তৃতীয় পরিচ্ছেদ
শ্রীরামকৃষ্ণ ও কর্ম — তাঁহার ব্রহ্মজ্ঞানের অবস্থা
ভক্ত — ব্রাহ্মসমাজের লোকেরা বলেন, সংসারের কর্ম করা কর্তব্য। এ-কর্ম ত্যাগ করলে হবে না।
গিরিশ — সুলভ সমাচারে ওইরকম লিখেছে, দেখলাম। কিন্তু ঈশ্বরকে জানবার জন্য যে সব কর্ম — তাই করে উঠতে পারা যায় না, আবার অন্য কর্ম!
শ্রীরামকৃষ্ণ ঈষৎ হাসিয়া মাস্টারের দিকে তাকাইয়া নয়নের দ্বারা ইঙ্গিত করিলেন, ‘ও যা বলছে তাই ঠিক’।
মাস্টার বুঝিলেন, কর্মকাণ্ড বড় কঠিন।
পূর্ণ আসিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কে তোমাকে খবর দিলে!
পূর্ণ — সারদা
শ্রীরামকৃষ্ণ (উপস্থিত মেয়ে ভক্তদের প্রতি) — ওগো একে (পূর্ণকে) একটু জলখাবার দাও তো।
এইবার নরেন্দ্র গান গাইবেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভক্তেরা শুনিবেন। নরেন্দ্র গাইতেছেন:
গান – পরবত পাথার।
ব্যোমে জাগো রুদ্র উদ্যত বাজ।
দেব দেব মহাদেব, কাল কাল মহাকাল,
ধর্মরাজ শঙ্কর শিব তার হর পাপ।
গান – সুন্দর তোমার নাম দীনশরণ হে,
বহিছে অমৃতধার, জুড়ায় শ্রবণ, প্রাণরমণ হে।
গান – বিপদভয় বারণ, যে করে ওরে মন, তাঁরে কেন ডাক না;
মিছে ভ্রমে ভুলে সদা, রয়েছ, ভবঘোরে মজি, একি বিড়ম্বনা।
এ ধন জন, না রবে হেন তাঁরে যেন ভুল না,
ছাড়ি অসার, ভজহ সার, যাবে ভব যাতনা।
এখন হিত বচন শোন, যতনে করি ধারণা;
বদন ভরি, নাম হরি, সতত কর ঘোষণা।
যদি এ-ভবে পার হবে, ছাড় বিষয় বাসনা;
সঁপিয়ে তনু হৃদয় মন, তাঁর কর সাধনা।
পল্টু — এই গানটি গাইবেন?
নরেন্দ্র — কোন্টি?
পল্টু — দেখিলে তোমার সেই অতুল প্রেম-আননে,
কি ভয় সংসার শোক ঘোর বিপদ শাসনে।
নরেন্দ্র সেই গানটি গাহিতেছেন:
দেখিলে তোমার সেই অতুল প্রেম-আননে,
কি ভয় সংসার শোক ঘোর বিপদ শাসনে।
অরুণ উদয়ে আঁধার যেমন যায় জগৎ ছাড়িয়ে,
তেমনি দেব তোমার জ্যোতিঃ মঙ্গলময় বিরাজিলে,
ভকত হৃদয় বীতশোক তোমার মধুর সান্ত্বনে।
তোমার করুণা, তোমার প্রেম, হৃদয়ে প্রভু ভাবিলে,
উথলে হৃদয় নয়ন বারি রাখে কে নিবারিয়ে?
জয় করুণাময়, জয় করুণাময় তোমার প্রেম গাইয়ে,
যায় যদি যাক্ প্রাণ তোমার কর্ম সাধনে।
মাস্টারের অনুরোধে আবার গাইতেছেন। মাস্টার ও ভক্তেরা অনেকে হাতজোড় করিয়া গান শুনিতেছেন।
গান – হরিরসমদিরা পিয়ে মম মানস মাতোরে।
একবার লুটহ অবনীতল, হরি হরি বলি কাঁদ রে।
(গতি কর কর বলে)।
গভীর নিনাদে হরিনামে গগন ছাও রে,
নাচো হরি বলে দুবাহু তুলে, হরিনাম বিলাও রে।
(লোকের দ্বারে দ্বারে)।
হরিপ্রেমানন্দরসে অনুদিন ভাস রে,
গাও হরিনাম, হও পূর্ণকাম, নীচ বাসনা নাশ রে।।
গান — চিন্তয় মম মানস হরি চিদঘন নিরঞ্জন।
গান — চমৎকার অপার জগৎ রচলা তোমার।
গান – গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে।
গান — সেই এক পুরাতনে, পুরুষ নিরঞ্জনে, চিত্ত সমাধান কর রে।
নারাণের অনুরোধে আবার নরেন্দ্র গাইতেছেন:
এসো মা এসো মা, ও হৃদয়-রমা, পরাণ-পুতলী গো।
হৃদয়-আসনে, হও মা আসীন, নিরখি তোরে গো।।
আছি জন্মাবধি তোর মুখ চেয়ে,
জান মা জননী কি দুখ পেয়ে,
একবার হৃদয়কমল বিকাশ করিয়ে,
প্রকাশ তাহে আনন্দময়ী ৷৷
[শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিমন্দিরে — তাঁহার ব্রহ্মজ্ঞানের অবস্থা ]
নরেন্দ্র নিজের মনে গাইতেছেন:
নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে ও রূপরাশি।
তাই যোগী ধ্যান ধরে হয়ে গিরিগুহাবাসী ৷৷
সমাধির এই গান শুনিতে শুনিতে ঠাকুর সমাধিস্থ হইতেছেন।
নরেন্দ্র আর একবার সেই গানটি গাইতেছেন —
হরিরসমদরিরা পিয়ে মম মানস মাতোরে।
শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট। উত্তরাস্য হইয়া দেওয়ালে ঠেসান দিয়া পা ঝুলাইয়া তাকিয়ার উপর বসিয়া আছেন। ভক্তেরা চতুর্দিকে উপবিষ্ট।
ভাবাবিষ্ট হইয়া ঠাকুর মার সঙ্গে একাকী কথা কহিতেছেন। ঠাকুর বলিতেছেন — “এই বেলা খেয়ে যাব। তুই এলি? তুই কি গাঁট্রি বেঁধে বাসা পাকড়ে সব ঠিক করে এলি?”
ঠাকুর কি বলিতেছেন, মা তুই কি এলি? ঠাকুর আর মা কি অভেদ?
“এখন আমার কারুকে ভাল লাগছে না।”
“মা, গান কেন শুনব? ওতে তো মন খানিকটা বাইরে চলে যাবে!”
ঠাকুর ক্রমে ক্রমে আরও বাহ্যজ্ঞান লাভ করিতেছেন। ভক্তদের দিকে তাকাইয়া বলিতেছেন, ‘আগে কইমাছ জীইয়ে রাখা দেখে আশ্চর্য হতুম; মনে করতুম এরা কি নিষ্ঠুর, এদের শেষকালে হত্যা করবে! অবস্থা যখন বদলাতে লাগল তখন দেখি যে, শরীগুলো খোল মাত্র! থাকলেও এসে যায় না, গেলেও এসে যায় না!”
ভবনাথ — তবে মানুষ হিংসা করা যায়! — মেরে ফেলা যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, এ-অবস্থায় হতে পারে[1]। সে অবস্থা সকলের হয় না। — ব্রহ্মজ্ঞানের অবস্থা।
“দুই-এক গ্রাম নেমে এলে তবে ভক্তি, ভক্ত ভাল লাগে!
“ঈশ্বরেতে বিদ্যা-অবিদ্যা দুই আছে। এই বিদ্যা মায়া ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায়, অবিদ্যা মায়া ঈশ্বর থেকে মানুষকে তফাত করে লয়ে যায়। বিদ্যার খেলা — জ্ঞান, ভক্তি, দয়া, বৈরাগ্য। এই সব আশ্রয় করলে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো যায়।
“আর-একধাপ উঠলেই ঈশ্বর — ব্রহ্মজ্ঞান! এ-অবস্থায় ঠিক বিধ হচ্চে — ঠিক দেখছি — তিনিই সব হয়েছেন। ত্যাজ্য-গ্রাহ্য থাকে না! কারু উপর রাগ করবার জো থাকে না।
“গাড়ি করে যাচ্ছি — বারান্দার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখলাম দুই বেশ্যা! দেখলাম সাক্ষাৎ ভগবতী — দেখে প্রণাম করলাম!
“যখন এই অবস্থা প্রথম হল, তখন মা-কালীকে পূজা করতে বা ভোগ দিতে আর পারলাম না। হলধারী আর হৃদে বললে, খাজাঞ্চী বলেছে, ভট্চাজ্জি ভোগ দিবেন না তো কি করবেন? আমি কুবাক্য বলেছে শুনে কেবল হাসতে লাগলাম, একটু রাগ হল না।
“এই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে তারপর লীলা আস্বাদন করে বেড়াও। সাধু একটি শহরে এসে রঙ দেখে বেড়াচ্চে। এমন সময়ে তার এক আলাপী সাধুর সঙ্গে দেখা হল। সে বললে ‘তুমি যে ঘুরে ঘুরে আমোদ করে বেড়াচ্চো, তল্পিতল্পা কই? সেগুলি তো চুরি করে লয়ে যায় নাই?’ প্রথম সাধু বললে, ‘না মহারাজ, আগে বাসা পাকড়ে গাঁট্রি-ওঠরি ঠিকঠাক করে ঘরে রেখে, তালা লাগিয়ে তবে শহরের রঙ দেখে বেরাচ্চি’।” (সকলের হাস্য)
ভবনাথ — এ খুব উঁচু কথা।
মণি (স্বগত) — ব্রহ্মজ্ঞানের পর লীলা-আস্বাদন! সমাধির পর নিচে নামা!
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারাদির প্রতি) — ব্রহ্মজ্ঞান কি সহজে হয় গা? মনের নাশ না হলে হয় না। গুরু শিষ্যকে বলেছিল, তুমি আমায় মন দাও, আমি তোমায় জ্ঞান দিচ্ছি। ন্যাংটা বলত, ‘আরে মন বিলাতে নাহি’!
[Biology — ‘Natural law’ in the Spiritual world]
“এ অবস্থায় কেবল হরিকথা লাগে; আর ভক্তসঙ্গ।
(রামের প্রতি) — “তুমি তো ডাক্তার, — যখন রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে এক হয়ে যাবে তখনই তো কাজ হবে। তেমনি এ অবস্থায় অন্তরে-বাহিরে ঈশ্বর। সে দেখবে তিনিই দেহ মন প্রাণ আত্মা!”
মণি (স্বগত) — Assimilation!
শ্রীরামকৃষ্ণ — ব্রহ্মজ্ঞানের অবস্থা! মনের নাশ হলেই হয়। মনের নাশ হলেই ‘অহং’ নাশ, — যেটা ‘আমি’ ‘আমি’ করছে। এটি ভক্তি পথেও হয়, আবার জ্ঞানপথে অর্থাৎ বিচারপথেও হয়। ‘নেতি নেতি’ অর্থাৎ ‘এ-সব মায়া, স্বপ্নবৎ’ এই বিচার জ্ঞানীরা করে। এই জগৎ ‘নেতি’ ‘নেতি’ — মায়া। জগৎ যখন উড়ে গেল, বাকী রইল কতকগুলি জীব — ‘আমি’ ঘট মধ্যে রয়েছে!
“মনে কর দশটা জলপূর্ণ ঘট আছে, তার মধ্যে সূর্যের প্রতিবিম্ব হয়েছে। কটা সুর্য দেখা যাচ্ছে?”
ভক্ত — দশটা প্রতিবিম্ব। আর একটা সত্য সূর্য তো আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — মনে কর, একটা ঘট ভেঙে দিলে, এখন কটা সূর্য দেখা যায়?
ভক্ত — নয়টা; একটা সত্য সূর্য তো আছেই।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, নয়টা ঘট ভেঙে দেওয়া গেল, কটা সূর্য দেখা যাবে?
ভক্ত — একটা প্রতিবিম্ব সূর্য। একটা সত্য সূর্য তো আছেই।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) — শেষ ঘট ভাঙলে কি থাকে?
গিরিশ — আজ্ঞা, ওই সত্য সূর্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ — না। কি থাকে তা মুখে বলা যায় না। যা আছে তাই আছে। প্রতিবিম্ব সূর্য না থাকলে সত্য সূর্য আছে কি করে জানবে! সমাধিস্থ হলে অহং তত্ত্ব নাশ হয়। সমাধিস্থ ব্যক্তি নেমে এলে কি দেখেছে মুখে বলতে পারে না!
——————–
১ … ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে [গীতা, ২।২০]