ছেলের বউকে ঘরে নেয়নি, পার্বতীচরণ মারা যাবার পর সুহাসিনীকে সান্ত্বনা জানাবার জন্য একবারও আসেনি, হঠাৎ এতদিন পর শুধু নাতির জন্য দরদ উথলে উঠেছে! কুলীনের ঘরে পুত্রসন্তানের দাম অনেক। প্ৰাণগোপাল আর একটু বড় হলেই শিবলোচন ওর পাঁচটা দশটা বিয়ে দিয়ে অর্থ উপার্জন করবে। নাতি যাতে পার না হয়ে যায়, তাই নিজের কাছে রাখতে চায়।
এমন কি বিধুশেখরের রাখা প্ৰাণগোপাল নামও শিবলোচনদের পছন্দ হয়নি ওরা নাম রেখেছে কালিকাপ্ৰসাদ। শিবলোচন যখন এ বাড়িতে এসে ডাকেন, কই, দাদুভাই, কালিকাপ্ৰসাদ—তখন বিধুশেখরের আপাদমস্তক জ্বলে যায়! এ যেন ইচ্ছে করেই তাঁর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের জন্য তাঁর দেওয়া নামে ওরা কক্ষনো ডাকে না।
এক মাস আগে শিবলোচন এসে বলেছিলেন, অন্তত কিছুদিনের জন্য প্ৰাণগোপালকে তিনি নিজের কাছে রাখতে চান। বিধুশেখর তখন সদ্য রোগমুক্ত হয়ে সবেমাত্ৰ শয্যায় উঠে বসতে পারছেন, বাইরে আসতে পারেন না। তিনি শিবলোচনের সঙ্গে দেখাও করলেন না, সোজা বলে পাঠালেন যে বিধুশেখর মুখুজ্যের নাতি একদিনের জন্যও এ বাড়ি ছেড়ে যাবে না। শিবলোচনের যতবার ইচ্ছে হয়, এ বাড়িতে এসে নাতির মুখ দেখে যেতে পারে।
শিবলোচন অপমানিত হয়ে শাসিয়ে গেছেন যে আদালতে গিয়ে তিনি মকদ্দমা রুজু করবেন। নাতির ওপরে ন্যায্য অধিকার তাঁর। বিধুশেখর ওষ্ঠ উল্টে হেসেছেন। যজমানী বামুন তাঁকে মকদ্দমার ভয় দেখায়! করুক একবার মকদ্দমা, শিবলোচনের ভিটেমাটি চাটি করে দেবেন তিনি!
অনেকদিন পর বারবাড়িতে এসে বৈঠকখানায় বসে বিধুশেখর গড়গড়ায় মৃদুমন্দ টান দিতে দিতে ইংরেজী কাগজ পড়ছিলেন। এমন সময় এক ভৃত্য এসে খবর দিল যে মুনশী আমীর আলী তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে এসেছেন। বিধুশেখর একটু বিস্মিত হলেন। মুনশী আমীর আলী দেওয়ানী আদালতে তাঁর সমসাময়িক প্রসিদ্ধ উকিল, হঠাৎ তিনি কোন প্রয়োজনে আসবেন তাঁর কাছে? মুনশী সাহেব খানদানী বংশের গণ্যমান্য লোক, তিনি তো বিনা কারণে আসবেন না।
বিধুশেখর খাতির করে মুনশী সাহেবকে ডেকে আনলেন। দীর্ঘকায় সুদৰ্শন মুনশী সাহেবের চুলে সদ্য রূপালী রঙের পাক ধরেছে, অঙ্গে জরিবসানো কালো রঙের কুতা, মাথায় ফেজ টুপি, দরজা থেকেই আদাব জানাতে জানাতে ঢুকলেন তিনি। বিধুশেখর সসম্মানে তাঁকে বসালেন কোঁচে, ভৃত্যকে হুকুম দিলেন পৃথক আলবোলা এনে দেবার জন্য।
বিধুশেখর যৌবনে ফাসী শিক্ষা করেছিলেন, তাই অনেক সময় তিনি মুনশী আমীর আলীর সঙ্গে ফাসীতে বাক্যালাপ করতেন। মুনশী সাহেব অবশ্য বাংলাও খুব ভালো জানেন।
কৌচে বসে মুনশী সাহেব হাফেজের একটি পঙক্তি বললেন, যার অর্থ হলো, প্রিয়তম কঠিন অসুখে পড়েছেন, তিনি কখন চলে যাবেন এই আশঙ্কায় আমার চিত্ত বেতবৃক্ষের মতন কম্পিত হচ্ছে।
বিধুশেখরও পাল্টা এক বয়েৎ বললেন, যার অর্থ হলো, এই পৃথিবীতে আকর্ষণীয় বস্তু তো তেমন কিছুই নেই, শুধু বন্ধুদের ভালোবাসা। একমাত্র তার টানেই মানুষ বেশীদিন বেঁচে থাকতে চায়!
মুনশী সাহেব এর পর বিধুশেখরের স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিলেন এবং তাঁর অভাবে দেওয়ানী আদালত যে এখন সিংহইন অরণ্যের মতন নিস্তেজ হয়ে আছে, সে কথাও জানালেন।
বিধুশেখর বললেন, কোকিলের সুস্বরে যখন বার্তাস আমোদিত হয় তখন গত বসন্তের জন্য আর কারু খেদ থাকে না। আমীর আলীর মতন পিকররাজ যখন রয়েছেন, তখন আর দেওয়ানী আদালতের অভাব কিসের!
এসবই কথার খেলা। বিধুশেখর জানেন যে মুনশী সাহেব শুধু নিছক ছড়া কাটার জন্য এখানে আসেননি।
সেই আসল বিষয়টা এলো একটু পরে। মুনশী সাহেব বললেন, খোদাতাল্লার এবং আপনার মতন দোস্তদের শুভেচ্ছায় আমি জানবাজারে একটি অতি সামান্য কুটির এবং এক টুকরো বাগান খরিদ করেছি, বড় সাধ ছিল আমার এই গরিবখানায় আপনার মতন একজন বিশিষ্ট অতিথিকে একদিন নিয়ে যাবো, কিন্তু আপনার শরীরগতিকের যা অবস্থা দেখছি…।
বিধুশেখর বললেন, আমার আর যাওয়া হয়েচে! এবার পরপারের ডাক আসার সময় হয়ে এলো!
বিধুশেখর কথার ফাঁকে ফাঁকে মুনশীর মুখখানি প্রখরভাবে লক্ষ করতে লাগলেন। মুনশী আমীর আলী প্রচুর ভূ-সম্পত্তির মালিক, বোঝাই যাচ্ছে তিনি আর একটি বড় বাগানবাড়ি ক্রয় করেছেন, কিন্তু সেখানে বিধুশেখরকে নিয়ে যাওয়া তো তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য হতে পারে না। আরও কিছু গুঢ় ব্যাপার আছে।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সম্পত্তিটা খরিদ করলেন কার কাছ থেকে? মু
মুনশী সাহেব জানালেন যে, বাগান ও বাড়িটি তিনি কিনেছেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদের কাছ থেকে।
বিধুশেখর জানেন যে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদের অবস্থা খুবই পড়তির দিকে। দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর বিশাল ঋণের বোঝা চেপেছিল তাঁর পুত্রদের ঘাড়ে। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবেন্দ্র জমি, বাড়ি, তালুক বিক্রয় করে করে সেই ঋণের অংশ। শুধছেন।
মুনশী বললেন যে, জানবাজারের এই বাড়ির সংলগ্ন বাগানটি ক্ষুদ্র হলেও অপরূপ, বহুরকম ফলাফুলের গাছ রয়েছে। কিন্তু এক জেনানার জন্য তা ঠিকমতন ভোগ করার উপায় নেই। ঠাকুরদের সম্পত্তিটি অনেকদিন অযত্নে অবহেলায় পড়েছিল, ঐ জেনানা থাকে পাশের কুঠিতে, সে আর তার লোকজনই এতদিন সব লুটেপুটে খাচ্ছিল। এখনো তারা এই বাগানে এসে উৎপাত করে, তাদের গরু চলে আসে এই বাগানে, সে জেনানার নিজস্ব লোকজনও অতি বদ, তারা রাতবিরেতে এই বাগানে এসে হল্লা করে।
বিধুশেখর উকিলী ভাষায় তৎক্ষণাৎ মুনশী সাহেবের বক্তব্যটি অনুবাদ করে নিলেন। এর প্রাঞ্জল অর্থ হলো, মুনশী আমীর আলী তাঁর জানবাজারের সম্পত্তির পাশের বাড়ির জেনানার বাগানটিও গ্রাস করতে চান। কিন্তু এজন্য তাঁর কাছে আসা কেন? মুনশী সাহেব বললেন, সে জেনানা এক কসবী! বিধুশেখর শুকনোভাবে বললেন, অ! মুনশী সাহেব বললেন, ঐ কসবীর নামে আমি মামলা দায়ের করতে যাচ্ছি, তাই সে বিষয়ে আপনার কাছে কিঞ্চিৎ পরামর্শ চাই।
বিধুশেখর আমোদহীন হাস্য করে বললেন, পরামর্শ, আমার কাছে? আপনি নিজে বিচক্ষণ ধুরন্ধর উকিল, আপনাকে পরামর্শ দেবো আমি?
মুনশী সাহেব বললেন, তোবা, তোবা, আপনার তুলনায় আমি? আপনার বুদ্ধির সামান্য এক কণা খরচ করলেই বড় বড় মামলার ফয়সালা হয়ে যায়। তা ছাড়া আর একটু কথা আছে। সে জেনানার হাল হকিকত আমি তল্লাশ করে দেখেছি। ঐ কসবীটা ঐ কুঠি। আর বাগান জবরদখল করে আছে। ঐ সম্পত্তি মরহুম রামকমল সিংহের, বর্তমানে যাঁর এস্টেটের অন্যতম আছি আপনি!
বিধুশেখরের তৎক্ষণাৎ চকিতে সব মনে পড়লো। জানবাজারের সেই মাগীটা, সেই কমলি, যার বাড়িতে শেষ নিশ্বাস ফেলেছিল রামকমল সিংহ। হ্যাঁ, ঠিক, সে বাড়িতে ঐ মাগী জোর করে চেপে বসে আছে। বিধুশেখর তাকে উচ্ছেদের চেষ্টাও করেছিলেন এক সময়।
এবার উৎসাহিত হয়ে তিনি মুনশী সাহেবের সঙ্গে আলোচনায় প্রবৃত্ত হলেন। অসুস্থ হয়ে শয্যায় পড়ে থাকা অবস্থায় বিধুশেখর অনেক দিন ও-বাড়ির কোনো খোঁজ পাননি। জানবাজারের সম্পত্তিটি উদ্ধারের এই তো সুবর্ণসুযোগ। বাগান সমেত বাড়িটি মুনশী সাহেবকে বিক্রি করে দিলে তারপর মুনশী সাহেব ঠিকই উচ্ছেদ করতে পারবেন ঐ মাগীকে।
কিছুক্ষণ এই বিষয়ে শলা-পরামর্শ হলো। তারপর বিধুশেখর মুনশী সাহেবকে বললেন যে, রামকমল সিংহের বিধবা পত্নীর সঙ্গে আলোচনা করে তিনি তাঁকে পাকা সংবাদ জানাবেন।
মুনশী আমী আলী চলে যাবার পর বিধুশেখর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি আদালত ছাড়তে চাইলেও মামলা-মোকদ্দমা তাঁকে ছাড়তে চাইছে না।
সেদিন অপরাহ্নে বিধুশেখর বাড়ি থেকে বার হলেন। এতদিন পর্যন্ত তিনি নিজগৃহ থেকে সিংহসদনে পদব্ৰজেই যাওয়া-আসা করতেন, সামান্যই তো পথ। কিন্তু পায়ে সেরকম আর জোর নেই, তিনি আজ জুড়িগাড়ি নিয়েই বেরুলেন, ইচ্ছে এই যে, ও-বাড়িতে একবার দেখা দিয়ে তিনি গড়ের মাঠ থেকে একটু হাওয়া খেয়ে আসবেন।
বিধুশেখরকে দেখে সিংহবাড়ির দ্বারবান-ভৃত্যরা ব্যস্ত হয়ে উঠলো। বেশ কয়েক মাস পরে বিধুশেখরের এখানে আগমন, তিনি তো এখানকার দ্বিতীয় প্ৰভু। ইতিমধ্যে চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে তাঁর, শীর্ণ হয়েছেন, মুখে সেই তেজের আভা নেই, একটি চক্ষু ঘষা কাচের মতন। দিবাকর খবর পেয়ে ছুটে এসে সন্ত্রস্ত হয়ে বলতে লাগলো, আসুন বড়বাবু, আসুন, আপনাকে না পেয়ে আমরা এতকাল একেবারে অনাথ হয়ে রইচি! আহা, কত জমজমাট ছেল এই বাড়ি, এখুন একেবারে সব ফাঁকা।
কিছুক্ষণ একতলায় দাঁড়িয়ে বিধুশেখর কর্মচারীদের কাছ থেকে নানা ষিষয়ে খবরাখবর নিতে লাগলেন। গঙ্গানারায়ণ অনেক কাল নিরুদিষ্ট তিনি জানেন। তিনি নিজেও শয্যাশায়ী থাকায় এ-বাড়ির বিষয়সম্পত্তিতে যে নানাবিধ অনাচার হয়েছে, তাতে আর সন্দেহ কী! নবীনকুমার বালক আর বিম্ববতী স্ত্রীলোক, বিষয় পরিচালনার কোনো জ্ঞানই তাদের কিছুমাত্র নেই। আবার শক্ত হাতে বিধুশেখরকেই হাল ধরতে হবে। তিনি যতদিন জীবিত আছেন, রামকমল সিংহের সম্পত্তির কোনো অনিষ্ট হতে দেবেন না। তিনি হাতের লাঠিগাছা উঁচু করে দিবাকরের উদ্দেশে দাবড়ানি দিয়ে বললেন, সব হিসেবপাত্তর কাল সকালে আমায় দেখাবি!
বিম্ববতীর কক্ষে খবর পাঠানো হয়েছে। এবার বিধুশেখর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে বিধুশেখরের কষ্ট হয়, তবু বিধুশেখর লাঠি ভর দিয়ে উঠতে লাগলেন পা হেঁচড়ে হেঁচড়ে। কয়েক ধাপ উঠেই দাঁড়িয়ে পড়ে দম নেন।
বিধুশেখর সিঁড়ির মধ্যপথ পর্যন্ত উঠেছেন, এমন সময় ওপর থেকে দুপদাপ করে নেমে এলো নবীনকুমার। তার যেন কিসের দারুণ ব্যস্ততা, সে বিধুশেখরকে দেখেও দেখলো না, পাশ কাটিয়ে নেমে গেল হুড়মুড়িয়ে।
অসীম বিস্ময়ে নবীনকুমারের দিকে তাকিয়ে থেকে বিধুশেখর ডাকলেন, ছোটকু!
নবীনকুমার ততক্ষণে নীচে পৌঁছে গেছে। সেখান থেকে বললো, কে, ও জ্যাঠাবাবু?
—ছোটকু, এদিকে শোন!
—জ্যাঠাবাবু, আপনি ওপরে বসুন। আমি একটু পরেই আসচি।
তারপরই সে দৌড়ে চলে গেল।
বিধুশেখর স্তম্ভিতভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। এই কয়েক মাসেই ছোটকু এতখানি বড় হয়ে গেছে! এতদিন পরেও তাঁকে দেখে ছোটকু প্ৰণাম করলো না। কোনো কথা জিজ্ঞেস করলো না! তাঁর অসুখের সময় বিম্ববতী দু-তিনবার গিয়েছিলেন তাঁদের বাড়িতে। দূর থেকে একগলা ঘোমটা দিয়ে তাঁকে দেখেছেন। কোনো কথা বলেননি। অপরের সমক্ষে বিম্ববতী বিধুশেখরের সঙ্গে বাক্যালাপ করেন না। কিন্তু নবীনকুমার একদিনও দেখতে যায়নি তাঁকে।
বিধুশেখর তাঁর হৃদয়ে একটা সূক্ষ্ম কাঁটার ব্যথা বোধ করলেন। ছোটকু তাঁর এত আদরের, সেই ছোটকু তাঁর কাছে আসে না। তাঁর মৃত্যু হলে ছোটকুরই তো মুখাগ্নি করার কথা!
দম নিতে নিতে বিধুশেখর উঠে এলেন ওপরে। বাঁপা, বাঁ হাতের শক্তি কি আর ফিরে আসবে না? আর কি কখনো তিনি দুপায়ে জুতো মশমশিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নমা করবেন না। সহজভাবে? সব হবে। কবিরাজ মশায় বলেছে, আবার তিনি পুরোপুরি সুস্থ জীবন ফিরে পাবেন।
সিঁড়ির সামনেই মজলিস-কক্ষ, সেটির দরজা খোলা। বিধুশেখর দেখলেন সেখানে পাতা হয়েছে নতুন গালিচা, ঝোলানো হয়েছে অনেকগুলি নতুন ঝাড়লণ্ঠন। বিধুশেখরের ভ্ৰ কুঞ্চিত হলো। এ কক্ষ অনেকদিন খেলা হয়নি। এখানে কে এখন আসর বসায়।
ধীরে পায়ে হেঁটে তিনি গেলেন ভিতরমহলের দিকে।
বিম্ববতীর ঘরের সামনের টানা বারান্দায় আগে এলেই শোনা যেত নানারকম পাখির কলকাকলি। আজ এ গৃহ যেন বড় বেশী নিস্তব্ধ। খাঁচাগুলি সার বেঁধে এখনো ঝুলছে, কিন্তু অধিকাংশই শূন্য। পাখিগুলি হয় উড়ে গেছে কিংবা পঞ্চাত্বপ্রাপ্ত হয়েছে। পাখি পোষার শখ আর বুঝি নেই বিম্ববতীর। একটি কথা বলা ময়নাকে এখনো একটি খাঁচার মধ্যে দেখতে পেলেন বিধুশেখর, আগে সে মানুষজন দেখলেই বলে উঠতো, ময়না, বলো, জয় রাখে! জয় কৃষ্ণ! সে পাখিটি তার লাল চক্ষু মেলে বিধুশেখরকে একবার দেখে আবার চক্ষু মুদলো। বৃদ্ধ হয়ে এ পক্ষীও বুঝি ভুলে গেছে কথা বলতে।
নির্দিষ্ট ঘরটির দরজার সামনে এসে বিধুশেখর ডাকলেন, বিম্ব!
একটি নতুন দাসী বেরিয়ে এসে বললো, কত্তামা আপনার জন্যে ভেতরে বসে আচেন।
বিধুশেখরের সঙ্গে সঙ্গে দাসীটিও প্রবেশ করলো ঘরে। আগেকার দাসীবাদীরা সব জানতো, বিধুশেখর এখানে এলে কেউ আর কাছাকাছি থাকতো না।
দক্ষিণ দেয়ালে রামকমল সিংহের বৃহৎ তৈলচিত্রের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বিম্ববতী। অবগুণ্ঠন কপাল পর্যন্ত তোলা, পরনে ধপধাপে শুভ্ৰ বসন। কতই বা বয়েস বিম্ববতীর। বড় জোড় চল্লিশ-বেয়াল্লিশ, কিন্তু যৌবন যেন এখনো মধ্য গগনে, সেই দেবী ভগবতীর মতন রূপ এখনো স্নান হয়নি।
পা টেনে টেনে ভেতরে গিয়ে বিধুশেখর পালঙ্কের বাজু ধরে দাঁড়ালেন তারপর দাসীটিকে উদ্দেশ করে বললেন, পান নিয়ে আয়। পান রেখে চলে যাবি, তোকে এখেনে থাকতে হবে না।
বিম্ববতী এগিয়ে এসে নীচু হয়ে বিধুশেখরের পায়ে হাত দিয়ে প্ৰণাম করলেন। বিধুশেখর তাঁর দু কাঁধ ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো, বিম্ব?
উত্তর না দিয়ে বিম্ববতী নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন।
বিধুশেখর বললেন, এক সময় মনে হয়েছেল, আর বুঝি কোনোদিন এখেনে আসতে পারবো না। আর বুঝি তোমাতে আমাতে এমন দেকা হবে না।
বিম্ববতীর ক্ৰন্দন এবার শব্দময় হলো।
আর কেঁদো না, বিম্ব! এই তো আমি এসিচি।
পালঙ্কের ওপর বসে বিধুশেখর বিম্ববতীর চিবুকটি দু আঙুলে তুলে প্রশ্ন করলেন, বলো, কী তোমার দুঃখ?
বিম্ববতী হাতের তালুতে অশ্রু মার্জনা করে বললেন, আমি ভগবানের কাছে দিনরাত প্রার্থনা করিচি-আপনি সুস্থ না হলে আমিও মত্তুম।
বিধুশেখর নরমভাবে বললেন, সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। আমি আরও দীর্ঘকাল বাঁচবো, তুমি দেকে নিও।
—আমার সব এমন ছারেখারে গেল।
—কেন, কিসের অভাব তোমার?
—এ-বাড়ি পূর্ণ ছিল, শূন্য হয়ে গেল-সব সময় মানুষজনে গমগম করতো, এখন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে।
দাসী পান নিয়ে এসেচে, বিম্ববতী একটু সরে গিয়ে একটি মোড়া টেনে নিয়ে বিধুশেখরের পায়ের কাছে বসলেন।
পান মুখে দিয়ে বিধুশেখর জিজ্ঞেস করলেন, ছোটকু অমন দৌড়ে দৌড়ে কোথায় গেল? আমায় দেকেও কাচে এলো না!
বিম্ববতী বললেন, কী জানি! বন্ধুরা এসেচে বুঝি! ওর কলেজের বন্ধুরা আসে, ও তাদের বাড়ি যায়। বউমা মারা যাবার পর ছোটকু যেন কেমন হয়ে গেসলো, কারুর সঙ্গে কতা বলে না, কাঁদে না পর্যন্ত, শুধু গুম হয়ে থাকে, আমি কাঁদি, আমি ওকে আদর করে কাচে টানতে চাই, ও আসে না কো, কদিন ধরে আবার দেকচি ও বারমুখো হয়েচে, আমি কিছু বলি না। আর।
বিধুশেখর বললেন, ওর আবার একটা বিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে!
বিম্ববতী বললেন, আর গঙ্গা, তার কোনো খবরও কেউ নিলে না…
বিধুশেখর জানতেন এই প্রসঙ্গটা উঠবেই। এ প্রসঙ্গ তাঁর মনঃপূত নয়। গঙ্গানারায়ণকে তিনি মন থেকে মুছে ফেলেছেন।
ঈষৎ ঝাঁঝের সঙ্গে তিনি বললেন, সে জোয়ানমদ মানুষ, সে যদি নিজে থেকে কোতাও চলে যায়, কে তার সন্ধান পাবে বলো? দিবাকর তো চতুর্দিকে লোক পাঠিয়েছেল। অনেক চেষ্টা হয়েচে।
বিম্ববতী বললো, আপনি সুস্থ হয়েচেন, আপনি এবার সব ব্যবস্থা করতে পারেন। একটা কতা বলবো?
–বলো!
—গঙ্গা কাশীতে যায়নি তো? আমার যেন মন বলচে।
—কাশী? কেন, সেখেনে যাবে কেন হঠাৎ?
—আপনি তখন আমায় সব খুলে বলেননি, কিন্তু আমি সব জেনেচি। কাশীতে আমার বিন্দুমা রয়েচে, গঙ্গা যদি তার জন্য কাশী যায়?
—যায় সে যেতে পারে। তার আবার মতিভ্রম হলে যা খুশি কত্তে পারে। কিন্তু ঈশ্বর আমায় কলঙ্ক থেকে রক্ষা করেছেন। কাশীতে বিন্দুবাসিনী নেই।
—নেই? কাশীতে নেই?
—কাল বড় করাল, বিম্ব। কে তার গতি রুকতে পারে?
—তার মানে?
—কাশীতে ছেল, কিন্তু বিন্দু আর বেঁচে নেই!
—বেঁচে নেই? বিন্দু? ও মা!
—কাশীতে এক শেঠের কাচে প্রতি ছ মাস অন্তর আমি বিন্দুর নাম করে টাকা পাঠাতুম। গত বছর সেই শেঠ জানিয়েচে যে বিন্দু মারা গ্যাচে।
—বিন্দু মারা গ্যাচে? আমরা অ্যাতদিন কেউ জানলাম না, শুনলাম না। কেউ তাকে দোকতে গোল না, তাকে দাহ করলো কে? বিন্দু, হতভাগিনী বিন্দু…
—কে যাবে বলো? আমি কি কখনো দূর দেশে গেচি? আমার বাড়িতে আর পুরুষ কোতায়? অন্য কোনো লোকজনকে বিশ্বাস নেই। কাশীর সেই শেঠ আমার মক্কেল ছেল, মানী লোক, সেই সব ব্যবস্থা করেচে।
বিম্ববতী চোখে আঁচল দিয়ে হু হু করে কাঁদতে লাগলেন। বিধুশেখরের চক্ষু শুষ্ক, তিনি কিছুক্ষণ সময় দিলেন বিম্ববতীর শোক ও অশ্রু মোচনের জন্য।
তারপর বিধুশেখর তাঁর এক চোখের দষ্টি বিম্ববতীর দুই চোখের ওপর পর্যায়ক্রমে ফেলে উদাত্ত স্বরে বললেন, নিয়তি! বৈধব্যই ছিল বিন্দুর নিয়তি, অল্প আয়ুই ছিল তার ভবিতব্য, স্বয়ংবিধাতাপুরুষ তার ললাটে লিকে দিয়েচেন, তুমি আমি খণ্ডাবার কে? গুরুবল এই যে, তোমার সুপুত্ত্বর তার ধর্ম নষ্ট কত্তে পারেনি।
বিম্ববতীর চক্ষু দিয়ে আবার জল গড়িয়ে পড়লো। বিধুশেখর জিজ্ঞেস করলেন, মজলিস-ঘরটি দেকলুম আবার গোচগোচ করা হয়েচে। রামকমলের এই ছবিখানাও তো সেখেনে ছিল, এটা এ ঘরে কে আনালে!
উদাসীনভাবে বিম্ববতী বললেন, ছোটকু। মজলিস-ঘরে সে কদিন হলো থ্যাটারের আসর বসিয়েচে।
—থ্যাটার!
বিধুভুষণ আঁতকে উঠলেন। প্রথমে ব্যাপারটা তাঁর বোধগম্যই হলো না। তারপর আরও কিছু কথাবার্তা বলে জিনিসটা বুঝে তিনি বললেন, কী? ইতর লোকদের মতন সে যাত্রা করবে? সঙ সাজবে? ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছা। বিম্ব, রাশ টানো, এ বয়েস থেকেই এমন করলে ও ছেলে যে উৎসন্নে যাবে! কক্ষনো হবে না, আমি বেঁচে থাকতে ওসব কক্ষনো হবে না! ঠিক আচে, কাল থেকে আমিই ওর শিক্ষার ভার নেবো। কাল থেকে আমি এ-বাড়িতে আবার রোজ আসবো। নিয়মিত আসবো, আমার ব্যবস্থা অনুযায়ী সব চলবে। ছোটকুর আবার বিয়ে দিতে হবে, ওকে ঘরে বেঁধে রাখতে হবে, এ যেন রামকমলের ধারা না পায়। তুমি কিছু ভেবো না, আমি সব ঠিক করে দেবো!
বিধুশেখর তাঁর সক্ষম পা-টি তুলে দিলেন বিম্ববতীর কোলে।