1 of 2

৪৬. যে-কোনও কারণেই হোক

যে-কোনও কারণেই হোক বাবা হঠাৎ এই সময় দাদামশাইয়ের আশ্রয় ছেড়ে নিজের পৈতৃক গ্রামে চলে যাবার জন্য জেদাজেদি করতে লাগলেন। বাবা নিরীহ ও লাজুক ধরনের মানুষ, কারওর মুখের ওপর জোর দিয়ে কথা বলতে পারেন না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে বেশ গোঁয়ার। একবার কিছু একটা বলে ফেললে আর অন্যের কথায় মত পরিবর্তন করতেন না।

দাদামশাইয়ের ওখানে আমাদের কোনও অসুবিধেই ছিল না। দিব্যি খেতাম দেতাম, ঘুরে বেড়াতাম। তবু সেই অবস্থা বাবার কেন অসহ্য বোধ হল, তা সেই বয়সে আমার বোঝার কথা নয়। তখনও আমি টের পাইনি যে সমস্ত পৃথিবী একটি বিনিময় ব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এই বিনিময়ের মাধ্যম মানুষ আবিষ্কৃত টাকা নামক একটি বস্তু। এবং বেঁচে থাকার ব্যাপারটাকে বেশ চমকপ্রদ করার জন্য এই টাকার বণ্টন প্রণালীও বেশ ঘোরালো করে রাখা হয়েছে।

আমার মায়ের একেবারে ইচ্ছে ছিল না বাপেরবাড়ি ছেড়ে যাবার। শ্বশুরের ভিটে সম্পর্কে তার কোনও মোহ নেই। মা চেয়েছিলেন অন্তত আমার দিদির বিয়েটা ওখান থেকেই দিয়ে যেতে। পর পর ক’ রাত্তির আমি মাঝ রাত্রে ঘুম ভেঙে শুনতাম বাবা ও মায়ের ঝগড়া। বাবা ও মা দুজনেই এত ভালো–অথচ সেই সময় চাপা গলায় বিষাক্ত ভাবে হিসহিস করছেন। দিনেরবেলা ওঁরা যাঁদের সঙ্গে অনেক হেসে কথা বলেন, এখন তাঁদের সম্পর্কেই কত রাগের খারাপ খারাপ কথা বেরিয়ে আসছে। বড়দের মনের মধ্যে কত রকম গোপন কথা থাকে। আমি ঘুমের ভান করে নির্জীব হয়ে শুয়ে থেকে সব শুনতাম।

ঝগড়ার সময় আমার মায়ের যুক্তি বেশি ছিল না, অভিমানী কান্নাই ছিল প্রধান অস্ত্র। কটু অভিমানের সঙ্গে মা বলতেন, তোমার হাতে পড়ে সারা জীবন শুধু কষ্ট পেলাম! এতই যদি কষ্ট দেবে, তা হলে বিয়ে করেছিলে কেন?

বাবা তিক্ত গলায় উত্তর দিয়েছিলেন, আমি তা হলে আত্মহত্যা করি। তারপর তুমি তোমার ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপেরবাড়িতে সুখে থাকো!

শেষ পর্যন্ত বাবার জেদই বজায় রইল। একদিন আমরা বাক্স-প্যাটরা নিয়ে আবার নৌকোয় চড়ে বসলাম। মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলি আমাদের পৌঁছে দিয়ে আসবে।

যে-কোনও নতুন জায়গাতে যাবার ব্যাপারেই একটা উত্তেজনা থাকে সেই বয়সে। আমি নৌকোর গলুইয়ের কাছে উৎসুক হয়ে বসেছিলাম সামনে দিকে চেয়ে। ছইয়ের ভেতরে মা আর বাবা। অনেকক্ষণ কান্নাকাটির পর মায়ের মুখখানা থমথমে। বাবা উদাসীন ভাবে একটার-পর-একটা সিগারেট ধরিয়ে যাচ্ছেন। দিদি গোড়া থেকেই পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে।

খাল-বিল-নদী পেরিয়ে চলেছে নৌকো। মনে হচ্ছে, এ-যাত্রার বিরাম নেই। যত দূর দেখা যায়, শুধু জল। মাথার ওপরে শীতকালের পরিষ্কার আকাশ। আমার ঠিক চোখের সামনেই নাদের আলি লগি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। তার খালি-গা, নিকষ কালো রং, তেল চকচকে সবল দীর্ঘ দেহ, মনে হয় যেন মাঝে মাঝে তার মাথাটা আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। তাকে কোনও কথা জিজ্ঞেস করলেই সে ঝকঝকে সাদা দাতে হাসে। যেন একটা চমৎকার ছবি।

আমি আমার নিজের বাড়িতে যাচ্ছি। নাদের আলি এই কথা বলেছে, বাবাও বলেছেন। এতদিনে এইটুকু বুঝেছি, কলকাতায় বড়বাবুর বাড়ি কিংবা এখানে মামাবাড়ি–আমাদের নিজের বাড়ি নয়। আরও ছেলেবেলায় মাটি কিংবা বালি দিয়ে যে-বাড়ি বানাতাম–তা ছাড়া আমার আর কোনও নিজের বাড়ি দেখিনি। একটা অদম্য কৌতূহলে ছটফট করছিলাম।

সত্যিকারের নিজের বাড়িতে পৌঁছে একটু চুপসে গেলাম। জরাজীর্ণ নৈরাশ্যময় পরিবেশ। এবাড়ি অনেক দিন পরিত্যক্ত। বাবার এক দূর সম্পর্কের মামার ওপর দেখাশুনোর ভার। তিনি বাড়ির এলাকার গাছের ফলমূল ভোগ করার জন্য যতটা দেখাশুনো করা দরকার, তা করতেন। আমরা খবর না দিয়ে হঠাৎ এসে পড়ায় তিনি বাবাকে বকাবকি করতে লাগলেন। খবর পেলে তিনি ঘরদোর অন্তত পরিষ্কার করে। রাখতেন।

অবস্থা দেখে মা খুব মুষড়ে পড়লেন। দিদি আদুরে মেয়ের মতন নাকেকান্না কঁদতে লাগল। আমি দৌড়োদৌড়ি করে সব জায়গাটা ঘুরে দেখতে লাগলাম একলা একলা। আমাদের দেখবার জন্য গাঁয়ের বেশ কিছু লোক ভিড় করে এসেছিল।

মায়ের প্রধান চিন্তা নাদের আলিকে নিয়ে। নাদের আলি ফিরে গিয়ে যদি এই রকম অবস্থার কথা বলে দেয়, তা হলে মামাবাড়ির সবাই খুব দুশ্চিন্তা করবে, দাদামশাই হয়তো আবার ফিরিয়ে নেবার জন্য লোক পাঠাবেন। বাবা তখন আবার কী কাণ্ড বাধাবেন কে জানে। মা সেই জন্য নাদের আলিকে খুব খাতিরযত্ন করতে লাগলেন, নগদ পাঁচটা রুপোর টাকা তার হাতে দিয়ে বললেন, নাদের, গিয়ে বলো আমরা সবাই ভালো আছি। আমরা এখন আমাদের এক মামাশ্বশুরের বাড়িতে থাকব–তারপর বাড়িঘর সারিয়ে টারিয়ে–চিন্তার কিছু নেই, তুমি বুঝিয়ে বোলো! কেমন?

নাদের আলিকে আমি আবার নৌকোর ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম। নৌকোয় ওঠার আগে নাদের আলি দু হাতে আমার কোমর ধরে উঠিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে আবার লুফে নিয়ে আদর করল। তারপর বলল, ঠাকুরভাই, আবার আইসো। এবার তোমারে। আমি ঠিক তিন প্রহরের বিলে নিয়া যাব।নাদের আলির সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। সে তার কথা রাখেনি। যে-কোনও চেনা মানুষ চলে গেলে আমার চোখে জল আসে।

ফুলপুরে প্রথম কয়েক দিন আমাদের ভালোই কেটেছিল। আমরা নতুন মানুষ, আমাদের গায়ে তখনও কলকাতার ছোঁয়াচ আছে, সুতরাং আমাদের সম্পর্কে অনেকেই আগ্রহী। প্রায়ই নানান বাড়িতে নেমন্তন্ন পাই। আর সে কী খাওয়া! এক থালা-ভরতি ভাত শেষ না করে কেউ উঠতেই দেয় না। কাধ ধরে জোর করে বসিয়ে রাখে। সেই ভাত কোনওক্রমে শেষ করলেও তারপর আবার নতুন গুড়ের পায়েস খেতেই হবে। খাওয়ার পর মনে হয়, না আঁচিয়ে সেখানেই শুয়ে পড়ি।

এক মাস-দেড় মাসের মধ্যেই অবশ্য এইসব কৌতূহল স্তিমিত হয়ে যায়। তখন আমরা শুধু নিজেদের নিয়ে একলা। বাবা, মা, দিদি আর আমি। এর আগে আমরা সব সময়ই বেশ বড় বাড়িতে অনেক লোকের সঙ্গে থেকেছি বলে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিলাম। এখন ছোট নিরালা বাড়িতে আমরা সবাই কাছাকাছি, যেন পরস্পরকে নতুন করে চিনে নিচ্ছি। মাকে দেখি সারা দিন রান্না করতে, বাবা গভীর ভাবে বসে থাকেন, দিদি জল তলে, কাপড় কাঁচে আর এ-পাড়া ও-পাড়া ঘুরে বেড়ায়।

এখানেই আমি নানা জনের কাছ থেকে টুকরো টুকরো ভাবে শুনি, আমার পূর্বপুরুষদের গল্প। আমার ঠাকুরদা, তিন ঠাকুমা, আর বিশ্বরঞ্জন কাকার চমকপ্রদ জীবনী, পূর্ণিমা পিসিমার বিয়ের কেলেঙ্কারির কথাও অনেকেই এখনও ভোলেনি। ভারী আশ্চর্য লাগে, সেই সব মানুষ সবাই মরে গেছে কবে, তবু তাদের গল্প এখনও বেঁচে আছে। আমি ওঁদের কারোকেই দেখিনি, তবু যেন দেখতে পাই। ওই বাতাবি লেবুর গাছটার তলায় বসে আমার ঠাকুরদা তামাক খেতেনবাগানের মধ্যে ভাঙা ঘরটায় আমার ছোটকাকা মূর্তি বানাতেন–আমি সেই সব জায়গায় দাঁড়াই–আর আমার গা শিরশির করে, শরীরের মধ্যে যেন টের পাই পূর্বপুরুষের রক্তস্রোতযদিও প্রত্যেক মানুষের জন্মই এক একটি আকস্মিক ঘটনা মাত্র। মা যখন রাগের মাথায় বাবাকে বলেন, তুমি আমায়। বিয়ে করলে কেন, তখন মায়ের মনে থাকে না যে তা হলে আমি বা দিদি জন্মাতাম না। অথচ সব মা-ই নিজের সন্তানকে সমস্ত প্রবৃত্তি দিয়ে ভালোবাসে। মানুষের জীবন এই রকমই অযৌক্তিক।

ঘন ঘন জায়গা বদলাবার ফলে আমি বন্ধুহীন হয়ে পড়ছিলাম। ফুলপুরে আমার তেমন কোনও বন্ধু হল না। বছর শেষ হয়নি বলে স্কুলেও ভরতি হইনি। আমি একা একা ঘুরে ঘুরে এক এক দিন এক একটা বাগান বা পুকুর বা পাটখেত আবিষ্কার করতাম। যা কিছু আমায় কেউ আগে থেকে চিনিয়ে দেয়নি, সেগুলোই আমার নিজস্ব মনে হত। আমার সেই অধিকারের জগতে আমি আপন মনে কথা বলতাম আমার পুরনো বন্ধুদের, সঙ্গে। কলকাতার কথা খুব মনে পড়ত, বিষ্ণু, জীমূত, রেণু ওদের যেন ঠিক চোখের সামনে দেখতে পেতাম। এক একদিন সূর্যদার সঙ্গেও আপন মনে কথা বলেছি। কল্পনায় দেখতাম, জেলখানায় গরাদের ও-পাশে সূর্যদা একটা হাফপ্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। ভীষণ রাগী থমথমে মুখ। সূর্যদা নিশ্চয়ই কোনও এক সময় জেলখানা ভেঙে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু তার আগেই যদি সূর্যদার ফঁসি হয়ে যায়?

একদিন একটা বাগানে অনেকগুলো লেবুগাছ দেখলাম। বড় বড় গন্ধরাজ লেবু ফলে আছে। লেবুফুল আমি আগে কখনও দেখিনি। সেই লেবুফুলের গন্ধ শুকতে গিয়ে হঠাৎ আমার হৈমন্তী কাকিমার কথা মনে পড়ল। একরাশ চুলের মধ্যে হৈমন্তী কাকিমার মুখখানা ঠিক গন্ধলেবুর ফুলেরই মতন। বড় লেবুর গায়ের মতন তার থুতনি। হৈমন্তী কাকিমা আমাকে বললেন, বাদল, আমি জীবনে কিছু পাইনি। আমি কথাটার মানে বুঝতে পারলাম। হৈমন্তী কাকিমা আবার বললেন, আমি জীবনে কিছু পাইনি। আমার বুক দুলে উঠল। আমি লেবুফুলের দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার জন্য আমি সবকিছু এনে দেব।

একদিন ঘুরতে ঘুরতে একটা খুব পুরনো বড় বাড়ির কাছে চলে গিয়েছিলাম। বাড়িটাতে কোনও মানুষজন নেই। আমি এক পা-দু পা করে ঢুকতে যাচ্ছি হঠাৎ পাশের বাগান থেকে একটা রোগা চিমসে মতন লোক বেরিয়ে এসে বলল, খোকা, যেয়ো না। ও বাড়িতে ভূত আছে। শুনে আমার মনে হল, ওই লোকটাই ভূত। আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালালাম।

তা ছাড়া, আর একটা জিনিস এখানে লক্ষ করার মতন। মামাবাড়ির গ্রামের তুলনায় এই গ্রামে অবস্থাপন্ন লোকের সংখ্যা কম। নিম্নমধ্যবিত্ত বা গরিবই বেশি হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের সংখ্যাধিক্য–যে দু-চার বড়লোক আছেন, তারাও মুসলমান। শিক্ষিত চাকুরিজীবী হিন্দুরা তখন থেকেই কলকাতামুখী। অনেক বনেদি বাড়ি প্রায় খালি পড়ে আছে–কর্তারা দোল দুর্গোৎসবে একবার করে বেড়াতে আসে।

ফুলপুরে এসে আমি খুব তাড়াতাড়ি বয়স্ক হয়ে গেলাম। আমার নানা রকম অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হতে লাগল।

এখানেই প্রথম ভালো ভাবে টের পেলাম, হিন্দু আর মুসলমান দুটো আলাদা জাত– এদের মধ্যে মেলামেশা বারণ। যে-সব মুসলমান আমাদের বাড়িতে আসে, তারা উঠোনে এসে দাঁড়ায়, কক্ষনও বারান্দায় বসে না। অর্থাৎ তাদের বসতে দেওয়া হয় না। কারওর কাছ থেকে কিছু কিনলে পয়সা দেওয়া হয় আলগোছে। তাদের মুখে লেগে থাকে একটা বিগলিত ভাব। সাধারণ কথাবার্তায় আমরা অনেককে চাচা কিংবা সাহেব বলি, মুখে বেশ মিষ্টি কথা থাকলেও ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে সবকিছু। হিন্দুরা আড়ালে মুসলমানদের সম্পর্কে এমন ভাবে কথা বলে যেন ওরা মানুষের অধম। ওরা চোর, ওরা হিংস্র, ওরা নোংরা। সাপ আর মুসলমানদের কখনও বিশ্বাস করতে নেই। হিন্দুদের নিজেদের মধ্যেও হাজার রকমের জাতবিচার, ছোঁয়াছুঁয়ি, ব্যবধান–কিন্তু মুসলমানদের সম্পর্কে সবাই একমত। যত গরিব বাড়ি, তত বেশি উগ্রতা। আমার মামাবাড়িতে এ রকম দেখিনি, সম্ভবত সেখানে হিন্দু আধিপত্য এত বেশি ছিল যে মুসলমানদের প্রতি দয়া দেখানো সহজ ছিল।

মুসলমানরা আলাদা পাড়ায় থাকে, তাদের জীবনযাত্রা অন্য রকম। কখনও কখনও রাস্তা সংক্ষেপ করার জন্য মুসলমানদের বাড়ির পাশ দিয়ে গেছি–মাথা নিচু করে নিঃশব্দে রাস্তাটুকু পার হতে হয়েছে–সে বাড়ির লোকেরাও নিঃশব্দে চেয়ে থেকেছে, কেউ কোনও কথা বলেনি। আড়চোখে দেখে নিই, তাদের বাড়ির উঠোনে মুরগির পাল দৌড়োদৌড়ি করে, বাচ্চারা ছাইগাদায় গড়ায়, ওদের বাড়ির মেয়েরা খড়ম পায় দেয়, সব জায়গায় কেমন যেন একটা রসুন রসুন গন্ধ।

মুসলমানরা বাড়িতে মুরগি পোষে–এটা বাঙালি হিন্দুর চোখে একটা ঘৃণার ব্যাপার। হিন্দুর বাড়িতে হাঁস থাকে–সেই হাঁসের ডিমও খাওয়া হয়, কিন্তু মুরগির মাংস বা ডিম একেবারে নিষিদ্ধ। হাঁস আর মুরগির ডিমের মধ্যে দুটি আলাদা ধর্ম কী ভাবে প্রবাহিত হচ্ছিল–সে-প্রশ্ন কারওর মনে জাগেনি। তখনও হিন্দুরা পোলট্রির ব্যবসায়ে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। কলকাতায় এক ভটচাজ বামুন জুতোর দোকান খুলেছিল বলে সবাই অবাক। আমাদের পাড়ায় একবার একটা শজারু মারা হয়েছিল, সেই শজারুর মাংস রান্না করে খাওয়া হয়েছিল খুব আহ্লাদের সঙ্গে। কিন্তু গ্রামে কোনও হিন্দু বাড়িতে মুরগির মাংস রান্না ছিল অকল্পনীয়।

সাধারণ মুসলমানরা হিন্দুদের সম্পর্কে আড়ালে কী মন্তব্য করত, তা আমার জানার কথা নয়। হিন্দুদের সম্পর্কে তাদেরও একই রকম ঘৃণার ভাব থাকার কথা। তবে পথেঘাটে হিন্দুদের সঙ্গে দেখা হলে তারা কথা বলত একটু বিনীত ভাবে। একবার শুধু একজন মুসলমানের বাড়ির পাশ দিয়ে আসবার সময় একজন মাঝবয়সি লোক আমাকে চোখ রাঙিয়ে বলেছিল, এই বামনা, ফের এদিক দিয়ে যাবি তো ঠ্যাং খোঁড়া কইর্যা দেব!

আমি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। আমি তো কোনও দোষ করিনি। এ বাড়ির ছাইগাদায় একটা টোপাকুল গাছে অসংখ্য বড় বড় কুল হয়ে আছে–একবার ভেবেছিলাম সেই কুল কয়েকটা লুকিয়ে পেড়ে নেব কিন্তু সরস্বতী পুজোর আগে আমার কুল খাওয়া নিষেধ, তাই লোভ সংবরণ করেছি। তবু এ-লোকটা আমাকে বল কেন?

আমি তেরিয়া হয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, কেন?

লোকটি উঠে এসে চেঁচিয়ে বলল, ভালো চাস তো পালা, নয়তো একখানা চোপড় (থাপ্পড়) দেব!

আমি লোকটির নিষ্ঠুর মুখের দিকে তাকালাম। কয়েক শতাব্দীর ভুল বোঝাবুঝির মাঝখানে আমরা দুজনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তাই আমার মনে হচ্ছিল, লোকটি বিনা কারণে আমাকে অপমান করছে। এবং লোকটি ভাবছিল, আমার ঠাকুরদার বাবার দোষে আমাকেই শাস্তি দেওয়া উচিত। সে-দিন লোকটি আমাকে খুন করে ফেললেও সেটি একটি ইতিহাসসম্মত ব্যাপারই হত।

হিন্দুদের মুখে মুখে তখন কাশেম আলির নাম খুব ঘুরত। কাশেম আলি তখন ওই তল্লাটে মুসলিম লিগের পাণ্ডা–এবং সে পাকিস্তান নামক একটা আজব জিনিস সম্পর্কে আবোলতাবোল বলে যাচ্ছে। ১৯৪০-এ লাহোর প্রস্তাব পাস হয়ে যাবার পরও অধিকাংশ হিন্দুই পাকিস্তান শব্দটির সঙ্গেও তখন পরিচিত নয়। কিন্তু মুসলমানেরা কাশেম আলির কথা বেশ মনে দিয়ে শুনছে। তার ফলে দু’-একটা ছোটখাটো ঘটনা ঘটতে লাগল। হাটেবাজারে মাঝে মাঝে হিন্দুরা মুসলমানদের হাতে মার খায়। হিন্দুরা প্রথম বুঝতে পারল, নাক-উঁচু ভাব নিয়ে থাকলেও তারা সংখ্যায় কম। জমিদারি আমল টলটলায়মান, নতুন যুগ এসেছে, ভোটাভুটির যুগ। এই ভোটাভুটির যুগে যে-দিকে জনসংখ্যা বেশি, সে-দিকেরই জোর।

আমাদের বাড়িতে প্রথম যেবার চুরি হল, আমরা খুব উত্তেজিত বোধ করেছিলাম। সিঁধ কেটে রাত্তিরবেলা চোর ঘরে ঢুকে অনেক কিছু নিয়ে গেছে। পরদিন সকালে কাছের বাগানে আমাদের খালি বাক্সগুলো পেলাম–টিনের বাক্স চোরেরা নেয় না। এর তিন দিন বাদেই দেখলাম, আমার চেন-লাগানো সিল্কের গেঞ্জি বাজারে একটি মাছওয়ালার গায়ে। সে আমাদের দেখে একটুও অপ্রতিভ বোধ করল না। আমি বাবার চোখের দিকে তাকালাম। বাবা বললেন, থাক, কিছু বলতে হবে না। পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা তখন থেকেই হারতে শুরু করেছে।

আর একটা জিনিস বুঝেছিলাম, আমরা গরিব। একথা যে শুধু আমরা জানি তাই-ই নয় অন্যরাও জেনে গেছে। আমরা প্রথম প্রথম আসবার পর লোকে ভেবেছিল, আমরা বোধহয় ঐশ্বর্যে সবার চোখ ধাঁধিয়ে দেব কারণ আমাদের ঝলমলে জামাকাপড়ের কায়দাই ছিল অন্য রকম, আমার মা ও দিদি স্নো ও পমেটম মাখে, আমার বাবা হুঁকো বা বিড়ির বদলে সিগারেট খান। আমাদের এসব ছিল, শুধু টাকা ছিল না। বাবা পাশের গ্রামের জমিদারি সেরেস্তায় কিংবা ইস্কুলে চাকরির চেষ্টা করেছিলেন, পাননি। আবার হোমিওপ্যাথি ডাক্তারির চেষ্টা করেছিলেন, পশার জমল না। গ্রামে তখন একটা ছন্নছাড়া ভাব। দুর্ভিক্ষের একটা বিরাট ছায়া উঁকি মারছে।

ক্রমশ জমানো টাকা সব শেষ হওয়ায় আমাদের খাওয়া-থাকারও কষ্ট দেখা দিল। এতদিন আমার ধারণা ছিল, টাকা জিনিসটা বড়দের পকেটে থাকে–কোনও কিছু কেনবার সময় পকেট থেকে বার করতে হয়। কিন্তু পকেট থেকে যে টাকা কখনও কখনও ফুরিয়ে যায় এবং সেজন্য বড়দের মনে কষ্ট জমে ওঠে, এই উপলব্ধি আমার নতুন। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে আমার পইতের সময় পাওয়া টাকাতেও হাত পড়তে লাগল। মা মাঝে মাঝেই দু’-পাঁচ টাকা চাইতে লাগলেন। আমি প্রথমে দিতে চাইনি কিন্তু মা’র থমথমে মুখ দেখে বেশি কথা বলতে পারিনি। আমার কৃপণের সঞ্চয় দ্রুত ক্ষয় হয়ে এল। যেদিন থেকে বুঝতে পারলাম আমরা গরিব, সেই দিন থেকেই খানিকটা অসহায় বোধ করতে লাগলুম। মনে হল, চোখ মেলে চারপাশের এই যে পৃথিবীকে দেখছি, এর ওপরে আমাদের অধিকার অন্যদের চেয়ে কম।

খাওয়ার সময় আর কোনও আনন্দ নেই। হঠাৎ বাবা আবিষ্কার করেছেন যে ভাতের ফ্যানের মধ্যেও প্রচুর খাদ্যপ্রাণ আছে, সুতরাং ফ্যানটুকু নষ্ট করা উচিত নয়। চালু হল ফ্যানভাত। সকালে-দুপুরে-রাত্তিরে আমরা শুধু ফ্যানাভাত খাই। তারপর রাত্তিরে ভাত খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। রাত্তিরে আমাদের খাদ্য শুধু আলুসেদ্ধ। অনেকগুলো আলু সেদ্ধ করে চটকে নুন দিয়ে মেখে বড় বড় গোল্লা পাকিয়ে থালায় নিয়ে বসি। খেতে খেতে গলায় আটকে যায়, ঢক ঢক করে জল খাই। আমার পছন্দ হয় না, আমি ভাতের জন্য কান্নাকাটি করি।

তখন আমি সবে লম্বা হতে শুরু করেছি, বালক অবস্থা থেকে আমার মানুষ হবার সময়–শরীরে অসম্ভব খিদে। সকাল থেকেই আমি খাই খাই করে মায়ের পেছনে ঘুরি। খিদের জন্য আমার মনখারাপ থাকে, আমি অবুঝের মতন ঘ্যানঘ্যান করে বাড়ির সবাইকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারি। তখন বুঝতে পারিনি, কত দিন দুপুরবেলা আমাকে পেট ভরে ভাত খেতে দিয়ে নিজে না খেয়ে থেকেছেন। সেই সময় থেকেই আমার মায়ের চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে।

দারিদ্র শুধু অশান্তি আনেনি, আমাদের নৈতিক অধঃপতনও এনে দিচ্ছিল আস্তে আস্তে। এখন আর বাবা-মায়ের ঝগড়া মাঝ রাত্রে ঘুম ভেঙে শুনতে হয় না, দিনেরবেলাতেও যখন তখন শোনা যায়। প্রকাশ্যে চেঁচিয়ে ঝগড়া, আমি হাঁ করে শুনি। দু’জনেই ঝগড়ার সময় এমন বদলে যান যে আমি আমার বাবা ও মাকে ঠিক চিনতে পারি না। ওঁদের কাছ থেকে কয়েকটা গালাগালি আমি শিখে নিচ্ছিলাম–এ ছাড়া বাইরের লোকদের কাছ থেকেও কিছু স্টক বাড়ছিল। একটি বারো বছরের ছেলের পক্ষে সময়টা মোটেই ভালো নয়। শহরের কিছুটা স্বাধীন জগত থেকে যে গ্রামের মধ্যে আমি গিয়ে পড়েছিলাম, সেখানে সামান্য দলাদলি ও সংঘর্ষ, জাতিভেদের নীচতা। সামান্য খাবারদাবার নিয়েও বাড়িতে ঝগড়া হয়, চতুর্দিকে নৈরাশ্য, ভালোবাসার কেউ নেই। সে বড় দুঃসময় ছিল।

একদিন রাত্তিরে পেটভরা খাবার না পেয়ে আমি অবুঝের মতন ঘ্যানঘ্যান করছিলাম, মা হঠাৎ মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে এঁটো হাতেই আমাকে এক চড় মারলেন খুব জোরে। মার খেয়ে ব্যথা পাবার বদলে আমি অবাক হয়েছিলাম বেশি। মা আমাকে কোনও দিন মারেননি। আমি একটু মায়ের আদুরে ছেলেই ছিলাম বলা যায়। চোখদুটি বড় বড় করে মায়ের দিকে তাকিয়েছি–মা রাগ সামলাতে না পেরে পর পর আরও দুই। থাপ্পড় দিলেন। আমি এমন কান্না শুরু করলাম যে কিছুতে আর আমার হেঁচকি থামে না। বাবা আমাকে সামলাতে এসে নিজেই চাচাতে লাগলেন, আমি বিষ খাব! আমি আজই। বিষ খাব!

এই অবস্থায় আর চলে না। এবার আমাদের কলকাতায় না গিয়ে আর উপায় নেই। তা ছাড়া দিদিকে নিয়েও গণ্ডগোল শুরু হয়েছিল। দিদিই তখন হয়ে উঠেছিল বাবা-মা’র অশান্তির প্রধান কারণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *