৪৬. ফিস্ককে অনুসরণ

৪৬.

ফিস্ককে অনুসরণ করে আলেক্সান্দ্রাও বেরিয়ে এলো রুম থেকে। তোমার সাথে কথা আছে আমার।

ফিস্ক ওদিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে যেতেই পিছু ফিরে জবাব দিলো, এখন না। তাড়ার মধ্যে আছি আমি। পরে কথা বলবো আপনার সাথে।

বলে হলের কোনা ঘুরতে যাবে ঠিক তখনই অন্যদিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকা এক হোটেল পরিচারিকার গায়ে ধাক্কা খেয়ে বসলো ফিস্ক। আইস বাকেট আর শ্যাম্পেইনের বোতলের দিকে নজর থাকায় পরিচারিকাও ফিস্ককে দেখতে পায়নি। ধাক্কা খেয়ে তার হাত থেকে বোতল আর আইস বাকেটটা পড়ে গেছে মাটিতে। ওদিকে ফিস্কের কোটটাও হাত থেকে ছুটে টলে থাকা পাম গাছের পাশে পড়ে গেছে। আরেকটু হলেও টবটাও উলটে পড়ে যেতো।

পড়ে যেতেই গালি দিয়ে উঠলো ফিস্ক। ফিস্কের গালি শুনে ওদিক ভয়ে কুঁকড়ে পরিচারিকা মেয়েটা। কোনো রকমে মিনমিনে গলায় বলল, স্যরি, স্যার। আপনাকে দেখিনি আমি।

হ্যাঁ, দেখবে কিভাবে, চোখ তো চোখের জায়গায় রাখো না, বলে উবু হয়ে কোটটা উঠিয়ে আবারো সামনের দিকে পা বাড়ালো ফিস্ক।

আলেক্সান্দ্রাও লবি পর্যন্ত অনুসরণ করে গেলো তাকে। তবে দরজা দিয়ে বেরুনোর আগে ফিস্ক তাকে থামিয়ে নিচু গলায় বলল, আমার কথাটা কি বুঝেননি আপনি? বললামই তো এখন কথা বলার সময় নেই আমার।

তুমি কাউকে মারতে পারবে না, ফিসফিসিয়ে বলল আলেক্সান্দ্রা। অন্তত এখানে না। এই রুমটা আমার নামে ভাড়া করা।

আপনিই তো এটার অংশ হতে চেয়েছিলেন। তারমানে এখন আপনাকেও আমার নিয়ম মেনে চলতে হবে। সেজন্যেই কাউকে পথ থেকে দূর করার সময় হলে, তখন সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র আমার। আপনার বা জ্যাক ইভানের না, শুধু আমার। বুঝেছেন আমার কথা?

ফিস্কের কথা বলার ধরনে ক্ষেপে গেলেও চুপচাপ মাথা ঝাঁকিয়ে আবারো লবিতে ফিরে এলো আলেক্সান্দ্রা। মোড় ঘুরে হলওয়েতে পা ফেলতেই দেখলো পরিচারিকা মেয়েটা এখনো মেঝে থেকে বরফের টুকরোগুলো তুলে বাকেটে রাখছে।

সে একটু কাছে এগিয়ে যেতেই মেয়েটা চোখ তুলে তাকালো তার দিকে। চোখে পানি টলটল করছে মেয়েটার। আরো একবার মাফ চেয়ে বলল, আমি সত্যিই দেখিনি উনাকে।

এতে তোমার দোষ নেই, বলল আলেক্সান্দ্রা। মেয়েটার জন্য কিছুটা খারাপ লাগছে তার। মেয়েটাকে সাহায্য করার জন্য পাম গাছের গোড়ায় পড়ে থাকা শ্যাম্পেইনের বোতলটা তোলার জন্য উবু হতেই একটা জিনিস চোখে পড়লো তার। সাইফার হুইলটা। ফিস্কের কোট পড়ার সময় হয়তো পকেট থেকে পড়ে গেছে হুইলটা।

তাই বোতলটা ওভাবে রেখে দিয়েই আলেক্সান্দ্রা বলল, দাঁড়াও, আমিও সাহায্য করছি। বলে পাম গাছের কাছে পড়ে থাকা বরফের টুকরোগুলো তুলতে শুরু করলো সে। এটা সত্যিই আমাদের দোষ ছিলো। তর্ক করতে করতে এগুনোর কারণে আমরাই দেখিনি তোমাকে।

না, না। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, ম্যাম। আমিই পরিষ্কার করে নিচ্ছি।

কিছু না বলে পাম গাছটার আরো কাছে এগিয়ে গেলো আলেক্সান্দ্রা। শ্যাম্পেইনের বোতল তোলার ভান করে উবু হয়ে সাইফার হুইলটা টবের মাটিতে ঢুকিয়ে বালি দিয়ে আড়াল করে দিলো। তারপর বোতলটা তুলে বাড়িয়ে দিলো মেয়েটার দিকে।

ধন্যবাদ, আলেক্সান্দ্রার হাত থেকে বোতলটা নিতে নিতে বলল মেয়েটা। ঠিক তখনই ফিস্ক এসে উদয় হলো আবার। আলেক্সান্দ্রা ও মেয়েটাকে এখনো হলওয়েতে দাঁড়িয়ে থেকে কিছুটা চমকে গেছে ও।

আবার ফিরে এলে যে? ফিস্ককে দেখে জিজ্ঞেস করলো আলেক্সান্দ্রা।

একটা জিনিস ফেলে গিয়েছি, তাদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল ফিস্ক। তবে তার নজর আটকে আছে মেঝের দিকে। বিশেষ করে পাম গাছের টবটার দিকে। পাম গাছের পাতাগুলো কিছুক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখে আলেক্সান্দ্রাকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি এখানে কিছু পাননি তো?

ফিস্ককে পাম গাছে হাত দিতে দেখেই ভড়কে গেছে আলেক্সান্দ্রা। কোনোরকমে নিজেকে শান্ত রেখে জবাবে বলল, না। কী খুঁজছো তুমি?

তাহলে মনে হয় রুমে ফেলে এসেছি, বলে রুমে চলে গেলো ফিস্ক।

ফিস্ক চলে যেতেই পরিচারিকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো আলেক্সান্দ্রা। তবে মেয়েটার নিরাপত্তা নিয়ে এখনো দুঃশ্চিন্তায় আছে। এই ভুল মুহূর্তে এখানে থাকলে মেয়েটার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যে এই বোতলটা খুলবে সে নিশ্চিতভাবেই চমকে যাবে। ঝাঁকি খাওয়া শ্যাম্পেইনের বোতল খুললে কী অবস্থা হয়, তা জানো না?

এটা মাথায়ই ছিলো না আমার। এখনই বদলে আনছি, আবারো উল্টোদিকে চলে গেলো মেয়েটা।

মেয়েটা চলে যেতেই রুমে এসে ঢুকলো আলেক্সান্দ্রা। ঢুকেই ফিস্ককে বিছানার নিচে খুঁজতে দেখে বলল, তুমি কী খুঁজছে সেটা বললে ভালো হতো। তাহলে আমরাও সাহায্য করতে পারতাম।

 কিছু না বলে বিছানার ম্যাট্রেসটা রেখে দিয়ে তার দিকে তাকালো ফিস্ক। সত্যি বলতে তার পাতলা জ্যাকেটের পকেটগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে ফিস্ক। কপাল ভালো যে জিনিসটা সে টবের ওখানেই রেখে এসেছিলো।

এভাবেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর অবশেষে ফিস্ক বলল, হয়তো গাড়িতেই ফেলে এসেছি।

কী জিনিস ওটা? আর ওটা খুঁজে না পেলে কী হবে?

তেমন কিছুই হবে না, বলে শেষবারের মতো আরেকবার রুমটায় চোখ বুলিয়ে দেখলো ফিস্ক। এমনিতেও ছবি ভোলা আছে আমার কাছে।

চোখ ঘুরিয়ে নাইজেলের দিকে তাকালো আলেক্সান্দ্রা। বেচারা লোকটা তার হাতের বাধন খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। লোকটাকে থামতে বলার ইচ্ছা করছে আলেক্সান্দ্রার। তাকে দড়ি ছুটানোর প্রচেষ্টা করছে দেখলে এখনই তাকে মেরে ফেলার নির্দেশ দিবে ফিস্ক। কথাটা মাথায় আসতেই ফিস্কের সাথে বলতে চাওয়া কথাটাও মনে পড়ে গেলো তার। তাই আবারো ফিস্ককে অনুসরণ করে আবারো রুম থেকে হলওয়েতে বেরিয়ে এলো।

আগেই বলেছি, এখন না, আলেক্সান্দ্রাকে পিছু পিছু আসতে দেখেই বলে উঠলো ফিস্ক।

 হ্যাঁ, ওটা তখনই বুঝেছি আমি, বলল আলেক্সান্দ্রা। আমি ফ্রন্ট ডেস্কে যাচ্ছি রাস্তার ওপাশে থাকা পাবের মেনু দেখতে। অনিমন্ত্রিত অতিথির সুবাদে তো এখন আমাদেরকে খাবার রুমে আনিয়েই খেতে হবে।

কোনা ঘুরে আবারো পাম গাছের টবের কাছে আসতেই হাঁটার গতি কমিয়ে দিলো ফিস্ক। সন্দেহাতীতভাবেই হারিয়ে যাওয়া যাওয়া হুইলটা খুঁজছে। তাকে আবারো পাম গাছের পাতাগুলোর দিকে এগিয়ে যেতেই ভয়ে জমে গেলো আলেক্সান্দ্রা। টবের এলোমেলো মাটির দিকেই চোখ আটকে আছে তার।

 তবে ফিস্কের নজর পড়েনি ওদিকে। পামের পাতাগুলো একবার উল্টেপাল্টে দেখেই নিচুস্বরে গালি দিয়ে আবারো লবির দিকে পা বাড়ালো ফিস্ক।

আলেক্সান্দ্রাও ফ্রন্ট ডেস্ক পর্যন্ত এগিয়ে গেলো তার সাথে। ফ্রন্ট থেকে পাবের মেন্যুটা দেখতে দেখতে ফিরে চলে যাওয়ার অপেক্ষা করছে। ফিস্ক চলে যেতেই মেনুটা রেখে আবারো ফিরে এলো হলওয়েতে। এরপর টবের মাটি থেকে হুইলটা বের করেই ছুট লাগালো তার নিজের রুমের দিকে। লুকিয়ে রাখলো তার স্যুটকেসের লাইনিংয়ের আড়ালে।

এটা দিয়ে সে কী করবে সেই ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই নেই। সে শুধু এটাই জানে যে এই জিনিসটা ফিস্কের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু। তাই জিনিসটা যেভাবেই হোক সে তার নিজের কাছে রাখতে চায়।

.

৪৭.

পর্দার ফাঁক দিয়ে কালো মার্সিডিজটাকে চলে যেতে দেখলো স্যাম। ফিস্ক চলে গেছে। যাক, শসংখ্যা একজন কমলো, ভেবে পর্দা টেনে দিয়ে রেমির কাছে ফিরে আসলো আবার। রেমি এখনো দেয়ালের পাশে বসে কানে গ্লাস ঠেকিয়ে রেখেছে।

ঠিক তখনই দরজায় টোকা দিলো কেউ। টোকার শব্দ শুনে দুইজনেই চমকে গেছে। স্যাম এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতে দেখলো হোটেল চারিকাদের একজন নববিবাহিত দম্পতির অর্ডার করা শ্যাম্পেইনের বোতলটা নিয়ে এসেছে। বখশিস দিয়ে বোতলটা হাতে নিয়ে আবারো দরজা লাগিয়ে দিলো স্যাম। কপাল ভালো যে মেয়েটা রুমের অধিবাসীদের পরিবর্তনটা বুঝতে পারেনি।

ড্রেসারের ওপর বোতলটা রাখতে রাখতে স্যাম ফিসফিসিয়ে বলল, কিছু শুনতে পারলে?

জবাবে শুধু আঙুল উঁচিয়ে ধরলো রেমি। তারপর ফিসফিসিয়ে বলল, শুনে মনে হচ্ছে রাস্তার ওপার থেকে খাবার কে আনবে সেটা নিয়ে আলোচনা করছে ওরা… আলেক্সান্দ্রা আর জ্যাক যাচ্ছে খাবার আনতে। ইভান রুমে থাকবে।

এতে আমাদের সুবিধাই হবে।

হ্যাঁ, তবে সমস্যা হলো… বলতে বলতে আবারো দেয়ালে কান ঠেকালো রেমি, খাবার আনতে শুধু হোটেলের লবি পর্যন্ত যাবে ওরা। রেস্টুরেন্ট থেকে লবিতে খাবার দিয়ে যাবে।

এরমানে যতোটা আশা করেছিলো তার থেকেও কম সময় পাচ্ছে ওরা। অন্ততপক্ষে তার পরিকল্পনার নকশা অনুযায়ী সময়টা বেশ কম হয়ে গেছে। যাই হোক, তাদেরকে এখন দ্রুত সময়ে কাজ সারতে হবে আর কী।

আলেক্সান্দ্রা আর জ্যাক চলে যেতেই রেমিকে তার পরিকল্পনার ব্যাপারে জানালো স্যাম। পরিকল্পনার অনেক কিছুই নির্ভর করছে ভাগ্যের ওপর। যদিও তার এবং রেমির কাছে দুটো পিস্তল রয়েছে, তবে প্রতিপক্ষের কাছে কী পরিমাণ অস্ত্র তা কিন্তু তারা কেউই জানে না। সত্যি বলতে, জিম্মি উদ্ধার করার মতো কোনো কিছু আগে থেকে পরিকল্পনা করেনি ওরা।

যাই হোক, ওসব নিয়ে এখন দুঃশ্চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। দুটো পিস্ত ল থাকলেও ব্যাকপ্যাক থেকে চাকু বের করে রেমির হাতে তুলে দিলো একটা! তাদের এখন মূল লক্ষ্য কোনোরূপ গোলাগুলি ছাড়াই রুমে ঢুকে আবার বেরিয়ে আসা। সংক্ষেপে বললে, স্যামের কাজ হলো ইভানকে ঘায়েল করা আর রেমির কাজ নাইজেলকে মুক্ত করে আনা।

পরিকল্পনা সাজানো হয়ে যেতেই স্যামের নির্দেশে ফোন তুলে ফ্রন্ট ডেস্কে কল করলো রেমি। রুম ১০৩, প্লিজ, বলতেই ১০৩ নম্বর রুমে কলটা ট্রান্সফার করে দিলো ফ্রন্ট ডেস্ক। ১০৩ নম্বর রুমের বাসিন্দা কল রিসিভ করতেই রেমি তার ব্রিটিশসুরে বলে উঠলো, ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে বলছি। খুব শীঘ্রই রুম সার্ভিস আপনাদের রুমে শ্যাম্পেইন নিয়ে উপস্থিত হবে,.. না, স্যার। আপনাদের রুমে থাকা ম্যাম খাবার আনতে বেরিয়ে যাওয়ার সময় এই শ্যাম্পেইনের অর্ডার করে গিয়েছে। বলেছে ডিনারের আগেই বোতলটা রুমে পাঠিয়ে দিতে… এটা হোটেলের সৌজন্যতা, স্যার। আপনি পান না করলেও অসুবিধা নেই।

বলে ফোন রেখে শ্রাগ করলো রেমি। ফিসফিসিয়ে বলল, সে মানতেই চাইছিলো না। কোনোভাবে রাজি করিয়েছি।

এটুকই যথেষ্ট। চলো, কাজে নেমে পড়া যাক।

সাথে সাথেই চুলোগুলো ঝুঁটি করে বেঁধে নিলো রেমি। পরিচারিকারা সাধারণত এভাবেই চুল বাধে। তারপর স্যাম তার ব্যাকপ্যাকটা হাতে তুলে নিয়ে দরজা খুলে বলল, প্ল্যানটা আরেকবার শুনে নাও। নাইজেলকে মুক্ত করার সাথে সাথেই জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাবে তোমরা। বেরিয়ে চলে যাবে গাড়িতে, তারপর হোটেলের সামনে এসে দেখা করবে আমার সাথে।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে শ্যাম্পেইনের বোতলসমেত আইস বাকেটটা হাতে নিয়ে হলওয়েতে বেরিয়ে এলো রেমি। গিয়ে দাঁড়ালো ইভানদের রুমের দরজার সামনে। স্যাম দরজার পাশে পজিশন নিয়ে দাঁড়াতেই দরজায় টোকা দিলো ও। সাথে সাথে ইভান যেন তার চেহারা দেখতে না পায়, সেজন্য নিজের মাথা নিচু করে রেখেছে।

দরজা খুলে মাথা বের করে ইভান জবাবে বলল, কে?

শ্যাম্পেইন, স্যার। বলে আইসবাকেটটা উঁচিয়ে ধরলো রেমি।

 আমি তো বলেছিই… বলতে বলতে দরজাটা আরেকটু ফাঁক করলো ইভান।

সাথে সাথেই ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে সজোরে দরজায় ধাক্কা দিলো স্যাম। ধাক্কা খেয়ে কিছুটা চমকে গেলেও দরজাটা শক্তভাবে ঠেলে ভিতর থেকে আটকে দেওয়ার চেষ্টা করছে ইভান। আর স্যামও বাইরে থেকে ঠেলা দিয়ে রেখেছে দরজাটা। এরই ফাঁকে স্যামকে পাশ কাটিয়ে রুমের ভিতরে ঢুকে গেলো রেমি।

দরজায় প্রায় ঝুঁকে পড়ে স্যামকে বাইরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে ইভান। স্যামও ওদিকে দরজার ফাঁকে পা ঢুকিয়ে দরজাটা প্রশস্তভাবে ভোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভারী ওজনের ইভানের শক্তির সাথে ঠিকমতো কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তাকে বাইরে ঠেলে দিয়ে ইভান দরজাটা আটকাতে যাবে, ঠিক তখনই দরজায় লাথি দিয়ে ইভানকে কোনায় ঠেলে দিলো স্যাম।

দৌড়ে রুমের ভিতরে এসে ঢুকলো স্যাম। ইভানকে তার দিকে পিস্তল উঁচিয়ে ধরতে দেখেই ব্যাকপ্যাক দিয়ে আঘাত হানলো তার হাতে। সাথে সাথেই বন্দুকটা খসে পড়ে গেলো ইভানের হাত থেকে। পিস্তলটা পড়ে যেতেই ঘুরে স্যামের পেটে ঘুষি হানলো ইভান। তবে স্যাম তৈরিই ছিলো। ইভানকে ঘুষি দিতে দেখে ইচ্ছা করেই পিছিয়ে গিয়ে দেয়ালের দিকে ঝুঁকে পড়েছে ও। দেয়ালের প্লাস্টারে গিয়ে লাগলো ঘুষিটা। হাতের গিট ফেটে রক্ত বেরুতে শুরু করেছে ইভানের। ব্যথায় গালি দিয়ে উঠে আবারো ঘুরে স্যামের দিকে তাকালো ইভান। স্যামকে পাশের দিকে সরে যেতে দেখেই ঝপ লাগালো ওর দিকে।

আবারো ঝুঁকে পাশে সরে গিয়ে আঘাতটা প্রতিহত করলো স্যাম। তবে এতে করে দরজার কোনা ও ইভানের ফাঁকে আটকে গেছে ও। ব্যর্থ আঘাতের রেশটা কাটিয়ে উঠে আবারো তার দিকে পাগলা ষাঁড়ের মতো তেড়ে আসতে শুরু করেছে ইভান।

স্যাম আবারো সরে যেতে যাবে, ঠিক তখনই শ্যাম্পেইন ভর্তি বোতলটা দিয়ে ইভানের মাথার পিছন দিকে আঘাত করলো রেমি। আঘাতের তীব্রতায় এক মুহূর্তের জন্য জমে গেলো ইভান। চমকটা কাটিয়ে উঠে রেমির দিকে ঘুরতে যাবে ঠিক তখনই স্যাম ঘুষি হানলো তার মুখে। আঘাতের তীব্রতা আর সামলাতে না পেরে ঝট করে মেঝেতে থুবড়ে পড়লো ইভান।

শ্যাম্পেইনের বোতলটা হাতে নিয়ে স্যামের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো রেমি। মনে হচ্ছিলো তোমার সাহায্য দরকার।

নাইজেল কোথায়? রেমির কথার জবাবে জিজ্ঞেস করলো স্যাম।

ভালো প্রশ্ন।

ইভান আর তারা ছাড়া রুমে আর কেউ নেই এখন। রুমের মাঝে থাকা চেয়ারের ওপর থেকে স্যামের সেলফোনটা উঁচিয়ে ধরে রেমি বলল, এই যে, এটাই তোমার প্রশ্নের উত্তর। তারা আমাদের ব্যাপারে জানতো।

তারমানে এখন অবশ্যই রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিৎ আমাদের, বলে ইভানের পিস্তল আর ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে জানালার দিকে দৌড় লাগালো স্যাম। রেমিকে জানালা দিয়ে বেরুতে সাহায্য করে নিজে বেরিয়ে এলো এরপর। তারপর দৌড় লাগালে উত্তর কোনা বরবার।

ড্রাইভওয়ে থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছে। শব্দটার উদ্দেশ্যে কোনা পেরিয়ে সামনে আসতেই ইভানকে একটা গাড়িতে চড়ে বসতে দেখলো ওরা। ইভান ওঠার সাথে সাথেই চলতে শুরু করেছে গাড়িটা। জ্যাক রয়েছে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে।

গাড়ির ভিতরে চারজন মানুষকে দেখতে পেলো স্যাম। তাদের মধ্যে নাইজেলও একজন।

দেরি না করে নিজেদের গাড়ির দিকে দৌড়ে গেলো স্যাম ও রেমি। তবে তারা গাড়িটা বের করে আনতে আনতে বিএমডব্লিউটা ততক্ষণে অনেক দূর চলে গেছে।

 যত যাই হোক, উদ্ধার অভিযানটা কিন্তু ভালোই ছিলো। আমাদের প্ল্যান কাজে লেগেছে, রেমি বলল।

হ্যাঁ, তবে কপাল খারাপ যে নাইজেল ছিলো না ওখানে।

 আমাদেরই এই লোকটাকে বিপদে টেনে আনাই উচিৎ হয়নি। দুর্গে… এভোগুলো মানুষের ভিতরে… আসলে আমি কখনো ভাবিওনি যে ভরদুপুরে কেউ কিডন্যাপ করবে তাকে।

যা হওয়ার তো হয়েই গেছে।

যাই হোক, মিশনটা একেবারে ব্যর্থও হয়নি।

বুঝলাম না? বলল স্যাম।

এরপর রেমি স্যামের দিকে তাকিয়ে বলল, অনুবাদের ব্যাপারে কিছুটা জানা গেছে। ফিস্ক আসার পর এটা নিয়ে আলাপ করছিলো ওরা। মূল লেখাটায় নাকি কিছু অক্ষর কম আছে।

তারা ঠিক কী নিয়ে কথা বলছিলো তা মনে আছে তোমার?

মাথা ঝাঁকালো রেমি। অন্ততপক্ষে তারা কোথায় যাচ্ছে সেটা জানি আমরা। অর্থটা বুঝতে পারলে ওখানেই যাবে ওরা।

কোথায়?

 নটিংহ্যাম।

শুনে রেমির দিকে চোখ কুঁচকে তাকালো স্যাম। এই উপসংহারে আসলে কিভাবে?

নাইজেলকে অনুবাদের জিজ্ঞেস করা শব্দগুলো থেকে, বলল রেমি। উলফস ডেন আর উলফস হেড। মানে এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে এক দুর্ধর্ষ সঙ্ঘের পালের গোদা।

এখানে নটিংহ্যাম পেলে কোথায়?

কারণ পালের গোদা বা উলফস হেড শব্দটা আসলে বিখ্যাত রবিন হুডর আরেক নাম। আর এটার ওপর ভিত্তি করলে উলফস ডেন শব্দটার অর্থ দাঁড়ায়। রবিন হুডের বাড়ি।

 তাহলে আমাদের পরের গন্তব্য এখন নটিংহ্যাম, অর্থটা বুঝার পর বলল স্যাম।

.

৪৮.

মিসেস ফার্গোর ধারণা একদম সঠিক, পরদিন সকালে স্কাইপ কলে তাদেরকে বলল লায়লা। গতরাতে সরাইখানা থেকে পালিয়ে সরাসরি নটিংহ্যামে চলে এসেছে ওরা। ভিন্ন এক নামে হোটেল সুইট ভাড়া করে কিছুক্ষণ ঘুমানোর পর সকালে উঠেই লাযলোকে কল করেছে। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি পড়ছে এখন। জানালায় বৃষ্টির ঝাঁপটার কারণে লাযলোর কথাও ঠিকমতো বুঝা যাচ্ছে না। তাই ট্যাবলেটের ভলিউমটা বাড়িয়ে দিলো রেমি। এককালে রবিন হুড উলফস হেড নামে পরিচিত ছিলো। অন্তত একেবারে প্রথমদিকে কিংবদন্তি গল্পগুলোতে। মিস যাওয়া এফ অক্ষরটাও খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে। শুরু থেকেই এটা জানা থাকলে আপনাদের সমস্যা অনেকটা কমিয়ে দিতে পারতাম।

তা তো অবশ্যই, বলে সরাসরি লাযলোর দিকে তাকালো স্যাম। এখন ম্যাপের সাইফারের ব্যাপারে বললো।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। উলফস ডেন আর নটিংহ্যাম। খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে। ভাবতেই পারছি না যে এটা আমি আগে ধরতে পারেনি।

গলা খাকরে সেলমাও নিজের উপস্থিতির জানান দিলো ওদেরকে। লায়লোর কাঁধের ওপর দিয়ে মাথা বের করে বলল, কিছু কিছু ব্যাপার জানতে পেরেছি আমরা। স্যার এডমুন্ড হারবার্ট এবং নটিংহ্যামের মধ্যে একটা সংযোগ ছিলো। সংযোগটা আসলে ছিলো তার সৎভাই রজার মর্টিমার এবং রানি ইসাবেলার জড়িত ঘটনাগুলোর কারণে। তৃতীয় এডওয়ার্ড সিংহাসনে বসার পর মর্টিমারকে আটক করে রেখেছিল নটিংহ্যাম ক্যাসলে, রানি ইসাবেলাকে নির্বাসিত করেছিলো ক্যাসল রাইজিং-এ।

 সেলমার কথা শুনে টেবিলে ছড়ানো ম্যাপটার দিকে তাকালো রেমি। আর স্যাম জিজ্ঞেস করলো, তো এটার সাথে রবিন হুড আর কিং জনের সম্পদের কী সম্পর্ক আছে।

রবিন হুডকে নিয়ে যে পরিমাণ গল্পের অস্তিত্ব আছে, সেই হিসেবে বিবেচনা করলে এটা খুবই ভালো একটা প্রশ্ন, জবাবে বলল লাযলো। নিশ্চিতভাবেই এসব গল্পের কিছু ছিলো কিং জনের সময়কালেও। যদিও রাজার সাথে রবিন হুডকে ঠিক মিলানো যাচ্ছে না। তবে যাই হোক, আমাদের গবেষণার ফলগুলো এখন একত্র হতে শুরু করেছে। আমাদের ম্যাপের চাবিটাও ওখানেই আছে।

কোথায়? একসাথে জিজ্ঞেস করলো স্যাম ও রেমি।

নটিংহ্যামে, অথবা ভালো করে বললে, নটিংহ্যামের ভিতরেই কোথাও, লায়লো জানালো। এখানে চার চেম্বার আর নিচে মৃত্যু নিয়ে কিছু লেখা আছে। এখনো এই অংশটা নিয়ে কাজ করছি। এবং ধরে নিচ্ছি যে আমার অনুবাদের কোনো ভুলও হচ্ছে না। যেহেতু ছবিতে হুইলের একটা অংশ আলোতে ঝলসে গেছে, তাই এখন শুধু আন্দাজই করতে পারবো আমি।

ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠলো স্যামের। পর্দার দিকে একবার তাকিয়ে কল রিসিভ করে স্পিকার চালু করে নিলো ও। তার মুখে চমকে যাওয়া একটা ছাপ লেগে আছে। নাইজেল?

 হাতে বেশি সময় নেই আমার। তারা যেকোনো সময় ফিরে আসতে পারে, আর আমার ব্যাটারিতেও খুব বেশি চার্জ নেই।

আপনি কোথায় এখন?

কোনো ধারণাই নেই এই ব্যাপারে। শুধু এটুকু জানি যে নটিংহ্যামের কাছাকাছি কোথাও আছি। কোনোরকমে একহাতের বাঁধন চুটিয়ে আমাকে পাহারা দেওয়া লোকটার পকেট থেকে আমার ফোনটা বের করেছি। তারা চার চেম্বার নিয়ে কী যেন বলাবলি করছিলো। আমি বলেছি যে তারা হয়তো চার গুহাকে বুঝাচ্ছে। যদি তারা জায়গাটা খুঁজে পায়, তাহলে ওখানেই যাব আমরা।

চার গুহা? স্যাম বলল।

তাদের আসার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, ফিসফিসিয়ে বলল নাইজেল। প্রফেসর অলড্রিজের কাছে চলে যান আপনারা। বলে কল কেটে দিলো নাইজেল।

কিছুক্ষণ ওভাবেই শূন্যদৃষ্টিতে ফোনটার দিকে তাকিয়ে রইলো স্যাম। তারপর ট্যাবলেটের পর্দায় ভেসে থাকা সেলমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, শুনেছো কথাগুলো?

প্রতিটা শব্দই শুনেছি, বলল সেলমা। তার কণ্ঠের সাথে কম্পিউটার কীবোর্ডের খুটখুট শব্দও ভেসে আসছে। নটিংহ্যাম ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর অলড্রিজ নামের একজন আছেন।

শুনে লাযলোর দিকে তাকালো স্যাম। নাইজেলের বলা চার গুহাই কি তোমার বলা চার চেম্বার?

হতে পারে। নেকড়ের ডেরা বলতে শেরউড ফরেস্টে রবিন হুডের লুকিয়ে থাকা গুহাগুলোকেও নির্দেশ করা হতে পারে, বলল লাযলো।

সাথে সেলমা যোগ করলো, প্রফেসর অলড্রিজের একটা কন্টাক্ট নাম্বার পেয়েছি আমি। দেখি তার সাথে আপনাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।

 পারফেক্ট, বলল রেমি। এখনই কল করো তাকে।

****

ইতিহাস বিভাগের অফিসেই প্রফেসর সেড্রিক অলড্রিজের সাথে দেখা করলো ওরা। লোকটার বয়স ষাটের কোঠার শেষ দিকে প্রায়, চুলগুলোও পেঁকে সাদা হয়ে গেছে।

 প্রফেসরের সাথে সৌজন্যতা বিনিময় চেয়ারে বসেই কাজের কথায় নেমে পড়লো স্যাম। আশা করছি আমার প্রশ্নটা উদ্ভট শোনাবে না, তবে কেউ কি আপনার কাছে কিং জন এবং তার সম্পদের ব্যাপারে জানার জন্য কখনো যোগাযোগ করেছিলো?

 না, উদ্ভট শোনাচ্ছে না, বললেন প্রফেসর অলড্রিজ। অনেক বছর আগে একবার একজন আমাকে এটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিলো। আমার এক সাবেক ছাত্র, নাইজেল রিজওয়েল। কিংস লিনে থাকে। আমার কাছে জানতে চাইছিলো, কিং জনের সম্পদগুলো জলাশয়ে ডুবে যাওয়ার গল্পটার কি গুজব হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা। শত্রুদের হাত থেকে সম্পদ বাঁচানো এবং এমন কিছুর কোনো ঘটনা আছে কিনা। জানি না সে কেন জানতে চেয়েছিলো। খুব সম্ভবই বই-টই লেখার জন্য হবে হয়তো। তবে এরপর আর কখনো ওর সাথে কথা হয়নি আমার।

প্রফেসর খুব সম্ভবত নাইজেল মজ ক্রাওলির গবেষণা চুরি যাওয়ার ব্যাপারে কিছু জানে না। যাই হোক, এটা নিয়ে এখন কথা তুলেও কোনো লাভ হবে না। তাই রেমি বলল, আপনার উত্তর কী ছিলো?

আমি জানি আমি সংখ্যালঘুদের দলে আছি, বললেন প্রফেসর। তবে থাকবই না বা কেন? আমিই তো প্রথমে স্বীকার করেছি যে ইতিহাসের ব্যাপারের সব কিছুই জানি না আমরা। একেক ইতিহাসবিদের ভাষায় ইতিহাস একেকরকম। তাদের থেকে টুকরো টুকরো অংশ সংগ্রহ করেই আমাদের জানা ইতিহাসের গল্পগুলো তৈরি হয়েছে। মাঝেমধ্যে ভাগ্য ভালো হলে, প্রকৃত ইতিহাস জানার সৌভাগ্য হয় আমাদের। তবে এমন প্রকৃত ইতিহাস পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এই কিং জনের ব্যাপারটাই ধরুন। আমরা শুধু রাজার মৃত্যুর ব্যাপারটাই নিশ্চিতভাবে জানি। কিন্তু তিনি আসলেই আমাশয়ে মরেছিলেন, নাকি অন্য কোনো কারণে-তবে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ভাবে কিন্তু না। আমরা এটুক জানি যে অসুস্থতার কারণে ভ্রমণকারীদের দল থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এরপরের ঘটনাগুলো আসলে চলে আসা গল্পগুলোর ওপর ভিত্তি করে ধরে নেওয়া হয়েছে। হয়তো সম্পদগুলো চুরি গিয়েছিলো রাজার থেকে এবং এরপর কারো সন্দেহ না জাগানোর জন্যই জলাশয়ে হারিয়ে যাওয়ার গল্পটা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ কি এটাকে অযৌক্তিক বলতে পারবে? বলে এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলেন প্রফেসর সাক্ষীর পরিমাণ কম থাকলে, চাহিদামতো যে কোনো গল্পই ছড়িয়ে দেওয়া যায়।

তাহলে ধরে নিচ্ছি গুজব গুলো সত্য, বলল স্যাম। অর্থাৎ রাজার সম্পদটা কখনোই জলাশয়ে হারায়নি… অর্ধেক বলেই থেমে গেলো ও। কথাটায় প্রফেসর প্রতিক্রিয়াটা দেখতে চাচ্ছে।

আপনি নাইজেলের থিউরিকে ইঙ্গিত করছেন?

হ্যাঁ।

এমনটা হলে তো এটা হবে শতাব্দীর সবচেয়ে সেরা ঐতিহাসিক আবিষ্কার, বলে হালকা ত্যাগ করলেন প্রফেসর। প্রত্নতত্ত্ববিদদের স্বপ্ন এটা।

প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো রেমি। আপনার স্বপ্ন না?

আমার? প্রফেসরও হেসে বলছেন। আমি কখনো এটা নিয়ে অতোটা ভাবিনি। আমার আগ্রহ শুধু আমার ক্লাসে থাকা শিক্ষার্থীদের ঘিরেই। ইতিহাস শুনে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখা, তাদের থেকে ইতিহাসের বিষয়ে থিউরি শোনাটা বেশি ভালো লাগে আমার। তবে আমার মনে হয় আপনারা আমাকে কথা বলতে আসেননি। যদি ভুল না শুনে থাকি, আপনারা বর্তমানে উলফস হেডের সূত্রপাত বা আমরা যাকে রবিন হুড নামে জানি, তার সম্পর্কে তথ্য জানতে এসেছেন। কিছু কিছু ইতিহাসবিদের মতে কিং জন আর রবিন হুড একই সময়ের অধিবাসি ছিলো। আবার অনেকের মতে, রবিন হুড আর কিং জনের সময়কালের মধ্যে কয়েকশো বছর আগে-পরের ব্যবধান ছিলো। আমার সহকর্মী প্রফেসর ওয়েন্ড অবসরে যাওয়ার পর রবিন হুডের ইতিহাসটা আমার সিলেবাসে যুক্ত করে নিয়েছি। এটা আমার জনপ্রিয় ক্লাসগুলোর একটা। আর শিক্ষার্থীরাও মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে বেশ আগ্রহী, তারা প্রায়ই রবিন হুডকে বিভিন্ন দৃশ্যপট কল্পনা করে ইতিহাসের সুধা পান করে।

রেমি সবসময়ই শিক্ষার্থীদের আগ্রহকে প্রাধান্য দেওয়া প্রফেসরদের বেশ পছন্দ করে। নিশ্চিতভাবেই আমি এ ধরনের ক্লাস করতে পছন্দ করবো। রবিন হুড কি বাস্তবে মুভিতে দেখানো মানুষটার মতোই বীরোচিত ছিলো?

ভালো একটা প্রশ্ন। ধনীদের থেকে ডাকাতি করে গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়াটা খুবই জনপ্রিয়। তবে এই জনপ্রিয়তাটা জোর করে বানানো হয়েছে। পার্সির মতে, তাকে বীর না বলে ডাকাত বলাই শ্রেয়। এজন্যই তো উলফস হেড শব্দটার উৎপত্তি হয়েছে।

হতাশাজনক, রেমি বলল।

 হ্যাঁ। সত্যটা হলো তাদের মতো মানুষেরা আসলে স্থলের ডাকাত ছাড়া কিছুই না।

মানে ভূমিদস্যু? জিজ্ঞেস করলো স্যাম। তাহলে কি তার বা তার মতোই অন্য কারোর কিং জনের সম্পদ ডাকাতি করার কোন সম্ভাবনা আছে?

ভালো বলেছেন। এই ধরনের কিছু গোপন রাখা অবশ্য খুব কঠিন কাজ। সাধারণ গল্পমতে সবাইই জানে যে কিং জনের সম্পদটা জলাশয়ে তলিয়ে গিয়েছিলো, সম্পদের সাথে কিং জনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেনাও ডুবে গিয়েছিলো পানিতে। এই সেনার ওপরই সম্পদকে নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। তবে এর সম্পদগুলোর কী হয়েছিলো সেটা নিয়ে কল্পনার শেষসীমা নেই। কেন পাওয়া যায়নি সম্পদগুলো? সত্যি বলতে কয়েকশো বছর একটা এটার ব্যাপারে আরেকটা গুজব ছড়িয়েছিলো যে রবার্ট টিপটফট অর্থাৎ তৃতীয় ব্যারন টিবেটট নাকি সম্পদটা খুঁজে পেয়েছিলো।

টিবেটট? জিজ্ঞেস করলো রেমি। কী গুজব ওটা?

গুজব আছে ব্যারন নাকি হুট করেই অব্যাখ্যায় এক সৌভাগ্যের সংস্পর্শ পেয়েছিলো। ধারণা করা হয় তার সৌভাগ্যের কারণ নাকি তার ভূমিতে কিং জনের সম্পদ খুঁজে পাওয়া। যদিও বেশির ভাগ ইতিহাসবীদই এই গল্পটা এড়িয়ে গেছে।

 রবিন হুডে ফিরে আসি আবার, স্যাম বলল। এটার কি কোনো সম্ভাবনা আছে ইতিহাসবিদরা রবিন হুডের কিছু ইতিহাস এড়িয়ে গেছে বা রবিন হুডের ইতিহাসের কিছু অংশ অতোটা ছড়াতে পারেনি? ধরুন, সে যদি সম্পদটা চুরি করে থাকে, তাহলে সে ওটা কোথায় লুকাতে পারে? আর সেই জায়গাটা নির্দেশ করার মতো কি কোনো বিশেষজ্ঞ আছে?

রবিন হুডের ওপর বিস্তারিত জ্ঞান থাকা দুজন বিশেষজ্ঞকে চিনি আমি। প্রথমজনের কথা আগেই বলেছি আপনাদের। পার্সি ওয়েন্ডর্ফ, অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর। কয়েক বছর আগে হলে আমি কোনো দ্বিধা না করেই তার কাছে পাঠিয়ে দিতাম আপনাদের। তবে এখন…

এখন কী? প্রফেসরকে অলড্রিজকে হঠাৎই চুপ করে যেতে দেখে রেমি জানতে চাইলো।

 এখন… বলতে গিয়ে মাথা নাড়ছেন প্রফেসর। আমার বন্ধুকে নটিংহ্যামশায়ারের সাথে জড়িত যেকোনো বিষয়ের চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া বলা যায়। মানে এক সময় এটাই ছিলো ও। রবিন হুড, দুর্গ, কিং জনসহ মধ্যযুগের সব কিছুর ওপরই অপরিসীম জ্ঞান ছিলো তার। তবে ইদানিং পার্সি একটু… ভুললামনা হয়ে গেছে। এই জন্যই অবসরে যেতে হয়েছে তাকে।

প্রফেসরের কথার প্রসঙ্গে রেমি কোনো মন্তব্য করার আগেই স্যাম জিজ্ঞেস করলো, আর অন্য বিশেষজ্ঞ?

ম্যালকম সুইফট। নিশ্চিতভাবেই, খুব জ্ঞানী ব্যক্তি। তবে পার্সির মতো অস্পষ্ট ব্যাপারগুলোতে তার জ্ঞান কিছুটা কম আছে। তারপরও আপনাদেরকে তার কাছে পাঠাতে কোনো সমস্যা ছিলো না আমার। তবে পার্সি আমার বন্ধু হওয়ায় আপনাদের সাথে দেখা করার জন্য তাকে এখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছি আমি। যদিও তাকে আনার জন্য কাউকে পাঠানো উচিৎ ছিলো আমার। তার স্মৃতি শক্তি অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে এখন।

 বলে ঘড়িতে সময় দেখে সেল ফোনটা বের করে আনলেন প্রফেসর। তার স্ত্রীকে কল দিয়ে দেখি। আমার এখানে আসার আগে আগাথার কাছে যাওয়ার কথা ছিলো ওর। বলে পার্সি ওয়েন্ডফের স্ত্রীকে কল করলেন প্রফেসর। আগাথা? সেড্রিক বলছি। পার্সি এখনো তোমার ওখানে…? ওহ, আচ্ছা…. কী ধরনের সমস্যা…? ওপাশের জবাব শুনে ভ্রু কুঁচকে গেছে তার। না। আমরা গিয়ে দেখে আসছি… কোনো সমস্যাই হবে… হ্যাঁ, ওখানে পৌঁছে তোমাকে জানাবো আমি।

বলে ফোন কেটে দিলেন প্রফেসর। তার চেহারায় দুঃশ্চিন্তার ছাপ লেগে আছে। সে আসলে আগাথার ওখানেও যায়নি। বলেছে পরে আরেকসময় ওর সাথে দেখা করবে। কী যেনো সমস্যা হয়েছে।

কী সমস্যা? স্যাম জিজ্ঞেস করলো।

আগাথা এটুকুই জানে শুধু। কী সমস্যা তা পার্সি খুলে বলেনি। আর এরপর থেকে পার্সির সাথেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে। সে ফোন-মেসেজ কোনো কিছুরই জবাব দিচ্ছে না।

আমাদের সাথে গাড়ি আছে, স্যাম বলল। আপনাকে লিফট দিতে কোনো সমস্যা হবে না আমাদের।

তাহলে তো ভালোই হয়। ধন্যবাদ।

ইউনিভার্সিটি থেকে পার্সি ওয়েন্ডফের বাসার দূরত্ব মাত্র দশ মিনিটের মতো। গাড়ির পিছনের সিটে বসে প্রফেসর অলড্রিজ বললেন, বাসাটা সামনেই। সামনের মোড়টা পেরুলেই পৌঁছে যাবো।

তবে মোড়ের কাছে পৌঁছুতেই এক অফিসার গাড়ি আটকে দিলো তাদের। দুঃখিত, রাস্তাটা আপাতত কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

অফিসারের কথা শুনে জানালার ফাঁকা দিয়ে সামনের দিকে তাকালো স্যাম। কিন্তু রাস্তার বাকের কারণে সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এক বাড়ির ওপরে জমা পাক খাওয়া ধোঁয়ার কুণ্ডলীটা দেখা যাচ্ছে শুধু। কী হয়েছে?

আগুন লেগেছে এক বাসায়।

আমাদের এক বন্ধু থাকে ওদিকে। ওর কাছেই যাচ্ছি আমরা। রাস্তা খুলতে কতক্ষণ লাগবে আর।

বলতে পারছি না। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেই রাস্তা খুলে দিবে ওরা।

বলার আর কিছু না পেয়ে প্রফেসরের দিকে ফিরে তাকালো স্যাম। স্যরি, এর থেকে বেশি কিছু করতে পারছি না আমি।

সমস্যা নেই। পার্কের ভিতর দিয়ে একটা পায়ে হাটা রাস্তা চলে গেছে। ওটা ধরে আরেকটু কাছে যেতে পারবো আমরা। মনে হয় না ওরা ঐ পথটা আটকে রেখেছে। আর যদি আটকেও রাখে, তাহলেও ওখান থেকে কী ঘটছে তা দেখতে পারবো আমরা। বলে পাহাড়ের ওপর দিয়ে চলে পাশের রাস্তাটার দিকে নির্দেশ করলেন প্রফেসর। দুটো কটেজের ফাঁকা দিয়ে একটা পায়ে হাঁটা রাস্তা চলে গেছে এলাকাটার ভিতরে। পার্সির বাসাটা রাস্তার ঠিক উল্টো দিকেই। আগুনটাও ঐ বাড়িতেই লেগেছে। এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই রাস্তায় জড়ো হয়ে দমকলকর্মীদের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কাজটা দেখছে। হেঁটে তারা তিনজনও গিয়ে জড়ো হলো ওদের সাথে। ইটের গাঁথুনিতে তৈরি দোতলা দালানটাকে বাইরে থেকে দেখতে একদম অক্ষতই মনে হচ্ছে। তাছাড়া ধোয়ার কুণ্ডলিও ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে আসছে। দমকলকর্মীরা খুব সম্ভবত আগুনটা দমিয়ে ফেলতে সমর্থ হয়েছে।

রাস্তা থেকে একটু দূরে একা দাঁড়িয়ে লম্বা টেকো মাথার এক লোকও চোখে ওয়্যার-রিমড় চশমা লাগিয়ে দমকলকর্মীদের কাজ করা দেখছে। প্রফেসর অলড্রিজ লোকটার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ওটাই পার্সি।

.

৪৯.

রাস্তা পেরুনোর আগে ফিস্ক এবং তার লোকদের খোঁজে একবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো স্যাম। কাউকে দেখা যাচ্ছে না দেখা সন্তুষ্ট হওয়ার পরই অন্যদের রাস্তা পেরুতে দিলো। দমকলকর্মীরা এখন ক্লান্ত পায়ে ভারী হোসপাইপগুলো আবার ফায়ারট্রাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পার্সি ওয়েন্ড হতভম্ব হয়ে তাদের কাজ করা দেখছেন। আমার প্যানজিগুলো…

প্রফেসর অলড্রিজ এগিয়ে হাত রাখলেন পার্সির কাঁধে। ফুল সব আবার বেড়ে উঠবে। অন্তত তোমার বাড়িটা তো এখনও টিকে আছে।

 তাই মনে হচ্ছে, বলে তাদের দিকে ফিরে তাকালেন পার্সি ওয়েন্ডর্ফ। স্যাম ও রেমিকে দেখছেন।

 প্রফেসর অলড্রিজ তাদের সাথে প্রফেসরের পরিচয় করিয়ে দিতেই স্যাম তাঁর সাথে হাত মিলিয়ে বলল, আরেকটু ভালো পরিস্থিতে দেখা হতে পারত আমাদের।

সহমত, বলে ক্লান্ত ভঙ্গীতে শ্বাস ফেললেন পার্সি। অবশ্য তারা আমাকে বলছে আগুনটা শুধু রান্নাঘর এবং সামনের বৈঠকখানাতেই লেগেছিলো।

হোসপাইপ গুটিয়ে নিতে থাকা দমকলকর্মীদের দিকে একবার তাকালো স্যাম। আগুনের সূত্রপাত কিভাবে হয়েছিল, সেই ব্যাপারে কিছু বলেছে ওরা?

বলেছে ফুলকি ছিটকে যাওয়ায় আগুন লেগে গেছে। কপাল ভালো যে আমি তখন কাছাকাছি কোথাও ছিলাম না।

কয়েকমিনিট পর দমকলকর্মীদের একজন এগিয়ে এলো তাদের দিকে। মি. ওয়েন্ড?

হ্যাঁ।

কিছুক্ষণের ভিতরেই কাজ শেষ হয়ে যাবে আমাদের। তবে বাড়ির ভিতরটা পানি-কাদায় প্রচুর নোংরা হয়ে আছে। আপনার কি বাড়ির ইনস্যুরেন্স করানো আছে?

হ্যাঁ, অবশ্যই।

তাদেরকে ব্যাপারটা জানান। কাকে দিয়ে পরিষ্কার করালে ভালো হয় সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে।

আচ্ছা, বলে আবারো বাড়িটার দিকে তাকালেন প্রফেসর ওয়েন্ড। স্পষ্টতই চমকটা এখনও সামলে উঠতে পারছেন না তিনি।

স্যাম বুঝতে পারছে পার্সি এখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো মানসিক অবস্থায় নেই। তাই দমকলকর্মীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। তবে আগুনটা কিভাবে লেগেছিল সেই ব্যাপারে কোনো ধারণা করতে পারছেন?

আমরা এখানে আসার পর উনি যা বলেছেন, তাতে এটাকে চিমনির আগুন বলেই মনে হচ্ছে। তেল জাতীয় কিছুর বিস্ফোরণ হতে পারে।

আপনি নিশ্চিত?

হেলমেট খুলে ঘামে ভেজা চুলগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে লোকটা বলল, মোটামুটি।

বাড়ির পুড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বাদ দিলে, অবশ্যই এটা ভালো একটা খবর। তবে এরপরও নিজের চোখে প্রমাণ না দেখা পর্যন্ত, অগ্নিকান্দ্রে সাথে এভেরি বা তার লোকদের সম্পৃক্ততার ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে পারছে না স্যাম।

আরো বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর অবশেষে বাড়ির ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিললো তাদের। বৈঠকখানায় পা দিয়েই বাকশূন্য হয়ে গেছেন পার্সি ওয়েন্ডর্ফ। শূন্য দৃষ্টিতে বৈঠকখানার অবশিষ্টাংশ দেখছেন শুধু। ধোঁয়ায় বাতাস। ভারী হয়ে আছে বলে এগিয়ে গিয়ে জানালাগুলো খুলে দিলেন প্রফেসর অলড্রিজ। আর স্যাম এগিয়ে গেলো ফায়ারপ্লেসের মেঝেটা দেখতে। পানির কারণে পায়ের জুতো ভারী হয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে গেলে থপথপ শব্দ করছে এখন। উনুনের বাইরে থাকা প্রাথমিকভাবে পোড়া দাগটা চোখে পড়লো তার। পাথরগুলোও কালোকয়লার মতো হয়ে গেছে। মেঝের কাঠের কিছু অংশও কয়লায় পরিণত হয়ে গেছে। এমনকি উনুনের কেন্দ্র থেকে কয়েক ফুট দূরে থাকা মেঝের ওরিয়েন্টাল কার্পেটটাও এখন পুড়ে কালো ও ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে।

দমকলকর্মীর ধারণাই ঠিক, ভাবলো স্যাম। আগুনের সূচনা হয়েছিল এই ফায়ারপ্লেস থেকেই, তারপর আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো রুমে। পুরোপুরিই দুর্ঘটনা। যদিও ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগিয়েও সেটাকে দুর্ঘটনার মাত্রা দেওয়া সম্ভব, তারপরও তার মনে হচ্ছে না যে এভেরির লোকেরা এতো যত্নসহকারে এই কাজটা করেছে।

স্যাম? ডাইনিং রুমে যাওয়ার দরজার সামনে থেকে বলল রেমি। টেবিলের ওপর দেখো, একটা টু-ডু কাজের লিস্ট আছে। তালিকার প্রথম কাজটাই হচ্ছে চিমনি পরিষ্কারককে ডাকা।

এটাই তো পরিষ্কার করে দিচ্ছে পুরো ব্যাপারটা। এটা আসলেই দুর্ঘটনা ছিলো।

হ্যাঁ, সবকিছুই তাহলে স্বাভাবিক আছে এখন।

 শুধুমাত্র নাইজেলের এখনও নিখোঁজ হয়ে থাকার ব্যাপারটা ছাড়া।

পার্সির দিকে তাকালো রেমি। লোকটা এখনো আগুনে পুড়ে যাওয়া ক্ষয়ক্ষতির দিকে তাকিয়ে আছেন। এমনকি প্রফেসর অলড্রিজও তাকে ঘর থেকে বের করে আনতে পারছেন না। প্রফেসরের থেকে সাহায্য পেতে চাইলে, তাকে কোনোভাবেই এখানে বেশিক্ষণ রাখা যাবে না, রেমি বলল।

না, জবাবে বলল স্যাম। আমরা তাকে এবং তার স্ত্রীকে আমাদের হোটেলে রাখতে পারি। অন্তত এই জায়গাটা পরিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত।

অবশ্য প্রস্তাবটা সাথে সাথেই প্রত্যাখ্যান করে দিলেন প্রফেসর অলড্রিজ। এটা অবশ্যই আপনাদের উদারতার নিদর্শন, তারপরও আমি নিশ্চিত না এটা

তার জন্য ভালো কিছু হবে কিনা। ব্যাপারটা তাদেরকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলার সুযোগ পাওয়ার আগেই, ষাটোর্ধ্ব এক মহিলা এসে হাজির হলেন বাড়ির ভিতরে। ভিতরে ঢুকে চারপাশের দৃশ্য দেখে মুখে হাতচাপা দিয়ে বলে উঠলেন, ওহ, খোদা। পার্সি, তুমি নিশ্চয় কোনো আগুন জ্বালাওনি? খুব সম্ভবত তিনিই পার্সির স্ত্রী, আগাথা।

অবশ্যই আমি জ্বালিয়েছি। কেন জ্বালাবো না?

চিমনি পরিষ্কারককে ডাকার জন্য আমি একটা নোট রেখে গিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম… বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মহিলা। বাদ দাও। বলতেই রেমি, স্যাম ও প্রফেসর অলড্রিজের ওপর চোখ পড়লো তার। বাসায় দেখছি মেহমানও এসেছে তোমার জন্য। বলে এগিয়ে গিয়ে পার্সির বাহুতে হাত রাখলেন আগাথা। স্যাম নিশ্চিত যে মহিলার চোখ অশ্রুতে টলটল করছে। চলো তাহলে, রান্নাঘরে যাই। ওখানে সবকিছু পরিষ্কার আছে।

হ্যাঁ, পার্সি বললেন। ভালো বলেছো।

তারপর অলড্রিজের দিকে একবার তাকিয়ে পার্সিকে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন তিনি। তাদের দৃষ্টিবিনিময়টাই স্যামকে বলে দিলো যে, আজকের আগুন লাগার ব্যাপারটা পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত ছিলো না। আগাথা চলে যেতেই প্রফেসর অলড্রিজ ভেজা মেঝের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি গিয়ে দেখি কোনো ঝাড়ু আর মোছনি পাই কিনা। পানি মুছে ফেলতে হবে।

এরপর তাকে অনুসরণ করে রান্নাঘরে গিয়ে পা রাখলো স্যাম ও রেমি। পার্সি টেবিলের সামনে একটা চেয়ারে বসে আছে। আগাথা তাদেরকে ঢুকতে দেখেই মুচকি হেসে বললেন, ওহ, ক্ষমা করবেন। আপনাদেরকে ওভাবেই ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছে চলে এসেছি বলে। আপনারা মেহমান। আর আমি? সাধারণত আমি এমনটা কখনো করি না।

 বাদ দাও তো, আগাথা, অলড্রিজ বললেন। তারপর স্যাম এবং রেমির দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, ও হচ্ছে পার্সির স্ত্রী, আগাথা। আর আগাথা, ইনারা হলেন স্যাম ও রেমি ফার্গো। তাদের হাত মেলানো শেষে আবার বললেন, ইনারা এখানে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক আর্টিফ্যাক্টের ব্যাপারে তথ্য জানতে এসেছেন। আর পার্সিরও আমাদের সাথে যোগ দেওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু সে যেতে পারেনি।

বুঝেছি, স্বামীর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন তিনি। সাধারণত তালিকার কাজে পার্সির অতটা ভুল হয় না। সম্ভবত আমারই লেখা উচিৎ ছিলো আগুন জ্বালিও না; চিমনি পরিষ্কারককেও আমার নিজেরই ডেকে আনা উচিৎ ছিলো।

আমি স্রেফ ভুলে গিয়েছিলাম, পার্সি বললেন।

তার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত হাসি হাসলেন আগাথা। আমি জানি।

যা হওয়ার হয়ে গেছে, শান্ত কণ্ঠে বললেন অলড্রিজ। এখন তোমার থাকার ব্যবস্থাটা নিয়ে কথা বলা উচিৎ?

চোখ ছলছল করে উঠলো আগাথার। অন্যদিকে ঘুরে গিয়ে সিংকে জমা বাসন ধোয়ায় ব্যস্ত করলেন নিজেকে। তারপর টেবিলে এসে বসে আবারো ক্লান্তভাবে হেসে বললেন, ক্যাম্পফায়ারের মতো পরিবেশে বসে থাকাটাই পছন্দ করব আমি। ধোয়াটে গন্ধটা তো এটারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আগাথার দিকে চোখ তুলে তাকালেন পার্সি। চিমনি পরিষ্কারককে ডাকতে ভুলে গিয়েছিলাম আমি।

বুঝেছি আমি, বলে মৃদু হেসে স্বামীর হাতে আলতো চাপড় দিলেন আগাথা। তা কী ধরনের আর্টিফ্যাক্ট নিয়ে কথা বলছিলে তুমি, পার্সি?

 আর্টিফ্যাক্ট? বলে স্যাম এবং রেমির দিকে চোখ তুলে তাকালেন পার্সি। আ… অলড্রিজ? এরাই কি ওরা?

হ্যাঁ। আমি এদের কথাই বলেছিলাম তোমাকে।

আচ্ছা… আমাদের তো দেখা করার কথা ছিলো। ভুলেই গিয়েছিলাম একদম। কারো বাড়ি পুড়ে গেলে এমনটাই হয়।

আসলেই, অলড্রিজ জবাব দিলেন। তবে এখন তো তারাই এখানে চলে এসেছে।

 হ্যাঁ, স্যাম এবং রেমির দিকে তাকিয়ে বললেন পার্সি। আশা করছি তোমরা নিজেদের চোখে গিয়েই দেখতে চাইবে।

পায়ে রেমির টোকা টের পেলো স্যাম। অবশ্যই বলল ও। তবে আমার মনে হয় আমাদের রিশিডিউল করা উচিৎ।

পার্সির দিকে তাকিয়ে সহানুভূতির হাসি দিলো রেমি। খুব সম্ভবত, এই মুহূর্তে আপনার নিজের ঘাড়েই যথেষ্ট ঝামেলা জমে আছে।

আসলে, আগাথা বললেন, এই পরিবেশ থেকে দূরে রাখলেই খুব সম্ভবত ভালো হবে তার জন্য। আপনাদের কাজের বিরতির ফাঁকে ফাঁকে আমাকে অনেকগুলো কল করতে হবে আর কী।

খুব ভালো, অলড্রিজ বললেন। তাহলে তো হয়েই গেলো সব।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে পার্ক করে রাখা গাড়ির দিকে যেতে যেতে স্যাম রেমিকে ফিসফিসিয়ে বলল, তোমরা এগুও, আমি আসছি। বলে প্রফেসর অলড্রিজের সাথে কথা বলার জন্য পিছনে রয়ে গেলো স্যাম। রেমি ও পার্সিরা যথেষ্ট পরিমাণ দূরে সরে যেতেই স্যাম প্রফেসর অলড্রিজকে বলল, উনার যেহেতু স্মৃতিশক্তির ব্যাপারটা আছে, তাহলে এখন হয়তো আমাদের ঐ অন্য বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলা উচিৎ।

স্বাভাবিকভাবেই হা বলা উচিৎ আমার, অলড্রিজ বললেন। পার্সির ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু না। তবে সে বেশি এলেমেলো হয়ে যায় নিজের ধারা থেকে ছিটকে গেলে। এমন কিছু ঘটলেই অস্বাভাবিক আচরণ করে বসে। যেমন আজকের আগুনের কথাটাই ধরুন।

কিন্তু যদি ঐ অন্য বিশেষজ্ঞ লোকটা সাহায্য করতে রাজি…

আমাদের হয়তো পার্সিকে আরেকটা সুযোগ দেওয়া উচিৎ। এসব নিয়েই জীবন-যাপন ওর। আর আমি আগাথার সাথেও এটা নিয়ে কথা বলেছি। সেও রাজি আছে। বলতে গেলে সে ই জোর করেছে। সে তার ধারায় ফিরে এলেই আবার খুশি হয়ে উঠবে। নটিংহ্যামের নিচের সুড়ঙ্গগুলোই তার ধারার আসল উপকরণ।

উনাকে শুধু গুহার প্রবেশমুখটা দেখিয়ে দিলেই হবে। এটা কি উনি করতে পারবেন?

পারবে বলেই ধারণা আমার। যদিও সে নিজে ওসবের ভিতর দিয়ে ঘুরতে পছন্দ করে। তবে, আমি নিশ্চিত এতে কোনো সমস্যা হবে না। সত্যি বলতে, এই সুড়ঙ্গগুলোর অনেকগুলোই সে ম্যাপ করে রেখেছে। ওটা হয়তো কাজে আসতে পারে।

ভালো ভাবেই কাজে আসবে ওটা, বলে পার্সির দিকে তাকালো স্যাম। লোকটা এখন বেড়ার প্রান্তে বসে থাকা পাখিগুলোকে দেখে হাসতে হাসতে রেমিকে কিছু একটা বলছে। স্যাম আশা করছে সে হয়তো কোনো ভুল করছে না। চলুন তাহলে, ম্যাপটা খুঁজে বের করি।

.

৫০.

স্যাম আশা করছিলো পার্সি ও অলড্রিজ হয়তো এখন আবার পার্সির বাড়িতে ফিরতে চাইবেন। কিন্তু এর বদলে পার্সি তাদেরকে শহরের কেনাকাটার দোকানের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।

জায়গাটায় পৌঁছেই স্যামকে পার্ক করার জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন পার্সি। প্রবেশমুখটা এখান থেকে পাঁচমিনিটের দূরত্বে আছে, বলে বেশ কয়েকটা দোকানের সামনে থাকা খোয়াবিছানো পথটা দেখালেন পার্সি। তারপর গিয়ে থামলেন এক দর্জির দোকানের সামনে। ম্যাপটা এখানে আছে।

দোকানের নামটার দিকে চোখ তুলে তাকালো রেমি। আপনি মজা করছেন?

দোকানের দরজাটা খুলতেই মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো পার্সির। অনেকটা অবিশ্বাস্য, তাই না?

আমি আসলে… ভিন্ন কিছুর আশা করেছিলাম।

এই পুরো শহরটাই গড়ে উঠেছে সুড়ঙ্গ ও গুহার ওপর। অনেক কিছুই দেখার আছে।

দর্জি দোকানের মালিক আসলে পার্সির এক আত্মীয়। তার মামাতো ভাইয়ের দোকান। পার্সির এরকম অপ্রত্যাশিত ভ্রমণের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে লোকটা। তারা ঢুকতেই তাদেরকে দোকানে পিছনে নিয়ে গিয়ে একটা দরজা খুলে দিলো লোকটা। একটা পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে দরজার ওপাশের অন্ধকারের দিকে। দরজাটার সামনে এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে দাঁড়ালেন পার্সি। অন্ধকার সিঁড়িটা দেখছেন। নামার সময় ইলেক্ট্রিক টর্চগুলো নিয়ে নামতে ভুলো না কেউ।

কাছেই থাকা একটা ক্যাবিনেট খুলে তাক থেকে বেশ কয়েকটা ফ্ল্যাশলাইট বের করে আনলেন অলড্রিজ। প্রত্যেকের হাতেই একটা একটা করে ফ্ল্যাশলাইট তুলে দিলেন তিনি।

লাইট হাতে নিয়েই পাথরের সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নামতে শুরু করলো ওরা। যতোই নিচে নামছে তাপমাত্রাও ততোই কমছে। এটা আমার প্রিয় জায়গা, পার্সি বলছেন। আমি সর্বপ্রথম এই গুহাতেই নেমেছিলাম। ঐ তখনই বুঝে গিয়েছিলাম যে আমি প্রতিটা গুহা-সুড়ঙ্গই ঘুরে দেখতে চাই।

স্যাম তার পিছনে পিছনে আসছে। হাঁটতে হাঁটতে পার্সি ওয়েন্ড ম্যাপটা কোথায় রেখেছেন সেটা নিয়েই ভাবছে শুধু। এখানে কতগুলো গুহা আছে? জিজ্ঞেস করলো ও।

 পঁচাত্তরটার বেশি। তবে এগুলোর বেশির ভাগই দালানকোঠা বানাতে গিয়ে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আর অন্য গুলোও আটশো বছরের চাপ সহ্য করতে না পরে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে পড়ছে। দুঃখের বিষয়, জাকজমকভাবে সাজানোগুলো ছাড়া সাধারণ মানুষদের অনেকেই এগুলোর কথা জানে না।

আর এই গুহাটা? গুহার মসৃণ দেয়াল, দেয়ালে খোদাই করে কাটা তাকগুলোর দিকে আলো ফেলে বলল স্যাম। এটা কিসের জন্য ব্যবহার করা হতো?

আগের মালিক এটাকে ওয়াইন সেলার হিসাবে ব্যবহার করতো, বলতে বলতে গুহা থেকে সুড়ঙ্গ দিয়ে বের হয়ে আরেকটা গুহার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন পার্সি। হাতে খোদাই করা হয়েছে এটা। পাথুরে বালি দিয়ে। এখানে মানুষ এসে বাস করারও আরো কয়েকশো বছর আগে তৈরি হয়েছে এটা। সত্যি বলতে শহরের সব গুহাই ঐসময়ের তৈরি। মাটির ওপরে প্রবেশমুখগুলো তৈরি করা হয়েছে নদীর পানিতে গুহাগুলোর ভেসে যাওয়া থেকে বাধা দেওয়ার জন্য। খুবই চমৎকার জায়গা এটা।

 একটা প্রশ্ন, গুহাগুলোতে তারা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরছে বুঝতে পেরে বলল স্যাম। এটার সাথে রবিন হুড আর আপনার ম্যাপের কী সম্পর্ক আছে?

 রবিন হুড বলে দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে অলড্রিজের দিকে তাকালেন পার্সি। আমি তো ভেবেছিলাম তারা এই গুহাটা দেখতে এসেছে। আমি কি তাদেরকে বলেছি যে আমি সর্বপ্রথম এই গুহাটাতেই নেমেছিলাম?

হ্যাঁ, বলেছো তুমি, অলড্রিজ বললেন।

রেমির দিকে তাকালো স্যাম। তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো রেমি। স্যাম বুঝতে পারছে তাদেরকে অবশ্যই দ্বিতীয় বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করা উচিৎ ছিলো, অন্তত আগুনের ঘটনার পর সেটাই স্বাভাবিক ছিলো। আমাদেরকে এখানে নিয়ে আসার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে, স্যাম বলল, তবে আমরা আসলে রবিন হুড, কিং জন, উইলিয়াম দ্য মার্শাল এবং চার চেম্বারের সাথে জড়িতগুলোর ব্যাপারেই জানতে চাচ্ছি।

তোমরা চার গুহার কথা বলছো? পার্সি জিজ্ঞেস করলেন।

ওরকমই কিছু মনে হয়, বলল স্যাম। পার্সির নাম শুধরে দেওয়াটা বুঝাচ্ছে যে লোকটা এখন আবার স্বাভাবিকত্বে ফিরে এসেছে। আপনি কি জানেন ওটা কোথায় আছে?

অনেকদিন আগে গিয়েছিলাম ওটাতে। মনে হয় আবারো খুঁজে বের করতে পারবো। তবে ওখানে কাউকে যেতে মানাই করবো আমি। খুবই ভয়ানক জায়গা। অনেক প্যাঁচ-মোচড় আছে ওটাতে। ঘুরে দেখার জন্য ওটার থেকেও আরো অনেক অনেক ভালো জায়গা আছে কিন্তু।

আমাদের খোঁজাখুঁজি করতে ভালো লাগে, প্রফেসর, রেমি বলল। হয়তো আপনি আমাদেরকে সেখানে যাওয়ার পথটা বলে দিতে পারবেন?

প্রায় দুপুর হয়ে যাচ্ছে তো। আমি তো এখনো লাঞ্চ করিনি। বলে ঘুরে বাইরের গুহা এবং দোকানে উঠার সিঁড়িটার দিকে পা বাড়ালেন পার্সি। আমার মনে হচ্ছে আমি কিছু একটা ভুলে যাচ্ছি। তবে আমার জীবনই তো এমন। ভুললামনা মানুষ। ওখানে কেন যেতে চাও তোমরা? অলড্রিজকে জিজ্ঞেস করলেন।

তারা আসলে ঐতিহাসিক আর্টিফ্যাক্টের খোঁজ করছে।

ওহ, হ্যাঁ, এখন মনে পড়েছে আমার। কিছুই পাওয়া যাবে না ওখানে। অনেক সুড়ঙ্গ আছে, ওগুলোতে ঢুকলে পথ হারানোরও সম্ভাবনা আছে। আর দেয়ালে কিছু কেল্টিক খোদাইকৃত নকশাও আছে। এগুলোই তো। আর্টিফ্যাক্টগুলো তো অনেক আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

 সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে স্যাম অলড্রিজকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি নিশ্চিত কাজটা ঠিক হবে?

ভুলে যেয়েন না, পার্সি কিন্তু আজ স্বাভাবিক নেই। আগুনটা নিশ্চিতভাবেই তাকে অনেকটা নাড়িয়ে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই, এখন আপনি চাইলে অন্য বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে পারেন। আপনি চাইলে আমি তাকে কল করে জানাবো।

 যেহেতু প্রফেসর অবস্থা ভালো নয়, তাই আমাদের মনে হয় সেটাই করা উচিৎ, যেহেতু এসবের ওপর নাইজেলের জীবন-মরণ নির্ভর করছে, তাই সে আর এখন এই ভুললামনা অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসরের ওপরে ভরসা করতে পারছে না। প্রফেসর অলড্রিজকে কল করার কথে বলে সে রেমির কাছে গিয়ে পুরো ব্যাপারটা জানালো।

তোমার সাথে আমি একমত, তবে…

তবে কী?

প্রফেসর কিন্তু ঠিকই চার গুহা আর কেল্টিক নকশাগুলোর কথা বলেছে। এর সাথে কিন্তু লাযলোর বলা চার চেম্বার আর সাইফার হুইলের কেল্টিক খোদাইটারও মিল আছে। এরমানে হচ্ছে তিনি ভুল কিছু বলছেন না।

উনি মনে করতে পারলে আর ভুল করেন না। কিন্তু মনে হওয়ারই তো কোনো ভরসা নেই।

আমার মনে হচ্ছে শর্ট-টার্ম মেমরি লস ছাড়াও আরো কিছু সমস্যা আছে প্রফেসরের। যেহেতু সেই ছেলেবেলা থেকেই তিনি এই গুহাগুলোতে ঘুরে বেড়াতেন…

এখন কিন্তু ওসবের সময় নেই, রেমি। আমরা এখানে এসেছি ম্যাপের খোঁজে, আর তিনি আমাদেরকে ওয়াইন সেলার ঘুরিয়ে দেখালেন। উনার সাথে আরেকটা দুর্ঘটনা ঘটলে হয়তো তিনি পারলে আমাদেরকে অন্য আরেক বিপদেও ফেলতে পারেন। এটার সম্ভাবনাও কিন্তু কম না। এমনিতেই নাইজেলকে এসবের মধ্যে জড়িয়ে বিপদে ফেলে দিয়েছি আমরা। তাই এখন আমাদের মূল কাজ হলো-নাইজেলকে বাঁচানো। আর পার্সির কিন্তু বিপদ নিয়ে কোনো ধারণাও নেই। এটা নিয়েই বেশি দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে আমার।

আমি অবশ্য ওভাবে ভাবিনি। আশা করো যেন প্রফেসর অলড্রিজ অন্য বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।

কল করার জন্য দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন অলড্রিজ। ফিরে এলেন আবার কিছুক্ষণের ভিতরেই। স্যরি, তবে সুইফটের স্ত্রী বলেছে তাকে নাকি বিকালের আগে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। একটা বিজনেস ট্রিপে গেছে। সে আসলেই মহিলা কল করবে আমাকে। তবে আমার মনে হচ্ছে যে আপনারা চাইলে পার্সির ওপর ভরসা করে দেখতে পারেন। সে এটা করতে চায়। বিশেষ করে যেহেতু এটার সাথে ঐতিহাসিক গুরুত্বের আবিষ্কারের বিষয়টা জড়িয়ে আছে, তাই সে খুব করেই চায় এটার অংশ হতে।

তারা যদি সাধারণ কোনো মিশনে আসতো, তাহলে পার্সির সাথে কাজ করতে কোনো সমস্যা হতো না। ঘড়ি দেখলো স্যাম। দুপুর গড়াচ্ছে মাত্র। যেভাবে সময় চলে যাচ্ছে, তাতে এখন এটা ছাড়া উপায়ও নেই তাদের হাতে। নাইজেল এখন বন্দী হয়ে আছে শত্রুদের হাতে। পার্সিই এখন তাদের একমাত্র অপশন। ম্যাপটা খুঁজে না পেলেও হয়তো অবস্থানটা মনে করে জায়গাটা চিহ্নিত করে দিতে পারবেন তিনি। তাই সবকিছুই অলড্রিজকে খুলে বলল স্যাম। এমনকি তারা কেন এটার সাথে পুলিশকে জড়াচ্ছে না সেই কারণটাও বলল।

এতে আসলেই অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে, অলড্রিজ বললেন। গিয়ে দেখি আমি তাকে শান্ত করে ম্যাপের অবস্থানটা বের করতে পারি কিনা। আমি নিশ্চিত সে এটা এই দোকানেই রেখেছে। এইজন্যই তো আমাদেরকে প্রথমেই

এখানে নিয়ে এসেছে। গুহা নিয়ে প্রায়ই এলোমেলো লেগে যায় তার।

ধন্যবাদ, স্যাম বলল।

****

স্যাম ও রেমি বাইরে অপেক্ষা করছে, আর ওদিকে অলড্রিজ কথা বলছেন পার্সির সাথে।

জানালা দিয়ে দৃশ্যটা দেখতে দেখতে তারা নিজেরাও বিকল্প উপায় নিয়ে আলোচনা করছে। হয়তো, রেমি বলছে, তিনি চার গুহার সাধারণ অবস্থানটা মনে করতে পারবেন। খুব সম্ভবত প্রফেসর অলড্রিজের সাথে ড্রাইভ করে গেলেই মনে করতে পারবেন। তখন আমরা শুধু অনুসরণ করবে তাদেরকে। তার গাড়ি থেকে বের হওয়ারও প্রয়োজন পড়বে না। শুধু জায়গাটা চিনিয়ে দিলেই হবে। এরপর তিনি চাইলে প্রফেসর অলড্রিজের সাথে করে বাড়িতেও ফিরে যেতে পারেন।

এটাই হয়তো আমাদের একমাত্র অপশন, বলল স্যাম। তখনই অলড্রিজ ভিতরে ডেকে পাঠালেন তাদেরকে।

 সুসংবাদ আছে, অলড্রিজ বললেন। পার্সির সাথে ঐ গুহাগুলো নিয়ে। হালকা আলোচনা করেছি আমি।

পার্সি এখন একটা কার্ডবোর্ড টিউব ধরে রেখেছেন। আমার বন্ধু বলেছে যে তোমরা নটিংহ্যামের গুহাগুলো নিয়ে আগ্রহী। আমারও বেশ প্রিয় ওগুলো। সেই ছোটোকাল থেকেই ওগুলোকে ভালো লাগে আমার।

 অলড্রিজ পার্সির কাঁধে হালকা একটা টোকা দিয়ে বললেন, তাদেরকে ম্যাপটা দেখাও, পার্সি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলে একটা টেবিলের কাছে গিয়ে কার্ডবোর্ডের টিউবটার মুখ খুলে নিলেন পার্সি। আলতো একটা টোকা দিতেই নটিংহ্যামের একটা বিশাল ম্যাপ বেরিয়ে এলো টিউব থেকে। ম্যাপটা টেবিলের ওপর বিছিয়ে রাখলেন প্রফেসর পার্সি ওয়েন্ড। পুরো ম্যাপটাই লাল মোটা পেন্সিলের দাগে ভরে আছে, বিভিন্ন জায়গা সম্পর্ক টুকিটাকি তথ্যও লেখা আছে। তারপর তারা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই জায়গাটা ম্যাপে টোকা দিয়ে দেখালেন পার্সি।

ম্যাপটার দিকে তাকালো স্যাম। নটিংহ্যাম ক্যাসল ও চার গুহার ওপরে থাকা লেখাটার দিকে ইশারা করে বলল, এই জায়গাটার সম্পর্কে ভেঙে বলুন আমাদের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *