1 of 3

৪৬. সন্তৰ্পণে দরজাটি খুলল

৪৬

মাঝরাতে যখন সন্তর্পণে দরজাটি খুলল নিমাই তখন তার চোখভরা জল। এত জল যে, চোখে কিছু ঠাহর করার উপায় নেই। তার ওপর কুয়াশা বড় জমাট। তেমনি জমাট অন্ধকার। সব যেন গলাগলি করে এসে দাঁড়িয়েছে আজ এক সঙ্গে। ঘরে একটা লণ্ঠন জ্বলছে টিমিয়ে। বিছানায় বীণাপাণি কেমন একটু এলোমেলো হয়ে শুয়ে। নিমাই আজ ওই বিছানায় শোয়নি। জলচৌকিতে বসে রইল। কত মশা কামড়েছে তাকে সে টেরও পায়নি আজ। মনের জ্বালা প্রবল হলে শরীরের জ্বলা ডুবে যায়। এই যে বীণাপাণি তাকে বিদেয় দিল, আর কি কখনও ফিরে আসতে পারবে নিমাই? আর হয়তো দেখাই হবে না, কটা বিলিতি টাকার জন্য এতকালের একটা সম্পর্ক ভেঙে দিতে বীণার বাধল না! দুনিয়াটা এই রকম করেই একটু একটু চিনতে হবে তাকে।

এক ধাপ মোটে সিঁড়ি, তার পরই উঠোন। অন্ধের মতোই আন্দাজে সিঁড়িতে পা রাখল নিমাই। দু’ চোখে আজ যেন বান ডেকেছে। বুকটা বড় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে। বড্ড অভিমান হচ্ছে তার। বড় অপমানও লাগছে। বড় দুঃখ হচ্ছে। দরজাটা খুব চুপিসাড়ে, বিনা শব্দে ভেজিয়ে দিল নিমাই। ঘুমোও গো, মনের সুখে ঘুমোও। এইরকমধারা একদিন বিষ্ণুপ্রিয়াকে রেখে নিমাই সন্ন্যাস নিয়েছিল। সে কত সুখের ছেড়ে-যাওয়া। আর এ নিমাই যে যাচ্ছে তার বড় অনাদর। বড়। গঞ্জনা।

উঠোনে পা ফেলতেই পায়ের তলা থেকে কী যেন একটা হড়কে সরে গেল সড়াৎ করে। সাপখোপ নেই এখানে? থাকলে দিক না ঠুকে। ল্যাটা চুকে যাক। মরা মুখটা দেখুক বীণাপাণি। বুকে পড়ে কাঁদুক।

কিন্তু মানুষের মনের মতো করে কবে কি ঘটেছে? সাপও যদি হয়ে থাকে সে ব্যাটাচ্ছেলেও। কামড়াল না নিমাইকে। পালাল। চোখের জলটা গামছা দিয়ে চেপে মুছল নিমাই। সামনেটা বড় আঁধার। কুয়াশা এত চেপে বসেছে যে, হাতখানেকের বেশী নজর যায় না। কোন দিকে যে আগড়, রাস্তা যে কোন দিকে তা বুঝে ওঠা মুশকিল। রাত আর একটু কাবার করে বেরোলে হত।

একটা কুকুর হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠল কোথা থেকে। বাড়ির কুকুরই হবে। কামড়ায় যদি তো কামড়াক। নিমাইয়ের আর ভয় কিসে?

কুয়াশা বটে তবে ঠাণ্ডা তেমন নেই। একটু সিরসিরে ভাব আছে। টপ টপ করে বেশ বড় বড় ফোঁটায় শিশির পড়ছে গাছপালায়। শিউলির গন্ধ ছেড়েছে খুব।

তাদের একখানা মাত্র টর্চ আছে। সেটা সঙ্গে নিলে নিমাইয়ের একটু সুবিধে হত। কিন্তু বীণাপাণির টর্চ বীণাপাণির জন্যই রেখে এসেছে সে। বনগাঁর বাড়িতে তার স্যুটকেসখানা আছে। টিনের সস্তা জিনিস। কয়েকখানা মোটে জামাকাপড়। সেটারও আর কোনও দরকার নেই তার। মায়া বাড়িয়ে লাভ কি?

দোকান-টোকানের কথা ভেবে আর লাভ নেই। নিমাই জানে, এখন কিছুদিন তাকে গতর খাটিয়ে খেতে হবে। যোগালির কাজ হোক, মাটি কাটার কাজ হোক, ছুতোরের কাজ হোক, বেড়া বাঁধার কাজ হোক, কিছু না-কিছু জুটেই যায়। পরিশ্রমের কাজটা এখনও খুব একটা পেরে ওঠে না নিমাই। তবে গতর পুষে রাখলে তো আর চলবে না! পেটটা তার একার নয়, পালপাড়ায় দুটো অসহায় বুড়োবুড়ি আছে। বীণাপাণির কাছে নিমাই যদি ত্যাগ হয়ে থাকে তবে তারাও তো ত্যাগ হল!

মাঝ-উঠোনে দাঁড়িয়ে নিমাই দিক ঠাহর করার চেষ্টা করছে। আগু-পিছু, বাঁ-ডান সব সমান। কোন দিকে গেলে পথে পড়া যাবে বুঝতে পারছে না।

একটা ক্ষীণ ম্যাদাটে আলো হঠাৎ এসে নিমাইকে চমকে দিয়ে তার পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ল। ব্যাটারি ক্ষীণ, তবু একটু আলো তো! কুয়াশা ফুঁড়ে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে আলোটার। নির্জীব হয়ে পড়েছে এইটুকু ধকলেই।

খুব চাপা একটা গলা শোনা গেল, কে?

শ্বশুরমশাই। নিমাই একবার ভাবল, জবাব না দিয়ে চলে যাবে। আবার গুরুজন বলে। অবহেলাও করতে পারল না।

ক্ষীণ গলায় বলল, আমি নিমাই।

অ। পেচ্ছাপ করবে নাকি? ওই বাঁ দিকে কচুবনের দিকে গিয়ে সেরে এসো।

আজ্ঞে, ঘুম আসছিল না বলে এই একটু বেরিয়েছি।

বাতি নিয়ে বেরোতে হয়। ঘরে লণ্ঠন রাখেনি?

আজ্ঞে আছে।

ঘুম আসছে না কেন?

বায়ুটা চড়েছে বোধ হয়।

এ সময়টায় হিম পড়ে। এসসা, বারান্দায় উঠে এসো।

নিমাই ইতস্তত করল একটু। বসাটা ঠিক হবে কি? বেরোনোর মুখে এ একটা বাধাই পড়ল কি? কিন্তু বুড়ো মানুষটাকে এড়িয়ে যায়ই বা কি করে নিমাই? বরং একটু বসেই যাবে সে। রাতটা একটু পাতলা হোক।

নিমাই নিঃশব্দে বারান্দায় উঠলে বিষ্ণুপদ টর্চটা জ্বেলে একটা মোড়া দেখিয়ে দিয়ে বলল, বোস বাবা।

আপনি ঘুমোননি?

বুড়ো বয়সের ঘুমের কোনও ঠিক নেই। একদিন পেল্লায় ঘুম হল, তো আর একদিন একেবারেই হল না।

চারদিকে অন্ধকারে সাদা কুয়াশা। যেন দুধসাগরে ডুব দিয়ে আছে সব কিছু। নিমাই চুপ করে বসে রইল।

বিষ্ণুপদ মৃদু গলায় বলল, আজ আবার সেই স্বপ্নটা দেখলাম। সেই যে ঘুমটা চটকে গেল আর এল না।

দুঃস্বপ্ন নাকি?

খারাপই। তবে এই বয়সে আর কতই বা খারাপ হবে! কিন্তু বড় ভয় খাইয়ে দেয়। কালঘড়ি আমার ঠাকুদাও দেখেছিল কিনা!

কালঘড়ি? সে আবার কী জিনিস?

বিষ্ণুপদ ব্যথাতুর গলায় বলে, ঘড়ির বৃত্তান্তটাও অদ্ভুত। জন্মে ঘড়ি নিয়ে কারবার করিনি বাবা। গাঁ-গঞ্জের লোক আমরা, ঘড়ি লাগে কিসে? তবু যে কেন দেখি! সে তো ছোটখাটো জিনিস নয়। আকাশজোড়া মস্ত একটা ঘড়ি। যেন কূলকিনারা নেই তার। একটা বড় কাঁটা, আর একটা ছোট কাঁটা, তা তাও যেন আকাশে এ-মুড়ো ও-মুড়ো জুড়ে। কাঁটা দুটো এগুচ্ছে। বুঝলে! এগুচ্ছে।

নিমাই কিছু বুঝল না। তবে কিছু বলতে হয় বলে বলল, তা স্বপ্ন কত রকমেরই তো হয়।

তা হয়। তবে আমার ঠাকুর্দা এই স্বপ্নটা দেখার পর আর বাঁচেননি। এ বংশে ওটা একটা ব্যাপার বলতে পার। কালঘড়ি মানেই, হয়ে এল।

নিমাই এবার একটু ভাবিত হয়ে বলে, তবে তো মুশকিল।

মরতে তো তৈরিই আছি। তবে মরার আগেও কিছু ভাবনা-চিন্তা থাকে।

মরার কথা ভাবছেন কেন?

মরার কথা ভাবি না। ওটা ভাবনার বিষয়ই নয়। কথা কী জান? মরার সময় এলে মানুষের মনের মধ্যে একটা তাড়াহুড়ো পড়ে যায়। যেমন গাড়ি ধরার সময় মানুষের হয়, কোন্ পোঁটলাটা পড়ে রইল, কোনটা নেওয়া হল না, ছেলেপুলেগুলো সব উঠতে পারল কিনা, কুলির ভাড়া বেশী দেওয়া হল কিনা। বুঝেছে ব্যাপারটা? মরার সময়ও মানুষের ওরকমই হয়। কোনটা করা হল, কোনটা বাকি রইল। বুঝলে ব্যাপারখানা? এই মাঝরাত্তিরে বসে সেই সবই ভাবছি।

যে আজ্ঞে, বুঝেছি।

ঘুম আসছে না বলে ভাবনা নেই। সামনে লম্বা ঘুম। সে ঘুম এলে সব কূপিত বায়ু একেবারে ঠাণ্ডা। তাই জেগে বসে মশা তাড়াচ্ছি।

কথাটা ঠিকই বলেছেন। ভাবনারও যেন শেষ নেই। একটা যায় তো আর একটা আসে।

তুমি বুঝদার মানুষ। এই ভাবনা-চিন্তার কথাটা লোককে বোঝাতে পারি না। কত কি ভাববার আছে বলো তো দুনিয়ায়?

তা বটে।

ক’দিন আগেও এক রাত্তিরে কালঘড়ির স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই থেকে মাথাটা খুব বেগোছ হয়ে গেল। তোমার শাশুড়ি তো কাঁদাকাটাও শুরু করেছিলেন। কালঘড়ির লক্ষণটা সুবিধের নয় ঠিকই। তবে কী জাননা, ওই মরার ভাবনাটা আছে বলেই মানুষ ভাবনা-চিন্তাটা অন্তত করে।

কিন্তু আপনার আর চিন্তাটা কিসের বলুন! রামুদাদা বুক দিয়ে আগলে রেখেছে, অমন। পিতৃ-মাতৃভক্ত ছেলে দেখা যায় না। বড়দাদাও—বলতে নেই—মস্ত কেওকেটা মানুষ। ভাতকাপড়ের কষ্টটাও তেমন নয়। পালপাড়ায় আমার মা বাবার অবস্থাটা যদি এমন হত তা হলেও ভাবনার কিছু ছিল না।

বিষ্ণুপদ গলাটা আরও খাদে নামিয়ে বলল, তারা আছেন এখনও?

আছেন আজ্ঞে।

দু’জনেই?

দু’জনেই।

তুমি তো ভাগ্যবান বাবা। যত পারো বাঁচিয়ে রেখো। ওঁরা মহাগুরু।

দুধ-মাখানো অন্ধকারের দিকে চেয়ে নিমাই মিহিন গলায় বলল, ভাগ্য কি আর ওঁরা করে এসেছেন? বুড়ো বয়সটায় বড় কষ্ট যাচ্ছে। আমার অসুখের সময় ক’বিঘে জমি বিক্রি হয়ে গেল। এখন হাঁড়ির হাল। আমার যা হোক, ওঁরা কষ্ট পেলে বড় কষ্ট হয় আমার।

তোমরা কি কষ্টে আছ বাবা? কই, বীণার চেহারা দেখে তো মনে হয় না।

নিমাই একটু ফাঁপরে পড়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে, কষ্টও বটে, আবার তেমন কষ্ট নয়ও বটে।

মানেটা কি হল?

আমাদের মতো মানুষের তো পায়ের নিচে ডাঙা জমি থাকে না। এর-ওর দয়ায় বেঁচে থাকা।

এ কথাটার মানে বুঝছি না। খোলসা হও বাবা। কাকা না কে যেন একটা লোকের কথা শুনেছি। সে কেমন লোক?

সেই আমাদের ভগবান। অসময়ে বড় দেখেছে আমাদের। আজও দেখে। কিন্তু কপালটাই আমাদের নিমকহারাম।

কেন বাবা, কপালের দোষটা কী হল?

নিমাই ফের ফাঁপরে পড়ল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, সে অনেক কথা। আপনাকে বলতে পারব না।

বিষ্ণুপদ একটা শ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, আমি এখন গাছপালার মতো হয়ে গেছি। ইট-পাথরের মতো। যখন কওয়ার লোক পাবে না আমার কাছে বোলো। বুদ্ধি পাবে না বটে, কিন্তু বুক হালকা হবে।

যে আজ্ঞে। কথাটা মনে থাকবে।

তোমাকে আমি বীণার জন্য বেছেছিলাম কেন জানো?

নিমাই লজ্জা পেয়ে বলে, জানি।

বিষ্ণুপদ নিবিড় গলায় বলে, তোমার মুখে চোখে একটা কিছু ছিল। কত ভুল দেখি আমরা, ভুল বুঝি। তবু মনে হয়েছিল, নিমাইয়ের মধ্যে ভক্তি আছে। গরিব হোক কি যাই হোক, ভক্তি তো কম কথা নয়।

আমাকে আর লজ্জায় ফেলবেন না। ওসব শুনলেও পাপ হয়। এ যুগে ভক্তির কীই বা দাম বলুন!

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, দাম নেই। ভক্তি বিশ্বাস সব তামাদি টাকা। চলে না। তা আমার। দেখবার চোখটিও যে পুরনো, সেও তামাদি। এ যুগের চশমা ধার পেলে অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করতাম।

নিমাই বিনীতভাবে চুপ করে থাকে।

বিষ্ণুপদ বলে, গরিব মানুষ আমরা, বরাবর হা-ভাত জো-ভাত করে কেটেছে। তার ওপর ভিটেমাটি ছেড়ে এই ভিনদেশে এসে হাউড়ে পড়ে আরও খারাপ হাল হল। আমার ছেলেমেয়েরা সব দাঁতে কুটো দিয়ে বড় হয়েছে। কষ্ট করারই ধাত। তাই ভেবেছিলাম গরিবঘরে মেয়ে গেলে আর নতুন কষ্ট কিসের? পয়মন্ত হলে, ধার্মিক লোকের ঘর করলে ভালই থাকবে।

যে আজ্ঞে।

এখন দেখছি গোটা অঙ্কটাই ভুল হয়েছিল। কিন্তু এ অঙ্ক তো আর ফিরে কষা যায় না। দেখছি, তোমরা ভাল নেই। কেন নেই বাবা?

নিমাই গলাটা একটু সাফ করার চেষ্টা করে। কিন্তু ফের তার চোখ ভরে জল এসেছে। গলায় আটকে আছে শুকনো ভাতের ডেলার মতো কান্নার গিট। তার সময় লাগল।

আজ্ঞে, দোষটা তো আপনারও, আমারও। বীণা বোধ হয় আরও একটু ভাল পাত্র চেয়েছিল। আমাকে বাছা আপনার ঠিক হয়নি।

সে সবই তো ভাবি বাবা। ঠিক বেঠিক মিলেমিশে এমন গোলমালে ফেলে দেয়। বীণা আমার কাছে কী একটা গচ্ছিত রাখতে চায়, সেও বলে না কী, তুমিও কবুল করো না। মনে হয়, জিনিসটা খুব সাদা জিনিস নয়। একটু ভয়-ভীতির ব্যাপারও আছে।

আজ্ঞে আছে।

বিষ্ণুপদ একটু চুপ করে থেকে বলে, সেই জন্যই তোমাদের আসা?

বীণা জানে।

আমি জিনিসটা রাখব না বাবা। তোমার ভয় নেই। তোমার মুখ দেখেই বুঝেছি, জিনিসটা ধর্মের জিনিস নয়। হক্কেরও নয়।

আপনি বড় জ্ঞানী মানুষ।

বিষ্ণুপদ একটু হাসল, তোমার শাশুড়ি ঠাকরুণেরও তাই বিশ্বাস। আমি নাকি একটা জ্ঞানী। কী যে সব বলো তোমরা মাথামুণ্ডু!

বই-পড়া জ্ঞানের কথা বলিনি আজ্ঞে। কাণ্ডাকাণ্ডজ্ঞানের কথা বলছিলাম।

তাহলে ধরেছি ঠিক?

যে আজ্ঞে।

বড্ড শীত করছে আমার। তুমি বরং একটু মুড়িসুড়ি দিয়ে বোসো। এ সময়টায় বড্ড ঠাণ্ডা লেগে যায়। তোমার বুকটা তো আবার কমজোরি।

ঠাণ্ডা লাগছে না তেমন। ঠিক আছে।

তোমরা থাকবে ক’দিন?

নিমাই ঘাড় হেঁট করল। মিনমিন করে বলল, বীণা বোধ হয় কয়েক দিন থাকবে।

তুমি?

আমি সকালেই যাচ্ছি।

কাজকর্ম যখন নেই, তখন যাবেই বা কোথায়?

ছোটখাটো কাজের আশা আছে। বসে থাকলে চলবে না।

বীণা কি তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে?

তটস্থ হয়ে নিমাই বলে, আজ্ঞে না তো? ও কথা কেন বললেন?

বিষ্ণুপদ ফের একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে বলে, বউ যখন রোজগার করে তখন তার দারোগার মেজাজ হয়।

নিমাই ফের মিনমিন করে বলে, সেরকম কিছু নয়।

বিষ্ণুপদ একটু হেসে বলে, কেন দারোগার মতো মেজাজ হয় জানো?

আজ্ঞে না।

মেয়েদের তো রোজগার করার কথা নয়। করেওনি কোনওদিন। হঠাৎ আজকাল তাদের আয় হতে শুরু করেছে। তাই বড্ড দেমাক হয়।

নিমাই শুকনো একটু হাসল। কিছু বলল না।

বিষ্ণুপদ খুব দূরের গলায় বলে, তার ওপর যাত্রাপার্টি। সে বড় খারাপ জিনিস। অন্য সব ধরছি না। ওই যে ক্ল্যাপ পায়, আলো-বাজনা, হাজার জনের চোখের সামনে নিজেকে জাহির করা, ওর একটা অহংকার আছে। বড্ড দেমাক হয়। তখন মাটিতে পা পড়তে চায় না, মানুষকে মানুষ বলে মনে করতে ইচ্ছে হয় না। যাত্রা তো একটা মিথ্যে মায়ার জগৎ।

যে আজ্ঞে।

বীণাপাণি নিজেও কষ্ট পাবে। তোমাকেও দেবে।

নিমাই আবার চুপ। বুকের মধ্যে কান্নাটা ধাক্কা দিচ্ছে, উথলে আসতে চাইছে বমির মতো।

শোনো বাবা, আমি চোখে ভাল দেখতে পাই না। কিন্তু কানে ভালই শুনি।

নিমাই শঙ্কিত হয়ে পড়ল। কথাটার মানে কি? কী শুনেছেন উনি?

বিষ্ণুপদ মৃদুস্বরে বলে, যখন দরজা খুলে তুমি বেরোচ্ছিলে তখন আমি একটা কান্নার মতো মা শুনেছিলাম। ভুল নয় তো!

নিমাই চুপ করে থাকে।

বিষ্ণুপদ অনেকক্ষণ কিছু বলল না। ঝুম হয়ে বসে রইল। তারপর বলল, কান্না জিনিসটা পুরুশ মানুষের বড় সহজে আসে না বাবা।

নিমাই বুড়ো মানুষটির দিকে অন্ধকারে জলভরা চোখে চেয়ে রইল। তারপর কাঁপা গলায় বলল, বীণার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল বাবা। আমি যাচ্ছি।

বিষ্ণুপদ একটু নড়ল। জলচৌকিতে অসমান পায়ায় একটা শব্দ হল, ঢক।

বিষ্ণুপদ র‍্যপার জড়ানো মাথাটা নেড়ে বলে, বুঝেছি বাবা। ছেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু দিয়ে যাচ্ছে কাকে?

সে তো জানি না। বীণা বুঝবে।

ও কি বোঝে? বুঝলে আর কথা ছিল কি?

আমার বড় অপমান হচ্ছে। বীণা চাইছে না।

বিষ্ণুপদ আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমার নৌকো তো ঘাট ছাড়ার মুখে। ভাল মন্দ কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে বলি, তুমি বড় সচ্চরিত্রের ছেলে। সৎ থাকা বড় কঠিন।

নিমাই দু’হাতে মুখ ঢেকেছে। চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। অবরুদ্ধ ফোঁপানি উঠে আসছে গলায়। কুকুরটা হঠাৎ এ সময়ে খেকিয়ে উঠল দুবার।

দুনিয়া তার নিজের নিয়মে চলবে। কত লোক কত কী করে বেড়াচ্ছে। কে কার কড়ি ধারে? আমি কি পারি দুনিয়ার সব কিছু নিজের মতো ঘটিয়ে তুলতে? আমি তা করার কে?

এ কথার জবাব হয় না। জবাব দেওয়ার মতো অবস্থাও নয় নিমাইয়ের। সে কাঁদছে। বিষ্ণুপদ একটা হাত বাড়াল তার দিকে। কাঁপা-কাঁপা দুর্বল হাত। ছোঁওয়ার চেষ্টা করল তাকে। নাগাল পেল না। হাতটা ফের সরিয়ে নিল বিষ্ণুপদ।

নিমাইয়ের কান্না থামল হেঁচকি উঠে যাওয়ার পর। নিজেকে বড় ঘেন্না হতে থাকে নিমাইয়ের। সে বড় দুর্বল। তার মনের কিছুমাত্র জোর নেই। বীণাপাণি কি সাধে তাকে ম্যাদাটে পুরুষ বলে হ্যাটা করে? করাই উচিত।

বিষ্ণুপদ গলা খাঁকারি দিল খুব সন্তর্পণে। তারপর বলল, একটু জল খাবে বাবা?

আজ্ঞে না।

তোমার জন্য আমার যদি কিছু করার থাকত তো করতাম। কিন্তু আমি এখন দুনিয়ার বার। কিছু করতে পারি না, হাত পা কোলে নিয়ে বসে বসে দেখি। চোখের সামনে কত কী হয়ে যায়। আগে মনে হত এটা ভাল হল না, ওটা ঠিক হল না। আজকাল ভাবি, বিচার করার আমি কে? আমার কি। অত জ্ঞান বা বুদ্ধি আছে? দুনিয়াটা কি আমি চিনি? লোকে যা করছে করুক। ভাল মন্দ তারা। বুঝবে।

নিমাই কান্নার পর অবসাদ নিয়ে বসে আছে। শ্বশুরমশাইকে তার কোনওদিন খারাপ লাগে না। একটু আলগা মানুষ, কিন্তু বড় মিঠে মোলায়েম। কোনও উগ্রতা নেই। পৃথিবীতে চারদিকে বড় শক্ত শক্ত মানুষ। যেন তাদের কাঁটাওলা গা, জিবে দাঁতে ধার, চোখে যেন খুনির দৃষ্টি।

মাঝরাত্তিরে কোথায় যাচ্ছিলে বাবা?

আজ্ঞে, রওনা দিচ্ছিলাম।

এই মাঝরাতের অন্ধকারে?

মাঝরাতেই ভাল। সবাই জেগে গেলে নানা কথা উঠবে, জিজ্ঞাসাবাদ হবে, বাধা পড়বে।

তা ঠিক। তবে এখনও রাত মেলা আছে। একটু বসে যাও।

শ্বশুরমশাইয়ের দিকে চেয়ে দেখল নিমাই। অন্ধকারের মধ্যে কালো একটা অবয়ব মাত্র। মুখের ভাব তোবোঝা যায় না। লোকটার খুব মায়া আছে তার প্রতি। নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে।

বিষ্ণুপদ আর একটু ঝিম মেরে থেকে বলে, বীণা বনগাঁয়ে থাকতে চায় না কেন বলো তো? সে কি ওই জিনিসটার জন্যই?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

ওখানে কি ওর অনেক শত্রু?

কে জানে! ও ভয় পাচ্ছে।

তুমি পাও না?

না আজ্ঞে। আমার আর ভয় কিসের? পরের ধন নিয়ে তো বসে থাকিনি।

বীণার ভয় থাকলে তোমারও হয়তো আছে।

আজ্ঞে সেরকম ভয়ের কিছু আছে বলে তো মনে হয় না। আজকাল কে কি না করছে বলুন। চুরিধারি, খুনখারাপি সব করেই দিব্যি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কে কার বিচার করবে?

তা বটে।

তাই বলছি, সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে বীণারও ভয় নেই। তবু যদি ভয় খায় তো কিছু করার নেই।

তোমাকে কি বীণা ত্যাগ দিয়েছে?

নিমাই লজ্জিত হয়ে বলে, একরকম তাই।

কি জন্য?

ও ভাবছে ওর টাকার বান্ডিলের কথা আমি চাউর করে দেব। দুর্বল মানুষ, আমার পেটে কথা থাকে না। তাই।

এ বড় অদ্ভুত কথা!

নিমাই চুপ করে থাকে।

বিষ্ণুপদ বলে, কত টাকা হবে? লাখো লাখো নয় তো!

আজ্ঞে আমি জানি না। বিলিতি টাকা, হিসেব বড় খটোমটো। তবে মনে হয় বেশ মোটা টাকাই হবে। কথাটা বলে ফেললাম, হয়তো বীণা শুনলে রাগ করবে। তা করুক, আপনাকে জানানো উচিত বলে মনে হল।

বিষ্ণুপদ একটু চুপ করে থেকে বলে, আমারও একটা আন্দাজ ছিল। তুমি কিছু গুহ্য কথা ফাঁস করোনি। কেউ গচ্ছিত রেখেছিল?

যে আজ্ঞে। সে খুন হয়েছে। ওয়ারিশান নেই। ওই টাকার জন্য পরে আরও খুনখারাপি হয়। অনেক কাণ্ড।

টাকার জন্য তোমাকে ছাড়ছে বীণা!

যে আজ্ঞে। আমিও আর পেরে উঠছি না। মনটা বড্ড ভার হয়ে আছে।

বিষ্ণুপদ হঠাৎ টর্চটা একটু জ্বালল। তারপর নিরাসক্ত গলায় বলে, চলল, তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি একটু।

এগিয়ে দেবেন? বলে অবাক হয়ে নিমাই অবয়বটার দিকে চায়।

এগিয়ে দিই। পথটা অন্ধকার, তুমি হয়তো খুঁজেও পাবে না। চলো।

নিমাই উঠে পড়ে। বলে, আপনাকে যেতে হবে না। আমি পারব।

তুমি বুঝবে না বাবা। বীণার জীবনে তোমাকে তো আমিই এনেছিলাম। আজ ফের তোমাকে বিদায় দেওয়াও আমার একটা কর্তব্য। বোধন করলাম আর বিসর্জন দেবো না? চলল।

চোখে জল এল নিমাইয়ের। নিচু হয়ে সে হঠৎ একটা প্রণাম করল বিষ্ণুপদকে। তারপর বলল, চলুন তাহলে।

স্নান টর্চের আলোয় কুয়াশা আর অন্ধকারে একটা অনির্দিষ্ট পথরেখা ধরে দু’জনে পাশাপাশি এগোতে লাগল। মন্থর পা। মুখে কথা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *