৪৬.
শহরের পথে পথে কত বিস্ময়। কত ধাঁধা। মালু যেন এখনো তার হদিস করে উঠতে পারে না। সেই যে মহানগরী, যা ছেড়ে এসেছে মালু এত বছর বাস করেও তার বিচিত্র জীবনের বেড় পায়নি মালু। আর এই ছোট্ট শহরটি যেন ওই মহানগরীরই একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। পদে পদে বিস্ময় ঘেরা জটিলতা এখানেও।
ওই নাম-না-জানা চোখে-চোখে-কথা বলা মেয়েটি, আর সেই নামহীন ঠিকানা হীন চিঠির উৎস কোনো মেয়ে, ওরা এই শহরেরই জটিলতার অংশ। ওরা বিচিত্র ধাঁধা।
চিরকুটটার সাথে সেই ঠিকানাহীন চিঠিগুলো মিলিয়ে দেখল মালু। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি ছত্র প্রতিটি শব্দ অক্ষর আর টান, পাশাপাশি রেখে মিলিয়ে চলল।
না। সন্দেহের এতটুকু অবকাশ নেই। ঠিকানাহীন অক্ষরের সাথে কথা-না বলা মেয়েটির হাতের লেখার সামান্য অমিল নেই। হয়রান মানে মালু। একি অদ্ভুত কৌতুকবোধ মেয়েটির? হয়ত অন্য কিছু। কিন্তু মেয়েটা কেমন বোকা বানিয়ে গেল মালুকে। যে লেখে চিঠি, ঠিকানা জানায় না, যার চোখে অভয়, মুখে নীরবতা–দুটো মেয়ে যে এক হতে পারে, প্রশ্নটা কোনোদিনই জাগেনি মালুর মনে। মালু না হয়ে যদি হত কোনো শহুরে ছেলে যাদেরকে বলা হয় চৌকস, দুটো কিস্সার মাঝে অদৃশ্য সূত্রের যোগাযোগটা অনায়াসেই খুঁজে পেতো ওরা। পৌঁছে যেত অনিবার্য সিদ্ধান্তে।
মালুর আনাড়িপনায় নিশ্চয় মনে মনে হাসছে মেয়েটি।
একটা অনিশ্চিত সুন্দর বিকেলের মিষ্টি প্রতীক্ষায় দিনটা কেটে গেল মালুর।
গেটের কাছাকাছিই দাঁড়িয়েছিল মেয়েটি। পাতলা কাঠের ফালির ছোট্ট গেট। কোমর সমান উঁচু। ওকে দেখে গেটের মাথায় বাঁকান লোহার আংটাটা আলগা করে এক পাশে সরে দাঁড়াল মেয়েটি। বলল না, আসুন, অথবা অন্য কিছু। শুধু চোখের একটি চকিত ঝিলিকে জানিয়ে দিল খুব খুশি হয়েছে ও।
কথা যখন বলবেনই না আপনি তখন উদ্যোগটা আমাকে নিতে হচ্ছে। গেট পেরিয়ে দোতলা দালান অবধি নুড়ি ছড়ান ছোট্ট পথটিতে পা রেখে বলল মালু। তারপর মেয়েটির দিকে চোখ এনে শুধাল : কী নামে ডাকব বলুন তো?
যে নামে ভালো লাগে আপনার? উত্তরটা যেন আগে থেকেই তৈরি রেখেছিল মেয়েটি।
শহুরে চতুরতার আবহাওয়ায় অনেকগুলো বছরই তো কাটিয়ে দিল মালু। কিন্তু, এ ধরনের সপ্রতিভতায় এখনো বুঝি তেমন অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। বিব্রত হল মালু। আমতা আমতা করেই বলল : মানে, মানে, আপনার নামটা…
ভারি দুঃসাহস তো আপনার। প্রথম সাক্ষাতেই নাম জানতে চাইছেন? মৃদু হাসির রেখা মেয়েটির মুখে।
বারে প্রথম সাক্ষাৎ কেন হবে?
তাহলে বলুন তো কোথায় কোথায় দেখেছেন?
যেখানেই গান সেখানেই…
যেখানেই গান সেখানেই? যেন অবাক হয়েছে মেয়েটি। কেমন টেনে টেনে মালুর কথাটারই পুনরুচ্চারণ করল।
বসুন। ঘরে এসে একটা কাউচের দিকে ইশারা দিয়ে বলল মেয়েটি। নিজেও বসল পাশের কাউচে।
সত্যি তো। ওদের তো আর প্রথম পরিচয় নয়! অনেক দিনের চেনা জানা। সহজ হয়ে আসে মালু। পায়ের উপর পা রেখে আরামের ভঙ্গিতে হেলান দিল ও, বলল : আপনি কিন্তু আমাকে প্রচণ্ড এক বিস্ময়ের চমক লাগিয়ে দিয়েছেন!
বিস্ময়ের চমক? খুব মজা পাচ্ছে ও, তেমনি করে মালুর কথাটারই পুনরাবৃত্তি করল মেয়েটি। চোখের কোণে দ্যুতির তরঙ্গ খেলিয়ে শুধাল আবার, কী রকম চমক, বলুন তো?
রকম বড় মারাত্মক। দুর্বোধ্য এক ধাঁধা, যার কোনো কিনারা পাই না।
ধাঁধা? কেমন ধাঁধা? আবারও মালুর কথা দিয়েই কথা বলে মেয়েটি। চিঠি লিখবেন, ঠিকানা জানাবেন না। পত্র দেবেন, উত্তর চাইবেন না। চেয়ে থাকবেন, কথা বলবেন না। শেষে ঠিকানা দিলেন, নাম রাখলেন লুকিয়ে।
শুনেছি, যে থাকে লুকিয়ে শিল্পীরা নাকি তাকেই উন্মোচন করে। আপনার হৃদয়ে তেমন কোনো বাসনা জাগেনি কখনো?
মালু বোবা। কোত্থেকে এক ঝলক রক্ত ছুটে এসে মুখময় ছড়িয়ে পড়েছে ওর, কানের লতিগুলো গরম করে তুলেছে। নিজের এই নাজেহাল অবস্থাটা যেন নিজের আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মালু।
মেয়েটি কিন্তু মিটি মিটি হেসে চলেছে। ওর মুখমণ্ডল চোখের মতোই স্নিগ্ধ আর মিষ্টি ওর মুখের হাসিটা।
অপরাধটা তাহলে স্বীকার করছেন? হাসি থামিয়ে সহসা গম্ভীর হয়ে গেল মেয়েটি।
শুধু নাজেহাল নয়, ওকে অপরাধী, হয়ত কাপুরুষ প্রতিপন্ন করেই ছাড়বে মেয়েটি।
পায়ের উপর রাখা পাটা নাবিয়ে নড়েচড়ে বসল মালু। বলল : অপরাধ কার এখুনি সে বিচার নাই-বা করলেন। কিন্তু হয়রানির আমার একশেষ হয়েছে, সেই প্রথম চিঠি পাবার পর থেকে। অদম্য আগ্রহ চেনবার জানবার অথচ উপায় নেই, এটাকে হয়রানি বলবেন না?
জীবনে বুঝি কারো জন্য হয়রানি পোহান নি?
না।
মেয়েটির সমাজে বুঝি অমন স্পষ্ট করে কথা বলার রেওয়াজ নেই। হয়ত সে জন্যই হঠাৎ করে চোখ তুলে ওকে দেখল মেয়েটি। বলল : একটু আগে যে বলেছিলেন ধাঁধা, সেই ধাঁধাটা?
মানে আপনি, বিচিত্র ওই পত্রদান, প্রথম সারির কোণের আসনটায় বসে থাকা সেই শুভেচ্ছা, সেই মমতার সুধা ঝরান একজোড়া চোখ, সবই-সবই শুধু হয়রানি, তাই না? কৌতুক ঝরে মেয়েটির হাসিতে।
নিজের কথার প্যাঁচে পড়ে নিজেই যেন ঠকে যাচ্ছে মালু। ত্রস্তে প্রতিবাদ উঠল : না না। হয়রানি হবে কেন? সে তো আনন্দ। ওর নৈপুণ্যের অভাব দেখে আবারও বুঝি হাসল মেয়েটি।
পর্দা ফাঁক করে উঁকি দিল একখানি মাঝবয়সী মুখ। বলল : রিহানা, তোমাদের চা কী এখানে পাঠাব, না ডাইনিং রুমে আসবে?
এখানেই চাটা জমবে, তাই না? খুব নীচু গলায় মালুকেই শুধাল মেয়েটি। কিন্তু ওর মত বা উত্তরটার জন্য অপেক্ষা করল না। পর্দার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল–এখানে।
অদৃশ্য হয়ে গেল মাঝবয়সী মুখখানি।
মা। মালুর দিকে তাকিয়ে বলল মেয়েটি।
নামটা কিন্তু সুন্দর আপনার।
ও। এই ফাঁকে শুনে নিলেন বুঝি? কিন্তু আপনি তো জানতে চেয়েছিলেন কী নামে ডাকবেন।
ছোট্ট একটা হু উচ্চারণ করে মুখ নামিয়ে নেয় মালু। সপ্রতিভ রিহানার সুমুখে আজ ও বিধ্বস্ত।
কিছুক্ষণ কেটে যায় চুপচাপ।
চা এল। চায়ের সাথে নাশতা।
বলুন না, কী নামে ডাকবেন? নাশতার তশতরিটা এগিয়ে দিয়ে রিহানাই শুধাল এবার।
কেন, রিহানা নামটি তো বেশ?
ও নামে তো সবাই ডাকে। যেন ক্ষুণ্ণ হল রিহানা।
যে নামে সবাই ডাকে মালুও কী যে সেই নামে ডাকবে ওকে? মালু ডাকবে ওর সুর ভরা কণ্ঠে, ওর নিজের দেয়া নামে, নিজের রচা অভিধায়। অনুযোগের চোখে তাই যেন বলে গেল রিহানা।
ভাবতে হবে যে, মাথা চুলকিয়ে বলল মালু।
এতদিন ভাবেননি বুঝি? মালুর আনাড়িপনায় আর একবার যেন হাসল রিহানা।
মায়ের মুখখানি আর একবার উঁকি দিয়ে গেল। পর পর আরো কয়েকখানি মুখ পর্দা সরিয়েই চকিতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
শুধু কৌতূহল নয় ওদের, আরো কিছু। হয়ত সন্দেহ। সোমত্ত কুমারী মেয়েকে একেবারে পাহারাবিহীন পরপুরুষের সান্নিধ্যে ছেড়ে দেয়ার আধুনিকতাটা বোধ হয় এখনো রপ্ত হয়নি এ বাড়িতে। অন্তত তাই মনে হল মালুর। গান শেখাতে গিয়ে অনেক ছাত্রীর বাড়িতে এ অভিজ্ঞতাটা পেয়েছে ও। তবু অস্বস্তিটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি ও, অবিশ্বাসের এমন স্পষ্ট ইঙ্গিতকে উপেক্ষা করার মতো নির্লিপ্ততা আয়ত্ত হয়নি ওর। রুমালে মুখ মুছে উঠে দাঁড়াল মালু।
সে কী? একটি করুণ মিনতি অস্ফুটে ঝরে পড়ল রিহানার মুখ থেকে। ও দৌড়ে গেল ঘরের কোণে। সেখানে ছোট্ট একটি টুলের উপর রাখা হারমনিয়ামটা এনে রাখল নিচের গালিচায়। বলল : এবার গান হবে। আজকের গানের শ্রোতা শুধু আমি।
অনুরোধ নয় রিহানার। মনের সুন্দর ইচ্ছাটাকে সহজ আদেশের ভঙ্গিতে ব্যক্ত করে গেল ও? যেন এটাই স্বাভাবিক, যেন কতদিন এমনি করে ওকে গান শুনিয়েছে মালু।
যেন চুম্বকের আকর্ষণে হারমোনিয়ামটার কাছে এসে বসল মালু। গান ধরল।
ওর সুমুখেই গালিচার উপর পা গুটিয়ে বসল রিহানা।
আঞ্চলিক টানের একটি দেহাতী গান ধরেছে মালু। সেই পুরানো দিনের মালু বয়াতির কণ্ঠে গাওয়া গণি বয়াতির গান। পুরানো গান, পুরানো সুর, কিন্তু নতুন প্রাণ। কথা তার মুখ্য নয়, মুখ্য তার ভাব। সুর তার প্রধান নয়, ঝংকার তার প্রাণ। ভাবে আর ঝংকারে প্রাচীন গান গেয়ে যায় নতুন অর্থ, নতুন বিস্তার। এ যেন সেই মান্ধাতার আমলের বুড়ো বাতাস, বসন্তের ছোঁয়ায় যার রূপ-শ্রী-গন্ধ সবই গেছে বদলে।
কী এক আবেশ মুগ্ধতায় নিমীলিত রিহানার দুটো চোখ। কখনো কেঁপে যায় চোখের পাতাগুলো হাওয়া লাগা পাঁপড়ির মতো। তারপর যেন প্রদীপের স্নিগ্ধ ঔজ্জ্বল্যে জ্বলে উঠলো চোখ জোড়া। কাছে আরো আছে যেন মালুর মুখের উপর নেবে এল সে চোখ। সুরগুলো বুঝি আপনাদের বিছিয়ে দিয়েছে সে চোখের মখমল কোলে। ধীরে ধীরে ঘন নিবিড়তায় ঠাই নিয়েছে স্থির অকম্প মণির গভীরতায়। তারপর কী এক উত্তাপ হয়ে ঝরে পড়ছে, একটি নিবেদিত হৃদয়ের উষ্ণতা নিয়ে ফিরে আসছে ওদেরই স্রষ্টার কাছে।
এ দৃষ্টির আশ্বাস, এ নির্ভয় প্রেরণা, এতদিন দূর থেকেই তো পেয়ে আসছে মালু। কিন্তু আজ ওরই সুরগুলো মধুর সে দৃষ্টির নির্মাল্য নিয়ে অনাস্বাদিত কোনো অমৃত ধারার মতো ঝরে পড়ছে। সে ধারায় অবগাহন করছে মালু। এ এক আশ্চর্য মধুর অনুভব মালুর জীবনে। মালু কৃতার্থ। এ তো আর মোহ নয়। অচেনার রহস্য মোড়া রোমাঞ্চও নয়। এ যে ওর গান সুর ভাব, ওরই আত্মার প্রতিবিম্ব। ও দেখছে। অনুভব করছে। লেহন করছে। শিশির টল টল সেই একজোড়া চোখ। আজ যেন বন্দীত্বের ডাক সে চোখের ভাষায়। যে হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি ওই চোখ, সে হৃদয়ের গভীরে বুঝি লীন হল মালু। সে হৃদয়ের গভীরে ওর সুরের প্রতিভাস, ওর গানের প্রতিধ্বনি।
চোখের কথায় আর গানের সুরে ঘরের ভেতর ওরা রচনা করে নিল মায়াময় এক পৃথিবী। মায়াময় সেই পরিবেশে ওরা বিমুগ্ধ, আচ্ছন্ন নয়। সত্তায় ওদের সঙ্গীতের অনুরণন, কিন্তু বিশ্লেষণ সচেতনায় উন্মুখ ওদের তন্ত্রী। সুরের পাখায় ভর দিয়ে খুইয়ে গেল না ওরা কল্পলোকের কোনো বিবশ অচেতনতায়।
সূক্ষ্ম আনন্দবোধটিকে সূক্ষ্মতর করে চুনিয়ে চুনিয়ে উপভোগ করছে ওরা। সুডোল ছোটখাট হাত রিহানার। সে হাত সুন্দর শৈথিল্যে উঠে আসে ওর খোঁপার দিকে। খোঁপার গন্ধরাজ কলিটি খুলে বাড়িয়ে দেয় মালুর দিকে।
আপনাকে সম্পূর্ণ করে তুলে দেয়ার যে প্রতীক, সে ফুলটা গ্রহণ করল মালু। ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করল, নাকের কাছে এনে গন্ধ নিল। তারপর যত্ন করে রেখে দিল বুকের পকেটে।
আসি তা হলে? হারমোনিয়ামের চাবিগুলো বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল মালু।
কাল আসছেন, ঠিক আজকের সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। বলল রিহানা।
কালই? আশ্চর্য হল, খুশিও হল মালু।
হ্যাঁ, কালই তো! আপনি যে এখন আমার মাস্টার। গান শেখাচ্ছেন। যেন আগে থেকেই এসব ঠিক করা, মালুই ভুলে যাচ্ছে।
মাস্টার? গান শেখাচ্ছি? রিহানা বুঝি ওকে শেষ পর্যন্ত নাজেহাল আর বেকুব বানিয়েই ছাড়ল।
আপনি সত্যিই একটা বোকা। কিচ্ছু বোঝেন না। কেমন দুষ্টু হেসে বলে রিহানা
এ ব্যাপারে কেমন করে আর দ্বিমত থাকতে পারে মালুর? সত্যিই সে বোকা।
গানই যদি না শেখাবেন, তবে এ বাড়িতে আসবার পথটা কী, বলুন তো?
কিছু বোঝেন না আপনি। সেই মখমলের চোখে এবার চটুল তরঙ্গ খেলা। ঠিকই। রিহানার মতেই সায় দেয় মালু, কিছু বোঝে না ও
আচ্ছা, কাল পর্যন্ত তবে বিদায়। শাড়ির ঢেউ তুলে দোতলার দিকে উঠে যায় রিহানা
মালু আসে। গান শেখায় না, গান করে।
রিহানা বসে। গান শেখে না গান শোনে।
সেই ছোট ঘরটিতেই বসে ওরা। গানে আর সুরে বুঝি স্বপ্ন বোনে। স্বপ্ন নামের চোখের কোলে। চোখের মিনতিতে ঝরে পড়ে হাজার গান। তারপর গান যায় থেমে। স্তব্ধ হয় সুর। সুরের প্রতিধ্বনিটিও মিলিয়ে যায় ধীরে ধীরে। শুধু ঘরময় ছড়িয়ে থাকে একটি সূক্ষ্ম অনুরণন। সে বুঝি ওদের হৃদয়ের স্পন্দন।
তুলতুলে নরম হাত রিহানার। কখন সে হাত উঠে আসে মালুর মুঠোয়। মালুর স্পর্শ পেয়ে যেন কথা কয়ে ওঠে আঙ্গুলগুলো। টনটনিয়ে ওঠে রিহানার হাতের আঙ্গুলগুলো। কিন্তু মিষ্টি, অদ্ভুত মিষ্টি সেই ব্যথাটা। হাতটা সরিয়ে নেয় রিহানা।
কী মনে হয় জান? চোখ তুলে বলল মালু।
কী? সুখের ভারে আধবোঝা অস্ফুট স্বর রিহানার।
মনে হয় তুমি আমার গানের মেয়ে, আমার সুরের মেয়ে।
গানের মেয়ে? আমি তোমার সুরের মেয়ে? কী এক আনন্দের ঢেউ নেচে যায়। রিহানার মুখের ঔজ্জ্বল্যে। গান? স্বর? সে তো অনেক আবেগ, অনেক আনন্দ, হৃদয় নিঙড়ান অনুভূতি? আমি কী তাই?
ঠিক তাই। ওর মাথার উপর হাত রাখল মালু।
জানো? বড় ভয় করে আমার। এত সুখ কী সইবে আমার কপালে? অমঙ্গল আশঙ্কায় বুঝি কেঁপে যায় রিহানার স্বর।
অমন ভাবছ কেন গো?
কী জানি। আগে কী ভেবেছি কখনো? না। এখনি যেন মনে এল, বলে ফেললাম।
না, অমন করে ভেব না।
ভাববো না? সত্যি বলছ তো? মালুর কাছ থেকে যেন আরো আশ্বাস চায় ও। চুপ করে কী যেন দেখে মালুর মুখের ডোলে। তারপর হঠাৎ করে শুধায় : আচ্ছা মালু, নিজেকে যখন আর ধরে রাখতে পারলাম না আমি, নির্লজ্জের মতো প্রকাশ করলাম; তার আগে তুমি কখনও ভাবতে আমার কথা? যখন দেখতে প্রথম সারির কোণের চেয়ারটিতে সাধারণ একটি মেয়ে বোকার মতো…
ওহ রে, কি রে আমার বোকা। ওকে থামিয়ে দেয় মালু। মিষ্টি করে হাসে। নরম করে তাকায়, বলে : এক জোড়া কোমল চোখের স্নিগ্ধ আলো সারাক্ষণ ঘিরে থাকত আমায়।
সত্যি? গ্রীবা ভঙ্গিতে বাঁকা রামধনুর অপরূপ রেখা আঁকে রিহানা। অপূর্ব ওর এই ভঙ্গিটা। ভালো লাগে মালুর।
আংটিটা খুলে খেলা করে রিহানা। মালুর কড়ে আঙ্গুলে লাগিয়ে পরখ করে। দেখে, উল্টে-পাল্টে। খুলে নিয়ে আবার গলিয়ে দেয় আপন মধ্যমায়। ধ্যাত, বাসায় একটুও মন ভরে গল্প করা যায় না। অভিযোগটা যেন মালুর বিরুদ্ধে তেমনি করে ওর দিকে তাকায় রিহানা।
এ এসে বসলো, ও এসে উঁকি মারল। আমার একটুও ভালো লাগে না। এবার আরো স্পষ্ট রিহানার অনুযোগের স্বরটা।
ভাল যদি না লাগে, কীই বা তার প্রতিকার হতে পারে! গালে হাত দিয়ে তাই যেন ভাবে মালু। ভেবে বুঝি উপায় পায় না খুঁজে। তাই গম্ভীর হয়ে যায়।
কেমন মরদ গো তুমি? আমাকে নিয়ে যাবার মতো একটি জায়গাও নেই তোমার? সহসা যেন একটা বিদ্রূপ ঝিলিক তুলে যায় রিহানার কণ্ঠে। চমকে তাকায় মালু। রিহানার মুখে লঘু হাসির চপলতা।
রিহানাকে কী নিজের ঘরে নিয়ে যাবে মালু? ওর তো রয়েছে একখানি ঘর। একলাই থাকে ও। ওদের নিভৃত আলাপনে উঁকি দেবার মতো কেউ থাকবে না সেখানে। কিন্তু কী এক সংকোচ আর লজ্জা এসে যেন টিপে ধরে ওর গলাটা। রিহানার অমন স্পষ্ট অভিপ্রায় সত্ত্বেও আমন্ত্রণের কথাটা কিছুতেই উচ্চারণ করতে পারবে না মালু। বুঝেছি এ ব্যবস্থাটাও আমাকেই করতে হবে। কোনো কম্মের নও তুমি। কী যে অকম্মাকে নিয়ে পড়লাম। কৃত্রিম অভিমান রিহানার।
একেবারেই অকম্মা। হাতে-নাতেই প্রমাণিত হয়ে গেল। স্বীকার করতেই হয় মালুকে।
কিন্তু, কম্ম যা করার সে তো তুমিই করছ, প্রথম থেকেই। আমার তো শুধু গান।
হাঁ মশাই হাঁ। তোমার শুধু গানই। আমুদে গলায় এবার মালুর কথাতেই সায় দেয় রিহানা। বুঝি আশ্বস্ত করে ওকে।
বেশ, ব্যবস্থা হল, আগামীকাল দুপুরে তুমি আমায় খাওয়াচ্ছ। ওই যে নতুন রেস্টুরেন্ট খুলেছে রমনায়, সেখানে।
রিহানার বুদ্ধি আর পরিষ্কার মাথাটার তারিফ না করে পারে না মাল। এক মিনিটের মধ্যেই একটা চমৎকার ব্যবস্থা বের করে ফেলেছে মাথা থেকে।
একটু স্বস্তিও পেল মালু। বাসার চাইতে রেস্তোরাঁর সাক্ষাৎটা বুঝি নিরাপদ।
৪৭.
কেবিনের আব্রুতে বসে আছে ওরা। পাশাপাশি। ধুঁয়ো ছাড়ছে কফির পেয়ালা।
কথা বলছে ওরা। নীরবতার মাঝে পরস্পর সান্নিধ্যটাকেই কী এক বিমুগ্ধতায় উপভোগ করে চলেছে। ওদের অনুভূতি জাগছে বুঝি কোনো শব্দহীন সঙ্গীতের শান্ত প্রবাহ। সুন্দর নৈকট্যে হারিয়ে যাবার মোহবিস্তার ওদের ঘিরে।
আধ বোজা চোখ মালুর, কী এক সুখের আচ্ছন্নতায় জাবর কাটা গরুর মতো। নিশ্বাস টানে ও। বাতাসের সাথে রিহানার নিবিড় ঘনিষ্ঠতার আস্বাদ এসে ভরে দেয় বুকটা।
রি-নু। যেন দূর কোনো স্বপ্নের ডাক মালুর কণ্ঠে।
দুনিয়ার যত দুষ্টুমি রিহানার মুখে। ছোট্ট হেসে সে দুষ্টুমিগুলো যেন ছড়িয়ে দেয় মালুর সারা গায়ে। একটু সরে বসে। কিন্তু আঁচলটি রেখে যায় মালুর কোলে।
হঠাৎ মুখর হয় রিহানা। ওর সুগোল ছোট ছোট হাত আর মুখের পেশী গুলো চপল চাঞ্চল্য ছড়িয়ে যায়।
সে কী মজাই না হোত। ভোরে উঠেই ঝাঁপিয়ে পড়তাম পত্রিকার ওপর খুঁজতাম ক্লাব-জলসার খবরগুলো। সব সময় যে তোমার নাম থাকত তেমন নয়। কিন্তু কোনো অনুষ্ঠান গানের হোক, সাহিত্যের হোক, ধরে নিতাম তুমি আসবেই।
আর কী আশ্চর্য। তুমি আসতে। স্রেফ আন্দাজের উপর এসে কতদিন যে তোমায় পেয়ে গেছি। আহা, সে হিসেবটা যদি লিখে রাখতাম। তখন কী আর জানতাম নাগাল পাব তোমার…
নাগাল বলতে নাগাল! একেবারে হাতের মুঠোয়। ওকে থামিয়ে নিজের কথাটা বলে নিল মালু।
আহা শোন না। মালুর মাথার কয়েকটা চুল আঙ্গুলে প্যাঁচিয়ে টেনে ধরে রিহানা।
বড় খারাপ তোমাদের এই পত্রিকাগুলোর স্বভাব। মা-বাপ নেই ওদের খবরের। খবর দিল অমুক তারিখে অমুখ জলসা। এ দিকে তারিখটা যে পাল্টিয়ে গেল সে খবরটি ছাপাবার নাম নেই। কতদিন যে বেকুব বনেছি আমি। এই না দেখে কী ব্যবস্থা করলাম, জান?
পানির মতো কলকল করে গড়িয়ে পড়ছে রিহানার কথা। মন দিয়ে তাই শুনছে মালু। সংক্ষেপে শুধু ওর প্রশ্নটাই ফিরিয়ে দেয় ওকে; কী করলে?
সে এক মজার ব্যাপার। আমার ছিল এক চেলা, ইংরেজিতে যাকে বলে স্টুজ, আমার খালাত ভাই। ওকে লাগালাম কাজে। তোমার গতিবিধির পাকা খবর ও-ই সংগ্রহ করে আনত আমার জন্য। সোজা গোয়েন্দাগিরি আর কী!
ঝর্নাধারা যেন আপন আনন্দে বয়ে চলেছে। মালু বাধা দেয় না। কিন্তু ও ভাবে কিসের জন্য রিহানার এই প্রচ্ছন্নতার কৌতুক? হয়ত আদৌ প্রচ্ছন্ন নয় রিহানার মন। কৌতুকের রেশ নেই সেখানে। এই মন একান্ত ভাবেই অপরিণত, তরল রোমান্টিকতায় ভরপুর। সেই তরল মনের খোরাক মালু।
রিহানার নিবিড় নৈকট্য শব্দহীন সঙ্গীতের মায়া। সেই মায়ায় হারিয়ে গিয়েও এ কথাগুলো মনে জাগে মালুর।
রিহানা তখন জিজ্ঞেস করছে, ব্যাপারটা খুব মজার না? বিশেষ করে কোনো মেয়ের পক্ষে?
মজারই বটে। ছেলেরাই এদেশে মেয়েদের পিছু ছোটে। মেয়েরাও যে ছোটে, এদেশে এটা নতুন।
আহা ফুলে যে একেবারে ঢোল হচ্ছে। কিন্তু মশাই আমি সে কথা বলিনি। আমি বলছিলাম, ওই স্পাই লাগানোটা।
সেটা শুধু মজার নয়, রীতিমতো রোমাঞ্চকর লোমহর্ষক ঘটনা। বলল মালু।
যাহ্ ফাজিল, কেন ঠাট্টা করছ? মালুর গালে ছোট্ট একটা চড় বসিয়ে দিল রিহানা। চড় বসান হাতটা খপ করে ধরে ফেলল মালু। সে হাতের প্রসারিত তালুতে মুখ বিছিয়ে চোখ বুজল মালু।
কফির ঠাণ্ডা পেয়ালাটা ঠেলে দিয়ে চেয়ারের গায়ে হেলান দিয়েছে রিহানা। যেমন মুখর হয়েছিল হঠাৎ, তেমনি হঠাৎই চুপ করে যায় ও।
এতক্ষণে, এই যেন প্রথম চোখ মেলে চাইল মালু। দেখল এক পিঠ ছড়ান চুল রিহানার। চুলের অবিন্যস্ত গোছাগুলো ওর মুখের চারপাশে, বুকের উপর এলোমলো। কালো চুলের ঝালর মেলা ওর ফর্সা মুখখানির দিকে লোভীর মতো চেয়ে থাকে মালু। সে মুখ বুঝি মেঘের আলিঙ্গনে এক খণ্ড শুভ্রতা। ধীরে ধীরে মালুর হাত জোড়া এগিয়ে গেল। তুলে নিল এক মুঠো চুল। তারপর মেঘের সুতোর মতোই সেই চুলগুলোকে ছড়িয়ে দিল আপন মুখের উপর।
৪৮.
ঝিরঝিরে ভোরের হাওয়ার আলতো ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙে মালুর।
রাতে বুঝি বৃষ্টি হয়েছিল। বাতাসে তার শৈত্য স্পর্শটা লেগে রয়েছে এখনো। মালুর ঘরের বাতাস কী এক গন্ধে আমন্থর। বুক ভরে সে গন্ধটা টেনে নিয়ে আবার চোখ বুজল মালু। তারপর হাতখানি বাড়িয়ে দিল শিথানের দিকে। তুলে নিল সেই মিহি সুবাসের উৎসটি।
কয়েকটা শুকনো গন্ধরাজ, শুকিয়ে কেমন খরখরে হয়ে গেছে তার পাপড়ি গুলো। আর কয়েক গাছি চুলের একটা গোল চাকতি।
বার বার ওর চুলগুলো এলোমেলা করে দিচ্ছিল মালু। মাথাটা সরিয়ে নিয়ে শুধিয়েছিল রিহানা, আমার চুলটা বুঝি খুব পছন্দ তোমার?
খুব! মনে হয় মেঘের সুতো, নরম ভিজে ভিজে। আর অপূর্ব এক সুরভি।
মাঝে মাঝে কেমন সুন্দর কথা বলে মালু। সেটাই বুঝি ভাবছিল রিহানা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল মালুর মুখের দিকে। তারপর ছিঁড়ে নিয়েছিল কয়েকখানি চুল। সুন্দর চাকতির মতো বানিয়ে গুঁজে দিয়েছিল মালুর পকেটে। বলেছিল নাও, আমার সুরভিটা রইল তোমার সাথে।
আর প্রতিদিনের বিদায়ের উপহার ওই গন্ধরাজগুলো। শুকিয়ে চিমসে আর বিবর্ণ ফুলগুলো। তবু কোনোটাই ফেলে দেয়নি মালু।
চুলের ছড়াটি আর গন্ধরাজের শুকনো পাপড়িগুলো নাকের কাছে ধরল মালু। আবার টেনে নিল সেই বিচিত্র সৌরভ।
হঠাৎ মনে পড়ল ওর। এ গন্ধের সাথে ওর যেন আবাল্য পরিচিতি। রানুর ঘরে ছড়িয়ে থাকত চাঁপার সুবাস। তালতলির সব বাড়িতেই যেন ভূর ভূর করত এ গন্ধটি।
সৈয়দ বাড়ির বাতাসে উড়ে বেড়াত যে ফিনফিনে এক সুরভি, সেটা ফুলের ছিল না। বিশেষ কোনো তেল বা প্রসাধনেরও নয়। সে ছিল বড় বাড়ির মেয়ে রাবু আর আরিফার বিচিত্র এক অঙ্গ সুরভি।
আশ্চর্য হয়ে যায় মালু। সেই একই সুরভি এই গন্ধরাজ মেয়েটাকে ঘিরে। ওরা একই জাতের, একই গোত্রের। বুঝি সবটাতেই অমন মিল ওদের। শিথানের চাদরটা উল্টিয়ে হাতে ধরা সুরভিগুলো রেখে দিল মালু।
চাদরটা আবার ঠিক করে রাখল। তারপর উঠে এল। হারমোনিয়ামটা টেনে সুর সাধতে বসল মালু।
মুহূর্তের মাঝেই উল্লসিত এক উন্মাদনায় হারিয়ে যায় মালু। সুরের সমুদ্রে একক অবগাহনের এই মুহূর্তগুলো বুঝি পরমতম আনন্দ, বুঝি গোটা পৃথিবীর বিনিময়ে কিনে নেওয়া কোনো দুর্লভ সম্পদ। রিহানার মুখটাও এই মুহূর্তে ম্লান আর অদৃশ্য। এই ঘরে এতক্ষণ ছড়িয়ে থাকা ওর সুরভিটুকুও মুছে গেছে। অন্য কোনো জগতের অন্য এক সুরভি, অন্য এক অনুভব এসে ঘিরে নিয়েছে মালুকে। সেখানে লুপ্ত এই পৃথিবীর অস্তিত্ব, রিহানা, বেতার ভবন–সব কিছু। কিন্তু সত্যি কী হারিয়ে যায় মালু? অতি মাত্রায় সজাগ আর সতর্ক ওর তন্ত্রীর সূক্ষ্মলোক, যেখানে ওকে বিচার করতে হয়, বিশ্লেষণ করতে হয়। শ্রবণেন্দ্রিয়ের সূক্ষ্ম সুচের আগায় বিদ্ধ করে যেতে হয় সুর তান লয়ের সামান্যতম বিচ্যুতি। এখানেই অধ্যবসায়, ধৈর্য আর নিষ্ঠার পরীক্ষা। এখানেই আনন্দলোকের সেই বিচিত্র সুধা। যেন একতাল মোম নিয়ে বসেছে মালু। চেপে চেপ্টে ফুলিয়ে চটকিয়ে বার বার ভেঙে গড়ে মহা সৃষ্টির প্রয়াস চলেছে ওর। সৃষ্টির এই মহালগ্নে পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ আর বেদনা এক সাথে মিলে মিশে কী যেন প্রলয়ের ডাক দিয়ে যায় ওর অন্তরের গভীরে।
সুর থামিয়ে অকস্মাৎ নিজের দিকে তাকায় মালু। অনুভব করে অন্তরের অতলে আনন্দ বেদনার মিশেল সেই প্রলয় মূৰ্ছনা। অবাক হয় ও। সুরের সাধনা কী বিচিত্র পৃথিবীর সন্ধান দিয়ে গেছে ওকে। আজ সে পৃথিবীর সাথে রিহানার অস্তিত্বটাও যেন অবিভাজ্য। রিহানাকে বুঝি আর বাদ দেয়া যাবে না মালুর জীবনের কোনো কিছু থেকে। নতুন রচা একটা স্বরলিপির উপর চোখ রেখে আবার গলা ছাড়ল মালু। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই থেমে যেতে হল ওকে। কে যেন কড়া নাড়ছে নিচে। গলা বাড়িয়ে দেখল মালু নিচের বাসিন্দারাই খুলে দিয়েছে দরজাটা। সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে একটি মেয়ে। পেছনে একজন পুরুষ। হুরমতি বুয়া?
হাঁরে ভাই আমি। চিনতে পারছিস?
ভাল করে দেখবার আগেই দুটো শীর্ণ বাহুর আলিঙ্গন টেনে নিল মালুকে। বিব্ৰত হল মালু। ছাড়িয়ে নিল নিজেকে।
পেছনে তাকিয়ে আরো আশ্চর্য হল মালু। ওকি! এস এস। ওরা বসল।
হুরমতি তো নয়, হুরমতির কংকাল। খেংরা কাঠির মতো শরীর। চিমসে যাওয়া হাতে মুখে বিশ্রী কালচে মতো দাগ। স্বাস্থ্যের সাথে সাথে রূপটিও গেছে ওর। সেই কাঁচা হলুদ রংয়ের ক্ষীণতম আভাটুকুও আজ খুঁজে পাওয়া যায় না ওর মুখে।
এ কেমন করে হল হুরমতি বুয়া? কিন্তু মালুর প্রশ্নটা যেন মালুকেই ব্যঙ্গ করে গেল।
আমার অসুখ। এইটুকু বলে চুপ করে গেল হুরমতি।
লেকুর দিকে তাকাল মালু। আগের চাইতে অর্ধেক হয়ে গেছে ও। কিন্তু জীবন সম্পর্কে এখনও কী এক তপ্ত আগ্রহ আঁকা ওর চোখের কোলে। ওদের জিজ্ঞাসা না করেও বুঝল মালু, এই শহরেই কোথাও ঘর পেতেছে ওরা। উজোন টেনে টেনে ওরা ক্লান্ত হয়নি এখনো। কত ঘূর্ণির আবর্তে পড়েছে। স্রোতের মোচড়ে হাড় ভেঙেছে, ছিটকে পড়েছে। তবু কিসের জোরে, সর্বস্ব হারিয়েও দ্বৈত জীবনের সুর মিলিয়েছে ওরা? কে রাখে সে খবর। মালু তো ভুলে গেছিল ওদের। আজই বা সে খবর শোনবার ফুরসত কোথায় মালুর? অথবা মনটাই তার বদলে গেছে। স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে বিগত অধ্যায়কে স্মরণ করতে চায় না মন।
অথচ… হুরমতি, লেকু ওদের নিয়ে দুর্ভাবনার অন্ত ছিল না মালুর। কিশোর দিনের কত দুঃখবোধ, কত চোখের জল ঝরিয়েছে ওদের জন্য। ওদের কেন্দ্র করেই কিশোর মনের কত আকুতি, কত নিষ্ফল ক্রোধ গুমরে উঠেছিল সেদিন। আজ বুঝি তার সামান্য চিহ্নও খুঁজে পায় না মালু।
আসলে সংকুচিত হয়ে এসেছে মালুর পৃথিবীটা। ইচ্ছা উদ্দেশ্য বাসনা, আহ্নিক গতির মতো ওর গোটা জীবনটাই এখন আবর্তিত হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে। গান-বেতার-ছাত্রী, সম্প্রতি রিহানা। জীবনটা এখন এই নির্দিষ্ট আবর্তন। স্বপ্নও বুঝি তাই। এর বাইরে কোনো স্বপ্ন নেই, কোনো অন্বেষণ নেই জীবনের।
বাকুলিয়ার হুরমতি, লেকু ওরা আর জীবনের অংশ নয় মালুর। ওদের সাথে অনেক তফাত আজকের মালুর। তবু অতীতটাকে তো কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলতে পারেনি মালু। তাই ওদের কথা শুনতে হয়। ওদের বেদনায় ভার হয়ে আসে বুকটা।
হুরমতির ব্যারাম। ডাক্তার দেখাবার সামর্থ্য কোথায় লেকুর। হাসপাতালে যদি ভর্তি করিয়ে দিতে পারে মালু, সেই আশাতেই ওর কাছে আসা। রেডিও অফিস থেকেই গত বিকেলে ঠিকানাটা সংগ্রহ করে এনেছিল লেকু। চল। জামা পরে বেরিয়ে এল মালু। পেছনে লেকু-হুরমতি। রিকশা চালায় লেকু। সে রিকশাতেই চড়ে বসল মালু আর হুরমতি।
কত টাকা পাও? কিছু না বললে খারাপ দেখায় তাই জিজ্ঞেস করল মালু।
কত আর! কোনোদিন পাঁচ। কোনোদিন চার। কোনোদিন আবার ছয়েও উঠে যায়। এর থেকে মালিকের ভাড়া কাটা যাবে। তিন সাড়ে তিন। মনে মনে একটা হিসেব কষল মালু। বলল! গড়ে তা হলে সত্তর-আশি টাকা থাকে মাসে। দু জনের সংসার এতে চলে কেমন করে?
লেকুও বুঝি অবাক হল এই উদ্ভট প্রশ্নে। জবাব দিল না।
লেকুকে ছেড়ে হুরমতির দিকেই মনোযোগ দিল মালু। কী অসুখ, কবে থেকে শরীর খারাপ ইত্যাদি, সবই কেমন সৌজন্যের প্রশ্ন। নিজের কানেই বেখাপ্পা ঠেকছে মালুর।
আধময়লা একটা মিলের শাড়ি হুরমতির পরনে। কিন্তু দেহ ওর ফুলেল তেলের গন্ধ ছড়ায় এখনো। এখনো বুঝি সেই তেল ব্যবহার করে ও। যেন আচমকা ওর কপালটার উপর নজর পড়ল মালুর। উদ্ধত কপালে সেই বিদ্রোহের তিলক বুঝি শিলার লিখন, কোনোদিন বিলুপ্তি নেই তার।
পুরনো ব্যধি। জ্বরটাতো মনে হয় টাইফয়েড। দেখে শুনে বললেন ডাক্তার।
পরিচিত ডাক্তার। মালুর অনুরোধে বিনা হয়রানিতেই ভর্তি করে নিলেন। দাওয়াইর একটি লম্বা তালিকা মালুর হাতে দিয়ে বললেন, এই ওষুধগুলো কিনে দিয়ে যাবেন।
মালুর চোখে প্রশ্ন। লক্ষ করে আবার বললেন ডাক্তার, আপনি তো শুধু ভর্তি করিয়েই খালাস হতে চান না। চিকিৎসা চান। বুঝেছি। হাসল মালু।
মানি ব্যাগটা খুলে কয়েকটা দশ টাকার নোট বের করল ও। টাকা আর ওষুধের তালিকাটা লেকুর হাতে দিয়ে বলল : ওষুধগুলো কিনে এই ডাক্তার সাহেবের হাতে দিয়ে যেও। বাকী টাকা রেখে দিও তোমার কাছে। রোজ কিছু ফল কিনে দেবে হুরমতিকে। গেইটের কাছে রাখা লেকুর রিকশাটা। লেকু ডাকল : আসেন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
ত্রস্তে যেন দুপা পিছিয়ে এল মালু। লেকু ওকে আপনি করে বলছে? আসবার সময় হুরমতি ছিল সাথে, তাই লেকুর রিকশায় চড়ে মনটা ওর খচ খচ করলেও কোনো অপরাধ বোধ করেনি। কিন্তু এখন মনে হল মালুর লেকুর রিকশায় জীবনে কখনো উঠতে পারবে না ও।
নাছোড়বান্দা লেকু। রিকশাটাকে ঘুরিয়ে একেবারে মালুর পায়ের কাছে এনে দাঁড় করায়, বলে : অল্প পথ। আর ওষুধের দোকানে ও পথেই তো যাচ্ছি আমি।
না না তুমি জলদি চলে যাও ওষুধ কিনতে। লেকুকে কোনো কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে গেট ছেড়ে রাস্তার দিকে দ্রুত পা ফেলল মালু। কী এক অপরাধ বোধ যেন পেছন থেকে তাড়া করে চলেছে মালুকে! মালু বুঝতে পারে না কী সেই অপরাধ।
ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বিকেল বেলায় একবার হাসপাতালে এসে হুরমতিকে দেখে যাবার ফুরসুতটা করে উঠতে পারেনি মালু। পরদিন বিকেলে এসে দেখা পেল না হুরমতির।
সবার অলক্ষে দুপুর বেলায় হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেছে হুরমতি। ডিসচার্জ সার্টিফিকেট নেয়নি। ডাক্তার নার্স কাউকে কিছু বলেনি। মালু কী আর কোনো দিন খোঁজ পাবে হুরমতির?
অনেক কাজ জমে আছে অফিসে। অনেক লোক বসে আছে দেখা করবার আশায়। নতুন গায়কদের কণ্ঠ পরীক্ষা, তারাও এসে গেছে। পরীক্ষার্থী আর দর্শনাথীদের বিদায় দিয়ে চেয়ারটায় এসে বসল মালু। সংবিধাননামাগুলোয় সই সেরে ডাকটা দেখল। দ্রুত চোখ বুলিয়ে গেল। চিঠিপত্রের ওপর। এর মাঝে দুটো চিঠি রিহানার। গুণী গো গুণী! কণ্ঠে তোমার এত সুধা, কিন্তু মনের ভেতর এত সীসে ঠেসে রেখেছ কেন গো?…
সারাটা দিন কেমন করে বন্দী থাক ওই হলদে পিঁজরায়? একবারও কী আমার কাছে ছুটে আসতে ইচ্ছে করে না তোমার?
লক্ষ্মীটি, আজ একটু সকাল সকাল এসো। অহো, বিকেলগুলোকে যদি আর একটু লম্বা করা যেতো। যায় না? ইতি।
প্রতি বিকেলটা এখন বাঁধা রিহানার জন্য। কোনো দিন বা দুপুরটাও। তবু যেন তৃপ্তি আসে না রিহানার। না-বলা থাকে অনেক কথা। তাই চিঠি লেখে ও। পাঁচ সাত লাইনের ছোট্ট চিঠি। অজস্র উচ্ছ্বাস অসংযত আবেগ। কখনো বা অভিমান। ছেলে মানুষিই বলে মালু। তবু ভালো লাগে মালুর।
ইচ্ছে হলো মালুর রিসিভারটা তুলে দুটো কথা বলুক রিহানার সাথে। কিন্তু বাড়ান হাতটা ফিরে এল ওর। সারা ঘরটা যেন চেয়ে রয়েছে ওর দিকে। কী কথা বলবে ও, তাই শোনার জন্য যেন উন্মুখ ঘরের আসবাব আর ওই দুটো মানুষ, করিম, ইয়াসীন। আর ও দিকে রিহানার বাড়িতে? সেখানেও তো ধরা পড়ে যাবে মালু।
মালুর মনে হয় গেঁয়ো শরম বোধটা এখনও ছাড়তে পারেনি ও। তাই কোনোদিনই রিহানাকে টেলিফোনে ডাকতে পারেনি ও। রিহানার বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও।
এই অপারগতার কারণটা শুনে হেসে লুটোপুটি খেয়েছিল রিহানা। ঠাট্টা করেছিল : টেলিফোন করতে শরম লাগে, পাছে কেউ দেখে ফেলে, শুনে ফেলে। এ কোন্ ধারা প্রেমিক গো!
স্যা-বলেই জিব কাটল করিম। বলল, হুজুর
আবার? চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকায় মালু।
কিন্তু, করিম বুঝি আজ বেপরোয়া। ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না ও। বলল করিম : স্যার না, হুজুর না, তবে বলব কী? সত্যি তো। কী বলে সম্বোধন করবে করিম? মালু হল উপরওয়ালা। তাই সম্বোধনের শব্দও হতে হবে সম্মানসূচক। এ দিকটা ভেবে দেখেনি মালু।
পাশের টেবিলে ইয়াসীন। মালুর দুরবস্থাটা দেখে বুঝি ঠোঁট টিপে হাসছে ও। তাড়াতাড়ি মুখটা ঘুরিয়ে নিল মালু। করিম মিঞার পা থেকে মাথা অবধি নজরটা বুলিয়ে নিয়ে বলল : কিছু না বললেই হয়। মানে এ-ই, হে-ই এ সব তো? ওই রাস্তার যত ছোটলোকদের মতো! চটে যায় করিম মিঞা। আঠার বছর ধরে নানা অফিসে এই কাজ করে আসছে সে। কিন্তু এমন বেঢপ সাহেব কখনো দেখেনি ও। এমন বেয়াক্কলে কথাও শোনেনি কখনো। বিড় বিড় করে ওর দুর্ভাগ্যটার উপরই সকল দোষ চাপিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যায় করিম মিঞা।
ময়মনসিংহের আবদুল বয়াতি পা ভেঙে শয্যাশায়ী। আসতে পারবে না জানিয়েছে। কাছে এসে জানায় ইয়াসীন।
এ্যাঁ! তা হলে? চেয়ার থেকে বুঝি ছিটকে পড়বে মালু। একটা স্থিরীকৃত প্রোগ্রাম বানচাল হবার অর্থ যে কত ঝামেলা দিকদারী সেটা মালু বা ইয়াসীনের মতো করে আর কে বুঝবে।
চটপটে বুদ্ধিমান ইয়াসীন। একটা উপায় নিজেই বের করে ফেলল ও। গুনাই বিবির দলটা এখনো ঢাকা ছাড়েনি। ওদের আর একটা প্রোগ্রাম দিয়ে দিলে কেমন হয়? শ্রোতারাও পছন্দ করবে।
চমৎকার চমৎকার। খুশিতে ইয়াসীনের পিঠটা চাপড়ে দিল মালু। রিসিপসন রুমেই তো বসে আছে ওদের লোক। ডেকে নিয়ে আসি? বলল ইয়াসীন।
যাও। এখখুনি।
ইয়াসীন বেরিয়ে গেল।
কাগজ-পত্রগুলো ঠেলে রাখল মালু। রিহানার চিঠিটার উপর আর একবার চোখ বুলিয়ে রেখে দিল পকেটে। টেলিফোনটার দিকে চোখ পড়ল। লোভ হল। ঘরটা এখন একেবারেই খালি। রিহানাকে কী ডাকবে একবার?
ক্রিং ক্রিং যেন মালুরই গোপন ইচ্ছায় সাড়া দিয়ে বেজে উঠল টেলিফোন। হাঁ, রিহানারই গলা। হাত ঘড়িটার উপর চোখ বুলিয়ে আনল মালু। প্রত্যাশিত সময়ের কিছু আগেই আজ রিহানার ফোন এল।
হ্যালো…। কী এক উৎকণ্ঠা রিহানার স্বরে।…তুমি কিন্তু এসো না বাসায়। ভীষণ ব্যাপার ঘটে গেছে।…আচ্ছা শোন। অফিসেই তো আছ তুমি থাকো, আমি আসছি।
কী সে ভীষণ ব্যাপার। মালু কী জানতে পারে না।
এত অস্থির হচ্ছ কেন, রিহানা? কী হয়েছে, বল না শুনি?
না। এখন না। আসছি…
হ্যালো।
না। নির্জীব তার। রিহানা ছেড়ে দিয়েছে লাইন।
ধুক ধুক প্রতীক্ষায় মুহূর্তগুলো গড়িয়ে যায়।
গত রাত আর আজকের একটি বেলা। এর মাঝে এমন কী ঘটে গেল! এমন ভীষণ ব্যাপার, যা টেলিফোনে আলাপ করতে পারে না রিহানা? মিনিটের কাঁটাটা গড়িয়ে গড়িয়ে ঘণ্টা পার করে দেয়।
আকাশ পাতাল, সম্ভব অসম্ভব ভেবে চলে মালু। কিন্তু, আসছি বলে এখনো আসছে না কেন রিহানা? এত দেরি হবার কোনো কারণ খুঁজে পায় না মালু।
অবশেষে এল রিহানা
ও কাঁপছে। ও ভয় পেয়েছে। কী এক শঙ্কা টেনে নিয়েছে ওর মুখের রক্ত। পাণ্ডর মুখের রক্তহীন সাদা শুকনো ঠোঁট জোড়া কিছুতেই নড়তে চাইছে না। আর ওর চরিত্রে এবং প্রকাশে যা ছিল গভীরতার স্বাক্ষর সেই মখমল চোখের স্নিগ্ধ দীপ্তিটা কারা যেন ছিনিয়ে নিয়েছে। সেখানে এখন বিহ্বল আতঙ্ক।
বাবা মা বড় ভাইয়া, সবাই জেনে ফেলেছে। কাল রাতে ওরা শাসিয়েছে আমায়। বলেছে : গান শেখা বন্ধ, বাইরে যাওয়া বন্ধ। ঘুস ঘুস পরামর্শ চলেছে ওদের রাত ভর। সকালে ওদের আখেরি সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দিয়েছে–পরশুদিন আমার বিয়ে, আমার সেই খালাত ভাইয়ের সাথে।
যেন দুঃসাধ্য চেষ্টায় কথাগুলো বলল রিহানা। বলে, হাঁপাল কিছুক্ষণ। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ছোট ছোট নিশ্বাস টানল অনেকগুলো। তারপর বলল : আমি পালিয়ে এসেছি।
বুদ্ধিটা যখন সজাগ চিন্তাটাও তখন স্পষ্ট। মনের গতিটা যুক্তির নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু হৃদয়, শুধু মাত্র হৃদয় দিয়েই যখন বুঝতে হয়, ভাবতে হয়, অনুভব করতে হয় তখন যুক্তির বাধ যায় ভেঙে। দুর্বার এক আবেগের প্লাবনে ভেসে যায় মানুষের স্বাভাবিক সতর্কতা, পৃথিবীর ছোট বড় হিসেব।
চলো। একটা আস্তানা তো আছে আমার! একজনার যখন অসুবিধে হয় না, দুজনারও হবে না নিশ্চয়।
একটু হাসল মালু।
সে হাসির ছটা পড়ল রিহানার মুখে। ও বলল–চলো।
৪৯.
ওরা যেন হারিয়ে রইল।
পৃথিবীর কোনো অনন্ত মায়ায় লীন হল ওদের সত্তার ভেদ।
মালুর কাছে এ এক অভাবনীয় পরিপূর্ণতা। হৃদয়ে ওর আশ্চর্য আর নিটোল এক স্থিতি। সার্থকতা আর সাফল্যের আনন্দ উত্তেজনায় উদ্দীপ্ত হয়েছে মালু। কিন্তু পরিপূর্ণতার এই শান্ত স্থিতিটা যেন সব কিছুকেই ছাড়িয়ে যায়।
ওরা ঘুরে বেড়াল।
শ্রীহট্ট, রাঙ্গামাটি চট্টগ্রাম। উত্তর বঙ্গের গেরুয়া মাটির দেশে।
ট্রেনে চড়ল। নৌকায় করে ঘুরল। গরুর গাড়ি, মোষের গাড়িতে চড়ল। আড়াই মাস পর ফিরে এল।
কী এক আচ্ছন্নতায় রিহানা বুঝি ঘুমিয়ে থাকে সারাক্ষণ। সুখের ভারে ঘুম ঘুম আবেশে নিজেকে মেলে দেয়, রেণু রেণু ঝরিয়ে দেয় আপনাকে। দুকোষ ভরে সে আনন্দ রেণু তুলে নেয় মালু। মিশিয়ে দেয় আপনার অস্থি পাঁজরে।
চলো না ঘুরে আসি। মালুর বুকের কাছটিতে এতটুকু হয়ে বলে রিহানা। কোথায় যাবে? তার চেয়ে কী এই ভালো না? এমনি নিঃশব্দে মুখোমুখি বসে থাকা?
তাহলে চলো সিনেমায়।
এত আনন্দ আর এত আলো ছড়ান এই ঘরে। সেটা ফেলে বদ্ধ ঘরে চোখ খারাপ করতে যাবে? চোখের কোলে কৌতুক খেলিয়ে বলল মালু। তারপর রিহানার ঠোঁটে চিবুকে এঁকে দিল দুরন্ত দুষ্টমি। যাও–নিজেকে আলগা করে শিথিল খোঁপাটা পাট করে রাখে রিহানা। এসো, গান শোন। ওর কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে গান শুনল রিহানা। গান শেষ হলেও ওর কোলে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ নিথর হয়ে পড়ে রইল। উঠে বসল, বলল : বাবা মার সাথে দেখা করে আসি। যাবে? একটু যেন চমকে উঠল মালু। শুধাল : ওঁরা কী আমাদের গ্রহণ করবেন? তাঁরা কী চান আমরা যাই?
মা তাঁর মতো পাল্টিয়েছেন। বিয়ে যখন করেই ফেলেছি আমরা, তিনি আমাদের মেনে নেবেন। তার ধারণা, আমরা যদি বাবার সুমুখে গিয়ে উপস্থিত হই, বাবাও মেনে নেবেন।
কী করে জানলে?
আমার এক বান্ধবীর মারফত খবর পাঠিয়েছেন মা।
জানালার বাইরে ল্যাম্পপোস্টটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মালু। কী যেন ভাবে।…
চুপ করে গেলে যে? শুধাল রিহানা।
তোমার ভাইরাও-তো একবার আসতে পারত।
হয়ত বাধছে ওদের মর্যাদায়।
মর্যাদা কী আমার নেই? বুঝি অসাবধানেই কড়া ঝাঁঝ ফুটল মালুর কথায়।
তা হলে যাচ্ছ না?
না।
চুপ করে যায় ওরা। নিকটের কোনো বাসা থেকে ভেসে আসছে ক্রুদ্ধ এক শিশুর কান্না। এক মনে সে কান্নাটাই যেন শুনে চলেছে ওরা।
এ ভাবে দিন রাত বাসায় বসে বসে আমার ভালো লাগছে না বাপু। না আছে দুটো গল্প করার লোক, না আছে একটা পরিবেশ। অনেকক্ষণ পর বলল রিহানা।
ধুপ করে কী যেন পতনের শব্দ পেল মালু ওর হৃৎপিণ্ডের অতলে। সামলে নিল মুহূর্তেই। সহজ হেসে বলল : বা রে আমি রয়েছি সারাক্ষণ তোমার পাশে পাশে। ঘরময় আমাদের গান আর সুরের মেলা। তবু তোমার পরিবেশ লাগবে?
লাগবে না? শুধু গান নিয়েই কী বাঁচতে পারে মানুষ?
পারে না? এবারও বুঝি চমক খেল মালু। বলল : আমি তো জানতাম গানের মাঝেই তোমার অস্তিত্ব, সুরের ধারায় তোমার প্রাণ।
ভালো জিনিসটিও কী সব সময় ভালো লাগে?
তিন মাসেই কী সব বাসি হয়ে গেল?
নিরুত্তর রিহানা সুমুখের দেয়ালটার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে। সেখানে একটা টিকটিকি। স্থির স্ফটিক চোখ টিকটিকির। সে চোখ দিয়ে রিহানাকেই যেন দেখছে টিকটিকিটি।
হয়ত একঘেয়েমির ক্লান্তি এসেছে রিহানার। বাপ মা ভাইবোন আত্মীয় পরিজনদের ছেড়ে কখনো দূরে থাকেনি। তাই এই ছোট্ট-পরিসরের সংকুচিত জীবনে একটু বাইরের হাওয়া চায় ও। ভাবল মালু, বলল : চল, রাবু আপার বাসা থেকে বেড়িয়ে আসি। সেই কবে গেছিলাম। এর মাঝে রাবু আপা বুঝি তিন চার বার দেখে গেছে আমাদের।
টিকটিকিটা দৌড়ে পালিয়ে গেল চৌকাঠের আড়ালে। সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছে রিহানা। হঠাৎ মুখটা নাবিয়ে মালুর চোখে চোখে তাকাল ও। বলল, উনি তোমার কেমন আপা?
কী জানতে চাইছে রিহানা? রাবুর পরিচয় পেতে গেলে মালুর গোটা জীবনটাই যে শুনতে হবে ওকে।
আর একদিন শুনে নিও, সংক্ষেপে বলল মালু।
এ কথার পর রাবুর বাসায় বেড়াতে যাবার প্রসঙ্গটা যেন আপনা আপনিই চাপা পড়ে গেল।
ওরা চুপ করে গেল।
জানালার কপাট কাঁপিয়ে এক দমকা বাতাস এল। গলির আবর্জনার গন্ধে ভরে গেল ঘরটা। নাকে আঁচল চাপল রিহানা, বলল : ইস, কী দুর্গন্ধ। এখানে মানুষ থাকে? তুমি যে বাসা খুঁজছিলে কী হল তার?
খুঁজছি।
খুঁজছি নয়, জলদি কর। এই ঘিঞ্জি ঘর আর এই নোংরা পাড়ায় দম বন্ধ হয়ে মরব আমি। অনুযোগের স্বর রিহানার।
খোঁজ খবর তো কয়েক জায়গায়ই লাগিয়েছি। কিন্তু, জান তো টাকা থাকলে ঢাকার বাজারে হিমালয় পর্বতটাও কিনতে পাওয়া যায়। যা পাওয়া দুঃসাধ্য সে হল বাড়ি। আত্মপক্ষে কেমন একটা কৈফিয়তের মতো শুনাল মালুর স্বরটা।
খট খট, দুটো শব্দ হল দরজায়।
কে? নিচে এসে দরজাটা খুলে দিল মালু। রিহানাও পিছে পিছে নিচে এসে উঁকি দেয়।
ওমা। আহসান ভাই। এসো এসো। কী আমার সৌভাগ্য। উচ্ছ্বসিত হয় রিহানা। ফিরতি সিঁড়িগুলো ডিঙিয়ে যায় তরতর করে।
আমার খালাত ভাই, আহসান। চাটগাঁয়ে খুব বড় ব্যবসা। ঢাকায়ও। পরিচয় করিয়ে দেয় রিহানা।
হয়ত নিষ্প্রয়োজন পরিচয়টা। পুরনো পরিচিতের মতোই হাত মিলায় মালু। অভ্যর্থনা জানায়–বসুন।
জান, এই আহসান ভাই-ই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু। এর কথাই তোমাকে বলছিলাম। সেই তো তোমার সব খবর জোগাড় করে আনতে। তিন মাস বিচ্ছিন্নতার পর আত্মীয় মানুষের সঙ্গ পেয়ে বুঝি উপচে পড়ছে রিহানা। তোমরা গল্প কর। আমি আসছি এখুনি। মালুর দিকে অপাঙ্গে একটা ইশারা ছেড়ে পাশের ছোট্ট ঘরটিতে অদৃশ্য হয়ে যায় রিহানা।
ফ্যামিলির তরফ থেকে নিজের তরফ থেকে তো বটেই, কগ্রাচুলেশান জানাচ্ছি আপনাকে। বিলম্বের জন্য লজ্জিত। আটকা পড়ে গেছিলাম খুলনায়। পাকা আঙ্গুরের মতো টসটসে মুখে সপ্রতিভ হাসি ফোঁটায় আহসান।
ভ্রূ উঁচিয়ে তাকায় মালু।
পরিবেশ ভেদে কত তফাত মানুষের। রেডিও অফিসের সেই কাচুমাচু অপ্রস্তুত মুখ আগম্ভকটিকে আজকের আহসানের মাঝে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এমনিই বুঝি হয়। টাকা আনা পাই, যোগ আর গুণের বিরাট অঙ্কের স্থূল হিসেবের জগতে যারা সার্থক সপ্রতিভ সেই মানুষগুলোই সূক্ষ্ম কোনো কারুময় পরিবেশে কেমন বুদ্ধিহারা। সইতে পারে না সেই পরিবেশের ধারাটা। হয়ত তাই সহজ হতে গিয়ে সেদিন হাস্যাস্পদ হয়েছিল আহসান। আর কারুময়ী এক কন্যার প্রেম পেতে গিয়ে নিজেকে করে তুলেছিল তার আজ্ঞাবহ দাস। কিন্তু নিজের পরিবেশে আর দশটি মানুষের মতোই সহজ স্বাভাবিক আহসান।
দেখুন, জীবন সম্পর্কে আমি খুব ইয়ে, মানে ইংরেজরা যাকে বলে স্পোর্টস্ ম্যান-লাইফ। দৌড়ে আপনারই জিত হয়েছে। হঠাৎ গোলাকার মুখটা মালুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল আহসান। একটুক্ষণ থেমে আবার বলল, আমার হারটাকে, বলতে পারি, সাহসের সাথেই গ্রহণ করেছি আমি। আর পরাজিতের প্রতি আপনিও নিশ্চয় একটা উদার মনোভাব নেবেন, যেমন আলেকজান্ডার নিয়েছিল পুরুর প্রতি। কী বলেন? করমর্দনের ভঙ্গিতে মালুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল আহসান। অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রসারিত হল মালুর হাত।
আচমকা কেন যেন কেঁপে গেল মালু। কী এক সন্দেহ অথবা ঈর্ষা বিদ্যুতের মতো দৌড়ে গেল ওর মনের উপর দিয়ে। আহসান কী এখনো আশা রাখে?
চা আর নাশতা নিয়ে এল রিহানা।
নিন। ভদ্রতার খাতিরেই অতিথিকে পরিবেশন করল মালু। কেন যেন আলেকজান্ডার আর পুরুর সেই উদ্ভট উপমাটা এখনো ঘূর্ণির মতো ঘুরে চলেছে ওর মাথায়।
আহসান ভাই, একটা ভালো বাসা খুঁজে দাও না আমাদের! নখের চিমটেয় একটা কেকের কণা ভাংতে ভাংতে বলল রিহানা।
ভা-লো-বা-সা? কেমন করে যেন উচ্চারণ করল আহসান। তারপর গোলক মুখখানা ফুটবলের মতো ফুলিয়ে পুরো গাল হাসল ও। বলল তার আর অভাব কী? আমার বাড়িটা তো খালিই পড়ে থাকে। এসে থাক না তোমরা!
মালুর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝি সম্মতি খুঁজল রিহানা। মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নিল মালু।
বেশ তোমার একতলাটা ছেড়ে দাও আমাদের। কত ভাড়া নেবে বল! কেন যেন গলার স্বরে অতিরিক্ত স্পষ্টতা আর জোর জুড়ে দিল রিহানা।
নিষেধের ইশারা দিল মালু। কেশে হাত নেড়ে ওর দৃষ্টিটা আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। কিন্তু রিহানা উত্তরের প্রতীক্ষায় তাকিয়ে রয়েছে আহসানের মুখের দিকে।
আহসান বলছে : জানি তোমাদের মর্যাদায় বাধবে, ভাড়া একটা গছাবেই আমাকে। তা, যা খুশি একটা দিও। তারপর মালুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল : তাহলে উঠে আসছেন কবে? আগামী হপ্তায় আমাকে আবার ছুটতে হবে করাচী।
কী বলবে মালু? রিহানাই উত্তরটা দিক। বলুক, না ধন্যবাদ। কাতর মিনতির দৃষ্টিটা রিহানার মুখের উপর ধরে রাখল মালু।
না। রিহানা এক মনে চায়ের পেয়ালার ধুঁয়ো দেখে চলেছে। তারপর কিছু একটা বলার জন্য ও যেন মুখটা তুলল। কিন্তু, ততক্ষণে আহসানের দেয়াল কাঁপানো হাসিটা ছিটকে পড়েছে ওদের মাঝে।
আপনি কী বলছিলেন? ল্যাংবোট? হা হা হা। আর আমি কী ছিলাম, জানেন? এন এভার অবলাইিজং স্লেভ মানে বশংবদ গোলাম। হা হা হা। হাসির চোটে ওর টসটসে মুখের লালচে আভাটা যেন ঝিলিক খেলে গেল। মানুষের হাসি কেমন করে এত বিশ্রী, এত কদর্য হতে পারে?
গা-টা বুঝি ঘিন ঘিন করে ওঠে মালুর। এখুনি মানুষের এই ইতর সংস্করণটিকে আস্তে করে তুলে জানালা গলিয়ে ফেলে দিতে পারলেই যেন স্বস্তি পেত মালু।
যাই বলুন, মেয়ে জাতটার বাহাদুরি আছে। ওরা বাঘকে ভেড়া বানায়, মানুষকে পশু বানায়, অমানুষকে আবার মানুষও বানায়। ওরা সবই পারে। ওদের অসাধ্য কিছুই নেই..বলে চলেছে আহসান।
রিহানাকেই দেখছে মালু। দেখছে ব্যথাভরা চোখের অনুযোগ মেলে, আহত বিস্ময়ে। কিন্তু সে দৃষ্টি স্পর্শ করে না রিহানাকে। আপনি গুণী, আপনি সাধক। আপনার কাছে হার মেনেছি বলে আমার কোনো লজ্জা নেই, এ কথা কিন্তু হলফ করেই বলতে পারি মিস্টার মালেক। হাসতে হাসতেই বলে চলেছে আহসান।
আচ্ছা আসি। হঠাৎ হাসি এবং কথা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল আহসান। চায়ের জন্য ধন্যবাদ ছিল। রিহানার দিকে তাকিয়ে বলল : ধুয়ে মুছে ঘরগুলো রেডি করে রাখব। যখন খুশি চলে এসো তোমরা।
ভালোই হল ব্যবস্থাটা। পাড়াটাও ভালো। বাড়িটা চমৎকার। ভাড়াটাও নিশ্চয় আনরীজন্যাবল কিছু হবে না। আহসানকে বিদায় দিয়ে অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলল রিহানা।
শক্ত উত্তরে ফেটে পড়ার মুখেই সামলে নিল মালু। শুধু সেই অমানুষিক চেষ্টার ক্ষীণ একটি রেশ জেগে রইল ওর ঠোঁটের কুঞ্চনে।
কেমন নির্দোষ চোখ তুলে তাকায় রিহানা। সে চোখে চাঁদের হাসি মোমের আলো।
আর সে চোখের নিচে গলে গেল মালুর দৃষ্টির ঘৃণা, মনের প্রাচীর। ওর মনের বাধা ডিঙিয়ে রিহানার ইচ্ছাটাই পথ করে নিল।
৫০.
নতুন বাসায় এসে খুশির ঝর্নায় উপচে পড়ে রিহানা, মনের মতন করে সাজায় ঘরগুলো-বসবার ঘর, শোবার ঘর, খাবার ঘর। সব ঘরেই ওর নিপুণ হাতের বিন্যাস। কার্পেটের রংয়ে, আসবাবে, সাজে, কুশানের আস্তরে, দেয়ালের ছবিতে ওর মার্জিত রুচির ছোঁয়া।
মনের মতন ঘর পেয়ে, সে ঘরকে মনের মতন সাজিয়ে সত্যি খুশি রিহানা। রিহানার এই খুশিকে উপেক্ষা করতে পারে না মালু। রিহানার খুশির ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যায় মালুর মনের দ্বিধা।
সুন্দর করে সাজে রিহানা। সকালে এবং বিকেলে। গোসল করে নতুন বেশে রিহানা যখন এসে বসে সাজানো ড্রয়িং রুমে তখন ওকে আরও সুন্দর, আরও আকর্ষণীয় মনে হয় মালুর। প্রলুব্ধের মতো চেয়ে থাকে মালু। মালুকে স্বীকার করতে হয়, এই ঝকঝকে ঘরের ঔজ্জ্বল্যেই মানায় রিহানাকে। এখানে রিহানা বরবৰ্ণিনী নিরুপমা। ইসলামপুরের সেই পচা গলির নোংরা ঘরে কিছুতেই মানায়নি, মানাতো না ওকে। সেখানে ম্রিয়মাণ ছিল ওর রূপ, এমনকি ওর তন্বী দেহের আকর্ষণটাও।
কোমরে হাত দিয়ে ঘরের দেয়ালগুলো নিরীক্ষণ করে রিহানা, বলে, অল্প আলো একটুও ভালো লাগে না আমার। আলো হবে ঝলমল উজ্জ্বল।
মালুকে তাই ছুটতে হয় মিস্ত্রীর সন্ধানে। মিস্ত্রী এসে নতুন পয়েন্ট লাগিয়ে যায়, চারদেয়ালে চারটে, মাঝখানে ঝাড়।
অসম্ভব। পঁয়তাল্লিশ পাওয়ার বালব চলবে না। ওতে নিজের হাতটাই চোখে পড়বে না তোমার। রিহানা ভ্রূ কুঁচকায়।
মালুকে আবার ছুটতে হয় দোকানে। ফরমাশ মাফিক পাল্টিয়ে আনতে হয় বাবগুলো। কোটা পঁচাত্তর পাওয়ার। কোটা একশো পাওয়ার। আর যখন সব কটি আলো জ্বালিয়ে দিয়ে মধুর হাসির তৃপ্তি ছড়ায় রিহানা-মালু তখন বোবা। মালুকে তখন মেনে নিতে হয় রিহানাই ঠিক। নিম আলোটা অন্ধকারের চেয়েও কুশ্রী। আলোকে হতে হবে ঝলমল উজ্জ্বল। সেই ঝলমল উজ্জ্বল আলোর রাজ্যে বুঝি রূপের রানী রিহানা।
মুগ্ধ মালু।
ব্যবসার কাজে করাচী ঘুরে ফিরে এসেছে আহসান। বেরোবার পথে, ফেরবার পথে রিহানার ঘরে একবার উঁকি দিয়ে যায়। প্রশংসা করে রিহানার রুচির, ওর সাজানো ঘরের মনোরম স্নিগ্ধতার। নতুন পাড়ায় এসে কেন যেন শখ চেপেছে মালুর, রিহানাকে নিয়ে বেড়াবে, এখানে সেখানে, কাছে দূরে, নির্দিষ্ট কোথাও নয়।
রিহানার শখ, ওর ভাষায়, শপিংয়ের অর্থাৎ বাজার করবার। ও যায়, মালুকে নিয়েই যায়, বাজার করতে। কখনও দুপুরে যখন ভিড় থাকে না পথে অথবা দোকানে। কখনও বা সন্ধ্যায়। কখনও রিকশায় চড়ে, কখনও বা আহসানের ভক্স ওয়াগনে।
চল না সিনেমায় যাই। সোহাগী স্বরে আমন্ত্রণ জানায় মালু।
সিনেমায় আপত্তি নেই রিহানার, মালুর সাথে সিনেমায় যায়। কিন্তু দশ মিনিটের বেশি সিনেমা কখনও দেখে না রিহানা। সেলুলয়েডের গায়ে প্রতিবিম্বিত চিত্রগুলো অন্ধকার সিনেমা হলের পর্দায় জেগে উঠতে না উঠতেই ঘুম পায় রিহানার। ও ঘুমিয়ে পড়ে। সন্ধ্যার শো বলে নয় ম্যাটিনী শোতেও দেখেছে মালু, দশ মিনিটের মধেই ঘুমিয়ে পড়েছে রিহানা। অগত্যা বাড়ি ফিরে আসতে হয় মালুকে। বাড়ি এসেই সজাগ রিহানা। কিছুক্ষণের অনুপস্থিতিতে কোথাও ধূলো পড়েছে এক কণা, অথবা কোনো একটা টেবিলক্লথ এলোমেলো হয়েছে বাতাসে, তাই নিয়ে কোমর বেঁধে লেগে যায় রিহানা।
নিঃশব্দ জিজ্ঞাসার চিহ্ন হয়ে চেয়ে থাকে মালু। রিহানার হয়ত চোখে পড়ে। রিহানা বলে, আসলে, সিনেমা আমার একটুও ভালো লাগে না।
কী ভালো লাগে? মালুর স্বরে ক্ষুব্ধ বিরক্তিটা চাপা থাকে না।
মখমল চোখের তারায় অনুরাগ ফুটিয়ে অপরূপ হল রিহানা। মালুর প্রশ্নটাই ফিরিয়ে দিল মালুকে–কী ভালো লাগে? ভালো লাগে এই ঘর আর তোমাকে। বুঝলে? তারপর দুহাতে মালুর গলা জড়িয়ে ওর কাঁধে মুখ রাখল রিহানা। নিথর হল। কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ল।
মনের ক্ষুব্ধ বিরক্তিটা কখন ভেসে গেছে রিহানার সোহাগের ধারায় জানতে পারে না মালু।
এও এক পরামার্শ্চ অথবা ধাঁধা মালুর কাছে। সেই মধুমাসের কথা। রিহানাই তখন বায়না ধরত সিনেমায় যাওয়ার।
ঘর সাজানো শেষ হয় না রিহানার। নিত্য নতুন খুঁত বের হয়। আর সে খুঁত ঢাকতে প্রয়োজন পড়ে নতুন আসবাবের, নতুন সাজের।
জমান টাকাগুলো যে দুহাতে উড়িয়ে দিচ্ছ। ভবিষ্যতের কথাটা একবার ভাবছ কী? ভীরু, ভীরু একটা প্রতিবাদ জানায় মালু।
রাখতো তোমার কিপ্টেমি। ওকে থামিয়ে দেয় রিহানা। তারপর অনুপম সেই চোখের হাসিতে ধুইয়ে দেয় ব্যথা পাওয়া মালুর মুখের অন্ধকার।
তিন মাসের ছুটিটা ফুরিয়ে গেল মালুর।
সেই ঘুম ঘুম আবেশে রেণু রেণু ঝরে পড়া রিহানা, মায়া মুগ্ধতার কোল ছেড়ে বুঝি জেগে উঠল।
জেগে উঠল ওরা দুজনই।
আচম্বিতে।
প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে।
হঠাৎ বিস্ফোরণে।