৪৬-৫০. নতুন ভারত

৪৬.

ঝুমার সঙ্গে নতুন ভারত-এর সামনে দেখা হয়ে যাবে, কল্পনাও করেনি বিনয়। এই দু-তিনটি দিন ঝিনুক তাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তার জন্য ছোটাছুটি চলছে বিরতিহীন। এর মধ্যে ঝুমার কথা পলকের জন্যও মাথায় আসেনি। অনন্ত বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে সে। টের পায় বুকের ভেতর দমাদ্দম আওয়াজটা আরও প্রবল হয়ে উঠেছে।

ঝুমা সামনে এসে দাঁড়ায়। তার কাধ থেকে চমৎকার একখানা চামড়ার ব্যাগ ঝুলছে। বই খাতায় ঠাসা। চকিতে বিনয়ের মনে হয়, হয়তো কলেজ থেকে বাড়ি না ফিরে এদিকে কোথাও এসেছিল, আচমকা তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু অচিরেই ভুলটা ভাঙল।

ঝুমা লঘু সুরে বলল, তুমি তো ভীষণ ফাঁকিবাজ

বিনয় হকচকিয়ে যায়। মানে?

 দুটো থেকে তোমার ডিউটি। পৌনে তিনটে বাজে। এখন তোমার অফিসে আসার সময় হল? অল্প অল্প মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ কুঁচকে ঝুমা বলে, তোমার চাকরিটা থাকলে হয়।

বিনয় চমকে ওঠে, কখন আমার ডিউটি শুরু, তোমাকে কে বললে? পরক্ষণে তার মস্তিষ্কে কিছু একটা ঝিলিক দিয়ে যায়, তুমি কি অফিসে গিয়ে আমার খোঁজ করেছিলে?

না হলে জানলাম কী করে?

বিনয়ের যেটুকু বা সংশয় ছিল, নিমেষে উধাও। ঝুমা তার সন্ধানেই এখানে হানা দিয়েছে। আনন্দ তার মামা। মামার কাছ থেকে কৌশলে নতুন ভারত-এর ঠিকানা জেনে নেওয়া তার পক্ষে এমন কি আর শক্ত কাজ? ঝুমা চিরকালই দুঃসাহসী। কতটা বেপরোয়া হলে একটা মেয়ের পক্ষে এভাবে এখানে চলে আসা সম্ভব, যত ভাবছিল ততই বিমূঢ় হয়ে যাচ্ছিল বিনয়। ঝুমাকে দেখতে দেখতে অন্য একটা ভাবনা কোত্থেকে উড়ে এসে তার মাথায় ঢুকে পড়ে। এই তো মাত্র কদিন হল, বিনয় এখানে কাজে লেগেছে। এর মধ্যেই কিনা পরীর মতো এক তরুণী তার সঙ্গে দেখা করতে অফিস অবধি ধাওয়া করেছে! অস্বস্তি, চরম অস্বস্তি। বিনয়ের সামনে একটি ছবি যেন ফুটে উঠতে থাকে। ঝুমার সঙ্গে কথা শেষ করে সে যখন নিউজ ডিপার্টমেন্টে গিয়ে ঢুকবে, চারপাশ থেকে জোড়া জোড়া চোখ তার দিকে ধেয়ে আসবে। কেউ যদি জানতে চায় ঝুমা কে, বিনয়ের সঙ্গে কীভাবে আলাপ হল, কী সম্পর্ক তাদের দুজনের, তখন কী বলবে সে? সবাইকে খুশি করার মতো একটা জুতসই উত্তর যখন বিনয় হাতড়ে বেড়াচ্ছে, সেইসময় ঝুমা বলে ওঠে, তোমাদের চিফ রিপোর্টার আমাকে ওয়েট করতে বলেছিলেন, কিন্তু চারদিকে পুরুষের ভিড়। একটা মেয়ের পক্ষে সেখানে বসে থাকা যায় না।

বিনয় জবাব দিল না।

ঝুমা থামেনি, তাই তোমাদের অফিস থেকে বেরিয়ে সেই দুটো থেকে একবার হাঁটতে হাঁটতে চলে যাচ্ছি মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের মুখে। ওখান থেকে ফিরে বিবেকানন্দ রোডের ক্রসিং। নজর রাখছিলাম কখন তুমি আসো। কোনও বাড়ির রোয়াকে যে বসব বা বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকব, তার কি উপায় আছে? কোনও মেয়েকে একা খানিকক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে দেখলে লোকে হেঁকে ধরে। কী যে হ্যাংলামি! তাই মুক্তারাম টু বিবেকানন্দ, বিবেকানন্দ টু মুক্তারাম–এই করতে হয়েছে মিনিমাম পঁচিশ বার। একটু থেমে তরল গলায় বলল, পঁয়তাল্লিশ মিনিটে যত হেঁটেছি, সবটা জোড়া লাগালে মিনিমাম চার মাইল লম্বা হয়ে যাবে।

বিনয় এতক্ষণে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে হুঁশে ফিরেছে। তারা যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, সেখান থেকে নতুন ভারত-এর অফিসটা বড় জোর পঁচিশ তিরিশ ফিট দূরত্বে। রাস্তায় ওপর মূল দরজাটা হাট করে খোলা। যে উর্দি পরা দারোয়ানটা হামেহাল ওখানে খাড়া থাকে, আপাতত সে নেই। হয়তো কোনও দরকারে কোথাও গেছে। যে-কোনও মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে। তবে অফিসে লোকজনের আনাগোনার বিরাম নেই। সাংবাদিক, প্রেস থেকে শুরু করে নানা সেকশনের এমপ্লয়ি, বাইরের ভিজিটর-কেউ ভেতরে যাচ্ছে, কেউ বেরিয়ে আসছে। ওরা তাকে আর ঝুমাকে দেখে ফেলতে পারে। প্রকাশ্য দিবালোকে, হাজার চোখের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনও তরুণীর সঙ্গে গল্প করাটা এখনও রপ্ত করে উঠতে পারেনি বিনয়। এখনও রাজদিয়ার সেই গেঁয়ো যুবকটিই থেকে গেছে-ভীরু, লাজুক, জড়সড়। ভীষণ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল সে। এধারে ওধারে তাকিয়ে বলল, চল, ওদিকটায় যাই

  বিনয়ের মনোভাব আঁচ করে নেয় ঝুমা। সেও বুঝল অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটা স্বস্তিকর নয়, দৃষ্টিকটুও। বলল, হ্যাঁ, চল–

বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে এসে ভয়ে ভয়ে বিনয় জিজ্ঞেস করে, আমার কাছে এসেছিলে কেন? আসার কারণটা কি আর আন্দাজ করতে পারেনি? তবু প্রশ্নটা করল।

তোমার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা আছে। পূর্ণ দৃষ্টিতে বিনয়ের দিকে তাকিয়ে খুব ধীরে ধীরে বলল ঝুমা। কণ্ঠস্বরে খানিক আগের সেই তরলতা নেই। সুরটা গম্ভীর, একটু থমথমে।

যে-ঝুমা চঞ্চল, চুলবুলে, সারাক্ষণ হইচই বাধিয়ে চারদিক মাতিয়ে রাখে সে যেন অন্য কেউ। রীতিমতো অবাক হল বিনয়। ঝুমার চোখে চোখ রেখে বলল, যা বলতে চাও বল

রাস্তায় দাঁড়িয়ে অত কথা বলা যাবে না। তুমি অলরেডি লেট করেছ। অফিসে গিয়ে কি ঘণ্টা দুয়েকের ছুটি নিয়ে আসতে পার?

অফিসের কাজে সকালে বেরিয়েছিলাম। এই ফিরছি। পরে সেখানে গেলেও চলবে। কিন্তু

 কিন্তু কী?

 দুঘণ্টার কথা বললে কেন?

ঝুমা জানায়, লোকচক্ষুর আড়ালে নিরিবিলিতে কোথাও বিনয়কে নিয়ে বসতে চায়। বলে, এস আমার সঙ্গে।

বিনয় বলে, কোথায় যেতে চাও?

এসই না–

যখনই ঝুমা তার কাছে আসে, বিনয় টের পায়, এই মেয়েটার মধ্যে অপার্থিব কোনও শক্তি রয়েছে। প্রবল নিয়তির মত। কী যে তার আকর্ষণ! সে কিছু বললে মুখের ওপর না বলতে পারে না। অথচ বিনয় জানে, তার আর ঝুমার মাঝখানে উঁচু দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝিনুক। টের পেল, ঝিনুককে ভেদ করে তাকে শেকড়সুদ্ধ উপড়ে টেনে নিয়ে চলেছে ঝুমা। এই দূরন্ত টানকে প্রতিরোধ করার কৌশল বা সামর্থ্য কোনওটাই তার নেই। ঝুমা তার শরীর আর মনের সবটুকু জোর শুষে নিয়ে তাকে পুতুল বানিয়ে ফেলেছে। নড়বড়ে, তলতলে, ইচ্ছাশক্তিহীন এমন এক পুত্তলিকা যার রাশ ঝুমার হাতে। মেয়েটাকে দেখলে কী যে হয়ে যায় তার! যে ঝিনুকের জন্য সকাল থেকে ছুটে বেড়াচ্ছে, তার মুখটা যেন ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে থাকে। এমনকি শিয়ালদা স্টেশনের উদ্বাস্তুদের যে মিছিলগুলো তাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছে সে-সবের কথাও মনে পড়ছে না। নিজের গালে ঠাস ঠাস চড় কষাতে ইচ্ছা হয় বিনয়ের। কী যে দুর্বল সে! কতটা যে অসহায়!

দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। ঝুমার শাড়ি থেকে, চুল থেকে, সেন্টের সেই চেনা সুগন্ধ উঠে এসে নাকের ভেতর দিয়ে শিরায় স্নায়ুতে ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। কেমন যেন নেশার ঘোর লাগে।

কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটের ক্রসিংয়ে এসে ঝুমা বিনয়কে নিয়ে একটা বাসে উঠে পড়ে। ঠনঠনে কালীবাড়ি পেরুবার পর কেশব সেন স্ট্রিটের মুখে এসে ঘটাং ঘটাং আওয়াজ করে বাসটা থেমে যায়। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে হ্যারিসন রোডের দিকটা দেখতে দেখতে ঝুমা বলল, এই রে, প্রচুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ভীষণ জ্যাম।

বিনয় জানতে চায়, কী ব্যাপার বল তো

এখানে বসে কী করে বলব? ঝুমা বলতে লাগল, জ্যাম কখন কাটবে, কে জানে। আমরা প্রায় এসেই গেছি। চল, নেমে পড়া যাক

বাস থেকে নেমে বাঁ পাশের ফুটপাথ ধরে খানিকটা যৈতে না যেতেই স্লোগান ভেসে এল।

এ আজাদি ঝুটা হ্যায়
 ভুলো মাত, ভুলো মাত।
ইনকিলাব
জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।
উদ্বাস্তুদের পশ্চিমবঙ্গে পুনর্বাসন
দিতে হবে, দিতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের বাস্তুজমি–
দিতে হবে, দিতে হবে।
 উদ্বাস্তুদের অন্য রাজ্যে নেওয়া
চলবে না, চলবে না  

স্লোগানগুলো তার চেনা। খানিক আগেই শিয়ালদায় শুনে এসেছে বিনয়। সচকিত হয়ে নিজের অজান্তেই বুঝি বা, লম্বা লম্বা পা ফেলে এগুতে থাকে সে।

আরে কী হল, অমন ছুটছ কেন? বলতে বলতে ঝুমাকেও গতি বাড়াতে হয়।

হ্যারিসন রোডের মুখে আসতেই চোখে পড়ল, ছোট বড় বেশ কটা মিছিল আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিক থেকে এগিয়ে আসছে। সেই একই স্লোগান, একই রকম প্ল্যাকার্ড, একই রকম ফেস্টুন, উদ্বাস্তুদের সেই শীর্ণ, ক্ষয়াটে, দড়ি পাকনা চেহারা। সঙ্গী পার্টির কর্মীরা।

স্লোগানগুলো সরকার বিরোধী। পলিটিল পার্টির ওয়ার্কারদের বিনয় সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লিতে বা খানিক আগে শিয়ালদা সেশনে দেখেছে, এখন তাদেরই মতো অন্য কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে মিছিলগুলোতে। অর্থাৎ দলটা দ্বাস্তু পুনর্বাসনের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। ভবিষ্যতে এই আন্দোলন কী আকার নেবে, কে জানে।

বিনয় ভাবতে চেষ্টা করল, ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্ট কি পূর্ব পাকিস্তান থেকে উৎখাত হয়ে আসা মানুষদের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। কিছুক্ষণ স্মৃতির ভেতর হাতড়ানো চলল। কিন্তু না, এমন খবর তার কাছে নেই।

রাজদিয়া থেকে কলকাতায় চলে আসার পর বিনয় কি নিশ্চিন্ত একটা দিনও কাটাতে পেরেছে? ঝিনুককে নিয়ে অবিরাম নানা সংকটের মধ্যে চলতে হচ্ছে। ঝিনুক নিরুদ্দেশ হবার পর তাকে নিয়ে সর্বক্ষণ উৎকণ্ঠা, সর্বক্ষণ মানসিক চাপ, অবিরল দৌড়ঝাঁপ। এরই মধ্যে আনন্দর সুপারিশে দুম করে নতুন ভারত-এ তার চাকরি। তাকে দেওয়া হয়েছে উদ্বাস্তুদের ওপর অ্যাসাইনমেন্ট যা কিনা সবচেয়ে দুরূহ, সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে জটিল। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারটা রাজনৈতিক টানাপোড়েন। ইন্ডিয়া আর পাকিস্তান–দুই দেশের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা, তুমুল শত্রুতা, বিদ্বেষ, এমন কত কী।

শিয়ালদা স্টেশন, কয়েকটি জবরদখল কলোনি, আর ত্রাণশিবির-এর বাইরে আর কোথাও যাওয়া হয়নি বিনয়ের। এগুলো ছাড়াও রয়েছে অগুনতি রিলিফ ক্যাম্প আর কলোনি। এমনও হতে পারে, সে যে-সব জায়গায় যায়নি তেমন কোথাও কোথাও সরকারি ফরমান জারি করা হয়েছে–পশ্চিমবঙ্গে থাকা চলবে না। ছেলেমেয়েদের হাত ধরে আরও একবার উদ্বাস্তু হয়ে চলে যেতে হবে বাইরে, বহুদূরে কোনও অচেনা ভূখণ্ডে। ক্যাম্পে কলোনিতে ঘুরে ঘুরে সঠিক খবরটা নিতে হবে বিনয়কে। সরকারি দপ্তরে গিয়ে জানতে হবে সুষ্ঠু পুনর্বাসনের জন্য কী ভাবা হয়েছে। সরকার বিরোধী আন্দোলনে যারা নেমেছে তাদের কাছেও যাওয়া দরকার। বুঝতে হবে উদ্বাস্তুদের নিয়ে ওদের অভিপ্রায়টা কী। এ-সব সম্পর্কে আধাশেঁচড়া, অস্পষ্ট ধারণা থাকলে উদ্বাস্তু সমস্যা ঠিকমতো তুলে ধরা যাবে না। সাংবাদিক হিসেবে সেটা হবে তার বিপুল ব্যর্থতা। নিউজ এডিটর তারাপদ ভৌমিক আর চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়ির তার কাছে প্রচুর প্রত্যাশা। সেটা পূরণ করতেই হবে।

মিছিলগুলো বাঁ পাশে ঘুরে কলেজ স্ট্রিটের দিকে চলে যাচ্ছে। বিনয়ের বিন্দুমাত্র সংশয় নেই, শিয়ালদার সেই মিছিলগুলোও ওই রাস্তা ধরে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে গেছে। অর্থাৎ ওখানে বড় আকারের সভাটভা হবে।

হিমঋতুর এই পড়ন্ত বিকেলে সমস্ত এলাকাটা মানুষের ভিড়ে সরগরম। রাস্তায় গাড়িটাড়ি আগেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। চারদিকে এখন চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। লোকজন সতর্ক চোখে মিছিলগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে বেশ ভয়ে ভয়েই দূরে সরে যাচ্ছে।

ত্রস্ত, চাপা গলায় ঝুমা বলে, এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। শিগগির চল। এক্ষুনি গণ্ডগোল শুরু হয়ে যাবে।

চমকে মুখ ফেরায় বিনয়, কীসের গণ্ডগোল?

দক্ষিণ দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয় ঝুমা। দূরে সিনেট হলের সামনে পুলিশের ভ্যান আর কটা জিপ ফুটপাথের ধার ঘেঁষে দাঁড় করানো। রাস্তা জুড়ে দু-তিনজন পুলিশ অফিসার আর বেশ কিছু আর্মড কনস্টেবল।

মস্তিষ্কে উত্তেজনা অনুভব করছিল বিনয়। সেটা দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা শরীরে। পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা না দেখে যাবার ইচ্ছা ছিল না তার। উদ্বাস্তুদের নিয়ে আজ একটা উত্তেজক ঘটনা ঘটতে চলেছে। প্রসাদ লাহিড়ি এটা নিয়ে কোনও অ্যাসাইনমেন্ট দেননি। এমনটা যে ঘটবে হয়তো তিনি তা জানেন না। বিনয় যদি এটা কভার করে, চিফ রিপোর্টার নিশ্চয়ই খুশি হবেন। কিন্তু ঝুমা একরকম জোর করেই দ্রুত পায়ে তাকে নিয়ে বাঁ পাশের গলিটায় ঢুকে পড়ল। মিছিলগুলো এখনও কলেজ স্ট্রিটে অদৃশ্য হয়ে যায়নি। যতক্ষণ দেখা যায় সেদিকে ঘাড় ফিরিয়ে রইল বিনয়।

একটু পর তারা যেখানে চলে এল তার দুপাশে উঁচু উঁচু, চাপ-বাঁধা, ছিরিছাঁদহীন সব বাড়ি। কলেজ স্ট্রিট কি কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট দিয়ে এতদিন ট্রাম বাসে যাতায়াত করেছে বিনয় কিন্তু কখনও নেমে ভেতর দিকে ঢোকেনি। এলাকাটা আদি কলকাতার একটা অংশ। পুরোনো, জীর্ণ, মলিন। চারপাশে আবর্জনার ভঁই। চল্লিশ কি পঞ্চাশ ফিট দূরে দূরে একটা করে গ্যাসবাতির পোস্ট।

বিনয় মিছিলটার কথা ভাবছিল। জিজ্ঞেস করল, ওদের কী হতে পারে বল তো?

মিছিল টিছিলের ব্যাপারে আদৌ কোনও আগ্রহ নেই ঝুমার। বলল, এরকম প্রশেসন আজকাল মাঝে মাঝেই বেরোয়। এ নিয়ে মাথা ঘামিও না।

বিনয় আর কিছু বলল না।

অলিগলির ভেতর দিয়ে একসময় ঝুমা শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কের উলটো দিকে একটা রেস্তোরাঁর সামনে নিয়ে আসে বিনয়কে। দরজার মাথায় বড় সাইন বোর্ডে লেখা : অজন্তা কেবিন।

বিনয় অবাক। জিজ্ঞেস করল, এখানে কী?

 ঝুমা বলল, আমার কথাগুলো বলতে হবে না?

এই রেস্তোরাঁয় বসে? ধন্দ-ধরা মানুষের গলায় বলে ওঠে বিনয়, তুমি না বলেছিলে কোনও নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে যাবে?

তেমন জায়গা এখানেই আছে। চল–

বিমূঢ়ের মতো ঝুমার সঙ্গে অজন্তা কেবিন-এ ঢুকল বিনয়।

.

৪৭.

রেস্তোরাঁটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ডান পাশে উঁচু কাউন্টারে বসে আছে মাঝবয়সী একটা লোক। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবির ওপর গরম চাদর। খুব সম্ভব সে অজন্তা কেবিন-এর প্রোপ্রাইটর। তার সামনের দিকে অনেকখানি জায়গা জুড়ে পনেরো ষোলটা টেবল পাতা। প্রতিটি টেবল ধবধবে চাদরে ঢাকা। দূরে পেছন দিকের দেওয়ালে বড় চৌকো একটা ফোকর। তার ওধারে কিচেন।

রেস্তোরাঁর চারপাশ থেকে গুঞ্জন উঠে আসছে। হালকা চালে কথাবার্তা, মাঝে মাঝে দমকা হাসি। শীতের এই বিকেলে একটা টেবলও খালি নেই।

বিস্ময়ের মাত্রাটা চড়ছিল বিনয়ের। ঝুমা বলেছিল, নিরিবিলিতে তার সঙ্গে কথা বলবে। এই কি নিরিবিলির নমুনা।

ঝুমাদের দেখে কাউন্টারের লোকটি তৎপর হয়ে ওঠে। –আসুন দিদি, আসুন—

ঝুমা জিজ্ঞেস করল, কেবিন খালি আছে?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। শিবু- গলা চড়িয়ে লোকটা হাঁক দিল, অ্যাই শিবু

একটা ঢ্যাঙা মতো রোগাটে চেহারার অল্পবয়সী বয় কিচেনের দিক থেকে ছুটে এল। গায়ে পাজামা, হাফ শার্টের ওপর রোঁয়াওলা খেলো উলের সোয়েটার। কাঁধে সাদা ঝাড়ন।

কাউন্টারের লোকটা শিবুকে বলল, দিদিদের তিন নম্বর কেবিনে নিয়ে বসা। টেবিল ফেবিলগুলো ভাল করে ঝেড়ে দিবি। ঝুমাদের শাঁসালো খদ্দের ভেবেই হয়তো লোকটা এমন খাতির করছে।

শিবু ঘাড় কাত করল। তারপর ঝুমাদের সঙ্গে করে ডান ধারের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেল। এখানে দেওয়ালের ধার ঘেঁষে কাঠের পার্টিশান দেওয়া সারি সারি খুপরি। সেগুলোর সামনে পর্দা ঝুলছে।

একটা পর্দা সরিয়ে শিবু বলল, দিদিরা, একটু দাঁড়ান- কেবিনে টেবল এবং সেটার দুধারে দুটো করে চেয়ার পাতা। সবই ফিটফাট, সাফসুতরো। তবু সেগুলোর ওপর যত্ন করে ঝাড়ন বুলিয়ে দিয়ে বলল, বসুন

ঝুমা আর বিনয় মুখোমুখি বসে পড়ে। শিবু জিজ্ঞেস করে, কী খাবেন বলুন

ঝুমা বলল, তোমাদের রেস্টুরেন্টে কী পাওয়া যাবে?

ফাউল কাটলেট, মাটন চপ, ডেভিল, কষা মাংস, চিংড়ির কাটলেট, কোর্মা, মোগলাই পরটা–গড় গড় করে নামতা পড়ার মতো লোভনীয় সব খাদ্যবস্তুর নাম আওড়ে গেল শিবু।

ঝুমা বলল, দু প্লেট ফাউল কাটলেট নিয়ে এস। টাটকা ভাজিয়ে আনবে।

 আমাদের এখানে বাসি মাল থাকে না। সব টাটকা। আর কী আনব?

পরে অর্ডার দেব।

পর্দা ফেলে দিয়ে শিবু চলে যায়।

পর্দার ওপাশে লোজন, হইচই। কিন্তু ভেতরটা নির্জন। ভিড়ের মধ্যে থেকেও এক টুকরো দ্বীপের মতো। বিচ্ছিন্ন, ভূমণ্ডলের সঙ্গে সংযোগহীন।

কেবিন ব্যাপারটা নিয়ে ধন্দে ছিল বিনয়। এবার খানিকটা বোধগম্য হল। কেন এখানে তাকে টেনে আনা হয়েছে সেটাও মোটামুটি আঁচ করা যাচ্ছে।

ঝুমা ব্যাখ্যা করে বলল, কলকাতায় মানুষ এত বেড়ে গেছে যে কোথাও ফাঁকা জায়গা নেই। যেখানেই যাও ভিড়। তাই রেস্তোরাঁর কেবিন ছাড়া আলাদা ভাবে কথা বলার জায়গা নেই। কফি হাউসের দোতলার ব্যালকনিতে গিয়ে বসতে পারতাম। ওখানে লোকজন বেশি যায় না। কিন্তু আজ কলেজ স্ট্রিটে মিছিল গেছে। গণ্ডগোল হবার খুবই সম্ভাবনা। তাই এখানে চলে এলাম।

বিনয় উত্তর দিল না। হঠাৎ করে চলে আসা অনেকগুলো মিছিল, তাদের তপ্ত স্লোগান, পুনর্বাসনের জন্য উদ্বাস্তুদের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে পাঠানোর বিরুদ্ধে আন্দোলন-এ-সব তাকে আনমনা করে রেখেছিল। কিন্তু এই মূহূর্তে কেবিনে সে আর ঝুমা ছাড়া অন্য কেউ নেই। পুরানো শিহরনটা নতুন করে ফিরে এল। বহুদিন আগে রাজদিয়ায় এক বিজ দুপুরে রামকেশবদের বাড়ির সবাই দিবানিদ্রায় যখন আচ্ছন্ন, তখন একটা ফাঁকা ঘরে সেদিনের কিশোরী ঝুমা গলা জড়িয়ে ধরে তাকে চুমু খেয়েছিল। জীবনে কোনও নারীর সেই প্রথম চুম্বন। আশ্চর্য এক নেশার ঘোরে সারা শরীর ঝিম ঝিম করছিল। এত বছর বাদেও সেই ঘোর কাটেনি।

অনেকক্ষণ নীরবতা।

তারপর ঝুমা বলল, তুমি আমাদের খুব কষ্ট দিয়েছ।

বিনয় কুমার চোখে চোখ রাখে, কষ্ট দিয়েছি। তার মানে? তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।

বাবা সুধাদিদের ওখানে গিয়ে তোমাকে আমাদের বাড়িতে আসার জন্যে বার বার বলে আসেননি?

বিনয় দমে যায়। ঢোক গিলে বলে, হ্যাঁ, বলেছিলেন।

 ঝুমা বলে, বাবার কথাটা কিন্তু তুমি রাখোনি।

বিনয় চোখ নামিয়ে নেয়। উত্তর দেয় না।

 বাবা মা ঠাকুরদা ঠাকুমা আমি–সবাই রোজ তোমার জন্যে অপেক্ষা করেছি এই কদিন। কিন্তু তুমি আসোনি।

এই প্রসঙ্গটাই যে উঠবে, নতুন ভারত পত্রিকার অফিসের সামনে ঝুমাকে দেখে তখনই আঁচ করেছিল বিনয়। সে চুপ করে থাকে।

শিবু কাটলেট নিয়ে আসে। নুন, গোলমরিচের কৌটো, টোমাটো সসের শিশি টেবলের একধারে সাজানো ছিল। কাটলেটে সস মাখাতে মাখাতে ঝুমা বয়টাকে নতুন অর্ডার দেয়, আধ ঘণ্টা পরে এক প্লেট করে ডেভিল দিয়ে যেয়ো। শিবু চলে গেলে বিনয়কে বলল, খাও

সেই কোন সকালে আগরপাড়ায় ছুটেছিল বিনয়। স্টেশনের দুধারে দুই কলোনিতে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ঝাঁপ করে ঝিনুককে খোঁজাখুজি করেছে। উৎকণ্ঠায় খিদে-তেষ্টার বোধটাই ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। সামনে খাবার দেখে সেটা চাড়া দিয়ে ওঠে। নিঃশব্দে কাটলেটে নুন আর গোলমরিচ ছড়াতে থাকে সে।

 ঝুমা বলে, দশটায় ভাত খেয়ে কলেজে গিয়েছিলাম। ছুটির পর বাড়ি যাইনি। ভীষণ খিদে পেয়েছে। ছুরি দিয়ে কাটলেটের একটা টুকরো কেটে মুখে পোরে সে।

নিঃশব্দে কিছুক্ষণ খাওয়ার পর ঝুমা বলে, বাবা বলছিল, তোমার জন্যে একটা ভাল চাকরির ব্যবস্থা করেছেন।

সেদিন সুধাদের বাড়ি গিয়ে ঠিক এই কথাই জানিয়ে এসেছিলেন শিশির। নামকরা ব্রিটিশ ফার্মে লোভনীয় চাকরি। নতুন ভারত-এ যে টাকায় বিনয় ঢুকছে ওখানে শুরুতেই তার চার-পাঁচ গুণ। সে যদি সেখানে জয়েন করে তার ভবিষ্যৎ খুবই ঝলমলে। শিশিরের সুপারিশে তাঁর বন্ধু এমন একটা লম্বা সিঁড়ি বিনয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবেন যার মাথা আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। তর তর করে বিনয়ের শুধু ওপরে, আরও ওপরে, আরও আরও ওপরে উঠে যাওয়া। স্বপ্নের এমনই একটা রঙিন, নিখুঁত ছবি সেদিনই সামনে-পেছনে-ডাইনে-বাঁয়ে টাঙিয়ে দিয়ে এসেছিলেন শিশির।

বিনয় ঝুমার কথার উত্তর দেয় না।

ঝুমা বলতে লাগল, পরে সুধাদির কাছে শুনলাম তুমি বাবার দেওয়া চাকরিটা নিতে চাও না।

বিনয় এবারও চুপ। ঝুমাকে দেখার পর নেশার ঘোর যেমন ছিল, অন্তর্নিহিত একটু অস্বস্তিও বুকের ভেতর চিন চিন করছিল, সেটা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

ঝুমা অধীর স্বরে জিজ্ঞেস করে, কেন–কেন নিতে চাও না? বাবার অপরাধটা কী?

 বিব্রত মুখে বিনয় বলে, কোনও অপরাধ নেই। কিন্তু, কিন্তু হঠাৎ থেমে যায় সে।

 কিন্তু কী?

কেউ অনুগ্রহ করছেন, এটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। নিজের যোগ্যতায় যেটুকু হয় তাতেই আমি খুশি। চোখকান বুজে সরল সত্যটাই বলে ফেলে বিনয়।

খাওয়া বন্ধ হয়ে যায় ঝুমার। চোখের দৃষ্টি স্থির। চাপা গলায় বলল, আত্মসম্মানে আটকাচ্ছে? তাহলে আনন্দমামার রেকমেণ্ডেশনে কাগজের চাকরিটা নিলে কী করে? তখন মর্যাদাবোধে বাধেনি? তার কণ্ঠস্বরে ঝাঁঝ ফুটে বেরোয়।

বিনয় চমকে ওঠে। আক্রমণটা এমন একটা দিক থেকে আসতে পারে, কে জানতো? সে হকচকিয়ে যায়। সামলে উঠতে একটু সময় লাগে। তারপর বলে, আনন্দদা যোগাযোগটা করে দিয়েছিল ঠিকই। আমি কিন্তু রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে ওখানে ঢুকেছি। তাছাড়া —

তাছাড়া কী?

আমার চাকরির পেছনে আনন্দদার কোনও উদ্দেশ্য ছিল না।

ঝুমার সারা শরীরে তড়িৎপ্রবাহ খেলে যায়। চোখমুখ আঁ আঁ করতে থাকে। সে কিন্তু ক্ষোভে, রাগে বা উত্তেজনায় ফেটে পড়ে না। নিজের স্নায়ুমণ্ডলী নিয়ন্ত্রণে রেখে শান্ত গলায় বলে, ঠিকই বলেছ। আনন্দমামার না থাকলেও আমার বাবার উদ্দেশ্য আছে, স্বার্থও আছে। কেন তিনি তোমাকে লাইফে এস্টাব্লিশড করতে চান, আর আমি কী চাই, তুমি বোঝো না? শেষ দিকে তার গলা কাঁপতে থাকে।

এ-সব নিয়ে সুধার সঙ্গে বিনয়ের কথা হয়ে গেছে। জীবনের এই পর্বটা সে চুকিয়ে দিতে চেয়েছে। রাজদিয়ায় রামকেশবদের বাড়িতে একদিন দুপুরে যা শুরু হয়েছিল তার জের আর টানতে চায় না বিনয়, কিন্তু ঝুমা ছাড়লে তো। প্রায় মরিয়া হয়েই বিনয় বলে, তুমি বোধহয় শোননি, ঝিনুকের খবর পাওয়া গেছে।

কিছু বলতে গিয়ে ঝুমা থমকে যায়। বিনয় যে আচমকা ঝিনুককে টেনে আনবে, সে কল্পনাও করেনি। আলো নিবে এলে যেমন হয়, তার মুখ তেমন মলিন দেখায়। জোরে শ্বাস টেনে নিরুৎসুক সুরে জিজ্ঞেস করে, কে খবর দিলে?

অধর ছুঁইমালীর নাম বলল বিনয়।

কোথায় আছে ঝিনুক?

কলকাতার আশেপাশেই। আজ সকালে তার সন্ধানে বিনয় যে আগরপাড়া গিয়েছিল এবং ভবিষ্যতে কোথায় কোথায় যাবে, তাও জানিয়ে দিল সে।

কেবিনের ভেতর অপার স্তব্ধতা নেমে আসে। পর্দার ওধারেও সব আওয়াজ বুঝি থেমে গেছে।

অনেকক্ষণ পর ঝুমা বলল, শুধু শুধুই তুমি ঝিনুককে খুঁজে বেড়াচ্ছ। ওকে তুমি পাবে না।

বিনয় জোর দিয়ে বলল, কী করে বললে পাব না?

যে নিজের থেকে হারিয়ে যায় তাকে পাওয়া যায় না বিনুদা বলে এক পলক থামে। তারপর ফের শুরু করে, ধরা যাক, খুঁজতে খুঁজতে ঝিনুককে একদিন পেয়ে গেলে, তখন তাকে নিয়ে কী করবে?

প্রশ্নটা আগে আরও একদিন এই ঝুমাই তাকে করেছিল।

অবনীমোহনও সোজাসুজি একই কথা জানতে চেয়েছিলেন। হতচকিত, দ্বিধাগ্রস্ত বিনয় উত্তর দিতে পারেনি। সংস্কার আর দ্বিধা কাটিয়ে ওঠার মতো বিপুল শক্তি তার মধ্যে সেদিন ছিল না। জগৎ সংসারের নাকের ডগায় তুড়ি বাজিয়ে বলতে পারেনি, ঝিনুককে নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে। আজও কি সে দ্বিধামুক্ত? গলা ফাটিয়ে সে কি ঘোষণা করতে পারে পচা গলা রদ্দি সংস্কার আমি মানি না? মনের ভেতর কোথাও একটা কুয়াশাঘেরা এলাকা আছে। ঝিনুককে যদি শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় তাকে নিয়ে কী করবে, সেটা বুঝি বা তার কাছে এখনও স্পষ্ট নয়।

এই মেয়েটা-ঝুমা, মাঝে মাঝে হুট করে চলে আসে আর ঘাড় ধরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে দুরূহ, সবচেয়ে নির্মম প্রশ্নটার সামনে তাকে দাঁড় করিয়ে দেয়। ঝিনুককে পাওয়া গেলে কী করবে তা এই মুহূর্তে বলতে না পারলেও তাকে খুঁজে বার করাটা বিনয়ের জীবনের সব চাইতে বড় দায়। সে বলল, আগেতো ঝিনুককে পাই, তারপর দেখা যাবে

 ঝুমা ভারী গলায় বলল, ঠিক আছে, তুমি খুঁজতে থাক। আমিও অপেক্ষা করতে থাকব। তার দুচোখ বাষ্পে ভরে যায়।

হতবাক তাকিয়ে থাকে বিনয়। যে ঝুমাকে সে চেনে সে বেপরোয়া। দুঃসাহসী। হঠকারী। পৃথিবীর কোনও কিছু তোয়াক্কা করে না। যা চায়, প্রবল প্রতাপে ছিনিয়ে নিতেও জানে। কিন্তু যে নারীটি টেবলের উলটো দিকে বসে আছে সে বিনয়ের সম্পূর্ণ অচেনা। এই ঝুমা বড় কোমল, বড় দুর্বল। এই মেয়েটাকে আগে কি কোনওদিন কাঁদতে দেখেছে? বিনয়ের মনে পড়ল না। এতকাল ঝুমাকে দেখলে স্নায়ুতে শিহরন খেলে যেত। আজই প্রথম বড় মায়ায় তার বুকের ভেতরটা ভরে যেতে থাকে।

বহুদিন ধরে বিনয়ের যা মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে ফের তা মনে পড়ে যায়। সে এমন এক গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছে যার আদি-অন্ত নেই। সে খুঁজে বেড়াচ্ছে ঝিনুককে, ঝুমা ছুটছে তার পিছু পিছু। কতকাল যে চক্রাকারে এই দৌড় চলবে, কে জানে। হয়তো যুগ যুগান্ত, হয়তো আমৃত্যু।

কখন যেন শিবু ডিমের ডেভিল দিয়ে গিয়েছিল। সেটা জুড়িয়ে গেছে। এদিকে ঝুমার গাল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছিল। তার খাওয়ার ইচ্ছেটা নষ্ট হয়ে গেছে।

 পর্দা সরিয়ে শিবু উঁকি মারল, দিদি, আর কী আনব? সে জানে কেবিনে যে যুবক যুবতীরা জোড়ায় জোড়ায় এসে বসে তারা একসঙ্গে সব খাবারের অর্ডার দেয় না। একটা খাওয়া হলে নতুন অর্ডার। অর্থাৎ কেবিনের ভেতর পর্দার আড়ালে যতটা বেশি সময় কাটানো যায় আর কি।

চকিতে রুমালে চোখ মুছে ঝুমা বলল, না, আর কিছু দরকার নেই। তুমি বিল নিয়ে এস।

শিবু অবাক হল। খাবার ফেলে রেখে হুট করে চলে যেতে চায়, এমন খদ্দের আগে সে আর দেখেনি। এক লহমা ঝুমাকে দেখে আচ্ছা বলে অদৃশ্য হল।

ধরা ধরা গলায় ঝুমা বিনয়কে বলল, তুমি খেয়ে নাও

 খাওয়ার স্পৃহা বিনয়েরও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সে বলে, না, থাক।

ঝুমা জোর করল না।

একসময় বিল মিটিয়ে দিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়ে। দুপ্লেট ডেভিল অজন্তা কেবিন-এ পড়ে থাকে।

সন্ধে নামতে এখনও খানিক বাকি। তবু এর মধ্যে চারপাশের রাস্তাঘাট, দোকানপাট আর বাড়িগুলোতে আলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে।

কলেজ স্ট্রিট থেকে অলিগলির ভেতর দিয়ে ঘুরপথে বিনয়রা অজন্তা কেবিন-এ এসেছিল। এবার ঝুমা আমহার্স্ট স্ট্রিট দিয়ে হ্যারিসন রোডে চলে আসে। তারপর সোজা কলেজ স্ট্রিটের মোড়। সারা পথ তারা কেউ একটা কথাও বলেনি। চুপচাপ দূরমনস্কর মতো হেঁটে এসেছে।

হঠাৎ সেই মিছিলগুলোর কথা মনে পড়ে যায় বিনয়ের। না, তার চিহ্নমাত্র নেই। কিন্তু আবহাওয়া কেমন যেন থমথমে। এসপ্ল্যানেড থেকে শ্যামবাজার কি বেলগাছিয়া রুটের কোনও বাস ট্রাম চলছে না। অন্য যানবাহন চলাচলও বন্ধ। তবে বড়বাজারের দিক থেকে হাওড়া আর হাইকোর্ট রুটের ট্রাম বা বাস এসে কলেজ স্ট্রিটের মোড় ঘুরে কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট হয়ে শ্যামবাজারের দিকে যাতায়াত করছে। এই রুটটা খোলা।

বিনয় চকিতে ভেবে নিল, মিছিলগুলো যেখানে গেছে অর্থাৎ ওয়েলিংটন স্কোয়ারে গিয়ে খোঁজখবর নেবে। তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় জানিয়ে দেয়, কিছু একটা ঘটেছে। নইলে ওধারের ট্রাম বাস বন্ধ হতো না। সে ঝুমাকে বলল, তুমি বাড়ি চলে যাও।

ঝুমা অবাক হল।–আর তুমি? অফিসে যাবে না? হাইকোর্ট-শ্যামবাজারের ট্রাম ধরে একসঙ্গে বিবেকানন্দ রোডের ক্রসিং অবধি যাওয়া যেত।

আমি এখন অফিসে যাব না। তুমি আর দাঁড়িও না। সন্ধে হয়ে যাচ্ছে বলে ঝুমাকে আর কিছু বলার সময় না দিয়ে কলেজ স্ট্রিটে ঢুকে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে শুরু করল।

.

৪৮.

রাস্তাটা প্রায় সুনসান। লোকজন নেই বললেই হয়। ডানপাশে প্রেসিডেন্সি কলেজে আলো জ্বলেনি। আবছা, ভৌতিক চেহারা নিয়ে বিশাল ইমারতটা দাঁড়িয়ে আছে। বাঁদিকে সারি সারি বইয়ের দোকান দাশগুপ্ত অ্যাণ্ড কোং, কমলা বুক ডিপো, চক্রবর্তী চ্যাটার্জি, ইউ এন ধর–সব বন্ধ। এখানে খোলা ফুটপাথে যারা পুরোনো বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসে তাদের কেউ নেই।

ফাঁকা ফুটপাথ ধরে এগিয়ে চলেছে বিনয়, একদিকে হিন্দু স্কুল, সংস্কৃত কলেজ, কলেজ স্কোয়ারের সুইমিং পুল, অন্যদিকে হেয়ার স্কুল, সেনেট হল, মেডিক্যাল কলেজ টলেজ পেরিয়ে বউবাজার ছাড়িয়ে এগুতে এগুতে এবার কিছু মানুষ চোখে পড়ছে। বাড়ি বা দোকান টোকানের দরজার পাল্লা আধাআধি খুলে তারা দাঁড়িয়ে আছে। বড় রাস্তা থেকে দুধারে অগুনতি গলি ভেতর দিকে অনেকদূর চলে গেছে। সেগুলোর মোড়ে মোড়ে ঘোট ঘোট জটলা। যারা জড়ো হয়েছে তাদের চোখে মুখে শঙ্কা, উত্তেজনা। সবাই দূরে মিশন রোর দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় কী যেন বলাবলি করছে।

বিনয় মিশন রোর দিকটায় তাকায়। সেখানে প্রচুর পুলিশ। তার বুকের ভেতরটা কেঁপে যায়। থমকে কয়েক লহমা দাঁড়িয়ে পড়ে সে। তারপর একটা জটলার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ওখানে কী হয়েছে বলুন তো? এত পুলিশ!

একজন চাপা উত্তেজনার সুরে বলল, মিশন রোর ও-মাথায় রিফিউজিদের সঙ্গে পুলিশের ভীষণ গোলমাল হচ্ছে। লাঠি গুলি-টুলি চলছে।

বিনয় চমকে ওঠে।হঠাৎ কী হল, যাতে তার কথা শেষ হতে না-হতেই আর-একজন জানায় দুপুর থেকে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে একটার পর একটা মিছিল এসে জড়ো হচ্ছিল। বেলা একটু পড়লে ওখানে মিটিং হয়। তারপর ফের মিছিল করে স্লোগান দিতে দিতে ওরা মিশন রো ধরে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের দিকে যেতে থাকে। কিন্তু পুলিশের বিরাট একটা বাহিনী রাইটার্সে পৌঁছবার আগে তাদের আটকে দেয়। রিফিউজিরা যাবেই। এই নিয়ে প্রথমে তর্কাতর্কি, বচসা। তারপর তুমুল হাঙ্গামা শুরু হয়ে যায়। এখনও সেটা পুরোদমে চলছে। আর তারই জেরে এই অঞ্চলের অফিস, দোকানপাট, গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ হয়ে গেছে। কতক্ষণ এই ধুন্ধুমার চলবে, কে জানে। লোকটা বলতে লাগল, স্বাধীনতার আগে আগে সেই রশিদ আলি ডেতে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের লড়াই হয়েছিল এই মিশন রো এলাকায়। রামেশ্বর আর কটা ছেলে গুলি খেয়ে মরল। তারপর রিফিউজিদের সঙ্গে আজকের এই হুজুৎ। অবশ্য দুটো লড়াই দুরকমের।

বিনয় জানতে চাইল, গুলিতে কতজন মারা গেছে, কত জন জখম হয়েছে, জানেন?

যেখানে কুরুক্ষেত্র চলছে সেখানে কি আমরা গেছি! কী করে বলব? তবে বুম বুম শব্দ হচ্ছিল। গুলি না চললে কি ওরকম আওয়াজ হয়? গুলি চললে মানুষ মরবে, সব্বাই তা জানে। তা পাঁচ সাতজন কি আর মরেনি?

বিনয় আর কোনও প্রশ্ন করল না। মিশন রোর দিকে পা বাড়ালো। ঘটনাস্থলের এত কাছাকাছি চলে এসেছে। নিজের চোখে না দেখলে হয়? হাজার হোক, সে একজন সাংবাদিক।

পুরো জটলাট্টা উৎকণ্ঠায় হাঁ হাঁ করে ওঠে। যাবেন না, যাবেন না। ভীষণ বিপদে পড়বেন।

বিনয় ফিরেও তাকাল না। মিশন রোর এ-মাথায় যেখানে এক দঙ্গল পুলিশ আর পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছে সেখানে চলে এল। মোড় ঘুরে সে যখন মিশন রোতে ঢুকতে যাচ্ছে, একজন মাঝবয়সী, মজবুত চেহারার পুলিশ অফিসার লম্বা লম্বা পা ফেলে তার সামনে চলে এলেন। ভারী গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছেন ওদিকে?

আচমকা সরকারি স্বীকৃতি পাওয়া প্রেস কার্ডটার কথা মনে পড়ে গেল। সেটা সারাক্ষণ বিনয়ের সঙ্গে থাকে। ওটা ছাড়া বহু জায়গায় ঢোকা বা বেরুনো যায় না। কার্ডটা বার করে অফিসারকে দেখাতে দেখাতে বলল, আমি নতুন-ভারত-এর রিপোর্টার। কাগজটা খুব শিগগির বেরুবে। এখন পুলিশের সঙ্গে রিফিউজিদের যে ক্ল্যাশটা চলছে তা আমি দেখতে চাই। একটা রিপোর্ট লিখতে হবে।

দূরে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউর ওধার থেকে তুমুল হইচই, চিৎকার ভেসে আসছে। যদিও রাস্তার এবং দুপাশের অফিস বিল্ডিংগুলোতে আলো জ্বলে উঠেছে, শীতের এই সন্ধেয় গাঢ় কুয়াশার জন্য কোনও কিছুই খুব স্পষ্ট নয়। তবু ঝাপসা ছবির মতো দেখা যাচ্ছে বহু লোক উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়চ্ছে। চোখে পড়ছে অজস্র আর্মড পুলিশ, সার্জেন্ট, পুলিশ অফিসার। তারাও এলোপাতাড়ি ছোটাছুটি করছে। কালো রঙের কত যে পুলিশ ভ্যান আর জিপ রাস্তা আড়াআড়ি আটকে দাঁড় করানো রয়েছে। সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে অফিসার বললেন, দেখছেন তো। ওই গোলমালের ভেতর না যাওয়াই ভাল। খুব রিস্কি হয়ে যাবে।

অফিসারের বাইরেটা রুক্ষ, গম্ভীর হলেও ভেতরটা বেশ নরম ধরনের। তিনি চান না বিনয় হাঙ্গামার মধ্যে গিয়ে বিপদে পড়ুক। 

সাংবাদিক হিসেবে বিনয় একেবারেই আনকোরা। আগে কখনও এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েনি। অফিসারের মুখের ওপর বলতে পারল না, বিপজ্জনক যে কোনও ঘটনা ঘটলে একজন সাংবাদিককে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। তাতে যত ঝুঁকিই থাক না।

চারদিক দ্রুত দেখে নিল বিনয়। এই এলাকা তার খুব ভাল করে চেনা। কেননা ঝিনুকের খোঁজে কলকাতার উত্তর দক্ষিণ পুব পশ্চিম, কোনও অঞ্চলই সে বাদ দেয়নি। প্রতিটি গলিখুঁজিতে হানা দিয়েছে।

মিশন রোর এই প্রান্তের ডান ধারে একতলা পুরনো একটা বিল্ডিংয়ে কর্পোরেশনের প্রাইমারি স্কুল। সেটার পেছন দিয়ে একটা গলি মিশন রোর পাশাপাশি এঁকেবেঁকে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ অবধি চলে গেছে। এই গলি থেকে পঞ্চাশ ষাট ফিট পর পর একটা করে ফ্যাকড়া মিশন রোতে গিয়ে ঠেকেছে। বিনয় মনস্থির করে ফেলল, প্রাইমারি স্কুলের পেছনের গলিটা ধরে এগিয়ে যাবে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পার হলে আরও দুতিনটে গলি মিশন বোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লালবাজারের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে। সেখান থেকে রাইটার্স আর কতটুকু। একরাতে ওখানে যেতে পারলে সুযোগমতো কোনও একটা ফ্যাকড়া দিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে উঠবে। সে আর দাঁড়াল না। নিঃশব্দে গলিটায় ঢুকে পড়ল।

সরু রাস্তাটার বাঁদিকে লাইন দিয়ে উঁচু উঁচু সব অফিস বিল্ডিংয়ের আড়াল। খানিকটা পর পর গলিটা থেকে আরও সরু সরু যে-সব পথ মিশন রোতে গিয়ে পড়েছে সেই ফাঁক দিয়ে ওধারের দৃশ্য চোখে পড়ছে। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউর এদিকটায় তেমন কিছু নেই, সব ফাঁকা ফাঁকা। কিন্তু ওধারে খানিকটা এগুতেই চোখে পড়ল–বিশাল রণক্ষেত্র। রাস্তা সারাইয়ের জন্য এখানে ওখানে প্রচুর খোয়া আর স্টোন চিপ ডাঁই করে রাখা হয়েছে। উদ্বাস্তু আর তাদের সঙ্গী পার্টির ছেলেরা পুলিশের দিকে তাক করে করে খোয়া ছুড়ছে। তাদের চোখমুখের চেহারা বেপরোয়া, হিংস্র। দাঁতে দাঁত চাপা ক্রোধ ফুটে বেরুচ্ছে লোকগুলোর ছোটাছুটিতে, পাথর ছোঁড়ার ভঙ্গিতে। সীমান্তের এপারে পা রাখার পর উদ্বাস্তুদের কীরকম দেখে আসছে বিনয়? একেবারে জড়সড়, এস্ত, ভীরু, উৎকণ্ঠায় দিশেহারা। কিন্তু শীতের সন্ধেয় এই ছিন্নমূল মানুষগুলোকে চেনাই যায় না। তারা যেন আমূল বদলে গেছে।

খোয়া তো ছুড়ছেই, মাঝে মাঝেই উদ্বাস্তুরা পুলিশের বেষ্টনী ভেঙে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের দিকে যাবার চেষ্টা করছে। সেই সঙ্গে চলছে তুমুল চিৎকার। পুলিশ তৈরিই আছে। তারা লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করে তাদের হটিয়ে দিচ্ছে। উদ্বাস্তুরা বেগতিক বুঝলেই রাস্তার দুধারের গলিঘুজিতে ঢুকে পড়ছে। পুলিশ একটু দূরে সরে গেলেই তারা ফের বেরিয়ে এসে খোয়া, পাথর ছুঁড়তে থাকে। বিনয় বারতিনেক পুলিশ এবং রিফিউজিদের এই মহড়া দেখল। সেই বিকেল থেকে নিশ্চয়ই এমনটা অনেকবার হয়ে চলেছে।

মিশন রোর ফুটপাথের ধারে প্রচুর প্রাইভেট কার। তার বেশ কয়েকটা ভেঙেচুরে গেছে। পুলিশের তিন চারটে জিপের হেডলাইট, জানালা চুরমার, মাডগার্ড তোবড়ানো। অজস্র কাঁচের টুকরো, ইট, খোয়া রাস্তাময় ছড়িয়ে আছে।

বিনয় সরু, চাপা গলিটার মুখ অবধি যায়নি; মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছিল।

সন্ধে নেমে গেছে। হঠাৎ একসময় শতিনেক মারমুখি উদ্বাস্তু এবং তাদের সঙ্গী পার্টির ছেলেরা পুলিশবহ ভেদ করার শেষ মরিয়া একটা চেষ্টা করে। পুলিশও তাদের রাইটার্সে যেতে দেবে না, রে রে করে উদ্বাস্তুদের ওপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে তিন চার জন কনস্টেবল টিয়ার গ্যাস শেল ফাটাতে থাকে। চারদিক চকিত করে শব্দ ওঠে-বুমবুমবুম। ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে শীতের বাতাসে। লাঠির ঘায়ে উদ্বাস্তুদের অনেকেরই হাত-পা ভেঙে যায়। কারও কারও মাথা মুখ ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড। অনেকে রাস্তায় আছড়ে পড়ে গোঙাচ্ছে। পুলিশও রেহাই পায়নি। খোয়া আর ইটের ঘায়ে তাদেরও কয়েকজনের কপাল কি থুতনি থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে।

অনেকক্ষণ লড়াইয়ের পর বিধ্বস্ত উদ্বাস্তুরা এবার ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে লাগল। পুলিশের মাথায় খুন চড়ে গিয়েছিল। তারা উদ্বাস্তুদের ঘাড় ধরে, কারওকে বা টেনে হেঁচড়ে কালো ভ্যানগুলোতে তুলতে থাকে। পার্টির লোকদেরও নিস্তার নেই। পুলিশ তাদেরও ছাড়েনি। প্রায় শখানেক আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করা হল।

বিনয় যে ঘুপচি গলিটায় রয়েছে, কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া হাওয়ায় হাওয়ায় সেখানে ঢুকে পড়েছে। চোখ ভীষণ জ্বালা জ্বালা করছিল তার।

মিশন রো দ্রুত ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। পুলিশ যাকে পেরেছে তাকে তো ধরছেই, যে উদ্বাস্তুরা চোট খেয়ে রাস্তায় পড়েছিল, এখন তাদের চ্যাংদোলা করে ভ্যানে পুরে ফেলছে।

শীতের সন্ধে আর কতক্ষণ? ঝপ করে রাত নেমে এল। কতজন উদ্বাস্তু আর পলিটিক্যাল ওয়ার্কারকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, কতজন জখম হয়েছে, তা মোটামুটি আন্দাজ করেছে বিনয়। সঠিক সংখ্যাটা ওই হুলস্থূলের মধ্যে জানতে পারেনি। সে আনকোরা প্রতিবেদক। কীভাবে জানা সম্ভব তার ধারণা নেই। এই নির্জন অন্ধকার সরু গলিতে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। যেদিক দিয়ে সে এসেছিল সেই পথেই ওয়েলিংটনের দিকে মিশন রোর অন্যপ্রান্তে চলে এল। এখন এই রাস্তা দিয়ে শ্যামবাজার রুটের ট্রাম বাস চলতে শুরু করেছে। তবে খুব বেশি নয়, মাঝে মাঝে দু-একটা।

একটা আধাআধি ফাঁকা ট্রামে উঠে পড়ল বিনয়। মিনিট পনেরোর ভেতর বিবেকানন্দ রোডের ক্রসিংয়ে নেমে বাকি পথটা হেঁটে অফিসে পৌঁছে গেল।

.

নতুন ভারত-এর নিউজ ডিপার্টমেন্টের এক কোণে রিপোর্টিং সেকশানে রীতিমতো হইচই চলছিল। চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়ি রোজ যেমন থাকেন তেমনই রয়েছেন। অন্য রিপোর্টাররাও আছে। আজ নিউজ এডিটর তারাপদ ভৌমিক তার কামরা ছেড়ে ওখানে এসে বসেছেন। বেশ কজন সাব-এডিটর এবং চিফ সাবকেও সেখানে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিন এমনটা দেখা যায় না।

তেতলায় নিউজ ডিপার্টমেন্টে ঢুকে নিজের সেকশানের দিকে যেতে যেতে বিনয় ভাবল, অন্য বিভাগের সাংবাদিকরা মাঝে মাঝেই তাদের সেকশানে আসে। কিন্তু নিউজ এডিটরকে কখনও ওখানে দেখেনি সে। কী এমন হতে পারে যাতে তিনিও চলে এসেছেন!

উত্তেজিত ভঙ্গিতে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন প্রসাদ, হঠাৎ বিনয়কে দেখে তার কপাল কুঁচকে গেল। গলার স্বর অনেক উঁচুতে তুলে প্রায় চিৎকার করে তাকে বললেন, কটায় ডিউটি তোমার? এখন কটা বাজে? আঙুল তুলে বার্তা বিভাগের বিশাল ওয়ালক্লকটা দেখিয়ে দিলেন।

বিনয় দেখল, আটটা বেজে সতেরো। সে কৈফিয়ৎ দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই ফের চেঁচিয়ে উঠলেন প্রসাদ, জানো আজ কী ঘটেছে? তোমাকে রিফিউজিদের সমস্ত ব্যাপারটা কভার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, অথচ তোমার অফিসে আসার কথা দুটোয় আর তুমি এলে কি না এত রাত করে! এদিকে বিকেলে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে পুলিশের বিরাট ক্ল্যাশ হয়ে গেছে। অন্য রিপোর্টারদের যে পাঠাব তার উপায় নেই। তারা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বেরিয়ে গেছে। কী যে করব

 তাকে থামিয়ে দিয়ে তারাপদ বলেন, আজই প্রথম উদ্বাস্তুদের ওপর এত বড় আকারে লাঠি আর টিয়ার গ্যাস চলেছে। আমাদের কাগজ না হয় এখনও বেরোয়নি, কিন্তু চালু থাকলে অবস্থাটা কী দাঁড়াত, ভাবতে পার? ওয়েস্ট বেঙ্গলের সবচেয়ে জ্বলন্ত সমস্যা যাদের নিয়ে তাদের এত বড় একটা ঘটনা কীভাবে আমরা ছাপতাম?

অনন্ত দুঃসাহসে বিনয় তারাপদদের কথার ফাঁকে বলে ওঠে, আপনারা কি মিশন রোর ঘটনাটার কথা বলছেন? আমি সোজা সেখান থেকেই আসছি।

কিছুক্ষণ একেবারে চুপ হয়ে রইলেন তারাপদ। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ওখানে গেলে কী করে? এমন একটা ব্যাপার ঘটবে, তা কি জানতে?

বিনয় জানায়, প্রসাদ তাকে রোজ একটা করে উদ্বাস্তু কলোনি বা ক্যাম্পে গিয়ে সে-সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জোগাড় করে একটি করে প্রতিবেদন তৈরি করতে বলেছেন। সেই মতো আজ গড়িয়ার ওধারে সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লিতে গিয়েছিল। সেখান থেকে কাজ সেরে একটা দরকারে কলেজ স্ট্রিটে আসে। তখন বিকেল। চোখে পড়ে সিনেট হলের সামনে বেশ কিছু পুলিশ রয়েছে। ট্রামবাস বন্ধ। খবর নিয়ে জানতে পারে, ওয়েলিংটনে উদ্বাস্তুরা মিটিং সেরে রাইটার্সে গেছে, বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে দাবিপত্র জমা দেবার জন্য। শোনামাত্র সেখানে চলে যায় বিনয়, তারপর যা ঘটেছে তার সবিস্তার বিবরণ দিয়ে গেল।

বিনয় যা বলেছে তার বেশিটাই সত্যি। বাকিটা আধা-সত্যি। সত্যি-মিথ্যে নিপুণভাবে মেশানো হয়েছে। আগরপাড়ায় মুকুন্দপুর বাস্তুহারা কলোনি এবং অন্য একটা নামকরণ না-হওয়া কলোনিতে যে গিয়েছিল তা পুরোপুরি বাদ দিয়েছে। কারণ তাকে কলকাতার দক্ষিণ দিকের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের রিফিউজি কলোনি আর ক্যাম্পগুলোতে যেতে বলা হয়েছিল। আগরপাড়ার কথা জানালে কেন সে উত্তর দিকের ওই এলাকায় গিয়েছিল, এই নিয়ে অনেক জবাবদিহি করতে হবে।

বিনয় যে মিশন রোতে গিয়েছিল তা শুনে খুশি হয়েছেন তারাপদ। তাঁর মুখ নরম দেখায়। বিনয়ের পিঠে হাত রেখে বললেন, খুব ভাল কাজ করেছ। সাংবাদিকদের সবসময় চোখকান খোলা রাখতে হয়।

প্রসাদও বিনয়কে যথেষ্ট তারিফ করলেন, দেখা যাচ্ছে যোগ্য লোককেই রিফিউজিদের সম্পর্কে অ্যাসাইমেন্ট দেওয়া হয়েছে। আই অ্যাম হ্যাপি

তারাপদ আর বসলেন না। তোমরা কাজ কর। আমি চলি। নিজের কামরার দিকে চলে গেলেন তিনি।

যে সাব-এডিটর আর চিফ সাবরা এসেছিল তারাও একে একে উঠে পড়ে।

বিনয় আন্দাজ করে নিল, রিফিউজি আর পুলিশের যে বড় আকারের সংঘর্ষটা আজ হয়েছে সে ব্যাপারে খবর নিতেই তারাপদরা রিপোর্টিং সেকশানে এসেছিলেন। কথায় কথায় তার প্রসঙ্গ উঠেছিল। কেননা উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে যাবতীয় দায়িত্ব তাকেই দেওয়া হয়েছে। নতুন ভারত এখনও বেরোয়নি ঠিকই, তবু আজ এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে, তার প্রতিবেদন লিখে রাখা জরুরি। ভবিষ্যতে হয়তো কাজে লাগবে। কিন্তু বিনয় অফিসে নেই, অন্য রিপোর্টাররাও বেরিয়ে গেছে, তাই মিশন রোতে কারওকে পাঠানো যায়নি। প্রসাধ্যার রাগের কারণ সেটাই। যাই হোক, বিনয় যে অপদার্থ নয়, নিজের অ্যাসাইনমেন্ট সম্পর্কে যথেষ্ট সজাগ, তা প্রমাণ করা গেছে।

প্রসাদ কিছু ভাবছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে বিনয়।

কেন? বিনয় তার মুখের দিকে তাকায়।

রিফিউজিরা এতদিন ভয়ে ভয়ে মুখ বুজে ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ জমা হয়ে আছে। আজ তার বড়রকমের একটা আউটবাঘটেছে। এটাই কিন্তু শুরু। যদি তাড়াতাড়ি ওদের রিহ্যাবিলিটেশনের উপযুক্ত বন্দোবস্ত না করা হয়, অ্যাজিটেশন ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। সারা ওয়েস্ট বেঙ্গল জুড়ে অশান্তি ছড়িয়ে পড়বে। একটু চুপ করে থেকে বললেন, কতদিন আর এইসব মানুষ ক্যাম্পে ক্যাম্পে, স্টেশন চত্বরে পশুর মতো জীবনযাপন করবে?

.

৪৯.

আরও সপ্তাহখানেক কেটে গেছে। আর ঠিক চারদিন পর নতুন ভারত বাজারে বেরিয়ে যাবে। এই সাতদিনের মধ্যে একটা রবিবার পাওয়া গিয়েছিল। সেদিন ফোন করে আনন্দ আর সুনীতিকে টালিগঞ্জে সুধাদের বাড়িতে আনিয়েছে বিনয়। ভবানীপুরের বাড়ি বিক্রির ঋণ শোধ করে যে টাকাটা বেঁচেছে, অবনীমোহন তার তিন ছেলেমেয়ের নামে ব্যাঙ্কে জমা করে দিয়েছেন। শেষ যেবার বিনয় বিমল গাঙ্গুলিদের বাড়ি যায় সেদিনই স্থির করেছিল তার ভাগের টাকাটা রামরতনের স্ত্রী আর মেয়েদের দেবে। একের পর এক ঘটনায় সে থই পাচ্ছিল না। তাই মনে মনে যে প্রতিজ্ঞা করেছিল তা পূরণ করা হয় নি। কিন্তু ওটা আর ফেলে রাখা যায় না।

সুধা সুনীতিরা রামরতনের স্ত্রী এবং মেয়েদের কথা ভাল করেই জানে। বিনয় তার ভাগের টাকা ওদের দিতে চায় শুনে কেউ আপত্তি করেনি। এমনকি দরকার হলে তারাও নিজেদের টাকাটা দিতে চেয়েছে। আপাতত একটা চেক লিখে হিরণকে দেওয়া হয়েছিল। বিনয়ের ভাগের এগারো হাজার টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে সুধার কাছে রাখা আছে। নতুন ভারত বেরুবার পর টাকাটা সে রামরতনের স্ত্রীর হাতে দিয়ে আসবে। এমনটাই ভেবে রেখেছে।

এই সাতদিনে রবিবারটা বাদ দিলে যে অ্যাসাইনমেন্ট তাকে দেওয়া হয়েছে, বিপুল উদ্যমে তা করে চলেছে বিনয়। সকালে উঠেই চান সেরে চা খেয়ে রোজ সে চলে গেছে একটা করে ত্রাণশিবির বা কলোনিতে। পাশাপাশি ঝিনুকের খোঁজ তো চলছেই।

এর ভেতর একদিন প্রসাদ লাহিড়ি তাকে গভর্নমেন্টের উদ্বাস্তু ত্রাণ বিভাগে পাঠিয়েছিলেন। এই বিভাগটা আপাতত দেখছেন মন্ত্রী নিকুঞ্জ বিহারী মাইতি। রিলিফ ডিপার্টমেন্টের অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের কাছ থেকে নানা তথ্য জোগাড় করে জবরদখল কলোনি আর রিলিফ ক্যাম্পগুলো  সম্পর্কে মোটামুটি ভালই ধারণা হয়েছে বিনয়ের। এতদিন তার জানাটা তত ব্যাপক ছিল না।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কলকাতায় তো বটেই, সারা বাংলা জুড়েই প্রচুর মিলিটারি ব্যারাক খাড়া করা হয়েছিল। প্লেন ওঠা-নামার জন্য তৈরি হয়েছিল লম্বা লম্বা কংক্রিটের রানওয়ে। যুদ্ধের পর সেগুলো পোডড়া অবস্থায় ছিল। রাতারাতি রানওয়েগুলোর ধারে নতুন নতুন শেড বানানো হয়েছে। এগুলো হল উদ্বাস্তুদের ত্রাণশিবির। সাময়িক আশ্রয়স্থল। কলকাতার লেক অঞ্চল, নিউ আলিপুর, বিজয়গড়, ব্যারাকপুর, বেহালা ইত্যাদি এলাকা ছাড়াও বনগাঁ লাইনের দুধারে পাকিস্তানের বর্ডার অবধি কত যে রিলিফ ক্যাম্প খোলা হয়েছে তার লেখাজোখা নেই। শুধু কলকাতাকে ঘিরেই না, উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, মালদা, দিনাজপুর এবং ওদিকের ইস্ট পাকিস্তানের বর্ডার ঘেঁষেও রিলিফ ক্যাম্পের ছড়াছড়ি। হাজার হাজার ছিন্নমূল মানুষকে সেখানে তোলা হয়েছে। শুধু সরকারের একার পক্ষে এত বড় দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সঙ্, মানোয়াড়ি রিলিফ সোসাইটি ইত্যাদি নানা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ত্রাণের কাজ করে চলেছে। দিবারাত্রি। ক্লান্তিহীন। এখন পর্যন্ত রিলিফ ক্যাম্পের যে সংখ্যাটি পাওয়া গেছে তা হল এক শ এগার। জবরদখল কলোনির কোনও হিসেব নেই। কলকাতার ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত বড় বড় জমিদার বাড়ি, আদ্যিকালের জনহীন, জঙ্গলে ছেয়ে যাওয়া বিশাল বিশাল ইমারত কিছু বাকি নেই। উদ্বাস্তুরা সর্বত্র জুড়ে বসছে। যশোর রোড, বি.টি. রোডের ধারের বাগানবাড়ি, পোডড়া জমি, নিচু জলা-ফাঁকা জায়গা পেলেই ঝাঁকে ঝকে উদ্বাস্তুরা দখল করে নিচ্ছে। মাথা তুলছে বাঁশের বেড়া আর টালি বা টিনের চালের সৃষ্টিছাড়া উপনিবেশ। সারা পশ্চিমবঙ্গ যেন এক বিশাল শরণার্থী শিবির এবং উদ্বাস্তু কলোনি। এতেও সবার জায়গা হয়নি। শিয়ালদা এবং কলকাতার আশেপাশের রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মগুলোতে তো বটেই, নদীয়ায় মালদায় দিনাজপুরে চব্বিশ পরগনায় কত মানুষ যে খোলা আকাশের নিচে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে রোদে পুড়ে, অঝোর বর্ষায় ভিজে বা হিমঋতুর অসহ্য ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে অবধারিত মৃত্যুর দিন গুনে চলেছে তাদের সংখ্যা কী বিরাট, কে জানে।

একটা তথ্য আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল বিনয়ের। একদা অখণ্ড বাংলার তিনভাগের এক ভাগ পড়েছে পশ্চিমবঙ্গে। আগে থেকেই জনসংখ্যার বিপুল চাপ ছিল। তার ওপর দেশভাগের পর পর এর মধ্যেই কুড়ি বাইশ লক্ষ মানুষ এসে পড়েছে। আসার বিরাম নেই। রিফিউজি স্পেশাল বোঝাই হয়ে বোজই আসছে। খুলনা আর যশোর থেকে পায়ে হেঁটে সড়ক ধরেও অনেকে আসছে দলে দলে। পশ্চিমবঙ্গের দিকে এই জনস্রোত কোনওদিন থামবে বলে মনে হয় না।

খণ্ডিত বাংলার এই অংশে এত মানুষের পাকাপাকি বাসস্থান কীভাবে হবে, ভেবে ভেবে তলকূল পায় না বিনয়। সেদিন শিয়ালদা সাউথ থেকে বেরিয়ে আসা মিছিলগুলোর ছবি তার মাথায় স্থির হয়ে আটকে আছে। যে-সব স্লোগান তারা দিচ্ছিল তা ভুলে যায়নি। বরং তাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছে। উদ্বাস্তুদের আশঙ্কা, তাদের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে পাঠানো হবে। একদিন এই নিয়ে প্রসাদ লাহিড়িকে প্রশ্নও করেছে। প্রসাদ বলেছিলেন, আসাম, ত্রিপুরা এবং বিহারের নানা জেলা ছিন্নমূল মানুষে ভরে গেছে। সব জায়গায় এর মধ্যেই গোলমাল শুরু হয়েছে। সানস অফ দা সয়েল অর্থাৎ স্থানীয় বাসিন্দারা চায় না আরও রিফিউজি সেখানে গিয়ে জুড়ে বসুক। প্রচণ্ড অসন্তোষ ওই তিন রাজ্যে দানা বাঁধছে। অবশ্য সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট ওড়িশা সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছে। ওড়িশায় যে নেটিভ স্টেটগুলো ভারতের সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়ে এদেশের সঙ্গে মিশে গেছে, তারা কিছু উদ্বাস্তুকে জমি দিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে দিতে রাজি। তবে কবে শরণার্থীদের পাঠানো হবে তা এখনও ঠিক হয়নি। শুধু কথাবার্তার স্তরেই তা আটকে আছে।

বিনয় কখনও কখনও নিজের মনে ভেবেছে, ভারতবর্ষ তো বিশাল, দেশ। কত বড় বড় প্রদেশ এখানে। সেন্ট্রাল প্রভিন্স, বোম্বে প্রেসিডেন্সি, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি, কর্ণাটক, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি। এই প্রভিন্সগুলো খানিকটা খানিকটা উদ্ধৃত্ত জমি যদি বাঙালি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য দিত, সমস্যার হয়তো একটা সুরাহা হয়ে যেত। প্রসাদকে এ-সব বলা হয়নি।

মিশন রোতে পুলিশের সঙ্গে উদ্বাস্তুদের সংঘাতের দৃশ্যই কদিন বারে বারেই বিনয়ের চোখের সামনে ফুটে উঠেছে। এই সর্বস্ব খোয়ানো মানুষগুলোর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ, ক্রোধ এবং প্রচণ্ড রোষের যে বাষ্প জমা হয়েছে সেদিন তার সামান্য একটু নমুনা দেখা গিয়েছিল। প্রসাদের অনুমানশক্তি প্রখর। তার ধারণা, উদ্বাস্তুদের ঠিকমতো পুনর্বাসন না হলে একদিন বিস্ফোরণ ঘটে যাবে। সেদিন তাদের যে হিংস্র চেহারা বিনয় দেখেছিল তাতে তার মনে হয়েছে, প্রসাদ ভবিষ্যতের ছবিটা নির্ভুল দেখতে পেয়েছেন।

.

৫০.

আজ পশ্চিমবঙ্গের প্রিমিয়ার ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় নতুন ভারত পত্রিকার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। কর্তৃপক্ষ আগেই সার্কুলার জারি করেছিলেন, প্রতিটি কর্মী যেন সকাল নটার ভেতর অফিসে হাজির হয়।

ঘুম থেকে উঠে চান টান সেরে চা জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়ল বিনয়।

সকালের দিকে অফিস টাইম শুরু হবার আগে অবধি কলকাতার রাস্তাটাস্তা মোটামুটি ফাঁকা থাকে। নটার একটু আগে আগেই তাদের অফিসে পৌঁছে গেল বিনয়।

শীতের শহরের ঘুম ভাঙে বেশ দেরি করে। তারপরও খানিকক্ষণ আলস্যে কেটে যায়। সেই সব পর্বের পর সবেমাত্র কিছু কিছু ব্যস্ততা শুরু হয়েছে।

নতুন ভারত-এর অফিসটাকে আজ আর চেনা যায় না। প্রথম যেদিন বিনয় আনন্দর সঙ্গে চাকরিতে জয়েন করতে এসেছিল তখন গোটা ছাদ জুড়ে বাঁশের ফ্রেম বাঁধার কাজ চলছে। এখন সেখানে ত্রিপল দিয়ে ঘিরে পুরোদস্তুর মস্ত একখানা প্যাণ্ডেল তৈরি হয়ে গেছে।

গোটা অফিস বিল্ডিংটা ঝেড়ে মুছে তকতকে ঝকঝকে করে তোলা হয়েছে। একতলা থেকে ছাদ পর্যন্ত প্রতিটি সিঁড়ির দুধারে ফুলের টব। রাস্তায় গেটের সামনে ফুল আর পাতা দিয়ে তৈরি উঁচু তোরণ। কাল রাতে বিনয় যখন বাড়ি যায় এ-সব চোখে পড়েনি। সে আঁচ করে নিল, বাকি রাত এই সব সাজানো গোছানোর কাজ চলেছে। বাইরে তোরণের পাশে একটা উঁচু অস্থায়ী নহবতখানা বসানো হয়েছে। এক সানাইওলা তার অন্য বাজনদারদের নিয়ে একটানা বাজিয়ে চলেছে। হালকা নিচু সুরে।

সব মিলিয়ে পুরো অফিস জুড়ে তুমুল চাঞ্চল্য। উৎসব উৎসব ভাব। ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে বিনয়ের চোখে পড়ল, কম্পোজিটর থেকে শুরু করে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের কর্মী, মেশিনম্যান, সাংবাদিক, কেউ বাকি নেই। সবাই তটস্থ ভঙ্গিতে থোকায় থোকায় দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ খুব নিচু গলায় কথা বলছে।

অফিসে জয়েন করার পর ছাদে কখনও আসেনি বিনয়। আজই প্রথম উঠল।

প্যাণ্ডেলের খুঁটিগুলো লাল নীল কাপড়ে মোড়া। সেগুলোর গায়ে ফুলের স্তবক আটকানো। একেবারে শেষ প্রান্তে উঁচু মঞ্চ। সেটার মাথায় সাটিনের চাদোয়া। পুরো মঞ্চটা প্রচুর ফুল লতাপাতা দিয়ে সাজানো। মঞ্চের সামনের দিকে সারি সারি চেয়ার পাতা। বোঝাই যায় সেগুলো বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট।

প্যাণ্ডেলের একধারে লাল-পাড় ধবধবে শাড়ি পরা পনেরো কুড়িটি কিশোরীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। মনে হয় এই এলাকার কোনও স্কুলের ছাত্রী। তাদের কারও হাতে পেতলের রেকাবিতে প্রচুর ঝুরো ফুল। কারও হাতে শাঁখ। এই মেয়েরা কী করবে, এখানে তাদের ভূমিকাটা কীসের, সঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

নিউজ এডিটর তারাপদ ভৌমিক, চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়ি আর জেনারেল ম্যানেজার আদিনাথ চক্রবর্তী কোথাও যাতে বিশৃঙ্খলা না ঘটে সেদিকে নজর রাখছিলেন। হাঁকডাক করে অফিসের কর্মীদের এটা সেটা ফরমাশ করছেন।

বিনয়কে দেখতে পেয়ে তারাপদ ভৌমিক কাছে ডেকে বললেন, ঠিক সময়েই এসে গেছ। জগদীশবাবু তার স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে ডাক্তার রায়কে আনতে গেছেন। দশটায় ওঁরা এসে যাবেন। কিছুক্ষণের মধ্যে গেস্টরা আসতে শুরু করবেন। তোমরা রিপোর্টিং সেকশানের-মণিলাল রমেন সুধেন্দু আর তুমি অতিথিদের ওপরে এনে বসাবে। ওই যে ওরা দাঁড়িয়ে আছে– মঞ্চের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিলেন তারাপদ। সেখানে মণিলালদের দেখা গেল। তাদেরও ডেকে একই কথা তো বললেনই, পাখিপড়ার মতো বুঝিয়ে দিলেন, আমন্ত্রিতরা সমাজের বিশিষ্ট সব মানুষ–বিজনেসম্যান, শিল্পপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, অ্যাড এজেন্সির হর্তাকর্তা, পুরানো স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজসেবী ইত্যাদি–তাদের সসম্মানে, অত্যন্ত বিনীতভাবে যেন অভ্যর্থনা জানানো হয়।

বিনয়রা নিচে নেমে তোরণের পাশে এসে অপেক্ষা করতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী আসছেন। তাই পুলিশের একটা জিপে একজন অফিসার আর চারজন কনস্টেবল কখন যেন এসে অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বিনয় যখন ছাদে, খুব সম্ভব সেই সময় পুলিশের এই ছোট্ট বাহিনীটি এসে পজিশন নিয়েছিল।

সাড়ে নটা থেকে অতিথিরা আসতে শুরু করলেন। সুধেন্দু আর মণিলাল অনেক বছর কলকাতার খবরের কাগজে কাজ করছে। এই শহরের বহু বিখ্যাত মানুষকে চেনে। তারা বলছিল, ইনি ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, ইনি ওমুক কাগজের সম্পাদক, ইনি মুক্তিসংগ্রামে অংশ নিয়ে ইংরেজ রাজত্বে পনেরো বছর জেল খেটেছেন, ইনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির নামকরা অধ্যাপক, ইত্যাদি। এঁদের অনেকের নাম বিনয়ের জানা, এই প্রথম তাদের স্বচক্ষে দেখল।

মণিলাল আর সুধেন্দু কখনও নিজেরাই অতিথিদের সঙ্গে করে সসমে ছাদে নিয়ে গিয়ে বসাচ্ছে, কখনও রমেন আর বিনয়কে দিয়ে ওপরে পাঠাচ্ছে।

দশটা যখন বাজতে চলেছে সেই সময় তারাপদ ভৌমিক, প্রসাদ লাহিড়ি আর আদিনাথ চক্রবর্তী ছাদ থেকে নিচে নেমে এলেন। সঙ্গে সেই কিশোরী ছাত্রীদের দঙ্গলটা। তারাপদ তোরণের দুধারে মেয়েদের লাইন দিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে পঁড় করিয়ে দিলেন।

ডাঃ রায় নতুন ভারত-এর অফিসে আসছেন, খবরটা হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। তাকে দেখার জন্য চারদিক থেকে ঝাঁকে ঝাকে মানুষ এসে জড়ো হতে শুরু করেছে। রাস্তায়, ফুটপাথে রীতিমতো ভিড় জমে গেছে। তবে পুলিশ কারওকে তোরণের কাছাকাছি ঘেঁষতে দিচ্ছে না। লাঠি উঁচিয়ে হাঁকাহাঁকি করে জনতাকে তফাতে থাকতে বলছে।

কাঁটায় কাঁটায় দশটায় দুটো ফোর্ড গাড়ি তোরণের সামনে এসে থামে। একটা গাড়ি থেকে শশব্যস্তে নেমে আসেন জগদীশ গুহঠাকুরতা, ধবধবে ফর্সা মধ্যবয়সিনী একজন মহিলা এবং খুব সুশ্রী একটি তরুণী।

মহিলাটির সাজসজ্জায় এতটুকু বাড়াবাড়ি নেই। পরনে বুটিদার টাঙ্গাইল শাড়ি। দুহাতে শাখা পলা এবং সোনার কঙ্কণ। গলায় তেঁতুলপাতা হার। কপালে মস্ত বড় সিঁদুরের টিপ। শরীরে সামান্য মেদ জমেছে। ঘন কালো চুলের ফাঁকে ফাঁকে দুচারটে রূপোলি তার। মুখখানা ভারী কোমল। গৃহলক্ষ্মী বলতে চোখের সামনে যে স্নিগ্ধ ইমেজটা ফুঠে ওঠে, অবিকল তাই। তরুণীটির চোখেমুখে মহিলার আদল পুরোপুরি বসানো। তার চেহারা ছিপছিপে, মেদহীন। পরনে সিল্কের শাড়ি। চুল একবেণী করে পিঠের ওপর ফেলে রাখা। বাঁ হাতে সোনার ব্যাণ্ডে ঘড়ি আর গলায় সরু চেন ছাড়া বাড়তি গয়না টয়না নেই। দুই ভুরুর মধ্যিখানে ছোট মেরুন রঙের টিপ। দেখামাত্র আন্দাজ করা যায়–মা আর মেয়ে।

বিনয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল সুধেন্দু। কানে মুখ ঠেকিয়ে ফিস ফিস করে, জগদীশবাবুর স্ত্রী আর মেয়ে।

এমনটাই ভেবেছিল বিনয়। সে আস্তে মাথা হেলিয়ে দিল।

এদিকে জগদীশ গুহঠাকুরতা দ্রুত অন্য গাড়িটার পেছনের দরজা খুলে দিয়ে হাতজোড় করে। বলেন, আসুন স্যার

গাড়ির ভেতর থেকে যিনি বেরিয়ে এলেন তার ছবি খবরের কাগজের পয়লা পাতায় প্রায় রোজই থাকে। হয় কোনও অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছেন, বা প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন, কিংবা এয়ারপোর্টে বিদেশি কোনও রাষ্ট্রনায়ককে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। খুবই পরিচিত মুখ। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কে সামনাসামনি এই প্রথম দেখল বিনয়। সতেজ, সটান, দীর্ঘ চেহারা। চুল বিরল হয়ে এসেছে। চওড়া কপাল। পরনে ধুতি, ফুলশার্টের ওপর কোট, পায়ে পাম্প শু।

ম্যাট্রিকুলেশনে বাংলা পাঠ্য বইতে কার একটা লেখায় শালপ্রাংশু মহাভুজ এই ওজনদার শব্দদুটো ছিল। হঠাৎ তা মনে পড়ে গেল বিনয়ের।

বিধান রায় সম্পর্কে রাজদিয়ায় থাকতে কত বিচিত্র কাহিনি শুনেছে সে। সেগুলো প্রায় রূপকথা। তার মতো ধন্বন্তরি ভূভারতে দ্বিতীয়টি নেই। যে রোগীকে সবাই খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছে, বিন্দুমাত্র আশা ভরসা নেই, কোনওরকমে ধরে করে ডাঃ রায়ের কাছে নিয়ে যেতে পারলে সে খাড়া হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলা, শুধু পূর্ব বাংলাই বা কেন, সারা ভারতবর্ষ থেকে মর মর রোগীদের নিয়ে তাদের আত্মীয়স্বজনেরা তাঁর বাড়ির সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকত। বেঁচে থাকতে থাকতেই তাকে নিয়ে কত লিজেণ্ড। সেই বিধানচন্দ্র শক্ত হাতে হাজার সমস্যায় ভেঙে-পড়া, ধ্বস্ত, বিপন্ন পশ্চিমবাংলার হাল ধরেছেন। পলকহীন তার দিকে তাকিয়ে আছে বিনয়। তার তাকানো, দাঁড়ানো, গম্ভীর মৃদু হাসি–সব কিছুর মধ্যে রয়েছে প্রখর ব্যক্তিত্ব।

সানাইওলা নিচু গতে এতক্ষণ বাজাচ্ছিল। হঠাৎ সুরটা এক ঝটকায় অনেক উঁচুতে তুলে ফেলল। লাল-পাড় শাড়ি পরা সেই কিশোরীদের একটা দল শাঁখে ফুঁ দিতে লাগল মুহূর্মুহু। অন্য দলটা ডাঃ রায়ের দিকে ফুল ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে থাকে।

ডাক্তার রায় যে গাড়িটায় এসেছেন সেটার ফ্রন্ট সিট থেকে নেমে মাঝবয়সী একটি লোক ছুটতে ছুটতে তার কাছে চলে এলেন। খুব সম্ভব তার একান্ত সচিব।

জগদীশ গুহঠাকুরতা বিধান রায়কে অফিসের ভেতরে নিয়ে যান। তাদের পেছন পেছন বাকি সবাই সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ওপরে উঠতে থাকে। অনেকটা শোভাযাত্রার ধরনে। ছাদে প্যাণ্ডেলের একটা চেয়ারও ফাঁকা নেই। ডাঃ রায় সেখানে যাবার সঙ্গে সঙ্গে অতিথিরা সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ালেন।

জগদীশ গুহঠাকুরতা তার স্ত্রী, মেয়ে এবং নতুন ভারত-এর অন্য সব কর্মকর্তারা ডাঃ রায়কে উঁচু মঞ্চে নিয়ে যান। বিশাল মঞ্চটার মাঝামাঝি ভেলভেটে মোড়া সিংহাসনের মতো একটা বড় চেয়ার। সামনে টেবল। মঞ্চের পেছন দিকে আরও কয়েকটা চেয়ার, সাধারণ গদিওলা। এক ধারে আরও একটা ছোট টেবল। সেটার সামনে মাইক।

জগদীশরা ডাঃ রায়কে বড় চেয়ারটায় নিয়ে বসান। তিনি বসলে অতিথিরাও ধীরে ধীরে বসতে শুরু করেন।

মঞ্চে জগদীশ, তার স্ত্রী, মেয়ে, তারাপদ ভৌমিক, প্রসাদ লাহিড়ি, আদিনাথ চক্রবর্তী এবং নতুন ভারত-এর বিভিন্ন বিভাগের সম্পাদক, নানা ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার যাঁরা উঠে গিয়েছিলেন তারা কিন্তু বসেন না। মেরুদণ্ড টান করে দাঁড়িয়ে থাকেন।

জগদীশ এবার ছোট টেবলের সামনে গিয়ে মাইকে বলতে লাগলেন, অনুষ্ঠান শুরু করার আগে পশ্চিমবঙ্গের রূপকার পরম শ্রদ্ধেয় ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কে পুষ্পস্তবক দিয়ে সংবর্ধনা জানানো হবে। স্তবকটি দেবে আমাদের প্রেস বিভাগের কর্মী দেবেন্দ্রনাথ মল্লিকের কন্যা কুমারী সুরমা মল্লিক। আমি সুরমাকে মঞ্চে ডাকছি।

অপার বিস্ময়ে প্যাণ্ডেলের এক ধারে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ করছিল বিনয়। কোনওদিন কি সে কল্পনা করতে পেরেছিল, এমন একটা ঘটনা তার জীবনে ঘটবে? এত সব বিখ্যাত মানুষের কাছাকাছি সে আসতে পারবে? একবার মনে হচ্ছে, কেউ যেন অলীক স্বপ্নের ভেতর তাকে ফেলে দিয়ে গেছে। পরক্ষণে মনে হয়, সে এই বিশাল অনুষ্ঠানেরই অংশ। কত রকমের অনুভূতি যে তার হচ্ছে! শিহরন। উত্তেজনা। আনন্দ। খুব ভাল লাগছে জগদীশের ঘোষণাটি শুনে। নিজের মেয়ে বা স্ত্রীকে দিয়ে ফুলের স্তবক ডাঃ রায়কে দেওয়াতে পারতেন। দেননি। তাদের বাদ দিয়ে সামান্য এক প্রেস কর্মীর মেয়েকে ডেকেছেন। ভদ্রলোকের হৃদয়টা সত্যি বেশ বড় মাপের।

লাল-পাড় শাড়ির জটলা থেকে একটি মেয়ে বিশাল ফুলের তোড়া হাতে মঞ্চে উঠে আসে। কুমারী সুরমা মল্লিক। সুন্দরী, জড়তাহীন। চোখে মুখে নিষ্পাপ সারল্য। ডাঃ রায়কে তোড়া দিয়ে সুরমা তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। হাসিমুখে সস্নেহে তিনি তার সঙ্গে দুএকটি কথা বলেন। সুরমা তারপর আর দাঁড়ায় না, মঞ্চ থেকে নেমে আসে। এদিকে সারা প্যাণ্ডেল হাততালিতে ফেটে পড়ে।

মাইকের সামনে থেকে জগদীশ ততক্ষণে সরে গেছেন। তারাপদ ভৌমিক এগিয়ে এসেছেন। কে একজন ব্যস্তভাবে একটা হারমোনিয়াম ছোট টেবলের ওপর সযত্নে রেখে দিয়ে যায়। তারাপদ মাইকের কাছে মুখ এনে বলেন, এবার উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইবে কুমারী পারমিতা গুহঠাকুরতা। বলেই পেছনে চলে যান।

মঞ্চের অন্য প্রান্ত থেকে হারমোনিয়ামের কাছে চলে আসে জগদীশ গুহঠাকুরতার মেয়ে। নিজের মেয়ে গাইবে, সেটা বলতে হয়তো সংকোচ হয়েছে জগদীশের। তাই তারাপদকে দিয়ে ঘোষণাটা করিয়েছেন।

মনে মনে ধাক্কা খায় বিনয়। পরিবারের কেউ ডাঃ রায়ের নজর কাড়ার জন্য কিছু একটা করবে না, তাই কখনও হয়? তাছাড়া অতিথিদের মধ্যে বিশিষ্ট নামকরা সব মানুষরা রয়েছেন। শেষ অবধি তাদের সামনে নিজেদের তুলে ধরার এমন একটা সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি জগদীশ। পৃথিবীতে কে আর এক শ ভাগ উদার বা মহৎ? আত্মপ্রচার বা পরিজনদের প্রচার কে না চায়? এটাই হয়তো নিয়ম।

কিন্তু হারমোনিয়ামের রিডে আঙুল চালিয়ে পারমিতা গান-ধরতেই মুহূর্তে বিনয়ের মনের খিচটা উধাও হয়ে যায়। চিরকালের সেই মৃত্যুঞ্জয় সঙ্গীত-বন্দে মাতরম্।

ডাঃ রায় উঠে দাঁড়িয়েছেন। তার দেখাদেখি মণ্ডপের প্রতিটি মানুষও।

পারমিতা মগ্ন হয়ে গাইছিল

 বন্দেমাতরম
 সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাং শস্য শ্যামলাং মাতরম্।
শুভ্র জ্যোৎস্না পুলকিত যামিনীং..

আশ্চর্য সতেজ, সুরেলা কণ্ঠ পারমিতার। এমন গলাতেই এই গান মানায়। শুদ্ধ মন্ত্রের মতো প্যাণ্ডেলের সীমানা ছাড়িয়ে তা ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

ছাদেও সুধেন্দু বিনয়ের পাশে। সে কানে কানে বলল, এই গানটা বিধানবাবুর ভীষণ প্রিয়।

গান শেষ হলে সবাই বসে পড়ল। ফের জগদীশ মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। মাননীয় ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, উপস্থিত বিশিষ্ট সুধীজনেরা, আপনারা আমাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আজ যে এখানে এসেছেন সেজন্য নতুন ভারত-এর তরফ থেকে সবাইকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।

আপনারা সবাই জানেন, আমরা একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করতে চলেছি। প্রশ্ন উঠতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষায় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত এবং জনপ্রিয় কাগজ রয়েছে, তবু কেন আরও একটি নতুন পত্রিকার কী প্রয়োজন? এই প্রসঙ্গে সবিনয়ে জানাই, স্বাধীনতার পর মানুষের পড়ার অভ্যাস দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে নানা বিষয়ে আগ্রহ। রাজনীতি, ধর্ম, খেলাধুলো, বিজ্ঞান, সিনেমা, থিয়েটার, সারা বিশ্বের নানা ঘটনা প্রবাহ-সব ব্যাপারেই তাদের অত্যন্ত কৌতূহল। তাছাড়া দেশভাগের কারণে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত। সেগুলো পাঠকের কাছে যথাযথ তুলে ধরা দরকার। অন্যান্য পত্রিকাগুলো যে তা করেছে না তা নয়। তাদের প্রতিযোগী হিসেবে নয়, সহযোগী হিসেবে একত্রে এই কাজ চালাতে চাই। খবরের নামে অর্ধসত্য বা বানানো গল্প নয়, প্রকৃত সত্যকেই আমরা প্রকাশ করব।

আমাদের কাগজের ট্রায়াল রান চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। আজও ছাপা হয়েছে, তবে সেগুলো সাধারণ পাঠকের জন্য নয়। কাল থেকে নতুন ভারত নিয়মিত বাজারে বেরুতে থাকবে। পরম শ্রদ্ধেয় ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কে তার প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততার মধ্যেও যে আমাদের মধ্যে পেয়েছি, সেজন্য কৃতার্থ বোধ করছি। আমাদের একান্ত অভিপ্রায় ছিল ডাঃ রায়কে পত্রিকার বিভিন্ন বিভাগ ঘুরিয়ে দেখাব। কিন্তু তার সময়াভাবের জন্য আজ তা সম্ভব হচ্ছে না। এগারোটা পনেরোয় রাইটাস!?য়ে তার মন্ত্রিসভার একটি জরুরি মিটিং আছে। তাকে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে। তাই এবার আমাদের ইচ্ছা পূরণ হল না। আশা করি, ভবিষ্যতে আবার লাভ করব।

যাই হোক, ডাঃ রায়ের কাছে আমাদের বিনীত নিবেদন, আজকের অনুষ্ঠানের জন্য যে কাগজ ছাপা হয়েছে, অনুগ্রহ করে তা উদ্বোধন করে দুএকটি কথা বলুন।

বক্তব্য শেষ করে জগদীশ মাথা সামান্য হেলিয়ে তারাপদ ভৌমিককে কিছু একটা ইঙ্গিত করলেন। মঞ্চের পেছন দিকের একটা চেয়ারে লাল রিবনে বাঁধা একটি সুদৃশ্য প্যাকেট পড়ে ছিল। তারাপদ ত্বরিত পায়ে সেটা এনে ডাঃ রায়ের হাতে দিলেন। ডাঃ রায় রিবন খুলে প্যাকেটের ভেতর থেকে নতুন ভারত-এর একটি কপি বার করে দর্শকদের দিকে তুলে ধরলেন।

ফের প্যাণ্ডেল জুড়ে হাততালির আওয়াজ। কাগজটা টেবলে রেখে উঠে দাঁড়ান ডাঃ রায়। এর ভেতর তারাপদ মাইকটা টেনে তার সামনে নিয়ে এসেছেন।

ডাঃ রায় বলতে শুরু করলেন, নতুন একখানা কাগজ বেরুচ্ছে। খুব ভাল কথা। কিছু ছেলের চাকরি বাকরি হয়েছে। কাগজ চললে আরও অনেকের কাজের সুযোগ হবে।

জগদীশ জানিয়েছে প্রকৃত সত্য ছাপাবে। সেটাই বাঞ্ছনীয়।

সকলেরই জানা আছে, পশ্চিমবঙ্গ মহা সংকটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। এখনকার জ্বলন্ত সমস্যা হল–উদ্বাস্তু। পূর্ব পাকিস্তান থেকে রোজই শরণার্থীরা এপারে চলে আসছে। তাদের পুনর্বাসন, রুজিরোজগারের ব্যবস্থা করা–এই নিয়ে সরকার ব্যতিব্যস্ত। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।

একটা কথা মনে রাখা দরকার, খবরের কাগজের বিরাট দায়িত্ব। এমন কিছু যেন ছাপা না হয় যাতে সীমান্তের এপারে ওপারে উত্তেজনার সৃষ্টি হতে পারে। তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি।

প্রতিটি কাগজের নিজস্ব মতামত থাকে। থাকাই স্বাভাবিক। সরকারি কাজকর্মের যদি কিছু ত্রুটি হয়, সমালোচনা নিশ্চয়ই করতে হবে, কিন্তু তা যেন অতি অবশ্যই গঠনমূলক হয়।

আশা করি, নতুন ভারত নিষ্ঠার সঙ্গে সামাজিক দায়িত্ব পালন করবে। নমস্কার

সংক্ষিপ্ত ভাষণ শেষ করে আর বসলেন না ডাঃ রায়। মঞ্চ থেকে নেমে সোজা সিঁড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন।

জগদীশ গুহঠাকুরতা টেবল থেকে ফুলের তোড়াটা নিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে চললেন। পেছনে বাকি সবাই।

নিচে এসে ডাঃ রায়কে গাড়িতে তুলে দিয়ে ফুলের তোড়াটা তার একান্ত সচিবের হাতে দিলেন জগদীশ।

ডাঃ রায়কে নিয়ে তার গাড়ি কংক্রিটে মোড়া সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ ধরে মসৃণ গতিতে ছুটে যায়। সেদিকে তাকিয়ে থাকে বিনয়। মহাবৃক্ষের মতো বিশাল একটি মানুষ তার মনে গভীর ছাপ ফেলে যান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *