1 of 2

৪৬. মরা বা জ্যান্ত

মরা বা জ্যান্ত!—বলে শ্রীনাথ খুব অবাক চোখে তৃষার দিকে চায়। একটু তেলা জিভে জিজ্ঞেস করে, ধরতে পারলে তুমি ওদের মেরে ফেলবে নাকি?

না।—তৃষা ঠান্ডা গলায় বলে, জ্যান্ত ধরতে পারলে মারব কেন? যদি জ্যান্ত ধরা না যায় তা হলে দরকার হলে মেরে ফেলব।

তুমি!—বলে বিস্ফারিত চোখে অনেকক্ষণ পলক ফেলে না শ্রীনাথ। তারপর যেন চুপসে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বলে, তুমি সব পারো।

ভুলে যেয়ো না ওরা আমাকেই মেরে ফেলতে চেয়েছিল।

শ্রীনাথ আর-একটা বিড়ি ধরায়। খুব ঘন ঘন বিড়ি খাচ্ছে এখন সে। তৃষার কথাটা শুনে একটু ভেবে বলল, কথাটা শুনতে কিছু অদ্ভুত। তবু বলি, তোমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল বলেই যে ওরা বধের যোগ্য তা কিন্তু নয়।

আমিও তা বলিনি। যদি ধরা পড়ে তা হলে যা করার পুলিস বা আইন আদালত করবে। যদি তারা উপযুক্ত শাস্তি না দেয় বা খালাস দেয় তখন আইন আবার আমরা হাতে নেব। কিন্তু সে অন্য কথা। আমাকে মারতে চেয়েছিল বলেই যে আমি তাদের মারব তা আমি এখনও বলছি না।

শ্রীনাথের গলার স্বর থেকে আত্মবিশ্বাস বিদায় নিয়েছে। কেমন মিনমিনে শশানাচ্ছে তাকে। তেমনি এক ভেজা ভিতু গলায় সে বলে, তুমি আগে আর কাউকে খুন করিয়েছ তৃষা?

তৃষা আজ রাতে নানা কারণেই কিছু বিভ্রান্ত। তবু এখন শ্রীনাথের মুখের দিকে চেয়ে তার একটু করুণা হল। সে মাথা নেড়ে বলল, না। কিন্তু আমার সম্পর্কে তোমার জ্ঞান এত কম কেন?

শ্রীনাথ একটা ঢোক গিলে বলল, জ্ঞান? না, আমার আর জ্ঞানের দরকার নেই। আমি আর কিছু জানতে চাই না।

বলতে বলতে শ্রীনাথের দাঁতে একটু খটখটি হল। সে যে অত্যন্ত ঘাবড়ে গেছে তা বুঝতে তৃষার কোনও কষ্ট হচ্ছে না। এ লোক যে তৃষাকে খুন করানোর জন্য তোক লাগাতে পারে না, তা বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারছে তুষা। কিন্তু সন্দেহের একটা আলপিন তবু ফুটে থাকে তার মনের মধ্যে। সে শান্ত কিন্তু কঠিন এক গলায় বলে, লোককে ঘরের কথা বলে বেড়ানো তোমার স্বভাব। কিন্তু তা বলে লোককে বলতে যেয়ো না যে, আমি বোমাওলাদের মেরে ফেলার তালে আছি। যদি বলল তা হলে তোমার ভাল হবে না।

শ্রীনাথ ভয় পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা বলে তৃষার এই প্রচ্ছন্ন চোখরাঙানোটাও তার সহ্য হয় না। সে আবার বিড়ির আগুন থেকে নতুন বিডি ধরিয়ে নেয়। বলে, আমি বললেই যে লোকে বিশ্বাস করবে এমন নয়। মাতাল বদমাশদের কথা লোকে রেখে-ঢেকে অর্ধেক ধরে, অর্ধেক ফেলে দেয়। আজকাল তাই বলাবলি ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু লোকে যদি আমার কথা বিশ্বাস করত তবে বলতাম।

কথা বলতে বলতে শ্রীনাথের একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। সে উঠে গিয়ে কাঠের আলমারি থেকে একটা ব্র্যান্ডির বোতল বের করে ছিপিতে ঢেলে কয়েকবার খেয়ে নিল। একটা বিদঘুটে সেঁকুর তুলে মুখটা বিকৃত করে আবার ইজিচেয়ারে বসে পড়ল। মুখটা বোকাটে, ঘাবড়ানো এবং সন্ত্রস্ত।

তৃষা বলল, লোকে তোমাকে বিশ্বাস না করলেও কেচ্ছাকে বিশ্বাস করে। তাদের কাছে কে বলেছে সেটা বড় কথা নয়, কী বলছে সেটাই বড় কথা। তাই বলছি বোলো না। তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি।

অসহায় মুখে শ্রীনাথ বলে, খুন-টুন আমি সইতে পারি না।

তুমি পুরুষমানুষ হয়ে যখন পারো না, আমি মেয়েমানুষ হয়ে কি পারি?-তৃষা যেন বাচ্চা ছেলেকে ভোলাচ্ছে এমনভাবে কথাটা বলল। একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু অনেক ঠেকে শিখেছি, আমি বিপদে পড়লে বাঁচানোর মতো কেউ নেই। আমার দুঃখ হলে পাশে এসে কেউ দাঁড়াবে না। তাই বিপদ-আপদ বা দুঃখ-টুঃখকে আমি কাছে আসতে দিই না। তার আগেই নিকেশ করি। মাঝরাতে দুটো ছেলে এসে বাড়িতে ঢুকে বোমা মেরে আমাকে উড়িয়ে দিয়ে যাবে, এতকাল তো এত কষ্টের জীবন শুধু সেজন্য বয়ে বেড়াইনি! কাজেই যারা মারতে এসেছিল তাদের একটু সমঝে দেওয়া ভাল। যদি আর কারও মনে ওরকম ইচ্ছে থেকে থাকে তবে তারাও হুঁশিয়ার হবে।

হয়তো তোমাকে মারতে চায়নি। হয়তো অন্য কাউকে-–

কী করে বুঝলে?

সেদিন স্টেশনের কাছে দুটো ছেলেকে সরিৎ চেন দিয়ে মেরেছিল! তারাও হতে পাবে। হয়তো সরিতের ওপর শোধ নিতে এসেছিল।

সরিৎ আমার ভাই। তাকে মারতে এলেই বা আমি ছাড়ব কেন? সে আমার আশ্রয়ে আছে, তার দায়দায়িত্ব আমার, সেটা ভুললেও তো চলবে না।

শ্রীনাথের আর কিছু বলার থাকে না। সে চুপ করে রইল।

তৃষা জিজ্ঞেস করে, সরিৎ যাদের মেরেছিল তাদের তুমি চেনো?

না। মুখচেনা।

সোমনাথ বহুকাল এদিকে আসছে না। তবু আমাকে সব খবরই নিতে হবে।

সোমনাথ! সোমনাথ এর মধ্যে নেই তৃষা। আমি বলছি।–খানিকটা আতঙ্কের সঙ্গে বলে ওঠে শ্রীনাথ।

নেই কী করে জানলে? সোমনাথ নিজে না থাকলেও তার অনেক সিমপ্যাথাইজার আছে এখানে।

ওকে এখানে কেউ চেনেই না। তা ছাড়া বুলু এখন তার বউকে নিয়ে ব্যস্ত।

তুমি কোনও খবরই রাখো না। ওদের বাচ্চাটা পেটেই নষ্ট হয়ে গেছে সেই কবে! সোমনাথ বাবাকে একটা চিঠিতে লিখেছে, আমিই নাকি কোন তান্ত্রিককে ধরে বাণ মেরে ওই কাণ্ড করিয়েছি।

বুলু লিখেছে?

হ্যাঁ। বাবার তোষকের নীচে চিঠিটা ছিল। তোষক রোদে দিতে গিয়ে চিঠিটা বৃন্দার হাতে পড়ে। সে আমাকে দেয়।

বুলুটা পাগল।

তাই হবে।—বলে তৃষা ওঠে। চারদিকে চেয়ে বলে, তুমি ঘুমোও। রাত আর বেশি নেই।

আর ঘুম!—বলে শ্রীনাথ আবার উঠে গিয়ে ছিপিতে ঢেলে ব্র্যান্ডি খায়।

তৃষা অন্ধকার বারান্দায় বেরিয়ে আসে। মস্ত বাগানের আনাচে-কানাচে এখনও টর্চ জ্বলছে।

তৃষা বারান্দা থেকেই চেঁচিয়ে বলল, তোদের আর খুঁজতে হবে না। ঘরে মা সবাই।

আনমনে রাস্তাটুকু পার হয়ে উঠোনে পা দিয়ে তৃষা দেখে, তার ঘরের সিঁড়িতে সরিৎ বসে আছে। হাতে একটা বেতের মোটা লাঠি। তার পাশে খ্যাপা নিতাই। নিতাইয়ের পায়ের কাছে ইস্পাত। তৃষাকে দেখে ইস্পাত উঠে এসে কুঁই কুঁই করে গায়ে পা তুলে আদর কাড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু কুকুরের আদরে বড় ঘেন্না তৃষার। বলল, যাঃ যাঃ।

সঙ্গে সঙ্গে ইস্পাত ভয় খেয়ে নিতাইয়ের কাছে ফিরে যায়।

তৃষা বলে, তোরা শুতে গেলি না?

সরিৎ হাই তুলে বলল, সাড়ে তিনটে বাজে, আর শুয়ে কী হবে?

তৃষা আর কিছু বলল না। বারান্দায় উঠে দরজার শিকল খুলল।

সরিৎ বলল, দরজাটা দিয়ে দাও। আমরা পাহারা দিচ্ছি।

তৃষা খুব অন্যমনস্ক। কথাটা শুনেও শুনল না। মশারি সরিয়ে বিছানার ধারে বসে রইল সে। স্ট্যান্ডে বন্দুকটা রেখে গেছে সরিৎ। তৃষার চোখ সেইদিকে। ভিতরে ভিতরে ফুঁসে উঠছে রাগ আর আক্রোশ। কিন্তু বাইরে খুব নিথর সে। মনে এখন আর কোনও ভয় বা বিভ্রান্তি নেই। তবে তীব্র জ্বালা আছে।

অনেকক্ষণ বসে থেকে তারপর উঠে স্টোভ জ্বেলে সে চায়ের জল চড়ায়। উঠোনে, বাগানে লোকজন জেগে পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু এই ভোরবেলা আর কোনও শত্রু এসে ঢুকবে না, এটা জানে। তৃষা। শত্রুরা জানে, এর পর তৃষা আরও সতর্ক হবে, নিষ্ঠুর হবে। তাই আর সহজে এ বাড়ির ছায়া মাড়াবে না তারা। কিন্তু মাড়ালেই যাও সুবিধে হত। হাতের মুঠোয় পেত তাদের।

পুলিসের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক দিনের। তারা এনকোয়ারিতে এসে কী কী জিজ্ঞেস করবে তা সে জানে। তার কোনও শত্রু আছে কি না। কাকে তার সন্দেহ হয়। লোকগুলো কেমন দেখতে। ইত্যাদি।

তৃষা দরজা খুলেই বিস্ফোরণ দেখেছিল। আর কিছু মনে নেই। কিন্তু তৃষা জানে, দরজা খোলা এবং বোমা ফাটবার মধ্যে যে কয়েক সেকেন্ড সময় তার মধ্যেই তার চোখ অনেক কিছু দেখেছে। কিন্তু বোমার ধাক্কায় মাথাটা এতই গুলিয়ে আছে যে কিছুই মনে পড়ছে না! তবে মনটাকে শান্ত ও নিরুদ্বেগ করে যদি একাগ্রভাবে চিন্তা করে সে, তবে নিশ্চয়ই মনে পড়বে।

কিন্তু মনটাকে শান্ত করা কি সোজা! সংসারের এত জ্বালাপোড়া, এত ক্ষোভ রাগ হতাশা জমে আছে ভিতরে! মশারির মধ্যে বসে চোখ বুজে যতবার ভাববার চেষ্টা করল ততবারই অন্য সব বাজে চিন্তা হিজিবিজি কথা এসে লন্ডভন্ড করে দিল মাথা। ওই কয়েক সেকেন্ডের জরুরি স্মৃতি কিছুতেই মনে এল না।

উঠোনটা অন্ধকার ছিল। কুকুরটা দৌড়ে দৌড়ে ডাকছিল খুব। দরজা খুলে কী দেখেছিল সে? শুধু অন্ধকার? আর কিছুই নয়? কোনও অস্বাভাবিকতা নয়? কোনও গন্ধ বা শব্দ নয়? কোনও নড়াচড়া নয়? যে দু’জোড়া পায়ের শব্দ শুনেছিল তার আওয়াজ কেমন? চটির আওয়াজ না জুতোর? ভারী পা, না হালকা?

চারদিকে ফটফটে ভোরের আলো দেখা গেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল তৃষা। বহু কাজ।

বাকি রাতটুকু ভাল ঘুম হয়নি শ্রীনাথেরও। তৃষা চলে যাওয়ার পর একা ঘরে এক রক্ত-জল-করা ভয় তাকে পেয়ে বসল। এ কার ঘর সে করছে এতকাল? তৃষা অনেক কিছু করতে পারে, সে জানে। কিন্তু তা বলে খুন? মাথাটা গরম হয়ে উঠছিল, বুদ্ধি ঘুলিয়ে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে উঠছে এক ধুকধুকনি। খুনখারাপি মারধর কোনওদিনই সহ্য করতে পারে না শ্রীনাথ। উঠে গিয়ে সে ব্র্যান্ডির বোতলটা বের করে আনল। জল মিশিয়ে অনেকক্ষণ খেল বসে বসে। তারপর শরীরে ঝিমঝিমনি উঠলে গিয়ে শুয়ে পড়ল। দুঃস্বপ্ন দেখল অনেক। উঃ আঃ শব্দ করল ঘুমের মধ্যেই।

 

একটু বেলায় ঘুম থেকে উঠল শ্রীনাথ। শরীর কাহিল, মন অবসন্ন। এত বিদঘুটে হ্যাংওভার বহুকাল হয়নি তার। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে সে গিয়ে মুখ-হাত ধুল। তারপর ইজিচেয়ারে পড়ে রইল মড়ার মতো। বাড়িতে বোমা পড়লেও যথাসময়ে চা এল ঠিকই। চেয়ে আরও এক পট দুধছাড়া চা আনিয়ে। খেল শ্রীনাথ। সঙ্গে অল্প ব্র্যান্ডি। কিন্তু মাথাটা অল্প অল্প ঘুরছে, শ্বাসের কষ্ট হচ্ছে বেশ।

সকালেই পুলিসের জিপ এসে ফটকের কাছে থেমে আছে। শ্রীনাথকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে অবশ্য কেউই এল না! এলে খুবই অস্বস্তিতে পড়বে সে। সে নিজেও জানে সত্যিকারের কাপুরুষ বলতে যা বোঝায় সে হচ্ছে তা-ই। তবে এখন আর সেজন্য কোনও লজ্জা নেই শ্রীনাথের। জীবনটাকে তো আর পালটানো যাবে না।

চোখ বুজেও সে দুঃস্বপ্নই দেখছিল এখন। চারদিকে শরতের উজ্জ্বল এক সকাল। চোখ বুজেই টের পেল দরজার আলোয় কে যেন এসে দাঁড়িয়ে ছায়া ফেলল।

চোখ চেয়ে অতি কষ্টে মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে শ্রীনাথ বলল, আয়। পুলিস কি চলে গেছে?

সজল ষড়যন্ত্রকারীর মতো বেড়াল-পায়ে ঘরে আসে! মুখ টিপে হেসে বলে, না। ডবল ডিমের ওমলেট খাচ্ছে বসে বসে। তবে খেয়েই চলে যাবে।

এনকোয়ারি হয়ে গেল?

হ্যাঁ।–সবাইকে ধরে ধরে অনেক কথা জিজ্ঞেস করল।

তোকেও করেছে?

হ্যাঁ।–বলে মাথা হেলায় সজল, আমি বলেছি বোমাবাজদের আমি চিনি।

সে কী?—বলে শ্রীনাথ চোখ বড় করে তাকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সকালের এই সাদা আলোটা সইতে পারে না একদম। চোখ কুঁচকে বলে, তুই আবার নাম-টাম বলিসনি তো?

বলেছি।

কার নাম বলেছিস?

রামলাখন আর কাটুমদা।

কাটুমদা কে?

শীতলাতলার ভটচায মশাইয়ের ছেলে, চেনো না?

সে বোমা মেরেছে?

মারতে পারে। মেজদিকে স্কুলের বাস্তায় রোজ ফলো করে। মেজদি একদিন চটি খুলে তাড়া করেছিল।

খুবই অবসাদ বোধ করে শ্রীনাথ। বলে, না জেনে পুলিসকে কোনও নাম বলা ঠিক নয়। বললি কেন?

এমনিই। পুলিস ধরে নিয়ে গিয়ে পেটালে ভাল হবে।

ধরবে নাকি ওদের? তোর কথায়?

না।–একটু হতাশার গলায় সজল বলে, মা যে সব নষ্ট করে দিল। মা পুলিসকে বলল, ওর কথা ধরবেন না। তোমার কথা মা কী বলেছে জানো?

কী বলেছে?

বলেছে আমার হাজব্যান্ড প্রকৃতিস্থ নন। ওঁকে জেরা করার দরকার নেই। তাই পুলিস তোমার কাছে আসেনি।

একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলল শ্রীনাথ। মনে মনে তৃষাকে ধন্যবাদ দিল।

সজল জিজ্ঞেস করল, বোমার শব্দটা তুমি শোনোনি বাবা?

না।

জায়গাটা দেখেছ? যেখানে বোমাটা মেরেছিল?

না দেখিনি।

গিয়ে একবার দেখে এসো। দারুণ। বারান্দার শানে অনেকখানি চিড় ধরে গেছে। মা’র গায়ে লাগলে একদম উড়িয়ে দিত।

বিরক্ত শ্রীনাথ বলে, তুই হাসছিস কেন? এটা কি মজার ব্যাপার?

সজল যেন ধরা পড়ে গিয়ে একটু কাঁচুমাচু হল। বলল, লাগেনি তো।

লাগেনি, কিন্তু ব্যাপাবটা তা বলে হাসির নয়।

আমার স্কুলের একটা ছেলে পেটো বানাতে পারে! কিছু টাকা দিলে শিখিয়ে দেবে।

খবরদার!–বলে শ্রীনাথ ধমক দেয়।

সজল ফের একটু মিচকি হাসি হেসে বলে, তুমি কেবল শুধু শুধু আমার ওপর রাগ কবছ। ছোটমামা নিজেই পেটো বানায় তা জানো?

স্তম্ভিত শ্রীনাথ বলে তোকে কে বলল?

কে বলবে? সবাই জানে।

তোর মা জানে?

মা-ই তো মশলা কেনার লকা দেয়।

শ্রীনাথ হাঁ করে থাকে। মাথাটা একটু বেশি পাক খায় বলে তাকাতে কষ্ট হয় খুব। বড় করে শ্বাস ফেলছে বারবার। বলল, সরিৎ ওসব বানায় কেন?

কে জানে?–ঠোঁট উলটে সজল বলে।

আবার এক তীব্র আতঙ্কে বিহুল হতবুদ্ধি হয়ে যায় শ্রীনাথ। এ সে কাদের মধ্যে রয়েছে? এ কারা তার আত্মীয়স্বজন? উঠতে গিয়ে টাল খেয়ে বসে পড়ল শ্রীনাথ। আবার চেষ্টা করল। এ বাড়ির চৌহদ্দি ছেড়ে এক্ষুনি তার বেরিয়ে পড়া দরকার। কিন্তু উঠতে গিয়ে এবার আর বসে পড়ল না। চোখ অন্ধকার আর মাথা শূন্য হয়ে দড়াম করে পড়ে গেল মেঝেয়।

সজল চমকে উঠেছিল। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল মেঝেয় পড়ে থাকা তার বাবার দিকে। উপুড় হয়ে মুখের কাছে মুখ নিয়ে ডাকল, বাবা! বাবা!

শ্রীনাথ রক্তবর্ণ দুটো চোখ খুলে বলে, একটু হাওয়া। আমাকে খোলা হাওয়ায় নিয়ে চলো।

কী হয়েছে তোমার?

আমি মরে যাচ্ছি! শিগগির।

সজল ভিতরবাড়িতে দৌড়ে গেল।

একটু বাদেই বাড়ির লোকজন আর ডাক্তার-বদ্যিতে ভরে গেল ঘর।

শ্রীনাথের বহুকাল কোনও অসুখ-বিসুখ করেনি। বিছানায় এক ঘোরের মধ্যে শুয়ে থেকেও সে সবই টের পায়। বিছানায় তৃষা, মঞ্জু আর স্বপ্ন খুব কাছাকাছি বসে আছে। ডাক্তার তার প্রেশার নিচ্ছে। মাথার কাছে একটা টেবিল-ফ্যান থেকে স্নিগ্ধ হাওয়া এসে লাগছে। পাতালে তলিয়ে যেতে যেতে মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে শ্রীনাথ। তারপর একটা ছুঁচের মুখ ঢুকে গেল হাতে। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে।

ডাক্তার বলে গেল, ভয়ের কিছু নেই। একজহশন, ড্রিংক, ল্যাক অফ এক্সারসাইজ। মাইল্ড স্ট্রোকও বলা যায়। প্রেশারটা ভীষণ লো। এখন থেকে সাবধান হওয়া দরকার।

তৃষা ডাক্তারকে বিদায় দিয়ে ভাবন-ঘরের ইজিচেয়ারে এসে বসে।

শ্রীনাথের তেমন কিছু হয়নি জেনে ছেলেমেয়েরা নেয়েখেয়ে স্কুলে গেল। বাড়ির লোক সংসারের নানা কাজে লেগে পড়ল। সরিৎ গেল ওষুধ আনতে।

একা তৃষা শ্রীনাথের ঘুমন্ত মুখের দিকে জ্বালাভরা চোখে তাকিয়ে রইল। মনে মনে বলল, অকৃতজ্ঞ! তোমার না হয়ে যদি আমার এ রকম হত, তবে তুমি আমার জন্য করতে এতটা?

পুরুষমানুষের মতো নিমকহারাম দুটো নেই দুনিয়ায়। তুমি বেশ্যাপাড়ায় গিয়ে মদ খেয়ে যত না নিন্দে কুড়িয়েছ, আমার একটা কলঙ্কের নিন্দে তার চেয়ে ঢের বেশি। বেশ আছ তোমরা কাপুরুষ মেরুদণ্ডহীন! মেয়েমানুষকে মারতে চোরের মতো মাঝরাতে এসে বোমা ছোড়া, তোমরা কেমন জন্তু?

পুরুষমানুষের ওপর আগ্রাসী রাগ খুব বেশিক্ষণ রইল না তুষার। বোমার খবর রটে গেছে। বহু লোক দেখা করতে আসছে। পাড়ার মাতব্বর, প্রাক্তন এক এম এল এ, সমাজকর্মী, কৌতূহলী গিন্নিবান্নিরা। বৃন্দাকে শ্রীনাথের ঘরে রেখে তৃষাকে উঠে যেতে হল।

ফাঁক পেতে পেতে সেই দুপুর। ঘুমন্ত শ্রীনাথকে আধোজাগা করে গরম দুধ খাইয়ে এল তৃষা। নিজে নেয়ে-খেয়ে একটা প্যাডের কাগজে লম্বা চিঠি লিখতে বসল দীপনাথকে।

দীপু, তোমাকে আমার গার্জিয়ান করতে চেয়েছিলাম। তুমি সেই ভয়ে সেই যে পালিয়ে গেলে আর এলে না। না হয় গার্জিয়ান না-ই হলে, তা বলে কি খোঁজ নিতে নেই! আমার কী বিপদ যাচ্ছে জানো না তো।…

অনেক অনেক কথা লিখল তৃষা। সচেতনভাবে যা সে কখনওই লিখতে পারত না। লজ্জা পেত।

চিঠিটা খামে এঁটে মংলাকে ডাকছিল ডাকে দেওয়ার জন্য। বারান্দা থেকেই হঠাৎ চোখে পড়ল, ফটক থেকে আলোছায়াময় আঁকাবাঁকা পথটি ধরে একজোড়া স্বামী-স্ত্রী আসছে। বোধ হয় পড়শিই কেউ হবে। তৃষা ঘরে গিয়ে চশমাটা চোখে দিয়ে বেরিয়ে এল।

বলল, ওমা!

উঠোনে দীপনাথ আর মণিদীপা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মৃদু মৃদু হাসছে।

দীপনাথ বলল, এলাম।

তৃষা নেমে গিয়ে মণিদীপার হাত ধরে বলল, তুমি বাপু আজ একদম সাজোনি!

মণিদীপা বড় বড় চোখে চেয়ে তৃষাকে দেখছিল। খুবই বুদ্ধিমতী। বলল, আমি না হয় সাজিনি। কিন্তু আপনার কী হয়েছে বলুন তো! ইউ লুক সো ক্রেস্টফলেন।

কিছু নয়। ঘরে এসো।

আপনাদের এ জায়গাটা আমার ভীষণ ভাল লাগে। অবশ্য তার জন্য আপনিই রেসপনসিবল আপনাকে ভাল লাগে বলেই জায়গাটাকেও ভাল লাগে। কিন্তু আপনিই তো আজ প্যাথস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *